স্বর্ণলিপ্সা – ৫৪

চুয়ান্ন

তিনদিন পর।

ফোর্ট উইলিয়ামের ঘুষখোর অফিসারদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে জেসিকা। ফলে হাজার হাজার জিজ্ঞাসা খুবলে খাচ্ছে স্কটিশ পুলিশের বড়কর্তাদের মন। দুর্গের উঠান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে রন স্টুয়ার্টকে। তদন্তে জানা গেছে, বেলফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে অচেতন পিটার হ্যাননকে খুনের চেষ্টা করেছিল সে। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। কেন যেন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে বিরক্ত করা হয়নি রানা বা বেন হ্যাননকে। এর বড় কারণ বোধহয় এটা: (অব.) কর্নেল হপকিন্স এবং ব্রিটিশ আর্মির কর্মরত ক’জন জেনারেল চেয়েছেন সাধারণ মানুষ যেন কিছুতেই জেনে না যায় ডিযঅনারেবলদের বিষয়টি।

দুর্গে হামলার পরদিন রানার সঙ্গে বেলফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে ভাতিজাকে দেখে এসেছে বেন হ্যানন। ডাক্তার ভরসা দিয়েছেন, আগের চেয়ে ভাল আছে পিটার। আগামী দু’এক দিনের ভেতর হয়তো জ্ঞান ফিরবে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে জোর করে ওস্তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছে রানা। প্রথমে আপত্তি তুললেও পরে ইতালিতে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে বেন।

বিকেলে ভাতিজার বাড়িতে রানা আর জেসিকার সঙ্গে বসে আছে বেন, এমনসময় এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে চেপে এসে ঝড়ের বেগে বাড়িতে ঢুকল মিরাণ্ডা। কেঁদেকেটে জারে- জার হয়ে গেছে। স্ত্রীর কথায় শপথ নিয়েছে বেন, জীবনেও কোনও বিপদে আর পা বাড়াবে না। আসলেই মেলা বয়স হয়েছে তার। তবে মিরাণ্ডাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার ফাঁকে রানার দিকে চেয়ে চোখ টিপেছে বুড়ো।

রানা ভাল করেই জানে, দুর্দান্ত সাহসী, বেপরোয়া, দুরন্ত স্বামীকে বেঁধে রাখা সত্যিই কঠিন হবে।

সন্ধ্যার দিকে ফোন করলেন ডাক্তার লরেন। ভাল সংবাদ পেল ওরা। কোমা থেকে উঠেছে পিটার। কথা বলতে পারছে। জ্ঞান হারাবার আগে কী হয়েছিল, সবই মনে আছে তার। ডাক্তার জানালেন, আশা করা যায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে সে।

সে-রাতেই হাসপাতালে গিয়ে ভাতিজার সঙ্গে কথা বলল বেন। একই রাতে খুশি মনে স্ত্রীর সঙ্গে বিমানে চেপে ফিরল ইতালিতে। অবশ্য তার আগে রানাকে বলেছে, ‘যার শেষ ভাল, তার সব ভাল, বাছা! নিশ্চয়ই এরপর আবারও দারুণ কোনও অভিযানে আমরা যেতে পারব!’

রাতে রানা ও জেসিকা জানল, জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পরিবেশবাদী জিম অ্যাণ্ডারসন ও তার দলের সদস্যদেরকে। রবার্ট উইলসন খুনের বিষয়ে জেসিকার দেয়া প্রমাণ আমলে এনে তাদের বদলে গ্রেফতার করা হয়েছে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে ও ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ডানকান রিডকে। রেহাই পায়নি তাদের দুষ্টচক্রের দুর্নীতি- পরায়ণ পুলিশ অফিসাররা কেউ। জেরার সময় সবার আগে ভেঙে পড়েছে রানা ও জেসিক র ওপর হামলা করা হাইওয়ের সেই দুই পুলিশ। তাদের কাছ থেকে জরুরি তথ্য পেয়ে আরও কঠোর হয়েছেন পুলিশের বড়কর্তারা। কিন্তু জানা যায়নি, কী কারণে ওই দুই পুলিশ পুড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের গাড়ি। এ ব্যাপারে কোনও কথাই বলেনি তারা।

রন স্টুয়ার্টের দুর্গে হামলার পর আজ তৃতীয় দিনে সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে দারুণ সুস্বাদু স্টেক ও হাতে-তৈরি পাউরুটির সুগন্ধে আনমনে হাসল রানা। গত ক’টা দিন যেন বাস করছে ও সত্যিকারের স্বর্গে। প্রতিরাত যেন আসছে স্বপ্নময় মধুরাতের মত। রানা ভাবছে, জেসিকার মত গুণী স্ত্রী পেলে সংসার জীবনটা না-জানি কী দারুণ আনন্দের হবে!

আজ ওরা চলেছে আরডাইক লকের তীরে পাইন বনে পিকনিক করতে। সেজন্যেই ভোর থেকে কিচেনে নানান খাবার রাঁধছে জেসিকা। ওর সুরেলা, মিষ্টি কণ্ঠের গুনগুন গান শুনল রানা। বিছানা ছেড়ে গিয়ে ঢুকল বাথরুমে। দশমিনিটে শাওয়ার সেরে পোশাক পাল্টে চলে এল কিচেনে। ওর পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে মৃদু হাসল জেসিকা। কিন্তু ওর চোখে কীসের যেন এক অচেনা বিষাদ আর গভীর শঙ্কা।

‘কী হয়েছে, জেসিকা?’ জানতে চাইল রানা।

ওর চোখে চেয়েও দৃষ্টি নামিয়ে নিল জেসিকা। নিচু গলায় বলল, ‘ফোনে এক ভদ্রলোক তোমাকে চেয়েছেন।’

‘নাম কী তাঁর?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘জানালেন, তিনি বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। বলেছেন, তুমি যেন ফোন করো তাঁকে।’ হাসল জেসিকা। তবে সেই হাসিতে একরাশ কষ্ট। ‘এবার বোধহয় তোমাকে ডেকে নেবেন তিনি। ‘

‘হয়তো,’ ঘুরে কিচেন থেকে বেরিয়ে বেডরুমে ঢুকল রানা। আবারও বসের সঙ্গে কথা বলবে ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করছে। বহুদিন পর সত্যিই হয়তো পাবে দুর্দান্ত কোনও অ্যাসাইনমেন্ট। সুযোগ আসবে দেশের জন্যে কিছু করার। ছোঁ দিয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন নিল রানা।

বেডরুমের দরজা থেকে বলল জেসিকা, ‘আমি তোমাকে সংসারের মায়াজালে বাঁধতে চাইনি। তবে আবারও এদেশে এলে তুমি যেন ভুলে যেয়ো না আমার কথা।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ফোনে ডায়াল করার আগে গভীর কণ্ঠে বলল, ‘কখনও নয়, জেসিকা!’

***  

1 Comment
Collapse Comments

চমত্কার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *