ইটেন

ইটেন

থিয়ো আর ভিনসেন্ট একদিন একসঙ্গে কাটাল ব্রুসেলসে, তারপর থিয়ো গেল তার কর্মস্থান প্যারিসে আর ভিনসেন্ট গেল বাবা-মার কাছে ইটেনে।

ভিনসেন্টের বরিনেজের জীবনযাত্রা বাবা-মা দুজনের কেউই পছন্দ করেননি। নিতান্ত নিজের সন্তান-যদি না হতো আর আত্মজকে অবহেলা করা যদি অধর্ম না হতো, তাহলে থিয়োডোরাস এমনি ছেলের সঙ্গে আর-কোনো সম্পর্ক রাখতেন না। আনা কর্নেলিয়ার বিরাগের কারণ অন্য। যে-জীবন এতদিন ছেলে যাপন করেছে তাতে সে সফল হোক বা নাই হোক সুখী তো হয়নি, দুঃখই পেয়েছে, মা হয়ে এ কি সহ্য করা যায়?

ভিনসেন্ট দেখল বাবার মাথার চুল আরও সাদা হয়ে গেছে, ডান চোখের পাতাটা আরও ঝুলে পড়েছে চোখের ওপর। শরীরটা তাঁর অনেক শুকিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে যেন চুপসে গেছে আগেকার ব্যক্তিত্ব। মার চেহারায় কিন্তু আগের চেয়ে অনেক শক্তির পরিচয়, অনেক বেশি আকর্ষণ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর আরও যেন ভরে উঠেছে, আরও বিকশিত হয়েছে মধুর মাতৃত্ব। মুখের রেখায় আর ওষ্ঠের হাসিতে ক্ষমার কারুণ্য, চোখের মৃদু কোমল দৃষ্টিতে সহজ আনন্দ আর সৌন্দর্যের নিত্য অভিনন্দন।

প্রথম ক-দিন কাটল আদর-যত্নে, ভোজনে আর অলস বিশ্রামে। কাজের মধ্যে গ্রামের কিনারে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানো সকালে সন্ধ্যায়। বরিনেজের দুঃস্বপ্ন ঘুচে গেল চোখ থেকে, শরীরও সেরে উঠল তাড়াতাড়ি। ইতিমধ্যে ঘনিয়ে এল বর্ষাঋতু।

একদিন ভোর বেলা আনা কর্নেলিয়া রান্নাঘরে এসে দেখেন ভিনসেন্ট উনুনটা জ্বেলেছে, আগুনের গরম তাতের কাছে পা রেখে কোলের ওপর একটা পেনসিলস্কেচ নিয়ে বসে আছে। স্কেচটা আসলে একটা সুপরিচিত ছবির কপি।

একি ভিনসেন্ট, এত সকাল সকাল উঠেছিস যে!

বাঃ, কী যে বল মা? সকাল কই? এবার থেকে কাজ করব যে!

কাজ! ওমা, উনুন জ্বালাবার জন্যে তোর দরকার আবার কীসের?

ও-কাজ নয় মা, ড্রয়িং করার কথা বলছিলাম।

স্কেচটা উঁকি দিয়ে দেখলেন আনা কর্নেলিয়া। খেলাচ্ছলে ছবির বই কপি করার শিশুর প্রচেষ্টা যেন

তুই কি ছবি আঁকতে শিখছিস নাকি ভিনসেন্ট?

ঠিক বলেছ।

ভিনসেন্ট মাকে মনের কথা খুলে বললে। থিয়ো যে তাকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছে সে-কথাও বললে। খুশি হলেন আনা কর্নেলিয়া। তাড়াতাড়ি পাশের ঘর থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসে বললেন—তোমার মামা অ্যান্টন মভ একজন শিল্পী, ছবি-আঁকিয়ে বলে খুব নাম, টাকাও করেছে খুব। সেদিন এই চিঠিখানা ওর শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়েছি, লিখেছেন গুপিলসে মিনহার টারস্টিগ নাকি ওর এক-একখানা ছবি পাঁচশো-ছশো গিল্ডারে বিক্রি করেন।

ঠিকই। মভ আধুনিক নামকরা শিল্পীদের একজন বটে।

আচ্ছা ভিনসেন্ট, এমনি একখানা ছবি আঁকতে ক-দিন লাগে?

সেটা ছবির ওপর নির্ভর করে মা। কোনো ছবি কয়েক দিনেই হয়, কোনো শেষ করতে বছরের পর বছর কেটে যায়।

বছরের পর বছর! একখানা ছবি!

একটু ভেবে আনা কর্নেলিয়া বললেন—আচ্ছা, একটা লোককে দেখে দেখে ঠিক তার চেহারা এই কাগজে আঁকতে পারিস?

তা ঠিক বলতে পারিনে। তবে দাঁড়াও, আমার আঁকা কয়েকটা স্কেচ তোমাকে এনে দেখাই।

স্কেচের তাড়াগুলো হাতে করে রান্নাঘরে ফিরে এসে দেখে, মা তাঁর কাজ শুরু করেছেন। সারাঘর জুড়ে চমৎকার খোশবাই।

মা বললেন—হ্যাঁরে, সেই যে পনিরের পিঠে তুই ভালোবাসতিস, মনে পড়ে? আজ তোকে তা-ই খাওয়াব।

ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি ডান হাত বাড়িয়ে মার কাঁধটা জড়িয়ে ধরল, শুধু বলতে পারল—মাগো!

ছলছল করে উঠল মার চোখ, কেমন একটু বিচিত্র হাসি ঠোটের কোণে। ভিনসেন্ট তাঁর প্রথম সন্তান। তার ব্যর্থতা সবচেয়ে বড়ো দুঃখ তাঁর। বললেন—সাত রাজ্যি ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত মার কাছে এসে থাকতে কেমন লাগে রে?

খুব ভালো মা, খুব ভালো!

বরিনেজবাসীদের ছবিগুলো আনা কর্নেলিয়া মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।

একটু পরে বললেন–কিন্তু এদের মুখগুলো ঠিক করে আঁকিসনি কেন?

ওদের মুখ নেই। মানে, মুখ আমি আঁকতে চাইনি। ওদের চেহারাগুলোই আমি আঁকতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু মুখ আঁকতে তুই পারিস তো? এখানে এই ইটেনে কত বড়ো বড়ো ঘরের মেয়ে আছে যারা নিজেদের ছবি আঁকাবার জন্যে পাগল। এ-কাজ যদি পারিস তাহলে কাজের ভাবনা কী তোর?

আরে দাঁড়াও। ওসব হবে, হবে। আগে ড্রয়িংয়ের হাতটা পাকা হোক! মনের মতো পোর্ট্রেট আঁকা কি একদিনের কথা?

.

ব্রেকফাস্টের টেবিলে আনা কর্নেলিয়া স্বামীর কাছে কথাটা পাড়লেন। গম্ভীর গলায় শুধোলেন থিয়োডোরাস ছবি তো আঁকবে, কিন্তু ভবিষ্যৎ কী এতে? এ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে?

ভিনসেন্ট বললে—প্রথমটা হয়তো পারব না। তবে ড্রয়িংটা যখন শুদ্ধ হবে তখন নিশ্চয়ই আর আটকাবে না। লন্ডনে প্যারিসে যারা শুধু ড্রয়িংই করে, তারাও দিনে দশ-পনেরো ফ্র্যাঙ্ক রোজগার করে। মাসিকপত্রের ছবি যারা আঁকে তারাও তো কম উপায় করে না।

থিয়োডোরাস অসুখী হলেন না। অর্থহীন অলস জীবনের চেয়ে ছেলের যাহোক ধরাবাঁধা একটা কিছু যে করবার মন হয়েছে, এ তবু মন্দের ভালো।

তিনি বললেন—বেশ, ছবি আঁকো তুমি। তবে আশা করি এ-কাজে লেগে থাকবে ঠিকমতো। আবার কোনো নতুন খেয়ালে মত না বদলাও, সেই আমার ভাবনা।

ভিনসেন্ট উত্তর দিলে—আমার কাজ আমি খুঁজে পেয়েছি বাবা। আর আমি কাজ বদলাব না।

.

বর্ষাকাল কাটল, এল উষ্ণ মধুর ঋতু। ভিনসেন্ট ছবি আঁকার জিনিসপত্র কাঁধে ঝুলিয়ে প্রতিদিন ধাওয়া করতে লাগল পল্লি-অঞ্চলে। প্রান্তরের ধারে বসে ছবি আঁকতে তার খুব ভালো লাগে, কখনও সে জলাভূমির ধারে ইজেল খাড়া করে আঁকে শামুক আর পদ্মফুলের ঝাঁক। ছোটো শহর ইটেন, প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। প্রতিবেশীরা তার খবর কানাঘুষোয় জেনেছে, তার এলোমেলো পোশাক আর এলোমেলো জীবন, তার রং-তুলি তারা সন্দেহের চোখে দেখে, কাছে ঘেঁষে না বড়ো।

ক-দিন থেকেই ভিনসেন্ট পাইন বনের ধারে ছবি আঁকছে। অনেকগুলো গাছ কাটা হচ্ছে, খালের ধারের লম্বা একটা পাইন গাছ সে খুব বড়ো করে আঁকছে দিনের পর দিন। একজন শ্রমিক রোজ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়, চোখ পাকিয়ে তার ছবি আঁকা দেখে আর ঠাট্টার হাসি হাসে। রোজই হাসির আওয়াজটা বেড়েই চলে।

একদিন ভিনসেন্ট খুব ভদ্রভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করল—আমি যে পাইন গাছটা আঁকবার চেষ্টা করছি, এতে হাসবার কী আছে’ বলো তো?

হো-হো করে উঠল লোকটা—হাসব না? আরে না হেসে উপায় আছে নাকি! আপনি যে বদ্ধপাগল!

একমুহূর্ত ভেবে নিল ভিনসেন্ট, তারপর বললে—ধরো আমি যদি একটা গাছ পুঁততাম, তাহলে কি আমাকে পাগল বলতে?

মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল লোকটা, বললে—তা কেন? না পুঁতলে গাছ গজাবে কী করে?

আর যদি গাছের গোড়ায় জল দিয়ে দিয়ে গাছটাকে বড়ো করে তুলতাম?

খাসা কাজই করতেন, নইলে গাছটা বড়ো হতো কী করে?

তারপর গাছে যখন ফল ধরত, সেই ফল পেড়ে যদি খেতাম, সেটাও কি পাগলামি হতো?

আলবত নয়। আপনার গাছের ফল আপনি পাড়বেন না তো কি?

তারপর ধরো গাছটাকে যদি একদিন কাটতাম, তার মধ্যে কি পাগলামি খুঁজে পেতে?

কে বললে? গাছ তো কাটতেই হতো, নইলে কাঠ মিলবে কোথা থেকে?

তাহলে বলছ, গাছ পোঁতা, গাছ বড়ো করা, গাছের ফল পাড়া আর গাছ কাটা—এসব কাজের একটাও পাগলামি নয়, আর গাছটার একটা ছবি আঁকাই পাগলামি, কেমন?

কেমন একটু ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আবার হাসতে লাগল লোকটা। বললে—এই যে দিনের পর দিন মাঠের মধ্যে হাঁ করে বসে থাকেন, এইটেই পাগলামি। আপনি যে পাগল, তা সারাগ্রামে সবাই জানে।

সন্ধে বেলা বসবার ঘরে বড়ো টেবিলের ধারে ধারে সমস্ত পরিবার একত্র হয়। কেউ সেলাই করে, কেউ চিঠি লেখে, কেউ পড়ে। ভিনসেন্টও সকলের সঙ্গে বসে। সবচেয়ে ছোটোভাইটি, কর তার নাম, সে খুব শান্ত, গম্ভীর, কথাই বলে না। বোনদের মধ্যে আনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সে শ্বশুরবাড়ি। মেজোবোন এলিজাবেথের তার ওপর এমনি উগ্র বিতৃষ্ণা যে সে যে ঘরে ফিরে এসেছে এটুকু মেনে নেয়াই যেন তার অসাধ্য। ছোটোবোন উইলেমিন তবু তাকে ভালোবাসে মন্দ নয়। এ-বোনকে দাঁড় করিয়ে তার ছবিও সে আঁকে মাঝে মাঝে। টেবিলের একধারে বসে ভিনসেন্ট একমনে ছবি আঁকে। অভ্যাস করে ড্রয়িং বা দিনের আঁকা স্কেচগুলো কপি করে নিবিষ্টভাবে। টেবিলের ঠিক মাঝখানে সকলের মাথার ওপর ছাদ থেকে মস্ত একটা তেলের আলো ঝোলে। থিয়োডোরাস দেখেন, ছেলে একই জিনিস বারে বারে আঁকছে, পেনসিল বুলোচ্ছে তো বুলোচ্ছেই, মুছছে তো মুছছেই, আর শেষপর্যন্ত কাগজটা ছিঁড়ছে। একদিন তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভিনসেন্টের ব্যর্থ প্রচেষ্টার দিকে তাকিয়ে তিনি শুধোলেন–আচ্ছা, আঁকা কি তোমার কিছুতেই ঠিকমতো আসে না? ভুলই কেবল হয়?

ভিনসেন্ট বললে—ঠিক বলেছেন।

আমার সন্দেহ হচ্ছে তুমি ভুল করছ না তো?

ভুলই তো করে চলেছি কেবল। কোন ভুলের কথা আপনি বলছেন?

আড়ষ্ট গলায় পাদরি বললেন—আমার সন্দেহ হচ্ছিল তুমি আবার লাইনটাই ভুল নাওনি তো? সত্যি-সত্যিই শিল্পী হবার মতো প্রতিভা যদি তোমার মধ্যে থাকত তাহলে আমার তো মনে হয় প্রথমবারেই তোমার ড্রয়িং নির্ভুল হতো!

ভিনসেন্টের সামনে তখন গ্রাম্য চাষার একটা ছবি, লোকটা মুখ নীচু করে খেত থেকে আলু তুলছে। লোকটার ডান হাতটা কিছুতেই ঠিকভাবে আঁকা হচ্ছে না। ভিনসেন্ট কাজ করতে করতে উত্তর দিল—হয়তো ঠিক বাবা, হয়তো সহজভাবে কাগজে ছবি ফুটিয়ে তোলবার স্বাভাবিক ক্ষমতা আমার নেই। তবে কী জানেন, প্রকৃতি সহজে শিল্পীর কাছে ধরা দেয় না, বাধা দেয়, এড়াতে চায়। আমি যদি প্রাণপণ খাটতে পারি, এ-বাধা আমি জয় করবই। ভুলকে আমি ভয় করিনে, এতে বরং আমার রোখ আরও বাড়ে।

থিয়োডোরাস বললেন—তোমার কথা আমি বুঝিনে। খারাপ থেকে কি ভালো হয় কিছু? যা ভালো তা গোড়া থেকেই ভালো। শিল্প যদি ভালো হয় সে ভালোর উন্মেষ গোড়া থেকেই হবে। গোড়ার থেকেই যে শুধু খারাপ আঁকে, সে আসলে শিল্পীই নয়। শিল্পী হবার তার যোগ্যতা নেই। সময় নষ্ট না করে তার আর–কিছু করা উচিত।

ভিনসেন্ট ছবির ওপর থেকে চোখ না তুলে প্রশ্ন করলে—কিন্তু সে-লোক যদি খারাপ ছবি এঁকেই তার সারাজীবনের আনন্দের খোরাক পায় তাহলে?

থিয়োডোরাস নির্বাক হয়ে গেলেন। যুক্তি দিয়ে এমনি বেয়াড়া প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব।

কৃষাণের হাতটাকে আধখামচাভাবে আলুর বস্তার ওপর ঝুলিয়ে রেখে মুখ তুলে ভিনসেন্ট এবার বললে—আসলে, বাবা, প্রকৃত যে-শিল্পী তার সঙ্গে প্রকৃতির শেষ পর্যন্ত কোনো বিরোধ থাকে না। বছরের পর বছর কাটে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে অসীম ধৈর্যে, শেষকালে প্রকৃতি হার মানে, শান্ত শিষ্ট হয়ে শিল্পীর হাতের মুঠোয় ধরা দেয়। তাই আজ যে-শিল্পসৃষ্টি নিতান্ত খারাপ, একদিন আসে যখন তা সুন্দর হয়, তার মূল্য আর মর্যাদা নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠে।

কিন্তু যা খারাপ তা যদি কোনোদিনই ভালো না হয়! এই যে তুমি দিনের পর দিন ধরে ওই বুড়োটাকে আঁকছ, ওর হাত এখনও সোজা হল না। বছরের পর বছর চেষ্টা করলেও ওর হাত যদি অমনি বাঁকাই থাকে? মানে, সোজাকথায়, হাজার ড্রয়িং করেও ড্রয়িং যদি কোনোদিনই ঠিক না হয়?

হতে পারে বাবা, কিন্তু সেই দুর্ভাবনা ভেবে শিল্পী কখনও ডরায় না।

বেশ, তা তো বুঝলাম। কিন্তু এত চেষ্টার শেষে তার দামটা সে কী পায়?

দাম? দাম কীসের?

বাঃ! ধরো, টাকাকড়ি, সম্মান! কিছুই যদি না জোটে শেষ পর্যন্ত?

ভিনসেন্ট মুখ তুলে বাবার মুখের দিকে স্পষ্ট চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। কী একটা অদ্ভূত প্রাণীকে সে যেন দেখছে। তারপর বললে–আমার ধারণা ছিল শিল্পের ভালোমন্দ নিয়েই বুঝি আমরা আলোচনা করছি!

দিনরাত্রি ভিনসেন্ট কাজ করে চলল। ফাঁকি নেই কোনো। যতক্ষণ পারে আঁকে। যখন আর পারে না, বই পড়ে। তাও যখন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখনি কেবল ঘুমোয়। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটি কেবল চিন্তা, থিয়োর গলগ্রহ হয়ে থাকার অবস্থা থেকে কবে সে মুক্তি পাবে! থিয়ো তাকে শুধু যে টাকা পাঠায় তা নয়, ছবি আঁকার কাগজ, পেনসিল, রং, কালি, কলম, তুলি, জন্তু-জানোয়ার ও মনুষ্যকঙ্কালের ছবি, শিল্পীদের ছবির প্রিন্ট—সব পাঠায়। চিঠিতে লেখে—কিছু ভেবো না, কাজ করে যাও, সত্যিকার শিল্পী হওয়া চাই, সাদামাটা ছবি-আঁকিয়ে নয়।

মনুষ্যমূর্তির ড্রয়িংয়ে যত বেশি সে পরিশ্রম করে, পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু আঁকার ব্যাপারে ততই সে লাভবান হয়। তাই যখন সে একলা একটা গাছ আঁকে, তখন সে শুধু নির্জীব একটা গাছই চোখে দেখে না, গাছের একটা জীবন্ত রূপের কল্পনা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে রেখায় রেখায়। প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে তার খুব ভালো লাগে, কিন্তু তারচেয়ে দশ গুণ ভালো লাগে মানুষ আঁকতে, যে-মানুষের সঙ্গে মাটির যোগ শ্রমের যোগ, জীবনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। গাভার্নি, ডমিয়ার, ডোরে প্রভৃতি শিল্পীদের যেখানে সার্থকতা, সাধারণ কৃষাণ শ্রমিকের ছবিতে সেই চমৎকার বাস্তববোধের আভাস তার কাঁচাহাতের ড্রয়িংয়েও কখনও কখনও চকিতে ফুটে ওঠে।

বই পড়া নিয়ে বাবার সঙ্গে তার তর্কবিতর্ক হল একদিন। থিয়োডোরাস বলেন–ছবি আঁকবে তো আঁকো। একগাদা বাজে ফরাসি বই পড়ে সময় নষ্ট করা কেন?

ভিনসেন্ট উত্তরে বললে—ছবি তো শুধু কাগজে দেহবিদ্যা মকশো করা নয়। মানুষের মাথা যখন আঁকতে হবে, জানতে হবে ওই মাথার ভেতর কী আছে। শুধু আঁকতে পারলেই শিল্পী হওয়া যায় না, শিল্পীর চাই জীবনবোধ, সাহিত্য তার প্রধান সহায়ক।

.

আবার গ্রীষ্মকাল এল। অগ্নিক্ষরা দ্বিপ্রহর, মাঠে মাঠে ছবি এঁকে বেড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠল। ছোটোবোনকে মডেল করে কয়েকটা ছবি আঁকল, বারে বারে বার্গের অনুসরণে ড্রয়িং অভ্যাস করতে লাগল। গ্রামীণ নরনারীর কয়েকটা স্কেচ নিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তাদের আঁকতে লাগল ঘরে বসে। মাটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ, এমন মানুষকে রেখায় প্রকাশ করতে সে ব্যাকুল, মেয়ে-পুরুষ, যারা মাঠে কাজ করে, মাটি খোঁড়ে, লাঙল দেয়, বীজ ছড়ায়, শস্য কাটে, এরাই তার শিল্পসাধনার প্রধান উপজীব্য। শহরের লোকেরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখে, কিন্তু মাঠের কৃষাণরা তাকে বিশ্বাস করে। সেও চেষ্টা করে তাদের বুঝতে, তাদের জীবনকে সমস্ত চেতনা দিয়ে উপলব্ধি করতে।

প্রকৃতিকেও সে আগের মতো ডরায় না, প্রাণবন্ত করে আঁকতে চায় উইলো গাছের একটি ঝাঁকড়া ডাল বা ফুটন্ত একটি আপেলমঞ্জরি।

মাটির মানুষ তাই যখন সে আঁকে, কেমন যেন তার সৃষ্টিতে মাটি আর মানুষ একাকার হয়ে যায়। কেন এমনি হয় তা সে যুক্তি দিয়ে উপলব্ধি করে না, তবে মনে মনে অনুভব করে, এ ঠিকই হচ্ছে। মাটি আর কৃষাণ, সে মনে মনে বলে—দুইয়ের মধ্যে পাকাপাকি একটা সীমারেখা থাকবে কী করে? মাটি তারা উভয়েই, একে মিশছে প্রতিমুহূর্তে অপরের সঙ্গে, মিলেমিশে রয়েছে অচ্ছেদ্য বাস্তব বন্ধনে।

মা ভাবেন—একলা একলা ছেলেটা ঘোরে, বিয়ে দিতে হবে ওর এবার। একদিন বললেন—কাল দুটো নাগাদ বাড়ি থাকিস, আমার একটু দরকার আছে।

ভিনসেন্ট শুধোয়—আমাকে আবার তোমার কী দরকার মা?

আমার সঙ্গে একটা চা-পার্টিতে তোকে যেতে হবে।

স্তম্ভিত ভিনসেন্ট। বলে—বলো কী, এমনি করে নষ্ট করার এখন কি আমার সময়?

নষ্ট কেন হবে তোর সময় এতে? তোর ছবি আঁকার কত খোরাক পাবি। জানিস, ইটেনের সেরা সেরা সব মেয়েরা এই পার্টিতে আসছে।

ভিনসেন্ট তো পালাতে পারলে বাঁচে। অনেক কষ্টে ঢোক গিলে বললে কিন্তু মা, তোমার ওই চা-পার্টিতে যেসব মেয়ে যাবে, তাদের আমি আঁকব কী করে? তাদের যে কারুর কোনো চরিত্র নেই!

চরিত্র নেই? বলিস কী? শহরের বড়ো বড়ো ঘরের সব মেয়ে! কারও নামে ঘুণাক্ষরেও কেউ আধখানা কথা রটাক দিকি!

হেসে উঠল ভিনসেন্ট—আমি সে-কথা বলিনি মা। আসল কথা হচ্ছে, ওরা সব একেবারে এক রকমের। একই ছাঁচের সহজ সাড়ম্বর জীবন, তাই ওদের কারও মুখে বিচিত্র চরিত্রের কোনো ছাপ নেই।

মা শুধোলেন—তাহলে তুই কি. মাঠের চাষাভুষো এঁকেই দিন কাটাবি?

ঠিক বলছ মা, তা-ই

কিন্তু কী লাভ হবে তাতে? ওরা কি তোকে দেবে এক আধলাও! জানিস, এসব বড়োঘরের মেয়েরা কত দাম দিয়ে তাদের ছবি আঁকিয়ে নেয়!–

ভিনসেন্ট বাঁহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে, ডান হাত দিয়ে তুলে ধরল তাঁর চিবুক। এত স্বচ্ছ নীল মার চোখ, তবু মা কেন বোঝে না?

আস্তে আস্তে সে বললে—মাগো, কেন বিশ্বাস রাখ না আমার ওপর? আর কটা দিন সময় দাও আমাকে। নিজের কাজ আমাকে করতে দাও নিজের মতো করে! একদিন দেখো তোমার এই ছেলের কত নাম হবে, তোমার হাতে কত টাকা সে এনে দেবে!

ভিনসেন্ট যেমন বোঝাতে ব্যাকুল, তেমনি ব্যাকুল আনা কর্নেলিয়া তাঁর এই ছেলেকে বুঝতে। তাড়াতাড়ি ছেলের রুক্ষ লাল দাড়িতে তিনি ওষ্ঠ স্পর্শ করলেন। তাঁর প্রথম সন্তানটি মৃত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, তারপর এ-ছেলে যখন পেট থেকে নেমেই চিৎকার ছেড়েছিল, তখন তাঁর আনন্দ আর স্বস্তির কোনো সীমা ছিল না। প্রথম সন্তানের জন্যে শোক আর পরবর্তী সন্তানদের নিরাপদ জন্মের স্বস্তি, দ্বিতীয় গর্ভের সন্তান ভিনসেন্টের প্রতি ভালোবাসায় ছিল ওই দ্বিবিধ অনুভূতির গঙ্গা-যমুনা।

স্নেহসিক্ত গলায় তিনি বললেন—নারে, তুই আমার বড়ো ভালো ছেলে ভিনসেন্ট। যা তুই ভালো বুঝিস, তা-ই কর।

তাই আবার মাঠেই গেল. ভিনসেন্ট। ন্যূব্জদেহ কৃষাণ-কৃষাণীদেরই আঁকতে লাগল সে।

গ্রীষ্মের শেষে আবার তার মনে এল চঞ্চলতা। নিজের চেষ্টায় যতটা অনুশীলন সম্ভব, তার অনেক হয়েছে। অন্য আর কোনো শিল্পীর সঙ্গে দেখা করার জন্যে, কতটা তার চরিতার্থতা তা যাচাই করবার জন্যে মন তৃষিত হয়ে উঠেছে। তা যদি না হয় তাহলে আর সে বাড়বে না, শিক্ষায় ছেদ পড়বে এইখানেই।

থিয়ো আমন্ত্রণ করল প্যারিসে আসতে, কিন্তু পা সে বাড়াল না। এখনই প্যারিসে যাওয়া তার পক্ষে ধৃষ্টতা হবে। কী সে জানে, কতটুকু সে শিখেছে? তার চাইতে হেগ শহর ভালো। কয়েক ঘণ্টার মাত্র পথ, সেখানকার গুপিল কোম্পানির ম্যানেজার মিনহার টারস্টিগের কাছ থেকে সাহায্য পাবে। এ ছাড়া নামকরা শিল্পী মভ তো তার আত্মীয়! হেগ-এ গিয়ে কিছুদিন শিক্ষানবিশি করাই বোধ হয় এখন ভালো। থিয়োর উপদেশ সে চাইল। থিয়ো উত্তরের সঙ্গে সঙ্গে রেলভাড়ার টাকা পর্যন্ত পাঠিয়ে দিল তাকে।

.

মিনহার হারমান টারস্টিগ হেগ স্কুল অব পেন্টিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও হল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পব্যবসায়ী। ছবি কেনার ব্যাপারে তাঁর উপদেশ নেবার জন্যে হল্যান্ডের সমস্ত অঞ্চলের লোক তাঁর কাছে আসে। ছবির ব্যাপারে মিনহার টারস্টিগের মতামতের ওপরে আর কথা নেই।

ভিনসেন্টের কাকা ভিনসেন্ট ভ্যান গকের পর মিনহার টারস্টিগ যখন গুপিল কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে এলেন তখন উদীয়মান ডাচশিল্পীরা সব এ-দিক ও-দিক ছড়িয়ে আছেন। অ্যান্টন মভ আর জোসেফ আছেন আমস্টার্ডামে, জেকব আর উইলেম মারিস আছেন মফস্সলে, আর জোসেফ ইসরেলস, জোহানেস বসবুম আর রমার্স ঘুরে বেড়াচ্ছেন এ শহর থেকে ও-শহরে। টারস্টিগ এঁদের প্রত্যেককে চিঠি লিখলেন এই বলে—আপনারা সবাই কেন হেগ-এ এসে জমায়েত হচ্ছেন না? তবেই তো এই শহর আবার ডাচশিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠবে! আমরা সবাই যদি এখানে একত্র হই, সবাই সবাইকে সাহায্য করতে পারি, আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় আমাদের জাতীয় শিল্পকে আবার বিশ্বখ্যাতির চূড়ায় বসাতে পারি, যে-খ্যাতি ছিল ফ্রান্স হ্যালস-এর যুগে, রেমব্রাঁর যুগে!

শিল্পীরা যে এই আহ্বানে যুগপৎ সাড়া দিলেন তা নয়, তবে ক্রমে ক্রমে অধিকাংশ প্রতিভাবান তরুণ শিল্পীই হেগ-এ এসে বসবাস শুরু করলেন। তখন তাঁদের ছবির একটিমাত্র ক্রেতাও ছিল না। বাজারে তাঁদের ছবি কাটে এই লোভে টারস্টিগ তাদের হেগ-এ আনেনি, তিনি তাঁদের মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রতিভার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তিনি এসব শিল্পীর ছবির প্রথম ক্রেতা, তারপর বছর ছয়েকের মধ্যে দ্বিতীয় ক্রেতা অনেকেরই আর জোটেনি।

বছরের পর বছর ধরে তিনি এইসব তরুণ অখ্যাত শিল্পীদের ছবি কিনে দোকানের পেছনের ঘরের দেয়ালের কোণে উলটো করে দাঁড় করিয়ে রাখতে লাগলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পরসিক। নবীন শিল্পীদের সাহায্য করা, প্রেরণা দেওয়া ছিল তাঁর ব্রত। এরা যাতে দারিদ্র্য আর হতাশায় হারিয়ে না যায়, সে-দিকে ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। ছবি কেনা, ছবির সমালোচনা করা, শিল্পীতে শিল্পীতে সমন্বয় ঘটানো, নতুন ছবির বিষয়বস্তু ও প্রয়োগপদ্ধতির আভাস দেওয়া, .একদিকে এই যেমন ছিল তাঁর কাজ, অন্যদিকে ছিল চিত্রবিলাসী ও ক্রেতার মনের পরিবর্তন আনা, আধুনিক ডাচ চিত্রকলার প্রতি দেশবাসীর আগ্রহকে উজ্জীবিত করা।

ভিনসেন্ট যে-সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল, তখনই সবে তাঁর চেষ্টা সার্থক হয়েছে। মভ, নিউহাইস, ইসরেলস ও মারিস যা-কিছু আঁকেন, গুপিল কোম্পানি চড়া দামে তা বিক্রি করে। সার্থক ও জনপ্রিয় শিল্পী বলে প্রত্যেকের নাম।

মিনহার টারস্টিগ সুপুরুষ। সুঠাম তাঁর মুখশ্রী, মস্ত চওড়া কপাল, পিছনের দিকে উলটিয়ে আঁচড়ানো ঘন বাদামি চুল, সুন্দর করে ছাঁটা সারামুখজোড়া দাড়ি, হল্যান্ডের হ্রদের ওপরকার আকাশ যেমন, তেমনি স্বচ্ছ নীল তাঁর চোখ। পরনে তাঁর মসৃণ কালো ভেলভেটের জ্যাকেট আর স্ট্রাইপ দেওয়া দীর্ঘ কালো ট্রাউজার্স, ধবধবে সাদা উঁচু কলারের সামনে সুদৃশ্য কালো বো-টাই।

টারস্টিগের মনে ভিনসেন্টের প্রতি অনেকদিন থেকেই একটা দরদ ছিল। গুপিল কোম্পানিতে কাজ করতে হেগ থেকে লন্ডনে যখন সে বদলি হয়, তখন হেগ-এর ম্যানেজার টারস্টিগ লন্ডনের ম্যানেজারের কাছে ভিনসেন্টের নামে খুব ভালো প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন। বরিনেজে যখন ভিনসেন্টের মনে প্রথম ছবি আঁকার প্রেরণা জাগে, সে তাঁকেও চিঠি লেখে ও তিনি তাকে কপি করার জন্যে কয়েকটি দামি ছবির বই পাঠিয়ে দেন।

হেগ শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় গুপিল কোম্পানির দোকান। ঠিকানা—২০ নং প্লাটস। স্টেশনে নেমেই ভিনসেন্ট সোজা চলল সেখানে। এই গুপিল কোম্পানির দরজা থেকে সে শেষ বার হয়ে এসেছিল আট বছর আগে। ভাগ্য তাকে কী উপঢৌকন দিয়েছে এই আট বছরে? শুধু বেদনার বন্যাস্রোত।

আট বছর আগে সকলে তাকে ভালোবাসত। ভিনসেন্টকাকার সে ছিল প্রিয়তম ভাইপো। সবাই জানত কাকার পর কাকার পদ তো সে নেবেই, কাকার উত্তরাধিকারীও সে-ই হবে। এতদিনে সে-ই তো হতো ইয়োরোপের কতগুলো নামকরা আর্ট গ্যালারির মালিক, কী বিরাট হতো তার মানসম্মান, প্ৰতিপত্তি!

কিন্তু তার বদলে?

মনে মনে এ-প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে রাস্তা পার হয়ে ঢুকে পড়ল গুপিল কোম্পানির দরজায়। অপূর্ব চারদিকের সাজসজ্জা, রাজপুরী যেন! ভুলেই সে গিয়েছিল যে তার পরনে শ্রমিকের মোটা কালো পোশাক, পায়ে চাষির মোটা বুটজুতো। প্রথম গ্যালারিটি লম্বা, লাল ভেলভেট আর সিল্ক-মোড়া দেয়াল। তারপর তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে প্রধান সালোঁ, সেটার ছাদ পর্যন্ত উজ্জ্বল কাচ দিয়ে মোড়া। সেটা পার হয়ে আরও কয়েক ধাপ উঠে দ্বিতীয় সালোঁটা, জাত শিল্পরসিকদের এটি তীর্থস্থল। বিরাট চওড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলা, সেখানে মিনহার টারস্টিগের অফিস আর কোয়াটার্স। সিঁড়ির দেয়াল জুড়ে অসংখ্য ছবি।

সমস্ত গ্যালারি জুড়ে সংস্কৃতির প্রদর্শনী, ঐশ্বর্যের সমারোহ। কর্মচারীদের সাজপোশাক যেমন ফিটফাট, ব্যবহারও তেমনি ধোপদুরস্ত। ছবির ফ্রেমগুলির কী–দাম, পর্দাগুলির কী বাহার! মেঝেতে মোটা কার্পেট, প্রত্যেকটি আসবাবে অভিজাত রুচির পরিচয়। হঠাৎ ভিনসেন্টের মনে হল—তার শিল্পপ্রচেষ্টার নায়ক-নায়িকা কারা? কয়লাখনির মজুর আর মজুরনি, শূন্য মাঠের কৃষাণ আর কৃষাণী! সর্বরিক্ত দারিদ্র্য যাদের দেহের প্রতিটি রেখায়, অঙ্গের প্রতিটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন ভূষণে। এই শিল্পপ্রাসাদে এসে কোনো ক্রেতা কি ওই হতভাগা বঞ্চিত মানুষদের ছবি কখনও কিনতে চাইবে? অসম্ভব। ফিরেও তাকাবে না, বড়োজোর চোখ পড়লে নাক সিটকোবে!

মভের আঁকা মোটাসোটা ধবধবে সাদা একটা ভেড়ার ছবির দিকে খানিকক্ষণ সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কর্মচারীরা একবার তার রুক্ষ মলিন বেশবাসের দিকে তাকিয়েই বুঝে নিল তার কদর। কেউ এগিয়ে এল না সামনে।

টারস্টিগ সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন। ভিনসেন্ট তাঁকে দেখতে পায়নি! তাঁর চোখ কিন্তু সোজা পড়ল ভিনসেন্টের ওপরে। কদমছাঁট চুল, খোঁচা খোঁচা লাল দাড়ি, গায়ে গলাবন্ধ শ্রমিকের কোট আর পায়ে চাষিদের বুটজুতো, বগলে একটা বোঁচকা। এই তাঁর পুরোনো কর্মচারী, সময়কালে মালিক হবার সম্ভাবনাও একদা যার ছিল। চারদিকের বিত্তগর্বিত পারিপাট্যের মাঝখানে বিশ্রী রকমের বেমানান।

নরম মোটা কার্পেটের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে টারস্টিগ বললেন—তারপর ভিনসেন্ট, কী খবর? কেমন দেখছ ছবিগুলো?

চমকে উঠল ভিনসেন্ট।

চমৎকার, ভারি চমৎকার! আপনার কাছেই এসেছি। কেমন আছেন মিনহার টারস্টিগ? বাবা মা আপনাকে তাঁদের নমস্কার জানিয়েছেন।

আট বছরের অদর্শন মাঝখানে। করমর্দন হল দুজনের।

ভিনসেন্ট বললে—আপনাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে মিনহার। আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে চেহারা।

ধন্যবাদ ভিনসেন্ট। চেহারাটা ঠিক আছে কেন জান? বেঁচে থাকাটা আমার ভালোই লাগে। মানে, মনে হয় বেঁচে আছি বলেই বুড়িয়ে যাচ্ছিনে। তোমার খবর কী? চলো, আমার অফিসে চলো আগে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে হোঁচট খেতে লাগল ভিনসেন্ট। দেয়াল থেকে সে চোখ সরাতে পারে না। কতদিন পরে আবার সে এসেছে শিল্পকলার জগতে, সেখানে চারদিকে সত্যিকারের ছবি, একটা নয়, অসংখ্য।

ঘরে ঢুকে টারস্টিগ বললেন–বোসো ভিনসেন্ট।

ভিনসেন্ট হাঁ করে তাকিয়ে ছিল সামনে দেয়ালে উইসেনব্রাকের আঁকা একটা ছবির দিকে। এ-শিল্পীর কোনো কাজ সে আগে দেখেনি। টারস্টিগের কথা শুনে চমকে উঠে সে ধপ করে সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ল। হাত থেকে মেঝেতে খসে পড়ল বান্ডিলটা। ত্রস্তভাবে সেটা তুলে নিয়ে বললে—আপনি যে ‘আমায় ছবির বইগুলো পাঠিয়েছিলেন, তার জন্যে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি মিনহার। বইগুলো ফেরত দিতে এসেছি।

বান্ডিলের মধ্যে বই আছে, আবার ফরসা একটা শার্ট আর মোটা একজোড়া মোজাও আছে। বইগুলো টেবিলের ওপর নামিয়ে কথাটা শেষ করল—এগুলো বড়ো উপকারে লেগেছিল, অনেক ড্রয়িং করেছি এদের সাহায্যে।

দেখাও আমাকে, টারস্টিগ বললেন—দেখি কেমন ড্রয়িং করতে শিখেছ। বান্ডিলের মধ্যে থেকে ভিনসেন্ট বার করলে তার ড্রয়িংয়ের তাড়া। কপিগুলো তিন ভাগে ভাগ করা। প্রথম দলে আছে বরিনেজে বসে সে যেসব কপি করেছিল সেগুলো। প্রথমেই সেগুলো সে দেখাল। টারস্টিগের মুখে নীরব কাঠিন্য। দ্বিতীয় গোছার কপিগুলো ইটেনে পৌঁছোবার পর করা। সেগুলো দেখে টারস্টিগ দু–একবার হুঁ বললেন মাত্র। তৃতীয় দলের কপিগুলো তার হেগ-এ আসবার কয়েক দিন আগেকার কাজ। এগুলো দেখতে দেখতে একটা মন্তব্য করলেন টারস্টিগ। টুকরো টুকরো কয়েকটি আশ্বাসবাক্য।

সব ড্রয়িংগুলো দেখানোর পর ভিনসেন্ট স্তব্ধ আগ্রহে স্থির হয়ে বসল, টারস্টিগ কী অভিমত দেন তা কান পেতে শোনবার জন্যে।

টেবিলের ওপর দীন দুটি হাত প্রসারিত করে আঙুলের সঙ্গে আঙুল মেলাতে মেলাতে টারস্টিগ বললেন—হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি তুমি করেছ ভিনসেন্ট, যদিও খুব বেশি নয়। তোমার প্রথম কপিগুলো দেখে আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম, তবে শেষ পর্যন্ত দেখে এটুকু আমার ধারণা হয়েছে যে তুমি পরিশ্রম করছ খুব, তা-ই না? শুধুমাত্র পরিশ্রম? আশা নেই, সম্ভাবনার কোনো ইঙ্গিত নেই? ভিনসেন্টের

গলায় আকুল প্রশ্ন। এ-প্রশ্ন না করে সে পারল না।

এত তাড়াতাড়ি সে-বিষয়ে কোনো মত দেওয়া যায় না ভিনসেন্ট।

আমার নিজের আঁকাও কয়েকটা ছবি আছে। দয়া করে দেখবেন?

বেশ তো দেখাও।

শ্রমিক ও কৃষাণদের কয়েকটি স্কেচ বার করে ভিনসেন্ট ধরল। চুপ করে রইলেন টারস্টিগ। একটু হুঁ শব্দও এবার করলেন না। ভয়াবহ স্তব্ধতা, সাংঘাতিক অর্থপূর্ণ স্তব্ধতা। এর মানে—কিছু না, কিছু না। ভিনসেন্টের বুক কাঁপতে লাগল, মনে হল যেন তার অসুখ করেছে হঠাৎ।

নিঃশব্দে ছবিগুলো দেখে টারস্টিগ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে, যেখানে স্বচ্ছ হ্রদে রাজহাঁসদের মেলা। ভিনসেন্টের মনে হল সে নিজে যদি কথা না বলে তাহলে এ-নিস্তব্ধতা বুঝি কখনও ভাঙবে না।

কোনো উন্নতির পরিচয় দেখতে পাচ্ছেন মিনহার ছবিগুলোর মধ্যে? এই তো বরিনেজে আঁকা ছবিগুলো, আর এগুলো আঁকা ব্রাবান্টে। পরেরগুলো কি একটুও ভালো হয়নি?

জানলা থেকে চোখ ফেরালেন টারস্টিগ। সোজা চাইলেন ভিনসেন্টের দিকে।

হ্যাঁ, এগুলো একটু ভালো বলতে হবে। তবে আসলে আঁকার হাতই তোমার ভালো নয়। ঠিক যে কী সেটা তা ধরতে পারছিনে, তবে তোমার আঁকায় কোথায় যেন একটা সাংঘাতিক ভুল আছে, একেবারে মৌলিক ভুল। নিজের থেকে ছবি আঁকবার ক্ষমতা এখনও তোমার বিন্দুমাত্রও হয়নি ভিনসেন্ট। এখনও বেশ কিছুদিন তুমি কপি করে যাও।

ছবি আঁকা শেখবার জন্যে আমি হেগেই এসে থাকব ভাবছিলাম মিনহার। আপনি কী উপদেশ দেন?

ভিনসেন্টকে টারস্টিগ ভালোই চেনেন। তার কোনো দায়িত্ব নিতে তিনি নারাজ। উত্তরে বললেন—হ্যাঁ, হেগ চমৎকার শহর, তা আর বলতে! ছবির গ্যালারি আছে কয়েকটা, অল্পবয়সি আঁকিয়েরও অভাব নেই। তবে হেগ কিংবা অ্যান্টোয়ার্প, প্যারিস কিংবা ব্রুসেলস, কোন শহর যে কার চাইতে বেশি ভালো, তা আমি বলতে পারব না।

ভিনসেন্ট বিদায় নিল, পরিপূর্ণ হতাশা নিয়ে নয়। টারস্টিগ হচ্ছেন ছবির শ্রেষ্ঠ সমঝদার, তিনি ছবি দেখেছেন তার। ছিঁড়ে তো ফেলেননি, বলেননি তো চোখ পাকিয়ে—ছেড়ে দাও এ-কম্ম! পরিশ্রম তো করতেই হবে, সাধনার এই তো শুরু। ভাবনা কীসের?

পরদিন সে গেল অ্যান্টন মভের বাড়ি। মভের শাশুড়ি আনা কর্নেলিয়ার বোন। ভিনসেন্ট পেল আত্মীয়তার আহ্বান।

বিরাটকায় ব্যক্তি মভ, মস্ত কাঁধ, চওড়া বুক, দেহে অমিত শক্তি। মস্ত বড়ো মাথা, চওড়া কপাল, হঠাৎ-খাড়া-হওয়া খাঁড়ার মতো নাক, ভাসা ভাসা দুটি চোখ। তামাটে রঙের ঘন দাড়িতে গোলগাল গাল আর চিবুক ঢোকা। ছবি আঁকায় মভের ক্লান্তি আসে না। ক্লান্তি এলে আরও আঁকেন, আঁকতে আঁকতে ক্লান্তি ঘোচে।

মভ বললেন—আমার স্ত্রী এখন বাড়িতে নেই। চলো একেবারে স্টুডিয়োতে গিয়ে বসি।

ভিনসেন্টও তো তা-ই চায়। বাড়ির পেছনে বাগান। বাগানের ধারে মভের স্টুডিয়ো। ঘরোয়া কোলাহল থেকে দূরে।

মস্ত স্টুডিয়ো, সারাঘর জুড়ে দামি তামাক আর পুরোনো পাইপের মধুর গন্ধ। দেয়ালে দেয়ালে অনেক ছবির রঙিন উষ্ণতা। এককোণে একটি কাঠখোদাইয়ের কাজ-করা টেবিল, সামনে মেঝেতে কার্পেট পাতা। উভয় দিকের দেয়াল জুড়ে জানলা। সামনে ইজেলের ওপর ছবি। চারিদিকে বই আর ছবি আঁকার সরঞ্জামের সমারোহ। জিনিসপত্রের এত ভিড়ের মধ্যেও সুন্দর একটি গোছাল ভাব।

গত ক-দিন ধরে মভ তাঁর সব শিল্পীবন্ধুদের এড়িয়ে চলছিলেন। গোধূলি অন্ধকারের একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য তিনি আঁকছিলেন। ছবিটা তাঁকে একেবারে পাগল করে রেখেছিল। ভিনসেন্টকে পেয়ে সংহত আগ্রহ কথার স্রোতে ফেটে পড়ল।

মাদাম মভ ফিরলেন। জোর করে সকলের সঙ্গে ভিনসেন্টকে খাবার টেবিলে বসালেন। সুন্দর খাবার ঘরটি, ফায়ার-প্লেসের কবোষ্ণ উত্তাপ, লোভনীয় খাদ্য ও পানীয়। স্বামী-স্ত্রীর চমৎকার জীবন, শিশুগুলির কী মিষ্টি ব্যবহার! মনটা কেমন করে উঠল ভিনসেন্টের। এমনি একটি সার্থক মধুর সংসার তার জীবনে সে কি পাবে কখনও?

খাওয়াদাওয়ার পর মভের সঙ্গে স্টুডিয়োতে গেল। কপিগুলি বার করল ভিনসেন্ট মভের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে।

মভ দেখে বললেন—মন্দ হয়নি, কিন্তু এ করে কী লাভ?

লাভ? তার মানে?

নিশ্চয়ই! স্কুলের ছেলের মতো তুমি তো খালি কপি করেই চলেছ, আর প্রকৃত শিল্পসৃষ্টি করছে অন্য লোক, তা-ই না?

আমতা আমতা করে ভিনসেন্ট বললে—আমার তো ধারণা প্রথমটা নকল না করলে শেখা যায় না।

ভুল, ভুল, একদম বাজে কথা। সৃষ্টিই যদি করতে চাও, নকলনবিশি করলে চলবে না, সোজাসুজি জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ো। নিজের আঁকা কোনো স্কেচ নেই?

টারস্টিগের অভিমতের কথা ভেবে বড়ো লজ্জায় বড়ো সন্তর্পণে ভিনসেন্ট বললে—হ্যাঁ, নিজেও আমি কিছু কিছু এঁকেছি, বোরেন শ্রমিক আর ব্রাবান্টের চাষিদের ছবি। কিন্তু ভালো হয়নি সেগুলো।

না হোক। তবু নিজের আঁকা তো? সঙ্গে থাকে তো দেখাও।

মভের শিক্ষার্থী হবার আগ্রহ নিয়ে ভিনসেন্ট হেগ-এ এসেছে। এবার আসল অগ্নিপরীক্ষা। কম্পিত হাতে সে তার অকিঞ্চিৎকর স্কেচগুলো তুলে দিল মভের হাতে।

একটার পর একটা ছবি মভ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন। মাঝে মাঝে চোখ পাকিয়ে তাকান, কোনো ছবিটা ইজেলের ওপর বসিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করেন। কখনও নিমীলিত চোখে ভাবেন আর বাঁ-হাতের আঙুলগুলো চালিয়ে নিজের মাথার ঘন চুলগুলোকে উসকোখুসকো করেন। দু-একটা ছবির ওপর নিজের হাতে পেনসিলের রেখাও টানেন কয়েকটা।

শেষপর্যন্ত বলেন—এই তো ঠিক হচ্ছে, রাস্তা পেয়ে গেছ তুমি। স্কেচগুলো তোমার বড়ো নোংরা, কিন্তু আসল কথা, এগুলো সত্যি। এগুলোর মধ্যে শক্তি আছে দৃঢ়তা আছে, যার দেখা সহজে মেলে না। কপিবই সব ফেলে দাও ভিনসেন্ট, সোজাসুজি রঙের বাক্স কেনো একটা। যত তাড়াতাড়ি রংকে ধরবে, তত তাড়াতাড়ি তোমার উন্নতি হবে। হ্যাঁ, ড্রয়িং তোমার ভালো নয়, কাঁচা হাত, তা আঁকতে আঁকতেই ড্রয়িং ভালো হবে।

ভিনসেন্ট সুযোগটা হারাল না। পরম বিনীতভাবে বললে—আমি স্থির করেছি হেগ-এ এসেই থাকব ভাই মভ। আপনি কি আমাকে দয়া করে একটু একটু সাহায্য করবেন? আমার মতো নতুন শিক্ষার্থী গুরুর নির্দেশ ছাড়া কাজ করবে কেমন করে? আপনিই আমার গুরু হবেন।

কুঁকড়ে গেলেন মভ। তাঁর হাতে অনেক অসমাপ্ত ছবি। স্টুডিয়োর বাইরে যেটুকু সময় পান সেটুকু স্ত্রী আর সন্তানদের সঙ্গে কাটাবার তাঁর তৃষ্ণা

বললেন—আমার সময় একদম থাকে না ভিনসেন্ট, আমি তোমার খুব সামান্য কাজেই আসব। শিল্পী বড়ো আত্মকেন্দ্রিক, নিজের কাজের মোহে সে বড়ো স্বার্থপর।

ভিনসেন্ট বললে—আমি বেশি কিছু চাইনে। শুধু মাঝে মাঝে আপনার এখানে কাজ করব। আজ বিকেলে আপনার নিজের ছবির কথা যেমন বলেছিলেন, তেমনি আলোচনা থেকেই আমার অনেক শিক্ষা হবে। আর আপনি কেমন করে ছবি শুরু করেন, শুরু থেকে শেষ করেন, চুপ করে তা-ই দেখব। নিতান্ত যখন বিশ্রাম, তখন হয়তো আমার ড্রয়িংয়ের ভুলগুলো আপনি সংশোধন করে দেবেন। আপনার বোঝা আমি হব না, দেখবেন।

মভ অনেকক্ষণ ভাবলেন। নিজের স্টুডিয়োতে শিক্ষানবিশ তিনি কখনও রাখেননি। তা ছাড়া একলা নাহলে তিনি কাজ করতে পারেন না। নিজের ছবি নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করা খুব বেশি যে তিনি পছন্দ করেন তাও নয়। তা ছাড়া নবীন শিষ্যদের উপদেশ দিতে গিয়ে অবশেষে সম্মান হারানোর তিক্ত অভিজ্ঞতাও তাঁর আছে। তবে কিনা ভিনসেন্ট তাঁর আত্মীয়। তা ছাড়া গুপিল কোম্পানি তাঁর সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষক। ছেলেটার কাঁচা হাতের নোংরা কাজের মধ্যে কোথায় যেন একটা বন্য উদ্দামতা আছে, এও তাঁকে টেনেছে।

স্বীকৃত হলেন শেষ পর্যন্ত। বললেন—আমি খুব একটা আশা তোমাকে দিচ্ছিনে। তবে দেখাই যাক কতদূর কী হয়। আমি ক-মাসের জন্যে বাইরে যাব। শীত পড়লেই তুমি চলে এসো।

ট্রেনে সারাপথ ভিনসেন্টের বুকে আনন্দগুঞ্জন বাজতে লাগল—গুরু পেয়েছি, গুরু পেয়েছি! আর আমাকে আটকায় কে?

ইটেনে পৌঁছে দেখল বাড়িতে কে ভস এসেছে।

.

সদ্য স্বামীহারা বিধবা কে ভস। শোকের বিষণ্ণ ছায়ামূর্তি। প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরনিবাসিনীরও যেন মৃত্যু ঘটেছে। কোথায় সেই উদ্দীপ্ত উচ্ছলতা! মুখে তপস্বিনীর কারুণ্য, নীল চোখ দুটির অতলে পুঞ্জিত বেদনার কৃষ্ণ মেঘচ্ছায়া। বিশীর্ণ দেহ, নিষ্প্রভ কান্তি। তবে রূপহীনা নয়, রূপের শান্ত সমাহিত নব প্রকাশ, যে-রূপ বৈরাগিণীর তপস্বিনীর।

সোজাসুজি নাম ধরে ভিনসেন্ট তাকে সম্ভাষণ করল—তাহলে এতদিন পরে তুমি আমাদের এখানে এলে, কে।

ধন্যবাদ ভিনসেন্ট—তেমনি নাম ধরে কে উত্তর দিল।

তোমার ছেলে জ্যান, তাকে আননি?

হ্যাঁ। বাগানে খেলছে।

এই প্রথম ব্রাবান্টে এলে, তা-ই না? দেখো, কত দেখবার জিনিস আছে গ্রামে, মাঠে, বনে। অনেক দূর পর্যন্ত তোমাকে আমি রোজ বেড়িয়ে আনব।

ভালোই লাগবে, ভিনসেন্ট।

আগ্রহহীন, মৃদু কণ্ঠ। ভিনসেন্ট লক্ষ করল আর গলার স্বরে নতুন গভীরতা, কে যেন মন্থর ঝংকার। একদা তার বড়ো দুঃখের দিনে বড়ো সহৃদয় ব্যবহার সে পেয়েছিল এই কে মেয়েটির কাছে। তার বিনিময়ে সে কি এখন সহানুভূতির কথা শোনাবে? থাক। যে-শোক নিত্য জাগ্রত আছে, তাকে আবার জাগাবার চেষ্টা করে লাভ কী?

কেও বুঝল। স্বামীর স্মৃতি তার কাছে পুণ্যস্মৃতি, অন্তরের গোপন ধন। তা নিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে তারও ভালো লাগে না। ভিনসেন্ট নিঃশব্দে শুধু তার হাত দুটি নিজের হাতে টেনে নিল, নীরব, কৃতজ্ঞকরুণ চোখ তুলে কে শুধু একবার তাকাল তার দিকে। সেই কম্পিত হাতের স্পর্শে, সেই বেদনাকৃষ্ণ আঁখির দৃষ্টিতে ভিনসেন্ট বুঝল—যে-মেয়ে একদা সুখে শুধু হাসিখুশি ছিল, দুঃখের অগ্নিস্পর্শ তাকে রূপান্তরিত করেছে মহীয়সী নারীতে।

নীচু গলায় সে বললে—তোমার এখানে ভালোই লাগবে, কে। আমি সারাদিন বাইরে ছবি এঁকে কাটাই। তোমাকে আর জ্যানকে আমার সঙ্গে আমি নিয়ে যাব।

।তোমার পথে তো আমরা বাধাই হব ভিনসেন্ট!

বাঃ, কে বললে? উলটে খুব ভালো লাগবে আমার। কত মজার মজার জিনিস তোমাদের দেখাব!

তাহলে তোমার সঙ্গে যেতে আমার আপত্তি নেই।

জ্যানেরও ভালো হবে দেখো। শক্ত হবে ওর শরীর।

এবার ভিনসেন্টের হাতে কে-র আঙুলের মৃদু কম্পিত স্পর্শ।

বেশ তো, এবার আমাদের সত্যিকারের বন্ধুত্ব জমবে, কী বলো? বাগানে গেল ভিনসেন্ট। গাছের ছায়ায় ক-র জন্যে একটা বেঞ্চি পেতে তার পাশে জ্যানের জন্যে একটা মাটির খেলাঘর তৈরি করতে বসল। হেগ থেকে যে মস্ত-সম্ভাবনার খবর সে এনেছে, সে-খবর সবাইকে জানাবার কথাও সে ভুলে গেল।

রাত্রে খাবার টেবিলে কথাটা সে ভাঙল যে মভ তাকে ছাত্র হিসেবে নিতে রাজি হয়েছেন। কে সামনে বসে, তাই নিজের সাফল্যের কথাটা একটু বাড়িয়েই বললে। সবচাইতে খুশি হলেন মা।

পরের দিন সকাল বেলা ভিনসেন্ট কে আর জ্যান যাত্রা করল লাইসবকের উদ্দেশ্যে। সেখানে ছবি আঁকবে সে, কিন্তু ব্যাপারটা যেন বনভোজনে চলেছে তারা। মা প্যাকেটে করে দিলেন তিনজনের মতো দুপুর বেলাকার খাবার। পথে গির্জের ধারে অ্যাকাসিয়া গাছের ডালে ম্যাগপাই পাখির বাসা। উৎসুক জ্যানের কাছে ভিনসেন্ট প্রতিশ্রুতি দিল পাখির একটা ডিম সে পেড়ে এনে দেবে তাকে। আঁকাবাঁকা এবড়োখেবড়ো পথে তারা পার হল পাইন বন। তারপর সোনালি আর সাদা বালি-ভরা প্রান্তর। নির্জন প্রান্তরের এক জায়গায় পড়ে আছে ভাঙা একটা লাঙল আর একটা হাতগাড়ি। গাড়িটার ওপর জ্যানকে বসিয়ে ইজেলটা নামিয়ে ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি তাকে স্কেচ করে নিল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল কে। ওর নিস্তব্ধতা ভাঙতে চাইল না ভিনসেন্ট। সে যখন আঁকছে, চুপ করে পাশে রয়েছে একটি মেয়ে, এই নবলব্ধ আশ্চর্য অনুভূতি সেও নিঃশব্দে উপভোগ করতে লাগল।

আবার চলল তারা। গ্রামের পথ, দু-পাশে কৃষাণকুটির। ক্রমে এসে পৌঁছোল রুজেনডালের রাস্তায়। এতক্ষণ পরে প্রথম কথা বললে কে।

জান ভিনসেন্ট, সে বললে—আমস্টার্ডামে তোমার সম্বন্ধে একটা কথা. আমি ভাবতাম, আজ ইজেলের সামনে তোমাকে আঁকতে দেখে সেই কথাটাই আমার মনে পড়ে গেল।

কী কথা, কে? শুধোলে ভিনসেন্ট।

শুনলে দুঃখ পাবে না, বলো?

মোটেই না, বলো তুমি।

তাহলে সত্যি কথাই বলি। তুমি যে পাদরি হবে শেষ পর্যন্ত, তা আমি কিছুতেই ভাবতে পারতাম না। কেমন যেন মনে হতো তুমি খালি সময় নষ্ট করছ।

বলনি কেন তখন আমাকে?

বলবার অধিকার ছিল মনে করিনি।

মাথার কালো টুপির সামনে কয়েকটি অবাধ্য অলক গুঁজে দিল কে। রাস্তাটা সরু হয়ে এসেছে। একবার হোঁচট খেয়ে সে টলে পড়ল ভিনসেন্টের গায়ে। ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি তার বাহুমূলে হাত দিয়ে চেপে ধরে তাকে সামলাল, তারপর হাত সরিয়ে নিতে মনে রইল না।

কে আবার বললে—তা ছাড়া যে-কথাটা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছ, তখন আমি সেটা বললেই কি কোনো লাভ হতো? তবুও তুমি যে একজন সংকীর্ণমনা পাদরি হবে তা আমার ভাবতেই খারাপ লাগত।

ভিনসেন্ট বললে—আশ্চর্য! তুমি নিজে যে ধর্মযাজকের মেয়ে!

এ আমার ভস-এর কাছ থেকে শিক্ষা। অনেক শিক্ষাই আমি ওর কাছ থেকে পেয়েছি।

হাতটা সরিয়ে নিল ভিনসেন্ট। হঠাৎ ভস-এর নাম যেন ছায়ার মতো নামল দুজনের মাঝখানে।

ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর তারা লাইসবকে পৌঁছোল। ভিনসেন্ট ইজেলটা ঠিক করে দাঁড় করাল। পিছনের একটা ছোটো টুলে বসে কে বইয়ের পাতা খুলল। বালিতে খেলা করতে লাগল জ্যান। স্কেচ করতে শুরু করল ভিনসেন্ট। মনে তার নতুন উন্মাদনা, পেনসিলের প্রতি রেখায় নতুন বলিষ্ঠতা। হয়তো মভের আশ্বাস, হয়তো কে-র উপস্থিতি এর কারণ। ক্ষিপ্রগতিতে স্কেচের পর স্কেচ সে করে চলল। একটিও কথা বলে কে তাকে বিরক্ত করল না, সেও কে-র দিকে মুখ ফিরিয়ে সময় নষ্ট করল না একটু। আজকের কাজ তার ভালো হওয়া চাইই চাই, দিনের শেষে কে-র প্রশংসাবাণী তাকে আদায় করতেই হবে।

দুপুর বেলা তারা আশ্রয় নিল ছায়াঘেরা একটি ওককুঞ্জে। শীতল ছায়ায় বসে কে খাবারের সামগ্রীগুলি সাজাল। অদূরের জলাভূমি হতে অসংখ্য পদ্মের মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে মিশেছে মাথার ওপরকার ওক পল্লবের মৃদু সুরভি। একদিকে বসল কে আর জ্যান, অপর দিকে তাদের মুখোমুখি ভিনসেন্ট। পাত্র সাজিয়ে খাবার গুছিয়ে দিতে লাগল কে। খাবার টেবিলের ধারে মভ আর তার পরিবারের সেই শান্ত তৃপ্ত পরিবেশটির কথা মনে পড়ল ভিনসেন্টের।

কে-র দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে হল, এমন সুন্দর আর কাউকে সে কখনও বুঝি দেখেনি। হাতে গড়া রুটিতে মাখানো সুস্বাদু ঘন পনির, সবই মার হাতের তৈরি, তবু ভিনসেন্টের গলা দিয়ে যেন নামে না। নতুন অভূতপূর্ব একটা ক্ষুধা মনের মধ্যে জেগে উঠেছে, কে-র শীর্ণ’ গম্ভীর মুখ, বেদনাকৃষ্ণ গভীর চোখ আর পাণ্ডুর ওষ্ঠ দুটি চুম্বকের মতো তার দৃষ্টিকে টেনে রেখেছে।

খাওয়ার পর মার কোলে মাথা রেখে জ্যান ঘুমিয়ে পড়ল। ছেলের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে চোখ নীচু করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল কে। ভিনসেন্ট বুঝল, শুধু ছেলের মুখই দেখছে না কে, সেই মুখের আদলে খুঁজছে ভসকে, মৃত্যুপারের দয়িতকে।

সারাবিকেল বেলাটা সে স্কেচ করল। অনেকবার জ্যান এসে বসল তার কোলে। ছেলেটা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। হাজার প্রশ্নে প্রশ্নে তাকে অস্থির করেছে, কালিঝুলি মাখিয়ে নষ্ট করেছে অনেকগুলো কাগজ। বিরক্ত বোধ করেনি ভিনসেন্ট, ভালো লেগেছে নিষ্পাপ সরল এই জীবন্ত শিশুটির চঞ্চল স্পর্শ।

সন্ধ্যাগমে আবার যাত্রা গৃহমুখে। পথে ছোটো ছোটো জলায় পড়ন্ত সূর্যের রঙিন লীলা, যেন প্রজাপতির বর্ণবৈচিত্র্য। চক্রবালের রক্তিমে আসন্ন রাত্রিছায়ার কারুণ্য। প্রান্তর-জোড়া ক্রমবৈরাগ্যের অভিব্যক্তি। সে-দিনের আঁকা স্কেচগুলি ভিনসেন্ট কে-কে দেখাল। কে-র মনে হল এগুলো শিশুসুলভ অপটু আর স্থূল কাজ। তবু জ্যানকে যে ভালোবেসেছে, তার দুঃখকে যে উপলব্ধি করেছে অন্তরে, সে লোক ভালো।

কেমন লাগল, কে?

ভালো, খুব ভালো।

সত্যি?

সহানুভূতির ছোট্ট কটি কথায় ভিনসেন্টের মনের বন্ধ অর্গল খুলে গেল। কে তাকে বুঝবে, কে বুঝবে তার ওই আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা! পৃথিবীতে আর কেউ নয়। বাড়িতে সে মুখ বুজে থাকে, মভ আর টারস্টিগের কাছে কথা বলতে হয় দীন আর বিনীতভাবে, থিয়ো থাকে বিদেশে। বন্ধু নেই একটিও, হৃদয়ের একটি বাতায়নও যার কাছে খোলা যায়।

এতক্ষণ পরে মুখ খুলল সে। কথা বলতে লাগল ঝড়ের মতো। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল জোরকদমে। তার হাঁটার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত হল কে-র পক্ষে। কোথায় গেল শহুরে ভদ্রতার পালিশ! আড়ষ্ট ভাষা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা কি সহজ? তাই তো আবার হাত ঝাঁকুনি কাঁধ ঝাঁকুনির মুদ্রাদোষগুলো বিকটভাবে প্রকট হয়ে উঠছে। কে অবাক হয়ে গেল, কেন এমনি ছটফট করছে, বকবক করছে অমার্জিত অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকের মতো? নারী বুঝল না যে লোকটা আসলে তার সামনে রাখছে শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রমের আন্তরিক অঞ্জলি।

প্রকাশহীনতার বেদনার যত অনুভূতি তার মনে জমা হয়েছিল সব সে ঢেলে দিতে চাইল এক নিশ্বাসে। কী তার আশা, কী তার আকাঙ্ক্ষা, কেমন শিল্পী সে হতে চায়, জীবনের কোন সত্যের বাস্তব রূপটিকে সে প্রকাশ করতে চায় তার কাজে, তার ছবিতে? স্বপ্ন সে দেখে, কিন্তু স্বপ্নবিলাসী সে নয়। দুঃখের পরিচয় সে পেয়েছে, তাই তার স্বপ্ন দুঃখপারের সার্থকতার স্বপ্ন! কে ভেবেই পেল না তার অত উত্তেজিত হয়ে ওঠার কারণটা কী। বাধা সে দিল না, কিন্তু কানেও নিল না অধিকাংশ কথা। স্মৃতি নিয়ে সে আছে, অতীতে নিমজ্জিত তার মন। ভবিষ্যৎ নিয়ে এত উত্তেজনার, এত আশার কথা তার কানে বেসুরো বাজে, কুঁকড়ে দেয় তার মনকে। কথার মাঝখানে একটা নাম শুনে হঠাৎ একবার কে বলে উঠল—

রিউহাইস? আমস্টার্ডামে এই নামে একজন শিল্পী থাকত, তার কথা বলছ?

হ্যাঁ, তার কথাই তো। সে এখন হেগ-এ আছে। তুমি জানতে তাকে?

ভস-এর বন্ধু ছিল সে। ভস প্রায়ই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসত।

ভস, কেবল ভস! লোকটা মরেছে, এক বছরের বেশি সে নেই। তবু তার প্রেত আজও কেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে কে-কে, কেন ভুলতে পারে না কে! সে তো এখন অতীত, ভিনসেন্টের জীবনে উরসুলা যেমন অতীত। তবু ভস অতীত নয়, তবু সে উপস্থিত। হঠাৎ ভিনসেন্টের ধারণা হল, আমস্টার্ডামে লোকটাকে যতবার সে দেখেছিল, একবারও তাকে তার ভালো লাগেনি।

শরৎ ঘনিয়ে এল। তামাটে হলুদ রং ধরল পাইন বনে। প্রতিদিন কে আর জ্যান ভিনসেন্টের সঙ্গে বার হয়। কে-র গালে লেগেছে রং, পায়ের চলায় এসেছে সুস্পষ্ট দৃঢ়তা। সঙ্গে সে নেয় সেলাইয়ের বাস্কেট। ভিনসেন্ট আঁকে সারাদিন, তার আঙুলও অলস থাকে না। কথাবার্তাতেও আবার প্রাণের আবেগ লেগেছে, ছেলেবেলাকার গল্প, আমস্টার্ডামের জীবনের গল্প। কে-র চোখে মাঝে মাঝে কৌতুকের ঝিলিক লাগে।

কে-র সবকিছু ভালো লাগে ভিনসেন্টের। দীর্ঘ রুক্ষ কালো পোশাকে ঢাকা ওর শীর্ণ তনু, সোনালি-চুল-ঢাকা পথে বার হবার কালো টুপিটি, কাছাকাছি যখন আসে তখন ওর মৃদু মধুর দেহসুরভি। চোখে চোখ পড়ে কখনও, কখনও-বা ক্ষণিক চকিত স্পর্শ। ওর গলার ভাঙা ভাঙা স্বর ভিনসেন্টের নিদ্রিত শ্রবণে গানের মতো বাজে, স্বপ্নে ভিনসেন্টের তৃষিত ওষ্ঠ তৃপ্তি খোঁজে ওর অঙ্গপ্রান্তের মরীচিকায়।

অধুনা সে উপলব্ধি করছে—বঞ্চিত, অসম্পূর্ণ তার জীবন। এমনি অসম্পূর্ণতায় বছরের পর বছর তার কেটেছে, অন্তরে ভালোবাসার স্নেহমমতার যে স্রোতস্বিনী ছিল তা শুকিয়ে গেছে দিনে দিনে, বুকজোড়া তার শুষ্ক মরু। এতদিনে তার স্বপ্নমানসী বুঝি রূপ ধরে দেখা দিল! তাই এত ভালো লাগে কে-র উপস্থিতি, উপস্থিতিটুকু যেন কোমল আলিঙ্গনের মতো। তার সঙ্গে যখন সে মাঠে যায়, নতুন প্রেরণা সে পায় ছবি আঁকায়, যেদিন যায় না সেদিন প্রতিটি লাইন আঁকা যেন গুরুতর পরিশ্রমের মতো লাগে। সন্ধে বেলা বসবার ঘরে টেবিলের ধারে বসে স্কেচগুলো কপি করে, কাজের আর তার দৃষ্টির মাঝখানে সর্বদা ভাসে কে-র মুখখানি। টেবিলের ওধারে বসে থাকে কে, নিঃশব্দে কোলের ওপর হাত দুখানি রেখে। হলদে মৃদু আলোর পারে আধো অন্ধকারে সে-মুখ ঢাকা। চোখ তুলে ভিনসেন্ট দু-একবার চায়, ওর চোখে চোখ পড়ে, কে-র রক্তিম ওষ্ঠে ফুটে ওঠে মৃদু হাসির ধূসর কারুণ্য। মাঝে মাঝে কে যেন হঠাৎ মারে বুকের মধ্যে, মনে হয় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে সে ওকে, শীতল ওষ্ঠপুটের অমৃত পান করবে সকলের সামনে, কাউকে গ্রাহ্য না করে সার্থক করবে তার অন্তরতৃষা।

শুধু যে কে-র রূপে সে মজেছে তা নয়, কে-র দেহমন সবকিছুর কাছে সে আত্মসমর্পিত। উরসুলাকে হারাবার পর থেকে ভুলে ছিল এতদিন তার চরম একাকিত্বের বেদনা। সারাজীবনে কোনো মেয়ে তার কানে একটি ভালোবাসার কথা বলেনি, আঙুলের সামান্যতম স্পর্শে সিঞ্চন করেনি সামান্যতম আদর। একটিমাত্র চুম্বনের সে চিরকাঙাল। এ তো জীবন নয়, এ জীবনমৃত্যু, প্রেমহারা এ জীবনযাত্রা। উরসুলাকে যখন ভালোবেসেছিল, তখন সবে তার বয়ঃসন্ধিকাল, তখন সে শুধু দিতেই চেয়েছিল, সেই দানটুকু গ্রহণ করেনি উরসুলা। এখন এ তার পরিণত মনের প্রেম, এ-প্রেম দিতে চায়, নিতেও চায়। সে ভাবে, কে যদি উত্তপ্ত আশ্লেষে তার এই নবজাত প্ৰেমতৃষা না মেটায়, তাহলে বাঁচবে সে কী নিয়ে আর? কে-র প্রতি পরিণত ভালোবাসাই তাকে যে আবার সম্পূর্ণ মানুষের বাসনা কামনার অধিকারী করেছে।

জ্যানকেও সে ভালোবাসে, জ্যান যে কে-রই অংশ। কিন্তু ঘৃণা করে সে ভসকে, সারা অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে ওই মৃত লোকটার প্রেতচ্ছায়াকে, যা এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার প্রেমাস্পদার মন। কে ভালোবেসেছিল, ক্ষতি নেই, দুঃখশোক পেয়েছে, ভালোই তো। সেও তো একদা ভালোবেসেছিল উরসুলাকে, যে-ভালোবাসার ব্যর্থতায় কম জ্বলেনি সে। দুঃখের দাহনে দুজনেরই অভিজ্ঞতা, সেই দাহনে পবিত্রতর হোক ওদের যুগল প্ৰেম।

আশঙ্কা নেই তার। ওই প্রেতকে সে ভয় করে না। জয় সে করবেই। অগ্নিক্ষরা ভালোবাসায় সে পুড়িয়ে দেবে কে-র মনের সমস্ত স্মৃতির জড়তা।

শীঘ্রই সে হেগ-এ যাচ্ছে মভের কাছে ছবি আঁকা শিখতে। কে-ও তার সঙ্গে যাবে। দুজনে নতুন জীবন শুরু করবে—স্বামী স্ত্রী। ঠিকই তো! সংসারী সে হৰে না নাকি? কে-র ছেলে-মেয়ে হবে, কে-র আর তার। অনেকদিন বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরেছে, আর না। অনেক অর্থহীন রুক্ষতা জমেছে তার চরিত্রে, এবার সেসব ঘুচবে, আসবে মাধুর্য, আসবে সম্পূর্ণতা। প্রেম ছাড়া তা অসম্ভব। জীবনের সব মাধুর্যের মূলে প্রেম। এই প্রেমকে সে জয় করবেই।

ভালোই হয়েছে যে উরসুলা তাকে ভালোবাসেনি। যদি সে প্রত্যাখ্যান না করত, সর্বনাশ হতো তাহলে। ছেলেবেলাকার সস্তা মোহ, তাকেই সে ভেবেছিল ভালোবাসা। ঝুটো কাচ দেখে মানিক ভেবে তার মন মজেছিল। প্রেমের প্রকৃত পরিচয় জীবনে আর তাহলে পেত না, ভালোবাসতে পারত না কে-কে। ওই একটা নিতান্ত সাধারণ আর চটুল আর মূর্খ মেয়েকে নিয়ে সারাজীবন তার ঘর করতে হতো। অমনি একটা মেয়ের জন্যেই কত দুঃখ না একদিন সে পেয়েছে। ভাবতে এখন হাসি আসে, আজ মনে হয়, একটি ঘণ্টা কে-র কাছে থাকার বিনিময়ে উরসুলার সারাজীবনের সঙ্গ সে বিলিয়ে দিতে পারে। দুঃখ সে পেয়েছে বটে, ক্ষতি কী তাতে? শেষ পর্যন্ত কে-কে তো পেল! ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দিন ঘুচল। পথ খুঁজে শেষ পর্যন্ত সে পেল, পেল সৃষ্টির দিশা, প্রেমের পরিণতি।

প্রচণ্ড প্রচেষ্টায় নিজেকে এখনও সংযত করে রেখেছে ভিনসেন্ট। সহস্র বার, কে যখন সে কাছে পায়, মনে হয় সে বলে—কে, রাগ কোরো না, মনের কথা তোমাকে বলি। মন চায় বাহুর বন্ধনে তোমাকে বাঁধতে, চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে তোমার মুখ। মন চায় তুমি আমাকে বিয়ে করো, ঘরনি হও আমার এ-চাওয়া কি দুরাশা?

কথাটা সে কিছুতেই গুছিয়ে পাড়তে পারে না। সে তাকে কোনো সুযোগ দেয় না। উচ্ছ্বাস-ভরা সব কথাকেই সযত্নে সে এড়িয়ে চলে। কী করে সে বলবে? এ-দিকে হেগ-এ যাবার সময় তার ঘনিয়ে আসছে, দেরি করা চলে না। কিন্তু সহসা আকাশ থেকে প্রেমপ্রলাপকে সে নামিয়ে আনে কেমন করে?

একদিন তারা চলেছে ব্রেডার পথে। সকাল বেলাটা ভিনসেন্ট কয়েকটি কৃষাণের স্কেচ করেছে। দুপুর বেলা একটি নদীর ধারে এলম গাছের ছায়ায় তারা বিশ্রাম করল। খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। ঘাসের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে জ্যান। ভিনসেন্ট নীচু হয়ে কে-কে কয়েকটা স্কেচ দেখাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল কে-র নরম একটি কাঁধ তার বুকের একটা অংশ স্পর্শ করে তার সারাদেহে যেন জ্বালা ধরিয়ে দিল। সংযমের এতদিনের বাঁধ মুহূর্তে ভেঙে গেল তার। হাত থেকে কাগজগুলো খসে পড়ল, চকিতে সে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল কে-কে। কর্কশ, পরুষ আলিঙ্গনের সঙ্গে সঙ্গে এতদিনের নিরুদ্ধ উদ্ভ্রান্ত ব্যাকুল ভাষার বন্যায় সে উজাড় করে দিল এক মুহূর্তে।

মাপ করো, মাপ করো কে! আমি বলব, আমাকে বলতেই হবে! আমি তোমাকে ভালোবাসি, কে, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, নিজের চেয়েও ভালোবাসি! প্রথম যে-দিন আমস্টার্ডামে তোমাকে দেখি সেই দিনটি থেকেই তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি ছাড়ব না, না, কিছুতে এড়াতে পারবে না আমাকে। কে, বলো আমাকে একটু তুমি ভালোবাস? আমরা এখান থেকে চলে যাব, হেগ-এ গিয়ে থাকব। সুখী হব আমরা। আমাকে তুমি ভালোবাস, তাই না লক্ষ্মীটি! বলো তুমি, আমাকে তুমি বিয়ে করবে তো?

নিজেকে ছাড়াবার জন্যে কোনো চেষ্টা করল না কে। বিস্ফারিত তার চোখ, আতঙ্কে আর বিতৃষ্ণায় মুখটা যেন তার বেঁকে গিয়েছে। ভিনসেন্টের সব কথা তার কানে পৌঁছোয়নি, কিন্তু কথার মানেটা সে বুঝেছে। আর্ত একটা চিৎকারকে রোধ করার জন্যে এক হাতে সে মুখটা ঢাকল, তারপর তীক্ষ্ণ রুদ্ধশ্বাসে হিসহিস করে উঠল তার কণ্ঠ

না, না, কখনও না!

এক ঝটকায় ভিনসেন্টের আলিঙ্গন থেকে সে মুক্ত করে নিল নিজেকে। তারপর ঘুমন্ত শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে দৌড় দিল মাঠের মধ্যে দিয়ে।

ভিনসেন্ট অনুসরণ করতেই গতি বাড়িয়ে দিল কে। ভিনসেন্ট স্তম্ভিত হয়ে গেল, কী হল? এরকম হল কেন? চিৎকার করে সে ডাকল—দাঁড়াও কে, দাঁড়াও! দৌড়িয়ো না এমনি করে!

তার গলার আওয়াজে কে আরও ভয় পেল। আরও জোরে সে দৌড়োতে লাগল, প্রাণপণে। পাগলের মতো লাফাতে লাফাতে ভিনসেন্ট ছুটতে লাগল তার পেছনে। হোঁচট খেয়ে একবার ঘাসের ওপর পড়ে গেল কে। কোল থেকে মাটিতে পড়ে ককিয়ে কেঁদে উঠল জ্যান।

সামনে হাঁটু গেড়ে বসে কে-র দু-হাত চেপে ধরল ভিনসেন্ট। পাগলের মতো বলতে লাগল—আমি তোমাকে ভালোবাসি, এ-কথা শুনে তুমি এমনি করে পালাচ্ছ কেন কে? পালাবার কী আছে? আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে নাহলে আমার চলবে না! তুমি তো আমাকে ভালোবাস! তবে? কত যে তোমাকে চাই তা তো জান! তবে? অতীতকে ভুলে যাও কে, তুমি আর আমি, নতুন জীবন হবে আমাদের!

আতঙ্কের ভাবটা কেটে গেছে কে-র চোখ থেকে। তার বদলে তিক্ত, তীব্র ঘৃণা। হাত দুটো ছিনিয়ে নিল মুহূর্তে। জ্যানের ঘুম একেবারে ভেঙে গেছে। ভিনসেন্টের উন্মত্ত চাহনি আর উন্মত্ত চিৎকারে ভয় হয়েছে তার। মার গলা জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।

ভিনসেন্ট সোজা হয়ে দাঁড়াল তাদের সামনে। অন্তরের সমস্ত ব্যাকুলতা যেন একটিমাত্র কাতর প্রশ্নে সে ছড়িয়ে দিল নিঃশব্দ প্রান্তরের আকাশে আকাশে–বলো, বলো কে! চুপ করে থেকো না তুমি, বলো, এইটুকু, এতটুকু ভালোবাস আমাকে!

না, না, কখনও না!

জ্যানকে বুকে নিয়ে আবার দৌড়োতে লাগল কে। মাঠ থেকে রাস্তায় পড়েও সে তেমনি দৌড়োতে লাগল। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ভিনসেন্ট। তারপর কতবার চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকল, কে পেছন ফিরে তাকাল না একবারও।

রাস্তা দিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে দৃষ্টির বাইরে অন্তর্হিত হয়ে গেল কে। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল ভিনসেন্ট কতক্ষণ, তারপর আস্তে আস্তে ফিরে গেল প্রান্তরের মাঝখানে। কানে কেবলই বাজছে চরম নিষ্ঠুর সেই ক-টি কথা—না, না, কখনও না। মাটিতে এলোমেলো ছড়ানো স্কেচগুলো আর অন্যান্য সরঞ্জাম সব কুড়িয়ে নিয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে ফিরে চলল বাড়ির দিকে।

সারাবাড়ি ভরা চাপা বিদ্যুৎ-উত্তেজনা। কে-র ঘরের দরজার খিল বন্ধ। বসবার ঘরে গম্ভীর থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন বাবা, পাশে মা; চোখে তাঁর ত্রস্ত চিন্তিত দৃষ্টি

তাকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠলেন মা—ভিনসেন্ট, তুই এ-কাজ করলি কী করে?

ভিনসেন্ট বললে—কী কাজ করেছি?

অমনি করে তুই কে-কে অপমান করেছিস!

আস্তে আস্তে পিঠ থেকে ইজেলটা নামাল ভিনসেন্ট। কী উত্তর সে দেবে সে নিজেই জানে না। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতার পর প্রশ্ন করল—কী শুনেছ তোমরা কে-র মুখ থেকে?

নিরুদ্ধ রাগে বাবার মুখে যেন রক্ত ফেটে পড়ছে। গলার বোতামটা খুলে দিয়ে দু-হাতে টেবিলের ধারটা আঁকড়ে ধরে চাপা গলায় তিনি বললেন—কে বলেছে যে তুমি তাকে মাঠের মধ্যে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলে আর চিৎকার করে পাগলের মতো প্রলাপ বকছিলে—

শান্ত গলায় ভিনসেন্ট বললে–তাকে আমি বলেছিলাম, আমি তাকে ভালোবাসি। এ-কথায় কাউকে অপমান করা হয় বলে আমি জানিনে।

এইমাত্র? শুধু এই কথা তুমি তাকে বলেছিলে?

না, আরও বলেছিলাম। বলেছিলাম আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।

বিয়ে! ওকে?

আশ্চর্য হবার কী আছে তাতে?

মা কেঁদে উঠলেন আবার—ভিনসেন্ট, এমন কথা তুই ভাবলি-বা কী করে!

কেন মা? আমি যদি ওকে ভালোবাসি–

ভিনসেন্ট, জলদগম্ভীর গলায় ধমকে উঠলেন বাবা—কে’তোমার আপন মাসতুতো বোন হয়, সে-কথা একবারও তোমার খেয়াল হয়নি? ছিঃ!

কেন, কী হয়েছে তাতে?

কী হয়েছে? বোনকে বিয়ে করতে চাও? একেবারে ইতর, অমানুষ হয়েছ তুমি?

কী বাজে কথা বলছেন বাবা? এ-যুগে আপনার পক্ষে এমনি ধারণা সাজে না। এ কি বাইবেল আওড়াচ্ছেন নাকি?

থামো তুমি, বকবক কোরো না। আমার বংশের সম্মান আছে, তোমার সে-জ্ঞান না থাক। আমার বংশে এমনি অনাচার আমি হতে দেব না।

মা বললেন—তুই আমার কথা শোন ভিনসেন্ট। তুই যদি ওকে ভালোই বাসিস, তবু আরও ক-দিন অপেক্ষা করতে পারলিনে কেন? বছরও ঘোরেনি ও বিধবা হয়েছে। স্বামীর শোক ওর বুকে দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলছে। তোর সবুর সইল না? আর বিয়েই যদি করিস বউকে খাওয়াবার সংস্থানই বা কোথায় তোর?

বাপ বললেন আবার দাঁতে দাঁত চেপে—তোমার ব্যবহার যেমন অশোভন, তেমনি মন তোমার নোংরা। এতদিন তোমাকে পুরোপুরি আমি চিনতে পারিনি।

দপ করে জ্বলে উঠল ভিনসেন্ট—আপনি ভুল করছেন বাবা। কে-র প্রতি আমার যে-ভালোবাসা তা মহৎ, তা পবিত্র। আপনি তা বুঝুন আর নাই বুঝুন, অন্তত সংযত হয়ে কথা বলবেন।

নিজের ঘরে চলে গেল ভিনসেন্ট। বসে পড়ল বিছানার ধারে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে, সবকিছু যেন লাগছে ধাঁধার মতো। এ কেমন হল? কেন হল? ভালোবাসা কি পাপ? ভালোবাসা প্রকাশ করা কি অন্যায়? তবু কেন কে তাকে অমনিভাবে এড়িয়ে ছুটে পালাল? সে তো কোনো ক্ষতি করতে চায়নি তার? একটুও কি সে ভালোবাসে না তাকে প্রতিদানে?

ক্রুর প্রতিধ্বনি কানে বাজল—না, না, কখনও না!

সারারাত কাটল অসহ্য যন্ত্রণায়। বিনিদ্র চোখের সামনে বিকেল বেলার ওই অসহ্য অকল্পনীয় দৃশ্যটা শত বার ভেসে ভেসে ওঠে, সহস্র বার কানে বাজে ওই নিষ্ঠুর ধিক্কারবাণী—না, না, কখনও না।

সকাল বেলা ঘর থেকে বার হল অনেক বেলা করে। রান্নাঘরে মা মিষ্টি গলায় বললেন—হ্যাঁরে, এত দেরি? রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো ভালো?

ভিনসেন্ট শুধোলে—কে কোথায়?

তোর বাবা তাকে পৌঁছে দিতে গেছেন ব্রেড়া স্টেশনে।

কেন?

কে রইল না। বাড়ি ফিরে যাবে।

আমস্টার্ডামে?

হ্যাঁ।

ও। তা বেশ। আমার কথা কিছু বলেনি?

না।

একটি কথাও না? কালকের কথার উল্লেখ করেনি একবারও?

না, শুধু বললে বাবা-মার কাছে ফিরে যাবে। তুই খেতে বোস ভিনসেন্ট। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। ওর কথা আর ভাবিসনে।

ট্রেন কটায় ছাড়ে মা?

দশটা কুড়িতে।

ভিনসেন্ট হাতঘড়ি দেখল। বললে—হ্যাঁ, ছাড়বার আর দেরি নেই। আর-কিছু করার নেই এখন আমার, সময় চলে গেছে।

দিনান্ত বেলায় ট্রেন এসে পৌঁছোল আমস্টার্ডামের সেন্ট্রাল স্টেশনে। কামরা থেকে লাফিয়ে নেমে হনহন করে চলল ভিনসেন্ট। আবার সে গৃহত্যাগ করেছে, হয়তো এই শেষবারের মতো। আবার ভেসে যাবে কোথায় জানে না। তার আগে একটি মাত্র আশা। একবার দেখা করে যাবে কে-র সঙ্গে।

সন্ধ্যা-অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে শহরের পথে পথে। দোকানপাট আপিস দফতর বন্ধ হচ্ছে। গৃহাভিমুখী কেরানির ভিড়।

রেভারেন্ড স্ট্রিকারের বাড়ির সামনে একটু থমকে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। তারপর পাথরের ধাপ ক-টা উঠে দরজার ঘণ্টাটা বাজাল। মুহূর্ত পরে দরজা খুলল। পরিচারিকাটি তাকে দেখে চিনতে পারল, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াল দরজার ফাঁকটা আগলে।

ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করলে—রেভারেন্ড স্ট্রিকার বাড়ি আছেন?

পরিচারিকা জানত কী বলতে হবে এ-ক্ষেত্রে। বললে—না, বাড়ি নেই।

বাড়ির ভেতর থেকে পরিচিত দুটি কণ্ঠস্বর কানে এল ভিনসেন্টের। ধমক দিয়ে উঠল—সরে যাও সামনে থেকে। ভেতরে যেতে দাও আমাকে!

এক ধাক্কায় পরিচারিকাটিকে সরিয়ে ভিনসেন্ট ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে। মেয়েটি ভয়ে চেঁচাতে লাগল—আরে, দাঁড়ান দাঁড়ান! চলেছেন কোথায় আপনি? বাড়ির সবাই খেতে বসেছেন যে?

সোজা হলঘর পার হয়ে ডাইনিংরুমে ঢুকল ভিনসেন্ট। মুহূর্তে চোখে পড়ল, কালো পোশাক পরা একটি পরিচিত মূর্তি অন্তর্হিত হয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। রেভারেন্ড স্ট্রিকার, তাঁর স্ত্রী উইলহেমিনা মাসি ও তাঁদের দুটি ছোটো ছেলে-মেয়ে খাবার টেবিলে। একটি চেয়ার ফাঁকা। সেটির সামনেও টেবিলের ওপর খাবারের পাত্র।

পরিচারিকা অনুযোগ করে উঠল—বললাম সবুর করুন, তা এঁর তর সইল না। একেবারে আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এ-ঘরে এসে ঢুকলেন।

টেবিলের দু-ধারে রুপোর দুটি বাতিদান, তাতে লম্বা লম্বা দুটি জ্বলন্ত মোমবাতি। তার নরম হলদে আলোয় দেয়ালে ক্যালভিনের প্রতিকৃতিটি অস্পষ্ট প্রতিভাত। টেবিলে রুপোর বাসনপত্রের কিনারাগুলি চিকচিক করছে বাতির মৃদু ছটায়।

মেসোমশাই বললেন—ব্যাপার কী ভিনসেন্ট! সামান্য ভব্যতাবোধও দেখছি তুমি খুইয়েছ! কী চাও তুমি?

স্পষ্ট স্বরে ভিনসেন্ট ঘোষণা করলে—কে-র সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই।

সে এখানে নেই। বন্ধুর বাড়ি গেছে।

মিথ্যে কথা। এইমাত্র সে এখানে ছিল। ওই চেয়ারে, ওই তার খাবারের পাত্র–

রেভারেন্ড স্ট্রিকার স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন—ছেলেমেয়েদের এ-ঘর থেকে নিয়ে যাও।

ঘর খালি হতে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠলেন তিনি। বললেন—অনেক যন্ত্রণা তুমি দিচ্ছ ভিনসেন্ট। শুধু আমাকে নয়, তোমার আমার পরিবারের সকলকে। এতটা বয়েস হল তোমার, কিছু করলে না, চাষার মতো আচার-ব্যবহার নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে নিজের ইহকাল পরকাল নষ্ট করলে। তোমার জন্য আমরা করিনি কী? একটু কৃতজ্ঞতাবোধও নেই তোমার? এতটা অশান্তি তুমি ঘটাচ্ছ কোন লজ্জায়? আমার মেয়েকে নাকি তুমি ভালোবাস। এত বড়ো সাহস তোমার! ধৃষ্টতার একটা সীমা আছে!

ভিনসেন্ট উত্তর দিল না ওসব কথার। শুধু বললে—কে-র সঙ্গে একবার দেখা করতে দিন আঙ্কল স্ট্রিকার। ওর সঙ্গে কথা আছে আমার।

কোনো কথা তোমার নেই আমার মেয়ের সঙ্গে! ও তোমার মুখদর্শন করতে চায় না।

বিশ্বাস করিনে। কে আপনাকে তা-ই বলেছে?

আলবত বলেছে। জ্বলে উঠলেন স্ট্রিকার—আমি মিথ্যে কথা বলছি?

জানিনে সত্যি কি মিথ্যে। সত্যি হয় তো হোক, তবু আমি নিজে ওর মুখ থেকে এ-কথা শুনে যেতে চাই।

অটল রইলেন স্ট্রিকার।

ক্লান্ত, হতাশভাবে ভিনসেন্ট কে-র পরিত্যক্ত চেয়ারটাতে বসে পড়ল। অনুনয় করে বললে—আপনারা ধর্মযাজক, লোহার বর্ম দিয়ে আপনাদের হৃদয় ঢাকা সে আমি জানি। তবু বিশ্বাস করুন, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আমি কে-কে ভালোবাসি। ঈশ্বর আমার সাক্ষী, এ-ভালোবাসা আমার প্রতিমুহূর্তের মৃত্যুযন্ত্রণা। একলহমার জন্যে ওকে আমি ভুলতে পারিনে। আপনি দয়া করুন আমাকে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জীবন আমার ব্যর্থ হবে না। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে খুব বেশিদিন আমার লাগবে না। আপনার মেয়ের যোগ্য আমি হবই। কিন্তু ওকে বোঝাবার, ওর ভালোবাসাকে জয় করবার সুযোগটুকু আমাকে দিন। আপনিও তো একদিন ভালোবেসেছেন, আমার এই দুঃসহ যন্ত্রণা আপনি কি বুঝবেন না, আপনার বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও কি আমি পাব না?

রেভারেন্ড স্ট্রিকার একটু ভাবলেন। তারপর চট করে মোড় ঘুরিয়ে দিলেন কথাটার। গলায় তিক্ততার আভাস এনে বললেন—যন্ত্রণা? যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি নেই তোমার? মানুষ নও তুমি? দুর্বল, কাপুরুষ কোথাকার! ব্যর্থ প্রেমের মিনমিনে কান্না ছাড়া আর-কিছু করার নেই তোমার?

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। সমস্ত বুক তার পাথর হয়ে উঠল কাঠিন্যে। স্ট্রিকারের মুখোমুখি সে দাঁড়াল। দুজনের মাঝখানে লম্বা দুটি মোমবাতি জ্বলছে। বাতি দুটোর আড়ালে না থাকলে সে হয়তো মেরেই বসত স্ট্রিকারকে। আঘাত লেগেছে তার মনুষ্যত্বে, তার পুরুষত্বে—চরম আঘাত। আলোকবিন্দু দুটির ওপর দিয়ে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ জ্বলন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

এমনিভাবে কতক্ষণ কাটল কারও খেয়াল নেই। হঠাৎ ভিনসেন্ট তার বাঁ-হাতটা তুলে ধরল মোমবাতির ওপর। ভৌতিক নিস্তব্ধতা ভেঙে কর্কশ গলায় বললে–যতটুকু সময় এই বাতির আগুনে আমি হাতটা রাখতে পারি, ততটুকু সময় আপনার মেয়ের সঙ্গে, আপনি আমায় কথা বলতে দিন। এর বেশি আমি কিছু চাইনে।

হাতটা উলটে নিয়ে সে ধরলে বাতির শিখার ওপর। ঘরের আলো কমে গেল তৎক্ষণাৎ। কালো হয়ে উঠল চামড়াটা। কয়েক মুহূর্ত যেতে না যেতেই চামড়াটা পুড়ে লাল দগদগে মাংস বার হয়ে এল। হাতটা সরাল না ভিনসেন্ট। একটু কাঁপল না পর্যন্ত। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রেভারেন্ডের চোখের দিকে। আরও কাটল কয়েক মুহূর্ত। পোড়া মাংসের উগ্র গন্ধে ঘর ভরে গেল। হাতের চামড়া খসে খসে পড়তে লাগল টেবিলের ওপর। আতঙ্কবিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন ধর্মযাজক। সারা অঙ্গে যেন তাঁর পক্ষাঘাত। নড়তে পারছেন না। ভিনসেন্টের চোখের বজ্রকঠিন দৃষ্টিতে তাঁর সমস্ত চৈতন্য যেন বন্দি হয়ে আছে। পোড়া মাংসগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে, তবু হাতটা কেঁপে উঠছে না এক লহমার জন্যেও। পলকবিহীন চোখ।

হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন রেভারেন্ড স্ট্রিকার। গলায় যত জোর আছে সব জোর সংহত করে চিৎকার করে উঠলেন একবার—তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন টেবিলের ওপর। একঝটকায় দুটো বাতি একসঙ্গে টেবিল থেকে সরিয়ে নিভিয়ে ফেললেন।

নীরন্ধ্র অন্ধকার। টেবিলে ভর করে দুজনে মুখোমুখি। কেউ কাউকে দেখছে না, অথচ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে দু-জোড়া চোখ। আবার আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন ধর্মযাজক—পাগল, পাগল কোথাকার! বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে! শুনে যাও, কে তোমাকে সারা মন দিয়ে ঘৃণা করে। এই আমার শেষ কথা শুনে চলে যাও এখান থেকে, জীবনে আর কখনও ছায়া মাড়িয়ো না এ-বাড়ির!

অন্ধকার পথ বেয়ে ভিনসেন্ট চলতে লাগল। কত অলিগলি পার হয়ে শেষে পৌঁছোল শহরের প্রান্তসীমায়। মরা খালটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নাকে এল বদ্ধ ঘোলাটে জলের ভ্যাপসা গন্ধ। রাস্তার গ্যাসের আলোর একটি পলাতক শিখা এসে পড়েছে ঠিক তার বাঁ-হাতটার ওপর, গভীর লাল ক্ষত সারা তালুর পেছনদিক জুড়ে। উপলব্ধির কোন গোপন শাসনে আগুনে সে বাঁ-হাতটা বাড়িয়েছিল, ডান হাত নয়, যে-হাত দিয়ে সে কাজ করে। কত ছোটো ছোটো শাখা খাল সে পার হল, নাকে আসতে লাগল কোন বিস্ময়সমুদ্রের সুরভি। শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছোল মেন্ডিস ডা কস্টার বাড়ির কাছে। একটা খালের ধারে মাটিতে সে বসে পড়ল। ঢিল একটা ছুঁড়ল খালের মধ্যে। ঢিলটা ডুবে গেল, কিন্তু খালে জল আছে কি না–আছে তার শব্দটুকুও কানে এল না।

ফুরিয়ে গেছে কে তার জীবন থেকে। স্পর্শটুকু তার নিশ্চিহ্ন হয়ে মুছে গেল হৃদয়ের চক্রবাল থেকে।—না না, কখনও না—এই তার অন্তরের কথা, এই সত্য। ব্যর্থ প্রেমের বিদীর্ণ বিশুষ্ক কাণ্ডে এই তিনটি কথা যেন বঞ্চনার রক্তপলাশ। না, না, কখনও না কখনও দেখা পাবে না তার, কখনও শুনবে না তার কণ্ঠ, কখনও মিলবে না তার মৃদুতম স্পর্শ। যন্ত্রণার অগ্নিদাহনে শুধু একখানা হাত নয়, সারাহৃদয়কে পোড়ালেও ফিরে পাবে না মুহূর্তের সার্থক প্রেম।

হৃদয়প্লাবী দুঃখের জোয়ার ভেঙে পড়তে চাইল কণ্ঠের তটে। সশব্দ কান্নাকে রোধ করবার জন্যে পোড়া বাঁ-হাতখানা সে চেপে ধরল মুখের ওপর। হাতে কোনো যন্ত্রণা নেই, ওষ্ঠে শুধু অঙ্গারের স্বাদ, ব্যর্থ বাসনার রিক্ত তিক্ত অঙ্গার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *