শিবের বিয়ে

শিবের বিয়ে

 দুর্গার এক নাম ‘পার্বতী’, অর্থাৎ পর্বতের মেয়ে। তাঁর পিতা হিমালয়, মা মেনকা। শিবের সঙ্গে যাতে তাঁর বিয়ে হয়, এজন্য পার্বতী অনেকদিন ধরে কঠিন তপস্যা করেছিলেন, তার ফলে শেষে শিবের সঙ্গেই তাঁর বিয়ে হল।

 পার্বতীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বিবাহ করতে চাইলেন। কিন্তু বর যে, সে তো আর নিজের কনের বাপের কাছে গিয়ে বিয়ে ঠিক করতে পারে না, তাহলে লোকে হাসে! কাজেই শিব সপ্তর্ষিদের ডেকে পাঠালেন। সপ্তর্ষিরাও তখনই সোনার বল্কল পরে, মুক্তামালা

গলায় দিয়ে, মণি-মাণিক্যের গহনা ঝল্‌মলিয়ে তাঁর কাছে এসে জোড়হাতে বললেন, ‘‘আমাদের কি সৌভাগ্য! প্রভু আজ আমাদের স্মরণ করেছেন। আজ্ঞা করুন, আমাদের কি করতে হবে।”

 শিব বললেন, ‘‘আমি হিমালয় পর্বতের মেয়ে পার্বতীকে বিয়ে করতে চাই; তোমরা তাঁর কাছে গিয়ে সব ঠিকঠাক কর। দেখো যেন ভালোমতে কাজটি করে আসতে পার।”

 সপ্তর্ষিরা তখন নিমেষের মধ্যে আকাশে উড়ে, সেই ঝক্‌ঝকে হিমালয় পর্বতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হিমালয় দূরে থেকে তাঁদের দেখতে পেয়ে মেনকাকে বললেন, “না জানি ঐ সাতটি সূর্য কি করতে আমাদের এখানে আসছে!” বলতে বলতেই তিনি দেখলেন, ওসব সূর্য নয়, সাতটি মুনি। তখন তিনি তাড়াতাড়ি তাঁদের কাছে গিয়ে, জোড়হাতে তাঁদের নমস্কার করে বসতে সুন্দর আসন দিয়ে বললেন,“মুনি-ঠাকুরেরা কি মনে করে আমাদের এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন?” মুনিরা বললেন, ‘‘শিব তোমার কন্যা পার্বতীকে বিয়ে করতে চেয়েছেন, তাই আমরা এসেছি। এমন জামাই আর পাবে না রাজা, শিবের কাছে তোমার পার্বতীর বিয়ে দাও।”

 তা শুনে হিমালয়ের আর আনন্দের সীমাই রইল না। তিনি তখনি ছুটে গিয়ে, পার্বতীকে সাজিয়ে গুজিয়ে এনে মুনিদের কোলে বসিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন, আমার পার্বতীকে।” এমন সুন্দর লক্ষ্মী মেয়ে আর কখনো হয় নি, হবেও না। পার্বতীকে দেখে স্নেহে মুনিদের মন গলে গেল। তাঁরা তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে, তাঁকে কত আশীর্বাদ করে, বিয়ের সব কথাবার্তা বলে সেখান থেকে পরম আনন্দে হাসতে হাসতে চলে এলেন। স্থির হল যে আর তিনদিন পরেই শিবের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হবে।

 সপ্তর্ষিরা শিবের কাছে এসে এসব কথা জানালে শিব যারপরনাই খুশি হয়ে বললেন, “বেশ বেশ! বিয়ের সময় তোমরা আমার পুরুত হবে কিন্তু। তোমাদের শিষ্যদেরও নিয়ে আসবে।”

 মুনিরা সে কথায় ‘যে আজ্ঞা’ বলে চলে যেতেই শিব বিয়ের আয়োজন করবার জন্য তাঁর ভূত প্রেত নিয়ে কৈলাস পর্বতে চলে এলেন। তারপর তিনি নারদকে ডেকে বললেন, “নারদ, বিয়ের ঠিক করেছি; কনে হচ্ছেন হিমালয়ের মেয়ে পার্বতী। এখন তুমি একটি কাজ কর তো; দেবতাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করে এস। মুনি-ঋষিদেরও বলবে; যক্ষ-গন্ধর্বেরাও যেন বাদ না পড়ে। সকলকেই আসতে হবে; যে না আসবে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছড়ি হবে।”

 নারদ মুনি যেমন তেমন চালাক লোক ছিলেন না, শিবের হুকুমমতো সব কাজ করে ফেললেন।

 ততক্ষণে কৈলাস-পর্বতে খুবই ধুমধাম পড়ে গেছে; ভূতেরা ঢাক, ঢোল, শিঙ্গা, সানাই, কাঁসর, করতাল সব বাজিয়ে সৃষ্টি মাথায় করে তুলেছে। তাদের মুখে আজ আর হাসি ধরে না। ক্রমে দেবতারাও একজন দুজন করে এসে উপস্থিত হলেন। হাঁসে চড়ে ব্রহ্মা এলেন, গরুড়ে চড়ে বিষ্ণু এলেন। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ, কেউ আসতে বাকি রইলেন না। গন্ধর্ব আর অপ্সরারা তো এর ঢের আগেই এসে গান বাজনা জুড়ে দিয়েছে। শিবও সেই কখন থেকে সেজেগুজে প্রস্তুত হয়ে আছেন। বরের বেশে তাঁকে কি সুন্দরই দেখাচ্ছে।

 তারপর সকলে শিবকে নিয়ে রওনা হলেন। দেবতারা নিজ নিজ দল নিয়ে বরের আগে আগে যেতে লাগলেন, বাজনদারেরা মাথা দুলিয়ে নাচতে নাচতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাজিয়ে চলল।

 এদিকে হিমালয়ও চুপ করে বসে থাকেন নি। পার্বতীকে নাইয়ে, সাজিয়ে তাঁরাও প্রস্তুত হয়ে আছেন। বাড়ি ঘর সাজিয়ে, তোরণ বানিয়ে, নিশান উড়িয়ে, স্বপ্নপুরীর মতো সুন্দর করা হয়েছে। পর্বতেরা সকলে সেজেগুজে সপরিবারে এসে কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছেন। শিবকে এগিয়ে আনবার জন্য স্বয়ং গন্ধমাদন পর্বত কখন বেরিয়ে গেছেন। বর এলে তাকে আদর করে আনতে হবে, সেজন্য নিজে হিমালয় ফটকে দাঁড়িয়ে।

 বাড়ির ভিতরেও অবশ্যি কেউ চুপ করে নাই। মেয়েদের আজ বড়ই আনন্দ আর উৎসাহ। পার্বতীর মা মেনকাদেবী তো আনন্দে মাথা ঠিকই রাখতে পাচ্ছেন না। তিনি এরই মধ্যে নারদ মুনিকে সঙ্গে করে গিয়ে ছাতে উঠে আছেন—যার জন্যে মেয়ে এত তপস্যা করলেন, সেই শিবকে সকলের আগে দেখতে হবে। সাধারণ দেবতারাই যখন দেখতে এত সুন্দর, শিব না জানি তবে কত সুন্দর।

 এমন সময় গন্ধর্বের রাজা বিশ্বাবসু এলেন। তিনি দেখতে খুবই সুন্দর, তাঁকে দেখে মেনকা বললেন, “এই বুঝি শিব!” নারদ তাতে হেসে বললেন, “না, না—ও তো আমাদের বাজনদার, ও কেন শিব হবে? তা শুনে মেনকা তো থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, ভাবলেন, ‘বাজনদারই দেখতে এমন, শিব না জানি তবে কেমন!’

 তারপর এলেন যক্ষদের নিয়ে কুবের; তিনি গন্ধর্বের রাজার চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর। মেনকা বললেন, “তবে এই শিব!” নারদ বললেন, “না!” শুনে মেনকা আরো আশ্চর্য হলেন।

 তারপর এলেন বরুণ, তিনি কুবেরের চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর; তারপর এলেন যম, তিনি বরুণের চেয়ে দ্বিগুণ সুন্দর; তারপর এলেন ইন্দ্র, তিনি যমের চেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর। মেনকা এঁদের একেকজনকে দেখে ভারি খুশি হয়ে বললেন, “এ নিশ্চয় শিব!” নারদ তাতে না বললেন, তিনি অপ্রস্তুত হয়ে মাথা চুলকাতে লাগলেন।

 এমনি করে সূর্য, চন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, বৃহস্পতি সকলকে দেখেই মেনকা বললেন, “এই শিব!” যখন শুনলেন যে এঁদের কেউ শিব নন, শিব এঁদের চেয়েও বড়, তখন তাঁর এতই আশ্চর্য বোধ হল যে, তিনি আর ভাবতেই পারলেন না, সেই শিব তবে কত সুন্দর।

 এমন সময় ভূত প্রেত ব্রহ্মদৈত্যি সব নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। এত ভূত আর মেনকা কখনো একসঙ্গে দেখেন নি; তাদের সেই বিকট ভেঙ্‌চি দেখেই তাঁর মাথা ঘুরে গেল। তাদের সঙ্গে যে আবার পাঁচমুখো একটা কে ষাঁড়ে চড়ে এসেছে—মাথায় জটা, পরনে বাঘছাল, গায়ে ছাই মাখা, গলায় মড়ার মাথা—সে কথার খবর নিবার খেয়ালই তাঁর রইল না। তখন নারদ সেই দেবতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন—“এই শিব!”

 যেই এই কথা বলা, অমনি মেনকা, “ও লক্ষ্মীছাড়া পোড়ারমুখী পার্বতী! করেছিস কি!” বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

 শিব সে কথা জানতে পেরে ছুটে এসে মেনকার মাথায় জল ঢেলে অনেক হাওয়া করতে শেষে তাঁর জ্ঞান হল।

 তখন যে তিনি শিবকে আর নারদকে বকুনিটা বকলেন! নারদের অপরাধ ছিল এই যে তিনি বলেছিলেন, “শিব বড় ভালো, তাঁর সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হবে।” বকতে বকতে তাঁর সেই সাত মুনির কথা মনে পড়ল যাঁরা পার্বতীর বিয়ে ঠিক করতে এসেছিলেন। অমনি তিনি তাঁদের উপর যারপরনাই চটে বললেন, “বেটারা গেল কোথায়? আজ তাদের দাড়ি ছিঁড়তে হবে।” আবার তখনই মাথায় চাপড় মেরে বললেন, “আর তাদেরই বা দোষ কি! ঐ অভাগী মেয়েই তো যত নষ্টের গোড়া!” এই বলে তিনি পার্বতীকে কত গালই দিলেন। শেষে তিনি বললেন, “আমি কিছুতেই এই কদাকার বুড়োর কাছে মেয়ের বিয়ে দিব না। ওর না আছে টাকা, না আছে গুণ, না জানে লেখাপড়া, না পারে একটা ঘোড়া কিনে চড়তে।”

 তখন সকলে মিলে মেনকাকে কত বুঝাইলেন, কারও কথায় কিছু হল না। পার্বতী নিজে এসে একবার তাঁকে মিনতি করে দুটো কথা বলেছিলেন, তাতে তিনি দাঁত কড়্‌মড়িয়ে খেপে উঠে পার্বতীকে এমনি কিল আর কনুয়ের গুঁতো মারতে লাগলেন যে, নারদ মুনি তাড়াতাড়ি এসে তাঁকে ছড়িয়ে না নিলে সেদিন ভারি মুশকিল হত আর কি!

 যা হোক শেষে বিষ্ণু এসে অনেক উপদেশ দিতে মেনকার মন একটু শান্ত হল। ঠিক সেই সময়ে নারদও শিবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁর চেহারা অনেকটা শুধরিয়ে এনে মেনকার সামনে উপস্থিত করলেন। তখন মেনকা দেখলেন যে শিবের মাথায় জটা আর গায়ে ছাঁই বলে তাঁকে একটু উস্কোখুস্কো দেখায় বটে, কিন্তু আসলে তিনি সকল দেবতার চেয়ে সুন্দর। মেনকা যতই তাঁর মুখের দিকে তাকান, ততই তাঁর মনে হয় যে, ‘আহা কি মিষ্টি! কি সরল!’

 এমনিভাবে মেনকা অনেকক্ষণ অবাক হয়ে শিবের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “আহা! আমার পার্বতীর কপাল ভালো যে এমন স্বামী পেয়েছে!” তা শুনে শিবের ভারি লজ্জা হওয়ায় তিনি জড়সড় ভাবে দেবতার কাছে চলে গেলেন।

 এদিকে মেয়েদের মহলে ভয়ানক ছুটাছুটির ধুম লেগে গেছে। সবাই বলছে, “আরে, দেখ এসে, পার্বতীর কি সুন্দর বর হয়েছে।” তারা যে যেমন ছিল, তেমনি ভাবে, কেউ রান্না ফেলে, কেউ কলসী কাঁকে, কেউ চুল বাঁধতে বাঁধতে কেউ ঘোমটা টানতে টানতে, কেউ আছাড় খেতে খেতে এসে উপস্থিত হল। শিবকে তারা চন্দন দিয়ে, খৈ দিয়ে, আরো কতরকমে পূজো যে করল তা কি বলব! তাঁকে নিয়ে হাসি তামাশা কত হল, তার তো অন্তই নাই। মেনকা অবধি এসে তাতে যোগ না দিয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি শিবের পিছনে গিয়ে, তাঁর গলায় কাপড় জড়িয়ে টানতে আরম্ভ করেছিলেন, দেবতারা দেখে ফেলায় হাসতে হাসতে ঘরে পালিয়ে গেলেন।

 তারপর শিবকে রেশমী কাপড় পরিয়ে তাঁর গলায় সোনার ফুলের মালা, কপালে তিলক দিয়ে তাঁকে আর পার্বতীকে বিয়ের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। মুনিরা বেদ পড়তে লাগলেন। ব্রহ্মা তাঁদের দিয়ে বিয়ের সকল কাজ করিয়ে নিলেন। তারপর তাঁর কথায় এসে শিব আর পার্বতীর কপালে খৈ ছড়িয়ে দিতে লাগল। আর, গন্ধর্ব আর অন্সরারা মিলে গান বাজনা যে খুবই করল, তার তো কথাই নাই।

 এমনি করে শিব আর পার্বতীর বিয়ে হয়ে গেল। হিমালয় দেবতাদের সকলকে এমনি আদর অভ্যর্থনা করলেন যে তাঁদের লাজে মাথা হেঁট করে থাকতে হল। তারা হিমালয়কে কত আশীর্বাদ যে করলেন, তার লেখাজোখা নাই। তখন মেনকা লাজে জড়সড় হয়ে তাঁদের কাছে এসে বললেন, “ঠাকুর। আপনাদের কাছে আমি ভারী পাগলামি করেছি, আমার বড় অপরাধ হয়েছে, আমাকে মাপ করতে হবে।” দেবতারা হেসে বললেন, “আপনার কোনো চিন্তা নাই; আপনি যা করছেন তাতে আমরা আমোদই পেয়েছি। আপনার দিন দিন সৌভাগ্য বাড়তে থাকুক।”

 তখন আবার বাজনা বেজে উঠল, সকলে সেজে প্রস্তুত হল, দেবতারা মনের সুখে বর কনে নিয়ে কৈলাসে যাত্রা করলেন। হিমালয় আর মেনকা সকলকে নিয়ে এঁদের গন্ধমাদন পর্বত অবধি এগিয়ে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে ভাবলেন, ‘হায়, সব যে অন্ধকার! কোথায় গেল আমাদের পার্বতী?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *