সূর্যের গৃহিনী

সূর্যের গৃহিনী

 বিশ্বকর্মার নাম তোমরা সকলেই শুনিয়াছ। বিশ্বকর্মা দেবতাদের কারিগরদের দেবতা। এই দেবতার একটি মেয়ে ছিল, তাহার নাম সংজ্ঞা; কেহ কেহ তাহাকে উষা আর সুরেণু বলিয়াও ডাকিত।

 বাপের ঘরে সংজ্ঞা সুখেই ছিলেন। কিন্তু, শেষে তাঁহার পিতা যখন সূর্যদেবের সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন, তখন হইতেই বেচারীর দুঃখের দিন আরম্ভ হইল। সূর্যের যে কি ভয়ানক তেজ, তাহা তোমরা সকলেই দেখিতেছ। দুরে থাকিয়াই এত তেজ, কাছে গেলে সে যে কিরকম হইবে, তাহা তো আমরা ভাবিয়াই উঠিতে পারি না। এর উপর আবার সেকালে নাকি সূর্যের তেজ এখনকার চেয়ে ঢের বেশি ছিল। তখন সূর্যের দেহ এমন সুন্দর গোল ছিল না; কদম ফুলের কেশরের মতো, তাহার চারিদিকে কিরণের ছটা বাহির হইত, তাহার যে কি ভয়ংকর তেজ, তাহা বেচারী সংজ্ঞাই বুঝিতে পারিয়াছিলেন।

 তবু সে তেজ সহিয়া থাকিতে সংজ্ঞা চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। ঝলসিয়া পুড়িয়া ফোস্কা পড়িয়া, তাঁহার দুর্দশার একশেষ হইল, তবু তিনি অনেকদিন ধরিয়া সূর্যের সেবা করিলেন। ক্রমে, মনু, যম, আর যমুনা বলিয়া তাঁহার তিনটি খোকা-খুকি হইল। খোকা-খুকিরা দূরে দূরে খেলা করিয়া বেড়ায়, তাহাদের কোনো কষ্ট নাই। যত কষ্ট সংজ্ঞার, কেননা, তাঁহাকে সূর্যের কাছে থাকিয়া তাহার সেবা করিতে হয়। এতদিন সে কষ্ট সহিয়া সহিয়া তাঁহার শরীর মাটি হইয়া গেল, আর সহিতে পারেন না।

 তখন সংজ্ঞা অনেক ভাবিয়া এক বুদ্ধি বাহির করিলেন। বিশ্বকর্মার মেয়ে, কাজেই অনেকরকম কারিকুরি তাঁহার জানা ছিল। আর সেই কারিকুরিতে এখন তাঁহার বড়ই কাজ হইল। তিনি সকলের অসাক্ষাতে এমন একটি মেয়ে তয়ের করিলেন যে, সে দেখিতে অবিকল তাহার নিজেরই মতন, কিন্তু সূর্যের তেজে তাহার কিছুই হয় না। মেয়েটির নাম রাখিলেন ছায়া।

 ছায়া তয়ের হওয়ামাত্র হাতজোড় করিয়া সংজ্ঞাকে বলিল, “আমাকে কি করিতে হইবে?” সংজ্ঞা বলিলেন, “আমি বাপের বাড়ি যাইতেছি, তুমি এখানে থাকিয়া ঘরকন্না কর। আমার খোকা-খুকিদের যত্ন করিয়া খাইতে পরিতে দিয়ো। আর, আমি যে চলিয়া গেলাম, এ কথা কাহাকেও বলিয়ো না।”

 এইরূপ কথাবার্তার পর সংজ্ঞা ছায়াকে সেখানে রাখিয়া ভয়ে ভয়ে, তাঁহার পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। বিশ্বকর্মা কিন্তু ন্যার দুঃখ বুঝিতে পারিলেন না। তিনি সংজ্ঞাকে দেখিয়া আশ্চর্য তো হইলেনই, বিরক্ত হইলেন তাহার চেয়েও বেশি। তিনি বলিলেন, “তুমি ভারি অন্যায় করিয়াছ, এখনি ফিরিয়া যাও।”

 বাপের বাড়িতে আসিয়াও সংজ্ঞার দুঃখ ঘুচিল না। বকুনির জ্বালায় সেখানে টিকিয়া থাকাই তাহার দায় হইল। কাজেই তখন আর কি করা যায়? সংজ্ঞা একটি ঘোটকী সাজিয়া সেখান হইতে উত্তর মুখে ছুটিয়া পলাইলেন। সকল দেশের উত্তরে কুরুবর্ষ বা উত্তর কুরু। সেখানকার সুন্দর সবুজ মাঠের কচি কচি ঘাসগুলি খাইতে বড়ই মিষ্ট। সংজ্ঞা ছুটিতে ছুটিতে সেই দেশে গিয়া, সেখানকার সুন্দর মাঠের মিষ্ট ঘাস খাইয়া মনের আনন্দে কাল কাটাইতে লাগিলেন। সেখানে পুড়িয়াও মরিতে হয় না, বকুনিও খাইতে হয় না।

 এদিকে সূর্যদেবের ঘরে কাজকর্ম সুন্দর মতেই চলিতেছে। ছায়া দেখিতে ঠিক সংজ্ঞারই মতো, আর কাজেকর্মেও বেশ ভালো। সুতরাং সূর্যদেব টেরই পান নাই যে একটা কিছু হইয়াছে। খোকা-খুকিরা কিন্তু ইহার মধ্যে বুঝিতে পারিয়াছে যে তাহাদের মা আর তাহাদিগকে ভালোবাসে না। তাহারা জানুক, আর নাই জানুক, ছায়া তো আর তাহাদের মা নয়। সে তাহাদিগকে মার মতো ভালবাসিবে কি করিয়া? মনু শান্ত ছেলে, সে আদর না পাইয়াও চুপ করিয়া রহিল। যম রাগী, সে অভিমানের ভয়ে ছায়াকে পা দেখাইয়া বলিল, “তোমাকে লাথি মারিব।” ছায়াও তখন রাগে অস্থির হইয়া বলিল, “বটে? এত বড় আস্পর্দা? তোর ঐ পা খসিয়া পড়ুক।”

 শাপের ভয়ে যম কাঁদিতে কাঁদিতে সূর্যের নিকট গিয়া নালিশ করিল, “বাবা, মা আমাদের ভালোবাসেন না বলিয়া আমি তাঁহাকে পা দেখাইয়াছিলাম, তাহাতে তিনি বলিয়াছেন, আমার পা খসিয়া পড়িয়া যাইবে। বাবা আমি তো লাথি মারি নাই, তুমি আমার পা খসিয়া পড়িতে দিয়ো না।” সূর্য বলিলেন, “বাবা, তোমার মা যখন শাপ দিয়াছেন, তখন তো আর তাহা আটকাইবার উপায় নাই। তবে, এইটুকু করা যাইতে পারে যে পোকায় তোমার পায়ের মাংস অল্পে অল্পে লইয়া যাইবে, আস্ত পা খসিয়া পড়ার দরকার হইবে না।”

 তারপর সূর্যদেব ছায়ার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি মা হইয়া ছেলের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করিতেছ?” ছায়া প্রথমে চুপ করিয়া রহিল কিন্তু তারপরই যখন সূর্য বিষম রাগের ভরে তাঁহার চুল ধরিয়া শাপ দিবার আয়োজন করিলেন, তখন আর সে না বলিয়া যায় কোথায়?

 সেকথা শুনিয়া সূর্য যে কিরূপ ব্যস্তভাবে তাঁহার শ্বশুরের নিকট ছুটিয়া আসিলেন, তাহা কি বলিব। বিশ্বকর্মা দেখিলেন, ঠাকুর বড় বেজায় রকমের চটিয়াছে, তাঁহার মুখ দিয়া ভালো করিয়া কথাই বাহির হইতে পারিতেছে না। তখন তিনি তাঁহাকে অনেক মিষ্টকথায় শান্ত করিয়া বলিলেন, “ঠাকুর জানেন তো আপনার তেজ কি ভয়ংকর। আমার মেয়ে সে তেজ কিছুতেই সহিতে না পারিয়া ভয়ে পলায়ন করিয়াছে। তবে, আপনি যদি চাহেন তো আপনার এই তেজ আমি অনেকটা কমাইয়া দিতে পারি। তাহা হইলে সংজ্ঞারও আপনার নিকট থাকিতে কষ্ট হইবে না। আর আপনার চেহারাটাও অনেক মোলায়েম হইয়া যাইবে।”

 সূর্য বাস্তবিকই সংজ্ঞাকে অতিশয় ভালোবাসিতেন। কাজেই তিনি তৎক্ষণাৎ বিশ্বকর্মার কথায় রাজি হইলেন। বিশ্বকর্মা আর দেরি না করিয়া তাড়াতাড়ি ঠাকুরকে কুঁদে চড়াইয়া দিলেন। আগেই বলিয়াছি, সূর্য সে সময়ে তেমন গোল ছিলেন না। কুঁদে চড়াইয়া সোঁ সোঁ শব্দে কয়েক পাক দিতেই তাহার উষ্কশুষ্ক কিরণগুলি বাটালির মুখে উড়িয়া গেল আর তাহার ভিতর হইতে তাহার ঐ সুন্দর গোল মুখখানি দেখা দিল, তখন সকলেই বলিল, “বাঃ, বেশ হইয়াছে। এখন ঠাকুর যেমন ঠাণ্ডা, তেমনি দেখিতে ভালো।”

 এ কথায় সূর্যদেব যারপরনাই সন্তুষ্ট হইয়া সংজ্ঞাকে খুঁজিতে বাহির হইলেন। তিনি শুনিয়াছিলেন, সংজ্ঞা ঘোটকী সাজিয়া উত্তরদিকে পলায়ন করিয়াছেন। কাজেই তাঁহাকে কোন দিকে যাইতে হইবে তাহা আর বুঝিতে বাকি রহিল না। সংজ্ঞা সাজিয়াছিলেন ঘোটকী, তিনি সাজিলেন ঘোড়া। তারপর সেই যে সেখান হইতে তিনি চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ছুট দিলেন আর একেবারে সংজ্ঞার সম্মুখে উপস্থিত না হইয়া থামিলেন না। কিন্তু সংজ্ঞাকে তিনি সহজে ধরিতে পারেন নাই, কারণ সে বেচারী কি করিয়া জানিবেন যে ঐ যে চিঁ-হিঁ হিঁ হিঁ শব্দে ঘোড়াটি ছুটিয়া আসিতেছে সেই হইতেছে তাঁহার স্বামী? কাজেই তিনি তাহাকে দেখিয়া প্রাণপণে ছুটিয়া পলাইয়াছিলেন। যাহা হউক, শেষে সকল গোলই চুকিয়া গেল, আর তখন তো সুখের সীমাই রহিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *