গান্ধী যখন মহাত্মা – শাহিদ আমিন

গান্ধী যখন মহাত্মা – শাহিদ আমিন

১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গান্ধী পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলায় আসেন। এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাত্রেই বারাণসীতে ফিরে যান। জনসমাবেশে এক থেকে আড়াই লাখ মতো মানুষ তাঁকে আবেগপূর্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু বিহারের চম্পারনে অথবা গুজরাটের খেড়ায় গান্ধীজি যেমন বেশ কিছুকাল কাটিয়েছিলেন, গোরখপুরকে তিনি তেমন কোনও সময় দেননি, যাতে কৃষক আর জনসাধারণের আন্দোলন সেখানে গড়ে উঠতে পারে। এই অঞ্চলে সশরীরে গান্ধী ছিলেন একদিনেরও কম, কিন্তু মহাত্মার কল্পরূপ পরবর্তী মাসের পর মাস জনমনের চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিল। এমন কী ১৯২১-এর এপ্রিল-মে নাগাদ স্থানীয় কিছু কংগ্রেসকর্মীর কাছেও এই দেবত্ব আরোপ (পায়নিয়র পত্রিকার ভাষায় ‘আনঅফিসিয়াল ক্যাননাইজেশন’) বেশ ভয়াবহ ঠেকে।

এই কয়েক মাসের সময়সীমায় নেহাতই ছোট সেই জায়গাটিতে মহাত্মার কর্ম এবং জীবনের প্রভাব কীভাবে পড়েছিল, তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। কৃষকের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ঐতিহাসিকদের কাছে বিষয় হিসাবে অসামান্য। এই প্রবন্ধে সেই সম্বন্ধের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গান্ধীর ‘ক্যারিসমা’র উপাদানসমূহ নয়, বরং কীভাবে ব্যাখ্যার অতীত তাঁর সেই ক্ষমতা কৃষকচৈতন্যকে স্পর্শ করেছিল, তাই আমাদের বিষয়। এমন কাজে ঐতিহাসিক দলিলপত্রই একটা মূল বাধা। মহাত্মার প্রতাপ নিয়ে যে গুজব গোরখপুরের পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছিল, তার সবগুলিরই প্রকাশ ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে। যে কাহিনীগুলি আমরা নির্বাচন করেছি, তার প্রতিটিই ওই সময়সীমার অংশ। তাই ১৯২১ সালের গোড়ায় চৌরিচৌরার দাঙ্গা অথবা অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহাত্মার কল্পরূপে কী পরিণতি এনেছিল, তা পুরোপুরি জানা যায় না। নির্বাচিত কাহিনীগুলির ভিত্তিতে বুঝতে চেষ্টা করব, গান্ধীকে নিয়ে কী ছিল কৃষকমনের অনুভব, লোকায়ত বিশ্বাসে মহাত্মার অবস্থানই বা কোথায়, কৃষকের প্রতিবাদে কী তার প্রভাব, যে প্রতিবাদ অনেকাংশেই কংগ্রেসী বিশ্বাসের ছকে ঢালা ব্যাখ্যা থেকে আলাদা।

উনিশ শতকের শেষ দশকে গৌ-রক্ষণী সভার প্রসার, পরে নাগরী আন্দোলনের অগ্রগতি, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে হিন্দি সাংবাদিকতা ও হিন্দু সমাজ-সংস্কার, এগুলোই ১৯১৯-২০ পর্যন্ত গোরখপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। জেলার বিভিন্ন স্তরের লোকেরা এই সব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরগনার ভূতপূর্ব রাজারানিরা, জমিদার-বংশের প্রতিনিধিবর্গ, স্কুলশিক্ষক, পোস্টমাস্টার, নায়েব, তহশীলদার, আহির এবং কর্মী রায়ত, সবাই সেই আন্দোলনে মেতে ওঠে। যদিও সেই আন্দোলন সম্বন্ধে আহির আর কুমীদের ধারণা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম কুড়ি বছরের ঘটনাসমূহ মূলত গণ্যমান্য বণিকশ্রেণীর সাহায্যনির্ভর, তবু বুদ্ধিজীবী, ধর্মপ্রচারক এবং গ্রামবাসীদের অংশবিশেষও সেই ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গড়ে ওঠেনি রাওলাট অ্যাক্ট-এক বিরোধিতায় কোনও আন্দোলন, যেমন হয়েছিল পঞ্জাবে, জন্ম নেয়নি অযোধ্যার সমতুল কোনও কিযাণ সভা-আন্দোলনও। গোরখপুরের গৌ-রক্ষণীসভাগুলি সমাজ-সংস্কারের প্রয়াসে বিংশ শতাব্দীর ‘সেবাসমিতি’ হিতকারিণী সভাগুলির পথ প্রদর্শক। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গোরখপুরে সমাজ-সংস্কার, হিন্দিভাষা বা হিন্দুধর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠন আর আন্দোলনগুলো ছিল জাতীয়তাবাদী কর্মধারায় অপ্রত্যক্ষ সাহায্যের মতো।

জাতি বা বর্ণকে ভিত্তি করে যেসব সভা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন ১৯২০-র ডিসেম্বরে ভিতিগ্রামে ভূমিহার-রামলীলামণ্ডল, উদ্দেশ্য শ্রীরামচন্দ্রজীর প্রকৃত চরিত্র উদ্‌ঘাটন করে একতা ও সত্যাগ্রহ প্রচার। একইভাবে নিম্ন আর মধ্যবর্ণের পঞ্চায়েতে দেখা গেল আহারের ব্যাপারে নতুন বাছ-বিচার। আসলে এ-সবই আত্মপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যার প্রকাশ মেয়েদের পরের বাড়িতে কাজ করায় অসম্মতিতে, অথবা সরকার কি জমিদারকে বেগার দেওয়ায় আপত্তিতে। একই সময় মেথর, ধোপা নাপিতের মতো বহু নিম্নবর্ণের মানুষ মদ মাংস ছেড়ে দেয়। আচার অনুষ্ঠানে যারা ছিল অশুদ্ধ, তাদের এই আত্মশুদ্ধির প্রয়াস অনেক ক্ষেত্রেই নিগ্রহের চিহ্নসমূহকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার সমতুল। উনিশ শতকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা প্রায় সকলেই মাংসাশী ছিল। ১৯২০ সালে হঠাৎ মাংস ছেড়ে দেওয়া তাদের দিক থেকে একটা জাতে ওঠার বা ‘সংস্কৃতায়ন’-এর প্রচেষ্টামাত্র নয়। মদ-মাংস, অন্যান্য নেশাদ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা জেলাশাসকদের জানিয়েছিল চিরাচরিত বেগার দেওয়ায় তাদের আপত্তির কথাও।

১৯২০ সালের গোরখপুরকে কোনওভাবেই কংগ্রেস অথবা স্বাধীন কিষাণ সভার দুর্গ বলা চলে না। কংগ্রেস সাপ্তাহিকী স্বদেশ-এর সম্পাদক গোরখপুর, বস্‌তি, আজমগড়ের এই অবস্থা নিয়ে একাধিকবার আক্ষেপ করেছেন। উপযুক্ত কর্মনিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবই এমন পরিস্থিতির হেতু, এই ছিল তাঁর যুক্তি। গোরখপুর শহরে, এমন কী দেওরিয়া, বাহরাজ বাজারের মতো ছোট শহরেও রাজনৈতিক সভা জোরদার হয় ১৯২০-র জুলাই-আগস্ট থেকে। ওই সময় কাউন্সিল নির্বাচনে রাজা রইস এবং উকিলদের প্রচারের বিরোধিতা করা হয়, সরাসরি প্রশ্ন ওঠে অত্যাচারী জমিদার আর স্বার্থান্বেষী উকিলদের সততার বিষয়ে। বহু খোলা চিঠি প্রকাশিত হয় স্বদেশ-এ, যার মূল বিষয় বড় জমিদারদের কৃষক নিপীড়ন। এতদূরও শোনা গেল যে প্রজাদের হয়ে কথা বলবার কোনও স্বাভাবিক অধিকার রাজাদের নেই। ডিসেম্বর ১৯২০-র নাগপুর কংগ্রেস আর কাউন্সিল নির্বাচন বয়কট-এর ধারাবাহিকতাতেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার মহাত্মার আত্মিক জীবনীর অংশ হিসাবে জোর পায়। ১১ নভেম্বরের স্বদেশ-এ প্রথম পৃষ্ঠায় দশরথ দ্বিবেদীর জোরাল সম্পাদকীয়তে বোল্‌ড হরফে ছাপা হল ভোটদাতাদের উদ্দেশে আবেদনঃ

গোরখপুরের ভোটদাতারা শুনুন! নিজেদের আত্মসম্মানের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হবেন না। পোষা দালালদের থেকে সাবধান। আপনাদের প্রকৃত শুভার্থী কে, সে বিষয়ে অবহিত থাকুন। মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, পণ্ডিত মালভিয়াজী, না সেই সব লোক যারা ভোট ভিক্ষে করতে এখন আপনাদের পিছনে ছুটছে? নিজেরাই ভেবে দেখুন, এসব লোক কী করেছে আপনাদের জন্য, যে কাউন্সিল-এর ভিতর থেকে তারা আপনাদের দুঃখদুর্দশার সম্মান আনবে? এবারে মহাত্মা গান্ধীর দিকে চোখ ফেরান। এই পবিত্র মূর্তি আপনাদের জন্য নিজের তনু মন ধন অর্পণ করেছেন। আপনাদের কল্যাণ করতেই তিনি সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন, জেলে গেছেন, অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও এই মুহূর্তে যে তিনি সারা দেশে ঘুরছেন, এ শুধু আপনাদেরই স্বার্থে। এ হেন মহাত্মা গান্ধীরই উপদেশ—আপনারা ভোট দেবেন না। দেবেন না, কারণ আপনাদের প্রায় তিরিশ হাজার পাঞ্জাবী ভাইদের উপর গুলি চলেছে অমৃতসরে। মানুষকে চলতে হয়েছে বুকে ভর দিয়ে। যাঁরা ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদের কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবধান! সাবধান! কাউকে ভোট দেবেন না।

গোরখপুরে জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্সিল বয়কট নিয়ে যে আলোচনা হয়, এই পাঠ্যাংশটিকে বলা চলে তার প্রতীক। ভোটদানে বিরত থাকার কারণ হিসাবে পাঞ্জাবের অত্যাচার, ব্রিটিশের উদাসীনতার উল্লেখ ছিল সেই লেখায়। লেখাটিতে অনস্বীকার্য যা, তা হল গান্ধীর সাধুসুলভ ব্যক্তিত্ব, দরিদ্রের যন্ত্রণায় যে ব্যক্তি দগ্ধ, আবার একই সঙ্গে নিজের আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য যে দাবি করে। এমনভাবে যদি দেখি, নির্বাচন বয়কট বা ব্রিটিশদরদী প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান ঠেকে ধর্মীয় আচরণের মতো; যে আচরণ মিল খুঁজে পাবে তৎকালীন বহু হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং আত্মশুদ্ধির প্রয়াসে। যা আবার জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রচারকদেরই প্রচার, যাকে পালনীয় ধর্ম বলে মেনে নেন হিন্দু নিম্নবর্ণের অনেক পঞ্চায়েত। এ তবে তেমনই এক অঞ্চল, যার সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ অযোধ্যায় হয়েছে কৃষকবিদ্রোহ, অথচ সেই অঞ্চলটিতে তখনও গড়ে ওঠেনি তেমন কোনও কৃষক আন্দোলন। এ-হেন গোরখপুরে গান্ধী এলেন ১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি।

১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর এক জনসভায় গান্ধীকে গোরখপুরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সভাপতি ছিলেন মৌলবী মকসুদ আলি ফৈজাবাদী, প্রধান বক্তা গৌরীশঙ্কর মিশ্র। সভায় খিলাফত আন্দোলনের বন্দিদের সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। অপর একটি সিদ্ধান্তে অসহযোগই অবশ্যকর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে গান্ধী এবং আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে গোরখপুরে আসবার জন্য তারবার্তা পাঠানো হয়। নাগপুর কংগ্রেসে গোরখপুরের প্রতিনিধিরাও দেখা করেছিলেন গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধী কথা দিলেন, জানুয়ারির শেষে কি ফেব্রুয়ারির গোড়ায় আসবেন গোরখপুরে। প্রতিনিধি দলটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য বাবা রাঘবদাসের নাম। অনন্ত মহাপ্রভুকে ঘিরে যে আধ্যাত্মিক সংগঠন, সেই সময় রাঘবদাস তার নেতা, বাহরাজ-এর পরমহংস আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাও বটে। অসহযোগের যে মন্ত্র রাঘবদাস আর দশরথ দ্বিবেদী নাগপুর থেকে নিয়ে এলেন তার সঙ্গে যুক্ত হল মন্ত্রের প্রবক্তার প্রত্যাশিত আবির্ভাবের উত্তেজনা। খুব তাড়াতাড়ি অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার জেলাকে একটা উৎসবের সাজে সাজিয়ে ফেলল৷ যেন আরও বড় কোনও ঘটনার প্রস্তুতিতে মাতিয়ে দেওয়া হল অঞ্চলটিকে। বাহরাজ-এর কাছে রাঘবদাস আর তাঁর ব্রহ্মচারী শিষ্যদের পদভ্রমণ, নিকটস্থ কুইন অঞ্চলে কৃষকদের কাছে গাওয়া চঙ্গুর ত্রিপাঠীর গান্ধীভজনের সুর তেমন কিছু উত্তেজনা আর প্রতীক্ষার ইতস্তত নিদর্শন। আবার নবপর্যায়ে প্রকাশিত কবি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কাব্যময়তার প্রবল আবেগেও সেই একই উত্তেজনার প্রতিফলন। যে কবিত্বের উদ্দেশ্য সকল মানুষকে শ্রেণী-নির্বিশেষে পরিত্রাতা কৃষ্ণের পুনরায় মর্ত্যে আবির্ভাবের বার্তায় আকুল করে তোলা।

জনগণের উত্তেজনার আভাস মিলবে গান্ধীর গোরখপুর আগমনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনাকল্পনা এবং সংবাদ পরিবেশনায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে গান্ধীর আগমনবার্তা বাধাহীন আগুনের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। স্বদেশ-এর সম্পাদক দশরথ দ্বিবেদীর কাছে শত শত চিঠি আসে, প্রতিটিরই প্রশ্ন গান্ধীর আগমনের সঠিক তারিখ নিয়ে। এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার আবহে ৯ জানুয়ারির স্বদেশ পাঠকদের জানাল যে বারাণসীর আজ পত্রিকায়, কানপুরের প্রতাপ এবং বর্তমান-এ, প্রয়াগের ভবিষ্য পত্রিকায় গান্ধীর আগমনের তারিখ প্রকাশিত হবে, লিডার আর ইনডিপেনডেন্ট কাগজেও থাকবে তার খবর। গোরখপুর জেলার ছ’টি তহশীলে পোস্টার, চিঠি, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি পৌঁছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল স্বদেশ নিজে।

একই সঙ্গে প্রস্তুতি চলছিল কংগ্রেস জেলা পরিষদেও। স্থির হল, একটি জাতীয় বিদ্যালয় উদ্বোধন করবেন গান্ধী, জেলা পরিষদই এ-বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিল। গান্ধীর আগমনবার্তা নিয়ে বক্তারা আগেই চলে যাবেন তহশীলভুক্ত বিভিন্ন অঞ্চলে, বক্তৃতায় তারা কংগ্রেসের আদর্শ প্রচার করবেন, অনুরোধ করবেন জাতীয় বিদ্যালয়ে অর্থ সাহায্যের জন্য। ৮ ফেব্রুয়ারির জনসভা, স্টেশনে স্টেশনে গান্ধীকে দেখবার জন্য বিশাল জনসমাগম প্রমাণ করে যে সংবাদ প্রচারের গতি ছিল যথেষ্ট দ্রুত। ৬ ফেব্রুয়ারির স্বদেশ-এ গান্ধীর আগমন সম্বন্ধে যে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই লেখা থেকে বোঝা যায় গান্ধীর কোন মূর্তি স্থানীয় কংগ্রেসকর্মীরা তুলে ধরেছিলেন; জানা যায় জাতীয়তাবাদী পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবর্গের সঙ্গে এলিট নেতৃত্বের সম্বন্ধটা কোন প্রকৃতির, সেখানে গান্ধীর অবস্থানই বা কোথায়। ‘গোরখপুরের পরম সৌভাগ্য’ শিরোনামের এই সম্পাদকীয়টি দশরথ দ্বিবেদীর লেখা। একজন গোঁড়া জাতীয়তাবাদী তিনি। ভেবেছিলেন, গান্ধীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গোরখপুরের অরাজনৈতিক পরিবেশ বদলে যাবে। সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণের যে নমুনা সম্পাদকীয়তে পাই, তা জরুরি:

প্রার্থনা এই যে গোরখপুরের সাধারণ জনতা কেবলমাত্র মহাত্মাজির দর্শন পেতেই উৎসুক। মহাত্মাজি আসবেন, কৃতার্থ করবেন দর্শন দিয়ে। নিজেদের ত্রাতাকে স্বচক্ষে দেখে মানুষের আনন্দের সীমা থাকবে না। তবে আমার জিজ্ঞাস্য, সরকারের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করছে যারা, এ সময় তাদের কোনও কর্তব্য আছে কি না। হৃদয় থেকে যে উত্তর পাই, তা বলে, নিশ্চয় আছে। তারা যেন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নতজানু হয়ে সেই পরমাত্মার কাছে প্রার্থনা করে, যাতে তিনি তাদের নৌকাকে এই ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছিয়ে দেন।…এই সময় আমাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর অবতীর্ণ হওয়া দেশ এবং সমাজের পক্ষে কতখানি কল্যাণের, তা সহজেই তোমরা বুঝতে পারবে।…কোনওরকম ইতস্তত না করে এগিয়ে এসো জেলার পীড়িত ভাইদের সেবায়। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে বাজাও স্বরাজের শঙ্খ। এই আন্দোলন, যা মহাত্মা গান্ধী তোমাদের কাছে পেশ করছেন, তা তোমাদের কাছে অমৃতস্বরূপ।

সাধারণ মানুষ এবং এলিট কীভাবে গান্ধীর আগমনকে আমন্ত্রণ জানাবে, এ লেখাতে তা পরিষ্কার। সমবেতভাবে গান্ধীদর্শন, দর্শন পেয়ে নিজেদের ভাগ্যবান মানা, আর এই স্বর্গসুখের আস্বাদ নিয়ে নিষ্ক্রিয়, নিপীড়িত জীবনে ফিরে যাওয়া—এই তাদের কর্তব্য। সাধারণ মানুষ এটাই কেবল জানবে যে মহাত্মা গোরখপুরে আসছেন শুধুমাত্র তাদের দর্শন দিতে। স্বরাজ আন্দোলনের আহ্বান তারা নিজেদের ভিতরে নিজেরা অনুভব করবে, এটা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। গ্রামে গ্রামে স্বরাজের শঙ্খ বাজাবে এলিটরা, গোরখপুরের নিপীড়িত ভাইদের আন্দোলন হবে গান্ধীর এলিট-অনুগামীদের প্রেরণানির্ভর। গান্ধীকে দেখতে কৃষকের গোরখপুরে আসা, মফস্বল স্টেশনে গান্ধীদর্শনের আশায় তাদের ভিড়, জাতীয়তাবাদের দর্পণে এ সবই তো অর্থহীন, যদি না নেতারা এই বিপুল জনসমর্থনকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন। কৃষকের এই যাত্রা যে অনেক সময়েই জমিদারের আদেশের বিরুদ্ধে, এবং সে অর্থে এক রাজনৈতিক প্রতিবাদ, এমনভাবেই যে সাধারণ গ্রামবাসী কোনও পণ্ডিতের ব্যাখ্যা ছাড়াই বুঝে নিতে পারে গান্ধীর মন্ত্রকে তার নিজের মতো করে, অনুরূপ কোনও সম্ভাবনা দশরথ দ্বিবেদীর মনে আদৌ দেখা দেয়নি। অথচ পরবর্তী কয়েক মাসে দ্বিবেদীর পত্রিকায় যেসব স্থানীয় খবর প্রকাশ পেল, তাতে দেখি গান্ধীর আগমনে সাধারণের প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের প্রত্যাশার অতীত। গান্ধীর গোরখপুর ভ্রমণ একান্ত সুব্যবস্থায় চিহ্নিত, তৎকালীন জনসমাবেশও বিস্ময়কর। স্বদেশ পত্রিকার বিবরণই বলে দেয়, যে ট্রেনে গান্ধী গোরখপুরে আসছিলেন, তা কীভাবে স্টেশনে স্টেশনে দর্শনপ্রার্থীর ভিড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২১-এ গান্ধী দর্শনের প্রত্যাশা নিয়ে গোরখপুরে যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে বহু কৃষকই এক বছরের ব্যবধানে ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে চৌরিচৌরা রেল স্টেশনের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সম্পূর্ণ অন্য এক ইতিহাস রচনা করতে। গোরখপুরে কৃষকদের মহাত্মাভক্তি যেন খানিকটা উগ্র ঠেকেছিল। মহাদেব দেশাই-এর ডায়েরি থেকে জানতে পারি, দর্শনলাভ ক্রমশই চলে যায় জনগণের অধিকারের পর্যায়ে। ‘জনতার হঠগ্রহ’, যা নাকি মধ্যরাত্রিতেও দর্শন দাবি করে, গান্ধীজির সহ্যসীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

এমন করে যদি গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানায় কৃষক, তাঁর মন্ত্রকে তারা তবে বোঝে কীভাবে? এমন কিছু কি ছিল গান্ধীর বাণীতে, যা দ্ব্যর্থবোধক? গোরখপুরের কৃষককে গান্ধী যা বলেছিলেন, তার প্রধান বক্তব্য এইভাবে সাজানো যায়: (১) হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, (২) যেসব কাজ করা জনগণের পক্ষে অনুচিত—লাঠির ব্যবহার, হাটবাজার লুট, সামাজিক বয়কট, (৩) মহাত্মা তাঁর অনুগামীদের যা যা বর্জন করতে বলেন—জুয়া, মদ- গাঁজা, বেশ্যালয়ে যাওয়া, (৪) উকিলদের কর্তব্য ওকালতি ছেড়ে দেওয়া, সরকারি বিদ্যালয় বয়কট করা এবং সরকারি খেতাব বর্জন করা উচিত, (৫) সাধারণের উচিত তাঁত বোনা, তাঁতিদের উচিত হাতে-বোনা সুতোয় কাপড় তৈরি করা, (৬) স্বরাজ আসন্ন, কিন্তু স্বরাজের জন্য প্রয়োজন তাত্মিক শক্তি ও শান্তি, ঈশ্বরের কৃপা, আত্মত্যাগ, আত্মশুদ্ধি।

গান্ধীর বক্তৃতার বক্তব্যকে তাঁর ভাবাদর্শের মূল উপাদানসমূহে এইভাবে ভেঙে নিয়েই হয়তো গোরখপুরের কৃষক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল।

উপরোক্ত (৩) এবং (৬) সংখ্যক উপাদানকে জড়িয়ে তাঁর প্রতাপ এবং জাদু সম্পর্কে তখনকার যে ধারণা, তা গান্ধী সম্পর্কিত অনেক গুজবের মূলে কাজ করে। কী উচিত আর কোনটা অনুচিত, অর্থাৎ (২) আর (৩) সংখ্যক উপাদান গ্রামের মানুষের কাছে তেমন অর্থবহ ছিল না। কিন্তু উপাদান (৩) আর (৬) একত্রে দেবতুল্য মানুষের আদেশে উপমা পায়। সামাজিক বয়কট ১৯২১-এর আগে প্রায় অপ্রচলিত ঘটনা। গান্ধী গোরখপুরে আসবার পরপরই মানুষ নিজের তাগিদে কি পঞ্চায়েত বা সভার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির কাজে ব্যাপৃত হতে থাকে। গান্ধীর মন্ত্রের প্রসার, আবার একই সঙ্গে তার পরিবর্তনের এটাই প্রণালী। গোরখপুরে তখন যেসব কাহিনী চালু হয়েছিল, তাতে পাই সেই পরিবর্তনের আভাস, ওই বদলের উপর অতি-মানবিকের প্রভাব আর সব কিছুর সঙ্গে মহাত্মার যোগাযোগ।

গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গল্প স্থানীয় পত্রিকায় প্রথম বেরোয় ১৯২১ সালের জানুয়ারির শেষে। স্বদেশ-এর যে সংখ্যা গোরখপুরে তাঁর আগমনের সংবাদ জানায়, তাতেই ছিল আর এক নিবন্ধ, শিরোনাম ‘স্বপ্নে মহাত্মা গান্ধী: উলঙ্গ ইংরেজদের পলায়ন’। এক জন ইঞ্জিন ড্রাইভার, সম্ভবত সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, রাত এগারোটা নাগাদ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তার ঘুম এসে গেল; এক দুঃস্বপ্ন দেখল সে, ঘুম ভেঙে গেল সেই স্বপ্ন দেখে। ইংরেজদের বাংলোর দিকে ছুটে গেল চিৎকার করতে করতে, পালাও পালাও, গান্ধী আসছেন অনেক অনেক ভারতবাসী সঙ্গে নিয়ে, ইংরেজদের ধ্বংস করতে করতে। সেই চিৎকারে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, তাতে সাহেবরা সব বিছানা ছেড়ে উঠে উলঙ্গ অবস্থাতেই ছুটে গেল স্টেশনের দিকে, মেমসাহেবদের বন্ধ করল বাক্স অথবা আলমারিতে। অফিসার অনুপস্থিত, তাই পাওয়া গেল না অস্ত্রাগারের চাবি। কিন্তু ইংরেজরা বলে চলে, বাব্বা, এখনও জয়ধ্বনি কানে ভাসছে, আর আমরা ফিরব না বাংলোয়। সকালে ঘটনা শুনে ইংরেজদের আত্মিক শক্তি নিয়ে ভারতীয়রা খুব একচোট হাসিঠাট্টা করল। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় বারাণসীর আজ পত্রিকায়, পরে স্বদেশ-এ। ইংরেজদের ছোট করে ভারতীয় শক্তিকে বাড়িয়ে দেখবার যে তৎকালীন প্রবণতা, এ কাহিনীর প্রচলন তারই এক নিদর্শন। এমন সব গল্পে ইংরেজকে দেখা হতো নেহাতই দুর্বল এক জাতির চেহারায়, যাদের মনে অহিংস মহাত্মাকে নিয়ে নিদারুণ আতঙ্ক।

গোরখপুর আর উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গান্ধীর সম্বন্ধে এরকম বহু গল্প সে-সময় চলত। কাঠামো আর ধারাবাহিকতার বিচারে কাহিনীসমূহ প্রায় একই রকম। চারটি ভাগে এ ধরনের গল্পসমূহের আলোচনা করা যায়: (ক) মহাত্মার শক্তির পরীক্ষা, (খ) মহাত্মার বিরুদ্ধাচরণ, (গ) গান্ধীবাদী মন্ত্রের বিরোধিতা, বিশেষত খাওয়া-দাওয়া, মদ্যপান আর ধূমপান-সংক্রান্ত ব্যাপারে এবং (ঘ) বরপ্রাপ্তি, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের ফলস্বরূপ হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া, বৃক্ষ বা কৃপের প্রাণলাভ।

(ক) ১। বস্‌তি জেলায় মনসুরগঞ্জ থানার সিকন্দর শাহু ১৫ ফেব্রুয়ারি বললে, মহাত্মাজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি তার কারখানায় আখের রস-ভরা কড়াই দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। কড়াইটি ঠিক মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেল।

২। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ, বসন্তপুরের এক কাহার মহাত্মাজিকে সাচ্চা মানবে বলেছিল, একমাত্র যদি তার বাড়ির চাল উপরে উঠে যায়। লোকটার বাড়ির চাল দেয়াল ছেড়ে একহাত উপরে চলে গেল। আবার স্বস্থানে তা ফিরে এল তখনই, কাহার যখন মহাত্মাকে মেনে নিয়ে কেঁদে উঠল।

৩। ১৫ মার্চ আজমগড়ের এক চাষি বলে, মহাত্মাকে সে সত্যি মানবে, যদি তার দেড় বিঘে জমি সর্ষেতে ভরে যায়। পরের দিন তার গমের ক্ষেতের সব শস্য সর্ষে হয়ে গেল।

৪। ১৫ মার্চ রিয়াজন মৌজার বাবু বীরবাহাদুর শাহী ক্ষেতের ফসল তুলতে তুলতে কিছু মিষ্টি প্রার্থনা করলেন মহাত্মার শক্তি পরীক্ষার জন্য। অকস্মাৎ তাঁর শরীরের উপর মিষ্টিবর্ষণ হলো। মিষ্টির অর্ধেকটা দিলেন তিনি মজুরদের, বাকিটা রাখলেন নিজের জন্য।

৫। ১৩ এপ্রিল মহাত্মাজির নাম করে একটি কড়াই তৈরি হচ্ছিল। এক ঠাকুরের বউ বললেন, কোনও অলৌকিক ঘটনা ঘটলে, তবেই তিনি কড়াইটি মহাত্মাকে নিবেদন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা একটা ধুতিতে আগুন লেগে সেটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যদিও কোনও পোড়া গন্ধ সেখানে পাওয়া যায়নি।

৬। বাহরাজ থেকে স্বদেশ-এর এক পাঠক লিখছেন, দুজন চামার মাটি খুঁড়ছিল, আর কথা বলছিল ভোর গ্রামে সদ্য-আবিষ্কৃত মূর্তিটি নিয়ে। এক জন হঠাৎ বলে, এইখানে যদি একটি মূর্তি বেরিয়ে পড়ে, তবেই সে বিশ্বাস করবে ভোর গ্রামের মূর্তিটি মহাত্মাকে ডাকছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে মহাদেবের একটি মূর্তি সেখানে পাওয়া গেল কাকতালীয়ভাবে। খবর ছড়িয়ে পড়ল, মানুষজন মেতে উঠল দর্শন পেতে, পূজা আর প্রণামী দিতে। স্থানীয় লোকেদের মত হলো যে, সেই প্রণামী দেওয়া উচিত জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।

৭। এমনই আর এক ঘটনা ঘটে বাহরাজ-এর কাছে বাবু শিবপ্রতাপ সিং-এর কুয়োতে। কিন্তু সেখানে লোকে যখন কুয়োর কাছে ছুটে যায় মূর্তিটি দেখবার আশায়, সেটি আর দৃশ্যমান ছিল না।

৮। রুদ্রপুর মৌজায় এক ব্রাহ্মণের অভ্যাসই হল ঘাস চুরি করা। লোকে তাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছে যে এসব কুকাজ বন্ধ করাই মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশ্য। ব্রাহ্মণ বলে, গান্ধীজিতে তার বিশ্বাস আসবে, যদি সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, বা অসুস্থ হয় কি গোবর খায়। ভগবানের এমনই লীলা যে তিন-তিনটি ঘটনাই ঘটে গেল। ঘাস চুরি করতে করতে হঠাৎ তার মনে হল, কে যেন ধরতে আসছে তাকে। চিৎকার শুরু হল তার। তার পর জ্ঞান হারাল, প্রচণ্ড জ্বরে পড়ল সে। লোকজন তাকে বাড়ি নিয়ে এল ধরাধরি করে। কিন্তু খানিক পরেই সে বাইরে গিয়ে গোবর খেল। তিন দিন বাদে তার পরিবারের লোকেরা মানত নেওয়ার পর সে সুস্থ হয়। এই ঘটনার ফলে সেই গ্রাম আর সেই অঞ্চলের সবাই চুরি করা ছেড়ে দিল।

৯। গোরখপুর বিদ্যালয়ের শ্রীবলরাম দাস স্বদেশ পত্রিকায় লিখে জানান যে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে তিনি রুদ্রপুর গ্রামে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। মহাত্মা-নির্দিষ্ট পথ সেখানে সবাই স্বীকার করে নেয়। এক ব্যক্তি শুধু তার পুরনো অভ্যাস ছাড়তে নারাজ, সে ঘাস কাটতে যায়। ফিরে এসে সে পাগল হয়ে গেল, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে লাগল। মহাত্মার নামে পাঁচ টাকা দেওয়ার পর সে শান্ত হয়।

এইসব গল্পে দুটি তথ্য খুব পরিষ্কার। প্রথমত, গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে গান্ধী তখন বিস্তৃত আলোচনার বিষয়। আমি গান্ধীজিতে বিশ্বাস করব, যদি কোনও অলৌকিক সম্ভব হয়, এই যে কথাটি বার বার ফিরে আসে, তা বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর পারস্পরিক কথোপকথনেরই প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, এই গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে অপর একটি ইঙ্গিত নিহিত। উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে অসামান্যকে পূজা করবার যে রীতি লোকায়ত বিশ্বাসের অঙ্গ, গান্ধীর প্রতি মানুষের আচরণ তার সঙ্গে এক হয়ে যায়। উইলিয়াম ক্রুক লিখছেন, এমন সব অসামান্য ব্যক্তিত্বে দেবত্ব আরোপের মূলে ছিল তাঁদের শুদ্ধ জীবনযাপন এবং অলৌকিক ক্ষমতা। জীবনযাপনে শুদ্ধতার শর্তটি গান্ধী তাঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ব এবং কর্মে পূর্ণ করতেন। ভগবৎবিশ্বাসী গ্রামীণ মানুষ এতে দেবত্বের সন্ধান পায়। প্রতিটি কাহিনীই গান্ধীকে দেয় জাদু আর অলৌকিকের অধিকার। ফলে সেলিম চিশতির গল্পে অভ্যস্ত যে কৃষক, তার মনে গান্ধীর চেহারা উপমা পায় কল্পনার ঈশ্বরের অবয়বে।

(১), (৩), (৪) এবং (৫) সংখ্যক আখ্যানে, কোনও ব্যক্তি তার কাজ অথবা পরিপার্শ্বকে জড়িয়ে কোনও প্রার্থনা করে। প্রার্থনা পূর্ণ হওয়াতেই কাহিনীর সমাপ্তি। কিন্তু (২) নং আখ্যান আরও কিছুদূর যায়। যে ব্যক্তি গান্ধীর শক্তি যাচাই করতে চেয়েছিল, তাকে মহাত্মার ক্ষমতার কাছে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করতে হয়। এমন সব কাহিনী কেমনভাবে গান্ধীর নাম ছড়িয়ে দেয় গ্রামে গ্রামান্তরে, সাধারণের আচারকে ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্যে, তার প্রমাণ (৬) সংখ্যক আখ্যান। মূর্তির উদ্দেশে দেওয়া প্রণামী কোনও ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয় না, চলে যায় জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে, যার সঙ্গে গান্ধীর গোরখপুরে আসা সরাসরি জড়িত। (৭) সংখ্যক কাহিনীতে মূর্তিটি অদৃশ্য হয়েছিল এবং খুবই সম্ভব একদল লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোটা গুজবটা ছড়িয়েছিল, এসব প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল এমন অলৌকিক ঘটনাসমূহকে গোরখপুরে গ্রামবাসীর একান্ত স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া। যার ধরনটি হয়তো মেলে ধর্মগ্রন্থপাঠের সঙ্গে। তবে সুপ্ত এক রাজনৈতিক চেতনার প্রভাবও সেখানে নিহিত থাকে।

(২) সংখ্যক আখ্যানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে (৫) সংখ্যক কাহিনীর। দুটি গল্পেই অবিশ্বাসীকে বিশ্বাসী করে তুলছে ভীতি। শাস্তির ভয় পূর্ব ভারতের বহু ধর্মোপাখ্যানেরই বিষয়। সন্দিগ্ধ কাহার অথবা অবিশ্বাসী মহিলা যখন ভক্তি আর বিশ্বাসেই আত্মসমর্পণ করে, মনে হয় এ যেন সেই পাঁচালি কি ব্রতকথার সমতুল, যেখানে দেবদেবীর ক্রোধ অবিশ্বাসীর বিরোধকে ভেঙে দেয়। একই বিষয়বস্তু আরও সুবিন্যস্ত (৮) এবং (9) সংখ্যক আখ্যানে। যেখানে মহাত্মার ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় মানুষ, আর মহাত্মার শক্তি সেই চ্যালেঞ্জকে পেরিয়ে নিজেকে অজেয় প্রমাণিত করে। রুদ্রপুরের ব্রাহ্মণ কোনও এক জন সাধারণ অবিশ্বাসী নয়; গান্ধীর মন্ত্রে উচ্চবর্ণের যে বিরোধিতা, তারই প্রতিনিধি ওই ব্রাহ্মণ। তার বিরুদ্ধতা এক অর্থে সমগ্র গ্রামের বিশ্বাসকেই প্রশ্ন জানায়। কিন্তু অবিশ্বাসের দাম তাকে দিতে হয় শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণায়। কাহিনীর পরিণামে গ্রামের সব মানুষ চৌর্যবৃত্তি বর্জন করে। এক নতুন নীতিবোধ যে গ্রামে জয়ী হল, এ তারই ইঙ্গিত। জয় আরও জোরদার, কারণ যথেষ্ট প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়েই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে।

(খ) ১০। বস্‌তি জেলার দামোদর পাণ্ডে জানায়, দুমারিয়া মৌজায় গান্ধীকে গালাগালি দেওয়ার ফলে এক ব্যক্তির চোখের পাতা জুড়ে গেছে।

১১। চারাঘাটের এক মাইল দূরে উনছাভা গ্রামে অভিলাখ আহীর-এর চার সের ঘি নষ্ট হয়ে যায়, কারণ সে গান্ধীর উদ্দেশে ব্যঙ্গোক্তি করেছিল।

১২। বেনুয়াকুটী মৌজার মৌনীবাবা রামানুগ্ৰহদাস বার বার গান্ধীকে গালমন্দ করেছিলেন। ফলে তাঁর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরতে থাকে। খানিক যত্ন নিলে, অবস্থার কিঞ্চিৎ উন্নতি হয়। মৌনীবাবা তখন যজ্ঞাহুতির আয়োজন করলেন।

১৩। মাঝৌলি থেকে মুরলীধর গুপ্ত লিখে জানিয়েছেন যে, ৮ ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী যখন গোরখপুর থেকে বারাণসী ফিরে যাচ্ছিলেন, সালেমপুর স্টেশনে তাঁকে দেখবার জন্য এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। সেই জনসভায় এসেছিল এক বারাই অর্থাৎ পানপাতার চাষির ছেলে। স্টেশনে আসবার সময় এক ব্রাহ্মণীর কাছে সে একটি চাদর চায়। ব্রাহ্মণী সেই অনুরোধ ক্রোধের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন। ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে কোনওমতে স্টেশনে এসে মহাত্মাকে দেখে বাড়ি ফিরে যায়। সকালবেলা আমি গ্রামে গুজব শুনলাম যে সেই ব্রাহ্মণীর গৃহে বিষ্ঠাবর্ষণ হয়েছে। শেষে ব্রাহ্মণী চব্বিশ ঘণ্টা নির্জলা উপোস আর মহাত্মাজির আরাধনায় শান্তিস্বস্ত্যয়ন করলেন।

১৪। বস্‌তি জেলার হরিহরপুর কসবায় এক রইস বাবু জ্ঞানপাল দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করছিল নিজের পিতার অন্তিম ইচ্ছানুসারে। সে ছিল গান্ধীবিরোধী; প্রজাদের ভয় দেখাত, যদি কেউ গান্ধীর শিষ্য হয়, এমন কি তাঁর নাম উচ্চারণ করে, পাঁচ টাকা জরিমানা হবে। চতুর্ভুজ এক বিশালাকার পুরুষ আবির্ভূত হলেন ৪ এপ্রিল রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ, জনসমাবেশে তিনি বললেন, “আমি শিবভক্ত। তোমরা সবাই শিবকে ভজনা কর। বাবুসাহেব, নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দেবেন না। সত্য বলুন, অধর্ম বর্জন করুন, ধর্মকে অনুসরণ করুন’। এর পর সেই মূর্তি ধীরে ধীরে তাদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রথম চারটি আখ্যানে শারীরিক যন্ত্রণা এবং শুদ্ধতাহানিকে দেখা হয়েছে গান্ধীর বিরুদ্ধাচরণে দৈবিক শাস্তিস্বরূপ। (১৪) সংখ্যক আখ্যানে শরীরের যন্ত্রণার পরিবর্তে আসল দেবতার হুঁশিয়ারি, যার প্রকাশ এক জনসমাবেশে। ফলে যাদের সামাজিক অবস্থান বাবুটির নীচে, তাদেরই সামনে বাবুর ইজ্জৎ ভাঙচুর হয়ে যায়।

‘সন্ন্যাসী’, ‘বাবা’—এই ধরনের লোকেরা জাতীয়তাবাদী মন্ত্রকে লোকায়ত বিশ্বাসে মিলিয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিলেন, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু (১২) সংখ্যক আখ্যানটি ভিন্ন এক ইঙ্গিতেই পূর্ণ। মৌনীবাবা তার মৌন ভেঙেছিল গান্ধীর সমালোচনা করতে। ফলে যে পরিণতি তার হয়, তাতে বুঝি, গ্রামের মানুষ স্থানীয় সাধুটির কথা আক্ষরিক অর্থে মানেনি। সাধুর যন্ত্রণা যে গান্ধী বিরোধিতারই পরিণতি এমন ব্যাখ্যা বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মৌনীবাবার কাছেও এই বিশ্লেষণ বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে, তাই তিনি যথোপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করেন। জানি না ওই ব্যাখ্যার আদিকর্তা কে, কোনও স্থানীয় কংগ্রেস নেতা, নাকি সাধারণ মানুষ। কংগ্রেস মহলে ব্যাখ্যার সূত্রপাত হলেও, তার প্রচলন, এবং এমন আরও অনেক কাহিনীর চলন বৃহত্তর এক বিশ্বাসেরই ইঙ্গিত।

দর্শনপ্রার্থীর নিষ্ঠা তাকে কতদূর কষ্টসহিষ্ণু করে, (১৩) সংখ্যক আখ্যানে তা দেখি। এও দেখি যে মহাত্মা-বিরোধীর যন্ত্রণা বা অশুদ্ধতা কীভাবে বাড়তে থাকে। উপবাস এবং পূজা প্রায়শ্চিত্তের অঙ্গ। গল্পটি পড়লে বোঝা যায়, গুজবের গতি কী দ্রুত, তার শক্তিই বা কী মারাত্মক। এই আখ্যানে ব্রাহ্মণী ছেলেটিকে কেবল সক্রোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু রায়কিশোর চাঁদ বা বাবু জ্ঞানপালদেবের মতো বড় জমিদার প্রজাদের গান্ধী দর্শনে আরও প্রত্যক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়ান। (১৪) সংখ্যক কাহিনীটির একাধিক ব্যাখ্যা আছে। স্বদেশ-এ এই কাহিনী যিনি লিখে পাঠান, সেই যমুনাপ্রসাদ ত্রিপাঠী বাবু জ্ঞানপালদেবের সঙ্গে একমত যে এক দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রথমজন ঘটনাকে দেখছেন গান্ধী-বিরোধীর প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধের উপমায়। বাবু জ্ঞানপালদেব তা অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শিবপূজার উন্নতি প্রকল্পেই ওই আবির্ভাব। অতিপ্রাকৃতের সেই উপস্থিতিকে কৃষক কোন অর্থে বুঝেছিল, তা সঠিক জানা যায় না। তবে এমন চিন্তা অমূলক নয় যে তাদের কাছে ঘটনাটি জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দৈবতিরস্কার।

(গ) ১৫। গোরখপুর থেকে এক ভদ্রলোক লিখে জানান, আলিনগর মহল্লার এক মোক্তার তার বাড়ির মেয়েদের চরকা কাটতে বলেছিলেন। মেয়েরা বলে, তাদের তো কিছুরই অভাব নেই, কেন তারা অকারণে চরকা কাটবে? ঠিক সেই সময় বাড়ির একটি তোরঙ্গে কাকতালীয়ভাবে আগুন ধরে যায়। গোটা শহরে এই খবর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

১৬। বিস্তাউলি মৌজায় এক ফৌজদারি মামলা চলছিল। পুলিশ সেখানে পৌঁছলে, আসামী, প্রতিবাদী উভয় পক্ষই মিথ্যা ভাষণ করে। একজন মহাত্মার প্রতাপের দোহাই দিয়ে মিথ্যা ভাষণ থেকে বিরত হতে বলল তাদের। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ লিখে নেওয়ার পরেই আসামীর পুত্রবধূ মারা যায়।

১৭। আজমগড় থেকে শ্রীতিলকধারী রাই লিখে জানান, মৌজাগাজিয়াপুরে ১৮ ফেব্রুয়ারির সভায় স্থির হল যে গবাদিপশু আর ছাড়া থাকবে না। কাদের চৌকিদার এই প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে সে তার কথা রাখেনি। সে অঞ্চলের মানুষজন প্রতিজ্ঞার কথা তাকে মনে করিয়ে দিলে, কাদের বলল, গবাদিপশু সে ছেড়েই রাখবে, দেখবে পঞ্চায়েত বা গান্ধীজি কী করতে পারেন। এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটার পা ফুলে উঠে যন্ত্রণা শুরু হয়। সে ফোলা আজও কমেনি।

১৮। দেওরিয়া থেকে বিশেষ প্রতিনিধি জানালেন, উকিল বাবু ভগবানপ্রসাদের কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! তার বাড়ির চারদিকে বিষ্ঠা; বাড়ির একটি মূর্তি, যা রাখা থাকত ট্রাঙ্কে, হঠাৎ পড়ে গেছে বাড়ির ছাদ থেকে। ভদ্রলোক বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরেও, চারপাশের সেই বিকট অবস্থা বদলায় না। শহরের অশিক্ষিত মানুষ বলে, উকিলসাহেব অসহযোগ নিয়ে আলোচনারত এক ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করেছিলেন, তাই এই দুরবস্থা।

১৯। দেওরিয়ার নামকরা উকিল ভগবানপ্রসাদের স্ত্রীর অবস্থাও অদ্ভুত। যেখানেই তিনি বসেন, চারপাশেই বিষ্ঠা দেখেন। যে পাতার উপর খাবার থাকে, সেখানেও মাঝেমধ্যে দেখেন বিষ্ঠা। বাড়িতে যে মূর্তি আছে, পূজার পর তাকে রাখলে সে অদৃশ্য হয়, অথবা উঠে যায় ছাদে কি পড়ে যায় ছাদ থেকে। কাউকে তিনি পুরি খেতে দিলে, চারটের জায়গায় দুটো কি পাঁচটা দিলে তিনটে থাকে। এ কথা সত্যি নয় যে মহিলাকে গান্ধীর এক অনুগামী অভিশাপ দিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, উকিল সাহেব কলকাতা কংগ্রেসে গিয়েছিলেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ওকালতি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ফিরে এসে কথা রাখেননি। তখন গান্ধীজির শিষ্যরা তাকে অভিশাপ দেন। তাই নাকি তিনি যত্রতত্র বিষ্ঠা দেখেন, এমনকি তাঁর আহার্যও মাঝেমধ্যে রূপান্তরিত হয় বিষ্ঠায়। এ সবই অসত্য। উকিলসাহেব দিব্যি আছেন। ওসব তিনি কিছুই দেখেন না। কলকাতায় কখনওই যাননি তিনি, ওকালতি ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলেননি, কেউ কোনও অভিশাপও দেয়নি তাকে। তার বউ বাড়িতে যেসব ঘটনা দেখে থাকেন, সে সবই ভূতের লীলা।

২০। ১১ এপ্রিল পরাশিয়া আহীর-এর গ্রামে কয়েকজন জুয়া খেলছিল। স্বদেশ পত্রিকার লেখক কাশীনাথ তেওয়ারি তাদের বারণ করেন। সবাই তাঁকে মেনে নেয়, কেবল একজন ছাড়া। সে গান্ধীজির উদ্দেশে গালিগালাজ আরম্ভ করে। ঠিক পরদিনই তার ছাগলকে তারই চারটে কুকুর কামড়ে দেয়। ফলে লোকটি এখন বেজায় অখুশি— সে মেনেও নিয়েছে তার কসুর।

২১। রাও চক্রীপ্রসাদ লিখেছেন, ভাত্‌নি স্টেশনের কাছে এক পানবিক্রেতার ছেলেরা ছাগল মেরে তার মাংস খেয়েছিল। যারা বাধা দিয়েছিল, তাদের কারও বারণই ছেলেরা মানেনি। একটু পরেই তারা বমি করতে থাকে, ভয় পেয়ে যায় সবাই। শেষ পর্যন্ত তারা মহাত্মার নামে শপথ নেয়, আর কোনওদিন মাংস খাবে না, সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থার উন্নতি হয়।

২২। বস্‌তি জেলার রামপুর গ্রামে এক পণ্ডিতকে বার বার বলা হয়েছিল মাছ খাওয়া ছেড়ে দিতে। বহু নিষেধ সত্ত্বেও পণ্ডিত অভ্যাস ছাড়েনি, বলেছিল মাছ সে খাবেই, দেখবে মহাত্মাজির দৌড় কতখানি। খেতে বসে সে দেখে, তার মাছভর্তি পোকা।

২৩। গোরখপুর জেলার নৈকট থানার বাবু ভগীরথ সিং লিখলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি বাবু চন্দ্রিকাপ্রসাদের পরামর্শে তাঁর রায়তরা মাদকদ্রব্য বর্জনের প্রতিজ্ঞা করে। এক কালোয়ার কিন্তু তার কথা রাখেনি। শুড়িখানার দিকে এগোনোর পথে, তার চারদিক থেকে ইঁট পড়তে থাকে। সে আন্তরিকভাবে মহাত্মাকে স্মরণ করলে ইঁট পড়া বন্ধ হয়।

২৪। গোদবাল গ্রামে ২২ ফেব্রুয়ারি এক সাধু এসে গাঁজার ছিলিমে টান দিচ্ছিল। মানুষজন তাকে থামাতে চাইল, শুরু হল মহাত্মার প্রতি তার কটুকাটব্য। পরদিন সকালে দেখা গেল, তার দেহ বিষ্ঠায় ভরা।

২৫। আজমগড় জেলায় পাহাড়িপুর গ্রামে পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ মিশ্র লেখেন যে কমলাসাগর মৌজার একটি সভায় স্থির হয়, কেউ কোনওরকম নেশা করবে না। পরে দুজন লোক লুকিয়ে লুকিয়ে খৈনি খাচ্ছিল। হঠাৎ একটা বাছুরের কাটা পা এক চতুর্বেদী সাহেবের বাড়ির সামনে পড়ে। এই অস্বাভাবিক ঘটনায় সবাই তামাক খৈনি ইত্যাদি বর্জন করে।

২৬। মাঝ্‌ওয়া মৌজার এক ব্যক্তি ধূমপান ছেড়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু কথা সে রাখতে পারেনি। ফলে চারপাশ থেকে নানাবিধ পোকামাকড় ঘিরে ধরে তাকে। এই খবরে মাঝ্‌ওয়ার দূরবর্তী অঞ্চলের লোকেরাও নেশা ছেড়ে দেয়।

২৭। দাভানি জেলায় পানবিক্রেতা একটি মেয়ে ধূমপান করত। একদিন স্বপ্নে সে দেখে, ধূমপানকালে হুঁকোটি আটকে গেছে তার মুখে। মেয়েটি ভয় পেয়ে প্রতিজ্ঞা করল, ধূমপান সে ছেড়ে দেবে।

এই সব আখ্যানে দেখি সেই একই ধারাবাহিকতা—ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, শুদ্ধতাহানি, প্রায়শ্চিত্ত—যার একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। ধারাবাহিকতায় লক্ষণীয় যে গান্ধীর মন্ত্র অনুযায়ী যা কিছু নিষিদ্ধ, তাকে সিদ্ধ করতে চাইলেই যন্ত্রণা অথবা শুদ্ধতাহানির সূত্রপাত। বুঝি, শুদ্ধতার যে গান্ধীবাদী সংজ্ঞা, তা লোকায়ত ধ্যানধারণাকে নিশ্চিতভাবে স্পর্শ করেছে। (১৮) এবং (১৯) সংখ্যক আখ্যান একই ব্যক্তি বা পরিবারকে ঘিরে। এ গল্পের দুটি আলাদা পাঠ আমরা পাচ্ছি, একটি স্বদেশ থেকে, অন্যটি ইংরেজের অনুগত জ্ঞানশক্তি পত্রিকা থেকে। স্বদেশ পত্রিকার লেখক জনপ্রিয় ব্যাখ্যা থেকে নিজেকে তফাতে রাখেন, যেমন ‘শহরের অশিক্ষিতদের মতে’, নিজের কোনও ভিন্ন ব্যাখ্যা তিনি নির্মাণ করেন না। কার্যত দেওরিয়ার অশিক্ষিতদের ভাবনাই তাঁর লেখার মাধ্যমে চালু হয়ে যায়। জ্ঞানশক্তি-র সম্পাদক উর্পযুক্ত ব্যাখ্যার প্রতিটি ভাবাদর্শকেই খণ্ডন করেন। গৃহের অশুদ্ধতাকে তিনি মানেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে উকিল স্বামীর থেকে তাঁর স্ত্রীরই ক্ষতি বা দায়, দুইই বেশি। স্ত্রীর ওই অস্বস্তির মূলে স্বামীর কোনও আচরণের তেমন ভূমিকা নেই। লেখক দেখান, স্বামীর সম্পর্কে গুজবগুলো সবই মিথ্যে। কংগ্রেসের কাছে কোনও প্রতিজ্ঞা করেননি তিনি, শারীরিক বা মানসিক আরামেরও কোনও অভাব নেই তাঁর। অস্বাভাবিক ঘটনাবলী নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও, তার ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। প্রচলিত বিশ্লেষণে গুজবটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি প্রসারের অংশ হয়ে যায়। ব্রিটিশ অনুগামী জনশক্তি-র কলমে এই বিশেষ দিকটি অনুপস্থিত। তথ্যখণ্ডনের প্রণালীতে মহাত্মা গান্ধীর স্থান নিল সেখানে ভূতের লীলা।

গান্ধীর মন্ত্রের জনপ্রিয় ব্যাখ্যার দিকটা অন্য কয়েকটি আখ্যানে আরও প্রকট। এখানে কাকতালীয় আর ঘটনাপরম্পরা কার্যকারণের স্থানে প্রতিষ্ঠিত। গোরখপুরের শ্রোতৃবৃন্দকে গান্ধী মাছ-মাংস পরিত্যাগ করতে বলেননি। অথচ (২১), (২২) বা (২৪) সংখ্যক আখ্যানে গান্ধীর ভাবরূপ এবং প্রতাপ কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়, ঘটনাপরম্পরায় বৃহত্তর অর্থসমূহ প্রাধান্য পেয়ে যায়। ‘আমি মাছ-মাংস খাব, ধূমপান করব, গাঁজা-তাড়ি-মদ খাব, দেখি তোমার মহাত্মাজি কী করতে পারে’, গান্ধীর প্রতি এই অবজ্ঞাপূর্ণ বিরোধী মন্তব্যই গুজবের জন্ম আর প্রচলনে জরুরি। মিতাচারের পক্ষ আর বিপক্ষের সংলাপে গান্ধীর নাম কীভাবে ব্যবহৃত, সে ইঙ্গিত কাহিনীগুলিতে পরিষ্কার। গান্ধীর পথকে মানতে চাইল না যারা, তাদের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী; সে সর্বনাশের সামাজিক তাৎপর্য এবং প্রায়শ্চিত্ত লোকায়ত বিশ্বাসকে অন্য এক চেতনার আস্বাদ দেয়; যা বোঝায়, স্থানীয় নিয়মে নির্ধারিত এসব রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ ব্যবহারিক জীবনে কত অসম্ভব, কত অবাঞ্ছিত।

খাওয়াদাওয়ার শুদ্ধতা নিয়ে কেন এত উদ্বেগ? এই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর জানবার মতো তথ্য আমাদের নেই। তবে কয়েকটি ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাখ্যা আছে। আগেই দেখেছি ১৯১০ সালে আচার-আচরণের শুদ্ধিকরণ নিয়ে গোরখপুরে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার জের নিরামিষ ভক্ষণ পর্যন্ত গড়ায়। নিরামিষাশী হওয়ার কথা যে শুধু ধর্মপ্রচারকরা বলেছিলেন, তা নয়, নিম্নবর্ণের পঞ্চায়েত যেমন ধোবি, ভাঙ্গি, নাপিত, এরাও ঠিক করে, আহারের নিষেধাজ্ঞা না মানলে, জরিমানা দিতে হবে। ১৯২১-এর গোড়ায় শুদ্ধতার প্রতি এই আসক্তিকে দেখা যেতেই পারে গান্ধীবাদী আত্মশুদ্ধির (যথা মদ-গাঁজা বর্জন) বিস্তার হিসাবে। এই বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিত এমনই যে, নিষেধাজ্ঞা মাছ-মাংস বর্জন পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে সহজেই। সঙ্গে সঙ্গে একে ভাবা যায় ধর্মভাব এবং নিম্নবর্ণের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রমাণ। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯২১-এর জানুয়ারিতে উত্তর বস্‌তির পঞ্চায়েতরা বলে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার যে একান্ন টাকা জরিমানা, তা দেওয়া হবে গৌশালার অর্থভাণ্ডারে।

(ঘ) ২৮। ভাগলপুরের দেবকলি মৌজার পণ্ডিত জীবনন্দন পাঠক লেখেন, ছ-মাস পূর্বে এক মুসলমানের পাত্র কূপে পড়ে গিয়েছিল। মহাত্মাজির কাছে মানত করার পরে পাত্রটি আপনিই আবার উঠে আসে।

২৯। আজমগড়ে নৈপুরা গ্রামে ডালকু আহীর-এর বহুদিনের হারানো বাছুর আবার তার খুঁটিতে ফিরে আসে, মহাত্মাজির উদ্দেশে মানত করার পর। ডালকু আহীর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে মানতের এক টাকা দান করেছিল।

৩০। বার্নিয়া জেলার এক ভদ্রলোক লেখেন, রুস্তমপুর মৌজায় গোয়ালাসাধুর কুঁড়েঘর থেকে নব্বই টাকা সমেত থলিটি উধাও হয়েছিল। মহাত্মার উদ্দেশে মানত করার পর টাকা-সমেত থলি ফিরে আসে।

৩১। দেওরিয়া তহশিল-এ সমগড় মৌজার এক নামী জমিদার ভগবতীজির কাছে মানতে ছাগবলি দেন। সেই মাংসের প্রসাদ অনেকেই নিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জমিদারতনয়ের হাত তার বুকের কাছে আটকে গেল, পাগল হয়ে গেল তার বউ। জমিদার তখন জাতীয় অর্থভাণ্ডারে সেই ছাগলের মূল্য দান করতে সম্মত হন। ব্রাহ্মণ-ভোজন করাবেন, এমন প্রতিজ্ঞাও নেন। ছেলে, ছেলের বউ, উভয়েরই স্বাভাবিকতা ফিরে এল।

৩২। গোরখপুর শহরে হুমায়ুনপুর মহল্লায় উকিলবাবু যুগলকিশোরের বাগানে দুটি গাছ মরে পড়ে গিয়েছিল। আবার তারা সজীবতা ফিরে পায়, উঠে দাঁড়ায় সোজা হয়ে। অনেকেই বলেন, মহাত্মাজির আশীর্বাদ এর মূলে। কারণ, যে লোকটি গাছ কেটেছিল, সে বলে মহাত্মাজির প্রতাপ যদি সাচ্চা হয়, গাছ দুটি আপনিই জীবন ফিরে পাবে। হাজার হাজার লোক রোজ আসে সেখানে, দেয় বাতাসা, টাকা, গয়না। লোকে বলে, এই প্রণামী স্বরাজ আশ্রম এবং তিলক স্বরাজ-অর্থভাণ্ডারে দেওয়া হবে।

৩৩। জ্ঞানশক্তি ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখল, একটি শীর্ণকায় আবৃক্ষ ঝড়ে উৎপাটিত হয়েছিল। গাছটির শাখাপ্রশাখার ভারবহনের পক্ষে তার শিকড় ছিল দুর্বল। গাছটি পড়ে যাওয়ার পরেও, তার মুলের অংশবিশেষ মাটির তলায় ছিল। লোকে যখন জ্বালানির প্রয়োজনে পড়ে-যাওয়া গাছের ডালপালা কেটে নিয়ে যায়, অপেক্ষাকৃত লঘুভার গাছটি সেই শিকড়ের জোরে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লোকের মুখে মুখে চালু হল, গাছটি আপনা থেকেই পুনর্জীবন পেয়েছে। লোকজন জড়ো হয় সেখানে, জায়গাটিতে যেন সর্বদাই মেলা। সকলেই দান করে বাতাসা, ফুল, টাকা। বলা হয় গান্ধীর প্রতাপেই নাকি তার জীবনলাভ। এই মেলা, লৌকিক বিশ্বাসের এই প্রকাশ শিক্ষিতের কাছে হাস্যকর।

৩৪। বস্‌তি জেলার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি স্বদেশ পত্রিকায় ঘটনাসমূহ লিখে পাঠিয়েছিলেন। চাকদেহী গ্রামে মহুয়া গাছের খুঁটি থেকে দুটি গাছ বেরিয়েছিল। কার্তিক মাসে খুঁটিটি পোঁতা হয়। তাতে বাঁধা থাকত এক পাঁড়েজির দুটি মহিষ। গুজব, যে এক চামার দেখেছিল, খুঁটি থেকে গাছটিকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু চামারের বউ সেটি টেনে একেবারে বের করে নেয়। ফলে চামারের উপর খানিকটা চোটপাট করে লোকজন। চামার প্রার্থনা করে, মহাত্মা, ‘তুমি যদি সত্যি সত্যি মহাত্মা হও, এই খুঁটিতে আর একটি গাছের জন্ম দাও’। তাই ঘটল। এখন প্রত্যহ সেই গাছ দেখতে বহু লোকের জমায়েত হয় জায়গাটিতে।

৩৫। বস্‌তি শহরে রঘুবীর কাসাউধন-এর বিধবা থাকেন। বিধবার পুত্রও বছর তিনেক হল মারা গেছে। তার স্বর্গত স্বামী দুটি আমগাছ পুঁতেছিলেন। একটিকে কিছুদিন আগে কেটে ফেলা হয়েছে, অন্যটিও গেছে শুকিয়ে। পনেরো দিন হল, শুকিয়ে যাওয়া গাছে হঠাৎ এসেছে নতুন পাল। বৃদ্ধা সেই বিধবা বলছেন, তিনি মহাত্মাজির কাছে মানত মেনেছিলেন—এই গাছই আমার স্বামীর একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন, একে তুমি বাঁচিয়ে দাও। এই স্থানেও এখন বিরাট জনসমাগম হয়।

৩৬। স্বদেশ, ১৩ মার্চ ১৯২১: গত শনিবার গোরখপুর শহরের গোটা চার পাঁচ কুয়ো থেকে ধোঁয়া বেরতে শুরু করে। লোকের ধারণা হল, কূপের জলে আগুন লেগে গেছে, গোটা শহর ভেঙে পড়ল কূপগুলির কাছে। কিছু মানুষ একটি কূপ থেকে জল তুলল, সেই জলে ছিল ক্যাওড়াফুলের সুবাস। লোকের মনে হয়, এটা মহাত্মাজির প্রতাপের ফল। কুয়োটিতে কিছু টাকা প্রণামী দেওয়া হয়।

৩৭। স্বদেশ, ১০ এপ্রিল ১৯২১: কিছুদিন আগে গোরখপুর সিভিল কোর্টের কাছে এক গ্রামে মারাত্মক আগুন লাগে। গোটা গ্রামই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কাছাকাছি একটি নালা ছিল। কাদা আর জলের আশায় লোকে সেই নালার মধ্যে একটি কাঁচা কুয়ো খুঁড়তে থাকে। অনেক হাত খুঁড়বার পরেও কিন্তু জল মেলে না। লোকমুখে শোনা যায়, সেই সময় কেউ একজন মহাত্মার কাছে মানত করেছিল। হঠাৎ ফোয়ারার মতো জলে উপচে উঠল কুয়ো, ষোলো-সতেরো হাত কুয়োটি ভরে গেল জলে। আশপাশের গর্তগুলিও জলে পরিপূর্ণ হল। তার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে আসছে, ফুল বাতাসা টাকা দিচ্ছে, স্নান করছে, মুখ ধুচ্ছে সেই জলে, বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে সেই জল।

৩৮। ওই একই ঘটনা সম্বন্ধে জ্ঞানশক্তি লেখে: গোরখপুর শহরের বাইরে বুলন্দ্‌পুর গ্রামের দক্ষিণে একটি বিশাল গর্ত আছে, যার গভীরতা ২৩ ফুটের কম নয়। গোরখপুর শহরের জলসীমা ২১ ফুট। অনেক সময় ওই সীমার আগেই জল পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে কুয়ো থেকে জল তুলতে সাধারণত ১১ হাত দড়ি ব্যবহার করা হয়। যে কুয়ো থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়েছে, সেটি এই গর্তের মধ্যে। জল পাওয়া গেলে, তা কুয়োটিকে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়। সেখানে এখন মেলা হচ্ছে। এমন একটি বিশাল গর্তে যখন কুয়ো খোঁড়া হয়, এরকম ঘটনা তো স্বাভাবিক। এ ধরনের কুয়ো অনেক দেখা যায়, যা গর্তের ভিতরেই খোঁড়া আর কানায় কানায় ভর্তি। লোকে বিশেষ কুয়োটিকে এখন টাকা বাতাসা ফুল দিচ্ছে, বলছে এ নাকি গান্ধীর আশীর্বাদের নিদর্শন, কূপের নামকরণও হয়েছে গান্ধীর নামে।…স্বরাজের জন্য কি এমন জ্ঞানবুদ্ধি প্রয়োজন?

৩৯। মির্জাপুর বাজার, যেখানে জল আপনাআপনি বেরিয়ে এসেছে, ভক্তরা সেখানে দান করেছে ২৩ টাকা ৮ আনা ১২ পাই। শীছেদিলাল এই টাকা গোরখপুর স্বরাজ অর্থভাণ্ডারে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেছেন।

৪০। বস্‌তি জেলার বিক্রমজিবাজারে এক কুয়োর জলে দুর্গন্ধ ছিল। দুজন মহাজন মহাত্মাজির নামে মানত করলেন। পরের সকালেই জল শুদ্ধ হয়ে যায়।

৪১। সোনাওরা গ্রামে মহামারী লেগেছে। লোক এসে থাকছে গ্রামের বাইরে এক কুঁড়েঘরে। কিন্তু সেখানকার কুয়ো এতই অগভীর যে ২৭ এপ্রিল একটা লোটাও তার জলে পুরোপুরি ডোবানো যাচ্ছিল না। দেখেশুনে এক মিশ্রজি গান্ধীজির নামে পাঁচ টাকা বিতরণ মনস্থ করলেন। এর পরই জল ক্রমশ বাড়তে থাকে, ২৮ তারিখ দুপুরের মধ্যে জল ওঠে পাঁচ হাত, তার পরদিন এগারো হাত।

কাহিনীগুলিতে আবার দেখছি, মহাত্মার ভাবরূপ লোকায়ত বিশ্বাস আর আচার-অনুষ্ঠানের কাঠামোতেই স্থান পাচ্ছে। আঞ্চলিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মানত করার যে প্রথা, তাই গান্ধীর আরাধনার উপায় (২৮) থেকে (৩০) সংখ্যক আখ্যানে। (৩১) সংখ্যক গল্পে দেখলাম তারই এক ভিন্ন চেহারা। যেখানে ভগবানকে মানত করা ছাগলের জন্য ফল হল হিতে বিপরীত, যেমন উচ্চবর্ণ জমিদার-পরিবারে শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক অসুস্থতা। যার প্রায়শ্চিত্ত শুধুমাত্র ব্রাহ্মণভোজনে সীমাবদ্ধ থাকল না, ছাগলের মূল্য-সমান টাকা দান করতে হল জাতীয় বিদ্যালয়ের অর্থভাণ্ডারে।

কংগ্রেসবিরোধী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা বৃক্ষ কি কূপের জীবনলাভকে (৩৩ নং, ৩৮ নং) যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা করল। অথচ রাজনৈতিক সচেতনতা সে বিন্যাস থেকে লুপ্ত। অঘটনের পার্থিব হেতুর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ব্যাখ্যা। পানীয় জল সরবরাহ এবং সেচব্যবস্থার গুরুত্ব বুঝি কূপ-সংক্রান্ত আখ্যানগুলি (৩৬ সংখ্যক থেকে ৪১ সংখ্যক) থেকে। তবে, এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রধান বিষয়বস্তু এক্ষেত্রে দুটি; প্রথমত, মহাজন কি উচ্চবর্ণের কোনও ব্যক্তির (সাধারণত জমিদার) পানীয় জল শুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মানত (আখ্যান ৪০ এবং ৪১ সংখ্যক); দ্বিতীয়ত, যেসব কূপে অলৌকিকভাবে জল এসেছে, সেখানে জনসাধারণের টাকা, ফুল, বাতাসা ইত্যাদি প্রণামী দেওয়া। দুটি বিষয়ই সহজে বোধগম্য, যদি মনে রাখি জমিদারেরই একমাত্র সামর্থ্য ছিল ইঁদারা নির্মাণের খরচ বইবার, আর গোরখপুরে ইঁদারা নির্মাণ ঘিরে গড়ে উঠেছিল আচারবহুল অনুষ্ঠান।

গোরখপুরে কূপ নির্মাণ নিয়ে পূজার মনোভাব তখন বর্তমান। তাই কুয়োর উদ্দেশে ফুল, বাতাসা, টাকা প্রণামী দেওয়া, বা সেই টাকা জাতীয় বিদ্যালয়ে দান করা, ১৯২১-এর গোড়ায় যা বিশেষ লক্ষণীয়, এই সব কিছুই উপস্থিত ধ্যান-ধারণাকে এক নতুন পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তৃত করছে। গান্ধীর নামে মানত, ব্ৰত বা আরাধনা, কি তাঁর নাম করে মহিলাদের ভিক্ষা চাওয়া, ভোগবিতরণ, সবই সেই একই বিস্তারের অংশ।

স্বদেশ-এর সম্পাদক ১৯২১-এর এপ্রিলে লিখছেন, দেবী ভবানীর নামে ভিক্ষা অথবা ভোগ যেমন প্রচলিত, তেমনি গান্ধীর নামে মেয়েদের ভিক্ষা চাওয়া আর ভোগ দেওয়ার খবর এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এমন কী ঢেঁকিশালে যখন সদ্য রবিশস্য তুলে আনা হয়েছে, মহিলারা আসতেন শস্যভিক্ষা চাইতে, যা লাগবে মহাত্মার ভোগে। ভোগ দেওয়ার যে আচার, তার সমসাময়িক তাৎপর্য সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে মনে হয় ভাগ্য ফেরানোর বিশ্বাস এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল দেবী ভবানীর আরাধনাসংক্রান্ত আচারের বিস্তার; ঢেঁকিশালে ভিক্ষা চেয়ে কৃষকের মনে এমন এক নৈতিক দায়বোধ চারিয়ে দেওয়ার প্রয়াসও বটে, যে শস্য যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আছে, তখন মহাত্মার নামে তা দান করা কর্তব্য। আরও লক্ষণীয়, যে গুড় তৈরি করে যে চাষি, তাকেও এমন দায়ে বদ্ধ করা হত। আখখোয়াড়ে গিয়ে গুড় ভিক্ষা চাওয়া প্রচলিত ছিল। আর সেই স্থান থেকে ভিখারিকে ফিরিয়ে দেওয়া নাকি অমার্জনীয় অপরাধ। ১৯২১-এর ১ মার্চ আজমগড় জেলায় নানুশাক গ্রামে এক আহীরের কাছে গুড় ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিল একজন সাধু। আহীর সাধুকে ফিরিয়ে দেয়। গুজব যে আধ ঘণ্টার মধ্যে আহীর-এর গুড় আর সঙ্গে দুটি মহিষ আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। স্বদেশ পত্রিকায় এ কাহিনীর যে বিবরণ পাই, তাতে গান্ধীর কোনও উল্লেখ নেই। কিন্তু লক্ষ্ণৌ-এর পায়নিয়র পত্রিকা অনুযায়ী, সাধুটি মহাত্মার নামেই ভিক্ষা চাইছিল। সত্যি হোক আর নাই হোক, গান্ধীর নাম যে এ ঘটনার সঙ্গে আরও পত্রিকাও জড়িয়েছিল, এটা খুবই সম্ভব।

স্থানীয় জাতীয়তাবাদী সাপ্তাহিকে এসব গুজবের প্রতিবেদন কি একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট করে না যে কিছু গোষ্ঠী কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে গুজবগুলো ছড়িয়েছিল? এ কথা সত্যি যে স্বদেশ-এ তা ছাপা হত তখনই, যখন পত্রিকা দপ্তরে কেউ লিখে পাঠাত তেমন কাহিনী। তবে তার অর্থ এই নয় যে, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার আগে এমন-সব গুজবের অস্তিত্ব কি প্রচলন ছিল না। জ্ঞানশক্তি-র মতো জাতীয়তাবাদবিরোধী স্থানীয় পত্রিকায় গুজবের প্রতিবেদনে সেই প্রচলনেরই প্রমাণ।

একথা অবশ্য সন্দেহাতীত যে স্বদেশ-এ প্রকাশ পেলে, তাদের প্রচলন বাড়ে, আরও বিশ্বাসযোগ্যও হয় তারা। ফরাসি বিপ্লবকালে গ্রামে আতঙ্কের বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক লেকেব্র দেখিয়েছেন, গুজবকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে সাংবাদিকরা কীভাবে তাতে জুড়ে দিতেন নতুন জোর। তা সত্ত্বেও এটা পুরোপুরি মানা যায় না যে ছাপার অক্ষর গুজবের চেহারাকে খুব বেশি বদলে দেবে। গুজব এমনই এক মৌখিক ভাষা, যার স্রষ্টার নাগাল পাওয়া ভার। ছাপার অক্ষরে তার কার্যকারিতা বাড়ে। তবে গোরখপুরের মানুষ যে গল্পসমূহ মেনে নেয়, তার কারণ এই নয় যে স্থানীয় সংবাদপত্রে তাদের আস্থা অগাধ। কাহিনীগুলি তাদের বিশ্বাস, অলৌকিক নিয়ে তাদের ধারণা, তাদের নীতিবোধ, এসবের সঙ্গে একাকার হয়েছিল—গোরখপুরের মানুষের বিশ্বাসের মূল এটাই।

এমন সব গুজবের প্রচলনে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মৌলভী সুবহানুল্লাহ ১৯২২ সালে স্টেশন কোর্টে স্বীকার করেন যে, জনগণকে গুজবে বিশ্বাস থেকে বিরত রাখতে কংগ্রেস বা খিলাফৎ-এর পক্ষে কোনও প্রচেষ্টাই ছিল না। স্বদেশ পবিত্রতার দোহাই দিয়ে গুজব ছেপে চলে ‘ভক্তদের বিশ্বাস’ শিরোনামে। কিন্তু গুজবের প্রতি এই কাগজেরও ছিল দুটি ভূমিকা। একদিকে, তারা মাঝেমধ্যে নোট ছাপত অলৌকিক ঘটনাসমূহকে উড়িয়ে দিতে, এমন কি ব্যঙ্গকৌতুকও করত সেসব নিয়ে। অন্য দিকে, পায়নিয়র-এর আক্রমণের প্রতিবাদে নিজেদের তরফে গুজব ছাপার সাফাই গাইত। চাপে পড়ে, স্বদেশ-এর সম্পাদক কৃষকের মেনে নেওয়াকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বদেশ-এর সম্পাদক, মহাত্মার প্রতি ভক্তির আদর্শ যিনি জেলায় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর দ্বিধা ছিল না মহাত্মার প্রতাপ-বিষয়ে গুজব প্রকাশ করতে। তবে গুজব যখন বিপজ্জনক কোনও ধারণা অথবা কাজের প্ররোচক, যেমন জমিদারিপ্রথা বিলোপ, খাজনা কমানো, বাজারে ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা, তখনই আবার স্বদেশ পত্রিকা গুজবের বিরোধী ভূমিকায় চলে যায়।

ঠিক যেমন গোরখপুরে নানান অলৌকিক ঘটনায় মহাত্মার নাম জড়িয়ে গেল, তেমনিভাবে জনসভা, পুস্তিকা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয় তাঁর নাম। যুক্ত হয় মহাত্মার নাম স্বরাজ কথাটির সঙ্গে, একাধিক অর্থে যার ব্যবহার। চৌরিচৌরা দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ কোর্টে জজেরা বললেন, এটা লক্ষণীয় যে গোরখপুরে কৃষকের মনে স্বরাজের সঙ্গে মিস্টার গান্ধীর নাম কীভাবে জড়িত। সাক্ষীরা বার বার বলে, এ হল গান্ধীর স্বরাজ অথবা মহাত্মার স্বরাজ, কৃষক যার পথ চেয়ে আছে। চৌরিচৌরা মামলার প্রধান আসামী লাল মহম্মদ কিছু উর্দু ঘোষণাপত্র বিক্রি করেছিল। তার মতে, সেগুলি গান্ধীর কাগজ; যখন গান্ধী চাইবেন, তখনই বের করবে বলে সে রেখেছিল। খিলাফৎ অর্থভাণ্ডারে দান করলে যে রসিদ পাওয়া যেত, তা অনেকটা এক টাকার মতো দেখতে। গোরখপুরের চাষিরা তাকে বলত গান্ধী-নোট। এসবের মধ্যে আমরা দেখি গান্ধীকে বিকল্প শক্তির স্রষ্টা ভাবতে জনসাধারণের বিশেষ প্রবণতা। স্থানীয় এক প্রামাণিক বিবৃতিতে পাওয়া যায়, ১৯২২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি চৌরা থানায় ঐতিহাসিক সংঘর্ষের ঘণ্টা কয়েক আগে যেসব কৃষক-ভলান্টিয়ার দু মাইল দূরে ডুম্‌রীর দিকে যাচ্ছিল এক সভায় যোগ দিতে, তারা বলে, গান্ধী-মহাত্মার সভায় যাচ্ছে তারা, যা এনে দেবে গান্ধী-স্বরাজ। গোরখপুরে জেলা-কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়াই গান্ধী-স্বরাজ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল। হাইকোর্ট জজরা লক্ষ করেছেন যে স্থানীয় কৃষক স্বরাজকে মিলিয়েছিল সেই আদর্শ স্বপ্নযুগে, যখন খাজনা নেওয়া হবে কম টাকায়, কি মাঠ বা ঢেঁকিশাল থেকে নেওয়া শস্যে, কৃষক জমি রাখতে পারবে নামমাত্র খাজনায়। আদালতে বিচারের সময় কংগ্রেস এবং খিলাফৎ-এর নেতারা বার বার বলেন যে এমন কোনও ধারণা গ্রামে তাঁরা প্রচার করেননি। বস্তুত এমন তথ্য আছে যে ১৯২১-এর মার্চ মাস থেকেই গোরখপুরের গ্রামে গ্রামে স্বরাজের আগমনবার্তা ঘোষিত হচ্ছিল। জমিদারদের অনুগামী জ্ঞানশক্তি পত্রিকা এসব ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাদের ভাষায়, এগুলি অশুভ ইঙ্গিত:

এক রাত্রে গ্রামবাসীরা নিদ্রা ত্যাগ করে আশপাশের চারটি গ্রামে ঘুরে বেড়াল। সে রাত্রে ঘুমনো প্রায় অসম্ভব। তারা চিৎকার করছিল—গান্ধীজির জয় হোক। তাদের সঙ্গে ছিল ঢোল, তাশা ইত্যাদি। আওয়াজে কান পাতা দায়। লোকে চেঁচিয়ে বলে যে, এ স্বরাজের ডঙ্কা। স্বরাজ এসে গেছে। গান্ধীর সঙ্গে বাজি ধরেছিল ইংরেজ—স্বরাজ তারা দেবে, যদি গান্ধীজি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একটি বাছুরের লেজ ধরে আগুন দিয়ে হেঁটে গেছেন গান্ধীজি। এখন স্বরাজ এসে গেছে। বিঘা প্রতি চার থেকে আট আনার বেশি খাজনা দেওয়া হবে না, এমন ঘোষণাও কানে আসে। এসব গুজব জমিদার আর কৃষকের মধ্যে সংঘাতের প্রতীক। চাষি আর জমিদারের কথা মানতে বা তার কাজ করতে রাজি নয়। এর প্রতিটিই দেশের পক্ষে অশুভ ইঙ্গিত।

গান্ধীর আগুন দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কৃতিত্ব যে তৎকালীন কৃষকচৈতন্যের স্তরে খাপ খেয়ে যাবে, তা স্পষ্ট। যা মিলে যায় সেই স্বর্গরাজ্যের স্বপ্নে, যে রাজ্যে কোনও খাজনা নেই। সেই রাত্রে গোরখপুরের গ্রামে স্বরাজের আগমনবার্তায় এমন চেতনাই ভাষা পেয়েছিল। স্বীকৃত কংগ্রেস নীতি থেকে এর দূরত্ব অনেক। ১৯২১-এর শেষে স্থানীয় ভলান্টিয়ারদের কার্যকলাপ আরও মারমুখী হয়ে ওঠে, স্বরাজের উপমা তখন পুলিশি শক্তির বিকল্পে। এটাও তৎকালীন কংগ্রেস নীতির স্বপক্ষে নয়। চৌরার যে থানাদার খুন হয়, তার ভৃত্য সরযু কাহারের কথায়, ঘটনার দু-চার দিন আগেই সে শুনেছিল, গান্ধী-মহাত্মার স্বরাজ এসে গেছে। চৌরা থানা উঠে যাবে, স্থাপিত হবে ভলান্টিয়ারদের নতুন থানা। ১৯২২-এর আগস্ট মাসে ফেঁকু চামার জজকে বলে, ‘বিপথ কাহার, স্বরূপভার আর মহাদেও ভুজ, এরা সবাই গান্ধী মহারাজ, গান্ধী মহারাজ বলতে বলতে উত্তর দিক অর্থাৎ চৌরার দিকে এগিয়ে আসে। আমি তাদের শুধোলাম, গান্ধী মহারাজের নাম করে তারা চেঁচাচ্ছে কেন? তারা উত্তর করল, চৌরা থানা পুড়িয়ে দিয়েছে তারা, মহারাজের স্বরাজ এসে গেছে।’

গান্ধীর স্বরাজের প্রকাশে যেমন পরিবর্তন এল, তেমনি চৌরিচৌরায় কৃষক ভলান্টিয়ারদের গান্ধী মহারাজের নামে জয়ধ্বনিতেও একটা প্রভেদ লক্ষণীয়। আগেই দেখেছি, ১৯২১-এর ফেব্রুয়ারিতে গান্ধী যখন গোরখপুর থেকে ফিরছিলেন, জয়ধ্বনিতে ছিল দাবির সুর। এক মাসের ভিতরে সেই ধ্বনি কৃষক ভলান্টিয়ারদের সংগঠিত শক্তি আর সংগ্রামের নিদর্শনে রূপান্তরিত হল। সে এমনই এক ধ্বনি, যা শত্রুদের মনে, এমনকি যে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী নয়, তার মনেও জাগায় আতঙ্ক। উত্তর ভারতে কৃষকের কাছে এ আর গান্ধীর জয়ধ্বনি নয়, থানা বা বাজারের উপর আক্রমণের ঘোষণামন্ত্র। জয় মহাবীর, বম্‌ বম্‌ মহাদেও, যা ছিল যুদ্ধের মন্ত্র, মহাত্মা গান্ধী কী জয় এখন তারই সমতুল। ভক্তি আর শ্রদ্ধার সেই জয়ধ্বনি সরাসরি সংঘর্ষের উদ্দীপনায় পরিণতি পেল। যেসব সংঘর্ষ মহাত্মা নামের দোহাই দিয়ে খাড়া করতে চায় সততার যুক্তি। কিন্তু কৃষকের এই মহাত্মা প্রকৃত গান্ধী নয়, কৃষকের কল্পনার প্রতিরূপ তিনি। যা করত তারা, ভেবে নিত তার বিধান আসছে তাদের কল্পনার মহাত্মার কাছ থেকে। আসলে সঠিক নীতি, ঔচিত্য আর সম্ভাব্য নিয়ে তাদেরই যে লোকায়ত ধারণা, সেখানেই তার প্রকৃত ভিত্তি। ১৯২১-এর শীতকালে উত্তর বিহারে যে সব হাট লুটের ঘটনা হয় সে-বিষয়ে এক জন আমলা লিখছেন:

সরকারের হাতে যা সাক্ষ্য রয়েছে, তাতে আর কোনও সন্দেহই নেই যে ওই হাট লুটের ঘটনা আর অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। লুণ্ঠনকারীরা এসে প্রথমে চাল বা কাপড় বা সবজি বা ওই জাতীয় কোনও জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করে। দাম শুনেই তারা বলে যে গান্ধী হুকুম দিয়েছেন দাম এই হবে, বলে চলতি মূল্যের এক-চতুর্থাংশ একটা মূল্য উল্লেখ করে। দোকানি ওই দামে জিনিস বিক্রি করতে অস্বীকার করলে তাদের গালাগাল আর মারধর করে তাদের দোকান লুঠ করা হয়।

পূর্ব উত্তরপ্রদেশ বা উত্তর বিহারের কৃষকের মনে মহাত্মা কোনও একটি বিশেষ স্বীকৃত ধারণা নয়। গান্ধীর বিধান আর প্রতাপ নিয়ে তাদের যে বোধ, তা অনেকাংশেই স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের ধারণার বিরুদ্ধে, গান্ধীবাদের মূলমন্ত্রেরও তা প্রতিকূল। এই স্ববিরোধই চৌরিচৌরার হিংসাত্মক ঘটনাবলীর সূত্র।

অনুবাদ: রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়, রুশতী সেন

টীকা

উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে গোরক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: John R. McLane. Indian Nationalism and the Early Congress (Princeton, 1977); Sandria Freitag. ‘Sacred Symbol as Mobilizing Ideology: The North Indian Search for a “Hindu” Community’. Comparative Studies in Society and History, 22 (1980). pp. 597-625. Gyan Pandey, ‘Rallying Round the Cow: Sectarian Strife in the Bhojpur Region.c. 1886-1917’ in R. Guha (ed.), Subaltern Studies II (Delhi, 1983)

Willian Crooke. The Popular Religion and Folklore of Northern India, Vol. 1 (London, 1896) pp. 183-96.

Bihar and Orissa Legislative Council Debates, 8 March 1921 vol. 1. p. 293.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *