হপ ফ্রগ – এডগার অ্যালান পো

হপ ফ্রগ – এডগার অ্যালান পো

রাজামশায় ঠাট্টাতামাসা পেলে দুনিয়া ভুলে যেতেন। বড় রঙ্গপ্রিয় ছিলেন ভদ্রলোক। বেঁচেছিলেন যেন কেবল রঙ্গব্যঙ্গের জন্যেই। তাঁর মন জয় করার নিশ্চিন্ত পন্থা হলো হাসির গল্প বলা এবং জমিয়ে বলে পেটে খিল ধরিয়ে দেওয়া।

রাজামশায় যদি নিজে এত আমুদে হন তো তাঁর পাত্রমিত্র অমাত্যরাও আমুদে হতে বাধ্য। সাতজন মন্ত্রীও নাম কিনেছিলেন ভঁড়ামোর জন্যে। রাজাকে অনুকরণ করতে গিয়ে রাজার মতই নাদাপেটা তেল চকচকে ভুড়িদাস বাবাজী হয়ে গিয়েছিলেন সাতজনই। মানুষ মোটা হলেই ভাঁড়ামো করে, না, ভাঁড়ামো করতে করতে মোটা হয়ে যায়-তা বলতে পারব না। চর্বির মধ্যে সঙ সাজার গুণ আছে কিনা, তাও বলতে পারব না। শুধু জানি, রোগা লিকলিকে হাড্ডিসার ভাঁড়েরা কখনো নাম কিনতে পারেনি।

রাজামশায় কিন্তু স্থূল রসিকতা ভাল বুঝতেন। সূক্ষ্ম রসিকতার কদর বুঝতেন না। কনুইয়ের পুঁতো দিয়ে হাসাতে জানতেন, কথার কারিকুরি। দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারতেন না। বেশি সূক্ষ হাস্যপরিহাস সহ্য হত না–হাঁপিয়ে উঠতেন। মোদ্দা কথা, মৌখিক রঙ্গতামাশার চাইতে পছন্দ করতেন গাড়োয়ানি ইয়ার্কি।

এ গল্প যে সময়ের, তখন রাজরাজড়াদের সভাগৃহে মূর্খ ভড়েদের অভাব ছিল না। ভাঁড় না হলে রাজসভা জমত না। তারা চোখা চোখা বুলি আর ধারালো বুদ্ধি দিয়ে হাসির বোমা ফাটিয়ে ছাড়ত সভাগৃহ। রাজার অনুগ্রহ পেতে কে না চায়?

আমাদের এই রাজাটি একজন উজবুক ভাঁড় মোতায়েন রেখেছিলেন। সেরা উজবুক সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর উজবুক মন্ত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যে-নিজেকেও উজবুক শ্রেণী থেকে বাদ দেননি।

তাঁর সংগ্রহীত পেশাদার ভড় শুধু মূর্খ নয়, বিকৃত-অঙ্গ এবং বেঁটে বামন। ভাঁড়ের মত ভাঁড়। এ ভাঁড়ের দাম তিনগুণ তো হবেই। রাজসভায় বেঁটে বামন আকছার দেখা যেত সেকালে। বামনরা মূর্খই হয়। তাই তাকে ছাড়া রাজসভার একঘেয়েমি ঘুচতো না। যে কোন রাজসভার অলস দিনগুলো যেন ফুরতে চায় না–মনে হত বড্ড বেশি লম্বা। এ অবস্থায় রাজারা চাইত ভাঁড় আর বামন–দুজনকেই। ভাঁড় হাসাবে আর বামনকে দেখে হাসবেন। কিন্তু আগেই বলেছি, শতকরা নিরানব্বই জন ভাড়ই চালকুমড়োর মত বেঢপ মোটা হয়। সেক্ষেত্রে হপ ফ্রগ একাধারে তিন তিনটে গুণের অধিকারী হওয়ায় রাজার ভারী পছন্দ তাকে।

হপ-ফ্রগ এই বেঁটে বিকৃতাঙ্গ ভাঁড়ের নাম। এ নাম সাতজন মন্ত্রীর দেওয়া। কারণ, হপ-ফ্রগ সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। এক পায়ে ব্যাঙ তড়কা লাফ আর কেঁচোর মত কিলবিলিয়ে গতি-এই দুটো জুড়ে দিলে যে চলনভঙ্গী, হপ-ফ্রগ হাঁটে সেইভাবে। রাজার ধারণা তিনি অতি সুপুরুষ (যদিও তাঁর মাথা হাঁড়ির মত এবং পেট জালার মত।)-তাই কদাকার হপ ফ্রগকে দেখলেই যেন তাঁর কাতুকুতু লাগে।

পায়ের গড়ন অস্বাভাবিক হওয়ার দরুণ হপ-ফ্রগকে পথ চলতে হত ঐভাবে। কিন্তু ঈশ্বর তাকে দিয়েছিলেন বলিষ্ঠ মাংসপেশী সমৃদ্ধ একজোড়া বাহু। ফলে, গাছে উঠতে বা দড়ি বেয়ে ঝুলতে জুড়ি ছিল না তার। বাচ্চা। বাঁদর আর চঞ্চল বেঁজির মত অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় খেলা দেখাতে পারত দড়ি বা গাছে। তখন আর তাকে ব্যাঙ বলে মনে হত না।

হপ-ফ্রগ কোন দেশে জন্মেছিল জানি না। নিশ্চয় রাজার এলাকা থেকে অনেক দূরে কোন অসভ্য অঞ্চলে। জোর করে ধরে আনা হয়েছিল তাকে তার জন্মস্থান থেকে। আনা হয়েছিল আরো একটি বামন মেয়েকে। মাথায় সে হপ-ফ্রগের চেয়ে সামান্য খাটো। দুজনকেই উপহার পাঠানো হয়। রাজাকে খোসামোদ করার জন্য।

মেয়েটির নাম ট্রিপেটা। বামন হলেও নিখুঁত সুন্দরী সে। ভাল নাচতে পারত। সুতরাং সবাই ভালবাসত তাকে। হপ ফ ব্যায়ামবীর হলে কি হবে, কারোর সুনজরে ছিল না। ট্রাপেটা আর হপ-ফ্রগের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল দুজনেই বামন বলে। দুজনেই দুজনকে নানাভাবে উপকার করত।

কি একটা উপলক্ষে রাজার খেয়াল হলো মুখোশ-নৃত্যের আসর বসাবেন। এ সব ক্ষেত্রে হপ-ফ্রগ আর ট্রিপেটার ডাক পড়ে সবার আগে। কেননা দুজনেরই উর্বর মাথা থেকে নানারকম পরিকল্পনা বেরোয়। বিশেষ করে হপ-ফ্রগ এমন সব চরিত্র কল্পনা করত, জামাকাপড় বানাতো, মুখোশ নাচের ছন্দ আবিষ্কার করত-যা কেউ ভাবতেও পারে না।

উৎসবের রাত এসে গেল। কুঁড়েমির জন্যে রাজা এবং তাঁর সাত মন্ত্রী কিন্তু নিজেদের জন্যে কোন যোগাড়যন্ত্র করেননি। অথচ নিমন্ত্রিত অতিথিরা সাতদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে–হরেকরকম পোশাক আর মুখোশ বানিয়ে নিয়েছে। যে ঘরে নাচ হবে, সে ঘরটিও ট্রিপেটার তত্ত্বাবধানে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। সাজেন নি কেবল রাজা আর তার মন্ত্রীরা। রাত ঘনিয়ে আসতেই টনক নড়ল সবার। ডাক পড়ল দুই বামনের।

ওরা এসে দেখল মন্ত্রীদের নিয়ে মদ্যপানে বসেছেন রাজা। হপ-ফ্রগ মদ সহ্য করতে পারত না একদম। মদ খেলেই মাত্রা ছাড়া উত্তেজনায় তুরুক–নাচ নাচত, রাজা তা জানতেন। মজা দেখাবার জন্যে জোর করে ওকে মদ গেলাতেন।

সেদিনও হইহই করে উঠলেন হপ-ফ্রগকে দেখে–এসো, এসো। এক ঢোক খেয়ে যাও–মগজ সাফ হয়ে যাবে।

হপ-ফ্রগ রসিকতা করে পাশ কাটানোর চেষ্টা করল বটে, কিন্তু পারল না নাছোড়বান্দা রাজার সঙ্গে। সেদিন আবার ওর জন্মদিন। দেশের বন্ধু বান্ধবদের জন্যে মন কেমন করছিল। রাজা তা জেনেই খোঁচা মারলেন অদৃশ্য বন্ধুদের উল্লেখ করে।

বললেন, নাও, নাও। একটু গিলে নাও। মনে কর অদৃশ্য বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছ?

কথাটা তীরের মত বিধল হপ-ফ্রগের মনে। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে।

দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন সপারিষদ রাজামশায়। খুব হাসতে পারে তো হপ-ফ্রগ! হাপুসনয়নে কি রকম কাঁদছে দেখো!

কেঁদেও নিস্তার পেল না হপ-ফ্রগ। রাজার হাত থেকে মদের গেলাস নিয়ে খেতে হলো এক চুমুকে! দুচোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল সুরার কারণে।

ভীষণ মোটা প্রধানমন্ত্রী বললেন– এবার কাজের কথা।

হ্যাঁ, এবার কাজের কথা, বললেন রাজা। হপ-ফ্রগ, নতুন কিছু চরিত্র বাতলে দাও তো। বলে হেসে গড়িয়ে পড়লেন রাজা। অগত্যা হাসতে হলো সাত মন্ত্রীকেও।

হাসল হপ ফ্রগও। কিন্তু ফাঁকা হাসি।

হলো কি তোমার? অসহিষ্ণুভাবে বললেন রাজা–মাথা খেলছে না বুঝি?

ভাববার চেষ্টা করছি, বিমূঢ়ভাবে বলল হপ-ফ্রগ। মদ খেয়ে মাথা তার তখন বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে, ভাববার শক্তি নেই।

চেষ্টা করছো? মাথাটা এখনো সাফ হয়নি দেখছি–নাও, আর এক পেয়ালা খাও!

হপ-ফ্রগের তখন দম আটকে আসছে–চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে।

রেগে গেলেন রাজা–খেতে বলছি না?

দ্বিধায় পড়ল বামন। রেগে লাল হয়ে গেলেন রাজা। মন্ত্রীরা আরো উস্কে দিলেন তাঁকে। ভয়ে পার হয়ে গেল ট্রিপেটা। সে রাজার পায়ের কাছে বসল-মিনতি করে বলল বন্ধুকে ছেড়ে দিতে।

রাজা তো হতবাক! মেয়েটার স্পর্ধা তো কম নয়! কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঠেলে ফেলে দিয়ে মদের গেলাসের সবটুকু মদ ছুঁড়ে দিলেন ট্রিপেটার মুখের ওপর।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ট্রিপেটা। ক্ষীণতম দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল না। গিয়ে বসল টেবিলে।

আধমিনিটটাক কোনো শব্দ নেই। গাছের পাতা পড়লে বা পাখির পালক উড়ে এলেও শোনা যায়, এমনি নৈঃশব্দ। তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভঙ্গ হলো একটা চাপা দাঁত কড়মড়ানির শব্দে। মনে হলো যেন ঘরের চার কোণ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল ভয়াবহ শব্দটা।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রাজা। তেড়ে গেলেন হপ-ফ্রগকে–ফের যদি ও রকম আওয়াজ করবি তো–

হপ-ফ্রগ মদের নেশা কাটিয়ে উঠেছিল। রাজার চোখে চোখ রেখে বললে শান্তকণ্ঠে, আমি? এমন আওয়াজ করা আমার পক্ষে কি সম্ভব?

একজন মন্ত্রী বলল –আমার তো মনে হলো আওয়াজটা এল ঘরের বাইরে থেকে। কাকাতুয়া জানালা বা খাঁচা ঠোকরাচ্ছে বোধ হয়।

হতে পারে। গরগর করে বললেন নিষ্ঠুর রাজা। আমার কিন্তু মনে হলো ঐ বেঁটে বদমাসের মুখ থেকেই বেরোলো আওয়াজটা।

শুনেই বড় বড় দাঁত বের করে হেসে ফেলল হপ ফ্রগ। রাজা এমন হকচকিয়ে গেলেন যে সভার মাঝে ভাঁড়ের হাসি দেখে প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেলেন। তবে হপ-ফ্রগ শক্ত দাঁতের হাসি গোপন করে প্রশান্ত কণ্ঠে আরো মদ্যপান করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই রাজার রাগ জল হয়ে গেল।

এক পেয়ালা মদ চেঁ-চো করে মেরে দিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে মুখোশ নাচের অভিনব পরিকল্পনা শোনাতে বসল হপ-ফ্রগ। মদ খেয়ে তিলমাত্র বিকার ঘটেছে বলে মনে হলো না। জীবনে যেন মদ স্পর্শ করেনি, এমনি শান্ত, সমাহিত কণ্ঠে বললে –আইডিয়াটা মাথায় এল রাজামশায়ের মদ ছোঁড়া দেখে আর জানালার বাইরে কাকাতুয়ার ঠোঁটে বিচ্ছিরি আওয়াজটা শুনে। পরিকল্পনাটা একেবারেই অভিনব-গতানুগতিক নয় মোটেই। এ নাচ আমরা। নাচি আমাদের দেশে। কিন্তু এখানে এ জিনিস একদম নতুন-দরকার কিন্তু আট জন।

হো-হো করে হেসে রাজা বললেন–বারে আমরা তো আটজনই!

বিকৃত বামন বললে-–এ নাচের নাম শিকলবাঁধা আট ওরাংওটাং। অভিনয়ের ওপর নির্ভর করছে নাচের সার্থকতা।

করব! করব! ভাল অভিনয় করব! লাফ মেরে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন রাজা।

এ খেলায় সব চেয়ে বড় মজা হলো, মেয়েরা দারুণ ভয় পায়। বলল হপ-ফ্রগ।

তাই তো চাই! তাই তো চাই! সে কি আনন্দ আটজনের। হপ-ফ্রগ বলল –আপনাদের ওরাংওটাং সাজানোর ভার আমার। অবিকল ওরাংওটাং সেজে ঘরে ঢুকলে অভ্যাগতরা চিনতেও পারবে না আপনাদের মনে করবে সত্যিকারের ওরাংওটাং-পালিয়ে এসেছে খাঁচা ভেঙে। আপনারা মিছিমিছি তাড়া করবেন, বিকট চেঁচাবেন-দারুণ ভয় পাবে সকলে- চেঁচামেচি, হুটোপুটি শুরু হয়ে যাবে। ঘর ভর্তি মেয়ে-পুরুষরা দামী দামী জামাকাপড় পরে থাকবে-অথচ আপনারা আটজনে কদাকার সাজে সেজে থাকবেন। ফারাকটা অবিশ্বাস্য হওয়ায় মজা জমবে আরো বেশি।

ঠিক বলেছো, ঠিক বলেছো, বলে মন্ত্রীদের নিয়ে উঠে পড়লেন রাজা। অনেক দেরি হয়ে গেছে তৈরি হতে হবে তো!

.

খুব সহজেই আটজনকে ওরাংওটাং সাজিয়ে দিল হপ-ফ্রগ। আগে টাইট শার্ট আর পাজামা পরালো প্রত্যেককে। তার ওপর বেশ করে লাগাল আলকাতরা। একজন মন্ত্রী প্রস্তাব করলেন-পালক লাগানো হোক আলকাতরার ওপর। হপ-ফ্রগ আপত্তি করল পালক নয়, ওরাংওটাংয়ের গায়ের লোম নকল করতে পারে শুধু পাট। পাটের পুরু স্তর চেপে চেপে বসিয়ে দেওয়া হলো আলকাতরার ওপর। তারপর একটা শেকল জড়ানো হলো আটজনের কোমরে। গোল হয়ে দাঁড়াল আটজনে-এক শেকলে বাঁধা অবস্থায়। বাড়তি শিকলটা বৃত্তের মাঝখানে কোণাকুণি করে রেখে দুটি ব্যাস তৈরি করল হপ ফ্রগ। বোর্ণিতে শিম্পাঞ্জী ধরা হয় ঠিক এই কায়দায়।

ওরাংওটাং পৃথিবীর খুব কম লোকই দেখেছে। আটজনের অতি কদাকার বীভৎস সাজসজ্জা দেখে তাই কারো বোঝবার উপায় রইল না যে ওরা ছদ্মবেশী মানুষ সত্যিকারের বনমানুষ নয়।

যে ঘরে মুখোশ নাচ হবে, সেটি গোলাকার। ছাদের ঠিক মাঝখানে একটি মাত্র স্কাইলাইট দিয়ে সূর্যালোক আসে। সেখানে দিয়েই একটি শিকল মেনে এসেছে ঘরের মধ্যে। শিকল থেকে ঝোলে প্রকান্ড ঝাড়বাতি। তাতে জ্বলে মোমবাতি। শিকলটা ছাদের ফুটো দিয়ে বাইরে অদৃশ্য হয়েছে। কপিকলের সাহায্যে ভারী ঝাড় বাতিকে তোলা নামা করা হয় বাইরে থেকে।

এ ঘরের সাজসজ্জার ভার ট্রিপেটার ওপর। কিন্তু ঠান্ডা মাথা হপ-ফ্রগ তাকে বুদ্ধি জুগিয়েছে এ ব্যাপারে। তাই ঝাড়বাতিটাকে সরিয়ে ফেলা হলো ঘর থেকে। কারণ, এই গরমে মোমের ফোঁটা পড়ে অভ্যাগতদের মূল্যবান পোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তার বদলে দেয়ালে জ্বলতে লাগল পঞ্চাশ যাটটা বড় মশাল।

রাত বারোটার সময়ে পাশবিক চিৎকার করতে করতে আটটা ওরাংওটাং ঢুকল সেই ঘরে। ঘরে তখন আর তিল ধারণের জায়গা নেই। সঙ্গে সঙ্গে রাজার হুকুমে সব কটা দরজা বন্ধ করে চাবিটা দেওয়া হল হপ-ফ্রগের হাতে।

আতঙ্ক চরমে উঠল আটটা বীভৎস মূর্তি দেখে আর তাদের অপার্থিব হুঙ্কার শুনে। বুদ্ধি করে আগেই রাজা হুকুম দিয়েছিলেন, অভ্যাগতরা অস্ত্র বাইরে রেখে ঘরে ঢুকবেন। নইলে তৎক্ষণাৎ অস্ত্রাঘাতে নিহত হতেন। সপারিষদ রাজামশায়।

সেকী হট্টগোল! ঠেলাঠেলিতে ছিটকে পড়ল নরনারীরা! ঝনঝন শব্দে শিকল বাজিয়ে এলোপাতারি ছুটছে আট ওরাংওটাং। কারো খেয়াল নেই। ছাদের দিকে। থাকলে দেখতে পেত ঝাড়বাতির সেই শিকলটা আস্তে আস্তে নেমে আসছে মেঝের দিকে-ডগায় ঝুলছে একটা হুক!

ঠিক সেই সময়ে হুল্লোড় করতে করতে আর মনে মনে পেট ফাটা হাসি হাসতে হাসতে রাজা আর মন্ত্রীরা এসে পড়লেন ঝুলন্ত হুকের তলায়। তৈরি হয়ে ছিল হপ-ফ্রগ। টুক করে হুকটা আটকে দিল কোণাকুণিভাবে লাগানো শিকল দুটির ঠিক মাঝখানে। তৎক্ষণাৎ হ্যাঁচকা টানে নাগালের বাইরে উঠে স্থির হয়ে গেল হুকটা। ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হলো আটজন ওরাংওটাং।

প্রথমে চমকে উঠলেও এখন হো হো করে হেসে উঠল অভ্যাগতরা। এতক্ষণে সবাই বুঝল, পুরো ব্যাপারটা সাজানো এবং হাস্যরসের জন্যই পরিকল্পিত। নরবানরদের দুর্গতি দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল প্রত্যেকের।

হাসির অট্টরোল ছাপিয়ে শোনা গেল হপ-ফ্রগের তীক্ষ্ণ চীঙ্কার-ওদের ভার আমার! আমি ওদের চিনি–আপনাদেরও চিনিয়ে দেব এখুনি।

বলেই, হঁচড় পাঁচড় করে উঠে গেল অভ্যাগতদের ঘাড়ের ওপর। ঘাড়ে পা দিয়েই লাফাতে লাফাতে গেল দেওয়ালের কাছে-একটা জ্বলন্ত মশাল খামচে ধরে ফিরে এল সেই পথেই। এক লাফে গিয়ে উঠল রাজার মাথায়। সেখান থেকে বিদ্যুৎগতিতে শিকল বেয়ে উঠে গেল খানিকটা ওপরে। তারপর মশালটা নামিয়ে ওরাংওটাংদের মুখ দেখতে দেখতে বলল বিষম তীব্র কণ্ঠে–বলছি, বলছি, এখনি বলছি ওরা কারা!

আটজন ওরাংওটাং সমেত অভ্যাগতরা তখন বেদম হাসিতে লুটিয়ে পড়তে পড়লে বাঁচে। হাসাতেও পারে বটে ভাঁড়টা! ঠিক তখনি তীক্ষ্ম শিষ দিয়ে উঠল হপ-ফ্রগ। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হাতের হ্যাঁচকা টানে তিরিশ ফুট ওপরে উঠে গেল শিকলটা, টেনে তুলে নিয়ে গেল আট ওরাংওটাংকে ছটফট করতে লাগল আটটা মিশমিশে কালো কুৎসিত মূর্তি ছাদের স্কাইলাইটের কাছে।

হপ-ফ্রগ কিন্তু তখনো নির্বিকারভাবে ঝুলছে শিকল ধরে এবং যেন কিছুই হয় নি এমনিভাবে জ্বলন্ত মশাল নাড়ছে ওরাংওটাংদের মুখের কাছে।

সব চুপ। ঘর নিস্তব্ধ। দারুণ অবাক হয়ে অভ্যাগতরা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখছে নতুন খেলা। উঁচ পড়লেও তখন শোনা যায়, এমনি স্তব্ধতা বিরাজ করছে অত বড় ঘরে।

আচমকা সেই থমথমে নৈঃশব্দ ভঙ্গ করে শোনা গেল একটা আশ্চর্য শব্দ। দাঁতে দাঁতে পেষার রক্ত জল করার আওয়াজ। ঠিক এই শব্দই শোনা গিয়েছিল রাজামশায় যখন মদ ছুঁড়ে ভিজিয়ে দিয়েছিলেন ট্রিপেটার মুখ। তখন শব্দের উৎস ধরা যায় নি-এখন ধরা গেল।

আওয়াজটা আসছে হপ-ফ্রগের দাঁতের পাটির মধ্য থেকে। শূদন্তের মত দাঁত কিড়মিড় করছে হপ-ফ্রগ, মুখের কোণ দিয়ে বেরুচ্ছে ফেনা-জ্বলন্ত চোখে উন্মত্ত ক্রোধে চেয়ে আছে রাজা আর তাঁর সাত মন্ত্রীর ঊর্ধ্বমুখের পানে।

অমানবিক কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল বেঁটে বামন-চিনেছি! চিনেছি! এবার তোদের চিনেছি! বলে, জ্বলন্ত মশালটা নামিয়ে মুখ দেখার অছিলায় আগুন ধরিয়ে দিল রাজার গায়ে। আধমিনিটের মধ্যেই আটজনের আলকাতরা ভিজানো পাটের সাজ জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। নীচের শিহরিত আতঙ্কিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা শুধু গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েই গেল প্রতিকার করতে পারল না।

আগুন লেলিহান হয়ে উঠল। গা বাঁচাতে শিকল বেয়ে বানরের মত ক্ষিপ্রগতিতে ওপরে উঠে গেল বেঁটে–আবার দম বন্ধ করা নীরবতা নেমে এল ঘরে। জনতা মূক হয়ে চেয়ে রইল অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যের দিকে।

তীব্র কণ্ঠে বলল বামন ভাড়-শুনুন আপনারা, শুনুন। এরা কারা এখন চিনতে পারছেন? রাজা আর তার সাত মন্ত্রী। অসহায় একটি মেয়েকে আঘাত করতে রাজার বিবেকে আটকায়নি। মন্ত্রীরা বাধা দেয়নি-বরং উসকে দিয়েছে। আর আমি? আমি হপ-গ-আপনাদের ভড়। কিন্তু এই আমার শেষ ভাঁড়ামো!

পাটের সাজ তখন আরো জোরে পটপট শব্দে জ্বলছে। আটটা কদর্য মাংসপিন্ড একত্রে ঝুলছে শেকলের প্রান্তে। পুড়ে কালো হয়ে চেনা দায়। বিকৃত বামন জ্বলন্ত মশাল জ্বলন্ত দেহগুলোর ওপর ছুঁড়ে মেরে অলস ভঙ্গিমায় উঠে গেল আরো ওপরে বেরিয়ে গেল স্কাইলাইট দিয়ে।

ছাদে দাঁড়িয়েছিল ট্রিপেটা। কপিকল ঘুরিয়ে সে-ই তুলেছে। ওরাংওটাংদের। প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করেছে হপ-ফ্রগকে। দুই বন্ধু ছাদ থেকে নেমে পালিয়ে গেল স্বদেশে-আর তাদের দেখা যায় নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *