হিসেবে কিছু ভুল ছিল – ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
জুতোজোড়া প্রথমে সজীব হয়ে নড়ে উঠল, তারপর গটগট করে বিছানার কাছে গিয়ে থেমে পড়ল।…
মহীতোষবাবুর গায়ে কাঁটা দিল। হেমেন রায়ের রহস্যরোমাঞ্চ সমগ্র বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। নাহ, আজ থাক। বাকিটা কাল সকালে পড়বেন।
ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চাশ। কনকনে শীতের রাত। চারিদিক নিশুতি। মহীতোষবাবুর মনে পড়ে গেল, আজ হেরম্ব দাস লেনে প্রকাণ্ড বাড়িতে তিনি একেবারে একা।
করিডরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। জ্বলুক সারারাত। বেডরুমেও আজ আলো নেভাবেন না।
হঠাৎ য—যা! আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং? শনিবারের রাতে!
পাঞ্জাবির পকেট হাঁটকে লাইটারটা বের করলেন। বুকের ভিতর ধপ—ধপ শব্দ।
হলুদ শিখা অনেকটা সাহস ফিরিয়ে দিয়েছে। মোমবাতি কোথায় আছে? মনে পড়ছে না।
পিপিং…পিপিং…। ল্যান্ড ফোনটা বাজতে শুরু করেছে। এত রাতে কে করল? বাজুক গে। তুলবেন না। উহুঁ, ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে হতে পারে। নতুন কী একটা যন্ত্র বসিয়ে দিয়ে গেছে। সেই সিস্টেমে হয়তো পাওয়ার ফেলিওর ধরা পড়েছে।
মহীতোষ চেনা পথে ফোনের দিকে এগোলেন। একহাতে জ্বলন্ত লাইটার।
‘হ্যালো।’
‘দাদা! ভালো আছ?’
গলাটা চেনা—চেনা। একটু ফ্যাঁসফেসে।
‘ক—কে?’
‘সে কী দাদা! ছোটভাইকে এর মধ্যেই ভুলে গেলে?’
‘ম—মানে? ক—কে আপনি?’
‘তোমার ছোট ভাই। মনোতোষ।’
‘কী! বাজে কথা বোলো না। আমার কোনও ছোটভাই নেই।’ মহীতোষের গলা কেঁপে যাচ্ছে।
‘এখন নেই। কিন্তু ছিল তো! এখানে একা—একা বড্ড কষ্টে আছি দাদা। তোমার কাছে আসছি।…ধরো না, এসেই গেছি। আজ তোমায় নিয়ে যাব দাদা।’
ফোন কেটে গেল।
মহীতোষ ধপ করে বিছানায় বসে পড়েছেন। শরীর থরথর করছে। দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে চেপে থাকা লাইটারটা পড়ে গেল। ডান হাতের রিসিভারটাও টলটল করছে।
ঠিক তখনই খট—খট…খটাখট…খট….খট…। বাথরুমের ভেতর থেকে বিশ্রী আওয়াজ। হঠাৎ কারা ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে।
মনোতোষ! ওকে নিয়ে যেতে সদলবলে এসে গেছে?
মহীতোষ বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যথা।
একটানা মিনিটখানেক চলার পরে অপার্থিব আওয়াজ থেমে গেল। মনোতোষ ঢুকে আসবে?
মহীতোষের চক্ষু বিস্ফারিত। একফোঁটা শক্তি নেই। চিনচিনে ব্যথা লাফিয়ে—লাফিয়ে বাড়ছে, ঠোঁট শুকনো, জিভ অসাড়।
বাথরুমের ভিতরে এবার কল—কল—কল—কল। কেউ জলের কল খুলে দিয়েছে। কী চায় মনোতোষ?
জলের শব্দ বন্ধ হয়েছে। মহীতোষ উঠে বসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
আচমকা আবার! আবার সেই ভয়ানক ধপাধপ…ধপাধপ। পুরো বাথরুমটা সেই শব্দে কাঁপছে।
বুকের বাঁ দিকটা খিমচে ধরলেন মহীতোষ সান্যাল। উঃ! অসহ্য!
.
‘প্রিয়তোষবাবু, নমস্কার। ভেতরে আসব?’
‘আপনি!’
‘কিরণকুমার। ডি.ডি. ইনসপেক্টর, লালবাজার।’
‘আসুন। কিন্তু আমি ঠিক…লালবাজার…’
‘মহীতোষ সান্যাল আপনার জ্যাঠামশাই তো?’
‘হ্যাঁ। কাল রাতে জ্যাঠাবাবু ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে…আজ সকালে দরজা ভেঙে ওনাকে… তখনই ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে খবর দিয়েছি…কিন্তু…পুলিশ…কেন?’
‘সোজাসুজি বলতে গেলে তদন্ত করতে।’
‘তদন্ত!’
‘ইয়েস প্রিয়তোষবাবু। সকালে জয়েন্ট সিপি সায়েবের ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি আমায় ছুটে আসতে হয়েছে। ও.সি.—ও একটু পরে আসছেন।’
‘জয়েন্ট কমিশনার!’
‘হ্যাঁ। মহিমা বাগচীকে চেনেন নিশ্চয়ই?’
‘নিশ্চয়ই। আমার বোন। জ্যাঠাবাবুর একমাত্র মেয়ে। বিয়ের বছর পাঁচেক পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায়। ঘণ্টাখানেক আগে আমিই ওকে খবরটা জানিয়েছি।’
‘ঠিক। ম্যাডামের হাসব্যান্ড জয়েন্ট সিপির বাল্যবন্ধু। সেই কানেকশানেই সাহেবকে ওনারা জানিয়েছেন, মহীতোষবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। দে ওয়ান্ট পোলিস ইনভেস্টিগেশন।’
‘মাই গড! মহিমা আমায় তো কিছু বলল না! স্ট্রেঞ্জ! ও বিদেশে চলে যাওয়ার পর থেকে জ্যাঠাবাবুকে আমরা—আই মিন আমার ফ্যামিলিই দেখাশোনা করে আসছে। আমায় ছেলের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। এমনকী জ্যাঠাবাবুর ব্যবসা—কারখানা সবকিছুই আমায় সুপারভাইস করতে হয়! ওনার বয়েস হয়েছিল সেভেনটি প্লাস।’
‘জানি মিস্টার সান্যাল। আসতে—আসতে আমি কিছু ইনফরমেশন ইন—পুট নিয়ে এসেছি। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমি হেলপলেস। হাই লেভেলের অর্ডার…।’
‘আমি টেরিবলি শকড মিস্টার কুমার। মহিমা কি আমায় সন্দেহ করছে?’
‘না। তেমন কিছু অবশ্য শুনিনি।…আপনার জ্যাঠা কি একাই থাকতেন?’
‘মহিমার বিয়ের পর পাঁচবছর একাই ছিলেন। একা মানে উনি আর কাজের লোকজন। জেঠিমা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। আমি শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে থাকতাম। একদিন নিজে থেকেই বললেন, বউমাকে নিয়ে তুই এখানেই চলে আয়। এত বড় বাড়ি, ফাঁকা পড়ে আছে। আমরা তবু আসতে চাইনি। শেষে খুব জোরজার করাতে বউ—ছেলে নিয়ে চলে আসি। সেও প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। আমার ছেলে তো দাদাইয়ের খুব ন্যাওটা।…উঃ, কিছুই বুঝতে পারছি না। মহিমা বলছে…’
‘কুল ডাউন মিস্টার সান্যাল। আপনি বললেন, দরজা ভেঙে ঢুকেছেন। দ্যাট মিনস, কালকে রাতে আপনারা এ বাড়িতে ছিলেন না?’
‘না। অ্যানুয়ালের পরে ছেলের ছুটি। মামার বাড়ি যাওয়ার বায়না করছিল। তাই পাঁচদিন হল, বউ—ছেলেকে হাতিবাগানে শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছি। কাল রাতে আমায় শাশুড়ি মা খেতে ডেকেছিলেন। তাই আমিও সেখানে যাই। হঠাৎ ভোর ছ’টা নাগাদ সন্ধ্যা ফোন করে জানাল, দরজা বন্ধ। কলিংবেল বাজিয়ে, ধাক্কাতেও জ্যাঠাবাবু সাড়া দিচ্ছেন না। তখন এক কাপড়ে ছুটে আসি।’
‘ওকে। সন্ধ্যা কি কাজের মহিলা?’
‘হ্যাঁ। রাত দিন থাকে। কাল ওর ছেলের শরীর খারাপ খবর পেয়ে রাতটুকুর জন্যে গেছিল। জ্যাঠাবাবু নিজেই ওকে ছুটি দিয়েছিলেন।’
‘অন্য কাজের লোকজন? একা সন্ধ্যাই বাড়ির সব কাজ করত?’
‘না। একমাত্র সন্ধ্যা রাতদিন থাকত। আমরা এ বাড়িতে আসার পর থেকে অন্যরা পার্ট টাইম। কেউ রান্না, কেউ ঘরদোর সাফ, বাসন মাজা, বাজারঘাট…ফ্যামিলির দিকটা আমার স্ত্রী দেখতেন।’
‘হুম! তার মানে কাল মহীতোষবাবু একাই ছিলেন?’
‘জাস্ট রাতটুকু। আমি সাতটা নাগাদ জ্যাঠাবাবুকে বলে বেরিয়েছি। সন্ধ্যা বলল, ও গেছে আটটা নাগাদ।’
‘আপনার বাবা কোথায় থাকেন?’
‘বাবা!…আমার বাবা—মা কেউ নেই মিস্টার কুমার। বাবা দশ বছর হল গত হয়েছেন। মা গেছেন আমায় জন্ম দিতে গিয়ে।’
‘সো স্যাড। কী হয়েছিল বাবার?’
‘কিছু হয়নি। হি কমিটেড সুইসাইড। তখন আমি জাস্ট এম.এ. পাশ করেছি।’
টুং—টুং। কলিংবেল বাজল।
‘আসুন ডাক্তারকাকু।’
‘হঠাৎ কী হল প্রিয়তোষ? আমি তো স্তম্ভিত! লাস্ট উইকেও মহীতোষদার সব চেক আপ হল। হি ওয়াজ অ্যাবসলিউটলি পারফেক্ট! ইনি?’
‘লালবাজার থেকে।’
‘নমস্কার ডক্টর। আমায় তদন্ত করতে জয়েন্ট কমিশনার সায়েব পাঠিয়েছেন। মহীতোষবাবুর সব ঠিক ছিল, বলছেন?’
‘হ্যাঁ অফিসার। জাস্ট হার্টটা একটু—’
‘কী?’
‘একটু উইক। অবশ্য সে বরাবরই। বাইরের থেকে মানুষটা খুব কড়া, রাশভারী। কিন্তু ভেতরে—ভেতরে একটু ভিতু।’
‘ভিতু!’
‘ওই আর কী! ভূতের ভয় ছিল। আমার সঙ্গে অনেকদিনের সম্পর্ক, তাই নানারকম কথা হত। আবার পরলোকতত্ত্ব, আত্মা—টাত্মা, ভৌতিক—থ্রিলার এসব বই খুব পড়তেনও।’
‘পিকিউলিয়র।’
‘হ্যাঁ অফিসার।…চলো প্রিয়তোষ, একবার দেখে আসি ওনাকে। আপনিও চলুন। ভেরি স্যাড।…ভালো কথা, মহিমাকে খবর দিয়েছ?’
‘দিয়েছি। ও আসছে বলল। না আসা পর্যন্ত বডি পিস হেভেনে রাখতে হবে।’
‘সে তো নিশ্চয়ই।…হুঁ! বডিতে রাইগর মর্টিস সেট ইন করেছে। মানে মৃত্যুটা হয়েছে কাল বারোটা—সাড়ে বারোটা নাগাদ।’
‘আর?’
‘ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে অফিসার। সাডেনলি!’
‘সাডেনলি কেন?’
‘কারণ আমার ডাক্তারি চোখ বলছে, মৃত্যুর আগে কোনও কারণে খুব ভয় পেয়েছেন। চোখদুটো খোলা। ডানহাত বুকের বাঁ দিকে।’
‘বিছানাটা দেখুন ডক্টর! এলোমেলো। জায়গায়—জায়গায় ভিজে গেছে।’
‘আতঙ্কে নিশ্চয়ই ঘাম বেরিয়েছিল।’
‘ডক্টর, নিচের দিকটা দেখেছেন? পাজামাটা ভিজে।’
‘দেখেছি অফিসার। সাডেন অ্যাটাকে অনেকসময় ইউরিন বা স্টুল বেরিয়ে আসে।…আচ্ছা, আমি কি ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে পারি?’
‘হ্যাঁ ডক্টর। আপনার ফাইন্ডিংস লিখে দিয়ে যান। বাই এনি চান্স, এখন তো ক্রিমেশন হচ্ছে না। ন্যাচারালি কোনও তাড়া নেই। ম্যাডাম আসুন, তারপর ডিসিশন নেওয়া যাবে। প্রিয়তোষবাবু! একটু কাছে আসুন তো।’
‘মানে! কেন?’
‘গন্ধ! কাম! কাম! কাল রাতে কী করছিলেন?’
‘ওই মানে…শালাদের সঙ্গে একটু আড্ডা, তার সঙ্গে…ইয়ে…’
‘কখন?’
‘রাত দশটা নাগাদ।’
‘তারপরে আর বেরোননি?’
‘না—না। ডিনার সেরে ওখানেই শুয়ে পড়ি।’
‘গুড। বাথরুমটা কোথায়?’
‘এই তো। পাশেই।’
‘খুলুন। লাইটটা জ্বালুন।…হুঁ…উঁ…ওকে, ওকে।’
‘অফিসার, আমি কি এবার যেতে পারি?’
‘জাস্ট একমিনিট। আপনার নাম্বারটা নেব। আচ্ছা, ডক্টর এটা খেয়াল করেছেন? বেডসাইড ফোনের রিসিভার নিচে ঝুলছে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো!’
‘এর মানে কী বলুন তো? মৃত্যুর ঠিক আগে মহীতোষবাবু কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।…যাই হোক, যা দেখার আপাতত কমপ্লিট। ওসি এলেই আমরা বেরিয়ে যাব। বাড়ি সিল করে পুলিশ ওয়াচিং থাকবে মহিমা ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত। প্রিয়তোষবাবু, আপনার আর ডাক্তারসায়েবের নাম্বারটা নেব।’
‘কিন্তু জ্যাঠাবাবুর বডি…?’
‘ওটা আর আপনার হেডেক নয়। বডি আমাদের কাস্টডিতে থাকবে।…আপনাদের সন্ধ্যা কোথায়?’
‘এখানেই আছে। ও খুব ভেঙে পড়েছে। সারাদিন ও—ই তো মানুষটার সেবা করত।…সন্ধ্যা! এদিকে এসো।’
‘ওকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। না—না—না, নিশ্চিন্ত থাকুন প্রিয়তোষবাবু। ওর ওপর কোনও টর্চার করা হবে না।’
.
‘এসো কিরণ। উই আর ওয়েটিং ফর য়ু। উইদিন আ ডে, য়ু হ্যাভ ব্রেক থ্রু দ্য ক্রাইম, ডান আ গ্রেট জব।’
‘থ্যাঙ্ক য়ু স্যার। অল ক্রেডিট গোস টু য়ু স্যার। আপনিই আমায় ওখানে পাঠিয়েছিলেন।’
‘না কিরণ। বরঞ্চ মহিমাকে কিছুটা ক্রেডিট দেওয়া যায়। বিকস ও আমাকে অত ভোরে ফোন করে বারবার রিকোয়েস্ট করেছিল। আই ডিডন্ট বিলিভ। কিন্তু আফটার অল ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বেটার হাফ। আমি ওর রিকোয়েস্ট রাখতে বাধ্য হই।’
‘রাইট স্যর। ম্যাডামের কাছে আমরা গ্রেটফুল। নইলে সত্যিটা কোনওদিন প্রকাশ পেত না।’
‘ইয়েস কিরণ।…স্টার্ট করো।’
‘ডক্টর মিত্র, সবচেয়ে আগে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনার কথা থেকে আমি প্রথম ক্লু পেয়েছি।’
‘তাই?’
‘ইয়েস। মনে করে দেখুন ডক্টর, কাল আপনি বলে ছিলেন, মহীতোষবাবু বাইরে কড়া। আসলে ভিতু মানুষ। পার্টিকুলারলি ওনার ভূতে খুব ভয়। ভূত বিশ্বাস করেন, তাই ভয় পান, আবার ভূতপ্রেত নিয়ে চর্চা করেন। এরপর মহীতোষবাবুর চোখ—খোলা ডেডবডি দেখে আপনার ফার্স্ট রিঅ্যাকশন ছিল, মৃত্যুর আগে উনি ব্যাপক ভয় পেয়েছেন।’
‘হুঁ।’
‘তখনই আমার মনে হল, মহীতোষবাবু ভয় পাবেন কেন? কেউ কি ভূত সেজে এসেছিল? মেন গেট বন্ধ। পসিবল নয়। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, ল্যান্ডফোনের রিসিভারটা ঝুলে আছে। অর্থাৎ একটা ফোন এসেছিল…এবং কথা বলার পরে মহীতোষবাবুর ফোন ধরে রাখার কন্ডিশন ছিল না। সে ফোন কার বলুন তো?’
‘কার?’
‘মহীতোষবাবুর ছোটভাই মনোতোষের। যিনি দশ বছর আগে ইহলোক ত্যাগ করেন।’
‘ওয়াট! আমার ছোটকাকা! কী বলছেন?’
‘ঠিকই বলছি ম্যাডাম। আপনার মৃত ছোটকাকা তো ফোনটা করেননি। করেছিলেন প্রিয়তোষ। বাবার গলা নকল করে, ডিসটর্টেড ভয়েস—এ। জ্যাঠাকে ভয় দেখাতে। ঠিক তার আগেই উনি বাড়ির মেন সুইচ অফ করে দেন। পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়।…কাল সকালে আমি যখন আচমকা পৌঁছ যাই, তখনও বাড়িটায় ইলেকট্রিসিটি ছিল না। সকালবেলা, শীতকাল। ফ্যান বা এসির দরকার নেই। পুরো বাড়ি থেকে সকলকে বের করে যখন আমরা দখল নিই, তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়।’
‘ওয়ান মিনিট কিরণ। হাও ইস ইট পসিবল? সাপ্লাই লাইনের মেইন সুইচ, মিটার সব তো বাড়ির মধ্যেই থাকে!’
‘না চম্পকদা। মিস্টার কুমারের ইনফর্মেশন কারেক্ট। নর্থ ক্যালকাটার পুরনো বাড়িগুলো সব গায়ে—গায়ে জোড়া। অন্ধকার সরু কমন প্যাসেজে মিটার—বক্স, মেন—সুইচ সেই মান্ধাতার আমল থেকে আছে। পরে সিইএসসিকে চিঠি দিয়ে অনেকে মিটারের প্লেসমেন্ট চেঞ্জ করে নিয়েছে। বাবা করেননি। একটু গেঁতো ছিলেন।…কিন্তু মিস্টার কুমার, আমার দুটো প্রশ্ন আছে।’
‘বলুন ম্যাডাম।’
‘প্রথমত, প্রিয়দাই যে ফোনে ছোটকাকা হয়ে ভয় দেখিয়েছে, এভিডেন্স কী? সেকেন্ডলি, সে—ই যে মেন সুইচ অফ করেছে, তার প্রুফ?’
‘ফোনের প্রুফ কালকেই বি.এস.এন.এল. থেকে কালেক্ট করেছি। ওটাই ছিল লাস্ট কল। নেক্সট কল না আসা পর্যন্ত কথাগুলো রেকর্ডেড থাকে। ফোনটা এসেছিল কোনও মোবাইল থেকে। ব্যাঙ্গালোরের সিম। অরিজিন্যাল মালিককে পাওয়া যায়নি।’
‘দ্বিতীয়টা?’
‘দ্বিতীয়টা সিসি টিভির ফুটেজ দেখে। তাছাড়া মেন সুইচে প্রিয়তোষবাবুর ফিঙ্গারপ্রিন্টও পাওয়া গেছে।’
‘সিসি টিভির ফুটেজ বলতে?’
‘রিসেন্টলি কলকাতা পুলিশ প্রায় সব মাঝারি স্ট্রিট আর বড় রাস্তায় সিসি টিভি বসিয়েছে। হেরম্ব দাস লেন গলির মুখের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, প্রিয়তোষবাবু রাত ১১—৫৫ পর্যন্ত আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা থেকে বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে বেশ কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করেছেন। অথচ আমায় বলেছিলেন, উনি নাকি সাড়ে দশটায় শুয়ে পড়েছিলেন। অথচ শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলল, পরশু রাতে উনি সেখানে আদৌ যাননি।’
‘আনবিলিভেবল! প্রিয়তোষ যেভাবে জ্যাঠার দেখভাল করত, নাহ! মেলাতে পারছি না।’
‘আমিও প্রথমে পারিনি। কাল দুপুরে আপনার কাছ থেকে ওদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানার পরে ক্রিমিনোলজি বইগুলো ঘেঁটেছি। এরকম ইনসট্যান্স আছে ডক্টর। এনি ওয়ে ওনার মোটিভ প্রসঙ্গে সব শেষে আসছি ডক্টর। তার আগে প্রিয়তোষের টোটাল প্ল্যানটা বলে নিই।’
‘ওকে কিরণ।’
‘থ্যাঙ্কয়ু স্যার। প্রিয়তোষবাবু ফোন, আলো নেভানো ছাড়াও আরেকটা ইনোভেটিভ প্ল্যান সাজিয়েছিলেন। ভেরি ইন্টারেস্টিং। সেটা কাজের মেয়ে সন্ধ্যাকে একতাড়া নোট ঘুষ দিয়ে। সন্ধ্যা কিন্তু বোঝেনি। মহীতোষবাবুর বেডরুমের ঠিক বাইরে বেশ বড় বাথরুম। তার এককোণে ওয়াশিং মেশিন। লেটেস্ট মডেল, পুরোটাই কম্প্যুটারাইজড। ঠিকঠাক টাইমার সেট করে, কাপড়জামা ঢুকিয়ে দিলে মেশিন নিজে—নিজেই জল নেয়, কাচাকুচি করে, জল বের করে দেয়, আবার জল নেয়, ধোয়, জল বের করে। টাইম ফুরনো না পর্যন্ত এই প্রসেস চলতেই থাকে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার বাড়িতেও স্ত্রী কিনেছে। দারুণ ব্যাপার!’
‘রাইট ডক্টর। কিন্তু আপনি মিসেসের কাচাকুচির সময় কখনও থেকেছেন কি?’
‘কী করে থাকব! আমি তো সকালেই বেরিয়ে যাই।’
‘মহীতোষবাবুও কখনও থাকেননি। উনিও সকালে অফিস বেরিয়ে যেতেন। দুপুরে সন্ধ্যা কাচাকুচি করে। তাই জানতেন না, কাচার সময় রেগুলার ইন্টারভ্যালে মেশিনের ভিতর থেকে ‘খটাখট’ শব্দ হয়! তারপর জল বেরোনোর কলকল…তারপর শিস—এর শব্দ…কিছু বুঝলেন?’
‘নাহ!’
‘ইমাজিন করুন। আলো নিভল, ভৌতিক ফোন করল মৃত ভাই, তারপর নিঝঝুম বাড়িতে ওইরকম বিকট শব্দ…জল পড়ছে…! কী ঘটবে মহীতোষবাবুর?’
‘মাই গড! কী বলছ কিরণ! ওয়াশিং মেশিনে টাইমার সেট করে কাপড়জামা ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল?’
‘ইয়েস স্যার। সন্ধ্যাকে দিয়ে প্রিয়তোষ এই কাজটা করিয়েছেন। টাইম সেট করা ছিল রাত বারোটা!’
‘তুমি বুঝলে কী করে?’
‘স্যর, মেশিনের মোটা পাইপ দিয়ে ওই সকালেও জল সিপ করছিল। নর্দমার মুখটা ভিজে। সেকেন্ড টাইম চেক করতে গিয়ে সব ক্লিয়ার হয়ে গেল স্যার।’
‘গ্রেট! গ্রেট কিরণ! উই আর রিয়্যালি প্রাউড অব য়ু।’
‘আই’ম অলওয়েস অ্যাট ইওর সার্ভিস স্যার।’
‘এবার ইন ব্রিফ বলো তো, প্রিয়তোষের মোটিভ কী ছিল? যাকে এতদিন এত যত্ন করে দেখাশোনা করল, তার বিজনেস সুপারভাইস করল, তাকেই এভাবে সরিয়ে দিতে গেল কেন?’
‘স্যর, একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘প্রিয়তোষবাবুর মোটিভ ম্যাডাম সব জানেন স্যর। নইলে খুড়তুতো দাদার কাছে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েই আপনাকে ফোন করতেন না। আমি স্যার, ওনাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি জেনেছি ডক্টর মিত্রর কাছ থেকে।’
‘মহিমা! বলবে?’
‘আমি?…আ—চ্ছা। ইটস আ স্যাড স্টোরি। চম্পকদা, আমার বাবা মানুষটা কিন্তু খারাপ ছিলেন না।’
‘না—না। তা কেন হবে? বলো, বলো। আমরা বিশ্বাস করব।’
‘চম্পকদা, বাবা ছিলেন একটু অদ্ভুত স্বভাবের। একদিকে স্নেহপ্রবণ, অন্যদিকে প্রচণ্ড রাশভারী। তেমনি ভয়ানক রগচটা। রেগে গেলে কোনও জ্ঞান থাকত না। যে—ই হোক, যা মুখে আসত, বলে দিতেন! একটা টাকাও বাজে খরচ করতেন না, অন্য কেউ করলে তার আর রক্ষে নেই। বাবা তাকে ধুয়ে দিতেন।’
‘আ—চ্ছা।’
‘কাকিমাকে আমি দেখিনি। তারপর মা—ও হঠাৎ চলে গেলেন। বাবা লাগামছাড়া বদরাগী হয়ে উঠলেন। একেবারে হিটলার হয়ে গেলেন। তখন বাবা—কাকা আর আমরা দুজন। আমাদের ব্যবসায় বাবা সোল প্রোপ্রাইটার। কিন্তু কাকা অংশীদার না হলেও ছিলেন মালিকের মতো। কারণ ভাইকে অসম্ভব ভালোবাসতেন বাবা। এরকম একটা সময়ে, বোধহয় বছর আট—নয় আগে, বাবার সঙ্গে কাকার একদিন মতান্তর হল। ব্যবসায় কোনও একটা লোকসান নিয়ে বাবা সকলের সামনে কাকাকে অকথ্য গালাগালি করলেন। কাকা নিতে পারেননি। সেই রাতে কাকা অপমানে সুইসাইড করলেন।’
‘সে কী!’
‘হ্যাঁ চম্পকদা। প্রিয়দা কাঁদতে—কাঁদতে মামাবাড়ি চলে গেল।…কিছুদিন পরে অবশ্য বাবা নিজে গিয়ে প্রিয়দাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এল। প্রিয়দা তবু এ বাড়িতে থাকল না। তবে বাবার অনুনয়—উপরোধে ব্যবসা দেখতে শুরু করল।’
‘তারপর?’
‘আমার বিয়ে হয়ে গেল। একসময় আমেরিকাও চলে গেলাম। বাবার বয়স বাড়ছে। আবার খ্যাপামি বাড়তে শুরু করল। যখন—তখন গালাগালি করে প্রিয়দাকে। দাদা গুম খেয়ে রাতে ফোন করে আমায়। আমি ফোন করে দাদাকে বোঝাই। রাগ কমে গেলে বাবা আবার অন্য মানুষ। ভাইপোর হাত জড়িয়ে দুঃখপ্রকাশ করে। এরমধ্যেই বাবা ধুমধাম করে ওর বিয়ে দিয়েছে।’
‘তারপর?’
‘বাবা অনেক অনুনয়—উপরোধ করে দাদা—বউদিকে পার্মানেন্টলি এ বাড়িতে থাকার জন্য নিয়ে এল।…তাতে সমস্যা কিন্তু বাড়ল। চম্পকদা, বউয়ের সামনে অপমান সহ্য করা খুব কঠিন।’
‘রিসেন্টলি এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল?’
‘হ্যাঁ চম্পকদা।…দিন চারেক আগে। প্রিয়দা বউদি—ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওঠে। বাবা অনেকবার ওকে বুঝিয়েছে, নিজের দোষ স্বীকার করেছে, প্রিয়দা ফেরেনি। কিন্তু অফিসে ঠিক আসত। বাড়িতে এসে বাবাকে দেখাশোনা করে রাতে চলে যেত। আসলে বাইরের লোককে বুঝতে দিত না। প্রতি রাতে এই নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হত। আমার ধারণা, প্রিয়দা সেই সময়েই প্রতিশোধের ডিসিশন নিয়ে ফেলে।’
‘ওঃ!’
‘প্রিয়দা স্যালারি পেত। বাবা ওকে পার্টনার করেনি। কিন্তু আমায় বলেছিল, গোটা ব্যবসাটা প্রিয়দার নামেই উইল করেছে। সম্পত্তিরও ফিফটি পার্সেন্ট ওকেই দিয়েছে। কিন্তু প্রিয়দা তো এসব কিছুই জানে না। তাই—’
‘হ্যাঁ মহিমা। বাবার মানে তোমার ছোটকাকার সুইসাইডের ঘটনাই বা প্রিয়তোষ ভোলে কী করে?’
‘ঠিক বলেছেন চম্পকদা। প্রিয়দাকে আমি খুনি ভাবতে পারছি না।’