পাতাল প্রবেশ
বিনোদ বলল— আমি সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছি না দিদি। ডেঞ্জারাস। যদি জলে নেমে যাই! নেমে পড়ি বরং হ্যাঁ?
রঞ্জাবতী দেখলেন গাড়ির বাইরেটা কেমন ঘোলাটে। তারপরেই বুঝলেন কাচের বাইরে জল শুধু জল। আকাশবারি তো আছেই, সেইসঙ্গে মাটিরও জল। ইঞ্জিন দিয়ে জল ঢুকছে।
—বিনোদ, আমরা বোধহয় কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো মরব। তুমি সাঁতার জানো?
—হ্যাঁ দিদি, আপনি?
—আমি একসময়ে চ্যাম্পিয়নজাতীয় কিছু একটা ছিলাম। চলো জলে নেমে যাই।
—আমার গাড়িটা দিদি! ব্যাংক লোন করে কিনেছি। এখনও হাফ শোধ হয়নি।
—তো কী! গাড়িটা নিয়ে মরতে চাও? জীবনটাই হাইপথিকেটেড হয়ে গেছে এখন।
অনেক ধস্তাধস্তি করে দরজা খুলতে হল। যতবার খুলতে যাচ্ছে, কোথা থেকে রাশি রাশি জল ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধ করে দিচ্ছে। কোনওরকমে যখন খোলা হল তখন বিনোদ কোথায় রঞ্জা আর জানেন না। চারদিকে জীবনমরণ এক হয়ে গেছে। নোংরা আঁশটে জীবনের স্বাদ। প্রাণপণে শুধু তার ওপরে উঠতে চাওয়া। হাত চলে না, পা চলে না। চ্যাম্পিয়নেরও অঙ্গে মরচে পড়ে যায়।
‘স্যার! স্যার’ ভূতের মতো দাঁড়িয়ে বিনোদ। রায়চৌধুরীর নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের বাড়ির দোরগোড়ায়। —বৃষ্টিতে কাল গাড়ি ব্রেক-ডাউন… দিদি ভেড়ির জলে…
—কী বলছ ঠিক করে বলো— রায়চৌধুরী ধমকে উঠলেন।
—দিদিকে পাচ্ছি না, জলে হারিয়ে গেছেন।
—মানে?
—জানেন তো, বৃষ্টি ভীষণ, রাস্তা ভেড়ি একাকার। গাড়িটা একদম ভোগে গেল।
—গাড়ির কথা রাখো, ম্যাডামের কথা বলো।
ম্যাডামের কোনও কথা নেই। কী বলবে বিনোদ। সে ভয়ে দুঃখে ঠকঠক করে কাঁপতেই পারে শুধু। যা দিনকাল। পুলিশে ধরলেই হল। বললেই হল দিদিকে সে-ই-ই! উঃ!
দরজায় বেল। কে এল? খবরের কাগজ? এত সকালে! —দরজা খুলে দিয়ে সুবীর দেখেন ঝোড়ো কাকের মতো রায়চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন।
আকাশ মেঘলা। প্রবল বারিপাত থেমেছে। আবার নামতে পারে। তবে আপাতত জল তার অনধিকার প্রবেশ স্বীকার করে নিয়ে লজ্জিত মুখে রাস্তা থেকে সরে যাচ্ছে।
ওখানকার থানায় খবর গেছে। দমকলেও। ডক্টর রায়চৌধুরী উদ্ভ্রান্ত। কেউ চায়নি, তবু কৈফিয়ত দিয়েই যাচ্ছেন। দিয়েই যাচ্ছেন।
—কী জানেন, প্রোঃ দত্ত। উনি নিজে… এমন একটা ইনভলভমেন্ট… রিসার্চ স্কলারদের একজনের পা ভেঙেছে। অন্য দুজনকে উনিই কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। একজন আর্কিওলজিক্যাল সেন্টারে। আরেকজন ন্যাশনালে কাজ করছে। আমি তো রেগুলার যাই, এবারের…
আজ মেঘ মেঘ দিন। হাওয়া ভারী। মুখ গোমড়া আকাশ। কিন্তু সেদিন রোদ-ঝলমল করছিল, শীতের দুপুর। মিক্সড ডাবল্স্। সুবীর আর রঞ্জাবতীর জুটি জিতল। মেয়েটি ডিগডিগে, বেতের মতো রোগা। ও নমনীয়। কোর্ট কভার করছিল দারুণ, ফিট খুব। শ্যামলা রং, তার ভেতর থেকে রক্তাভা বেরোচ্ছে। স্বাস্থ্যের লালিমা, উজ্জ্বল চোখ, দীর্ঘ কেশ ঝুঁটি বাঁধা, সালোয়ার কামিজ পরে খেলছে। ওহ্, সে কতকাল আগে।
জিতলি বটে! —বন্ধুরা ইয়ারকি দিল।
তিনি বুঝতে পারেননি, বলেন— জিতব তো বটেই, তোদের সন্দেহ ছিল? টুর্নামেন্টের কাপটা নিয়ে তবে শান্তি!
—আরে আসল টুর্নামেন্টটাই তো জিতে গেছিস।
—মানে!
—রঞ্জাবতী…!
—দুর, তোরাও যেমন…
—হোল গ্যালারি প্যাঁক দিচ্ছিল শুনতে পাসনি?
সেই দিনও হারিয়ে গেছে। সেই সুবীরও নেই। সেই রঞ্জাবতী….?
খেলাধুলো ছাড়ল, সিরিয়াস পড়াশুনোর দিকে বাঁক নিল ওর জীবন। তিনিও কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়লেন। কোচ ছিলেন সম্পৎ সিন্হা, বলেছিলেন— ডাট, তুমি ক্রিকেটটা ছেড়ে দিচ্ছ! হোয়াই! আর য়ু ম্যাড অর হোয়াট!
—ইন্ডিয়ার ব্লেজার পরতে পারব গ্যারান্টি দিতে পারেন!
—নো। তা পারি না। কিন্তু তাতে কী! খেলাটা পারো, তার আনন্দ নেই?
কে শোনে কার কথা, স্পোর্টস কোটায় রেলওয়েতে ঢুকে গেলেন। খেলতেন। কিন্তু মন ছিল না। পড়াশোনাটা বাধা পাচ্ছে। শেষ করতে হবে। বিয়ে, তারপরেই দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে, মোটাসোটা বইগুলো খুলে বসলেন। রঞ্জা বরাবরই তাঁর পেছনে লেগে ছিল। মাস্টার্সটা শেষ করো, শেষ করো। কিন্তু এই ভাবে ভাল চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে…! জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলো না সুবীর! ছিনিমিনি! প্রবল কথা-কাটাকাটি! ঝগড়া! তিক্ততা। পড়া শেষ হল। কলেজ লেকচারারের চাকরিতে ঢুকলেন। চারপাশে বইয়ের পর বই। ছাত্রের পর ছাত্র। খালি রঞ্জার বিষয়টা নিয়ে তিনি কখনও উৎসাহ দেখাননি! — কী যে রস পাও অতীতে! খুঁড়লে কে জানে কী বেরোবে!
—কী আর বেরোবে, রঞ্জা কেমন অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বলত— যাই হোক ডাইনোসর হলেও তো তা কঙ্কাল মাত্র। কিংবা ফসিল! ভয়ের কিছু না। সেই সব হাড়গোড় রিকনস্ট্রাক্ট করে পুরো জানোয়ারটাকে গড়ে তোলা কম ইন্টারেস্টিং?
এখন পথের দুধারে অনতিঅতীতের টুকরোটাকরা খুঁজতে খুঁজতে যাচ্ছেন সুবীর। পদচিহ্ন, কোনও চিহ্ন! বাইরের মানুষটা বদলায়, ভেতরটাও, কিন্তু মানুষের আসলটা বদলায় না রঞ্জাটা। সব নিস্পৃহতা, উদাসীনতা, প্রতিযোগিতা বাহ্য। শোনো রঞ্জা। তুমি বরাবর আমাকে ভুল বুঝেছ, আমি নিজেকে সরিয়ে নিইনি। ভেতরে গনগনে আঁচ নেই, কিন্তু উত্তাপ আছে। উষ্ণতা। তুমিও কি গুটিয়ে যাওনি? কিন্তু আমি জানি তোমার আসলটা ঠিক জায়গায় আছে। সত্য এত গভীরে থাকে যে তাকে পুরাবস্তুর মতোই উৎখনন করতে হয়। পললের পর পললের স্তর সরিয়ে। গ্রানাইট ব্যাসল্টের খাঁজের পর খাঁজ ভেঙে আশ্চর্য ফসিল, ভালবাসার। সবুজ মুছে গেছে, কিন্তু স্পষ্ট সোনালি ধূসর ফসিল।
—আরে কী হল প্রোফেসর দত্ত, আপনি ওরকম ভেঙে পড়ছেন কেন? নিজেই তো বলছেন উনি চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু ছিলেন।
—সে যখন ছিলেন তখন ছিলেন— প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন সুবীর। মনে মনে বললেন— তোমাকে আমি মাফ করব না রায়চৌধুরী। আমার অতীতখ্যাপা বউটাকে অজ্ঞাতকুলশীলে পাঠিয়ে নিজে সেক্রেটারিয়েট টেবলের সামনে শীতল ঘরে আরাম করছ। সুবিধেবাদী। এদিকে পেপার যত বেরোবে দুজনের নামে। ভাল রে ভাল। আর মেয়েটা এমন নিপাট বোকা যে চিরটা কাল এক ভাবে ঘোল খেয়ে এল। —শোনো সুবীর। তুমি ভুল বুঝছ। আমার ফিল্ড ওয়র্ক, আর ওর ডেস্ক ওয়র্ক— কাজটা দুজনের হল না।
আরে! ও পুরুষমানুষ ও ফিল্ডে যাক। ব্যস অমনি ফেমিনিস্ট বউয়ের মুখে উপেক্ষার হাসি ফুটে উঠবে— ভুলে যাচ্ছ সুবীর, আমি অ্যাথলিট ছিলাম তার কিছু তো এখনও অবশিষ্ট আছে। আর ডক্টর রায়চৌধুরী তো স্রেফ ভুঁড়িদাস।
—দেউলিয়া, বেড়াচাঁপা দুটো নামই আজ্ঞে চালু, একরাম আলি সঙ্গে চলেছেন। শুকনো কাদা ফাটা পথ মাড়িয়ে রায়চৌধুরীর ইন্ডিকা উড়ে যেতেই চাইছিল। বারাসতের পর টাকি রোড ধরেছেন। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ।
—দেউলিয়াকে দেবালয় বানানো হয়েছে। দেউলিয়া কেমন দেউলে দেউলে লাগে না। তাই দেবালয় বোঝলেন না?
দেউলেই তো! সুবীর ভাবেন— ছেলে গেছে অকালে, এখন বউও… দেউলে ছাড়া কী! হঠাৎ চিত্ত আকুলিবিকুলি করে ওঠে! ঈশা! ঈশা কেমন আছে? তারও তো জীবনে তোলপাড় চলছে তিনি জানেন। কিন্তু এসব কথা ঈশা মায়ের সঙ্গে বলে। বাবার সঙ্গে না। তিনি এসব নিয়ে ভাবেন না, যা ভাববার রঞ্জা ভাববে, যা করার রঞ্জা করবে। তাঁকে যদি নির্দিষ্ট কিছু করতে বলা হয় করে দেবেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার জগৎ থেকে তিনি বড় একটা বার হতে চান না। নিয়তি আজ গালে কষে একটা চড় মেরে বাইরে বার করে দিয়েছে। কথাটা দুম করে মনে হল। নিশীথ নামে ছেলেটি খুব ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করছিল, রঞ্জা বলেছিল— ঠিক আছে, ওদের পাঠিয়ে দাও। তিনি রেগে গিয়েছিলেন খুব। হঠাৎ তাঁর মনে হল যে কোনও ঘটনাকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে থাকেন। লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতে হয় তিনি প্রথমেই ভেবেছিলেন একটা বাচ্চা নিয়ে মেয়ে এসে পড়বে। ওই বাচ্চা বড় করার যাবতীয় দায়িত্ব, একটি যুবতী মেয়েকে রক্ষা করার দায়িত্ব এই বয়সে তাঁকে নিতে হবে! মেয়ের অবস্থান সম্পর্কে কিছু ভাবার আগে তিনি নিজের অবস্থানের কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু রঞ্জার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। সে মেয়ের মানসম্মানের কথা, তার পরিস্থিতির কথাই শুধু ভেবেছে। আর কিছু না। আগেও না। পরেও না।
—বেড়াচাঁপা গ্রামের নামের পেছনেও হিস্ট্রি আছে— একরাম অক্লান্ত বলে চলেন।
—চন্দ্রকেতুগড়ের গেটওয়ে হল এই বেড়াচাঁপা। কথিত আছে রানির কাছে পৌঁছেছে পির আব্বাস বা গোরাচাঁদের অলৌকিক ক্ষমতার কথা। তিনি কিছু চমৎকার দেখতে চাইলেন। পিরের সঙ্গে তখন তেনাদের দহরম মহরমের মরশুম তো? লড়াই শুরু হয়নি। তা রাস্তার পাশে একজনার বাগান। তাতে বাঁশের বেড়া যেমন হয়। বেড়া ছুঁয়ে মনে মনে কী বিড়বিড় করতে লাগলেন পিরসাহেব। ব্যস, বেড়ার গায়ে একটার পর একটা চাঁপাফুল ফুটতে লাগল।
গোরাচাঁদের মন্ত্রবলে চাঁপাফুল ফুটল বেড়ার গায়।
মনোহর সরকার বলে, দেখবে তো এসো বেড়াচাঁপায়।
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে সুবীরের। একটা প্রকাণ্ড দুর্ঘটনা ঘটেছে, আর এই মিঞা এমন হিস্ট্রি বলছে যেন তাঁরা মিউজিয়াম কি রুইনস দেখতে এসেছেন। বেড়াচাঁপা মাই ফুট!
সামনে বসেছেন একরাম। হঠাৎ পেছন ফিরে বললেন— ভাববেন না সাহেব। আমি চারদিকে খোঁজ পাঠিয়েছি। এসব হল হুলিগান এরিয়া। চুপিচাপি কাজ করতে হয়। হ্যাভ পেশেন্স। তা ছাড়া মাকে আমি দেখেছি। শক্তিময়ী। নমস্তস্যৈ নমোনমো।
আবার একটু পর শুরু হল।
—বোঝলেন সাহেব— পুরনো পাঁক তুলতে গিয়ে, কুয়ো খুঁড়তে গিয়ে, বাড়ির ভিত কাটতে গিয়ে কত যে সিলমোহর, পুতুল, পটারি বেরিয়েছে! খনার ঢিপির চারদিকে এদিক-ওদিক এখনও মেলে। লোক্যাল ছেলেছোকরারা ভাল দামে বেচে দেয় দালালদের। বোঝলেন না পেটের খিদেটি যেমন করে হোক মেটা চাই, ঠিক কি না! দোষ দিয়ে লাভ নাই।
তা ছাড়া নানা কারণে এদিকে এক্সক্যাভেট বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও বাড়ির মালিক বলছেন— ‘কিছু পাওয়া গেলে আমার ভদ্রাসনটি চৌপাট হয়ে যাবে, দয়া করে বন্ধ করুন এসব।’ কোথাও বা জল উঠছে, জল, খালি জল। জলের শেষ নাই। আবার কোথাও শাবল, গাঁইতি ছিটকে আসছে। মানেটা বোঝলেন? কিছু আছে। লোহা হোক, পাথর হোক। কিছু না কিছু কনস্ট্রাকশন। সাহেব, আপনি অস্থির হবেন না, বোঝলেন না এসব হুলিগান জায়গা… খুব সাবধানে খোঁজখাঁজ করতে হয়।
শায়রীকে নিয়ে ঈশা মাসির সঙ্গে আসতে থাকে। ধরবার মতো কোথাও কিছু নেই। নেই, পাবে না বুঝে শেষ পর্যন্ত এককথায় সমস্ত ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে। আর তখনই… যখন মাকে তার সবচেয়ে দরকার…. তার বুকের ভেতরটা থম ধরে আছে। আশ্চর্য। এই ফ্লাইটেও মিস রঙ্গরাজন। কিন্তু সে তাকে চিনি-চিনি করেও চিনতে পারে না। কোথাও দেখেছি, কোথাও… যেন জলের তলায় দেখা মানুষের মুখ। রঙ্গরাজন একমুখ হাসল, কিন্তু তার শুকনো মুখে আলো ফুটিফুটি করেও ফুটল না।
—আমি অরুন্ধতী রঙ্গরাজন— গত সপ্তাহে হায়দরাবাদ-দিল্লি ফ্লাইটে দেখা হল?
আনমনে ঘাড় নাড়ে ঈশা। ফিকে হাসি।
পাশে মঞ্জুলিকাকে দেখে মেয়েটি বলল— আর ইউ রিলেটেড টু হার ম্যাডাম?
—ইয়া, শি ইজ মাই নিস!
—ইজ এনিথিং রং, আই মিন, রং উইথ হার।
—হার মাদার ইজ মিসিং…..
কেঁপে উঠল ঈশা। মাদার ইজ মিসিং। সেই ছোটবেলাকার অনুভূতি। মা বেরিয়ে গেছে। জানা কথা বিকেলে ফিরবে, কিন্তু মনে হচ্ছে আর ফিরবেনা। মা নেই, মা নেই। ঠাম্মা দুপুর-ঘুমে। সে আর ভাই দুপুরবেলা স্কুল থেকে এসে ক্যারম নিয়ে টানাটানি করছে। হঠাৎ ভাই টকটকে লাল চোখে ডিগবাজি খেতে খেতে শূন্যে উঠে গেল, শূন্য ভাঙা মন্দির। বিগ্রহ নেই, পূজারি নেই। উপকরণ নেই। ঝড় আসছে, জোরালো হাওয়ায় জানলা-দরজা খুলে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ঢুকে আসছে ঘরে। …ব্লু ছাপা শাড়ি পরে গেছে আজ মা। সে রোজ মায়ের সাজটা দেখে। গেল ফোটা ফুলের মতো, আসবে শুকনো ফুলের মতো। হা-ক্লান্ত। পাপড়িগুলো খসে খসে পড়ছে। মা যদি না থাকে আর? জীবনের এই দুর্গততম মুহূর্তে মা পাশে না থাকলে সে কী করে দাঁড়াবে? মা, মা, অন্তত যত দিন না আমি নিজের পায়ে দাঁড়াই। যত দিন না এই বাস্তবের যোগ্য হতে পারি… তত দিন।
এয়ার পকেটে একটা গোঁত্তা খেল প্লেন। ঈশার মনে হল তার আত্মাটাকে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল আকাশ। এ সে কী বলছে! আমি যত দিন না দাঁড়াই… মাকে সে তার ফেরিঘাটের নৌকো হিসেবে চাইছে শুধু? পার করে দাও, তারপর যাবার হলে যাও, আমি আর আঁকড়াব না!
ফেরির মাঝি ভেড়াও ভেড়াও
শেষ করে নিই দেওয়া-নেওয়া
কড়ির কাঙাল, পাড়ের কাঙাল।
স্রেফ অনুপল দাঁড়িয়ে থাকা।
মুখ দেখি না মুখ দেখি না
রেজগি গুনি মিলছে কিনা হিসেব-নিকেশ।
তারপরে শেষ। তারপরে শেষ। তারপরে শেষ।
তার মানে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে প্রত্যেক মানুষের সম্পর্ক এরকম প্রয়োজনের সুতো দিয়ে বাঁধা। মৌলিক কোনও বিভব সেখানে খোঁজা বৃথা! তাকে দিয়ে খুব হালকা কতকগুলো প্রয়োজন মিটল না বলে নিশীথ সম্পর্কচ্ছেদ করছে, মা ছাড়া সংসার অচল তাই বাবা নানা মতের গভীর অমিল সত্ত্বেও মাকে নিয়ে বাস করছে? তার মনে পড়ল একটা মূর্তি। সাদা, সরু পাড় কাপড় পরা, চুলগুলো প্রায় সবই সাদা, গোছানো। চুপচাপ বসে আছেন জোড়াসনে। চোখ উধাও। দিদা—বেদবতী। বুড়োমা অর্থাৎ সর্বমঙ্গলা দেবীর মৃত্যুর পর একগোছা ফটো পাঠিয়েছিল মা, তার মধ্যে দিদার এই ছবিটা ছিল। যে-ই তুলে থাক, অদ্ভুত তুলেছে। বেদবতী স্তব্ধ। ৯৫/৯৬ বছরের বৃদ্ধা অ্যালঝাইমার ও অন্যান্য উপসর্গে আর মানুষ ছিলেন না শেষ ক’ বছর। অশেষ কষ্ট পেয়ে ও দিয়ে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। এ মৃত্যুতে শোক করার কিছু নেই। বেদবতীর দৃষ্টিতে শোক নেই। কিন্তু কী গভীর এক স্মৃতি-ঘোর। তিনি যেন শ্রাদ্ধবাসরের এক প্রান্তে বসে তাঁর মায়ের সারাজীবনটার চলচ্চিত্র দেখছেন। অবলোকন করছেন। কী মহিমা এই বিশোক শোকের। কী যে বলতে চায় এই আলোকচিত্র, পুরোপুরি বোঝা যায় না। মহাকালকে উদ্দেশ করে বলছে কি— তুমি এই সব দিয়েছিলে, নিয়ে নিয়েছ। নিংড়ে নিংড়ে জীবনরস নিয়ে নিয়েছ হে, কিছুই আর রাখলে না! তার সামনেও একটা ফিলমের রোল খুলে যেতে থাকে— যুবতী মা লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, আদর করছে, কাজ করছে, দুম করে বেরিয়ে গেল, এক ব্যাগ নতুন জামা-কাপড় নিয়ে ঘর্মাক্ত, আলো-আলো মুখে ফিরছে। মা আর যুবতী নেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভাইয়ের মৃত্যুতে মুহ্যমান মা। কত দিন কথা বলেনি মা! চট করে তাকে অপাঙ্গে দেখে নিল, চোখে অপার আকুলতা। না মা, না। তুমি বড় জরুরি আমার জীবন-বিন্যাসে। একেবারে অত্যাবশ্যক। তবু তুমি তোমার জন্যেই বাঁচো। রঞ্জাবতী দত্ত, স্ত্রী, মা, শাশুড়ি, বউমা হিসেবে অশেষ কর্তব্য যিনি সমাপন করে থাকেন, অশেষ কষ্ট পেয়েছেন, পাচ্ছেন, সমালোচনায় জর্জরিত, তবু যিনি খনামিহিরের ঢিপির উৎখনন লব্ধ পুরাবস্তুর খোঁজে, সেই পুরাবস্তু অতীতের কোন মৌনকে মুখর করে জানতে, এই পঞ্চাশোত্তর বয়সে পুত্রশোককে বুকের পাথরে ফসিল করে রেখে কন্যার বিবাহ-বিভ্রাটের সদ্য ঘায়ে জ্বলতে জ্বলতে চলে গেছেন, এখন জীবন মরণ বন্যার কবলে। ঈশা চোখ বুজল। বড্ড জ্বালা করছে, জানলার দিকে মুখ ফেরাল, জল নামছে। এতক্ষণে।