হনুমানের বাল্যকাল

হনুমানের বাল্যকাল

 হনুমানের মায়ের নাম ছিল অঞ্জনা। বানরের স্বভাব যেমন হইয়া থাকে, অঞ্জনার স্বভাবও ছিল অবশ্য তেমনিই। হনুমান কচি খোকা, তাহাকে ফেলিয়া অঞ্জনা বনের ভিতরে গেল, ফল খাইতে। বনে গিয়া সে মনের সুখে গাছে গাছে ফল খাইয়া বেড়াইতে লাগিল, এদিকে খোকা বেচারা যে ক্ষুধায় চ্যাঁচাইতেছে, সে কথা তাহার মনেই হইল না।

 হনুমান বেচারা তখন আর কি করে? চ্যাঁচাইয়া সারা হইল, তবু মার দেখা নাই, কাজেই তাহার নিজেকেই কিছু খাবারের চেষ্টা দেখিতে হইল। সেটা ছিল ভোৱের বেলা, টুকটুকে লাল সূর্যটি তখন সবে বনের আড়াল হইতে উঁকি মারিতেছে সেই টুকটুকে সূর্য দেখিয়াই হনুমান ভাবিল ওটা একটা ফল। অমনি আর কথাবার্তা নাই, সে একলাফে আকাশে উঠিয়া ভয়ানক সোঁ সোঁ শব্দে সেই ফল পাড়িয়া খাইতে ছুটিল।

 তোমরা আশ্চর্য হইও না। মুমান তখন কচি খোকা বটে, কিন্তু সে যে-সে খোকা ছিল না, সে কথা আমরা সহজেই বুঝিতে পারি। সেই শিশুকালেই তাহার বিশাল দেহ ছিল, আর গায়ের রঙটি ছিল সেই ভোরবেলার সূর্যের মতোই ঝক্‌ঝকে লাল। দেব দানব যক্ষ সকলেই তাহার কাণ্ড দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। অবাক না হইবেই বা কেন? সেই খোকা এমন ভয়ংকর ছুটিয়া চলিয়াছে যে, তেমন গরুড়েও পারে না, ঝড়েও পারে না। সকলে বলিল, “শিশুকালেই এমন, বড় হইলে না জানি এ কেমন হইবে।”

 এদিকে হনুমান গিয়া তো সূর্যের কাছে পৌছিয়াছে, কিন্তু ইহার মধ্যে আর এক ব্যাপার উপস্থিত। সেইদিন ছিল গ্রহণের দিন, রাহু বেচারা অনেক দিনের উপবাসের পর সেইদিন সূর্যকে খানিক সময়ের জন্য গিলিয়া একটু শান্ত হইতে পাইবে। সে অনেক আশা করিয়া সূর্যকে গিলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিল, কিন্তু সেখানে হনুমানকে দেখিয়া ভয়ে তাহার প্রাণ উড়িয়া গেল। সে অমনি “বাবা গো!” বলিয়া প্রাণপণে দে ছুট্‌, ছুটিতে ছুটিতে একেবারে ইন্দ্রের সভায় গিয়া উপস্থিত।

 ইন্দ্রের কাছে গিয়া সে নিতান্ত ব্যস্তভাবে বলিল, “আপনারই হুকুমে আমি সূর্যটাকে গিলিয়া ক্ষুধা দূর করি; এখন আবার সেই সূর্য কাহাকে দিয়া ফেলিয়াছেন? আজ তো দেখিতেছি আর একটা রাহু তাহাকে গিলিতে আসিয়াছে।”

 এ কথায় ইন্দ্র যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া তখনই ঐরাবতে চড়িয়া দেখিতে চলিলেন, ব্যাপারটা কি? রাহু তাহার আগে ছুটিয়া আবার সূর্যের নিকট গিয়াছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে টিকিতে পারে নাই।

 রাহুর কিনা দেহ নাই, শুধুই একটি গোল মাথা, কাজেই হনুমান, তাহাকে দেখিবামাত্র ফল মনে করিয়া ধরিতে আসিল। রাহু তখন “ইন্দ্র! ইন্দ্র।” বলিয়া চ্যাঁচাইয়া অস্থির। ইন্দ্র বলিলেন, “ভয় নাই আমি এটাকে এখনই মারিয়া ফেলিতেছি।”

 তখন হনুমান তাড়াতাড়ি ইন্দ্রের দিকে ফিরিয়া তাকাইতেই, ঐরাবতের প্রকাণ্ড সাদা মাথাটা তাহার চোখে পড়িল। সে ভাবিল, এটাও বুঝি একটা ফল। এই ভাবিয়া যেই হনুমান, সেটাকে ধরিতে গিয়াছে, অমনি ইন্দ্র ব্যস্ত সমস্ত হইয়া তাহার উপরে বজ্র ছুঁড়িয়া মারিলেন।

 সেই বজ্রের ঘায়ে একটা পাহাড়ের উপর পড়িয়া ‘হনু’ অর্থাৎ দাড়ি ভাঙিয়া যাওয়াতেই তাহার ‘হনুমান’ এই নামটি হইয়াছিল। পাহাড়ের উপর পড়িয়া সে যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছে এমন সময় তাহার পিতা পবন আসিয়া তাহাকে কোলে করিয়া একটা পর্বতের গুহায় লইয়া গেলেন। তারপর তিনি রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “দাঁড়াও ইহার শোধ ভালো মতেই লইব।”

 পবন, অর্থাৎ বায়ু, হইতেছে সংসারের প্রাণ, সেই বায়ু রাগিয়া বসিলে কি বিপদই না ঘটিতে পারে। সেই রাগের চোটে বাহিরের বায়ু কোথায় চলিয়া গেল, দেহের ভিতরের বায়ু উৎকট হইয়া উঠিল। নিশ্বাস ফেলিতে না পারিয়া জীবজন্তুর প্রাণ যায় যায়। বায়ুর উৎপাতে সকলের মাথা খারাপ হইয়া গেল, তাহারা এক করিতে আর করিয়া বসে। দেবতাদের অবধি পেট ফাঁপিয়া ফানুসের মতো হইয়া গেল ঠিক যেন উদরীর বেয়ারাম।

 সেই অবস্থায় সকল দেবতা কাঁদিতে কাঁদিতে ব্রহ্মার নিকট গিয়া বলিলেন, “প্রভু! আমাদের দশা দেখুন। ইহার উপায় কি হইবে?” ব্রহ্মা বলিলেন, “উপায় আর কি? চল বায়ুর নিকট গিয়া তাহাকে খুশি করি। ইহা ভিন্ন আর আমাদের গতি নাই।”

 পবন অচেতন হনুমানকে লইয়া কোলে করিয়া গুহায় বসিয়া আছেন এমন সময় ব্রহ্মাকে লইয়া দেবতাগণ সেখানে গিয়া উপস্থিত। ব্রহ্মা আসিয়া হনুমানের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেই সে সুস্থ হইয়া উঠিয়া বসিল, যেন তাহার কখনো কোনো অসুখ হয় নাই। ইহাতে পবন কত দূর খুশি হইলেন বুঝিতেই পার। পবনের রাগ চলিয়া যাওয়াতে কাজেই সংসারের সকল জীবের বিপদও কাটিয়া গেল।

 তখন ব্রহ্মা দেবতাদিগকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, এই খোকা বড় হইলে তোমাদের অনেক কাজ করিয়া দিবে। সুতরাং তোমরা সকলে ইহাকে বর দিয়া খুশি কর।” এ কথায় দেবতারা যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া হনুমানকে বর দিতে লাগিলেন। সেই সকল বরের জোরে হনুমান চিরজীবী হইয়া গেল। কোনো দেবতা বা যক্ষ, গন্ধর্ব বা মানুষের কোনো অস্ত্রে তাহার মরণের ভয় রহিল না। কেহ শাপ দিয়া তাহার প্রাণনাশ করার পথ অবধি বন্ধ হইল। তাহা ছাড়া ব্রহ্মা বলিলেন, “তুমি ভগবানকে জানিতে পারিবে, আর যখন যেমন ইচ্ছা, তেমনি রূপ ধরিতে পারিবে।” সূর্য বলিলেন, “আমার তেজের শতভাগের এক ভাগ তোমাকে দিলাম। আর একটু বয়স হইলে আমি তোমাকে লেখাপড়া শিখাইব:তাহা হইলে তুমি খুব বলিতে কহিতে পারিবে।”

 বর পাইয়া হনুমান বড় লোক হইয়া গেল! তবে অবশ্য;ইহার সকল ফল ফলিতে সময় লাগিয়াছিল। শিশুকালে তাহার স্বভাব অন্যান্য বানরছানার চেয়ে বেশি উঁচুদরের ছিল না। মুনিদের আশ্রমে গিয়া সে দৌরাত্মটা যা করিত, সে আর বলিবার নয়। তাহার পিতামাতা কত নিষেধ করিতেন, কিন্তু সে কি নিষেধ শুনিবার পাত্র? তাহার উৎপাতে মুনিদের কোশাকুশী, ঘটি, বাটি, কাপড়-চোপড় কিছু আগলাইয়া রাখিবার জো ছিল না। এদিকে আবার তাহাকে শাপ দিয়াও ফল নাই, কারণ, ব্রহ্মার বরে শাপে মরিবার ভয় তাহার কাটিয়া গিয়াছে আর তাহাকে দেখিয়া তাঁহাদের কতকটা মায়াও হইত। কাজেই তাঁহারা নিরুপায় হইয়া তাহার অত্যাচার সহ্য করিতেন, আর ভাবিতেন, উহাকে বেশি ক্লেশ না দিয়া কি উপায়ে একটু জব্দ করা যায়। শেষে অনেক বুদ্ধি করিয়া তাঁহারা তাহাকে এই শাপ দিলেন, “যা বেটা, তোর যত ক্ষমতা তাহার কথা তুই একেবারে ভুলিয়া যা। বড় হইলে কেহ সেই ক্ষমতার কথা তোকে মনে করাইয়া দিবে, তখন তুই অনেক অদ্ভুত কাজ করিবি।”

 তখন হইতে হনুমান সামান্য বানরছানার ন্যায় নিতান্ত ভয়ে ভয়ে চলে, আর দূর হইতে কাহাকেও দেখিলেই প্রাণপণে ছুটিয়া পলায়। কাজেই মুনিদেরও আর তাহার অত্যাচার সহিতে হয় না। যাহা হউক, সে এর মধ্যে সূর্যের নিকটে ঢের লেখাপড়া শিখিয়া ফেলিল। মুনিদের বাড়ি গিয়া সে যাহাই করুক, লেখাপড়ায় যে সে খুব লক্ষ্মীছেলে ছিল, একথা স্বীকার করিতেই হইবে। কি পরিশ্রম করিয়াই না সে লেখাপড়া শিখিয়াছিল। সূর্য তো আর এক জায়গায় বসিয়া থাকেন না, যে, পুঁথি লইয়া তাহার কাছে গিয়া বসিলেই কাজ হইবে। হনুমানকে উদয় হইতে অন্ত পর্বত পর্যন্ত রোজ তাঁহার পিছু পিছু ছুটাছুটি করিয়া পড়া বুঝিয়া লইতে হইত। তাহার ফলে সে বিদ্বানও হইয়াছিল বড়ই ভারি রকমের। এমন পণ্ডিত অতি অল্পই জন্মাইয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *