সোনার ঘণ্টা – ৬

ফ্রান্সিস এবার ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল–ভাইসব, আমি জানি তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো। আমি জীবন দিয়েও তোমাদের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখব।

সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল। ফ্রান্সিস বললো–অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে আজকে আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। জীবনের কোন সুলতান ফ্রান্সিসের মখের দিকে তাকিয়ে দুঃখ-কষ্টই বৃথা যায় না। আমরা সফল হবোই। বললেন, তুমি বোধহয় সবই শুনেছ। সোনার ঘন্টার সেই দ্বীপ আমাদের নাগালের মধ্যে। শুধু একটা বাধা ডুবো পাহাড়। সেই বাধা অতিক্রমের উপায় আমরা জানতে পেরেছি। এখন সবকিছু নির্ভর করছে আমাদের শক্তি সাহস আর বুদ্ধির ওপরে। তোমরা আমাকে সাহায্য করো।

সবাই চীৎকার করে ফ্রান্সিসকে উৎসাহিত করলো।

ফ্রান্সিস বলতে লাগল এবার আমাদের কি কাজ তাই বলছি। কয়েকজন চলে যাও জাহাজের পেছনে। সুলতানের জাহাজটা আমাদের জাহাজের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধতে হবে। আর একদল চলে যাবে দাঁড় টানতে। বাকি সবাই থাকবে ডেকের ওপর।

ফ্রান্সিস একটু থেমে আবার বলতে লাগল–ঝড় শুরু হলেই আমি আর হ্যারি যে নৌকোটা আমরা তৈরি করেছি, সেটাতে চড়ে এগিয়ে যাবো। আমাদের সঙ্গে থাকবে একটা লম্বা কাছি। দুটো ডুবো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটু এগোতে পারলেই শান্ত সমুদ্র পাব। তার ডানপাশেই ন্যাড়া পাহাড়ের দ্বীপ। সেখানে পাহাড়ের মাথায় আমরা কাছির একটা প্রান্ত বাঁধবো। কাছিটার আর একটা প্রান্ত থাকবে ডেকে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে, তাদের হাতে। আমি কাছিটার তিনবার ঝাঁকুনি দিলেই তারা কাছি টানতে শুরু করবে। দাঁড়িরা দাঁড় বাইতে শুরু করবে। দাঁড়িরা দাঁড় বাইতে শুরু করবে। দুটো জাহাজই বিনা বাধায় ডুবো পাহাড় পেরিয়ে যেতে পারবে। আমরা সফল হবোই।

সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠল–ও-হো-হো। ফ্রান্সিসের নির্দেশমত কাজে লেগে পড়ল সব। জাহাজ আবার এগিয়ে চলল সোনার ঘন্টার দ্বীপের দিকে। একটু পরেই কুয়াশার ঘন আস্তরণ ঘিরে ধরলো জাহাজটাকে। তারপরেই শুরু হলো ঝড়ের তাণ্ডব। ফ্রান্সিস আর হ্যারি নৌকোটা জলে ভাসালো। সেই মস্ত লম্বা কাছির একটা প্রান্ত ধরে রইলো জহাজের ডেকে দাঁড়ানো ভাইকিংরা। ফ্রান্সিস নৌকোর দাঁড় বাইতে লাগল। হালে বসল হ্যারি। ওরা কাছি ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে চলল। কিন্তু সেই উঁচু-উঁচু ঢেউ পেরিয়ে এগোনো সোজা কথা নয়। তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, ঢেউয়ের ঝাঁপটা। ফ্রান্সিস প্রাণপণে দাঁড় বাইতে লাগল। সেই প্রচণ্ড দুলুনি উপেক্ষা করে হ্যারি হাল ধরে চুপ করে বসে রইলো।

এমন সময় সোনার ঘন্টার গভীর শব্দ শোনা গেল–ঢং-ঢং-ঢং।

জাহাজ থেকে ভাইকিংরা মহা উল্লাসে চীৎকার করে উঠল। ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে ওদের সেই চীৎকারের শব্দ ফ্রান্সিস আর হ্যারি শুনতে পেল। আজকে চূড়ান্ত লড়াই। দুজনে নতুন উদ্যমে নৌকো চালাতে লাগল। প্রচণ্ড ঢেউয়ের ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস পাকা নাবিকের মত নৌকো চালাতে লাগল। এক-একবার মনে হচ্ছে নৌকোটা বোধহয় ঢেউয়ের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ঢেউয়ের মাথায় উঠে আসছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ফ্রান্সিস আবছা দেখলো বাঁদিকের ডুবো পাহাড়ের ভেসে ওঠা মাথাটা। সমুদ্রের জলের ঢেউ সরে যেতেই মাথাটা ভেসে উঠছে, পরক্ষণেই ডুবে যাচ্ছে। ঝড়ের ধাক্কাটা আসছে ডানদিক থেকে। কাজেই যে করেই হোক ডানদিক ঘেঁষেই ওদের বেরিয়ে যেতে হবে। নইলে ঝড়ের ধাক্কায় নৌকো বাঁদিকের ডুবো পাহাড়ে গিয়ে আছড়ে পড়বে। নকশটাতে ডানদিক ঘেঁষে যাওয়ার নির্দেশ আছে। ফ্রান্সিস চীৎকার করে হ্যারিকে বললো–ডানদিক ঘেঁষে।

হ্যারি শক্ত করে হাল ধরে রইলো। আস্তে-আস্তে নৌকো এগোতে লাগলো। সমস্ত শরীর জলে ভিজে গেছে। যেন স্নান করে উঠেছে দুজনে। সমুদ্রের নোনা জলে চোখ জ্বালা করছে। তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে যেন আর দম নেই। হাত অবশ হয়ে আসছে। শুধুতো দাঁড়টানাই না, কাছিটাও শক্ত করে ধরতে হচ্ছে মাঝে মাঝে। সমস্ত কাছিটাই যাতে সমুদ্রের জলে পড়ে না যায়, তার জন্যে ফ্রান্সিস কাছির প্রান্তটি নৌকার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল।

হঠাৎ ডানদিকের ডুবো পাহাড়ের মাথাটা একবার ভেসে উঠেই ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পর-পর কয়েকটা ঢেউয়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় নৌকোটা সামনের দিকে এগিয়ে এলো। আশ্চর্য আর বৃষ্টি নেই। হাওয়ার তেজও কমে গেছে। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে তাকালো। নৌকো ডুবো পাহাড় ছাড়িয়ে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। তারও পেছনে জাহাজ দুটো। ঝাপসা কাঁচের মধ্যে দিয়ে যেন দেখছে ফ্রান্সিস, ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজ দুটো একবার উঠছে, একবার পড়ছে। আর ঝড় নেই। আকাশে জ্বলন্ত সূর্য। পরিষ্কার নির্মেঘ আকাশ। সমুদ্রের ঢেউ শান্ত। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে দুদিকের পাথুরে দ্বীপ। আরো দূরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা পাহাড়ের দ্বীপ। পাহাড়ের মাথায় একটা সাদা রঙের মন্দির মত। ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসল। হ্যারিও হাসল। কিন্তু আনন্দের সময় এখন নয়। আসল কাজই এখন বাকি।

ডানদিকের ন্যাড়া পাহাড়ের দ্বীপটায় ওরা নৌকো লাগাল। নৌকায় বাঁধা কাছির মুখটা খুলে কাঁধে নিলো ফ্রান্সিস। তারপর পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগল। ছোট্ট পাহাড়। শ্যাওলা ধরা পেছল পাথরে সন্তর্পণে পা ফেলে-ফেলে ওরা এক সময় পাহাড়টার মাথায় উঠে এল। তারপর কাছিটাকে শক্ত প্যাঁচ দিয়ে পাহাড়ের মাথায় বাঁধলো। টেনে দেখলো যথেষ্ট শক্ত হয়েছে। দুজনে মিলে কাছিটাকে যথাসাধ্য টান-টান করে ধরল। তারপর তিনবার জোরে ঝাঁকুনি দিলো। জাহাজের ডেকে যারা কাছিটার আর একটা প্রান্ত ধরে ছিল, তারা সংকেতটা বুঝতে পারল। তারা এবার সবাই মিলে কাছিটা টানতে লাগল। দাঁড়িদেরও খবর দেওয়া হলো। তারাও প্রাণপণে দাঁড় টানতে লাগল। জাহাজ দুটো সেই জল ঝড়ের মধ্যে দিয়ে দোল খেতে-খেতে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। একসময় ডুবো পাহাড় দুটোও পেরিয়ে গেল। হঠাৎ আর বৃষ্টি নেই, ঝড় নেই। শান্ত সমুদ্র। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু ঝলমলে রোদ। সবাই আনন্দে চীৎকার করে উঠল। একদল ডেকের ওপর নাচতে শুরু করলো। কেউ-কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরলো। সুলতানের জাহাজেও আনন্দের বান ডাকলো। সৈন্যরা কেউ-কেউ চীৎকার করতে করতে শূন্যে তরোয়াল ঘেরাতে লাগল। সুলতান ডেকে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে-নেড়ে সবাইকে উৎসাহিত করতে লাগলেন।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি কাছি বেয়ে-বেয়ে জাহাজে উঠে এল। সবাই উঠে এলো ওদের জড়িয়ে ধরবার জন্যে। ওদের দুজনকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে গেল। সেই শান্ত সমুদ্রের বুক ভরে উঠল বহু কণ্ঠের চীৎকার, হই-চই আনন্দধ্বনিতে। জাহাজ দুটো এবার চললো সামনের সেই ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের দ্বীপটার দিকে। চুড়োয় সাদা গোল মন্দিরটায় সূর্যের আলো পড়ছে। ওখানেই আছে সোনার ঘন্টা।

দূরত্ব বেশী নয়। একটু পরেই জাহাজ দুটো সবুজ ঘাসে ঢাকা দ্বীপটায় এসে ভিড়ল। দ্বীপে প্রথমে নামলেন সুলতান। তার সঙ্গে রহমান, তারপর আরো কয়েকজন সৈন্য। সুলতান ফ্রান্সিসকে ডেকে পাঠালেন। ফ্রান্সিস ও হ্যারি আর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে এলো। তারপর সবাই সেই ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের গা বেয়ে-বেয়ে উঠতে লাগল। খাড়া পাহাড় নয়, কাজেই পাথরের খাঁজে-খাঁজে পা রেখে ঝোঁপঝাড় ধরে উঠতে খুব একটা কষ্ট হলো না। মন্দিরের কাছে পৌঁছে সবাই থামলো। তাকিয়ে-তাকিয়ে গোল মন্দিরটা দেখলো। সাদাটে রঙের আস্তরণ মন্দিরটায়। এখানে-ওখানে সবুজশ্যাওলার ছোপ। জাহাজ থেকে যতটা ছোট মনে হচ্ছিল, ততো ছোট নয়। মন্দিরটায় একটা মাত্র ছোট দরজা। দরজাটা খোলা। কোন পাল্লা নেই। সুলতান একাই মন্দিরটার দিকে এগোলেন। আর সবাই অপেক্ষা করতে লাগল। জাহাজের সবাই ডেকে এসে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে দেখছে এখানে কি ঘটছে। সবার মনেই বোধহয় এক প্রশ্ন–সোনার ঘন্টা কি এখানেই আছে?

সুলতান মন্দিরে মধ্যে ঢুকলেন। সবাই উৎকণ্ঠিত। সবাই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপ হয়ে আছে। শুধু সমুদ্রে ঢেউয়ের ওঠা-পড়ার শব্দ। শুধু বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ। আর কোন শব্দ নেই। এতগুলো মানুষ। কারো মুখে কোন কথা নেই।

একটু পরে সুলতান ধীরে পায়ে মন্দিরটা থেকে বেরিয়ে এলেন। ফ্রান্সিসরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এসে একবার ফ্রান্সিসের দিকে আর একবার রহমানের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফ্রান্সিসের বুক দমে গেল। তবে কি সোনার ঘন্টা এখানে নেই? এত দুঃখ-কষ্ট, এত পরিশ্রম সব অর্থহীন? সব ব্যর্থ?

ফ্রান্সিস আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে মন্দিরটার মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। কোথায় সোনার ঘন্টা? মন্দিরটার মাথা থেকে পেতলের শেকলে ঝুলছে একটা পেতলের ছোট্ট ঘন্টা। চারদিকেই দেয়াল। আর কিছু নেই মন্দিরটাতে। রাগে-দুঃখে ফ্রান্সিসের চোখ ফেটে জল এলো। এই তুচ্ছ একটা পেতলের ঘন্টার জন্যে এত দুঃখ-কষ্ট? সেই ছেলেবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছে, সেই স্বপ্ন, এইভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে? সোনার ঘন্টার গল্প তাহলে একটা ছেলেভুলোনা কাহিনী মাত্র? ফ্রান্সিসের মাথায় যেন খুন চেপে গেল। সে দুহাতে পেতলের ঘন্টাটা জোরে ছুঁড়ে দিলো দেওয়ালের গায়ে।

ঢং-ঢং-ঢং–প্রচণ্ড শব্দে ফ্রান্সিস ভীষণ চমকে উঠল। দুহাতে কান চেপে বসে পড়ল। একি? তবে–তবে কি–সমস্ত গোলাকার মন্দিরটাই একটা সোনার ঘন্টা?

ঢং-ঢং ঘন্টার শব্দ বেজে চললো। বাইরে সুলতান, রহমান, হ্যারি, সঙ্গের সৈন্যরা, নীচে জাহাজের উৎসুক ভাইকিংরা সবাই প্রচণ্ড বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল গোল মন্দিরটার দিকে। এত বড় সোনার ঘন্টা! ঢং-ঢং, গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে পড়তে লাগল মাথার ওপরে নীল আকাশের নিচে শান্ত সমুদ্রের বুকের ওপর দিয়ে দূর-দূরান্তরে।

সুলতানের মুখে হাসি ফুটলো। ফ্রান্সিস মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে হ্যারি তাকে। জড়িয়ে ধরলো। আনন্দে অতগুলো মানুষের চীৎকার হৈ-হুঁল্লায় নির্জন দ্বীপমুখর হয়ে উঠল। কিন্তু এই আনন্দ আর উল্লাসের মুহূর্তে কেউই লক্ষ্য করেনি, যে সেই ডুবো পাহাড়ের দিক থেকে একটা জাহাজ তীরবেগে সোনার ঘন্টার দ্বীপের দিকে ছুটে আসছে।

সেই জাহাজটাকে প্রথম দেখলো রহমান। সে সুলতানের কাছে ছুটে এলো। সুলতান তখন সোনার ঘন্টার বাইরের পলেস্তারটা কতটা শক্ত, তাই পরীক্ষা করছিলেন। রহমান সুলতানকে জাহাজটা দেখালো। তখন জাহাজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এতক্ষণে সবাই দেখতে পেল সেই দ্রুত ছুটে আসা জাহাজটাকে। একটা কালো পতাকা উড়ছে জাহাজটার মাস্তুলে। তাতে সাদা রঙের মড়ার মাথার খুলি আর ঢ্যাঁড়ার মত দুটো হাড়ের চিহ্ন আঁকা। জলদস্যুদের জাহাজ। নীচের জাহাজ দুটোয় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। সবাই যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে লাগলো। সুলতান, রহমান, ফ্রান্সিস সবাই দ্রুত পায়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসতে লাগল।

জলদস্যুদের জাহাজটা প্রথমে সুলতানের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। খালি গা, মাথায় কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা খোলা তরোয়াল হাতে জলদস্যুরা জাহাজে লাফিয়ে উঠে এল। এবার ফ্রান্সিসদের জাহাজের গায়ে লাগল। সেখানেও শুরু হল তরোয়ালের যুদ্ধ। চীৎকার, হই-চই, তরোয়ালের ঠোকাঠুকির শব্দ, আহত আর মুমূর্ষদের আর্তনাদে ভরে উঠল সমস্ত এলাকাটা। লড়াই চলতে লাগল। সুলতান রহমান, ফ্রান্সিস তারাও ততক্ষণে নেমে এসেছে। তারাও ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে জলদস্যুদের উপর।

যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ ফ্রান্সিস মকবুলকে দেখতে পেল। তার পরনে জলদস্যুদের পোশাক নয়, আরবীয়দের পোশাক। এতক্ষণে ফ্রান্সিসের কাছে সব স্পষ্ট হলো। তাহলে মকবুলই এই জলদস্যুদের সোনার লোভ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। যুদ্ধের ফাঁকে এক সময় ফ্রান্সিস চীৎকার করে মকবুলকে ডাকলো মকবুল, আমাকে চিনতে পারছো?

মকবুল ওর দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল–আমি বেঁচে থাকতে সোনার ঘন্টা কেউ নিয়ে যেতে পারবে না।

ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলল না। নিপুণ হাতে তরোয়াল চালিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল।

–ফ্রান্সিস! ডাক শুনে ফ্রান্সিস পেছনে তাকিয়ে দেখল ফজল।

–মকবুল এদের সঙ্গে এসেছে তাইনা? ফজল জিজ্ঞেস করল।

–ঠিক ধরেছ।

–কিন্তু ওরা এল কি করে?

–আমাদের জাহাজ অনুসরণ করে ওরা এসেছে। আমরা যেভাবে ডুবো পাহাড় পেরিয়েছি, ওরা ঠিক সেইভাবেই পেরিয়েছে।

–মকবুলকে দেখেছো?

–ঐ যে মাস্তুলটার ওপাশে লড়াই করছে।

ফজল আর দাঁড়ালো না। সেইদিকে ছুটলো। মকবুল কিছু বোঝবার আগেই ফজল মকবুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুজনের লড়াই শুরু হয়ে গেল। মকবুলের তুলনায় ফজলের হাত অনেক নিপুণ। ফজল বেশ সহজ ভঙ্গিতেই তরোয়াল চালাচ্ছিলো।

অল্পক্ষণের মধ্যেই মকবুল বেশ হাঁপিয়ে পড়লো। ফজলও হাঁপাচ্ছিল। একবার দম নিয়ে ফজল বললো–মরুদস্যুদের দলে ঢুকেছিলাম, শুধুই তরোয়াল চালানো শেখবার জন্যে। তারপর কপালের কাটা দাগটা দেখিয়ে বলল–এটার বদলা নিতে হবে তো।

মকবুল কোন কথা না বলে তরোয়াল উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আবার লড়াই শুরু হল। প্রথম আক্রমণের মুখে ভাইকিং আর সুলতানের সৈন্যরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশি সময় লাগল না। সুলতানের বাছাই করা সৈন্য আর দুধর্ষ ভাইকিংদের হাতে জলদস্যুরা কচুকাটা হতে লাগল। ওরা পিছু হটতে লাগল। দুজন একজন করে নিজেদের জাহাজে পালাতে লাগল। এদিকে মকবুল ফজলের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ দড়িতে পা আটকে ডেকের ওপর চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফজল ওর বুকে তরোয়ালটা চেপে ধরল। দুজনেই ভীষণভাবে হাঁপাচ্ছে তখন। দেখতে পেয়ে ফ্রান্সিস ছুটে এলো। ফজলের হাত চেপে ধরে বলল ফজল, ওকে মেরে ফেলোনা।

ফজল দাঁত চিবিয়ে বললো–আমি যদি না মারি, ও আমায় মারবে।

–তবু আমার অনুরোধ, ওকে ছেড়ে দাও।

ফজল এক মুহূর্ত ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বেশ। তোমার কথাই রাখলাম।

ফজল তরোয়াল সরিয়ে নিলো। মৃত্যু ভয়ে মকবুলের মুখটা কাগজের মত সাদা হয়ে । গিয়েছিল। ও হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে যে ও বেঁচে গেল, এটা ওর বুঝতে সময় লাগল। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে।

তারপর আস্তে-আস্তে উঠে বসল। ফ্রান্সিস ডাকলো–মকবুল!

মকবুল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো।

–এই জলদস্যুরা কি তোমার বন্ধু? তুমি কি এদের সঙ্গে ফিরে যেতে চাও?

–না।

–এখনও ভেবে দেখো, ওরা কিন্তু জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে।

সত্যিই জলদস্যুরা তখন নিজেদের জাহাজে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। বাকি কয়েকজন গিয়ে উঠলেই জাহাজ ছেড়ে দেবে। মকবুল ভয়ার্ত চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। বললো–না-না, আমাকে ঐ জাহাজে আর পাঠিয়ো না।

–কেন? ফ্রান্সিস ব্যঙ্গ করে বললো–তোমার বন্ধু ওরা। তোমার জন্যে সোনার ঘন্টা উদ্ধার করে দিতে এসেছিলো। এক সঙ্গেই যেমন এসেছে, ফিরেও যাও একসঙ্গে।

–না-না, ওরা আমাকে পেলে হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

–হুঁ। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বললো–এবার আমার মোহরটা ফেরত দাও।

মকবুল কোমরবন্ধনী থেকে একটা থলে বের করলো। থলে থেকে ফ্রান্সিসের সেই চুরি যাওয়া মুদ্রাগুলো আর মোহরটা বের করে ফ্রান্সিসের হাতে দিলো। মোহরটা হাতে পেয়েই ফ্রান্সিস আর ফজল মোহরটার ওপর ঝুঁকে পড়লো। মনোযোগ দিয়ে উল্টে পিঠের দ্বীপ থেকে ফিরে আসার নকশাটা দেখতে লাগল।

মকবুল ত্রুর হাসি হেসে বললো–অন্য মোহরটা যদি পেতাম, তাহলে এই সোনার ঘন্টা তোমরা নিয়ে যেতে পারতে না।

–জানি। ফ্রান্সিস মোহরটা থেকে চোখ না সরিয়েই বললো।

জলদস্যুদের দল দ্রুত জাহাজ চালিয়ে সরে পড়লো। ওদের জাহাজ সমুদ্রের দিগন্তে মিলিয়ে যেতেই সুলতান সোনার ঘন্টা নামিয়ে আনার হুকুম দিলেন। সৈন্যরা সব দড়ি জোগাড় করে তৈরি হতে লাগলো।

নীচে জাহাজে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন সুলতানের হুকুমে মিস্ত্রীরা সোনার ঘন্টার গা থেকে পলেস্তারা খসাচ্ছিলো। এতক্ষণে পলেস্তারা খসানো শেষ হলো। সবাই কাজ ফেলে ডেকে এসে ভীড় করে দাঁড়ালো। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বিস্ময়ে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল।

অন্ধকার নামলো সোনার ঘন্টার দ্বীপে, বালিয়াড়িতে, সুদূর প্রসারিত সমুদ্রের বুকে। দ্বীপের সমুদ্রতীর বিরাট একটা কাঠের পাটাতন তৈরি করা হতে লাগল। ঐ পাটাতনে রাখা হবে সোনার ঘন্টা তারপর জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে।

রাত গভীর তখন। আকাশে আধভাঙা চাঁদ। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। ডেকের ওপরে পায়চারী করছে। কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে মশালের আলোগুলো কাঁপছে। ঠকঠক পেরেক পোঁতার শব্দ উঠছে। মিস্ত্রীদের কথাবার্তাও কানে আসছে। কিন্তু ফ্রান্সিসের সেদিকে কান নেই। নিজের চিন্তায় সে ডুবে আছে। এত দুঃখকষ্টর পর সোনার ঘন্টা যদিও বা পাওয়া গেল, কিন্তু সেটাকে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া হলো না! ফ্রান্সিস পাহাড়ী দ্বীপের চূড়োর দিকে তাকালো! জ্যোৎস্না পড়েছে সোনার ঘন্টার মসৃণ গায়ে। একটা মৃদু আলো চারিদিকবিচ্ছুরিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওটা যেন মাটিতে নেই। শূন্যে ভাসছে। স্বপ্নময় রহস্যেভরা এর অপার্থিব সৌন্দর্যের আভাস। ফ্রান্সিসের মন বিদ্রোহ করলো। অসম্ভব! এমন সুন্দর একটা জিনিস, যেটাকে ঘিরে তার আবাল্যের স্বপ্ন গড়ে উঠেছে, সেটা এভাবে শুধু অর্থ আর লোকবলের জোরে সুলতান নিয়ে যাবে? আর ওরা তাকিয়ে দেখবে? না, এ কখনই হতে পারে না। আপন মনেই ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকাল–না না। যে করেই হোক, সোনার ঘন্টা তারা নিজের দেশে নিয়ে যাবে। এতে যদি তাদের জীবন বিপন্ন হয় হোক্।

পরদিন সকালেই ঘন্টার মাপ অনুযায়ী একটা মস্ত বড় কাঠের পাটাতন তৈরী হলো। এবার সোনার ঘন্টা নামিয়ে আনবার পালা। পাহাড়ের ঢালু গায়ে যে কটা খাটো গাছ ছিল, তাতেই দড়িদড়া বেঁধে কপিকলের মত করা হলো। তারপর সোনার ঘন্টা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে নামানো হতে লাগল। কিন্তু দড়ি দড়ার কপিকল সোনার ঘন্টার অত ভার সহ্য করতে পারল না। দুতিন জায়গায় দড়ি ছিঁড়ে গেল। একটা গাছ তো গোড়সুদ্ধ উপড়ে গেল। পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে সোনার ঘন্টা ঢং-ঢং শব্দ তুলে গড়িয়ে পড়লো ধারে। কয়েকজন ছেঁড়া দড়িদড়াসুদ্ধ ছিটকে মারা পড়লো। কিন্তু সুলতানের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। হুকুম দিলেন, যে করেই হোক সোনার ঘন্টাকে কাঠের পাটাতনের ওপর তুলো। তারপর সেটাকে সুলতানের জাহাজের পেছনে বেঁধে যাত্রা শুরু হলো আমদাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে।

মোহরের গায়ে যে নকশা আঁকা ছিল সেটা দেখে হিসাব করে ফ্রান্সিসই ফেরার পথের নিশানা বের করলো। জাহাজ দুটো চললো সেই পথ ধরে একটা অদ্ভুত পাহাড়ের নির্দেশ দেওয়া ছিল নকশাটায়। সেইউঁচু পাহাড়টারবনীচে একটা সুড়ঙ্গ পথ। ফ্রান্সিস হ্যারিকে যখন নকশাটা বোঝাল, হ্যারি বলল–তাহলে এই সুড়ঙ্গ পথটা দিয়েই তো । ফ্রান্সিস হাসল। বলল–প্রথমতঃ, এই সুড়ঙ্গ পথের খবর আমরা জানতাম না।

–আর দ্বিতীয় কারণ?

–আমার মনে হয়, ঐ পথ দিয়ে একটা জাহাজ এদিক থেকে ওদিকে যেতে পারে, কিন্তু ওদিক থেকে এদিকে আসতে পারে না।

–এ আবার হয় নাকি। হ্যারি অবাক হলো।

–প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল। ফ্রান্সিস হাসলো।

সন্ধ্যের সময় সেই উঁচু পাহাড়টায় দেখা পাওয়া গেল। কাছে যেতে সুড়ঙ্গ পথটাও দেখা গেল। একটা জাহাজ যেতে পারে, এমনি বড় পথ সেটা। ফ্রান্সিসের অনুমানই ঠিক।

সামনে রাত্রির অন্ধকার। অন্ধকারের মধ্যে সুড়ঙ্গ পথে ঢোকা বিপজ্জনক। স্থির হলো সকালের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

পরদিন সকালে প্রথমে ফ্রান্সিসদের জাহাজটা ধীরে ধীরে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলো। একটু এগোতেই বাইরের আলো ম্লান হয়ে গেল। কেমন ছায়া-ছায়া হয়ে এল ভেতরটা। তবু মাথার ওপর ঝুঁকে পড়া ছাদ, দুপাশের পাথুরে দেওয়াল দেখা যাচ্ছিলো। সুড়ঙ্গটা একষ্টা জায়গায় বাঁক নিয়েছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে দেওয়ালে ধাক্কা না লাগিয়ে জাহাজটাকে বাঁক ঘুরিয়ে বের করে নিয়ে আসা হলো। বাঁক ঘুরতে এক অপূর্ব দৃশ্য! এদিকে ওদিকে থামের মত গোল এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেয়াল জল থেকে উঠে ওপরের ছাদের সঙ্গে লেগে আছে যেন। সেগুলোর গায়ে নীলাভ দ্যুতিময় পাথরের টুকরো। ওপরের পাথুরে ছাদেও কত বিচিত্র বর্ণের পাথর। সেই ছাদের গা বেয়ে কোথাও বা শীর্ণ ঝরণার মত জল পড়ছে। যেটুকু আলো সুড়ঙ্গের থেকে বাইরে আসছিল, তাই দ্বিগুণিত হয়ে জায়গাটায় এক অপার্থিব আলোর জগৎ রচনা করেছে। বিচিত্র বর্ণের মৃদু আলোর বন্যা যেন। সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল।

ভাইকিংদের মধ্যে দু-একজন হাতুড়ি নিয়ে এলো। হাতের কাছে এত সুন্দর রঙিন পাথর। পাথুরে থামের গায়ে-গায়ে সেই নীলাভ পাথরের ঝিলিক। লোভ সামলানো দায়। ওরা নিশ্চয় থামগুলো ভেঙে পাথর নিয়ে আসতো। কিন্তু পারলো না ফ্রান্সিসের জন্যে।

ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলল–কেউ থামগুলোর গায়ে হাত দেবে না।

ফ্রান্সিসের গম্ভীর কণ্ঠস্বর সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

–কেন? হাতুড়ি হাতে একজন ভাইকিং বললো।

–এই থামগুলো পাহাড়টার ভারসাম্য রক্ষা করছে। যদি কোন কারণে ভেঙে যায়, সমস্ত পাহাড়টাই জাহাজের ওপর ভেঙে পড়বে।

সবাই বিপদের গুরুত্বটা বুঝলো। অগত্যা চেয়ে-চেয়ে দেখা ছাড়া উপায় কি? সবাই নিঃশব্দে সেই অপূর্ব স্বপ্নময় জগতের রূপ দেখতে লাগল। জাহাজ এগিয়ে চললো।

একসময় সুড়ঙ্গের ওপাশে আলো ফুটে উঠল। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের মুখ ছেড়ে জাহাজটা বাইরের রৌদ্রালোকিত সমুদ্রের বুকে আসতেই সবাই আনন্দে হই-চই করে উঠল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–কিছু লক্ষ্য করেছিলে?

–কি?

–সুড়ঙ্গটা ভেতরের দিকে একটা অদ্ভুত বাঁক নিয়েছে। এপাশের কোন জাহাজই সেই বাঁক পেরোতে পারবে না।

–হ্যাঁ, এটা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। পর-পর সুলতানের জাহাজ আর সোনার ঘন্টা বসানো কাঠের পাটাতনটাও সুড়ঙ্গ পেরিয়ে চলে এলো। আবার চললো জাহাজ শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে আমদাদ বন্দরের উদ্দেশ্যে।

সবাই নিশ্চিন্ত। যাক, অনেকদিন পরে আবার মাটির ওপর পা ফেলা যাবে। ভাইকিংদের কাছে আমদাদ বিদেশ। তবু তোক বিদেশ, মাটি তো! সুলতানের আদেশে মিস্ত্রীরা এর মধ্যেই বড়-বড় চাকা বানাতে শুরু করেছে। সোনার ঘন্টা বসানো পাটাতনটা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত। চাকা লাগাতে পারলে কোন অসুবিধে নেই। ঘোড়া দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে। চাকা বানানোর কাজ চলছে পুরো দমে। জাহাজের সবাই খুসিতে মশগুল।

কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। শুধু হ্যারিই ওর একমাত্র সমব্যথী। গভীর রাত্রে ডেকের ওপর দুজন দেখা হয়। সোনার ঘন্টার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলে জানো হ্যারি, ওটা আমাদের প্রাপ্য, সুলতানের নয়।

–কিন্তু উপায় কি বলো!

–উপায়–বিদ্রোহ।

–সে কি! হ্যারি চমকে উঠে।

ফ্রান্সিস ডেকে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে করতে বলে–কালকে রাত্তিরে কয়েকজন ভাইকিংকে নিয়ে এসো। সুলতানের সৈন্যদের একটু কায়দা করে হার স্বীকার করাতে হবে। তারপর সোনার ঘন্টা নিয়ে আমরা দেশের দিকে পাড়ি জমাবো।

–সুলতানের সৈন্যরা কিন্তু সংখ্যায় আমাদের প্রায় দ্বিগুণ।

–হ্যারি, আমি সব ভেবে রেখেছি।

পরের দিন গভীর রাত্রে ফ্রান্সিসের ঘরে সভা বসলো। কয়েকজন বিশ্বস্ত ভাইকিং এলো। কিভাবে বিদ্রোহ হবে, সুলতানের সৈন্যদের কিভাবে বোকা বানানো হবে, এসব কথা ফ্রান্সিস কিছু ভাঙলো না। শুধু ওদের মতামত চাইলো। দুজন বাদে সবাই ফ্রান্সিসকে সমর্থন করলো। সেই দুজন বললো–যদি বিদ্রোহ করতে গিয়ে আমরা হেরে যাই, সুলতান আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। কারণ ওর কাছে আমাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস বলল কথাটা সত্য!কিন্তু এছাড়া আমাদের উপায় কি? একবার আমদাদের রাজপ্রাসাদে সোনার ঘন্টা নিয়ে যেতে পারলে আমরা কোনদিনই ওটা উদ্ধার করতে পারবো না।

শেষ পর্যন্ত স্থির হল, অন্য ভাইকিং বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের কপাল মন্দ। এ কান সে কান হতে হতে কথাটা সুলতানের কানে গিয়েও উঠলো। সুলতান সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ভাইকিংদের কাছ থেকে তরবারি কেড়ে নেবার কুম দিলেন। তারপর নিরস্ত্র ভাইকিংদের জাহাজের নীচের কেবিনে বন্দী করে রাখা হল। সেনাপতি আর তার দলের লোকেরাও বাদ গেল না। সুলতান বোধহয় কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ফ্রান্সিসের বিদ্রোহের পরিকল্পনা সমস্ত ভেস্তে গেল।

তখনও সূর্য ওঠেনি। আবছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দূরে আমাদের দুর্গ চূড়া দেখা গেল। সূর্য উঠল। চারিদিক আলোয় ভেসে গেল। আমদাদ বন্দরের জাহাজ, লোকজন, দূর্গের। পাহারাদার সৈন্য সব স্পষ্ট হল। বন্দর আর বেশি দূরে নেই।

জাহাজ দুটো বন্দরে ভিড়লো। কিন্তু এ কি হলো? জনসাধারণের মধ্যে সেই আনন্দ উল্লাস কোথায়? কই কেউ তো সুলতানের জয়ধ্বনি দিচ্ছে না। দলে-দলে ছুটে আসছে না, সেই আশ্চর্য সোনার ঘন্টা দেখতে? সবাই যেন পুতুলের মত নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দেখছে সুলতানের জাহাজ তীরে ভিড়লো, পেছনে সোনার ঘন্টার পাটাতন, তারপর ভাইকিংদের জাহাজ।

সুলতান আর রহমান রাজপথ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চললেন রাজ প্রাসাদের দিকে। পেছনে হাতে দড়ি বাঁধা ভাইকিংদের দল। তাদের দুপাশে খোলা তরোয়াল হাতে সৈন্যরা ঘোড়ায় চড়ে চলেছে। তাদের পেছনে সোনার ঘন্টা টেনে নিয়ে আসছে আটটি ঘোড়া। চাকা বসানো পাটাতন গড়গড়িয়ে চলছে। এত কাণ্ড সব, তবু রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো আমদাদবাসীদের মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। সৈন্যরা পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেখে সুলতানের রাগ বেড়েই চললো। এর মধ্যে যে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে, সেটা সুলতান বা ভাইকিংরা কেউই জানতো না। ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা ভাইকিং রাজার জাহাজ নিয়ে পালিয়ে আসার কয়েকদিন পরে ভাইকিংদের রাজা মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন। রাজার সঙ্গে ছিল দুজাহাজ ভরতি সৈন্য। তারা ফ্রান্সিসের খোঁজ করতে করতে এই আমদাদ নগরে এসে উপস্থিত হল। তখন সুলতান। সৈন্য আর ভাইকিংদের নিয়ে সোনার ঘন্টার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। সুলতানের সঙ্গে বাছাই করা সৈন্যরা চলে গেছে। ভাইকিংদের রাজা খুব সহজে যুদ্ধ করে আমদাদ দখল করে নিলেন। এবার সুলতানের আর ভাইকিংদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করা।

যেদিন সুলতান সোনার ঘন্টা নিয়ে ফিরলেন, সেদিন রাস্তার দু’পাশের দাঁড়ানো লোকজন আর সুলতানের সৈন্যদের আগে থেকেই সতর্ক করে দেওয়া হল–সবাই যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সুলতান যেন ঘুনাক্ষরেও বুঝতে না পারেন, আমদাদ শহর বিদেশীরা দখল। করে নিয়েছে। তাই সেদিন কোথাও না ছিল উত্তেজনা, না ছিল উল্লাস। সুলতানের প্রত্যেকটা সৈন্যের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের পিঠে তরোয়াল ঠেকিয়ে ভাইকিং সৈন্যরা আত্মগোপন করেছিল। কেউ যেন টু শব্দটি না করে। ভাইকিংদের রাজা চাইছিলেন–সুলতান যেন। আগে থাকতে কোনো বিপদ আঁচ করে পালাতে না পারেন।

রাজপথ দিয়ে চলেছেন সুলতান। পেছনে বন্দী ভাইকিংরা। তারও পেছনে সোনার ঘন্টা। প্রাসাদের কাছে এসে সুলতান দেখলেন, প্রাসাদের প্রধান ফটকের কাছে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী ও প্রধান-প্রধান অমাত্যরা বসে আছেন। মাঝখানে সুলতানের সিংহাসন, সেটা ফাঁকা। তার পাশে একটা সিংহাসনে বেগম বসে আছেন। সুলতান এগিয়ে চললেন।

হঠাৎ বেগম সিংহাসন থেকে নেমে এসে রাজপথ দিয়ে সুলতানের দিকে ছুটে আসতে কম লাগলেন। কারা যেন তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ততক্ষণে বেগম অনেকটা চলে এসেছেন। সুলতান স্পষ্ট শুনলেন, বেগম চীৎকার করে বললেন–পালাও, পালাও ভাইকিংরা এদেশ দখল করে নিয়েছে।

কিন্তু বেগম কথাটা আর দুবার বলতে পারলেন না। তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বর্শা বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে তার পিঠে ঢুকে গেল। বেগম রাজপথের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। সুলতান ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে গিয়ে বেগমের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বেগম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন–পালাও।

আর কিছু বলতে পারলেন না। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

ততক্ষণে সুলতানের সৈন্যদের সঙ্গে ভাইকিং সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষেরা চীৎকার করতে করতে যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাতে শুরু করেছে। ব্যাপার দেখে ফ্রান্সিসরা তো অবাক। তারপর ওরা সব বুঝতে পারলো। ভাইকিং সৈন্যরা ছুটে এসে ওদের হাতের দড়ি কেটে দিলো। তরোয়াল হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস আর তার বন্ধুরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সুলতানের সৈন্যরা প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল। কিন্তু দুর্ধর্ষ ভাইকিং সৈন্যদের সঙ্গে তারা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলো না। প্রচণ্ড যুদ্ধ চললো। সুলতান নিজেও তখন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এঁর নিপুণ তরোয়াল চালনায় বেশ কয়েকজন ভাইকিং ঘায়েল হলো। যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে ভাইকিং সেনাপতি আর তার অনুচরেরা পালিয়ে গেলো।

যুদ্ধ করতে করতে ফ্রান্সিস হঠাৎ দেখলো, সুলতান রক্তমাখা খোলা তরোয়াল হাতে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস তরোয়াল উঁচিয়ে হাসলো। বললো-সুলতান, আমি এই দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলাম। সুলতান সে কথার কোন জবাব না দিয়ে উন্মাদের মত ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ফ্রান্সিস খুব সহজেই সে আঘাত ফিরিয়ে দিয়ে পালটা আক্রমণ করলো। শুরু হলো দুজন নিপুণ যোদ্ধার যুদ্ধ।

যুদ্ধ চললো। দুজনের নাক দিয়ে ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে। দুজনেই দুজনের দিকে কুটিল চোখে তাকাচ্ছে। আঁচ করে নিচ্ছে, কোন দিক থেকে আক্রমণটা আসতে পারে। একসময় সুলতানের আক্রমণ ঠেকাতে-ঠেকাতে ফ্রান্সিস মঞ্চের সিঁড়িতে পা রেখে রেখে ওপরে উঠে গেল। পরক্ষণেই পালটা আক্রমণ করলো। সুলতান এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন। হঠাৎ ফ্রান্সিসের পর-পর কয়েকটা তরোয়ালের আঘাত সামলাতে গিয়ে সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে গেলেন। গড়িয়ে গেলেন কয়েকটা সিঁড়ির নীচে। ঠিক তখনই চাকাওয়ালা কাঠের পাটাতনটায় করে সোনার ঘন্টাটা নিয়ে যাওয়া। হচ্ছিল। হঠাৎ একটা চাকা গেল ভেঙে। ঘোড়াগুলো টান সামলালো, কিন্তু সোনার ঘন্টাটা রাজপথে পড়ে ঢং-ঢং। শব্দ তুলে কয়েকবার গড়িয়ে গেল। সুলতান ঠিক তখনই মঞ্চের সিঁড়িটা থেকে ওঠবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কে উঠতে আর পারলেন না। সোনার ঘন্টা গড়িয়ে সুলতানের ওপর গিয়ে পড়ল। সুলতান আর্ত-চীৎকার করে দুহাত তুলে সোনার ঘন্টাটাকে ঠেকাতে গেলেন, কিন্তু ও ভারী নিরেট সোনার ঘন্টা–পারবেন কেন! সিঁড়ির সঙ্গে পিষে গেলেন। একটা মর্মান্তিক চিৎকার উঠল ধারেকাছের সকলেই ছুটে এলো। এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ফ্রান্সিসও বিমূঢ় হয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। কিন্তু ততক্ষণে সুলতানের রক্তাপ্লুত দেহ বার কয়েক নড়ে স্থির হয়ে গেছে। সুলতান মারা গেছেন।

ফ্রান্সিস! ডাক শুনে ফ্রান্সিস মঞ্চের দিকে তাকালো। দেখলো বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে ভাইকিংদের রাজা। দুজনেই মিটিমিটি হাসছেন। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। রাজা বললেন তুমি ভাইকিং জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছে।

–তবু–ফ্রান্সিসের বাবা বললেন, জাহাজ চুরির অপরাধটা?

রাজা বললেন, হ্যাঁ, শাস্তিটা তো পেতেই হবে, এই রাজত্বের শাসনভার তোমাকে দিলাম।

ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বলে উঠল দোহাই, ঐ-টি আমি পারবো না। জাহাজ চলানো, ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করা তরোয়াল চালানো, এসব এক জিনিস, আর একটা রাজত্ব চালানো, সে অন্য ব্যাপার। যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি, এই রাজত্বের ভার ফজলকে দিন।

–কে ফজল?

–আমার বন্ধু। সবদিকে থেকে ফজলের মত উপযুক্ত আর কেউ নেই। সেই এই দেশেরই মানুষ। যাদের দেশ, তারাই দেশ শাসন করুন, এটাই কি আপনি চান না?

–নিশ্চয়ই চাই। বেশ! ডাক ফজলকে।

ফ্রান্সিস চারিদিকে তাকিয়ে ফজলকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও তার দেখা পেল না। ফ্রান্সিস বললো–ফজল এখানেই আছে কোথাও। আমাকে সময় দিন, ওকে খুঁজে বের করব।

–বেশ, রাজা সম্মত হলেন।

ফ্রান্সিস দেখলো যুদ্ধ থেমে গেছে। সুলতানের সৈন্যদের বন্দী করা হচ্ছে। সুলতানের মৃতদেহ ঘিরে শোকার্ত মানুষের ভীড়। ফ্রান্সিসের ভালো লাগছিল না এসব। নাঃ আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। মাথার ওপরে অন্ধকার ঝোড়ো আকাশ, পায়ের কাছে পাহাড়ের মত উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ছে, উন্মত্ত বাতাসের বেগ। জীবন তো সেখানেই।

ফ্রান্সিস পায়ে-পায়ে রাজার কাছে গিয়ে বললো–এবার একটা ভাল জাহাজ দেবেন?

রাজা সবিস্ময়ে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–কেন?

–আফ্রিকার ওঙ্গালি বাজারে যাব—

–আবার?

–চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না–ফ্রান্সিস উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল–কি বিরাট হীরে! কি চোখ ধাঁধানো আলো ছিটকে পড়ছে!

ফ্রান্সিসের আর বলা হলো না। পেছন থেকে বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–এখান থেকে আমার সঙ্গে সোজা বাড়ি ফিরে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *