হ্যাঁ – ১০

দশ

হাসপাতালের ভেতর থেকে সড়কে আসার পর আলমের বুকে চেপে বসে থাকা উদ্বেগের পাথরটা সরে গেল। নিজের প্রাণের প্রাণ অটোটা ঠিকঠাক আছে দেখতে পেয়ে স্বস্তির সঙ্গে কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল ওর মন। পাহারাদার অটোচালকের কাছে গিয়ে বলল, ভাই, আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব বুঝতে পারছি না।

বিশেষ সম্বোধনের প্রয়োজন কী, ভাই?

না। এই যে কতক্ষণ বসে থাকলেন। লাভ ছাড়া আমরা কেউ তো কিছু করি না।

আমার যে কিছু লাভ হয়নি কীভাবে বুঝলেন?

আপনার লাভ হয়েছে! কী বলেন? এতক্ষণ তো দুতিনটা যাত্রী পেয়ে যেতেন।

তা পেতাম। টাকা রোজগার হতো। টাকা তো বহু রোজগার করেছি। আর আপনাকে দেখে, আপনার কাজের দায়-দায়িত্ব দেখে, অনেক কিছু শিখে ফেলেছি। শেখাটাও তো একটা লাভ। টাকার চেয়েও বড় লাভ, তাই না?

চুপ হয়ে গেল আলম। অটোচালকের কথায় নিজের ভেতর দায়িত্ব বোধের তাড়া আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এই চালক তার খুব কাছের একজন মনে হলো। মনে হলো খুব আপন কেউ। আর তাই ঘনিষ্ঠতা জমানোর জন্য জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী, ভাই?

রিয়াজ।

নিশ্চয় আপনি যাত্রী পেয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

তারপরও আমার অটো ফেলে চলে যাননি। আমি খুব খুশি।

আমি খুশি অন্য কারণে। রিয়াজ বলল।

কী কারণ?

অ্যাকসিডেন্টে অজ্ঞান হয়ে পড়া গুরুতর রোগী ফেলে আপনি পালিয়ে যাননি দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। অটোচালক হিসেবে আপনাকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে গৌরব বোধ করেছি। কে বড় কাজটা করেছে! আপনি, না আমি?

চুপ হয়ে গেল আলম। নিজের কাজের প্রশংসা পেয়ে গোপনে শক্তি পেয়ে চুপ হয়ে রইল।

ভাববেন না। আপনার পাশে আছি। এখন রোগীর কী অবস্থা?

পরিস্থিতি খুলে বলার পর রিয়াজ আবার বলল, ভাববেন না, আমার কাছে তিন হাজার আছে। আপনার কাছে কত আছে দেখুন। সব একত্র করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আর আমি অটোর পাহারায় থাকি।

রিয়াজের ভেতরও বিপদে পড়া মানুষের পাশে থাকার তাগিদ দেখে আলমের ভেতরের ভয় উড়ে গেল। দায়িত্ব এড়িয়ে না গিয়ে। রোগীর সেবার জন্য সব কিছু করার হ্যাঁ-বোধক সংকেত আরও শক্তভাবে গেড়ে বসল।

আলমকে অবাক করে দিয়ে রিয়াজ নিজের পকেটের তিন হাজার টাকা থেকে পাঁচশ টাকা রেখে দিয়ে পঁচিশ শ তুলে দিয়ে বলল, যান ফিরে যান। যা যা করার দরকার করুন।

হাত বাড়িয়ে টাকা নিল আলম। বার কয়েক কেঁপে কেঁপে উঠল ও। তার মনে হতে লাগল এ মুহূর্তে রিয়াজ ভাই আমার চেয়েও বড়ো কাজটা করে ফেলেছেন। নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও পেল আঠার শ টাকা। দু শ আলাদা করে রেখে পঁচিশ শর সঙ্গে মিলিয়ে একচল্লিশ শ টাকা হাতে করে ও মুঠি ভরে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল অসহায়কে কোনো মতেই ফেলে যাওয়া যাবে না।

ফিরে যেতে গিয়েও সামনে এগোলো না আলম। এবার দাঁড়াল রিয়াজের মুখোমুখি।

আপনি কি পড়াশোনা করেছেন?

আলমের প্রশ্ন শুনে থমকে গেল রিয়াজ। ম্লান হাসির রেখা ভেসে উঠল ওর ঠোঁটে।

জবাব না দিয়ে বলল, যান। ভেতরে যান। রোগীর সেবা করুন।

আর দাঁড়ালো না আলম। প্রশ্নের জবাব পায়নি। তবু ভাবল পেয়ে গেছে জবাব। এবার দ্রুতগতিতে ও হাঁটতে লাগল নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের দিকে। প্রত্যেক ঘটনার মধ্যে একটা হ্যাঁ লুকিয়ে আছে। লুকোনো সম্পদটার শক্তি পায়ে ভর করেছে। পেশি পাচ্ছে জোর। মনও। শক্তি ভর করেছে মনে। আর তাই ও চারপাশের কাতর ধ্বনি, অসহায়ত্ব, আর বিড়ম্বনার মধ্যেও দেখতে পেল অন্য আলো। সেই আলোয় আলোকিত হয়ে নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ঢুকে কিছুক্ষণ আগে দেখে যাওয়া চারপাশটাকে বদলে যেতে দেখল। আগে ভেবেছে এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচি। এখন ভাবছে রোগীকে সুস্থ না করে বাড়িতে পৌঁছে না দিলে কর্তব্য শেষ হবে না।

রোগীর বেডের কাছে দেখল সেই নার্স যত্নের সঙ্গে কাজ করছেন। নার্সদের নিয়ে নানা বদনাম শুনেছে। তাদের দুর্ব্যবহারের কথা

শুনেছে। এখন নার্সের সেবা করার সুন্দর দৃশ্য দেখে কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে ওর মন। চুপচাপ পাশে এসে দাঁড়াল। রোগীকে সেলাইন পুশ করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পর তিনি দেখলেন পাশে দাঁড়ানো আলমকে।

সত্যি সত্যিই ফিরে এসেছেন?

আমাকে দেখে কি মিথ্যা মনে হয়, দিদি?

নার্সের সাদা অ্যাপ্রনের পকেটের মার্জিন কাপড়ে লেখা জেনি কেয়া মণ্ডল, নামটা এক ঝলক দেখার পর ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে সহজ শব্দ, আন্তরিক শব্দ, দিদি। শুনে জেনি কেয়া মণ্ডল স্বস্তি আর সম্মান পেয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, মিথ্যা মনে হবে কেন? বরং একজন মানবিক চালকের দায়িত্ববোধ দেখে আমিও রোগীকে বেশি সেবা দেওয়ার জোর পাচ্ছি ভেতর থেকে। অপরিচিত রোগীকে তুলে এনেছেন, আর আমি সেবা দেব না, তা কি হয়, আলম সাহেব?

আমি টাকা জোগাড় করেছি। আরেক অটো চালক পঁচিশ শ দিয়েছে। অবিশ্বাস্য লাগবে আপনার। কিন্তু এটাই সত্য। আমি দিয়েছি ১৬ শ। মোট একচল্লি শ জোগাড় হয়েছে। সিটি স্ক্যান করা যাবে এ টাকায়, দিদি?

যাবে। সরকারি খরচে দুই হাজারের মতো লাগবে।

তাহলে ব্যবস্থা করুন প্লিজ।

আমি রিকুইজিশন ফর্ম ফিল আপ করে দিচ্ছি। ডিউটি ডক্টর থেকে সিগনেচার নেওয়ার পর নিউরো ইমেজিং বিভাগে যাবেন।

আচ্ছা, কথা শেষ করে ফর্ম ফিল আপ করে জেনি নার্স রোগীর শিট আর ফর্মটা নিয়ে হাজির হলো ডিউটি ডক্টরস রুমে। সিগনেচার দিতে গিয়ে চিকিৎসক প্রশ্ন করলেন, সিটি স্ক্যান করানোর মতো টাকার ব্যবস্থা হয়েছে?

জি। অটো চালকরা টাকা তুলে ফান্ড করেছে। ওরাই সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থা করেছে।

নার্সের দিকে ক্ষণকালের দিকে চোখ তুলে তাকালেন চিকিৎসক। তারপর কাগজে সাইন করে কক্ষ থেকে ওয়ার্ডে ঢুকে রোগীর বেডের দিকে গিয়ে আলমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনিই অটো চালক?

জি।

ওনার সিটি স্ক্যান করাতে পারবেন?

একচল্লিশ শ টাকা আছে। পারব কি না জানি না।

হ্যাঁ। সরকারিভাবে সিটি স্ক্যান করাতে বাইশ শ লাগে। পারবেন।

খুশি হয়ে গেল আলম।

রোগিণীর অবস্থা কেমন, স্যার?

৪৮ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু আপাতত আমার কাছে ঝুঁকিমুক্ত মনে হয়েছে। তবে ব্রেনের সিটি স্ক্যান করুন। করানো জরুরি। সেটা আপনারা করার ব্যবস্থা করেছেন শুনে অবাক হয়েছি। এমন কাজ এর আগে ঘটতে দেখিনি। সাধারণত অজ্ঞান আর অপরিচিত রোগীদের বেডে রেখে ভেগে যায় মানুষ। আপনারা তার ব্যতিক্রম। এমন উদ্যেগ কেন নিতে চাইলেন?

অসহায়ের পাশে থাকব না? থাকব। তবে কেন থাকব বা আছি, তা জানি না। কেবল মনে হচ্ছে ওনাদের এলাকাটা চিনলেও ওনার হুঁশ ফেরা পর্যন্ত, বাসায় ঠিকানা জেনে ওনাকে বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত থাকা উচিৎ ওনার পাশে। এমন একটা হ্যাঁ ভেতরে জেগে উঠেছে। সেটা না বানাব কীভাবে, বলুন?

আলমের কথা শুনে ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসক, সহকারী রেজিস্ট্রারের ঘোর কাটল না। আরও ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি বললেন, আপনার এ রোগীর চিকিৎসার জন্য আমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ওষুধের স্যাম্পল দিয়ে দেব। যতটুকু আমার ক্ষমতা আছে, ফ্রি করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। তারও মনের মধ্যে হ্যাঁ-এর বুদবুদ উঠছে। আর কেবল তার কানে বাজতে লাগল হ্যাঁ ভেতরে থেকে জেগে উঠেছে। সেটা না বানাব কীভাবে, বলুন? নিজেই তাজ্জব বনে গেলেন চিকিৎসক।

এগার

অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনে রোদ্দুর ভীত হয়ে ঢুকে গেল ওর বাপির কোলে। মেয়েকে বুকে পেয়ে প্রমিত দিশেহারা অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরে নিজের পালনীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠল। শাশুড়িকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিজেও ওঠার সময় রোদ্দুরও রইল বুকের সঙ্গে লেপ্টে। কাপড়-চোপড় কী নিতে হবে, টাকা-পয়সা হাতে লাগবে কিনা প্রথমে কিছুই মাথায় আসেনি। বিপদের সময় ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। হঠাৎ এসবের কথা মনে পড়ায় নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। বাসা থেকে রওনা হওয়ার সময় অল্প সংখ্যক টাকা নিয়ে বেরিয়েছে। হঠাৎ টাকা লেগে যেতে পারে। বিষয়টি ভেবে দেখেনি এর আগে। একবার বলতে চাচ্ছিল, আম্মা হাতের কাছে কোথাও টাকা রেখেছেন? পাওয়া যাবে এখন? বলতে পারল না।

বুয়াটাকে বেশ বুদ্ধিমতি মনে হলো। দ্রুত ছুটে গিয়ে আরেক সেট কাপড় আর শাল এনে একটা ব্যাগে ভরে তুলে দিল প্রমিতের হাতে। বুয়াকেও প্রমিতের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল টাকা-পয়সা কোথায় রাখে, জানো কিনা। প্রশ্নের ইমপালসটা আটকে ফেলল। প্রমিতের অসহায় চেহারা দেখে বুয়া আবার দৌড় দিলে ভেতরের দিকে। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এল পলিথিন প্যাকে মোড়ানো একটা প্যাকেট নিয়ে। প্রমিতের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ভাইজান হাসপাতালে টাহা লাগে। এই নেন, এহানে আমার তিন মাসের বেতনের টাহা জমা আছে। আগে এড়া নেন। তারপর খালুজানকে ফোনে ডাক দেন।

বুয়ার কথা শুনে আবার টনক নড়ল প্রমিতের। অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে শুরু করেছে হাসপাতালের দিকে। আর সাইরেন-বাজছে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে। একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল রোদ্দুরকে রেখে যেতে। পরক্ষণেই সে ইচ্ছা বাদ করে ওকে বুকে জড়িয়ে রাখল।

ফাঁকে রোদ্দুর বলে বসল, আমার মাম্মিকে ফোন দাও। হাসপাতালে আসতে বলো।

ছোট মেয়ের বুদ্ধিও এবার ওর বাপির মাথায় ঢুকে গেল।

দ্রুত কল করল মিতুর নম্বরে।

না। সেট অন করেনি সে। মোবাইলে ঢুকতে না পেরে চাপা উত্তেজনায় বুকে চাপা খেতে লাগল ও। অ্যাম্বুলেন্সের বেডে শুয়ে আছেন শাশুড়ি। তাকেও জানাতে পারছে না মিতুর ফোন না খোলার কথা। বাবার অসহায় অবস্থা দেখে রোদ্দুর আবার বলল, মাম্মিকে মেসিজ দাও।

আবার বুদ্ধি খুলে গেল প্রমিতের মাথায়। আবার দ্রুততার সঙ্গে সেট হাতে নিয়ে মেসিজ লিখল, আম্মা অসুস্থ। তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। তুমিও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চলে এসো। মেসিজটা সেন্ট করে রোদ্দুরের উদ্দেশে বলল, পাঠিয়েছি।

কী লিখেছো?

মেসিজটা পড়ে শোনাল প্রমিত।

না। হবে না। এতে মাম্মির রাগ যাবে না। লেখো রোদ্দুরের নানুভাইয়ের অসুখ হয়েছে। তোমার আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি।

তাই তো! মাথা ব্লক হয়ে গেছে। বুদ্ধি খুলছে না। পাঠানো মেসিজটায় বোঝা যাচ্ছে না কোন মা অসুস্থ–নিজের না শাশুড়ি মা। এতটুকুন মেয়ের বুদ্ধির ধার দেখে মনে মনে খুশি হয়ে মেসিজটা আবার কারেকশন করে পাঠাল ও।

পাঠিয়েছ, বাপি?

হম। পাঠিয়েছি।

দেখো। আবার মাম্মিকে পেয়ে যাব আমরা।

মেয়ের আত্মবিশ্বাসটা ছুঁস মেরে নিজের বিশ্বাসও জাগিয়ে তুলল। তার কথায় সায় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ। এবার তোমার মাম্মিকে পেয়ে যাব আমরা।

পেয়ে যাব কী, বাপি? বলো হ্যাঁ পেয়ে যাব!

প্রমিত ছাত্রের মতো শিখে নিচ্ছে শিক্ষকের কাছে থেকে। তারপর মিন মিন করে বলল, হ্যাঁ, পেয়ে যাব।

বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে কী বলছো, বাপি? জোরে বলল, হ্যাঁ। বলো। বলো। হ্যাঁ বলোজোরে বলো। নানুকে শুনিয়ে বলল।

মেয়ের প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব বুঝতে পারছে প্রমিত। তার নির্দেশও পালন করে যাচ্ছে। শাশুড়ির উদ্দেশে কথা বলতে গিয়ে দেখল ওঁনার শাসকষ্ট কমে এসেছে। শাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক না হলেও স্বাভাবিকের কাছে চলে এসেছে। নাতনির কথা নিশ্চয় ওঁনার কানে ঢুকেছে। নিশ্চয় হ্যাঁ এর দাপুটে কথার তোড়ে উড়ে গেছে ওঁনার ওপর চেপে বসা আতঙ্কের চাপ। মিতুর চুপ মেরে থাকাকে নিশ্চয় উনি ভয় নিয়ে মেপেছেন। ভয় পেলেও, চাপে পড়লেও এমন শ্বাসকষ্ট হতে পারে ভেবে ভেবে জোরেই শাশুড়ির উদ্দেশে বলল, মিতুকে মেসিজ দিয়েছি। নিশ্চয় সে এবার জবাব দেবে। নিশ্চয় হাসপাতালে চলে আসবে।

আসমা বেগমের মুখে কথা না ফুটলেও তার চোখে আর মুখের ভাষায়ও হ্যাঁ সূচক উত্তর ফুটে উঠেছে। তা দেখে বাবার কোলে বসেই রোদ্দুর ছুঁয়ে দিল নানুর হাত।

.

জরুরি বিভাগের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভাগের ভিতর থেকে একটা প্যাশেন্ট ট্রলি নিয়ে ছুটে এলো দুজন স্বাস্থসেবা কর্মী। ট্রলিতে শুইয়ে দেওয়া হলো তাকে। দ্রুতই ট্রলিসহ রোগী ঢুকে গেল ভেতরে।

পেছন পেছন ঢুকল প্রমিত, রোদ্দুর।

কর্তব্যরত চিকিৎসক আসার আগেই আসমা বেগমকে শুইয়ে দেওয়া হলো জরুরি বিভাগের বেডে।

কাছে গিয়ে প্রমিত প্রশ্ন করল, কেমন লাগছে, আম্মা?

প্রমিত দেখল, চোখ বুজে আছেন শাশুড়ি। কথা বলছেন না।

নার্স এসে বলল, আপনারা সরে দাঁড়ান।

সরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বেড ঘিরে একটা টানাপর্দা টেনে রোগিণীকে আড়ালে ঢেকে নার্স প্রশ্ন করলেন, বুক ব্যথা করছে? শাস কষ্ট হচ্ছে?

উত্তর পাওয়া গেল না। নার্স ফটাফট ইসিজি করার যন্ত্রপাতি ফিট করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রিপোর্টও বেরিয়ে এলো।

পর্দার বাইরে দাঁড়িয়ে ভীত হয়ে গেল প্রমিত। রোদ্দুরও হতবাক হয়ে দেখছে জীবনের অন্য চেহারা। মানুষের কষ্ট আর অসুস্থতার নানা সংকট দেখছে নির্বাক তাকিয়ে। এ সময় পর্দা সরিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঢুকলেন ভেতরে। রোগিণীর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী সমস্যা, মা?

চিকিৎসকের মা সম্বোধনটা পরানে পানি ঢেলে দিলেও প্রমিত বুঝল শাশুড়ি কথা বলছেন না। জবাব দিচ্ছেন না। ইসিজি রিপোর্টটা তাৎক্ষণিক দেখে চিকিৎসক আবার বললেন, শুনুন, আপনার হার্ট ভালো আছে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে ফুসফুস দেখতে দেখতে বললেন, শ্বাস নিন। শাস ছাড়ুন।

সব দেখে শুনে বললেন, লাংগস্ও ভালো।

প্রেসার আর পালরেট দেখে বললেন, ভালো। সব ভালো। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে এবার প্রশ্ন করলেন, ওনার সঙ্গে কে আছেন?

সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল প্রমিত। রোদ্দুর ধরে আছে বাপির হাত। বাসা থেকে নিয়ে আসা ব্যাগটা হাতেই ধরা আছে।

চিকিৎসক জিজ্ঞেস করলেন, কে হন উনি?

শাশুড়ি। বলল প্রমিত।

আমার নানুভাই। বলল রোদ্দুর।

বাহ। নাতনি চলে এসেছে! বলেই রোদ্দুরের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। ভয়ের কিছু নেই।

শান্তি পেল প্রমিত। রোদ্দুরও এগিয়ে গিয়ে ধরল নানুভাইয়ের হাত।

কী হয়েছিল? কেন জরুরি বিভাগে ছুটে আসতে হলো?

হঠাৎ ওনার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে কষ্ট কমে গেছে মনে হলো।

দুর্ঘটনা বা চাপে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছে?

জি। ঘটেছে।

কী ঘটনা?

ওনার মেয়ে মানে আমার স্ত্রী, রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে সিএনজি নিয়ে। তারপর আমার শাশুড়ির সঙ্গেও রাগ দেখিয়ে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে সুইচ অফ করে রেখেছে। এখনও সুইচ অন করছেন না। আমরা সবাই পেরেশানিতে আছি।

চিকিৎসক আবার বললেন, আপনার স্ত্রী?

জি।

আমার মাম্মি। সঙ্গে সঙ্গে বলল রোদ্দুরও।

বলুন তো তার, পরনে কী পোশাক ছিল?

প্রমিত জবাব দিতে পারল না।

রোদ্দুরই বলল, এই যে, এ রঙের। নিজেরটা দেখিয়ে দিলো।

চিকিত্সকের মনে পড়ে গেল সকালের দিকে আসা নাম না-জানা সেই রোগিণীর কথা। অটো চালক নিয়ে এসেছিল।

নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে এক নাম না-জানা মেয়েকে আমরা অ্যাডমিট করেছি। ভিডিও ফুটেজে দেখে নিতে পারেন তিনি আপনার স্ত্রী কিনা। প্রমিতের উদ্দেশে কথাটা বললেও রোদ্দুরের গালে টোনা মেরে আদর দিয়ে চিকিৎসক এগিয়ে যেতে শুরু করলেন। প্রমিত বলল, কোথায় ভিডিও ফুটেজ মনিটরিং কক্ষ?

ওই যে। পাশের কক্ষে যান। আমি বলে দিচ্ছি। আর আপনার শাশুড়ির প্রেসক্রিপশন ঠিক করে দিচ্ছি।

রোদ্দুর একবার গিয়ে নানুভাইয়ের হাত চেপে ধরে ফিরে এসে আবার ধরেছে বাপির হাত। তারপর চিকিত্সকের উদ্দেশে জিজ্ঞেস করল উনি কি কমলা রঙের ড্রেস পড়েছিলেন?

বাহ! তুমি রং সব চেনো?

উত্তর না দিয়ে রোদ্দুর আবার জিজ্ঞেস করল, ওনার ড্রেসের রং কি আমারটার মতো ছিল?

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তিনি জবাব দিলেন, চোখের ইমেজে তেমনই মনে হচ্ছে।

ভয় বেড়ে গেল প্রমিতের। নিউরোসার্জারি শব্দটা আতঙ্ক জাগিয়ে তুলল।

রোদ্দুর আবার প্রশ্ন করল, তিনি কি আমার মাম্মি?

চলে যেতে উদ্যত চিকিত্সক এবার ঘুরে তাকালেন তার পেছন পেছন হাঁটতে থাকা রোদ্দুরের প্রতি। তারপর মাথায় হাত রেখে আদর দিয়ে আবার বললেন, আমি তো তোমার মাম্মিকে চিনি না, মা।

আব্বু, চলো ভিডিও দেখি। মেয়ে ভুলে গেল নানুভাইয়ের কথা। মায়ের সন্ধান পেয়ে গেছে ভেবে আনন্দিত হলো না। ভয়ে কুঁকড়েও গেল না। এক ধরনের দুর্বিনীত তাড়না জেগে উঠল মাম্মিকে খুঁজে বের করার জন্য।

প্রমিত বলল, তোমার নানুভাই তো একা। ওনাকে রেখে যাব?

চলো, নানুভাইকে বলে আসি। বলেই বাপির হাত টেনে ও আবার এলো পর্দা ঘের দেওয়া বেডের পাশে।

ঠিক এ সময়ে রোদ্দুরের নানা আলি আশরাফ চৌধুরী ঢুকলেন জরুরি বিভাগে। এক নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, আসমা বেগম নামের একজন রোগী এসেছেন?

ওই যে, ওই বেডে।

নানাভাইয়ের কণ্ঠ শুনে পর্দার ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো রোদ্দুর। প্রমিতও।

রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে পড়ল নানাভাইয়ের কোলে। তারপর কোল থেকে নেমে সে কমান্ড করল, নানাভাই নানু ভালো আছে। তুমি নানুর পাশে দাঁড়াও। আমি আর আব্ব ভিডিও ফুটেজ দেখতে যাব। আম্মুকে খুঁজে দেখতে যাব।

এ কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না রোদ্দুরের নানাভাই।

পর্দাঘেরা বেডের সামনে এসে স্ত্রীকে শুয়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেও তাকে ভালো দেখে বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

বার

ভিডিও ফুটেজ অপারেটর টিভিস্ক্রিনের ওপর চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কটার সময় উনি জরুরি বিভাগে এসেছিলেন?

জবাব দিতে পারল না প্রমিত।

রোদ্দুর বলল, ধীরে ধীরে দেখেন। মাম্মির ড্রেস দেখলে চিনে ফেলব আমি।

তা পারবে। তো তোমার মাকে কটার সময় হাসপাতালে আনা হয়েছে, জানলে দ্রুত পেয়ে যাব।

কী যেন বলতে চাচ্ছিল রোদ্দুর। বলল না। বাবার হাত ছেড়ে দৌড়ে এসে আবার ঢুকল জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কক্ষে। ততক্ষণে লোকজন ঘিরে ধরেছে চিকিৎসককে।

রোদ্দুর ফাঁক গলে ঢুকে চলে এলো টেবিলের কাছে। তারপর বলল, আংকেল! আংকেল! মাম্মিকে কটার সময় হাসপাতালে আনা হয়েছিল?

ভিড়ের মধ্যে থেকে চিকিত্সক চোখ তুলে তাকালেন। মাকে আকুল প্রাণে খুঁজতে থাকা শিশুটির দিকে তাকিয়ে ভিড়ের চাপে দিশেহারা থাকা অবস্থাও তাঁর মন নরম হয়ে গেল। হাতের কাজ বন্ধ রেখে প্রশ্ন করলেন, উনি তোমার মা? নিশ্চিত তুমি?

প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলেও পাল্টা প্রশ্ন করল, কটার সময় উনি এসেছিলেন?

থমকে গেলেন চিকিৎসক। অনুমান করে বললেন, আমি সকাল সাড়ে সাতটায় এসেছি ডিউটিতে। তার আধা-ঘণ্টা একঘণ্টা পর হবে। আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত খুঁজে দেখতে বলল।

আচ্ছা। যেন ও পেয়ে গেছে মাকে এমন স্বস্তি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েও পারল না। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে বেরোনোর সময় ও শুনল চিকিৎসকের আরেক প্রশ্ন, উনি সত্যিই তোমার মা?

থেমে মাথা ঘুরিয়ে রোদ্দুর জবাব দিল, জি।

কীভাবে বুঝলে?

আমার মন বলছে, হা উনি আমার মা।

আচ্ছা যাও। খুঁজে দেখো। আমাকে জানিয়ে যেও।

আচ্ছা। বলেই রোদ্দুর ফাঁক গলে বেরিয়ে দৌড়েই এলো অপারেটরের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আটটা থেকে সাড়ে আটটা।

চলমান ভিডিও ফুটেজটি স্লো করে দিয়েছেন অপারেটর।

উকণ্ঠা নিয়ে দেখছে প্রমিত। রোদ্দুরও। আচমকা একটা ভিডিও চিত্র দেখে চিৎকার করে উঠল রোদ্দুর। চিৎকার শুনে স্থির হয়ে গেল চিত্রটি। একজন লোক সিএনজি অটো থেকে কোলে করে বের করে নিয়ে আসছেন একজন মহিলাকে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে ড্রেস দেখা যাচ্ছে–কমলা রঙের।

মাম্মি! মাম্মি! মাম্মি! গলার স্বর বসে গেল। রোদ্দুর চিৎকার দিতে পারল না। কেবল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রমিতও দিশেহারা হয়ে গেল। অজ্ঞান মিতুকে কোলে করে নামাচ্ছে কে? প্রশ্নটি কেবল জেগে উঠল মনে। অপারেটর আবার চালু করলেন ফুটেজ। পুরো চিত্র দেখা গেল। বিছানায় শোয়ানো, চিকিৎসক-নার্সের কর্তব্য পালনের দৃশ্য তারপর ট্রলিতে ঠেলে ওয়ার্ডের দিকে গমন।

রোদ্দুর ছুটে গেল চিকিত্সকের দিকে। মেয়েটির প্রাণকাড়া আকুলতা দেখে সবাই তাকে ছাড় দিল যাওয়ার। পথ করে দিল, টেবিলের সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে কেবল বলতে পারল, মাম্মি! মাম্মি!

পেয়েছো! উনিই তোমার মা?

হুম।

পেয়েছো তোমার মাকে?

হ্যাঁ।

তোমার মা!

হ্যাঁ। হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমার। আমার।

আচ্ছা, শান্ত হও। তোমার মার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

মাম্মিকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে কেন? কে উনি?

উনি সিএনজি চালক। চালকই ওনাকে হাসপাতালে এনেছে। আর… বলতে গিয়েও বললেন না যে উনি কপালে চোট খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

আর কী? থেমে গেলেন কেন, আংকেল? আম্মু ভালো আছেন তো?

আছেন। ভালো আছেন। সংক্ষেপে কথা শেষ করতে গিয়েও শেষ করতে পারলেন না কর্তব্যরত চিকিৎসক।

ভালো থাকলে মাম্মিকে কোলে করে হাসপাতালে ঢোকাচ্ছে কেন?

উনি কপালে একটু চোট পেয়েছেন তো। কপাল ফুলে গেছে।

আমি মাম্মির কাছে যাব।

ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা করছি।

জরুরি বিভাগের কর্মরত এক আয়াকে ডেকে বললেন, ওদের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দাও।

রোদ্দুর ছুটে গেল নানু আর নানাভাইয়ের কাছে। আসমা খাতুন ততক্ষণে উঠে বসেছেন বেডে। নাতনিকে দেখে বুকে জড়িয়ে বললেন, আমি ভালো হয়ে গেছি!

মাম্মির খবর পেয়েছি, নানুভাই। তুমি আর চিন্তা কোরো না। নানাভাইয়ের সঙ্গে থাকো এখানে। আমি আর আব্ব যাচ্ছি মাম্মির কাছে।

কোথায় সে? প্রশ্ন করলেন আলি আশরাফ চৌধুরী।

মিতু হাসপাতালে? শ্বাসকষ্ট কমে যাওয়ায় প্রশ্ন করলেন আসমা বেগম।

হাসপাতালে।

কী হয়েছে আমার মেয়ের?

এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না প্রমিত। রোদ্দুরও।

তের

নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে ঢুকতে বাধা পেল প্রমিত। বাবার হাত ছেড়ে রোদ্দুর এগিয়ে গেল বাধাদানকারী ওয়ার্ডেবয়ের দিকে।

আমার মাম্মিকে নিতে এসেছি। ওনার কাছে যেতে দিবেন না?

ওয়ার্ডে এখন রাউন্ড চলছে। অধ্যাপক স্যার রাউন্ড দিচ্ছেন। ডাক্তার-নার্সরা দল বেঁধে একটার পর একটা বেডের রোগী দেখছেন।

এ সময় কাউকে ওয়ার্ডে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।

আমি ছোটো মানুষ। আমি ঢুকলে ওঁনারা কিছু বলবেন না। আমি যাব মাম্মির কাছে। নিচে থেকে বলে দিয়েছেন এক ডাক্তার আংকেল। উনি সতের নম্বর বেডে আছেন।

সতের নম্বর বেডের রোগীর তো নাম পাওয়া যায়নি। টিকিটে লেখা আছে নাম জানা নেই। কী নাম ওনার?

মিতু। মাম্মির নাম মিতু।

আচ্ছা। আপনারা দাঁড়ান। আমি অনুমতি নিয়ে আসি। আর ডাক্তারদের বলে আসি সতের নম্বর বেডের মেয়ে এসেছে। কথা শেষ করে ওয়ার্ডবয় জিজ্ঞেস করল, আপনি কে হন?

আমি মিতুর হাজবেন্ড।

আচ্ছা। ভালো হলো। দাঁড়ান এখানে।

ওয়ার্ডবয় ভেতরে ঢুকে আলাপ করার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন এক মহিলা চিকিৎসক।

আপনারা এসেছেন!

জি। আমি মাম্মির কাছে যাব।

আচ্ছা। এখন এখানে, এই যে আমাদের সহকারী রেজিস্ট্রারের কক্ষে বসুন। সতের নম্বর বেডের রোগীর স্বজনদের খুঁজছিলাম আমরা। ভালোই করেছেন এসে।

এসব কথা শুনছে না প্রমিত, রোদ্দুরও।

আমি মাম্মির কাছে যাব। বারবার বলতে লাগল রোদ্দুর।

অবশ্যই যাবে। কিন্তু এখন উনি বেডে নেই। ওনাকে রেডিও ইমেজিং বিভাগে নেওয়া হয়েছে। ব্রেনের সিটি স্ক্যান করানো হচ্ছে। রিপোর্ট পেলে মূল চিকিৎসা শুরু হবে। আপাতত কনজারভেটিভ চিকিত্সা চলছে।

শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পারছে না প্রমিত। রোদ্দুরও না। সে এবার কান্না জুড়ে দিল, আমি মাম্মির কাছে যাব। কোথায় নিয়ে গেছে আমার মাম্মিকে। আমি সেখানে যাব।

প্রমিত স্থির কণ্ঠে জানতে চাইল, মিতু ভালো আছে তো?

বাবার বলা প্রশ্নটা আলোড়ন তুলল রোদ্দুরের মাথায়। সেও প্রশ্ন করে বসল, মাম্মি ভালো আছে তো? কী হয়েছে ওনার?

এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না চিকিৎসক। শান্ত কণ্ঠে বললেন, প্লিজ। এখানে অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণের মধ্যে ওনাকে এখানে নিয়ে আসা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে বাকি চিকিৎসার।

ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন মহিলা চিকিৎসক। বুকে লাগানো তার নেম প্লেটে লেখা আছে ডা. রুবিনা।

রোদ্দুর ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে বললেন, আমি আমার আম্মুর বেড়ে গিয়ে বসব। আমাকে নিয়ে চলুন।

শিশুর আকুল কথায় একদম শিথিল হয়ে গেল ডা. রুবিনার মন। আর রোদ্দুরও বেপরোয়া। ও ধরে বসে আছে ওনার ডান বুড়ো আঙুল। তিনি চোখ তুলে তাকালেন প্রমিতের দিকে। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন, আপনি এখানে বসুন।

প্রমিত দাঁড়িয়ে রইল। আর রোদ্দুর চিকিৎসকের আঙুল আঁকড়ে ধরে ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকে গেল।

এক রোগীর বেডের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চিকিৎসক দলের সবাই একযোগে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে লাগল শিশুটিকে।

রাউন্ডের অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন, ও-ই কি সতের নম্বর বেডের রোগিণীর মেয়ে?

জি, স্যার।

তিনি এগিয়ে গেলেন। তারপর শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোমার?

রোদ্দুর।

বাহ! চমৎকার নাম। যেমন নাম তেমন মিষ্টিও তুমি।

এসব আদুরে কথা আর প্রশংসায় মন টলল না রোদ্দুরের। ওর মুখ ফুটে গেল আবার। গরগর করে বলতে লাগল, মাম্মির কাছে যাব।

অবশ্যই মাম্মির দেখা পাবে তুমি। এখানেই আসবেন কিছুক্ষণের মধ্যে।

আমার মাম্মি ভালো আছে?

কী জবাব দেবেন অধ্যাপক। প্রশ্নের ভেতরের আকুলতা দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। এমন জখমে আক্রান্ত রোগীর অবস্থা কীভাবে জানাবেন? ভেবে নিয়ে বললেন, এখনই তোমার মাম্মি আসবেন এখানে। আসার পর আমরা পুরো চিকিৎসা শুরু করব।

এখনো চিকিৎসা শুরু করেননি?

আবারও থমকে গেলেন ওয়ার্ড প্রধান, কর্তব্যরত অধ্যাপক।

ডা. রুবিনা রোদ্দুরের হাত ধরে অনেকটা বুকে জড়িয়ে ওকে নিয়ে গেলেন সতের নম্বর বেডের পাশে। সাইড টেবিল দেখিয়ে বললেন, এখানে বসো। আমি রাউন্ড শেষ করে আসি।

রোদ্দুর বলল, না। তুমি যেয়ো না। তুমিও দাঁড়াও। আমার ভয় করছে। মাথা কেমন কেমন করছে। তুমি যেয়ো না। তুমিও থাকো। মাম্মি আসুক। এলে যেয়ো।

রুবিনা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।

অধ্যাপক সাহেব ইশারা করে বললেন, থাকো।

রুবিনা দাঁড়িয়ে রইল রোদ্দুরের পাশে।

তুমি কি আমার মাম্মিকে দেখেছ, রুবিনা আপু?

বাহ! আমার নাম জেনে ফেলেছ?

হ্যাঁ। তোমার নাম জানা তো সোজা। ওই যে নাম লেখা আছে। তোমার বুকে।

পড়তে পারো তুমি?

বানান করে করে পড়ে ফেলেছি।

ব্রিলিয়ান্ট!

বিরিলিয়ান্ট অর্থ কী, আপু?

মেধাবী।

আমার মেধাবী হওয়ার দরকার নেই। মাম্মিকে চাই।

তোমার মাম্মিকে আমি দেখেছি।

ভালো আছেন?

খারাপ না। এটুকুন বলব।

তাহলে যাও তুমি। আমার মাম্মিকে নিয়ে আসো।

সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না রুবিনা। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকল বোকার মতো।

রোদ্দুর এবার জুতো খুলে বেডের ওপর উঠে বালিশটা জড়িয়ে শুয়ে রইল। আর তার চোখ বেয়ে দরদর করে নেমে আসতে লাগল লোনা জল। রোদ্দুরকে বাধা দিলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম চলে এলো রোদ্দুরের দুচোখে। বালিশটা বুকের তলে রেখে মাথা কাত করে ঘুমিয়ে গেল ও।

কিছুক্ষণ ওকে খেয়াল করে রুবিনা বাইরে এসে প্রমিতের উদ্দেশে বললেন, আপনি রোদ্দুরের বাবা তো?

জি।

আসুন। রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডে শুয়ে আছে। আপনি বেডসাউড টুলে বসে থাকুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে রোদ্দুরের মা।

তার কি জ্ঞান ফিরেছে? ভিডিও ফুটেজে দেখলাম অজ্ঞান অবস্থায় একজন ওকে কোলে করে জরুরি বিভাগে ঢোকাচ্ছে।

আমি দেখেছি। অজ্ঞান অবস্থায় থাকলেও সব নির্ভর করেছে সিটি স্ক্যানের রিপোর্টের ওপর। ধৈর্য তো ধরেছেন। আর কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকুন।

চোখ বুজে আসে প্রমিতের। ভেতরের চোখ দিয়ে সে নিজেকে খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে লাগল। ভেতরে আপন সত্তার জলের তল খুঁজে পেল না। ভেতরের ভেতরটা দেখার শক্তি হারিয়ে গেছে। অন্ধ হয়ে গেছে চোখ। অন্ধত্বের কি কোনো অন্ধ চোখ আছে? মনে হলো আছে। অন্ধত্বের সে চোখের খোঁজ পেল না। কেবল শূন্যতার দিকে চেয়ে রইল। দুহাতের কবজি পেচিয়ে দুহাত চেপে থাকতে থাকতে মনে হলো অন্ধ হয়ে অন্ধের প্রতিশব্দ খুঁজে বেরাচ্ছে অন্ধকূপে।

চৌদ্দ

জরুরি বিভাগের চিকিৎসা নিয়ে ভালো বোধ করতে থাকায় আসমা বেগম স্বামীর উদ্দেশে চিন্তিত স্বরে বললেন, মিতুর খোঁজ নাও। হাসপাতালে এলো কেন।

মিতুর মুঠোফোনে কল করে দেখলেন ওর ফোনের সুইচ বন্ধ হয়ে আছে। কল করলেন প্রমিতকে।

মিতুকে সিটি স্ক্যান করার জন্য রেডিও-ইমেজিং বিভাগে নিয়ে গেছে। বলল প্রমিত।

কে আছে ওর সঙ্গে? হাসপাতালে কেন ও?

জানি না এখনও ভালো করে।

তুমি কী করছে? রোদ্দুর কোথায়?

নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে সতের নম্বর বেডের পাশে অপেক্ষা করছি। আর রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়েছে বেডে।

আমরা আসছি। তোমাদের আম্মা সুস্থ বোধ করছেন। জরুরি বিভাগ থেকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে।

আসুন লিফটের তিন। এলেই ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকতে দেবে না। বাইরের বারান্দায় বসার জায়গা আছে। ওখানে বসবেন।

বসার দরকার কী? তোমার শাশুড়িকে রোদ্দুরের পাশে রেখে আমরা রেডিও-ইমেজিং বিভাগে চলো। মিতুর পাশে দাঁড়াই।

জি। ঠিক বলেছেন। আসুন।

প্রমিত একবার তাকাল রোদ্দুরের দিকে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি মেয়েটা। ক্লান্তি আর ভয়ে ভেঙে পড়েছে। ঘুমিয়ে গেছে। অসহায় লাগছে। নিজেকেও মনে হচ্ছে পাথর। পাথরে ধার দেওয়া দরকার। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া দরকার। নিজেকে শাসন করার দরকার নেই। পুরো ঘটনার টানে ইতিমধ্যে শাসিত হয়ে বসে আছে ও। কিছু ঋণ তৈরি হয়ে গেছে। ঋণ শোধ দেওয়ার সুযোগ দেবে কি না মিতু, কে জানে। মনে আগুন নেই। ঋণের ভারে নিভে গেছে বুকের ঘরে জ্বলতে থাকা চিতা। প্রকৃত সত্য আসল সত্য নয়, নিরপেক্ষ সত্যের নাটাই ঘোরে কার হাতে, কে জানে। সত্যের প্রতিশব্দরা অন্ধ হয়ে বসে আছে। নিয়তির মধ্যই কি লুকিয়ে আছে তার খোঁজ? ভাবতে থাকে প্রমিত।

মায়ের সেটে পুরোনো একটা বাংলালিংক সিম ঢুকিয়ে নিয়েছিল। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশন মোড় থেকে কম্পন বেরোতে থাকায় হাতের দিকে তাকাল ও। হাতে ধরা ছিল ফোন। এক্সবুম কল করেছে। একটা নাড়া খেল প্রমিত। তীব্র আঘাত হানল বুকে। নিজের সৃষ্ট অন্ধকূপের তলে দেখল স্বামিত্বের মৃত্যুমুখ, পিতৃত্বেরও। নিজের ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়েছে তির। কত গভীরে ঢুকে গেছে ওই বিষ-তির বোঝার সাধ্য নেই। হঠাৎ এত ঘটনার মধ্য থেকে জৈবিকসত্তা নড়ে উঠল। কল রিসিভ করবে না ভেবেও রিসিভ করে বলল, বিপদে আছি। কল কেটে দিচ্ছি। পরে কথা বলব।

বিপদে আছো, নাকি এভয়েড করছো?

টেনশনে আছি, হাসপাতালে। রাখো এখন?

হাসপাতালে কেন? আসব আমি? বিপদে তো কাছে থাকতে হয়, বন্ধুর মতো। আসব?

না।

লাইন কেটে দিল প্রমিত। আবার কল এসেছে। এবার সুইচ অফ করে দিল ও। তাকাল রোদ্দুরের মুখের দিকে। জানালার পাশে বেড। জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে। মিতুর রাখা

রোদ্দুর নামটার অর্থ বুঝতে পারল ও। কচি কোমল মায়াবি মুখের অন্য আলো ঢুকে যেতে লাগল নিজের বুকের ঘরে। অন্ধকূপে অলো ঢুকছে। মায়ার আলোয় আলোময় হয়ে গেছে চারপাশ। না। ওটা মৃত্যুকূপ নয়। ওই কূপে জ্বলজ্বল করছে পিতৃত্বের ফুল। আগাছার মতো কেবল বেড়ে উঠতে দেখল জৈবিকত্বের শাখা-প্রশাখা। মাকড়সার জালের মতো ধুলো ময়লা মেখে তা মলিন আর নোংরা হয়ে আছে। এসব ময়লা কীভাবে দূর হবে জানে না প্রমিত।

হঠাৎ শোরগোল শুনল ওয়ার্ডের গেটে। কারা যেন ঢুকতে চাচ্ছে। ঢুকতে দিচ্ছে না ওয়ার্ডবয়। বাক-বিতণ্ডা হচ্ছে। টুল থেকে উঠে সামনে এগিয়ে গিয়ে শুনল, সতের নম্বর বেডে এর মধ্যে দুজন। এসেছেন। একজন রোগীর মেয়ে। আরেকজন স্বামী। ওনারা বেড়ে অপেক্ষা করছেন। এখনই রোগিণী ফিরবে ওয়ার্ডে। স্যাররা এক রোগীর সঙ্গে এত লোক দেখলে রেগে যাবেন।

দ্রুত কাছে গেল প্রমিত।

আর তখনই শুনল কঠিন কণ্ঠস্বর, এই বিপদে মোবাইল ফোন বন্ধ করে বসে আছো? তোমার মতলব কী? আমার মেয়েকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছো? আবার মোবাইলও বন্ধ! শ্বশুরের ভয়াল কথার আক্রমণ সামাল দেওয়ার জন্য যা বলা দরকার, কিছুই বলতে পারল না। প্রমিত ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়ার্ডবয়ের উদ্দেশে বলল, ভাই, আমার শশুর-শাশুড়ি ওঁনারা। শাশুড়িকে আসতে দিন। আমার মেয়ের পাশে গিয়ে বসুক। আমি বরং বাইরে থাকি। আর উনি আমার শ্বশুর। ওঁনার কথায় রাগ করবেন না। ববাঝেনই তো আমরা সবাই টেনশনে আছি।

প্রমিতের কাতর কথায় নরম হয়ে গেল ওয়ার্ডবয়ের মন। শাশুড়িকে বেডের কাছে বসিয়ে দিয়ে গেটে ফিরে এসে শশুরের উদ্দেশে বলল, স্যরি আব্বা। বারবার অফিসের ফোন আসছিল তো তাই সুইচ অফ করে দিয়েছিলাম।

অফ করবে কেন? ভাইব্রেশন মোডে রাখো। অথবা সাইলেন্ট মোড রেখে হাতে ধরে রাখ মুঠোফোনটা। প্রয়োজনীয় কল এলে ধরতে হবে না, এই বিপদের সময়?

স্যরি, আব্বা। স্যরি।

আলি আশরাফ চৌধুরীর রাগ কমল না। ভেতরের ক্ষোভ ঝেড়েও শেষ করতে পারলেন না। আরও গম্ভীর হয়ে কঠোর স্বরে বললেন, আমার মেয়েকে কোথায় আঘাত করেছো?

আমি আঘাত করিনি, আব্বা।

ক্রিমিনালরা সব সময় নিজেকে নির্দোষ ভাবে।

শশুরের এমন ভয়ংকর রূপ কখনও দেখেনি প্রমিত। আজ দেখল ভিন্ন রূপ। ক্রোধান্ধ পিতার ভয়াল আক্রমণের পেছনে রয়েছে ভুল ধারণা, কমিউনিকেশন গ্যাপ। বুঝতে পারল প্রমিত। এ মুহূর্তে ভুল ধারণা ভাঙতে গেলে, সত্যটা তুলে ধরতে গেলে আরও সংঘাত বেঁধে যেতে পারে ভেবে চুপ হয়ে গেল ও।

তুমি যে এমন ভয়ংকর ছেলে, কল্পনাও করতে পারিনি আমি।

মনে রেখো, আমার মেয়ের কিছু হলে ছাড় দেব না তোমাকে।

জি, আব্বা। এখন চলেন। দুজনই যাই নিউরোইমেজিং বিভাগে। দেখি সিটি স্ক্যান করাতে এত দেরি হচ্ছে কেন?

এ কথায় দমে গেলেন আলি আশরাফ চৌধুরী। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *