সোনার ঘণ্টা – ২

বালিতে কয়েকটা মশাল পুঁতে রাখা হয়েছে। চারদিকে ভীড় করে দাঁড়িয়েছে মরুদস্যু দলের লোকেরা। পরিষ্কার আকাশে লক্ষ তারার ভিড়। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে বালিতে ফুটফুটে চাঁদের আলো।

ফ্রান্সিসকে আসতে দেখে মরু-দস্যুদলের ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। ওরা ভিড় সরিয়ে পথ করে দিল। ফ্রান্সিস সহজ ভঙ্গিতে ভিড়ের মাঝখানকার ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়াল। একদিকে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, তার নিচে সর্দার বসে আছে। সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে, কাসেম। হাতে খোলা তরোয়ালে মশালের আলো পড়ে চকচক করছে। মশালের আলো কাঁপছে তার টকটকে লাল আলখাল্লায়। ওকে দেখতে আরো বীভৎস লাগছে। ফ্রান্সিস তখনও খাপ থেকে তরোয়াল খোলেনি।

ফজলকে ডেকে সর্দার কি যেন বলল। ফজল কাসেমকে ফাঁকা জায়গার মাঝখানে এগিয়ে আসতে বলল। ফ্রান্সিসকেও ডাকল। ফ্রান্সিস এবার তরোয়াল খুলল। তারপর পায়ে-পায়ে এগিয়ে কাসেমের মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম মুখোমুখি দাঁড়াল। সর্দার হাততালি দিয়ে কি একটা ইঙ্গিত করতেই কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। কাসেমের তরোয়ালের আঘাত ঠেকাল বটে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে বালির ওপর বসে পড়ল। ভিড়ের কাসেম তরোয়াল উঁচিয়ে মধ্যে থেকে হাসির হররা উঠল। আবার কাসেম তরোয়াল ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চালাল। এবারও একই ভঙ্গীতে ফ্রান্সিস কাসেমের তরোয়ালের ঘা থেকে আত্মরক্ষা করল। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে কাসেমকে লক্ষ্য করে তরোয়াল চালাল। শুরু হল দুজনের লড়াই। বিদ্যুৎগতিতেই দু’জনের তরোয়াল ঘুরছে। মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় চকচক করছে তরোয়ালের ফলা। ঠং-ঠং ধাতব শব্দ উঠছে তরোয়ালের ঠোকাঠুকিতে।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মরুদস্যুর দল দেখতে লাগল এই তরোয়ালের লড়াই। কেউ কম যায় না। দুজনেরই ঘন-ঘন শ্বাস পড়তে লাগল। কপালে ঘামের রেখা ফুটে উঠল। হঠাৎ ফ্রান্সিসের একটা প্রচণ্ড আঘাত সামলাতে না পেরে বালিতে কাসেমের পা সরে গেল। কাসেম কাত হয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস এই সুযোগ ছাড়ল না। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে তরোয়াল চালাল। কাসেম মরীয়া হয়ে সে আঘাত ফেরাল। কিন্তু মুঠি আলগা হয়ে তরোয়াল ছিটকে পড়ল একটু দূরে। কাসেম চিৎহয়ে বালিতে পড়ে গেল, ফ্রান্সিস তরোয়াল নামিয়ে কাসেমের দিকে তাকাল। কাসেমের চোখেমৃত্যুভীতি। মুখ হাঁকরে সেশ্বাস নিচ্ছে তখন। ফ্রান্সিসও হাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সিস তরোয়ালের ছুঁচলো ডগাটা। কাসেমের লাল আলখাল্লায় বিঁধিয়ে একটা টান দিল। লাল আলখাল্লাটা দু’ফালি হয়ে গেল। বুকের অনেকটা জায়গা কেটেও গেল, রক্তে ভিজে উঠল আলখাল্লাটা। মরুদস্যুদের মধ্যে গুঞ্জনধ্বনি উঠল। কোনদিকে না তাকিয়ে ফ্রান্সিস চলল সর্দারের কাছে। ও তো জানে এক রকম দু’জনের মধ্যে তরোয়ালের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বেদুইনদের রীতি কী? সর্দার যা বলবে তাই সে করবে।

ফ্রান্সিস! ফজলের অস্পষ্ট সতর্ক কণ্ঠস্বর শুনে ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। ভোলা গা, উদ্যত তরোয়াল হাতে কাসেম ছুটে আসছে। ঠিক ওর মাথার ওপর কাসেমের তরোয়াল। পলকমাত্র সময় হাতে। ফ্রান্সিস উবু হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কাসেমের তরোয়াল নামল। বাঁ কাঁধে এক একটা তীব্র যন্ত্রণা। তরোয়ালের ঘা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ফ্রান্সিসের মাথায় খুন চেপে গেল। কাপুরুষ! ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। উন্মত্তর মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কাসেমের ওপর। কাঁধের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে আঘাতের পর আঘাত হানল। কাসেম সেই তীব্র আক্রমণের সামনে অসহায় হয়ে পড়ল। পিছিয়ে যেতে-যেতে কোনরকমে আত্মরক্ষা করতে লাগল। কিন্তু বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না সেই আক্রমণের মুখে। তার হাত অবশ হয়ে এল। উপুর্যপরি কয়েকবার আঘাত হেনে সুযোগ বুঝে ফ্রান্সিস বিদ্যুৎবেগে তরোয়াল চালাল কাসেমের বুক লক্ষ্য করে। কাসেমের গলা দিয়ে শুধু একটা কাতরধ্বনি উঠল। পরক্ষণেই সে বালির ওপর লুটিয়ে পড়ল। বুকে বেঁধা তরোয়ালটা টেনে খোলবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর শরীর স্থির হয়ে গেল। ফ্রান্সিস বালিতে হাঁটু গেড়ে বসে তখনও হাঁপাচ্ছে।

তরোয়াল যুদ্ধের এই ফলাফল দস্যুদলের কেউই আশা করেনি। কারণ, এর আগে কাসেমের সঙ্গে তরোয়ালের যুদ্ধে হেরে গিয়ে অনেককেই তারা মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে। তরোয়াল যুদ্ধে কাসেম ছিল অজেয়। সেই কাসেম আজ একজন ভিনদেশীর কাছে শুধু হার স্বীকার করা নয়, একেবারে মৃত্যুবরণ করবে, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। দস্যুদলে কাসেমের অনুগামীর সংখ্যা কম ছিল না। তারা দল বেঁধে খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে গেল। ফ্রান্সিসকে ঘিরে ধরল তারা, কিন্তু ফ্রান্সিসকে আক্রমণ করবার আগেই সর্দার উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে থামতে ইঙ্গিত করল, তারপর ধীর পায়ে নিজের তাঁবুতে ফিরে গেল।

কাঁধের যন্ত্রণাটা অনেকখানি কমেছে। একটু আগে সর্দার একজন লোক পাঠিয়েছিল। এই দলে হেকিমের কাজ করে লোকটা। কি একটা কালো আঠার মত ওষুধ ক্ষতস্থানে লাগিয়ে ন্যাড়া দিয়ে বেঁধে দিল। রক্ত পড়া বন্ধ হল। একটু পরে ব্যথাটা কমতে শুরু করল। কিন্তু ফ্রান্সিসের চোখে ঘুম নেই। অনেক রাত পর্যন্ত ও জেগে রইল। দেশ ছেড়েছে কতদিন হয়ে গেল, তারপর জাহাজে নাবিকের জীবন বন্ধু জ্যাকব’ জাহাজডুবি, সোনার ঘন্টার ঢংঢং শব্দ, আর আজ কোথায় এসে পড়েছে। নাঃ, এখান থেকে পালাতে হবে। ছেলেবেলা থেকে যে সোনার ঘন্টার স্বপ্ন ও দেখেছে, তার হদিশ পেতেই হবে। ভাবতে ভাবতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ একটা আর্ত চীৎকারে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। কে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল। কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। ফ্রান্সিস কান পেতে রইল। আবার চীৎকার। ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল।

ভোর হয়–হয় সূর্য উঠতে আর দেরি নেই। আবছা আলোয় ফ্রান্সিস দেখল–চার পাঁচজন ঘোড়সওয়ার দস্যু কাকে যেন দড়িতে হাত বেঁধে বালির ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। লোকটা হাতে বাঁধা দড়িটা টানছে। কাকুতি মিনতি করছে। ফ্রান্সিস সেই আবছা আলোতেও চিনল। লোকটা আর কেউ না–ফজল। কিন্তু ফজলকে ওরা কোথায় নিয়ে চলেছে? হঠাৎ ঘোড়াগুলো ছুটতে শুরু করল। ফজল বালির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল। পৈশাচিক আনন্দে ওরা ফজলকে বালির ওপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিস বুঝতে পারল–ফজল ওকে সাহায্য করেছে–প্রাণে বাঁচিয়েছে। সেই অপরাধের শাস্তিটা ওকে পেতে হচ্ছে। ও আর দাঁড়াল না। যে করেই হোক ফজলকে বাঁচাতে হবে। তাঁবুতে ফিরে এসে পোশাক পরে নিল। কোমরে তরোয়াল বাঁধলো। তারপর নিঃসাড়ে খেজুর গাছে বাঁধা ঘোড়াটাকে খুলে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। নিজে চলল ঘোড়াটার আড়ালে। জলাশয়ের ওপাশ দিয়ে কিছুটা এগোতেই একটা উঁচু বালিয়াড়ির পেছনে মরুদ্যানটা আড়াল পড়তে ঘোড়ার পিঠে উঠে বালি উড়িয়ে ঘোড়া ছোটাল।

সূর্য উঠল। সকালের রোদে তেজ কম। তাই ফ্রান্সিসের পরিশ্রম হচ্ছিল কম। বেশী দূর যেতে হল না। ফ্রান্সিস দেখল–একটা নিঃসঙ্গী খেজুর গাছে ফজলের হাত বাঁধা দড়িটার একটা কোণা বাঁধা রয়েছে। আর ফজলকে ওরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ফজলের হাত বাঁধা। পা ছুঁড়ে নানাভাবেও বাধা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওদের সঙ্গে পারবে কেন?ফ্রান্সিস ঘোড়া ছুটিয়ে সেই দস্যুগুলোর কাছাকাছি আসতেই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ও শিউরে উঠল। কি সাংঘাতিক। ফজলকে ওরা চোরাবালিতে ঠেলে ফেলে দিতে চাইছে। চোরাবালিতে আটকে গেলেই গাছের সঙ্গে বাঁধা ফজলের হাতের দড়িটা কেটে দেবে। ফ্রান্সিসের অনুমানই সত্যি হল। ফজলের একটা মর্মান্তিক চীৎকার ওর কানে এল। দেখল–ফজলকে ওরা এমন সময় একজন দস্য মাথার ওপর চোরাবালিতে ঠেলে দিয়েছে। ফজল প্রাণপণ শক্তিতে তরোয়াল তুলল দড়িটা কাটবার জন্য। গাছের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা টেনে ধরে চোরাবালি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। এমন সময় একজন দস্যু মাথার ওপর তরোয়াল তুললো দড়িটা কাটবার জন্যে। এক মুহূর্ত। দড়িটা কেটে গেলে ফজল চোরাবালির অতল গর্ভে তলিয়ে যাবে। ওর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ফ্রান্সিস উল্কার বেগে ঘোড়া ছোটাল। তারপর চলন্ত ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে সেই দস্যুটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দড়ি আর কাটা হল না। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না। ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল। শুধু ডান হাতেই তাকে টানতে হচ্ছিল। কারণ বাঁ হাতটা তখনও প্রায় অবশ হয়ে আছে। দুটো তিনটে হ্যাঁচকা টান মারতেই ফজল চোরাবালির গহ্বর থেকে শক্ত বালিতে উঠে এল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। বালিতে শুয়ে পড়ল। এতক্ষণের শারীরিক নির্যাতন, তার ওপর এই মৃত্যুর বিভীষিকা, এই সবকিছু তার দেহমনের শেষ শক্তিটুকু শুষে নিয়েছিল।

এত অল্প সময়ের মধ্যে এত কাণ্ড ঘটে গেল। দস্যুর দল কি করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফজলকে চোরাবালি থেকে উঠে আসতে দেখে ওদের টনক নড়ল। এবার ফ্রান্সিসকে ঘিরে ধরল। ফ্রান্সিস একবার চারদিক থেকে ঘিরে ধরা দস্যুদের মুখের দিকে তাকাল। তারপর চীৎকার করে বলে উঠল ফজল আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। যে ওর গায়ে হাত দেবে, আমি তাকে দু’টুকরো করে ফেলবো।

ফ্রান্সিসের সেই ক্রোধোন্মত্ত চেহারা দেখে দস্যুরদল বেশ ঘাবড়ে গেল। এটা যে ফ্রান্সিসের শূন্য আস্ফালন নয়, সেটা ওরা বুঝল। গত রাত্রে তার প্রমাণও পেয়েছে ওরা। কাজেই ফ্রান্সিসকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস করল না। নিজেদের মধ্যে ওরা কী যেন বলাবলি করল। তারপর ঘোড়া ছোটালো সেই মরুদ্যানের দিকে। যতক্ষণ ওদের দেখা গেল ফ্রান্সিস তাকিয়ে রইল। তারপর দ্রুতপায়ে ফজলের কাছে এল। জলের পাত্রটা খুলে ফজলের চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে দিল। ফজল দু’একবার চোখ পিটপিট করে ভালোভাবে তাকাল। মুখ হাঁ করে জল খেতে চাইল। ফ্রান্সিস ওর মুখে আস্তে আস্তে জল ঢেলে দিতে লাগল। জল খেয়ে ফজল যেন একটু সুস্থ হল। ফ্রান্সিস ওর হাতের দড়িটা কেটে দিল। তারপর ডাকল ফজল।

ফজল ম্লান হাসল। ফ্রান্সিস বললো–চলো–ঘোড়ায় বসতে পারবে তো?

ফজল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ফ্রান্সিস ওকে ধরেধরে কোনরকমে ঠেলেঠুলে ঘোড়ার ওপর বসিয়ে নিল। তারপর নিজে লাফিয়ে উঠে পেছনে বসল। আর সময় নষ্ট না করে ঘোড়া ছোটাল। এ জায়গাটা ছেড়ে পালাতে হবে। বলা যায় না, হয়তো দলে ভারী হয়ে ওরা এখানে আসতে পারে। হলোও তাই। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে দেখল বালির দিগন্ত রেখায় কালো বিন্দুর মত কালো ঘোড়সওয়ার দস্যুর দল ছুটে আসছে।

ফজল এতক্ষণে যেন গায়ে জোর পেল। ও একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।

–তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে ভাই।

ফ্রান্সিস হেসে বললো, এখনও আমাদের প্রাণের ভয় যায় নি ফজল।

–কেন?

–পেছনে তাকিয়ে দেখ।

ফজল ফিরে তাকাল। ধুলো উড়িয়ে দূরন্ত বেগে ছুটে আসছে মরুদস্যুর দল। একে অসুস্থ ফজলকে ধরে রাখতে হচ্ছে, তার ওপর কাঁধের কাটা জায়গাটার যন্ত্রণা। ফ্রান্সিস খুব জোরে ঘোড়া ছোটাতে পারছিল না। ক্রমেই মরুদস্যুদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান কমে আসছিল।

–ফ্রান্সিস? ফজল ডাকল।

–হুঁ–

সামনের ঐ যে পাহাড়ের মত একটা বালির ঢিবি দেখছো?

-–হুঁ।

–ঐ টিবিটার ওপাশেই একটা মরুদ্যান আছে।

–ওখানেই যাবে?

–না…. না। ঐ ঢিবিটার আড়ালে আড়ালে আমরা ডানদিকে বাঁক নেব।

–কিন্তু–

–এছাড়া বাঁচবার কোন পথ নেই। ওরা ধরেই নেবে আমরা নিশ্চয়ই ঐ মরুদ্যানে আশ্রয় নেব, কারণ আমরা দুজনেই অসুস্থ–বেশীদূর যেতে পারবো না।

–তা ঠিক।

–কাজেই আমাদের আশ্রয়ের জন্যে অন্য কোথাও যেতে হবে।

–কোথায় যাবে সেটা বলো–

–ডানদিকে মাইল কয়েক গেলেই আমদাদ শহর। একবার ঐ শহরে ঢুকতে পারলে তোমার আর কোন ভয় নেই।

–কেন?

–ওরা অনেকেই দাগী দস্যু–সুলতানের সৈন্যরা চিনে ফেলবে, এইজন্যে ওরা, আমদাদ শহরে ঢুকবে না।

–কিন্তু তুমি?

–আমি আর কোথাও আস্তানা খুঁজে নেব।

কথা বলতে বলতে ওরা পাহাড়ের মত উঁচু বালির ঢিবিটার আড়াল দিয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটাল। অনেকদূর পর্যন্ত আড়াল পেল ওরা। এক সময় ঢিবিটা শেষ হয়ে গেল। সামনে অনেক দূরে দেখা গেল হলদে-সাদা রঙের লম্বা প্রাচীর। ফজল বলল–এই হচ্ছে আমদাদ শহর। আর ভয় নেই।

ফ্রান্সিস পেছনে তাকাল। ধূ-ধূ বালি। মরুদস্যুর চিহ্নমাত্র নেই।

আমদাদ শহরের প্রাচীরের কাছে এসে পৌঁছল ওরা। ফ্রান্সিস দেখল–শহরের পশ্চিমদিকে তামাটে রঙের পাথরের একটা পাহাড়। ফজল আঙুল দিয়ে পাহাড়টা দেখিয়ে বলল–ঐ পাহাড়ের নীচেই সুলতানের প্রাসাদ। আর পাহাড়ের ওপাশে সমুদ্র।

–সমুদ্র?–ফ্রান্সিস অবাক হল।

–হ্যাঁ, কেন বল তো?

–জাহাজডুবি হয়ে ভাসতে ভাসতে ঐ সমুদ্রের ধারেই এসে ঠেকেছিলাম। যদি সমুদ্রের ধারে ধারে পশ্চিমদিকে যেতাম, তাহলে আগেই এই শহরে এসে পৌঁছতাম।

–তুমি তাহলে উলটো দিকে গিয়েছিলে–মরুভূমির দিকে।

গম্বুজঅলা শহরের তোরণ। কাছাকাছি আসতেই ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা নজরে পড়ল। উটের পিঠে, ঘোড়ায় চড়ে শহরে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে। ফজল বলল–এবার ঘোড়া থামাও–আমি এখান থেকে অন্যদিকে চলে যাব।

ফ্রান্সিস ঘোড়া থামাল।

–ফ্রান্সিস। –ফজল ডাকল।

–হুঁ।

–তোমার তরোয়ালটা আমাকে দাও। ওপরের জামাটাও খুলে দাও।

–কেন? ফ্রান্সিস একটু অবাক হলো।

–এই পোশাক আর তরোয়াল নিয়ে শহরে ঢুকলে বিপদে পড়বে। এসব মরুদস্যুদের পোশাক। সুলতানের সৈন্যরা তোমাকে দেখলেই গ্রেফতার করবে। আর ভাই কিছু মনে করো না–তোমার ঘোড়াটা আমি নেব। কোথাও আশ্রয় তো নিতে হবে আমাকে।

–বেশ তো।

–আর একটা কথা।

–বলো।

–শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ, মদিনা মসজিদ। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। মদিনা মসজিদের বাঁ পাশের গলিতে কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে মীর্জা হেকিমের বাড়ি। দেখা করে বলো ফজল পাঠিয়েছে। বিনা খরচে তোমার জখমের চিকিৎসা হয়ে যাবে।

–সে হবে’খন কিন্তু তোমার জন্যে–

-–আমার জন্যে ভেবোনা। হ্যাঁ, ভালো কথা, ফজল কোমর বন্ধনীর মধ্যে থেকে একটা ছোট সবুজ রঙের রুমাল বের করল। রুমালের গিঁট খুলে দুটো মোহর বের করল। বলল–জানো ভাই, এই মোহর দু’টোর পেছনে ইতিহাস আছে। আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ ও বিরাট এক মরুদস্যু দলের সর্দার ছিল। একটা ক্যারাভ্যান লুঠ করতে গিয়ে সে এই মোহর দুটো পেয়েছিল। কিন্তু মজার কথা কি জানো। শুনেছি যে লোকটার কাছে মোহর দুটো ছিল, সে কিন্তু বণিক বা ব্যবসায়ী ছিল না।

–তবে?

–তার পরনে নাকি ছিল পাদরীর পোশাক।

–পাদ্রী? ফ্রান্সিস চমকে উঠল।

–হ্যাঁ–তোমাদের ওদিককার লোকই ছিল সে। দাড়ি গোঁফ–কালো জোব্বা পরনে। গলায় চেন বাঁধা ক্রশ।

–হ্যাঁ ঠিকই বলেছো–পাদ্রীই ছিল সে।

–কাণ্ড দেখ–ধর্ম-কর্ম করে বেড়ায়, তার কাছে সোনার মোহর।

–তারপর?

–তারপর থেকে মোহর দুটো বারবার পুরুষানুক্রমে আমাদের কাছেই ছিল। সবশেষে আমার হাতে এসে পড়ে। যাকগে–মোহর দুটো তুমিই নাও।

–না–না।

–ফ্রান্সিস–তুমি তো ঐ দেশেরই মানুষ। ডাকাতি করে পাওয়া জিনিস তুমি নিলে আমাদের পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে।

মোহর দুটো হাতে নিয়ে ফ্রান্সিস উলটে-পালটে দেখল। একদিকে একটা আবছা মাথার ছাপ। অন্যদিকে আঁকাবাঁকা রেখাময় নকশারমত কি যেন খোদাই করা। ফ্রান্সিস কোমরবন্ধনী একটু সরিয়ে মোহর দুটো রেখে দিল।

ঘোড়া থেকে নামল দুজন। ফ্রান্সিস ওর তরোয়াল আর ওপরের জামা খুলে দিল। হঠাৎ আবেগ কম্পিত হাতে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল ফজল। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগল। বোধহয় ফ্রান্সিসের কল্যাণ কামনা করলো। বিদায় জানিয়ে ফজল উঠল ঘোড়ার পিঠে। তারপর মরুভূমির দিকে ঘোড়া ছোটাল। ফজলের কথা ভেবে ফ্রান্সিসের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তোরণ পেরিয়ে আমদাদ শহরে ঢুকল। তারপর শহরের মানুষের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

আমদাদ শহরটা নেহাৎ ছোট নয়। ফ্রান্সিস বেশিক্ষণ ঘুরতে পারল না! কাঁধটা ভীষণ টনটন করছে। ব্যথাটা কমানো দরকার। ফ্রান্সিস খুঁজে খুঁজে মীর্জা হেকিমের বাড়িটা বের করল। দেউড়িতে পাহারাদার ওর পথ রোধ করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস অনুরোধ করল–ভাই আমি অসুস্থ, চিকিৎসার জন্যে এসেছি।

–সবাই এখানে চিকিৎসার জন্যেই আসে। গম্ভীর গলায় পাহারাদার বলল–আগে। হেকিম সাহেবের পাওনা জমা দাও–তারপর।

–আমি গরীব মানুষ—

–তাহলে ভাগো–পাহারাদার চেঁচিয়ে উঠল।

ফ্রান্সিস পাহারাদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল! লোকটা আঁতকে উঠল। কান কামড়ে দেবে নাকি? ফ্রান্সিস ফিসফিস করে বলল–হেকিম সাহেবকে বললো গেল–একজন রোগী এসেছে ফজল আলি পাঠিয়েছে।

–ফজল আলি কে?

–সে তুমি চিনবে না। তুমি গিয়ে শুধু এই কথাটা বলো।

–বেশ। পাহারাদার চলে গেল। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। তাড়াতাড়ি বলল–কিমুশকিল আগে বলবে তো ভাই। আমার চাকরি চলে যাবে। শীগগির যাও–হেকিম সাহেব তোমাকে ডাকছে।

ফ্রান্সিস মৃদু হেসে ভেতরে ঢুকল। কার্পেট পাতা মেঝে। ঘরের মাঝখানে ফরাস পাতা। তার ওপর হেকিম সাহেব বসে আছেন। বেশ বয়েস হয়েছে। চুল, ভুরু তুলোর মত সাদা। কানে কম শোনেন। কয়েকজন রোগী ঘরে ছিল। তাদের বিদায় দিয়ে ফ্রান্সিসকে ডাকলেন। ফ্রান্সিস সব কথাই বলল। মাথাটা এগিয়ে সব কথা শুনে জামাটা খুলে ফেলতে বললেন। ক্ষতস্থানটা দেখলেন। তারপর একটা কাঁচের বোয়াম থেকে ওষুধ বের করে লাগিয়ে দিলেন। একটা পট্টিও বেঁধে দিলেন। বললেন দিন সাতেকের মধ্যেই সেরে যাবে। ফ্রান্সিস কোমরে গোঁজা থলি থেকে একটা মোহর বের করল। তাই দেখে হেকিম সাহেব হাঁ-হাঁ করে উঠলেন –না না কিছু দিতে হবে না।

হেকিম সাহেবের বাড়ি থেকে ফ্রান্সিস এবার আমদাদ শহর ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগল। দেখার জিনিস তো কতই আছে। সব কি আর একদিনে দেখা যায়?সুলতানের শ্বেতপাথরের তৈরী প্রাসাদ। প্রাসাদের পিছনে সমুদ্রের ধারে খাড়া পাহাড়ের গায়ে দুর্গ, মন্ত্রীর বাড়ি, বিরাট ফুল বাগিচা, বাজার-হাট এসব দেখা হল। বেড়াতে বেড়াতে খিদে পেয়ে গেল খুব। কিন্তু খাবে কি করে? খাবারের দোকানে তো আর মোহর নেবে না। সুলতানী মুদ্রাও তো সঙ্গে কিছু নেই। ফ্রান্সিস একটা সোনা-রূপো দোকান খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল।

শুটকে চেহারার দোকানী খুব মনোযোগ দিয়ে পাথরে মোহরটা বার কয়েক ঘষল। তারপর জিজ্ঞেস করলে–এ সব মোহর তো এখানে পাওয়া যায় না–আসল জিনিষ। আপনি পেলেন কোথায়?

–ব্যবসার ধান্ধায় কত জায়গায় যেতে হয়।

–তা তো বটেই। যাকগে–আমি আপনাকে পাঁচশো মুদ্রা দিতে পারি।

–বেশ তাই দিন।

শুটকে চেহারার দোকানীটা মনে মনে ভীষণ খুশী হল। খুব দাঁও মারা গেছে। অর্ধেকের কম দামে মোহরটা পাওয়া গেল। ফ্রান্সিস কিন্তু ক্ষতির কথা ভাবছিল না। খিদেয় পেট জ্বলছে। কিছু না খেলেই নয়। সুলতানী মুদ্রা তো পাওয়া গেল। এবার খাবারের দোকান খুঁজে দেখতে হয়। খুব বেশী দূর যেতে হল না। বাজারটার মোড়েই জমজমাট খাবারের দোকান। শিক কাবাবের গন্ধ নাকে যেতেই ফ্রান্সিসের খিদে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। খাবার দেবার সঙ্গে সঙ্গেই গোগ্রাসে গিলতে লাগল। যেভাবে ও খেতে লাগল তা দেখে যে কেউ বুঝে নিতো, ওর রাক্ষসের মত খিদে পেয়েছে। ব্যাপারটা একজনের নজরেও পড়ল। সেই লোকটা অন্য জায়গায় বসে খাচ্ছিল।

এবার ফ্রান্সিসের সামনে এসে লোকটি বসল। ফ্রান্সিস তখন হাপুস হুপুস খেয়েই চললে। লক্ষ্যই করেনি, কেউ ওর সামনে এসে বসেছে। কাজেই লোকটা যখন প্রশ্ন করলে–কি আপনিও বোধহয় আমার মতই বিদেশী।

ফ্রান্সিস বেশ চমকেই উঠেছিল। খেতে-খেতে মাথা নাড়ল।

–আমার নাম মকবুল হোসেন কার্পেটের ব্যবসা করি।

-–ও! ফ্রান্সিস সে কথার কোন উত্তর দিল না। খেয়ে চলল। মকবুলও চুপ করে গেল। কিন্তু হাল ছাড়ল না। অপেক্ষা করতে লাগল কতক্ষণে ফ্রান্সিসের খাওয়া শেষ হয়। মকবুলের চেহারাটা বেশ নাদুসনুদুস। মুখে যেন হাসি লেগেই আছে। ওর ধৈর্য দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল–একে এড়ানো মুসকিল। লোকের সঙ্গে ভাব জমাবার কায়দাকানুন ওর নখদর্পণে।

খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস ঢেকুর তুলল। মকবুল এবার নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল–আপনার খাওয়ার পরিমাণ দেখে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিল।

–হাসুক গে। তাই বলে আমি পেট পুরে খাবো না?

–আমিও তাই বলি–মকবুল একইভাবে হেসে বলল–আপনার মত অত সুন্দর স্বাস্থ্য অটুট রাখতে গেলে এটুকু না খেলে চলবে কেন। আলবৎ খাবেন কাউকে পরোয়া করবেন কেন?

ফ্রান্সিসের খাওয়া শেষ হল। এতক্ষণ মকবুল আর কোন কথা বলেনি। এবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বলল–জানেন ঠিক আপনার মত আমিও একদিন গোগ্রাসে খাবার গিলেছিলাম। কোথায় জানেন, ওঙ্গালিতে।

–ওঙ্গালি? ফ্রান্সিস কোনদিন জায়গাটার নামও শোনেনি।

–হ্যাঁ–মকবুল হাসল–ওঙ্গালির বাজার। কারণ কি জানেন? তার আগে চারদিন শুধু বুনো ফল খেয়ে ছিলাম।

–কেন?

–বেঁচে থাকতে হবে তো। হীরে তো আর খাওয়া যায় না।

–হীরে? ফ্রান্সিস অবাক হয়ে বেশ গলা চড়িয়েই বলল কথাটা।

–শ-শ। মকবুল ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল। তারপর আর একবার চারদিক তাকিয়ে নিয়ে চাপাস্বরে বলতে লাগল এখানকার মদিনা মসজিদের গম্বুজটা দেখেছেন তো?

-হ্যাঁ!

–তার চেয়েও বড়।

–বলেন কি?

–কিন্তু সব বেফরদা।

–কেন?

–আমরা তো আর জানতাম না, যে হীরেটা নাড়া খেলেই পাহাড়টায় ধ্বস নামবে?

–আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল?

–হ্যাঁ, ওঙ্গালির এক কামারকে নিয়েছিলাম হীরের যতটা পারি কেটে আনবো বলে।

–সেটা বোধহয় আর হল না।

–হবে কি করে, তার আগেই ধস নামা শুরু হয়ে গেল।

–ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন? এতক্ষণে ফ্রান্সিস উৎসুক হল। মদিনা মসজিদের গম্বুজের চেয়েও বড় হীরে। শুধু হীরে না বলে হীরের ছোটখাটো পাহাড় বলতে হয় এও কি সম্ভব?

–তাহলে একটু মুরগীর মাংস হয়ে যাক।

–বেশ! ফ্রান্সিস দোকানদারকে ডেকে আরো মুরগীর মাংস দিয়ে যেতে বললো। মাংস খেতে-খেতে মকবুল শুরু করল কার্পেট বিক্রীর ধান্ধায় গিয়েছিলাম ওঙ্গালিতে জায়গাটা তের বন্দরের কাছে। আমার ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকাটা রাস্তায় পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল ভেঙে! কাজেই এক কামারের কাছে সারাতে দিলাম। এই কামারই আমাকে প্রথম সেই অদ্ভুত গল্পটা শোনাল। ওঙ্গালি থেকে মাইল পনের উত্তরে একটা পাহাড়। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পাহাড়টার মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে একটা গুহা। দূর থেকে গাছগাছালি ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গুহাটা প্রায় দেখাই যায় না। সূর্যটা আকাশে উঠতে উঠতে যখন ঠিক গুহাটার সমান্তরালে আসে সূর্যের আলো সরাসরি গিয়ে গুহাটায় পড়ে। তখনই দেখা যায় গুহার মুখে আর তার চারপাশের গাছের পাতায়, ডালে, ঝোপে এক অদ্ভুত আলোর খেলা। আয়না থেকে যেমন সূর্যের আলো ঠিকরে আসে–তেমনি রামধনুর রঙের মত বিচিত্র সব রঙীন আলো ঠিকরে আসে গুহাটা থেকে। অনেকেই দেখেছে এই আলোর খেলা। ধরে নিয়েছে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা! ভূতপ্রেতকে ওরা যমের চেয়েও বেশী ভয় করে। কাজেই কেউ এই রঙের খেলার কারণ জানতে ওদিকে পা বাড়াতে সাহস করে নি।

–আচ্ছা, এই আলোর খেলা কি সারাদিন দেখা যেত।

–উঁহু। সূর্যের আলোটা যতক্ষণ সরাসরি সেই গুহাটায় গিয়ে পড়তো, ততক্ষণই শুধু তারপর আবার যেই কে সেই।

–সেই কামারটা এর কারণ জানতে পেরেছিল।

–না, তবে অনুমান করেছিল। ও বলেছিল–ঐ আলো হীরে থেকে ঠিকরানো আলো না হয়েই যায় না। ও নাকি প্রথম জীবনে কিছুদিন এক জহুরীর দোকানে কাজ করেছিল। হীরের গায়ে আলো পড়লেই সেই আলো কিভাবে ঠিকরোয়, এই ব্যাপারটা ওর জানা ছিল। আমি তো শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

–কেন?

–ভেবে দেখুন–অত আলো–মানে আমি তো সেই আলো আর রঙের খেলা পরে দেখেছিলাম মানে–ভেবে দেখুন হীরেটা কত বড় হলে অত আলো ঠিকরোয়।

তা-তো বটেই। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। বলল–তারপর?

–তারপর বুঝলেন, একদিন তল্পিতল্পা নিয়ে আমরা তো রওনা হলাম। যে করেই হোক গুহার মধ্যে ঢুকতে হবে। কিন্তু সেই পাহাড়টার কাছে পৌঁছে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। নীচ থেকে গুহা পর্যন্ত পাহাড়টা খাড়া হয়ে উঠে গেছে। কিন্তু ঝোঁপঝাড়, দু-একটা জংলী গাছ আর লম্বা-লম্বা বুনো ঘাস–এছাড়া সেই খাড়া পাহাড়ের গায়ে আর কিস্যু নেই। নিরেট পাথুড়ে খাড়া গা। কামার ব্যাটা বেশ ভেবে চিন্তেই এসেছে বুঝলাম। ও বললো–চলুন আমরা পাহাড়ের ওপর থেকে নামবো ভেবে দেখলাম সেটা সম্ভব। কারণ পাহাড়টার মাথা থেকে শুরু করে গুহার মুখ অবধি, আর তার আশে-পাশে ঘন জঙ্গল। দড়ি ধরে নামা যাবে।

সন্ধ্যের আগেই পাহাড়ের মাথায় উঠে বসে রইলাম। ভোর বেলা নামার উদ্যোগ আয়োজন শুরু করলাম। পাহাড়টার মাথায় একটা মস্ত বড় পাথরে দড়ির একটা মুখ বাঁধলাম। তারপর দড়ির অন্য মুখটা পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলিয়ে দিলাম। দড়ি গুহার মুখ পর্যন্ত পৌঁছল কিনা বুঝলাম না। কপাল ঠুকে দড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম। দড়ির শেষ মুখে পৌঁছে দেখি, গুহা তখনও অনেকটা নীচে। সেখান থেকে বাকি পথটা গাছের ডাল গুঁড়ি লতাগাছ এসব ধরে, শ্যাওলা ধরে পাথরের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে পা রেখে-রেখে একসময় গুহার মুখে এসে দাঁড়ালাম। বুঙ্গা মানে কামারটাও কিছুক্ষণের মধ্যে নেমে এল। ও যে বুদ্ধিমান, সেটা বুঝলাম ওর কাণ্ড দেখে। বুঙ্গা দড়ির মুখটাতে আরো দড়ি বেঁধে নিয়ে পুরোটাই দড়ি ধরে এসেছে। পরিশ্রমও কম হয়েছে ওর।

–তারপর?

ফ্রান্সিস তখন এত উত্তেজিত, যে সামনের খাবারের দিকে তাকাচ্ছেও না। মকবুল কিন্তু বেশ মৌজ করে খেতে-খেতে গল্পটা বলে যেতে লাগল।

–দু’জনে গুহাটায় ঢুকলাম। একটা নিস্তেজ মেটে আলো পড়েছে গুহাটার মধ্যে। সেই আলোয় দেখলাম কয়েকটা বড় বড়পাথরের চাই–তারপরেই একটা খাদ। খাদ থেকে উঠে আছে একটা ঢিবি। ঠিক পাথরে ডিবি নয়। অমসৃণ এবড়ো-খেবড়ো গা অনেকটা জমাট আলকাতরার মত। হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ শক্ত। সেই সামান্য আলোয় ঢিবিটার যে কি রঙ, ঠিক বুঝলাম না। তবে দেখলাম যে ওটা নীচে অনেকটা পর্যন্ত রয়েছে, যেন পুঁতে রেখে দিয়েছে কেউ।

বুঙ্গা এতক্ষণ গুহার মুখের কাছে এখানে ওখানে ছড়ানো-ছিটানো বড়-বড় পাথরগুলোর ওপর একটা ছুঁচালো মুখ হাতুড়ির ঘা দিয়ে ভাঙা টুকরোগুলো মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল। তারপর হতাশ হয়ে ফেলে দিচ্ছিলো। আমি বুঙ্গাকে ডাকলাম–বুঙ্গা দেখ তো, এটা কিসের টিবি?

বুঙ্গা কাছে এল। এক নজরে ঐ এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটার দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ওর মুখে কথা নেই।

ঠিক তখনই সূর্যের আলোর রশ্মি সরাসরি গুহার মধ্যে এসে পড়ল। আমরা ভীষণ ভাবে চমকে উঠলাম। সেই এবড়ো-খেবড়ো ঢিবিটায় যেন আগুন লেগে গেল। জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড যেন! যে কি তীব্র আলোর বিচ্ছুরণ। সমস্ত গুহাটায় তীব্র চোখঝলসানো আলোর বন্যা নামল যেন। ভয়ে বিস্ময়ে আমি চীৎকার করে বললাম–বুঙ্গা শীগগির চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড় নইলে অন্ধ হয়ে যাবে।

দু’জনেই চোখ ঢাকা দিয়ে বসে পড়লাম। কতক্ষণ ধরে সেই তীব্র তীক্ষ্ণ চোখ অন্ধ করা আলোর বন্যা বয়ে চলল জানি না। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। ভয়ে-ভয়ে চোখ খুললাম। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, নিশ্চিদ্র অন্ধকার চারদিকে। অসীম নৈঃশব্দ। হঠাৎ সেই নৈঃশব্দ ভেঙে দিল বুঙ্গার ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। অবাক কাণ্ড! ও কাঁদছে কেন? অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বুঙ্গার কাছে এলাম। এবারে ওর কথাগুলো স্পষ্ট শুনলাম। ও দেশীয় ভাষায় বলছে

–অত বড় হীরে আমার সব দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যাবে–আমি কত বড়লোক হয়ে যাব–আমি পাগল হয়ে যাবো।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তাহলে ঐ অমসৃণ পাথুরে ঢিবিটা হীরে? অত বড় হীরে। এ যে অকল্পনীয়। বুঝলাম, প্রচণ্ড আনন্দে চূড়ান্ত উত্তেজনায় বুঙ্গা কাঁঁদতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে ওকে ঠাণ্ডা করলাম। আস্তে-আস্তে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এল। বুঙ্গাকে বললাম–এসো, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

কিন্তু কাকে বলা। বুঙ্গা তখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে গেছে। হঠাৎ ও উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সেই হীরের টিবিটার দিকে। হাতের ছুঁচালো হাতুড়িটা নিয়ে পাগলের মত আঘাত করতে লাগল ওটার গায়ে। টুকরো হীরে চারদিকে ছিটকে পড়তে লাগল। হাতুড়ির ঘা বন্ধ করে বুঙ্গা হীরের টুকরোগুলো কোমরে ফেট্টিতে খুঁজতে লাগল। তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল হাতুড়িটা নিয়ে। আবার হীরের টুকরো ছিটকোতে লাগল। আমি কয়েকবার বাধা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উত্তেজনায় ও তখন পাগল হয়ে গেছে।

–তারপর? ফ্রান্সিস জিজ্ঞাসা করল।

–এবার বুঙ্গা। করল এক কাণ্ড! গুহার মধ্যে পড়ে থাকা একটা পাথর তুলে নিল। তারপর দু’হাতে পাথরটা ধরে হীরেটার ওপর ঘা মারতে লাগল, যদি একটা বড় টুকরো ভেঙে আসে। কিন্তু হীরে ভাঙা অত সোজা? সে কথা কাকে বোঝাব তখন? ও পাগলের মত পাথরের ঘা মেরেই চলল। ঠকঠক পাথরের ঘায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল গুহাটায়। হঠাৎ–

–কি হল?

–সমস্ত পাহাড়টা যেন দুলে উঠল। গুহার ভিতর শুনলাম, একটা গম্ভীর গুড়গুড় শব্দ। শব্দটা কিছুক্ষণ চলল। তারপর হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ। শব্দটা এলো পাহাড়ের মাথার দিক থেকে। গুহার মুখের কাছে ছুটে এলাম। দেখি পাহাড়ের মাথা থেকে বিরাট বিরাট পাথরের চাই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। বুঝলাম, যে কোন কারণেই হোক পাহাড়ের মধ্যে কোন একটা পাথরের স্তর নাড়া খেয়েছে, তাই এই বিপত্তি। এখন আর ভাববার সময় নেই। গুহা ছেড়ে পালাতে হবে। অবলম্বন একমাত্র সেই দড়িটা। ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরলাম। টান দিতেই দেখি–ওটা আগলা হয়ে গেছে। বুঝলাম–যে পাথরের চাইয়ে ওটা বেঁধে এসেছিলাম, সেটা নড়ে গেছে। এখন দড়িটা কোন গাছের ডালে বা ঝোপে আটকে আছে। একটু জোরে টান দিলাম। যে ভেবেছি তাই। দাঁড়ির মুখটা ঝুপ করে নীচের দিকে পড়ে গেল। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে খোদাতাল্লাকে ধন্যবাদ জানালাম। কিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছেনা। পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করেছে। ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছি না। টলেটলে পড়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি দড়ির মুখটা একটা বড় পাথরের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। এখন দড়ি ধরে নামতে হবে। কিন্তু বুঙ্গা? ও কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল? এত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, বুঙ্গার হুঁশও নেই। ও পাথরটা ঠুকেই চলছে। ছুটে গিয়ে ওর দু’হাত চেপে ধরলাম। বুঙ্গা শীগগির চল–নইলে মরবে। কে কার কথা শোনে। এক ঝটকায় ও আমাকে সরিয়ে দিল। আবার ওকে থামাতে গেলাম। তখন হাতের পাথরটা নামিয়ে ছুঁচালো মুখ হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরল। বুঝলাম, ওকে বেশী টানাটানি করলে ও আমাকে মেরে বসবে। ওকে আর বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। গুহার মধ্যে তখন পাথরের টুকরো, ধুলো ঝুপঝুপ করে পড়তে শুরু করেছে। আর দেরি করলে আমারও জ্যান্ত কবর হয়ে যাবে। পাগলের মত ছুটলাম গুহার মুখের দিকে।

তারপর গুহার মুখে এসে দড়িটা ধরে কিভাবে নেমে এসেছিলাম, আজও জানি না। পর পর পাঁচদিন ধরে বুনো ফল আর ঝরনার জল খেয়ে হাঁটতে লাগলাম। গভীর জঙ্গলে কতবার পথ হারালাম, বুনো জন্তু জানোয়ারের পাল্লায় পড়লাম। তারপর যেদিন এক সন্ধ্যার মুখে ওঙ্গালির বাজারে এসে হাজির হলাম, সেদিন আমার চেহারা দেখে অনেকেই ভূত দেখবার মত চমকে উঠেছিল।

মকবুলের গল্প শেষ। দু’জনেই চুপ করে বসে রইল। দু’জনের কারোরই খেয়াল নেই যে রাত হয়েছে। এবার দোকান বন্ধ হবে।

–এই দেখুন–মকবুল ডান হাতটা বাড়াল। মাঝের মোটা আঙুলটায় একটা হীরের আংটি।

–সেই হীরের টুকরো নাকি? ফ্রান্সিস বিস্ময়ে প্রশ্ন করল।

মকবুল মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল, বলল–বুঙ্গা যখন হাতুড়ি চালাচ্চিল তখন কয়েকটা টুকরো ছিটকে এসে আমার জামারআস্তিনে আটকেগিয়েছিল। তখন জানতে পারিনি, পরে দেখেছিলাম।

দোকানী এসে তাড়া দিল, রাত হয়েছে দোকান বন্ধ করতে হবে।

দু’জনে উঠে পড়ল। দোকানীর দাম মেটাতে গিয়ে ফ্রান্সিস ওর থলিটা বের করল। সুলতানী মুদ্রাগুলোর সঙ্গে মোহরটাও ছিল। মোহরটা দেখে মকবুল যেন হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে পড়ল। থাকতে না পেরে বলেই ফেলল–মোহরটা একটু দেখব?

–দেখুন না–ফ্রান্সিস মোহরটা ওর হাতে দিল। ফ্রান্সিস দাম মেটাতে ব্যস্ত ছিল। তাই লক্ষ্য করল না মোহরটা দেখতে দেখতে মকবুলের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। কিন্তু নিজের মনের ভাব গোপন করে ও মোহরটা ফিরিয়ে দিল।

-সুন্দর মোহরটা, রেখে দেওয়ার মত জিনিস।

–হুঁ, –রাখতে আর পারলাম কই? ফ্রান্সিস সখেদে বলল।

–কেন?

–আর একটা ঠিক এরকম দেখতে মোহরও ছিল।

–কি করলেন সেটা?

–এখানকার বাজারে এক জহুরীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি।

–ইস, –মকবুল মাথা নাড়ল–ও ব্যাটা নিশ্চয়ই ঠকিয়েছে আপনাকে।

–কি আর করব, নইলে না খেয়ে মরতে হত।

–কোন্ জহুরীর কাছে বিক্রি করেছেন?

–রাস্তায় নেমে মকবুল জিজ্ঞেস করল–কোথায় থাকেন আপনি?

–এখনো কোন আস্তানা ঠিক করিনি।

–বাঃ, –বেশ–মকবুল হাসল–চলুন আমার সঙ্গে।

–কোথায়?

–সুলতানের এতিমখানায়।

–এতিমখানায়!

–নামেই এতিমখানা–গরীব মানুষেরা থাকতে পায় না। আসলে বিদেশীদের আড্ডাখানা ওটা।

–চলুন–মাথা তো গোঁজা যাবে।

রাস্তায় আসতে-আসতে ফ্রান্সিস মকবুলকে জহুরীর দোকানটা দেখাল। মকবুল গভীরভাবে কি যেন ভাবছিল। দোকানটা দেখে মাথা নেড়ে শুধু বলল–ও।

ফ্রান্সিস আন্দাজও করতে পারেনি মকবুল মনে মনে কি ফন্দি আঁটছে।

মকবুলের কথা মিথ্যে নয়। সত্যিই এতিমখানা বিদেশী ব্যবসায়ীদের আড্ডাখানা। কত দেশের লোক যে আশ্রয় নিয়েছে এখানে। আফ্রিকার কালো কালো কোঁকড়া চুল মানুষ, যেমন আছে, তেমনি নাক চ্যাপ্টা কুতকুতে চোখ মোঙ্গল দেশের লোকও আছে।

মকবুল একটা ঘরে ঢুকল। দু’জন লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। আর একটা বিছানা খালি, ওটাই বোধহয় মকবুলের বিছানা। ঘরের খালি কোণটা দেখিয়ে মকবুল বলল–ওখানেই আপনার জায়গা হয়ে যাবে, সঙ্গে তো আপনার বিছানা পত্তর কিছুই নেই?

–না।

–আমার বিছানা থেকেই কিছু কাপড়-চোপড় দিচ্ছি, পেতে নিন। ফ্রান্সিস বিছানামত একটা করে নিল। সটান শুয়ে ক্লান্তিতে চোখ বুজল। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিল ঘরের দু’জন লোকের সঙ্গে মকবুল মৃদুস্বরে কি যেন কথাবার্তা বলছে। সে সব কথার অর্থ সে কিছুই বুঝতে পারে নি।

ঘুম ভাঙতে ফ্রান্সিস দেখল বেশ বেলা হয়েছে। লোকজনের কথাবার্তায় এতিমখানা সরগরম। ফ্রান্সিস পাশ ফিরে মকবুলের বিছানার দিকে তাকাল। আশ্চর্য! কোথায় মকবুল? মকবুলের বিছানাও নেই। পাশের বিছানায় লোকটি তখন দু’হাত ওপরে তুলে মুখ হাঁ করে মস্ত বড় হাই তুলছিল। ফ্রান্সিস তাকেই জিজ্ঞাসা করল–আচ্ছা, মকবুল কোথায়?

লোকটা মৃদু হেসে হাতের চেটো ওল্টাল, অর্থাৎ সে কিছুই জানেনা। মরুক গে এখন হাত মুখ ধুয়ে কিছু খাওয়ার চেষ্টা দেখতে হয়, ভীষণ খিদে পেয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসেফ্রান্সিস দেখল, ঘরের আর একজন তখন ফিরছে। কিন্তু মকবুল একেবারেই বেপাত্তা। ফ্রান্সিস খেতে যাবে বলে থলেটা কোমর থেকে বের করল, কিন্তু এ কি? থলে যে একেবারে খালি। সুলতানী মুদ্রাগুলো তো নেই-ই, সেই সঙ্গে মোহরটাও নেই। সর্বনাশ! এই বিদেশ বিই। কে চেনে ওকে? মাথা গোঁজার ঠাঁই না হয় এই এতিমখানায় জুটল। কিন্তু খাবে কি? খেতে তো দেবে না কেউ। তার ওপর কাঁধের ঘাটা এখনও শুকোয় নি। শরীরের দুর্বলতাও সবটুকু কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এই অবস্থায় ও একেবারে সর্বশান্ত হয়ে গেল। ফ্রান্সিস চোখে অন্ধকার দেখল।

ওর চোখমুখের ভাব দেখে ঘরের আর দু’জনেও বেশ অবাক হল–কি ভিনদেশী লোকটার? ওদের মধ্যে একজন উঠে এল। লোকটার চোখের ভুরু দুটো ভীষণ মোটা। মুখটা থ্যাবড়া। ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল–কি হয়েছে?

ফ্রান্সিস প্রথমে কথাই বলতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল–হল কি? ও-রকম ভাবে তাকিয়ে আছেন?

–আমার সব চুরি গেছে।

–ও, তাই বলুন। লোকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার বিছানায় গিয়ে বসল। বলল—

–এটা এতিমখানা–চোর, জোচ্চোরের বেহেস্ত মানে স্বর্গ আর কি? তা কত গেছে? ফ্রান্সিস আন্দাজে হিসেব করে বলল। মোহরটার কথাও বলল।

–ও বাবা। মোহর-ফোহর নিয়ে এতিমখানায় এসেছিলেন? কত সরাইখানা রয়েছে, সেখানেই গেলে পারতেন।

–মকবুলই তো যত নষ্টের গোড়া।

–কে মকবুল?

–কাল রাত্তিরে যার সঙ্গে আমি এসেছিলাম।

–কত লোক আসছে-যাচ্ছে।

–কেন, আপনারা তো কথাবার্তা বলছিলেন মকবুলের সঙ্গে বেশ বন্ধুর মত।

–হতে পারে। হাত উল্টে লোকটা বলল।

ফ্রান্সিস লোকটার ওপর চটে গেল। একে ওর এই বিপদ কোথায় লোক্টা সহানুভূতি দেখাবে তা নয়, উলটে এমনভাবে কথা বলছে যেন সব দোষ ফ্রান্সিসের।

ফ্রান্সিস বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল–আপনারা মকবুলকে বেশ ভাল করেই চেনেন, এখন বেগতিক বুঝে চেপে যাচ্ছেন।

অন্য বিছানায় আধশোয়া লোকটা এবার যেন লাফিয়ে উঠল। বলল–তাহলে আপনি কি বলতে চান, আমরা গাঁট কাটা?

–আমি সেকথা বলিনি।

–আলবৎ বলেছেন। ভুরু মোটা লোকটা বিছানা ছেড়ে ফ্রান্সিসের দিকে তেড়ে এল। ফ্রান্সিস বাধা দেবার আগইে ওর গলার কাছে জামাটা মুঠো করে চেপে ধরল। কাঁধে জখমের কথা ভেবে ফ্রান্সিস কোন কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

–আর বলবি? লোকটা ফ্রান্সিসকে ঝাঁকুনি দিল।

–কি?

–আমরা গাঁটাকাটা।

–আমি সেকথা বলিনি।

–তবে রে! লোকটা ডান হাতের উল্ট পিঠ ঘুরিয়ে ফ্রান্সিসের গালে মারল এক থাপ্পড়। অন্য লোকটি খ্যাখ্যা করে হেসে উঠল। ফ্রান্সিস আর নিজেকে সংযত করতে পারল না। ওর নিজের গেল টাকা চুরি, আর উল্টে ওকেই চোরের মত মার খেতে হচ্ছে। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর লোকটা কিছু বোঝবার আগেই হাঁটু দিয়ে ওর পেটে মারল এক গুঁতো। লোকটা দুহাতে পেট চেপে বসে পড়ল। অন্য লোকটা এরকম কিছু একটা হতে পারে, বোধহয় ভাবতেই পারেনি। এবার সে তৎপর হল। ছুটে ফ্রান্সিসকে ধরতে এল। ফ্রান্সিস ওর চোয়াল লক্ষ্য করে সোজা ঘুষি চালাল। লোকটা চিৎ হয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেল। ফ্রান্সিস বুঝল–এর পরের ধাক্কা সামলানো মুশকিল হবে। কাজেই আর দেরি না করে এক ছুটে ঘরের বাইরে চলে এল। ভুরু মোটা লোকটাও পেছনে ধাওয়া করল। ফ্রান্সিস ততক্ষণে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে হুড়কো তুলে দিয়েছে। বন্ধ দরজার ওপর দুমদাম লাথি পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে এতিমখানা থেকে বেরিয়ে এল।

এতবড় আমদাদ শহর। এত লোকজন, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, কোথায় খুঁজবে মকবুলকে কিন্তু ফ্রান্সিস দমল না। যে করেই হোক মকবুলকে খুঁজে বের করতে হবে। সব আদায় করতে হবে। তারপর বন্দরে গিয়ে খোঁজ করতে হবে ইউরোপের দিকে কোন জাহাজ যাচ্ছে কি না। জাহাজ পেলেই উঠে পড়বে। কিন্তু মকবুলকে না খুঁজে বের করতে পারলে কিছুই হবে না। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে না খেয়ে মরতে হবে।

সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াল ফ্রান্সিস। বাজার, বন্দর, অলি-গলি কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু কোথায় মকবুল? একজন লোককে তো মকবুল ভেবেও উত্তেজনার মাথায় কাঁধে হাত রেখেছিল। লোকটা বিরক্ত মুখে ঘুরে দাঁড়াতে ফ্রান্সিসের ভুল ভাঙল। মাফ-টাফ চেয়ে সে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। উপোসী পেটে সারাদিন ওই ঘোরাঘুরি। দুপুরে অবশ্য, একফালি তরমুজ চালাকি করে খেয়েছিল।

বাজারের মোড়ে একটা লোক তরমুজের ফালি বিক্রি করছিল। খিদেয় পেট জ্বলছে। সেই সঙ্গে জলতেষ্টা। একফালি তরমুজ খেলে খিদেটাও চাপা পড়বে সেই সঙ্গে তেষ্টাটাও দূর হবে। কিন্তু দাম দেবে কোত্থেকে? অগত্যা চুরি। ফ্রান্সিস বুদ্ধি ঠাওরাল। রাস্তার ধারে এক দল ছেলে খেলা করছিল। ফ্রান্সিস ছেলেগুলোকে ডাকল। ছেলেগুলো কাছে আসতে বলল

–ঐ যে তরমুজওলাটাকে দেখছিস, ও কানে শুনতে পায় না। তোরা গিয়ে ওর সামনে বলতে থাক–এক ফালি তরমুজ দাও তাহলেই কানে শুনতে পাবে। লোকটা খুশী হয়ে ঠিক তোদের একফালি করে তরমুজ দেবে।

ব্যাস! ছেলের দল হল্লা করতে করতে ছুটে গিয়ে তরমুজওলাকে ঘিরে ধরল। তারপর তারস্বরে চাঁচাতে লাগল–

এক ফালি তরমুজ দাও তাহলে তুমি কানে শুনতে পাবে। তরমুজওলা পড়ল মহা বিপদে। আসলে ওর কানের কোন দোষ নেই। ও ভালই শুনতে পায়। ও হাত নেড়ে বারবার সেকথা বোঝাতে লাগল। কিন্তু ছেলেগুলো সেকথা শুনবে কেন?

তাদের চীৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা। একদিকের ছেলেগুলোকে তাড়ায় তো অন্যদিকের ছেলেগুলো মাছির মত ভিড় করে আসে। আর সেই নামতা পড়ার মত চীৎকার। অতিষ্ট হয়ে তরমুজওলা ঝোলা কাঁধে নিয়ে অন্যদিকে চলল। ছেলের দলও চাঁচাতে চাঁচাতে পিছু নিল। এবার ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। তরমুজওলাকে ডেকে দাঁড় করাল, বলল–তোমার ঝোলায় সব চাইতে বড় যে তরমুজটা আছে, বের কর। তরমুজওলা বেশ বড় একটা তরমুজ বের করল।

–এবার কেটে সবাইকে ভাগ করে দাও। ছেলেরা তো তরমুজ খেতে পেয়ে বেজায় খুশী। ফ্রান্সিসও একটা বড় টুকরো পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কামড় দিল, আঃ কি মিষ্টি! হাপুস হুপুস করে খেয়ে ফেলল তরমুজের টুকরোটা। তরমুজওলা এবার দাম চাইলে ফ্রান্সিস অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল–বাঃ, এই যে তুমি বললে কানে শুনতে পেলে সবাইকে তরমুজ খাওয়াবে।

–ও কথা আমি কখন বললাম? তরমুজওলা অবাক।

–এই তো তুমি কানে শুনতে পাচ্ছো।

ছেলেগুলো আবার চেঁচাতে শুরু করল–কানে শুনতে পাচ্ছে।

তরমুজওলা ছেলেদের ভিড় ঠেলে আসার আগেই ফ্রান্সিস ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দিল।

একফালি তরমুজে কি আর খিদে মেটে? তবু সন্ধ্যে পর্যন্ত কাটাল। যদি ওর দূরবস্থার কথা শুনে কারো দয়া হয়, এই আশায় ফ্রান্সিস কয়েকটা খাবারের দোকানে গেল। সব চুরি হয়ে যাওয়ার কথা বলল। অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কেউই ওকে বিশ্বাস করল না।

সন্ধ্যার সময় শাহীবাগের কোণার দিকে একটা পীরের দরগার কাছে এসে ফ্রান্সিস দাঁড়াল। একটু জিরানো যাক। দরগার সিঁড়িতে বসল ফ্রান্সিস। ভেতরে নজর পড়তে দেখল অনেক গরিব-দুঃখী সার দিয়ে বসে আছে। সবাইকে একটা করে বড় পোড়া রুটি আর আলুসেদ্ধ দেওয়া হচ্ছে। তাই দেখে ফ্রান্সিসের খিদের জ্বালা বেড়ে গেল। সেও সারির মধ্যে বসে পড়ল। যে লোকটা রুটি দিচ্ছিল, সে কিন্তু ফ্রান্সিসকে দেখে একটু অবাকই হল। খাবার দিল ঠিকই, কিন্তু মন্তব্য করতেও ছাড়ল না–অমন ঘোড়ার মত শরীর–সুলতানের সৈন্যদলে নাম লেখাও গে যাও। ফ্রান্সিস কোন কথা বলল না। মুখ নীচু করে পোড়া রুটি চিবুতে লাগল। হঠাৎ দেশের কথা, মা’র কথা মনে পড়ল। কোথায় এই অন্ধকার খোলা উঠোনে ভিখিরিদের সঙ্গে বসে পোড়া রুটি আলুসেদ্ধ খাওয়া আর কোথায় ওদের সেই ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোকিত খাওয়ার ঘর, ফুলের কাজকরা সাদা টেবিল ঢাকনা, ঝকঝকে পরিষ্কার কঁটা-চামচ, বাসনপত্র। খাওয়ার জিনিসও কত। কত বিচিত্র স্বাদ সে সবের। সেই সঙ্গে মা’র সস্নেহ হাসিমুখ–ফ্রান্সিস চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল। না–না–এসব ভাবনা মনকে দুর্বল করে দেয়। এসব চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। বাড়ির নিশ্চিন্ত বিলাসী জীবনের নাম জীবন নয়। জীবন রয়েছে বাইরে অন্ধকার ঝড়-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে, আগুন ঝরা মরুভূমিতে তরবারির ঝলকানিতে, দেশবিদেশের মানুষের স্নেহ-ভালবাসার মধ্যে।

তখনও রাত বেশী হয় নি। ফ্রান্সিস এতিমখানায় এসে ঢুকল। খুঁজে খুঁজে নিজের ঘরটার দিকে এগোল। সেই লোক দুটো কি আর আছে? ব্যবসায়ী লোক হয় তো এক রাত্রির জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। সকালে নিশ্চয়ই দরজায় ধাক্কাধাক্কি লাথি মারার শব্দে আশেপাশের ঘরের লোক এসে দরজা খুলে দিয়েছে। তারপর দুপুর নাগাদ পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছে।

দরজাটা বন্ধ। ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত মনেই দরজাটা ঠেলল। দরজা খুলে গেল। এই সেরেছে। সেই মূর্তিমান দু’জনেরই একজন যে। মোটা ভুরু নাচিয়ে লোকটা ডাকল এসো ভেতরে। ফ্রান্সিস নড়ল না। লোকটা এবার হেসে ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখতে গেল। ফ্রান্সিস এক। ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল। ঘরে চোখ পড়তে দেখল অন্য লোকটাও রয়েছে।

–তোমার এখনও রাগ পড়েনি দেখছি। লোকটা হাসল।

ফ্রান্সিস ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটি বললো–বিশ্বাস করো ভাই সকালে তোমার সঙ্গে আমরা যে ব্যবহার করেছি, তার জন্যে আমরা দুঃখিত।

ফ্রান্সিস তবু নড়ল না।

–ঠিক আছে, তুমি ভেতরে এসো। যদি মাফ চাইতে বলো–আমরা তাও চাইবো।

ফ্রান্সিস আস্তে-আস্তে ঘরে ঢুকল। লোকটা দরজা বন্ধ করতে উদ্যোগী হতেই ফ্রান্সিস ঘুরেদাঁড়াল। বললো দরজা বন্ধ করতে পারবে না।

–বেশ। লোকটা হেসে দরজা খোলা রেখেই ওর কাছে এগিয়ে এল। বলল–এবার বিছানায় বসো।

ফ্রান্সিস নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। অন্য লোকটি তখন একটা পাত্র হাতে এসি, এল। পাত্রটা ফ্রান্সিসের সামনে রেখে বলল–খাও। সারাদিন তো তরমুজের একটা ফালি ছাড়া কিছুই জোটেনি।

ফ্রান্সিস বেশ অবাক হল। এসব এই লোকটা জানলো কি করে? মোটা ভুরুওলা লোকটা এবার বলল–তুমি ঠিকই ধরেছো। মকবুল আমাদের খুবই পরিচিত। ওকে আমরা ভালো করেই জানি। গাঁট কাটার মত নোংরা কাজ ওর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের উল্টে তোমাকেই সন্দেহ হয়েছিল।

–আমাকে?

–হ্যাঁ। তাই দুপুরবেলা আমরা দুজন তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে ছিলাম। পেলামও তোমাকে। বাজারের মোড়ে তুমি তখন তরমুজ খাচ্ছিলে।

ফ্রান্সিস হাসল। লোকটা বললো খুব বেঁচে গেছো। তুমিও গা ঢাকা দিলে আর ঠিক তক্ষুণি সুলতানের পাহারাদার এল। অবশ্য কোন বিপদ হলে আমরাও তৈরী ছিলাম তোমাকে বাঁচাবো বলে–

–তাহলে তো তোমরা সবই দেখেছো। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ তখনি বুঝলাম–তুমি মিথ্যে বলোনি। সত্যি তোমার সব চুরি হয়েছে–নইলে ওরকম চুরির ফন্দী আঁটো। খাও ভাই–এবার হাত চালাও–খেয়ে নাও আগে।

ফ্রান্সিস আর কোন কথা বললো না নিঃশব্দে খেতে লাগল। পরোটা, মাংস। উটের দুধ দিয়ে তৈরী মিষ্টি চেটেপুটে খেয়ে নিল সব।

এবার মোটা ভুরুওলা লোকটা বলল–শোন ভাই–আমার নাম হাসান। কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমরাও খোঁজে থাকব-মকবুলের দেখা পেলেই সব আদায় করে লোক মারফত তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। তুমি তো এখানেই থাকবে?

–হ্যাঁ, যতদিন না জাহাজের ভাড়া যোগাড় করতে পারি।

–বেশ। এবার তাহলে ঘুমোও। অনেক রাত হল।

ফ্রান্সিসও আর জেগে থাকতে পারছিল না। পরদিন কি খাবে, কি ভাবে জাহাজের ভাড়া সংগ্রহ করবে–এইসব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *