হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর – ২০

২০

সময় সময় এমন সব অঘটন ঘটে যা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। তবুও তা ঘটে এবং সেইসব ঘটনাই বোধহয় মানুষকে ঠেলে নিয়ে যায় তার নিজের লক্ষ্যে, অথবা ফেলে দেয় বিস্মৃতির অন্তরালে, যেখান থেকে সে শত চেষ্টায়ও ফিরে আসতে পারে না নিজের জায়গায়।

তেমনি ঘটনা ঘটেছিল আমাকে নিয়ে ওই ‘বসু পরিবার’ ছবিকে কেন্দ্র করে।

আপনারা জানেন না, জানবার কথাও নয়, তবু ঘটনাটা ঘটেছিল সবার অলক্ষ্যে। এর পর থেকে, চেষ্টা করে কিছু হয়, এ বিশ্বাস আমার একেবারে চলে গেছে। যিনি দেবার মালিক তিনি ঠিক সময় প্রার্থিত বস্তু হাতে পৌঁছে দেন।

আপ্রাণ চেষ্টা করেও ‘বসু পরিবার’ এর নায়কের ভূমিকায় যখন আমার পরিবর্তে অন্য অভিনেতা মনোনীত হল, তখন হতাশ হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সিনারিও (চিত্রনাট্য) লেখা হল। ফ্লোরে ছবি যাবার জন্যে সব ঠিকঠাক। যাঁর নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করবার কথা ছিল, তিনি সেই সময় অন্য ছবির স্যুটিং-এ ব্যস্ত থাকার ফলে সময় দিতে পারলেন না।

এদিকে ছবি তুলতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই নির্মলবাবু) আমাকে দিয়েই ছবির কাজ শুরু করলেন। আমি যথাসাধ্য অভিনয় করবার চেষ্টা করলাম। ঠিকই করে ফেলেছি, যদি এ ছবিতেও দর্শকের মনোরঞ্জন না করতে পারি, তাহলে এ লাইন ছেড়ে দেবো জন্মের মতন।

এই ছবিতেই আমার বোনের ভূমিকায় অভিনয় করতে আসেন বর্তমানের বিখ্যাত নায়িকা সুপ্রিয়া চৌধুরী৭১। সেই তাঁর দ্বিতীয় কি তৃতীয় ছবি।

ছবির কাজ শেষ হয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছে এ ছবি বোধহয় জনসাধারণ নেবে। বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। আমার ছবি কাগজে কাগজেও বেরোলো।

এই ছবিতে ঠিক আমার বিপক্ষে কোনো নায়িকা ছিলেন না, কারণ নায়ক অবিবাহিত।

প্রধান স্ত্রী-ভূমিকায় অবতীর্ণা হয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।৭২

এইবার ছবি দেখার পালা।

একটা ব্যাপার এই লাইনে আমি লক্ষ্য করেছি যেটা অনেক সময় আমার মর্মবেদনার কারণ হয়েছে। সেটা আর কিছু নয়, আমাদের নিজেদের মধ্যে সমালোচনা করার স্পৃহা। তাতে মনে উৎসাহ আসে না, আনন্দ আসে না, আসে হতাশা।

বোধহয় এরই প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে সেদিন যাঁরা ‘প্রোজেকশান শো’ দেখেছিলেন, তাঁরা সমালোচনা করলেন—ছবি মোটেই সুবিধের হয়নি। পাহাড়ী, সাবিত্রী, উত্তম সকলেই লাউড অভিনয় করেছেন। এখন জনসাধারণের কানের পর্দা থাকলে হয়!

মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল। এত খেটেখুটে পরিণামে এই! গোরাচাঁদবাবুকে বললাম—‘আর ফিল্ম লাইন নয় দাদা, যথেষ্ট হয়েছে—এইবার নিয়ম করে দশটা পাঁচটা অফিস।’

ঠিক এমনি সময় একদিন একটা শুক্রবার ‘বসু পরিবার’ মুক্তি পেল। মুক্তি বোধ হয় কেবল সেদিন ‘বসু পরিবার’ পায়নি, তার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল আমার অভিনয় করার বন্দীসত্তা।

দর্শক আমাকে নিয়েছেন। যত শুনি তত আনন্দ পাই। কারণে অকারণেই যেতাম সেই সমস্ত ছবি-ঘরের সামনে যেখানে ‘বসু পরিবার’ দেখানো হচ্ছে। চেয়ে দেখতাম দর্শকদের ভিড়। আত্মগোপন করে শুনতাম আমার প্রশংসা। কেউ যাতে না চিনতে পারে, তার জন্যে পরতাম কালো চশমা। শুনতে এতো ভালো লাগত যখন দর্শকরা বলতেন—‘উত্তম বেশ অভিনয় করেছে।’

এ লাইনের মজা, যদি আপনার একটা ছবি ‘হিট করে’ তা হলেই আপনি পরের পর চান্স পাবেন। আর দর্শক ছবি যদি না নেন তাহলেই, শত ভালো অভিনয় করা সত্ত্বেও আপনাকে থাকতে হবে যবনিকার অন্তরালে।

আর একটা ব্যাপার আছে। সেটা ভয়ংকর মারাত্মক। ছবি তৈরি হয় সমবেত চেষ্টায়। তার থেকে সিনারিও-লেখক, প্রযোজক, এমনকি যাঁরা আলোর কাজও করেন তাঁদের কারোর অবদান কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু ছবি যদি কোনো কারণে দর্শক না নেন, তাহলে সব দোষ এসে পড়বে অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের ওপর। তার কারণ আমার মনে হয়, তাঁদের ছায়াছবি থাকে ফিল্মের ওপর, আর দর্শকরা তাঁদেরই কণ্ঠস্বর শুনতে পান।

কিন্তু ঠিক তেমনি, ছবি যখন ভালো হয়, তেমনটি হয় না। তখন অবশ্য সকলেই সম্মান ভাগ করে পান। তবে এ ক্ষেত্রেও দেখেছি, অভিনেতা অভিনেত্রীরা পান প্রধান অংশটুকু।

যাক সে কথা। ডাক এল অনেকগুলো ছবির। হ্যাঁ, একসঙ্গে। মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠল। তাহলে এতদিন পরে অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি আমি পেলাম!

গোরাচাঁদবাবু হঠাৎ একদিন এসে বললেন—‘হ্যাঁরে, তুই যে অফিসে মন দিয়ে কাজ করবি বললি, তার কী হল?’

আমি হেসে বলি—‘বোধহয়, দাদা, এবার শিকে ছিড়ল। আর অফিসে জয়েন করা হল না।’

—‘ছুটি তোমার পাওনা নেই। আগে তবু এক-আধবার যেতে অফিসে সইটা করতে, আজকাল তাও যাও না। বলি, এদিক যখন ভালো হয়েছে তখন চাকরিটা ছাড়ো। নইলে কোম্পানি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়াটা কি ভালো!’

সেইদিনই একটা রেজিগনেশন লেটার লিখে দিই গোরাচাঁদবাবুর হাতে, আর বলি—‘আপনার এ ঋণ জীবনে শোধবার নয়।’

আজ তাই তো আত্মকথা লিখতে বসে গোরাচাঁদবাবু আর আমার সহকর্মীদের কথা স্মরণ করলাম। কারণ সেদিন তাঁরা সাহায্য না করলে, অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় অধমকুমার হয়েই থাকত, কোনোদিনই উত্তমকুমারে পরিবর্তিত হতে পারত না।

যাইহোক, আরও দু’ একখানা ছবি পরে পরেই দর্শকরা নিলেন, তার ফলে আমিও ভালো অভিনেতা হিসাবে স্বীকৃতি পেলাম।

ঠিক এমনি সময় এম. পি. তোলা ঠিক করলেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। আমার বিপক্ষে নতুন নায়িকা চাই। তখন মালা সিনহা৭৩ থাকতেন এই ভবানীপুর অঞ্চলে জগুবাবুর বাজারের কাছে।

আমি তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। তাঁর বাবাকে বলেছিলাম আমাদের এই নতুন ছবিতে কাজ করবার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। তাই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ এ তাঁর অভিনয়ও করা হল না।

পরে ‘ঢুলি’৭৪ ছবিতে অভিনয় করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।

খোঁজাখুঁজি চলল। অবশেষে একদিন আমাদেরই অফিসে এলেন আজকের বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘সুচিত্রা’ বা ‘রমা সেন’। সেই প্রথম আমরা এক ছবিতে কাজ করি।

কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ফ্লোরে ফ্লোরে যারা ঘুরে বেড়ায় অথচ ছবির প্রযোজনার সঙ্গে যাদের কোনো সম্বন্ধই নেই, তেমন লোকেরা তাঁকেও একদিন বলেছিল, এঁর অভিনয়ের কোন দক্ষতা নেই।

তাঁর দক্ষতা আছে কি না তার স্বীকৃতি দিয়েছেন আপনারা। বিশেষ করে, কোন টাইপ চরিত্রে অভিনয় করতে তিনি অদ্বিতীয়।

প্রায় এই সময়েই স্টার থিয়েটার৭৫ নতুনভাবে শুরু করেন তাঁদের অভিযান।

যুদ্ধের সময় বা যুদ্ধের আগে এঁদের এখানে রোজই অভিনয় হত। সে অভিনয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হতো ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা ধর্মমূলক।

একমাত্র স্টার থিয়েটারেই তখন প্রতিদিন অভিনয় হত। কিন্তু কলকাতার অন্য প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় হত সপ্তাহে তিনদিনে চারবার। বৃহস্পতি, শনি, রবি ছিল তাদের অভিনয়ের দিন।

স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী শ্রীসলিলকুমার মিত্র ঠিক করলেন, অন্য প্রেক্ষাগৃহের মতো তিনিও সপ্তাহে চারবার অভিনয় করাবেন।

পুরোনো দলকে বিদায় দিয়ে তিনি আবার নতুন করে দল তৈরি করলেন। এই দল গড়তে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন থিয়েটারের বিশেষজ্ঞ শ্রদ্ধেয় যামিনী মিত্র এবং শিশির মল্লিক।

এঁরা ঠিক করলেন নিরুপমা দেবীর৭৬ ‘শ্যামলী’কে নতুনভাবে নাট্যরূপ দিয়ে, তাকেই মঞ্চস্থ করবেন। নায়ক অনিলের চরিত্রে অভিনয় করবার জন্য একজন নতুন অভিনেতা চাই। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করছেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মূক অভিনয় অদ্ভুত। ওই দলেতে আরও ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা রবি রায়৭৭, জহর গাঙ্গুলি বা সুলালদা।

সুলালদা আমাকে একদিন বললেন—‘থিয়েটার করবি?’

আমিও ভাবলাম, মন্দ কী! পাড়ায় তক্তা ফেলে অভিনয় করেছি। তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শক ছিলেন আমার পরিচিত ব্যক্তিরা। সুযোগ যখন পাচ্ছি, কেন জানাব না আমার অভিবাদন, আমার দর্শকদের!

বিখ্যাত নাট্যকার শ্রীদেবনারায়ণ গুপ্ত৭৮ মহাশয় ‘শ্যামলী’র নাট্যরূপ দিয়েছিলেন।

রিহার্সাল শুরু হল। একদিন অভিনয়ের জন্যে তা প্রস্তুতও হল।

আজ ঠিক সাল আর তারিখ মনে নেই, তবে এইটুকু মনে আছে সময়টা ছিল পুজোর আগে।

বাতাস হয়েছে শিশিরে ভেজা, আকাশ হয়েছে মেঘমুক্ত। চারিদিকে খেলে যাচ্ছে একটা সুন্দর আলোর প্রবাহ। লোকে ব্যস্ত পুজোর বাজারের জন্য।

এমনি এক পরিবেশের মধ্যে ইলেকট্রিক বেল জানিয়ে দিল, অভিনয় আরম্ভ হতে আর দশ মিনিট দেরি আছে।

ধীরে ধীরে দর্শকরা নিজেদের আসন গ্রহণ করলেন। হ্যাঁ, সাজঘরে থেকেই জানতে পারলাম প্রচুর দর্শক সমাবেশ হয়েছে।

মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালা।৭৯ হঠাৎ মনে হল এত লোকের ভিড়ে দর্শকরা বোধহয় আমাকে মনেও রাখতে পারবেন না। সত্যি কথা কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।

স্টারেতেও সেই প্রথম শুরু হয়েছে ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ।

আবার বেল পড়ল। দরজা বন্ধ হল। যবনিকা সরে গেল। তীব্র আলো এসে পড়লো মুখে। এ ক্যামেরার সামনে অভিনয় নয় যে ভুল করলে ফিল্ম কেটে বাদ দিলেই চলবে। দর্শকরা জানতেও পারবেন না আমার ত্রুটির কথা। এখানে যদি ভুল হয় বা অভিনয়ে ক্রটি ধরা পড়ে তাহলে বিচার করবেন ওই দর্শকরা আর তখনই হাততালি বা শিস দিয়ে রায়ের ছাপ দিয়ে দেবেন আমার ললাটে, পাশ না ফেল!

২১

তুলসীদার সম্বন্ধে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। তাঁর অভিনয়ে বহুমুখী প্রতিভার সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলা দরকার মনে করছি।

বহুদিন আগে, খুব সম্ভব সেটা ১৯৪৪ সাল, রঙমহলে হয়েছিল ‘রামের সুমতি’।

শরৎচন্দ্রের এই ‘রামের সুমতি’-তে তুলসীদা অভিনয় করেছিলেন ‘ভোলা’-র চরিত্রে।

আপনারা সকলেই জানেন ‘ভোলা’ কিশোর। তুলসীদা তখন ৪০ পার হয়ে গেছেন। দর্শকের সামনে তিনি কেমন করে অভিনয় করবেন? অবশ্য তখন তাঁকে দেখেছিলাম কেবল দর্শকের আসনে বসে। প্রাণের চঞ্চলতা দিয়ে তিনি এমন নিখুঁত করে চরিত্রের রূপদান করেছিলেন, যেকোনো দর্শকের চোখেই তা খারাপ বলে বোধ হয়নি। তার কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃত অভিনেতা। শুধু তাই নয়, তিনি ভালো গানও গাইতে পারতেন। এছাড়া প্রয়োজন হলে, নেচেও লোককে আনন্দ দিতেন। এর ভেতরে আমরা জানি, তিনি ভালো তবলা বাজাতে পারতেন। কোনো কিছুতেই তাঁকে পেছপা হতে দেখিনি।

আমাকে তিনি বলেছিলেন—‘যদি ভালো অভিনেতা হতে চাও, তাহলে, কেবল অ্যাকটিং করলেই হবেনা, তার সঙ্গে গান শেখো।’

গানটাও অবশ্য ছেলেবয়স থেকেই আমার ভালো লাগত। শেখবার চেষ্টাও আমি করেছিলাম। কিন্তু, ইদানীং বিশেষ আর চর্চা ছিল না। তিনি বললেন—‘অমন করে হবে না। নিয়ম করে লেগে যাও। ঘুম থেকে উঠে অন্তত এক ঘণ্টা গলা সাধো হে! তাহলেই দেখবে একদিন তুমি বেশ ভালো গান শিখেছ।’

একরকম তাঁরই কথায় নতুন উৎসাহে গানের চর্চা শুরু করলাম। আর একটা কথা তিনি বলেছিলেন—এটা তখন বুঝিনি, আজ বুঝছি। সেটা হল আর কিছুই নয়। গান গাইলে মনের সমস্ত অবসাদ কেটে যায়। নতুন করে আবার মনে আসে আনন্দ। বোধহয় তুলসীদা সেইজন্যেই ছিলেন অতখানি হাস্যমুখর।

যাক সেকথা। কথায় কথায় এসে পড়েছি কাহিনির শেষ দিকে। এবারে বলি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের দু’একটা কথা। আমাদের এখানে ছবি তোলা হয়। ল্যাবরেটরির দোষেই তা অনেকসময় খারাপ হয়ে যায়। কথাটা বোধহয় আরেকটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।

ক্যামেরাম্যান ছবি তুললেন সেলুলয়েডের ওপর। শব্দযন্ত্রী শব্দ রেকর্ড করলেন সেই সেলুলয়েডের ওপর। এখন এই নেগেটিভকে ভালো করে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে তাকে নতুন করে প্রিন্ট করতে হয় পজিটিভ ফিল্মে। এখন আপনার সুবিধে মতো যত কপি ইচ্ছে তত কপি আপনি নেগেটিভ থেকে প্রিন্ট করে নিতে পারেন। এই সমস্ত প্রক্রিয়াই ঘটে থাকে ল্যাবরেটরিতে। ধরুন আপনি অনেক কষ্ট করে মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি করেছেন ছবিতে। কিন্তু, ল্যাবরেটরির দোষে আপনার মুখের সে ভাব পর্দায় প্রতিফলিত হল না। কিংবা ধরুন, আপনার গলার আওয়াজ ছবি দেখবার সময় হয়েছে খ্যানখেনে কিংবা অস্পষ্ট। আপনারা ছবি দেখবার সময় অনেকবার লক্ষ্য করেছেন সময় সময় কথা কী রকম অস্পষ্ট হয়। অবশ্য এর দ্বারা আমি এই মানে করছি না যে সবসময়ই এর কারণ ল্যাবরেটরি। অনেকসময় প্রেক্ষাগৃহের যন্ত্রে গোলমাল থাকলেও এমনটি হতে পারে। তবে ল্যাবরেটরির পদ্ধতি আজকাল বৈজ্ঞানিক যুগে দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সেইজন্যেই আমার মনে হয় ল্যাবরেটরির কর্মীদেরও সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার। কিন্তু, তেমন কর্মী কোথায় যিনি এ কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করবেন? আমার বন্ধু শ্রীতাপস মজুমদার তেমন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১৯৫৭ সালে আমি নায়ক হিসেবে আপনাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি। অনেকেই আসছেন আমার কাছে তাঁদের ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অনুরোধ নিয়ে। তাঁদের চুক্তিপত্রে সই করবার জন্যে। কিন্তু, কার, চুক্তিপত্রে কী আছে, কোন কথার আইনঘটিত কী অর্থ হতে পারে, এইসমস্ত দেখতেই আমার অনেকখানি সময় নষ্ট হত। তার ফলে, আমার শিল্পীজীবনের অনেকখানি ক্ষতি হচ্ছিল। আমি শিল্পী, শিল্প দিয়ে কী করে আপনাদের আনন্দ দিতে পারি, তাই আমার লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু, আমার হয়ে এ সমস্ত কাজ কে করে দেবে? একদিন হঠাৎ সকালবেলায় এলেন এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে দেখেই যেন মনে হল, কত আপনার। আমার বহুদিনের পরিচিত। এ যে কেবল আমার জীবনেই ঘটে তা নয়, আপনাদের জীবনেও দেখবেন, হঠাৎ কোনো বিশেষ ভদ্রলোককে দেখে আপনাদের মনে হবে, তিনি যেন আপনাদের কত পরিচিত। তাপসবাবুকে দেখেও ঠিক আমার তেমনি মনে হয়েছিল। কিন্তু, প্রথম দর্শনেই সেকথা তো বলা যায় না। নমস্কার বিনিময়ের পর তাপসবাবু আমাকে বললেন—‘আধুনিক বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটা ল্যাবরেটরি তিনি করতে চান। আমিও রাজি হয়ে গেলাম তাঁর কথায় এবং যুক্ত হলাম ইন্ডিয়ান ফিল্ম ল্যাবরেটরির সঙ্গে।

তাপসবাবুর সঙ্গে সেই হল আমার বন্ধুত্বের শুরু। তিনি কাজের লোক দেখে, তাঁকে একদিন সব কথা খুলে বললাম। তিনি রাজি হয়ে গেলেন আমার কাজের ভার নিতে। এইরকমভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব।

বাবা তখন মারা গেছেন। স্টুডিওতে যাই আর আসি। কিছু ভালোও লাগে না। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা মানুষকে যে এমনভাবে অভিভূত করে, তা আমার জানা ছিল না। কাজের মধ্যে যখন থাকি, তখন একরকমভাবে কাটে। কিন্তু, বাড়িতে যখন থাকি, তখন কাটে অন্যভাবে। বুকের মধ্যে যেন সদাসর্বদা হু হু করে। রবিবাবুর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—

‘কার যেন এই মনের বেদন, কার? চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়?’ মন যেন কিছুতেই ভরতে চায় না। এমনসময় একদিন তাপসবাবু এসে, বললেন— ‘আপনাকে নিজের কথা লিখতে হবে।’

আমি চমকে উঠলাম—‘বলেন কী! অন্য লোকের লেখা সংলাপ চিরদিন ক্যামেরার সামনে আবৃত্তি করে আসি। স্টেজে যখন অভিনয় করি, তখনও অন্য লোকের সংলাপই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। আমি লিখলে পাঠকরা নেবে কেন?’ তিনি বললেন—‘দীর্ঘদিন অভিনয় করার দরুন দর্শকরা আপনাকে জানতে চায়। তার কারণ, পর্দার অন্তরালে যে মানুষ বাস করে, তার স্বরূপ জেনে তারা আনন্দ পাবে, এইজন্যেই আপনার লেখা দরকার।’

গৌরী সেখানেই বসেছিল। সে বললো—‘লেখো না কেন, মজুমদারদা যখন বলছেন।’

তখনকার মতো কথাটা চাপা পড়ে গেল। তার পরেরদিন এসে তাপসবাবু আবার আমাকে তাগাদা করেন। সেইদিন রাত্রে বসলাম কাগজ কলম নিয়ে। কিন্তু, একদিনেই তো লেখা যায় না। তাপসবাবুকে বলি—‘আমি লিখব, কিন্তু বেশ বড়ো হয়ে যাচ্ছে যে! তিনি বলেন, ‘ক্ষতি কী, ধারাবাহিকভাবে বেরোবে।’ ইতিপূর্বে ধীরাজবাবু আর অহীন্দ্রবাবুর আত্মকথা৮০ বেরিয়েছে। ধীরাজবাবু দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ছবির নায়ক ছিলেন। নির্বাক যুগ থেকেই তিনি নায়কের ভূমিকা পেয়েছিলেন, এবং তাতে অধিষ্ঠিতও ছিলেন অনেকদিন ধরে। ভরসা পেলাম তাপসবাবুর কথায়। লিখতে শুরু করলাম। তিনিই নিয়ম করে প্রতি মাসের প্রথম দিকে আমায় তাগাদা দিতে শুরু করেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে তাগাদা দেয় গৌরী।

সকালবেলায় গলা সেধে ওঠবার পরই, হাতের কাছে কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে গৌরী বলে—‘লেখো’। লিখতে আরম্ভ করি।

দীর্ঘ দুটো বছর ধরে, আমার জীবনের বহু ঘটনা আপনাদের কাছে উপস্থাপিত করেছি। বহু চিঠিও আপনাদের কাছ থেকে পেয়েছি। তাতে উৎসাহও পেয়েছি প্রচুর। আর, আমাকে এ কাজে উৎসাহ দিয়েছেন, আমার স্নেহময়ী জননী। যেদিন প্রথম লেখা বেরোলো, সেদিন লেখাটা মার কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘মা, এই দ্যাখো, কেমন লিখেছি বলো তো?’ ভেবেছিলাম মা বলবেন—‘কিছুই হয়নি।’ কিন্তু, মা বললেন—‘বেশ হয়েছে। তুই লিখে যা। ভালোই হবে।’

তাঁর কাছ থেকে সেদিন আশার বাণী শুনে উৎসাহিত হয়েছিলাম, যেমন উৎসাহিত হতাম, প্রথম দিকে ছবি করার পর মা দেখে এসে যখন বলতেন—‘খোকা, ভালোই হয়েছে। আরও, ছবি করবার চেষ্টা কর…’

১। ১৮৬৩—১৯১৩। বাংলা গানের অন্যতম যুগ প্রবর্তক। এছাড়াও, একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। কৃষ্ণনগরে জন্ম। বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন একজন ওস্তাদ গাইয়ে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ভাবধর্মী সংগীতের ধ্যানধারণা পোষণ করতেন। ইংলন্ডে গিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা পড়তে। সেখানেই পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে পরিচয়। ফিরে এসে সরকারি চাকরিতে যোগদান, এবং অনবরত বদলির আক্রমণ। বিদেশ যাওয়ার আগেই ‘আর্যগাথা ১ম ভাগ’ নামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তারপর ‘আর্যগাথা ২য় ভাগ’, ‘মন্দ্র’, ‘আষাঢ়ে’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

বাংলা গানে প্রথম সার্থকভাবে পাশ্চাত্যসংগীতের প্রয়োগ ও হাসির গান সৃষ্টি করেন। জীবনের শেষ দিকে পরপর অনেকগুলি নাটক (পরপারে, মেবার পতন, দুর্গাদাস, সীতা ইত্যাদি) লেখেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘সাজাহান’ (১৯০৯) ও ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) উত্তমকুমার এখানে সাজাহান নাটকের অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র ‘দিলদার’ এর সংলাপ উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে শক্তিমান অভিনেতারা এই চরিত্রে রূপদান করেছেন। প্রখ্যাত সংগীতব্যক্তিত্ব ও বিদগ্ধ মানুয দিলীপকুমার রায় ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র।

২। Sir Morris Gayer ছিলেন OXFORD UNIVERSITY -র প্রধান। ১৯৪০ সালে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে ডি. লিট সম্মান প্রদান করেছিল, তা নিজের হাতে কবির হাতে সমর্পণ করতে শান্তিনিকেতনে আসেন Sir Gayer। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি ‘গেস্ট হাউস’—এর নামও Sir Morris Gayer-এর নামে নামাঙ্কিত। উত্তমকুমার তাঁর রচনায় এই প্রাজ্ঞ মানুষটির নাম উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কতখানি ওয়াকিবহাল ছিলেন। (Sir Morris Gayer সংক্রান্ত উপরিল্লিখিত তথ্যটি পাওয়া গেছে শ্রদ্ধেয় কবি শ্রীশঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে। স.)।

৩। উত্তমকুমারের বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। মেট্রো সিনেমাহলের চীফ অপারেটর ছিলেন। সংসারের হাল ধরে মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে দাঁড় করানোর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ছেলে উত্তমের, ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে আপত্তি তো করেনই নি, উপরন্তু এক বন্ধু মারফত উত্তমকে ছবিতে সুযোগের ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছিলেন।

৪। উত্তমকুমারের মা চপলা দেবী। প্রধান অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে ছেলে উত্তমের জীবনে সবসময় ছিলেন। উত্তমকুমারেরও প্রধান ভরসাস্থল ছিলেন তাঁর মা। অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রিয় পুত্রের প্রয়াণের সময় জীবিত ছিলেন চপলা দেবী।

৫। চলচ্চিচত্রের আদি যুগে যে পদ্ধতিতে ছবি দেখানো হত, তাকে ‘বায়োস্কোপ’ বলা হয়। একইসঙ্গে এই চলচ্চিচত্র দেখানোর গৃহটিকেও বলা হত ‘বায়োস্কোপ’। আগেকার দিনের মানুষরা অনেকদিন পর্যন্ত সিনেমাকে ‘বায়োস্কোপ’ বলতেন।

৬। উত্তমকুমারের আপন ছোটোভাই তরুণকুমার। ডাক নাম ছিল ‘বুড়ো’। উত্তমের অসম্ভব স্নেহের ভাই ছিলেন তাঁর আদরের ‘বুড়ো’। সারাজীবন তরুণকুমার সবরকম ঘাত—প্রতিঘাতের সময় তাঁর দাদার পাশেই ছিলেন। তরুণকুমারের জন্ম ১৯৩৩ সালে। উত্তমকুমারের বিস্তৃত প্রভাবের মধ্যে অভিনয় জগতে এসেও সম্পূর্ণ এক নতুন অভিনয়শৈলীকে আশ্রয় করে, নিজেকে পৃথকভাবে তুলে ধরেছিলেন তরুণকুমার, যা খুব সহজ কাজ ছিল না। ১৯৫৪ সালে ‘হ্রদ’ ছবিতে প্রথম অভিনয়, যার নায়ক ছিলেন তাঁর অগ্রজ। এরপর, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘অবাক পৃথিবী,’ ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘চৌরঙ্গী’ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ২০০ ছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়া, নিয়মিতভাবে মঞ্চেও অভিনয় করেছেন তরুণকুমার। নাটকের মধ্যে ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘ক্ষুধা’, ‘সেতু’, ‘আসামী হাজির’, ‘নহবৎ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অভিনেতা হিসেবে পরবর্তীকালে নিজেকে একজন শক্তিশালী কমেডিয়ান হিসেবে তুলে ধরেন তরুণকুমার। অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে তরুণকুমার ‘কল্পতরু গোষ্ঠী’ গড়ে তোলেন এবং উত্তম—প্রয়াণের বেশ কিছু বছর পরে এই গোষ্ঠীই ‘উত্তম মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। পরিচালিত নাটক ‘অশ্লীল’। তরুণকুমারের স্ত্রী বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়।

৭। ফণী রায় বিশ শতকের প্রথম ভাগের একজন বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতা। নিজেকে কৌতুক অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নাটকের মাধ্যমে অভিনয় জীবনের শুরু। প্রথম জীবনে বেশকিছু নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। ফণী রায় মহিলাদের সঙ্গে অভিনয় করার বিরোধী ছিলেন। এই কারণে, ‘আর্ট থিয়েটার’ সংস্থার নাট্যাভিনয়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে, অবশ্য এই সংকল্প ত্যাগ করে পেশাদারি মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত কালী ফিল্মসের ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ করেন ফণী রায়। এ ছবিতে এক হাঁপানি রুগির চরিত্রে মনকাড়া অভিনয়ের নজির রাখেন এই অভিনেতা এবং এই অভিনয়ের কথাই উল্লেখ করেছেন উত্তমকুমার। এরপর, একের পর এক ‘নন্দিনী’, ‘বন্দী’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মানে না মানা’, ‘নিরক্ষর’, ‘সহসা’ ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেন। প্রসঙ্গত ফণী রায়ের আসল নাম পঙ্কজভূষণ কবিরত্ন। এক সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ছিলেন এই অভিনেতা। ১৯৬৬ সালে ফণী রায় প্রয়াত হন।

৮। প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কালী ফিল্মসের প্রযোজনায় ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায় ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিটি। পরিচালক ছিলেন তিনকড়ি চক্রবর্তী। এই ছবিতেই নায়ক ‘বিশু’—র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম চলচ্চিচত্র জগতে প্রবেশ ঘটে প্রখ্যাত ছবি বিশ্বাসের। একই নামে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৪ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায়। নায়ক ও নায়িকা ছিলেন যথাক্রমে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন।

৯। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৬—১৯৪৩) ছিলেন বাংলা অভিনয় জগতের প্রখ্যাত অভিনেতা। প্রথম ‘স্টার’ তিনি। বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের জমিদার বংশের ছেলে ছিলেন। অভিনয়ের নেশায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রথমে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে আঁকা শিখে সিন আঁকার কাজ নিয়ে থিয়েটারে ঢোকেন। প্রথম মঞ্চাবতরণ ১৯২৩ সালে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে। স্টার থিয়েটারে এই নাটকের পরিচালক ছিলেন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। এরপর, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘ইরানের রানী’, ‘মেবার পতন’, ‘স্বয়ম্বরা’, ‘মাটির ঘর’, ‘পি.ডব্ল্যু.ডি’ মিলিয়ে প্রায় ৪০—এর বেশি নাটকে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেন দুর্গাদাস। ১৯৪২ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত—র ‘কাঁটা ও কমল’ নাটকে শেষবারের মতো মঞ্চে নামেন। প্রসঙ্গত, মঞ্চ থেকেই ‘স্টার’ হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে নির্বাক ছবিতে অভিনয় শুরু করে, ১৯৩১ সালে ‘নিউ থিয়েটার্স’ প্রযোজিত প্রেমাঙ্কুর আতর্থী পরিচালিত প্রথম সবাক ছবি ‘দেনা—পাওনা’—য় নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে সবাক ছবিতে প্রবেশ করেন দুর্গাদাস। এরপর, ‘চণ্ডীদাস’, ‘মীরাবাঈ’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দিদি’, ‘দেশের মাটি’ সহ প্রায় ১৬ টি সবাক ছবিতে নায়ক রূপে দুর্গাদাসকে দেখা যায়। ১৯৪৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সৌম্যেন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত নিউথিয়েটার্স—এর ‘প্রিয়—বান্ধবী’ ছবিই দুর্গাদাসের শেষ অভিনীত ছবি। বেশকিছু মঞ্চনাটক ও রেকর্ড—নাটক পরিচালনা করেন এবং কয়েকটি বেতার—নাটকেও অংশ নেন দুর্গাদাস।

১০। ‘অহীনবাবু’ হলেন নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী (১৮৯৫—১৯৭৪)। বাংলা চিত্র ও নাট্যজগতের অভিনয় দুনিয়ায় একটি যুগের নাম। পড়াশুনার গভীরতা তাঁকে অভিনয়—সম্বন্ধীয় এক প্রাজ্ঞ মানুষে পরিণত করে। ১৯২১ সালে ‘ফটো প্লে সিন্ডিকেট’ প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এই প্রতিষ্ঠান—নির্মিত ‘সোল অফ আ স্লেভ’—ই অহীন্দ্র চৌধুরীর প্রথম ছবি। এই প্রতিষ্ঠান তৈরির আগে অহীনবাবু তিনকড়ি চক্রবর্তীর সাহায্যে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আর্ট থিয়েটারে যোগ দেন। পেশাদার মঞ্চে ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে প্রথম মঞ্চাবতরণ। এছাড়া, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মিশরকুমারী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ ইত্যাদি অনেক নাটক অহীন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য অভিনয়ের সাক্ষ্য বহন করেছে। তবে অহীনবাবু ‘সাজাহান’ নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয়ে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হন। অন্যদিকে, ‘ডাক্তার’, ‘জীবনসঙ্গিনী’, ‘মানে না মানা’, ‘সোনার সংসার’, ‘বিদ্যাসাগর’ ইত্যাদি প্রায় দুশো—র বেশি ছবিতে দেখা গেছে অহীনবাবুর অভিনয় চাতুর্থ। ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’, রবীন্দ্র—ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি—লিট, সংগীত—নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন অহীন্দ্র চৌধুরী। তাঁর আত্মজীবনী ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ এক আকরগ্রন্থ।

১১। বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলার পাঁজিয়া গ্রামে ১৯০৫ সালে বিশিষ্ট অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম। ম্যাডান কোম্পানির ‘সতীলক্ষ্মী’ (১৯২৫) নির্বাক ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু। এরপর, মধু বসু পরিচালিত ‘গিরিবালা’ ছবিতে নায়ক গোপীনাথের চরিত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য চরিত্রলাভ। ‘নৌকাডুবি’, ‘মৃণালিনী’ ইত্যাদি নির্বাক ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রথমে পুলিশে চাকরি করতেন। পরে ইস্তফা দিয়ে হয়ে গেলেন পুরোপুরি পেশাদার অভিনেতা। ‘পরশমণি’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘মানে না মানা’, ‘কঙ্কাল’, ‘কালোছায়া’, ‘হানাবাড়ি’ ইত্যাদি প্রায় ২০০-র কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেন ধীরাজবাবু। মঞ্চেও নিয়মিত তাঁকে অভিনয় করতে দেখা গেছে। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে ধীরাজ ভট্টাচার্য-র ‘হাজারি ঠাকুর’-এর চরিত্রে অভিনয় চিরস্মরণীয়। বেতার ও রেকর্ডেও অভিনয় করেছেন। বেতারে ‘অলীক’ নাটকে তাঁর অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো। ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ ধীরাজ ভট্টাচার্য-র লেখা স্মৃতিকথাধর্মী বই দুটি উল্লেখযোগ্য।

১২। ‘ছবিদা’ হলেন প্রখ্যাত ছবি বিশ্বাস (১৯০০-১৯৬২)। অভিনয় জগতের জ্যোতিষ্ক। ভালো নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার জাগুলি (ছোটো)-র জমিদারবংশে জন্ম। ছবির মতো সুন্দর দেখতে হয়েছিল বলে, মা নাম রেখে!ছলেন ‘ছবি’। এই নামেই জগৎবিখ্যাত হন। ‘হাওড়া নাট্য সমাজ’, ‘কাঁকুড়গাছি নাট্য সমাজ’-এর হয়ে ‘নদীয়া বিনোদ’ নাটকে ‘নিমাই’ চরিত্রে সুনাম অর্জন করেন। এরপর ‘মীরকাশেম’, ‘দুই পুরুষ’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। ১৯৩৬ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তীর পরিচালনায় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে প্রথম নায়ক হিসেবে চিত্রাবতরণ করেন ছবি বিশ্বাস। এরপর, ‘ছদ্মবেশী’, ‘মিলন’, ‘শুভদা’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জীবনস!ঙ্গনী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জলসাঘর’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দাদাঠাকুর’, ‘একদিন রাত্রে’ ইত্যাদি ২০০-র বেশি ছবিতে চলচ্চিত্র-অভিনয়ের এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছে ছবিবাবুর অবিস্মরণীয় অভিনয়ে। ‘যার যেথা ঘর’ ও ‘প্রতিকার’ দুটি ছবির পরিচালক ছিলেন ছবি বিশ্বাস। এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই জ্যোতিষ্কস্বরূপ অভিনেতা।

১৩। ‘নাট্যাচার্য’ হলেন বাংলা নাট্যজগতের প্রবাদপুরুষ শিশিরকুমার ভাদুড়ি (১৮৮৯-১৯৫৯) ‘গিরিশ-যুগ’-এর পর বাংলা থিয়েটার জগতে ‘শিশির-যুগ’-এর আবির্ভাব ঘটে। প্রথম জীবনে মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ)-এ অধ্যাপনা করেন। বন্ধু নটশেখর নরেশচন্দ্র মিত্রের অনুরোধে অধ্যাপনা ছেড়ে নাট্যজগতে আসেন। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চে অ্যামেচার থিয়েটার শুরু করেন। ১৯১২ সালে এই মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ তার ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ গল্পের মঞ্চায়নে শিশিরবাবুর ‘কেদার’ চরিত্রে অভিনয় দেখে তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। ১৯২৩ সালে ইডেন গার্ডেনে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটক মঞ্চস্থ করে, প্রথম নিজস্ব নাট্য দল নিয়ে তাঁর নাট্যাভিনয় শুরু করলেন শিশিরকুমার। এরপর, ‘আলমগীর’, ‘বিজয়া’, ‘যোগাযোগ’, ‘রীতিমত নাটক’, ‘বিপ্রদাস’, ‘বিসর্জন’, ‘রঘুবীর’, ‘প্রফুল্ল’, ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগু%প্ত’ আরো অজস্র নাটক মারফত মণিমাণিক্য ছড়িয়েছিলেন শিশিরকুমার। শ্রীরঙ্গম (বিশ্বরূপা) মঞ্চে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছিলেন। ‘মোহিনী’ (নির্বাক), ‘কমলে কামিনী’ (নির্বাক), ‘সীতা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘টকি অব টকিজ’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘চাণক্য’ ইত্যাদি ছবিতেও শিশিরবাবুকে দেখা গেছে।

১৪। ‘শ্রীরঙ্গম’ উত্তর কলকাতাস্থিত একটি নাট্যমঞ্চের নাম। এটির আগে নাম ছিল ‘নাট্যভারতী’। ১৯৪১ সালে শিশিরকুমার ভাদুড়ি, এই মঞ্চটিকে নতুন করে আধুনিকরণ করে, এর নাম দেন দেন ‘শ্রীরঙ্গম’। অনেক পরে, ‘শ্রীরঙ্গম’ পাল্টে হয় ‘বিশ্বরূপা’। বর্তমানে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই প্রেক্ষাগৃহ।

১৫। এ. আর. পি-র পুরো কথাটি হলো ‘এয়ার রেড প্রোটেকশন (AIR RAID PROTECTION)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলিকাতায় সাধারণ যুবকদের নেওয়া হয়েছিল এ. আর. পি হিসেবে। এরা মিলিটারিদের সাহায্যকারী হিসেবে ছিল। বোমা পড়ার সম্ভবনা দেখা গেলে, মানুষকে আগাম সতর্ক করা বা তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, ইত্যাদি আরো কিছু কাজ ছিল এ. আর. পি-র। এদের পোশাক ছিল নীল-সাদা রঙের।

১৬। সিভিক গার্ড হল সাময়িক ভিত্তিতে নিযুক্ত শান্তিরক্ষক বাহিনী। যারা পুলিশ-মিলিটারিকে বিভিন্ন অশান্তি দমনের বিষয়ে সাহায্য করত। এদের মধ্যে অনেকে পুলিশ বিভাগে স্থায়ী চাকরিতেও বহাল হতো। এদের ধরনের সঙ্গে পরবর্তীকালের ‘হোমগার্ড’—দের ধরনের একটা মিল ছিল।

১৭। ভারতীয় সংগীতজগতের এক উজ্জ্বল যুগস্রষ্টা কুন্দনলাল সাইগল (১৯০৭-১৯৪৭)। অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর ও সাংগীতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই সংগীতশিল্পী। কলিকাতায় এসে নিউথিয়েটার্সের (১৯৩৩) হিন্দি ‘পুরাণ ভকত’ ছবিতে প্রথম দেখা যায় সাইগলকে। ১৯৩২ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানির উদ্বোধনের বছরেই সাইগলের গাওয়া-‘হরি হে ব্রজরাজ দুলারে.’ গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। নায়ক-গায়ক হিসেবে নিউথিয়েটার্সের বেশকিছু বাংলা-হিন্দি ছবিতে সারা ভারত মাতিয়ে!ছলেন তিনি। বাংলার মধ্যে- ‘দেবদাস’, ‘জীবনমরণ’, ‘দেশের মাটি’, ‘দিদি’, ‘পরিচয়’, ও হিন্দিতে-‘দুশমন’, ‘দেবদাস’, ‘ধূপছাঁও’, ‘প্রেসিডেন্ট’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত ‘জীবনমরণ’ ছবিতে সায়গলের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমি তোমায় যত…’ চিরস্মরণীয়। এরপর মুম্বাই গিয়ে ওমর খৈয়াম, তানসেন, পরোয়ানা, শাহজাহান ইত্যাদি ছবিতে অভিনয়সহ অসাধারণ গান উপহার দেন এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।

১৮। পাহাড়ী সান্যাল (১৯০৭-১৯৭৪) বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক কালজয়ী অভিনেতা। প্রকৃত নাম নগেন্দ্রনাথ। শৈলশহর দার্জিলিঙে জন্মেছিলেন বলে ডাকনাম হয় ‘পাহাড়ী’। লক্ষ্নৌ-এর মরিস কলেজে রীতিমতো নিষ্ঠা সহকারে হিন্দুস্থানি সংগীত শেখেন। দেবকীকুমার বসুর ‘মীরাবাঈ’ (১৯৩৩) ছবিতে প্রথম অভিনয়। এরপর, ‘ভাগ্যচক্র’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘বড়দিদি’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘গিরিশচন্দ্র’, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘নির্জন সৈকতে’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়ের নমুনা পেশ করেছেন পাহাড়ী সান্যাল। মঞ্চাভিনয় বিশ্বরূপায় ‘আসামী হাজির’ নাটকে। অনেক ছবিতে অভিনয়সহ বেশকিছু গানও গেয়েছেন।

১৯। ‘জহরদা’ হলেন বাংলা নাট্য ও চিত্রজগতের চিরভাস্বর অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায় (১৯০৩- ১৯৬৯)। ‘সুলাল’ নামে পরিচিত ছিলেন। মিত্র থিয়েটারে যুক্ত হয়ে ‘শ্রীদুর্গা’ নাটকে (১৯২৬) প্রথম মঞ্চে ওঠেন। ১৯৩১ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তী পরিচালিত নির্বাক ‘সীতা’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। ‘চাঁদ সদাগর’ (১৯৩৪) ছবিতে প্রথম সবাক ছবির দুনিয়ায় প্রবেশ। তবে, রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে কানন দেবীর বিপরীতে প্রথম নায়কের চরিত্র পান জহরবাবু। এরপর, আর পিছনদিকে তাকাতে হয়নি। নায়ক ও পরে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে একের পর এক- ‘শহর থেকে দূরে’, ‘যোগাযোগ’, ‘মানে না মানা’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘প্রিয়বান্ধবী’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে কয়েক দশকজুড়ে অসামান্য অভিনয়নৈপুণ্যে মাতিয়ে দিয়েছেন। মঞ্চাভিনয়ের ক্ষেত্রে ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘পরিণীতা’, ‘শ্যামলী’, ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ ইত্যাদি বহু নাটকে তাঁর প্রতিভার নমুনা রেখেছেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘নটী বিনোদিনী’ নাটকে শেষবার মঞ্চে ওঠেন। ভালো গান গাইতে পারতেন। প্রবীন বয়সে ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ নাটকে ‘ভোলাময়রা’ চরিত্রে গানসহ দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। মোহনবাগান ক্লাবের অন্ধ সমর্থক ছিলেন। এই ক্লাবের হকি-সচিবও হয়েছিলেন। বেতার ও রেকর্ডেও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন।

২০। নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৩-২০১২) একজন গুণী সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক। ধ্রুপদ, ধামার, খেযাল, ঠুংরি ইত্যাদি রীতিমতো তালিম নিয়ে শিখেছেন। প্রথিতযশা বিভিন্ন সংগীতগুরুর কাছে সঙ্গীতশিক্ষা নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে আছেন ধ্রুপদিয়া অমর ভট্টাচার্য, বিনোদ মল্লিক, মণিলাল দাস, খেয়ালিয়া মেহেদি হাসান (রামপুর), কে.জি. ঢেকনে (গোয়ালিয়র), কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় (রামপুর), সত্যেন সেন (পাতিয়ালা), রামদাস মিশ্র (বেনারস) প্রমুখ গুণীজন। উত্তমকুমারের এরকম একজন সংগীতগুরুকে নির্বাচন করা অত্যন্ত যথাযথ।

২১। প্রমথেশ বড়ুয়া (১৯০৩-১৯৫১) ছিলেন চলচ্চিত্রজগতের রাজকুমার। অসমের গৌরীপুরের রাজপরিবারে জন্ম। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হন। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস লিমিটেডের বোর্ড অব ডিরেক্টরর্সের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন এবং এই প্রতিষ্ঠানের ছবি ‘পঞ্চশর’-এ ছোটো চরিত্রে অভিনয়ের প্রথম সুযোগ পান প্রমথেশ। ১৯৩০-এ প্যারিসে গিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষা নেন। ফিরে এসে ১৯৩১-এ ‘বড়ুয়া ফিল্ম’ তৈরি করে ‘অপরাধী’ ছবি নির্মাণ করেন ও ঐ ছবিতে নায়করূপে অবতীর্ণ হন। প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত প্রথম সবাক ছবি ‘বাংলা ১৯৮৩’। ১৯৩৩ সালে নিউ থিয়েটার্স-এ যোগ দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন প্রমথেশ বড়ুয়া-মুক্তি, দেবদাস, গৃহদাহ, জিন্দেগী, অধিকার ইত্যাদি বেশকিছু অসাধারণ ছবি সৃষ্টি হল। এরপর, মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেন এম. পি. প্রোডাকসন্স। ‘শেষ উত্তর’, ‘মায়ের প্রাণ’ মিলিয়ে অসাধারণ জনপ্রিয় কিছু ছবি উপহার দেন এই সংস্থা, যার পিছনের মূল কারিগর ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। বিয়ে করেছিলেন চিত্রাভিনেত্রী যমুনা বড়ুয়াকে। পরিচালকের পাশাপাশি এক অসম্ভব জনপ্রিয় ‘স্টার’ হিসেবেও তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজেকেই তুলে ধরেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া।

২২। গৌরীরানী গাঙ্গুলী উত্তমকুমারের স্ত্রী। ১৯৪৫-৪৬ সালে জ্যাঠতুতো বোন অন্নপূর্ণার বন্ধু গৌরীর সঙ্গে নিজেদের গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতেই প্রথম পরিচয় উত্তমকুমারের। ধীরে ধীরে প্রেম, অবশেষে সম্পর্কের পরিণতি শুভ-পরিণয়ে। ১৯৫০ সালের ১ জুনে বিয়ে হয়। উত্তমবাবুর প্রয়াণের সময় (১৯৮০) জীবিত ছিলেন গৌরীদেবী।

২৩। ল্যান্সডাউন রোডের বর্তমান নাম শরৎ বসু রোড। এই রাস্তাতেই বনেদি গাঙ্গ%লি-বাড়ি অবস্থিত। এই বাড়িরই মেয়ে গৌরী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন উত্তমকুমার।

২৪। বিশিষ্ট অভিনেতা বিশ্বনাথ ভাদুড়ি (১৮৯৭-১৯৪৫)-র অগ্রজ ছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি। শিশিরবাবুর কাছেই অভিনয় শিক্ষা। ১৯২৩ সালে শিশিরকুমারের পরিচালনায় ‘সীতা’ নাটকে লক্ষ্মণের চরিত্রে বিশ্বনাথবাবু প্রথম মঞ্চেনামেন। এরপর, ‘জনা’,’সাজাহান’, ‘পাষাণী’, ‘রঘুবীর’, ইত্যাদি আরো অনেক নাটকে অসামান্য অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন। এছাড়া, ‘সমাজ’, ‘টকি অব টকীজ’, ‘সীতা’, ‘ভাগ্যচক্র’, ‘গৃহদাহ’, ইত্যাদি বেশকিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ি।

২৫। ‘নরেশদা’ হচ্ছেন প্রখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা ‘নটশেখর’ নরেশচন্দ্র মিত্র (১৮৮৮-১৯৬৮)। শিশির ভাদুড়ির অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন নরেশচন্দ্র এবং নরেশবাবুরই অনুরোধে কলেজের চাকরি ছেড়ে থিয়েটার জগতে প্রবেশ করেন শিশিরকুমার। ছাত্রাবস্থায় ১৯০৮ সালে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে ‘কুরুক্ষেত্র’ নাটকে নরেশবাবু ও শিশিরবাবু অভিনয় করেন যথাক্রমে ‘দুর্বাসা’ ও ‘অভিমন্যু’ চরিত্রে। কখনো পরিচালনাসহ অভিনয় আবার কখনো বা শুধুই অভিনয় দিয়ে নাট্যমঞ্চ আলোকিত করেছেন নরেশ মিত্র। ‘পুনর্জন্ম’, ‘প্রফুল্ল’, ‘কর্ণার্জুন’, ‘প্যালারামের স্বাদেশিকতা’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ ইত্যাদি আরো অজস্র নাটকে অভিনয় বা পরিচালনা করেছেন। নির্বাক যুগের ছবি মানভঞ্জন, চন্দ্রনাথ, দেবদাস ইত্যাদি আর ‘গোরা’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’, ‘কঙ্কাল’, ‘উল্কা’, ইত্যাদি সবাক ছবির পরিচালক ছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র।

২৬। চন্ডীদাসের জন্ম বীরভূম জেলার নানুর গ্রামে। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন বৈষ্ণব মতাদর্শের কবি। তবে, চন্ডীদাসের অস্তিত্ব নিয়ে নানা মত চালু আছে। চন্ডীদাস নামে ‘বড়ু’, ‘দ্বিজ’, ‘রামী, ‘দীন’, ইত্যাদি একাধিকজনের কথা উঠে এসেছে। তবে, রামী নামে রজকিনীর সঙ্গে যে চন্ডীদাসের প্রেমের কথা সর্বজনবিদিত এবং যাঁর কাব্যে বারবার এসেছে বাঁশুলি দেবীর কথা, সেই ‘রামী-চন্ডীদাস’-ই সর্বাধিক আলোচিত হন। এই চন্ডীদাসের জীবনকথা নিয়ে নিউথিয়েটার্সের প্রযোজনায় ও দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় ১৯৩২ সালে মুক্তিপায় ‘চন্ডীদাস’ ছবিটি। এতে মুখ্য চরিত্রে ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, উমাশশী দেবী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীবর্গ। সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল।

২৭। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সপ্তপদী’-র চিত্ররূপ দেন পরিচালক অজয় কর। ছবিটি মুক্তি পায় ২০ নভেম্বর ১৯৬২। সুপারহিট হয় ছবিটি। নায়ক-নায়িকা হিসেবে উত্তম-সুচিত্রা ছাড়াও এ ছবিতে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, তরুণকুমার, ছায়াদেবী, পদ্মাদেবী, প্রীতি মজুমদার প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতাবর্গ। উত্তম-সুচিত্রার লিপে হেমন্ত-সন্ধ্যার গাওয়া, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়.’ সর্বকালের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় বাংলা গানটি এই ছবিতেই ছিল। এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিতে ‘কৃষ্ণেন্দু’ ও ‘রীনা ব্রাউন’-এর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন।

২৮। ‘ধীরেনদা’ হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ইনি সিনেমা ও থিয়েটারে ড্রেস মেটিরিয়াল সরবরাহকারী তৎকালীন প্রখ্যাত দোকান ‘নিউ স্টুডিও সাপ্লায়ার্স’-এর মালিক ছিলেন। অভিনয়মহলে ধীরেনবাবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। এনার দোকানটি ছিল টালিগঞ্জ অঞ্চলের চারু এভিন্যু-এ।

২৯। ‘অসিতদা’ অর্থাৎ বিশিষ্ট অভিনেতা অসিতবরণ (১৯১৬-১৯৮৪)। পুরো নাম অসিতবরণ মুখোপাধ্যায়। অভিনয় ছাড়াও, যেমন গান গাইতে পারতেন, তেমনটি ছিলেন একজন দক্ষ তবলাবাদক। প্রথম জীবনে আকাশবাণীর তবলাবাদক ছিলেন। গানও গাইতেন। এক সংগীতের আসরে পাহাড়ী সান্যালের নজরে পড়ার ফলে, ১৯৪১ সালে হেমচন্দ্র পরিচালিত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিতে একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ মিলে যায় অসিতবরণের। এরপর, নায়ক-গায়ক হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘কাশীনাথ’, ‘কবি জয়দেব’, ‘নিরুদ্দেশ’, ‘দৃষ্টিদান ইত্যাদি ছবি-এর উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রসঙ্গত, নীতিন বসু পরিচলিত ‘দৃষ্টিদান’, (১৯৪৮) ছবিতেই নায়ক অসিতবরণের ছোটোবেলার চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে আবির্ভাব ঘটে উত্তমকুমারের। পরবর্তীকালে, অসিতবাবু গান গাওয়া বন্ধ করে শুধুই অভিনেতা হয়ে ওঠেন। পূর্বোক্ত বাদে, ‘বন্ধু’, ‘পলাতক’, ‘চলাচল’, ‘অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ইত্যাদি আরো কিছু অসিতবরণ অভিনীত ছবির কথা উল্লেখ করা যায়। অসিতবরণ একজন বিশিষ্ট মঞ্চাভিনেতাও ছিলেন। ‘পরিণীতা’, ‘কথা কও’, ‘সেতু’, ‘ডাঃ শুভঙ্কর’, ইত্যাদি বেশকিছু নাটকে তাঁর অভিনয়ের সাক্ষ্য রেখেছেন তিনি। এই সবকিছুর পাশাপাশি অসিতবরণের ছিল অসম্ভব ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা। ডাকনাম ‘কালো’ নামে পরিচিতমহলে জনপ্রিয় ছিলেন।

৩০। বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুনন্দা দেবীর জন্ম ১৯২১ সালের অগস্ট মাসে কলকাতায়। বাবা জগদীশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কমলালয় কোম্পানীর ম্যানেজার। সুনন্দা দেবীর আসল নাম ‘ইলা’। মাত্র সাত বছর বয়সেই ‘ইলা’ নামে নির্বাক ছবি ‘নিদ্রিত ভগবান’-এ অভিনয় করেছিলেন। ১৩ বছর বয়সে ব্যানারম্যান স্টোরের মালিক সুধীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইলা তথা সুনন্দার বিয়ে হয়। কিছুদিন পরে স্বামীর ব্যবসায় হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এলে চিত্রজগতে পা রাখতে হয় সুনন্দা দেবীকে। প্রথম ছবি, ‘কাশীনাথ’ (১৯৪৩)-এ নায়ক অসিতবরণের বিপরীতে নায়িকা হলেন। নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। এরপর, ‘দম্পতি’, ‘দুই পুরুষ’, ‘সমাপিকা’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘অঞ্জনগড়’ ইত্যাদি অনেক ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। তবে ‘বিরাজ বউ’ ছবিতেই তিনি সবচেয়ে মনকাড়া অভিনয় করেন। সুনন্দা দেবী ‘এস. বি. প্রোডাকসন্স’ নামে একটি চিত্র প্রযোজকসংস্থা খুলেছিলেন এবং ‘নীহারিকা ‘ নামে একটি পত্রিকাও কিছুদিন সম্পাদনা করেন। অকালেই তিনি প্রয়াত হন।

৩১। কেতকী দত্ত ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিশির ভাদুড়ির ছোটোভাই তারাকুমার ভাদুড়ি ছিলেন বাবা এবং অবিস্মরণীয়া অভিনেত্রী প্রভাদেবী ছিলেন মা। কেতকী দত্ত নাচ-গান এবং অবশ্যই অভিনয়, সবেতেই অসম্ভব পটু ছিলেন। ‘শ্রীরঙ্গম’ তৈরির সময় প্রভা দেবী তাঁর মেয়েকে নিয়ে আসেন শিশিরকুমারের কাছে। ঐ ৮/৯ বছর বয়সেই ‘মায়া’ নাটকে অভিনয় প্রতিভার নমুনা রাখলেন কেতকী। এরপর ‘সিরাজদ্দৌল্লা’, ‘কামাল আতাতুর্ক’, ‘দুঃখীর ইমান’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘আত্মদর্শন’, ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ ইত্যাদি অজস্র নাটকে বিচ্ছুরিত হয়েছে কেতকী দত্ত-র অভিনয় দীপ্তি। এমনকি, প্রৌঢ় অবস্থায় গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চে যে অসামান্য একক-অভিনয়ের নৈপুন্য তিনি ‘কমল কামিনী’ নাটকে দেখিয়েছিলেন, তা ভোলা যায় না। ‘গরবিনী’, ‘যার যেথা ঘর’, ‘পঞ্চায়েত’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘হসপিটাল’, ‘হার মানা হার’ ইত্যাদি বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন কেতকী দত্ত। ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘নাগরিক’ ছবিতে অসামান্য অভিনয় করেন এই অভিনেত্রী। প্রসঙ্গত, অভিনেতা চপল ভাদুড়ি হলেন কেতকী দত্ত-র আপন ভাই। ২০০৩ সালে কেতকী দত্ত প্রয়াত হন।

৩২। নিরুপমা দেবীর রচনা অবলম্বনে দেবনারায়ণ গুপ্ত-র নাট্যরূপে শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্রের নির্দেশনায় ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর ‘স্টার’ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ‘শ্যামলী’ নাটক। এই নাটক অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এবং ৪৮৪ রজনী একটানা অভিনীত হয়ে শেষবারের জন্য মঞ্চস্থ হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ জানুয়ারি। এই নাটকে ‘অনিল’ চরিত্রে নায়কের ভূমিকায় সবকটি রজনীতে অভিনয় করেন উত্তমকুমার। নামভূমিকায় ‘বোবা’ মেয়ে ‘শ্যামলী’-র চরিত্রে রূপদান করেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া, এই নাটকে অভিনয় করেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সরযূবালা দেবী, রবি রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পীরা। এর আগে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় প্রশংসিত হওয়ায়, এই নাটকে তিনি সুযোগ পান এবং তাঁর মঞ্চাভিনয় অচিরেই দর্শককুল গ্রহণ করেন। সম্ভবত, এই একটিবারই উত্তমকুমার পেশাদার নাট্যমঞ্চে অভিনয় করেছিলেন।

৩৩। ১৯১৯ সালে কলিকাতায় দীপক মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দীপক মুখার্জির আসল নাম কানাইলাল মুখোপাধ্যায়। জ্যাঠতুতো ভাই পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাই দীপককে প্রথম নায়ক চরিত্রে সুযোগ দিলেন, তাঁর ‘পূর্বরাগ’, ছবিতে। এরপর ‘স্বপ্ন ও সাধনা’, ‘শাঁখা সিঁদুর’, ‘জ্যোতিষী না ৪২০’, ‘দাসীপুত্র’, ‘ওরে যাত্রী’, ‘হারানো সুর’, ইত্যাদি আরো কিছু ছবিতে দীপকবাবুকে দেখা গেছে। শুরু করেছিলেন নায়ক হিসেবে, শেষে ভিলেন হলেন। ‘শরৎ’ নামে একটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন। ১৯৫৪ সালে অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় রঙমহলে ‘উল্কা’ নাটকে প্রথম মঞ্চে নামেন। ‘অরুণাংশু’-র বীভৎস মেক-আপসহ প্রায় আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে অসাধারণ অভিনয় করেন ‘উল্কা’ নাটকে। এরপর, ১৯৫৬ সালে ‘শেষলগ্ন’ নাটকে শেষবারের জন্য মঞ্চে নামেন। অপেশাদার মঞ্চে ‘বৌবাজার ওল্ড ক্লাব’ প্রযোজিত ও নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকে ‘ভূতনাথ’ চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেন দীপক মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত, ৫০-এর দশকের শেষের দিকে অকাল প্রয়াত হন এই অভিনেতা।

৩৪। ‘রমা’ হচ্ছেন সুচিত্রা সেন। জন্ম ১৯২৯ সালে পাটনায় মামারবাড়িতে। আসল নাম ‘রমা’। ডাকনাম ‘কৃষ্ণা’। উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটিতে সুচিত্রা অভিনীত ছবিগুলি বাংলা তোলপাড় করে দিয়েছিল। আজও এর রেশ বর্তমান। সুচিত্রা সেন প্রথম বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবিতে অভিনয় করেন ১৯৫২ সালে। কিন্তু তা মুক্তি পায়না। যা ১৯৭৪ সালে কিছুটা অংশ নতুন করে অভিনয় করে কিছুটা পুরোনো অংশ রেখে ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ নামে মুক্তি পায়। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি সুকুমার দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘সাত নম্বর কয়েদী’ (১৯৫৩)। একই বছরে প্রথম ‘উত্তম-সুচিত্রা’ জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পায়। ১৯৫৪ সালে অগ্রদূত পরিচালিত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে এই জুটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। ‘শাপমোচন’, ‘সবার উপরে’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘ইন্দ্রাণী’ একের পর এক ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা জুটিতে রোম্যান্টিক সম্পর্কজাত গল্পসমৃদ্ধ চিত্ররূপ বাঙালি সমাজে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। অন্যান্য ছবির মধ্যে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ইত্যাদি ছবিতে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। অজয় কর পরিচালিত ‘সাতে পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’-র সম্মান পান। ‘মুসাফির’, ‘দেবদাস’, ‘বোম্বাই কা বাবু’, ‘মমতা’, ‘আঁধি’, ইত্যাদি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ১৯৫৯ সালে একটি রেকর্ডে দুখানি বাংলা গান গেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। গত শতকের ৫-এর দশকে একবারই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে বিষ্ণুপ্রিয়া চরিত্রে বেতার নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান পেয়েছেন। এই কিংবদন্তি নায়িকা ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবিতে অভিনয় করে, নিজেকে অন্তরালে নিয়ে চলে যান।

৩৫। প্রভা দেবী ( ১৯০৩-১৯৫২) ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের এক বিরাট মাপের অভিনেত্রী। মা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী থাকতেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী তিনকড়ির কাছে। ইনিই নৃত্যশিক্ষক ললিত গোস্বামীর কাছে ছোট্ট প্রভাকে নাচ শিখতে পাঠান। মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম এক বালকের চরিত্রে ‘জয়দেব’ নাটকে অভিনয় করেন। ম্যাডান কোম্পানির হয়ে সখির দলে নাচ ও গান করেন। ১৬ বছর বয়সে প্রথম ‘রত্নেশ্বরের মন্দির’ নাটকে বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে রূপদান করেন। এরপর ‘আলমগীর’ নাটকে প্রথম নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করেন। এরপর, নাট্যাচার্যের সঙ্গে একের পর এক নাটকে অভিনয়। ১৯৩০ সালে এই দলের সঙ্গে আমেরিকায় নাটক করতে যান। শিশিরবাবুর দল ছাড়াও অন্যান্য দলেও অভিনয় করেন। প্রভা দেবী শেষবারের মতো রঙমহলে ‘সেই তিমিরে’ (৬/১/১৯৫২) নাটকে মঞ্চে নামেন। ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মাতৃস্নেহ’ (১৯২৩), ‘পাপের পরিণাম’ (১৯২৪), ‘বিষবৃক্ষ’ (১৯২৮)- তিনটি নির্বাক ছবিতে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। এরপর, সবাক যুগের ‘পল্লীসমাজ’, ‘টকি অব টকিজ’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ছবিতে প্রভা দেবী অভিনয় করেন। তাঁর শেষ ছবি সম্ভবত ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘নাগরিক’, যা তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পায়। প্রভা দেবী গানও লিখেছেন। তাঁর লেখা একটি গানের সংকলন ‘গীতায়ন’, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। শিশিরবাবুর ভাই অভিনেতা তারাকুমার ভাদুড়িকে বিয়ে করেন প্রভা দেবী। প্রভা দেবীর সুযোগ্য পুত্র ও কন্যা যথাক্রমে অভিনেতা চপল ভাদুড়ি ও অভিনেত্রী কেতকী দত্ত।

৩৬। ১৯৪৯ সালের ৪ মার্চ পূর্ণশ্রী, প্রাচী, আলেয়াসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় নব্যেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কামনা’ ছবিটি। এই ছবিতেই প্রথম নায়ক হিসেবে অবতীর্ণ হন উত্তমকুমার। কয়েকজনকে দিয়ে পরীক্ষা করে, অবশেষে উত্তমকে নির্বাচিত করা হয়। উত্তমের আগে ছবিটিতে অধীর বিশ্বাস নামে এক অভিনেতা কিছুদিন নায়ক চরিত্রে স্যুটিং করেন। পরে, তাঁকে বাতিল করে উত্তমকুমারকে বাছা হয়। এই ছবিতে উত্তম তাঁর আসল ভালো নাম ‘অরুণকুমার’ নামে অভিনয় করেছিলেন। উত্তমের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ছবি রায়।

৩৭। উত্তমকুমার যে ছবিতে প্রথম নায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন, সেই ‘কামনা’ ছবিতে তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। বয়সে তিনি উত্তমকুমারের চেয়ে বড়ো থাকার সুবাদে, সারাজীবন তাঁকে ‘ছবিদি’ বলে ডাকতেন উত্তমবাবু। নিউ থিয়েটার্সের ‘মাই সিস্টার’ ছবিতেই প্রথম অভিনয় ছবি রায়ের। এরপর, ‘স্পর্শমণি’, ‘কামনা’, ‘ওগো শুনছো’, ‘মিথুন লগ্ন’, ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’, ‘সহযাত্রী’, ‘অপরাজিতা’, ‘পহেলা আদমি’, ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘রামের সুমতি’ ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেন ছবি রায়। জীবনে মাত্র একটি ছবিতে ছবি রায়ের সঙ্গে অভিনয় করলেও এবং নিজে একজন অত বড়ো স্টারে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও, উত্তমকুমার তাঁর ছবিদি’-র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছবি রায় প্রয়াত হন। ঘটনাচক্রে ছবি রায়ের প্রয়াণের দিনটি, উত্তমকুমারের জন্মদিনও বটে।

৩৮। প্রযোজক ও চিত্র-পরিচালক সরোজ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৪ সালে কলকাতায়। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এনার প্রথম ছবি ‘অলকানন্দা’ (প্রযোজক সরোজবাবু)। এরপর, ‘মনে ছিল আশা’, ‘শ্যামলীর স্বপ্ন’, ‘অভিমান’, ‘জিপসী মেয়ে’, ‘অপবাদ’, ‘অনুরাগ’, ‘মহিষাসুর বধ’, ‘না’, ‘জওয়ানি কি রাত’ (হিন্দি), ‘প্রশ্ন’ ইত্যাদি আরো কিছু ছবির পরিচালক ছিলেন সরোজবাবু।

৩৯। ‘প্রদীপবাবু’ হলেন একসময়ের প্রখ্যাত চিত্রাভিনেতা ‘প্রদীপকুমার’। পুরো নাম প্রদীপকুমার বটব্যাল। কন্দর্পকান্তি চেহারা ছিল এই অভিনেতার। আসল নাম ‘শীতল’। ১৯২৫ সালে কলকাতায় জন্ম। ১৯৪৭ সালে দেবকীকুমার বসু পরিচালিত ‘অলকানন্দা’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ, প্রযোজক ছিলেন সরোজ মুখোপাধ্যায়। মন্মথ রায়ের কাহিনিনির্ভর এই ছবির সংলাপ লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এরপর ‘৪২’, ‘ভুলি নাই’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘স্বামী’, ‘অপবাদ’, ‘স্পর্শমণি’ ইত্যাদি বাংলা ছবিতে অভিনয় করে, ১৯৪৯ সালে পরিচালক হেমেন গুপ্ত-র আহ্বানে মুম্বাই গিয়ে ‘ফিল্মিস্তান’ প্রযোজিত ‘ঝাঁসি কি রানী’ ছবিতে প্রথম হিন্দি ছবির জগতে প্রবেশ করেন প্রদীপকুমার। এরপর ‘আনন্দমঠ’, ‘আনারকলি’, ‘নাগিন’, ‘তাজমহল’, ‘এক ঝলক’, ইত্যাদি অসম্ভব জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করে হিন্দি ছবির জগতে আসন পাকা করে নেন। কলকাতায় এসে আবার ‘দস্যুমোহন’, ‘অভিশপ্ত চম্বল’, ‘গৃহদাহ’, ‘ত্রয়ী’, ইত্যাদি আরো কিছু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন প্রদীপকুমার।

৪০। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন ‘মায়ের প্রাণ’ নামে যে ছবিটি মুক্তি পায়, তার প্রযোজক সংস্থা হিসেবে দেখা গেল ‘এম. পি. প্রোডাকসন্স’ নামটি। মালিক মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। সংস্থার পুরো নাম ‘মায়ের প্রাণ’ (এম. পি) প্রোডাকসন্স’। প্রথম ছবিটির (উপরিল্লিখিত) নামও তাই। ছবিটির পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান ছিলেন প্রখ্যাত প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। নায়ক চরিত্রেও তিনি। মুরলীধরবাবু সাউথ সিঁথি রোডের মোড়ে স্টুডিওসহ প্রোডাকসন ইউনিটটিকে উন্নতমানে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯৪৮ সালে। এরপর, এম.পি-র প্রযোজনায় ‘আভিজাত্য’, ‘সঙ্কল্প’, ‘ইন্দ্রনাথ’, ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’, ‘সহযোগী’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘বাবলা’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বসু পরিবার’, ‘কার পাপে’, ‘বিদ্যাসাগর’ (হিন্দি), ইত্যাদি অজস্র ছবি মুক্তি পায়। উত্তম-সুচিত্রা-র ঐতিহাসিক জুটির শুরু এই সংস্থার দ্বারা প্রযোজিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকেই।

৪১। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দুই ভাই’ ছবিটি মুক্তি পায় ২০ অক্টোবর ১৯৬২ তারিখে। দুই সহোদর ভাইয়ের এক অদ্ভুত আন্তরিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছবি ফুটে উঠেছে, এই চলচ্চিত্রে। বড়োভাই উৎপল চরিত্রে রূপদান করেছিলেন উত্তমকুমার। তৎকালীন ছবিগুলিতে উত্তমকুমার বেশিরভাগক্ষেত্রে যেমন একধরনের রোম্যান্টিক নায়ক চরিত্রের ভূমিকা নিতেন, সেইদিক থেকে দেখলে, এই উৎপল চরিত্রটি অনেকটাই ব্যতিক্রমী। উৎপলের ভাই ‘কমল’ চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্বজিৎ। দুটি প্রধান নারী চরিত্রের অত্যন্ত সার্থক রূপ দেন যথাক্রমে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও সুলতা চৌধুরী। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন জীবেন বসু, তরুণকুমার, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ স্বনামধন্য অভিনেতারা। সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

৪২। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (১৯০৫-১৯৬৩) বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার ফুটিগোদা গ্রামে জন্মেছিলেন। এক বহুমুখী প্রতিভাধর ছিলেন- গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি অজস্র বিষয়ে লেখালিখি করেছিলেন। বিশেষ করে শিশু সাহিত্যে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণে-র অবদান চিরস্মরণীয়। সারা পৃথিবীর সেরা কাহিনির শিশুপোযোগী অসাধারণ বঙ্গানুবাদ করেছিলেন এই সাহিত্যিক। অত্যন্ত জনপ্রিয় অনেকগুলি চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গীতিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় সুনামের শিখর ছুঁয়েছিলেন বলা যায়। কলকাতা বেতার প্রতিষ্ঠানের আদি যুগ থেকে বেশ কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। ‘বিদ্যার্থীমণ্ডল’, ‘পল্লীমঙ্গল আসর’, ‘গল্পদাদুর আসর’ (‘দাদুমণি’ নামে) ইত্যাদি জনপ্রিয় বেতারানুষ্ঠান নানা সময়ে পরিচালনা করেছেন। ১৯৩৯ সালে পুরী থেকে প্রথমবার সরাসরি রথযাত্রার ধারাভাষ্য সম্প্রচারিত হয় কলকাতার বেতারে। ধারাভাষ্যকার ছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। ‘গল্পভারতী’ মাসিক-পত্রিকার প্রতিষ্ঠা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ‘মহীয়সী মহিলা’, ‘সান ইয়াৎ সেন’, ‘মা'(অনুবাদ), ‘সেক্সপিয়ারের কমেডি’, ‘সেক্সপিয়ারের ট্রাজেডি’, ‘নানাকথা’, ইত্যাদি আরো কিছু গ্রন্থের লেখক ছিলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ। ‘গীতগোবিন্দ’-র গদ্যানুবাদও করেছিলেন।

৪৩ ও ৪৪। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত প্রখ্যাত ‘সাজাহান’ নাটকের দুটি মুখ্য চরিত্র। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি একই শো-এ দুটি চরিত্রেই সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে অবিস্মরণীয় অভিনয় করতেন। শেষ দৃশ্যে যেখানে একবারই মাত্র ‘সাজাহান’ ও ‘ঔরঙ্গজীব’-এর দেখা হচ্ছে, সেখানে ডামি ব্যবহার করে অদ্ভুতভাবে দৃশ্যটিকে সাজাতেন শিশিরকুমার। সে যুগে এই প্রয়োগ পদ্ধতিগত দিক থেকে যথেষ্ট বিস্ময়কর।

৪৫ ও ৪৬। ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘আলমগীর’ নাটকের দুটি চরিত্র।

৪৭ ও ৪৮। ডাঃ জেকিল ও মিঃ হাইড হল রবার্ট লুই স্টিভেনসনের লেখা ‘THE STRANGE CASE OF DR. JACKIL & MR. HIDE’ গল্পের দুই মুখ্য চরিত্র। ডাঃ জেকিল একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন, যা খেলে মনের সুপ্ত খারাপ চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। এর ফলে, জেকিল অন্য মানুষ হয়ে মিঃ হাইডে পরিণত হতেন। এইসব নিয়েই এই গল্পটি গড়া হয়েছে। একটি মানুষের আমূল চারিত্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, এই চরিত্র দুটি দিয়ে উদাহরণ দেওয়ার রেওয়াজ তখন থেকেই চালু হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই গল্পের ভিত্তিতে তৈরি কাহিনিনির্ভর ছবি ‘বহ্নিশিখা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পীযূষ বসু পরিচালিত এই ছবিটিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তমকুমার।

৪৯। তুলসী চক্রবর্তী (১৮৯৯-১৯৬১) এক সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। অভিনয়ের পাশাপাশি গান, নাচ সবেতেই পারদর্শী ছিলেন। তুলসীবাবুর জ্যাঠামশাই পাবলিক থিয়েটারে অভিনয় করতেন। তাঁর জন্যে প্রতিদিন থিয়েটারে খাবার নিয়ে যেতে যেতে অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন তুলসী চক্রবর্তী। এরপর, সেই অল্পবয়সে ‘বোসেজ সার্কাস’ নামক এক সার্কাস দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশ ঘুরতে থাকেন। এরপর কলকাতায় ফিরে অন্যান্য কাজের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থেকে অবশেষে স্টার থিয়েটারে যোগ দেন। প্রথম অভিনয় করেন ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে। সেইসময় স্টারের নির্দেশক-প্রযোজক প্রখ্যাত অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে সারাজীবন গুরু মানতেন তুলসীবাবু। তাঁর শেষ মঞ্চাভিনয় স্টারে ‘শ্রেয়সী’ (১৯৬১) নাটকে। ১৯৩২ সালে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর পরিচালনায় ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ। এরপর ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সমাপিকা’, ‘ভুলি নাই’, ‘অঞ্জনগড়’, ‘শ্রীতুলসীদাস’, ‘সবার উপরে’, ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’, ‘পথের পাঁচালি’, ‘পরশপাথর’ ইত্যাদি অসংখ্য ছবিতে তাঁর অবিস্মরণীয় অভিনয়ের সাক্ষ্য রাখেন তুলসী চক্রবর্তী। বেতার নাটকেও বহুবার তুলসীবাবুর অভিনয় শোনা গেছে।

৫০। রোনাল্ড কোলম্যান (১৮৯১-১৯৫৮) ছিলেন হলিউড চলচ্চিত্রজগতের একজন স্টার। লন্ডন কলোসিয়াম-এ ১৯১৬ সালে প্রথম ‘মহারানি অফ আরাকান’ নাটকে অভিনয় করেন। এরপর ছবির জগতে এসে ‘দ্য ডার্ক অ্যাঞ্জেল’, ‘এ টেল অব টু সিটিজ’, ‘দ্য প্রিজনার অব জেন্ডা’ ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় ছবির নায়ক হিসেবে স্টার হয়ে ওঠেন। কলকাতায় অভিনেতাদের বিশেষ করে যারা নায়ক চরিত্রে অবতীর্ণ হতেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন কোলম্যান। ১৯৪৮ সালে ‘এ ডাবল লাইফ’ ছবির জন্য অভিনেতা হিসেবে ‘অস্কার’ পেয়েছিলেন রোনাল্ড কোলম্যান।

৫১। ধর্মতলার ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারদের অফিসগুলিকে বোঝানো হয়েছে। ছবি তৈরির পর তা দেখে, এরাই প্রযোজকের কাছ থেকে ছবির প্রিন্টটি কিনে নেন। জনপ্রিয়তার সম্ভাবনা অনুযায়ী ছবির দাম নির্ধারিত হয়। অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, সঙ্গীতকার, কাহিনিকার ইত্যাদি আরো নানা বিষয়কে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়।

৫২। পীযূষ বসু পরিচালিত ‘শিউলিবাড়ি’ ছবিটি শ্রী, ইন্দিরা, প্রাচীসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে ২৩/২/১৯৬২ তারিখে মুক্তি পায়। ছবিটির নায়ক-নায়িকা ছিলেন উত্তমকুমার ও অরুন্ধতী (দেবী)।

৫৩। রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা। যা অনেক প্রখ্যাত আবৃত্তিকারের কণ্ঠে স্মরণীয় হয়ে আছে।

৫৪। উত্তমকুমারের একমাত্র সন্তান পুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্ম। কয়েকবছর আগে প্রয়াত। গৌতমবাবুর অভিনয় জগতের সঙ্গে কোনো যোগ ছিল না। কিন্তু এনার পুত্র গৌরব চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এক সুপরিচিত অভিনেতা হয়ে উঠেছেন।

৫৫। ১৯৫৮ সালের ২১ নভেম্বর মিনার, বিজলী, ছবিঘরসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ‘সূর্যতোরণ’ ছবিটি। নায়ক ও নায়িকা ছিলেন যথাক্রমে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, এই ছবির গানগুলির গীতিকার ছাড়াও ছবিটির কাহিনিকারও ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

৫৬। উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলাসহ অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে ১৯৬০ সালের ২৮ এপ্রিল মুক্তি পায় রবীন্দ্রনাথের কাহিনিনির্ভর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ছবিটি। ছবিটিতে চাকর ‘রাইচরণ’-এর মতো একটি ব্যতিক্রমী চরিত্রে রূপদান করেন উত্তমকুমার। সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

৫৭। এম.পি. প্রোডাকসন্স (৩৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য) ছিল ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত উত্তমকুমার-ভারতী দেবী অভিনীত ‘সহযাত্রী’ (১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত) ছবিটির প্রযোজক। এই প্রযোজনা সংস্থার ম্যানেজার ছিলেন বিমলবাবু ওরফে বিমল ঘোষ। উক্ত ছবিতে অভিনয়ের বিষয়ে উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রথমে এই বিমল ঘোষেরই কথা হয়।

৫৮। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক বিভূতি লাহার জন্ম ১৯১৫ সালে। ১৯২২ সালে প্রথম চিত্রজগতে আসেন। ক্যামেরাম্যান হিসেবে প্রথম কাজ করেন ‘কচি-সংসদ’-এর চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে। ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে। ইনি শব্দযন্ত্রী যতীন দত্ত, ব্যবস্থাপক বিমল ঘোষ এবং রসায়নাগারিক শৈলেন ঘোষালের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী। এই সংস্থার প্রথম প্রযোজিত ছবি: ‘সঙ্কল্প’, প্রথম পরিচালিত ছবি: ‘স্বপ্ন ও সাধনা’। যতীন দত্ত ও বিমল ঘোষের পরপর প্রয়াত হওয়া আর শৈলেন ঘোষালের সরে যাওয়ার ফলে, বিভূতি লাহা একাই ‘অগ্রদূত’ নামে চিত্রপরিচালনার কাজ করতে থাকেন। ‘অগ্রদূত’ গোষ্ঠী উপহার দেয় একের পর এক জনপ্রিয় ছবি। উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত জনপ্রিয় ছবিগুলির মধ্যে বেশিরভাগই ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ছবি। এরমধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘ত্রিযামা’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘বিপাশা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, উত্তমকুমারসহ আরো অন্যান্য অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী অভিনীত বেশকিছু জনপ্রিয় ছবির পরিচালক ছিলেন ‘অগ্রদূত’ নামের আড়ালে বিভূতি লাহা।

৫৯। বীরেন্দ্রনাথ সরকার প্রতিষ্ঠিত একসময়ের বাংলার সর্ববৃহৎ ফিল্ম নির্মাণ-সংস্থা ছিল, ‘নিউ থিয়েটার্স’। ১৯৩০ সালে একটি বিশাল স্টুডিওসহ এই সংস্থার পত্তন করেন মি. বি.এন. সরকার। ‘চোরকাঁটা’ ও ‘চাষার মেয়ে’ নামে দুটি নির্বাক ছবির পর, এই সংস্থা নির্মিত প্রথম সবাক ছবি ‘দেনা পাওনা’ মুক্তি পায় ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এরপর ‘দেবদাস’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘মুক্তি’, ‘অধিকার’, ‘উদয়ের পথে’ ইত্যাদি বাংলা ছবি, আর, ‘দুশমন’, ‘ধরতি মাতা’, ‘মাই সিস্টার’, ‘যাত্রিক’ ইত্যাদি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করে, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন ফেলে দেয় এই সংস্থা। প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, কানন দেবী, কে. এল. সায়গল, নীতিন বসু, বিমল রায় ইত্যাদি উজ্জ্বল প্রতিভাকুল এসে জড়ো হয়েছিলেন এখানে। কয়েকদশক জুড়ে বাংলা ও হিন্দি ছবির জগতে রাজত্ব করে গেছে ‘হাতি’ মার্কা চিহ্নসংবলিত ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর ছবিগুলি।

৬০। মুরলীধর চট্টোপাধ্যায় (১৮৯৩-১৯৭৩) ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রজগতের এক উজ্জ্বল মানুষ। বহু অবদান ছিল তাঁর। যশোর জেলার কাশীপুর গ্রামে জন্ম মুরলীবাবুর। উত্তরপাড়া সরকারি ইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে আই.এ, ঢাকায় গিয়ে বি.এ ও এম.এ পাশ করেন। এরপর নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই ১৯১৯ সালে প্রখ্যাত চিত্র-নির্মাণ সংস্থা ম্যাডান কোম্পানিতে যোগ দেন। এই সংস্থার প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি ছিলেন মুরলীবাবুর মাসতুতো দাদা। ১২ বছর এখানে কাটানোর পর ‘রীতেন অ্যান্ড কোম্পানি’ হয়ে অবশেষে তৈরি করলেন প্রখ্যাত ‘এম.পি. প্রোডাকশন’ (৩৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)। এর মাঝে অবশ্য ‘কমলা টকীজ’ নামক প্রযোজক সংস্থা তৈরি করে, ‘রাজকুমারের নির্বাসন’ ও ‘স্বামী-স্ত্রী’ নামক দুটি ছবি করেন মুরলীবাবু। এরপর মূলত এনারই উদ্যোগে এবং মহারাজ প্রদ্যোতকুমার ঠাকুর, দাশরথী চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়নাথ গাঙ্গুলি প্রমুখের সহায়তায় পূর্বতন ‘কর্ণওয়ালিশ’ ও ‘ক্রাউন সিনেমা’ যথাক্রমে ‘শ্রী’ ও ‘উত্তরা’-য় পরিণত হয়। এছাড়াও, ‘পূরবী’, ‘উজ্জ্বলা’, ‘রূপম’ (বর্তমানে বিলুপ্ত), ‘নবরূপম’ (বর্তমানে বিলুপ্ত), ‘ওরিয়েন্ট’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র-প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নেন মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রজগতে ইনি একজন নমস্য মানুষ।

৬১। ভারতী দেবী (১৯২২-২০১১) ছিলেন ‘নিউ থিয়েটার্স’ যুগের এক বিশিষ্ট নায়িকা। পরে, দীর্ঘদিন এক শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে বিরাজ করেছেন। বাবা হরেকৃষ্ণ দাসের ব্যবসায় হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এলে, অর্থোপার্জনের চেষ্টায় মেয়ে ভারতী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কাশী হিন্দু বিদ্যালয়ের ব্যায়ামশিক্ষক মণি রায়ের সঙ্গে ভারতী দেবীর বিয়ে হয়। অচিরেই মনান্তরের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য ভারতী দেবীকে মুসলিম ধর্ম পর্যন্ত গ্রহণ করতে হয়। পরে আবার হিন্দু ধর্মে তিনি ফিরে আসেন। ভারতী দেবীর ছোটো থেকেই ব্যায়ামের কসরতের বিষয়ে আগ্রহ ছিল। ফলে, প্রখ্যাত ব্যায়ামবীর বিষ্ণু ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড় হয়। পরে, বিষ্ণুবাবুই তাঁকে ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ‘ডাক্তার’ (১৯৪০) ছবিতে প্রথম চিত্রাবতরণ ঘটে ভারতীর। প্রথম ছবিতেই বাজীমাত। এরপর, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘সৌগন্ধ’ (হিন্দি), ‘কাশীনাথ’, ‘ওয়াপস’ (হিন্দি), ‘চন্দ্রশেখর’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সমাপ্তি’ (হিন্দি), ‘বাগদাদ’ (হিন্দি), ‘নির্জন সৈকতে’, ‘আলো, ‘নায়ক’ ইত্যাদি অজস্র ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। মুম্বইয়ের কিছু হিন্দি ছবি, হাল আমলের টেলিভিশন-সিরিয়াল, বেতার-নাটক, সর্বত্র বিচরণ করেছেন। উত্তমকুমারের একেবারে প্রথম দিকের ছবি ‘সহযাত্রী’-র, তিনি ছিলেন নায়িকা। তপন সিংহের ‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ছায়া দেবী, রেণুকা রায় ও রুমা গুহঠাকুরতার সঙ্গে ভারতী দেবীও ভারতসেরা অভিনেত্রী হিসেবে সরকারি পুরস্কার পান। একসময়ে চলচ্চিত্রে নিজকণ্ঠে তাঁর গানও শোনা গেছে। চলচ্চিত্রজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অমর মল্লিকের সঙ্গে পরবর্তীকালে ভারতী দেবীর বিবাহ হয়।

৬২। ১৯৪০ সালের ৩১ অগস্ট ‘চিত্রা’ (বর্তমানে ‘মিত্রা’), ‘পূর্ণ’ ইত্যাদি আরো কিছু প্রেক্ষাগ্রহে মুক্তি পায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নির্ভর এবং ফণী মজুমদার পরিচালিত ‘ডাক্তার’ ছবিটি। পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত এই ছবির গান বাংলা মাতিয়ে দিয়েছিল। যার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল স্বয়ং পঙ্কজবাবুর কণ্ঠে এবং এ ছবির নায়কও ছিলেন তিনিই। এছাড়াও, পান্না দেবী, অহীন্দ্র চৌধুরি, জ্যোতিপ্রকাশ, ভারতী দেবী, ইন্দু মুখোপাধ্যায়, শৈলেন চৌধুরি, অমর মল্লিক, কমলা ঝরিয়া প্রমুখ আরো অনেকে অভিনয় করেন এই ছবিতে। প্রসঙ্গত, ‘ডাক্তার’ ছবির হিন্দি সংস্কারণটিও মুক্তি পায় ১৯৪২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘নিউ সিনেমা’ (বর্তমানে বিলুপ্ত) সহ আরো প্রেক্ষাগৃহে।

৬৩। ১৯৪১ সালের ১৪ অগস্ট ‘চিত্রা’ সহ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় বিনয় চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনিনির্ভর ও হেমচন্দ্র চন্দ্র পরিচালিত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবিটি। সংগীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল। এ ছবিতে অভিনয় করেন অসিতবরণ, ভারতী দেবী, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, জহর গাঙ্গুলি, বিনয় গোস্বামী, চন্দ্রাবতী দেবী, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা দেবী, তুলসী চক্রবর্তী, শৈলেন চৌধুরি ও আরো অনেকে। ‘ওয়াপস’ নামে এ ছবির হিন্দি সংস্করণটি মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালের ২৮ এপ্রিল ‘নিউ সিনেমা’, ‘ চিত্রা’, ‘রূপালী’ সহ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহে।

৬৪। ‘৫৮’ নং টীকা দ্রষ্টব্য।

৬৫। কলকাতার রাস্তায় একসময় ছোটো আকারের একধরনের ট্যাক্সি চলত। এতে মাত্র দু’জন সওয়ারি হতে পারতেন। খুব দ্রুতগামী ছিল এই ট্যাক্সি। ভাড়াও ছিল প্রচলিত বড়ো ট্যাক্সির চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম।

৬৬। স্বাধীনতার একবছর আগে ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। প্রায় একমাস এক নারকীয় হত্যালীলা চলতে থাকে। কলকাতার জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এর জের চলতেই থাকে এবং তা তীব্র আকার নিয়ে আবার শুরু হয় ১৯৪৭ সালের মে মাসে। মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৭-এর এই সময় দাঙ্গা থামানোর উদ্দেশ্যে এসে অবস্থান করেন কলকাতার বেলেঘাটায়। ১৯৪৬-এর শুরু হওয়া দাঙ্গার নৃশংস রূপ ‘The great Calcutta killing’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।

৬৭। ১৯৫২ সালের ১১ এপ্রিল এম.পি. প্রোডাকসন্সের ‘বসু পরিবার’ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটির পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। এই ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন উত্তমকুমার। প্রথম অভিনীত ছবি থেকে পরপর ৭ খানি ছবি মুখ থুবড়ে পড়ার পর, এই ‘বসু পরিবার’ ছবি থেকেই উত্তমকুমারের ভাগ্যের চাকা ঘোরে। প্রতিষ্ঠা পান চলচ্চিত্রজগতে। এ ছবির নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এবং একটি ছোটো চরিত্রে অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী।

৬৮। বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার শৈলেন রায় (১৯০৫-১৯৬৩) কুচবিহারে জন্মেছিলেন। কাজী নজরুলের সহায়তায় রেকর্ডের জন্যে গান লিখতে শুরু করেন। ১৯২৭ সালে কুচবিহারনিবাসী অসামান্য লোকসংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দিন রেকর্ডে গেয়েছিলেন, ‘স্মরণপারের ওগো প্রিয়…’ গানটি। এই গানটিই ছিল শৈলেন রায়ের লেখা প্রথম রেকর্ডস্থ গান। পরপর, কয়েকদশক জুড়ে নন-ফিল্ম ও ফিল্মের জগতে অসংখ্য অবিস্মরণীয় গানের বাণী রচনা করেছিলেন এই গীতিকার। ‘প্রেমের সমাধি তীরে…’, ‘রাতের ময়ূর ছড়ালো…’, ‘গানের সুরে জ্বালব তারার দীপগুলি…’ (স্বপ্ন ও সাধনা’), ‘মানুষের মনে ভোর হলো আজ…’ (সমাপিকা’), ‘তোমারই পথপানে চাহি…’ ইত্যাদি শৈলেন রায় রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য গান।

৬৯। বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক বিশিষ্ট ও ব্যতিক্রমী পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। যে ছবি থেকে উত্তমকুমারের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার শুরু, সেই ‘বসু পরিবার’ ছবির পরিচালক ছিলেন ইনিই। তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবী সহ আরো অনেকের অবিস্মরণীয় অভিনয়ে ভরা সর্বকালের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় হাসির ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩) ছবিটিরও পরিচালক ছিলেন নির্মল দে। প্রসঙ্গত, এই ছবি থেকেই উত্তম-সুচিত্রা জুটির যাত্রা শুরু। এছাড়াও, উত্তমকুমারের অসাধারণ অভিনয় সংবলিত এবং নিপুণভাবে পরিচালিত ‘চাঁপাডাঙার বউ’ (১৯৫৪) ছবিটিও নির্মল দে পরিচালনা করেন।

৭০। ১৯২০ সালে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রাভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের জন্ম। প্রখ্যাত ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের (ডি.জি.) ‘পুনর্জন্ম’ (১৯৩২) ছবিতে মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রথম চিত্রাবতরণ। কলেজে পড়ার সময় অনেক নাটক করেছেন। আবার চলচ্চিত্রে এসে হীতেন চৌধুরির ‘নৌকাডুবি’ ছবিতে বড়ো চরিত্রে নামলেন। এরপর, ‘দেবদূত’, ‘মায়ের ডাক’, ‘অশ্রু’, ‘বিষের ধোঁয়া’, ‘ভৈরব মন্ত্র’, ‘পরিত্রাণ’, ‘রত্নদীপ’ (হিন্দি), ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘অমানুষ’, ‘অনুসন্ধান’— দীর্ঘকাল ধরে নানা ছবিতে অভি ভট্টাচার্যকে দেখা গেছে। মুম্বই চিত্রজগতে পাকাপাকিভাবে গিয়ে স্থায়ী আসন পেয়েছিলেন এই অভিনেতা। অনেক জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে তাঁকে নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখা গেছে। বিশিষ্ট চিত্রাভিনেত্রী প্রণতি ঘোষকে বিবাহ করেন অভিবাবু। বেশ কয়েকবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন অভি ভট্টাচার্য।

৭১। বিশিষ্ট অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরির জন্ম ১৯৩৮ সালে বার্মায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পায়ে হেঁটে বার্মা থেকে ভারতে আসেন। নীরেন লাহিড়ি পরিচালিত ‘নাগপাশ’ ছবিতে (১৯৫০) নায়িকা চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর, উত্তমকুমারের বোনের চরিত্রে করেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। তারপর, ‘প্রার্থনা’, ‘মধুরাতি’ এই দুটি ছবিতে ঐ ১৯৫২ সালেই পরপর অভিনয় করেন সুপ্রিয়া দেবী। এর অনেকদিন পর ‘আম্রপালী’ ছবিতে এক সাহসী চরিত্রে নায়িকা হিসেবে ভালো মানের অভিনয়ের সাক্ষ্য রেখে অচিরেই চিত্রজগতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। এরপর, ‘স্বরলিপি’, ‘সোনার হরিণ’, ‘স্বয়ম্বরা’, ‘অগ্নিসংস্কার’, ‘জীবন মৃত্যু’ ইত্যাদি প্রায় ২০০-র বেশি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। আজও বেশকিছু ছবিসহ নানা টেলিভিশন-সিরিয়াল ইত্যাদি অনেক জায়গায় অভিনয় করে চলেছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয় অবিস্মরণীয়। উত্তমকুমারের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে সম্ভবত সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। সারাজীবন অনেক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। যার মধ্যে সদ্য পাওয়া ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানও আছে।

৭২। ১৯৩৭ (মতান্তরে ১৯৩৯) সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। দেশে থাকতেই গুরুর কাছে তালিমসহযোগে ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্যে দক্ষতা অর্জন করেন। অল্পবয়সে কলকাতায় চলে আসেন। প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় হাত ধরে নিয়ে এসে সাবিত্রীকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারে—‘নতুন ইহুদি’। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে সলিল সেনের এই নাটকটি মঞ্চস্থ করতেন ‘উত্তর ফাল্গুনি নাট্য সংস্থা’। এই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বিনু বর্ধনের। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে সুধীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সুপারহিট ছবি ‘পাশের বাড়ি’-তে নায়িকা হিসেবে সুযোগ মেলে সাবিত্রীর। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর, ‘বসু পরিবার’, ‘শুভদা’, ‘কাজরী’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘বালুচরী’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মৌচাক’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘ডাকহরকরা’, ‘ক্ষুধা’ ইত্যাদি অসংখ্য ছবিতে তাঁর সীমাহীন অভিনয়-নৈপূণ্য প্রদর্শন করেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আটপৌরে বাংলার দুখিনী নারী থেকে আরম্ভ করে, কমেডি অভিনয়—সমস্ত কিছু অনায়াসলব্ধ এই বরেণ্য অভিনেত্রীর। নাটক তিনি সারাজীবনে ভোলেননি। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ‘শ্যামলী’ (উত্তমকুমারের সঙ্গে সেই বিখ্যাত নাটক), ‘মল্লিকা’, ‘রাজকুমার’ ইত্যাদি অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে অনেকগুলি ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই জনপ্রিয় হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই অবিস্মরণীয়া অভিনেত্রীকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করেছেন। এছাড়া, ‘বি. এফ. জে. এ’-র তরফে কয়েকবার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

৭৩। মালা সিনহার জন্ম ১৯৩৬ সালে কলকাতায়। ছোটোবেলা থেকে নিষ্ঠাভরে সংগীতশিক্ষা করেন। গানই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের নেশায় পায় মালা সিনহাকে। ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রোশেনারা’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করলেন। এরপর, ‘যোগ বিয়োগ’। তারপর, ‘ঢুলি’ (১৯৫৪) ছবিতে জনপ্রিয়তার সন্ধান পেলেন। এরপর, একে একে ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘বিল্বমঙ্গল’, চিত্রাঙ্গদা’, ‘সাথীহারা’, ‘বন্ধু’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’, ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’, ‘কবিতা’ ইত্যাদি আরো বেশকিছু বাংলা ছবিতে দীর্ঘদিন ধরে মালা সিনহা অভিনয় করে গেছেন, যার মধ্যে উত্তমকুমারের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে অনেকগুলি ছবি আছে। এছাড়া, বাংলা থেকে মুম্বই গিয়ে এক প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে নিজেকে হিন্দি ছবির জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘বাদশাহ’ ছবি দিয়ে হিন্দি জগতে শুরু করে, ‘রিয়াসত’, ‘হ্যামলেট’, ‘পয়সা হি পয়সা’, ‘রঙিন রাতেঁ,’ ‘অপরাধী কৌন’, ‘চাহত’, ‘আনপড়’, ‘নাইট ইন লন্ডন’ ইত্যাদি সহ অনেক পরবর্তীকাল পর্যন্ত বহু হিন্দি ছবিতে মালা সিনহা দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। প্রসঙ্গত, চলচ্চিত্রে অভিনয়জগতে আসার আগে, কয়েকটি ছবিতে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে এবং বেতারেও গান করেছিলেন মালা সিনহা।

৭৪। পিনাকী মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঢুলি’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় ছবিটি। বিশেষ করে, এই ছবির গান মাতিয়ে দিয়েছিল সারা বাংলাকে। সংগীত পরিচালক রাজেন সরকারের অসামান্য সুররচনায় জন্ম নিয়েছিল বেশকিছু চিরকালীন জনপ্রিয় গান। ‘নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি…’ (প্রতিমা), ‘এই যমুনারি তীরে…’ (যূথিকা), ‘ভাঙনের তীরে…’ (ধনঞ্জয়), ‘ত্রিনয়নী দুর্গা…’ (ধনঞ্জয়) ইত্যাদি গান, আমাদের মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। প্রশান্তকুমার, সুচিত্রা সেন, মালা সিনহা ও আরো বরেণ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল ‘ঢুলি’ ছবিটি।

৭৫। এখন যেখানে বিডন স্ট্রিট ও চিত্তরঞ্জন এভিন্যু (পূর্বতন সেন্ট্রাল এভিন্যু) মিশেছে, সেখানে ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘স্টার থিয়েটার’ (৬৮,বিডন স্ট্রিট)। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র ইত্যাদি আরো কয়েকজনের উদ্যোগে তৎকালীন কলকাতার এক ধনী বাবু গুর্মুখ রায় মুসাদ্দি নিজ অর্থ ব্যয়ে এই থিয়েটার তৈরি করেন। কিন্তু, সংগীত-নৃত্য-অভিনয়ে পটিয়সী প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিনোদিনী দাসীর নিজেকে গুর্মুখের হাতে সঁপে দেবার শর্তে রাজি না হলে, এ থিয়েটার তৈরিই হত না। শুধু তাই নয়, বিনোদিনীর নাম অনুযায়ী, এই থিয়েটারের নাম ‘বি-থিয়েটার’ হওয়ার কথা প্রথমে হলেও, পরে তা হল ‘স্টার থিয়েটার’। তাও বিনোদিনীকে মেনে নিতে হয়। গিরিশচন্দ্র-র ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটক দিয়ে থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এরপর, অনেক নাটক চলার পর, ১৮৮৮ সালে এই থিয়েটার উঠে আসে, হাতিবাগানের মোড়ে। উত্তমকুমার এই মঞ্চেই ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে একটানা ৪৮৪ রাত্রি অভিনয় করেন, ‘শ্যামলী’ নাটকে। ১৯৯১ সালের ১৩ অক্টোবর মাঝরাতে, এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ‘স্টার থিয়েটার’-এর বেশিরভাগ অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরবর্তীকালে, কলকাতা পৌর প্রতিষ্ঠান, এই থিয়েটারকে নতুন করে তৈরি করলেও, আজ এটি প্রধানত মূলত চলচ্চিত্র-প্রেক্ষাগৃহে পরিণত হয়েছে।

৭৬। সাহিত্যিক নিরুপমা দেবী (১৮৮৩—১৯৫১) বহরমপুরে জন্মান এবং তাঁর বাল্যজীবন কাটে বিহারের ভাগলপুরে। তাঁর অকালবৈধব্যের পর দাদা বিভূতিভূষণ ভট্ট ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় এঁদেরই পরিচালিত হাতে লেখা পত্রিকায় সাহিত্যকর্ম শুরু করেন নিরুপমা দেবী। এনার রচিত প্রথম উপন্যাস ‘উচ্ছৃঙ্খল’। স্বদেশি যুগে বেশ কিছু গানও লেখেন। ১৩১৯-২০ সালে, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় নিরূপমা দেবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দিদি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এনাকে ‘ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক’ প্রদান করেন। এছাড়াও, নিরুপমা দেবী আরো কিছু সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। নিরুপমা দেবীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল—‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘দেবত্র’, ‘শ্যামলী’, ‘বন্ধু’, ‘বিধিলিপি’, ‘অনুকর্ষ’ ইত্যাদি। এই সাহিত্যিকের বহু রচনা চিত্রায়িত ও মঞ্চায়িত হয়েছে।

৭৭। প্রখ্যাত অভিনেতা রবি রায়ের (১৮৯৫—১৯৫৬) পুরো নাম রবীন্দ্রমোহন রায়। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি এনাকে অভিনয়জগতে নিয়ে আসেন। ১৯২২ সালে একইদিনে দুটি নির্বাক ছবি যথাক্রমে ‘কমলে কামিনী’ ও ‘আলমগীর’-এ অভিনয় করেন। সেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ থেকে পরবর্তীকালের ‘শ্যামলী’—এক দীর্ঘসময় ধরে থিয়েটার-মঞ্চ সমৃদ্ধ হয়েছে রবি রায়ের অভিনয়ে। ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, ‘রজনী’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, ‘হরিভক্তি’ (হিন্দি) ইত্যাদি বেশকিছু ছবিতেও অভিনয় করেন। প্রখ্যাত অভিনেতা ভূমেন রায়ের আপন দাদা ছিলেন রবি রায়।

৭৮। বিশিষ্ট নাট্যকার ও পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত-র জন্ম ১৯১০ সালে। নাট্যজগতে আসার আগে, ‘ভাণ্ডার’, ‘ভারতবর্ষ’ ইত্যাদি অনেক নামী পত্র-পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একটানা ২৩ বছর স্টার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন নাট্যরূপ তেমনি মৌলিক নাটকরচনা এবং নাট্য পরিচালনা— সবকিছুতেই নিজের প্রতিভাকে চিনিয়েছেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ‘শ্যামলী’, ‘শর্মিলা’, ‘প্রেয়সী’, ‘সীমা’ ইত্যাদি এরকমই কিছু নাটক। চলচ্চিত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রেও দেবনারায়ণ গুপ্তকে দেখা গেছে।

৭৯। সরযূবালা দেবী (১৯১৩-১৯৯৪) ছিলেন ‘নাট্যসম্রাজ্ঞী’। ১৯২৮ সালে মঞ্চজগতে এসে দীর্ঘ ৬০ বছর এখানে রাজত্ব করেছেন। বাণীবিনোদ নির্মলেন্দু লাহিড়ির সংস্পর্শে আসার পর তাঁর অভিনয়প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এছাড়া, শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গেও অভিনয় করেন। মনমোহন থিয়েটারে এক রাত্তিরের জন্যে ‘মীরাবাঈ’ নাটকে কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেও, ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে ‘কুন্দনন্দিনী’-র ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমেই যথাযথভাবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে তাঁর যাত্রা শুরু করেন, সরযূবালা দেবী। ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’—এরকম অজস্র নাটকে অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। নির্বাক ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ থেকে আরম্ভ করে সবাক যুগের ‘শাপমুক্তি’, ‘শ্রীদুর্গা’, ‘দাসীপুত্র’, ‘যার যেথা ঘর’ ইত্যাদি বেশকিছু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন। প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা জহর রায়ের সঙ্গে অন্যতম সত্ত্বাধিকারী হিসেবে দীর্ঘকাল ‘রঙমহল’ থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সরযূবালা দেবী। এবছর, এনার জন্মশতবর্ষ।

৮০। পাঁচের দশকে প্রথম জীবনে পুলিশ ও পরে অভিনয়—এই দুটি ভিন্নধর্মী জীবনের স্মৃতিকথা যথাক্রমে, ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ এই শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য। যা প্রকাশিত হতো ‘দেশ’ পত্রিকায়’। পরে, দুটি রচনাই পৃথকভাবে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে, এর নতুন সংস্করণও প্রকাশিত হয়। একইভাবে, ‘নটসূর্য’ অহীন্দ্র চৌধুরি তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন। ‘নিজেরে হারায়ে খুঁজি’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে, এই রচনাটি প্রকাশিত হত, ‘অমৃত’ পত্রিকায়। পরে, দু’খণ্ড বই আকারেপ্রকাশ পায়। বিশাল আকারের এই আত্মজীবনীটিকে একটি সময়ের দলিল বলা যায়। বর্তমানে, এটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *