দুই পৃথিবী – বিনোদ ঘোষাল

দুই পৃথিবী – বিনোদ ঘোষাল

তুমি একজন উন্মাদ। তোমার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই। একটু আগে অর্চি আমাকে এই কথাগুলো বলে গেল। বলার সময় ও অনেক বড় করে হাঁ করছিল। ওর অন্ধকার মুখের ভেতর দিয়ে খসখসে জিভ আর আলজিভটা থিরথির করে নড়তে দেখছিলাম আমি। একটা অদ্ভুত দৃশ্যকল্প। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ভুলে গেছিলাম অর্চি আসলে কী বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছে। ওর চিৎকারগুলো বহু দূর থেকে হাওয়াতে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছতে শুরু করছিল আমার কাছে। টুকরো টুকরো ভাঙা কথা। তার মধ্যে ‘মাকে খুন…মাকে খুন’, শব্দ দুটো বেশ কয়েকবার ছিল। আমি আন্দাজ করছিলাম অর্চি আবার ওর মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু একটা বলছে। বুলার মৃত্যু আমার কাছেও খুব বেদনার তা কি অর্চি জানে? এমনকী আমার নিজের মৃত্যুও যথেষ্ট যন্ত্রণার, তা-ও জানে না কেউ।

আজ আমি মরে যাব। কারণ? মরে যাওয়ার জন্য কোনো যথেষ্ট কারণ লাগে বলে আমি মনে করি না। আমার আজকের পর থেকে আর কোনো কাজ নেই, সুতরাং আমি মরে যেতেই পারি। আর একমাত্র মৃত মানুষদের হাতেই কোনো কাজ থাকে না।

অর্চি আমার ছেলে। উনিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর। আমার সঙ্গেই থাকে। কেন থাকে কে জানে? হয়তো চাকরি কিংবা বিয়ে কিছু একটা করার পরদিন থেকে আর থাকবে না। থাকা সম্ভবও না। এই দুটো ঘরের মধ্যে এত বছর ধরে এত মানুষ এসে দিনের পর দিন থাকে যে, যে-কারওরই মেনে নেওয়া কঠিন। আমি নিজেই হাঁফিয়ে উঠি একেক সময়। ঘরে হাঁটাচলা করতে গিয়ে ধাক্কা লাগে পরস্পরের সঙ্গে। আমি নিজের চোখে দেখি সেসব দৃশ্য। বুলা বিরক্ত হত খুব। একসময় বিরক্তিটা মাত্রা ছাড়াতে শুরু করল। তারপর একদিন অরণ্য নিজে হাতে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করল বুলাকে। আমি নিজে চোখে দেখলাম বুলা ঘুমোচ্ছিল সেইরাত্রে বিছানায়। আমি টেবিলে বসেছিলাম। অরণ্য বেরিয়ে এসে বালিশ নিয়ে বুলার মুখে চেপে ধরল। বুলা দু-হাত ছড়িয়ে তীব্র ছটফট করছিল, হাত বাড়িয়ে বোধহয় আমাকে খুঁজছিল বাঁচার জন্য। কিন্তু ওকে বাঁচাতে যেতে পারিনি। কারণ আমি তখন চেয়ারে বসেছিলাম। কিন্তু সত্যি আমার সেদিন বড় কষ্ট হচ্ছিল। আমি বারবার নিজের চোখের জল মুছছিলাম। কিন্তু অরণ্যর হাত থেকে বুলাকে বাঁচাতে পারিনি, কারণ আমি তো চেয়ারে বসেছিলাম। আমার প্রিয় টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায়।

আমার চোখের সামনে বুলা চলে গেল। তবে খুব বেশি কষ্ট পায়নি। মিনিট খানেক। বড় ভালো ছিল বুলা। আমাকে ভালোবাসত খুব একসময়। সেই বিয়ের কত আগে থেকে। কিন্তু অরণ্য ওকে একটুও সহ্য করতে পারত না। মেরেই ফেলল। আমার চোখের সামনে। খুন করে আবার ঢুকে গেল।

আমার মনে আছে পরের দিন পুলিশ এসে শুধু আমাকে জেরা করছিল। অরণ্যকে কেউ খোঁজেনি। আমার আশ্চর্য লাগছিল। অ্যারেস্ট হওয়া উচিত ছিল অরণ্যর। হলাম আমি। যখন থানায় যাচ্ছি আমি পিছন ফিরে দেখি আমার টেবিলের এককোণে দাঁড়িয়ে অরণ্য মিটিমিটি হাসছে। বুলাকে খুন করে একটুও লজ্জা নেই ওর।

অবশ্য আমি ছাড়া পেয়ে গেলাম। বেকসুর। বুলা নাকি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরেনি। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছিল। হাই প্রেশার ছিল বুলার। বছর খানেক আগে একটা সিভিয়র অ্যাটাকও হয়েছিল। আমার খুব অবাক লেগেছিল পুলিশ খবর পেল কী করে? পরে বুঝেছি, পুলিশে খবর দিয়েছিল অর্চি। আমার একমাত্র ছেলে অর্চিস্মান। নিজে ছেলে হয়ে বাপকে খুনের আসামি কেন ভেবে বসল কে জানে! ভেবেছিল ওর মা, মানে বুলাকে, আমি খুন করেছি। কেন করব আমি? কারণ কী?

যাই হোক। বুলা চলে যাওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম অর্চিও চলে যাবে বাড়ি ছেড়ে। গেল না। গেলে ভালোই হত। দুটো মাত্র ঘর। এতগুলো লোক-বাচ্চাকাচ্চা এই দুটো ঘরে কখনও আঁটে? আর মানুষগুলো তো কেউ ঘর ছেড়ে যায় না কোথাও। সামনের দোকানটাতেও যায় না, আমি না বললে, খুব বাধ্য। যখন বলি কথা বলতে, বলে। যখন বলি হাঁটতে, হাঁটে। আদর করতে নির্দেশ দিলে আদর করে। আর যদি বলি কাউকে…।

এই তো অরণ্য, বিদিশা, তপন, পুষ্পল, নীল, স্বর্ণালি, মিঃ সেন, দাশবাবু, নীহারুল, বিক্রম এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন প্রায় আড়াই বছর ধরে আমার বাড়িতে রয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অরণ্য, বিদিশা, নীল আর স্বর্ণালীর সঙ্গেই আমার কথা হয় বেশি। বাকিদের সঙ্গে অনেক কম। কয়েকজনকে তো ভুলেই গেছিলাম আমি। তবু ওরা সবাই মিলে এই দুটো ঘরেই থাকত। ওরা যে আসবে এবং থাকবে অনেকদিন সে কথা কিন্তু আমি আগেই বুলা আর অর্চিকে জানিয়েছিলাম। শুনে বুলা শুধু ‘হুম’ বলেছিল। আর কিছু বলেনি। আর অর্চি এবারেও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাও তো?

বাড়িতে লোক আসার সঙ্গে ওষুধ খাওয়ার সম্পর্ক কী? আর এ তো প্রথমবার নয়। এর আগেও অনেকবার এসেছে, নতুন নতুন মানুষ। আমাদের সঙ্গে কেউ মাসের পর মাস, কেউ বছরের পর বছর, কাটিয়েছে। বুলা এ সব জানত। কারণ বিয়ের আগেই আমি ওকে জানিয়েছিলাম এইসব কথা। ও সব শুনে শুধু হেসে বলেছিল, আসুক না। কোনো অসুবিধা নেই। শুধু তোমার আর আমার মাঝখানে না শুলেই হল।

না, কেউ শোয়নি তো! তবু বিয়ের কুড়ি বছর পর কেন যে বুলা হঠাৎ অসহিষ্ণু হতে শুরু করল। আমাকে অসুস্থ ভাবতে শুরু করল। আমি অসুস্থ! কই ঘরের মধ্যে এতগুলো লোক কখনও তো আমাকে সে-কথা বলেনি। কী সম্মান করে আমাকে! এত সম্মান আমাকে আর কেউ করে না।

আমার এই ঘরদুটোর মধ্যে আমি এত বছরে কম কিছু তো দেখিনি। প্রেম-বিরহ-মৃত্যু, বিচ্ছেদ, লোভ-ঘেন্না-ভালোবাসা, অনেক অনেক কিছু। কত সংসার তৈরি হল, ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কত শিশুর জন্ম হয়েছে এই ঘরে। তার কান্নায় আমারা ঘরের দেওয়াল, ছাদ, উঠোন ভরে গেছে। আমার মনে রয়েছে দীপ্তেন আর ঊর্মিমালার মেয়ে হয়েছিল এক শরৎকালের ভোরবেলায়। ওরা তিন বছর ছিল এই ছোট্ট ঘরটায়। বাচ্চাটার যখন জন্ম হচ্ছিল আমি বাইরে, জানলার বাইরে, তাকিয়ে দেখছিলাম, উঠোনে শিউলি গাছটার নীচে ফুলে ভরে গেছে। আমি আনন্দে কাঁদছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল শিশুটাকে একবার ওই ভোরের আলোতে ফুলের মধ্যে শোওয়াতে। ঊর্মিকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ঊর্মি অনুমতি দেয়নি। আমি জোর করিনি। ওরই তো মেয়ে। আমি ওর নাম দিয়েছিলাম উমা। সেই নাম পছন্দ হয়েছিল ঊর্মির।

আরও কত কত ইতিহাস রয়েছে এই ঘরে। আমার এই ঘরদুটোতে। এই তো বছর চারেক আগে অম্লান যখন পুলিশের গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেছিল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার এই ঘরের মেঝে। আমি নিজে হাতে সারা রাত ধরে বালতি বালতি জল ঢেলে সেই রক্ত ধুয়েছি। রক্তের আঁশটে গন্ধে ভরে গেছিল ঘর। মেঝে ধুয়ে আমি যখন উঠে দাঁড়িয়েছি দেখি খাটের এককোণে গুটিয়ে বসে বুলা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। আমাকে দেখে ভীষণ ভয় পাচ্ছিল ও। অর্চিও কখন যেন নিজের ঘর ছেড়ে এ-ঘরের দরজার সামনে এসে আমার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। আমার দিকে কেন? মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা মাওবাদী নেতা অম্লানের দিকে ওরা একেবারের জন্যও কেউ তাকাচ্ছিল না কেনও?

আমাকে ওরা দুজনে মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। আমি গেছিও। ওরা যাতে শান্তি পায় করুক না। শুধু ওষুধগুলো না খেলেই হল। আমি জানি ওই ওষুধগুলো খেলে আমি শুধু ঘুমোব, আর ঘুমোব। আর এই লোকগুলো যারা আমার সঙ্গে মাসের পর মাস বছরের পর বছর থাকে, আমার কথায় ওঠে, বসে, সিগারেট খায় ওরা কেউ আর থাকবে না। আর আমি পারব না ওদের ছেড়ে থাকতে।

বুলা অশান্তি করতে শুরু করেছিল অনেকদিন আগে থেকেই। অর্চি বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ও যেন একটা সাপোর্ট পেয়ে অশান্তিটা আরও বাড়তে থাকছিল। আমি ওদের বেশ কয়েকবার বলেছি অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। শোনেনি। শুধু অশান্তি আর অশান্তি। এবারে যেন সবথেকে বেশি। অরণ্য, বিদিশা, তপন, পুষ্পল, নীল ওরাও বিরক্ত হচ্ছিল বুলা অরা অর্চির ওপর। বিশেষ করে অরণ্য খুব রেগে উঠছিল বুলার ওপর। অরণ্য এমনিতেই খুব রাগী। আমিও যথেষ্ট সমঝে চলি ওকে। অনেক সময়ই আমারও কথা শোনে না ও। নিজের ইচ্ছেমতো চলে। আর আমি অসহায় হয়ে চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকি টেবিলের দিকে।

সেদিন রাত্রে এমনই অশান্ত ছিল অরণ্য। মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল। টলছিল। আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম দিশি মদের। সেদিনই সন্ধেবেলা বুলা আবার আমার সঙ্গে খুব ঝগড়া করল। আমাকে পাগল, ব্যর্থ, অসামাজিক ইত্যাদি আরও অনেক শব্দ বলল। শব্দগুলো পীড়া দিচ্ছিল আমাকে। শরীর খারাপ লাগছিল আমার। মাথার ভেতর ঝনঝন শব্দ হতে শুরু করেছিল। তবু নিজের টেবিল চেয়ার ছেড়ে উঠিনি। আমি বুলার করা সব অপমান সহ্য করে নিয়েছিলাম, কিন্তু অরণ্য পারেনি। আসলে ওরা কেউ কোনোদিনই আমার লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারে না। আমি স্পষ্ট দেখলাম মাঝরাতে অরণ্য বেরিয়ে এল। বুলাকে খুন করে আবার ঢুকে গেল।

জানি কেউ বিশ্বাস করবে না এসব কথা। এই যেমন আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অর্চির ব্যবহারে বেশ কিছুদিন ধরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হচ্ছে বিদিশা। আমাকে বারবার বলছে, তুমি একজন প্রতিভা। কেন এত অপমান সহ্য করছ মুখ বুজে? ওকে সরিয়ে দাও। ও তোমাকে পছন্দ করে না।

আমি জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমার কাছে থাকে কেন?

থাকে কারণ ওর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এই মুহূর্তে।

কেন, ওর মা-র কাছে গিয়েই তো থাকতে পারে!

আমার এমন কথায় সামান্য ঠোঁট হেলিয়ে হাসে বিদিশা। সেই হাসিতে ওর ভরা শরীর সামান্য কেঁপে ওঠে। আমার সামনে ঘন হয়ে এসে বলে, বেশ তো, তাহলে ওর মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দাও ওকে। ওখানেই থাকুক। আমি বিদিশার মুখের ভেতর থেকে এলাচের গন্ধ পাই। ওকে এলাচ খাওয়া আমিই অভ্যাস করিয়েছি। বিদিশার কাঁধে হাত রাখি আমি। গত আড়াই বছর ধরে একটু একটু করে ওকে গড়ে তুলেছি আমি। নিজের মনের মতো করে। ও আমার সামনেই স্নান করে, শাড়ি পড়ে, চুল আঁচড়ায়। এতটুকু লজ্জা পায় না। শুধু ও কেন, এই ঘরে বছরের পর বছর ধরে যে ওরা থাকে, ঘোরে ফেরে খায়, ঘুমোয় তারা কেউ কোনোকিছু করতেই লজ্জা পায় না আমার সামনে। ওদের আগে যারা থেকেছে তারাও পায়নি কোনোদিন। কারণ ওরা পুরোটাই আমার। একমাত্র আমার। ওদের প্রতিটা নিঃশ্বাসে শুধুমাত্র আমার অধিকার। আমি ঠিক করি ওরা কতদিন কতক্ষণ কীভাবে নিঃস্বাস ফেলবে। আমার হুকুম ছাড়া ওরা কিচ্ছু করতে পারে না। অথচ এই ঘরের মধ্যেই বুলা আমাকে অস্বীকার করত। আমাকে উন্মাদ বলত, অপদার্থ বলত। আমাকে ওদের সামনে যখন-তখন অপমান করত। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখত ওদের ঈশ্বর তার স্ত্রী, পুত্রের কাছে দিনের পর দিন লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাই একদিন রাত্রে আমার অরণ্য, যাকে আমি সব থেকে ভালোবাসি, বুলাকে আমারই সামনে খুন করল। আমি তখন লিখছিলাম। লিখছিলাম, অরণ্য হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঝুঁকে দেখল একবার। তারপর আচমকা বালিশটা ঠেসে ধরল ওর মুখে…।

ইদানীং অর্চিও একেবারে সহ্য করতে পারছে না আমাকে। একেবারে ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। বিদিশা আমাকে বারবার বলে আমি কোনোদিন অর্চিকে কিছু একটা করে ফেলব। আমি সামলে রাখি বিদিশাকে। কতদিন পারব এভাবে জানি না।

.

অর্চিও এভাবে চলে যাবে আমি ভাবতে পারিনি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আমি প্রাণপণ বিদিশাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি যাতে অর্চিকে আজ রাত্রে ও খাবার না বেড়ে দেয়। আমি জানতাম কিছু একটা ঘটবে। ঠিক তাই ঘটল। রুটি, তরকারি, ডাল ডাইনিং টেবিলে বেড়ে দিল বিদিশা। আর ডাল তরকারির মধ্যে মিশিয়ে দিল বিষ। তীব্র বিষ। খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছটফট করতে করতে ওই টেবিলের মধ্যেই মাথা গুঁজে পড়ে রইল অর্চি। বিদিশা হাসছিল। এমনভাবে অর্চির শরীরটার দিকে তাকিয়ে হাসছিল যেন বহুদিন পর ও জিতে গেছে। আমার কান্না পাচ্ছিল খুব। আমার একমাত্র ছেলে আমারই সামনে মৃত পড়ে রয়েছে। আর আমি অসহায়, কিচ্ছু করতে পারছি না। ক্রমাগত আমাকে লিখে চলতে হচ্ছে, ‘অর্চির শরীরটাকে দু-হাতে কয়েকবার নেড়ে দেখল বিদিশা। কোনো সাড়া নেই। নিশ্চিন্ত হল। অর্চির চোখদুটো বিস্ফারিত। ভীষণ ভয়।’ বিদিশা আমাকে ক্রমাগত বলে চলেছে, এবার লিখুন, নিজের একমাত্র সন্তানকে নিজেরই চোখের সামনে খুন হতে দেখলে কোন পিতা নিজেকে ঠিক রাখতে পারে? আর আমি লিখছি, লিখেই চলেছি। ঠিক যেভাবে আমাকে লিখতে হয়েছিল ‘অরণ্য হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঝুঁকে দেখল একবার। তারপর আচমকা বালিশটা ঠেসে ধরল বুলার মুখে…।’

তপন, পুষ্পল, নীল, স্বর্ণালি, মিঃ সেন, দাশবাবু, নীহারুল, বিক্রম আরও সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্চিকে। ওরা কেউ শোকার্ত, কেউ আনন্দিত। আজ ওরাও চলে যাবে আমাকে ছেড়ে। একটু পরেই। শেষ হবে আমার আঠেরোতম উপন্যাস। আমি আর লিখব না। নিজের স্ত্রী-পুত্র সবাই ছেড়ে গেছে আমাকে এদের জন্য। ওদের দুজনকে খুন করেছে ওরা। আর না। বুলা আমাকে বলত আমি একজন ব্যর্থ লেখক। আমার সতেরোটা উপন্যাসের একটাও বিক্রি হয়নি, কোনো পুরস্কার পায়নি। আমি বুলার রোজগারের টাকায় বই করি। কেউ আমাকে পছন্দ করে না। শুধুমাত্র আমার চরিত্ররা আমাকে ভালোবাসে। ওরা আমার সঙ্গে থাকে, খায়, ঘুমোয়, কথা বলে— যতদিন না আমার লেখা শেষ হয়। শেষ হলে আবার নতুনরা আসে। থাকে, খায়…।

লেখাটা শেষ করি ভোর রাত্রে। আর একে একে মিলিয়ে যেতে থাকে অরণ্য, বিদিশা, নীল, মিঃ দাশ সবাই। কষ্টে আমার বুক ছিঁড়ে যেতে থাকে। এতগুলো দিন একসঙ্গে একই ঘরে থাকার পর চলে যাচ্ছে ওরা। আমাকে ছেড়ে। প্রিয়জনকে শ্মশানে দাহ করে স্নান সেরে ফেরার মতো অনুভূতি হতে থাকে আমার। গোটা বুক ফাঁকা হতে হতে একেবারে শূন্য হয়ে যায়।

আর কেউ নেই ওরা। মধ্যরাতের বাজারের মতো খাঁখাঁ করছে ঘরটা। কলম বন্ধ করে পাণ্ডুলিপির ওপর রেখে ক্লান্ত আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়াই চেয়ার ছেড়ে। আর বিছানার দিকে চোখ পড়তেই শিউরে উঠি। বুলা ঘুমোচ্ছে খাটে! জানলা দিয়ে ভোরবেলার আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। তাহলে?…এতদিন কোথায় ছিল বুলা? আমি পা ঘসে ঘসে হ্যাচোর-প্যাচোর করতে করতে পাশে অর্চির ঘরে যাই, দেখি ও-ও ঘুমোচ্ছে, একেবারে ওর মায়ের মতো করে। তাহলে…!

আমি ফিরে আসি আবার নিজের ঘরে। খুব সাবধানে বুলার পাশে এসে গুটিয়ে শুই। ওর মুখের দিকে তাকাই। বড় সুন্দর লাগে ওর মুখটা। ভালো লাগে ওকে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। টেবিলে ড্রয়ারে যে বিষের শিশিটা রাখা রয়েছে সেটার কথা মনে পড়ে। আমি আবার উঠতে যাই, কিন্তু ঠিক তক্ষুনি খুব আবছা একটা মুখ চোখের সামনে দুলতে শুরু করে। ভোরবেলার মতো নিষ্পাপ কিশোরী মুখ। আমি ওর নাম দিয়ে ফেলি লাজবন্তী। তারপর ভাবতে শুরু করি। ভাবতে থাকি। লাজবন্তী একটু একটু করে আমার কাছে আসতে থাকে। আমার ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *