অ্যান আই ফর অ্যান আই – জেফরি আর্চার
স্যার ম্যাথিউ রবার্টস কিউ সি (কুইনস কাউন্সেল বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) ফাইলটি বন্ধ করে তার সামনের ডেস্কের ওপর রাখলেন। তিনি খুব অসন্তুষ্ট। মেরি ব্যাঙ্কসকে তিনি রক্ষা করতে চান তবে ভদ্রমহিলা যে নট গিল্টি বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করছে সেই ব্যাপারে খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন না।
নরম চামড়ার গদিতে হেলান দিলেন স্যার ম্যাথিউ। মামলাটি নিয়ে ভাবছেন। অপেক্ষা করছেন সলিসিটরের জন্য। তিনি স্যার ম্যাথিউকে ব্রিফ করেছেন। তাঁর জুনিয়র কাউন্সেলও আসবে। তাকে এ কেসের জন্য নির্বাচন করেছেন ম্যাথিউ। মিডল টেম্পল কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবছিলেন আশা করি সঠিক সিদ্ধান্তটিই নেয়া হয়েছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রেজিনা বনাম ব্যাঙ্কসের এ মামলাটি মামুলি একটি মার্ডার কেস। তবে ব্রুস ব্যাঙ্কস তাদের এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে যেভাবে তার স্ত্রীকে দমন করে রাখত, নির্যাতন চালাত, তাতে স্যার ম্যাথিউ নিশ্চিত তিনি এ হত্যা মামলার শাস্তি শুধু কমিয়ে আনতেই পারবেন না, জুরি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য যদি থাকেন নারী, তাহলে বিবাদীকে খালাস করে আনাও সম্ভব হতে পারে। তবে এখানে একটি জটিলতা রয়েছে।
তিনি একটি সিগারেট ধরিয়ে জোরে টান দিলেন, যদিও ধূমপান তাঁর স্ত্রী মোটেই পছন্দ করতেন না। এ জন্য বকাও দিতেন। স্যার ম্যাথিউ ডেস্কে, তাঁর সামনে রাখা ভিক্টোরিয়ার ছবিটির দিকে তাকালেন। ছবিটি তাকে তার যৌবনকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে ভিক্টোরিয়া সবসময় তরুণীই থাকবেন মৃত্যু তাঁর জন্য ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি মনোযোগ ফেরালেন তার ক্লায়েন্ট এবং মিটিগেশনের জন্য তার আবেদনের প্রতি। তিনি ফাইলটি আবার খুললেন। মেরি ব্যাঙ্কসের দাবি সে তার স্বামীকে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে শূকরের খোঁয়াড়ের নিচে কবর দেয়নি। কারণ স্বামীর মৃত্যুর সময় সে স্থানীয় হাসপাতালে রোগী হিসেবেই শুধু ছিল না, তখন সে চোখেও দেখত না। স্যার ম্যাথিউ আবারও বুক ভরে ধোঁয়া টানলেন। এমন সময় দরজায় কেউ নক করল।
ভেতরে আসুন, তিনি গাঁক গাঁক করে উঠলেন– শুধু এ কারণে নয় যে নিজের কণ্ঠটি তার পছন্দ, আসলে হুঙ্কার না ছাড়লে ভীষণ পুরু দরজার ওপাশে তাঁর গলা শোনা যাবে না।
স্যার ম্যাথিউর ক্লার্ক দরজা খুলে ঘোষণা করল মি. বার্নার্ড ক্যাসন এবং মি. হিউ উইদারিংটন এসেছেন। দুজন একদম আলাদা স্বভাবের মানুষ, ওঁরা ভেতরে প্রবেশ করলে মনে মনে ভাবলেন স্যার ম্যাথিউ, তবে এ মামলায় উভয়েই তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করবে।
বার্নার্ড ক্যাসন পুরানো আমলের সলিসিটর ফর্মাল, শিষ্টাচারসম্পন্ন এবং সবসময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পটু। তিনি সারা বছর একইরকম সুট পরে থাকেন, পরিবর্তন হয় না কখনো। ম্যাথিউ প্রায়ই ভাবেন ভদ্রলোক সস্ত রি মার্কেট থেকে একইরকম আধডজন সুট কিনে রেখেছেন কি-না যা তিনি পালাক্রমে প্রতি সপ্তাহে পরিধান করেন।
তিনি তাঁর অর্ধচন্দ্রাকৃতির চশমার ওপর দিয়ে ক্যাসনের দিকে তাকালেন। আইনজীবীটির সরু গোঁফ এবং পরিপাটিভাবে আঁচড়ানো কেশ চেহারায় সেকেলে একটা ভাব এনে দিয়েছে যা অনেক প্রতিপক্ষকেই বোকা বানিয়ে দেয় যখন তাঁরা ভাবেন লোকটা দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্রিটিশ নাগরিক। তবে স্যার ম্যাথিউ নিয়মিত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ভাগ্যিস তার বন্ধুটি কোনো পাবলিক স্পীকার নন, কারণ বার্নার্ড ব্যারিস্টার হলে আদালতে তাঁর বিপক্ষে দাঁড়ানোর স্বাদটি তিনি উপভোগ করতে পারতেন না।
ক্যাসনের এক কদম পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তার জুনিয়র কাউন্সেল হিউ উইদারিংটন। উইদারিংটন পৃথিবীতে আসার সময় সৃষ্টিকর্তা তার প্রতি খুব একটা হৃদ্যতা দেখাননি। কারণ ছেলেটার না আছে চেহারা না মস্তিষ্ক। ঈশ্বর ওকে যদি কোনো গুণ দিয়েও থাকেন, তাহলে তা এখনও আবিষ্কৃত বা প্রকাশিত হয়নি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা-তদবিরের পরে উইদারিংটনকে বার এ সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। এ মামলায় যখন উইদারিংটনের নাম জুনিয়র কাউন্সেল হিসেবে প্রস্তাব করা হয় তখন স্যার ম্যাথিউর ক্লার্কের কপালে ভাঁজ পড়েছিল, তবে প্রত্যুত্তরে স্যার ম্যাথিউ হাস্য করেছেন কেবল, কোনো ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন বোধ করেননি।
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন স্যার ম্যাথিউ, অ্যাশট্রেতে সিগারেটটার গলা টিপে মারলেন এবং উপস্থিত দুই অভ্যাগতকে ডেস্কের অপর পাশের খালি চেয়ারে বসার ইশারা করলেন। ওঁরা বসার পরে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন।
আমার অফিসের আসার জন্য ধন্যবাদ, মি. ক্যাসন, বললেন তিনি। যদিও উভয়েই জানেন সলিসিটরটি বার এর সদস্যপদটি ধরে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজ করেন না।
মাই প্লেজার, স্যার ম্যাথিউ, জবাবে বললেন বৃদ্ধ সলিসিটর। মৃদু বো করলেন দেখাতে এখনো তিনি পুরানো সৌজন্যবোধগুলো বজায় রেখেছেন।
আপনার বোধহয় হিউ উইদারিংটনের সঙ্গে পরিচয় নেই, সাদামাটা চেহারার তরুণ ব্যারিস্টারের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন স্যার ম্যাথিউ। ও এ মামলায় আমাকে সাহায্য করছে।
উইদারিংটন নার্ভাস ভঙ্গিতে ব্রেস্ট পকেটে রাখা সিল্কের রুমালটি স্পর্শ করল।
না, মি. উইদারিংটনের সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি, করিডরে কেবলই দেখা হলো, বললেন ক্যাসন। আপনি এ মামলাটি নিয়েছেন বলে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছে, স্যার ম্যাথিউ।
বন্ধুর ফরমালিটিতে হাসলেন ম্যাথিউ। তিনি জানেন জুনিয়র কাউন্সেল উপস্থিত থাকাকালীন বার্নার্ড কখনোই তাকে তার ডাক নামে ডাকার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। আপনার সঙ্গে আবার কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি বলে আমি খুবই খুশি, মি. ক্যাসন। যদিও এ মামলায় আপনি আমাকে একরকম চ্যালেঞ্জের মুখেই ফেলেছেন।
খেজুরে আলাপ শেষ, বৃদ্ধ সলিসিটর তার জরাজীর্ণ গ্লাডস্টোন ব্যাগ থেকে বাদামী রঙের একটি ফাইল বের করলেন। আপনার সাথে শেষবার দেখা হওয়ার পরে আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে আরেকবার কথা হয়েছে। তিনি ফাইলটি খুললেন, আপনার মতামত তাঁকে জানিয়েছি। তবে মিসেস ব্যাঙ্কস নট গিল্টির আবেদন করতে বদ্ধপরিকর।
তিনি তাহলে এখনো নিজেকে নিরপরাধ বলে দাবি করছেন?
জি, স্যার ম্যাথিউ। মিসেস ব্যাঙ্কস জোর দিয়ে বলছেন তিনি খুনটি করেননি কারণ স্বামীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর স্বামী তাকে অন্ধ করে দেন। আর স্বামীর মৃত্যুর সময় তিনি স্থানীয় হাসপাতালে রোগিণী হিসেবে ভর্তি ছিলেন।
মৃত্যুর সময়টি নিয়ে প্যাথলজিস্টের রিপোর্ট অস্পষ্ট, পুরানো বন্ধুকে স্মরণ করিয়ে দিলেন স্যার ম্যাথিউ। লাশ আবিষ্কার হয়েছে বেশ কয়েকদিন পরে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, মিসেস ব্যাঙ্কসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চব্বিশ কিংবা আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই হত্যাকাণ্ডটি সাধিত হয়।
আমিও ওদের রিপোর্ট পড়েছি, স্যার ম্যাথিউ, বললেন ক্যাসন। এবং এর তথ্য উপাত্তগুলো মিসেস ব্যাঙ্কসকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনি বারবার বলছেন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই, এবং জুরিরা নাকি এ কথা বিশ্বাসও করবেন। বিশেষ করে যখন স্যার ম্যাথিউ রবার্টস আমার ডিফেন্ডার হিসেবে আছেন, ঠিক এ কথাগুলোই তিনি বলেছিলেন যদুর মনে পড়ে। হেসে যোগ করলেন তিনি।
শুনে আমি বিমোহিত হতে পারলাম না, আরেকটি সিগারেট ধরালেন স্যার ম্যাথিউ।
আপনি ভিক্টোরিয়াকে কথা দিয়েছিলেন– এক মুহূর্তের জন্য বর্ম নামিয়ে ফেললেন সলিসিটর। তবে ওই একবারই বললেন কথাটা।
তো তাঁকে কনভিন্স করার একটাই সুযোগ আছে আমার। বন্ধুর মন্তব্য গ্রাহ্যে আনলেন না স্যার ম্যাথিউ।
এবং আপনাকে কনভিন্স করার শেষ সুযোগটি রয়েছে মিসেস ব্যাঙ্কসের। বললেন মি. ক্যাসন।
বেড়ে বলেছেন, বন্ধুর সরস প্রত্যুত্তরের জবাবে মাথা ঝাঁকালেন স্যার ম্যাথিউ। তাঁর মনে হচ্ছে পুরানো বন্ধুটির সঙ্গে এই তরবারি খেলায় তিনি হেরে যাচ্ছেন। এখন প্রত্যাঘাতের সময় এসেছে।
তিনি ডেস্কের খোলা ফাইলে নজর ফেরালেন। প্রথমত, তিনি সরাসরি তাকালেন ক্যাসনের দিকে যেন সহকর্মীটি রয়েছেন কাঠগড়ায়, মাটি খুঁড়ে লাশ বের করার সময় মৃত ব্যক্তিটির জামার কলারে আপনার মক্কেলের রক্ত লেগে ছিল।
আমার মক্কেল তা মেনেও নিয়েছেন, নিজের নোটগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে শান্ত গলায় বললেন ক্যাসন। তবে…
দ্বিতীয়ত, ক্যাসনকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না স্যার ম্যাথিউ। যে অস্ত্রটি দিয়ে তার শরীর টুকরো টুকরো করা হয়, একটি কুঠার, সেটি পরদিন খুঁজে পাওয়া যায় এবং ওটার হাতলে মিসেস ব্যাঙ্কসের মাথার চুল পাওয়া গেছে।
আমরা তাও অস্বীকার করছি না, বললেন ক্যাসন।
আমাদের বাছাই করার মতো বেশি জিনিস নেই, বললেন স্যার ম্যাথিউ, চেয়ার থেকে উঠে ঘরে পায়চারি শুরু করলেন। এবং তৃতীয়ত, যে বেলচা দিয়ে ভিক্টিমের কবর খোঁড়া হয় সেটিরও অবশেষে সন্ধান মিলেছে। এবং তাতে আপনার মক্কেলের হাতের ছাপ ছিল সর্বত্র।
আমরা এটিরও ব্যাখ্যা দিতে পারি, বললেন ক্যাসন।
কিন্তু জুরিরা কি আমাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করবেন, গলার স্বর চড়ালেন স্যার ম্যাথিউ, যখন তারা জানবেন খুন হওয়া লোকটির সহিংসতার লম্বা একটি রেকর্ড রয়েছে, আপনার মক্কেলকে স্থানীয় গায়ে প্রায়ই আহত অবস্থায় দেখা গেছে, গায়ে ক্ষতচিহ্ন, চোখের নিচে কালশিটে, মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে– এমনকী একবার তার ভাঙা হাতেরও পরিচর্যা করা হয়?
আমার মক্কেল সবসময়ই বলে আসছেন ওসব ক্ষতচিহ্নের সৃষ্টি হয়েছে। খামারে কাজ করার সময়। আর তাঁর স্বামী ছিলেন ওই খামারের ম্যানেজার।
কিন্তু এসব ব্যাখ্যা আমার বিশ্বাসের জায়গায় একটা দাগ ফেলেছে যার বিরোধিতা করা একেবারেই অসম্ভব, বললেন স্যার ম্যাথিউ। ঘরময় চক্কর শেষে নিজের চেয়ারে ফিরে এসেছেন। ওই খামারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মাত্র একজনের –এক পোস্টম্যানের। গায়ের আর কারও খামারের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকাই নিষেধ ছিল। তিনি তাঁর নোটের আরেকটি পৃষ্ঠা ওল্টালেন।
এ কারণেই হয়তো কারও পক্ষে খামারে ঢুকে ব্যাঙ্কসকে হত্যা করা ছিল সহজ, আলটপকা বলে উঠল উইদারিংটন।
জুনিয়রের দিকে বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টি দিয়ে না তাকিয়ে পারলেন না স্যার ম্যাথিউ। ছেলেটা যে এখানে আছে তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, মন্তব্য করলেন তিনি। তারপর বলে চললেন, পরবর্তী যে সমস্যাটির আমরা মুখোমুখি হবে তা হলো আপনার মক্কেলের দাবি তাঁর স্বামী তাঁকে গরম ফ্রাইং প্যান দিয়ে আঘাত করার দরুণ তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। বেশ সুবিধাজনক ব্যাখ্যা, মি. ক্যাসন, কী বলেন?
আমার মক্কেলের মুখের এক পাশে সেই ক্ষত চিহ্ন এখনো পরিষ্কার রয়েছে, বললেন ক্যাসন। আর ডাক্তাররা বলেছেন তিনি সত্যি অন্ধ হয়ে গেছেন।
বিচারক এবং কাউন্সেলদের কাছে অনুযোগ করার চেয়ে ঢের সহজ ডাক্তারদেরকে বোঝানো, মি. ক্যাসন, ফাইলের আরেকটি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বললেন স্যার ম্যাথিউ। নেক্সট, লাশের স্যাম্পল যখন পরীক্ষা করা হয়–সৃষ্টিকর্তা জানেন এমন কঠিন কাজটি কে করে–রক্তে প্রচুর পরিমাণে স্ট্রিকনিনের আলামত মিলেছে যে বিষ খেলে একটা হাতিও কুপোকাত হয়ে যাবে।
এটি শুধুমাত্র ক্রাউন হাসপাতালের প্যাথলজিস্টদের মতামত, বললেন মি. ক্যাসন।
এবং আদালতে একটি বিষয় খণ্ডন করা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে, বললেন স্যার ম্যাথিউ, কারণ প্রসিকিউশনের কাউন্সেল মিসেস ব্যাঙ্কসকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন তিনি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কেন রিডিংয়ে এক অ্যাগ্রিকালচারাল সাপ্লায়ারের কাছে গিয়েছিলেন চার গ্রাম স্ট্রিকনিন কিনতে। আমি কাউন্সেলের জায়গায় থাকলে অবশ্যই এ প্রশ্নটি বারবার জিজ্ঞেস করতাম।
হয়তো বা, নোটে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন ক্যাসন, তবে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন খামারে ইঁদুরের উৎপাত খুব বেড়ে গিয়েছিল। ওগুলো মুরগি মেরে ফেলছিল। মিসেস ব্যাঙ্কস ভয় পেয়েছিলেন ইঁদুরগুলো ফার্মের অন্যান্য প্রাণীগুলোর না আবার ক্ষতি করে। তিনি তাঁর নয় বছর বয়সী শিশু সন্তানটিকে নিয়েও চিন্তায় ছিলেন।
ও, হ্যাঁ, রুপার্ট। কিন্তু ও তো ওইসময় বোর্ডিং স্কুলে ছিল, নয় কি? বিরতি দিলেন স্যার ম্যাথিউ।
মি. ক্যাসন, আমার সমস্যাটি অতি সাধারণ। তিনি বন্ধ করলেন ফাইল। আমি আসলে ভদ্রমহিলাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
ক্যাসনের একটি ভুরু উত্তোলিত হলো।
মিসেস ব্যাঙ্কস অত্যন্ত ধূর্ত একজন নারী। তিনি ইতিমধ্যে অনেককেই তার এ অবিশাস্য গল্প শুনিয়ে বোকা বানিয়েছেন। তবে মি. ক্যাসন, আপনাকে বলে রাখছি, উনি আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না।
কিন্তু আমরা কী করতে পারি, স্যার ম্যাথিউ, যদি মিসেস ব্যাঙ্কস তাঁর এ কেসে গোঁ ধরে থাকেন এবং তাঁর পক্ষে আমাদেরকে মামলাটি লড়তে অনুরোধ করেন? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাসন।
আবার চেয়ার ছাড়লেন স্যার ম্যাথিউ এবং নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগলেন। শেষে সলিসিটরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। তবে আশা করছি ভদ্রমহিলাটিকে মানুষহত্যার জন্য গিল্টি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়ত দিতে রাজি করাতে পারব। তাহলে আমরা যে কোনো জুরির সহানুভূতি অর্জনে সমর্থ হব, বিশেষ করে যে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে তা জুরিরা শোনার পরে। শুনানী চলাকালীন নারীবাদী কোনো সংগঠনও আদালতে তাঁর পক্ষ নিতে পারে। কোনো বিচারক তাঁকে কঠোর কোনো সাজা দেয়ার চেষ্টা করলে প্রতিটি খবরের কাগজ সেই বিচারকের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। তাঁকে অভিযুক্ত করা হবে উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং লিঙ্গ বৈষম্যকারী হিসেবে। তখন মিসেস ব্যাঙ্কসকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে দুই দিনও সময় লাগবে না। না, মি. ক্যাসন, ওনাকে গিল্টি প্লি তে রাজি করাতে হবে।
কিন্তু তিনি তো নিজেকে নিরপরাধ বলে সবসময়ই দাবি করছেন। তাহলে কীভাবে কী হবে? জানতে চাইলেন ক্যাসন।
স্যার ম্যাথিউর মুখে এক টুকরো হাসি ফুটল। মি. উইদারিংটন এবং আমার একটা প্ল্যান আছে, তাই না, হিউ? উইদারিংটনের দিকে দ্বিতীয়বার ঘুরলেন তিনি।
জি, স্যার ম্যাথিউ, জবাব দিল তরুণ ব্যারিস্টার। খুশি কারণ অবশেষে তার মতামত চাওয়া হয়েছে, যদিও দায়সারাভাবে। স্যার ম্যাথিউ পরিকল্পনার বিষয়ে কোনো কু দিলেন না বলে ক্যাসনও জানার জন্য চাপাচাপি করলেন না।
তাহলে কবে আমরা আমাদের মক্কেলের মুখোমুখি হচ্ছি? সলিসিটরের দিকে মনোযোগ ফেরালেন স্যার ম্যাথিউ।
সোমবার সকাল এগারোটায় যেতে পারবেন? প্রশ্ন করলেন ক্যাসন।
এ মুহূর্তে তিনি আছেন কোথায়? ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জানতে চাইলেন স্যার ম্যাথিউ।
হলোওয়েতে, জবাব দিলেন ক্যাসন।
তাহলে আমরা সোমবার সকাল এগারোটায় হলোওয়েতে যাব। বললেন স্যার ম্যাথিউ। এবং সত্যি বলতে কী, মিসেস মেরি ব্যাঙ্কসের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমার আর তর সইছে না। ওই মহিলার সাহস আছে বটে, আর কল্পনা শক্তির কথা তো বাদই দিলাম। আমার কথাটা মার্ক করে রাখুন, মি. ক্যাসন, যে কোনো কাউন্সেলের জন্য তিনি নিজেকে দারুণ প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন।
.
হলোওয়েতে কারাগারের ইন্টারভিউ রুমে স্যার ম্যাথিউ প্রবেশ করে এই প্রথম মেরি ব্যাঙ্কসকে দেখলেন এবং চমকে গেলেন। কেস ফাইলের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি জানেন ভদ্রমহিলার বয়স সাঁইত্রিশ, তবে তাঁর সামনে কোলে হাত রেখে পলকা এবং ভঙ্গুর চেহারার, ধূসর চুলের যে মহিলাটি বসে আছেন দেখে মনে হচ্ছে তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তবে ভদ্রমহিলার চমৎকার চোয়ালের গঠন এবং ছিপছিপে দেহ দেখে অনুমান করা যায় একদা তিনি বেশ সুন্দরী ছিলেন।
ক্রিম কালারের ইটের কামরাটির মাঝখানে একটি ফরমিকা টেবিল আর খান কয়েক চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। ক্যাসন স্যার ম্যাথিউকে মিসেস ব্যাঙ্কসের বিপরীত দিকের চেয়ারটিতে বসতে বললেন। ঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে এক ঝলক আলো আসছে। আললাটি সরাসরি পড়েছে মিসেস ব্যাঙ্কসের গায়ে। স্যার ম্যাথিউ এবং জুনিয়র সলিসিটরের দুই পাশে বসলেন। প্রধান কাউন্সেল শব্দ করে এক কাপ কফি ঢেলে নিলেন নিজের জন্য।
গুড মর্নিং, মিসেস ব্যাঙ্কস, বললেন ক্যাসন।
গুড মর্নিং, মি. ক্যাসন, প্রত্যুত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা, যেদিক থেকে কথা ভেসে এসেছে সেদিকে সামান্য মাথা ঘোরালেন। আপনি বোধহয় সঙ্গে কাউকে নিয়ে এসেছেন।
জি, মিসেস ব্যাঙ্কস। আমার সঙ্গে আছেন স্যার ম্যাথিউ রবার্টস কিউ সি, তিনি আপনার ডিফেন্স কাউন্সেল হিসেবে কাজ করবেন।
মিসেস ব্যাঙ্কস সামান্য মাথা ঝাঁকালেন। স্যার ম্যাথিউ চেয়ার ছেড়ে সিধে হলেন, এক কদম সামনে বেড়ে বললেন, গুড মর্নিং, মিসেস ব্যাঙ্কস। তারপর ঝট করে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলেন সামনে।
গুড মর্নিং, স্যার ম্যাথিউ, জবাব দিলেন মিসেস ব্যাঙ্কস, তার মুখের একটি পেশীও কাঁপল না, এখন তাকিয়ে আছেন ক্যাসনের দিকে। আপনি আমার হয়ে মামলা লড়বেন জেনে খুবই খুশি হলাম।
আপনাকে স্যার ম্যাথিউ কিছু প্রশ্ন করতে চান, মিসেস ব্যাঙ্কস, বললেন ক্যাসন। যাতে তিনি ঠিক করতে পারবেন কীভাবে আপনার মামলাটি নিয়ে এগোবেন। প্রসিকিউশনের কাউন্সেলের ভূমিকা পালন করবেন তিনি, যাতে আপনি বুঝতে পারেন উইটনেস বক্সে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
বুঝতে পারছি, প্রত্যত্তরে বললেন মিসেস ব্যাঙ্কস। আমি স্যার ম্যাথিউর যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারলে খুশিই হবো। আমি নিশ্চিত তাঁর মতো একজন খ্যাতিমান মানুষের পক্ষে এ কথা প্রমাণ করা কঠিন হবে না যে একজন পলকা শরীরের অন্ধ মেয়ে মানুষের পক্ষে ষোল স্টোন ওজনের একজন পুরুষকে কুপিয়ে হত্যা করা সম্ভব নয়।
যদি কিনা সেই দুশ্চরিত্র ষোল স্টোন ওজনের মানুষটিকে কোপানোর আগে বিষ খাইয়ে দেয়া হয়, মৃদু গলায় বললেন স্যার ম্যাথিউ।
যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেই জায়গা থেকে পাঁচ মাইল দূরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা কেউ যদি এমন কাজ করতে পারে তাহলে তার হিম্মত আছে স্বীকার করতেই হবে, জবাবে বললেন মিসেস ব্যাঙ্কস।
অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় যদি সত্যি সেটা ঘটে থাকে, বললেন স্যার ম্যাথিউ। আপনি বলছেন মাথার পাশে আঘাত পেয়ে আপনি অন্ধ। হয়ে গেছেন।
জি, স্যার ম্যাথিউ। আমি নাশতা বানানোর সময় আমার স্বামী উনুন থেকে ফ্রাইং প্যানটি তুলে নিয়ে ওটা দিয়ে আমাকে আঘাত করে। আমি মাথা নুইয়ে ফেলেছিলাম, তবে প্যানের কিনারা বাড়ি খায় আমার মুখের বাম পাশে। তিনি বাম চোখের ওপরে একটি দাগে হাত ছোঁয়ালেন। গভীর ক্ষতচিহ্ন। সারাজীবনই হয়তো ওটা তাঁকে বয়ে বেড়াতে হবে।
তারপর কী হলো?
আমি রান্নাঘরের মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরলে টের পাই কেউ এসেছে ঘরে। তবে লোকটা কে বুঝতে পারছিলাম না তার কণ্ঠ শোনার আগ পর্যন্ত। লোকটা ছিল জ্যাক পেমব্রিক, আমাদের পোস্টম্যান। সে আমাকে কোলে করে তার গাড়িতে তোলে এবং লোকাল হসপিটালে নিয়ে যায়।
আর আপনি যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন পুলিশ আপনার স্বামীর লাশ উদ্ধার করে?
জি, স্যার ম্যাথিউ। পার্কমিড হাসপাতালে আমি প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলাম। গির্জার যাজক প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসত। ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ব্রুস আমাকে ছাড়া কীভাবে চলছে।
আপনার কাছে কি ব্যাপারটি বিস্ময়কর মনে হয়নি হাসপাতালে থাকাকালীন আপনার স্বামী একটিবারের জন্যও আপনাকে দেখতে আসেননি? জিজ্ঞেস করলেন স্যার ম্যাথিউ। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর কফির কাপটি টেবিলের কিনারে ঠেলে দিচ্ছিলেন।
না। আমি বিভিন্ন সময় ওকে হুমকি দিয়েছিলাম ওকে ছেড়ে চলে যাব এবং আমার মনে হয় না… কাপটা খসে পড়ল টেবিল থেকে এবং পাথুরে মেঝেতে পড়ে বিকট শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
লাফিয়ে উঠলেন মিসেস ব্যাঙ্কস তবে ভাঙা কাপের দিকে ফিরে তাকালেন না।
আপনি ঠিক আছেন তো, মি. ক্যাসন? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
দোষটা আমার, বললেন স্যার ম্যাথিউ। বড্ড আনাড়ি আমি।
ক্যাসন হাসি চেপে রাখলেন। উইদারিংটন পাথর মুখ করে থাকল।
প্লিজ বলে যান, স্যার ম্যাথিউ ঝুঁকে ভাঙা কাপের টুকরোগুলো তুলতে লাগলেন মেঝে থেকে। আপনি বলছিলেন আমার মনে হয় না..
ও, হাঁ, বললেন মিসেস ব্যাঙ্কস। আমার মনে হয় না আমি ফার্মে ফিরলাম কী ফিরলাম না তাতে ব্রুসের কিছু এসে যেত।
তা তো বটেই, টেবিলে কাপের ভাঙা টুকরোগুলো তুলে রাখলেন স্যার। ম্যাথিউ। আপনি কি আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন পুলিশ কেন কুঠারের হাতলে আপনার একটি চুল খুঁজে পেয়েছিল যে অস্ত্রটি দিয়ে আপনার স্বামীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করা হয়েছে?
জি, স্যার, ম্যাথিউ। আমি ব্যাখ্যা দিতে পারব। আমি ওর নাশতা বানানোর জন্য কিছু কাঠ কাটছিলাম চুল্লি ধরাব বলে।
তাহলে আমাকে এ প্রশ্নটি করতেই হচ্ছে কুঠারের হাতলে আপনার হাতের কোনো ছাপ ছিল না কেন, মিসেস ব্যাঙ্কস?
কারণ আমি গ্লাভস পরে কাজটি করছিলাম, স্যার ম্যাথিউ। আপনি যদি অক্টোবরের মাঝামাঝিতে কোনো খামারে সকাল পাঁচটার সময় কাজ করতে যান তাহলে বুঝতে পারবেন ঠাণ্ডা কাহাকে বলে।
এবারে ক্যাসন তাঁর মুখে হাসি ফুটতে দিলেন।
আপনার স্বামীর জামার কলারে যে রক্তের দাগ পাওয়া গেল তার ব্যাখ্যা কী? ক্রাউনের ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা বলছেন ওটা আপনার রক্ত?
আপনি ভালো করে চোখ বুলালে ওই বাড়ির অনেক কিছুর ওপরেই আমার শরীরের রক্তের দাগ দেখতে পাবেন, স্যার ম্যাথিউ।
আর বেলচায় যে আপনার হাতের ছাপ ভর্তি? ওইদিন সকালে নাশতা বানানোর আগে কি কোনো খোঁড়াখুঁড়ি করছিলেন?
না। তবে তার আগের সপ্তাহে প্রতিদিনই আমাকে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়েছে।
ও, আচ্ছা, বললেন স্যার ম্যাথিউ। এবারে অন্য একটি বিষয় নিয়ে কথা বলব যে কাজটি বোধহয় আপনাকে প্রতিদিন করতে হয় না। বিশেষ করে স্ট্রিকনিন কেনার বিষয়টি। প্রথমত, মিসেস ব্যাঙ্কস, আপনার এতটা বিষ কেনার দরকার পড়ল কেন? দ্বিতীয়ত, এ জিনিস কিনতে সাতাশ মাইলের দূরের রিডিং শহরেই বা গেলেন কেন?
আমি প্রতি বৃহস্পতিবারে রিডিংয়ে কেনাকাটা করতে যাই, ব্যাখ্যা দিলেন মিসেস ব্যাঙ্কস। আশপাশে অ্যাগ্রিকালচারাল কোনো সাপ্লায়ার নেই।
স্যার ম্যাথিউর কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি আসন ছাড়লেন। মন্থর গতিতে মিসেস ব্যাঙ্কসকে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলেন। ওদিকে ক্যাসন একঠায় তাকিয়ে রইলেন মিসেস ব্যাঙ্কসের চোখের দিকে। কিন্তু চোখজোড়া অপলক একদিকেই চেয়ে আছে।
স্যার ম্যাথিউ তাঁর ক্লায়েন্টের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। ঘড়ি দেখলেন। সকাল ১১:১৭। তিনি জানেন তার টাইমিং হতে হবে নিখুঁত কারণ তিনি নিশ্চিত শুধু চতুর নয়, অসম্ভব ধূর্ত এক মহিলার সঙ্গে কাজ করছেন। ভুলে যেয়ো না, নিজেকে মনে মনে বললেন তিনি, ব্রুস ব্যাঙ্কসের মতো পাজি লোকের সঙ্গে যে এগারো বছর ঘর সংসার করতে পারে, টিকে থাকতে তাকে ধূর্ততার পরিচয় দিতেই হবে।
আপনি কিন্তু এখনো বললেন না কেন অতটা বিপুল পরিমাণের স্ট্রিকনিন আপনার দরকার হয়েছিল, ক্লায়েন্টের পেছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন তিনি।
আমাদের অনেকগুলো মুরগি মারা যাচ্ছিল, জবাব দিলেন মিসেস ব্যাঙ্কস বিন্দুমাত্র মাথা না নাড়িয়ে। আমার স্বামীর ধারণা ছিল এসব ইঁদুরের কাজ। ওরাই মুরগিগুলোকে মেরে ফেলছে। সে ইঁদুর মারার জন্য আমাকে বেশি পরিমাণে বিষ কিনে আনতে বলে। চিরতরে নিকেশ করো ঠিক এ কথাটাই বলেছিল সে।
কিন্তু শেষে দেখা যাচ্ছে আপনার স্বামীই নিকেশ হয়ে গেলেন। চিরতরে –এবং নিঃসন্দেহে ওই একই বিষ প্রয়োগে। বললেন স্যার ম্যাথিউ।
রুপার্টের নিরাপত্তা নিয়েও আমি চিন্তিত ছিলাম, কাউন্সেলের ব্যাঙ্গোক্তি এড়িয়ে গেলেন মিসেস ব্যাঙ্কস।
কিন্তু ওই সময় তো আপনার ছেলে বোর্ডিং স্কুলে ছিল, নয় কি?
জি। তবে ওই সপ্তাহের ছুটিতে ওর বাড়ি ফেরার কথা ছিল।
আপনি ওই সাপ্লায়ারের দোকানে আগে কখনো গিয়েছিলেন?
নিয়মিতই যাই, বললেন মিসেস ব্যাঙ্কস। স্যার ম্যাথিউ আরেকটা চক্কর দিয়ে আবার তার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মাসে অন্তত একবার ওই দোকানে যাওয়া হয় আমার, ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। তিনি মাথাটা ডানদিকে একটু ঘোরালেন।
স্যার ম্যাথিউ নিশ্চুপ রইলেন। আরেকবার ঘড়ি দেখার ইচ্ছেটি দমন করলেন। তিনি জানেন আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটি ঘটবে। একটু পরেই ইন্টারভিউ রুমের দূর প্রান্তের দরজাটি খুলে গেল এবং বছর নয়ের একটি বাচ্চা ঘরে ঢুকল।
ওঁরা তিনজন চুপচাপ দেখলেন বাচ্চাটি নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে মিসেস ব্যাঙ্কসের দিকে। রুপার্ট ব্যাঙ্কস তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। হাসল। তবে কোনো সাড়া পেল না। আরও দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল সে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল। তাকে ঠিক যেভাবে করতে বলা হয়েছিল সেভাবেই করল। মিসেস ব্যাঙ্কসের চাউনি স্থির হয়ে আছে স্যার ম্যাথিউ এবং মি. ক্যাসনের মাঝখানে।
ক্যাসনের মুখের হাসিতে এবার প্রায় বিজয় উল্লাস ফুটে ওঠার জোগাড়।
ঘরে কেউ এসেছে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ব্যাঙ্কস। দরজা খোলার শব্দ পেলাম যেন।
না, বললেন স্যার ম্যাথিউ। শুধু আমি আর মি. ক্যাসন ছাড়া আর কেউ নেই এ ঘরে। উইদারিংটন এখনও নিজের জায়গায় প্রস্তরবৎ বসে আছে।
আবার মিসেস ব্যাঙ্কসকে ঘিরে চক্কর দিতে লাগলেন স্যার ম্যাথিউ। জানেন এটাই শেষ সুযোগ। তিনি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছেন ভদ্রমহিলাকে বোধহয় ভুল বিচারই করেছেন। মিসেস ব্যাঙ্কসের ঠিক পেছনে আবার এসে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকালেন জুনিয়রের উদ্দেশ্যে। সে ভদ্রমহিলার সামনেই বসে আছে।
উইদারিংটন তার ব্রেস্ট পকেট থেকে সিল্কের রুমালটি বের করল। ধীরে সুস্থে ভাঁজ খুলল। তারপর টেবিলে সমান করে বিছাল। মিসেস ব্যাঙ্কসের চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
উইদারিংটন ডান হাতের আঙুলগুলো প্রসারিত করল, মৃদু আঁকাল মাথা, তারপর বাম চোখের ওপর হাত রাখল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চট করে কোটর থেকে চোখের মণিটি খুলে বের করে সিল্কের রুমালের ওপর রাখল। ঝাড়া ত্রিশ সেকেন্ড চোখের মণিটি পড়ে রইল রুমালের ওপর, তারপর সে ওটা মুছতে লাগল। বৃত্ত ঘেরা শেষ করলেন স্যার ম্যাথিউ, বসলেন চেয়ারে। দেখলেন ঘাম ফুটেছে মিসেস ব্যাঙ্কসের কপালে।
উইদারিংটন বাদাম আকারের কাঁচের জিনিসটি রুমাল দিয়ে মোছা শেষ করে মুখ তুলে সরাসরি তাকাল মিসেস ব্যাঙ্কসের দিকে। তারপর মণিটি তার শূন্য কোটরে ঠেসে ঢোকাল। মিসেস ব্যাঙ্কস ঝট করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন মুখ। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন দ্রুত, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
চেয়ার ছাড়লেন স্যার ম্যাথিউ। হাসলেন তাঁর ক্লায়েন্টের দিকে তাকিয়ে। ক্লায়েন্টও ফিরিয়ে দিলেন হাসি।
মন থেকেই বলছি, মিসেস ব্যাঙ্কস, বললেন তিনি, মানুষ হত্যার জন্য গিল্টি প্লি করা হলে আমি সত্যি খুব আশ্বস্তবোধ করব।
(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)