দেবীর আবির্ভাব – ডেভিড হার্ডিম্যান
১
উনিশশো বাইশের নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে, দক্ষিণ গুজরাটে কাতারে কাতারে আদিবাসী বা উপজাতীয় কৃষকরা সলাহবাই নামে এক দেবীর উপদেশ শোনার জন্য জমায়েত হতে শুরু করে। এই ‘দেবী’ বা ‘মাতা’-র কোনও মূর্তি নেই, ভক্তদের ধারণা তিনি পুবের পাহাড় থেকে আসেন আর লোকের ওপর ‘ভর’ করে তাঁর আদেশ জানান। এইরকম একএকটি জমায়েতে বেশ কতকগুলি গ্রামের আদিবাসীরা এসে জড়ো হত এবং সেখানে তাদের অনেকেরই ভর হত। ভরগ্রস্তরা প্রচণ্ড মাথা ঝাঁকাত আর সেই অবস্থায় যেসব কথা বলত, লোকের ধারণা ছিল সেসব হচ্ছে দেবীর প্রত্যক্ষ আদেশ। প্রধান আদেশগুলি ছিল, মাংস ও মদ বর্জন, প্রতিদিন স্নান, শৌচের জন্য পাতার পরিবর্তে জল ব্যবহার, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখা, খাওয়া বা বলিদানের জন্য পালিত ছাগল, মুরগি ইত্যাদি ছেড়ে বা বিক্রি করে দেওয়া, পারসি শুঁড়ি আর জোতদারদের বয়কট করা। সাধারণের বিশ্বাস ছিল, দেবীর এই সব আদেশ যে মানবে না, তার ওপর নানান বিপদ নেমে আসবে, সে পাগল হয়ে যেতে পারে এমনকী তার মৃত্যুও ঘটতে পারে। সাধারণত একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিন এই রকম জমায়েত চলার পর দেবী সরে যেতেন আর এক গ্রামে এবং সেখানে একই ঘটনার পুনরাভিনয় হত।
দেবীর দ্বারা ভূতাবিষ্ট হওয়ার এই ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। বরোদা রাজ্যের শোনগড় (Songadh) ও ভিয়ারা (Vyara) মহকুমার পুরোটাই এর আওতায় চলে আসে। এই বিস্তৃত অঞ্চলের কোনও আদিবাসী গ্রামই এর আওতা থেকে মুক্ত ছিল না। নভেম্বর শেষ হওয়ার আগেই বারদোলি আর মাণ্ডবী (Mandvi) তালুকে এই হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে, ২ ডিসেম্বরের মধ্যে পৌঁছে যায় জালালপুর তালুকে, আর ১৪ তারিখের মধ্যে সুরাট শহর এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে। ডিসেম্বরে দেবীর নতুন কিছু কিছু আদেশ কানে আসতে শুরু করে। সলাহবাই এবার আদিবাসীদের বলছিলেন গান্ধীর নামে শপথ নিতে, খাদির কাপড় পরতে, আর জাতীয়তাবাদী স্কুলগুলিতে যোগ দিতে। গুজব শোনা গেল যে মাকড়সারা গান্ধীর নামের আদলে বুনছে তাদের জাল। এও শোনা গেল যে গান্ধী জেল থেকে পালিয়েছেন এবং এক পাতকুয়োর মধ্যে তাঁকে সলাহবাইয়ের পাশে বসে চরকা কাটতে দেখা যাবে।১
সরকারি কর্মচারীরা ভেবেছিল যে এই আন্দোলন হবে ক্ষণস্থায়ী। বারদোলির মামলতদার মন্তব্য করে; ‘আমার অভিজ্ঞতায় এই নিয়ে দশবার কালিপরজদের মধ্যে মদ্যপান বন্ধ করার গুজব ছড়াতে দেখলাম।২ এসব গুজব ছড়ায় খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু এদের প্রভাব কখনই বেশিদিন টেঁকেনি।’৩ মামলতদারের প্রত্যাশা অবশ্য ফলেনি, কারণ এই এলাকায় দেবী আন্দোলনের প্রভাব হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী। সুরাট জেলার কালেক্টর এ. এম. ম্যাকমিলানের ১৯২২-২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে এই অঞ্চলে, বিশেষত চোধ্রী (Chodhri) আদিবাসী-অধুষিত এলাকায়, দেবীর প্রভাব তখনও বজায় ছিল। এখানে মদ আর তাড়ি খাওয়া অনেকখানিই বন্ধ হয়েছিল, আর সেইসঙ্গে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থার ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য উন্নতি। জনসাধারণের দাবিতে ম্যাকমিলান সাহেব মাণ্ডবী তালুকে তেরোটি, বারদোলি তালুকে একটি, এবং ভালোড় মহলে একটি মদের দোকান বন্ধ করে দেন।৪ এর পরের বছরের রিপোর্টে তিনি লেখেন:
আন্দোলন চালু থাকায় মাণ্ডবীর চৌধ্রা [চোধ্রী-অধ্যুষিত] এলাকাগুলি স্পষ্টতই উপকৃত হয়েছে। রাজস্বের কিস্তি মেটানোর জন্য লোকজনকে সাহুকারদের কাছে ধার করতে হয়নি—যা আগে সবসময়েই তাদের করতে হত, বছরটা ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন। উৎসব-অনুষ্ঠানের খরচাপাতি তারা কমিয়ে দিয়েছে, ফলে তাদের এর জন্য সাহুকারদের কাছ থেকে আগাম নেওয়ারও প্রয়োজন হয়নি। তাদের চেহারার স্পষ্টতই উন্নতি হয়েছে, যেমন হয়েছে তাদের ঘরদোর এবং গ্রামেরও। রান্নার জন্য পিতলের বাসনপত্র এখন তারা কিনতে পারছে, বউকেও কিনে দিতে পারছে ভাল কাপড়চোপড় এবং গয়নাগাঁটি।৫
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার ভারতবর্ষের অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী আন্দোলনের সঙ্গে দক্ষিণ গুজরাটের এই দেবী আন্দোলনের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মোটের উপর এই আন্দোলনগুলি পণ্ডিতদের মনোযোগ বিশেষ আকর্ষণ করতে পারেনি। প্রধান ব্যতিক্রম অবশ্য বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলের ওরাওঁদের মধ্যে ১৯১৪ সালের টানা ভগৎ আন্দোলন, দেবী আন্দোলনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে যার সাদৃশ্য চমকপ্রদ।৬ সারা ভারতবর্ষের আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি থেকে এই ধরনের আরও আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া গেছে। পূর্ব তথা উত্তর-পূর্ব গুজরাট৭ এবং উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্রের৮ ভিলদের মধ্যে এই ধরনের আন্দোলন দেখা গেছে। দেখা গেছে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের খোন্দ৯, বিহারের ওরাওঁ, সাঁওতাল ও ভূমিজ১০, এবং উড়িষ্যার গোন্দ১১ উপজাতির মধ্যেও। মোটামুটি একই ধরনের কার্যসূচি সম্বলিত বিভিন্ন আন্দোলনের এক মিলিত জোয়ার আশ্চর্যরকম দ্রুততা ও শক্তির সঙ্গে এই এলাকার আদিবাসী গ্রামগুলিকে গ্রাস করেছিল। আন্দোলনের চেহারা ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ, এবং বহুক্ষেত্রে তার প্রভাব হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী। এছাড়া ছিল অসংখ্য সহিংস আদিবাসী আন্দোলন, যেমন বিরসা মুণ্ডার বিদ্রোহ, যাতে স্থান পেয়েছিল সমাজসংস্কারের কর্মসূচি।১২
এই ধরনের আন্দোলনগুলিকে আরও ভাল করে বোঝার উদ্দেশ্যে এই প্রবন্ধে আমি দেবী আন্দোলন সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করব। আলোচ্য বিষয়গুলি হল, পর্যায়ক্রমে, সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমি, আন্দোলনের যথাযথ ইতিহাস, এবং আদিবাসীদের গৃহীত সংস্কারসূচির নিহিতার্থ ও তাৎপর্য।
২
যাদের জীবন এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু, সেই আদিবাসীদের অধিকাংশই বাস করত ‘রানিমহল’ নামে পরিচিত দক্ষিণ গুজরাটের এক জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায়। রানিমহল মোটামুটি সমতল এলাকা; সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণীর খাড়া পাহাড়গুলি দাঁড়িয়ে আছে এর পূর্বসীমানার উপর। উনিশ শতকের গোড়ায় রানিমহলের অধিকাংশই ছিল জঙ্গলে ছাওয়া। অবশ্য এই এলাকার গাছপালা কেটে ফেলে মাঠ বানানো হয়েছিল এই শতকের মধ্যেই। ১৯২০ সাল নাগাদ ঘন জঙ্গল বলতে আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা এই এলাকার উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রানিমহলের মাটি ছিল উর্বর, আর বৃষ্টিপাতও হত প্রচুর, ফলে একবার চাষের আওতায় এলে একই জমি থেকে বছরের পর বছর ভাল ফসল পাওয়া যেত।
‘কালিপরজ’ নামে পরিচিত প্রধান উপজাতিগুলি ছিল চোধ্রী (Chodhri), গমিৎ (Gamit), ধোড়িয়া (Dhodiya) আর কোঙ্কনী (Konkani)। এছাড়া নায়েক (Naikas), কোতওয়ালিয়া (Kotvaliya) আর কাঠোড়িয়ার (Kathodiya) মতো ছোটখাটো উপজাতিও ছিল। রানিমহলের যে অঞ্চলগুলিতে প্রধান চারটি উপজাতি বাস করত সেগুলি ছিল পরস্পরসংলগ্ন, এমন কী এক এলাকা আর-একটিতে উপচে পড়েছিল অনেকখানি। চোধ্রীদের বাস ছিল প্রধানত মাণ্ডবী, ভালোড়, ভিয়ারা আর মাহুবা (Mahuva) তালুকে। গমিৎরা আস্তানা গেড়েছিল ভিয়ারা আর সোনগড় তালুকে, আর পশ্চিম খান্দেশে। ধোড়িয়ারা থাকত দক্ষিণের দিকে, মাহুবা, পশ্চিম ভাঁসদা (Vansda), চিখ্লি (Chikhli), পূর্ব ভালসাদ (Valsad), পশ্চিম ধরমপুর আর পার্দিতে (Pardi)। আর কোঙ্কনীরা ছড়িয়ে পড়েছিল রানিমহল ছাড়িয়ে সহ্যাদ্রি পর্বতমালায়—ভাঁসদা, ধরমপুর, দাং (Dang), সুরগনা (Surgana) আর নাসিক জেলায় বাসা বেঁধেছিল তারা। পশ্চিম ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে যারা বৃহত্তম, সেই ভিলদের রানিমহলে খুঁজে পাওয়া যেত না বিশেষ; তাদের এলাকা শুরু হয়েছিল বাজপুর (Vajpur) আর রাজপিপলা (Rajpipla) রাজ্য থেকে। অবশ্য এর ব্যতিক্রম ছিল দাং—যেখানে প্রভুত্বকারী গোষ্ঠীনেতারা ছিল ভিল, আর চাষিদের অধিকাংশই কোঙ্কনী। ভিলদের সঙ্গে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির কৃষ্টিগত তফাৎ ছিল অনেক; শেষোক্তদের কোনওমতেই এই প্রধান উপজাতিটির প্রশাখা বলা চলত না।
রানিমহলের আদিবাসীদের অধিকাংশই ছিল স্থায়ী কৃষক, যারা থাকত ছোট ছোট গ্রামে বা ‘ফলিয়ায়’ (faliya)। রাজস্ব আদায়ের একক হিসেবে পরিগণিত হত যে গ্রাম, তা গঠিত হত বেশ কয়েকটি ‘ফলিয়া’ নিয়ে। কারিগর বা অন্যান্য বিশেষ জীবিকানির্বাহী জাতির অস্তিত্ব না থাকায় এইসব গ্রামের কোনও নাভিকেন্দ্র ছিল না। এদিক থেকে বিচার করলে, ব্রাহ্মণ পুরোহিত, আধিপত্যশালী জাতি, অধস্তন শ্রমজীবী জাতি, বানিয়া দোকানদার, কারিগর জাতি আর অস্পৃশ্যদের স্তরবিন্যাস নিয়ে গড়ে-ওঠা তথাকথিত ‘সনাতন’ ভারতীয় গ্রামের সঙ্গে এইসব আদিবাসী গ্রামের বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। অধিকাংশ আদিবাসী ফলিয়ার সদস্যই ছিল একই উপজাতির লোক। হয় তারা ছিল নিজেরাই জমির মালিক, অথবা তারা জমি ভাড়া খাটাত, এবং সাধারণত তাদের নিজস্ব চাষবাসের সরঞ্জাম আর হালটানার বলদ থাকত।
আদিবাসী গ্রামের উদাহরণ হিসেবে মাণ্ডবী তালুকের সাতভাও (Sathvav)-কে বেছে নেওয়া যেতে পারে। তিরিশের দশকের প্রথমদিকে সমাজতত্ত্ববিদ বি. এইচ. মেহ্তা এই গ্রামটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করেন।১৩ সেই সময়ে সাতভাও-এর জনসংখ্যা ছিল ৫৮৮, যা ১১৪টি পরিবারে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ১০৬টি ছিল চোধ্রী আদিবাসী পরিবার, ৪টি ভিল, ২টি অস্পৃশ্য ঢের (Dhed) জাতের এবং ২টি পারসি। প্রত্যেক পরিবার কি পরিমাণ জমির মালিক ছিল এবং/অথবা কতটা জমি ভাড়া খাটাত সে সম্পর্কে মেহ্তার সংগৃহীত তথ্য থেকে নীচের সারণীটি তৈরি করা সম্ভব:
অধিকৃত জমির পরিমাণ (একর হিসেবে) | পরিবারের সর্বমোট সংখ্যা | পরিবারের শতাংশ |
শূন্য | ২১ | ১৮ |
৫-এর কম | ২১ | ১৮ |
৫ থেকে ১০ | ১৪ | ১২ |
১০ থেকে ২০ | ৩৪ | ৩০ |
২০ থেকে ৩০ | ১২ | ১১ |
৩০ থেকে ৪০ | ৫ | ৪ |
৪০ থেকে ৫০ | ৩ | ৩ |
৫০-এর বেশি | ৪ | ৪ |
মোট | ১১৪ | ১০০ |
সবচেয়ে বেশি জমির মালিক ছিল এক পারসি, যার দখলে ছিল ১০৮ একর জমি। তিনজন চোধ্রী যথাক্রমে ৬৪, ৬০ এবং ৫২ একর জমির মালিক ছিল। মেহ্তার মতে একটি পরিবারের উপযুক্ত ভরণপোষণ যোগানোর জন্য দরকার তো অন্তত কুড়ি একর জমি।১৪ এর চেয়ে কম জমির মালিক অথবা একেবারেই ভূমিহীন ছিল ৮৮টি (৭৭ শতাংশ) পরিবার। সুতরাং সাতভাওয়ের আদিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ যে বেশ দারিদ্রের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিল, এমন মনে করাটা অযৌক্তিক হবে না। এবং এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে, শুধু যে তারা দরিদ্র ছিল তাইই নয়, তিরিশের দশকের মধ্যেই গ্রামগুলিতে বৈষম্য ছড়িয়ে পড়েছিল ভালভাবেই। অবশ্য যেখানে অসংখ্য চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক উচ্চবর্ণের ভূম্যধিকারীদের হয়ে কাজ করত, দক্ষিণ গুজরাটের সেই আদিবাসীহীন গ্রামগুলির তুলনায় আলোচ্য আদিবাসী গ্রামগুলিতে বৈষম্যের তীব্রতা ছিল অনেক কম।
এইসব বৈষম্য সত্ত্বেও এক আদিবাসী আর এক আদিবাসীকে শোষণ করত সামান্যই। শোষণ তার চরমতম রূপ পরিগ্রহ করেছিল উচ্চবর্ণের মহাজন এবং পারসি সুরা-ব্যবসায়ীদের হাতে। বলপূর্বক শ্রম আদায় ছাড়াও বিভিন্ন আইনসম্মত ও বেআইনি কর আরোপ করার মাধ্যমে আদিবাসী শ্রমশক্তি শোষণের কাজে যোগ দিয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র। পুলিশ, এবং রাজস্ব, আবগারি ও বনবিভাগের অফিসাররা প্রত্যেকেই এতে ভাগ বসাত। মহাজনদের অধিকাংশই ছিল বানিয়া, পারসি আর ব্রাহ্মণ। বানিয়া আর ব্রাহ্মণরা থাকত তালুকের সদর শহরগুলিতে। তারা টাকা ধার দিত হয় তাদের শহরের বাড়ি থেকে, অথবা সাপ্তাহিক হাট থেকে, যেগুলি বসত সমগ্র আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন জায়গায়। যারা মহাজনী কারবার এবং মদের ব্যবসা দুইই একসঙ্গে চালাত, সেই পারসির সাধারণত থাকত বড় বড় আদিবাসী গ্রামগুলিতে। এই সব গ্রামে তাদের মদ বিক্রি করার একচেটিয়া অধিকার ছিল। মাণ্ডবী তালুকের ১৩৫টি গ্রামে ১৩টি, অর্থাৎ গড়পড়তা প্রতি দশটি গ্রামপিছু একটি মদের দোকান ছিল। এই তথ্য থেকে গ্রামবাসী পারসিদের সংখ্যা ও তাদের প্রভাব সম্বন্ধে খানিক ধারণা করা যায়। প্রায়ই তারা একাধিক গ্রামে জমির মালিকানা ভোগ করত। বিশ শতকের গোড়ার দিকের মধ্যেই তাদের কেউ কেউ বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়, এবং স্থানীয় গোমস্তাদের হাতে এগুলির ব্যবস্থাপনার ভার ছেড়ে দিয়ে শহরে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু ছোটখাটো পারসি ভূস্বামীদের অনেকে আদিবাসী গ্রামগুলিতেই থেকে যায়। আদিবাসীদের খড়ে-ছাওয়া মাটির কুঁড়ের পাশাপাশি এদের বাড়ি হত দোতলা, ইঁট আর টালির তৈরি। সারা বছর ধরে এরা মদ আর তাড়ি ধার দিয়ে যেত, আর ফসল কাটার সময় আদায়ীকৃত শস্যের হিসেবে বহুগুণ বর্ধিত হারে ফিরে পেত তাদের দাম। ভূমিহীন আদিবাসীরা তাদের ধার শোধ দিত পারসিদের ক্ষেতে গায়ে খেটে।১৫ আদিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পারসিরা যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করত তার অসংখ্য বিবরণ মেলে।১৬ শ্রম আদায় করা ছাড়াও, যৌন উদ্দেশ্যে আদিবাসী মেয়েদের অপব্যবহার করা হত।১৭ গরিব আদিবাসীরা সবসময়েই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। যে কোনও প্রতিবাদকে চটপট উত্তম-মধ্যম দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিত পারসি মালিক নিজে অথবা তার পোষা গুণ্ডাবাহিনী। স্থানীয় সরকারি কর্মচারি এবং পুলিশ সবসময়েই পারসিদের পক্ষই অবলম্বন করত।
পারসিদের হাত শক্ত করেছিল মদব্যবসা সংক্রান্ত সরকারি আইনকানুনও, যার মধ্যে মুখ্য ছিল ১৮৭৮ সালের বোম্বাই আবগারি আইন। ওই বছরের আগে মদ চোলাই এবং বিক্রি করার অধিকার ইজারা-বিলি করা মদের উপর শুল্কও ছিল কম। মদ (যা গুজরাটে ‘দারু’ নামে পরিচিত) চোলাই করা হত গ্রামে, আর এর প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হত ‘ম্হৌরা’ (mhowra) গাছের শর্করাসমৃদ্ধ ফুল। তাড়ি ছিল গেঁজে-ওঠা তালের রস, যা প্রায় বিয়ারের মতোই কড়া। যেসব তালগাছের রস থেকে তাড়ি বানানো হত সেগুলির উপর সামান্য শুল্কের মাধ্যমে এর উপর কর আরোপ করা হয়েছিল। দারু এবং তাড়ি, উভয়ক্ষেত্রেই কর ফাঁকি দেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকায় এই ব্যবস্থা ব্রিটিশদের পছন্দসই ছিল না। ১৮৭৮ সালের আইন স্থানীয় ভিত্তিতে মদ উৎপাদন পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পর কেবল জেলা সদরগুলিতে একটি করে কেন্দ্রীয় ভাটিখানা চালু রাখার অনুমতি দেয়। এই কেন্দ্রীয় ভাটিখানাগুলি চালাত জেলার একচেটিয়া ব্যবসাদারেরা, যাদের ফি বছর সরকারকে মোটা টাকা দিতে হত। কেন্দ্রীয় শুল্কব্যবস্থার আয়ত্তাধীন এই মদ যারা গ্রামে বিক্রি করত, পরওয়ানা বাবদ তাদেরও ফি বছর সরকারকে দিতে হত নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা। তাড়ির সঙ্গে দামের তারতম্যহেতু এই নতুন মহার্ঘ্য মদের ক্রয়যোগ্যতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকায় তালগাছগুলির উপর কর প্রচুর বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আরও নিখুঁতভাবে গাছগুলিকে তালিকাভুক্ত করা হয়।১৮
এমন নতুন ব্যবস্থায় আবগারি রাজস্বের যে বিপুল বৃদ্ধি হয়েছিল তা নীচের সারণী থেকেই স্পষ্ট হবে। বাঁ-দিকের স্তম্ভে প্রদত্ত সংখ্যাগুলির মাধ্যমে বোম্বাই প্রেসিডেন্সির সর্বমোট রাজস্বের শতাংশকে বোঝানো হয়েছে। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ভূমিরাজস্বের যে অনুরূপ শতাংশের হিসেব এই সারণীতে দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে একই সময়সীমার নিরিখে আগের সংখ্যাগুলির তুলনামূলক বিচার করা যেতে পারে।১৯
বছর | আবগারি | ভূমিরাজস্ব |
১৮৬৫-৬৬ | ৪.৪ | ৪০.৩ |
১৮৭৫-৭৬ | ৪.২ | ৩৮.৮ |
১৮৮৫-৮৬ | ৮.২ | ৩৮.৭ |
১৮৯৫-৯৬ | ৭.৭ | ৩৪.৭ |
১৯০৫-০৬ | ৮.৯ | ২৪.২ |
১৯১৫-১৬ | ১৩.৭ | ৩১.৪ |
১৯২৫-২৬ | ২৯.৩ | ৩৮.১ |
আলোচ্য সময়সীমার মধ্যে একটি জেলায় (সুরাট) দেশি মদ ও তাড়ির উপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ কিভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তা নীচে টাকার অঙ্কের হিসেবে দেখানো হয়েছে।২০
রাজস্ব বছর | রাজস্ব (টাকার অঙ্কে) |
১৮৭৭-৭৮ | ৩,৭০,৪২৩ |
১৮৮৫-৮৬ | ৭,৯৪,২২১ |
১৮৯৫-৯৬ | ১১,৬৪,৫৮৫ |
১৯০৫-০৬ | ১১,৬৭,৭১৮ |
১৯১৫-১৬ | ১৭,৪৪,৮৬৭ |
১৯২৫-২৬ | ৩৪,৩৬,২৯১ |
সুরাট জেলায় এই শুল্কবৃদ্ধির ভার নিচুজাতের লোকেদের, বিশেষত আদিবাসীদেরই বহন করতে হয়েছিল। এই নতুন ব্যবস্থার মুনাফা ভালভাবেই লুটেছিল মদবিক্রেতারা। তাদের মদ চোলাইয়ের অধিকার চলে গেলেও, গ্রামকে গ্রাম জুড়ে কারখানায়-তৈরি মদ বিক্রি করার একচেটিয়া অধিকার ছিল। গ্রামে বাস করার দরুন মদবিক্রেতারা বেআইনি মদচোলাইয়ের বেশির ভাগটাই রুখতে পেরেছিল। কারখানায় তৈরি চড়াদামের মদের উপর লাভ করা হত ওজনে মেরে, জল মিশিয়ে বা চড়া সুদে এই মদ ধার দিয়ে। দোকানদারেরা ঠগবাজি আর জুলুমের মাধ্যমে তাদের পকেট ভারি করত, আর আবগারি বিভাগের কর্মচারীদের ঘুষ দেওয়া হত এ ব্যাপারে নাক না গলানোর জন্য।২১ ১৯২৩ সালে বোম্বাই আবগারি কমিটির কাছে দেওয়া সুরাটের হরিভাই দেশাই-এর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে কোনও মদের দোকান পরিদর্শনে যাবার আগে আবগারি অফিসাররা বেশ ভালরকমই আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখত। দোকানদারেরা প্রায়ই অফিসারদের টাকা ধার দিত এবং অন্যান্যভাবেও তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে সাহায্য করত। দেশাই আরও বলেন:
বস্তুত বর্তমান ব্যবস্থায় একজন মদের দোকানি গ্রামের একজন অধিকর্তাবিশেষ, আগে যেখানে তাকে থাকতে হত ‘পারিয়া’ হিসেবে। সত্যিকথা বলতে কি, আমার দেখা অনেক গ্রামেই আবগারি দোকানদাররাই একমাত্র পয়সাওয়ালা লোক। আর্থিক স্বাচ্ছল্য আর সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ, এই দুইয়ে মিলে তাদের গ্রামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি বিপজ্জনক শক্তিতে পরিণত করেছে। তারাই ঝগড়া বাধায়, আবার মেটায়, আর সরকারি প্রশ্রয় এবং অনুগ্রহের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে অনেক মানী লোকের সম্মান নষ্ট করতেও দ্বিধা করে না। এইসব দোকানদারদের সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল।২২
মহাজনী কারবার এবং মদের ব্যবসা থেকে লব্ধ মুনাফার অনেকটাই জমিতে বিনিয়োগ করা হত। ১৮৬০-এর দশকের ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তগুলির আগে পর্যন্ত আদিবাসীরা তাদের চিরাচরিত রীতি অনুসারেই জমি ব্যবহার করত, অর্থাৎ কৃষিযোগ্য জমির সন্ধানে তারা প্রত্যেক বছরই সরে যেত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে আলাদা আলাদা জমির মালিক হিসেবে ভাবার রেওয়াজ তাদের মধ্যে ছিল না। যাই হোক, ১৮৬০-এর দশকে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী কৃষকরা যে জমি চাষ করত, সেই জমির মালিকানাস্বত্ব তাদের দেওয়া হয়, এবং জমি এই প্রথম একটি বিপণনযোগ্য পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়। কিন্তু আদিবাসীদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি না থাকায় এবং তারা তুলনামূলকভাবে বশংবদ হওয়ায় (কারণ নিজেদের জমিকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অতীতে তাদের কোনওদিনই ছিল না) মহাজন এবং মদব্যবসায়ীরা শীঘ্রই তাদের মালিকানাস্বত্ব থেকে বঞ্চিত করতে শুরু করে। স্বভাবভীরু হওয়ার ফলে আদিবাসীদের এই রূপান্তর হয়েছিল অত্যন্ত অনায়াসসাধ্য।
সুতরাং জমির উপর মালিকানাস্বত্বের আবির্ভাব এবং সুরাসংক্রান্ত আইনকানুন এই নতুন শোষণব্যবস্থার ভিত গড়ে দিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষের দিকে বরোদা এবং তার সংলগ্ন নৃপতিশাসিত রাজ্যগুলি একই ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করার ফলে অবস্থা সেখানেও দাঁড়ায় প্রায় একই রকম। আদিবাসীদের উপর তাঁদের শাসনের ভয়ঙ্কর প্রভাব খুব তাড়াতাড়িই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, কিন্তু এই ব্যবস্থার যাথার্থ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে তাঁরা আদিবাসী কৃষকদের কল্পিত নৈতিক ভ্রষ্টতার উপরই দোষ চাপান। বিশেষভাবে তাঁরা দায়ী করেন আদিবাসীদের সুরাসক্তিকে। মাণ্ডবী তালুকের চোধ্রীদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ১৮৮১ সালে সুরাট জেলার এক ডেপুটি কালেক্টর মন্তব্য করেন:
এইসব কালিপরজরা সুরার প্রতি বেশ ভালরকমই আসক্ত। সত্যি বলতে কি, [মাণ্ডবী তালুকে] যে আবগারি শুল্কের মোট পরিমাণ পঁচিশ হাজার টাকারও বেশি, তার বেশির ভাগটাই ওঠে এদের কাছ থেকেই। মদের পিছনে খরচের অর্ধেকটাও যদি এরা জমিতে খাটাত অথবা চাষবাসের উন্নতমানের সরঞ্জাম কেনার জন্য ব্যয় করত তাহলে এদের অবস্থা আস্তে আস্তে ফিরে যেত। সে জায়গায়, সাহুকারদের ধার মেটাতে এখন তাদের চাল ইত্যাদি ভাল ভাল শস্যের পুরোটাই দিয়ে দিতে হয়। তাদের নিজস্ব খোরাকের জন্য পড়ে থাকে কৌ দ্রা নাগ্লী আর অন্যান্য নিকৃষ্ট শস্য।২৩
মনে করা হয়েছিল যে এই সমস্যার সমাধান হবে আদিবাসীদের লেখাপড়া শেখানো যাতে তারা পানাহারের ব্যাপারে মিতাচার ও সংযমের সুফলগুলি বুঝতে শেখে। সুরাটের এক সহকারী কালেক্টরের ভাষায়, ‘যতদিন না তারা পর্যাপ্ত শিক্ষালাভ করছে এবং মিতাচারের নিয়মকানুন বোঝার মতো অবস্থায় পৌঁছচ্ছে, ততদিন কাল্পনিক দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত করার প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র।’২৪ একই সুর শোনা যাচ্ছে সাত বছর পর, আরেক সহকারী কালেক্টরের লেখাতেও:
এটা আদৌ অত্যুক্তি নয় যে একজন গড়পড়তা চোধ্রা (আদিবাসী) দশের উপর গুনতে জানে না, এবং স্কুলকে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতিয়ার ভেবে ঘৃণা করে। তবে শত প্রচেষ্টাতেও তাকে কিছুই শেখানো যায় না—এমন ধারণাটা যে ভুল তা ভালোড়-এর দৃষ্টান্তই প্রমাণ করে। মাণ্ডবীর তুলনায় এই এলাকা [সরকারি] নজর পেয়েছে বেশি। এই মহলটিতে শুধুমাত্র চোধ্রাদের জন্যই নির্দিষ্ট দুই বা তিনটি স্কুল রয়েছে, এমনকি দু-তিনজন চোধ্রা স্কুলশিক্ষকও আছেন। আমি লক্ষ্য করেছি যে যেসব গ্রামে স্কুল রয়েছে, একমাত্র সেগুলিতেই এমন চোধ্রাদের খুঁজে পাওয়া যাবে যারা পাকা বাড়িতে বাস করে, কোদ্রা এবং নাগলী-র থেকে ভাল খাবার জোটাতে পারে, গ্রীষ্মের কথা ভেবে আগাম জমিয়ে রাখে গবাদি পশুর খাবার, এবং জানে যে পাওনা আদায়ের অজুহাতে হাল-বলদ কেড়ে নেওয়াটা বেআইনি।২৫
এইভাবে ঔপনিবেশিক সরকারের চোখে শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায় আদিবাসী দারিদ্রের সর্বরোগহর উপশমক।
আদিবাসী গ্রামগুলিতে প্রাথমিক স্কুল খোলা হয়েছিল। এই পরীক্ষা বড় একটা সফল হয়নি। উচ্চবর্ণের শিক্ষকরা দূরবর্তী আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে কাজ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন, এবং খুব কমসংখ্যক আদিবাসীই ছিল শিক্ষকতার জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা শিক্ষার উন্নয়নে আদৌ আগ্রহী। অনেকেই বিশ্বাস করত যে স্কুলে-পড়া ছেলেরা অল্পবয়সে মারা যায়।২৬ স্কুলগুলিতে উপস্থিতির হার ছিল খুবই নগণ্য এবং বেশ কয়েকটিকে তো বন্ধই করে দিতে হয়েছিল। পরিস্থিতি অবশ্য সম্পূর্ণ নৈরাশ্যজনক ছিল না, কারণ বরোদা রাজ্য আদিবাসী প্রশিক্ষণে ছোটমাপের কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল। ১৮৮৫ সালে রানিমহল পর্যটনের পর সয়াজীরাও গাইকোয়াড় আদিবাসী ছাত্রদের জন্য সোনগড়ে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণের আদেশ দেন, যাতে তারা শহরের প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার জন্য তাদের পূর্ণ সময় নিয়োজিত করতে পারে। প্রথম প্রথম আবাসিক খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর। কিন্তু এর প্রথম সুপারিন্টেন্টে ফতেহ্খান পাঠান ছিলেন সাফল্য অর্জনে বদ্ধপরিকর, এবং তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছাত্রসংগ্রহ করতে শুরু করেন। তাঁর দর্শনমাত্রেই আদিবাসীরা জঙ্গলে পালিয়ে যেত। এই অবস্থার পরিবর্তন হয় যখন ফতেহ্খান গমিৎ সম্প্রদায়ের এক চাঁইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁর দুই ছেলেকে সোনগড়ের ছাত্রাবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদের একজন, অমর সিং গমিৎ, পরে একজন অগ্রণী সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিত হন।২৭ ১৯০০ সালের মধ্যে এই ছাত্রাবাসের আবাসিকসংখ্যা সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এর আদিবাসী আবাসিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রতিবছরই সপ্তম স্ট্যান্ডার্ডের গুজরাটি পরীক্ষায় পাশ করে শিক্ষকতার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে মাণ্ডবী তালুকে একটি অনুরূপ ছাত্রাবাস খুলতে মনস্থ করে। গড়সাম্বা (Godsamba) বোর্ডিং হাউস নামে পরিচিত এই আবাসটিতে সারা সুরাট জেলা থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে। এই হস্টেল থেকে পাশ-করা ছাত্রদের অনেকেই পরে রানিমহলের আদিবাসী সমাজ সংস্কারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে।
এই সমাজসংস্কারকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন সোনগড়ের প্রাক্তন ছাত্র অমর সিং গমিৎ (১৮৭৩-১৯৪১)। ১৯০৫ সালে ফতেহ্খান পাঠানের সঙ্গে তিনি ভিয়ারা তালুকে তাঁর নিজস্ব গ্রামে একটি আদিবাসী সম্মিলনের আয়োজন করেন। এখানে আদিবাসীদের মদ্যপান ও কুসংস্কারভিত্তিক আচারপালন ছেড়ে দিতে, লেখাপড়া শিখতে, এবং মহাজনদের ঋণের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে উৎসাহিত করে কয়েকটি প্রস্তাবও পাশ করা হয়।২৮ এর পরের কয়েকবছর অমর সিং গমিৎ গ্রামে গ্রামে ঘুরে আদিবাসীদের জীবনাচরণের বিধিগুলি পালটাতে উৎসাহিত করেন। তাদের মধ্যে রোজ স্নান করা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা এবং অসুস্থতার সময় ওঝা-ঝাড়ফুঁকের পরিবর্তে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সাহায্য নেওয়ার প্রথা তিনি প্রচলন করতে চেয়েছিলেন।২৯ একইসঙ্গে তিনি প্রচার অভিযান চালান রতনজী দাবু নামে এক বড় পারসি জমিদারের বিরুদ্ধেও, যে খোলাখুলিভাবেই আদিবাসীদের শোষণ করে যাচ্ছিল। অমর সিং-এর এই অভিযান অবশ্য নিষ্কন্টক হয়নি, এবং এর সাফল্যও ছিল সীমিত।
ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত মাণ্ডবী তালুকে, গড়সাম্বা বোর্ডিং হাউসে শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণবয়স্ক চোধ্রীরা ‘ভজনমণ্ডলী’ নাম দিয়ে ছোট ছোট গানের দল গড়তে শুরু করে। এগুলির উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার সংক্রান্ত ধ্যানধারণার প্রসার। এর একজন চাঁই ছিলেন মারবাড়ী মাস্টার নামে এক চোধ্রী যিনি ১৯০৯ সালে গড়সাম্বা থেকে গুজরাটির ফাইন্যাল পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন মাণ্ডবী তালুকের এক গ্রামের কৃষক, প্রায় চল্লিশ একর জমির মালিক। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে মারবাড়ী ছিলেন মোটামুটি সম্পন্ন এক চোধ্রী পরিবারের প্রতিনিধি। পরে স্কুলশিক্ষক হয়ে তিনি মাণ্ডবী তালুকের বিভিন্ন গ্রামে পড়িয়েছিলেন। তিনি এবং গড়সাম্বার আরও কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র মিলে একটি গানের দল গড়ে তোলেন। ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে এরা ঘুরে বেড়াত। এইসব গানে সাধারণত মিতাচার ও আত্মনির্ভরতার গুণকীর্তন করা হত, আর বলা হত বিদেশী মহাজন আর পারসিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা। এমন একটি গান ছিল:
ও ভাইসকল! দারু বা তাড়ি খেওনা হে।
ও ভাইসকল! মদ খেলে যে লুটে নেবে পারসি তোমার জমিজিরেত।
তার কাছে যাও যদি তবে বিষয়-আশয় বেহাত হবে হে।
ও ভাইসকল! দারুর নেশা ছেড়ে দাও।
দারুর পিছে ছোটো যদি বানিয়া আর ঘাঁচী [তেলি] মিলে
তাবৎ বিষয় আশয় তোমার লুটে নেবে হে।৩০
গান শোনার জন্য লোকজন জমায়েত হলেই সংস্কারকরা এইসব বিষয়ের উপর চোধ্রী উপভাষায় বক্তৃতা দিতে শুরু করত।
এইভাবে বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে আদিবাসী তরুণরা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সমাজসংস্কারকের ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করে। বহুক্ষেত্রেই এরা আসত অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী আদিবাসী পরিবারগুলি থেকে, যাদের সঙ্গতি ছিল দু-একটি ছেলেকে চাষবাসের কাজ থেকে রেহাই দিয়ে স্কুলে পাঠানোর। বাইরের শোষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এমন এক ধরনের নেতৃত্ব এই পরিবারগুলি থেকেই উঠে এসেছিল। শিক্ষিত হওয়ার ফলে এইসব সমাজসংস্কারকেরা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট সম্মান ভোগ করত, এবং তাদের কয়েকজনের উদ্যোগপ্রসূত কয়েকটি আন্দোলন দেবী আন্দোলনের পথ প্রস্তুত করেছিল। যেমন ১৯০৫ সালে সুরাট জেলার সহকারী কালেক্টর লেখেন:
এই বছরের গত দুমাস ধরে কালিপরজদের মধ্যে এক চমকপ্রদ ও ব্যাপক সুরাবর্জন আন্দোলন লক্ষ করা গেছে। এর সূত্রপাত হয় যখন বরোদার এক স্কুলমাস্টার বলে যে এক দেবতার কাছ থেকে সে উত্তেজক সুরা পানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছে। এ-খবর প্রথম পৌঁছয় বালসারে (Bulsar) এবং সেখানে প্রচুর সংখ্যক নিষেধাজ্ঞাপক ইস্তাহার বিলি করা হয়। কোনও কোনও অনাভিল (Anavil) প্যাটেলও সোৎসাহে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। শোনা যায় অনেক গ্রামে ‘দেবতার’ রহস্যময় চিঠিপত্রও পাওয়া গেছে। বিরাট বিরাট জমায়েতে সম্মিলিত হয়ে কালিপরজরা সিদ্ধান্ত নেয় যে শেষবারের মতো এক বড়মাপের আমোদপ্রমোদের পর তারা মদ্যপান পুরোপুরি ছেড়ে দেবে। এখন পর্যন্ত তাদের এই শপথ তারা কঠোরভাবে পালন করে এসেছে। আবগারি রাজস্বহানির আশঙ্কায় ত্রস্ত সরকার প্রতিবেশী দেশীয় রাজ্যে এই মিতাচারীদের কড়া ধরনের হুমকি দিয়েছে। কিন্তু লোকজন জবাব দিয়েছে যে সরকারি আদেশের চেয়ে দেবতার আদেশ বড়, এবং মিতাচার তারা ছেড়ে দেয়নি। আমার মনে হয় এই আন্দোলন কোনওমতেই মদের চড়া দামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়, এবং এর ভেতর রয়েছে এক নৈতিক ও ধর্মীয় চরিত্র।৩১
এর পরের বছর আন্দোলন ঝিমিয়ে আসার খবর আসে। অবশ্য এই সময় দেখা দেয় একই ধরনের আরও বেশ কয়েকটি আন্দোলন, যার দরুন ১৯২২ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে আন্দোলনের এক ঐতিহ্য।
৩
এইভাবে প্রস্তুত হয়েছিল দেবীর আগমনের পথ। অবশ্য এই আন্দোলন দক্ষিণ গুজরাটের রানিমহলে শুরু হয়নি, হয়েছিল বোম্বাই শহরের ঠিক উত্তরদিকে, বেসিনের উপকূলবর্তী গ্রামগুলিতে। এই আন্দোলনের উৎপত্তি অনথিবদ্ধ এবং ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। আমার সমস্ত তথ্যই তাই সংগ্রহ করতে হয়েছে এই অঞ্চলের বৃদ্ধ জেলেদের সাক্ষাৎকার থেকে।৩২ মনে হয় ১৯২২-এর গোড়ার দিকে ‘মাঙ্গেলা কোলি’ জেলেদের মধ্যে এক গুটিবসন্তের মড়ক দেখা দেয়। এরা বিশ্বাস করেছিল যে এই মড়কের জন্য দায়ী এক দেবী, অতএব তাঁকে সন্তুষ্ট করা দরকার। এই সময়কার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাঙ্গেলা কোলি মেয়েদের উপর এই দেবীর ভর হয়। ভরগ্রস্তাদের মাধ্যমে দেবী মাঙ্গেলা কোলিদের জানান যে তিনি খুশি হবেন একমাত্র তখনই, যদি তারা কিছুদিনের জন্য মাছমাংস এবং মদ বা তাড়ি খাওয়া ছেড়ে দেয়। মাঙ্গেলা কোলিরা এই আদেশ মেনে চলে। যেসব মেয়েদের উপর এই দেবীর ভর হয়েছিল তাদের নাম দেওয়া হয় ‘সলাহ বাই’, অর্থাৎ এমন মেয়ে (বাই) যারা পরামর্শ (সলা) দেয়। দেবীর সন্তোষবিধানের এই আন্দোলন উপকূলরেখা ধরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে উত্তরদিকে, থানা, দমন এবং সুরাট জেলার অন্যান্য ধীবর-অধ্যুষিত গ্রামে। দমন, পার্দি এবং ভালসাদ তালুকের উপকূলবর্তী গ্রামগুলি থেকে আবার তা ছড়িয়ে যায় ধোড়িয়া আদিবাসী-অধ্যুষিত অন্তবর্তী গ্রামগুলিতে। ইত্যবসরে দেবী নিজেই ‘সলাহ বাই’ নামে পরিচিতি পান, এবং নারী-পুরুষ উভয়েই ভরগ্রস্ত হতে শুরু করে। অবশ্য এই পর্যায়ে এই মাহাত্ম্যের প্রচারের গতি তুলনামূলকভাবে ধীর হয়ে আসে, কারণ ভর হওয়ার অনুষ্ঠানগুলি তখন হত লোকজনের বাড়িতে, স্বল্প উপস্থিতির ভিতর। তখনও এর উপর সরকারি কর্তৃপক্ষের নজর পড়েনি। ভালসাদ এবং পার্দি থেকে এই আন্দোলন পূর্বে ধরমপুর রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এবং কোঙ্কনী উপজাতির মধ্যে স্থিতি লাভ করে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমঘাটের গা বেয়ে সুরগনা রাজ্য এবং নাসিক জেলায় এবং একই সময়ে উত্তর-পূর্ব দাং-এ। শেষোক্ত জায়গায় এই আন্দোলন পোঁছয় ১৯২২ সালের অগস্ট মাস নাগাদ।৩৩
দাং অঞ্চলে এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটে। এতদিন পর্যন্ত আন্দোলনের সুর ছিল নিচু পর্দায় বাঁধা, এবং এর মধ্যে এমন কিছুই ছিল না যাকে স্থানীয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গণ্য করা যেতে পারত। দাং অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে লোকেরা সংঘবদ্ধভাবে সভায় যোগ দিতে শুরু করে। ফলত বনবিভাগের কর্মচারীদের পক্ষে কাঠ-কাটা ও পরিবহণের জন্য শ্রমিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। আন্দোলনের সংগঠন আরও উন্নত হয়েছিল, কারণ দাঙ্গি ওঝারা—যারা ‘গৌলা’ (Gaula) নামেও পরিচিত ছিল—আন্দোলনকে নিয়ে যেত এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। দাং-এর অনেক আদিবাসী মদ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ায় স্থানীয় পারসিরা চটপট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে তাদের বিক্রিবাটা এবং মুনাফা গুরুতরভাবে হ্রাস পেয়েছে। দাং অঞ্চল থেকে গৌলারা নিজেরাই এই আন্দোলনকে নিয়ে যায় উত্তর-পূর্বে খান্দেশে এবং উত্তর-পশ্চিমে সোনগড় তালুকে। দাঙ্গি গৌলারাই এই অঞ্চলগুলিতে প্রথম দেবীর সমাবেশ সংগঠিত করতে শুরু করে।৩৪ কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর আন্দোলনকে নিজের থেকে ছড়ানোর সুযোগ দিয়ে তার সঙ্গে আসে। খান্দেশে যেসব অঞ্চলে গৌলারা গিয়েছিল তার বাইরে আন্দোলন বিস্তৃত হয়নি, কিন্তু দক্ষিণ গুজরাটের রানিমহলে এ আন্দোলন পশ্চিমমুখীভাবে আরব সাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার মতো যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল।
আন্দোলনকে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে প্রসারিত করেছিল সেইসব লোকেরা যারা হয় দেবীর দ্বারা ইতিমধ্যেই আবিষ্ট হয়েছিল নয়তো দেবীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজেদের এলাকায়। দেবী যে আসছেন তা স্থানীয় আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই আঁচ করেছিল, কারণ এ ধরনের জনশ্রুতি কিছুকাল ধরেই ছড়াচ্ছিল। যখন কোনও সভা আহ্বান করা হত—সাধারণত কোনও গ্রামের নেতৃস্থানীয়দের দ্বারা—তখন আশপাশের পল্লীগুলি থেকে অনেকসংখ্যক মানুষ সেখানে জড়ো হত। একবার জমায়েত হলে যে কোনও পুরুষ বা স্ত্রীলোকই ভরগ্রস্ত হতে এবং দেবীর আদেশ উচ্চারণ করতে পারত। যাদের ভর হত তাদের অনেকেই ছিল সাধারণ চাষী। তাদের ভর হবার কোনও ব্যক্তিগত ইতিহাস ছিল না এবং পরে আর কখনওই তারা এইভাবে ভরগ্রস্ত হয়নি। সভাগুলি সাধারণত চলত বেশ কয়েকদিন ধরে, এবং অংশগ্রহণকারীরা হয় সভাস্থলেই থাকত অথবা প্রত্যেকদিন সকালে সমবেত হত। খাবার প্রলোভন এড়ানোর জন্য তারা তাদের মুরগি ও ছাগলগুলিকে ছেড়ে অথবা বিক্রি করে দিয়েছিল। এছাড়াও তারা প্রতিদিন স্নান করতে শুরু করে এবং যাতে এক ফোঁটাও দারু বা তাড়ি না ছুঁতে হয়, সেজন্য সতর্ক হয়। গোপনে ‘অপবিত্র’ অভ্যাসগুলি চালিয়ে যেতে গিয়ে অসংস্কৃত ব্যক্তিরা অলৌককভাবে দেবীর মাধ্যমদের দ্বারা উদঘাটিত হয়েছে এবং সর্বসমক্ষে তাদের অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, এরকম অসংখ্য ঘটনার কথা শোনা গিয়েছিল। সভাগুলির সমাপ্তি সূচনা করেছিল এক গণভোজ এবং দেবীবন্দনার এক চূড়ান্ত অনুষ্ঠান।
এটি ছিল একটি রীতিমতো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যাতে যে কোনও আদিবাসী ভর-হওয়ার ফলে কিছু সময়ের জন্য একজন উচ্চকর্তৃত্বসম্পন্ন ও সম্মানীয় নেতা হয়ে উঠতে পারত। সুতরাং কাঠামোর দিক থেকে দেবী আন্দোলন ঠিক ‘মেসায়ানিক’ আন্দোলন ছিল না।৩৫ ঈশ্বরের দ্বারা আবিষ্ট হওয়াই ছিল এই পর্যায়ে আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। সারা দুনিয়ার দরিদ্র ও নিম্নবর্গের মানুষেরা তাদের সমষ্টিগত ক্ষোভ ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার জন্য প্রায়শই এই উপায়টিকেই বেছে নিয়েছে। আই. এম. লিউইস তাঁর দৈবাবেশ-সংক্রান্ত ধর্মাচরণ সম্পর্কে সমীক্ষায় দেখিয়েছেন যে যেসব উপজাতিরা গত শতাব্দীতে কঠিনতম ক্লেশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল তাদের মধ্যেই প্রেবেশের বহিঃপ্রকাশের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।৩৬ এভাবেই তারা তাদের উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি খুঁজে পায়। ভারত প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে রিচার্ড ল্যানয় বলেছেন যে ‘দৈবাবেশ কেবল বিশৃঙ্খল একটি মূর্ছারোগমাত্র নয়, বরং কাঠামোবদ্ধ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত রীতিবদ্ধ একটি ঘটনা যা সংস্কৃতি-সৃষ্টিকারী হতে পারে এবং ব্যক্তির ও দলের চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।’৩৭ ১৯২২-২৩-এর সলাহ বাই-সংক্রান্ত ঘটনাসমষ্টিকে এই শর্তের নিরিখেই বোঝা প্রয়োজন। দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী সাধারণের আকাঙ্ক্ষা ও তাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত অন্যায়ের ধারণাকে ব্যক্ত করতে সাহায্য করেছিল দৈবাদেশের তরঙ্গ।
৪
প্রেতমাধ্যমের সাহায্যে উচ্চারিত দেবীর প্রত্যাদেশগুলি এক জমায়েত থেকে আর এক জমায়েতে রীতিমতো ভিন্নরকমের চেহারা নিত—একটি বিক্ষিপ্ত সংগঠনহীন আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা প্রত্যাশিত। স্থানীয় পরিবেশ স্পষ্টতই এই প্রত্যাদেশগুলির কয়েকটিকে নির্দিষ্ট করেছিল। উদাহরণ হিসেবে, ভিয়ারা তালুকে দেবী আদিবাসীদের আদেশ দেন খ্রিস্টান না হবার জন্য।৩৮ ভিয়ারা ছিল মিশনারি কার্যকলাপের একটি কেন্দ্র। যাই হোক, এই সমস্ত রকমফেরের মধ্যেও আদেশগুলির একটি সারাৎসার শনাক্ত করা, এবং সেটিকে নীচের শীর্ষকগুলির মাধ্যমে শ্রেণীবিভক্ত করা সম্ভব:
১. মাদক(ক) সুরা বা তাড়ি খেয়ো না।
(খ) সুরা বা তাড়ির দোকানে কাজ কোরো না।
(গ) তাড়ি গাছ থেকে তাড়ি নিষ্কাশন কোরো না।
২. মাংস(ক) মাংস বা মাছ খেয়ো না।
(খ) (খাওয়া বা বলির জন্য রেখে দেওয়া) সমস্ত জ্যান্ত মুরগি, ছাগল ও ভেড়া বিক্রি করে দাও।
(গ) মাংস রান্নার সমস্ত পাত্রগুলি নষ্ট করে ফেল।
(ঘ) বাড়ির চালগুলি (আদিবাসী গ্রামে সাধারণত খড়ে-ছাওয়া) সরিয়ে ফেল এবং পুড়িয়ে দাও, কারণ মাংস রান্নার জন্য ব্যবহৃত আগুনের ধোঁয়া এই চালগুলির মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
৩. পরিচ্ছন্নতা(ক) প্রত্যেকদিন স্নান করো (কোনও কোনও ক্ষেত্রে দিনে দুবার বা তিনবার)।
(খ) মলত্যাগের পর শৌচকর্মের জন্য জল ব্যবহার করো।
(গ) বাডি ও উঠোনগুলি ঠিকঠাক পরিষ্কার রাখে।
৪. প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী(ক) পারসিদের বয়কট করে।
(খ) মুসলমানদের বয়কট করো।
(গ) সুব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এমন কারও জন্য কাজ কোরো না।
(ঘ) বেতনবৃদ্ধি দাবি করো।
(ঙ) কোনও পারসির ছায়া মাড়ালে স্নান করো।
এই আদেশগুলি আদিবাসীদের জীবনচর্চায় এক সার্বিক পরিবর্তন দাবি করেছিল। দারু ও তাড়ি খাওয়া ছিল এদের সংস্কতিরই এক সম্যক অঙ্গ। এই পানীয়গুলি মূল্যবান খাদ্যবস্তু হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তো ছিলই—বিশেষত গ্রীষ্মকালে, যখন খাদ্যের ভাণ্ডারে টান পড়ত। উপরন্তু বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও এগুলি ব্যবহৃত হত এবং অনেক ধর্মীয় উৎসবে তথা বিবাহে এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও অবাধে পান করা হত।৩৯ একই ভাবে আদিবাসী ক্রিয়াবিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বলি। বলির মাংস পরে খাওয়া হত। প্রাত্যহিক স্নানের প্রথা সেই সময়ে সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল না, কেননা আদিবাসী গ্রামগুলিতে জল সরবরাহের ব্যবস্থা প্রায়শই শুধুমাত্র জলপানের উদ্দেশ্যেও যথেষ্ট ছিল না। অতএব, অনুগামীদের জীবনযাত্রাকে সহজতর করে তোলাই দেবীর যাবতীয় আদেশের উদ্দেশ্য ছিল না। এগুলির অন্তর্নিহিত যুক্তিগুলিকে আমাদের আরও ভাল করে পরীক্ষা করা দরকার।
সেই সময় বেশ কিছু পর্যবেক্ষক একে দেখেছিলেন আদিবাসীদের ‘বিশুদ্ধীকরণ’ আন্দোলন হিসেবে। যেমন, গান্ধীবাদী নেতা সুমন্ত মেহতা একে আদিবাসীদের ‘আত্মশুদ্ধি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।৪০ দেখা যাচ্ছে যে এই উপলব্ধিকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে ‘সংস্কৃতায়ন’ প্রক্রিয়াটি, যাকে এম. এন. শ্রীনিবাস বর্ণনা করেছেন এইভাবে:
সংস্কৃতায়ন হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি ‘নিচু’ হিন্দু জাতি বা উপজাতি বা অন্য কোনও গোষ্ঠী তার লোকাচার, ক্রিয়াবিধি, মতাদর্শ ও জীবনচর্যাকে একটি উঁচু, এবং প্রায়শই ‘দ্বিজ’ জাতির আদলে পরিবর্তিত করে। বর্ণভিত্তিক স্তরকাঠামোয় ওই জাতির যে স্থান স্থানীয় সমাজের দ্বারা সনাতনভাবে স্বীকৃত। তার থেকে উচ্চতর স্থানের দাবি সাধারণত এই ধরনের পরিবর্তনের পরেই আসে। এই দাবির স্বীকৃতি পেতে লেগে যায় বেশ কিছু সময়, বলতে কি, দু-এক পুরুষও।৪১
এই প্রত্যয়টির নিরিখে ভারতীয় সমাজের গতিসূত্রগুলিকে সাপলুডো খেলার মতোই মন্থরতায় আক্রান্ত বলে দেখানো হয়েছে। এই খেলায় যোগদান করার সময় খেলুড়েরা থাকে অশুদ্ধ, এবং পুরুষানুক্রমে তারা ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতার পথে এগিয়ে যায়। এই অগ্রগতির পথে থাকে নানা খানাখন্দ, এবং বেশিরভাগ সম্প্রদায়ের পক্ষেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভবই হয় না। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অবশ্য অবিসংবাদিত: ‘সংস্কৃতায়নের ব্রাহ্মণ্য, এবং মোটের উপর শুদ্ধাচারনিষ্ঠ পথটিই এযাবৎ সার্বিক প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। এমনকি মাংসাশী এবং মদ্যপায়ী ক্ষত্রিয় তথা অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিও অন্যান্য পথের তুলনায় এই পথটির শ্রেষ্ঠত্বকেই পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে।’৪২
শ্রীনিবাস আরও বলেন, ‘সংস্কৃতায়ন শুধুমাত্র হিন্দু বর্ণগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিম ভারতের ভিল, মধ্যভারতের গোন্দ এবং ওরাওঁ এবং হিমালয়ের পাহাড়িদের মতো উপজাতি এবং আধা-উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যেও এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ করা যায়। এর ফলে সাধারণত যে উপজাতি সংস্কৃতায়নের সাহায্য নিচ্ছে তারা নিজেদের হিন্দু বর্ণপ্রথার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে।’৪৩ বলা যেতে পারে যে দেবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সুরাবর্জন, নিরামিষাহার এবং পরিচ্ছন্নতার মতো নব্য শুদ্ধাচারগুলি পালনের মাধ্যমে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসীরা শুদ্ধ বর্ণ হিসেবে হিন্দু বর্ণভিত্তিক সমাজকাঠামোর ভিতর অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাচ্ছিল। অতএব এই আন্দোলনকে আদিবাসী সমাজে সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার একটি নাটকীয় উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
অবশ্য এই প্রত্যয়টির ব্যবহারে কিছু অসুবিধা রয়েছে। শ্রীনিবাসের উপরোক্ত উক্তিটি ওরাওঁদের সম্বন্ধে। ওরাওঁ সমাজে সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে এস. সি. রায়ের উৎকৃষ্ট গ্রন্থটি পড়লে বোঝা যায় যে রায় নিজে এই ধরনের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেননি। তিনি লেখেন যে আর্য সমাজ প্রভৃতি হিন্দু সংস্কারক গোষ্ঠীগুলি ‘শুদ্ধি’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওরাওঁদের হিন্দু সমাজের আওতার মধ্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। কারণ রায়ের মতে, ‘আলোকপ্রাপ্ত ওরাওঁ নেতারা স্বভাবতই এই ধরনের প্রচারকদের এড়িয়ে চলত। কারণ তাদের ভয় ছিল (এবং এই ভয় আদৌ অমূলক ছিল না) যে দ্বিজ বর্ণগুলির ধর্মীয়-সামাজিক বিশেষ মর্যাদা নিয়ে গড়ে-ওঠা শাস্ত্রানুগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম বর্ণান্তরিত আদিবাসীদের স্থান দেবে হিন্দু বৰ্ণস্তর কাঠামোর একেবারে নীচে না হলেও বেশ নীচের দিকে।’৪৪ অন্যান্য তথ্যসূত্র থেকেও অনুমান করা যায় যে মোটের উপর আদিবাসীরা বর্ণস্তরকাঠামোয় কোনও স্থান দাবি করেনি। অবশ্য একথা সত্যি যে ক্ষেত্রবিশেষে তারা নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবি করেছে।৪৫ এই ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ক্ষত্রিয়রা মাংসাহার এবং সুরাপানের মতো ‘অপবিত্র’ ক্রিয়াকর্মের শরিক হয়েও উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ক্ষত্রিয়োচিত প্রতিষ্ঠার দাবিদার আদিবাসীরা চায় যে ‘অপবিত্র’ আচারবিধিতে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো হোক। কিন্তু সম্প্রতিকালে এই ধরনের উদাহরণগুলি ব্যতিক্রমী হয়ে দাঁড়িয়েছে।৪৬ দেবী আন্দোলনের মতো বিশুদ্ধিকরণ আন্দোলনগুলির কার্যপ্রণালীতে এসেছে পরিবর্তন। এই ধরনের আন্দোলনে আদিবাসীরা কিছু কিছু হিন্দু মূল্যবোধ গ্রহণ করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে বর্ণপ্রথায়। অন্তর্ভুক্তির দাবি থেকে বিরত থেকেছে। সুতরাং এই উদাহরণগুলি থেকে আদিবাসীরা যে বর্ণপ্রথাকে মেনে নিয়েছে, এমন মনে করে নেওয়াটা অযৌক্তিক হবে। বরং বলা যেতে পারে উচ্চবর্ণোচিত জীবনচর্যা গ্রহণের মাধ্যমে আদিবাসীরা উচ্চবর্ণের হিন্দুর সমমর্যাদার দাবিদার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংস্কৃতায়ন তত্ত্বের আর একটি অসুবিধা হল এই যে, এই তত্ত্বে যথোচিত গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি সেই সংঘাতময় প্রক্রিয়ার উপর, যার মাধ্যমে এইসব দাবিদাওয়াকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে হয়। শ্রীনিবাসের তত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে লুই দুমঁ দেখিয়েছেন, যেসব নিম্নবর্গের বর্ণ বা উপজাতি তাদের জীবনচর্যায় সংস্কার নিয়ে আসে, তাদের পক্ষেও এই পদ্ধতির মাধ্যমে নিজেদের সামাজিক সংস্থানকে উন্নত করা খুবই কঠিন। রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে উচ্চবর্ণগুলির কাছ থেকে বলপূর্বক এই সংস্থান আদায় করে নিতে হয়। এইভাবে কোনও সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং বর্ণকাঠামোয় তাদের অবস্থান পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে পড়ে।৪৭ ফলত আদিবাসীদের পক্ষে উচ্চতর মর্যাদা বা সামাজিক সমস্থিতি দাবি করা বৃথা, যদি না একইসঙ্গে ক্ষমতাশালী সম্প্রদায়গুলির প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে তারা একটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। দেবীর আদেশগুলিকে বিশ্লেষণ করলে ঠিক এই জিনিসটিই চোখে পড়ে: এইজন্যই আদিবাসীরা উচ্চবর্ণোচিত মূল্যবোধ গ্রহণের কার্যসূচির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় প্রতিপত্তিশালী পারসি ভূস্বামী ও সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এক বয়কট আন্দোলন। প্রচলিত সমাজকাঠামোর উপর যে আক্রমণ এই ধরনের আন্দোলনের একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ, সংস্কৃতায়ণ তত্ত্বে তাকে এড়িয়ে গিয়ে শুধুমাত্র ‘বিশুদ্ধীকরণের’ দিকটির উপরেই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এছাড়াও, কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক মাত্রা এই তত্ত্বে অনুপস্থিত। এতে মনে করা হয়েছে যে অনন্তকাল সবাই শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতার লক্ষমাত্রায় পৌঁছানোর জন্যই চেষ্টা করে যাবে। শ্রীনিবাসের কথায়, ‘…সংস্কৃতায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত যে সচলতা, তা প্রচলিত সমাজে শুধুমাত্র অবস্থিতিগত পরিবর্তন নিয়ে আসে, অবয়বগত পরিবর্তন নয়। অর্থাৎ একটি বর্ণ তার প্রতিবেশী বর্ণদের উপরে উঠে যায়, এবং আর একটি নেমে আসে; কিন্তু এই সমস্ত কিছুই ঘটতে থাকে একটি মূলত দৃঢ়বদ্ধ স্তরবিভাজিত সমাজকাঠামোর মধ্যে। এই সার্বিক প্রথার কোনও পরিবর্তন হয় না।’৪৮ আমাদের পূর্বব্যবহৃত রূপকের নিরিখে বলা যায় যে সাপলুডো খেলা চলতে থাকে, কিন্তু এই খেলার ছক কখনওই পালটায় না। অথবা বিকল্প ঐতিহাসিক এবং দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে যে-কোনও সমাজব্যবস্থাই তার পূর্ববর্তী সমাজব্যবস্থাগুলি থেকে উদ্ভূত এক সংশ্লেষ। আদিবাসী ও হিন্দুসমাজের বহু বছরব্যাপী মিথস্ক্রিয়ার থেকে জন্ম নেয় এমন এক নতুন সংশ্লেষ যা পুরোপুরি উপজাতীয় বা বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ্য, কোনওটিই নয়। দেবী আন্দোলনের মতো আন্দোলনগুলি তাদের বিশিষ্টতা লাভ করে এমন এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের প্রেক্ষিতে, যখন উপজাতীয় এবং অনুপজাতীয় উপাদানগুলির তীব্র বৈপরীত্য সংশ্লেষের প্রয়োজনকে জোরালো করে তোলে।
তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে এই ধরনের আদিবাসী আন্দোলনগুলি ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। আজ পর্যন্ত এগুলি চলে আসছে। অতীতে আদিবাসীরা ভারতীয় জনজীবনের মূলস্রোতটি থেকে নিজেদের অনেকখানিই বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পেরেছিল। অনুপজাতীয় উচ্চবর্গের মুল্যবোধগুলি তারা আত্তীকৃত করবে এমন আশা করা হত না, এবং সেরকম করার কোনও পার্থিব তাগিদও তাদের ছিল না। আত্তীকরণ কখনও-সখনও ঘটলেও তা হত অতিমাত্রায় আংশিক, অথবা তা প্রভাবিত করত আদিবাসীদের একটি ক্ষুদ্রাকার উচ্চবর্গকে, যারা ‘রাজপুত’ ইত্যাদি প্রতিপত্তিসূচক উপাধি গ্রহণ করে স্বীয় সম্প্রদায় থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখত। এই অবস্থার পরিবর্তন আসে উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ, যখন ব্রিটিশরা আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে সম্পূর্ণভাবে বিজয় ও বশীভূত করতে সমর্থ হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ঔপনিবেশিক আইন বলবৎ হয়, এবং আদিবাসী অঞ্চলগুলি অর্থনৈতিক শোষণের সম্মুখীন হয়। এইভাবে আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রের আবির্ভাব-প্রক্রিয়াই গড়ে দেয় এই আন্দোলনগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। এর থেকে আবির্ভূত আদিবাসী সংস্কারপ্রবক্তারা একটি কৃষ্টিগত সংশ্লেষ গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে এই সংশ্লেষ নতুন সমাজে তাঁদের সম্প্রদায়কে একটি সম্মানজনক স্থান এনে দেবে।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী শ্রেণীগুলির মূল্যবোধই আদিবাসীদের অনুমোদন লাভ করেছিল। তাদের কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আদিবাসীরা মূল্যবোধ ও ক্ষমতার সম্বন্ধ সম্পর্কে তাদের সচেতনতা প্রকাশ করেছিল। কেননা, মূল্যবোধের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ক্ষমতার সেই উপাদান যার মাধ্যমে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলি ন্যূনতম বলপ্রয়োগের সাহায্যে অধীনস্থ শ্রেণীগুলিকে বশীভূত করে। এর সুস্পষ্ট উদাহরণ, যেমন, ‘শুদ্ধতা’-র ব্রাহ্মণ্য ধারণাটি ভারতের তথাকথিত ‘অপবিত্র’ অধীনস্থ শ্রেণীগুলির উপর একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। আত্মসাৎকরণের মাধ্যমে এ-ধরনের মূল্যবোধগুলির উপর একটি গণতান্ত্রিক চরিত্র আরোপ করে আদিবাসীরা এদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যশক্তি হরণ করতে চেষ্টা করেছিল।
অতএব ক্ষমতাকেন্দ্রিক সম্পর্কই আমাদের আলোচ্য বিষয়। বিভিন্ন মূল্যমান-ব্যবস্থা নয়। এই মোদ্দা কথাটি বুঝতে পারলেই নানা ক্ষেত্রে আদিবাসীদের গৃহীত বিভিন্ন কার্যসূচির কেন্দ্রীয় যুক্তিটিকে বোঝা সহজতর হয়ে ওঠে। দেশীয় জনসাধারণের মধ্যে স্থানীয় প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির মূল্যবোধ অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসীরা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতে আদিবাসীরা ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে, কারণ তারা খ্রিস্টীয় মিশনারিদের মূল্যবোধকে ব্রিটিশদের ক্ষমতার সঙ্গে একাত্ম করে দেখেছিল। দক্ষিণ গুজরাটে তারা তাদের প্রত্যক্ষ শোষক পারসিদের মূল্যবোধগুলিকে বর্জন করেছিল কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ও বানিয়াদের প্রতিপত্তিশালী আঞ্চলিক সংস্কৃতির অনুমোদন করে। যে মূল্যবোধগুলিকে আত্মসাৎ করা হত সেগুলি হয় ছিল ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর মূল্যবোধ, নতুবা কোনও আঞ্চলিক প্রতিপত্তিশালী দেশীয় শ্রেণীর, নয়তো আদিবাসীদের স্থানীয় শোষকদের। অনুমোদিত মূল্যবোধগুলির মধ্যে পার্থক্য ছিল বিস্তর, কিন্তু ক্ষমতাচর্চার অনুষঙ্গ ছিল তাদের সাধারণ ধর্ম।
আধিপত্যশালী মূল্যবোধ আত্তীকরণের এই কার্যসূচিগুলির একটি প্রধান শক্তি ছিল এই যে এগুলি আদিবাসী সম্প্রদায় এবং প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির কিছু কিছু প্রগতিশীল সদস্যের মধ্যে এক ধরনের সংযোজক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এখানেই ছিল এদের সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর মূল্যবোধ সরাসরি বর্জন করার কার্যসূচিগুলির মূল তফাৎ। উচ্চশ্রেণীর প্রগতিশীলদের মধ্যে কেউ কেউ উন্নত ধরনের উদারপন্থী মতামত পোষণ করতেন, অর্থাৎ জাতীয় সংহতি এবং একটি গণতান্ত্রিক ভারতীয় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলায় বিশ্বাস করতেন। এছাড়া ছিলেন সেইসব রাজনীতিকরা যাঁরা আদিবাসীদের দেখতেন ক্ষমতার একটি সম্ভাব্য উৎস হিসেবে। উপজাতীয় জনসাধারণের দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী এবং তাঁদের স্বীয় শ্রেণীর অন্যান্য সদস্যের বিশ্বাস উৎপাদনের ব্যাপারে এই মানুষগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারতেন। সুতরাং এই ধরনের আদিবাসী আন্দোলনগুলি উচ্চবর্গের অন্তর্বিভেদের সুযোগ নিয়েছিল।
এইবার যদি আমরা দেবীর প্রত্যাদেশগুলির দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব যে সেগুলি দুটি দিক থেকে আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করেছিল। একদিকে সেগুলি আঞ্চলিক প্রতিপত্তিশালী উচ্চবর্ণের হিন্দু মূল্যবোধগুলিকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিল। এই গণতন্ত্রীকরণ-প্রচেষ্টার মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। এই প্রসঙ্গে যে ব্যাপারটি তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, যদিও বানিয়া ও ব্রাহ্মণ বণিক এবং কুসীদজীবীরা আদিবাসীদের শোষণ করত, তৎসত্ত্বেও দেবীর প্রত্যাদেশগুলিতে কখনওই তাদের বয়কট করার কথা বলা হয়নি। এই বয়কট আরোপ করা হয়েছিল শুধুমাত্র পারসি এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপর। এর যুক্তি ছিল এইরকম যে, যেখানে বানিয়া ও ব্রাহ্মণদের ‘পবিত্র’ জীবনাচরণ আদিবাসীদের মধ্যে আত্তীকরণের তাগিদ জাগিয়ে তুলেছিল, সেখানে পারসি এবং মুসলমানেরা ছিল ‘অপবিত্র’। অন্যদিকে স্থানীয় শোষণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে লোভী বলে পরিচিত পারসিদের বিরুদ্ধে দেবীর প্রত্যাদেশগুলি ছিল এক আত্মঘোষণা। সুরাপান থেকে বিরত হয়ে এবং সুরাব্যবসার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় ব্যক্তির হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করে আদিবাসীরা পারসিদের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক বন্ধনসূত্রগুলি ছিন্ন করেছিল। এদিক থেকে সুরাপান ছেড়ে দেওয়া ছিল বেআইনি মদ-চোলাই প্রভৃতি ছলনামূলক কার্যকলাপের থেকে অনেক বেশি কার্যকর আত্মঘোষণা, কারণ এই বর্জনের পিছনে কাজ করেছিল এক বিরাট নৈতিক শক্তি।
সুতরাং এই বিশেষ অঞ্চলটিতে দেবীর প্রত্যাদেশগুলিকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল আদিবাসী আত্মঘোষণার এক শক্তিশালী কার্যসূচি। রানিমহলে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিল তাদের সবাইকেই এই আন্দোলন বেশ ধাক্কা দেয়। বিশেষত পারসি সুরাব্যবসায়ী তথা ভূস্বামীদের প্রতি এটি ছুঁড়ে দেয় এক চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন সম্পর্কে আদিবাসী সমাজ-বহির্ভূত অংশের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি এবার খতিয়ে দেখা যাক।
৫
ভূতাবেশ-সংক্রান্ত ধর্মীয় আচারবিধি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে কোনও বড় ধরনের আঘাতকে সূচিত করে না। আই. এম. লিউইস দেখিয়েছেন যে প্রতিপত্তিশালী শ্ৰেণীরা প্রায়শই এগুলিকে, অস্বস্তির সঙ্গে হলেও, মেনে নেয়। ভুতাবেশকে মনে করা হয় এমন এক চাপ-নিষ্কাশক যন্ত্র যা ন্যূনতম সামাজিক সম্ভোগের বিনিময়ে নিম্নবর্গের প্রচ্ছন্ন নাশকতামূলক অনুভূতিগুলিকে প্রশমিত করতে পারে।৪৯ যাই হোক, প্রতিরোধের সম্পূর্ণ আচারভিত্তিক এবং অপেক্ষাকৃত স্পষ্টতর ধারাদুটির মধ্যে বিভাজক রেখাটি কিন্তু সহজেই অতিক্রম্য। এইজন্যই প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলি এ-ধরনের ধর্মাচরণবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখে, যাতে কোনওরকম বাড়াবাড়ি ঘটলেই তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। দেবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীগুলির টনক নড়েছিল তখনই যখন আদিবাসীরা দলে দলে জমায়েত হতে শুরু করে, কেননা এ ধরনের বিশাল জনসভার মধ্যেই নিহিত ছিল সক্রিয়তর প্রতিরোধ ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের বীজ।
দেবী আন্দোলন নে এক দুর্ঘটনা তা পারসিরা তাড়াতাড়িই বুঝতে পেরেছিল। তাদের সুরাব্যবসা কমতে কমতে শূন্যে এসে দাঁড়ায়, আদিবাসীরা তাদের তাল গাছগুলি থেকে তাড়ি নিষ্কাশন করতে প্রত্যাখ্যান করে, প্রত্যেকেই তাদের জমিতে কাজ করতে অথবা বাড়ির চাকর হতে অস্বীকার করে, এবং তার সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হয়। আরও অপমান করার উদ্দেশ্যে পারসিদের ছায়া মাড়ালেই আদিবাসীরা নিজেদের ‘পবিত্র’ করার জন্য স্নান করতে শুরু করে; কেউ কেউ এমনকি পারসিদের পারস্যে ফিরে যাওয়ার জন্যও উপদেশ দেয়। আন্দোলন সম্পর্কে পারসিদের প্রতিক্রিয়ার ধরন থেকেই বোঝা যায় যে তাদের সামাজিক অবস্থানের উপর এই আঘাতকে তারা কত গুরুতরভাবে দেখেছিল। কখনও কখনও আবগারি বিভাগের কর্মচারিদের সহায়তায় পারসিদের গুণ্ডাবাহিনী একজন আদিবাসীকে পাকড়াও করে জবরদস্তি মদ গিলিয়ে দিত। এইভাবে ওই আদিবাসীটির ব্রত ভঙ্গ করে তাকে আবার শাস্ত্রমতে অপবিত্র বানিয়ে দেওয়া হত। প্রতিরোধকারীদের মারধর করা হত, এমনকি সাজানো অভিযোগে গ্রেফতারও করা হত।৫০ কোনও কোনও ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের পানীয়জলের সঙ্গে মদ খেতে বাধ্য করার জন্য পারসিরা গ্রামের কুয়োগুলিতে তাড়ি ঢেলে দিত। এছাড়াও আদিবাসীদের নব্য ‘শুদ্ধাচার’-কে উপহাস করার জন্য তারা তাদের মন্দির ও পবিত্র স্থানগুলিতে মলমূত্র ত্যাগ করত।৫১
দেবী আন্দোলন এমনকি বহু স্থানীয় কর্মচারীর কাছেও জনপ্রিয় ছিল না। তাদের কাছে আদিবাসীরা বরাবরই ছিল নিকৃষ্ট ও বশংবদ এক জনগোষ্ঠী যাকে অতি সহজে এবং কোনওরকম বিবেক দংশন ছাড়াই শোষ করা যায়। কিন্তু এখন আত্মঘঘাষণার এই নতুন সুর তাদের বুঝিয়ে দেয় যে বিনামূল্যের জিনিসপত্র, পরিচর্যা এবং শ্রমের যোগান এখন থেকে আর সুনিশ্চিত থাকবে না। ঘুষ থেকে তাদের রোজগারের পথটি বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আন্দোলনকে হীনবল করতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে, এবং বহু ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মনোবল ভাঙার কাজে পারসিদের সঙ্গে হাত মেলায়। ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে স্থানীয় কর্মচারীরা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিশেষ মদত পায়নি, কিন্তু পেয়েছিল বরোদা রাজ্যভুক্ত অঞ্চলগুলিতে। এর পরে আমাদের আলোচ্য বিষয় হবে যথাক্রমে বরোদা রাজ্যে এবং ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলে আন্দোলন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়ার রকমফের।
‘বাইরে থেকে এসে যেসব লোক এ-ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বেঁধে ফেলার জন্য’৫২ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়াই ছিল ভিয়ারা তালুকস্থিত বরোদার রাজকর্মচারীদের প্রথম প্রতিক্রিয়া। মদ ছেড়ে দিয়েছে, এমন আদিবাসীদের আর একবার সুরাপান করতে প্ররোচিত করার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা হয়। মাদক-পরিহারের একজন সমর্থক, ভিয়ারা মিশনের রেভারেন্ড ব্লান্ট, এই ঘটনা শোনার পর বরোদার গাইকোয়াড়ের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী সি. এন. সেনের কাছে প্রতিবাদ জানান। সেডন আদেশ জারি করেন যে কর্মচারীরা দেবী আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করবে না এবং একে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ার অবকাশ দেবে।৫৩ আন্দোলন রোধ করার জন্য জেলা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করার উদ্দেশ্যে পঁচিশজন পারসির একটি প্রতিনিধিমণ্ডলী ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে নৌসারিতে যায়। কিন্তু পুলিশ-প্রধান অথবা সুবা-র (জেলা কালেক্টরের সমতুল) কেউই তাদের কথা শুনতে রাজি ছিলেন না।৫৪
এর অল্প কিছুকাল পরেই বরোদার দেওয়ান স্যার মনুভাই মেহতা সিদ্ধান্ত নিলেন আন্দোলন বন্ধ করতেই হবে। পরে তাঁর নিজের যুক্তিগুলি জানিয়ে তিনি গাইকোয়াড়কে (যিনি তখন ছিলেন ইউরোপে ভ্রমণরত) এক চিঠি দেন।৫৫ তিনি জানান যে রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীরা এবং অসহযোগীরা আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে; পারসিদের ভয় দেখানো হচ্ছে এবং জাতিগত বিবাদের সূচনা হয়েছে; আন্দোলনকারীরা অনেকগুলি তালগাছ কেটে ফেলার ভয় দেখাচ্ছে, যা সরকারি আবগারি রাজস্বের ক্ষতি করবে; বহু স্কুলশিক্ষক আন্দোলনকে সমর্থন করছেন এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে সরকারি আবগারি রাজস্ব-নীতির সমালোচনা করে ভাষণ দিচ্ছেন; ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে; বনবিভাগের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে; আদিবাসীরা তাদের জমি চাষ না করে এবং পারসিদের হয়ে কাজ করতে অস্বীকার করে (যার ফলে তারা বেতন হারাচ্ছে) অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিজেদেরই ধ্বংস করছে। আন্দোলনের লক্ষের প্রতি মনুভাই মেহতার সহানুভূতির অভাব এইভাবে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তাঁর বক্তব্যে একই সঙ্গে দেখা গিয়েছিল যে কোনও মূল্যে আবগারি রাজস্ব বজায় রাখার এক আমলাতান্ত্রিক ইচ্ছা, পারসিদের দৃষ্টিকোণের প্রতি প্রবল পক্ষপাতিত্ব, আন্দোলন সম্পর্কে অজ্ঞতা (আদিবাসীরা কখনোই নিজেদের জমিতে কাজ করতে অস্বীকার করেনি), এবং এক আশঙ্কা যে রাজ্যের জাতীয়তাবাদী নেতারা নৌসারি জেলার আদিবাসীদের মধ্যে একটি জোরদার ঘাঁটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আন্দোলনটিকে ব্যবহার করতে পারে।
রানিমহলে জনসমাবেশ অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করা হয়। দেবীর সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যকলাপে অংশ না নেওয়ার জন্য সরকারি চাকুরে এবং স্কুলশিক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়। গোটা নৌসারি জেলা জুড়ে তালগাছ কাটা নিষিদ্ধ হয়।৫৬ পারসি ও আদিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেখানে সবচেয়ে তীব্র ছিল, সেই মাহুবা তালুকে পাঠানো হয় বাড়তি পুলিশ।৫৭
বরোদা রাজ্যের জাতীয়তাবাদীরা এসব ব্যাপার-স্যাপার শান্তভাবে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিগত তিন বছর ধরেই নৌসারি শহরে গান্ধীবাদী আন্দোলন বেশ জোরদার সমর্থন পেয়ে আসছিল।৫৮ ১৯২৩ সালের গোড়ার দিকে এই শহরের মুখ্য জাতীয়তাবাদীরা ‘কালিপরজ সংকট নিবারণমণ্ডল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। বরোদা শহরের নেতা সুমন্ত মেহতা এর সভাপতি হতে রাজি হন। সমিতির সদস্যরা কর্তৃপক্ষের হাতে হয়রানি থেকে আদিবাসীদের রক্ষা করার জন্য গ্রামে যেতে শুরু করেন। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সরকারি অত্যাচার সম্পর্কে স্বয়ং তদন্ত করার উদ্দেশ্যে সুমন্ত মেহতা ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে নৌসারিতে যান। বরোদায় ফেরার পর তিনি দেখা করেন দেওয়ানের সঙ্গে, যিনি আবার তাঁর এক আত্মীয়। এঁর কাছে তিনি দাবি করেন যে নৌসারি জেলায় মদ্যপান ও সুরাব্যবসা নিষিদ্ধ করা হোক। সুরার উপর নিষেধাজ্ঞা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যর্থ হয়েছে, এই যুক্তিতে মনুভাই মেহতা এই অনুরোধ খারিজ করে দেন, কিন্তু যে অঞ্চলে আন্দোলন ছিল সবচেয়ে বেশি জোরদার সেখানে কয়েকটি মদের দোকান বন্ধ করে দেবার আদেশ দিতে তিনি রাজি হন।৫৯
রানিমহলে সমাবেশ করার অভিযোগে বরোদা সরকার ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে কালিপজ সংকট নিবারণমণ্ডলের পাঁচজন প্রধান সদস্যের বিরুদ্ধে নালিশ আনে। এই মোকদ্দমার শুনানি হয় আগস্ট মাসের গোড়ায়, এবং গোপানজী দেশাই নামে ভিয়ারার এক প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞ অভিযুক্ত নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে নৌসারির নেতাদের সঙ্গে আদিবাসীদের কথাবার্তা ছিল একান্তই অনিয়মিত, এবং দু পক্ষের মধ্যে সে অর্থে কোনও সমাবেশ হয়নি। ফলত এই নেতাদের উপর থেকে অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।৬০ শহরের নেতাদের নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়ে নৌসারির সুবা অতঃপর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আদিবাসীর বিরুদ্ধে এক মামলা শুরু করেন। পারসি এবং অন্যান্য মালিকদের খামারে কাজ করা থেকে স্বীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের বলপূর্বক নিবৃত্ত করার দায়ে এদের অভিযুক্ত করা হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলা হয় যে ওই সময়ের মধ্যে তাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে হবে, এবং তা করতে ব্যর্থ হলে আবার আদালতে হাজির হতে হবে।৬১ এই দমননীতি সত্ত্বেও সুরাবর্জন ও পারসি-বয়কট আন্দোলন বরোদার রানিমহলে, বিশেষত মাহুভা তালুকে, বেশ ভালভাবেই চলতে থাকে।৬২ এতেই বোঝা যায় যে বাইরের জাতীয়তাবাদী নেতাদের প্রচেষ্টা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। হতাশ হয়ে মনুভাই মেহতা ১৯২৩ সালের ১ নভেম্বর এক আদেশ জারি করে রানিমহলে সভাসমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও ছমাস বাড়িয়ে দেন, এবং দেবীমাহাত্ম সংক্রান্ত যাবতীয় সমাবেশও নিষিদ্ধ করে দেন।৬৩ এইভাবে অবশেষে বরোদা সরকার দেবীকে নিষিদ্ধ করেন। মেহতার বিজ্ঞপ্তিতে (যা জারি করা হয়েছিল নৌসারির সুবার নামে) প্রকাশিত কিছু কিছু ধারণা আন্দোলন সম্পর্কে বরোদা সরকারের মনোভাব সম্বন্ধে চিত্তাকর্ষক আলোকপাত করে। এতে এরকম ইঙ্গিত ছিল যে শহরের গোলযোগকারীরাই দেবীকে সৃষ্টি করেছে:
কোনও কোনও যড়যন্ত্রকারী লোক শাসক এবং শাসিতের কিসে মঙ্গল হবে তা না জেনেই কালিপরজদের কাছে ব্যাপারটা ভুলভাবে সাজিয়েছে, তাদের ভয় দেখিয়েছে, এবং তাদের বড় বড় জমায়েত ডাকতে প্ররোচিত করেছে…এইসব লোকেরা রাজকর্মচারীদের বিরুদ্ধে কালিপরজদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করে, এবং ফলত সরকারের প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে ক্ষুণ্ণ করে। এছাড়াও তারা সরকারি বিচারব্যবস্থার উপর কালিপরজদের আস্থা ভাঙতে চায়, এবং তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে সরকার তাদের সম্প্রদায়ের প্রকৃত মঙ্গল সম্পর্কে উদাসীন।৬৪
এই আদেশ কিছুটা অসংলগ্নভাবেই দেখানোর চেষ্টা করেছিল যে দেবী জনগণের ভ্ৰান্তদিশারী এক অশুভ শক্তিমান এবং এই দেবীর ‘দুষ্ট ক্রিয়াকলাপ’ সহ্য করা যায় না। এই বক্তব্যগুলি যে শুধু পরস্পরবিরোধী তাই নয়, পরিষ্কার বোঝা যায় যে এই তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ দেশীয় রাজ্যগুলি আদিবাসীদের আত্মঘোষনাকে মেনে নিতে পারছিল না। উনিশ শতকের শেষভাগে যে রাজ্য আদিবাসী-প্রশিক্ষণের পথিকৃৎ হিসাবে কাজ করেছিল, এক প্রজন্মের ব্যবধানে সেই রাজ্যই আর ওই নীতির পরিণাম গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না।
গাইকোয়াড় স্বয়ং তাঁর দেওয়ানের চেয়ে বেশি বদান্য বলে প্রমাণিত হয়েছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জায়গায় দীর্ঘ প্রবাসের পর ১৯২৩ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ডিসেম্বর মাসে মাহুভা, ভিয়ারা এবং সানগড় তালুক থেকে দুশোরও বেশি আদিবাসীর এক প্রতিনিধিবর্গ মহারাজকে তাদের বিক্ষোভ সম্পর্কে জানাতে বরোদায় এসে উপস্থিত হয়।৬৫ এর কিছুদিন পরেই নৌসারির সুবাকে তার চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, এবং এক আদেশ জারি করে রানিমহলে মিতাচার এবং মদ্যপান নিবারণ সংক্রান্ত কাজকর্মের উদ্দেশ্যে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। স্থানীয় কর্মচারীদের এইসব কাজকর্মে সহযোগিতা করতে আদেশ দেওয়া হয়।৬৬ এই নতুন আবহাওয়ার প্রতি সাড়া দিয়ে সুমন্ত মেহতা ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে রানিমহল সফর করেন, যে সফরে তিনি আদিবাসীদের কয়েকটি বৃহৎ গোষ্ঠীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। সাম্প্রতিক আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই জমায়েতগুলি কেবলমাত্র মিতাচারের প্রতিই মনোযোগী ছিল। কিন্তু এর বিশেষ কোনও তাৎপর্যই ছিল না। আদিবাসীদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল এই যে, ভূস্বামী ও সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের ঐক্যকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে তাদের আবার জমায়েত হবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সুমন্ত মেহতা দেখেছিলেন যে বিগত বছরের দমননীতি আন্দোলনকে ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। আদিবাসীরা তাঁর কাছে আত্মোন্নতি ও সমাজসংস্কারের এক তীব্র বাসনা প্রকাশ করেছিল। এই সফরের সময়ই সুমন্ত মেহ্তা প্রথম ‘কালিপরজ’ শব্দটির ব্যবহার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ব্রিটেনে লোকেরা যখন তাঁকে ‘নিগার’ বা ‘ব্ল্যাকি’ বলে ডাকতে তখন যে তিক্ত যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছিলেন, তা তাঁর মনে ছিল। রানিমহলের আদিবাসীদের উল্লেখ করার জন্য এরপর থেকে তিনি ‘রানিপরজ’ (জঙ্গলের মানুষ) শব্দটি ব্যবহার করা স্থির করেছিলেন।৬৭ আত্মঘোষণার মাধ্যমে আদিবাসীরা দক্ষিণ গুজরাটের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল সদস্যদের কাছ থেকে যে বাড়তি শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পেরেছিল, এই শব্দটি ছিল তারই একটি তাৎপর্যপূর্ণসূচক।
দেবী আন্দোলনের প্রতি ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া ছিল গুণগত বিচারে বরোদা রাজ্যের থেকে আলাদা। এর আগে সুরাবিরোধী গণ-আন্দোলনগুলির প্রতি তারা প্রায়ই বেশ কড়া নীতি অবলম্বন করে এসেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৬ সালে যখন থানা ও কোলাবা জেলার প্রচুরসংখ্যক কৃষক সুরাপান বর্জন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চটপট এই আন্দোলনের নেতাদের কারাবন্দী করে ফেলে। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আবগারী কমিশনার তাঁর এই আচরণের সাফাই গেয়েছিলেন এই ভাষায়: ‘যে প্রশ্নের সমাধান আবশ্যক তা হল এই যে, আমরা কি চুপচাপ বসে থেকে আন্দোলনকে চলতে এবং ছড়াতে দিয়ে বেশ মোটা টাকার রাজস্ব জলাঞ্জলি দেব, নাকি লোকজনের বিচারবুদ্ধি যতে ফিরে আসে সেরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করব?’৬৮
১৯২১-২৩ সাল নাগাদ এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আর প্রত্যাশিত ছিল না। মন্টেগু-চেম্স্ফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী আবগারি শুল্ক একটি ‘হস্তান্তরিত’ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম গণনিবার্চিত মন্ত্রী ছিলেন স্যার চুনিলাল মেহ্তা, যিনি পুনর্গঠিত পরিষদের সর্বপ্রথম অধিবেশনেই ‘সুরারূপ শয়তানের’ বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন।৬৯ মদের দোকানগুলিতে সুরাসরবরাহের উপর উত্তরোত্তর কঠোরতর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে তিনি ক্রমিক ভিত্তিতে মদ্যপান-নিবারণ নীতির প্রচলন করেছিলেন। বোম্বাই প্রেসিডেঙ্গিতে মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণের প্রশ্নটি বিবেচনা করার জন্য তিনি একটি কমিটিও নিযুক্ত করেন। ফলত, সুরাটের কালেক্টর এ. এম. ম্যাকমিলানের পক্ষে দেবীর মিতাচার-সংক্রান্ত কার্যসূচির প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব প্রদর্শন করা ছাড়া উপায় ছিল না।
যেহেতু ব্রিটিশরা ছিল বিদেশি, সে জন্য স্থানীয় সমাজত্তর-কাঠামোয় এই ওলটপালটের থেকেও তারা বেশি চিন্তিত ছিল আদিবাসী সম্প্রদায় এবং গুজরাটের গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে আপাতনির্মীয়মান এক মৈত্রীকে নিয়ে। প্রথমদিকে এই আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক’ এই আখ্যা না দিয়ে ‘ধর্মীয়’, অতএব সহনীয়, বলে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু পাছে এর মধ্যে রাজনীতির দিকে মোড় নেবার কোনও ইঙ্গিত দেখা দেয়, সেজন্য এর উপর সতর্ক নজর রাখার নির্দেশ ছিল৭০ বারদোলির জাতীয়তাবাদীরা এই আন্দোলনকে প্ররোচিত করেছে কিনা তা অনুসন্ধান করার জন্য ম্যাকমিলান একবার রানিমহল সফর করেন। সফরশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে আন্দোলনটি ছিল বাস্তবিকই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’, এবং তা ‘জনসাধরণের বিশেষ কোনও ক্ষতিসাধন করছিল না।’৭১ যাই হোক, ডিসেম্বরের শেষের দিকে রিপোর্ট আসতে থাকে যে দেবী বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর এবং সরকারি স্কুল বয়কটের ডাক দিয়েছেন। দুটিই ছিল অসহযোগ কর্মসূচির মূল বৈশিষ্ট্য। অতএব ১৯২৩-এর জানুয়ারির মধ্যেই ম্যাকমিলান বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেন:
আমি ভাবছি প্রভাবশালী লোকেদের সাহায্যে ‘মাতা’ আন্দোলনের গতিরোধ করার এটাই উপযুক্ত সময় কিনা, কারণ এই আন্দোলন আপত্তিজনক চেহারা নিতে শুরু করেছে। এর জন্য দায়ি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ, এবং এই ধরনের আন্দোলনের অত্যন্ত মোটাদাগের উদ্ভট চেহারা নেবার সেই সাধারণ প্রবৃত্তি যা বাইরের সমালোচনার সংযতকারী প্রভাব এবং সাধারণ বিচারবুদ্ধির প্রয়োগের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে দেখা যায়।৭২
একজন পারসি তাড়ির দোকানের মালিককে একটি স্থানীয় জাতীয়তাবাদী স্কুলে ১২০ টাকা জরিমানা দিতে বাধ্য করার অভিযোগে জালালপুর তালুকে দেবীর মাধ্যম হিসাবে কার্যরত এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা আনা হয়।৭৩ অবৈধ জুলুমের দায়ে দোষী সাব্যস্ত এই ব্যক্তির শাস্তি হয় পনেরো দিনের হাজতবাস এবং তিনশো টাকা জরিমানা।৭৪ জালালপুর তালুকে দেবী আন্দোলন ছিল দুর্বল (এটি আদিবাসী এলাকা ছিল না), এবং ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকেই স্থানীয় পুলিশপ্রধান এই মর্মে রিপোর্ট দিতে সক্ষম হন যে এই মোকদ্দমার ফলে আন্দোলন ক্ষীণ হয়ে এসেছে।৭৫
রানিমহলে অবশ্য এই আন্দোলনকে অত সহজে দমানো সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে ম্যাকমিলান সাহেব হস্তক্ষেপ না করাই যুক্তিযুক্ত স্থির করেন। বরং তিনি ভেবেছিলেন যে আদিবাসীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলাই ভাল, যাতে তারা জাতীয়তাবাদীদের দলে গিয়ে না ভেড়ে। এই নীতি অনুসারে তিনি আবগারি কমিশনারের কাছ থেকে রানিমহলে ষোলোটি মদের দোকান বন্ধ করে দেবার অনুমতি আদায় করেন। পরে ম্যাকমিলান তাঁর বার্ষিক রিপোর্টে দাবি করেন যে তাঁর নীতি সফল হয়েছে: ‘অসহযোগ আন্দোলনের স্থানীয় নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যর কারণে আন্দোলনটিকে করায়ত্ত করতে চেয়েছিলেন। যেখানে যেখানে এই আন্দোলন ছিল কমজোরী, যেমন জালালপুরে, সেখানে সেখানে এটি চলাকালীন তাঁরা ভালরকমই সাফল্য অর্জন করেছেন। কিন্তু মাণ্ডবীর মতো জায়গায়, যেখানে আন্দোলন ছিল তীব্র এবং অকৃত্রিম, তাঁদের চেষ্টা খুব বেশি পাত্তা পায়নি।’৭৬ এই রায় কি গ্রহণযোগ্য? কেবলমাত্র আংশিকভাবে, কারণ গান্ধীবাদীরা অতীব দক্ষতার সঙ্গে দেবী আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগস্থাপন করে। এটা করার জন্য তারা কার্যসূচির সেই সেই অংশগুলির উপর ঝোঁক দেয়, যেগুলি তাদের নিজস্ব পরিকল্পনার সঙ্গে খাপ খেয়েছিল। যে অংশগুলি এভাবে মেলেনি, সেগুলিকে তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল।
১৯২১-এর শেষের দিক থেকেই গান্ধীবাদীরা বারদোলি তালুক এবং ভালোড় মহলের আদিবাসীদের মধ্যে তাদের কাজকর্ম চালাচ্ছিল। ঐ বছর গান্ধী জোর দিয়ে বলেন যে এই দুই মহকুমায় আইন অমান্য অভিযান শুরু করার আগে আদিবাসীদের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে টেনে নেওয়া দরকার। সেই সময় অবধি আদিবাসীরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। আদিবাসী গ্রামগুলিতে কংগ্রেস নেতা কুঁয়ারজী মেহ্তার এক চমকপ্রদ অভিযানের ফলে আদিবাসীরা শুধু গান্ধীর নামের সঙ্গে পরিচিতই নয়, আন্দোলনের প্রতিও অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে।৭৭ সুতরাং পরের বছর দেবীর মাধ্যমরা যখন চটপট দেবীর নামের সঙ্গে গান্ধীর নামকে জড়িয়ে ফেলে, তখন সেটা আদৌ বিস্ময়কর ছিল না। অনেক গান্ধীবাদীর কাছে দেবী আন্দোলন এক দৈব বিধানের মতো ঠেকেছিল, কারণ মনে হয়েছিল আদিবাসীরা যেন এক লহমায় গান্ধীর আদেশবাণীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের জীবনচর্যাকে শুদ্ধিকৃত করে নিয়েছে। এই ব্যাপারটি শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন পরেই বারদোলি তালুকের কয়েকজন গান্ধীবাদী নেতা আদিবাসী অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করেন এবং দেবীর কয়েকটি জনসভায় উপস্থিত হন। দেবীর মাধ্যম হিসেবে কার্যত কয়েকজন ব্যক্তির কাছে তাঁরা প্রস্তাব দেন যে খদ্দর পরিধানের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে দেবীর আজ্ঞাসূচিটিকে আরও জোরদার করা যেতে পারে। মাধ্যমদের অনেকেই এই প্রস্তাবগুলিকে মেনে নিয়েছিলেন।৭৮
বারদোলির কংগ্রেসিরা একটি কালিপরজ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে বল্লভভাই প্যাটেলের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। তারা আদিবাসীদের জানায় যে গান্ধী নিজে এখন জেলে, কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে বল্লভভাই প্যাটেল তাঁর গদিতে আসীন রয়েছেন। আদিবাসীদের তারা সম্মিলনে উপস্থিত হয়ে বল্লভভাই এবং গান্ধীপত্নী কস্তুরবার বক্তব্য শোনার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। দলে দলে আদিবাসী আসার প্রতিশ্রুতিও দেয়। এইভাবে ১৯২৩ সালের ২১ জানুয়ারি বরোদা রাজ্যের মাহুভা তালুকের শেখপুরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম কালিপরজ সম্মিলন। এতে আদিবাসী উপস্থিতি ছিল প্রায় কুড়ি হাজার—যা তাদের বিক্ষিপ্ত এবং নাতিবৃহৎ জনসমষ্টির তুলনায় বেশ বড় সংখ্যাই ছিল (উদাহরণস্বরূপ, ভালোড়ো চোধ্রীদের মোট জনসমষ্টি ছিল মাত্র আট হাজার)। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে সম্মিলনটিকে ভাগ করা হয়েছিল দুটি পৃথক অংশে। এর একটি নির্দিষ্ট ছিল সম্মিলনের আনুষ্ঠানিক কার্যাবলির জন্য, যার মধ্যে ছিল এক সুশৃঙ্খল শ্ৰোতৃমণ্ডলীর প্রতি গান্ধীবাদী নেতাদের ভাষণ। আদিবাসীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে এক জোরদার অভিযানের প্রতি জাতীয়তাবাদীরা তাঁদের পূর্ণ সমর্থন কবুল করেন। তাল গাছ কেটে ফেলা, মদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া, এবং খাদির প্রসারের ডাক দিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব পাশ করা হয়।৭৯ সম্মিলনের অন্য অংশটিকে দেবীর মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অনেকসংখ্যক ব্যক্তিকে একত্রিত করা হয়। তাদের পৃথক করে রাখা হয়েছিল এই আশঙ্কায় যে তারা সম্মিলনের আনুষ্ঠানিক কার্যকলাপে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। আনুষ্ঠানিক সম্মিলনটি শেষ হলে বল্লভভাই এবং কস্তুরবা দেবী মাধ্যমদের উদ্দেশে ভাষণ দেবার জন্য আসেন। তাঁরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মাধ্যমরা একযোগে ভরগ্রস্ত হয়ে প্রচণ্ডবেগে মাথা ঝাঁকাতে এবং হাতে লাল কাপড় ওড়াতে থাকে। দশ মিনিট পরে তারা কিছুটা শান্ত হলে বল্লভভাই বলতে শুরু করেন, কিন্তু তাঁর গলার আওয়াজ শোনামাত্র তারা আবার আবিষ্ট হয়ে পড়ে, এবং ‘গরম, গরম, গরম’ বলে চেঁচাতে থাকে। উপস্থিত সকলেই এই সভাটিকে এক বিরাট সাফল্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।৮০
পুরনো থেকে নতুন কায়দায় রাজনীতিতে রূপান্তরের এক চমকপ্রদ প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রথম কালিপরজ সম্মিলনে পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে রানিমহলের আদিবাসী জনসমাবেশগুলি ক্রমেই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধারণ করতে থাকে। কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে দৈবী সমাধিদশার শক্তি ক্রমশই দুর্বল হতে থাকে, এবং ক্রমে তার স্থান দখল করে গণভোটের মাধ্যমে গৃহীত প্রস্তাব। এছাড়া এই সন্ধিক্ষণে আদিবাসীদের মধ্যে এক নতুন নেতৃত্বের উদ্ভবও লক্ষ করা যায়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের বহিরাগত নেতৃত্বের সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে, কারণ বহুবার তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিল। যাই হোক, এই সময় থেকে তারা গান্ধীবাদী নেতাদের উপর আস্থা স্থাপন করতে এবং তাদের সভাসমিতিতে এই নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা দান করতে থাকে।
আদিবাসীদের কাছে একবার গৃহীত হওয়ার পর গান্ধীবাদীরা দেবী আন্দোলনের তীব্রতাকে প্রশমিত করার আরও চেষ্টা করেন। তাঁদের বিশ্বাস অনুযায়ী আন্দোলনটির প্রধান মূল্য আদিবাসীদের আত্মশুদ্ধির মধ্যে নিহিত ছিল। ভাবা হয়েছিল যে এইভাবে এক নতুন জীবনের প্রতি পা বাড়িয়ে আদিবাসীরা স্বাধীন ভারতের যোগ্য নাগরিক হয়ে উঠবে। এরকম শুদ্ধিকরণ নিজে থেকেই নিম্নবর্গের উন্নয়ন নিয়ে আসবে এমন ধারণা যদি গান্ধীবাদীদের মনে কাজ করে থেকে থাকে, তবে এই অর্থে তাঁদের সংস্কৃতায়ন-তাত্ত্বিকদের পূর্বদিশারী বলে মনে করা যেতে পারে। সুতরাং আন্দোলনের যে দিকটিকে তাঁরা কম গুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিক বিভেদসষ্টিকারী, অতএব জাতীয় সংহতির পক্ষে প্রতিকূল, বলে মনে করতেন—যেমন পারসি আধিপত্যের প্রতি আদিবাসীদের চ্যালেঞ্জ—সেটির উপর তাঁরা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেন। কয়েকজন পারসি যখন বয়কটের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে তখন গান্ধীবাদীরা আদিবাসীদের বলেন যে যদিও পারসিদের হয়ে মদের দোকানে খাটা, তাল গাছ থেকে তাড়ি নিষ্কাশন ইত্যাদি অপবিত্র কাজ বন্ধ করে তারা ঠিকই করেছে, তবুও পারসিদের জমিতে কাজ করতে অস্বীকার করার সিদ্ধান্তটি ভুল। ১৯২৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন সোনগড় তালুকের দোসওয়াড়ায় (Dosvada) দ্বিতীয় কালিপরজ সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয় তখন বল্লভভাই প্যাটেল নিম্নলিখিত বার্তাটি পড়ে শোনানোর জন্য পাঠান:
তোমাদের সমাজে জাগরণ প্রত্যেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু তোমাদের খুব সাবধান হতে হবে। বেশি তাড়াহুড়ো করলেই আছাড় খাবার সম্ভাবনা। পারসি ও মুসলমানদের শ্রমিক হিসেবে কাজ না করার যে সিদ্ধান্ত তোমার নিয়েছ, তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যে পদক্ষেপ তোমরা নেবে তা সুচিন্তিত হওয়া দরকার।৮১
সম্মিলনের সভানেত্রী কস্তুরবা গান্ধীর বক্তব্য ছিল আরও খোলামেলা: তিনি আদিবাসীদের বলেন যে পারসিদের হয়ে কাজ করার জন্য তাদের ফিরে যাওয়া উচিত।৮২ আদিবাসীরা এই পরামর্শ গ্রহণ করেনি। প্রত্যুত্তরে তারা বলে যে পারসিরা অত্যন্ত ধূর্ত, এবং অতীতে বহুবারই মদ ছেড়ে দিতে গিয়ে তারা তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। তাদের ভয় ছিল এই যে একবার শ্রমদানের মাধ্যমে পারসিদের কবলে পড়লেই তারা আবার মদ ধরতে বাধ্য হবে। তাদের প্রলুব্ধ করার জন্য পারসিরা তাদের মধ্যে বিনামূল্যে মদ বিতরণ করতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আদিবাসীরা আর পারসিদের প্রতি সদয় হতে রাজি ছিল না। সুতরাং পরিপূর্ণ বয়কট চলতে থাকে।৮৩
গান্ধীবাদী এবং আদিবাসীদের মধ্যে এই ধরনের মতভেদের কথাই সম্ভবত কালেক্টর ম্যাকমিলানের স্মরণে এসে থাকবে যখন তিনি রিপোর্ট লেখেন যে আদিবাসীরা গান্ধীবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেননি। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ে আদিবাসীদের বেশ বড় একটা অংশ গান্ধীর অনুগামীদের এবং গান্ধীবাদী কর্মসূচির প্রতি তাদের আগ্রহ প্রদর্শন করতে থাকে। খাদির প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। খাদির উৎপাদন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই আকর্ষণীয় ছিল না, আদিবাসীদের কাছে তার তাৎপর্য ছিল কিছুটা ঐন্দ্রজালিক। স্মরণ করা যেতে পারে যে তাদের দেখা স্বপ্নদৃশ্যে কুয়েতে উপবিষ্ট গান্ধীকে চরকা কাটতে দেখা গিয়েছিল। আদিবাসীদের বিশ্বাসোৎপাদন হয়েছিল যে চরকার সুতোকাটাটা এমন এক ধর্মীয় আচার যা জাতির স্বাধীনতা এবং তাদের নিজেদের মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে।
চরকার প্রতি এরকম আগ্রহ থেকেই আদিবাসীরা এমন প্রশিক্ষকের জন্য প্রার্থনা করে, যে তাদের সুতো কাটা এবং চরকার রক্ষণাবেক্ষণ শেখাতে পারে। ১৯২৪ সালে একজন সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত খাদি কর্মচারীকে রানিমহলে পাঠানো হয়। নির্বাচিত ব্যক্তিটি ছিলেন চুনিলাল মেহ্তা, আহ্মেদাবাদের কাছের এক গ্রামের জনৈক ব্রাহ্মণ। তিনি ভালোড় তালুকস্থিত বেদ্ছি গ্রামের একজন উৎসাহী চোধ্রী সমাজসংস্কারক জীবন চোধ্রীর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন।৮৪ তিনি বেদ্ছিতে একটি ট্রেনিং ক্লাস শুরু করেন, এবং খাদির প্রচলন ব্যাপকতর করার উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি পরিভ্রমণ করেন।৮৫ ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে বেদ্ছিতে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় রানিপরজ সম্মিলন (ব্রিটিশ-অধিকৃত অঞ্চলের গান্ধীবাদীরা তার মধ্যে আদিবাসীদের সম্পর্কে সুমন্ত মেহ্তার ব্যবহৃত অভিধাটি পরিগ্রহণ করেছে)। কারামুক্ত গান্ধী ছিলেন সভাপতি। প্রচুরসংখ্যক আদিবাসীকে খদ্দরের সুতো কাটতে দেখে তিনি বিশেষ প্রীত হন।৮৬ জীবন চোধ্রী ছিলেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি, এবং তাঁর ভাষণে তিনি গান্ধীর প্রতি তাঁর সম্প্রদায়ের মনোভাব বিবৃত করেন: ‘জগদ্গুরু ভগবান মহাত্মা গান্ধীকে আমাদের সঙ্গে পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট এবং প্রীত হয়েছি। সর্বগুণান্বিত ভগবানকেই আমাদের ভজনা করা উচিত। এই ভগবান আমাদের যতখানি প্রজ্ঞা দিয়েছেন, এখন থেকে আর কোনও ভগবানই তা পারবেন না।’৮৭
পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে ১৯২৮, ১৯৩০-১, এবং ১৯৪২ সালে বহু চোধ্রী গান্ধীবাদী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় সংগ্রামের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে তাঁদের এই প্রতিশ্রুতির সারবত্তা প্রমাণ করেন। সুতরাং আদিবাসীরা গান্ধীবাদীদের মোটের উপর উপেক্ষাই করেছে, ম্যাকমিলানের এই বক্তব্য ছিল ভুল। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মৈত্রী সমস্যাকণ্টকিত হলেও যথেষ্ঠ বাস্তব ছিল।
৬
বছরখানেক বাদে বহু আদিবাসীই তাদের মিতাচার এবং নিরামিষাহারের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে শুরু করে। ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ কালেক্টর ম্যাকমিলান রানিমহল অঞ্চলে সুরার চাহিদা বৃদ্ধির কথা রিপোর্ট করেন। মাণ্ডবী তালুকে চারটি, ভালোড়ে একটি এবং বারদোলিতে একটি মদের দোকান তিনি আবার খুলে দেন।৮৮ মিতাচার আন্দোলনের শক্তিহ্রাসের জন্য শুধুমাত্র পারসি এবং রাজকর্মচারীরাই নয়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভিতরের লোকও দায়ী ছিল। প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে যারা ব্যর্থ হয়েছিল এমন অনেকে ছাড়াও এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল আদিবাসী ওঝারা, সনাতন সমাজে যাদের সম্মানিত অবস্থানকে বিপন্ন করেছিল এই সংস্কারমুখী তাগিদ। বর্ণহিন্দুর জীবনচর্চা এবং নেতৃত্বের উপর আস্থা রাখার সম্পর্কে অনেকেই তখনও সন্দিহান ছিল। বছর দুয়েকের মধ্যেই সম্প্রদায়ের অন্তর্বিরোধ তীব্র হয়ে দাঁড়ায়। ‘বরজেলা’, অর্থাৎ যারা দেবীর নির্দিষ্ট নব্য জীবনধারাকে অনুসরণ করেছিল, এবং ‘সরজেলা’, অর্থাৎ যারা তাদের প্রাক্তন অভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করেছিল, তাদের মধ্যে বিভেদের সূচনা হয়। ‘বরজেলা’-রা ছিল গান্ধীবাদী কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য গ্রামবাসীদের দ্বারা বর্জিত একটি বিচ্ছিন্ন ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হয়ে থাকলেও বেদ্ছির মতো অন্যান্য জায়গায় তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সামগ্রিক বিচারে বরজেলারা ছিল সংখ্যালঘু। কখনও কখনও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তীব্র হয়ে দাঁড়াত। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন চোধ্রী সুরজেলা চোধ্রী দেবতা আহীনের উদ্দেশে পশুবলি দেবার উদ্যোগ করলে মাণ্ডবী তালুকের পিপলওয়াড়ায় (Phipalvada) সরজেলা এবং বরজেলাদের মধ্যে এক তুমুল সংঘর্ষ হয়।৮৯ আদিবাসীদের সকলেই অবশ্য শুদ্ধিকরণ সম্পর্কে দেবীর কয়েকটি প্রত্যাদেশ মেনে চলতে থাকে। প্রত্যেকদিন স্নান করা, মলত্যাগের পর পরিষ্কৃত হবার জন্য জল ব্যবহৃত করা, এবং বাড়িতে অধিকতর পরিচ্ছন্নতার অভ্যাসগুলি ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত হয়েছিল।
যদিও কৃষ্টিগত সংস্কার আন্দোলন হিসাবে এর সীমাবদ্ধতাগুলি অনস্বীকার্য, তবুও ভূস্বামী, মহাজন এবং সুরাব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আত্মনির্ঘোষ হিসাবে এই আন্দোলন যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছিল বলা যেতে পারে। দেবী আন্দোলনের পর ঐ অঞ্চলের পারসিদের অবস্থা কখনওই ঠিক আর আগের মতো হয়নি। কেননা, যেমনভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশদের সম্বন্ধে জনগণের ভয় কমিয়েছিল, ঠিক তেমনই পারসিদের সম্পর্কে আদিবাসীদের ভীতিতে ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছিল দেবী আন্দোলন। সংগ্রাম যে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিল তা নয়, পরবর্তী দশকগুলিতে পারসিরা আবার পুনরুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা আদিবাসীদের ভালরকমই মদত দিয়েছিল; এবং তাছাড়া ভারতের স্বাধীনতা যেসব ভূমিসংস্কারের সূচনা করেছিল তাদের শক্তি দেশের অন্যান্য অংশের থেকে গুজরাটে ছিল বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারসি এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ভূস্বামীদের জমি রানিমহলের আদিবাসী কৃষক সমাজের কাছে হস্তান্তরিত হয়।৯০ ১৯৩৮ সালে বারদোলি এবং ভালোড় তালুকে এবং ১৯৫০ সালে দক্ষিণ গুজরাটের অন্যান্য অঞ্চলে মদ্যপানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ পারসিদের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি করেছিল। এর ফলে তাদের মদ ও তাড়ির ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর থেকে আদিবাসীরা খেয়ে এসেছে তাদের বাড়িতে বেআইনিভাবে চোলাই-করা শস্তা দারু। এই পানীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন, শোষণের হাতিয়ার হিসাবে সুরার দিন যে শেষ হয়ে গেছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
সুতরাং দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসী এবং তাদের শোষণকারীদের মধ্যে সংগ্রামের ইতিহাসে দেবী আন্দোলনকে একটি দিক্চিহ্ন হিসেবে দেখা যেতে পারে। একই সঙ্গে এই আন্দোলন আদিবাসী সমাজের মধ্যে এক বিত্তশালী কৃষক শ্রেণীর বিকাশের একটি স্তরকে সূচিত করেছিল। দেবী আন্দোলনের আগেই শুরু হলেও এই প্রক্রিয়াটি শক্তি সঞ্চয় করেছিল আন্দোলন থেকেই, কেননা এর সাহায্যেই অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন আদিবাসীরা গুজরাটি সমাজে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর থেকে পারসিদের ক্রমাবনতির সঙ্গে তাল রেখে সম্পন্ন আদিবাসী কৃষকেরা রানিমহল অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শোষণকারী গোষ্ঠী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এই আন্দোলনকে মহিমামণ্ডিত করার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এর প্রকৃত চরিত্রটিই স্বীকৃতির দাবি রাখে—একদিকে যেমন এটি এনে দিয়েছিল মুক্তি, অন্যদিকে তেমনি এই আন্দোলন নব্য আঙ্গিকের শোষণের ভিত্তিস্থাপন করেছিল।
অনুবাদ: জয়ন্ত সেনগুপ্ত
টীকা
১ বি. পি. বৈদ্য, রেক্তিমা বাহন (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৭৭) পৃ. ১৭৭, সুরাটের কালেক্টরের রিপোর্ট, 14 ডিসেম্বর 1922, Maharashtra State Archives. Bombay (এরপর থেকে BA বলে উল্লিখিত), Home Department (Special) (এরপর থেকে H. D. Sp.). 1922 সালের 637 নং।
২ ‘কালিপরজ’—অর্থাৎ ‘কালা আদমি’—ছিল একটি অবজ্ঞাসূচক অভিব্যক্তি, যার মাধ্যমে দক্ষিণ গুজরাটের আদিবাসীদের বোঝানো হত।
৩ বারদোলির মামলতদারের রিপোর্ট, 15 নভেম্বর 1922, BA, H. D. (Sp.), 1922 সালের 637 নং।
৪ Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency, including Sind, for 1923-24 (Bombay, 1925), p. 39. গুজরাটের কালেক্টরের অফিসের রেকর্ড রুম থেকে প্রাপ্ত ১৯১৪ সালের একটি তালিকা থেকে দেখা যায় মাণ্ডবীতে তেরোটি এবং ভালোড়ে আটটি সুরার দোকান ছিল; এর থেকে মনে হয় যে মাণ্ডবীর সবকটি দোকানই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
৫ তদেব, পৃ. ৩৯-৪০।
৬ টানা ভগৎদের বিষয়ে সর্বোত্তম গ্রন্থটি হল S. C. Roy. Oraon Religion and Customs (1928; পুনর্মুদ্রিত, Calcutta, 1972), p. 246-97.
৭ Stephen Fuchs, Rebellious Prophets (Bombay, 1965), p. 240. T. B. Naik, The Bhils (Delhi, 1956), p. 324.
৮ BA, H. D. (Sp.), 1938-42 সালের 982 নং।
৯ Fuchs, p. 79. L. K. Mahapatra & C. Tripathy, ‘Raj Mohini Devi: A Social Refomer among Tribals of North Central India’, Vanyajati, 4: 4 (October 1956).
১০ Fuchs, p. 57, p. 68; Surajit Sinha, ‘Bhumij-Kshatriya Social Movement in South Manbhum’, Bulletin of the Department of Anthropology, 8: 2 (July 1959), p. 16-19.
১১ Report of the Excise Committee Appointed by Government of Bombay, 1922-23, vol. I (Bombay, 1924), p. 32-3.
১২ Suresh Singh, Dust-Storm and Hanging Mist: A Study of Birsa Munda and his Movement in Chhotanagpur (1874-1901) (Calcutta, 1966).
১৩ B.H. Mehta, ‘Social and Economic Conditions of the Chodhras, an Aboriginal Tribe of Gujarat’ (M. A. thesis, University of Bombay, 1933), ভূমিস্বত্ব সংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলি পরিশিষ্ট খণ্ডের পরিবার-তালিকা থেকে সংকলিত হয়েছে।
১৪ তদেব, পৃ. ৪৭০; সাতভাও-এ সেচের কোনও সুবিধা না থাকায় এই অঞ্চলে জীবিকানির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ অন্যান্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল।
১৫ Gazetteer of the Bombay Presidency, volume II, ‘Surat and Broach’ (Bombay, 1877), p. 190.
১৬ উদাহরণ হিসেবে দেখুন, সুমন্ত মেহতা, সমাজ দর্পণ (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৬৪), পৃ. ৩৪০।
১৭ Dr. U. L. Desai of Vyara to A. D. C. to Gaikwad of Baroda, 5 December 1923, Baroda Records Office (এরপর থেকে BRO), Confidential Department, File 301.
১৮ Report of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay, 1922-3, vol. I, p. 43; vol. II, p. 301.
১৯ পরিসংখ্যানগুলি বার্ষিক Reports on the Administration of the Bombay Presidency থেকে গৃহীত।
২০ পরিসংখ্যানগুলি বার্ষিক Reports on the Administration of the Abkari Department in the Bombay Presidency, Sind, and Aden থেকে গৃহীত।
২১ Reports of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay, 1922-23, vol. I. p. 49.
২২ তদেব, vol. II, p. 526.
২৩ ডিষ্ট্রিক্ট ডেপুটি কালেক্টরের বিপোর্ট, 1880-1. BA Revenue Department, (এরপর থেকে R. D) 1881, vol. 22, Comp. 1435.
২৪ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট, 1886-7, BA, R. D. 1887, vol. 26, Comp. 1548.
২৫ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরেল রিপোর্ট, 1893-4, BA, R. D. 1894, vol. 36, Comp. 1305.
২৬ আই. আর. দেশাই, রানিপরজমা জাগ্রতি (গুজরাটি) (সুরাট, ১৯৭১), পৃ. ১৯।
২৭ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
২৮ তদেব, পৃ. ১০।
২৯ তদেব, পৃ ১১।
৩০ মারবাড়ী মাস্টারের গানের দলের একজন প্রাক্তন সদস্য—মাণ্ডবী তালুকের শলাইয়ের দলুভাই চোধ্রী— আমাকে গানটি শুনিয়েছিলেন। এই গানটি আমি সুরাটের অধ্যাপক আই. পি. দেশাইয়ের সহায়তায় চোধ্রী উপভাষা থেকে অনুবাদ করেছি। এতে ‘পারসি’দের বোঝাতে ‘পার্হা’ এবং ‘বানিয়া’দের বোঝাতে ‘ভাঙ্গি’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। অধ্যাপক দেশাইয়ের মতে এই শব্দ দুটি পারসি এবং বানিয়াদের কাছে অত্যন্ত অপমানজনক বলে গণ্য হত।
৩১ অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট, 1904-5, BA. R. D. 1906, vol. II, Comp, 511, Pt VI.
৩২ এই প্রসঙ্গে বোম্বাইয়ের এস, এন. ডি. টি. বিশ্ববিদ্যালয়ের সুধা মোকাশি আমাকে যে সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ইনি আমাকে থানা জেলার বাসিন এবং পালঘাট তালুকের ধীবর গ্রামগুলিতে নিয়ে যান।
৩৩ আন্দোলনের যাত্রাপথটিকে অনুসন্ধান করা আমার পক্ষে একটি চিত্তাকর্ষক কিন্তু শ্রমসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিষয়টি সম্বন্ধে সমসাময়িক নথিপত্রের বক্তব্য খুবই ধোঁয়াটে যে জন্য খান্দেশ থেকে শুরু করে গ্রামকে গ্রাম ধরে পিছিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে কালক্রম নির্ধারণ করা কঠিন, কিন্তু সুবাটের তৎকালীন কালেক্টরের মতে দেবী দাং-এ ছিলেন ১৯২২ সালের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency for 1922-3. p. 43.
৩৪ এই ধরনের সমাবেশের বর্ণনার জন্য দেখুন, রানিপরজমা জাগ্রতি পৃ, ১৩৮-৪১।
৩৫ মাইকেল অ্যাডাস দেখিয়েছেন যে ‘মেসায়ানিক’ আন্দোলনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল একজন ত্রাতারূপী অথবা সত্যদ্রষ্টা নেতার অস্তিত্ব। দ্র. Michael Adas, Prophets of Rebellion: Millernarian Protest Movements Against the European Colonial Order (Chapel Hill, 1979). pp. 92-3 & 115. এখানে অ্যাডাস যে প্রবন্ধটির উপর নির্ভর করেছেন সেটি হল Norman Cohn, Medieval Dreanis in Action (New York, 1970), Pp 32-43. ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি আদিবাসী আন্দোলন, যাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিরসা মুণ্ডার আন্দোলন, ত্রাতাধর্মী নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু দেবী ইত্যাদি বহু আন্দোলনে যে এই ধরনের নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল, এই ঘটনা থেকে মনে হয় যে এরকম আন্দোলনের একমাত্র ব্যাখ্যা হিসেবে এই প্রত্যয়টিকে গ্রহণ করার যথার্থ প্রশ্নসাপেক্ষ। এই প্রসঙ্গে স্টিফেন ফুসের বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। Rebellious Prophets গ্রন্থে তিনি ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কারকামী আন্দোলনের (যদিও দেবী আন্দোলনের নয়) বর্ণনা করেছেন, এবং সেগুলিকে ‘ত্রাতামুখাপেক্ষী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর প্রারম্ভিক অধ্যায়ে তিনি ‘ত্রাতামুখাপেক্ষী’ আন্দোলনের চোদ্দোটি বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করে বলেছেন যে এধরনের আন্দোলনে এই বৈশিষ্ট্যগুলি হয় একত্রে নয়তো খণ্ডিতভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ, এবং একটি আন্দোলনের ভিতর সবকটি বৈশিষ্ট্যকে দেখতে পাওয়াটা অসম্ভব। অতএব ফুক্স্ এ-ধরনের আন্দোলনগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনও তত্ত্ব পেশ করেননি, কেননা কোনও তত্ত্বের সারকথাই হল এই যে, খণ্ডগুলির পরম্পর জোড়া লাগা উচিত। সুতরাং এটি একটি দুর্বল প্রত্যয়, যেটি কোনও কোনও আদিবাসী আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রকৃতিকে বর্ণনা করার পর আর আমাদের বোধকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যায় না।
৩৬ এর একটি উদাহরণ জিম্বাবোয়ের ‘শোনা’, দ্র. I. M. Lewis, Ecstatic Religion: An Anthropological Study of Spirit of Possession and Shamanism (Harmondsworth, 1978). pp. 141-3.
৩৭ Richard Lannoy. The Speaking Tree: A Study of Indian Culture and Society (New York, 1975). pp. 198-9.
৩৮ 1922 সালের 28 নভেম্বর পুলিশ বিপোর্ট, BRO, Confidential Department, 327.
৩৯ Papers Relating to the Revision Survey Settlement of the Mandvi Taluka of the Surat Collectorate. Selection from the Records of the Bombay Government, No. CCCCXXVI—New Series (Bombay, 1904), p. 41. F. S. P. Lely to J. G. Moore, 22 May 1886, BA, R. D. 1887. Vol. 7, Comp. 26, অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টরের রিপোর্ট 1885-6. BA, R. D. 1886, vol. 32, Comp. 1548.
৪০ এস. মেহতা, ‘কালীপরজ’, যুগধর্ম (গুজরাটি), 2: 3 (1923), p. 220.
৪১ M. N. Srinivas, Social Change in Modern India (Bombay, 1972). p. 6. এটি হল সংস্কৃতায়ন সম্পর্কে শ্রীনিবাসের সংশোধিত সংজ্ঞা। Caste in Modern India (Bombay. 1962) গ্রন্থের ‘A Note on Sanskritization and Westernization’ প্রবন্ধে শ্রীনিবাস যে আদি বক্তব্য রেখেছিলেন, তার বিবিধ সমলোচনার প্রতি এখানে নজর দেওয়া হয়েছে। শ্রীনিবাসের তত্ত্ব এবং তাঁর বক্তব্যের ক্রমপরিবর্তন সম্বন্ধে একটি বিশ্লেষণাত্মক সমীক্ষার জন্য দ্র. Yogendra Singh, Modernization of Indian Tradition: A Systematic Study of Social Change (Delhi, 1973), p. 7-12.
৪২ Srinivas, Social Change, p. 26.
৪৩ তদেব, পৃ. ৭।
৪৪ Roy. p. 9 সুরেশ সিং বিরসা মুণ্ডার আন্দোলন সম্পর্কে একই কথা বলেছেন, পৃ. ১৯৮-৯।
৪৫ Rebellious Prophets গ্রন্থে ফুক্স্ অনেকগুলি আদিবাসী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়েছেন। শুধু দুটি ক্ষেত্রে (পৃ. ৬৭ এবং ৬৯-এ উল্লিখিত) আদিবাসীরা বর্ণীয় মর্যাদার দাবি করে, এবং উভয় ক্ষেত্রেই তা ছিল ক্ষাত্ৰ-মর্যাদার জন্য।
৪৬ সুরজিৎ সিংহ যাকে আদিবাসীদের ‘রাজপুতায়ন’ (Rajputization—অর্থাৎ রাজপুত বা ক্ষাত্র-মর্যাদার জন্য দাবি—বলছেন, তা সম্ভবত মধ্যযুগে যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল (‘Bhumij-Kshatriya Social Movement in South Manbhum’)। বহু শতাব্দী ধরে রাজপুত শক্তির পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই ছকটিও মনে হয় ক্রমান্বয়ে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
৪৭ Louis Dumont, Homo Hierarchicus,/i> (London, 1972). pp. 244 & 283.
৪৮ Srinivas, Social Change, p. 7
৪৯ I. M. Lewis, Ecstatic Religion, p. 128.
৫০ মেহতা, সমাজ দর্পণ, পৃ. ৩৪১-২।
৫১ মেহতা, ‘কালীপরজ’, পৃ. ২২২।
৫২ Report by Police Naib Suba, Navsari, 13 November 1922, BRO, Confidential Department. 327.
৫৩ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923. BRO, Confidential Department, 273.
৫৪ Report by Police Commissioner, Baroda, 16 December 1922, BDO, Confidential Department, 327.
৫৫ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923. BRO, Confidential Department 273.
৫৬ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৫৭ এস. মেহতা, ‘কালীপরজ কে রানিপরজ’, যুগধর্ম (গুজরাটি) 3(1924),444.
৫৮ Bombay Chronicle, 27 April 1922.
৫৯ Manubhai Mehta to Gaikwad, 7 June 1923, BRO, Confidential Department 273.
৬০ Times of India. 4 August 1923; Servant of India, 30 August 1923, p. 363.
৬১ Times of India. 18 September 1923.
৬২ Manubhai Mehta to Gaikwad, 5 October 1923. BRO, Confidential Department 273.
৬৩ Bombay Chronicle. 30 November 1923.
৬৪ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৬৫ Bombay Chronicle, 11 December 1923.
৬৬ Bombay Chronicle, 28 January 1924.
৬৭ মেহতা, ‘কালীপরজ কে রানিপরজ’, পৃ ৪৪৬।
৬৮ Reports of the Excise Committee Appointed by the Government of Bombay. 1922-23, vol. I. p. 45.
৬৯ তদেব, পৃ. ৫০।
৭০ M. S. Jayakar to Macmillan, 16 November 1922, BA. H. D. (Sp.), 1922 সালের 637 নং।
৭১ Macmillan to Crerar, 1 December 1922, তদেব।
৭২ Report by Macmillan, 19 January 1923, তদেব।
৭৩ Reports of 12 and 13 January 1923, তদেব।
৭৪ Report by Macmillain, 20 January 1923, তদেব।
৭৫ Report of 10 February 1923, তদেব।
৭৬ Land Revente Administration Report of the Bombay Presidency for 1922-3. p. 43.
৭৭ বিশদ আলোচনার জন্য দ্র. বি. পি. বৈদ্য রচিত কুঁয়ারজী মেহতার জীবনী, রেন্তিমা বাহন, পৃ. ১৬৫-৭৭।
৭৮ তদেব, পৃ. ১৭০।
৭৯ Bombay Chronicle, 7 February 1923. বরোদার পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট, 25 January 1923, BRO, Confidential Department 327.
৮০ রেন্তিমা বাহন, পৃ. ১৭১। রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ২৫-৬।
৮১ রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ৭০।
৮২ গ্রন্থে পূর্বে উদ্ধৃত।
৮৩ তদেব, পৃ. ২৯।
৮৪ জগৎরাম দাভে, খাদিভক্ত চুনিভাই (গুজরাটি) (আমেদাবাদ, ১৯৬৬), পৃ ১৩-২০।
৮৫ রানিপরজমা জাগ্রতি, পৃ. ৫২-৩।
৮৬ তদেব, পৃ. ৫৩-৪, ঐ সময়ের মধ্যে চুনিলাল মেহ্তা ঐ অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে ৫২০টি চরকা বিক্রি করে ফেলেছেন। তদেব, পৃ. ৭২
৮৭ তদেব, পৃ. ৭১।
৮৮ Land Revenue Administration Report of the Bombay Presidency for 1923-4. pp. 39-40.
৮৯ B.H. Mehta, ‘Social and Economic Conditions of the Chodhris’,p. I78. সংস্কার আন্দোলনের ফলে মাঝে মাঝেই আদিবাসীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এই ধরনের বিভেদ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংস্কারপ্রাপ্ত গোষ্ঠীটি একটি পৃথক জাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণের জন্য দ্র. Roy. পূর্বোক্ত, pp. 286-90.
৯০ এই জমি যে সুষমভাবে বণ্টিত হয়েছিল, তার কোনও মানে নেই, বৃহৎ আদিবাসী ভূস্বামীদের সুবিধেই হয়েছিল বেশি, যার ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বছরগুলি সম্পন্ন এবং দরিদ্র আদিবাসীদের মধ্যে মেরুপ্রমাণ ব্যবধান গড়ে দেয়। Ghanshyam Shah, ‘Tribal Identity and Class Differentiations: A Case Study of the Chodhri Tribe’, Economic and Political Weekly. Annual Number, February 1979, pp. 459-65.