বায়ান্ন
কানা লোকটার ফোন ব্যবহার করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠের ডিযঅনারেবলকে কল দিল রানা। ফোন রিসিভ করলেও ওদিক থেকে কথা বলল না লোকটা। নিচু গলায় তাকে জানাল রানা, ‘তোমাদেরকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি, মন দিয়ে শুনবে। বাঁচতে হলে এখনই পালিয়ে যাও। নইলে একে একে মরবে আমাদের হাতে।’
‘মর্, কুত্তার বাচ্চা!’ জবাবে বলল লোকটা।
ফোন রাখার আগে জানাল রানা, ‘তা হলে আর সুযোগ পাচ্ছ না।’ বেনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে জেসিকার কথা ভাবল ও। বেচারি নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে গোলাগুলির আওয়াজ। বুঝে গেছে, ওর জন্যে আবারও দুর্গে ঢুকেছে রানা। অথবা জেসিকা হয়তো এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে এখান থেকে। খারাপ কিছুও হয়ে থাকতে পারে, হয়তো ধরা পড়ে গেছে ডিযঅনারেবলদের হাতে।
জেসিকার চিন্তা জোর করে মন থেকে দূর করল রানা। যুদ্ধের সময় সতর্ক থাকতে হবে ওকে।
দুর্গে গোলকধাঁধার মত অজস্র করিডোর। এদিকে-ওদিকে দরজা। একের পর এক খিলান। সামনে ওপরে গেছে চওড়া সিঁড়ি। ওপরের গ্যালারির জানালা দিয়ে ঢুকছে মৃদু আলো। রানার ইশারায় ওর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল বেন। জানালা দিয়ে উঠান দেখল ওরা। থমথম করছে চারপাশ। কাত হয়ে ঝরছে তুষার। জানালা থেকে সরে যেতে গিয়েও থমকে গেল রানা।
বাইরে তুষারভরা জমিতে কারা যেন!
এইমাত্র দুর্গের সামনের দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেছে উঠানে। তাদের হাতে রাইফেল না থাকলে স্টুয়ার্টের সাধারণ কর্মচারী বলে ধরে নিত রানা। এখন পরিষ্কার বুঝে গেল, খুন হওয়ার ভয়ে ভেগে যাচ্ছে পাঁচ ডিযঅনারেবল। তাড়াহুড়ো করে মাঝের মিটসুবিশি জিপে উঠল তারা। দরজা খুলে যাওয়ায় বাতি জ্বলে উঠেছে গাড়ির ভেতর। সেই আলোয় রানা জেনে গেল, ওই পাঁচজনের ভেতর বাক ওয়াকি নেই।
পানিভরা গামলা থেকে মাছ তুলে নেয়ার মত সহজ কাজ করল রানা। পকেট থেকে রিমোট নিয়ে আঙুল রাখল বাটনে। গাড়ির দরজা বন্ধ করেছে লোকগুলো। চালু হলো জিপের ইঞ্জিন। জ্বলে উঠল হেডলাইট। উঠানের দূরে গিয়ে পড়ল জোরালো আলো। সরসর করে উইণ্ডশিল্ডে জমা তুষার সরাচ্ছে ওয়াইপার। এগস্ট থেকে বেরোল শীতল ধোঁয়া।
এবার রওনা হবে গাড়িটা। জানালা থেকে সরে একে একে দ্বিতীয় আর তৃতীয় চ্যানেলের বাটন টিপল রানা। দুটো মিটসুবিশির নিচে এক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে বিস্ফোরিত হলো দুই আরডিএক্স বোমা। একটাই যথেষ্ট ছিল। হালকা খেলনার মত আকাশে উঠল মাঝের গাড়িটা। একই হাল হলো সামনের আর পেছনের গাড়িদুটোর। উঠানে যেন ঝিকিয়ে উঠেছে মধ্যদুপুরের রোদ। কিছু বোঝার আগেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছে পাঁচ ডিযঅনারেবল।
দলে তারা এখন তেরোজন নয়। মাত্র দু’জন। আর আছে রন স্টুয়ার্ট। রানার ধারণা, ওই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে বাক ওয়াকি। জ্বলন্ত গাড়ির দিক থেকে ফিরে বেনকে ‘চলুন,’ বলতে গিয়েও থমকে গেল রানা। প্রায় দুই ভাঁজ হয়ে বুক চেপে ধরেছে বেন। মানুষটা যে-কোনও সময়ে অসুস্থ হবে ভাবছিল রানা। এখন তাই হয়েছে। এত উত্তেজনার ধকল সহ্য করতে পারেনি বেনের দুর্বল হৃৎপিণ্ড।
হাত থেকে রাইফেল ফেলে দু’হাতে তার কাঁধ চেপে ধরল রানা। ‘বেন! বেশি খারাপ লাগছে? আপনাকে কি শুইয়ে দেব?’
ওর ওস্তাদের হাত ফস্কে পড়ল রাইফেল। দেয়ালে পিঠ ঘষে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসল সে। ব্যথা সহ্য করতে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজে ফেলেছে। মুহূর্তে যেন বেড়ে গেছে বয়স বিশ বছর। ভীষণ দুর্বল। রানার মনে হলো, যে- কোনও সময়ে মারা যাবে ওর ওস্তাদ, অথচ কিছুই করতে পারবে না ও!
পেরোল দীর্ঘ ক’টা মুহূর্ত, তারপর চাপা স্বরে বিড়বিড় করল বেন, ‘আমি… ঠিক আছি!’ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ‘ঠিক হয়ে যাবে! আসলে বিশ্রাম নিইনি যে! তুমি রওনা হও, রানা!’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘না, আপনার পাশেই থাকছি।’
চুপ করে আছে বেন। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ রাখল শিষ্যের চোখে। এত কড়া দৃষ্টি যে চমকে গেল রানা। ‘রওনা হও, বাছা! মেয়েটা খুব ভাল, ওকে বাঁচাতে হবে! তুমি রওনা হও, নইলে আমি নিজেই তোমাকে গুলি করব!’
রানার হয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে বেন হ্যানন।
দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। মেঝে থেকে সংগ্রহ করে নিল রাইফেল। ওস্তাদের পাশে বোমাভরা চটের থলে রেখে করিডোর ধরে এগোল।
.
দ্বিগুণ বা তিনগুণ মরফিন আর ক্রিস্টাল মেথ শরীরে নেয়ার পরেও এতক্ষণে কেটে যাচ্ছে বাক ওয়াকির ঘোর। ভাঙা কাঁধে শুরু হয়েছে দপদপে ব্যথা। দুর্গের অন্ধকার করিডোর ধরে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে বারবার। আনমনে ভাবছে, প্রথম বিস্ফোরণের আওয়াজটা শোনার আগপর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ওরা ঠিক করেছিল, দলের ডিযঅনারেবলরা খুঁজে বের করবে মাসুদ রানাকে। ওদিকে বকে খুঁজে নেবে বাক ওয়াকি। কিন্তু সব ভণ্ডুল হয়ে গেছে। এরপর দুর্গের ভেতর শুরু হলো গুলির আওয়াজ। বাক ওয়াকি বুঝে গেল, এক এক করে তার দলের সদস্যদেরকে খুন করছে মাসুদ রানা। কয়েকটা দল তৈরি করে আলাদা হয়ে গেল ওরা। তখন থেকে বারবার স্টুয়ার্টের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে চেয়েছে সে। তবে তাতে লাভ হয়নি। কোথায় যেন ঘাপটি মেরে আছে হারামির বাচ্চা!
রক্তাক্ত প্যান্টের কোমরে পিস্তল গুঁজে করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে ওয়াকি। হঠাৎ করেই তার হাতে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। কল স্টুয়ার্টের নয়! ভীত কণ্ঠে জানাল ম্যাড, ‘একটা কথা, ওয়াকি! আমরা চলে যাচ্ছি! আলী, এরিক, লুই, ডগলাস আর আমি! তোমারও আমাদের সঙ্গে যাওয়া উচিত বলে মনে করি!’
‘ওই লোক কিন্তু একা,’ তীব্র ব্যথা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল বাক ওয়াকি। ‘তোমরা কি মাত্র একজনের ভয়ে পাঁচজন মিলে পালিয়ে যাবে?’
‘ফালতু কথা বাদ দাও, ওয়াকি,’ বলল ম্যাড। ‘ওই শালা একা নয়। সঙ্গে আছে অন্তত দশজন সৈনিক। ঘাসের মত কাটা পড়ছি আমরা!’
‘মৌরেন কই? ও কি তোমাদের সঙ্গে আছে?’
‘জানি না কোথায়। মাথা ঠিক থাকলে পালাও এই নরক থেকে। আমাদের সঙ্গে যাবে, নাকি মরবে?’
‘আমি যাচ্ছি না,’ কর্কশ স্বরে বলল বাক ওয়াকি। ‘আগে বকে খুঁজে বের করব।’
‘যা খুশি করো! আমরা চলে যাচ্ছি!’
কল কেটে যেতেই স্টুয়ার্টকে ফোন দিল বাক ওয়াকি। কিন্তু ফোন বন্ধ। তার মনে হলো, কমোডে ভেসে যাচ্ছে দুই মিলিয়ন পাউণ্ড। ঠিক করল, প্রথম সুযোগে পিস্তলের মুখে স্টুয়ার্টকে রেখে তার কাছ থেকে নগদ সব টাকা আদায় করে নেবে। তারপর পালিয়ে যাবে দুর্গ ছেড়ে। এখন মাসুদ রানা ওই হারামি ব্যবসায়ীকে নাগালে পাওয়ার আগেই তাকে হাতের মুঠোয় পেতে হবে। এটাই চ্যালেঞ্জ।
শুধু টাকার জন্যেই রয়ে গেছে বাক ওয়াকি। কাঁধের স্পঞ্জ ভিজে সপ-সপ করছে। নতুন করে আবার পড়ছে রক্ত। ক্রমে আরও দুর্বল হচ্ছে সে। টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। স্টাডিরুমে নেই স্টুয়ার্ট। জানালায় গিয়ে নিচে ম্যাড আর দলের কয়েকজনকে দেখল। প্রাণভয়ে চলে যাচ্ছে কাপুরুষগুলো! মরুক হারামজাদারা!
বাক ওয়াকি বুঝে নিল, সত্যিই একা হয়ে গেছে সে। তবে মরে গেলেও হার মানবে না।
জানালা থেকে সরে গিয়ে দরজার দিকে রওনা হতেই শুনল প্রচণ্ড বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। বাইরে একই সঙ্গে ঝলসে উঠেছে রক্তিম আগুন আর ধবধবে সাদা আলো। চুরমার হয়েছে তিনটে গাড়ি, আর ওগুলোর সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে পাঁচ ডিযঅনারেবল। জানালায় চোখ রেখে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে হাঁ হয়ে গেল ওয়াকি। কয়েক মুহূর্ত পর টলতে টলতে বেরিয়ে এল স্টাডিরুম থেকে। আবারও সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল নিচতলায়।
সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে হঠাৎ উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে গেল সে। কে যেন নিচু গলায় ডাকল তাকে। থমকে গিয়ে চরকির মত ঘুরে ওপরে তাকাল বাক ওয়াকি।