পালটানো যায় না – জয়দীপ চক্রবর্তী

পালটানো যায় না – জয়দীপ চক্রবর্তী

রঙ্গনদের বুথে পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আসলে ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারেই সময় লেগে গেল অনেকখানি। মালপত্র নেওয়া, মিলিয়ে দেখে পোলিং পার্টির সকলকে একত্র করে পুলিশ ট্যাগিং করা, তারপর লঞ্চ নাম্বার দেখে ঠিকঠাক লঞ্চে চেপে বসা। আবার লঞ্চে চাপলেই তো হল না, ওই লঞ্চে অন্য যেসব বুথের ভোটকর্মীদের যাওয়ার কথা তাঁদের জড়ো হতে হবে। আর সবশেষে নদীর জোয়ার—ভাটার ব্যাপার। লঞ্চ মানুষের মর্জিতে চলে না, সে চলে নদীর স্রোত অনুযায়ী। রঙ্গনরা ভোটকর্মী পাঁচজন, সঙ্গে চারজন পুলিশকর্মী আছেন। বন্দুকধারী। ডি.সি—তে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ডিকোডিং করার সময়েই, ওঁরা বলে দিয়েছিলেন, ‘বুথটা সেনসিটিভ, ট্যাক্টফুলি ম্যানেজ করবেন—’ লঞ্চে আসার সময়ে পুলিশের লোকগুলোও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যাতে অযথা এমন পরিস্থিতি তৈরি না হয় যে তাঁদের লোকাল সব এর সাথে কনফ্রনটেশনে যেতে হয়। রঙ্গনের অবাক লাগছিল। এঁরা পুলিশের লোক, তবু এত ভয়—অন্যায়কে রুখে দেবার মানসিকতা থেকে এঁরাই যদি এতখানি দূরে অবস্থান করেন তাহলে সাধারণ মানুষ কী করবে! চওড়া নদী আর বাণী গাছের সবুজ জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রঙ্গন ভাবছিল অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে করতে ক্রমশ ক্লীব হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর দলে নিজেকে সচেতনভাবে ভেড়াতে পারবে না সে। আইন অনুযায়ী যে দায়িত্ব সব পালন করা উচিত, সে তাই করার চেষ্টা করবে।

ফার্স্ট পোলিং চঞ্চলবাবু প্রৌঢ় মানুষ। অভিজ্ঞ। এর আগে অন্তত চারবার পঞ্চায়েত ইলেকশন করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। কম—বয়সি সদ্য চাকরি পাওয়া রঙ্গনকে প্রথম ট্রেনিং—এর দিন থেকেই অভয় দিয়ে আসছিলেন তিনি। বুথে পৌঁছে কাঁধের ব্যাগ আর ভোটের মালপত্র নামিয়ে রাখল রঙ্গন। বুথ মানে ছোট্ট ছোট্ট দুটো প্লাস্টারবিহীন ইটের ঘর। মেঝে মাটির, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। ঘরে গ্রিল লাগানো জানলা আছে, কিন্তু পাল্লা নেই। এই দু—কামরাঅলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটা ঘরেই কাল ভোট দিতে হবে। ইলেকট্রিক নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ ঢিলেঢালা। ভোটিং কমপার্টমেন্টের গোপনীয়তা নিশ্চিত করাটাই বেশ কঠিন। রঙ্গন ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সামনে বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ, মাঠের ওপারে নদী। নদীর দিক থেকে একটা জোলো জোলো ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে সর্বক্ষণ। স্কুলবাড়ির ডানদিকে মাঠের ওপাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দু—চারটে বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কাঁচাবাড়ি। টালির ছাউনি। বাঁ পাশে মাঠের শেষ থেকে কৃষিজমি শুরু হয়ে গেছে। আগে এ জমিতে ভালো চাষ হত। আয়লার পর থেকে জমিটা নাকি ততখানি ফসল দিচ্ছে না আর। রঙ্গন মাঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। খুব ভালো লাগছিল তার। রুক্ষ, ধূসর স্কুল মাঠটুকু বাদ দিলে চারদিকেই সবুজের কোনো খামতি নেই। নদীর দিক থেকে একটানা এত হাওয়া দিচ্ছে যে গরম মালুমই হচ্ছে না তেমন। চারদিক শান্ত চুপচাপ। একদল কচিকাঁচা ছেলেমেয়ে এসে জুটেছে মাঠে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে হাঁ করে রঙ্গনদের দেখছিল ওরা। একটু আগে একজন পুলিশকর্মী এগিয়ে গিয়ে ‘কী চাই তোদের’ বলে হেঁকে উঠতেই দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালিয়েছিল ওরা, সেই ভদ্রলোক সরে যেতেই গুটি গুটি পায়ে আবার এসে জুটেছে ছেলেমেয়েগুলো। রঙ্গনের বেশ মজা লাগছিল ওদের দেখে। স্কুলবাড়ির পাশেই মাঠের ধুলোর ওপরে অনেকক্ষণ থেকে একটা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। গায়ের মলিন সালোয়ার কামিজে ধুলো মেখে একসা। একদৃষ্টে সে তাকিয়েছিল রঙ্গনের দিকে। মেয়েটি যুবতী। স্বাস্থ্য মন্দ না। তার ওড়নাবিহীন বুকের দিকে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিল রঙ্গন অন্যদিকে। মেয়েটি নির্বিকার। তার চোখে চোখ পড়তে গা শিরশির করে উঠল রঙ্গনের। মেয়েটার চাউনিটা বড় অদ্ভুত। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। চঞ্চলবাবু ঘরের মধ্যে থেকে ডাক দিলেন এই সময়েই, ‘স্যার আসুন, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আলো মরে আসার আগে কাজ যতটা এগিয়ে রাখা যায় ততই ভালো। সাইকেল মেসেঞ্জার একটার বেশি হ্যারিকেন জোগাড় করতে পারবে না বলে দিয়েছে। কাজে কাজেই—’

‘আসছি—”বলে কমবয়সি ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকায় রঙ্গন। গলাটা ইচ্ছে করে দাবী করে বলে, ‘আমরা কাজ করব। তোরা এখন যা। পালা এখান থেকে—’ ছেলেগুলো রঙ্গনের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে একটু তফাতে সরে যায়। চলে যায় না। রঙ্গন মাটিতে বসে থাকা মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব নরম গলায় বলে, ‘আপনি এভাবে বসে আছেন কেন এখানে? আপনি এবার আসুন। এখানে বসে থাকবেন না এভাবে।’ মেয়েটি রঙ্গনের মুখের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। কোনো কথা বলে না। নড়েও না সেখান থেকে।

রঙ্গন আবার বলে, ‘কী হল, উঠুন আপনি—’

মেয়েটা গা দোলাতে দোলাতে খিল খিল করে হেসে ওঠে। সেই হাসিতে কেন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে রঙ্গনের। ছেলের দল দূর থেকে বলে ওঠে, ‘ও এখন আর সহজে কথা কয় না। ও কেবল হাসে আর কখনও কখনও কাঁদে। চৈতিদিদি পাগল হয়ে গেছে—’

মেয়েটা ঘাড় বেঁকিয়ে ছেলেগুলোর দিকে চায়। হাত নেড়ে বলতে থাকে ‘যা: যা:’—তারপর আবার হেসে ওঠে, খিলখিল করে।

চঞ্চলবাবু আবার ডাকেন, ‘স্যার আসুন। সব পেপারে ডিস্টিংগুইশিং মার্ক লাগিয়ে দিচ্ছি। আপনি পেপারগুলোর কমপ্লিট করতে শুরু করুন। অনেক ভাইটাল কাজ পড়ে রয়েছে। সময় নষ্ট করা যাবে না আর—’ মাঠ ছেড়ে স্কুলের মাটির বারান্দায় উঠে এল রঙ্গন। প্লাসটিক বিছিয়ে বসে পড়ল অন্যদের সাথে কাজে শামিল হতে।

সন্ধে গড়ানোর পরে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বুথের ভিতরে ঢুকলেন একজন হোমরা চোমরা গোছের মানুষ। সুঠাম ঋজু চেহারা। পরনে চেক লুঙ্গি এবং শার্ট। হ্যারিকেনের আলোয় একমনে তখন পেপার রেডি করছিল রঙ্গন। প্রথমটা অল্প আলোয় অসুবিধা হচ্ছিল খুব। কাজের গতি কমে যাচ্ছিল ক্রমাগত। এখন এই আলোয় চোখ অনেকটা সেট করে গেছে। কাজ করতে আর অসুবিধা হচ্ছে না তেমন। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রিসাইডিং অফিসার কে আছেন?’

রঙ্গন উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘বলুন—’

‘আপনি?’

‘হ্যাঁ। বলুন।’ আবার বলে রঙ্গন।

আপনার তো বেশ কম বয়েস—’ বলেই ফস করে একটা সিগারেট ধরালেন ভদ্রলোক। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আগে ভোট করার অভিজ্ঞতা আছে, নাকি এই প্রথম?’

‘প্রথম।’ বলে হাসে রঙ্গন। মনে মনে বোঝে লোকটা পরোক্ষে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে তার ওপর। খুব স্বাভাবিক গলায় সে বলে, ‘আমার অসুবিধা হবে না, ইনফ্যাক্ট সব কাজই তো একবার না একবার শুরু করতে হয়—’অসুবিধা হবে না। আমরা আছি তো—কোনো দরকার হলে বলবেন আমাদের, সঙ্কোচ করবেন না—’ ভদ্রলোক হাসলেন।

পাশের একটি ছেলে এতক্ষণে রঙ্গনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল তাঁর, ‘ইনি আমাদের অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান—’

‘নমস্কার—’রঙ্গন দু’হাত জড়ো করে তুলে আনে বুকের কাছে।

‘নমস্কার—’সিগারেট ধরা ডানহাতটা কপালে ছোঁয়ান ভদ্রলোক ‘কাল দেখা হবে—’

‘নিশ্চয়ই।’ রঙ্গন বলে, ‘একটা কথা মাথায় রাখবেন। এজেন্টরা যেন কাল সকালে সময় মতন চলে আসেন। আমি কিন্তু ঠিক সাতটায় পোল স্টার্ট করব।’

‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না এসব নিয়ে—’

আশা করি আপনাদের সকলের সহযোগিতা পাব কাল—’

‘একশোবার। আমাদের এখানে ভোট করাতে এসেছেন। আপনারা এখন আমাদের অতিথি। আপনাদেরে সুবিধে—অসুবিধে তো আমাদের দেখতেই হবে—’ বলে পাশের আর একটা ষণ্ডা মতন ছেলের দিকে চাইলেন প্রধান মশাই, ‘প্যাটকা, কাল সকাল থেকে থাকিস এদিকে। সকাল থেকে বিকেল স্যারদের খাওয়াদাওয়ার কোনো সমস্যা যেন না হয়। দায়িত্ব তোর।’

‘হ্যাঁ দাদা। আজই আমি তরুণকে দিশি মুরগির অর্ডার দিয়ে দিয়েছি—’

‘গুড। আর শোন। ভালো দেখে কিছু কচি ডাব পাড়িয়ে রাখিস। যা গরম—’

‘হয়ে যাবে দাদা—’বশংবদ ভঙ্গিতে বলে ছেলেটা।

‘এসবের দরকার হবে না—’ গম্ভীর হবার চেষ্টা করে রঙ্গন, কনটিজেন্সির টাকা থেকে ওটা আমরা ব্যবস্থা করে দেবখন—’

‘তা তো হবে না। বলেই তো দিয়েছি আপনারা আমাদের অতিথি এখন—’ ভদ্রলোকের আপাত শান্ত ভাবটা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রঙ্গন বুঝতে পারল লোকটার চোখমুখ ক্রমশ শীতল আর কঠিন হয়ে উঠছে এবার। প্রধান বলে চললেন, ‘এখানে আমি ঠিক করি কী হবে আর কী হবে না। আমাদের দিক থেকে সবরকম সহযোগিতা আপনারা পাবেন কোনো অসুবিধা হবে না আপনাদের। তবে হ্যাঁ, আমরাও কিন্তু কাল আপনাদের কাছ থেকে সহযোগিতা আশা করব—’

‘সে তো বটেই। শুধুমুধু ঝামেলা পাকিয়ে তো লাভ নেই। আমরাও তো চাই নির্ঝঞ্ঝাটে ভোটটা করে বাড়ি ফিরতে—’ রঙ্গনকে কিছু বলতে না দিয়েই ওর পাশ থেকে সেকেন্ড পোলিং অফিসার বলে উঠলেন। ‘একশোবার—’থার্ড পোলিং অনাথবন্ধুবাবুও সমর্থন করলেন তাঁকে।

‘মনে থাকে যেন,’ পঞ্চায়েত প্রধান বললেন, ‘এখানে আসাটা আপনাদের ইচ্ছেয়, কিন্তু ফেরাটা আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী—’ ভদ্রলোক সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রঙ্গন যাবার সময় তাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, চঞ্চলবাবু ইশারায় চুপ করতে বললেন তাকে।

ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে ফাঁকা মাঠে এসে দাঁড়াল রঙ্গন।

নদীর দিক থেকে ছুটে আসা হাওয়ার গতি আরো বেড়েছে এখন। বিকেলে নদীর ও পাশে আর ধানজমির ওই দিকে সবুজ পাঁচিলের মতন বিছিয়ে থাকা গাছগুলো ভারী সুন্দর লাগছিল। এখন ছায়া ছায়া ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে মিশে থাকা আরো গাঢ় অন্ধকার হয়ে থাকা গাছগুলির দিকে চাইলে অকারণেই যেন গা ছম ছম করে ওঠে। কী অদ্ভুত রকম নিস্তব্ধ চারদিক! কাল এই স্কুলবাড়ির আশপাশের এলাকাগুলো থেকেই প্রায় হাজার মানুষ ভোট দিতে আসবে এই বুথে, এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেন একথা বিশ্বাসই করা যায় না। আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে। কিন্তু আলোর জোর নেই একটুও। মাঝে মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘের টুকরো উড়ে এসে চাঁদকে ঢেকে ফেলছে যেই, অমনি সেই মৃদু আলোটুকুও মুছে যাচ্ছে। মেঘ সরে গেলে আবার আলো ঠিকরে আসছে আকাশ দিয়ে। পঞ্চায়েত প্রধান তাঁর দলবল নিয়ে মাঠ পার হয়ে যেতেই একখণ্ড ‘বড়’ কালো মেঘ চাঁদটাকে ঢাকা দিয়ে দিল। আর তখনি একটানা খিল খিল খিল খিল করে হাসির শব্দ উড়ে এল রঙ্গনের কানে। সেই হাসির মধ্যে শুধুমাত্র অসংলগ্নতা নয়, রঙ্গনের মনে হল, যেন একটা তীব্র বিদ্রুপ খেলা করে বেড়াচ্ছিল পুরো মাঠ জুড়ে। চমকে সেদিকে ফিরে তাকাল সে।

সন্ধের আগে যেমন বসেছিল, চৈতি এখনও ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই বসেছিল মাটির ওপর। একই জায়গায়। বসে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে পঞ্চায়েত প্রধান যে দিকে চলে গেলেন সেদিকে চেয়ে সে হাসছিল। রঙ্গন ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে হঠাৎ হাসি থামিয়ে রঙ্গনের মুখের দিকে চাইল। তারপর রঙ্গনকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, ‘তোমরা সবাই শয়তান। তোমরা সবাই একইরকম আমি জানি তোমরা কেউ আমাদের ভোট দিতে দেবে না কাল—’

রঙ্গন অবাক হয়ে গেল। মেয়েটা তার সাথে কথা বলছে। কিন্তু এমন কথা বলছে কেন ও? ওর কথাগুলো কি নিছকই পাগলের প্রলাপ?

মেয়েটা আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রধানের চলে যাওয়া— পথের দিকে। রঙ্গন একটুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে খুব শান্ত গলায় মেয়েটিকে বলে উঠল, ‘চৈতিদিদি, অন্ধকার হয়ে গেছে। তুমি বাড়ি যাবে না?—’

কী বললে আমায়, দিদি—চকিতে রঙ্গনের দিকে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল মাটি থেকে। তারপর রঙ্গনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে উঠল ঠান্ডা গলায়, ‘আমি বিশ্বাস করি না। নতুন গাঁয়ের পল্টনকেও তো আমি দাদা বলে ডাকতাম। কিন্তু—’

‘কিন্তু কী?’ জিজ্ঞেস করে রঙ্গন।

চৈতি এ কথার উত্তর দেয় না। নিঃশব্দে হাসে। তারপর ঘাড় বে�কিয়ে দাঁড়িয়ে রঙ্গনের দিকে চেয়ে ডানহাত দিয়ে চুলের বিনুনিটা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘তুমি তো ভোটবাবু, কাল আমায় তুমি ভোট দিতে দেবে?’

‘নিশ্চয়ই—’ রঙ্গন আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলে।

‘তুমি সত্যি কথা বলছ তো’, মেয়েটা বিনুনি থেকে হাত সরায়, ‘আমার না নিজেরটা নিজে দেবার খুব শখ। আগের বারই তো মাত্র ভোটার হলাম সবে—’

‘আগেরবার ভোট দাওনি তুমি?

‘না।’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় চৈতি।

‘ক্যানো?’

উত্তর দেয় না চৈতি। খিলখিল করে হেসে ওঠে আবার। তারপর দ্বিতীয়বার দিকে করে রঙ্গনকে, ‘সত্যি সত্যিই কাল তুমি আমায় ভোট দিতে দেবে তো?

‘শুধু তুমি কেন চৈতিদিদি, সবাই কাল নিজের ভোট নিজে দেবে। আমি নিশ্চিন্ত করে বলছি’ রঙ্গন বলে, ‘সেইজন্যেই তো আমরা এসেছি—’

‘এমনি এমনিই ভোট দিতে দেবে আমায়?’

‘মানে?’

‘কিছুই দিতে হবে না তার বদলে?’

‘কী দেবে তুমি আমায় চৈতিদিদি?’

‘আমার যা আছে,’ বলে দীর্ঘ হাসিতে ফেটে পড়ে চৈতি, তারপর দ্রুত হাতে কামিজের বোতাম খুলতে শুরু করে সে।

মেঘের হালকা আবডাল ফুঁড়ে চাঁদের আবছা আলো এসে পড়ছে চৈতির অন্তর্বাসহীন আধখোলা বুকের ওপর। মেয়েটাকে মায়াবী লাগছে ভীষণ। রঙ্গন মারাত্মক ভয় পেয়ে গেল। হাতের আঙুল আড়ষ্ট হয়ে উঠল তার। শরীর ঘেমে উঠল। শুকিয়ে যাওয়া গলায় কোনোক্রমে বলে উঠল সে, ‘কী করছ তুমি চৈতিদিদি, তুমি বাড়ি যাও। আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমরা সবাই ঠিকঠাক ভোট দেবে। আমি নিজে দেখব এটা—’ তারপর পিছন ফিরে ছুটতে শুরু করে সে মাঠ পেরিয়ে, স্কুলবাড়ির দিকে।

এজেন্টরা পৌঁছ গিয়েছিল সকাল সাড়ে ছ’টার মধ্যেই। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম, সইসাবুদ সেরে কাঁটায় কাঁটায় সাতটাতেই শুরু হয়েছিল ভোট। এই সকালবেলাতেই প্রচুর মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছেন স্কুলের বাইরের ফাঁকা মাঠে। আলো ফোটারও আগে আজ ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে রঙ্গনকে। আমার সারারাত ঘুমই হয়নি ভালো করে। বাথরুম—পায়খানার কোনো বন্দোবস্ত এখানে নেই। মাঠে—ঘাটে খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য সারার কথা ভাবতেই পারে না সে। কাজেই ও কাজটা হয়নি। পুকুরে স্নান করার অভ্যাসও নেই তার। তবুও অনেক কষ্টে পুকুরে নেমে ভয়ে ভয়ে দু—একটা ডুব দিয়ে নিয়েছে সে সেই কাকভোরে। সকাল থেকেই মনের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তি কাজ করছিল। পোল ঠিকঠাক শুরু হওয়াতে এখন অনেকটা স্বস্তি বোধ করছিল সে।

এজেন্টদের মধ্যে একজন রঙ্গনের চেনা। পঞ্চায়েত প্রধানের সাথে ভদ্রলোক কাকভোরে এসেছিলেন রঙ্গনের সঙ্গে দেখা করতে। আজ ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে রঙ্গনের। উনি তুহিন সরকার। এলাকায় বিল্ডিং মেটারিয়ালের বড় ব্যবসা আছে। তুহিনবাবু মানুষটি বেশ হাসিখুশি। কথাবার্তাও অমায়িক। ভোট শুরু হবার মিনিট দশ—পনেরো বাদেই পাশে বসা কমবয়েসি একটা ছেলেকে তাড়া দিলেন তিনি কীরে, কী আক্কেল বল’তো তোদের, স্যারদের চা টা কিছু খাওয়াবি তো নাকি—এখুনি? বলে হাসে ছেলেটা।

এখুনি কী রে, সাড়ে সাতটা বাজতে চলল তো—’ধমকে ওঠেন তুহিনবাবু’ আরো পরে চা খাওয়ালে টিফিন খাওয়াবি কখন—জানিস তো বাবুদা বারবার করে বলে দিয়েছেন স্যারেদের যত্নআত্তিরে যেন কোনো ত্রুটি না হয়—। আর শোন, পলটন আর প্যাটকাকে এবার চলে আসতে বলে দে। পল্টনদা আটটায় আসবে বলেছে—

‘মানে এক ঘণ্টা এভাবে চলবে? ব্যাপারটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না?’

‘রিস্কের কী আছে। এক ঘণ্টায় কত আর পোল হবে—আশি, খুব বেশি হলে একশো—হাজার ছাপ্পান্ন ভোটার আছে এই বুথে। অত ভাবছেন ক্যানো দাদা—’ বলতে বলতে উঠে পড়ে ছেলেটা। রঙ্গনের দিকে চেয়ে হাসে। তারপর আসছি একটু স্যার—বলে দরজার দিকে পা বাড়ায়।

রঙ্গনের অস্বস্তি হচ্ছিল। ওদের কথাবার্তার মধ্যে অন্য কিছু একটা ইঙ্গিত আর ইঙ্গিতটা রঙ্গন ধরতে পারছিল না। একটুক্ষণের মধ্যেই চা এসে গেল। সঙ্গে দুটো করে বিস্কুট। তুহিনবাবু রঙ্গনের দিকে চেয়ে একগাল হাসলেন, ‘খেয়ে নিন স্যার।’

চা খেয়ে বুথের বাইরে এসে দাঁড়াল রঙ্গন। ফাঁকা মাঠে ভোটদাতাদের দীর্ঘ লাইন পড়েছে। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সেই লাইন। রঙ্গন একটা সিগারেট ধরাল। চলমান মানুষের সারির দিকে চেয়ে আসমানে ধোঁয়া ছাড়তে লাগে সে সিগারেট থেকে। হঠাৎ লাইনের অনেকখানি পিছন দিকে সে চৈতিকে দেখতে পেল। ভোটদাতাদের লাইনে ভোট দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। ওর ঠিক পিছনে ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়া। মাথায় ঘোমটা টানা। বিধবা। চৈতির মা হয়তো। রঙ্গন এগিয়ে গেল। ওর ভালো লাগছিল। মেয়েটা কাল ভোট দিতে পারবে কিনা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছিল চৈতি, কী আশ্চর্য, ঠিক চিনতে পারল রঙ্গনকে। রঙ্গনের দিকে চেয়ে হাসল। হাসিটা কাল রাতের মতন দুর্বোধ্য ও রহস্যময় নয়। পিছনের মহিলাকে রঙ্গনের দিকে ইশারা করে দেখাল চৈতি। বলল, ‘মা এ লোকটা পল্টনদের মতন নয়। ও ভালো লোক। ও আমাকে ভোট দিতে দেবে বলেছে—’

মহিলা ম্লান হাসলেন। ধীর গলায় রঙ্গনের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ও ঠিক সুস্থ নয়। ওর কথায় কিছু মনে কোরো না বাবা—’

‘মনে করার কিছু নেই মাসিমা,’ রঙ্গন হেসে বলে, ‘চৈতিদিদির সাথে সত্যিই কাল আমার এ কথা হয়েছে—’

‘ও।’ বলে চুপ করে যান মহিলা। রঙ্গন বলে চলে, ‘আমাদের দেশ ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। আর আপনারা সেই গণতন্ত্রের স্তম্ভ। আমাদের তো এটাই কাজ মাসিমা, আপনারা যাতে ঠিকঠাক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেটা আমি অবশ্যই দেখব—’

মাঠের পাশে একটা অটো এসে থামল। অটো থেকে জনাছয়েক লোক নেমে এগিয়ে এল মাঠের দিকে। এরপর অটোর পিছনে এসে থামল তিনটে মোটর বাইক। আরো ছজন। ওরা সকলেই লাইনের সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ‘পল্টন—’ বলেই হি হি করে কাল রাতের সেই অদ্ভুত গা শিরশির করা হাসিটা হেসে উঠল চৈতি।

লাইনের সামনের দিকে একটা জটলা এবং হালকা হৈ চৈ শুরু হল। রঙ্গনের মনে হল ধীরে ধীরে এগোতে থাকা ভোটদাতাদের দীর্ঘ লাইন হঠাৎ যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রঙ্গন বুথের ভেতরে ঢোকার জন্যে দ্রুত পা চালাল।

.

বুথে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেল রঙ্গন। ভোটকেন্দ্রের দখল নিয়ে নিয়েছে বহিরাগতরা। চঞ্চলবাবুসহ সমস্ত ভোটকর্মীই প্রতিবাদহীন হুকুম তামিল করে যাচ্ছে ওই লোকগুলোর। চারজন পুলিশকর্মীর মাত্র একজনকে দেখতে পেল রঙ্গন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে। তাঁকে দেখে মনেই হল না ভিতরে অন্যায় এবং অসাংবিধানিক একটা ঘটনা ঘটছে এবং সেটা আটকানোর দায়িত্ব তাঁর। রাগে ফেটে পড়ল রঙ্গন। ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল সে, ‘এমন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে করছেনটা কী আপনি? ভিতরে কী চলছে দেখছেন না—’

ভদ্রলোকের চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। চাপা গলায় রঙ্গনকে পরামর্শ দিলেন তিনি, ‘আপনিও চেপে গিয়ে বসে পড়ুন নিজের জায়গায় এভাবে। ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে এসব আটকানো যায় না। সবাই জানে। এমনই তো চলে আসছে—’

‘ছিঃ ছিঃ, পুলিশ হয়ে আপনি একথা বলছেন,’ বিরক্ত হয় রঙ্গনও, ‘আর নিধিরাম সর্দার বলছেন ক্যানো নিজেকে, হাতে তো রাইফেল রয়েছে আপনার—’

‘খবর্দার যেন আবার ফায়ারিং অর্ডার দিয়ে বসবেন না—’পাতলা একটা হাসি ফুটে ওঠে ভদ্রলোকের মুখে, ‘এসব রাইফেলে গুলি সহজে বেরোয় না। ‘

‘মানে?’

‘আরে মশাই এসব মান্ধাতার আমলের জিনিস। ভোটের সময় এগুলো বেরোয় একজিবিট করার জন্য। চালানোর জন্যে নয়। তাছাড়া আমার এই বন্দুক ঘাড়ে তুলে গুলি করার জন্যে রেডি করতে করতে সব এসে ঠাস করে চড় মেরে বন্দুকটি কেড়ে নেবে। তখন আরো বড় কেলো। আমার চাকরিটি যাবে—’ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কথা বলার ইচ্ছে হল না রঙ্গনের। সামনের মাঠের দিকে চেয়ে সে দেখল ভোটদাতাদের দীর্ঘ লাইন ভেঙেচুরে গেছে। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে মানুষ। দু—একজন প্রতিবাদ করতে গিয়ে বকা খাচ্ছেন পুলিশকর্মীদের কাছেও। খুব কাছেই কোথাও ধ্রাম করে বোমা ফাটার আওয়াজ হল একটা। রঙ্গনের চোখের সামনেই খুব দ্রুত মাঠটা ফাঁকা হয়ে গেল। ও দেখল চৈতির হাত ধরে দ্রুত পায়ে ফিরে যাচ্ছে ওর মা। পাছে ওর চোখে চোখ পড়ে যায়, তাই তাড়াতাড়ি বুথের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল রঙ্গন।

তুহিন সরকার রঙ্গনের দিকে চেয়ে হাসলেন। তাকে আশ্বস্ত করার ঢঙে বললেন, ‘ব্যস আর কোনো ঝামেলা নেই স্যার। আপনি নিশ্চিত হয়ে বসে রিল্যাক্স করুন। আর পারলে পেপারগুলো রেডি করে ফেলুন, বাকিটা আমরা সামলে নিচ্ছি। চিন্তা করবেন না, সেন্ট পারসেন্ট পোল আমরা করব না। জানি আপনি অসুবিধেয় পড়তে পারেন তাতে। তবে এইট্টি এইট্টি ফাইভ পারসেন্ট পোল হতেই পারে। এগজ্যাক্ট নাম্বারটা একটু পরে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আপনি বসিয়ে নেবেন ওটা—’

অসহায় আক্রোশে বুকের মধ্যেটা জ্বালা জ্বালা করছিল রঙ্গনের। পোলিং পার্টির বাকি লোকগুলোকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল সে। কারো মধ্যে কোনো বিচলন নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। এই লোকগুলোর হুকুম তামিল করাই যেন একমাত্র কর্তব্য তাঁদের।

রঙ্গন উঠে দাঁড়াল। প্রতিবাদে ফেটে পড়ল সে, ‘এটা হতে পারে না। আমি এ হতে দিতে পারি না—’

চঞ্চলবাবু চোখের ইশারায় থেমে যেতে বললেন ওকে। সেকেন্ড ও থার্ড পোলিং অফিসারও বোঝালেন, ‘স্যার আপনার অভিজ্ঞতা কম। দীর্ঘদিন ভোট করছি আমরা। আপনি থেমে যান। না হলে আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাব।’

রঙ্গন কথা শুনল না। মোবাইল বের করল পকেট থেকে। বলল, ‘আপনি বসে থাকুন হাত—পা গুটিয়ে। আমি পারব না। আমি সেক্টরে ফোন করব। দরকার হলে সেন্ট্রাল ফোর্স আনিয়ে ভোট করাব। আমি—।’

রঙ্গনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই একটা ষণ্ডা—মতন ছেলে এসে দাঁড়াল তার সামনে। কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্রটা একটানে পাঞ্জাবির নীচ থেকে বের করে এনে রঙ্গনের নাকের সামনে দোলাতে দোলাতে সে বলতে লাগল, ‘কর্তব্যবোধ যে একেবারে উথলে উঠছে দেখছি। দুটো দানা শরীরে ভরে দিয়ে এক্ষুনি যদি গাঙের জলে ভাসিয়ে দিই, এসব বোলচাল কোথায় যাবে চাঁদু—’

তুহিন সরকার ছদ্ম ধমক দিয়ে ওঠেন, ‘তুই বড্ড অল্পে মাথা গরম করিস পল্টন। ভুলে যাস না উনি অতিথি আমাদের। এক্ষুনি দানা টানার কথা ক্যানো তুলছিস—তুই বরং এক কাজ কর। ওঁর মোবাইলটা আপাতত নিয়ে আমার কাছে গচ্ছিত রাখ। দু’ঘণ্টা অন্তর রিপোর্ট পাঠাতে হবে ওই মোবাইল থেকে। ওনার যা মনের অবস্থা তাতে ওনার ওপরে কাজের চাপ দিয়ে আর কাজ নেই। আমিই বরং সময়ে সময়ে রিপোর্টগুলো পাঠিয়ে দেব’খন—’

এই তাহলে পল্টন। চৈতি এই ছেলেটার বিষয়েই একটা কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছিল কাল। ভাবতে ভাবতে অসহায়ের মতন নিজের চেয়ারে বসে পড়ে রঙ্গন। একটা অদ্ভুত কান্নার ভাব হচ্ছে বুকের মধ্যে। পরাজিত মনে হচ্ছে নিজেকে। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেরই দুয়ো দিতে ইচ্ছে হচ্ছে বার বার। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। কবে যে সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে! ভারতবর্ষের মানুষ সত্যি সত্যি গর্ব করতে পারবে নিজেদের গণতন্ত্র নিয়ে, তুহিন সরকার বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘টিফিনে লুচি আলুর দম আর মিষ্টি বলে এবার আনাই?’

‘আনান’—সকলে বলল। রঙ্গন কথা বলল না।

‘দুপুরে মাংস আর ভাত থাকছে। বেশি রিচ করতে না করেছি। যা গরম—’ সরকার আবার বললেন।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। হালকা ঝোলভাতই ভালো—’ সকলে বলল। রঙ্গন কথা বলল না।

তুহিন সরকার রঙ্গনের দিকে চাইলেন, ‘স্যার—’

‘আমি খাব না কিছু—’

‘সে কী, ক্যানো?’

‘আমার রুচি নেই।’

‘দুপুরে ভাত—’

‘খাব না।’

‘একটু চা বলি তবে?’

‘না।’

‘এটা কি আপনার প্রতিবাদ?’

রঙ্গন কথা বলল না। তুহিন সরকার নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন।

হালকা জোলো বাতাস বইছিল নদীর দিক থেকে। গাছের পাতায় ধাক্কা খেতে খেতে সেই বাতাস অদ্ভুত এক বিষণ্ণ শব্দ তুলছিল। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে আবছা অন্ধকারে। রঙ্গন সেই ফিকে অন্ধকারে নদীর দিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিল অন্যদের থেকে খানিকটা তফাতে। সাইকেল মেসেঞ্জার বুথ থেকে জেটিঘাটে পৌঁছে দিয়ে ওর থেকে রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। সেক্টর থেকে খবর পাঠানো হয়েছে ওদের লঞ্চ অন্য একটা দ্বীপের পোলিং পার্টিদের তুলতে গিয়ে ভাটায় আটকে পড়েছে, জোয়ার না এলে তার আর নড়ার উপায় নেই। অতএব অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই এখন। সকলেই কম বেশি ক্লান্ত। দুপুরের গুরু ভোজনে আর নদীর দিক থেকে আসা ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া চোখের পাতা ভারী করে দিচ্ছে ক্রমাগত। রঙ্গনের সহকর্মীরা ভোটের জিনিসপত্রের ওপরেই মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে কেউ কেউ। এমনকী পুলিশকর্মীরাও জেটিঘাটের নির্জন চাতালে পলিথিন শিট বিছিয়ে নাক ডাকাচ্ছেন নিশ্চিন্তে।

রঙ্গনের চোখে ঘুম আসছিল না। খিদে পেয়ে পেয়ে মরে গিয়ে একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তি হচ্ছে শরীরের মধ্যে। মনটাও তুমুল বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। অন্যায়ের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই করতে পারল না সে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে চেয়ে ওর মনে হচ্ছিল ঠিক এই সময়ে এই দ্বীপে ভোট না দিতে পারা মানুষগুলো একজোট হয়ে এসে যদি ভোটের অরক্ষিত কাগজপত্র সব কেড়েকুড়ে নিত তাহলেও হয়তো রিপোর্ট করানো যেত এখানে। তখনও হয়তো ফল একই হত, কিন্তু রঙ্গনের আর কোনো দায়ভার থাকত না হাতে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেল রঙ্গন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট ধারায় অকারণ পায়চারি করতে লাগল নদীর পাড় বরাবর ইটপাতা রাস্তার ওপর দিয়ে।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রঙ্গন। একটা ছায়া—মানুষ পথ বেয়ে ক্রমশ এগিয়ে আসছে এইদিকে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। তবে কি এক্ষুনি যা ভাবছিল তাই সত্যি হতে চলেছে—গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে হামলা করতে আসছে তাদের ওপর রাতের অন্ধকারে? রঙ্গন চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ছায়ামূর্তি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে তার থেকে একটু দূরে এসে থামল। সঙ্গীহীন, একা একাই। তারপর কাপড়ের আড়াল থেকে একটা হাত বের করে নিঃশব্দে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল তাকে।

রঙ্গন অবাক হয়ে গেল। চিনতে একটুও অসুবিধা হল না তার। চৈতির মা। ধীর পায়ে তাঁর সামনে গিয়ে অপরাধীর মতন মুখ করে দাঁড়াল সে। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘আমায় ক্ষমা করবেন মাসিমা। আমি পারিনি—’

মহিলা কথা বললেন না। এক হাতে রঙ্গনের হাত ধরে আরো খানিকটা তফাতে নিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচল সরিয়ে আর এক হাতে ধরা টিফিন কৌটোটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও বাবা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও—’

—রঙ্গন ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল। মহিলা আবার বললেন, ‘আমি জানি তুমি কিচ্ছু খাওনি সারাদিন। আমি শুনেছি। অমন করে কেউ—না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ হবে যে—’

‘আমি পারিনি মাসিমা—’ গলা ভারী হয়ে আসে রঙ্গনের, ওদের দেওয়া খাবার—তুমি আমার ছেলেরই মতন। বয়েসেও, স্বভাবেও—তোমার মতনই ও—ও ছিল। তবে বড্ড এক বগ্গা। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে পারত না। আর তোমারই মতন বোকা। বুঝতেই চাইত না যে একা একা সবকিছু পাল্টে ফ্যালা যায় না—’

‘তারপর?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রঙ্গন।

মহিলা টিফিন কৌটো খুলে মেলে ধরেন রঙ্গনের সামনে, ‘বেশি কিছু নেই বাবা, অভাবের সংসার আমার। রুটি আছে। আর কুমড়োর তরকারি। রঙ্গন হাত দিয়ে রুটি তরকারি নিয়ে মুখে দেয়। মহিলা বলতে থাকেন, ‘সেবার চৈতি প্রথম ভোট দেবে। পাঁচ বছর আগের সে দিনেও পল্টনরা আমাদের সরিয়ে দিয়ে বুথ দখল করে নিয়েছিল। আমার ছেলে তার দিদিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। বলেছিল দিদির ভোট দিদিই দেবে—’

‘কী হল তারপর?’

‘ভোট দিবি, আয়—বলে চৈতির হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে পঞ্চুদের ভাঙা গোয়ালঘরে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল পল্টন—’ বলে একটু থামলেন উনি। তারপর বড় করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমার বোকা ছেলেটা দিদিকে বাঁচাতে তখনও লড়াই করতে গিয়েছিল পল্টনের সাথে। প্রতিবাদ করেছিল সে—আর তাই দুদিন নিখোঁজ থাকার পর সে ওই নদীর জলে ভেসে উঠেছিল। পুলিশে রিপোর্ট লেখা হয়েছিল স্নান করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত জলে ডুবে মৃত্যু—’

‘আর পল্টন?’ বোকার মতন জিজ্ঞেস করে রঙ্গন।

‘দেখলে তো নিজের চোখে। সেদিনও যা করত, এখনও তাই করে। সময়মতন দলটা পাল্টে ফেলেছে শুধু। কে ওকে ছোঁবে বাবা—ওকে যে সবার দরকার। আমরা তো কারো কাছে দরকারি নই—’ বলতে বলতে শূন্য টিফিন কৌটোটা আঁচলের নীচে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার রঙ্গনের দিকে চাইলেন তিনি। তারপর আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘তোমার জন্য ভারী চিন্তা হচ্ছিল আমার। তুমি বেঁচে থেকো আর সাবধানে থেকো বাবা—’

রঙ্গন কিছু বলার আগেই উল্টো পথে হনহন করে হাঁটা দিলেন তিনি।

রঙ্গনও পিছু ফিরল। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে এখন। চাঁদ থেকে ঠিকরে আসা আলো পড়েছে রাস্তায়। নদীর দিক থেকে আসা হাওয়া আরো তীব্র হয়েছে। জোয়ারে জল ফুলে উঠেছে নদী জুড়ে। রঙ্গন জেটিঘাটের দিকে পা বাড়াল। একটু পরেই লঞ্চ এসে যাবে। রিসিভিং কাউন্টারে পৌঁছতে রঙ্গনকে সেই লঞ্চে চড়ে জ্যোৎস্নায়, জলপথে দুলতে দুলতে এখন অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *