দ্য মেন হু উড বি কিং – রাডিয়ার্ড কীপলিং

দ্য মেন হু উড বি কিং – রাডিয়ার্ড কীপলিং

যে গল্পটি বলতে যাচ্ছি তার শুরু একটি ট্রেনে। ট্রেনটি মাহা থেকে আজমীর যাচ্ছিল। পকেটে মালপানি কম ছিল বলে মধ্যম শ্রেণীর যাত্রী হয়েছিলাম আমি। মধ্যম শ্রেণীতে আরাম-আয়েশের কোন ব্যবস্থা নেই। নিতান্ত দরিদ্র শ্রেণীর লোকজন ছাড়া এতে কেউ যাতায়াতও করে না। আর আমি সেই শ্ৰেণীরই মানুষ। ভ্যাগাবন্ড টাইপের, কোন পিছু টান নেই, পেটে টান পড়লে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজটাজ জুটিয়ে নিতে পারি।

মধ্যম শ্রেণীতে এবারের ভ্রমণটা অবশ্য আমার কাছে আরামদায়কই মনে হচ্ছিল। কারণ নাসিরাবাদ পর্যন্ত কেউ আমার কমপার্টমেন্টে ওঠেনি, হাত-পা ছড়িয়েই আসতে পারছিলাম।

নাসিরাবাদ পৌঁছানোর পরে এক লোক উঠল। চেহারাসুরতে আমার মতোই ভ্যাগাবন্ড টাইপের। আর ভয়ানক বাক্যবাগীশ। ভারতবর্ষের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়ল সে যাত্রার শুরুতেই। আর এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে সে কথা বলতে ছাড়ল না। এক পর্যায়ে সে আমাকে ধরে বসল আজমীর থেকে ফেরার পথে আমি যেন অবশ্যই মারোয়ার জংশনে, বোম্বে মেইলের একটি কক্ষে উঁকি মেরে দেখি। কারণ সে তার জন্যে কিছু জিনিস নিয়ে আসবে।

আমার সেই মেসেঞ্জার, বলল আমার নতুন যাত্রী, লাল দাড়িঅলা দীর্ঘদেহী পুরুষ। একটা সেকেন্ড ক্লাস কমপার্টমেন্টে হাত-পা ছড়িয়ে তাকে ঘুমাতে দেখবেন আপনি। আপনার কাজ হবে তার কমপার্টমেন্টের জানালা খুলে সে হপ্তাখানেকের জন্যে দক্ষিণে চলে গেছে, এই কথাটি শুধু বলা। আপনার মায়ের কসম, কাজটা আমার জন্যে আপনি করবেন। তা হলে আমার খুব উপকার হবে।

সমস্যা হলো আমি সহজে কাউকে না বলতে পারি না। আর লোকটা যেভাবে আমাকে মিনতি করছিল, খারাপই লাগছিল বলা যায়। শেষে তাকে কথা দিতে বাধ্য হলাম, কাজটা আমি করব। সে খুশি হয়ে রাস্তার ধারে একটি ছোট স্টেশনে নেমে পড়ল। আর আমাকে নিয়ে ট্রেন ছুটে চলল আজমীরের দিকে।

আজমীরে কিছু কাজ ছিল আমার, সেগুলো সেরে নাইট মেইলে চড়ে রওনা হয়ে গেলাম গ্রেট ইন্ডিয়ান ডেজার্ট অভিমুখে। প্রতিশ্রুতি মাফিক নেমে পড়লাম মারোয়ার জংশনে। এখানে নেটিভদের তৈরি একটি রেলওয়ে। আছে, ট্রেন যোধপুর পর্যন্ত যায়। বোম্বে মেইল মারোয়ার জংশনে খানিক বিরতির জন্যে থেমে দাঁড়ায়।

বোম্বে মেইল এই স্টেশনে এসে থামা মাত্র আমি ক্যারিজের দিকে এগিয়ে গেলাম। ট্রেনে সাকুল্যে একটাই সেকেন্ড ক্লাস। আমি কমপার্টমেন্টের জানালা নামিয়ে দেখি লাল দাড়িঅলা এক লোক ট্রেনের কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। দেখেই বুঝলাম এ সেই লোক। তার বুকের খাঁচায় খোঁচা দিলাম আলতো করে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল লাল দাড়ি, ঘোত-ঘোত করতে করতে বলল, আবার টিকেট?

না, জবাব দিলাম আমি। আমি আপনাকে বলতে এসেছি সে হপ্তাখানেকের জন্যে চলে গেছে দক্ষিণে। কথাটা পুনরাবৃত্তি করলাম আবার জোরে।

এদিকে ট্রেন নড়তে শুরু করছে। লাল দাড়ি দুহাতে চোখ ঘষছে। সে হপ্তাখানেকের জন্যে চলে গেছে দক্ষিণে? কথাটা রিপিট করল সে। সে তো যাবেই। ওটাই তার কম্ম। ভালো কথা, সে কি কিছু দিতে বলেছে। আপনাকে? কিন্তু আমি দেব না।

না, বলেনি, বলে চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। তাকিয়ে রইলাম অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে থাকা ট্রেনের পেছনের লাল বাতি দুটির দিকে। ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে, বাতাস বালু ওড়াচ্ছে। আমি এবার নিজের ট্রেনে চড়ে বসলাম, তবে মধ্যম শ্রেণীতে নয়। লোকগুলোর ব্যাপারে আর কৌতূহল দেখালাম না। কিন্তু জানতাম না এদের সাথে আবার আমার অদ্ভুতভাবে দেখা হয়ে যাবে। এক আশ্চর্য গল্প জন্ম নেবে এ থেকে। সে কথাতেই এবারে আসছি।

শুরুতেই বলেছি আমি ভ্যাগাবন্ড, যখন পেটের টান পড়ে একটা কিছু কাজ জুটিয়ে নিই।

এবার একটা খবরের কাগজে ফোরম্যানের চাকরি হলো আমার। একদিন ফোরম্যানের ডিউটি পালন করতে গিয়ে সেই লোকগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেই দুজন, যাদের এক জনের সাথে আমার ট্রেনে দেখা হয়েছিল।

সেই লোকটি বেঁটেখাটো। তার সঙ্গী সেই লালদাড়ি। তবে ওদের দেখে আমি খুশি হতে পারলাম না। কারণ সারা রাত ডিউটির পরে এখন আমার ঘুমের সময়। এখন এদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তা ছাড়া এরা আমার এমন ঘনিষ্ট কেউ নয় যে, এদের জন্যে ঘুম নষ্ট করতে হবে। অবশ্য এদের দেখে আমার এড়িয়ে যাবার চেষ্টার পেছনে একটা কারণও আছে। বেঁটে লোকটা, অর্থাৎ আমার ট্রেনের সেই সহযাত্রী ডেগুম্বরের রাজাকে ব্ল্যাকমেইল করার পরিকল্পনা করেছিল। সে ব্যাকউডসম্যান নামের পত্রিকায় ভুয়া সাংবাদিক সেজে কাজটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তার পরিকল্পনার বাদ সাধি। ফলে ব্ল্যাকমেইলিং-এর প্ল্যান ভুল হয়ে যায় তার। এ কারণে আমার ওপর রাগ ছিল তার।

তাই তাকে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠছিলাম। অবশ্য অতীত প্রসঙ্গের ধারে কাছ দিয়েও গেল না সে। হয়তো নতুন ফন্দি এঁটেছে, আমার সাহায্য দরকার। আমার ধারণাই ঠিক। লাল দাড়ি বলল, তোমার কাছে এসেছি একটা সাহায্যের জন্যে। আগেই বলে রাখি, ডেগুম্বরের মতো কোনো ঘটনা যেন ঘটাতে যেয়ো না। তা হলে কিন্তু খবর আছে, হ্যাঁ।

জবাবে আমি কিছু বললাম না, চুপ করে রইলাম। এবার কথা বলল আমার ট্রেনের সঙ্গী, বেঁটেখাটো লালচুলো মানুষটা। বলল, কথা শুরুর আগেই নিজেদের পরিচয় দিয়ে নিই। এ হলো আমার ভাই ড্যানিয়েল ড্রাভট আর আমি পিচি কার্নেহান। আমাদের পেশা সম্পর্কে যত কম মুখ খুলব। ততই মঙ্গল। তবে আমরা এমন কোনো কাজ নেই যা করিনি। সৈনিক, নাবিক, কম্পোজিটর, ফটোগ্রাফার, প্রুফরিডার, ফেরিঅলা, সাংবাদিক সব ধরনের পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। আমরা সারা ভারতবর্ষ চষে বেরিয়েছি। বেশিরভাগ সময়ই পায়ে হেঁটে। তবে এ জীবন আমাদের আর ভালো লাগে না। তাই ঠিক করেছি রাজা হব।

রাজা হবে? অবাক হয়ে গেলাম আমি। বললেই রাজা হওয়া যায় নাকি?

অবশ্যই যায়। বলল ড্রাভট। রাজা হবার স্বপ্ন আমরা দেখে আসছি গত ছমাস ধরে। কোন দেশের রাজা হওয়া যায় সন্ধান পাবার জন্যে আমরা বই-পত্র, মানচিত্র সব ঘেঁটেছি। শেষে এমন একটা জায়গার সন্ধান পেয়েছি, যেখানে আমাদের মতো করিকর্মা মানুষের পক্ষে রাজা হওয়া সহজ কাজ। জায়গাটার নাম হলো কাফিরিস্তান। যতদূর জানি এটা আফগানিস্তানের সর্বানে, পেশোয়ার থেকে তিন শ মাইল দূরে। ওখানে স্লেচ্ছ লোকদের বাস। আমরা ওখানেই ঘাটি করব। পাহাড়ি এলাকা, আর মেয়েগুলো বেশ সুন্দরী।

কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের চুক্তির বাইরে। বলল কার্নেহান। মদ কিংবা মেয়েমানুষ স্পর্শ করা যাবে না, ড্যানিয়েল।

জানি সেটা। আমরা ওখানে গিয়ে অশিক্ষিত লোকগুলোকে সহজেই বশ করতে পারব। তারপর এক সময় রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেরাই রাজা হয়ে যাব।

আরে, সীমান্ত থেকে পঞ্চাশ মাইল ভেতরে যেতে পার কিনা তাই। দেখ, ব্যঙ্গ করলাম আমি। স্রেফ কচু কাটা হয়ে যাবে। ওই দেশে পৌঁছুতে তোমাদের আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ওখানে শুধু পাহাড় আর গ্লেসিয়ার। কোনো ইংরেজ আজতক আফগানিস্তান পাড়ি দিতে পারেনি। পাহাড়ি লোকগুলো ভয়ানক হিংস্র স্বভাবের। ওখানে যেতে পারলেও কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

তুমি আমাদের পাগল ভাবতে পার, বলল কার্নেহান, তাতে বরং আমরা খুশিই হব। যাকগে আমরা যে জন্যে এসেছি তোমার কাছে সেটা শোন। তুমি আমাদের এই দেশটা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দাও। আর ওদের ম্যাপটা দেখাও। আমরা বইটই পড়তে পারি। তবে তোমার মতো শিক্ষিত নই।

আমি ওদের অনুরোধে ভারতের বিশাল ম্যাপটা খুলে বসলাম, দুটো ফ্রন্টিয়ার ম্যাপও দেখালাম। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে ইনফকান ভল্যুম পড়েও শোনালাম।

এই যে, এখানে, ম্যাপে বুড়ো আঙুল ঠেকাল ড্রাভট। জগদ্দালকের কাছে, পিচি আর আমি রাস্তাটা ভালো করেই চিনি। রবার্টের সেনাবাহিনীর সঙ্গে গিয়েছিলাম ওখানে। জগদ্দালক থেকে ডানে মোড় নিয়ে ল্যাংমান অঞ্চল দিয়ে এগোতে হবে। তারপর চৌদ্দ-পনেরো হাজার ফুট উঁচু পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। ওখানে নিশ্চয়ই এ সময় খুব ঠান্ডা পড়বে। ম্যাপে দেখলে বোঝা যায় না জায়গাটা কতদূর।

দেশটা সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। বললাম আমি। নাও, ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের এই লেখাটা পড়।

কার্নেহান লেখাটা পড়ল। বলল, ড্যান, এ দেশে বেশিরভাগই দেখছি চ্ছে। তবে বইতে লিখেছে ইংরেজদের সাথেই ওদের সম্পর্ক রয়েছে।

ঠিক আছে, বলল ড্রাভট, যা জানার মোটামুটি জেনে নিয়েছি। এখন চারটে বাজে। তুমি ইচ্ছে করলে ঘুমিয়ে নিতে পার। ভয় নেই, তোমার কোনকিছু নিয়ে কেটে পড়ব না। কাল সন্ধ্যায় আমরা রওনা হয়ে যাব, ইচ্ছে করলে সেরাইতে এসো। দেখা হবে।

তোমরা আসলে পাগল হয়ে গেছ, বললাম আমি। ভালো চাইলে ফিরে এসো নইলে কপালে সত্যি দুর্গতি আছে তোমাদের।

তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। বলল ড্যান। ইচ্ছে হলে সেরাইতে এসো। না হলে নাই।

ওদের সাথে আর তর্ক করতে মন চাইল না। দুজনকে আমার অফিস রুমে রেখে বাড়ি ফিরে এলাম। খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাতে হবে।

কুমহারসেন সেরাই হলো বড় একটা বাজার। এখানে উত্তর থেকে পণ্য নিয়ে উট আর ঘোড়ার দল আসে। পন্য খালাস হয়, পূর্ণ হয় সেরাই বাজারে। মধ্য এশিয়ার প্রায় সব জাতের মানুষের মিলন মেলা এ বাজার। তবে বেশিরভাগই ভারতের গ্রামের লোকজন। বলখ আর বোখারা এখানে মিলিত হয় বেঙ্গল এবং বোম্বের সাথে। এমন কোনো জিনিস নেই যা সেরাইতে পাওয়া যায় না। অনেক অদ্ভুত জিনিসও মেলে যা মানুষের কাজে লাগে না। আমি পরদিন বিকেলে এখানে এলাম দেখতে ওরা দুজন সত্যি সেরাইতে এসেছে নাকি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে শুয়ে আছে বাড়িতে।

আমাকে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দুই শ্রীমানই ছদ্মবেশ নিয়ে হাজির হয়ে গেল সেরাইতে। একজন সেজেছে ধর্মযাজক, অন্যজন তার ভৃত্য। ছদ্মবেশি ধর্মযাজক অনেকগুলো মাটির খেলনা নিয়ে এসেছে। সেরাই-এর লোকজন তাকে দেখে হাসাহাসি শুরু করে দিল।

এক ঘোড়া ব্যবসায়ী আমাকে বলল, প্রীস্ট আসলে একটা পাগল। কাবুল যাচ্ছে আমিরের কাছে খেলনা বিক্রি করতে। হয় আমির ওকে খাতির করবেন নতুবা কল্লা নামিয়ে দেবেন। লোকটা আজ সকালে এসেছে। এসেই পাগলামী শুরু করে দিয়েছে।

আমি জবাবে কিছুই বললাম না। রাজপুতনার ঘোড়া ব্যবসায়ী ইউসুফ জাই হেঁড়ে গলায় বলল, ওহে, যাজক মশাই, কোত্থেকে এসেছেন আপনি, যাবেনই বা কোথায়?

এসেছি রোয়াম থেকে, হাতে একটা লাঠি বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে জবাব দিল প্রীস্ট। এসেছি অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করে। তবে কোনো কিছুই আমাকে দমাতে পারেনি। যাব উত্তরে আমিরের কাছে। আমাকে কি কেউ সেখানে নিয়ে যেতে পারবে। তা হলে তাকে আমি দোয়া করব। এমন দোয়া করব যাতে তার উটের দল কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়বে না। তার সন্তান কখনো অসুস্থ হবে না। স্ত্রী থাকবে বিশ্বস্ত।

হুজুর, ইউসুফ জাই বলল, দিন কুড়ির মধ্যে একটা ক্যারাভান রওনা হবে পেশোয়ার থেকে কাবুলের পথে। আমার উটের দলও যাবে তাদের সাথে। আপনি ইচ্ছে করলে যেতে পারেন।

আমার এখনই যাওয়া দরকার। হুংকার ছাড়ল প্রীস্ট। আমি আমার ডানাঅলা উটের পিঠে চড়ে এক দিনের মধ্যে পেশোয়ার পৌঁছে যেতে পারি। ওহে হাজার মির খান, চেঁচাল সে তার চাকরকে উদ্দেশ্য করে, উটগুলো বের কর। তবে সবার আগে আমাকে চড়তে দাও।

পশুটা হাঁটু গেড়ে বসল, এক লাফে তার পিঠে উঠল প্রীস্ট, আমার দিকে ঘুরে হাঁক ছাড়ল, ইচ্ছে করলে আপনিও সঙ্গে আসতে পারেন, সাহেব। কিছুটা রাস্তা না হয় এক সাথে গেলাম। আপনাকে এমন এক কবচ দেব যা আপনাকে কাফিরিস্তানের রাজা বানিয়ে দেবে।

ভণ্ড প্রীস্ট আর কী করে দেখার আগ্রহ নিয়ে ওর সাথে উঠের পিঠে চড়ে বসলাম। সেই থেকে বেরিয়ে একটা খোলা রাস্তায় এসে বাহনের রাশ টেনে ধরল প্রীস্ট।

বুদ্ধিটা কেমন বের করেছি, বল তো? বলল সে ইংরেজিতে। কার্নেহান ওদের ভাষা জানে না। তাই ওকে আমার চাকর বানিয়ে দিয়েছি। আমরা এরপর একটা ক্যারাভান ধরব পেশোয়ারের, জগদ্দালক পর্যন্ত যাব, তারপর ঘোড়া বা গাধা যা-ই পাই, ওতে চড়ে ঢুকে পড়ব কাফিরিস্তানে। আমিরের জন্যে জিনিস নিয়ে যাচ্ছি বটে। একবার বস্তাগুলোয় হাত বুলিয়েই দেখ না।

আমি বস্তায় হাত দিতেই মার্টিনির একটা বাট ঠেকল, তারপর একটা, তারপর আরো একটা।

মোট বিশটা বন্দুক, গর্বের সাথে বলল ড্রাভট।

লাটিম আর মাটির পুতুলের নিচে লুকিয়ে প্রচুর গোলাবারুদও নিয়ে যাচ্ছি।

একবার এই জিনিস নিয়ে ধরা পড়লে তোমাদের কিন্তু খবর হয়ে যাবে, বললাম আমি। পাঠানদের কাছে একটা মার্টিনির মূল্য তাদের নিজের ওজনের সমান রুপোর মতো।

শোন, বহু কষ্টে যোগাড় করা পনেরো শ রুপী এই উট দুটোর পেছনে ব্যয় করেছি, বলল ড্রাভট। কাজেই সহজে ধরা পড়ছি না। আমরা খাইবার গিরিপথ ধরে যাব রেগুলার ক্যারাভানের সাথে। একজন গরিব প্রীস্টকে কে সন্দেহ করবে বা ঘাটতে আসবে?

যা যা চেয়েছিল সব পেয়েছ? জানতে চাইলাম আমি।

সব পাইনি, তবে পেয়ে যাব। কবে আবার দেখা হবে জানি না, দোস্ত। তাই তোমার স্মৃতি হিসেবে কিছু দাও আমাকে। তোমাকে আমার সত্যি ভালো লেগেছে।

আমি ঘড়ির চেইন থেকে কম্পাসটা খুলে ড্রাভটকে দিলাম। সে খুব খুশি হলো। আন্তরিকতার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, বিদায়, কার্নেহান, দোস্তের সাথে হাত মিলাও।

দ্বিতীয় উটে ছিল কার্নেহান। সে-ও আমার সাথে হাত মিলাল। তারপর দুজনে মিলে অদৃশ্য হয়ে গেল ধূলি ধূসরিত পথে। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরা যে ছদ্মবেশ নিয়েছে তাতে ধরা পড়ার ভয় ক্ষীণ। সেরাইতেই এর প্রমাণ পেয়েছি। হয়তো কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করেই কার্নেহান এবং ড্রাভট আফগানিস্তানে ঢুকতে পারবে। তবে কোনোভাবে যদি ধরা পড়ে যায় তা হলে ওদের কপালে কঠিন মৃত্যু লেখা আছে।

দিন দশেক পরে আমার স্থানীয় এক বন্ধুর চিঠি পেলাম পেশোয়ার থেকে। সে লিখেছে, এক পাগলা প্রীস্টের কান্ডকারখানায় এখানে দিন কয়েক মানুষজন খুব হাসাহাসি করেছে। এই লোক জপমালা নিয়ে যাচ্ছে বোখারার আমিরের কাছে বিক্রি করতে। সে কাবুলগামী এক ক্যারাভানের সঙ্গী হয়েছে পেশোয়ার থেকে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা তাকে সাথী হিসেবে পেয়ে অখুশি নয়। কারণ এরা সবাই কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তাদের ধারণা একজন ধর্মযাজক সাথে থাকলে রাস্তায় বিপদ-আপদ হবে না।

ওরা হয়তো এত দিনে সীমান্ত ছাড়িয়েছে, ভাবলাম আমি। তবে ওদের নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবার সময় হলো না। কারণ ওই সময় ইউরোপের একজন রাজা মারা যাবার কারণে সেই খবর নিয়ে খবরের কাগজের আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।

.

সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। রাত গড়িয়ে দিন হয়, কালের আবর্তে বদলায় ঋতু। গ্রীষ্ম শেষে শীত আসে, তারপর বসন্ত…এভাবে যায় সময়। চাকরিতে দেখতে দেখতে দুবছর হয়ে গেল আমার। এই সমযের মধ্যে কয়েকজন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলেন, আমার প্রেসের যন্ত্রগুলো আরো জীর্ণ হলো, অফিসের বাগানের গাছগুলো লম্বায় আরো খানিকটা বাড়ল।

একদিন, বেলা তিনটার দিকে অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ছাপা বন্ধ হুকুম দিয়ে অফিসে ঢুকেছি আমি, দেখি একলোক শরীরটা ঝুঁকিয়ে কাঁধের মধ্যে মালা ঢুকিয়ে মৃদু-মৃদু দুলছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুলে চাইল সে, ফিসফিস করে বলল, আমাকে একটা ড্রিঙ্ক দিতে পার? ঈশ্বরের দোহাই, তেষ্টায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

আমি ঘরের বাতি জ্বেলে দিলাম।

আমাকে চিনতে পারছো না? ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে, মুখ দিয়ে হাঁপিয়ে ওঠার মতো শব্দ করল। আলোতে এবার তার মুখটা দেখতে পেলাম। মাথার চুল ধূসর, চেহারা ভীষণ বিবর্ণ। চেনা-চেনা লাগল আগন্তুককে, কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না।

তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না, হুইস্কির গ্লাসটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। তোমার জন্যে কী করতে পারি?

তরল আগুনটা এক ঢোক গিলল সে, এত প্রচণ্ড গরমেও কেন জানি শিউরে উঠল।

আমি চলে এসেছি, বলল সে, আমি রাজা ছিলাম কাফিরিস্তানের আমি এবং ড্রাভট –মুকুট পরা রাজা! এই অফিসে শলা পরামর্শ করেছিলাম আমরা–তুমি ওখানে বসেছিলে, আমাদের হাতে বই দিয়েছ। আমি পিচি পিচি টালিয়াফেরো কার্নেহান, তুমি এখনো এখানেই পড়ে আছ–ওহ্! লর্ড!

এবার আর ওকে চিনতে কষ্ট হলো না। অবাক ভাবটা গোপন করে ওকে সহানুভূতি জানাবার চেষ্টা করলাম।

ঘটনা সত্য, কর্কশ গলায় বলল কার্নেহান, ছেঁড়া তেনায় ব্যান্ডেজ করা পায়ে হাত বোলাচ্ছে। বাইলেলের মতোই সত্য ঘটনা। আমরা রাজা হয়েছিলাম, মাথায় রাজমুকুটও পরেছি-আমি এবং ড্রাভট-বেচারা ড্যান–আহা, বেচারা, কখনো আমার পরামর্শ নিতে চাইত না, শত অনুরোধ। করলেও!

হুইস্কিটা শেষ কর, বললাম আমি। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সম্ভব হলে পুরো ঘটনা আমাকে খুলে বল। তোমরা সীমান্ত পার হয়েছ জানতাম। ড্রাভট পাগলা গ্রীস্টের ছদ্মবেশ নিয়েছিল, তুমি সেজেছিলে তার চাকর। মনে। আছে?

আমি এখানে পাগল হইনি–তবে হয়তো শ্রীঘই মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটবে। আমার। সব মনে আছে আমার। সব বলব তোমাকে। আমার চোখের দিকে তাকাও। নইলে হয়তো উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করব আমি।

আমি ওর দিকে তাকালাম। কার্নেহান একটা হাত রাখল টেবিলের উপর, কব্জিটা ধরলাম আমি। পাখির থাবার মতো কুঁচকে গেছে হাতের চামড়া, উল্টোপিঠে হীরের ছাপের দগদগে, লাল ঘা।

ওদিকে না। আমার চোখের দিকে তাকাও। বলল কার্নেহান।

এ ব্যাপারটা পরে ব্যাখ্যা করব তোমাকে। তবে ঈশ্বরের দোহাই, আমার মাথার গোলমাল করে দিও না। আমরা ওই ক্যারাভানের সাথে রওনা হয়ে যাই, আমি এবং ড্রাভট। সাথের লোকজনদের ভেড়া বানিয়ে রাখার জন্যে নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলাম দুজনে। সেগুলো বেশ কাজেও লেগেছে। ড্রাভট সন্ধ্যাবেলায় মজার মজার গল্প বলে সবাইকে খুব আনন্দ দিত। একবার হাসতে-হাসতে তো ড্রাভটের লম্বা দাড়িতে আগুনই ধরে গিয়েছিল। সে নিয়েও কত হাসাহাসি।

তোমরা তো জগদ্দালক পর্যন্ত গিয়েছিলে, বললাম আমি।

ওখান থেকে কাফিরিস্তানে ঢুকলে কী করে?

না, জগদ্দালকে আমরা যাইনি। ওদিকে রাস্তাঘাট ভালো শুনলেও পরে দেখি উট চলার মতো ভালো নয়। আমরা ক্যারাভান ছেড়ে একা এগোবার সময় ড্রাভটের পরামর্শে স্থানীয় স্ট্রেচ্ছদের ছদ্মবেশ নিই। ড্রাভট বলেছিল কাফিররা পাদ্রী বা ধর্মযাজকের ছদ্মবেশ পছন্দ নাও করতে পারে। আমরা এমনকি মাথাও কামিয়ে ফেলি। ওই দেশটা ছিল পর্বত সঙ্কুল, খাড়া চড়াই উত্রাই পার হতে পারছিল না আমাদের উট দুটো। শেষে উট দুটোকে মেরে ফেলতে হয়। আমরা উটের মাংসও খেয়েছি। শেষে এত অস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে কি করব ভেবে যখন দিশা পাচ্ছিলাম না, এমন সময় দেখলাম দুটো লোক চারটে খচ্চর নিয়ে আসছে। ড্রাভট ওদের কাছে গিয়ে বলল, আমার কাছে খচ্চরগুলো বিক্রি করে দাও। তখন একজন বলল, খচ্চর কেনার টাকা যখন তোমাদের আছে, বোঝাই যাচ্ছে তোমরা বেশ ধনী। এই বলে সে ডাকাতি করার চেষ্টায় ড্রাভটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ড্রাভট ওকে ধরে এমন আছাড় দেয়, এক আছাড়েই সে শেষ। বাকি লোকটা সঙ্গীর অমন দশা দেখে চো চো দৌড় দেয়। আমরা তখন খচ্চরের গায়ে অস্ত্রের বোঝা চাপিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে দিই।

এ পর্যন্ত বলে কার্নেহান বিরতি দিল। আমি ওকে আরেক গ্লাস হুইস্কি। ঢেলে দিলাম। জানতে চাইলাম ও দেশের প্রকৃতির কথা তার কিছু মনে আছে কি না।

যতটুকু মনে আছে বলছি, শুরু করল কার্নেহান। তবে আমার মাথাটা তেমন কাজ করছে না। ওরা আমার মাথায় পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছিল, বোঝাতে ড্রাভটের মৃত্যু আরও কত ভয়ঙ্কর ছিল। দেশটার চারদিকে ছিল পাহাড়, লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত, ছিল নিঃসঙ্গচারী। আমরা একটার পর একটা পাহাড় পাড়ি দিতে থাকি। জোরে কথা বলার সাহসও ছিল না। তখন ছিল শীতকাল। ভয় হত পাহাড় ধসিয়ে কখন হিমবাহ নেমে আসে গায়ের ওপর। কিন্তু বেপরোয়া ড্রাভট চুপ করে থাকার পাত্র নয়। সে বলত, একজন রাজাকে চুপ করে থাকা মানায় না। তাকে অবশ্যই গান গাইতে হবে। সে খালি খচ্চরের পাছায় লাথি মারত আর ক্রমাগত পথ চলত। অমন ভীষণ-ঠান্ডার মধ্যেও কোথাও থামেনি সে। ফলে অতিরিক্ত পরিশ্রমে খচ্চরগুলোর অবস্থা মরো-মরো হয়ে যায়। আমরা পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় ঢোকার পরে খচ্চরগুলো মেরে ফেলি। তবে ওগুলোকে দিয়ে উদরপূর্তির উপায় ছিল না। ওদিকে এত জিনিসপত্র নিয়ে কীভাবে পথ চলবে ভেবে না পেয়ে অস্ত্রশস্ত্র ভরা বাক্সের ওপরেই বসে থাকি, আগডুম বাগডুম চিন্তা করতে থাকি।

এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল। দেখলাম জনা দশেক লোক, হাতে তীর ধনুক, দৌড়ে আসছে উপত্যকা দিয়ে। লোকগুলোর চুলের রঙ হলুদ, সুঠাম শরীর। তাদেরকে ধাওয়া করছে কমপক্ষে বিশ জনের একটা দল। ড্রাভট বলল সে দশ জনের দলটার পক্ষ নেবে। তারপর দুহাতে দুই রাইফেল নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে গুলি করতে লাগল। গুলি করে একজনকে ফেলে দিল ড্রাভট। তারপর একের পর এক ওদের গুলি করতে লাগলাম দু জনে মিলে। ওদের বেশিরভাগ গুলি খেয়ে মারা গেল, বাকিরা পালাল প্রাণ ভয়ে। আমাদের রণংদেহী মূর্তি দেখে দশ জনের ওই দলটাও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাদের দিকে এগোতে তারা আমাদের লক্ষ করে তীর ছুঁড়তে লাগল। ড্রাভট তখন ওদের মাথার ওপরে শূন্যে গুলি ছুঁড়ল। ভয় পেয়ে সবাই শুয়ে পড়ল মাটিতে। ড্রাভট ওদেরকে লাথি মেরে দাঁড় করাল। তারপর সবার সাথে হাত মিলিয়ে বুঝিয়ে দিল আমরা ওদের শত্রু নই, বন্ধু। ওদের হাতে গোলাবারুদের বাক্সগুলো তুলে দিল ড্রাভট বহন করার জন্যে, এমনভাবে নির্দেশ দিল যেন ইতোমধ্যে রাজা বনে গেছে সে।

বাক্সগুলো নিয়ে ওরা উপত্যকা ধরে পাহাড়ের ওপরে একটা পাইনের বনে ঢুকল, ওখানে পাথরের তৈরি বড়-বড় বেশ কয়েকটা মূর্তি।

ওই দশ জনের দলে সবচে বলিষ্ঠ এবং লম্বা লোকটির নাম ছিল ইমব্রা, সে দলপতি। ইব্রা নিজের নাকের সাথে ড্রাভটের নাক ঘষে আনুগত্য প্রকাশ করল। এরপর তারা ড্রাভটের জন্য খাবার নিয়ে এল। কিন্তু ওদের দেয়া প্রত্যেকের খাবার সে প্রত্যাখ্যান করল। শেষে গ্রাম থেকে যখন ধর্মযাজক এবং মোড়ল খাবার নিয়ে এল, ড্রাভট সেই খাবারটা খেল। ওরা আমাদের বোধহয় দেবতাটেবতা কিছু ভেবেছিল। মনে করেছে আকাশ। থেকে ছিটকে পড়েছি।

বুঝলাম সবই, বললাম আমি। তা রাজা হলে কী করে?

আমি রাজা হইনি, বলল কার্নেহান। রাজা হয়েছিল ড্রাভট। ড্রাভটের মাথায় সোনার মুকুট খুব মানিয়ে গিয়েছিল। সে প্রতিদিন সকালে ইমব্রাকে সাথে নিয়ে বসে থাকত, গ্রামবাসী এসে তাকে পুজো করত। এটা ছিল ড্রাভটের আদেশ। একবার একদল দস্যু গ্রাম আক্রমণ করে। আমরা এমনভাবে গুলি ছুঁড়তে শুরু করি যে ওরা পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এভাবে একের পর এক গ্রামে আমরা আমাদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকি। গ্রামে কোনো সমস্যা হলেই গ্রামবাসী সমাধানের জন্য আসত। ড্রাভটের কাছে। ড্রাভট সব সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দিত। সে একাই ছিল বিচারপতি। ড্রাভট বলত তার আদেশ না মানলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। অশিক্ষিত গ্রামবাসী আমাদের ভয়ে তাই সব সময় থর থর করে কাঁপত।

আমরা এক-এক করে অনেকগুলো গ্রামে ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং নানা কৌশল খাঁটিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকি। একবার বরফ ঢাকা এক গ্রামে লোকজন কেউ ছিল না, কয়েকজন পাহারাদার ছাড়া। ওরা আমাদেরকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমরা ওদের আরও ভয় পাইয়ে দিতে গুলি করি। তারপর পাশের গ্রামে চলে যাই।

ওই গ্রামের গ্রাম প্রধান প্রথমে বীরত্ব দেখাতে চাইলেও পরে আমাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। আমরা কিছু গ্রামবাসীকে ড্রিল, মার্চপাস্ট ইত্যাদিও শিখিয়েছিলাম। বেশিরভাগ লোকজন আমাদের ভক্ত হয়ে উঠেছিল। এদিকে আমাদের সাম্রাজ্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতেই থাকে।

আমরা শেষের দিকে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলাম। কয়েকটি গ্রাম শাসন করত ড্রাভট, আমি করতাম বাকিগুলো। তবে আমার একার পক্ষে এই বিশাল রাজ্য শাসন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি ড্রাভটকে আমার সমস্যার কথা লিখে জানাই, বলি সে যেন এই রাজ্যভার গ্রহণ করে। তারপর আমি প্রথম উপত্যকায় ফিরে যাই প্রীস্টরা কী করছে দেখতে। ওই গ্রামের নাম ছিল এরহেব। এরহেবের প্রীস্টরা কাজ কাম ভালোই করছিল। তবে তারা অভিযোগ করল, পাশের গ্রাম থেকে নাকি মাঝে-মাঝে রাতের বেলা তীর ছুঁড়ে মারা হয়। আমি ঐ গ্রামে ঢুকে পরপর চার রাউন্ড ফায়ার করে এলাম। সাবধান করে দিলাম যাতে আর কেউ কেরানি দেখানোর সাহস না পায়।

কিছুদিন পরে, একদিন সকালে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ড্যান ড্রাভটের আগমন ঘটল আমাদের আস্তানায়। পাহাড় থেকে রীতিমতো মার্চ করে এল সে, সঙ্গে শতাধিক মানুষ। অবাক হয়ে গেলাম, ওর মাথায় চকচক করছে ভারী স্বর্ণ-মুকুট।

মাই গড, কার্নেহান, বলল ড্রাভট, দারুণ কাজ হচ্ছে হে। গোটা দেশের মালিক এখন আমরা। আমার পরিচয় এখানে রানী সেমিরামিসের। পুত্র আলেকজান্ডার, আর তুমি আমার ছোট ভাই এবং একজন দেবতাও। আমি গত ছয় হপ্তা ধরে লড়াই করেছি। সবগুলো লড়াইতে জিতেছি। ওদের রাজা বনে গেছি। তোমার জন্যেও একটা রাজমুকুট এনেছি। শু নামের একটা জায়গায় বসে ওরা সোনার মুকুট জোড়া বানিয়েছে। ওখানে পাহাড়ের নিচে সোনা থকথক করছে, মাংসের মধ্যে চর্বির মতো। আর আছে মহামূল্যবান রত্ন, পাথরের খাঁজে-খাঁজে। নদীর বালুতে প্রচুর খনিজও দেখলাম। এই যে দেখ এক লোক আমার জন্যে অম্বর নিয়ে এসেছে। যাও, সব প্রীস্টদের ডেকে নিয়ে এস। তোমার মাথায় এখন মুকুট পরানো হবে।

এক লোক একটা কালো ব্যাগ খুলে মুকুটটা বের করল। মুকুটটা ছোট কিন্তু খুব ভারী। কমপক্ষে পাঁচ পাউন্ড ওজন হবে, ব্যারেলের ঢাকনির মতো দেখতে।

পিচি, বলল ড্রাভট, আমরা আর মারামারির মধ্যে যেতে চাই না। তারপর সে আমার সাথে বিলি ফিশের হাত মিলিয়ে দিল। বিলি হলো বাষকাই গ্রামের মোড়ল। ওর নাম আমরাই দিয়েছি বিলি ফিশ। ও পরে আমাদের সবচে বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠে।

ড্রাভট বলল, কমপক্ষে চল্লিশ জন গ্রাম্য মোড়ল আমার অধীনে। আমরা ওদের নিয়ে ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারব।

এরপর ড্রাভট বলল গ্রাম প্রধান এবং প্রীস্টদের সে বড় একটা সম্মেলন করবে। ইমব্রার মন্দিরটা আপাতত প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করবে, জানাল সে।

ড্রাভটের ধৈর্য কম। আর সে সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি পেতে চায়। সে। সেইরাতেই গ্রামের লোকজন নিয়ে পাহাড়ের পাশে আগুন জ্বালিয়ে সম্মেলনের ব্যবস্থা করল। ড্রাভট আমাদের পরিচয় দিল দেবতা হিসেবে, বলল আমাদের পূর্বপুরুষরা জাদুবিদ্যায় খুবই পারদর্শী ছিল। বলল আমরা এখানে এসেছি কাফিরিস্তানকে এমন একটি দেশে পরিণত করতে যেখানে মানুষ কখনো না খেয়ে থাকবে না। অনাহারে মরবে না, সবাই সুখে শান্তিতে বাস করবে।

বেশ গুরুগম্ভীর একটা বক্তৃতা দেয়ার পরে গ্রাম্য প্রধানরা শ্রদ্ধা জানাতে একে-একে এল আমাদের সাথে হাত মেলাতে। ওদের একেক জনের নাম দিলাম আমরা বিলি ফিশ, হলি ডিলওয়ার্থ, পিক্কি কেরগান ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে সবচেয়ে অবাক করা ঘটনাটা ঘটল পরদিন রাতে, মন্দিরে। বুড়ো বটগাছের মতো প্রাচীন ধর্মযাজকরা তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের লক্ষ করে চলছিল। আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল ভেবে এরা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে আমাদের সবই বুজরুকি, তা হলে না জানি কি দশা হবে। তবে ভাগ্যই বলতে হবে তেমন কিছু ঘটল না।

ড্রাভট গ্রামের মেয়েদের হাতে বানানো বেশ দামি একটি আলখেল্লা পরে বড় একটা পাথরের ওপর বসল। ওরা এটাকে বলে স্টোন অভ ইমব্রা। বাশকাই গ্রামের সবচে বুড়ো প্রীস্ট লোকটা কেন যেন পাথরটাকে উল্টে দেয়ার চেষ্টা করছিল। না পেরে শেষে ওটার তলা ঘষতে থাকে হাত দিয়ে। ধুলো আর মাটি সরে গিয়ে পাথরের গায়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে একটা চিহ্ন। কাকতালীয় ব্যাপারটা আমাদের জন্যে যেন সাপে বর হয়ে দাঁড়াল। ড্রাভট আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, আবার সৌভাগ্যের দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। প্রীস্টরা বলছে এটি নাকি একটি হারানো চিহ্ন। এর অর্থ এদের কারো জানা নেই। এখন বরং আমাদের দুশ্চিন্তা আরও কমল। আমরা যে দেবতা এই বিশ্বাসটা ওদের ভেতরে এবার বদ্ধমূল হবে। তারপর খামোকাই বন্দুকের বাট দিয়ে পাথরে একটা বাড়ি মারল ড্রাভট, তারপর গ্রামবাসীদের দিকে ফিরে বজ্র নির্ঘোষে বলতে লাগল, মহাপুরুষদের যে আর্শীবাদ রয়েছে আমার ওপর তার ওপর নির্ভর করে এবং পিচির পক্ষে আমি ঘোষণা করছি, কাফিরিস্তানের সকল ফ্রি মিসোনারীর রাজা আজ থেকে আমি এবং পিচি। এই বলে মাথায় মুকুট পরল সে, আমার মাথায়ও চাপিয়ে দিল একটা। তারপর বলল, আগামী সে মাসের মধ্যে আমরা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নতি সাধন করব। দেখব তোমরা কে কীভাবে কাজ করছ।

পরবর্তীকালে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যে অনেক কাজ করলাম। আমি গ্রামবাসীদের চাষাবাদ শেখালাম, কীভাবে দড়ির ব্রিজ তৈরি করতে হয় শেখালাম। বড়-বড় গিরিখাদের মাঝখানে সেতুগুলো ঝুলান হলো।

ড্রাভট আমার কাজে সন্তুষ্টই ছিল। তবে আমার কোনো পরামর্শ সে কানে তুলত না, নিজের মর্জি মাফিক চলত। অবশ্য লোকের সামনে ও আমাকে কখনো অসম্মান করেনি। লোকজন ভয় পেত আমাদেরকে। ভয় পেত আমাদের নিজের হাতে গড়া সেনাবাহিনীকে। তবে ওরা ড্রাভটকে ভালও বাসত। প্রীস্ট আর গ্রাম প্রধানদের সাথে দারুণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ড্রাভটের। পাহাড়ের ওপরে থেকে কেউ নালিশ নিয়ে এলে চার প্রীস্টের কাছে পরামর্শ চাইত ড্রাভট, কী করা যায় সে ব্যাপারে। এরা ছিল বাশকাইর বিলি ফিশ, শু-র পিচি কেরগান, কাফুজেলামের এক গ্রাম প্রধান এবং মাডোরার প্রীস্ট। গ্রামে যদি মারপিট বেধে যেত তার সমাধান দিত এই চার প্রীস্টই।

আমার কাজ ছিল দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। কমপক্ষে পাঁচ শ মানুষকে আমি ড্রিল করা শিখিয়েছি, দুশ জনকে অস্ত্র বাহন করতে শিখিয়েছি। হাতে তৈরি গাদা বন্দুক তাদের কাছে আজব বস্তু বলে মনে হত। ড্রাভট স্বপ্ন দেখত এক সময় বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে সে, একদিন গোটা পৃথিবীর মালিক হয়ে বসবে।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। রাজা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ড্রাভট, এখন সে সম্রাটের সমান ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু সুখে থাকতে ভূতে কিলায় বলে একটা কথা আছে, ঠিক সেটাই একদিন ঘটল ড্রাভটের জীবনে, আর তার সব কাজের সাগরেদ ছিলাম বলে একই নিয়তির শিকার হতে হলো আমাকেও।

আমরা যাত্রা শুরুর আগে একটা চুক্তিপত্র করেছিলাম। তাতে দ্বিতীয় ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ ছিল আমরা কখনোই সাদা কিংবা বাদামী কোনো নারীর দিকে নজর দেব না। কিন্তু সেই শর্তের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ড্রাভটের মনে বিয়ের শখ চাগিয়ে উঠল। বলল, আমি বিয়ে করতে চাই পিচি, এদেশের মেয়েগুলো ইংরেজ মেয়েদের চেয়েও সুন্দরী। তবে শুধু আমিই সুখ ভোগ করব কেন? তুমিও বিয়ে করবে, পিচি। তোমাকেও সুন্দরী একটি মেয়ের সাথে বিয়ে দেব।

আমাকে লোভ দেখিও না।বললাম আমি। নারী সঙ্গের আমার কোনো প্রয়োজন নেই।

আরে আমি তো স্রেফ বিয়ে করার জন্যে বিয়ে করব না, বলল ড্রাভট। আমার চাই একজন রানী যে আমাকে পুত্র সন্তান উপহার দেবে। হবে এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজা। আমার জন্যে সবচেয়ে শক্তিশালী উপজাতিদের মাঝ থেকে কনে খুঁজে আনবে, পিচি। এই শীতেই আমি বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই।

আমি ড্রাভটকে বোঝাতে চাইলাম, বললাম মেয়েরা বিশ্বসঘাতিনী হয়, কোনো মেয়ে আমার সাথে কবে ভালবাসার অভিনয় করে দাগা দিয়ে গেছে এবং সে-ক্ষত আমার এখনো শুকায়নি, সে গল্পও শোনালাম। বললাম, তোমাকে মিনতি করছি, ড্যান। এমন কিছু করতে যেয়ো না। তা হলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। বাইবেলে বলেছে, রাজাবাদশারা তাদের সময় নারীদের পেছনে নষ্ট করতে পারবে না, বিশেষ করে যে রাজার রয়েছে। নতুন রাজ্য গঠনের গুরু দায়িত্ব।

আমি যা বলেছি তাই করব, গম্ভীর গলায় কথাটা বলে পাইনের বনে গেল ড্রাভট পায়চারী করতে। এখানে হাঁটাহাটি করার সময় সে সব মাস্টার প্ল্যান করে।

আমি হাল ছেড়ে দিলাম। তবে ড্যান যতটা সহজ ভেবেছিল কনে খুঁজে পাওয়া ততটা সহজ মোটেই হলো না। পরিষদ সভা ডাকল ড্যান ড্রাভট, নিজের বিয়ের প্রস্তাব রাখল সেখানে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলল না, বলা ভালো খুলতে চাইল না। শুধু বিলি ফিশ বলল, সে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে দেখবে। শুনে ভয়ানক ক্ষেপে গেল ড্রাভট। আমার দোষটা কোথায়?খ্যাক-খ্যাক করে উঠল সে। আমি বাঘ না ভালুক যে মেয়েদের খেয়ে ফেলব। বরং তোমাদের ফালতু মেয়েছেলেদের চেয়ে আমার জায়গা অনেক উঁচুতে। আমি কি এই দেশটাকে ছায়ার মতো আগলে রাখছি না? গতবার আফগানদের হামলা থেকে কে বাঁচিয়েছিল তোমাদের? (আসলে কাজটা করেছিলাম আমি, রাগের চোটে ড্রাভট ভুলে গেছে সে কথা।) কে তোমাদের জন্য বন্দুকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে? কে তোমাদের ভাঙা সেতু নির্মাণ করেছে? সমানে এভাবে গাঁক গাঁক করেই যেতে লাগল সে। বিলি ফিশসহ অন্যান্যরা চুপ হয়ে রইল।

পরে আমি বিলি ফিশকে একান্তে ডেকে নিয়ে শুধালাম, সমস্যাটা কী, বিলি ফিশ? আমাকে সত্যি কথাটা বল তো?

আপনাকে সত্যি কথাই বলছি, বলল বিলি ফিশ। আমাদের মেয়েরা কী করে একজন দেবতা বা শয়তানকে বিয়ে করবে? এটা মোটেই উচিত হবে না।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওরা আমাদের দেবতা জ্ঞান করে। এখন ভুলটা ভেঙে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বললাম, একজন দেবতা যা খুশি করতে পারে। রাজা যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করেন তা হলে তিনি আর তাকে মরতে দেবেন না।

তাকে অবশ্যই মরতে হবে, দৃঢ় গলায় বলল বিলি ফিশ। এই পাহাড়ে আরও অনেক দেবতা এবং শয়তান আছে। এদেরকে যে মেয়ে বিয়ে করছে পরবর্তীতে তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া, আপনারা দুজনেই পাথরের সেই কাটা চিহ্ন রহস্যের কথা জানেন। দেবতা ছাড়া মানুষের পক্ষে ওই রহস্য জানা সম্ভব নয়। আমরা আপনাদের শুরুতে মানুষই ভেবেছিলাম। কিন্তু ওই পাথরের চিহ্ন দেখার পর থেকে জানি আপনারা মানুষ নন, দেবতা।

আমি আর বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। সে রাতে আমার ঘুম হলো না দুশ্চিন্তায়। বারবার মনে হচ্ছিল ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের জীবনে।

সে রাতে পাহাড়ের ওপরের ছোট্ট মন্দিরটা থেকে বারবার ভেসে এল শিঙা ফোকার আওয়াজ। শুনলাম গুঙিয়ে-গুঙিয়ে কাঁদছে একটি মেয়ে। পরে শুনেছি রাজাকে বিয়ে করার জন্যে ওই মেয়েটিকে প্রস্তুত করা হচ্ছিল এ কারণে সে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল।

ড্যান অবশ্য অত কথা শুনতে চাইল না। সে সাফ-সাফ বলে দিল, আমি অমন ভীতু মেয়ে চাই না, তবে তোমাদের রীতিনীতির ওপর হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছেও আমার নেই। প্রয়োজনে আমি নিজেই মেয়ে বেছে নেব।

মেয়েটা আসলে একটু ভয় পেয়েছে, বলল এক প্রীস্ট। তার ধারণা হয়েছে সে মরে যাবে।

আগামী কাল সকালের মধ্যে মেয়ে যোগাড় করে না আনতে পারলে তোমরাও কেউ বাঁচতে পারবে না, গরগর করে উঠল ড্রাভট। প্রীস্টকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিল ড্রাভট। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে বেড়াল পরদিন সকালের সুখ-কল্পনাকে আশ্রয় করে।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল আমার। তখন ড্রাভট অবশ্য ঘুমে অচেতন। দেখি গ্রামের প্রায় সব প্রীস্ট এসে হাজির হয়েছে, গ্রাম প্রধানরাও রয়েছে সঙ্গে, ফিসফিস করে কী যেন বলছিল তারা, আমাকে আড়চোখে লক্ষ করল।

কী হয়েছে, ফিশ? বাশকাই গ্রাম প্রধানকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ঠিক বলতে পারব না।, জবাব দিল বিলি ফিশ। তবে রাজাকে এই পাগলামী ছাড়তে বলুন। না হলে ঘোর বিপদে পড়তে পারেন তিনি। ভাবগতিক তেমন সুবিধের ঠেকছে না আমার কাছে। অবশ্য জনা বিশেক লোক নিয়ে এসেছি সাথে। ওরা আমার কথা শুনবে। কিন্তু অন্যদের কথা বলতে পারছি না। তাদের মধ্যে বিক্ষোভের আলামত পাচ্ছি। ঝড় শেষ হবার সাথে-সাথে আমরা বাশকাই ফিরে যাব।

রাতের বেলা তুষার ঝড় হয়েছে। এখানে জোর বাতাস বইছে। গোটা প্রকৃতি ঢেকে গেছে সাদা বরফে। আকাশে ভারী মেঘের আনাগোনা। দেখলাম ড্রাভট বেরিয়ে এল তার ঘর থেকে, মাথায় সোনার মুকুট, টলছে সে, হাত দোলাতে-দোলাতে এগিয়ে এল আমার কাছে।

শেষ বারের মতো বলছি তোমাকে, ড্যান, ফিসফিস করে করলাম আমি, এসব ছাড়ান দাও। বিলি ফিশ বলছে ঝামেলা হতে পারে।

আমার লোক ঝামেলা করবে? তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল ড্রাভটের কণ্ঠে প্রশ্নই ওঠে না। তুমি তো মস্ত বোকা, পিচি। বিয়ে করার এমন সুযোগ পেয়েও হারালে। যাকগে, মেয়েটা কোথায়? সব প্রীস্ট আর মোড়লদের নিয়ে এসো, সম্রাট নিজের চোখে দেখতে চায় কনেকে তার সাথে মানাবে কি না।

অবশ্য কাউকে ডেকে পাঠানোর দরকার ছিল না। সবাই এসেছে এবং পাইনের বনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় যে যার বন্দুক এবং বর্শার ওপর। ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। একদল প্রীস্ট গিয়েছিল মন্দির থেকে মেয়েটিকে নিয়ে আসতে।

বিলি ফিশ তার কুড়ি জন সশস্ত্র মানুষ নিয়ে রাজার পেছনে এসে দাঁড়াল। আমি দাঁড়ালাম ড্রাভটের পাশে। আমার পেছনেও বিশ জনের সশস্ত্র একটা দল। ওরা রুপোর গহনা আর মূল্যবান রত্ন পরা একটি মেয়েকে নিয়ে এল। মেয়েটি সুন্দরী, কিন্তু ভয়ে সাদা হয়ে আছে মুখ। সে বারবার পেছন ফিরে প্রীস্টদের দিকে তাকাচ্ছিল।

একে দিয়েই চলবে, মেয়েটার আপাদমস্তক দেখে বলল ড্যান। আমাকে এত ভয় কিসের সুন্দরী? এসো, চুমু খাও। সে মেয়েটির গলা জড়িয়ে ধরল। মেয়েটি সভয়ে চোখ বন্ধ করল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অস্ফুট গোঙানি, ড্যানের মস্ত লাল দাড়ির আড়ালে তার মুখখানা হারিয়ে গেল।

শালী আমাকে কামড়ে দিয়েছে। আর্তনাদ করে উঠল ড্যান, ঘাড়ের কাছে হাত বোলাতে লাগল। সত্যি তাই। তার হাত রক্তে লাল হয়ে গেছে। দৃশ্যটা দেখামাত্র বিদ্যুৎ খেলে গেল বিলি ফিশের শরীরে। সে ড্যানকে কাঁধে করে একটানে নিয়ে এল নিজের দলের মাঝখানে।

এদিকে ভয়াবহ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে প্রীস্টদের মধ্যে। ক্রুদ্ধ গলায় গর্জন ছাড়ল তারা। দেবতা বা শয়তান নয়, ওরা আমাদের মতোই মানুষ। হতভম্ব হয়ে গেলাম দেখে এক প্রীস্ট হাতের বর্শা নিয়ে যুদ্ধংদেহি ভঙ্গিতে ছুটে আসছে আমার দিকে। তারপর যা শুরু হলো সে ভয়াবহতার বর্ণনা দেবার সাধ্য আমার নেই।

আক্ষরিক অর্থেই জায়গাটা রণক্ষেত্র হয়ে উঠল। আমরা দেবতা নই, স্রেফ ওদের মতো মানুষ, কারণ আমাদেরও গা থেকে ওদের মতো রক্ত ঝরে, এ ব্যাপারটা উপলব্ধি করার পরে সমস্ত প্রীস্ট, গ্রাম প্রধান এবং শতশত গ্রামবাসী যেন উন্মাদ হয়ে উঠল। আমাদের সাথে রইল শুধু বিলি ফিশ এবং তার দল। আমাদের বন্দুক ওদের চেয়ে উন্নত মানের হলেও অতগুলো হিংস্র মানুষের সাথে পেরে ওঠা মুখের কথা নাকি?

পেছনে বেশ কিছু হতাহত মানুষ ফেলে বিলি ফিশের পরামর্শমতো আমাদের রণেভঙ্গ দিতেই হলো। ড্যান অবশ্য আসতে চাইছিল না। ক্রোধে সে-ও উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অসম এই যুদ্ধে পেরে উঠব না জেনে ওকে জোর করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চললাম।

কিন্তু ওরা আমাদের পিছু ছাড়ল না। প্রীস্টরা বড়-বড় পাথর গড়িয়ে দিল আমাদের দিকে। আমাদের সৈন্যবাহিনীও প্রাণপণে যুদ্ধ করল। কিন্তু ওরা সংখ্যায় কয়েক শ আর আমরা অল্প কয়েকজন। কোনো মতে ওদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে উপত্যকার নিচে এসে দেখি আমরা মাত্র ন জন বেঁচে আছি। আমি, ড্যান, বিলি ফিশ এবং জনা ছয় সৈনিক।

বিলি ফিশ বলল, আমাদের নিয়ে তার গ্রাম বাশকাইতে যাবে। ওরা সবগুলো গ্রামে খবর পাঠাবে, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়।

ড্যানের বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে উন্মাদের মতো আচরণ করছিল। একবার আমাকে খুব বকাঝকা করল। বলল, এ সব কিছু নাকি আমার দোষেই হয়েছে। আমার মাথায় বুদ্ধি নেই তাই রাজার বিরুদ্ধে ওদের ষড়যন্ত্র টের পাইনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না। জানি বললে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠবে সে। অনেকক্ষণ গজগজ করে শেষে ড্যান বলল, একবার বাশকাই গিয়ে পৌঁছি। তারপর ফিরে এসে সবগুলো বিদ্রোহীর ঝাড়ে-বংশে উৎখাত করে ছাড়ব।

আমরা সারা দিন আর সারা রাত হাঁটলাম। ড্যান বরফের ওপর দিকে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেল বারবার, অভ্যাস মতো নিজের লাল দাড়ি চিবুতে লাগল আর বিড়বিড় করে সারাক্ষণ কি যেন বকে চলল।

রক্ষা পাবার কোনো উপায় আমাদের নেই, এক সময় হতাশ গলায় বলল বিলি ফিশ, ধর্মগুরুরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই গ্রামে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে আপনারা দেবতা নন, মানুষ। আপনারা আর কটা দিন কেন দেবতা হয়ে থাকতে পারলেন না? এখন ধরা পড়লে আপনারা তো মরবেনই, আমিও শেষ! বলে বরফের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে, তার দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগল।

পরদিন সকালে আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছুলাম যেখানে সমতল ভূমি বলে কিছু নেই, খালি চড়াই আর উত্রাই। কোনো খাবারও নেই। বিলির সঙ্গী সেই ছয়জন সৈনিক বারবার তাদের সর্দারের দিকে তাকাতে লাগল, যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলল না কিছুই। দুপুর নাগাদ আমরা হাজির হয়ে গেলাম বরফ ঢাকা, ভোতা এক পাহাড় চুড়োয়। মাত্র চুড়োয় উঠেছি, এমন সময় ওদের চোখে পড়ে গেলাম। বিরাট একটা দল অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে।

প্রীস্টরা খুব দ্রুত খবর পাঠাতে পেরেছে দেখছি, তেতো গলায় বলল বিলি ফিশ। ওরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

শত্রুপক্ষ থেকে আকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। একটা গুলি এসে লাগল ড্যানিয়েলের পায়ের গুলতিতে। সে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। চারদিকে শত্রু দেখে কাত্রাতে কাত্রাতে বলল, ফিরে যাও, বিলি ফিশ। তোমার লোকদের নিয়ে চলে যাও। তোমার পক্ষে যা করা সম্ভব তা করেছ। এখন প্রাণে বাঁচতে চাইলে কেটে পড়ো। তুমিও কার্নেহান, ওরা হয়তো তোমাকে হত্যা করবে না। আমি একা ওদের মোকাবেলা করব। ঝামেলা আমিই পাকিয়েছি। আমি রাজা। আমার ঝামেলা আমাকেই শেষ করতে দাও।

আমি বললাম, তোমাকে ছেড়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। বিলি ফিশ, তোমার রাস্তা খালি। তুমি যেতে পার। আমরা দুজন যতক্ষণ পারি ওদের ঠেকিয়ে রাখব।

আমি একজন সর্দার, গম্ভীর গলায় বলল বিলি ফিশ, আমি আপনাদের সঙ্গেই থাকব। আমার লোকেরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারে।

তার মুখ থেকে কথা খসা মাত্র বাকি, সঙ্গে-সঙ্গে বাশকাইর সৈন্যরা দৌড়ে পালাল। তারপর আমরা তিনজন রুখে দাঁড়ালাম শত্রুদের বিরুদ্ধে সেই ভয়ঙ্কর শীতের মধ্যে সেই শীত এখানো যেন ঢুকে আছে মাথার ভেতরে।

.

প্রেসের লোকজন সবাই ঘুমাচ্ছে। আমার অফিস ঘরে দুটো কেরোসিন বাতি জ্বলছে, টের পাচ্ছি ঘামে ভিজে গেছে শরীর, কপাল থেকে ঘামের রেখা নামছে। কার্নেহানের দিকে ঝুঁকলাম। ও কাঁপতে শুরু করেছে। ভয় হলো অজ্ঞান না হয়ে পড়ে। আমি রুমাল দিয়ে মুখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী হলো?

তারপর? গুঙিয়ে উঠল কার্নেহান। মরণপন লড়াইয়ে হেরে গেলাম আমরা। বিলি ফিশ, আমাদের সহৃদয় বন্ধুটির গলা কেটে ফেলল ওরা এক কোপে। তারপর ড্যানকে ধরে হেঁচড়াতে-হেঁচড়াতে নিয়ে চলল অনেক দূরে একটা খাদের ধারে। সারাটা রাস্তা ওরা ওকে পেছন থেকে লাথি মারতে মারতে নিয়ে গেল। ড্যান অমন অবস্থার মধ্যেও আমাকে বারবার বলছিল, তোমার এই দুর্দশার জন্যে আমিই দায়ী, পিচি। আমিই তোমাকে তোমার নিরুদ্বেগ জীবন থেকে টেনে এনেছি কাফিরিস্তানে একদল বুনোর হাতে খুন হবার জন্যে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল সে।

ওরা ড্যানকে একটা খাদের ওপর দড়ির ব্রিজে নিয়ে তুলল। তারপর এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে ফেলল মুণ্ড। দ্বিখণ্ডিত শরীরটা ছিটকে পড়ে গেল কয়েক শ ফুট নিচে।

এরপর আমার পালা। ওরা আমাকে পাহাড়ের জঙ্গলে নিয়ে যীশুকে যেভাবে ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল, ঠিক সেভাবে একটা গাছে ঝুলিয়ে দিল। হাতে এবং পায়ে কাঠের গজাল ব্যবহার করেছিল ওরা। কিন্তু কি আশ্চর্যের ব্যাপার, অত যন্ত্রণা সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত আমি টিকে যাই। পরদিন সকালে ওরা আমাকে জীবিত দেখে খুব অবাক হয়ে যায়। আমাকে ওরা গাছ থেকে নামায়…

এ পর্যন্ত বলে চেয়ারে দুলতে-দুলতে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল কার্নেহান। দশ মিনিট কেঁদে বোধহয় বুকটা খালি হলো, হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছে আবার শুরু করল সে।

আমাকে ওরা মন্দিরে নিয়ে গেল। কিছু খেতে দেয়নি। ওরা বলাবলি করছিল ড্যানিয়েল মানুষ হলেও আমাকে দেবতার পর্যায়ে ফেলা যায়। কারণ ক্রুশে ঝুলেও আমি বেঁচে গেছি। ওরা আমাকে তারপর বরফের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বলল, বাড়ি যাও। আর কখনো এদিকে এসো না।

আমার পুরো একটা বছর লেগেছে বাড়ি ফিরে আসতে। ওরা আমার হাতে ড্যানের কাটা মুণ্ডুটা ধরিয়ে দিয়েছিল সোনার মুকুটসহ। এ কাজটা করেছিল আমি যাতে আর ওদিকে পা বাড়ানোর সাহস না করি। আমি বহুদিন অনাহারে অর্ধাহারে থেকেছি। কিন্তু সোনার মুকুটটা হাত ছাড়া করিনি। কারণ এই মুকুট মাথায় পরত আমার ভাই ড্যান। তার মুকুটের মর্যাদা আমার কাছে অনেক বেশি। ওতো আমার ভাই, বন্ধু, সবই ছিল। এই যে দেখ আমার ভাইয়ের কী দশা করেছে ওরা।

ফোঁপাতে-ফোঁপাতে একটা ঘোড়ার চামড়ার থলে খুলল কার্নেহান, তারপর আমার দিকে ঠেলে দিল শুকনো, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ড্যানিয়েল ড্রাভটের কাটা মুণ্ডুটা। বাতির আলোয় সেই বিখ্যাত লাল দাড়ি যেন আবার ঝলসে উঠল, কোটর দুটো শূন্য, ভাঙা খুলির ওপর ঝকঝকে একটা রত্নখচিত সোনার মুকুট বসিয়ে দিল কার্নেহান।

এই সেই রাজা, বলল কার্নেহান। যত দিন বেঁচে ছিল নিজেকে কাফিরিস্তানের রাজা ভেবেই বেঁচেছে। ভাবলে কষ্টে বুক ফেটে যায় বেচারা ড্যানিয়েল এক সময় রাজা ছিল।

কাটা মুণ্ডুটার দিকে তাকিয়ে আমার গা শিউরে উঠল। এই লোকটার সাথে আমার মারোয়ার জংশনে পরিচয় হয়েছিল ভাবতে কেমন যেন লাগল। কার্নেহান উঠে দাঁড়িয়েছিল চলে যাবার জন্যে। আমি ওকে নিষেধ করলাম যেতে। কারণ বাইরে যাবার মতো শারীরিক সামর্থ ওর নেই।

আমাকে হুইস্কির বোতলটা দাও আর পারলে কয়েকটা টাকা দাও, হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল সে। আমি এখন ডেপুটি কমিশনারের কাছে যাব। বলব শরীর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেন আশ্রমে থাকার অনুমতি পাই। না, ধন্যবাদ, গাড়ি ডেকে দিতে হবে না। আমার কাজ আছে দক্ষিণে মারোয়ারে-এক্ষুনি ছুটতে হবে ওখানে।

খোঁড়াতে-খোঁড়াতে সে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। হাঁটা দিল ডেপুটি কমিশনারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওই দিন দুপুরবেলা আমাকে বাজার সওদা করতে যেতে হলো সদর রাস্তায়। দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কাঁপতে কাঁপতে ভিক্ষা চাইছে কার্নেহান। কিন্তু কেউ ওকে ভিক্ষা দিচ্ছে না। দেখে আমার খুব মায়া হলো। ওকে জোর করে গাড়িতে তুলে কাছের একটা মিশনারীতে নিয়ে গেলাম। গাড়িতে যাবার পথে কার্নেহান করুণ গলায় গান গাইতে থাকল, আমাকে চিনতে পারল না।

দিন দুই পরে কার্নেহানের খবর নিতে মিশনারীতে গেলাম। সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ওর ভয়ানক সানস্ট্রোক হয়েছিল। গত কাল সকালেই মারা গেছে লোকটা। আচ্ছা, লোকটা নাকি দুপুরবেলা প্রখর রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইছিল?

হ্যাঁ, বললাম আমি। আচ্ছা, মারা যাবার সময় ওর সঙ্গে কোনো জিনিস ছিল?

আমার জানামতে ছিল না, জবাব দিলেন সুপারিনটেনডেন্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *