সৎকার

সৎকার

ভোরের হিম বাতাস বইছে উত্তর থেকে। আবার আসছে শীত। কিছুকাল অন্তর অন্তরই এরকম হয়। পালটে যায়, আকাশ-বাতাস, জল, জলের রংচং। এ এক বিস্ময়। এই বিস্ময়ের সঙ্গে আজও মানিয়ে নিতে পারল না অর্যমা। প্রতিটি দিনের আলো-অন্ধকার এক বিস্ময়, নদীতে জোয়ার, ভাটা আরেক বিস্ময়। বিস্ময় চাঁদের ক্ষয়ে যাওয়া, পুবের ওঠা, তারপর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। সূর্য কিন্তু ওরকম করে না। সে সব সময়ে গোল। তার রং বদলায় অবশ্য। কিন্তু বর্তুলতা নষ্ট হয় না। ভেতরে কোনও কালো দাগও নেই চাঁদের মতো। অর্যমা যোদ্ধা নয়, তাই গোষ্ঠীতে তার তেমন কদর নেই। তাতে তার কিছু এসে যায় না। সে যে মাতঙ্গী, সিংহ এদের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়নি বি-গোষ্ঠীর আক্রমণে— এটাই তার কাছে অনেক। সে দেখতে পাবে—এই সব দেখতে পাবে আরও অনেক দিন ধরে। সিংহরাও দেখছে নিশ্চয়। কিন্তু তাদের তো কেউ দেখতে পায় না। তারা কী ভাবে দেখে কে জানে! দেহহীন হয়ে দেখে কি? সে রাত্রে অর্যমা বনের অনেক গভীরে যে নিভৃত কুটির তৈরি করেছে, সেখানে বসে মাটিতে আঁচড় কাটছিল। অনেককাল ধরে সে এই আঁচড় কাটছে, ঠিক কত চাঁদ কত সূর্য পরে এই হিম আসে, তারপর দাহ আসে, তারপর আকাশ থেকে জল নামে এই সব হিসেব, গুলিয়ে গুলিয়ে যায়, গণনা সমান হয় না, কেন কে জানে? সে বোঝে তার থেকে অনেক অনেক শক্তিশালী এরা, নিজেদের ইচ্ছামতো নিজেদের চালনা করবে, কিন্তু তার ভেতর কিছু নিয়ম আছেই আছে। সেই নিয়ম তার কাছে এখনও অধরা, যদিও কাছাকাছি একটা হিসেব সে করতে পারে। মাতঙ্গী বলত—বাতাস গায়ে ঠেকলে, আকাশ দেখলেই তো এই বদল চোখে পড়ে, তার জন্য মাটিতে আঁক কাটতে হবে কেন! বুদ্ধু একটা! হয়তো ঠিকই। কিন্তু অর্যমার এটা নেশা। সে চাঁদের আকাশভ্রমণ দেখছে বসে বসে। অন্ধকারে গাছগুলি দুলছে চুপচাপ। হাওয়া নেই। চাঁদের আলো ছেঁড়া মেঘের মধ্য দিয়ে এসে পড়েছে গাছগুলির মাথায়। তার ইন্দ্রিয় বলে একটা কিছু ঘটছে। কিছু একটা! সে বেরিয়ে এল, তার গায়েও পড়ল চাঁদের আলো। কেমন শিউরে উঠল সে। চাঁদ তাকে কী বলছে, কী বলছে! সে বুঝতে পারছে না, কী যেন তাকে একটু দোলা দিল। বুঝতে পারছে না কেন? হঠাৎ তার মনে হল—কেউ এসেছে, খুব কাছে দাঁড়িয়েছে, তার নিশ্বাসের চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছে, চকিতে সে কুটিরে ঢুকে গেল। বর্শা হাতে বেরিয়ে এল। কোনও জন্তু, এক্ষুনি পেছন থেকে তার টুঁটি টিপে ধরত। নিজেকে কেন্দ্র করেই সে কয়েক পাক ঘুরে গেল, কেউ নেই। কিন্তু বোধটা যাচ্ছে না, কেউ আছে! কে আছে! কে! সহসা সে বুঝতে পারে—এ মাতঙ্গীর ভারী দেহের প্রভাব। বিদেহী মাতঙ্গী এসে দাঁড়িয়েছে কাছেই। দেখছে, তার পুত্র অর্যমার মতোই দেখছে এই চন্দ্রালোকিত রাত! শুনছে এই নিস্তব্ধ বনভূমিতে পশুদের চরার শব্দ, গর্জন। পাখি পোকা সাপ এদের সবার চলা ফেরা ওড়া বসার অস্ফুট শব্দগুলি—সব একটার থেকে একটা আলাদা। মনে সাহস এনে সে চেঁচিয়ে উঠল—মাতঙ্গী! কী চাও! তোমার কি আর কিছু প্রয়োজন হয়! খাদ্য, বাকল, জল, কিছু! কিছু! একটা গভীর নিশ্বাস ভেসে এল কোন সুদূর থেকে। মাতঙ্গী বলতে পারে না। কিন্তু সে চায়। তার হাত পুড়ে গেছে তাই ধরতে পারে না। পা পুড়ে গেছে, তাই চলতে পারে না। তাই চলতে… এই তো এখানে চলে এসেছে তো! কী করে এল? অনেকক্ষণ ভাবে অর্যমা, এই বাতাসে মিশে রয়েছে মাতঙ্গী। বাতাস চালালে চলে। নইলে চলে না।

হরিণ মাংসর একটা পিণ্ড তার খাওয়ার জন্য ছিল, আর ফল। সে সেগুলিকে আধাআধি করল। তারপর পাতায় করে বাইরে রেখে দিল। বলল—মাতঙ্গী, তুমি আমায় গর্ভে ধারণ করেছিলে। জন্ম দিয়েছ বলে আমি এই জীবন, এই পৃথিবী উপভোগ করতে পাচ্ছি। তুমি আমার অর্ঘ্য নাও, যদি তোমার খাওয়ার ক্ষমতা থাকে তো খাও। না থাকলেও তুমি তৃপ্ত হও। কম্পিত দেহে সে কিছুক্ষণ অর্ঘ্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু ঘটে না। তার সামনে বিদেহী মাতঙ্গী কিছু করতে পারবে না। সে কুটিরের ভেতরে চলে যায়। ছিদ্রপথ দিয়ে তাকিয়ে থাকে। একটু পরে একটি শিয়াল এসে মাংসখণ্ডটি মুখে করে ছুটে পালায়। তবে কি মাতঙ্গী শিয়ালের দেহে প্রবেশ করেছে? নাকি মাতঙ্গী নেই, ওটা নেহাতই শিয়াল। মাংসখণ্ড দেখে স্বভাবমতো মুখে তুলে নিয়েছে। সারারাত অযৰ্মা ভাবল আর ভাবল আর ভাবল। শিয়াল না মাতঙ্গী? মাতঙ্গী না শিয়াল? ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেছে কখন। কখন ভোর রাতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে জানে না, জানে একমাত্র সাক্ষী গাছপালাগুলি।

খড়মড় খড়মড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এক বোঝা গাছপাতা হাতে একটি মূর্তি। সর্বশ্বেত। চুল, ভ্রূ, শ্মশ্রু— সব শ্বেত। চোখ দুটি পিঙ্গল। কীরকম যেন দৃষ্টি, যেন অনেক দূরের দিকে দেখছে। অনেক দূর অবধি দেখতে পাচ্ছে।

অর্যমা হাঁটু গেড়ে বসল—ভগ, তুমি আমায় বাঁচিয়েছ, আমার কৃতজ্ঞতা নাও।

উত্তরে ভগ বলল—এগুলি কী?—সে মাটির ওপর দাগগুলির দিকে আঙুল দেখাল।

—এসব অঙ্ক কীসের? অঙ্কিত করেছ? কী? চিত্র তো নয়?

অর্যমার ভাষায় কুলোয় না, সে ভয়ে ভয়ে বলে—এই হিম, এই দাহ, এই বৃষ্টি, ঘুরে ঘুরে আসে। কত চাঁদ, কত সূর্য পর—হিসাব করি।

—কী ভাবে?

—এক শীত থেকে আরেক শীত ছোট ছোট দাগ কেটে যাই। তারপর সেগুলির পাশে—একটি নতুন বড় দাগ বসাই। আবার ছোট ছোট দাগ বসাতে থাকি। আগের জায়গায় আবার শীত ঘুরে আসে দেখি দাগগুলি মিলল কি না!

—মেলে? ভগ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।

—মেলে না। একটু এদিক ওদিক হয়। তবে মোটামুটি মেলে।

—তুমি গণনা করো, প্রকৃতি বোঝো, তুমি মহান অর্যমা।

অর্যমা সসম্ভ্রমে বলল—তুমিই প্রকৃত মহান। তুমি আঘাত সারাও। প্রাণ ফিরিয়ে দাও।

—চেষ্টা করি অর্যমা। এই সব অরণ্যের বহু বহু গাছপালা, লতাপাতা, বাকল শেকড়ের বন্ধুত্ব আছে মানুষের সঙ্গে, পশুর সঙ্গে। আমি সেই বন্ধুত্বটুকু কাজে লাগিয়ে চলেছি। কিন্তু হায় একবার দেহ স্তব্ধ হয়ে গেলে, বুকের ধুকধুকি চুপ হয়ে গেলে দেহটি কেন শক্ত, পাণ্ডুর, দুর্গন্ধ হয়ে যায় বুঝি না। এই মৃত্যু থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে পারি না।

—মৃত্যু হলে শরীর বাতাসে মেশে ভগ, তখন বাতাসে মিশে দেহহীন ঘুরে বেড়ায় মৃতরা।

—সে কী? তোমার অনুমান সুন্দর। কিন্তু কেন এ কথা মনে হল তোমার?

—আমি মাতঙ্গীকে অনুভব করেছি…কাল। মাতঙ্গী এসেছিল। মাতঙ্গী তার সন্তানদের ভালবাসে, তাই এসেছিল।

—মাতঙ্গী? তোমাদের নেত্রী?

—হ্যাঁ।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল ভগ, তারপর বলল—তুমি ঠিক জানো!

—হ্যাঁ ভগ, আমি তার ক্ষুৎপিপাসা বুঝে তাকে মাংস দিয়েছিলাম।

—তারপর? —ভগর স্বরে চাপা উত্তেজনা।

—একটি শেয়াল হয়ে সে এসে নিয়ে গেল।

—শিয়ালই নয়? শিয়ালের মধ্যে মাতঙ্গী? কী করে নিশ্চিত হচ্ছ!

—আমি অনুভব করেছি। স্পষ্ট অনুভব করেছি।

ভগ উঠে দাঁড়াল। বলল— চলো অর্যমা, এই কথা আমাদের পাড়ায় গিয়ে বলো। মৃতরা শান্তি না পেলে জীবিতরা শান্তি পাবে না। আমাদের কিছু করা উচিত।

অতঃপর তারা দুজনে যায়। পাড়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলে,

—শোনো মাতঙ্গী ও মধুরার মিলিত দল— আজ আমরা একটি নতুন কথা জেনেছি। মৃতরা যায় না। মৃতরা বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে। তাদের দীর্ঘশ্বাস আমাদের জীবিতদের কাছে কিছু প্রার্থনা করে। এখনও সদ্যোমৃতদের ক্ষুৎপিপাসা যায়নি। তা মেটাও। আমাদের সমবেত হয়ে তা মেটাতে হবে।

—নইলে? —নিমেষ উদ্ধত ভঙ্গিতে ধানের শিষ দাঁতে কাটছে।

ভগ হাসল— কীসে কী হয়, তার কতটুকু আমরা জানি নিমেষ! যে কোনও অমঙ্গলের জন্য প্রস্তুত থাকো। হতে পারে সিংহ, তরক্ষু, বরাহ ও ভালুকের দল আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দিল। হতে পারে ঝঞ্ঝা প্রবল হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব। হতে পারে বিষফল খেয়ে আমাদের শিশুগুলি মারা গেল। হতে পারে আর কোনও গোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর, আমরা যেমন ঝাঁপিয়েছিলাম মাতঙ্গীদের ওপর। এবং এ-ও হতে পারে নিমেষ, তুমি, মধুরা ও অন্যান্য বীর তাদের প্রতিহত করতে পারলে না।

—এই সব, শুধু মাতঙ্গীদের জন্যই হবে? —নিমেষ উদ্ধতভাবে প্রশ্ন করে।

—হতে পারে।

—কী মধুরা? তুমি এ কথা মানো?

মধুরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ উত্তর দিক থেকে এক প্রবল শীতার্ত হাওয়া ধেয়ে এল। ক্রমে জোরালো হতে লাগল ঝড়, গাছগুলি বিপজ্জনক ভাবে দুলতে থাকল, পাখিদের আর্তনাদে ভরে উঠল বনস্থল! ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে পড়তে লাগল উড়ন্ত পাখিরা। এবং… এবং ভূ প্রকম্পিত হতে লাগল। চতুর্দিকে ছিটকে পড়ল মানুষগুলি। পাতার কুটিরগুলো উড়ে কোন দিগ্‌বিদিকে চলে গেল, গর্ত থেকে বেরিয়ে সাপেরা মৃতপ্রায় হয়ে শুয়ে পড়ল। আছড়ে পড়তে লাগল বড় বড় গাছ। ভূমি জায়গায় জায়গায় ফেটে গেল। তার মধ্যে কারও পা, কারও কোমর পর্যন্ত ঢুকে গেল, পরমুহূর্তে ফাটল জুড়ে গেলে আর বেরোতে পারল না তারা। আর্তনাদ করতে করতে অঙ্গহীন হয়ে বেরিয়ে এল কেউ কেউ— অন্যান্যরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এরই মধ্যেই অশ্বগুলি তাদের বাঁধন ছিঁড়ে বিকট চিৎকার করতে করতে নদী পেরিয়ে ছুটতে লাগল। ভূ-কম্পনে বেশির ভাগই মাটিতে পড়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল। অন্যরা উধাও। একই দশা অন্য পোষ্য পশুগুলির।

পৃথিবীর, বনের, বন্যজন্তুদের, মানুষের মূৰ্ছা যখন ভাঙল, ভস্ম রঙের আকাশে তখন কোথাও আর কোনও রং নেই। ধন্যার জল প্লাবিত করেছে চারিদিক। সহসা ছোট নদীটি যেন মত্তমাতঙ্গী হয়ে গেছে। সগর্জন ভীমদেহ নিয়ে বইছে। বিধ্বস্ত গ্রাম। কোনও কুটির নেই, ধান্য নেই, শস্যক্ষেত্ৰ ফাঁকা হয়ে গেছে। ধন্যার জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে। একটি সাপ জড়িয়ে ছিল নিমেষকে। সে নড়াচড়া করতে সাপটি সড়সড় করে চলে গেল। মধুরা একটি ভালুকের পিঠে শুয়ে ছিল, ভালুকটি হঠাৎ তাকে পিঠ ঝেড়ে ফেলে দিতে তার মূর্ছা ভাঙে। মধুরাদের দলের অধিকাংশই মৃত কিংবা আহত। নিমেষ, মধুরা— কেউই সুস্থ নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ এবং অপ্রভাবিত আছে কেবল তিনজন। অর্যমা, ভগ ও রঙ্কা।

বিধ্বস্ত শ্মশানে শুধু শুশ্রূষা চলে, ভগ নির্দেশ দেয় অর্যমা, রঙ্কা ওষধি তৈরি করে, শম, অলম্বুষ আদি সেগুলি যথাসাধ্য মাখায়, খাওয়ায়, উন্মুক্ত বনে তুষার বায়ুর তলায় ঠান্ডায় জমে যায়, মরে যায় কেউ কেউ, দ্রুত কুটির তৈরি শুরু হয়। মৃত পশুদের ছালগুলি খুলে, পরিষ্কার করে কাঁচা অবস্থাতেই গায়ে দিয়ে হি হি করে কাঁপতে থাকে সব। এবং শুশ্রূষা চলতে থাকে, চলতে থাকে।

গণনা করে অর্যমা— এক পূর্ণ চাঁদ থেকে আর এক পূর্ণ চাঁদ চলে যায় কুটির তৈরি করতে। পশু মেরে খাদ্য তৈরি করে, ছালটি রোদে শুকিয়ে পিটিয়ে পরিধানযোগ্য করে নিতে। কেউ চাঁদ প্রথমবার অদৃশ্য হতে হতেই উঠে বসে, কারও আরও সময় লাগে, উঠে বসে নিমেষ, তার মাথার জটাগুলি ছুরি দিয়ে কেটে দেয় রঙ্কা। উঠে বসে মধুরা, তারও জটাবদ্ধ কেশ কাটা যায়। মাঝে মাঝে চিরে চিরে ওষধি লেপে দেওয়া হয়। আবার বনের ফল, কন্দমূল সংগ্রহ করতে যেতে হয় কাউকে কাউকে। কেউ কেউ শিকারে যায়। ধানক্ষেত্রে জল থইথই করে।

অবশেষে একদিন যখন সব মোটামুটি গোছগাছ হয়ে গেছে— নিমেষের বল, মধুরার বল ফিরে এসেছে, তাদের জন্য কন্দমূল পাতায় করে এনে রঙ্কা দু হাত কোমরে রেখে দাঁড়ায়, বলে—হল তো? হল?

তার উজ্জ্বল শানানো চোখে চোখ রাখতে পারে না নিমেষ। মধুরা, অন্য দিকে তাকিয়ে বলে—কী হল?

—মাতঙ্গী সিংহ অদ্রিরা কাতর ছিল। তাদের প্রাপ্য দাওনি, তাই…

—মৃতরা কি এই ভাবে প্রতিশোধ নেয়, রঙ্কা?

অর্যমা মৃদুস্বরে বলে— প্রতিশোধ নয়, বুভুক্ষা। তাদের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাতে হয়। ভগ মাথা নাড়ে। বলে— সেবার যখন আমাদের গোষ্ঠী নেত্রী সুজলা স্তব্ধ হয়ে গেল, আমরা তাকে জলে দিয়ে স্তব্ধ ভাবে বসে ছিলাম। আমাদের ভাল লাগছিল না, শোক জাগছিল। সজলা বর্ণার গর্ভধারিণী, মধুরা বর্ণার কন্যা, সুজলার সঙ্গে বর্ণার রেষারেষি ছিল। তবু মধুরাও আর্ত হয়েছিল, কেননা সুজলা কোনও দিন অসম বণ্টন করেনি। তার সংগ্রহ সে কখনও সঞ্চয় করে কোনও প্রিয়পাত্রকে দিত না। সেই যে শোক, সেও আমাদের স্মরণ, দান। কিন্তু এই মাতঙ্গীর দল, এদের আমরা হত্যা করেছি। এদের যা কিছু ছিল, কেড়ে নিয়েছি। যথাযথ সৎকার করিনি।

—সৎকার? —ভগ নিজেই শব্দটি উচ্চারণ করে, নতুন একটি শব্দ। আশ্চর্য হয়ে থাকে। বিনম্র ভাবে বলে— সৎকার। সৎকার চাই।

সুতরাং ভারে ভারে পাতায় করে ফল আসে, মাংস আসে। সিদ্ধ ধান্য আসে। মাটির তালের মধ্যে গর্ত করে রোদে শুকিয়ে পাত্র হয়, তাতে ভরা হয় জল এবং আকাশ বাতাস ধ্বনিত করে আওয়াজ ওঠে।

হে কুরঙ্গীর পুত্রী মাতঙ্গী, হে সন্নার পুত্র সিংহ, হে মাতঙ্গীকন্যা অদ্রি, হে মাতঙ্গীপুত্র অম্ব, অদ্রিপুত্র শব, রোমাপুত্র সর্ব… তোমাদের রোচক মাংস দিচ্ছি, ফল দিচ্ছি, জল দিচ্ছি— খাও, পান করো, তারপর আমাদের প্রতি প্রসন্ন হও হে…।

পুরোহিত জলধর ভট্টাচার্য মশাই বললেন—কুশের আংটিটি ঠিক করে নিন, খুলে গেছে ভবানীবাবু। আপনি তো অনেকগুলি শ্রাদ্ধ পার হলেন। হ্যাঁ, এবার জলস্পর্শ করে পিণ্ডের ওপর হাত রাখুন, বলুন— বিষ্ণুরোম তৎসৎ অদ্য চৈত্র মাসি কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমী তিথৌ কৌশিক গোত্রস্য মন্মাতুর সর্বমঙ্গলা দাস্যা:… গত তিন পিতৃপিতামহের নাম করেছেন তো, মাতামহ প্রমাতামহদের নামগুলি করুন… তিন পুরুষ অবধি… হ্যাঁ, এবার বলুন অক্ষয় স্বৰ্গকাম, এতৎ স্বোপকরণামান্নচর্চিত, শ্রীবিষ্ণুদৈবতং যথাসম্ভব গোত্ৰনাম্নে ব্রাহ্মণায় অহং দদানি।… কুশপত্রের দ্বারা আমান্নের ওপর জলের অভ্যুক্ষণ মানে ছিটে দিন।

ঠিক দেড়টার সময়ে বুড়োমার কাজ শেষ হল। অধ্যাপক বিদায় আগেই ছোটপুত্র শিবানীপ্রসাদ করে রেখেছেন। দ্বাদশ ব্রাহ্মণ-ভোজনের পাতা পড়েছে। ওদিকেও সর্বসাধারণের জন্য পাতা পড়ছে। বুড়োমা বা কর্তামার নাতি অভিষেক, নাতবউ পূর্ণা ওদিকটা দেখাশোনা করছে।

“বলো শান্তি বলো শান্তি দেহসাথে সব ক্লান্তি

পুড়ে হোক ছাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *