সেন্ট রেমি

সেন্ট রেমি

ঠিক যেন কোনো একটা গ্রাম্য রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুম। আসলে কিন্তু ওটা উন্মাদদের তৃতীয় শ্রেণির ওয়ার্ড। টুপি বলো, চশমা বলো, ওভারকোট বলো, উম্মাদরা সবকিছু পরে সবসময় তৈরি। যার ছড়ি আছে, তার সেই ছড়িটি পর্যন্ত হাতে। সামান্যতম সম্পত্তিও হয়তো আড়াল করতে তারা নারাজ।

ঘরটা যেন সুদীর্ঘ একটা বারান্দা। সিস্টার ভিনসেন্টকে নিয়ে এলেন খালি একটা খাটের কাছে।

মশিয়েঁ, এই আপনার শোবার জায়গা। রাত্রি বেলা পর্দাগুলো টেনে দিতে পারেন। জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে ডাক্তার পেরনের সঙ্গে অফিসে দেখা করবেন।

নিভক্ত স্টোভটাকে ঘিরে এগারোটি প্রাণী। কেউ একটি কথা বলল না, নতুন একটি প্রাণী যে ঘরে এল, খেয়াল নেই কারও। সরু ঘরের শক্ত মেঝের ওপর দিয়ে খটখট করতে করতে বিদায় নিল সিস্টার, কড়া-ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা গাউন আর কুচকুচে কালো ওড়না সমেত।

ভিনসেন্ট হাতের ভ্যালিসটা নামিয়ে চারিদিকটা দেখল। লম্বা ঘরের আড়াআড়ি দু-দিকের দেয়ালের সামনাসামনি খাট পাতা সারি সারি করে।

প্রত্যেকটা খাটের চারদিকে ফ্রেমে আঁটা নোংরা ঘি রঙের পর্দা, রাত্রে সেগুলো টেনে দেওয়া চলে। নীচু কড়িগুলো মোটা মোটা অমসৃণ কাঠের, সাদা চুনকাম করা দেয়াল, ঘরের মাঝখানে একটা স্টোভ। ছাদ থেকে ঠিক স্টোভের ওপর ঝোলানো একটিমাত্র আলো।

অন্যান্য রোগীদের এত চুপচাপ দেখে ভারি আশ্চর্য লাগল ভিনসেন্টের। একটি কথা বলছে না কেউ বা পড়ছে না বা খেলছে না। লাঠির ওপর ভর করে বসে ফাঁকা চোখে প্রত্যেকে চেয়ে আছে স্টোভটার দিকে।

বিছানাটার মাথার দিকে দেয়ালে আটকানো একটা কাঠের বাক্স, জিনিসপত্র রাখবার জন্যে। ভিনসেন্ট তার পাইপ তামাক আর একটা বই কেবল রাখল ওই বাক্সে, বাকি জিনিসপত্রভরতি ভ্যালিসটা ঠেলে দিল খাটের নীচে। তারপর ঘর ছেড়ে বাগানে গেল বেড়াতে। পথে পড়ল এক সার অন্ধকার তালাবদ্ধ ঘর, যার মধ্যে বহুকাল কেউ ঢুকবে বলে মনে হয় না।

সারা উদ্যানটা অযত্নরক্ষিত, জনবিবর্জিত। বড়ো বড়ো ঘাস উঠেছে এলোমেলো, বুনো গুল্মের জটলা, তাদের মাথায় বড়ো বড়ো পাইন গাছের জড়াজড়ি। চারিদিকে দেয়াল ঘেরা, তার ফাঁক দিয়ে দিনান্তের সূর্যরশ্মিটুকু এসে পড়ে এখানে-ওখানে ঠিক যেন স্রোতহীন জলা। বাঁ-হাতে একটু এগিয়ে আলাদা একটি বাড়ি, সেখানে ডাক্তার পেরন থাকেন। ভিনসেন্ট ধাক্কা দিল দরজায়।

ডাক্তার পেরন প্রথম জীবনে মার্সাইতে জাহাজি ডাক্তার ছিলেন। পরে বাতের আক্রমণে তাঁকে সে-পেশা ছাড়তে হয়। শহরের বাইরে কম পরিশ্রমের কাজ তিনি খুঁজছিলেন, এই উন্মাদশালার পরিচালকের কাজটি হয়েছে তাঁর মনের মতো।

ডাক্তার বললেন—দেখো ভিনসেন্ট, আগে ছিলাম শরীরের ডাক্তার, দেহের রোগ সারাতাম। এখন হয়েছি মনের ডাক্তার, আত্মার ব্যাধি নিয়ে নাড়াচাড়া করি। ডাক্তারি দুইয়েতেই লাগে।

ভিনসেন্ট প্রশ্ন করলে—আপনার তো স্নায়বিক ব্যাধি সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতা আছে। কীসের তাড়নায় আমি আমার কানটা কেটে ফেলেছিলাম, বলতে পারেন? তোমার রোগটা হল অপস্মার বা সন্ন্যাসরোগ। এ রোগে কখনও কখনও এইরকম উপসর্গ প্রব শ পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। শ্রবণেন্দ্রিয়টা অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ। রোগীর কানের কাছে কত ভ্রান্ত স্বর যেন গুঞ্জন করতে থাকে, রোগী ভাবে কানটা কেটে ফেললে ওদের হাত থেকে মুক্তি পাবে।

ও, বুঝলাম। আচ্ছা, এখানে আমার চিকিৎসা কী করবেন ডাক্তার?

চিকিৎসা? হ্যাঁ, চিকিৎসা হবে বই কী। এই ধরো রোজ দু-বার করে স্নান। প্রত্যেক বার স্নানের সময় দু-ঘণ্টা করে জলে ডুবে থাকতে হবে।

তা ছাড়া?

তা ছাড়া একেবারে সম্পূর্ণ শান্ত জীবনযাত্রা, একটুও উত্তেজনা যাতে না আসে। কাজ করবে না, বই পড়বে না, বেশি কথা বলবে না, তর্ক করবে না—

কাজ! এত দুর্বল আমি এখন, কাজ তো করতেই পারব না।

আর এখানকার সেন্ট পল মঠ সংক্রান্ত যেসব ধর্মকর্ম আছে তাতে যদি যোগ দিতে না চাও তো তাও মন্দ নয়, সিস্টারদের আমি বলে দেব। এ ছাড়া যখনই যা দরকার বলে মনে হবে আমাকে এসে বললেই আমি তার ব্যবস্থা করে দেব।

ধন্যবাদ ডাক্তার।

ও, হ্যাঁ, পাঁচটার মধ্যেই সাপার খেয়ে নিতে হবে। ঘণ্টা শুনতে পাবে এখনই। দেরি কোরো না তাহলে। মনে রেখো, হাসপাতালের দৈনন্দিন রুটিনের সঙ্গে যত শীঘ্র নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পার, তত শীঘ্রই তোমার উপকার শুরু হবে।

এলোমেলো বাগান আর তালাবদ্ধ অন্ধকার খুপরিগুলো পার হয়ে ভিনসেন্ট আবার এসে পৌঁছোল তার থার্ড ক্লাস ওয়ার্ডে। এসে বসল তার বিছানায়। তখনও নিশ্চল নির্বাক তার এগারোটি সহবাসিন্দা। একটু পরে ‘ ঘণ্টা বেজে উঠল। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব নিয়ে এগারোজন উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করল। ভিনসেন্টও অনুসরণ করল তাদের।

খাবার ঘরটায় কাঁচা মাটির মেঝে। দেওয়ালে জানলা নেই একটিও। ঘরজোড়া লম্বা একটি তক্তা দিয়ে বানানো টেবিল, দু-পাশে তক্তা-পাতা বেঞ্চি। সিস্টাররা পরিবেশন করছেন, খাবার কিন্তু জঘন্য। প্রথমে একটুকরো কালো রুটি আর আরশোলা-ভাসা ঝোল। তারপর পাঁচমিশেলি ওঁচা তরিতরকারির চচ্চড়ি। আর কিছু না। অন্য সবাই প্রাণপণে চেটেপুটে খেতে লাগল, ভিনসেন্টের কিন্তু প্যারিসের রেস্তরাঁর কথা মনে পড়ে চোখ ফেটে জল আসতে লাগল।

খাওয়া শেষ হবার পর রোগীরা ঘরে ফিরে স্টোভের ধারে যে-যার চেয়ারে গিয়ে বসল, খাড়া হয়ে বসে রইল খাদ্যদ্রব্য হজম হবার আশায়। তারপর একে একে জামাকাপড় ছেড়ে নিজের নিজের বিছানায় গিয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল, টেনে দিল খাটের চারপাশের পর্দা। এ পর্যন্ত ভিনসেন্ট কারও মুখে টু শব্দটি শোনেনি।

সন্ধের অন্ধকার তখন সবে ঘনিয়ে আসছে। ভিনসেন্ট জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে প্রসারিত সবুজ প্রান্তর, ফিকে নীলচে রঙের স্বচ্ছ আকাশ, দিগন্ত জুড়ে পাইন গাছের কালো পাড়। সারা ওয়ার্ডে সূচীভেদ্য স্তব্ধতা। যেটুকু আলো আর যেটুকু রং—শুষে নিতে লাগল প্রদোষের ধূসরতা। ঘরের মধ্যে জমতে লাগল ছায়া কালো কালো। আলোটা পর্যন্ত কেউ জ্বেলে দিয়ে গেল না। এমনি সায়াহ্ন প্রহরে কিছু করবার নেই, কেবল আপন আত্মার মুখোমুখি হয়ে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া।

জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় গেল ভিনসেন্ট। নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইল মাথার ওপরের কড়িকাঠগুলোর দিকে তাকিয়ে। দেলাক্রোয়ার বইটা সে সঙ্গে এনেছিল। অন্ধকারে বাক্স হাতড়ে বইটা বার করে বুকের ওপর চেপে ধরল। মস্ত একটা আশ্বাস জাগল মনে। তাকে ঘিরে একই ঘরে একই ছাদের নীচে ওই যেসব বাক্যহারা বাতুলের দল, ওদের দলে সে নয়। পৃথিবীর মহান শিল্পীর সাহচর্যে সে আছে, চামড়ার মোটা বাঁধাইয়ের মধ্যে দিয়ে তাঁর বাণী তাঁর আশা তার ব্যাকুল চিত্তে আশ্বাস জাগাক, স্পর্শ দিক সফল সান্ত্বনার।

একটু পরে সে ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল জানে না, হঠাৎ সে জেগে উঠল চাপা একটা গোঁ-গোঁ শব্দে। গোঁ-গোঁ শব্দটা ক্রমে ক্রমে বাড়তেই লাগল, শেষ পর্যন্ত ফেটে পড়ল আর্ত চিৎকারে—যাও, যাও, চলে যাও! কেন আমার পেছনে লেগেছ? ও, ভেবেছ আমি বুঝতে পারিনি, তা-ই না? বোকা পেয়েছ আমাকে! জানি জানি, তুমি পুলিশ! কিন্তু আমার পেছনে কেন? বলছি তো আমি খুন করিনি, আত্মহত্যা করেছে ও নিজে? তবু আমাকে ছাড়বে না? তবু আমার পিছু নেরেই? তবু একটু শান্তি দেবে না আমাকে শয়তান?

লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। পর্দা সরিয়ে দেখে, বছর তেইশ বছরের সুপুরুষ এক যুবক দাঁত নখ দিয়ে নিজের গায়ের রাত্রিবাস ছিঁড়ছে। ভিনসেন্টের ওপর চোখ পড়তেই ছেলেটি দৌড়ে তখন সামনে এল, হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাত জোড় করে বলতে লাগল—মশিয়েঁ মুনে-সুলি, আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন না! বিশ্বাস করুন, ও আমি করিনি। অস্বাভাবিক যৌন অপরাধের অপরাধী সত্যিই আমি নই। আমি উকিল, আপনার সব কেস আমি বিনিপয়সায় করে দেব। আমাকে গ্রেপ্তার করবেন না, দোহাই আপনার! আমি খুন করিনি, আমি টাকা চুরি করিনি! আমি, আমি…

সমানে চিৎকার করতে লাগল ছেলেটা আর বিছানার চাদরটা হাতে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়তে লাগল সম্পূর্ণ অচৈতন্য উন্মত্ততায়। বাকি সমস্ত লোক তখন নিরুদ্‌বেগে ঘুমোচ্ছে।

ভিনসেন্ট ছুটে গেল পাশের বিছানার ধারে। পর্দাটা সরিয়ে সে বিছানার লোকটাকে সজোরে ধাক্কা দিল। লোকটা জেগে উঠে বোকা চোখে চেয়ে রইল ভিনসেন্টের দিকে।

উঠুন উঠুন, ছেলেটাকে ঠান্ডা করতে হবে, নইলে নিজেরই কী বিপদ ঘটাবে বলা যায় না।

ধড়ফড়িয়ে লোকটা উঠে বসল বিছানায়। মুখ দিয়ে হাউহাউ আওয়াজ করল খানিকটা। ঠোটের ধার দিয়ে লালা গড়াতে লাগল খালি।

এক কাঁধে হাত দিল ভিনসেন্টের। চমকে লাফিয়ে সে মুখ ফেরাল। তৃতীয় বাসিন্দা। এ-লোকটির বয়েস অনেকটা বেশি। বুড়োসুড়ো মানুষ। ঠিক পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বললে—ওটাকে টেনে তুলে লাভ নেই। জড়পিণ্ড ওটা, এখানে এসে পর্যন্ত কথা বলেনি একটাও। আসুন আমরা দুজনে ছোঁড়াটাকে ঠান্ডা করছি।

চিৎকার করে চলেছে ছেলেটা। বিছানার গদি ফুটো করে তার মধ্যে থেকে শুকনো ছোবড়া বার করে করে চারিদিকে ছড়াচ্ছে।

ভিনসেন্ট কাছে এগিয়ে আসতেই পাগল ছেলেটা একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিনসেন্টের বুকের ওপর, দু-হাত চাপড়াতে চাপড়াতে চেঁচাতে লাগল—

স্বীকার করছি, স্বীকার করছি! হ্যাঁ, খুন—খুন করেছি। কিন্তু সে ওই নোংরা কাজটার জন্যে নয়, সে-কেলেঙ্কারি আমি করিনি। খুন করেছি টাকার জন্যে। পুলিশ লেলিয়ে দেবে? গারদে পুরে রাখবে? ইঃ! কেস করো আমার নামে, হারিয়ে দেব! সব আইন আমার জানা আছে। ঠিক হারিয়ে দেব, হ্যাঁ!

ধরুন ধরুন, ডান হাতটা চেপে ধরুন। এবার বিছানায় শুইয়ে দিন।

বিছানায় শুয়েও বকবক করতে লাগল ছেলেটা। প্রায় এক ঘন্টা পরে শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেও বিড়বিড় করতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে।

বয়স্ক লোকটি বললে—ছেলেটা খুব ভালো ছিল মশিয়েঁ। আইন পড়ছিল। অত্যধিক পড়াশুনোর ফলে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। এখন দিন দশেক অন্তর একবার করে এরকম খেপে ওঠে। তবে মারধোর করে না কাউকে কখনও, এইটেই রক্ষা। আচ্ছা, গুড নাইট মশিয়েঁ।

আবার সব স্তব্ধ। কিন্তু বিছানায় গিয়ে আর শুতে পারল না ভিনসেন্ট। আবার সে খোলা জানলার ধারে এসে দাঁড়াল। ভোর হতে এখনও দেরি, দিগন্তে দপদপ করছে শুকতারাটা। দ্যবিনির আঁকা প্রভাতী তারার চিত্রটা তার স্মরণে ভেসে উঠল—অন্ধকার আকাশের ওই ধ্রুবতারা, আর তার নীচে বিরাট বিশ্বের বিপুল প্রশান্তি, আর অনাদ্যন্ত সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে অকিঞ্চিৎকর একটি মানুষ, যে একলা তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে ওই তারার দিকে।

পরদিন সকাল বেলা প্রাতরাশ সারার পর বাতুলরা সব বাগানে গেল। সেখানে বল নিয়ে রুটিন-বাঁধা অনাসক্ত তাদের খেলাধুলো। পাথরের একটা বেঞ্চিতে বসে বসে ভিনসেন্ট তাদের দেখতে লাগল। প্রাচীরের বাইরে দেখা যাচ্ছে তৃণহীন পর্বতরাজি। সেন্ট জোসেফ দ্য অরেনাস সম্প্রদায়ের ধর্মযাজিকারা কালো-সাদা পোশাক পরে প্রাচীন রোমক গির্জায় চলেছে, গর্তে বসা ভাষাহীন তাদের চোখ। ডান হাতে মালা ঘোরাচ্ছে, আর বিড়বিড় করছে প্রভাতী নামজপ।

এক ঘণ্টা পরে সবাই ফিরে এল ওয়ার্ডে। আবার বসল যে-যার চেয়ারে। তাদের এমনি অপরিসীম অকর্মণ্যতা দেখে ভিনসেন্টের বিস্ময় লাগে। সারা ওয়ার্ডে এক পাতা পুরোনো খবরের কাগজও নেই যে চোখ বোলানো চলে।

এমন নির্বাক স্থাণুত্ব কতক্ষণ সহ্য হয়! ভিনসেন্ট আবার বাগানে গেল, পায়চারি করতে লাগল উদ্দেশ্যবিহীন। সূর্যের আলোও এখানে যেন মুমূর্ষু, নিষ্প্রাণ। একবার ইচ্ছে করল ছুটে পালায় এখান থেকে। কিন্তু লোহার গেট তালাবন্ধ, আর পাঁচিলগুলো সব বারো ফুট উঁচু।

বুনো গোলাপের একটা ঝাঁকড়া ঝোপের ধারে বসে পড়ল ভিনসেন্ট। ভাবতে লাগল, কিন্তু ভেবে পেল না, কেন, কেন সে এই অর্ধমৃতদের আস্তাবল সেন্ট পলে এসে আস্তানা নিয়েছে। সমস্ত প্রাণ ভরে গেল অবসাদে, সমস্ত মন ডুবে গেল গভীর একটা আতরে। আর ভরসা নেই, আর ফল নেই বৃথা ভাবনা ভেবে। ভরসাবিহীন আসক্তিবিহীন জীবমৃত্যু, এই শেষ পর্যন্ত তার ললাটলিখন!

পায়ে পায়ে সে ফিরে চলল ওয়ার্ডে। বাড়ির বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র তার কানে এল অদ্ভুত রকমের কুকুরের ডাক। ঘরের চৌকাঠে পা দেবার মধ্যেই কুকুরের ডাক নেকড়ের চিৎকারে পরিবর্তিত হয়েছে।

এগিয়ে চলল ভিনসেন্ট। দীর্ঘ ওয়ার্ডের এক কোণে দেয়ালের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে গতরাত্রের সেই বুড়ো লোকটা। ছাদের দিকে মুখ উঁচু করে লোকটা তার গলার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওই অদ্ভুত জন্তুর চিৎকার করছে, রক্তবর্ণ মুখে ফুটে উঠেছে কেমন একটা পাশবিক ভাব। নেকড়ের চিৎকারের পর আবার নতুন রকমের চিৎকার শুরু হল, অরণ্যের কোনো বন্য পশুর কান্না।

এ কোন চিড়িয়াখানায় এরা বন্দি করেছে আমাকে! মনে মনে বলল ভিনসেন্ট।

আর সবাই বসে আছে স্টোভের ধারে ধারে যে-যার চেয়ারে, বুড়োটা চেঁচিয়ে চলেছে—যেন কোনো মার খাওয়া জানোয়ারের মরণ-আর্তনাদ! সহ্য করা যায় না। ভিনসেন্ট চেঁচিয়ে বলে উঠল—এ কী! লোকটাকে থামানো যায় না কিছুতেই? দু-পা সে এগিয়ে যেতেই তার পথ আটকে দাঁড়াল কাল রাত্রের সেই সুন্দর চেহারার তরুণটি।

বললে—না; ওকে ঘাঁটাবেন না। তাহলে এমন খেপে যাবে যে আর সামলানোর উপায় থাকবে না। ঘণ্টা কতক চেঁচিয়ে ও আবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।

পালিয়ে গেল ভিনসেন্ট ঘর ছেড়ে। লুকিয়ে গিয়ে বসে রইল বাগানের অনেক দূরের এক কোণে। মঠবাড়ির পাথরের দেয়াল ভেদ করে সারা সকাল ধরে তার কানে আসতে লাগল উন্মাদ মানুষের কণ্ঠে জানোয়ারের ভাষায় বুকফাটা বীভৎস আর্তনাদ।

সন্ধে বেলা সাপার খেতে বসেছে সবাই। হঠাৎ একটি যুবক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। লোকটার শরীরের সারা বাঁ-দিকটায় পক্ষাঘাত। ডান হাত দিয়ে বুকের উপর একটা ছুরি ধরে হেঁকে উঠল সে—সময় হয়েছে, এইবার আমি মরব, এই ছুরি বিধিয়ে নিজের হাতে মরব!

দু-চোখ বিস্ফারিত করে ভিনসেন্ট তাকিয়ে রইল মত্ততার আর-এক অভিব্যক্তির দিকে।

পাগলটার ডান দিকে আর-এক যে-পাগল বসে ছিল, সে নিতান্ত ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়াল। ছুরিসুদ্ধ লোকটার ডান হাতটা চেপে ধরে সে বললে—আজ নয় রেমন্ড, আজ যে রবিবার।

হোক রবিবার। এই মুহূর্তে আমি আর বাঁচতে চাইনে। হাত ছেড়ে দাও! হ্যাঁ, আজ এখুনি…

কাল রেমন্ড, কাল। আজ দিনটা ভালো নয়।

ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমার হাত! এই ছুরিটা আমি আমূল বিধিয়ে দেব আমার বুকের মধ্যে! দেখো তোমরা সবাই!

নিশ্চয়ই, দেবে বই কী। কিন্তু এখনই নয়। এরও তো একটা দিনক্ষণ আছে। কাল….

রেমন্ডের-হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে লোকটা তাকে খাবার ঘর থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে চলল। ব্যর্থতার আক্রোশে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলল সে।

ভিনসেন্ট তার পাশের চেয়ারের লোকটার দিকে তাকাল। চোখ দুটো লোকটার লাল দগদগে, উপদংশ ব্যাধির উপসর্গ। প্রশ্ন করলে—ওরকম করেছিল কেন?

ও তো রোজকার ব্যাপার! রোজই ও একবার করে খেপে ওঠে আত্মহত্যা করার জন্যে।

তা এমনি সকলের সামনে কেন? একটা ছুরি লুকিয়ে রাখলেই পারে, তারপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিশুতি রাত্রে…

আসলে বোধ হয় মরতে ও চায় না, মশিয়েঁ।

পরদিন সকালে উন্মাদরা যখন মাঠে নিয়মিত ব্যায়াম করছিল, একজন লোক হাত-পা ছুড়ে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে উলটে পড়ল সশব্দে। শুরু হল তার প্রবল খিঁচুনি।

এই সেরেছে, মৃগীরোগী উলটেছে! চিৎকার করে উঠল একজন।

আর-একজন বললে—চেপে ধরো ওর হাত-পা!

চেপে ধরতে লাগল চার-পাঁচজন। মূর্ছাগ্রস্ত মৃগীর শরীরে অমিত শক্তি। গতকালকার সেই সুন্দর ছেলেটি পকেট থেকে চট করে একটা চামচ বার করে মৃগীরোগীর দুই চোয়ালের ফাঁকে পুরে দিল, যাতে সে নিজের জিভটাকে কামড়ে দু-টুকরো করে না ফেলে।

প্রায় আধ ঘণ্টার প্রবল তাড়নের পর লোকটা একেবারে অচৈতন্য হয়ে পড়ল। পড়ে রইল নিশ্চল হয়ে। ভিনসেন্ট আর দুজন তাকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ব্যাস, এই পর্যন্ত। এ সম্বন্ধে কেউ আর কথা বলল না একটিও।

দু-সপ্তাহের মধ্যে ভিনসেন্ট তার এগারোজন পাগল সঙ্গীর প্রত্যেকের পাগলামির উপসর্গের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেল। একজন খেপে খেপে উঠে চিৎকার করে আর পোশাক পরিচ্ছদ বিছানাপত্র সব ছেড়ে, একজন আর্তনাদ করে বিভিন্ন জন্তুর স্বরের অনুকরণে, একজন সর্বদা আত্মহত্যা করব বলে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে, তা ছাড়া দুজনের মাথা খারাপ রতিজ রোগ, থেকে, দুজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত উন্মাদ, একজনের মৃগী, একজনের মত্ততার প্রকাশ দুর্বলের প্রতি নিষ্ঠুরতায়, একজন বোবা আর একজন চমকে উঠছে এই ভয়ে—ওই বুঝি পুলিশ ধরল তাকে।

একটি দিনও কাটে না যে-দিন কারুর-না-কারুর পাগলামি ফেটে না পড়ে। এমন দিন যায় না যে-দিন একজন উন্মাদের শুশ্রূষা ভিনসেন্টকে করতে না হয়। তৃতীয় শ্রেণির যারা রোগী তারাই এর-ওর ডাক্তার, এর-ওর নার্স। দুনিয়া তাদের বরবাদ করে দিয়েছে, আত্মীয়স্বজন করেছে আপদ বিদায়। সিস্টারদের টিকি দেখা যায় না প্রকৃত সেবার সময়ে, ডাক্তার নিজেই আসেন সপ্তাহে মাত্র একবার। রোগীর দলের প্রত্যেকেই জানে কবে তার নিজের আসবে সংবিৎহারা মত্ততা। তখন এই অন্ধকূপের যারা তার জীবনসঙ্গী তারাই তাকে ধরবে, সামলাবে, সহ্য করবে, যতটা পরিবর্তন করবার করবে। পারস্পরিক মায়া-মমতায় ঘেরা পাগলদের এই থার্ড ক্লাস কামরা।

ভিনসেন্টের দুঃখ নেই, বরং খুশিই সে এখানে এসেছে বলে। বিভিন্ন উন্মাদের দৈনন্দিন জীবন আর বিচিত্র উন্মত্ততার প্রত্যক্ষ পরিচয় তার পক্ষে মস্ত অভিজ্ঞতা, পাগলামির ভয়টাও তার কাটছে। আস্তে আস্তে তার উপলব্ধি হচ্ছে যে বাতুলতা একটা ব্যাধি মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। সঙ্গী হিসেবে তত ভয় নয়, যত ভয় যক্ষ্মা বা ক্যান্সার রোগীকে।

মাঝে মাঝে ভিনসেন্ট আলাপ করবার চেষ্টা করে বোবা বাতুলটার সঙ্গে। লোকটা কথা বলতে পারে না, লালা-ঝরা মুখ দিয়ে কেবল হাউহাউ আওয়াজ করে। কিন্তু ভিনসেন্টের মনে হয়, সে যে ওর সঙ্গে আলাপ করে তাতে ও খুশিই হয়, তার কথা ওর সহসা উপলব্ধির কোথায় গিয়ে যেন বাজে। নার্সরা এক হুকুম করা ছাড়া কোনো রোগীর সঙ্গে কথা বলে না। সপ্তাহে একবার করে ডাক্তার পেরন এলে সে তাঁর সঙ্গে মিনিট পাঁচেক করে আলাপ করবার সুযোগ পায়, সেইটুকুই তার সুস্থ স্বাভাবিক কথাবার্তার সুযোগ।

আচ্ছা বলুন তো ডাক্তার—একদিন সে প্রশ্ন করল—এরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে না কেন? সুস্থ অবস্থায় এদের অনেকেরই তো বেশ বুদ্ধিসুদ্ধি আছে দেখি।

ওরা কথা বলতে চায় না ভিনসেন্ট। বোঝে কথা বলতে বলতেই তর্ক শুরু হবে, আর মনে উত্তেজনা এলেই পাগলামি ওদের চেপে ধরবে। ওরা বুঝেছে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে হলে যতটা সম্ভব চুপ করে থাকাই ওদের দরকার।

কিন্তু এর নাম কি বেঁচে থাকা! এ তো মরারই শামিল।

তা বলতে পারো, এটা হল মতের কথা।

কিন্তু চুপ করে বই পড়লেও তো পারে। পড়াশুনো করলে তো—

হ্যাঁ, পড়াশুনো করা মানে মনটাকে মন্থন করা। তারও ফল প্রচণ্ড মত্ততা। না ভায়া, চারিদিক কালো দেয়াল দিয়ে ঘেরা ওদের নিজের নিজের বন্ধ স্থানটিতে চুপ করে বসে না থেকে ওদের উপায় নেই। ওদের জন্যে তাই বলে দুঃখ করবার প্রয়োজন নেই। ড্রাইডেনের সেই কথাটা মনে নেই?—‘পাগল হওয়ার মধ্যেও সুখ আছে, সে সুখ কেবল পাগলেই উপভোগ করতে পারে।’

এক মাস কাটল। এই এক মাসের মধ্যে ভিনসেন্টের একবারও এ-জায়গা ছেড়ে যাবার অভিলাষ হয়নি। এই উন্মাদাশ্রম ছেড়ে যাবার জন্যে আর কার যে ইচ্ছে আছে তাও তার একবারও মনে হয়নি। এমনি অভিলাষবিহীন স্বৰ্গ, সে জানে এর মূল কোথায়। প্রত্যেকে জানে, আশা নেই ভরসা নেই কারও, কারও নেই বহির্বিশ্বে এক ইঞ্চি জায়গা। তাই এই কারাগারই ভালো, এইখানেই মুক্তি, এইখানেই পরিত্রাণ।

প্রতীক্ষা শুধু চরম পরিত্রাণের, সারা ওয়ার্ড জুড়ে গন্ধ শুধু মরন্ত মানুষের।

শক্ত করে নিজের মনটাকে বেঁধে রাখে ভিনসেন্ট। মৃত্যুর প্রতীক্ষায় নয়, কবে আবার শক্তি ফিরে পাবে, বাসনা ফিরে পাবে আঁকবার, সেই দিনের প্রতীক্ষায়। তার সঙ্গীরা যা পায় তা-ই শুধু তিন বেলা খায় আর অলস রোমন্থন করে। ভিনসেন্ট আপ্রাণ চেষ্টা করে বিনষ্ট জীবনের সেই ব্যর্থ জগদ্দলকে দূরে সরিয়ে রাখতে। থিয়ো তাকে এক ভল্যুম শেক্সপিয়র পাঠিয়েছে—’রিচার্ড দি সেকেন্ড’, ‘হেনরি দি ফোর্থ’ আর ‘হেনরি দি ফিফথ’ সে পড়ে ফেলেছে, মনকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছে অন্য যুগে অন্য রাজ্যে।

বুকের মধ্যে বেদনার জোয়ার বন্যার মতো ফুঁসে ফুঁসে ওঠে, ডুবিয়ে দিতে চায়, প্রাণপণে বাঁধ বাঁধে সে আশ্বাসের।

.

বিয়ে করেছে থিয়ো। সে আর তার নববিবাহিতা স্ত্রী জোহানা প্রায়ই ভিনসেন্টকে চিঠি লেখে। থিয়োর শরীর ভালো নয়। এ-ভাবনা ভিনসেন্ট ভাবে, জোহানাকে চিঠি লেখে নিজে হাতে ভালো করে রান্না করে থিয়োকে খাওয়াতে। এত বছর রেস্তরাঁতে খেয়ে খেয়েই দেহ তার পাত হতে চলেছে।

সপ্তাহ দুয়েক পরে ডাক্তার পেরন তার জন্যে ছোটো স্টুডিয়োর ব্যবস্থা করে দিলেন। পাঁশুটে সবুজ রঙের ঘরটার দেয়াল। ম্লান গোলাপ ফুল আঁকা সবুজ রঙের দুটি পর্দা আর একটি পুরোনো আরামকেদারা—এ দুটি দ্রব্য পয়সাওয়ালা এক মৃত রোগীর নিদর্শন। জানলার বাইরে সোজা চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র—মুক্তির আহ্বান। জানলায় অবশ্য কালো কালো মোটা মোটা লোহার গরাদ।

জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়া মাত্র ভিনসেন্ট বহির্দৃশ্যটা আঁকা শুরু করে দিল। ছবিটার সামনের দিকে ঝড়ে নুয়ে পড়া শস্যখেতের কিছুটা অংশ, ঢালু বেয়ে একটা দেয়াল, দূরে কয়েকটি অলিভ গাছ, কয়েকটি কুটির আর পাহাড়ের শ্রেণি। ছবির একেবারে মাথায় সুনীল আকাশের গায়ে মস্ত একটা ধূসর-সাদা মেঘ।

সারাদিন ছবি আঁকার পর সাপার খাবার সময় সে ওয়ার্ডে ফিরে এল। উৎফুল্ল তার মন, ক্ষমতা সে হারায়নি, প্রকৃতি তাকে পরিত্যাগ করেনি একেবারে। প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে আবার সৃষ্টির প্রেরণাকে ফিরে পেয়েছে।

ভয় কী তার? জীবমৃতদের এই আস্তানা আর তাকে মারতে পারবে না। এইবার সে সেরে উঠল বলে। কমাস পরেই সে বার হবে এখান থেকে। ফিরে যাবে প্যারিসে, পুরোনো বন্ধুদের আড্ডায়। এই তো তার নবজীবনের সূচনা। লম্বা চিঠি লিখল থিয়োকে রং চেয়ে, তুলি চেয়ে, ক্যানভাস আর নতুন নতুন আকর্ষণীয় বই চেয়ে

পরদিন সকাল বেলা মেঘহীন উজ্জ্বল আকাশে উঠল জ্বলন্ত হলুদ সূর্য। ভিনসেন্ট তার ইজেল নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বাইরে বাগানে গেল, পাইন গাছ, বন, ঝোপ আর বাগানের হাঁটা-পথ মিলিয়ে শুরু করল একটি দৃশ্যপট আঁকা। ওয়ার্ডের অন্য বাসিন্দারা পেছনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে সম্ভ্রমভরা চোখে দেখতে লাগল তার কাজ।

বিকেল বেলা সে গেল ডাক্তার পেরনের সঙ্গে দেখা করতে।

আমি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছি ডাক্তার, বাইরে মাঠে গিয়ে ছবি আঁকতে আমাকে অনুমতি দিন।

ডাক্তার বললেন—তা, তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে ভিনসেন্ট যে তুমি যথেষ্ট ভালো হয়েছ। স্নান আর বিশ্রাম এই দুয়ে মিলে তোমার খুব উপকার করেছে। তবু বাইরে যাওয়া এখনই কি তোমার উচিত হবে?

কেন ডাক্তার পেরন, কেন উচিত হবে না?

ধরো মাঠের মধ্যে একলা, এমনি অবস্থায় যদি হঠাৎ তোমার আবার স্ট্রোক হয়?

হেসে উঠল ভিনসেন্ট—কী বলেন! আবার পাগলামির আক্রমণ? ভুলে যান ডাক্তার, ও আর আমার হবে না। ওসব শুরু হবার আগে নিজেকে যতটা ভালো লাগত, এখন তার চাইতে অনেক বেশি ভালো লাগছে আমার।

তবু ভিনসেন্ট, আমার ভয় হয়—

কিছু ভয় নেই ডাক্তার, আমার অনুরোধ’ আপনি রাখুন। যেখানে খুশি ঘুরব, যা ভালো লাগে আঁকব বিশ্বাস করুন, এই হচ্ছে আমার এখন ওষুধ। কাজ না করলেই বরং আবার আমি ডুবব।

বেশ, কাজ করলেই যদি তুমি ভালো থাকবে বলে মনে করো—

ভিনসেন্টের জন্যে উন্মাদনিকেতনের লোহার দরজা উন্মুক্ত হল। পিঠে ইজেল বেঁধে পথে বার হল ভিনসেন্ট আবার, ছবির উপাদানের অন্বেষণে। সারাদিন তার কাটতে লাগল উন্মাদাগার থেকে দূরে পাহাড়ে জঙ্গলে। সেন্ট রেমির আশপাশের সাইপ্রেস কুঞ্জ ভিড় করে এল তার ভাবনায়। আশ্চর্য সুন্দর ওরা, সোনালি দৃশ্যপটের মাঝে ফুটে ওঠা ওদের কালো রূপের কী অপূর্ব মহিমা! কেন ওদের সে দেখেও দেখেনি এতদিন, আর্লসের সূর্যমুখীর ছবিগুলোর মতো ওদের নিয়েও কি প্রাণভরা ছবি আঁকতে সে পারবে না?

আর্লসের দিনের পুরোনো অভ্যাসগুলো সব ফিরে এল আবার। প্রতিদিন ভোর বেলা সে রং-তুলি, ইজেল আর ক্যানভাস নিয়ে বার হয়, সম্পূর্ণ একটি ছবি এঁকে নিয়ে আসে সন্ধ্যা বেলা। সৃজনীশক্তিতে যদি-বা একটু ভাটা পড়েছে, তা সে ধরতেও পারে না। মনে হয়, আবার সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। শক্তি বাড়ছে দিনে দিনে, অনুভূতি হচ্ছে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর।

তিন মাস কাটবার পর হঠাৎ একদিন তার রক্তে নেশা ধরিয়ে দিল ওই সাইপ্রেস গাছ, সেই নেশা তাকে নিয়ে গেল দুঃখসুখের ঊর্ধ্বে, সব বেদনা পেরিয়ে। বিরাট বিরাট গাছগুলো। ছবি শুরু করল ওদের নিয়ে। ছবির সামনের দিকটা নানাপ্রকার গুল্মে ভরা, পেছনে বেগুনি রঙের কয়েকটা পাহাড়, গোলাপি সবুজে মেশা আঁধার-করা আকাশ, তাতে ক্রমহ্রাসমান চন্দ্র। সে-দিন রাত্রে ঘরে গিয়ে ক্যানভাসটা যখন ভালো করে দেখল, বুঝল সে, আর তার ভয় নেই। অন্ধকার গহ্বরবাসের যুগ তার অতিক্রান্ত, আবার শক্ত মাটিতে এসে দাঁড়িয়েছে খোলা আকাশের নীচে, সামনে তার নবোদ্ভাসিত সৃজনসূর্য।

আনন্দের বান ডাকল সারা প্রাণে। মুক্তি, মুক্তি! আবার সে মুক্ত মানুষ! পিঞ্জরাবদ্ধ জন্তুর দুর্ভাগ্য তার কাটল এতদিনে

থিয়ো তাকে বেশি কিছু টাকা পাঠাল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সে গেল আর্লসে, হলদে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে তার ছবিগুলো ছাড়িয়ে আনবার জন্যে। প্লেস লা মার্টিনের অধিবাসীরা তার সঙ্গে যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করল, কিন্তু হলদে বাড়িটা দেখেই মাথাটা যেন কেমন করে উঠল। মনে হল এই বুঝি মুর্ছা যাবে। ঠিক ছিল প্রথমে যাবে ডাক্তার রে আর রুলিনের কাছে, কিন্তু মত বদলে তাড়াতাড়ি ছুটল মালিকের সন্ধানে। সকলের আগে ছবিগুলো উদ্ধার করা চাই-ই চাই।

কথা রাখতে পারল না। বলেছিল সে-দিন রাত্রেই ফিরে আসবে আর্লস থেকে। পরদিন সকাল বেলা তার মূর্ছিত দেহটা পাওয়া গেল টারাসকন আর সেন্ট রেমির মাঝামাঝি জায়গায়। পথের ধারে একটা খাদের মধ্যে উপুড় করা, মাথাটা ডোবানো।

প্রচণ্ড জ্বর, আচ্ছন্ন চৈতন্য। এমনি কাটল তিন সপ্তাহ। ওয়ার্ডের অন্য অধিবাসীরা খুব করল তার জন্যে। কী তার ঘটেছিল তা উপলব্ধি করার মতো মাথাটা যখন পরিষ্কার হল, বারে বারে সে বলতে লাগল—ছি, ছি! কী করেছি! কী কেলেঙ্কারি!

তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে সে ওয়ার্ডের বারান্দায় একটু একটু চলাফেরা করতে পারছে। শরীর তখনও দুর্বল, কিন্তু মনটা সুস্থ হয়ে এসেছে অনেকটা। এমনি সময় একদিন সিস্টাররা একজন নতুন রোগীকে ভরতি করল। রোগীটি বেশ শান্তভাবে তার বিছানায় এসে বসল, কিন্তু সিস্টাররা পেছন ফেরামাত্র ফেটে পড়ল পাশবিক উন্মত্ততায়। লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে উঠল গলা ফাটিয়ে, নিজের সমস্ত জামাকাপড় আর বিছানার চাদর বালিশ সব নখ দিয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে, তারপর খাট, বাক্স, পর্দার কাঠ, সব মড় মড় করে ভাঙল।

আনকোরা নতুন রোগীকে পুরোনো বাসিন্দে রোগীরা ছোঁয় না, পাগলামিতে যত সর্বনেশেই সে হয়ে উঠুক না কেন। হাসপাতালের কয়েক জন পরিচারক ছুটে এসে উন্মাদটাকে ধরে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে গেল ওয়ার্ড থেকে। বারান্দার পাশে খালি একটা কুঠুরির মধ্যে তাকে তালা দিয়ে রাখা হল। প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে পাগলটা ঘা-খাওয়া বন্দি জানোয়ারের মতো দিনরাত অবিশ্রাম আর্তনাদ করতে লাগল। তার এই নিরবচ্ছিন্ন চিৎকার অসুস্থ ভিনসেন্টের মাথার মধ্যে বাজতে লাগল কশাঘাতের মতো। তারপর একদিন সব চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। ভিনসেন্ট লক্ষ করল হাসপাতালের লোকেরা অদূরের কবরখানায় লোকটাকে মাটি চাপা দিচ্ছে।

সাংঘাতিক একটা অবসাদ কালো কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করল ভিনসেন্টের মন। শরীর তার যতই সেরে ওঠে, বিচারবুদ্ধি যতই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে; এই অবসাদ তত ঘন হয়ে মনের আকাশে জমে। কী হবে শিল্পী হয়ে? কী হবে ছবি এঁকে? কী মূল্য জীবনের? কিন্তু জীবন যতদিন আছে, কাজ না করে, ছবি না এঁকেই-বা সে করবে কী!

ডাক্তার পেরন তার স্বাস্থ্যোন্নতির জন্যে আলাদা করে কিছুটা মাংস ও মদের ব্যবস্থা করে দিলেন, কিন্তু তাকে স্টুডিয়োতে যাবার অনুমতি কিছুতেই দিলেন না। সুস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গে পাগল সঙ্গীদের সঙ্গে কর্মহীন দিন কাটিয়ে আর অসহ্য অলসতা দেখে দেখে নিজেই আবার প্রায় পাগল হয়ে উঠল ভিনসেন্ট, ছুটে গেল ডাক্তার পেরনের কাছে।

সোজাসুজি সে বললে—ডাক্তার পেরন, কাজ না করলে আমি কিছুতেই সুস্থ হব না। ওইসব পাগলদের সঙ্গে হাত গুটিয়ে চুপ করে থেকে যদি আমার জীবন কাটে, তাহলে আর ক-দিন পরে ওদেরই মতো পাগল হয়ে যাব আমি।

তা বুঝি, ভিনসেন্ট। কিন্তু বেশি কাজ করে করেই তোমার আবার ওইরকম হয়েছিল। কাজ মানেই উত্তেজনা, ও তোমার চলবে না।

না ডাক্তার, কাজ করে আমার কিছু হয়নি। হল আর্লসে যাবার ফলে। প্লেস লা মার্টিন আর আমার পুরোনো সেই বাড়িটা দেখেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। আর্লসে আর আমি যাচ্ছিনে, পড়ছিওনে খানার মধ্যে আবার। যেতে চাই শুধু এখানকার আমার স্টুডিয়োতে।

ডাক্তার পেরন নিজে দায়িত্ব নিলেন না, লিখলেন থিয়োকে। থিয়ো উত্তর দিল সঙ্গে সঙ্গে—ছবি আঁকুক ভিনসেন্ট, যা হয় হোক।

সেইসঙ্গে সে একটি শুভ খবর দিল ভিনসেন্টকে। শীঘ্রই মা হতে চলেছে জোহানা। এমনি সুখবরের খুশিতে মুহূর্তে সুস্থ হয়ে উঠল ভিনসেন্ট। তখুনি সে লিখল থিয়োকে—আমার কী মনে হচ্ছে জান থিয়ো? নীল আকাশ আর চষা খেত, সবুজ ঘাস আর গ্রাম্য কিষাণ—এদের কাছ থেকে যে-ঐশ্বর্য আমি পেয়েছি, তোমার পরিবারের কাছ থেকেও তাই তুমি পাবে। তোমাকে উপহার দেবার জন্যে যে-সন্তানটিকে জোহানা তার গর্ভে সৃষ্টি করে চলেছে, সে-ই তোমাকে দেবে বাস্তবের সন্ধান, জীবনসত্যের সঙ্গে তোমাকে নিত্য-বন্ধনে বাঁধবে সে-ই। জোহানা গর্ভে শিশুটির নড়াচড়া ধরতে পারবে, আর প্রসূতির গভীর প্রাণস্পন্দন তোমার প্রাণে এসে স্পন্দিত হবে।

আবার সে অনুমতি পেল স্টুডিয়োতে যারার। জানলার ধারে বসে বসে আঁকল সামনের শস্যখেতটা, নিঃসঙ্গ একটি কৃষাণ আর আকাশে মস্ত সূর্য একলা সারা ছবিটা জুড়ে হলুদ রঙের মেলা, কেবল জানলার ঠিক বাইরে কয়েদখানার প্রাচীরের কর্কশ রেখা আর দূরে বেগুনি পাহাড়ের দিগন্তস্পর্শ ছাড়া।

থিয়োর অভিলাষ অনুসারে ডাক্তার পেরন তাকে বাইরেও যেতে দিল কিছু দিন পরে।

আবার তার মনে সাইপ্রেস গাছের নেশা লাগল। আঁকল সাইপ্রেস, আঁকল অলিভ সংগ্রহকারিণী ক-টি মেয়ের আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবি।

মাঠে যেতে যেতে কোনো চাষির সঙ্গে দেখা হলে তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে শুরু করল সে। নিজেও সে চাষি, তার বেশি কিছু নয়। একদিন একজনকে বললে—দেখো, তুমি যেমন লাঙল চষ মাটিতে, আমিও তেমনি চষি ক্যানভাসের ওপর, ফসল ফলাও তুমি, আমিও তাই।

এল শরতের শেষ। সারা প্রকৃতিতে রূপের পরম প্রকাশ, রঙের বিচিত্রতম লীলা। সারা মাটি ছেয়ে গেল ভায়োলেটে, বাগানে গোলাপ গাছের নীচে নীচে রৌদ্র-জুলা ঘাসে আগুন-মাখা লালচে আভা, কাঁচা রোদের রঙে রঙে গাছের সব পাতা সোনালি-হলুদ হয়ে উঠছে, মেঘহীন আকাশে মন-উধাও-করা নীলিমা।

আর এই শেষশরতের সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণ শক্তি ফিরে পেল ভিনসেন্ট। কাজে সে বাধা পাচ্ছে না, ভালো ভালো আইডিয়া তার মাথায় আসছে, দানা বাঁধছে। এখানকার বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়ও নিবিড় হচ্ছে দিনে দিনে। আর্লসের মতো সর্বনেশে মত্ততা-জাগানো জায়গা নয় এই সেন্ট রেমি। সূর্যের তেজ কম, পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে দিগন্ত প্রান্ত থেকে ঝড় ফিরে ফিরে যায়। প্রকৃতির শোভা মনকে কেড়ে নেয়, বেঁধে রাখে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকে, উন্মাদাগারকে আর কয়েদখানা বলে মনে হয় না। মনে হয়, ও হাসপাতাল নয়, হোটেল। বেশ আছে, কোথায় সে আবার ঘুরে মরতে যাবে এমন জায়গা ছেড়ে!

প্যারিসের চিঠি সর্বদা মনে খুশির খোরাক জোগায়। জোহানা নিজের হাতেই রাঁধছে ডাচ খাবারদাবার, থিয়োর শরীর ভালো হচ্ছে দিনে দিনে। প্রসূতিরও স্বাস্থ্য ভালো। তা ছাড়া শুধু চিঠি নয়, থিয়ো প্রায়ই পাঠাচ্ছে তামাক বা চকোলেট, বই বা খুচরো টাকা। ছবি আঁকার সরঞ্জাম তো আসছেই যত চাই।

আর্লসে গিয়ে যে-উন্মত্ততার আক্রমণে পড়েছিল সে-কথা ভুলেই যেতে চায় ভিনসেন্ট। তার দৃঢ় ধারণা, ওই দুর্ভাগ্যের শহরে যদি সে পা না বাড়াত তাহলে ছ-টি মাস সে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকতে পারত। মাঝের কেলেঙ্কারিটা ঘটত না। সাইপ্রেস আর অলিভ গাছের ছবিগুলো আঁকা শেষ করে সেগুলো একটু মদ দিয়ে ওয়াশ করে ভিনসেন্ট থিয়োর কাছে পাঠিয়ে দিল। থিয়ো উত্তরে লিখল, তার কয়েকটা ছবি ইন্ডিপেন্ডেন্টস গ্যালারিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছে। এতে সে খুব যে খুশি হল তা নয়। এখনও যে তার হাত পাকেনি, শ্রেষ্ঠ শিল্পসৃষ্টি করতে তার যে এখনও অনেক দেরি—এরই মধ্যে?

থিয়ো সর্বদাই তাকে লেখে, খুব ভালো কাজ করছে সে, খুব উন্নতি হচ্ছে তার ছবির। ভিনসেন্ট ঠিক করেছে এই হাসপাতালের এক বছরের মেয়াদ শেষ হলে এখানেই সে থাকবে। গ্রামের মধ্যে একটা বাড়ি ভাড়া করে নেবে। কত কাজ এখানে তার বাকি! গগাঁ এসে জোটার আগে আর্লসে প্রথম প্রথম যেমন সার্থক আনন্দের সন্ধান পেয়েছিল, তেমনি আনন্দে আবার তার মন ভরে উঠছে।

একদিন বিকেল বেলা শান্ত মনে মাঠের মাঝখানে বসে সে ছবি আঁকছে একলা, হঠাৎ মাথার মধ্যেটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। মুহূর্ত পরে আর-কিছু মনে নেই। গভীর রাত্রে হাসপাতালের রক্ষীরা খুঁজে পেল তাকে তার ইজেল যেখানে পেতেছিল সেখান থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। একটা সাইপ্রেস গাছের কাণ্ডের সঙ্গে কাঠ হয়ে জড়িয়ে আছে তার অনড় মূর্ছিত দেহটা।

পুরো পাঁচ দিন পরে ভিনসেন্টের স্বাভাবিক চৈতন্য ফিরে এল। মানসিক ব্যাধির দ্বিতীয় বারের এই আক্রমণের পর সবাই এটাকে অবশ্যম্ভাবী বলে মেনে নিয়েছে, এইটে জেনেই সবচেয়ে খারাপ লাগল তার।

শীতকাল এল। দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে রইল ভিনসেন্ট, ওঠবার মতো মানসিক শক্তি নেই। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত রোগীরা ঘরে বসে থাকে স্টোভটাকে ঘিরে। দেয়ালের উঁচু উঁচু ছোটো ছোটো জানলাগুলো দিয়ে যত না আলো আসে, বন্ধ ঘরে ছায়া জমে তার চেয়ে বেশি। স্টোভটার গরম শীত তাড়ায়, সারা ঘর ভরে যায় জীবতের কটু গন্ধে। কালো কালো টুপি আর ওড়নার নীচে সিস্টারদের মুখ আরও ঢাকা পড়ে, মালা ঘোরাতে ঘোরাতে আর নাম জপ করতে করতে তারা ছায়ামূর্তির মতো সায়াহ্নে বারান্দায় ঘোরে। দূরে শষ্পহীন রুক্ষ পাহাড় যেন মৃত্যুর পাহারা।

ঘুম আসে না। চুপ করে বিছানায় পড়ে থাকে ভিনসেন্ট। মনে মনে ভাবে, শিল্প থেকে সে কী শিখেছে, কী শিখেছে মহৎ সাহিত্য থেকে? দুঃখ পাও কিন্তু অভিযোগ কোরো না, বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হবে হৃদয়, কিন্তু ঘৃণা কোরো না বেদনাকে। এ-শিক্ষা মহৎ, কিন্তু দিনে দিনে বেদনা আনে মত্ততা, যন্ত্রণা নিয়ে চলে মৃত্যুর পথে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমনি একটা মুহূর্ত আসে যখন বুকের মধ্যে সঞ্চিত বেদনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয় জীর্ণ কন্থার মতো।

দিন কাটে নিষ্ফল পৌনঃপুনিকতায়। কোনো কল্পনা আসে না মনে, জাগে না কোনো আশা। সিস্টাররা তার ছবি আঁকা নিয়ে আলোচনা করে, বলাবলি করে–সে ছবি এঁকেই পাগল হয়েছে, না পাগল হয়েছে বলেই ছবি আঁকে। ওদের কথা কানে আসে মাঝে মাঝে।

বোকা বাতুলটা কোনো কোনো দিন বিছানার ধারে তার পাশে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাউহাউ করে যায়। নিজেকে সে ব্যক্ত করতে পারে না, ওই ভাষাহারা ধ্বনির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করতে চায় বন্ধুত্বের উষ্ণতা। ভিনসেন্ট তাকে তাড়িয়ে দেয় না, কখনও কখনও তাকে সামনে রেখে কথা বলে যায়। কথা বলার লোক চাই তো!

একদিন সিস্টাররা চলে যাবার পর ভিনসেন্ট জড় লোকটাকে বললে—ওরা কী ভাবে জানিস? ওরা মনে করে আমার কাজই আমাকে পাগল করেছে। এটা ঠিক যে শিল্পী শুধু তার দু-চোখ দিয়ে যা দেখে তাতেই মত্ত হয়ে যায়, জীবনের সবকিছু খুঁটিনাটির ওপর সে আর কড়া নজর রাখতে পারে না। কিন্তু তাই বলে তাকে কি লোকে পাগল বলে? বলে, সমাজে বসবাস করবার অনুপযুক্ত?

শেষপর্যন্ত দেলাক্রোয়ার বইয়ের একটি লাইন তাকে শক্তি দিল বিছানা ছেড়ে ওঠবার, সেই যে লাইনটি—‘যখন আমার বুকে নেই নিশ্বাসের জোর, মুখে নেই একটিমাত্র দাঁত, তখন আমি আবিষ্কার করলাম অঙ্কনশিল্পকে।’

শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু ওই পর্যন্ত। দু-পা হেঁটে বাগানে যাবার ইচ্ছাটুকু পর্যন্ত নেই। কয়েক সপ্তাহ কাটল শুধু স্টোভের ধারে চেয়ারে বসে থেকে থিয়োর পাঠানো এটা-ওটা বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে। সঙ্গীদের কারও যখন উন্মত্ততার আক্রমণ হয় তখনও সে চেয়ার ছেড়ে ওঠে না। মত্ততাকে আর তার আশ্চর্য লাগে না, যা অস্বাভাবিক তাকে স্বাভাবিক মনে করে নিতে একটুও তার বাধে না।

কর্মপ্রেরণার আভাসটুকু নেই মনে। এত অবসাদ, এত ক্লান্তি। যায় ডাক্তার পেরনের কাছে।

না ভিনসেন্ট, আমি দুঃখিত, কিন্তু ছাড়া তুমি পাবে না। গেটের বাইরে তোমাকে যেতে দেবার আমার উপায় নেই।

কিন্তু আপনি আমাকে স্টুডিয়োতে বসে কাজ করতে দেবেন তো?

তাতেও আমার মত নেই।

আপনি আমাকে আত্মহত্যা করতে বলেন ডাক্তার?

বটে? বেশ, স্টুডিয়োতে যেতে পারো। তবে বেশি খাটবে না, রোজ কয়েক ঘণ্টা মাত্র।

কোনো লাভ হল না। ইজেল আর রং-তুলির সান্নিধ্য বিন্দুমাত্র স্পন্দন জাগাল না মনে। দিনের পর দিন সে আরামকেদারায় হেলান দিয়ে নিশ্চলভাবে কাটিয়ে দিল জানলার লোহার গরাদের মধ্যে দিয়ে শীতের শূন্য মাঠের দিকে শুধু তাকিয়ে। ক-দিন পরে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি সই করে নেবার জন্যে ডাক্তার পেরনের আপিসে তার ডাক পড়ল। খামের মধ্যে চারশো ফ্র্যাঙ্কের একখানা চেক, আর থিয়োর চিঠি। চারশো ফ্র্যাঙ্ক! এত টাকা সে জীবনে পায়নি একসঙ্গে। কোত্থেকে থিয়ো পাঠাল!

মাই ডিয়ার ভিনসেন্ট,

হল শেষ পর্যন্ত! গত বছর বসন্তকালে আর্লসে থাকতে সেই যে লাল আঙুর কুঞ্জের ছবিটি এঁকেছিলে সেটি বিক্রি হয়েছে চারশো পাউন্ড দামে। ডাচশিল্পী বক-এর বোন আনা বক ছবিটি কিনেছেন।

অভিনন্দন জানাই তোমাকে, এবার থেকে তোমার ছবি সারা ইয়োরোপে বিক্রি হবে। চেকটা পাঠালাম, ডাক্তার পেরন যদি রাজি হন তো এই টাকায় প্যারিসে চলে এসো।

সম্প্রতি আমার একটি চমৎকার’ লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ডাক্তার গ্যাচেট। অভার্সে থাকেন, প্যারিস থেকে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তা। দ্যবিনি থেকে প্রত্যেকটি নামকরা শিল্পী তাঁর আশ্রয়ে থেকে কাজ করেছে। তিনি বলেন তোমার কেসটা তিনি ঠিক ধরেছেন, যে-দিন তুমি অভার্সে যাবে সে–দিন থেকেই তোমাকে তিনি তাঁর হাতে নেবেন।

কাল আবার লিখব।

থিয়ো

ভিনসেন্ট চিঠিটি ডাক্তার পেরন আর তাঁর স্ত্রীকে দেখাল। পেরন চিঠিটি মন দিয়ে পড়েই চেক-এ টাকার অঙ্কটিতে চোখ বুলিয়ে খুব উৎসাহে কথা বললেন ভিনসেন্টকে। ভিনসেন্ট বিদায় নিল অন্যমনস্কভাবে। তার মাথায় তখন আবার নতুন উদ্দীপনা জেগেছে। বাগানের কাঁচা রাস্তার আধাআধি গিয়ে হঠাৎ তার মনে পড়ল, চেকটা পকেটে করে এনেছে, কিন্তু থিয়োর চিঠিটা ডাক্তারের ঘরেই ফেলে এসেছে। তাড়াতাড়ি সে আবার ফিরে চলল।

দরজায় টোকা মারতে হাতটা তুলতেই কানে এল তারই নাম। তারই সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছে ঘরের মধ্যে। একটু চমকে সে চুপ করে দাঁড়াল, শুনতে লাগল কান পেতে।

মাদাম পেরন বলছেন—থিয়ো তাহলে এমন কাজটা করল কেন?

এই আশায় যে, ডাক্তার উত্তর দিচ্ছেন—এতে হয়তো তার ভাইয়ের উপকার হবে।

কিন্তু এত টাকা একসঙ্গে খরচা করার তার সামর্থ্য কোথায়?

সামর্থ্যের বাইরেও লোক করে। যদি ভিনসেন্ট আবার সুস্থ হয়ে ওঠে, এই দুরাশায়—

তাহলে তুমি বলছ এই ছবি কেনার মধ্যে কোনো সত্য নেই?

কোত্থেকে থাকবে? তুমি বুঝছ না মেরি, ছবিটা যে কিনেছে সে নাকি থিয়োর এক শিল্পীবন্ধুর বোন। এর থেকেও বুঝতে পারছ না?

নিঃশব্দে ভিনসেন্ট ফিরে গেল বন্ধ দ্বারের সামনে থেকে।

সন্ধ্যা বেলা খাবার সময় থিয়োর কাছ থেকে এল এক টেলিগ্রাম:

তোমার নামে খোকার নাম রাখলাম। জোহানা আর বাচ্চা ভিনসেন্ট খুব ভালো আছে।

ছবি বিক্রির খবর, থিয়োর ছেলে হওয়ার খবর, এই দুইয়ে মিলে এক রাত্রে ভিনসেন্টকে চাঙা করে তুলল। পরদিন ভোর না-হতেই সে দৌড়োল স্টুডিয়োতে। পুরোনো সব এদিক-ওদিক ছড়ানো ছবি একধারে গুছিয়ে ইজেল পাতল, তুলিগুলো ধুয়ে নিল ভালো করে। বললে মনে মনে—বুকে দম নেই আর মুখে দাঁত নেই, আর মাথায় আছে খালি পাগলামি। পারব আমিও।

নিঃশব্দ বিক্রমে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার কাজে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তার—আর থামবে না। দেলাক্রোয়ার ‘দি গুড সামারিটান’ আর মিলেটের ‘দি সোয়ার’ আর ‘দি ডিগার’ ছবিগুলো কপি করল সে। সে জানে প্রচণ্ড বিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনের চিত্রশিল্প। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কত পুরোনো আদর্শ, মস্থিত হয়ে উঠেছে কত ধ্যানধারণা। তবু ভাবনা কী তার, কীসের তার অনুযোগ?

চেকখানা পাবার ঠিক দু-সপ্তাহ পরে থিয়ের কাছ থেকে ডাকে সে পেল ‘মারকিউরি দ্য ফ্রান্স’ কাগজের জানুয়ারি সংখ্যাখানা। প্রথম পাতার প্রবন্ধটি থিয়ো লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দিয়েছে।

পড়তে লাগল সে:

ভিনসেন্ট ভ্যান গকের সমস্ত শিল্পসৃষ্টির মধ্যে যে অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা হচ্ছে শক্তির প্রাচুর্য, আত্মপ্রকাশের প্রমত্ততা। বস্তুর মূল সত্যটি তাঁর শিল্পে উদ্ঘাটিত, তাই তাঁর শিল্পরীতিতে দেখা যায় কখনও কখনও অনাড়ম্বর সারল্যের বলিষ্ঠ উন্মোচন—যে-উন্মোচনের রূপ শিল্পীর চোখের সামনে প্রকৃতির নগ্ন আত্মঘোষণায়। তাই শিল্পীর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে অনাবৃত আকাশের জ্বলন্ত সূর্য, তাই তাঁর রেখায় ও রঙে আদিম অনুভূতির প্রচণ্ড স্পন্দন। ভিনসেন্টের শিল্পসৃষ্টি পুরুষের সৃষ্টি, যে-পুরুষ নির্ভীক অভিযাত্রী, যার আত্মপরিচয় একাধারে কখনও নিষ্ঠুর ভয়াল, কখনও পেলব মধুর।

ভিনসেন্ট ভ্যান গক ডাচশিল্পী। ফ্রান্স হালস-এর ঐতিহ্য তাঁর সাধনার ভিত্তিমূলে। তাঁর যাঁরা পূর্বসূরি তাঁদের স্বাস্থ্য ছিল হৃষ্টপুষ্ট, মন ছিল নিক্তির ওজনে বাঁধা। তাঁদের উপলব্ধিগোচর ছোটোখাটো সত্য আর স্বল্পপরিসর বাস্তবের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে ভিনসেন্ট ভ্যান গকের সত্যানুসন্ধান আর বাস্তববোধ। বস্তুর আপাত রূপ নিয়ে ভিনসেন্ট তৃপ্ত নন। বস্তুর মূল রহস্যটির উদ্ঘাটনের জন্য তাঁর নিত্য অনুসন্ধিৎসা, চরিত্রের মৌলিক তথ্যটিকে আবিষ্কারের প্রেরণায় চিত্ত তাঁর নিত্য-সংবেদনশীল। প্রকৃতির প্রেমে, সত্যের অনুরক্তিতে উৎসুক প্রাণ তাঁর শিশুর মতো উন্মুখ

পরম শক্তিমান এই যে শিল্পী, নিত্য সূর্যের আলোকে অন্তর যাঁর উদ্ভাসিত, সাধারণের মর্মে কবে তাঁর বাণী গিয়ে পৌঁছোবে? সহজে বলে মনে হয় না। তার কারণ সমসাময়িক বুর্জোয়া মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর শিল্পশৈলী অনাড়ম্বর অথচ নিপুণ, তাঁর অনুভূতি সহজ অথচ বড়ো গভীর। তাঁকে যদি কেউ সম্যক বুঝতে পারে, তা কেবল সমপথযাত্রী চিত্রশিল্পীরাই হয়তো পারবে, সাধারণ্যে নয়।

জি. অ্যালবার্ট অরিয়ার

ভিনসেন্ট প্রবন্ধটা ডাক্তার পেরনকে দেখাল না।

ফিরে এল তার পূর্ণ শক্তি, উদ্দীপ্ত জীবনজিগীষা। জাগল সৃষ্টির নব জোয়ার। লোহার দরজা তাকে আবদ্ধ রেখেছে, তাতে কী এসে যায়? পর পর সে ছবি এঁকে চলল, একখানা তাঁর ওয়ার্ডের, একখানা ওখানকার সুপারিন্টেন্ডেন্টের, একখানা তাঁর স্ত্রীর। মিলেট ও দেলাক্রোয়ার ছবির পর ছবি সে কপি করল। তার দিন রাতকে সে ভরিয়ে দিল উত্তেজিত পরিশ্রমে।

নিজের অসুস্থতার ইতিহাস গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে সে ভেবে দেখল যে তার এই মানসিক উন্মত্ততার আক্রমণটা চক্রবৎ ঘুরে ঘুরে আসে, ঠিক তিন মাস অন্তর অন্তর। ঠিক আছে। এবার থেকে সে হিসেব রাখবে, সময় বুঝে সাবধান হবে। পরবর্তী আক্রমণের সময় যখন ঘনিয়ে আসবে তখন সে কাজকর্ম বন্ধ করে ক-দিনের জন্যে সোজা বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নেবে। তারপর আবার ঘোর কাটবে, আবার সে সুস্থ মানুষ হয়ে কাজে লাগবে। ভয়টা কী? লোকের তো মাঝে মাঝে সর্দি-জ্বরও হয়, দু-দশ দিন বিছানায় পড়ে থাকতেও হয় সেজন্যে, তার বেশি তো না!

তবে, অধুনা এখানকার ধর্মভাবটা তার পক্ষে খুব পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। শীতকাল, ধূসর অন্ধকার প্রতিটি দিন। তার মনে হতে লাগল শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিস্টারদের মনে যেন কেমন একটা ধার্মিকতার বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে, এও এক রকমের মানসিক ব্যাধি। সিস্টাররা কালো পোশাকে ঢাকা প্রেতায়িত মূর্তি নিয়ে নিঃশব্দে ঘরে বারান্দায় বাইবেলে চোখ লাগিয়ে ঘুরছে, সর্বদা মালা ঘোরাচ্ছে, নাম জপ করছে বিড়বিড় করে, আর দিনের মধ্যে পাঁচ-ছয় বার লেগেই আছে উপাসনা। এ এক চূড়ান্ত বাতিক। ওদের ক্রিয়াকলাপ দেখে দেখে ভিনসেন্টের মনে ভাবনা হতো—কারাই-বা সত্যি পাগল, আর কারাই-বা সেবিকা? বরিনেজ যখন ছাড়ে মোটামুটি তখন থেকেই ধর্মের নামে বাড়াবাড়িকে তার অসহ্য লেগেছে, সেই ভালো-না-লাগা ক্রমে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে তার মনে। সেই আতঙ্কে আজকাল সে শিউরে শিউরে ওঠে যখন ওইসব ধর্মোন্মাদিনীর দিনগত জীবনযাত্রাকে নিরুপায়ে লক্ষ করে যেতে হয়। ওই কালো কালো মূর্তি তার স্বপ্নে যেন ভিড় করে আসে, কিছুতে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না ওদের।

তৃতীয় মাসের সেই সম্ভাবিত তারিখটা আসার দু-দিন আগে থাকতে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। কাজকর্ম বন্ধ করে শয্যায় গিয়ে আশ্রয় নিল। শরীর তার সুস্থ, মন সুস্থ ততোধিক। পাছে ওই সিস্টারদের দেখে তার মনের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয়, তাই বিছানার চার ধারে পর্দা টেনে অন্তরাল সৃষ্টি করে নিল চমৎকার।

ঠিক যে-দিন তার অসুখে পড়বার কথা সে-দিনটি এল। উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ভিনসেন্ট। কিছুই হল না। আশ্চর্য হল, অনেকটা যেন আশাহত হল সে। দ্বিতীয় দিন কাটল, কাটল তৃতীয় দিন।

হেসে উঠল ভিনসেন্ট—বোকা আমি! ডাক্তার পেরনের কথা ভুল, মিছে আমারও ভ্রান্তি। সুস্থ আমি, সুস্থ থাকব চিরদিন, এমনি মানসিক রোগের আক্রমণ আর আসবে না আমার জীবনে কোনোদিন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে খালি সময় নষ্ট। কাল সকাল থেকে আবার স্টুডিয়োতে কাজে লেগে যাব।

গভীর রাত। সুষুপ্ত সারা হাসপাতাল। হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠল ভিনসেন্ট। খালি পায়ে ওয়ার্ডের বারান্দা পার হয়ে চলল। পৌঁছোল গিয়ে কয়লা রাখার ঘরে। খুপরি-ঘরটার দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। একমুঠো কয়লাগুঁড়ো নিয়ে সারা মুখে মাখল।

দেখুন, দেখুন মাদাম ডেনিস! এতদিন পরে ওরা আমাকে আপনার করে নিয়েছে, স্বীকার করেছে যে আমি ওদেরই একজন! ওরা আগে আমাকে বিশ্বাস করত না, কিন্তু আজ? ঈশ্বরের বাণী ওদের কানে শোনাবার প্রকৃত অধিকার এতদিনে আমি পেয়েছি!

ভোর হওয়ার একটু পরেই ওরা ভিনসেন্টকে খুঁজে পেল। সেই একই জায়গায় বসে আছে, বিড়বিড় করে কখনও প্রার্থনা করছে, কখনও বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি আওড়াচ্ছে, কখনও-বা চুপ করে কান খাড়া করে কী শুনছে। ওর কানের কাছে কোনো অশরীরী মায়াবীর শব্দহীন ভাষা। সম্পূর্ণ উন্মাদ সে—ধর্মোন্মাদ।

এমনি মত্ততা ক-দিন চলল। কিছুটা যখন স্বাভাবিক হল, ডাক্তার পেরনকে ডেকে পাঠাল। ডাক্তার আসতে ভিনসেন্ট তাঁকে বললে—আমার দৃঢ় বিশ্বাস ডাক্তার, এবার আমার এমনি কিছুতেই হতো না যদি চারদিকে সিস্টারদের ধর্মের হিস্টিরিয়ার মধ্যে আমাকে থাকতে না হতো। এমনি দৃশ্য দেখে দেখে সুস্থ মানুষ পাগল হয়।

ডাক্তার পেরন তাড়াতাড়ি ভিনসেন্টের খাটের চারদিকের পর্দাগুলো টেনে দিলেন। বললেন—কী করি বলো, শীতকাল হলেই সিস্টারদের ধর্মের বাতিক বাড়ে। আমি পছন্দ করিনে, তবে বাধা দেওয়াও সমীচীন মনে করিনে। হাজার হোক, এই সিস্টারদের মতো এমনি নিঃস্বার্থ সেবিকা পাব কোথায়?

তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমার অবস্থাটাও ভেবে দেখুন। চব্বিশ ঘণ্টা তো আসল পাগলের পালের সঙ্গে ঘর করে কাটে, এর ওপর যদি আবার ধর্মের নামে হঠাৎ-পাগলদের এখানে ছেড়ে দেন, তাহলে আমার মতো আধপাগলের আর আশা কী? আমি তো আক্রমণের সময়টা প্রায় পার করেই দিয়েছিলাম—

নিজেকে ঠকিয়ো না ভিনসেন্ট। এমনি আক্রমণ হতোই। তোমার স্নায়ুমণ্ডলী ঠিক তিন মাস অন্তর একবার করে অচল হয়ে যায়, যাবেই। তার অন্যথা নেই। ফলে এমনি মতিভ্রম। ধর্ম নিয়ে যদি না হতো, অন্য কিছু একটা নিয়ে ঠিক হতোই।

আর-একবার যদি আমার এরকম হয় ডাক্তার, আমি আমার ভাইকে লিখব এখান থেকে আমাকে নিয়ে যেতে।

বেশ, যেমন তোমার ইচ্ছে।

বসন্তকালের প্রথম উজ্জ্বল দিনটিতে ভিনসেন্ট আবার স্টুডিয়োয় পা বাড়াল। জানলার বাইরের দৃশ্য সে আঁকল। ঘন বেগুনি রঙের লাঙল-চষা মাটিতে হলুদের আভাস। বাদাম গাছের কুঁড়িগুলো ফুটছে, আবার সন্ধে বেলার আকাশে মন–কেমন-করা নীলিমা।

কিন্তু প্রকৃতির জীবনলীলার এই চিরন্তন অথচ অপূর্ব নতুন রূপ কোনো নতুন সাড়া জাগাল না শিল্পীর অন্তরে। সারা মন আচ্ছন্ন হয়ে রইল আতঙ্কে। উপায় নেই, উপায় নেই। কোনো পথ নেই মুক্তির, ওই উদার দিগন্ত আর ওই নিঃসীম আকাশ, প্রকৃতির ওই চিরনবীন আমন্ত্রণ, তার জন্যে নয়। বাতুল আর ধর্মোন্মাদ, ওরা তাকে জড়িয়ে রেখেছে নাগপাশে, ওরাই তার জীবনে সত্য। রেখা নয়, রং নয়, সত্য শুধু উন্মাদাগারের লৌহ-অর্গল।

ভাইকে লিখল আতঙ্ককাতর ভাষায়, থিয়ো, সেন্ট রেমি ছাড়তে সত্যি আমি চাইনে। কিছুই দেখলাম না এখানকার, কিছুই আঁকলাম না। কিন্তু আর-একবার যদি গতবারের মতো ধর্মোন্মত্ততার খপ্পরে পড়ি, তাহলে বুঝব সে এই হাসপাতালের আবহাওয়ার দোষ, আমার স্নায়ুর দোষ নয়। এমনি মানসিক রোগের আক্রমণ দু–তিন বার যদি হয়, তারপর আমি আর নেই।

তোমার সেই ডাক্তার গ্যাচেটের খবর কী? তিনি কী বলেন? তাঁর হাতে আমার উদ্ধারের কি আশা নেই? আর একবার আমি দেখব, তারপর নির্ঘাত পালাব এখান থেকে যেখানেই আশ্রয় পাই।

থিয়ো উত্তরে লিখল—ডাক্তার গ্যাচেট তোমাকে তাঁর তত্তাবধানে রাখতে ইচ্ছুক। তিনি শুধু মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ নন, শিল্পী ও শিল্পেরও বিশেষজ্ঞ। তোমার ছবি তিনি দেখেছেন, তিনি চান তুমি তাঁর কাছে থাকো আর নিজের কাজ করে যাও। অতএব তোমার যখন খুশি তুমি চলে আসতে পারো।

না, এখনই নয়। আর একবার। আরও তিনটি মাস।

নতুন গরম। মে মাস। সময় হয়েছে আবার। কারা কানে কানে কথা কয়, চমকে চমকে উঠে চিৎকার করে উত্তর দেয় পাগল। প্রতিধ্বনি ফিরে আসে ভাগ্যের ক্রূর অট্টহাসির মতো। কারা ঘুরে ঘুরে আশেপাশে ফেরে অধরা ছায়ামূর্তি যেন।

এবার ওরা তাকে পেল গির্জার মধ্যে মূর্ছিত অবস্থায়। আবার ক-দিন কাটল সুস্থতা ফিরে পেতে।

থিয়ো চাইল নিজে সেন্ট রেমিতে এসে তাকে নিয়ে যেতে। ভিনসেন্টের তাতে আপত্তি। একলাই সে প্যারিস পর্যন্ত যাবে, টারাসকনে কেউ তাকে ট্রেনে তুলে দিলেই যথেষ্ট। লিখল সে:

ভাই থিয়ো, আমি শয্যাশায়ী রোগী নই, মত্ত কোনো দানবও ন‍ই এখনও পর্যন্ত। সাধারণ অবস্থায় আমি যে সুস্থ স্বাভাবিক লোক, সেইটে প্রমাণ করতে দাও। আমি যদি উন্মাদাগার থেকে মুক্তি পেয়ে অভার্সে গিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারি, আমার এই সাময়িক ব্যাধিকে আমি জয় করবই।

আর একটি বার ভাগ্যপরীক্ষা আমি করছি। এখানে সবাই পাগল, আমিও তাই পাগল হবার পথে। সুস্থ জগতে নেমে এলে আমিও কি সকলের মাঝখানে সুস্থ হয়ে উঠতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব। তারপর ডাক্তার গ্যাচেট তো থাকবেনই।

তোমাকে তার করে জানিয়ে দেব কখন ট্রেনের সময়। তুমি স্টেশনে থেকো। শনিবার হয়তো এখান থেকে যাব। তাহলে রবিবারটা বাড়িতে কাটাতে পারব—তুমি, জোহানা আর বাচ্চাটি, তিনজনকে নিয়েই। রবিবার তোমার ছুটি তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *