স্বর্ণলিপ্সা – ৫৩

তেপ্পান্ন

সিঁড়িতে অনিয়মিত পায়ের আওয়াজ পেয়ে রানা বুঝে গেছে, ওই লোক মারাত্মকভাবে আহত। নিঃশব্দে আওয়াজ অনুসরণ করে কয়েক মুহূর্ত পর দেখল, সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখেছে লোকটা। হাঁপিয়ে চলেছে বেদম। সে করিডোরে নেমে যাওয়ার আগেই ওপর থেকে রাইফেলের বাতিটা জ্বালল রানা। জোরালো আলোয় চিনে গেল তাকে। এখন আর নেই আগের সেই বাক ওয়াকি। পাণ্ডুর হয়েছে গোটা মুখ। চোখে তীব্র ব্যথা আর পরাজয়ের গ্লানি। রক্তে ভিজে কালো হয়ে গেছে পোশাক। দেহের পাশে মরা সাপের মত ঝুলছে বামহাত। আড়ষ্ট মুঠোয় ধরে রেখেছে পিস্তল। রানা জেনে গেল, গোলাগুলির সময় ডানজন থেকে নিরাপদে বেরোতে পারেনি সে।

‘নড়বে না, ওয়াকি,’ নিচু গলায় বলল রানা।

থমকে গেছে ঠাণ্ডা-মাথার খুনি। কড়া, আলোয় চোখ পিটপিট করে রানাকে দেখতে চাইছে। অসাড় হাতে ওপরে তুলতে চাইল পিস্তল। তাতে কাজ হলো না।

‘ভুল কোরো না,’ বলল রানা, ‘ট্রিগার টেপার আগেই খুন হবে।’

‘চাইলে গুলি করো,’ জবাবে বলল বাক ওয়াকি। বড় ক্লান্ত তার কণ্ঠস্বর। ‘আমি এমনিতেই শেষ।’

‘জেসিকা কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

শুকনো হাসল বাক ওয়াকি। ‘জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, তা-ই না?’

‘ওর কাছে পৌছে দাও, বদলে পালিয়ে যেতে দেব। প্রাণে বেঁচে যাবে।’

‘ও, তা হলে তোমার কথা মেনে আমাকে চলতে হবে?’

‘আগে হাত থেকে পিস্তল ফেলো। তারপর আমাকে নিয়ে চলো জেসিকার কাছে।’

বাক ওয়াকি কিছু বলার আগেই অন্ধকারে গুড়গুড় করে উঠল ভারী কণ্ঠস্বর, ‘না, বাক, ওকে কোথাও নিতে হবে না। ও এবার মরবে কুকুরের মত।’

চোখের কোণে রানা দেখল, অন্ধকার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশালদেহী এক লোক। তার রাইফেলের আলো পড়েছে ওর মুখে। আলো পড়তেই চোখ কুঁচকে ফেলল রানা। ভারী গলায় লোকটা বলল, ‘কী খবর, মেজর? ভেবেছিলে যা খুশি করবে?’ বাক ওয়াকিকে বলল সে, ‘তুমি ভেবেছ তোমাকে ফেলে চলে যাব, দোস্তো?’

মাত্র একজনকে গুলি করতে পারবে, বুঝে গেছে রানা। অন্যজনের হাতে খুন হবে। শুকনো গলায় বলল ও, ‘চাইলে গুলি করতে পারো। তবে সেক্ষেত্রে বাঁচবে না তোমার বন্ধু।’

কর্কশ গলায় হাসল দানব। ‘বাকের এখন যে অবস্থা, গুলি করলে হাসতে হাসতে মরে বাঁচবে। তবে সেক্ষেত্রে তুমি নিজেও খতম হবে, মেজর। মাথায় বুদ্ধি থাকলে হাত থেকে রাইফেল ফেলো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। রাইফেল তাক করে রেখেছে বাক ওয়াকির বুকে। আহত ডিযঅনারেবলের হাত থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। মৃদু টলছে লোকটা। জানতে চাইল রানা, ‘কী বিষয়ে কথা বলবে?’

‘তোমার কাছ থেকে সোনার কয়েনের গল্প শুনবে লরি আঙ্কেল। তুমি কি ভেবেছ এমনি এমনি রক্তভরা এই দোজখে রয়ে গেছি?’

‘সোনা চাইলে কোদাল হাতে মাটি খুঁড়তে শুরু করো, শুকনো গলায় বলল রানা। ‘একদিন না একদিন কিছু না কিছু পেয়েই যাবে।

‘বাজে কথা বাদ দাও। ভাল করেই জানি, তুমি কোথাও লুকিয়ে রেখেছ সোনার কয়েন। আমরা চুক্তি করব। আমাকে দেবে সব সোনা, বদলে তোমাকে ছেড়ে দেব। ভাল প্রস্তাব, কী?’

‘ওকে গুলি করো,’ বেসুরো কণ্ঠে বলল বাক ওয়াকি।

আবারও কর্কশ স্বরে হাসল মৌরেন লরি। ‘সেক্ষেত্রে ওর গুলিতে খুন হবে আমার বন্ধু। তুমি কি তা-ই চাও, বাক?’

‘রানা অত দ্রুত নয়,’ বিড়বিড় করল বাক ওয়াকি।

‘আমরা কেউই মরতে চাই না,’ বলল মৌরেন, ‘আর মরতেই হবে, এমনও নয়।’

রানা বা বাক ওয়াকি কিছু বলার আগেই অন্ধকারে বলে উঠল চতুর্থ কণ্ঠ, ‘কথাটা ভুল!’

ইঁদুরের মত কিঁচকিঁচ শব্দে চেঁচিয়ে উঠল মৌরেন লরি। তার হাত থেকে মেঝেতে খটাস্ করে পড়ল রাইফেল। একইসময়ে স্লো মোশন ছায়াছবির মত বাক ওয়াকির হাতের পিস্তল ওপরে উঠতে দেখল রানা। ট্রিগারে চেপে বসছে তর্জনী। ওর বুকের দিকে ঘুরে গেছে পিস্তলের নল। দেরি না করে দ্বিধাহীনভাবে গুলি করল রানা। হাই-ভেলোসিটির রাইফেলের বুলেট সরাসরি বিধল বাক ওয়াকির কপালে। ভীষণ ঝটকা খেল তার মাথা। পরক্ষণে ধড়াস করে করিডোরে পড়ল লোকটার লাশ।

চরকির মত ঘুরেই মৌরেনের দিকে রাইফেল তাক করল রানা। জোরালো আলোয় দেখল মস্ত হাঁ মেলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে লোকটা। গলগল করে মুখ থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে রক্তের স্রোত। তার পেটে গেঁথে দেয়া হয়েছে চওড়া ফলার একটা তলোয়ার। মৌরেন লরির পিঠ আর পেট ভেদ করে দিয়েছে ওটা। আলো উঁচু করে রানা দেখল, দানবের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জেসিকা। এখনও দু’হাতে ধরে রেখেছে তলোয়ারের হাতল।

‘জেসিকা?’

অস্ফুট স্বরে কী যেন বলল মেয়েটা, কথাটা বুঝতে পারল না রানা। মোটা গলায় কর্কশ আর্তনাদ শুরু করেছে মৌরেন লরি। পেট থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে রক্ত। হ্যাঁচকা টান দিয়ে তলোয়ারটা খুলতে চাইল জেসিকা। তবে পাঁজরে আটকা পড়ে গেছে বলে বেরিয়ে এল না ফলা।

‘একপাশে সরে দু’হাতে কান ঢাকো, জেসিকা,’ বলল রানা। মৌরেন লরির পরিণতি দেখে খারাপই লাগছে ওর। জেসিকা সরে যেতেই তার মগজে গুলি করল রানা। আচমকা থামল বিকট আর্তনাদ। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। এখনও পিঠ-পেট ভেদ করে গেঁথে আছে তলোয়ার।

‘হ্যাঁ, এবার বলো,’ বলল রানা। ‘তোমার কথা শুনতে পাইনি।’

‘আমি বলেছি অনেকক্ষণ পর দেখা হলো।’

‘আমি তোমাকে খুঁজছিলাম।’

‘পেয়েও তো গেছ।’

‘অথবা, তুমি আমাকে পেয়েছ।’

কাঁধ ঝাঁকাল জেসিকা। ‘ঘর থেকে তোমার গলার আওয়াজ পেলাম। তখন মনে হলো, আমি হয়তো কোনও উপকারে আসতে পারি।’

‘তা পেরেছ।’

‘তো এত যে উপকার করলাম, বদলে কি আমাকে দুই- একটা চুমু দেয়া যায় না?’

রাইফেল ফেলে কয়েক পা গিয়ে জেসিকাকে জড়িয়ে ধরল রানা। ওর নিষ্ঠুর ঠোঁটদুটো নেমে এল মেয়েটার নরম অধরে। মিনিটখানেক পর মুখ পিছিয়ে নিয়ে বলল জেসিকা, ‘ওরা সবাই কি…’ আর কিছুই বলছে না।

‘ডিযঅনারেবলরা আর নেই। তবে খুঁজে বের করতে হবে স্টুয়ার্টকে।’

‘আর বেন হ্যানন?’ কথাটা বলতে গিয়ে কেঁপে গেল জেসিকার কণ্ঠ।

ওস্তাদের কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে গেছে রানার। কী বলবে ভাবছে, এমনসময় নিচতলা থেকে বলল বেন হ্যানন, ‘এই যে আমি, আরেকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছি। তোমাদের জন্যে একটা চমকও আছে।’

‘সেটা কী?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘সদরদরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল ব্যাটা—রন স্টুয়ার্ট,’ বলল বেন। ‘তবে তার পায়ের আওয়াজ পেয়ে পিছু নিয়েছিলাম। সহজেই ধরা পড়েছে আমার হাতে। ওর পরনে নানদের কালো ড্রেস। বোধহয় ভেবেছে এই পোশাকে পালিয়ে যেতে পারবে। ওকে বলেছি, পুলিশের হাতে তুলে দেব। তবে ভুলেও যদি আমাদের কথা তাদেরকে বলে, নিজে তো ভালমত ফাঁসবেই, পরে জেলখানায় ঢুকে স্রেফ খুন করে ফেলব।’

‘কী বলেছে সে?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘একটু আগে বলল, জীবনেও আমাদেরকে দেখেনি।’

‘আমি কিছুই করিনি, কিছুই বলিনি,’ স্টুয়ার্টের মিনমিনে কণ্ঠ শুনল রানা ও জেসিকা। ‘আমাকে খামোকা বন্দি করা হয়েছে। আমাকে ছেড়ে দেয়া হোক।’

‘কিছুই করোনি, তাই না? শালার পো শালা, হারামির বাচ্চা!’ কড়া ধমক দিল বেন হ্যানন।

‘জেসিকা নিচতলায় নেমে যাও,’ বলল রানা। ‘আমি দড়ি জোগাড় করে আনছি। আরও কিছু কাজ রয়ে গেছে।’

.

দশমিনিট পর উঠানে প্রবল তুষারপাতের ভেতর বড় এক রাজকীয় চেয়ারে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হলো রন স্টুয়ার্টকে। বাইরে বিধ্বস্ত সব গাড়ি এবং পোড়া দালানের উপর চোখ বুলাল জেসিকা, তারপর ওর দুই গালে কষে দুটো চড় মেরে রানার চুরি করা মরিস মাইনর গাড়ির পেছন সিটে গিয়ে উঠল জেসিকা।

একটু আগে ওস্তাদের কাছ থেকে বোমাভরা চটের থলে নিয়েছে রানা। ঘুরে এসেছে দুর্গের দোতলার বড় কয়েকটা ঘর থেকে। মরিস মাইনর গাড়িতে ওঠার আগে বেন হ্যাননের হাতে রিমোট ডেটোনেটরটা দিল রানা। মৃদু মাথা দোলাল। ‘আপনিই শেষ করুন, ওস্তাদ।’

‘আগে গাড়িতে উঠি,’ বলল বেন হ্যানন।

ওরা চেপে বসল প্রাচীন মরিস মাইনরের সামনের দুই সিটে। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে চলল রানা। ভাবছে, লুঠ করা যে টাকা ওর কাছে রয়ে গেছে, সেগুলো ব্যয় করে ক্ষতিপূরণ দেবে ডুবে ডুবে জল খাওয়া ওই টয়োটা গাড়িটার রেন্টাল কোম্পানিকে।

দুর্গের কম্পাউণ্ড থেকে বেরিয়ে রিমোট ডেটোনেটরের সেণ্ড অল বাটনটা টিপে দিল বেন।

পরমুহূর্তে পেছনে বিদ্যুতের ঝিলিকের মত সাদা আলো দেখল ওরা। লাফ দিয়ে আকাশে উঠল দুর্গের নানান অংশ। কানে এল বিকট আওয়াজ। বিস্ফোরণের আঘাতে হুড়মুড় করে ধসে পড়ছে বিশাল দালান। লাল আগুনের গোলা বেরোচ্ছে অসংখ্য ভাঙা জানালা দিয়ে। গলগল করে বেরিয়ে আকাশে উঠছে ঘন ধোঁয়া।

জঙ্গুলে সরু পথ শেষ করে এস্টেটের মেইন গেটে পৌছে গেল রানা। খুলে রাখা হয়েছে দুই কবাট। কর্মচারীরা গোলাগুলি আর বোমার আওয়াজে আগেই পালিয়ে গেছে। তুষারভরা পথে তিনটে গাড়ির গভীর দাগ দেখল ওরা।

গ্রামের দিকে গাড়ি বাঁক নেয়ায় পেছনের সিট থেকে নিচু গলায় বলল জেসিকা, ‘এবার কিন্তু আমার বাড়িতে উঠব, রানা। জরুরি কিছু দেনা-পাওনা আছে।’

চট্ করে রানাকে দেখল বেন হ্যানন। বুঝে গেছে, তার শিষ্যকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে মেয়েটা। মতামত জানাল সে, ‘রানা খুবই ভাল ছেলে, ওর দ্বারা তোমার কখনও কোনও ক্ষতি হবে না।’

দূরে ওরা শুনল পুলিশের অন্তত বিশটা গাড়ির সম্মিলিত সাইরেন।

‘স্কটল্যাণ্ডের পুলিশ মাত্র দু’ঘণ্টায় পৌঁছে যায়,’ তিক্ত স্বরে বলল জেসিকা। ‘আর আমি তাদেরই একজন!’

‘তুমি আবার যখন-তখন আমাকে গ্রেফতার করবে না তো?’ মৃদু হেসে জানতে চাইল রানা।

‘কথামত চললে শেষমেশ হয়তো এবারের মত ছেড়েই দেব,’ লাজুক স্বরে বলল জেসিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *