হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর – বীণা দাস
১৯৪৭-এর দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর যাঁরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই সব মহিলাদের ব্যক্তিগত কিছু কাহিনী আলোচনা করব এই প্রবন্ধে। কাহিনীগুলো আমি সংগ্রহ করেছি পঞ্চাশটি শহরবাসী পঞ্জাবি পরিবারের কাছ থেকে। পরিবারগুলি একে অন্যের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত।
এইরকম একজন মহিলার গল্প শুনুন। গল্পটি আমি আমার আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে চাইছি। এর সঙ্গে অন্য কাহিনীগুলোর তুলনা পরে করব। মহিলার নাম ধরা যাক মনজিত। দেশভাগের সময় এঁর বয়স ছিল তেরো। লাহোর থেকে পালাবার পথে এর বাবা আর মা সাম্প্রদায়িক আক্রমণে মারা যান। গ্রামের মুসলমানেরা মনজিত আর তার দাদাকে বাঁচিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের হাতে তুলে দেয়। পরে তারা অমৃতসরে এসে পৌঁছয়। এদের এক মামা লুধিয়ানার সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার ছিলেন। তিনি এদের আশ্রয় দেন।
মনজিতের জীবনকাহিনীর এই তথ্যগুলি আমি তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারি। তাঁকে একদিন বলেছিলাম, ‘দেশভাগের সময় আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই।’ মনজিত রাজি হয়ে যান। কিন্তু বলেন, ‘আমার বাড়িতে নয়। আপনার বাড়িতে যাব একদিন।’ যেদিন এলেন, লক্ষ করলাম মনজিতের পোশাক, চলাফেরা, কথাবার্তায় একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেন কোনও অনুষ্ঠানে এসেছেন, এমনি গল্প করতে আসেননি। বসেই একটা কাগজ বের করলেন, তাতে পঞ্জাবিতে লেখা। কাগজটা আমায় দেখিয়ে বললেন, ‘ভাবলাম আমার অভিজ্ঞতাগুলো লিখেই নিয়ে আসি।’ তারপর আমার সামনে বসে মনজিত নিম্নলিখিত কাহিনীটি পড়ে শোনালেন।
প্রথম স্মৃতিচারণ
আমরা যখন লাহোর ছাড়তে বাধ্য হই তখন আমার বয়স তেরো। শহরে যে দাঙ্গা হচ্ছে, তা আমরা জানতাম। কিন্তু দাঙ্গা আগেও হয়েছে। মাঝে মাঝে হয়, তারপর সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। দাঙ্গার জন্য, কেউ কখনও দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। কিন্তু ক্রমে দেখলাম, অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠল। রোজ সকালে দেখতাম শহরে আগুন জ্বলছে। রাস্তা দিয়ে রক্তের স্রোত বইছে, এদিক-ওদিক সাদা কফন। সকলেই চলে যেতে শুরু করল। আমরাও ভাবলাম,একা-একা পড়ে থাকা সম্ভব নয়। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে হিন্দু-মুসলমান যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী একসঙ্গে বাস করেছে, তারা আর একত্রে থাকতে পারবে না। কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে আমরাও ট্রাকে উঠলাম। মোটা টাকার বিনিময়ে ড্রাইভার কথা দিল অমৃতসর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। পথে ট্রাকটি আক্রান্ত হল। আমার আর কিছু মনে নেই। শেষ পর্যন্ত অমৃতসর পৌঁছলাম, এটুকুই শুধু মনে আছে। সম্প্রতি শিখ তীর্থযাত্রীদের একটি দলের সঙ্গে আমি লাহোর গিয়েছিলাম। গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ওখানে হিন্দু মন্দির আর শিখ গুরদুয়ারার অবস্থা সঙ্গিন। গুরদুয়ারার উন্নতির জন্য ভারত সরকারের কিছু করা উচিত।
এই কাহিনী এবং কাহিনীকারের কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে প্রথমেই লক্ষ করার বিষয়, এর আনুষ্ঠানিক প্রথাগত ঢঙ। নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বলতে গিয়ে মনজিত হঠাৎ এই আনুষ্ঠানিক কথনের পেছনে লুকোতে চাইলেন কেন?
আমরা জানি, এই ধরনের কাহিনীতে স্থানকে কিভাবে ভাগ করা হচ্ছে, সেটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। নানাভাবে স্থান ভাগ করা যায়। একটা হল ভেতর আর বাইরের মধ্যে ভাগ। এই ভিতর ভাগ আর বাহির ভাগের মধ্যে আবার নানা মাত্রা সংযোজন করা যায়, তার প্রত্যেকটির এক-এক রকমের তাৎপর্য। গোটা কাহিনীটি আবার হয় ভেতরের দিকে নয় বাইরের দিকে নির্দিষ্ট থাকে—এটা নির্ভর করে কাহিনীকারের অবস্থানের ওপর। আমরা আরও জানি, অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ভেতর আর বাইরের সম্পর্ক খুব জটিল হয়ে যায়। বাস্তবে যা অনেক দূরে, মনের দিক দিয়ে সেই জায়গাটাই হয়তো অত্যন্ত কাছের। আবার দেশান্তরী মানুষ বাস্তবে যে নতুন জগতে অবস্থিত, সেই জায়গাটাই হয়তো তার মনে হয় ভয়ানক দূরের। দেশান্তরের কারণ যেখানে হিংসা আর সংঘাত, ভেতর আর বাইরের জগতের সীমানাগুলো যেখানে জোর করে টানা হয়েছে, সেখানে যে ভিতর-বাহিরের সম্পর্ক আরও অনেক বেশি জটিল হয়ে যাবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মনজিতের কাহিনী থেকে এটাই দেখাতে চাই।
গল্প বলতে গিয়ে মনজিত যে নিতান্তই আনুষ্ঠানিক একটা ঢঙ বেছে নিলেন, আমার ধারণা এইভাবে তিনি আমায় বোঝাতে চাইছিলেন যে, স্মৃতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। নৃতত্ত্ববিদ হিসেবে আমি যখন মনজিতকে বলি, ‘আপনার অভিজ্ঞতার কথা মনে করে বলুন’, তাঁর মনের ওপর এর ফলে যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার জন্য তো আর আমি কোনও দায়িত্ব নিচ্ছিলাম না। এতে যে বিপদ আছে, সেটাই মনজিত আমায় মনে করিয়ে দিলেন। সেজেগুজে এলেন, হাতে লিখিত বক্তব্য, সেটা বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে পড়ে গেলেন। এতে করে তাঁর নিজের বক্তব্যের সঙ্গেই একটা দূরত্ব স্থাপন করে রাখলেন মনজিত। বোঝা গেল, এই প্রাথমিক বক্তব্যটা একবার বলা হয়ে গেলে তারপর অন্য কথায় যাওয়া যাবে।
সুতরাং রাজনৈতিক সংঘাত আর দেশান্তরের ফলে যে স্থানটি বাস্তবে দূরের, মনের দিক দিয়ে তা কাছের হলেও সেটা বর্ণনা করার সময় মনজিত নিজেকে তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছিলেন। দেশভাগের ঘটনা নিয়ে যে কথাসাহিত্য, সেখানেও দেখেছি যে গল্পের লেখক একটা নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যকারের ভূমিকা নিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। এ-সব গল্পের ক্রিয়ার কাল সব সময় অতীতে, ঘটনার স্থান নৈর্ব্যক্তিক, যেমন হাসপাতাল কিংবা হোটেল। একমাত্র নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যকারই যেন এ-সব ঘটনার যথাযথ বর্ণনা দিতে পারে। একান্ত নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মনজিতও দেখলাম একই ভঙ্গি অবলম্বন করলেন।
একটা কথা অবশ্য বলা দরকার। যে স্থানটি এক সময় মনজিতের নিজের দেশ ছিল, এখন বিদেশ হয়ে গেছে, তার ওপরেও কিন্তু তিনি একটা দাবি জানিয়ে রাখতে চাইছিলেন। তাই বললেন, গুরদুয়ারাগুলোর সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকারের কিছু করা উচিত। অন্য অনেক জায়গায় দেখা গেছে, অভিবাসীরা তাদের ফেলে-আসা জগতের মূল্যবোধ দিয়েই নতুন পরিবেশকে অর্থবহ করে তুলতে চায়। মনজিতের কাহিনীতে এর আরও দৃষ্টান্ত পরে দেখব। এখানে শুধু লক্ষ করা দরকার যে, পুরনো জগৎটা থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার ওপর একটা দাবি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, যে দাবি পূরণ করার প্রায় কোনওই সম্ভাবনা নেই।
দ্বিতীয় স্মৃতিচারণ
মনজিত আরও একবার আমায় তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প বলেন। এবার নিজের উদ্যোগেই। প্রথম সাক্ষাৎকারের প্রায় এক মাস পর আমি ওঁদের পাড়ায় গিয়েছিলাম। খবর পেয়ে মনজিত এসে আমায় বললেন:
কাল রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি। দেখলাম আমি লাহোরে ফিরে গেছি। চারদিকে আগুনের গন্ধ। আমি ছুটে ছাদে চলে গেলাম আগুন আর ধোঁয়া দেখব বলে। লাহোরে থাকতে আমি ওইরকম ছাদে গিয়ে আগুন দেখতাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্বপ্নের মধ্যে আপনি সব চেয়ে বেশি ভয় পেলেন কিসে?’ তিনি বললেন, ওই সময় লাহোরে ওঁর দাদা রোজ রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে বেরিয়ে যেতেন। একদিন সকালে বেরোবার সময় মনজিতের হাতে একটা ছোট্ট পুরিয়া ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সঙ্গে রাখ। গুণ্ডারা এলে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলবি। খবরদার, ওদের হাতে পড়িস না।’ মনজিত পাশের বাড়ির এক বান্ধবীকে কথাটা বলেছিলেন। ‘আমাদের সাহস ছিল না দাদাকে জিজ্ঞেস করি পুরিয়াতে কি আছে। আমরা দুজনেই শালোয়ারের দড়ির সঙ্গে পুরিয়াটা বেঁধে রাখতাম। আসলে জানতাম, ওটা নিশ্চয়ই বিষ। দরকার হলে সাহস করে খেতে পারব কিনা, তাই নিয়ে আমাদের আতঙ্কের সীমা ছিল না।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওঁর দাদা কোথায় যেত সেটা তিনি জানতেন কি না। মনজিত বললেন, ‘নিশ্চয় অন্যদের মতো লুঠপাট করতেই যেত। যখন ফিরে আসত, দেখতাম চোখে কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টি।’ এর বেশি আর কিছু জানতে পারলাম না।
স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে মনজিত যা বললেন তার একটা অংশ হল দূর থেকে জ্বলারু দৃশ্য দেখা, অন্যটা হল ঘরের ভেতরকার আতঙ্ক। দাদা ঘরে থেকে বোনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়নি। বাইরে গিয়ে লুঠ করা, আগুন দেওয়া, ধর্ষণ করা, এটাই তার কাছে অনেক বেশি পুরুষোচিত মনে হয়েছিল। দাদা যে ঠিক কি করত, আমরা জানি না। মনজিতের কথা থেকে এটুকুই স্পষ্ট যে পুরুষসমাজের অংশ হয়ে সে ওইসব কাজে অন্তত উপস্থিত থাকত। বোনের হাতে বিষের পুরিয়া ধরিয়ে দিয়ে পাড়ার ছেলেরা জানিয়ে দিল, তাদের বোনেরা যেন শত্রুর হাতে গিয়ে না পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনজিতের আতঙ্কের কারণ তার নিজের মনোবল নিয়ে একটা সন্দেহ—সে যদি এই মারাত্মক দায়িত্বটা পালন করতে না পারে? একটু গভীরে দেখলে, আমার ধারণা, আতঙ্কের সূত্রটা যে অন্য জায়গায় নিহিত রয়েছে, সেটা বোঝা যাবে। এই প্রথম বোধ হয় মনজিত বুঝতে পারল যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা মান-ইজ্জতের লড়াইয়ে তার শরীরটা শুধুমাত্র একটি চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই তার শরীর নিয়ে দুপক্ষেরই এত মাথাব্যথা।’
একটা অন্য কাহিনী বিচার করলে মনজিতের ভয়টা হয়তো আর একটু ভাল করে বোঝা যাবে। মনজিত নিজেই আমায় বললেন অমৃতসরের এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ মুসলিম পরিবারের কথা। তারা পাকিস্তানে যেতে পারেনি, কারণ বৃদ্ধ পিতা তখন অত্যন্ত অসুস্থ এবং তাঁর দুই মেয়ে বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে রাজি হয়নি। মেয়েরা পর্দানশিন, তাই বাইরের সঙ্গে যা যোগাযোগ সবই হত তাদের ছোট ভাই-এর মাধ্যমে। একদিন বাবার অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ভাই গেল ডাক্তার ডাকতে। ঠিক সেই সময় এক বিরাট জনতা তাদের বাড়ি ঘেরাও করল। ছেলেটিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল। মৃতপ্রায় বাবা আর দুই দিদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ছেলেটিকে তলোয়ার দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হচ্ছে। বাবা এ-দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না, ওই অবস্থাতেই মারা গেলেন।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। সেই দাঙ্গাকারী জনতার সামনে এবার দুই বোনকে হাজির করা হল মুজরা নাচার জন্য। ‘মুসলমানেরা পরে বলে বেড়ায় যে মেয়ে দুটো তাদের জামার ভেতর ছুরি লুকিয়ে রেখেছিল। নাচতে নাচতে তারা দাঙ্গাবাজদের নেতাকে ছুরি মেরে হত্যা করে। তার পর নিজেরা আত্মহত্যা করে।’ এইটুকু বলে মনজিত নিজে থেকেই যোগ করলেন, ‘এটা অবশ্য একেবারেই বানানো গল্প হতে পারে। অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করে যে মুজরা নাচের পর মেয়ে দুটো অনেক পুরস্কার পায়। তার পর যারা ওদের ভাইকে মেরেছিল, তাদেরই রক্ষিতা হয়ে যায় ওরা।’
আমার সন্দেহ, এই গল্পটার মধ্যে লৌকিক ধারার অনেক উপাদানই মিশে গেছে। এর সত্যাসত্য বাস্তব ঘটনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ এর অর্থ বহুলাংশেই মনস্তাত্ত্বিক। সত্যটা লুকিয়ে আছে নারীত্বের সেই সংকটময় অবস্থায় যেখানে দুটিই মাত্র বিকল্প—হয় কোনওমতে প্রাণরক্ষা করে বেঁচে থাকা, না-হয় পুরুষ-সমাজের নির্ধারিত মান-ইজ্জতের নিয়ম মেনে নিয়ে মৃত্যু বরণ করা। মনজিতের নিজের অভিজ্ঞতার কাহিনী বা অন্যের মুখে শোনা এই গল্প, দুই-এর মধ্যেই এটা লক্ষ করা যাবে। দুটো গল্পেই দেখছি ভেতর আর বাইরের সীমানা ভয়ানকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, ভদ্র পর্দানশিন মহিলা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে মুজরাওয়ালিতে, নারীর শরীর নিয়ে বিবদমান পুরুষদের মধ্যে ঘটছে সংঘাত। দেশান্তরী মহিলাদের ফেলে-আসা সত্য লুকিয়ে আছে এইসব ঘটনার মধ্যে। এবার দেখা যাক পুরনো জগতের এই স্মৃতি অভিবাসীদের নতুন পরিবেশে কেমনভাবে বদলে যায়।
নীরবতা
আগে বলেছি, মনজিতকে উদ্ধার করে ভারতে নিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবকেরা। পরে মনজিত আর তার দাদা মামার বাড়িতে এসে থাকে। মামা তাঁর দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি মনজিতের বিয়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে মনজিতের বিয়ে হয়। কুলমর্যাদায় শ্বশুরবাড়ি কিছুটা খাটো ছিল। বিয়েতেও বিশেষ ঘটা হয়নি। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মনজিত বললেন, এটাই স্বাভাবিক। দেশভাগের ওইসব সাংঘাতিক ঘটনায় মেয়ের কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি, তা নিয়ে কেউই নিঃসন্দেহ হতে পারত না। তাই নিচু ঘরে বিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
আমার খুড়তুতো বোনকে মুসলমানেরা ধরে নিয়ে যায়। শুনেছি সে মুসলমান হয়ে গেছে। ভালই করেছে। এখানে এলে কেউ কি বিশ্বাস করত যে তার কুমারীত্ব নষ্ট হয়নি।
খুড়তুতো বোনের গল্পটা হয়তো অজুহাত। আসলে মনজিত বোধ হয় নিজের কথাই বলতে চাইছিলেন। আমায় অনেকবার বলেছেন, নতুন জায়গায় এলে অনেক ব্যাপারে নীরব থাকাটাই শ্রেয়। ‘ভাল বিয়ে হলে মেয়েদের খুব সতর্ক থাকতে হয়। অসাবধানী কথায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।’ জগৎকে এই দুভাগে ভাগ করা—এক যেখানে কথা বলা যায়, আর-এক যেখানে কথা বলা নিষেধ—এটা শুধু মনজিতের ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। সাধারণভাবেই হিন্দু পরিবারে মেয়েরা বহু কথা লুকিয়ে রাখতে শেখে। বাপের বাড়িতে যে কথা প্রাণ খুলে বলা যায়, শ্বশুরবাড়িতে এসে তা খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতে হয়, এ প্রায় প্রত্যেক মহিলারই জীবনের অভিজ্ঞতা। মনজিতের বেলায় কিন্তু এই চিরাচরিত প্রথার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। কৈশোরের অভিজ্ঞতাকে নীরবতার আড়ালে ঢেকে রেখে, কার্যত সেটাকে যেন ভুলে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে সমাজ তাঁকে আর পাঁচজন মহিলার মতোই জীবনযাপন করার রাস্তা খুলে দিয়েছিল। মনোবিজ্ঞানে যেমন বলে যে ভয়াবহ কোনও অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করতে পারলে ভয়টি কাটিয়ে ওঠা যায়, এক্ষেত্রে তা হয়নি। মনজিতের স্বামী অবশ্য মাঝে মাঝে মদ খেয়ে এসে তাঁকে বেশ্যা ইত্যাদি বলে গাল দিত। মনজিত নিজেই সে-কথা আমায় বলেছিলেন। কিন্তু মত্ত অবস্থায় এরকম উদ্ভট অপবাদ তো অনেকেই দেয়। মনজিতের আশপাশের মহিলারা এ-সব অপবাদে কান দিত না। ফলে যতই বিচ্ছিন্ন, যতই বিষময় হোক না কেন, এক ধরনের সহনীয় জীবনযাত্রা সম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁর পক্ষে। যে-সময়কার ঘটনা মনজিত মনে আনতে চাইতেন না, জোর করে তা নিয়ে কথা বলাতে গেলে তাঁর স্বামী, মামা, দাদা, প্রত্যেকেই বাধ্য হত একে অপরকে দোষী করতে। মান-ইজ্জতের ভয়ানক লড়াই বেধে যেত আবার। সন্তর্পণে তাই প্রত্যেকেই যেন একমত হয়ে গিয়েছিল, এ-নিয়ে আর বেশি ঘাঁটানোর দরকার নেই। মনজিতের জীবনের এই ঘটনা যে সবার ক্ষেত্রেই ঘটত তা নয়। অন্য মহিলাদের কথা জানি যাঁরা ধর্ষিতা হয়েছেন এই সন্দেহে আত্মীয়দের কাছ থেকে চরম দুর্ব্যবহার পেয়েছেন।
রূপান্তর
যে সব মহিলাদের সঙ্গে দেখা করেছি, তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে চাননি। দেশভাগের ঘটনা নিয়ে একেবারেই কোনও কথা বের করা যায়নি, এমন নয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা নিরপেক্ষ দর্শকের জবানিতে। অনেক সময় সংঘাতের কোনও বিশেষ মুহূর্তের খুব খুঁটিনাটি বর্ণনা পাওয়া গেছে। যেমন:
‘দুপাট্টাটা টেনে নেওয়ার সময়টুকুও পাইনি। যেমন ছিলাম সেভাবেই পালাতে হল।’
‘রুটিটা সবে তাওয়ায় চাপিয়েছি এমন সময় গোলমালের আওয়াজ পেলাম।
পালালাম। রুটিটা উনুনের ওপরেই পড়ে রইল।’
‘খালি পায়েই দৌড়লাম।’
‘বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। জামার বোতামগুলো লাগাবার পর্যন্ত সময় পেলাম না।’
এই যে পরিচিত দৈনন্দিন জীবনের ধারাবাহিকতা হঠাৎ বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া, এটাও মহিলাদের কথনভঙ্গির একটা বৈশিষ্ট্য। মেয়েদের গল্পে মৃত্যুর বর্ণনাও সাধারণত এইভাবেই উপস্থাপিত হয়। কোনও নিকট আত্মীয়ের মারা যাওয়ার কথা বলতে গেলে মেয়েরা প্রায়শই এরকম ছোটখাটো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তাঁদের শোক বোঝাতে চায়। যেখানে আগের পরিচিত জগৎটাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তার সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলো নতুন পরিস্থিতিতে আর মনে আনা সমীচীন নয়, সেখানে একমাত্র মৃত্যুর উপমার আড়ালেই সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ সম্ভব হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয়: দেশভাগের পর পুরনো আর নতুন জগতের সীমানা যে চিরস্থায়ী, এই সত্য আবিষ্কারের বিস্ময়। মহিলাদের কথায় তাদের সে-সময়কার মনোভাবটা বারে বারে বেরিয়ে আসে। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন, পলায়নটা সাময়িক, একটা আকস্মিক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়মাত্র। মহামারি, যুদ্ধবিগ্রহ, দুর্ভিক্ষ—এসব সময় বাঁচার জন্য সাময়িকভাবে পালাতে হয়, এ তো সবাই জানে। বিপদ কেটে গেলে আবার লোকে ঘরে ফিরে যায়। ‘হিন্দুরা কতরকম রাজত্বে বাস করেছে। আমরা তো আর ক্ষমতা চাইনি। ব্রিটিশদের সঙ্গে যেমন মানিয়ে চলেছি সেরকম মুসলমানদের সঙ্গেও মানিয়ে চলতাম। যারা রাজত্ব করবে তারা আমাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে চাইবে কেন?’ রাষ্ট্রের যে নির্দিষ্ট এবং চিরস্থায়ী সীমানা থাকে, বহু মহিলাই এই প্রথম এটা শিখলেন। ব্রিটিশ আমলেও ব্রিটিশশাসিত অঞ্চল আর দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে যাতায়াতের বাধা ছিল না। ‘কাপুরথালায় বা পাটিয়ালার লোকেদের সঙ্গে লাহোর বা অমৃতসরের লোকেদের স্বচ্ছন্দে বিয়ে-থা হত।’ এঁদের মনে রাষ্ট্রের সীমানা ছিল সহজভেদ্য, সামাজিক সম্পর্ক অনায়াসেই রাজনৈতিক সীমারেখা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়তে পারত। বিপদে পড়লে সীমানা পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে, বিপদ কাটলে আবার এপারে ফিরে আসব, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। নতুন দুই সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানা যে একেবারেই দুর্ভেদ্য, একবার পার হলে আর ফিরে আসার কোনও উপায় নেই, এই নির্মম সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করার প্রস্তুতি এঁদের অভিজ্ঞতায় ছিল না।
শরীরের ভাষা
উর্দু লেখক সাদাত হাসান মান্টোর ‘ফুন্দানে’ নামে একটি গল্প আছে। তাতে মেয়েদের দুটো করে শরীর—একটা জন্মগত স্বাভাবিক শরীর, অন্যটা যাতে হিংসার ফল লালিত হয়। ‘মেয়েরা স্বামীর দোষ নিজেদের শরীরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে’—পুরুষের অত্যাচার সম্বন্ধে যে নীরবতা, মেয়েরা এভাবেই তার ব্যাখ্যা দেয়। দেশভাগকে কেন্দ্র করে মেয়েদের ওপর যে আক্রমণ, তা শুধু শত্রু পক্ষের পুরুষদের দিক থেকেই আসেনি। তার চেয়েও মর্মান্তিক তাদের আত্মীয় পুরুষদের প্রতারণা। এই প্রতারণার কথা তারা মুখে বলে না, এ-কথা আগেই বলেছি। কিন্তু মুখের ভাষা নীরব থাকলেও শরীর তার নিজের ভাষায় এই যন্ত্রণা প্রকাশ করে ফেলে।
একজন মহিলা যেমন দাবি করলেন যে পালাবার সময় তাঁর শরীরে এমন একটা আঘাত লাগে যেটা কখনোই আর সারেনি। এমনিতে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি আমায় প্রায় কিছুই বলতে চাইলেন না, কিন্তু এই আঘাতের কথাটা খুব বিস্তারিতভাবে বললেন। একের পর এক বৈদ্য আর ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তিনি। কেউই কিছু করতে পারেনি। মাঝে মাঝে ব্যাথাটা থাকত না, অন্য সময় অসহ্য ব্যথা হত। তাঁর পুত্রবধূরা অবশ্য এই আঘাতের ব্যাপারটা মোটেই বিশ্বাস করতেন না, বলতেন ওটা তাঁর ছেলেদের তাঁবে রাখার কৌশল। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল যে, এই আঘাতের গল্পটা আসলে গভীর কোনও যন্ত্রণার প্রকাশ, যা খোলাখুলি বলা যায় না। তাই শরীরের ভাষায় বলতে হয়।
কান্তার গল্পটা আরও নাটকীয়। কান্তা একজন প্রৌঢ়া। মাঝে মাঝেই তাঁর ফিট্ হত। হঠাৎ শরীরটা শক্ত হয়ে আসত আর তিনি মূর্চ্ছা যেতেন। তাঁর স্বামীর একটু মাথার দোষ ছিল। লাহোরের যৌথ পরিবারে থাকার সময় তাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। স্বামীরা তিন ভাই। তাদের স্ত্রী-সন্তান, তার ওপর শ্বশুর-শাশুড়ি, সব মিলিয়ে কান্তার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছলই ছিল। দেশভাগের দাঙ্গায় এক ভাই মারা যান। বাকিরা অমৃতসরে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু আর্থিক অবস্থা হয়ে পড়ে সঙ্গিন। মানসিক রোগগ্রস্ত স্বামীকে নিয়ে কান্তা চলে আসতে বাধ্য হলেন দিল্লির এক বস্তিতে। এক দোকানদারের জন্য সেলাইয়ের কাজ করে কান্তার সংসার চলত। স্বামী জি. পি. ও.-র সিঁড়িতে বসে অন্যের চিঠিপত্র লিখে দিয়ে দিনে পাঁচ-দশ টাকা রোজগার করতেন। আত্মীয়েরাও মাঝে-মধ্যে অল্পস্বল্প সাহায্য করত। কারও মৃত্যু ঘটলেই কিন্তু কান্তার ফিটের অসুখ দেখা দিত। শুধু আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের মৃত্যুতেই নয়, পাড়ার যে-কেউ মারা গেলেই দেখা যেত, কান্তা উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। তার পরেই ফিট্। পাড়া-পড়শির মৃত্যুতে মেয়েদের সমবেত বিলাপ অবশ্য সম্পূর্ণ প্রথাগত। তাই সেদিক দিয়ে দেখলে কান্তার আচরণ এমন কিছু অদ্ভুত নয়। কিন্তু অন্য মহিলারা কান্তার এই কান্নাকাটির ব্যাপারটাকে বাড়াবাড়ি বলেই মনে করতেন। বলতেন, নিজে এত কষ্ট পেয়েছে বলেই সে ওরকম করে।
কান্তার কাহিনীর আরও একটা দিক আছে। দেশান্তরের অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা বোধ হয় সব চেয়ে বেশি আঘাত করে তাদেরই, পরিবারের ভেতর যাদের নিরাপত্তা কিছুটা কম। এর ফলে সাধারণভাবেই পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের ওপর এইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। কান্তার ক্ষেত্রে তার ওপর আরও জটিলতা এসে জড়ো হয়েছে। নতুন পরিবেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করার দায়িত্ব প্রায় সম্পূর্ণই এসে পড়েছিল তাঁর একার ঘাড়ে। অসুস্থতার জন্য কান্তার স্বামীর যৌথ পরিবারের মধ্যে কোনও ক্ষমতা ছিল না। ঠিক সেই রকম, বাপের বা শ্বশুরবাড়ির ওপর নির্ভরশীল অল্পবয়সী বিধবা মেয়েদের ক্ষেত্রেও এই একই জটিলতা দেখা যায়। এই রকম এক বিধবার গল্প দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব।
বিপন্নতা
ধরা যাক এঁর নাম আশা। আমার সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আশার বয়স পঞ্চান্ন। ১৯৪১ সালে আশার যখন কুড়ি বছর বয়স, তখন স্বামী টাইফয়েডে মারা যান। যৌথ পরিবারে ভাইদের মধ্যে স্বামীই ছিলেন সব চেয়ে ছোট। মা মারা যাওয়ার পর দাদারাই তাঁকে মানুষ করেন, ফলে দাদাদের সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর আশা শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যান। ভাশুর-জায়েরা তাঁকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করেননি। আশার ছেলেপুলে ছিল না। ছোট ননদ তাঁর নিজের ছেলেকে আশাকে দিয়ে দেন পোষ্য হিসেবে। ছেলে অবশ্য তার নিজের মায়ের কাছেই থেকে যায়। সকলেই ধরে নেয়, বড় হলে এই ছেলেই আশার ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে। এরকম ব্যবস্থা যৌথ পরিবারে প্রায়ই ঘটত।
এইভাবে দেশভাগ হওয়া পর্যন্ত আশা শ্বশুরবাড়িতেই বাস করছিলেন। বাপের বাড়ি ছিল জলন্ধরে। এপারে চলে আসার পর সেখানেই আশ্রয় নিতে পারতেন আশা। বিশেষ করে যখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় লাহোর ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। আশা তাঁর ‘পালিত’ পুত্রের সঙ্গে কিছুদিন বাপের বাড়িতেই রইলেন। কিন্তু পারিবারিক জটিলতা ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠল। যে-কোনও ঝামেলাতেই দোষ এসে পড়ত আশার ওপর। এমনকি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর জন্যও দায়ী করতে লাগল। ‘ওঁরা বলত, আমি যথেষ্ট সুন্দর নই বলে নাকি আমার স্বামীর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল। সে খুব সুপুরুষ ছিল, আর আমি একেবারেই সাদামাটা। কথাটা শুনতে আমার এত খারাপ লাগত যে মাঝেমাঝে ভাবতাম আত্মহত্যা করব।’
চার বছর ধরে আশা একবার বাপের বাড়ি, একবার ননদের বাড়ি, এইভাবে চালাতে লাগলেন।
সবখানেই আমি সংসারের কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজকর্মে লেগে থাকতাম। বাচ্চাগুলোকে আমি খুব ভালবাসতাম, তাই কোনও কষ্ট হত না। কিন্তু সকলেই আমায় ঠেস দিয়ে কথা বলত। ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল যখন বড় নন্দাই আমার দিকে নজর দিতে শুরু করলেন। (বড় ননদ দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন।) একদিকে মৃত স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চাইতাম। বড় ননদকেও খুব ভালবাসতাম। কিন্তু নতুন একটা সম্পর্ক হতে পারে, এটাও আমাকে আকৃষ্ট করত। কি করা উচিত, বুঝতে পারতাম না। আমাকে নিয়েই যেন সকলের টানাটানি। নন্দাই কখনো বিয়ের কথা বলেননি। এতদিন এক বাড়িতে আছি, সে ভয়ানক লজ্জার ব্যাপার হত। আমার স্বামীর এক বন্ধু থাকতেন পুনায়। শেষ পর্যন্ত তাঁকেই চিঠি লিখলাম। তিনি আমায় পুনায় এসে কিছুদিন থাকতে বললেন। পুনায় যাওয়ার পর তিনি আমায় খুব বোঝালেন। বললেন, ‘গোটা জীবনটাই পড়ে রয়েছে তোমার সামনে। এভাবে সব সময় অপমানিত হয়ে থাকবে কেন? আবার বিয়ে করো।’ পুনার এক ভদ্রলোক ওঁর বন্ধু ছিলেন। ধনী লোক। ওঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হল। বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়িতে লিখলাম বিয়ের কথা। তুমুল গোলমাল বেঁধে গেল। ওঁরা বললেন, আর আমার মুখদর্শন করবেন না। আমি গোটা পরিবারের ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি। ঠিকই বলেছিলেন ওঁরা। কলঙ্ক তো বটেই। ওঁরা আমায় কত ভালবাসতেন। তারপর ওঁদেরই যখন বিপদ এল, তখন আমি পালিয়ে গিয়ে ওঁদের বংশে কালি দিলাম। সমাজে আর ওঁরা মুখ দেখাতে পারবেন না। কিন্তু আমিই বা কি করব বলুন? আমার কোনও উপায় ছিল না।
তীব্র সংকটের মধ্যে পড়লেন আশা, বিয়ে করার চার বছরের মধ্যে তাঁর দুটি সন্তান হল। কিন্তু পুরনো শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারলেন না। এদিকে নতুন স্বামীরও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী-র সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রইল। আগের স্ত্রী মাঝে মাঝেই চলে আসতেন। বোঝাতে চাইতেন যে সম্পত্তির ওপর তাঁর ছেলেমেয়ের দাবি অটুট রয়েছে। একটি ছেলে এ-বাড়িতে এসেই থাকতে শুরু করল। আশার সঙ্গে একাধিক সাক্ষাৎকারের পর আমার মনে হয়েছিল আশা নিজেও নিজেকে খানিকটা তাঁর স্বামীর রক্ষিতা হিসেবেই ভাবতেন, স্ত্রী হিসেবে নয়। আগের পক্ষের স্ত্রী যখন আসতেন, তখন তাঁর কেমন লাগত জিজ্ঞেস করাতে আশা একটু আশ্চর্য হয়েই আমায় বললেন, ‘কেন? ওর তো আসার অধিকারই ছিল।’
ব্রাহ্মণ্যধর্মে বৈবাহিক সম্পর্কের যে গভীর ধর্মীয় ভিত্তি আছে, এটা হয়তো তারই প্রতিফলন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল প্রাক্তন স্বামীর পরিবারের সঙ্গে আশার সম্পর্ক। পুনর্বার বিবাহের পর আশা খুব সহজেই আগের সম্পর্কগুলো মুছে ফেলতে পারতেন। তা না করে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা চালিয়ে গেলেন তিনি। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার পরেও ছোট ননদের সঙ্গে তাঁর চিঠির আদানপ্রদান ছিল। যে নন্দাই একসময় তাঁকে নানারকম প্রস্তাব দিতেন, তিনি অবশ্য আশার চরিত্র সম্বন্ধে সব চেয়ে বেশি কুৎসা রটিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট ননদ একটা মিটমাট করার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। অবশেষে আট বছর পর ছোট ননদ একদিন পুনায় আশার কাছে এলেন।
আগের পক্ষের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার এত কি প্রয়োজন ছিল? আশার বক্তব্য, তাঁর ছোট ননদের প্রতি ভালবাসার জন্যই তিনি এত সচেষ্ট ছিলেন যাতে একটা কোনও সম্পর্ক বজায় থাকে।
‘আমার যখন বিয়ে হয়, এই ননদটি তখন খুব ছোট। সে সবসময় আমার সঙ্গেই থাকত। নানারকম খেলা তৈরি করেছিল আমার সঙ্গে। আমরা একজন আর একজনের দুপাট্টা পরতাম। এক থালায় খেতাম। সে এক গ্রাস আমার মুখে পুরে দিত, আমি এক গ্রাস ওর মুখে দিতাম। অন্যেরা আমাদের দেখে হাসত। খুব মজা হত।…আমার স্বামীর সঙ্গে তো খুব একটা বেশি দিন থাকতে পারিনি। ফুল ফুটতে না ফুটতেই যেন ডাল থেকে পেড়ে নিল কে। আমার শখ-আহ্লাদ ছিল অনেক। অন্য সময়, অন্য অবস্থায় সে সব মিটত নিশ্চয়ই। কিন্তু এটা নিশ্চিত জানতাম, ওই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা আমায় রাখতেই হবে।’
দ্বিতীয় বিয়ের তাৎপৰ্যটা তাহলে কি? আপাতদৃষ্টিতে সে বিয়েটা তো সুখের। সুন্দর দুটি মেয়ে হয়েছে আশার। তাদের নিয়েই থাকেন সবসময়
হ্যাঁ, খুব সুখে আছি। এরকম স্বামী পাওয়া আমার সৌভাগ্য। উনি আমায় কোনও কষ্ট দেননি। আমিও যথাসাধ্য ওঁর যত্ন করি। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়েটা তো করতে হল এই পোড়া শরীরটার জন্য। তার তাড়নাগুলো তো আমি সামলাতে পারি না। শুধু আমার নিজের তাড়নাই নয়, পুরুষেরা যখন আমার দিকে তাকাত, আমার তো তখন কিছু করার থাকত না। ওরা তো আমায় দেখত না, আমার এই শরীরটাকে দেখত। নন্দাই যদি আমার দিকে নজর না দিতেন, আমি হয়তো শুদ্ধ হয়েই থাকতে পারতাম, বিধবার যেমন থাকা উচিত। কিন্তু ওই ঘটনার পর আমার ননদের সামনে আর দাঁড়াতাম কি করে? পরলোকে স্বামীর সামনেই বা দাঁড়াতাম কি করে? এখনকার স্বামীর সঙ্গে তো সাময়িক বোঝাপড়া। সমুদ্রে ঝড় উঠলে দু-টুকরো কাঠে যেমন হঠাৎ ঠোকাঠুকি লেগে যায় আর পরক্ষণেই আলাদা আলাদা ভেসে চলে যায়, সেই রকম। ওনার সঙ্গে সব দেওয়ানেওয়া এ-জন্মেই চুকিয়ে ফেলতে হবে। তা হলে আর আমার কোনও দুঃখ থাকবে না। ওনার তো আর একজন স্ত্রী আছে। ঈশ্বরের চোখে সেই ওঁর পাশে থাকবে। আমি তো পাপী।
মনে হতে পারে তাঁর মৃত স্বামীর প্রতি আশার একটা গভীর টান আছে। কথা বলতে গিয়ে কিন্তু দেখেছি, স্বামীর চরিত্রটা তাঁর কাছে খুবই ধোঁয়াটে। একবার যেমন বললেন, স্বামীর সঙ্গে ওঁর কয়েকটা পুরনো ফটোগ্রাফ আছে। ‘সেগুলো দেখলে মনে হয় অচেনা দুটো লোক।’ ওঁর কথাবার্তায় ননদেরাই অনেক বেশি জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হত। বিশেষ করে ছোট ননদ যে পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত একটা সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। মনজিতের ক্ষেত্রে যেমন দাদা, ঠিক তেমনি আশার ক্ষেত্রে তাঁর নন্দাই—যাকে রক্ষক হিসেবে ভেবেছিলেন, তার দিক থেকেই যখন আক্রমণটা এল, আশার পরিচিত জগৎটা খানখান হয়ে গেল। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সম্পর্কটা জোড়া লাগল শেষ পর্যন্ত অন্য মেয়েদের সাহায্যে। আশা কিন্তু মেয়েদের এই স্বতন্ত্র সামাজিকতার শক্তি সম্বন্ধে সচেতন ভাবে কিছু বলতে পারেননি। প্রচলিত স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে দিয়েই তাঁর জীবনকাহিনী বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
অনুবাদ: পার্থ চট্টোপাধ্যায়