হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর – ১০

১০

যে কখনও চিনি খায়নি তাকে যেমন মিষ্টির স্বাদ বোঝানো যায় না, তেমনি যে কখনও প্রেম করেনি তাকে, প্রেমে পড়লে মানুষের মনে যে কী অনুভৃতি হয়, তাও বোঝানো যায়না।

রোম্যান্টিক ‘হিরো’ বলে আমার একটা নাম আছে। অনেকে খুশিও হয়েছেন আমার সে অভিনয় দেখে। কারণ আমি তাঁদের কাছে প্রশংসাপত্র পেয়েছি এবং ‘বাহবা’ ধ্বনি শুনেছি।

নানাধরনের রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখেছি বাংলা ছবির নায়ককে যেন সবসময় বোকা বোকা হয়ে থাকতে হয়। তার সাজগোজটা হবে careful অথচ careless, অর্থাৎ সব ব্যাপারটাই সে বোঝে অথচ উদাসীন। তারপরে এই ধরনের চরিত্রগুলোতে বেশিরভাগ সময় দেখতে পাওয়া যায় নায়কের বাবার থাকে প্রচুর টাকা। সে একটা ক্রাইসলার গাড়ি বা ওই জাতীয় কিছুতে চড়ে বেড়াচ্ছে।

নায়িকা তার জন্যে জানলায় অপেক্ষা করছে। কিংবা ডিনারে, পার্টিতে তাদের প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম হল। অথবা প্রেম হবার পর নায়িকা রয়েছেন ঘরের মধ্যে বন্দী। নায়কের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ অনেকদিন নেই। মন অত্যন্ত খারাপ নায়কের জন্যে। সেকেন্ড ‘হিরো’ বা ‘ভিলেন’ নায়িকার সঙ্গে বিয়ে একরকম পাকাপাকি করে ফেলেছে—এমনি সময় বসন্তের কোকিলের ডাকের মতন রেডিওতে ভেসে এল নায়কের কণ্ঠস্বর। নায়িকা বুঝল নায়ক বেঁচে আছে। উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে ‘ভিলেন’কে তখন প্রত্যাখ্যান করল। বলল—‘এ বিয়ে আমি করব না’, কিংবা মোটর নিয়ে ছুটল নায়ককে ধরবার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু আমার জীবনের ঘটনা, ঠিক এপথে চলেনি। ‘ক্রাইসলার’ গাড়ি তো দূরে থাক, সামান্য বাস-ট্রামেই ঘুরে বেড়াতাম। সামান্য কেরানি আমি অথচ প্রাণে শখ অনেক। প্রেম করলাম তো করলাম—ওই অবস্থাপন্ন মেয়ের সঙ্গে! এখন আমার উপায়?

বাড়িতে গৌরী বন্দী। সে-ই আবার আমাকে চিঠি লিখল তার সমস্ত কথা জানিয়ে। বর্তমানে ‘অ্যাটম বম্ব’ কিংবা ‘হাইড্রোজেন বম্ব’ কী তা দেখিনি, কিন্তু আমার মনে হল এই চিঠি তার চেয়েও ভীষণ সাংঘাতিক।

এর কিছুদিন আগে গত মহাযুদ্ধের শেষে ‘হিরোসিমা’ আর ‘নাগাসাকি’র ওপর ‘অ্যাটম বম্ব’ পড়েছিল। কাগজে পড়েছিলাম শহর দুটোই নাকি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তাছাড়া আরও অনেক কথা।

চিঠিটা পেয়ে আমারও তেমনি অবস্থা হল, কিছুই ভালো লাগে না।

কিন্তু ভালো লাগে না বললে সংসার ছাড়বে কেন? ন’টার পর মুখ ভার করে অফিস যেতে হত বৈকি। খেলাধুলা, যাত্রা, থিয়েটার সবই একরকম বন্ধ করে দিলাম। বন্ধুরা ডাকতে এলে বলতাম—ভালো লাগে না ভাই।

ভালো তো লাগে না, করিটা কী? কেবল নিজের ঘরে বসে বসে গৌরীকে চিন্তা করছি। শুনেছি শিবকে পাবার জন্যে গৌরী নাকি তপস্যা করেছিলেন বরফের মতো ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে।

এ যুগে আমার গৌরী কী করেছিল জানি না, আমি প্রায় ‘তপস্যা’র মতো করে ফেলেছিলাম আর কি! দিনরাত কেবল একই চিন্তা—কী হবে, কী হবে!

মা’কে রাজি করানো শক্ত নয়। মা মত দিলে বাবাও মত দেবেন এ বিয়েতে। কিন্তু গৌরীর বাড়িতে? শুধু তখন আমার শ্বশুরমশাই একা নন, তাঁরও পিতা অর্থাৎ আমার দাদাশ্বশুর নগেন গাঙ্গুলি মহাশয় তখনও জীবিত। তিনি যখন শুনবেন আমি ফিল্ম করি, তার ওপর অফিসেও একটা সামান্য চাকরি করি, তখন তিনি কি এ বিয়েতে রাজী হবেন? তাঁর আদরের ছোটো নাতনিকে কিছুতেই আমার মতো পাত্রের হাতে সঁপে দেবেন না।

মনে মনে চিন্তা করতাম, সাহসে ভর করে আমি একদিন চলে গেছি গৌরীদের বাড়িতে, সকলের সামনে বুক চিতিয়ে বলছি, গৌরীকে আমার চাই, নইলে আমার জীবন একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ঠিক সেইসময়ে মনে হত, ওদের বাড়ির দারোয়ানদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে একা বসে আমার ঘণ্টা দু’তিন ধরে ভাবনার গতিটা যেন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে অন্য দিকে চলে যেত। ভাবতাম—যদি ওরা অপমান করে? যদি ওরা আমার কথা না শোনে? তাহলে?

অপমানটা আমার তো কেবল একার হবে না! হবে আমার বাবা, মা, সকলকার। তাহলে? না না, এ কাজ আমি কখনও করতে পারব না। নিজের জন্য কোনোদিন ভাবি না, ভাবতে চাই-ও না। কিন্তু আমি এমন কাজ করতে পারি না যাতে আমার মা-বাবার অপমান হয়। এজন্যে যদি গৌরীকে আমি না-ও পাই সেও ভালো। মৃত্যু অবধি যদি তার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়, তাও করব। প্রাণ থাকতে আমি এ কাজ করতে পারব না।

আবার সেই একটানা হতাশা। একঘেয়ে জিজ্ঞাসা—কী হবে, আর কী হবে!

বন্ধুবান্ধব কাউকে একথা বলতে পারি না, কারণ কে কোন চোখে দেখবে কে জানে! বুদ্ধি দেওয়া দূরে থাক, হয়তো ঠাট্টা করে আমাকে পাগল করবে। আমি খারাপ হতে পারি, কিন্তু আমার প্রেম আমার ভালোবাসা—এত খারাপ নয়! আমার মনের এই পবিত্র জিনিসকে নিয়ে কেউ যে ঠাট্টা করবে তা আমার সহ্য হবে না। তাহলে এমন কী উপায় করা যায়? অথচ সন্ন্যাসী তো বলেছেন, ‘ওকে’ আমি পাবই।

প্রথম দিনকতক তো গেল এইভাবে। ভগবানকে যে কোনোদিন খুব একটা বিশ্বাস করতাম তা নয়। কিন্তু ব্রাহ্মণের ছেলে, একটা সংস্কার তো ছিল। আর কিছু না হোক গলায় উপবীত তো আছে। তাই সকাল সন্ধ্যায় যখনই কোনো দেব বা দেবীর মন্দিরের সামনে দিয়ে যাই, অমনি তাঁকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম জানাই। বলি—‘ভগবান, একটা ব্যবস্থা করো’। সে তীব্র অনুভূতি লিখে বোঝানো যায় না। হয়তো মুখে বললেও লোকে আমাকে পাগল আখ্যা দেবে। তবুও বিশ্বাস করুন, সেই তুষের জ্বালা আমি অহোরাত্র সহ্য করেছি! তখন রেকর্ডে গাওয়া কানন দেবীর একটা গান কেবলই মনে পড়তো। গানটি হল—

‘সখি! কে বলে পিরিতি ভালো। হাসিতে হাসিতে পিরিতি করিয়া কাঁদিতে জনম গেল।’

কারোর সামনে কাঁদিনি বটে, কিন্তু কাঁদতে বাকি ছিল কতটুকু? যত দিন যায় তত মনের জ্বালা যেন তীব্র হয়ে ওঠে। তীব্রভাবে সে যেন আমাকে পোড়াতে চায়। ভেতরটা তখন সত্যিই আমার তুষের আগুনের মতো জ্বলে যাচ্ছিল। খেতে ভালো লাগে না, রাত্রে চোখে ঘুম আসে না। দিনের বেলায় ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে যখন সামান্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়তাম তখন দেখতাম কত মজার স্বপ্ন। কখনও দেখতাম গৌরী আমার কাছে এসেছে, কখনওবা দেখতাম ও যেন কোথায় চলে যাচ্ছে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওর নাগাল পাচ্ছিনা।

বেশিরভাগ, রাত্রেই এ সমস্ত স্বপ্ন দেখার পর ঘুম ভেঙে যেত। তারপর সারারাত জেগে কাটাতে হত। সে কল্পনাও যেন অপূর্ব সুখের তীব্র অনুভূতি দিয়ে যেত। কিন্তু তারপর?

রাত্রির পরে ভোর হলেই আবার সেই একটানা হতাশা।

আমার এইরকম অবস্থা মা’র চোখ এড়ায়নি। তিনি একদিন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন—‘হ্যাঁরে খোকা, তোর কী হয়েছে রে? ভালো করে খাস না, রাত্রেও লক্ষ করেছি, খুব ভালো করে ঘুমোতে পারিস না, ছটফট করে কেবল দরজা খুলে বের হোস। কী হয়েছে বল তো?’

বুঝলাম মা’র কাছে ধরা পড়ে গেছি। তবুও প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলি—‘নাঃ কিছু তো হয়নি!’

মা বলেন—‘না হলেই ভালো।’

দিন পনেরো এইভাবে কাটাবার পর হঠাৎ একদিন অফিস থেকে বাড়ি এসে শুনলাম গৌরী এসেছে আমাদের বাড়ি। বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল। কান মাথা যেন গরম হয়ে উঠল। সমস্ত পৃথিবীর শব্দ যেন কেবল একসুরে বলে উঠল—‘ওরে পাগল চেয়ে দেখ, গৌরী এসেছে।’

১১

আমার জীবনে তখন নেমে এসেছে হতাশা। একদিকে গৌরী, অপর দিকে ফিল্ম। গৌরীর কাহিনি আগেই বলেছি। অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই সেজন্যে হতাশাও কমেনি।

অপরদিকে ‘দৃষ্টিদান’-এর হবু নায়কের চরিত্রে অভিনয় করার পর আর কোনো নতুন সুযোগ আমার জীবনে তখনও আসেনি।

অথচ ফিল্মে অভিনয় করবার আশা আমার দুরন্ত।

এইরকম সময় যখন মনের দোলায় আমি দুলছি, তখন হঠাৎ একদিন বড়োমামা এসে আমাকে বললেন—‘কী রে, কোথায় যাচ্ছিস?’

আমি বলি—‘ন’টা বেজে গেছে, অফিসে।’

আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বড়োমামা বললেন—‘পরের গোলামি আর কতদিন করবি?’

এইখানে বলে রাখা ভালো আমার বড়োমামা জ্যোতিষ নিয়ে চর্চা করেন। তাই ভাগ্নের কুষ্ঠীও তিনি মা’র কাছ থেকে আগেই চেয়ে নিয়ে বিচার করেছেন।

আমি সন্ন্যাসীর কথার খানিকটা প্রতিধ্বনি তাঁর মুখ থেকে শুনে জিজ্ঞেস করলাম—‘কী করব বড়োমামা যদি চাকরি ছেড়ে দিই?’

বড়োমামা বলেন—‘তুই শিল্পী!’

মনটা আশায়, আনন্দে দুলে উঠল। শিল্পী! তবুও ঠাট্টা করে বলি—‘আমি তো ছবি আঁকি না।’

বড়োমামা আমার উপহাসটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন। তাই একটু গুরুগম্ভীর চালে বললেন—‘যতসব জ্যাঠা ছেলে!’

খোঁচালে ফল আর ভালো হবে না। ওদিকে আমার অফিস যেতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে—তাই জামাটা গায়ে ফেলে দিয়েঅফিসে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি নাকেমুখে গুঁজে আবার সেই বাস ধরা, অফিস, সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফেরা। সেই একঘেয়ে জীবন, এতে নেই কোনো পরিবর্তন, নেই কোনো আকর্ষণ।

কিন্তু পরের দিন সকালবেলায় সত্যিই আমাকে বিস্মিত হতে হল, যখন বুড়ো (বর্তমানে তরুণকুমার) এসে আমায় খবর দিল, বাবার বসবার ঘরে আমার ডাক পড়েছে।

চোরের মন সদাসর্বদা যেমন বোঁচকার দিকে থাকে, তেমনি আমারও হঠাৎ বাবা ডাকছেন শুনে মনে হল, আমার লুকিয়ে প্রেম করার কথা বাবা কি জেনে ফেলেছেন নাকি?

সর্বনাশ! যদি তাঁর কানে ওঠে তবে কী জবাব দেব? মিথ্যে কথা বলব? কখনও তো বাবার কাছে মিথ্যে কথা বলিনি। তার ওপর এক্ষেত্রে যদি এখন মিথ্যে কথা বলি, পরে সত্যি কথা বলবার সুযোগও পাবোনা। তখন উপায়?

বুড়ো তাড়া মেরে বলে—‘দাদা, কী ভাবছ এতো, বাবা ডাকছে না!’

একটু খোশামোদ করেই তাকে জিজ্ঞেস করি—‘কেন বাবা ডাকছে রে?’

বুড়ো উত্তরে বলে—‘তা তো জানি না, একজন কে লোক এসেছে তাই তোমায় ডাকছে।’

সর্বনাশ! গৌরীদের বাড়ির কেউ আসেনি তো! যদি এসে থাকে তাহলে উপায়?

আমার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে বুড়োকে বলি—‘লোকটা কে রে?’

বুড়ো বলে—‘গিয়েই দেখোনা, আমি কী জানি!’

সে তো বলেই খালাস। কথা শেষ করে বুড়ো ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

কিন্তু আমি তো অত সহজে খালাস হতে পারলাম না। ভাবলাম একবার—বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব! কিন্তু সেখানে ভয় আছে, বুড়ো আমায় দেখে গেছে ঘরে, বাবাকে এক্ষুনি গিয়ে বলে দেবে। তাতে ফল ভালো হবে না। তাই ভগবানের নাম স্মরণ করে কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার বসবার ঘরের দিকে।

গিয়ে দেখলাম, এতক্ষণ যা ভেবে এসেছি তা মোটেই নয়। গৌরীদের বাড়ি থেকে বাবার কাছে আমার নামে নালিশ করতে কেউ আসেননি। তার বদলে সেখানে বসে রয়েছেন বাবারই বাল্যবন্ধু পুলিনবাবু।

বাবা আমাকে দেখেই বললেন—‘এই যে খোকা, পুলিন তোমায় অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।’

আমি তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি।

পুলিনবাবু বললেন—‘আমি একটা ছবি করছি। নামবে আমার ছবিতে?’

ছবি! ভেতরের হিম রক্তটা হঠাৎ যেন উষ্ণ হয়ে উঠল।

আমি বলি—‘কী ছবি করছেন?’

পুলিনবাবু বলেন—‘ওরে যাত্রী’ বলে একটা ছবি তুলব ভাবছি।

—‘আমাকে কী করতে হবে?’

—‘তোমাকে?’—আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করে নিয়ে তিনি বলেন—‘সেকেন্ড হিরোর পার্ট।’

যাক, এবারে আর হবু নায়কের পার্ট নয়, একেবারে উপনায়কের পার্ট। দর্শকদের কিছু দেখাবার মতন একটা সুযোগ হয়তো এবার পাব। ‘উপ’ শব্দটার মধ্যে বোধহয় একটা মাধুর্য আছে। কারণ এই ‘উপ’দের নিয়েই শুনেছি রচিত হয়েছে বহু কাব্য। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একজায়গায় বলেছেন—ভগবানকে ভালোবাসতে হবে ওই উপস্ত্রীর মতো বা উপপতির মতো। তাই সেকেন্ড হিরো বা উপনায়কের পার্টের কথা শুনে আশায় আর আনন্দে আমার মন দুলে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করি—‘কবে থেকে আমাকে যেতে হবে?’

পুলিনবাবু বলেন—‘তাহলে তুমি রাজি?’

রাজি! মনে মনেই ভাবি। শোনামাত্রই আমি যে প্রস্তুত। সেই যে কথায় আছে না—‘ভাত খাবি আয়, না হাত ধোবো কোথা’। আমারও মনের অবস্থা তখন ঠিক তাই।

মনে মনে বেশ একটু রাগ হল। দূর ছাই! আমার চেহারাটা যদি আর একটু মোটা হত, তাহলে পুলিনবাবুকে ধরে করে হিরোর চান্সটা আমিই হয়তো পেতাম। কিন্তু উপস্থিত তা তো হবার উপায় নেই।

যাক, যা পাওয়া যাচ্ছে, ঠিকমতো বলতে গেলে ভাগ্যে যা জুটছে তাকে অবহেলা করা উচিত নয়।

অনেকক্ষণ চুপ করে আছি। আমি কথা বলছি না বলে তিনিও বিশেষ কথা বলছেন না, তাই নীরবতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলাম—‘ছবিটা পরিচালনা করবেন কে?’

পুলিনবাবু বলেন—‘রাজেন চৌধুরী’।

একটু আমতা আমতা করে বলি—‘নায়কের পার্ট করবেন কে?’

—‘দীপক মুখার্জি৩৩। তুমি বোধহয় তার অভিনয় দেখেছ।’

—‘দীপকবাবুর অভিনয়’,—আমি বলি—‘হ্যাঁ দেখেছি’।

আমার কৌতূহল দেখে বোধহয় পুলিনবাবু আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন—‘হিরোর পার্ট করতে পারলে বড়ো খুশি হতে, না?’

আমি সুযোগ পেয়ে বলি—‘আজ্ঞে! আমি কী পারব?’

আমাকে একরকম আশ্বাস দিয়েই তিনি বলেন—‘দেখো, বই যদি ভালো চলে, তাহলে আমার next ছবিটায় তোমাকে হিরো করতে আর আপত্তি থাকবে না। অবশ্য যদি তোমাকে দর্শক নেয়।’

সেদিন প্রবীন প্রযোজকের মুখে যে-কথা শুনেছিলাম সে কথার অর্থ বুঝতে পারিনি তখন। ভেবেছিলাম পুলিনবাবু ইচ্ছা করলেই তো আমাকে একটা চান্স দিতে পারেন। দর্শকের নেওয়া বা না নেওয়া—সে তো প্রযোজক আর পরিচালকের হাতে। সে কথার অর্থ বুঝলাম আরও কিছুদিন পর।

যাক, সময়মতো সেকথা বলব।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে পুলিনবাবু বলেন—‘তুমি একদিন এসো আমার ধর্মতলার অফিসে, চুক্তিপত্রটা সেইখানেই সই করে দিও। আর দেখো, আমি তোমায় এমনিতে খাটাব না, পারিশ্রমিক কিছু দেব।

বাবা বলেন—‘ছেলেটার বড়ো শখ ফিল্মে নামবার। দেখো শিখিয়ে পড়িয়ে যদি নিতে পারো। তারপরে ওর ভাগ্য।’

আমি বলি—‘কবে যাব, কালই যাব?’

পুলিনবাবু কী একটা ভেবে নিয়ে বলেন—‘বেশ, কালই এসো আমার ধর্মতলার অফিসে, সেইখানেই কথাবার্তা হবে। আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পারো।’

যেতে আমার মোটেই ইচ্ছা ছিল না সে জায়গা ছেড়ে, তবু আমাকে যেতে হল ভদ্রতার খাতিরে। মনের মধ্যে তখন আর হতাশা নেই, সব মনটা জুড়েই তখন উঠেছে আর একটা রঙিন স্বপ্ন।

পরের দিন চুক্তিপত্র সই হয়ে গেল যথানিয়মে।

পুলিনবাবু আমাকে বললেন—‘এই ছবিটার জন্যে তোমাকে আমি ৭০০ টাকা দিতে পারি। কেমন, রাজি?’

রাজি! এর আগের ছবি দৃষ্টিদানে পেয়েছি মাত্র ১৩০ টাকা। তার ওপর উপনায়কের পার্ট। এ কি আমি ছাড়তে পারি! যাইহোক, কিছু না দিলেও আমি করতে প্রস্তুত। টাকা যেটা আমায় নিতে হয় সেটা আমার নিজের জন্য নয়, মা আর বাবার কিছুটা সুখ-সুবিধা করে দিতে পারব বলে।

মাকে দেখেছি, সংসারের জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন। আমি তাঁর ছেলে হয়েও তাঁর সে কষ্ট এখনও ঘোচাতে পারিনি। তাই এই টাকা নেওয়ার প্রশ্ন।

চাকরি যা করি তাতে কি আর হয়। সেকথা আমিও বুঝি। সংসারের জন্যে চাই আমার টাকা। আমার ছোটো দুটি ভাই তখনও নাবালক।

যাক সেসব কথা।

চুক্তিপত্রে সই করার পরেই মনে প্রশ্ন উঠল, এখন স্যুটিং-এর দিনে কী করে স্টুডিওতে উপস্থিত হওয়া যায়? এ তো একদিন বা দু’ দিনের কাজ নয়। এ একেবারে পনেরো কুড়ি দিন যেতে হবে, তাও রোজ নয়—যেদিন ‘সেটে’ আমার পার্ট থাকবে সেদিন। ক্যাজুয়াল লীভগুলো নষ্ট করব? না, ‘earned leave’ নিয়ে একমাসের ছুটি নেব?

কিন্তু earned leave-এ ছুটি নিলে নির্দিষ্ট তারিখে আবার অফিসে যোগ দিতে হবে। কিন্তু তখন যদি আমার স্যুটিং শেষ না হয়, তাহলে?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গিয়ে বসলাম অফিসে আমার নির্দিষ্ট জায়গায়।

আরও দিন দুই কেটে গেল। কিন্তু সমস্যার সমাধান আর কিছু হল না।

এদিকে নিয়মমতো পার্ট মুখস্থ করে যাচ্ছি অথচ মনে জুৎ পাচ্ছি না।

এমনি সময় হঠাৎ একদিন অফিসে আমায় ধরে বসলেন আমাদেরই অফিসের বড়োবাবু গোরাচাঁদবাবু।

জিজ্ঞেস করলেন—‘অরুণ, তোমার মুখটা ক’দিন ধরে কেন ভার ভার দেখছি ভাই? কী হয়েছে বলো তো।’

আমি তাঁকে অকপটে সব কথা বলি।

গোরাচাঁদবাবু শুনে বললেন—‘আরে, এই ব্যাপার? তা এতদিন কেন বলোনি? মিথ্যে মুখ ভার করে বসে আছ কেন? আরে আমি কি তোমার পর? একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। আর ওপরওয়ালাকে ম্যানেজ করার ভার তো আমার ওপর! তোমার জন্যে আর এটুকুও করতে পারব না!’

কৃতজ্ঞতায় আমি গলে গিয়ে বলি—‘দেখুন, ফিল্মে নামার আমার বড্ড শখ। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে এদিকে যেতেও সাহস হচ্ছে না। কারণ জানেন তো আমার অবস্থা।’

হেসে বড়োবাবু বললেন,—‘কুছ পরোয়া নেই ব্রাদার, তুমি এগিয়ে যাও, তোমাকে দেখার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। আর ছবিটা উঠলে আমাকে দেখাতে ভুলো না।’

এই প্রসঙ্গে আরও দু’জনার নাম উল্লেখ না করে পারি না, যাদের অকৃত্রিম স্নেহ আর বন্ধুত্বের জোরেই আমি আরও তিন বছর চাকরি করতে পেরেছিলাম। তাঁরা হলেন লালচাঁদবাবু আর শ্যামবাবু।

অভিনেতা উত্তমকুমারকে হয়তো আপনারা কোনোদিনই দেখতে পেতেন না যদি না সেদিন অফিস থেকে এঁরা আমাকে সাহায্য করতেন।

তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের কথা আমি আমরণ স্মরণ রাখব।

অফিসের ব্যবস্থা একরকম হয়ে গেল। এইবারে স্যুটিং এর দিনের জন্যে আমি প্রস্তুত হতে লাগলাম।

দিনও একদিন পড়ল। গেলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কারণ ওখানেই আমাদের তখন ‘ওরে যাত্রী’ তোলা হচ্ছে।

কিন্তু তখন স্টুডিওর পরিবেশ আজকের মতন ছিল না। একদল লোক সদাসর্বদা সেটের মধ্যেই বসে থাকতেন। তাঁরা না শিল্পী না টেকনিশিয়ান।

অথচ তাঁদের সঙ্গে পরিচয় থাকত সব পরিচালক আর প্রযোজকদের।

শুধু তাই নয়, বড়ো বড়ো শিল্পীদের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠভাবেই পরিচয় থাকতো।

নতুন কোনো ছেলে বা মেয়েকে স্টুডিওর মধ্যে আসতে দেখলেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পরিচালক আর প্রযোজককে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, নতুন ছেলে বা মেয়েটার কিছু হবে না। পত্রপাঠ যেন তাকে বিদায় দেওয়া হয়।

এক্ষেত্রে একটা কথা না বলে পারি না। বর্তমানের বিখ্যাত অভিনেত্রী চিত্রতারকা রমা বা সুচিত্রা সেন৩৪কেও এঁরা বাদ দেননি।

একজন মন্তব্য করেছিলেন, এ মেয়ের দ্বারা কিছু হবে না। তাঁর কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আজ সুচিত্রা গৌরবের আসনে বসেছেন। এইসমস্ত লোকেরা জানেনও না তাঁদের ওই ধরনের কথাবার্তা তরুণ-তরুণীদের মনে কতখানি হতাশা এনে দেয়।

আমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পরিচালকের নির্দেশে মেকআপ-ম্যানের কাছ থেকে মেকআপ নিয়ে গেলাম ফ্লোরে।

করছি এক ডাক্তারের পার্ট। স্টেথিসকোপ গলায় জড়ানো। অপরদিকে আমার রোগিণী সেজেছেন মঞ্চ ও পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রভা দেবী।৩৫

প্রথম সীনেই আমি তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করব। মুখে আলো ফেলা হল। ওদিকে ‘মনিটার’ শুরু হবে, অর্থাৎ ক্যামেরা চালাবার পূর্বে ক্যামেরাম্যান, পরিচালক এবং সাউন্ডম্যান দেখে নেবেন দৃশ্যটা কেমন উঠছে।

যতক্ষণ না ওঁদের মনঃপূত হবে ততক্ষণ এই ধরনের মনিটার চলতেই থাকবে, আর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তাঁদের নির্দেশ মেনে বার বার একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে যেতে হবে।

আগেই বলেছি, আমার চেহারা ছিল রোগা। তার ওপর এই ধরনের একটা অভিনয়ের উত্তেজনাও কম নয়। ভেতর ভেতর বেশ নার্ভাস হয়েছিলাম। মুখে আলো পড়তেই, সেই অবাঞ্ছিত দলের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন— ‘রাজেনদা, এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড় দিলে উড়ে যাবে যে!’ কথাটা শাণিত ছুরির মতো গিয়ে বিঁধল আমার মনের ওপর।

আর একজন মন্তব্য করলেন—‘একেবারে নতুন আমদানি হয়েছে যে গাঁ থেকে!’

একেই নার্ভাসনেস আর উত্তেজনায় আমার আগেই হাত পা ঠান্ডা হতে আরম্ভ করেছিল, এ ধরনের মন্তব্য শুনে শুরু হল কাঁপুনি।

ঠিক এমনি সময় পরিচালক নির্দেশ দিলেন—‘অর্ডার! Now you boy, এগিয়ে গিয়ে তোমার patientকে examine করো।’

অগত্যা গেলাম এগিয়ে। জলতেষ্টায় তখন আমার গলা শুকিয়ে গেছে।

নাড়ি দেখবার জন্যে প্রভা দেবীর হাত ধরলাম। আমার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রভা দেবী চোখ তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। তারপর বললেন—‘এ ছেলে অভিনয় করবে কী! এর তো এখনই হাত পা ঠান্ডা হয়ে জমে এসেছে। এ তো কাঁপছে ভয়ে।’

বলতে বাধা নেই, তখন আমার হাত এত বেশি কাঁপছিল যে প্রভা দেবীও তা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন।

ভিড়ের মধ্যে থেকে মন্তব্য হল—‘চেহারা দেখেই আমাদের মালুম হয়েছে। আগেই বলেছিলুম এর দ্বারা কিসসু হবে না।’

আমার দ্বারা হবে না! কথাটা শুনে আমার সারা মন প্রাণ হতাশায় ভরে গেল। কিন্তু কেন হবে না, তা তো কেউ কিছু বললেন না।

১২

সেই ‘কেন’র জবাব আমায় কেউ দিল না বটে, অথচ ফ্লোর ছেড়ে যাওয়াও আমার চলল না। যাব বলে তো আসিনি। এত দীর্ঘদিন ধরে যা কল্পনা করেছি, যে স্টুডিও ছিল আমার ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন, সেই স্টুডিওর ফ্লোর আমায় ছেড়ে যেতে হবে!

কিছুতেই না। সুযোগ যখন পেয়েছি তখন তাকে ছাড়া, কিছুতেই চলবে না। যাক, সেদিনে ঘেমে গিয়েও পরিচালকের নির্দেশমতো ছবির কাজ করে গেলাম। কাজের শেষে সেই ভিড়-করা লোকেরা আমাকে প্রশ্ন করলেন—‘আর কোনো ছবিতে কাজ করেছ? না, এই প্রথম?’

আমি বলি—‘না, আরও দুটো ছবিতে কাজ করেছি।’

তার মধ্যে থেকে আর একজন বললেন—‘কিন্তু মানিক, দেখে যে মনে হচ্ছে একেবারে নতুন। মা’র কাছে মামার বাড়ির গল্প! আমরা যে বাবা রোজ সেই বারোটা থেকে এখানে বসে থাকি, প্যাক আপ (স্টুডিওর কাজ শেষ হয়ে গেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়াকে ‘প্যাক আপ’ বলে) না হওয়া অবধি।’

আমি বলি—‘ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস করবেন না। তবে দেখুন, পরিচালক রাজেনদা কিন্তু বিশ্বাস করেন, তাঁকেই একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন।’

এবারে বোধহয় কাজ হল।

তাঁদের মধ্যে একজন বললেন—‘আরে, অত করে জিজ্ঞেস করার কী আছে! ছোঁড়াটা বলছে যখন, তখন কি ভুল কথা বলছে! নিশ্চয় দু’একবার নেমেছে।’

সেদিনকার মতো ব্যাপারটা সেখানে চুকে গেলেও, চুকল না পরের দিন।

আবার স্টুডিওতে গিয়ে দেখি, সেই তাঁরাই সকলে বসে রয়েছেন ‘সেটে’।

মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম। ভাবলাম, পরিচালক বা প্রযোজক এদের কেন ‘সেটে’ আসতে দেন! তাড়িয়ে দিতে পারেন না!

কিন্তু আমি মনে করলেই তো, তা হবে না।

আমাকে দেখেই একজন বলে উঠলেন—‘হিয়ার কামস নিউ দুর্গাদাস!’

দুর্গাদাসবাবুর অপূর্ব অভিনয়ের কথা শুনেছি। ‘পরশমণি’, ‘প্রিয়বান্ধবী’ প্রভৃতি দু একটা ছবিও দেখেছি। দেখে বুঝেছিলাম কী অপূর্ব নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি অভিনয় করতেন। দর্শকদের মন কেড়ে নেবার কতখানি তাঁর ক্ষমতা ছিল!

একজন সেটাকে ঠিক করে বললেন—‘দুর্গাদাস, না না, তার চেয়ে বরং বল, ছবি বিশ্বাস। ভবিষ্যতে ও-তো ওনারই পদ নেবে।’

মনে হল থাক আমার অভিনয়। থাক আমার সবকিছু পড়ে। আমি ফিরে যাই আমার সেই পোর্ট কমিশনার্স অফিসে।

কিন্তু, কেন বার বার এই উপহাস! পাড়াতে অভিনয় করে বা একবার দুবার এক্সট্রার মধ্যে থেকে স্টুডিওর সম্বন্ধে আমার যে ধারণা হয়েছিল, তা তো একেবারে পাল্টে গেল। অভিনয় করা যতটা সোজা মনে করেছিলুম ততটা সোজা তো নয়!

অভিনয় সোজা হলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে আমাকে এখন জয় করতে হবে। তাই মনে মনে বিরক্ত হয়েও মুখে ভাব দেখাই অন্যরকম।

পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলি—‘আসুন, নিন!’

অমনি চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে আমার সিগারেটের প্যাকেট গেল শূন্য হয়ে। তা যাক, তাতে দুঃখ নেই।

সিগারেট ধরিয়ে যে ক’জন সেখানে বসেছিলেন তাঁরা ধোঁয়া ছেড়ে বলেন— ‘না হে ছোকরা, নার্ভাস হয়ো না। তোমার এলেম আছে। হলেও হতে পারে।’

আমি তাঁদের আরও আপ্যায়িত করে বলি—‘আপনাদের বুঝি সকলের সঙ্গে আলাপ আছে?

ওঁদের মধ্যে একজন জবাব দিলেন কথার।

—‘আলাপ মানে? অহীন্দ্রবাবু, ছবিবাবু থেকে সকলের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব। খাতিরও আছে। সব পরিচালকদের সঙ্গে আমাদের আলাপ আছে। যদি ছবির চান্স চাও তাহলে আমাদের সঙ্গে খাতির রাখো—আমরা যা বলি তাই করো। তারপরে তুমি স্রেফ লক্ষ করো তোমার কী হয়ে গেছে।

বুঝলাম আমার প্রথম ওষুধ কাজে লেগেছে। মুখে বলি—‘তা তো নিশ্চয়! আচ্ছা, কতদিন ধরে আপনারা এরকম স্টুডিওতে যাতায়াত করছেন?’

এক ভদ্রলোক বলেন—‘অনেকদিন ধরে। এই যাতায়াত আছে বলেই আমাদের সকলকার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছে কিনা।’

একটু আগেই সেদিন স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। ‘মেকআপ-ম্যান’ তখনও এসে পৌছোয়নি। তাই হাতে খানিকটা সময়ও ছিল। সেই ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে বলি—‘চলুন না, একটু চা খাওয়া যাক।’

তাঁদের মধ্যে আর একজন বলেন—‘চা খাওয়াবে, তা বেশ চলো।’

আমি বলি—‘আমার মতো লোক আপনাদের আর কী করতে পারে বলুন! তবে হ্যাঁ, ওই চা খাওয়ার ফাঁকে আলাপটা একটু জমিয়ে নেব। কারণ বুঝতেই তো পারছি এ লাইনে উন্নতি করতে গেলে আপনাদের সাহায্য ছাড়া হবে না।’

একজন আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন—‘বিলক্ষণ, ছোকরাকে যতটা বোকা বলে মনে হয়েছিল, ততটা বোকা নয় হে হরিশ!’

এই হরিশ বা হরিশদা ছিলেন এই দলের পান্ডা-গোছের লোক।

আমার আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ করে তিনি বললেন—‘হ্যাঁ, হতে পারে।’

আমি বলি—‘যাক ওসব কথা, চলুন না চা খাওয়া যাক।’

চা, টোস্ট, ডিমের ওমলেট, পাশেরই একটা ক্যানটিন থেকে তাঁদের খাওয়ালাম। আরও দু প্যাকেট সিগারেট কিনে তাদের পরিতুষ্ট করলাম।

এইসমস্ত করতে গিয়ে আমার পকেটে যা ছিল তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল। স্টুডিও থেকে ফেরবার বাসভাড়াটুকুও পর্যন্ত রইল না।

না থাক ক্ষতি নেই, হেঁটেই ফিরব। বড়ো জোর এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা সময় যাবে। তাতে কী হয়েছে। এই ধরনের লোকগুলোর হাত থেকে তো অব্যাহতি পাওয়া যেতে পারে। আর তাছাড়া আমার সম্বন্ধে অনবরত বিরুদ্ধ মন্তব্য শুনলে পরিচালক প্রযোজকরাই বা কী ভাববেন! যদি রাগ করে আমাকে তাঁরা বাদ দিয়ে দেন!

তাই আমাকে করতেই হবে এঁদের মনতুষ্টি!

সেদিন কিন্তু স্যুটিং-এর সময় দেখলাম একটা অদ্ভুত ব্যাপার। যাঁরা আগের দিন বলেছিলেন—আমার দ্বারা এতটুকু অভিনয় করা সম্ভবপর হবে না, আমি নাকি একেবারে গেঁইয়া,—তাঁরাই মনিটারের সময় ‘বাঃ চমৎকার’, ‘বেস্ট অ্যাকটিং’ বলে আমাকে উৎসাহিত করলেন।

উৎসাহের আতিশয্যে কেউ কেউ বা পরিচালককে লক্ষ্য করে বললেন—‘এ ছেলে আপনার বইতে বেস্ট অ্যাকটিং করবে দেখবেন। বই যদি চলে ওরই জন্যে চলবে।’

আমি মনে মনে বুঝলাম—এ আর কিছুই নয়, সকালবেলার চা, টোস্ট আর সিগারেটের ফল।

যাইহোক, সেদিনটাও ভালোয় ভালোয় স্যুটিং হয়ে গেল।

আমি কিন্তু চা আর সিগারেট উপহার দিতে ভুলি না। অবশ্য একদিন ‘ওরে যাত্রী’র স্যুটিং শেষ হয়ে গেল। বই তখন দেখানোর জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

ভেবেছিলাম, প্রথম ছবির থেকেই আমি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারব। কিন্তু আমার এমনি দুর্ভাগ্য, ‘ওরে যাত্রী’ দর্শকরা নিলেন না, দু তিন সপ্তাহ চলবার পর ছবি হল বন্ধ।

আমারও হয়ে গেল মন খারাপ। আবার যাই অফিসে। মন বসাবার চেষ্টা করি কাজে। কিন্তু মন আর বসে কই!

দুপুরবেলায় কাজ করতে করতে অলস মুহূর্তে নিজের কানে যেন শুনতে পাই স্টুডিওর ‘ক্ল্যাপাস্টিক’ টানার আওয়াজ, ডিরেক্টারের ‘রেডি’ বলার শব্দ। চমকে উঠে সামনের দিকে চেয়ে দেখি কোথায় বা স্টুডিওর ফ্লোর, কোথায় বা কী! আমি বসে রয়েছি আমাদেরই অফিসের চেয়ারে।

ওপরওয়ালার কাছ থেকে একটা স্লিপ নিয়ে বেয়ারা এসে ডাকছে — ‘অরুণবাবু, এ অরুণবাবু!’

মুহূর্তের মধ্যেই স্টুডিওর উত্তমকুমার হয়ে যায় পোর্ট কমিশনার্সের ‘অরুণবাবু’।

শ্লিপটা হাতে নিয়ে বলি—‘তুই যা, আমি দেখছি।’

এরপরে আমার জীবনে সুযোগ আসে ‘কামনা’৩৬ ছবিতে একেবারে নায়কের পার্টে। সুযোগ অবশ্য করে দেন ছবির পরিচালক শ্রীনবেন্দুসুন্দর ব্যানার্জি।

আমার অপর দিকে নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ছবি রায়।৩৭

আগেকার মতনই এবারেও অফিসে ব্যবস্থা করেছিলাম। ছবি তোলবার সময় অফিস থেকেও সাহায্য পেয়েছিলাম প্রচুর। তাই নির্বিঘ্নে ছবিটাও তুলে ফেললাম।

ছবিতে এবারে পারিশ্রমিক পেলাম ১৫০০ টাকা। ভেবেছিলাম, ছবিটা হয়তো দর্শকরা নেবেন, কিন্তু এবারেও ভাগ্য খারাপ, ছবি চলল না। নায়ক সেজে আমার অভিনয় করার স্বপ্ন, স্বপ্ন হয়েই মিলিয়ে গেল। মনে হল কি আর হবে ছবি করে! নাম তো করতে পারলাম না! দর্শকের মনে রেখাপাতই যদি না করতে পারি, তাহলে আমার অভিনয় করে লাভ!

কিন্তু একটা কথা আছে, স্বভাব মলেও যায় না! তাই বার বার বাইরে থেকে আঘাত এলেও, আমার মনের ইচ্ছে বোধহয় ম্লান হল না। কেবলই মনে হয়, একটা ভালো ছবিতে যদি কাজ করতে পেতাম! কিন্তু তেমন ভালো ছবি পাই কোথায়? তাছাড়া, যাঁরা ছবি তুলবেন তাঁদেরও আমায় পছন্দ হওয়া চাই!

আবার সেই একটানা হতাশা আমাকে পেয়ে বসতে লাগলো। এমনি সময় খবর পেলাম, সরোজবাবু অর্থাৎ সরোজ মুখার্জি৩৮ নায়ক খুঁজছেন। ওঁরা প্রথমে প্রদীপবাবু৩৯কে এই বই-এর নায়ক মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটা ছবির কাজে প্রদীপবাবু আটকে যাওয়ায়, তাঁকে তখন পাওয়া গেল না। তাই তাঁদের এখন একজন নায়ক প্রয়োজন।

আমি গিয়ে দেখা করলাম। বললাম আমার সব কথা। ওরা শুনলেন। শুনে কী ভেবে রাজিও হয়ে গেলেন আমায় নিতে। কেবল একটা শর্ত হল আমি এই ছবিতে উত্তমকুমার নামে অভিনয় করতে পারব না।

এ ছবিতে আমার নামকরণ হলো অরূপকুমার। ছবির কাজ পুরোদমে চলছে। ঠিক সেইসময় ‘এম. পি.’র৪০ ম্যানেজার বিমল ঘোষ মহাশয় ‘এম. পি.’র জন্য নতুন নায়ক খুঁজছেন।

ওঁরা অসিতদাকে নিয়ে একটা ছবি করবার মনস্থ করেছিলেন কিন্তু কী জানি কেন সেটা আর সফল হয়নি।

বিমলবাবু একদিন এলেন স্টুডিওতে। আমাকে দেখে ওঁদের পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু উনি যে আমাকে দেখেছিলেন, সেকথা আমি তখন জানতে পারিনি। জেনেছিলাম পরে। ছবিতে পাহাড়ীদাও কাজ করছিলেন, তাঁকেই আড়ালে নিয়ে গিয়ে বিমলবাবু প্রশ্ন করেন—‘ছেলেটি কেমন অভিনয় করে? চলতে পারে কি?’

উত্তরে নাকি সেদিন পাহাড়ীদা বলেছিলেন—‘আমার তো মনে হয় ঘষলে মাজলে ভালোই হতে পারে।’

বিমলবাবু যেমন নীরবে এসেছিলেন সেইরকম নীরবেই আমাকে দেখে চলে গেলেন। আমি জানতেও পারিনি তাঁর উপস্থিতি।

সরোজবাবুর ‘মর্যাদা’ ছবির কাজও শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যে অবশ্য এবারেও আমার সেই একই ফল। ছবি ‘ফ্লপ’ করল, দর্শকে নিল না।

ভাবলাম ফিল্ম লাইন ছেড়েই দেব। অবশ্য সংসারে তখন টানাটানি বেড়েছে। রোজগার করবার মধ্যে বাবা আর আমি। জিনিসপত্রের দাম তো হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। বরুণ, তরুণ দুজনেই তখন স্কুলে পড়ে। আমার আয় বাড়ানোর দরকার। তাহলে মা একটু শান্তি পান। মুখ বুজে কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করেন!

কিন্তু আয় বাড়াবার উপায় কিছু খুঁজে পাই না। আমার মতন বিদ্যেতে যা করা সম্ভব তা আমি করছি।

টেনেটুনে বি. এ. টা যদি পাস করতে পারি, তাহলে কাজের আর একটু উন্নতি হতে পারে। কিন্তু বি. এ. পাস! সেও তো সোজা নয়!

এমনি যখন আমার মনের অবস্থা তখন হঠাৎ এল মুরলীবাবুর ‘এম. পি.’ থেকে একখানা চিঠি। তাঁদের ধর্মতলা অফিসে আমায় গিয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। ভাবলাম, কী হবে গিয়ে। সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এতগুলি ছবি করলাম। কী হল। এমনি সময় তরুণ আর বন্ধু তারাপদ একরকম জোর করেই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ‘এম. পি.’র অফিসে।

সেদিন তরুণ আমাকে বলেছিল—‘দাদা, এম. পি.তে যখন চান্স পাচ্ছ ছেড়ো না। ভালো কোম্পানি, দেখোই না একবার গিয়ে, কী হয়!

সেদিন একরকম ওরই উৎসাহে দুপুরবেলা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম ‘এম. পি.’র অফিসে। গিয়ে দেখি, একটা ঘরের মধ্যে একদঙ্গল ছেলে আর মেয়ে বসে রয়েছে। তার মাঝখানে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে কী যেন বলছেন।

পরিবেশ দেখেই আমার স্টুডিওর কথা মনে পড়ে গেল। আবার সেই ‘ফড়ের’ দল! চা আর সিগারেট দিয়ে যাদের সন্তুষ্ট করতে হবে! কিন্তু ইনি কে? চিঠিখানা দিলাম তাঁর হাতে।

চিঠিখানা পড়ে ভদ্রলোক আমার আপাদমস্তক ভালো করে আবার দেখলেন। তারপর একরকম তিক্তকণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন—‘আপনার নামই উত্তমকুমার?’

আমি জবাবে বলি—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

—‘অভিনয় করা নেশা, না পেশা?’

বিরক্তিতে ভরে গেল মন। তবুও সংযত হয়ে জবাব দিলাম—‘আপাতত নেশা, পরে সুবিধে হলে পেশা করতে আপত্তি নেই।’

—‘আচ্ছা দেখা যাক, আপনাকে নিয়ে কী করা যায়, আসুন এ ঘরে।’

আমিও ধীরে ধীরে ভদ্রলোকের সঙ্গে গেলাম।

১৩

অনেকে মনে করেন অভিনেতার জীবন বড়ো সুখের, বড়ো আরামের, যেন নরম ফুল দিয়ে বিছানো। এর প্রধান কারণ শখের দলে এক—আধ দিনের জন্যে অভিনয় করতে সকলেরই ভালো লাগে। তাতে উত্তেজনাও প্রচুর আছে, সেকথা স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সেই অভিনয় যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে থাকে, তখন আর তার মধ্যে আনন্দ থাকে না। একথা আমি আগে বলেছি ‘শ্যামলী’র অভিনয় থেকে যখন বিদায় নিয়েছিলাম তার কারণ হিসেবে।

আপনারা হয়তো বলবেন, বাপু হে, তুমি তো অভিনয় করছ ক্যামেরার সামনে। সে ক্যামেরা চলতে শুরু করে, যখন তুমি তাকে চলতে বলো। আর এতে তোমায় একটানা অভিনয় করতেও হয় না। সামান্য কয়েকটা মিনিট—তাতে আবার কষ্ট কী? আমি বলব—এ সামান্য কয়েকটা মিনিটের পেছনে থাকে বিরাট প্রস্তুতি। হয়তো দশটায় স্যুটিং আরম্ভ হবার কথা, সাড়ে নটার মধ্যে আপনি স্টুডিওতে পৌঁছেছেন, মেকাপ করেছেন। সেটে পৌঁছেছেন। হয়তো সেদিন আপনাকে একটা হাসির দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে, কিন্তু মুশকিল বেধেছে আপনার নিজেকে নিয়ে। হাসি আর সেদিন আপনার ফুটছে না, পরিচালকেরও মনোমতো হচ্ছে না। ফলে সে দু’মিনিটের দৃশ্য তুলতে লেগে গেল দু’ঘন্টার ওপর।

কেন এমন হয়?

এই দেহের পিছনে মন বলে আমাদের একটা পদার্থ আছে। সেই মনটা ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাদের শরীরটাকে। সেই মনটাই মাঝে মাঝে মহা অনর্থ সৃষ্টি করে বসে। একদিন হয়তো ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন, আপনার মনটা অকারণে দুঃখে ভরে রয়েছে। বাড়িতে এটা—সেটা করতে যান। এদিকে স্টুডিওতে যাবারও সময় হল। স্টুডিওতে এসেও, যে চরিত্রে আপনি অভিনয় করবেন, তা ভাববার সময় আপনি পাবেন না। মেকাপ—রুমে যান, বন্ধুবান্ধব এসে কথা বলছেন, কারোকে আপনি না বলতে পারছেন না। না বলাটা অভদ্রতা —তাঁরাই বা কী মনে করবেন। ফ্লোরে গেলেন, সেখানেও ঐ একই অবস্থা। স্যুটিং হচ্ছে, এদিকে গালগল্পও চলছে। আপনার ডাক এলো, চরিত্র নিয়ে আপনি চিন্তাও করেননি ইতিপূর্বে। তাই পরিচালক চরিত্রচিত্রণে মুখের ওপর যেমন অভিব্যক্তি চান, তেমনটি আপনার মুখে আর ফুটছে না। কারণ ইতিপূর্বে আপনার মনঃসংযোগ হয়নি। তাই খাটুনিও বেড়ে চলল। সে খাটুনির কোনো মাপকাঠি নেই।

আমার মনে হয়, অভিনেতা যখন মেক—আপ নিতে শুরু করেন, তখন থেকে পরিচালক বা সহকারী পরিচালক যদি শিল্পীদের কাছে এসে তাঁদের চরিত্র সম্বন্ধে ভালো করে বুঝিয়ে দেন বা সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁরা দর্শককে কী বোঝাতে চাইছেন, সেটুকু আলোচনা করেন, তাহলে অভিনয়ের মান আরো উন্নত হতে পারে এবং কম খাটুনিতেও ছবি তোলা সম্ভব হতে পারে। একথা বলছি তার কারণ হচ্ছে, যিনি যখন যে চরিত্রে অভিনয় করবেন, সাময়িক হলেও তাঁর নিজেকে ভুলে যেতে হবে। ভাবতে হবে সেই চরিত্রই আমি। এই চিন্তা তাঁর মধ্যে যত স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাঁর চরিত্র—রূপায়ণ তত ভালো হবে।

এই ক্ষেত্রে একটা কথা বলি। ‘সপ্তপদী’র কৃষ্ণেন্দুর চরিত্র বা ‘দুই ভাই’৪১ এর উৎপল—এর চরিত্র—দুটো চরিত্রই আমার ভালো লেগেছিল। অভিনয় করে আমি নিজেও আনন্দ পেয়েছি। ইদানীং রোম্যান্টিক চরিত্রে অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারাশঙ্করবাবুর কৃষ্ণেন্দুর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে দেখি সেখানে রয়েছে নতুন কথা— মানুষকে ভালোবাসো, মানুষের ঊর্ধ্বেও আর একজন আছেন যিনি আমাদের চালিয়ে নিয়ে চলেছেন, তিনি আমাদের ভালোই করেন, কখনও মন্দ করেন না। মানুষের মধ্যে কৃষ্ণেন্দুকে তাঁর প্রকাশ দেখে।

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণের৪২ ‘দুই ভাই’এর উৎপলের চরিত্রের মধ্যেও তেমনি নতুনত্ব দেখেছি। সে বড়োভাই, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার ছোটোভাই কমলকে। তার কল্পনা অনুপাতে সে ছোটোভাইকে মানুষ করতে চায়। কিন্তু ছোটোভাই তার কল্পনা নিচ্ছে না। সে কালের চাকায় গড়িয়ে চলেছে, লাগল ভালোবাসার সঙ্গে সংঘাত। সবটুকুর মধ্যেই রয়েছে ভালোবাসা। দুঃখ, বেদনা, হাসি,—সবগুলোই গাঁথা রয়েছে এক সূত্রে। হয়তো মনের কোনো গোপন অজানা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে হয়েছে তার মিল। তাই আনন্দ পেলাম এই চরিত্রদুটোতে অভিনয় করতে।

এখন কথা হল এ দুটো চরিত্র আমার নয় মনোমতো হয়েছে। এমন তো বহু চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে হয়, যা আমার মনোমতো হয় না। তখনই প্রয়োজন হয়েছে মনঃসংযমের এবং সেইজন্যই বলছিলাম পরিচালক বা সহকারীদের উচিত বারবার অভিনয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে অভিনেতা—অভিনেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা, যাতে চরিত্র বুঝতে এতটুকু দেরি না হয়।

শ্রদ্ধেয় নাট্যাচার্য এ বিষয়ে বলতেন—’যখন তুমি যে চরিত্রে অভিনয় করবে, তখন পর্দা উঠলে তুমি মনে করবে তুমি সেই। তোমার সত্তাকে তুমি একেবারে দেবে ডুবিয়ে।’ অদ্ভুত অভিনেতা ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি অভিনয় করতেন সাজাহান৪৩ আর ঔরঙ্গজেব৪৪, আলমগীর৪৫ আর রাজসিংহের৪৬ চরিত্রে। সাজাহান স্নেহবৎসল ঔরঙ্গজেব কঠোর, কুটিল; সাজাহান পুত্রস্নেহে পাগল, ঔরঙ্গজেব স্বার্থসিদ্ধির খাতিরে ধর্মের ভান করে। তেমনি আলমগীর কুটিল হলেও সত্যাশ্রয়ী আর রাজসিংহ যুদ্ধপ্রিয় হলেও সরল, উদার। এই ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।

মনঃসংযম দিয়ে তিনি বদলে ফেলতেন নিজেকে। এ যেন একই মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ডক্টর জেকিল৪৭ আর মিস্টার হাইড৪৮। তাই আজও তিনি যুগান্তকারী অভিনেতা— তিনি সত্যিকারের একজন সাধক।

তাই বলি অভিনয় ছেলেখেলা নয়। দুটো ছবিতে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে, দু—চারটি নায়িকার সঙ্গে রোম্যান্টিক দৃশ্যে অবতীর্ণ হয়ে, দম্ভভরে ভালো জামা গায়ে দিয়ে গাড়ি চড়ে রাস্তায় বা লোকের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেলাম—কিছু স্কুল—কলেজের পড়ুয়া ছেলে একটু টীকাটিপ্পনী কাটল বা কিছু রঙিন মুখে তাকিয়ে হাসল বা একটু উচ্ছ্বাস দেখাল, এটা অভিনয়ের মূল কথা নয়। অভিনয়, সাধনার বস্তু। এ রসে যারা একবার মজেছে তারাই মরেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ অভিনেতা তুলসীদা মানে তুলসী চক্রবর্তীর৪৯ মুখে আমি একটি গল্প শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে যুগের স্টেজ সম্বন্ধে তুলসীদা যা বলেন সেগুলো গল্প নয়—সেগুলো সত্য ঘটনা। তিনি বলেছিলেন যে তখনকার দিনে কোনো একজন অভিনেতা, নামটা আমার ঠিক মনে নেই, জয়দেব চরিত্রে অভিনয় করতেন। দিনের পর দিন যায়। তিনি ভক্তিরসে নিজেকে আপ্লুত করার চেষ্টা করেন। সেই ভক্তিরসে ডুবতে গিয়ে তিনি শেষে মজে গেলেন। একদিন দেখা গেল তিনি আর স্টেজে এলেন না, কৃত্রিম পথে ভগবানকে না পেয়ে অকৃত্রিম পথে তিনি ছুটলেন ভগবানের পিছনে। কিছুদিন খোঁজ তল্লাসির পর তাঁকে পাওয়া যায় পুরীর রাস্তায়,— মুখে ঠিক সেই অভিব্যক্তি— সেই বাণী—হা প্রভু! হা জগন্নাথ! তারপর শোনা যায় যে, যে—মুহূর্তে তিনি জগন্নাথ—মন্দিরে পদার্পণ করেন সেই মুহূর্তে তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হয়। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কিন্তু এটা সত্যি ঘটনা। তুলসীবাবু শ্রদ্ধেয়, মাননীয় এবং আমি তাঁর কথা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করি— বিশেষ করে তিনি যখন পুরোনো দিনের স্টেজের কথা বলেন।

তাছাড়া এসব কথা নিয়ে কেউ মশকরা করে না বলেই আমার ধারণা। এই থেকে বুঝতে পারা যায়, সৎ চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে যদি সে সত্যি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে, তবে আখেরে সে সৎই হয়ে যায়।

এই প্রসঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বলা একটা কথা মনে পড়ল। তিনি বলতেন, ‘মন ধোপা ঘরের কাপড়। একে যে রঙে রাঙাবে সেই রঙ হবে।’

এতেই বোঝা যাবে তুলসীদা যে ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে বুজরুকি থাকা সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, সৎ অভিনয় মানুষকে দেবতার স্তরে তুলে নিয়ে যেতে পারে।

যাক সে কথা।

অভিনয়ের কথা বলতে বসে অভিনয় থেকে অভিনেতার চরিত্রের পরিবর্তনের সম্ভাবনা অবধি আলোচিত হয়ে গেল। এখন অভিনেতাদের মধ্যে বিশেষ করে বিদেশি অভিনেতাদের মধ্যে কাকে আমার ভালো লাগে বলছি।

বলছি আমি এই কারণে, কেন অভিনয়টাকে আমি শিল্প বলে গ্রহণ করতে পেরেছি। যাঁর কথা বলব, যাঁকে আজও আমি আমার সর্বান্তঃকরণ দিয়ে শ্রদ্ধা করি, তিনি আজ জীবিত নেই। তবুও তাঁর সুক্ষ্ম অবস্থিতি আমি প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করি।

সেই চিরস্মরণীয় অভিনেতার নাম রোনাল্ড কোলম্যান।৫০ ‘Double Life’এ তাঁর অভিনয় দেখতে দেখতে আমি অভিনেতাকে হারিয়ে ফেলে নায়কের সুখদুঃখের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছিলুম। এখনও মনে হয় এ কি করে সম্ভব হয়, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে— বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি—

১৪

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অভিনয়ের কথা। অভিনয় করতে করতে মনের পরিবর্তনের কথা। তুলসীদার মুখ থেকে যেমন ওই কথা শুনেছি তেমনি ছেলেবয়সে যাত্রা দেখতে দেখতে এর কিছুটা প্রমাণও পেয়েছি।

একবার ছেলেবয়সে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম, শ্রীগৌরাঙ্গ সম্বন্ধীয় কোনো যাত্রা অভিনয় হচ্ছিল। অভিনয় জমে উঠেছে।

যে ভদ্রলোক ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’র পার্ট করছিলেন তিনি নিমাই—এর গৃহত্যাগের দৃশ্যে অঝোরধারায় কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি এতটা আত্মহারা হয়ে গেলেন যে, সেই সভাতেই হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন।

সকলে তো ত্রস্ত,—কী হল কী হল! দলের লোক জানতেন। তাঁরা তাড়াতাড়ি তাঁকে সভা থেকে তুলে নিয়ে গেলেন। শুশ্রূষার পর তাঁর আবার জ্ঞান ফিরে এল। শুনেছিলাম সেইবার প্রথম নয়, এমনটি নাকি তাঁর প্রায়ই হয়। বড়ো আশ্চর্য লেগেছিল তখন। কিন্তু আজ আর কোনো বিস্ময় জাগে না। মনে হয় সবই সম্ভব।

অপরদিকে দেখেছি দীর্ঘদিন স্বামী—স্ত্রীর অভিনয় করতে করতে অভিনেতার মনেও এসেছে লোভ, এসেছে আকাঙ্খা।

যেমন ধরুন, এক নায়িকার সঙ্গে দীর্ঘদিন আপনি ভালোবাসার অভিনয় করছেন। তিনি করছেন আপনার সঙ্গে অভিনয়। পরিচালক আপনাদের অভিনয় দেখে খুশি হয়েছেন।

বললেন— ‘অদ্ভুত জীবন্ত হচ্ছে!’ উৎসাহ আপনার বেড়ে গেল। আপনি লক্ষ করলেন অপর দিকের উৎসাহও কম নয়। সারাদিন অভিনয়ের পর আপনি হয়তো ফিরছেন বাড়িতে। বাড়ি ফেরার পথে এই চিন্তাটা আপনাকে পেয়ে বসল— যার সঙ্গে সারাদিন ধরে ভালোবাসার অভিনয় করলেন সেটা কি শুধু অভিনয়? না তার মধ্যে কিছু সত্যতা আছে?

মনের মধ্যে আবার কল্পনার রং ভেসে উঠল। তার মনের অবস্থা কেমন? জানতে পারলে বড়ো ভালো হয়।

এই প্রসঙ্গে এক বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিকের কথা না বলে পারছি না। তিনি বলেছিলেন— ‘মানুষের দেহই বুড়ো হয়, মন কখনও বুড়ো হয় না। তবে সব মানুষ যে নিজেকে সংযত করে রাখে তার কারণ সামাজিক বন্ধন।’

যখন পড়েছিলাম তখন ওই কথায় গুরুত্ব দিইনি বুঝতেই পারিনি এর অন্তর্নিহিত অর্থ। পরে বুঝেছিলাম এটা কতদূর সত্য।

যাক যে কথা বলছিলাম। আপনার ভেতরের ‘হিরো’,—হিরোই বলুন আর তাকে ‘সেক্স’ই আখ্যা দিন, আমি সে বলতে চাইনা,—সেই সত্তাটা হঠাৎ জেগে উঠবে—’ওকে না পেলে জীবন আমার দুর্বিষহ হয়ে যাবে।’ মনের এই অহরহ তাগাদা আপনাকে অস্থির করে তুলবে। বাস্তবে তার প্রতিফলন চাইবে। আপনি ঠিক করলেন, পরের দিন স্টুডিওতে গিয়েই তাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করব— তার মধ্যেও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। সে—ও এ জিনিসকে অনুমোদন করে কি না!

আপনি ঠিক করেই ফেললেন। পরের দিন আপনি স্টুডিওতে আগে এলেন। সবাই দেখে উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘আজ এত সকাল সকাল?’

এসে থেকে আপনার হতে লাগল অস্বস্তি। কী হবে, কী উত্তর পাবেন!

যদি অসংযত কথা বলার জন্য অসম্মানিত হন? তখন আপনি কী করবেন? এইরকম একটা উৎকণ্ঠা নিয়ে আপনি নিয়ে এলেন স্টুডিওতে।

সারাদিন ভাবলেন, জিজ্ঞেস করা যায় কী করে? অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্ল্যানও বার করেছেন। কিন্তু আসল সময়ে দেখলেন, আপনার মন চাইছে না সে প্রশ্ন করতে। কারণ সামাজিক বন্ধন।

শুধু সামাজিক বন্ধনই নয়, ঘরে আপনার স্ত্রী আছেন, আত্মীয়স্বজন সকলেই আছেন। তাঁদের চোখের জল আর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কথা ভেবে আপনি আর এগিয়ে যেতে পারলেন না। আসল ব্যাপারটা আমার মনে হয়, যাঁরা সত্যিকারের ভালোবাসা পান, সেবা পান, যত্ন পান, তাঁরা বোধহয় আগের ভালোবাসা কাটিয়ে আর এগিয়ে যেতে পারেন না। তাঁরা অভিনয়টাকে পেশা হিসাবেই দেখে থাকেন। স্ফূর্তি বা আমোদের সুযোগ হিসেবে দেখেন না। শুনেছি, আগেকার দিনে এসব জায়গাকে কেন্দ্র করে নাকি নানারকম ব্যাপার ঘটত। তবে শোনা কথার উপর কোনো কিছু না বিশ্বাস করাই ভালো। কারণ এই শোনা কথাটাই মানুষের জীবনে অনেকরকম ঘটনা ঘটায়। মানুষকে মরীচিকার পিছনে ছোটায়। আকাশেও তোলে, আবার সময় সময় পাতালেও নামায়। তাই বলছিলাম শোনা কথার গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো।

ধরুন একজন অভিনেতা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নিযুক্ত হলেন।

প্রথম ছবিতে তিনি বেশ সুন্দর অভিনয় করলেন। দর্শকও নিলেন। ব্যস, দু’চারটে প্রশংসার কথা শুনে তাঁর ধারণা হল তিনি মস্ত অভিনেতা। অভিনয়ের অনুশীলন আর তাঁর প্রয়োজন নেই। দম্ভভরে চলতে আরম্ভ করলেন। অভিনয়ের অনুশীলন ছেড়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন, আমি যা অভিনয় করব তাই দর্শকরা নেবেন। কিন্তু তারপর দেখা গেল দু’ তিনখানা ছবি দর্শক নিলেন না।

এমনটি ঘটলে ধর্মতলার অফিস৫১গুলো তাঁকে আর ডাকবে না। তিনি যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে সচেতন হলেন, তখন আর সময় নেই। সব সুযোগই চলে গেছে।

একথা বলতে পারছি, কারণ প্রথম দিকে দর্শক আমাকে নেননি। তাই অভিনয়ে নিষ্ঠার দাম আমি বুঝেছিলাম।

আজ যত প্রশংসাই শুনি না কেন, অভিনয়ের ব্যাপারে আমি খুব জেনে গেছি, এ ধারণা আমার কখনও হয় না।

কিংবা কোনো নাটক শুধু আমার জন্যই চলছে, এ বিশ্বাসও আমার হয় না। কারণ আমি জানি ফুটবলের একজন খেলোয়াড়ের একলার সাধ্য নেই একটা দলকে জিতিয়ে দেওয়ার, তিনি যত ভালোই খেলুন না কেন। একথা যেমন আমি জানি, তেমনি জানেন আপনারাও। একইভাবে ছবির কাহিনি যদি দুর্বল হয় বা চিত্রনাট্য যদি মানুষের মন স্পর্শ না করতে পারে, তাহলে শত ভালো অভিনেতা হলেও ছবি চলে না। একটা ভালো ছবির সম্পদ, ও দুটোই। ও দুটো একসঙ্গে হলে তবেই ছবি দর্শকরা নেন। তাছাড়া পরিচালক, সাউন্ড, ক্যামেরাম্যানের কাজও ভালো হওয়া চাই। নইলে কিন্তু ছবি চলা শক্ত।

ওঁদের দেশের ছবির মধ্যে দেখেছি, যতদূর সাধ্য ওঁরা নিখুঁত করার চেষ্টা করেন। ক্যামেরা, সাউন্ডের কাজ আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত ধরনের হয়।

সেইজন্য আমার মনে হয় এ দেশেও যদি ভালো টেকনিশিয়ান তৈরি হয়, তাহলে আরও উন্নত ধরনের ছবি সৃষ্টি করা যেতে পারে।

প্রসঙ্গত আমি কেবল স্টুডিওতেই অভিনয় করি না। এইতো সেদিন পাড়ার ছেলেরা এসে ধরলো আমাকে—যাত্রা করতে হবে।

আমি বলি— কী বই অভিনয় করবে তোমরা?

ওরা বলে —’গয়াসুর’ । আপনাকে নারায়ণের পার্টটা করতে হবে।

—গয়াসুর, নারায়ণ!

মনের ভিতর যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে পড়ে গেল, আমি ছোটো ছেলে, স্কুলে পড়ি। আমার জীবনের প্রথম অভিনয় ‘গয়াসুর’এর ছোটো কৃষ্ণ। সেই প্রথম মুখে রং মেখে এসে মাকে দেখানো।

পাড়ার ছেলেদের কথায় চটকা ভাঙে —’উত্তমদা জগদ্ধাত্রী পূজোর কী হবে। তুমি করছ তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *