নিষ্ক্রান্তি

নিষ্ক্রান্তি

ঈশা জানে না কেন সে কলকাতা নয়, দিল্লির টিকিট কাটল। সম্পূর্ণ ইনটুইশন। মন বলল, মুখ বলল, সে কেটে নিল। একটা বড় সুটকেসে যতটা পেরেছে, পুরেছে। শায়রীর বইপত্র, নিজের আরও কিছু দরকারি জিনিস সে কারগোয় দিয়ে দিল। প্লেনের খাবার খুব খারাপ। সে মুখে দিতে পারল না। শায়রীর জন্যে এক বাক্স ভরতি কেক পেষ্ট্রি এনেছিল, আর ছিল কিছু বিস্কুটের প্যাকেট। তাকে খাবার প্রত্যাখ্যান করতে দেখে একটি বিমানসেবিকা এগিয়ে এল— ম্যাডাম, ডোন্ট য়ু লাইক আওয়ার সার্ভিস?

—নো ও— এত রূঢ় জবাব জীবনে কখনও ঈশার মুখ দিয়ে বেরোয়নি। তার বন্ধুরা বরাবর বলেছে— কীরে মিছরি হাসি! কখনও মুখ গম্ভীর করতে শিখবি না? লার্ন টু বি রুড। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল রুড।

হতে পারে সে গভীর ভাবে অন্তর্মুখ। কিন্তু লোকজনের সঙ্গে মেলামেশায় হাসিটুকুর অভাব তার কখনও হত না। পৃথিবীর প্রথম বালিকার মতো নিষ্পাপ, মধুময় হাসি।

ঈশা বলল— স্যরি, আই মিন নট ইয়োর সার্ভিস, বাট দা ফুড ইউ আর কমপেল্ড টু সার্ভ!

মেয়েটি অপ্রতিভ মুখে চলে গেল। কিন্তু অপমানবোধের যে উপশম হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়। একটু পরে সে গোটা চার টুকটুকে লাল ছোট সাইজের আপেল নিয়ে এল। অনেকটা যেন প্লামের মতো দেখতে!

—ম্যাডাম, আই উইল বি ওবলাইজ্‌ড্‌। আই মিন ভেরি হ্যাপি ইফ য়ু ক্যান মেক ডু উইথ দিজ।

সে নিল। ভীষণ খিদে পেয়েছিল। গতকাল সকাল থেকে যে উৎকট বিস্বাদ তার সমস্ত খিদে কেড়ে নিয়েছিল, সেই খিদে হঠাৎ প্রবল তীক্ষ্ণতায় জানান দিচ্ছে। কামড় বসাতেই মুখটা অপরূপ আহ্লাদে ভরে গেল। একটা খেল, দুটো খেল, তৃতীয়টা শায়রীর হাতে দিল, চতুর্থটায় কামড় বসাতে যাচ্ছে। মেয়েটি ফিরে এল, বলল— ইজ ইট ও কে ম্যাডাম!

—ওহ, আ থাউজন্ড টাইমস ইয়েস, বাট আই ওয়জ ওয়ান্ডারিং… ডু য়ু ক্যারি সাচ অ্যাপলস্ অন দ্যা ফ্লাইট! হোয়্যার আর দে ফ্রম?

মেয়েটি আবারও একটু অপ্রতিভ হল, বলল— দে আর অ্যামেরিকান অ্যাপলস্‌। লাস্ট উইক সামবডি বট দেম দেয়ার ফর মি…. ক্যারিইং উইথ মি, ইউ সি! —লাল হল মেয়েটি! চট করে চলে গেল।

ঈশা আশ্চর্য ও লজ্জিত হয়ে রইল। মেয়েটিকে কেউ এনে দিয়েছে, কে? সে নিশ্চয় ইন্টারন্যাশন্যাল ফ্লাইটে কাজ করে? ওর বয়ফ্রেন্ড, নিশ্চয়ই তাই। ও নিজের জন্য রেখেছিল। ম্যাডামকে রাগত ও ক্ষুধিত দেখে দিয়ে দিয়েছে। এমা! ছি ছি!

মেয়েটির আসা-যাওয়ার পথে সে নজর ফেলে রেখে দিল। একটা না একটা সময়ে তাকে সাড়া দিতেই হল। ঈশা বলল— আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি মিস…

—রঙ্গরাজন।

—এক্সট্রিমলি স্যরি মিস রঙ্গরাজন। আই অ্যাপ্রিশিয়েটেড ইয়োর ফ্রুটস অ্যান্ড ইয়োর ওয়ান্ডারফুল জেসচার, বাট আই কান্ট এক্সপ্রেস মাই এমব্যারাসমেন্ট। থ্যাংকস, থ্যাংকস আ লট… অ্যান্ড… অ্যান্ড… স্যরি, রিয়্যালি স্যরি…

রঙ্গরাজন মিষ্টি হেসে তাকে আশ্বস্ত করে চলে গেল। আর একটা অনভ্যস্ত ভাললাগায় তার মনটা ছেয়ে গেল। বুঁদ হয়ে আছে সে। শুধুই কি আপেলের স্বাদে? রঙ্গরাজনের বদান্যতায়! না তো! ঈশার অবাক লাগল ভেবে পুরো ব্যাপারটা সে খুব ভাল সামলাল তো! অন্য সময়ে হলে, সে নিশীথকে বলত— আমি এগুলো খেতে পারছি না। পারো তো অন্য ব্যবস্থা করো।

—কী ব্যবস্থা করব, এখন?

—কোরো না, দরকার নেই!

—মানে? কিছু তোমাকে খেতেই হবে, নইলে তোমার সেই বিখ্যাত মাইগ্রেন শুরু হবে। সে রুড হল, সামলে নিল, খাবার জোগাড় করল, তার জন্য কেউ আত্মত্যাগ করল, তার… জন্য…. কেউ… আত্মত্যাগ…! ওয়ান্ডারফুল, তার অভিজ্ঞতায় নেই ইদানীং। এবং বেশ কিছুটা কথাবার্তা, হৃদ্যতা, কথাবার্তার মধ্য দিয়ে… বা বেশ তো। সে তো পারে! কিছুই হয়তো নয় এটা। তবু খুব মসৃণভাবে সে পারল। সেই মুখচোরামি কোথায় গেল তার? আইলের সিটে একটা স্বাদু অনুভবের মধ্যে ডুব দিল সে। শুধু অনুভব, তার মধ্যে কোনও বিষয় বা বস্তু নেই। কিংবা হয়তো আছে, সে জানে না, এখনও জানে না।

শায়রী মিষ্টি গলায় বলল— মা। দিল্লি অনেক দূর!

সে মৃদু গলায় জবাব দিল— না, দূর আর কই। এসে গেলেই এসে যাবে। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও।

ঈশার এখন প্রবল ইচ্ছে করছে ওই রঙ্গরাজনের সঙ্গে কথা বলতে, ভাব জমাতে। সে খুব কষ্ট করে ব্রেক কষল। তার এই দোষ। সে খুব অন্তর্মুখী, চট করে কারও সঙ্গে মিশতে পারে না। লোকটি বলে— য়ু আর ফুল অব কমপ্লেক্স। হবেও বা। কিন্তু কাউকে যদি ভাল লেগে যায়। কেউ যদি ভাল, সুন্দর ব্যবহার করে, আগ্রহ দেখায়, হঠাৎ কারও মুখ, কারও হাসি, ভাষা, ভঙ্গি হঠাৎ যেন অন্য কোনও সুন্দরতর লোক থেকে ঝরে পড়ে সে ভুলে যায়। বিগলিত, বিহ্বল হয়ে যায়। এই বৈপরীত্য তার চরিত্রে আছে। লোকটি বলে থাকে— এটা সফিস্টিকেশন নয়। সফিস্টিকেশন হল— তোমার ভাললাগা, মন্দলাগা দুটোই একরকম ভাবে হ্যান্ডল করো, পরিমিত উচ্ছ্বাসে। পরিমিত ঠিক আছে, কিন্তু উচ্ছ্বাস! ওই মিসেস চ্যাটার্জি, আস্থা মেহরাদের সঙ্গে? মিসেস চ্যাটার্জি বলবেন —দেখো দেখো ঈশা, ডিরেক্টরসাবকে দেখো, কত অমায়িক। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কী সিনসিয়ার, হাইট অব কমপিটেন্স, নো? —তিনটে ছেলেমেয়ে বানিয়েছে, তারা বাবা কী জিনিস জানে না। কথায় কথায় আইসক্রিম আর চকলেট দিয়ে কর্তব্য সারা আর বাচ্চাগুলোকে স্পয়েল করার একটা লোক— এই পর্যন্ত। ডিরেক্টর কেচ্ছা চলতেই থাকবে। চলতেই থাকবে… শেষের দিকে ডিরেক্টরসাবের অশেষ মেয়ে লালসা এবং বলিহারি পছন্দের কাহিনি। —কী কিছু বলছ না কেন? য়ু আর গোয়িং টু হ্যাভ দা সেম এক্সপিরিয়েন্স এনিওয়ে।

ভেতরটা মূলসুদ্ধু কেঁপে যায়। কেননা সে দেখে অতি দূরে কোনও কেতাদুরস্ত মহিলার সঙ্গে সাগ্রহ বার্তা বিনিময় করে এবার এক অখাদ্য কিন্তু যুবতী মহিলার সঙ্গে কথা বলছে নিশীথ। তার মনে পড়ে যায় মালবিকাদি, মুন্নি। আশ্চর্য হয়— এরা কিন্তু ওদের নখের যোগ্যও নয়। তার স্বামীর স্ট্যান্ডার্ড কি তা হলে দিন দিন পড়ছে!

আর আস্থা? —হ্যালো ঈ-শা। প্ল্যানিং এনি পার্টি? নট ইয়েট! —এই সময়ে আস্থার চোখের দৃষ্টিতে একটা অদ্ভুত অবজ্ঞা ও বিস্ময় মেখে থাকে। সে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করে না কখনও। একটা দুটো কথা ছুড়ে দিয়ে সাবলীলভাবে মিশে যায় পুরুষ-প্রজাতির সঙ্গে। বাকি সময়টা ঈশাকে এরকম ‘কাট’ করতে থাকে।

কিন্তু তার ভেতরেও তো কথা আছে। সেই কথাগুলো খলবল করতে থাকে থলিতে জিওল মাছের মতো। কাউকে দেখে, শুনে বার হয়ে আসতে চায়। যেমন শম্পাদি। থাকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ান। কত যে জানে, আর কত যে তার পড়াশুনো। কিন্তু কলকাতায় এলে সে ঈশার খোঁজ করবেই। নিশীথ নেই। তো কী? চলো তোমাতে আমাতে একদিন খেতে যাই। খুব দামি রেস্তোরাঁয়। শম্পাদি, নিশীথের আপন পিসতুতো বোন— অজস্র ডিগ্রিধারী। ভীষণ ভালবেসে কথা বলে ঈশা। একজন সামান্য গ্রাজুয়েট ‘গৃহবধূর’ সঙ্গে। শুধু ঈশা, আর কেউ না। বলে— ‘মামা মামিদের সঙ্গে আরেক দিন হবে, আজকে একটু তোমার সঙ্গে কথা বলে নিই!’ যেন ঈশার কথা বলাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। ঈশার কিন্তু একটুও অপদার্থ লাগে না তখন নিজেকে।

তবু বলে, —শম্পাদি, আমার সঙ্গে কথা বলে কী সুখ পাও গো?

তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে শম্পাদি বলে— এখানে সব্বাই বড় কনশাস, জানো ঈশা! কে ভাবছে আমি এত উচ্চপদস্থ, কে মনে করছে আমি অমুকের ঘরনি, আমার ব্যাংকে এত টাকা, কেউ বিদ্যা, কেউ যশ। এভরিবডি কামস উইথ ব্যাগেজেজ। য়ু ডোন্ট কাম উইথ এনি। জানো, হার্ভার্ড, কেমব্রিজ ভরতি নোবেল লরিয়েট, কেউ তাদের ফিরেও দেখে না। দে ডোন্ট এক্সপেক্ট দ্যাট।

—আমার কিছু নেই যে শম্পাদি, না টাকা, না উচ্চপদ, না কোনও বলবার মতো গুণ!

—আরে! য়ু আর সোললি আ হিউম্যান বিয়িং হুম আই লাইক ভেরি ভেরি মাচ। বাইরের জিনিস বা অ্যাচিভমেন্টগুলো ছাড়াও তো মানুষের একটা চরিত্র থাকে! সেইটা, সেইটা বুঝলে না! বলে শম্পাদি অনুপম হাসি হাসে আর ঈশা কৃতজ্ঞতায় গলে যায় এই আত্মবিশ্বাসটুকু উপহার পাওয়ার জন্য।

—শম্পাদি? শম্পাদির সঙ্গে তাজ-এ গিয়েছিলে? একা? বাট হোয়াই?

নিশীথ অবাক হয়ে থাকে, নিশীথের মা, বাবা।

বাবা বিড়বিড় করতে থাকেন— শি ইজ হার্ভার্ড এডুকেটেড।

মা চেঁচিয়ে ওঠেন— ও ছবিও আঁকত না! দারুণ!

সে যেন একটা মহা অপরাধ করে ফেলেছে। কিংবা অলৌকিক কিছু। শম্পা লাহিড়ি কেনস, যিনি একজন অস্ট্রেলীয় লেখককে বিয়ে করে ক্যানবেরায় সেট্‌লড্‌। তিনি কেন ঈশাকে একলা ট্রিট দেন! একটা ধাঁধা, সে ধাঁধার উত্তর খুঁজে পায় না ঘোষাল পরিবার।

রঙ্গরাজন! মিস রঙ্গরাজন! তোমার প্রথম নাম কী! প্রথম নামটার বড্ড দরকার হয় ভাব করতে গেলে। আই অ্যাম অলরেডি মিসিং য়ু রঙ্গরাজন। চোখের ওপর রুমাল চাপা দিল সে। কেননা কাল থেকে মুলতুবি কান্নাটা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসছে। রুমালের পেছনে সে প্রাণপণে কেঁদে নেয়। প্রাণপণে সামলাতে চেষ্টা করে। ভাগ্যিস, উইন্ডো-সিটে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাকে কাঁদতে দেখলে ও ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে। গত চার বছরে তা বারবার প্রমাণিত হয়ে গেছে। গতকাল সকালের দৃশ্য ওকে মূক করে দিয়েছে। মেয়ে, মেয়ের কথা ভেবেও এই অস্থির, অশান্ত, দূষিত পরিবেশ থেকে দূরে চলে যেতে হবে তাকে। নিজের কথাও কথা! সে বোধহয় এই ভয় ও ভয়ংকরের পরিবেশে মেন্টাল পেশেন্ট হয়ে যেতে যাচ্ছে। না, না। তোমাকে বাঁচতে হবে ঈশা। এ ভাবে শেষ হওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া চলে না। চলে না। এটা তোমার জীবন। কে জানে ফিরে পাবে কি না। পালাও প্রসারপিনা এই প্লুটোর পাতাল রাজ্য থেকে।

মাকে আজ তেমন করে মনে পড়ছে না ঈশার। মা নিজের কাজ নিয়ে বড্ড ব্যস্ত। সময় পায় না। ঈশাকে সাহস দেয়, নিশীথকে পরিমিত বকে, কিন্তু কখনওই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবার সাহস তাকে দেয় না। বাবা তো নয়ই! সেদিন যে বলল ওদের পাঠিয়ে দাও, তার মধ্যেও একটা নিশীথ-নির্ভরতা আছে। চলে এসো নয় পাঠিয়ে দাও। ঘাড় ধরে বার করে দাও আর কী। তো তাই হল। আই’ল থ্রো য়ু আউট অব দিস হাউস— বলে বিকট চেঁচিয়েছিল লোকটা। শায়রী থরথর করে কাঁপছিল। তার ভয়ের চেয়ে হয়েছিল বিস্ময়, গভীর বিস্ময়। এই সেই লোক যে নাকি পার্ক হোটেলের রেস্তোরাঁয় বসে নিজেকে নিবেদন করেছিল। কী আগ্রহ ছিল দু চোখে।

—আমি কিন্তু খুব সাধারণ নিশীথদা, বিশ্বাস করুন, আমার ভাল লাগে আপন মনে থাকতে। বই পড়তে… আর. আর… চা করা ছাড়া কোনও রান্নার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই।

—আচ্ছা ঈশা, দিস ইজ টু মাচ। রান্নার জন্যে কেউ বিয়ে করে। কিন্তু রান্না জানো নাই বা কেন? মেয়েরা তো সবাই পারে। তোমাকেও পারতে হবে।

—ওমলেটটাও পারি। তবে মা বলে রান্নাটা শুধুমাত্র মেয়েদেরই কর্ম বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অথচ বিদেশে ছেলেরা আকছার রান্না করে খাচ্ছে। মেয়ে ইকোয়ালস রান্না— এই ইকোয়েশন থেকে মা দূরে থাকতে চায়।

—ফেমিনিস্ট!

—কী জানি। শব্দটা খুব কঠিন লাগে। বুঝতে পারি না। তবে হ্যাঁ, আর কিছু দিন পরে রান্না-টান্না শিখতে তো হবেই। মাকে খাওয়াব, বাবাকে খাওয়াব…

—নিশীথ ঘোষালকে খাওয়াবে।

এটুকু রসিকতা অন্তত লোকটি করতে পারত।

যখন রাগে লাল হয়ে চেঁচিয়েছিল! তার ভেতরটা কাঁপছিল। এ কে? কোন রাক্ষস? এর সঙ্গে এক শয্যায় শুয়েছে। সহবাস করেছে! কোনও রাক্ষস শিশু জন্মায়নি তো! নরম রেশম চুলের ছোট্ট একটি মানবিকা এসেছে, সে আকারে প্রকারে অবিকল ঈশারই মতো।

সে দুটো কাজ করেছিল নিশীথ বেরিয়ে যাবার পর। একটা চিঠি লিখেছিল— আমি চললাম। যেমন তুমি চেয়েছ। চেয়েছিলে এসেছিলাম। চেয়েছ যাচ্ছি। যাওয়া-আসা দুটোই তোমার ইচ্ছায়। কোনওটাতেই আমার কোনও দায়িত্ব নেই। তেমন সায়ও ছিল না, নেই। তোমাকে কিছু মনে করিয়ে দিতে চাই না। কোনও শপথ, কোনও সুন্দর মুহূর্ত, কোনও কর্তব্য। আমিও ওই সব শপথ, মুহূর্ত, কর্তব্য পুঁটলি বেঁধে নিয়েছি, গঙ্গার জলে বিসর্জন দোব। ও, তুমি তো আমার বাংলা ভাল পড়তে পারো না। একটু কষ্ট করে বানান করে পড়ে নিয়ো। দয়া করে যে পকেট-মানি এত দিন দিয়েছ সেই জমানো টাকা থেকেই যাবার ব্যবস্থা করলাম— আমি।

দ্বিতীয় কাজটা ছিল আরও কঠিন, আরও সাহসের। মালবিকাদিকে সে একটা ফোন করেছিল বাঙ্গালোরে। মোবাইল নম্বরটা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু কাজটা সে বেশ কিছু দিনের গোয়েন্দাগিরিতে সম্ভব করে রেখেছিল।

—হাঁলো!

—আমি ঈশা বলছি।

—হ্যাঁ ঈশা, আরে! ঈ-শা! বলো। সব ঠিক আছে তো।

—না সব ঠিক নেই। ইউ প্লিজ কাম অ্যান্ড টেক ওভার।

—মিনস। —চূড়ান্ত বিস্ময় মালবিকা কাজির গলায়।

—তুমি তো এখন মুক্ত মালবিকাদি। অসুবিধে হবে না। আমি তোমার চিরকালের বন্ধু, দোসরকে মুক্তি দিলাম। এসে ভার নিতে পারো। বাই।

সে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। নিশীথ সব সময়ে টুর করছে। তাকেও নানা কাজে নানা জায়গায় থাকতে হয়। কিন্তু আজও সামান্য একটা মোবাইল লোকটি তাকে কিনে দেয়নি। বাড়ি বন্ধ করে চাবি কেয়ারটেকারের হাতে জমা দিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছিল।

এখন ওপর থেকে বাহাইদের লোটাস-টেম্পল দেখা যাচ্ছে। গোধূলির আলোয় অপার্থিব দেখাচ্ছে। তার মনে হল হৃৎ-কমল কথাটা যেন কোথায় আছে। অকস্মাৎ তার মনে পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের গান, মা গাইত— এই হৃৎ-কমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়। হৃৎ-কমলের রাঙা রেণু চারদিকে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাস ভরা সেই রেণুর সুবাস। কেন হে নাথ, আমায় খেলায় হারিয়ে দিয়ে তোমার কী সুখ হল? কী সুখ? আমি তো কিছু চাইনি। আই ওনলি ওয়ান্টেড টু বি, টু বি মাইসেল্‌ফ্‌।

এয়ারপোর্ট থেকে মঞ্জুমাসিকে ফোন করল ঈশা।

—ঈশা? হঠাৎ? এরকম?

—আসব না বলছ? তা হলে চলে যাই।

—উঃ, কী পাগলামি হচ্ছে। যেখানে আছিস সেখানেই থাক, আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

—না আমি প্রি-পেড ট্যাকসি নিয়ে যাচ্ছি মাসি। তোমাকে শুধু জানিয়ে দিলাম।

না, কেউ না। কাউকে গাড়ি নিয়ে রিসিভ করতে আসতে হবে না। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে। একটা সাত বছরের মেয়ের মা। যথেষ্ট কর্তব্য পালন করছে। হয়তো চূড়ান্ত রকমের ভাল ভাবে নয়, কিন্তু ভালই করেছে। সে যাই বলুক। এখন সে বুঝতে পারছে—ওগুলো ছল। অজুহাত। আসলে… আসলে ওর বোধহয় তাকে আর ভাল লাগছিল না। ট্যাকসিতে যেতে যেতে হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকের মতোই তার উপলব্ধিটা হল। কেনই বা সে মাসির কাছে এল? প্রথমত এই সময়ে মা একটা বিশেষ আর্কিওলজিক্যাল কাজে ভীষণ ব্যস্ত। তার এই সিদ্ধান্ত, এই চলে আসা বজ্রাঘাতের মতো বাজবে মায়ের বুকে। মা যদি সামলাতে না পারে? সে-ও তো মেয়ে। মায়ের প্রতি তার সে দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ তা-ও তো অবচেতনে সব সময়ে কাজ করে যায়। আর দ্বিতীয়ত, মাসি এবং এই দিল্লি বহু ধরনের কাজকর্মের খোঁজ খবর রাখে। তাকে তো দাঁড়াতে হবে। নিজের দুটো পায়ে। মাসি তো একাধিক এন. জি. ও-র সঙ্গে জড়িতও আছে! কিন্তু, কিন্তু এই সাহস… এই রোখ কতক্ষণ টিকবে। এসবই তো তার চরিত্রবিরুদ্ধ। ছোটখাটো বিদ্রোহ সে করতে পারে, যেমন একনাগাড়ে সপ্তাখানেক মাছ নেই দেখে শাশুড়িকে বলেছিল—ভাত-টাতগুলোও নাই খেলাম মা, কিছু পয়সা বেঁচে যাবে! —তাতে তার অসভ্য মুখফোঁড়, লোভী বলে বদনাম হয়েছিল। ঠিকই হয়েছিল। কিন্তু মাছের অভাবে তার প্রোটিনাকাঙক্ষী দেহই অসভ্যতাটা করেছিল।

শ্বশুরকে একদিন বলে ফেলেছিল— এত লোককে শাস্তি দিতে দিতে তোমার কেমন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে, না বাবা? —তখন বদনাম হয়েছিল রূঢ় বলে। দেবতুল্য মানুষটাকে বোঝবার ক্ষমতা নেই বলে। মাঝেমধ্যে ফোঁস করে উঠেছে নিশীথের ব্যবহারে। দ্বিগুণ ত্রিগুণ ফোঁস করে তাকে নিস্তেজ করে দিয়েছে নিশীথ।

মাথাটা এখন কীরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হালকা। বড় ভার চেপেছিল মাথায়। বড় ভয়। রান্নাটা ঠিক হল তো? বারেবারে চেখে দেখেছে। বাড়ির ধুলো ঝাড়াঝাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এইরে, ললিতা কাজের লোকটা মাটির চমৎকার পটটা ভেঙেছে। ওই কলস তারা এগজিবিশন থেকে কিনেছিল। বকল লোকটিকে, কিন্তু এ গল্প তো এখানেই শেষ হবে না। ললিতা শুধু সূচনাসূত্র। সে উপলক্ষ, আসল ধ্রুপদ-ধামার বাজবে রাত বারোটায়। সামলাতে পারো না? একটা জিনিস সামলাতে পারো না! গলার আওয়াজটা এসব সময়ে কীরকম ঢাকের মতো হয়ে যায়! না, না, দুর্গাপুজোর ঢাক নয়, সতীদাহর ঢাক, মড়ার সঙ্গে জ্যান্ত মানুষটাকে চিতায় তুলেছে, আগুন উঠছে লেলিহান শিখায়। জ্যান্ত মানুষ পুড়ছে—তার উৎকট আকাট বিকট চিৎকার চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রবল ঢক্কানিনাদে। সেই ঢাক। এই অদ্ভুত উপমাটা তার মনে এল কেন? তবে কি সে ন’ বছর ধরে জ্যান্ত পুড়ছিল, আর একটার পর একটা অভিযোগের খুঁতপাড়ার গর্জনে চাপা পড়ে যাচ্ছিল তার কৈফিয়ত, তার আত্মপক্ষ সমর্থন। শায়রীর অঙ্ক বই খাবার টেবিলের চেয়ারে কেন? বারান্দার দিকের দরজাটা খোলা কেন? খবরের কাগজ রাখার আর জায়গা নেই বাড়িতে? পরশু দিনের কাগজটা কোথায় গেল? মভ শার্টটার বোতাম বসানো হয়নি কেন?

উত্তরগুলো কত সহজ, স্বাভাবিক। শায়রী অঙ্কের খাতা পেনসিল চেয়ারের ওপর রেখে ঘুমোতে চলে গেছে। আমি কী করে জানব! বাচ্চারা ওইরকম একটু-আধটু করে থাকে। এখনও তো রুটিন মিলিয়ে বইপত্র সব ব্যাগে ভরিনি! তখন ঠিকই ধরা পড়ত।

বারান্দার দিকের দরজাটা ইচ্ছে করে খুলেছি। দক্ষিণে হাওয়ার দেশের মানুষ আমি। এমন বন্ধ-ছন্দ থাকতে পারি? এখানে চোর ওঠার সম্ভাবনা নেই নিশীথ! শোবার আগে তুমি বা আমি যে-কেউ বন্ধ করে দেব। সে সময়ে জানলা-দরজাগুলো তো আমরা চেক করেই থাকি। একটু এয়ারিং দরকার। অক্সিজেন!

কলসিটা? অনেকবার করে বলেছিলাম ওটা এক কোণে রাখো। তাতেও সুন্দর দেখাবে। তা হল না, ওই কৌচের পাশেই রাখা চাই। ললিতা প্রাণপণে ন্যাতা টানছে। মন পড়ে আছে বাড়িতে। সন্দেহবাতিক মারকুটে স্বামী আর স্কুলগামী ছেলের ওপর, তার ওপর বিশাল নিতম্ব। একটু ধাক্কা লাগতেই কলসি কাত।

খবরের কাগজ তো তুমি চোখের আড়ালেই রাখতে বলো, লফ্‌টে তুলে দিই প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে। আজকের কাগজ তোমার টেবিলে, পরশুর কাগজ লফ্‌টে চলে গেছে। মই এনে পেড়ে দেব? এক্ষুনি?

মভ শার্টের বোতাম পাচ্ছি না। জে. এন. রোড, এম. জি. রোড হাঁটকে ফেলেছি। সব বোতাম খুলে সাদা লাগিয়ে দেব?

এই এতগুলো তৈরি জবাব। সঠিক কৈফিয়ত ভয়ংকর যমমূর্তির সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে।

—অত পড়াচ্ছ কেন ওইটুকু বাচ্চাকে! ভুরু কুঁচকে আধা-গর্জন।

আরে। আমি পড়াচ্ছি নাকি! স্কুল পড়াচ্ছে। টিচার টাস্‌ক দিচ্ছে। সমাজ, দেশ পড়াচ্ছে— আমি তো নিমিত্তমাত্র।

—এত পড়িয়েও র‍্যাংক এল না?

—অত পড়াইনি তো নিশীথ, একটু ড্রিলিং করতাম, কিন্তু বাবা যেই বলল অত পড়াচ্ছ কেন, শিশুটি তার প্রার্থিত মেসেজ পেয়ে গেল। আর তাকে বাগাতে পারলাম না। তাই র‍্যাংক নেই। নাই বা রইল। ওইটুকু বাচ্চা, একবার বি-প্লাস পেলে কী এসে যায়?

এসবই অনুক্ত থেকে যায়। খালি শাঁখের করাত চলতে থাকে ঘষঘষ ঘষঘষ। এদিকেও কাটছে সূক্ষ্ম সাদা ধুলো উড়ছে কাটা অলিন্দ নিলয় থেকে, ওদিকেও কাটছে। আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা, মায়া মমতা, ভালবাসা মানের ওপর দিয়ে নির্মম করাত চলে যায়।

সেই ভার নেই। দারুণ ধাক্কায় সবের এক লহমায় ভার নামিয়ে দেওয়া যায়। যেমন গুড়ের কলসি মাথা থেকে নামিয়ে নেয় গুড়ের ফেরিওয়ালা? এটা সে জানত না। ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বাইরে বড় কৃতী চাকুরের বউ, একটা সুন্দর শিশুর মা, আয়নায় দেখা চমৎকার প্রতিবিম্ব। প্রতিদিনকার অতি যত্নের গার্হস্থ্য সব একেবারে শূন্য। আই’ল থ্রো ইউ আউট অব দিস হাউস! কেন? না সে একটা দিন পরিবার শুধু পরিবার নিয়ে দিন কাটাতে চেয়েছিল। আর কিছু না। হোটেলে রেস্তোরাঁয় বিরিয়ানি, লং ড্রাইভ নয়, নয়। দামি শাড়ি-গয়না যা তার স্বামীর কলিগরা স্ত্রীদের অকাতরে দিয়ে থাকে, তা তো নয়ই। তা হলে? কী রইল আর? হাতে আর ‘আপনি’টুকু ছাড়া। কিচ্ছু রইল না। কপনিটুকু খুঁজে নিতে হবে।

তুই নিশীথকে ছেড়ে চলে এসেছিস? —আপাদমস্তক সুখী মঞ্জুমাসি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

—চলে এসেছি নয়। আসতে হয়েছে মাসি— এ নিয়ে আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। —সে কী করে বলবে তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

—ভুল করেছিস ঈশা, —তুই চিরকালের জেদি, গোঁ ধরলে ছাড়িস না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুই যে খুবই নরম প্রকৃতির। যাকে বলে মেয়েলি-মেয়ে। রঞ্জার মতো নয় এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই! কী করে এমন সিচুয়েশন হল? খুব ন্যাগিং করতিস, নাকি? ন্যাগিং ছেলেরা একদম পছন্দ করে না, তোর মেসোকে আমি কখনও ন্যাগ করি না।

—মেয়েরা পছন্দ করে? —ঈশা আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করল।

—কী?

—ওই যে তুমি বললে— ন্যাগিং?

—ওহ হো তুই ফেমিনিজ্‌ম্‌-এর চক্করে পড়ে গেছিস।

—কেন মাসি! একটা জিনিস যদি অপছন্দের হয় তার মধ্যে জাত-বিচার থাকবে কেন? যা ছেলেদের পছন্দ হয় না, তা মেয়েদেরও পছন্দ না হওয়ারই কথা।

মাসি কিছুক্ষণ মূক হয়ে যায়। তারপরে বলে— তুই ভুল বলিসনি ঈশা। কিন্তু যা ঠিক, যা জাস্ট তা কি সব সময়ে হয়? এই তো দেখ না সাম্য-সাম্য, সম্পদের সমবণ্টন নিয়ে সারা পৃথিবী তোলপাড় হয়ে গেল। কথাটা কি খারাপ? বেঠিক? নয় তো! কিন্তু কোথাও আজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না। রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি এলে বস্তি দেখতে পেতিস। বসতি নয়, বস্তিও নয়। বলা উচিত নরককুণ্ড, ছেঁড়া ন্যাকড়া কানি, প্লাস্টিকের ঠোঙা, শুয়োরের নাদ, ছাগল, পতপত করে উড়ছে প্লাস্টিকের ঝুপড়ির ছাত। সেখানেই পোকার মতো মানুষ ঘুরে বেড়ায়। রাজধানী! রাজধানীর অ্যাপ্রোচ! ভাব ঈশা। আর এখানে এই হাউজিং-এ। প্রত্যেকের একাধিক গাড়ি আছে, আড়াই তিন হাজার টাকা মাইনে দিয়ে আমরা কাজের লোক রাখি, হেন গ্যাজেট নেই যা আমাদের আছে। পাশাপাশি বাস করি। কেউ যদি বলে মানুষের জীবনযাত্রার এই আকাশ পাতাল ফারাক কেন? তুই কী উত্তর দিবি? সিনেমা-স্টার মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে লোক মারল, এর জন্য যা লোকদেখানো শাস্তি হচ্ছে, অন্য একজন রামা-শ্যামার জন্যেও কি তা-ই হবে?

ঈশা তর্ক করার মেজাজে নেই। মাসি নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্সের এম.এস। কী বলবে? এই জাতি বিচার, একজনের পক্ষে যা অপ্রীতিকর অন্যজনকে সেটাই মেনে নিতে হবে? সে মেয়ে বলে? সমস্ত মেনে প্রাণপণে একটা গৃহ ও গৃহসুখ রচনা করবার পর— আই’ল থ্রো য়ু আউট অব দিস হাউজ? ওই হাউজ, চার বছর ধরে সে-ই দেখেছে, সে-ই রেখেছে। অন্যজনের ওই হাউজের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু শোয়ার। লজিং-এর মতো! তবু সে তাকে ওই গৃহ থেকে উৎখাত করার কথা মুখে আনতে পারে? তবু ও বাড়ি তার হয় না? তার স্বামীর স্টেটাস ফিল্‌ম স্টারের, তার— ফুটপাথবাসীর।

—তার ওপর তো তুই পড়াশুনোটাও শেষ করলি না, বা আর কিছু! মাসি কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলল।

—মাসি আমি বরং চলেই যাই। আমার বোধহয় এখানে আসা ঠিক হয়নি। আর কোথাও…

আঁতকে উঠলেন মঞ্জুলিকা। —বলছিস কী? ঈশা, আর য়ু ইন ইওর সেন্সেজ? কোনও কথা নয়। এক্ষুনি গিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ো। আমি যা করার করছি।

—কী করবে? নিশীথের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। আর মা? মা-বাবার সঙ্গে আমিই যোগাযোগ করব। মায়ের হাজারো কাজ। প্রত্যেকটা ভীষণ জরুরি। তাই হঠাৎ এমনি করে…

ঈশা ঘোরে ছিল। মাসি রোজ এক ডোজ করে ঘুমপাড়ানি দিচ্ছে। ঘুমের মাসি বহু চেষ্টা করেছে। তবু একটা ঘোরের বেশি কিছু হয়নি। সেই ঘোরের মধ্যে ঈশার মধ্যেকার ঈশা প্রলাপের মতো অসংলগ্ন প্রশ্ন করতে থাকে। এই জগতের, জীবনের কী মানে? সত্যিই কোনও অর্থ আছে না পাগলের গল্প এটা। অনেক শব্দ, অনেক ক্রোধ, চিৎকার আর কাঙক্ষা কিন্তু কোনওটারই কোনও মানে নেই! গল্পটা শুরু হচ্ছে এক ভাবে, বাঁক নিল অন্য ভাবে, তারপর আবার বাঁক নিল, পাত্র-পাত্রী বদলে গেল। পটভূমি পালটে গেল। কোনও সামঞ্জস্য নেই একটার সঙ্গে আরেকটার। একেবারে বদ্ধ উন্মাদ এই জীবন। গত পরশুর, আগের দিন স্কিৎজোফ্রিনিক জীবন দেখে এসেছে। মাঝখানে ছিল মূক বধির জীবন, তারও আগের ন’বছরের জীবন তৃষ্ণা, চক্ষে তৃষ্ণা, বক্ষ জুড়ে তৃষ্ণা, হৃদয় তৃষায় থরথর করে কেঁপেছে। দাও দাও বাৎসল্য দাও— আমি আমার বাবা-মার আশ্রয় ফেলে তোমাদের কোলে এসেছি, ভিন্ন মাটির মেয়ে। একটু অনুকূল বাতাস চাই, সার চাই জৈব এবং অজৈব। একটু স্নেহ দাও, একটু আদর, এমন করে সমালোচনার খর চোখে তাকিয়ো না, শুকিয়ে যাই। দাও দাও একটু মুগ্ধতা, আবেশ, ভরসা, ভালবাসা দাও, দাও— সত্যি কথা আমি ভীষণ রাগ করেছি, অভিমান করেছি, সে তুমি পিপাসার জল এক আঁজলাও দিতে পারোনি বলে। দিতে পারোনি না দাওনি আর বিচার করতে চাইনি। কর্নেলের এম.এস এম.বি.এ. মালবিকা কাজিকে যা দেওয়া যায়, নামমাত্র গ্রাজুয়েট, নাচ-গান-সাহিত্য মুগ্ধ সহজ সরল ঈশা দত্তকে হয়তো তা দেওয়া যায় না। না বুঝে, নিজেকে, আমাকে না বুঝে ডাকলে কেন? পেয়েছিলাম তো? অনিমেষ, নীলাব্জ, কৌশিক, কেউ তো খারাপ ছিল না! আমার জন্য পাগল ছিল! ক্লাস ফেলোকে আবার বিয়ে করা যায় নাকি! কিংবা রাস্তায় আলাপ হওয়া কাউকে? ঈশা এমনই ভেবেছিল। সব সুন্দরকে, মুগ্ধকে, আগ্রহী উৎসুককে ফিরিয়ে দিলাম শুধু দিবারাত্র দুর্ব্যবহার আর নিন্দায় দগ্ধ হব বলে? বাসনায় বাসনায় অধীর আর কিছু করতেও পারলাম না। নিজের সংশয় দুঃখে উদ্ভ্রান্ত অপমানিত মনটাকে বাগাতে পারিনি। মাসি তুমি পূর্ণ, তুমি কী করে বুঝবে গোলাম আলির গজল শুনে আমার প্রাণটা কেমন করত! মানবেন্দ্র, সতীনাথ, শ্যামল মিত্র, মান্না দে শুনে থরথর করে কাঁপতাম, কোথাও না কোথাও দু চোখের গভীর অজরামর চাওয়া বুঝি আমার জন্য অপেক্ষা করছে, শুধু আমার ঠোঁট একটু ছুঁইয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। তা হলেই কারও গান অমর হয়ে যাবে। যতই ভালবাসুক, আরও ভালবাসা দেওয়ার জন্য কী কাতরতা সেই দিওয়ানার! সমস্ত ভাবনাটাই যে অলীক মায়া, ছেলেমানুষি কিংবা মানুষের অপ্রাপ্য কোনও অজাত সংবেদন, তা তো ভাবিনি! আমার জীবনভাবনার সঙ্গে সুতোয় সুতোয় জড়ানো সাহিত্য। গান আমাকে সেই অপ্রাপ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এত দিন পরে এই জানা আমায় পাথর করে দিয়েছে। আমি আর ঈশা নই, দত্ত বা ঘোষাল। আমি কী, তা আমাকে এবার ভাবতে হবে।

এইরকমই ঘোর, ঘোরের মধ্যে অজস্র আত্মজিজ্ঞাসার কুচি, চাওয়া ও পাওয়ার আশা ও বাস্তবের তুলনামূলক কাটাকুটি খেলায় চলে যায় দিনের পর দিন।

টুংটাং করে ফোনটা বাজল। মাসি ধরেছে। একটিমাত্র অব্যয়— অ্যাঁ?

সে চমকে উঠে বসল। এরই মধ্যে সব জানাজানি হয়ে গেল! অন্তত বারো দিনের জন্য আমেরিকা গেছে তো! বাড়তেও পারে। তাকে অবশ্য বলেওনি, সে-ও জিজ্ঞাসা করেনি। এইটুকু সময় তো এ তথ্য অনাবিষ্কৃত থাকার-ই কথা! তত দিনে সে একটা কিছু ঠিক করবে। তার যা ভাগ্য! কোনও পরিকল্পনা। মেজাজ-মর্জিই খাটে না। অভাগিনি টু দা পাওয়ার ইনফিনিটি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *