সোনার ঘণ্টা – ৪

পাঁচদিন পরে জাহাজটা ভাইকিংদের দেশের রাজধানীতে এসে পৌঁছাল। ফ্রান্সিসের যেন তর সয় না। কতক্ষণে শহর-বন্দরে ভিড়বে। জাহাজটা ধীরে ধীরে এসে জেটিতে লাগল। জেটির গেট খুলে দিতেই ফ্রান্সিস এক ছুটে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

তখন সকাল হয়েছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট।

একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল ফ্রান্সিস। টস্টন্টস্ট’ ঘোড়ার গাড়ি চলল পাথর বাঁধানো পথে শব্দ তুলে। ফ্রান্সিসের আবাল্য পরিচিত শহর। খুশিতে ফ্রান্সিস কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। একবার এই জানালা দিয়ে তাকায়, আর একবার ঐ জানালা দিয়ে। কতদিন পরে দেশের লোকজন, পথঘাট দেখতে পেল! এক সময় বাড়ির সামনে এসে পড়ল।

বাড়ির গেট-এর লতাগাছটা দুদিকের দেয়ালে বেয়ে অনেকক্টা ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্রান্সিস ওটাকে চারাগাছ দেখে গিয়েছিল। কত অজস্র ফুল ফুটেছে গাছটায়। গেট ঠেলে ঢুকল ফ্রান্সিস। প্রথমেই দেখল মা’কে। বাগানে ফুলগাছের তদারকি করছে। ফ্রান্সিস শব্দ না করে আস্তে আস্তে মা’র পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই ছোটবেলা সে মাকে এমনি করেই চমকে দিত। ওদের বুড়ো মালিটা হঠাৎ মুখ তুলে ফ্রান্সিসকে দেখেই প্রথমে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর ফোকলামুখে একগাল হাসল। মা ওকে হাসতে দেখে ধমক লাগাল। তবু হাসছে দেখে মা পেছন ফিরে তাকাল। বয়সের রেখা পড়েছে মার মুখে। বড়শীর্ণ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে মাকে। ফ্রান্সিস আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মার কান্না আর থামে না। ফ্রান্সিসের মাথায় হাত বুলোয় আর বিড়বিড় করে বলে পাগল, বদ্ধ পাগল ই-আমার কথা একবারও মনে হয় না তোর? হ্যাঁ পাগল কোথাকার—

ফ্রান্সিসের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। সে বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করল। ওর চোখে জল দেখলে মাও অস্থির হয়ে পড়বে।

বাবা বাড়ি নেই। রাজপ্রাসাদে গেছেন সেই ভোরবেলা। কি সব জরুরী পরামর্শ আছে রাজার সঙ্গে। যাক–বাঁচা গেল। এখন খেয়ে-দেয়ে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেবে।

কিন্তু ফ্রান্সিসের কপালে নিশ্চিন্ত ঘুম নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মা’র কণ্ঠস্বর শুনল–বেচারা ঘুমুচ্ছে–এখন আর তুলে–

–হুঁ। বাবার সেই গম্ভীর গলা শোনা গেল।

একটু পরে দরজা খুলে গেল। আস্তে আস্তে ফ্রান্সিসের বাবা এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। ভুরু কুঁচকে ফ্রান্সিসের দিকে। তাকিয়ে রইলেন স্থির দৃষ্টিতে। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি বিছানার ওপরে উঠে বসল। বাবা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আমতা-আমতা করে বলতে লাগল—ম্‌-মানে ইয়ে হয়েছে—

–পুরো এক মাস এইখান থেকে কোথাও বেরোবে না।

–বেশ–ফ্রান্সিস আর কোন কথা বলার চেষ্টা করল না।

–পালিয়েছিলে কেন?

–বললে তো আর যেতে দিতে না।

–হুঁ!

–বিশ্বাস কর বাবা, সোনার ঘন্টা সত্যিই আছে।

–মুণ্ডু।

–আমি সোনার ঘন্টার বাজনার শব্দ শুনেছি।

–এখন ঘরে বসেই সোনার ঘন্টার বাজনা শোন।

–একটা জাহাজ পেলেই আমি—

–আবার! বাবা হেঁকে উঠলেন।

ফ্রান্সিস চুপ করে গেল। ফ্রান্সিসের বাবা দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকলেন–এদিকে এসো।

ফ্রান্সিস ভয়ে-ভয়ে বিছানা থেকে নেমে বাবার কাছে গেল।

–কাছে এসো।

ফ্রান্সিস পায়ে-পায়ে এগোল। হঠাৎ বাবা তাকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলে। কয়েক মুহূর্ত। ফ্রান্সিস বুঝল বাবার শরীর আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ ফ্রান্সিসকে ছেড়ে দিয়ে ওর বাবা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ফ্রান্সিস দেখল, বাবা হাতের উল্টেপিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন।

বেশ কিছুদিন গেল। ফ্রান্সিস আবার সেই আগের মতই শক্তি ফিরে পেয়েছে–দৃপ্ত, সতেজ। কিন্তু মনে শান্তি নেই। এও তো আর এক রকমের বন্দী জীবন। ওর মত দুরন্ত ছেলের পক্ষে একটা ঘরে আটকা পড়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। তবু বাবার অজান্তে মা ওকে বাগানে, যেতে দেয়, গেট-এ গিয়েও দাঁড়ায় কখনো কখনো। কিন্তু বাড়ীর বাইরে যাবার উপায় নেই। মার কড়া নজর। বন্ধু বান্ধবের দল বেঁধে আসে। ফ্রান্সিসের কথা যেন আর ফুরোতে চায় না। বন্ধুরা সব অবাক হয়ে ওর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনে। ফ্রান্সিস বলে–ভাই তোমরা যদি আমার সঙ্গে যেতে রাজী হও, তাহলে সোনার ঘন্টা আমার হাতের মুঠোয়।

ওরা তো সবাই ভাইকিং। সাহসে, শক্তিতে ওরাও কিছু কম যায় না; ওরা হইচই করে ওঠে আমরা যাব। ফ্রান্সিস ঠোঁট আঙ্গুলে ঠেকিয়ে ওদের শান্ত হতে ইঙ্গিত করে। মা টের পেলে অনর্থ করবে।

ফ্রান্সিসের নিকট বন্ধু হ্যারি। কিন্তু সে চেঁচামেচিতে যোগ দেয় না। সে বরাবরই ঠাণ্ডা প্রকৃতির, কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান। সে শুধু বলে আগে একটা জাহাজের বন্দোবস্ত করো–আমাদের নিজেদের জাহাজ–তারপর কার কত উৎসাহ দেখা যাবে।

আবার চেঁচামেচি শুরু হয়। মা ঘরে ঢোকে। বলল–কি ব্যাপার?

সবাই চুপ করে যায়। মা সবই আন্দাজ করতে পারে। তাই ফ্রান্সিসের ছোট ভাইটাকে পাঠিয়ে দেয়। সে এসে ওদের আড্ডায় বসে থাকে। ব্যাস আর কিছু বলবার নেই! ওরা যা বলবে ঠিক ফ্রান্সিসের মার কাছে পৌঁছে যাবে। সব মাটি তাহলে–

একা-একা ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে দিন কাটতে চায় না। সমুদ্রের উন্মত্ত গর্জন, উত্তাল ঢেউ তাকে প্রতিনিয়ত ডাকে! আবার কবে সমুদ্রে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে, ফ্রান্সিস শুধু ভাবে আর ভাবে। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করবে তারও উপায় নেই। মার কড়া নজর। অগত্যা একটা উপায় বের করতে হল। রাত্রে মা একবার এসে দেখে যায়, ছেলে ঘুমোল কিনা। ফ্রান্সিস সেদিন ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। মা নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে চলে যেতেই ফ্রান্সিস জানলা খুলে মোটা লতাগাছটা বেয়ে নিচে বাগানে নেমে এল। তারপর দেয়াল ডিঙিয়ে রাস্তায়।

বন্ধুদের ডেকে পাঠাতে একটু সময় গেল। ততক্ষণ ফ্রান্সিস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে একটা পোড়া বাড়িতে বন্ধুদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একজন-দুজন করে সবাই এল। সোনার ঘন্টা আনতে যাবে, এই উত্তেজনায় হইচই শুরু করে দিলে ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল। গোলমাল একটু কমলে ফ্রান্সিস বলতে শুরু করল–ভাই সব, শুধু উৎসাহকে সম্বল করে কোন কাজ হয় না। ধৈর্য চাই, চিন্তা চাই। দীর্ঘদিন ধরে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে আমাদের। নিজেদের দাঁড় বাইতে হবে, পাল খাটাতে হবে, ডেক পরিষ্কার করতে হবে, আবার ঝড়ের সঙ্গে লড়তে হবে, ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা সামলাতে হবে। কি, পারবে তোমরা?

–আমরা পারবো–সবাই সমস্বরে বলে উঠল।

–হয়তো আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম, খাদ্য ফুরিয়ে গেল, জল ফুরিয়ে গেল–তখন কিন্তু অধৈর্য হবে না–নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করাও চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে বুক দিয়ে সব কষ্ট সহ্য করতে হবে। কি পারবে?

–পারবো। আবার সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সবাই।

কয়েক রাত এই রকম সভাও পরামর্শ হল। কিভাবে একটা জাহাজ জোগাড় করা যায়? ফ্রান্সিস দু’একবার বাবাকে বলবার চেষ্টা করেছে–যদি উনি রাজার কাছ থেকে একটা জাহাজ আদায় করে দেন। কিন্তু ফ্রান্সিসের বাবা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন।

হ্যারিই প্রথমে বুদ্ধিটা দিল। হ্যারি কথা বলে কম, কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে বলল–। আমরা রাজার জাহাজ চুরি করব।

–জাহাজ চুরি? সবাই অবাক।

–হ্যাঁ, রাজা যখন চাইলে জাহাজ দেবেন না, তখন চুরি ছাড়া উপায় কি।

–কিন্তু–ফ্রান্সিস দ্বিধাগ্রস্ত হল।

–আমরা তো সমুদ্রে ভেসে পড়ব, রাজা আমাদের ধরতে পারলে তো! তাছাড়া–যদি সত্যিই সোনার ঘন্টা আনতে পারি–তখন–

–ঠিক–ফ্রান্সিস লাফিয়ে উঠল। সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হল।

গভীর রাত্রি। বন্দরের এখানে-ওখানে মশাল জ্বলছে। মশালের আলো জলে কঁপছে। রাজার সৈন্যরা বন্দর পাহারা দিচ্ছে। অন্ধকারে নোঙর করা রয়েছে রাজার জাহাজগুলো।

প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে ফ্রান্সিস আর তার পঁয়ত্রিশজন বন্ধু জাহাজগুলোর দিকে এগোতে লাগল। পাথরের ঢিবি, খড়ের গাদা, স্তূপীকৃত কাঠের বাক্সের আড়ালে-আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। হাতের কাছে সব চাইতে বড় যে জাহাজটা, সেটাতেই নিঃশব্দে উঠতে লাগল সবাই। যে সব প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছিল, তারা এতগলো লোককে হঠাৎ যেন। মাটি খুঁড়ে জাহাজে উঠতে দেখে অবাক হয়ে গেল। ওরা খাপ থেকে তরোয়াল খোলবার। আগেই ফ্রান্সিসের বন্ধুরা একে একে সবাইকে কাবু করে ফেলল। তারপর জাহাজ থেকে ছুঁড়ে জলে ফেলে দিল। জাহাজটা কূল ছেড়ে সমুদ্রের দিকে ভেসে চলল।

এদিকে হয়েছে কি, সেই জাহাজে রাজার নৌবাহিনীর সেনাপতি একটা গোপন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল রাজার বিরুদ্ধে। সেনাপতিই ছিল সেই ষড়যন্ত্রের নেতা। যাতে আরো সৈন্য তারদলে এসে যোগ দেয়, গোপন সভার সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। তারা আলোচনায় এত তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে, তারা জানতেও পারল না কখন জাহাজটা চুরি গেছে, আর জাহাজ মাঝ সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ জাহাজটা দুলে-দুলে উঠতে লাগল। সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা তো অবাক। জাহাজ মাঝ সমুদ্রে এল কি করে? ওরা সিঁড়ি বেয়ে ডেক-এ উঠে এল কি ব্যাপার দেখতে। ওরা উঠে আসছে বুঝতে পেরে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা সব লুকিয়ে পড়ল। সেনাপতি তার দলবল নিয়ে ডেক-এ এসে দাঁড়াতেই সবাই লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ালো। সেনাপতি খুব বুদ্ধিমান। বুঝল, এখন ওদের সঙ্গে লড়তে গেলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। লোকদের ইঙ্গিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে? বলল।

ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–সেনাপতি মশাই, আপনাকেও আমরা সঙ্গে পাব, এটা ভাবতেই পারিনি। যাকগে, মিছিমিছি তরোয়াল খুলবে না, দেখতেই পাচ্ছেন আমরা দলে ভারি। এবার আপনাদের তরোয়ালগুলো দিয়ে দিন।

সেনাপতি নিঃশব্দে নিজের তরোয়াল সুদ্ধ বেল্টটা ডেক-এর ওপর রেখে দিল। সেনাপতির বেল্টটা ডেক-এর ওপর রেখে দিল। দেখাদেখি তার দলের সৈন্যরাও তরোয়াল খুলে ডেক-এর ওপর রাখল। ফ্রান্সিসের দলের একজন তরোয়ালগুলো নিয়ে চলে গেল। সেনাপতি গম্ভীর মুখে বলল–তোমরা রাজার জাহাজ চুরি করেছ–এজন্যে তোমাদের শাস্তি পেতে হবে।

–সে আমরা বুঝবো–ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু তোমরা জাহাজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?

–সোনার ঘন্টা আনতে—

সেনাপতি মুখ বেঁকিয়ে হাসল–ওটা একটা ছেলে ভোলানো গল্প।

–দেখাই যাক না। ফ্রান্সিস হাসল।

ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। পালগুলো ফুলে উঠেছে হাওয়ার তোড়ে। শান্ত সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ চলতে লাগল দ্রুতগতিতে। ফ্রান্সিসের বন্ধুরা খুব খুশী। দাঁড় টানতে হচ্ছে না। সমুদ্রও শান্ত। খুব সুলক্ষণ। নির্বিঘ্নেই ওঁরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবে।

ফ্রান্সিস কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তার মনে শান্তি নেই। সারাদিন যায় জাহাজের কাজকর্ম তদারকি করতে। তারপর রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, ফ্রান্সিস তখন একা-একা ডেক-এর ওপর পায়চারী করে। কখনও বা রেলিং ধরে দূর অন্ধকার দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। একমাত্র চিন্তা–কবে এই যাত্রা শেষ হবে–দ্বীপে গিয়ে পৌঁছবে। মাঝে-মাঝে হ্যারি বিছানা থেকে উঠে আসে। ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে এবার শুয়ে পড়গে যাও।

–হ্যারি–ফ্রান্সিস শান্তস্বরে বলে–তুমি তো জানো সোনার ঘন্টা আমার সমস্ত জীবনের স্বপ্ন। যতদিন না সেটার হদিস পাচ্ছি, ততদিন আমি শান্তিতে ঘুমুতে পারব না।

তবু শরীরটাকে তো বিশ্রাম দেবে! হ্যারি বলে।

-হ্যাঁ, বিশ্রাম। ফ্রান্সিস হাসল–চল। কতদিন হয়ে গেল। জাহাজ চলেছে তো চলেছেই। এরমধ্যে তিনবার ফ্রান্সিসদের জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়েছিল। প্রথম দু’বারের ঝড় ওদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু শেষ ঝড়টা এসেছিল হঠাৎ। পাল নামাতে নামাতে দুটো পাল ফেঁসে গিয়েছিল। পালের দড়ি ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে সব মেরামত করতে হয়েছে। কিন্তু সেলাই করা পালে তো ভরসা করা যায় না। জোর হাওয়ার মুখে আবার ফেঁসে যেতে পারে।

জাহাজতখন ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। কোন বন্দরে জাহাজ থামিয়ে পালটা পালটে নিতে হবে। কিন্তু ফ্রান্সিসের এই প্রস্তাবে সকলে সম্মত হল না। কেউ আর দেরি করতে চায় না। কতদিন হয়ে গেল দেশ বাড়ি ছেড়ে এসেছে। ফেরার জন্যে সকলেই উদগ্রীব। কিন্তু ফ্রান্সিস দৃঢ় প্রতিজ্ঞ–পালটা পালটাতেই হবে। যে প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে তাদের পড়তে হবে, সে সম্বন্ধে কারো কোন ধারণাই নেই। শুধু ফ্রান্সিসই জানে তার ভয়াবহতা। সেই মাথার ওপর উন্মত্ত ঝড় আর নীচে ডুবো পাহাড়ের বিশ্বাসঘাতকতা। সে সব সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। প্রায় সকলেরই ধারণা হল, ফ্রান্সিস বিপদটাকে বাড়িয়ে দেখছে। এই নিয়ে ফ্রান্সিসের সঙ্গীদের মধ্যে গুঞ্জনও চলল।

সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা এতদিন চুপ করেসব দেখছিল। ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে তার সঙ্গীদের খেপিয়ে দেবার সুযোগ খুঁজছিল। এবার সুযোগ পাওয়া গেল! এরমধ্যে ফ্রান্সিসের একটা হুকুমও ভালো মনে নিল না। ফ্রান্সিসেরই তিনজন সঙ্গী দেশে ফিরে যাবার জন্যে বারবার ফ্রান্সিসকে করছিল। কিন্তু ফ্রান্সিস অটল। অসম্ভব ফিরে যাওয়া চলবে না। সে সোজা বলল–ওসব ভাবনা মন থেকে তাড়াও। কাজ শেষ না করে কেউ ফেরার কথা মুখেও এনো না। কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। ওদের প্যানপ্যানিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল ফ্রান্সিস। তাই যে ছোট্ট বন্দরটায় পালটা পাবার জন্যে জাহাজটা থামল, ফ্রান্সিস ওদের সেখানে জোর করে নামিয়ে দিল। অন্য জাহাজে করে ওরা যেন দেশে ফিরে যায়। এমনিতেই ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনাটা তাতে আরো একটু ইন্ধন জোগাল। সেই ছোট্ট বন্দরে পালটা বদলে, জাহাজের টুকিটাকি মেরামত সেরে নিয়ে তাদের যাত্রা আবার শুরু হল।

দিন যায়, রাত যায়। কিন্তু কোথায় সেই দ্বীপ? কোথায় সেই সোনার ঘন্টা? সকলেই হতাশায় ভেঙে পড়তে লাগল। এ কোথায় চলেছি আমরা? গল্পের সোনার ঘন্টার অস্তিত্ব আছে কি? না কি সবটাই ফ্রান্সিসের উদ্ভট কল্পনা? সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা এতদিনে সুযোগ পেল। তারা গোপনে সবাইকে বোঝাতে লাগল–ফ্রান্সিস উন্মাদ। একটা ছেলে ভুলানো গল্পকে সত্যি ভেবে নিয়েছে। আর দিন নেই, রাত নেই সেই কথা ভাবতে-ভাবতে ও উন্মাদ হয়ে গেছে। কিন্তু ও পাগল বলে আমরা তো পাগল হতে পারি না? দীর্ঘদিন আমরা দেশ ছেড়েছি। কোথায় চলেছি, তার ঠিকানা নেই। কবে দেশে ফিরব, অথবা কেউ ফিরতে পারবে কি না, তাও জানি না। একটা কাল্পনিক জিনিসের জন্যে আমরা এভাবে আমাদের জীবন বিপন্ন করতে যাব কেন?

কিন্তু উপায় কি? সবাই মুষড়ে পড়ল। সেনাপতিও ধীরে-ধীরে ফ্রান্সিসের বন্ধুদের মন তার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলতে লাগল।

এর মধ্যে আর এক বিপদ। জাহাজে খাদ্যাভাব দেখা দিল। মজুত জলে তখনও টান পড়েনি। কিন্তু কম খেয়ে আর কতদিন চলে? খাদ্য যা আছে, তাতে আর কিছুদিন মাত্র চলবে। তারপর? সেনাপতি বুদ্ধি দিল সবাইকে এখনও সময় আছে। চল আমরা ফিরে যাই। এই সবকিছুর মূলে হচ্ছে ফ্রান্সিস। তার নেতৃত্ব অস্বীকার করো। বেশী বাড়াবাড়ি করলে ওকে জলে ফেলে দাও। তারপর জাহাজ ঘোরাও দেশের দিকে।

কথা সকলেরই মনে ধরল। শুধু হ্যারি সবকিছু আঁচ করে বিপদ গুনলো।

ফ্রান্সিস কিন্তু এসব ব্যাপার কিছুই আঁচ করতে পারেনি। ওর তো একটাই চিন্তা যে করেই হোক সেই দ্বীপে পৌঁছতে হবে। আজকাল ওর বন্ধুরা কেমন যেন এড়িয়ে-এড়িয়ে চলে। ওর দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। একমাত্র হ্যারিই আগের মত ফ্রান্সিসের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তবে তার প্রশ্নেও সংশয়ের আভাস ফুটে ওঠে।

গভীর রাত্রিতে ডেক-এ দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল দু’জনে। হ্যারি জিজ্ঞাসা করল–ফ্রান্সিস তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস কর, সোনার ঘন্টা বলে কিছু আছে?

–তোমার মনে সন্দেহ জাগছে? ফ্রান্সিস একটু হাসে।

–সে কথা নয়। এতগুলো লোক একমাত্র তোমার ওপর ভরসা করেই যাচ্ছে।

–হ্যারি আমি জাহাজ ছাড়ার সময়ই বলেছিলাম–যারা আমার সঙ্গে যাচ্ছে, সকলের জীবনের দায়িত্ব আমার। কাউকে বিপদের মুখ থেকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে যদি প্রাণ দিতে হয়, তাই আমি দেব।

–তোমাকে আমি ভালো করেই জানি ফ্রান্সিস–কথার খেলাপ তুমি করবে না! কিন্তু হাজার হোক মানুষের মন তো–

-–আমি বুঝি হ্যারি! দীর্ঘদিন আমরা দেশ ছেড়ে এসেছি–আত্মীয়স্বজন, বাড়ী ঘরের জন্যে মন খারাপ করবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু বড় কাজ করতে গেলে সব সময় পিছুটান। অস্বীকার করতে হয়। নইলে আমরা এগোতেই পারব না।

-–আচ্ছা ফ্রান্সিস, তুমি আমাদের যা-যা বলেছ, সে সব তোমার কল্পনা নয় তো?

ফ্রান্সিস কিছু বলল না। কাঁধের কাছে জামাটা একটানে খুলে ফেলল। ও তরোয়ালের কোপের সেই গভীর ক্ষতটা দেখিয়ে বলল–এটা কি কল্পনা হ্যারি?

হ্যারি চুপ করে গেল। বলতে সাহস করল না যে, ওর বন্ধুরা সবাই ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। ফ্রান্সিস কথাটা শুনলে হয়তো ক্ষেপে গিয়ে আর এক কাণ্ড বাধিয়ে বসবে।

ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চূড়ান্ত রূপ নিল একদিন। সেদিন সকাল থেকেই সেনাপতি আর তার দলের লোকেরা গোপনে ফ্রান্সিসের কয়েকজন বন্ধুকে বলল–জানো আমরা পথ হারিয়েছি। ফ্রান্সিস নিজেই জানে না, জাহাজ এখন কোনদিকে, কোথায় চলেছে।

এমনিতেই সকলের মনে অসন্তোষ জমেছিল। এই মিথ্যা রটনা যেন শুকনো বারুদের স্তূপে আগুন দিল। মুহূর্তে খবরটা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল! সেনাপতির নেতৃত্বে গোপন সভা বসল। সবাই একমত হলো সেনাপতিই হবে জাহাজের ক্যাপটেন। ফ্রান্সিসের হুকুম আর চলবে না। হ্যারিও সভার ব্যাপারটা আঁচ করে সেখানে গিয়ে হাজির হল। সে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে উঠল। কিন্তু পারল না। তার আগেই কয়েকজন মিলে তাকে ধরে ফেলল। একটা ঘরে কয়েদী করে রেখে দিল। ফ্রান্সিস যাতে আগে থাকতে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে না পারে, তার জন্যে সবাই সাবধান হল।

তখন গভীর রাত। ফ্রান্সিস এক-একা ডেকে পায়চারী করছে! পরিষ্কার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোত্সার ছড়াছড়ি। ফ্রান্সিসের কিন্তু কোনদিকে চোখ নেই। ভুরু কুঁচকে তাকাচ্ছে জ্যোৎস্নধোয়া দিগন্তের দিকে।

হঠাৎ পেছনে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। ও ভেবেছিল হ্যারি এসেছে বোধহয়। কিন্তু না। হ্যারি নয়–সেনাপতি। পেছনে তার দলের কয়েকজন। ফ্রান্সিসের আশ্চর্য হওয়ার তখনও বাকি ছিল। নীচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে ফ্রান্সিসের সবাই দল বেঁধে উঠে আসছে ডেক-এ। ব্যাপারটা কি?

সেনাপতি এগিয়ে এসে ডাকল–ফ্রান্সিস?

–হুঁ।

–আমরা কেন উঠে এসেছিল বুঝতে পেরেছ?

–না।

–তোমাকে একটা কথা জানাতে।

–কি কথা?

–এই জাহাজ তোমার হুকুমে আর চলবে না।

–কেন?

–তোমাকে কেউ আর বিশ্বাস করে না।

–তাহলে কাকে বিশ্বাস করে?

-–আমাকে। এই জাহাজের দায়িত্ব এখন আমার।

ফ্রান্সিসের কাছে এবার সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। এই ষড়যন্ত্রের মূলে সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা। তারাই ওর বন্ধুদের মন বিষিয়ে তুলেছে। ফ্রান্সিস এবার সকলের দিকে তাকাল। চীৎকার করে বলল–ভাইসব, আমাকে বিশ্বাস করো না তোমরা?

কেউ কোন কথা বলল না। ফ্রান্সিস সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কেউ-কেউ মুখ ফেরাল। কেউ-কেউ মাথা নিচু করল। আশ্চর্য! হ্যারি কোথায়?

ফ্রান্সিস বুঝল, তাহলে ব্যাপার অনেক দূর গড়িয়েছে।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। গভীর দুঃখে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। একটা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, সব ব্যর্থ হয়ে গেল। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। ফ্রান্সিস অশ্রু রুদ্ধস্বরে বলতে লাগল, ভাইসব, অতি নগণ্য সংখ্যক হলেও পৃথিবীর এমন কিছু মানুষ আছে, ঘরের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যাদের ঘরে আটকে রাখতে পারে না। বাইরের পৃথিবীতে জীবনমৃত্যুর যে খেলা চলছে–নিজের জীবন বিপন্ন করেও সেই খেলায় মাতে সে। এর মধ্যেই সে বেঁচে থাকার আনন্দ খুঁজে পায়। আমিও তেমনি একজন মানুষ ফ্রান্সিস একটু থামল। তারপর বলতে লাগল, তোমাদের কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, সোনার ঘন্টা খুঁজে বের করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য কি? উত্তর খুবই সহজ আমি বড়লোক হতে চাই? কিন্তু তোমরা আমার বন্ধু। ভালো করেই জানো আমাদের পরিবার যথেষ্ট বিত্তশালী। তবে কেন এত আগ্রহ? কেন এই অভিযান? ভাইসব, উদ্দেশ্য আমার একটাই। ছেলেবেলা থেকে যে গল্প শুনে আসছি, কত রাতের স্বপ্নে দেখেছি যে সোনার ঘন্টা সেটা খুঁজে বের করব। তারপর দেশে নিয়ে যাব। আমাদের রাজাকে উপহার দেব। ব্যস–আমার কাজ শেষ। এর জন্যে যে কোন দুঃখকষ্ট, বিপদ-বিপর্যয় এমনকি মৃত্যুর। মুখোমুখি হতেও আমি দ্বিধাবোধ করব না।

ফ্রান্সিস একটু থেমে আবার বলতে লাগল–তোমরা সেনাপতিকে ক্যাপটেন বলে মেনে নিয়েছো। ভালো কথা। জাহাজের মুখ ঘোরাও দেশের দিকে। ফিরে গিয়ে ঘরে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাগে। কিন্তু আমি ফিরে যাব না। ফেরার পথে প্রথমে যে বলটা পাব, আমি সেখানেই নেমে যাব। জাহাজ জোগাড় করে আবার আসবো। আমাকে যদি সারাজীবন ধরে সোনার ঘন্টার জন্যে আসতে হয়, আমি আসব।

ফ্রান্সিস থামল। কেউ কোন কথা বলল না। হঠাৎ সেনাপতি চেঁচিয়ে বলল–এসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার। জাহাজের মুখ ঘোরাও।

ভীড়ের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল। দেশে ফিরে যাবে, এই আনন্দে সবাই চীৎকার করে উঠল। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেনি, চাঁদের আলো ম্লান হয়ে গেছে। ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের মত কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে! বাতাস থেমে গেছে। জাহাজের গতিও কমে এসেছে। ভাড়ের মধ্যে কে একজন বলল–এত কুয়াশা এল কোত্থেকে?

কথাটা কারো কারোকানে গেল। তারা কুয়াশা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য! এত কুয়াশা? এই অসময়ে? গুঞ্জন উঠল ওদের মধ্যে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কুয়াশার সেই আস্তরণের দিকে।

ফ্রান্সিস রেলিঙে ভর দিয়ে হাতে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। সেও লক্ষ্য করেনি? চারিদিকের পরিবেশ এই পালটে যাওয়ার ঘটনাটা। হঠাৎ ওর কানে গেল সকলের ভীত গুঞ্জন। ফ্রান্সিস মুখ তুলল। এ কি! চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। চারদিক। কুয়াশার ঘন আস্তরণ ঢেকে আস্তরণ ঢেকে দিয়ে সমুদ্র আকাশ।

ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–‘এক মুহূর্ত নষ্ট করবার মত সময় নেই। দাঁড়ে হাত লাগাও। সামনেই প্রচণ্ড ঝড় আর ডুবো পাহাড়ের বাধা। সবাই তৈরী হও।

কিন্তু সেই ভীড়ে কোন চাঞ্চল্য জাগল না। সবাই স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল। কি করছে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

হঠাৎ সেনাপতি চীৎকার করে বলে উঠল–সব ধাপ্পাবাজি।

ফ্রান্সিস সেনাপতির দিকে একবার তাকাল। তারপর দুহাত তুলে ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল–আমাকে বিশ্বাস কর। আমার বন্ধুত্বের মর্যাদা দাও। সবাই তৈরি হও দেরি করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমরা সোনার ঘন্টার বাজনার শব্দ শুনতে পাবে।

–পাগলের প্রলাপ–সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল।

এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করো না। ফ্রান্সিস তবু বলে যেতে লাগল পাল নামাও, দাঁড়ে হাত লাগাও!

ফ্রান্সিস আর বলতে পারল না। পিঠে কে যেন তরোয়ালের ডগাটা চেপে ধরেছে। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াতে গেল। পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে তরোয়ালের চাপ বেড়ে গেল। শুনল সেনাপতি দাঁত চাপা স্বরে বলছে–আর একটা কথা বলেছো তো, জন্মের মত তোমার কথা বলা থামিয়ে দেব।

সেনাপতির কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের প্রচণ্ড ধাক্কায় সমস্ত জাহাজটা ভীষণভাবে কেঁপে উঠল। উত্তাল ঢেউ জাহাজের রেলিঙের ওপর দিয়ে ছুটে এসে ডেকে আছড়ে পড়ল। সেনাপতি কোথায় ছিটকে পড়ল। অন্য সকলেও এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। শুরু হল জাহাজের প্রচণ্ড দুলুনি। ডেকে দাঁড়ায় তখন কারসাধ্য। ঠিক তখনই ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে বেজে উঠল সোনার ঘন্টার গম্ভীর শব্দ–ঢং–ঢং–ঢং।

ডেকে এখানে-ওখানে তালগোল পাকিয়ে পড়ে থাকা মানুষগুলো উৎকর্ণ হয়ে শুনল সেই ঘন্টার শব্দ। এই ঘন্টা যেন মন্ত্রের মত কাজ করল। সোনার ঘন্টা–এত কাছে। জাতে ভাইকিং ওরা। সমুদ্রের সঙ্গে ওদের নিবিড় সম্পর্ক। ঝড় প্রচণ্ড সন্দেহ নেই। সমুদ্রও উন্মত্ত। কিন্তু ওরাও জানে কীভাবে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। ওরা আর কারো নির্দেশের অপেক্ষা করল না। একদল গেল দাঁড় বাইতে, আর একদল গেল মাস্তুলের দিকে পাল নামাতে।

মাস্তুলের মাথায় উঠে দেখতে হবে ঘন্টার শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। ফ্রান্সিস জাহাজের ভীষণ দুলুনি উপেক্ষা করে মাস্তুল বেয়ে উঠতে লাগল। একেবারে মাথায় উঠে প্রাণপণ শক্তিতে মাস্তুলটা আঁকড়ে ধরে রইল। তারপর যেদিক থেকে ঘন্টার শব্দ আসছে, সেইদিকে তাকাল। ঝড়-বৃষ্টির আবছা আবরণের মধ্যে দিয়ে দেখল, দুটো পাহাড়ের মত পাথুরে দ্বীপ। মাঝখানে সমুদ্রের জল বিস্তৃত। আশ্চর্য! সেখানে সমুদ্র শান্ত। সেই সমুদ্রের মধ্যে দূরে একটা নিঃসঙ্গী পাহাড়ের মত দ্বীপ। পাথুরে দ্বীপ নয়। সবুজ ঘাস আছে দ্বীপটার গায়ে। তার মাথায় একটা সাদা রং-এর মন্দির মত। শব্দটা আসছে সেই দিক থেকেই। ফ্রান্সিস আর কিছুই দেখতে পেল না। ঝড়ের ধাক্কায় জাহাজটা কাত হয়ে গেল। মাস্তুল থেকে প্রায় ছিটকে পড়ার মত অবস্থা। ও তাড়াতাড়ি মাস্তুল বেয়ে নীচে নামতে লাগল। ডেকে পা দেবার আগেই দুটো পাল খাটাবার কাঠ সশব্দে ভেঙে পড়ল। ডেকে কয়েকজন চীৎকার করে উঠল। কি হল, তা আর তাকিয়ে দেখবার অবকাশ নেই।

ফ্রান্সিস ডেকে নেমেই ছুটল সিঁড়ির দিকে। নীচে নেমে চলে এল দাঁড় টানার লম্বা ঘরটায়। সারি সারি বেঞ্চিগুলোর দিকে তাকাল। দেখলো, সবাই প্রাণপণে দাঁড় টানছে। জাহাজের দুলুনিতে ভালোভাবে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস সেই দুলুনির মধ্যে কোনরকমে দাঁড়িয়ে চীৎকার করতে লাগল–ভাইসব, সামনেই ডুবো পাহাড়। আমরা আর সামনের দিকে যাব না। জাহাজ পিছিয়ে আনতে হবে। ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়াতে হবে। তারপর ঝড়ের ঝাঁপটায় জাহাজ যে দিকে যায় যাক।

সবাই দাঁড় বাওয়া বন্ধ করে ফ্রান্সিসের কথা শুনল। নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ফ্রান্সিস যে সত্য কথাই বলেছে, এ বিষয়ে কারও মনে আর সন্দেহ রইল না। এবার সবাই উল্টেদিকে দাঁড় বাইতে লাগল। জাহাজ পিছিয়ে আসতে লাগল। ঝড়ের কয়েকটা প্রচণ্ড ধাক্কায় অনেকটা পিছিয়ে এল। কিন্তু ডুবো পাহাড়ের ধাক্কা এড়াতে পারলোনা। খুব জোরে ধাক্কা লাগল না তাই রক্ষে। পেছনের হালটা মড়মড় করে ভেঙে গেল। সেই সঙ্গে পেছনের রেলিঙের কাছে অনেকটা জায়গা ভেঙে খোঁদল হয়ে গেল। তবু খোদলটা খুব উঁচুতে হল বলে বেশী জল ঢুকতে পারলো না। জাহাজ ডোবার ভয়ও রইল না। তারপরঝড়-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে কলার মোচার মত নাচতে নাচতে জাহাজ কোনদিকে যে চললো, তা কেউ বুঝতে পারল না।

ফ্রান্সিস ততক্ষণে জাহাজের খোলের ঘরগুলো খুঁজতে আরম্ভ করেছে। এ ঘরের দরজায় ও ঘরের কাঠের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে-খেতেও হ্যারিকে খুঁজতে লাগল। একটা বন্ধ ঘরের দরজায় ফ্রান্সিস জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল–হ্যারি!

ভেতর থেকে হারির উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল–কে? ফ্রান্সিস!

ফ্রান্সিস আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল। কিন্তু দরজা ভাঙল না। মরচে ধরা কড়াটা একটু আলগা হল। তলাটা ঠিকই ঝুলতে লাগল। এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে একটা হাতলভাঙা হাতুড়ি নজরে পড়ল। সেটা এনে মরচে ধরা কড়াটায় দমাদ্দম ঠুকতে লাগল। কয়েকটা ঘা পড়তেই কড়াটা দুমড়ে ভেঙে গেল। খোলা দরজা দিয়ে হ্যারি কোনরকমে ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল।

ফ্রান্সিস দ্রুত বলল এখন কথা বলার সময় নেই, ডেকে চলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফ্রান্সিস বুঝলো জাহাজটা আর তেমন দুলছে না। ডেকে উঠে দেখলো, জল-ঝড় তেমন নেই আর। তবে সমুদ্রে আকাশে এখনও পাতলা কুয়াশার আস্তরণ রয়েছে। হাওয়ায় কুয়াশা উড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। হলোও তাই। কুয়াশা উড়ে গেল। আকাশে দিগন্তের দিকে হেলে পড়া পাণ্ডুর চাঁদটা দেখা গেল। রাত শেষ হয়ে আসছে।

ফ্রান্সিস ডাকল–হ্যারি!

হ্যারি এগিয়ে আসতে ফ্রান্সিস বললো–চলো, হালের অবস্থাটা একবার দেখে আসি।

দেখা গেল, হালটা একেবারেই ভেঙে গেছে। তার সঙ্গে জাহাজের অনেকটা জায়গা, ভেঙে হাঁ হয়ে গেছে। সব দেখে-শুনে ফ্রান্সিস বললো–বেহাল জাহাজ, কোথায় যেন চলেছে তা ঈশ্বরই জানে।

–সে সব কাল ভাবা যাবে। এখন ঘুমিয়ে নেবে চল। হ্যারি তাগাদা দিলো।

–হ্যাঁ চল। খুব পরিশ্রান্ত আমি। পা টলছে, দাঁড়াতে পারছি না। পরদিন ঘুম ভেঙে যেতেই ফ্রান্সিস ধড়মড় করে উঠল। সকাল হয়ে গেছে। সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গত রাত্রির কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডেকের দিকে ছুটল। ডেকে দাঁড়িয়ে দেখলো, আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। সমুদ্রও শান্ত। সাদা রংয়ের সামুদ্রিক পাখিগুলো উড়ছে। তীক্ষ্মস্বরে ডাকছে। কিন্তু এ কোথায় এলাম? একটা ধুধুমরুভূমির মত জায়গায় জাহাজ কাত হয়ে বালিতে আটকে আছে। এখন আর ভাববার সময় নেই। সবাইকে ডেকে তুলতে হবে। জাহাজ মেরামত করতে হবে। তারপর সেই দ্বীপের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

ফ্রান্সিস সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল। কাউকে ধাক্কা দিয়ে, কাউকে আস্তে পেটে ঘুষি মেরে, কারো পিঠে চাপড় দিয়ে সে গলা চড়িয়ে বলল–ওঠ সব, ডেক-এ চল।

সবাই একে-একে উঠে পড়ল। উপরে ডেকে এসে দাঁড়াল। ডাঙার ধু-ধু বালির দিকে তাকিয়ে বোধহয় ভাবতে লাগল–কোথায় এসে ঠেকলাম? ওদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল–সবাই কথা বলতে লাগল। সবার মুখে একই প্রশ্ন–কোথায় এলাম?

ফ্রান্সিস ডেকে এসে দাঁড়াল! সবাইকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, ভাইসব, জাহাজ কোথায় এসে ঠেকেছে, আমরা কেউই বলতে পারব না। ওসব ভাবনা পরে ভাবা যাবে।

এখন নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই। একদল চলে যাও রসুই ঘরে রান্নার বন্দোবস্ত করো। আর সবাই জাহাজ মেরামতির কাজে হাত লাগাও।

ফ্রান্সিস সেনাপতি আরতার দলের লোকেদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–আপনাদেরও হাত লাগাতে হবে।

সেনাপতি আর তার সঙ্গীরা মুখ গোমড়া করে সকলের সঙ্গে চলল। ফ্রান্সিস আবার তার বন্ধুদের বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে, এটা সেনাপতির দলের কাছে ভাল লাগল না। ওরা ধান্ধায় রইল, কি করে ফ্রান্সিসকে অপদস্থ করা যায়।

জাহাজ থেকে কাঠের তক্তা নামানো হল। হালের জায়গাটায় যেখানে খোঁদল হয়ে গেছে, সেই জায়গাটা জোড়া দেবার কাজ চলল! নির্জন সমুদ্রতীর মুখর হয়ে উঠল ওদের হাঁকডাক কথাবার্তায়।

পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল–ওটা কি? তার কণ্ঠে বিস্ময়। তার কথা যাদের কানে গেল, তারা ঘুরে লোকটার দিকে তাকাল। কি ব্যাপার? লোকটা আঙুল তুলে সেই মরুভূমির মত ধু-ধু বালির দিগন্ত দেখাল। সত্যিই তো। দিগন্ত রেখার একটু উঁচুতে কি যেন চিকচিক করছে, একটা, দুটো, তিনটে, অনেকগুলো। চিকচিক করছে যে জিনিসগুলো, সেগুলো চলন্ত। এদিকেই লোকটা আঙ্গুল তুলে সেই মরুভূমির মত। এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে সবাই সেদিকে তাকাল। ধু-ধু বালির দিগন্ত দেখাল। সকলের চোখেমুখেই বিস্ময়। ওগুলো কি?

সবাই ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি জাহাজ থেকে ঝোলানো দড়ি বেয়ে জাহাজে উঠেপড়ল। রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দিগন্ত রেখার দিকেভুরু কুঁচকেতাকিয়ে খুব নিবিষ্টমনে দেখতে লাগল। একটু পরে নিচের দিকে তাকিয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বলতে লাগল–একদল সৈন্য আসছে কালো ঘোড়ায় চেপে। ওদের পরনেও কালো পোশাক। ওদের গলায় লকেটের মত কিছু ঝুলছে। লকেটে সূর্যের আলো পড়েছে, তাই চিকচিক করছে। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আর সবাইও এতক্ষণে দেখতে পেল, একদল অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বালির ঝড় তুলে ওদের দিকেই ছুটে আসছে।

ফ্রান্সিস দড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। এখন কি করা? সকলেই ফ্রান্সিসের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস মাথা নীচু করে গম্ভীরভাবে চিন্তা করল। তারপর মুখে তুলে চীৎকার করে বললো–ওরা লড়তে চাইলে আমরাও লড়ব।

সবাই সমস্বরে হইহই করে উঠল। চীৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। এবার অস্ত্র সংগ্রহ। সেনাপতি আর তার দলের লোকদের তরবারিগুলো জাহাজ থেকে আনা হল। তাছাড়া যাদের তরবারি ছিল, তারাও সেগুলো নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস সেনাপতি আর দলের লোকদের তরবারিগুলো বেছে বেছে কয়েকজনের হাতে দিলো। বাদ-বাকিরা হাতের কাছে যে-যা পেল জোগাড় করে নিয়ে এল। ভাঙা দাঁড়, লোহার শেকল, কুড়ুল, লোহার বড়-বড় পেরেক, কাঠের খুঁটি–এসব যে যা পেল, হাতে নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়াল।

সৈন্যদল ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস হিসেব করে দেখল সৈন্যরা সংখ্যায় ওদের চেয়ে বেশি নয়। সমানই হবে। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলল–সবাই তৈরি থাকো, কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত কেউ এগিয়ে যাবে না। ওরা ঘোড়ায় যুদ্ধ করবে, ওদেরই সুবিধে বেশি। আমাদের প্রথম কাজই হবে, যেভাবে হোক ওদের মাটিতে ফেলে দেওয়া। তাহলেই জিত আমাদের।

সৈন্যদল অনেক কাছে এসে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওদের।

কালো পোশাক পরনে। গলায় ঝুলছে চকচকে লকেট। আরো কাছে! ফ্রান্সিস ওদের ঘোড়া ছোটানোর ভঙ্গি দেখেই বুঝল, ওরা বন্ধুত্ব করতে আসছে না। ওদের লক্ষ্য যুদ্ধ। হঠাৎ ফ্রান্সিসের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–এগোও–আক্রমণ করো–

প্রচণ্ড কোলাহল উঠল ভাইকিংদের মধ্যে। চীৎকার করতে-করতে সবাই ছুটল সৈন্যদলের দিকে।

প্রথম সৃংঘর্ষেই বেশ কিছু সৈন্য ঘোড়া থেকে বালির ওপর পড়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যেও আহত হ’ল কয়েকজন। ভাইকিং অশ্বারোহী সৈন্যদের পায়ে তরোয়াল বিঁধিয়ে দিতে লাগল। ভাঙা দাঁড়, পেরেক, কুড়ুল দিয়ে ওদের পেছনে আঘাত করতে লাগল। আরও কিছু সৈন্য বালির ওপর পড়ে গেল। এবার শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ। ফ্রান্সিসের বাছাই করা দল নিপুণ হাতে তরোয়াল চালাতে লাগল। সৈন্যরা কিছুতেই ওদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। একে-একে সৈন্যরা প্রায় সবাই মারা গেল, নয়তো মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে বালির ওপর শুয়ে-শুয়ে গোঙাতে লাগল। জনা দশেক যারা বেঁচেছিল, ঘোড়ার পিঠে উঠে তারা পালাতে শুরু করল। ভাইকিংরা হইচই করে তাদের তাড়া করলো। অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল। ভাইকিংদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবাই আনন্দে চীৎকার করতে লাগল–কেউ নাচতে লাগল, কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরল। যুদ্ধে জয়ের উত্তেজনা স্তিমিত হতে সবাই আবার জাহাজ মেরামতির কাজে হাত লাগাল। আবার কাজ চালালো।

হঠাৎ চিকচিক্–বালির দিগন্ত রেখায় আবার লকেটের ঝিকিমিকি। ফ্রান্সিস হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছিল। হ্যারি পেরেক এগিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ হ্যারি ডাকল–ফ্রান্সিস।

–কি?

–ওদিকে চেয়ে দেখ।

ফ্রান্সিস ফিরে তাকাল। দেখলো, দিগন্তরেখার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অজস্র লকেটের ঝিকিমিকি। এতক্ষণে সবাই দেখল। কাজ ফেলে দিয়ে ফ্রান্সিসের কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়াল। সবাই উত্তেজিত–লড়াই হবে। একটু আগেই একটা লড়াইতে জিতেছে। সেই জয়ের উন্মাদনা এখনও কাটেনি। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। বালির ঝড় তুলে এগিয়ে আসছে কালো পোশাক পরা সৈন্যবাহিনী। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে লকেটগুলো। উত্তেজিত ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কারও উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল–লড়বো আমরা, পরোয়া কিসের? সবাই চীৎকার করে উঠল–ও-হো-হো।

ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। গভীরভাবে কি যেন ভাবল। তারপর মুখ তুলে সকলের দিকে তাকাল। গুঞ্জন থেমে গেল। সবাই উৎসুক হলো–ফ্রান্সিস কি বলে?

ফ্রান্সিস হাত থেকেহাতুড়িটা বালির ওপর ফেলে দিল। বলল না, আমরা লড়াই করবনা।

ফ্রান্সিসের এই সিদ্ধান্ত অনেকেরই মনঃপুত হল না। আবার গুঞ্জন শুরু হল। সেনাপতি তার দলের লোকদের নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে শলাপরামর্শ করছিল। এবার সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল। সেনাপতি বলল–ফ্রান্সিস, তুমি ভীরু কাপুরুষ, ভাইকিংদের কলঙ্ক। ভিড়ের মধ্যে কেউ-কেউ চীৎকার করে সেনাপতিকে সমর্থন করল। ফ্রান্সিস শান্তস্বরে বলল আমাকে যা খুশি বলতে পারেন, কিন্তু এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে আমি ছিনিমিনি খেলতে পারব না।

–লড়তে গেলে প্রাণ নিতেও হবে, দিতেও হবে। তাই বলে কাপুরুষের মত আগে থাকতে হার স্বীকার করে বসে থাকবো? সেনাপতি ক্রুদ্ধস্বরে বলল।

ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে থাকা সৈন্যবাহিনীকে দেখাল–বলল আন্দাজ করতে পারেন ওরা সংখ্যায় কত?

–যতই হোক আমরা লড়ব।

–সাধ করে নিশ্চিত মৃত্যুকে ডেকে আনছেন।

–তুমি ভীরু দুর্বল।

–বেশ আমার বন্ধুরা কি বলে শোনা যাক।

ফ্রান্সিস ভাইকিংদের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব, আমি কাপুরুষ নই। তোমরা যদি লড়তে চাও, আমিও তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করব। কিন্তু তোমরা একটু ভেবে দেখ যদি ওরা আমাদের বন্দী করেও নিয়ে যায়, তবু সময় আর সুযোগ বুঝে আমরা পালাতে পারব। কিন্তু একবার এই লড়াইয়ে নামলে আর পালাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই লড়াইতে আমরা কেউ বাঁচবো না।

সবাই ফ্রান্সিসের কথা মন দিয়ে শুনল। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–তোমরা হয়তো ভাবতে পারো লড়াই না করে তার স্বীকার করা কাপুরুষের কাজ। আমি বলল–না! শুধু কবজির জোরে লড়াই হয় না, সঙ্গে বুদ্ধির জোরও চাই। আজকে আমরা লড়ব না, কিন্তু পরে লড়তে আমাদের হবেই, শত্রুর দুর্বলতার মুহূর্তে। একেই বলে বুদ্ধির লড়াই।

সবাই চুপ করে রইল। শুধু সেনাপতি গজরাতে লাগল–আমরা ভাইকিং, এভাবে হার স্বীকার করা আমাদের পক্ষে লজ্জার কথা। কিন্তু কেউ তাকে সমর্থন করল না। সেনাপতির দলের লোকেরা গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে তারা চুপ করে গেল।

সেই কালো পোশাক পরা সৈন্যদল কাছাকাছি এসে ঘোড়ার চলার গতি কমিয়ে দিল। সারবন্দী হয়ে ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। ওদের সেই সারি থেকে দুজনকে সকলের আগে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ফ্রান্সিস চমকে উঠল–একি! সুলতান আর রহমান। তাহলে জাহাজ ডুবি হয়েও যে ভাসতে ভাসতে যেখানে এসেছিলে, এবার জাহাজটাও সেইখানে এসেই ঠেকেছে।

সুলতান এবং ফ্রান্সিস দুজনেই দুজনকে দেখতে পেলেন। ফ্রান্সিসের সামনে ঘোড়া থামিয়ে সুলতান ক্রুর হাসি হাসলেন–এই যে, পুরোনো বন্ধু দেখছি।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। সুলতান বললেন—হ্যাঁ ভালো কথা, দুর্গের সেই জানালাটায় গরাদ লাগানো হয়েছে।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। সুলতান তরোয়াল খুলে সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন–সব কটাকে বেঁধে নিয়ে চলো।

সৈন্যদল থেকে কিছু সৈন্য ঘোড়া থেকে নেমে এল। সবাইকে সারি বেঁধে দাঁড় করাল। জাহাজে যারা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তাদেরও এনে সারিতে দাঁড় করানো হল। সকলের বাঁধা হাতের ফাঁক দিয়ে একটা লোহার শেকল টেনে নেওয়া হল। শেকলটার দুই মাথা দুজন অশ্বারোহী সৈন্যের হাতে রইল। পেছনে চাবুক হাতে একজন অশ্বারোহী সৈন্য চলল। বন্দীরা বালির উপর দিয়ে হেঁটে চলল। কেউ দল থেকে একটু পেছলেই চাবুকের ঘা পড়তে লাগল।

পায়ের নীচে বালি তেঁতে উঠেছে। গরম হাওয়া ছুটছে। এর মধ্য দিয়ে বন্দীরা চলল। কেউ-কেউ ভাবল, এই অপমানের চেয়ে লড়াই করা অনেক ভাল ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। এখন ওরা বন্দী। বন্দীদের নিয়ে সুলতান যখন আমদাদ শহরে এসে পৌঁছলেন, তখন সূর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে।

আমদাদ শহরের রাস্তার দুপাশে ভিড় জমে গেল। সবাই অবাক হয়ে ভাইকিং বন্দীদের দেখতে লাগল। মরুভূমির ওপর দিয়ে এতটা পথ ওরা হেঁটে এসেছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে। পা দুটো যেন পাথরের মত ভারী। শরীর টলছে। অথচ দাঁড়াবার উপায় নেই, বসবার উপায় নেই। অমনি সপাং করে চাবুকের ঘা এসে পড়ছে।

দলের মধ্যে শুধু ফ্রান্সিসই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। একবারও পিছিয়ে পড়েনি। ওর মুখে ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। কারণ বাইরের কোন কিছুই তাকে ছুঁতে পারছে না। ওর মাথায় শুধু চিন্তা আর চিন্তা কি করে পালানো যাবে। এতগুলো মানুষের জীবনের দায়িত্ব তার ওপর, সে নিশ্চিন্ত থাকে কি করে?

সুলতানের প্রাসাদে যখন ওরা পৌঁছল, তখন সন্ধ্যে হয়-হয়। প্রাসাদের সামনের চত্বরে, একপাশে ঘোড়াশালের কাছে বন্দীদের বসতে বলা হল। সুলতান প্রাসাদের মধ্যে চলে গেলেন। রহমান কয়েকজন সৈন্যকে ডেকে পাঠাল। চত্বরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা কি সব পরামর্শ করতে লাগল। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ফ্রান্সিসের দলের সবাই কাতর হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হ্যারি এমনিতে অসুস্থ ছিল, এখন প্রায় অজ্ঞানের মত হয়ে গেল।

যে সৈন্য ক’জন ওদের পাহারা দিচ্ছিল, ফ্রান্সিস তাদের একজনকে কাছে ডাকল। সৈন্যটি কাছে এলে ফ্রান্সিস রহমানকে দেখিয়ে বলল–ওকে ডেকে দাও। পাহারাদার ফ্রান্সিসের কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনি ভঙ্গিতে খোলা তরোয়াল হাতে যেমন হেঁটে বেড়াচ্ছিল, তেমনি হেঁটে বেড়াতে লাগল। ফ্রান্সিস চীৎকার করে বলে উঠল–পেয়েছ কি আমাদের? আমরা জন্তু-জানোয়ার? এতদূর পথ চাবুক খেতে-খেতে হেঁটে এসেছি। আমাদের খিদে পায় না, তেষ্টা পায় না?

ফ্রান্সিসের কথা শেষ হওয়া মাত্র তার দলের লোকেরা হইহই করে উঠে দাঁড়াল। পাহারাদার। সৈন্যটা বেশ ঘাবড়ে গেল। কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।

এখানকার চীৎকার হইচই রহমানের কানে গেল। সে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। সব শুনে সে তখনি একজন সৈন্যকে সুলতানের কাছে পাঠাল। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললো সবই বুঝতে পারছি, কিন্তু সুলতানের হুকুম না হলে কিছুই দেবার উপায় নেই।

–তাহলে ক্ষুধায় তেষ্টায় আমরা মারা যাই, এই চান আপনারা?

–সুলতান যদি তাই চান, তবে তাই হবে।

ফ্রান্সিসের দলের লোকেদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জাগল। শেকলে ঝনঝন শব্দ উঠল। কিন্তু কিছুই করবার নেই। তাদের হাত বাঁধা। শেকলের দুটো মুখ দেয়ালে গাথা। সেই সৈন্যটা ফিরে এল। সুলতান বোধহয় অনুমতি দিয়েছে। রহমান জল আর খাবার আনতে হুকুম দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার এল। পিঁপে ভর্তি জল এল।

খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়ল। চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে। শুধু কয়েকজন মিস্ত্রীর হাতুড়ি পেটানোর শব্দে মাঝে-মাঝে ওদের ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। মিস্ত্রীরা মোটা মোটা কাঠ পুঁতে কাটা তার দিয়ে ঘিরে দিলো জায়গাটা। এটাই হল ভাইকিংদের বন্দীশালা। বন্দীশালা তৈরী হলে সকলের হাত খুলে দেওয়া হল। বাইরে খিলানওয়ালা দরজার পাশেও মিস্ত্রীরা কাজ করছিল। ফ্রান্সিসের দলের লোকেরা কেউ জানতে পারেনি যে, ওখানে মিস্ত্রীরা একটা ফাঁসিকাঠ তৈরী করছিলো।

রাত্রি গভীর হলো। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু মিস্ত্রীদের হাতুড়ি ঠোকার শব্দ সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিচ্ছিল। ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। দু’হাতে মাথা রেখে সে ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চিন্তার যেন শেষ নেই। হঠাৎ একজন পাহারাদার কাঁটাতারের দরজার কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করল–ফ্রান্সিস কে?

কেউ কোন উত্তর না দিতে লোকটা আবার বললো–ফ্রান্সিস কে?

প্রশ্নটা কয়েকজনের কানে যেতে তারা বললো–ফ্রান্সিসকে কেন?

–সুলতান ডেকেছেন।

এইসব কথাবার্তা কানে যেতে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। সে যাবার জন্যে পা বাড়াল। কিন্তু যাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তারা ফের চেঁচিয়ে বলল না ফ্রান্সিস যাবে না। সুলতানকে হয় এখানে আসতে বল।

চিৎকার আর কথাবার্তায় অনেকেরই ঘুম ভেঙে গেল। তারা সবাই একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়ে বললো–না, ফ্রান্সিস একা যাবে না।

এবার কাঁটাতারের দরজার কাছে রহমানের মুখ দেখা গেল। সে হেসে বলল–আমি ফ্রান্সিসকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমাদের ভয় নেই, ওর কোন ক্ষতি হবে না।

ফ্রান্সিস হাত তুলে সবাইকে শান্ত করল। পাহারাদার। কাঁটাতারের দরজার তালা খুলে দিল। ফ্রান্সিস বাইরে এসে, রহমানের সামনে এসে বললো–চলুন।

রহমান ওকে সঙ্গে নিয়ে চলল। প্রাসাদে ঢোকার আগে রহমান একবার দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল–সুলতান তোমায় ডাকেননি।

–তবে?

–সুলতানের বেগম তোমাকে ডেকেছেন।

–সুলতানের বেগম তোমাকে ডেকেছেন।

ফ্রান্সিস আশ্চর্য হল। বেগমের উদ্দেশ্য কি? কিন্তু–ফ্রান্সিস বলল–আমার মত একজন বিদেশীকে–

–বেগমের সঙ্গে কথা হোক, তাহলেই জানতে পারবে।

সুসজ্জিত ঘরের পর ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলে এল ওরা। অন্দরমহলের জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মেঝের দেয়ালে জাফরী কাটা জানালায় কি সুন্দর কারুকাজ! একসময়ে সিঁড়ি বেয়ে ওরা একটা পুকুরের সামনে এসে দাঁড়াল। পুকুরের চারিদিক শ্বেত পাথরে বাঁধানো। কাঁচের মত শান্ত জল টলটল করছে। পুকুরের ওপাশে বাগানে ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে গেছে। বাগানের কাছে একটা দোলনা রূপোর শেকলে বাঁধা। দোলনায় কে যেন বসে আছে। রহমান ফিস ফিস করে বলল–বেগমসাহেবা দোলনায় বসে আছেন।

–একা?

–হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎটা খুবই গোপনীয়।

বেগম সাহেবার কাছে গিয়ে রহমান আদাব করে সরে এল। ফ্রান্সিসও রহমানের দেখাদেখি আদাব করল। এখানে মশালের ক্ষীণ আলো এসে পৌঁছেছে, তাতে স্পষ্ট বেগমসাহেবার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তবু ফ্রান্সিস বুঝল, বেগমসাহেবা অপরূপা সুন্দরী। ভুরু দুটো যেন তুলিতে আঁকা। টানা লাল ঠোঁটের পাশে একটা তিল। মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠেছে বেগমের পোশাকের সোনার কারুকাজ করা নকশাগুলো।

-–তুমিই ফ্রান্সিস? সুরেলা গলায় বেগমসাহেবা প্রশ্ন করলেন।

–হ্যাঁ, –ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল।

–তুমি জানো সোনার ঘন্টা কোথায় আছে?

–না।

–কিন্তু সুলতান বলেন, তুমি নাকি সব জানো।

–আমি যা জানি সুলতানকে বলেছি।

–সেই মোহর দু’টোর কথাও বলেছো?

–কোন মোহর?–ফ্রান্সিস আশ্চর্য হল।

–তোমার কাছে যে দুটো মোহর ছিল।

–তার একটা বিক্রি করে দিয়েছি, আর একটা চুরি হয়ে গেছে।

–তুমি জানো, এ দুটো মোহরের একটাতে সেই সোনার ঘন্টার দ্বীপে যাওয়ার, অন্যটাতে ফিরে আসার নকশা খোদাই করা ছিল।

–না, আমি জানতাম না।

–তুমি মিথ্যে কথা বলছে। মোহর দুটো তোমার কাছেই আছে।

ফ্রান্সিসের বেশ রাগ হলো। সে গম্ভীর স্বরে বলল–আমি মিথ্যে কথা বলছি না, বেগম সাহেবা।

–তোমার মৃত্যু তুমি নিজেই ডেকে আনছে।

–তার মানে?

–দেউড়ির খিলানে এতক্ষণে ফাঁসিকাঠ তৈরি হয়ে গেছে।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল–তাহলে আমাকে–

-হ্যাঁ, তোমাকে কাল সকালে ফাঁসি দেওয়া হবে।

ফ্রান্সিস কোন কথা বলতে পারল না। একবার মনে হলো, বেগমের কাছে সে প্রাণ ভিক্ষা করে। পরক্ষণেই মনে হল, না আমরা ভাইকিং। আমাদের মৃত্যু ভয় থাকতে নেই।

–আমার বন্ধুদের কী হবে?

–তারা বন্দী থাকবে।

ফ্রান্সিসের মন শান্ত হল। যাক, আমার বন্ধুরা তো বেঁচে থাকবে। বেগম সাহেবা কি যেন ইঙ্গিত করলেন। রহমান এগিয়ে এসে আদাব করল। মৃদুস্বরে ফ্রান্সিসকে বলল–চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *