নিউনেন

নিউনেন

নিউনেনের ধর্মযাজকের বাড়িটা দোতলা, চুনকাম করা সাদা ধবধবে। পেছন দিকে বিরাট একটা বাগান। তাতে দিঘি আছে, ফুলবাগান আছে, আছে বড়ো বড়ো গাছ নিউনেন-এর জনসংখ্যা ছাব্বিশশোর কম নয়, কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মাত্র শ খানেক। থিয়োডোরাসের গির্জেটিও খুব ছোটো। ইটেনের মতো জমকালো শহর থেকে নিউনেন-এ বদলি হওয়া কিছুটা অবনতিই বলতে হবে।

শহরে পাকা বাড়ির সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ বাসিন্দাই হয় তাঁতি, নাহয় চাষি। পাকারাস্তা থেকে দূরে দূরে মাঠের মাঝে মাঝে তাদের কুটির। অধিবাসীরা কর্মঠ, ধর্মভীরু আর খুবই রক্ষণশীল।

দোতলার একটি ঘরে ভিনসেন্টের স্থান হল। ভোর বেলা পুবদিকের জানলা দিয়ে দেখা যায় গির্জের চুড়োর ও-পারে সূর্যোদয়, চুড়োটির ছায়া দিঘির জলে কাঁপে। সন্ধে বেলা পশ্চিম আকাশের রক্তিমা ঘন তেলরঙের মতো ছড়িয়ে যায় দিঘির ওপর, ক্রমে মিলিয়ে যায় প্রদোষের ধূসরতায়।

মনে মনে ভিনসেন্ট তার বাবা-মাকে ভালোবাসে, বাবা-মাও ভালোবাসেন তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে। ভিনসেন্টের আদরযত্নের অভাব নেই, প্রচুর খায়দায় আর ঘুমোয়, মাঝে মাঝে মাঠে বেরিয়ে বেড়ায়।

দু-সপ্তাহের জন্যে ভিনসেন্ট এখানে এসেছে, জুড়িয়ে এসেছে শরীর-মনের ক্ষত। মনে মনে ইচ্ছে, বেশ কিছুদিন থেকে যায়। ব্রাবান্ট দেশ তার বড়ো আপনার, এ-জায়গার সঙ্গে তার নাড়ির যোগ। এখানকার শস্যক্ষেত্রের শ্যামলিমা এখানকার অরণ্যের নির্জনতা তার অন্তরে বুলিয়ে দেয় শান্তির স্নিগ্ধ প্রলেপ। দীর্ঘ বিড়ম্বিত ভাগ্য এখানকার উদার আকাশের নীচে যেন নিস্তব্ধ স্বস্তিতে পা ছড়িয়ে বসে।

কথা বলতে ইচ্ছে করে না, ভাবনা উড়ে যায় অলস পাখায়, ইচ্ছে করে প্রাপ্তর-প্রান্তে বসে শুধু চোখ মেলে দেখতে আর যা দেখে তা আঁকতে। এই তো সব! কৃষাণের জীবনযাত্রা চিরদিন তাকে টেনেছে। মনে মনে ভাবে, এই হবে তার শিল্পের উপকরণ। অনেক মন-কেমন-করার পর আবার ফিরে এসেছে গ্রামে, পল্লিজীবনে ডুবে যাবে এবার, পল্লির ছবিই শুধু আঁকবে এবার থেকে।

মনে মনে ভিনসেন্টের কেমন একটা ধারণা ছিল যে শেষ পর্যন্ত এই ব্রাবান্টেই সে ফিরে আসবে, এখানেই জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু নিউনেনে বাবার সঙ্গে স্থায়ীভাবে থাকা কি সম্ভব?

খোলাখুলি সে কথা বললে বাবার সঙ্গে।

বাবা বললেন—সত্যিই তোমার ছবির হাত অনেক খুলেছে ভিনসেন্ট। অনেক দূর তুমি এগিয়েছ। খুব খুশি হয়েছি আমি।

ভিনসেন্ট বললে—বেশ, কিন্তু একটা কথা আমি খোলাখুলি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনিও অকপটে জবাব দিন। আপনি সত্যিই কি চান, আপনার এখানে আমি থেকে যাই?

নিশ্চয়!

কতদিনের জন্যে?

যতদিন তোমার খুশি। তুমি তো আমাদেরই ভিনসেন্ট, এ-বাড়ি তো তোমারই!

কিন্তু ধরুন, কখনও যদি আপনার সঙ্গে মতবিরোধ হয়?.

হবে বই কী তা। তবে সে নিয়ে মাতামাতি না করলেই হল। মতবিরোধও শান্ত মনে মেনে নিতে হবে। একে অপরকে সহ্য করে নিতে না পারলে সমাজ সংসার কিছুই তো থাকত না।

কিন্তু আমার তো একটা আলাদা স্টুডিয়ো চাই বাবা। বাড়ির মধ্যেই নিজের জন্যে স্টুডিয়ো বানাই, সে আপনিও পছন্দ করবেন না।

এ-কথাও আমি ভেবে রেখেছি ভিনসেন্ট। বাগানের গায়ের ছোট্ট ঘরটা তুমি নাও। ও-ঘরটা একলা তোমার, কেউ ওখানে যাবে না, বিরক্ত করবে না তোমাকে। চলো, দুজনে দেখে আসি।

বাড়ির পেছনে রান্নাঘর। তার পাশেই ঘরটা। ছোটো ঘর, একটি মাত্র জানলা। দরজা খুললেই বাগান। কাঁচামাটির মেঝে। ঠিক যেন চাষির কুটির।

থিয়োডোরাস বললেন—মেঝেটা কাঠের করে দেব। আর চাও তো জানলাটাও বড়ো করে দিতে পারি।

ভিনসেন্ট বললে—না না, জানলাটা ঠিক আছে, এর বেশি আলো আমার দরকার নেই। মনে করুন এখানকার কোনো চাষির কুটিরে যদি ছবি আঁকতাম। সে ঘরে তো এর চেয়ে বেশি আলো আসত না!

নিউনেনের চারপাশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লোক তারা যারা তাঁত বোনে। কাদামাটি লেপা খড়ে ছাওয়া ছোটো কুটিরে তাদের বাস। সাধারণত প্রতিটি পরিবারের দুটি করে ঘর। একটি ঘর বসবাসের, একটিমাত্র চিলতে জানলা দিয়ে আলো আসে সে-ঘরে। এ ছাড়া দেয়ালে চৌকো কয়েকটা ঘুলঘুলি। এই ঘরেই শোয়া, খাওয়া, রান্না। পাশের ঘরটি আয়তনে আরও ছোটো, ছাদ তার আরও ঢালু। সেই ঘরে তাঁত।

একটানা কাজ করে সপ্তাহে অন্তত ষাট গজ কাপড় একজন বুনতে পারে। পুরুষরা তাঁত চালায়, মাকুতে সাহায্য করে মেয়েরা। ষাট গজ কাপড়ে সাপ্তাহিক লাভ অল্পবিস্তর সাড়ে চার ফ্র্যাঙ্ক। তবে হয়তো প্রতি সপ্তাহেই খদ্দের জোটে না। ভিনসেন্ট দেখল বরিনেজের কয়লাশ্রমিকদের সঙ্গে এই গ্রাম্য তাঁতিদের অনেক তফাত। শান্তিপূর্ণ এদের জীবনযাত্রা, কথাবার্তায় নেই হতাশার কাঠিন্য বা উত্তেজনার উত্তপ্ততা। মেজাজ সর্বদা হাসিখুশি।

এই তাঁতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমতে দেরি হল না ভিনসেন্টের। এরা বড়ো সরল, সামান্য এদের চাহিদা, জীবনযাত্রার যৎকিঞ্চিৎ উপকরণেই এরা খুশি। ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে ভিনসেন্ট তাদের ছবি আঁকে, খুশি মনেই তারা তাকে ডেকে নেয়। ভিনসেন্টও যখন যে-বাড়িতে যায়. শিশুটির জন্যে হয় নিয়ে যায় কয়েকটা মিষ্টি বা বুড়োকর্তার জন্যে কিছুটা তামাক।

সবুজে ব্রাউনে মেশানো রঙের পুরোনো ওক কাঠের একটা তাঁত এক বাড়িতে তার চোখে পড়ল, তাতে খোদাই করে লেখা আছে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ। তাঁতটির ধারে একটি জানলা, তা দিয়ে বাইরের সবুজ একটু মাঠ চোখে পড়ে। জানলাটির ধারেই বাচ্চার একটি চেয়ার। তাতে একটি শিশু বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একমনে চলন্ত মাকুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। জীর্ণ গৃহ, কাদা-নিকোনো মেঝে, কিন্তু ভিনসেন্টের চোখ কেমন একটা শান্তি আর মাধুর্যের রূপ খুঁজে পেল এই পরিবেশে, উতলা হয়ে উঠল মন ছবির পটে রূপটিকে ধরবার জন্যে।

প্রত্যুষে ভিনসেন্ট ঘুম থেকে ওঠে, তাড়াতাড়ি বার হয়ে যায়। সারাদিন সে কাটায় হয় বনে প্রান্তরে, নাহয় কৃষাণ বা তাঁতিদের ঘরে ঘরে। ওদের সঙ্গেই সে মিশতে পারে সবচেয়ে ভালো। তার সমস্ত শিল্পদৃষ্টি ওদের দৈনন্দিন জীবনের ছোটো বড়ো আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।

ড্রয়িংয়ের প্রতি তার আগ্রহ আগের মতোই আছে, সঙ্গে যোগ দিয়েছে রঙের মোহ। পাকা শস্যভরা খেতের রং হলুদ ব্রোঞ্জ আর সোনালির বিচিত্র সংমিশ্রণ, সেই বর্ণতরঙ্গের পেছনে অনন্ত আকাশের নিস্তরঙ্গ নীলিমার কী চমক, কী যাহার! মাঝে মাঝে শ্রমিকবধূদের আনাগোনা। ভারী কর্মঠ দেহ, রৌদ্রে পোড়া মেঠো লাল রং তাদের অঙ্গের, পরনে ধূলিমলিন ফিকে নীল পোশাক, বাদামি চুলের রাশ কালো টুপির নীচে ঢাকা।

শহরের লোক কিন্তু বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায়। পিঠে ইজেল বেঁধে হাতে ভিজে ক্যানভাস ঝুলিয়ে সে যখন দিনান্তে বড়ো রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে, শহরের মেয়েরা জানলার ফাঁক দিয়ে সন্দিগ্ধ চোখে তার দিকে তাকায়। বাড়িতেও সকলের সঙ্গে সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়। বোন এলিজাবেথ তাকে ঘৃণা করে, ঘরে এমনি অসভ্য বুনো ভাই থাকতে পাছে ভালো পাত্রে বিয়ের সম্ভাবনা তার ফসকে যায়, এই আশঙ্কা। উইলেমিন তার ওপর বিরূপ না থাকলেও আসলে তাকে পৌঁছেই না। ছোটোভাই কর-এর সঙ্গেও কোনো ঘনিষ্ঠতা জমেনি।

ভিনসেন্ট বাড়ির সকলের সঙ্গেই খায়, তবে এক টেবিলে নয়। ঘরের এক কোণে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে, কোলের ওপর প্লেটটা ধরে কোনো রকমে খাওয়াটা শেষ করে। পাছে অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়, তাই সে শুকনো রুটিই চিবোয়। বাকি যেটুকু সময় সে ঘরে বসে, নিবিষ্ট দৃষ্টিতে নিজের হাতের কাজ পরীক্ষা করে দেখে। সাধারণত কারুর সঙ্গেই সে কথা বলে না, ভাই-বোনেবাও তাকে এড়িয়ে চললেই স্বস্তি বোধ করে। অপব্যয়ী সন্তান ঘরে ফিরে এসেছে, তবু তার একাকিত্ব ঘোচেনি।

প্রায় এক মাস হল ভিনসেন্ট রোজ মাঠে গিয়ে ছবি আঁকছে—এমনি সময় হঠাৎ ক-দিন ধরে তার মনে হতে লাগল কে যেন লুকিয়ে তার ওপর নজর রাখছে। নিউনেনের অধিবাসীরা বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায়, মাঠের কৃষাণরা মাঝে মাঝে পাশে দাঁড়িয়ে অপলক চোখে তার ছবি আঁকা দেখে, কিন্তু এ-নজর যেন অন্যরকম। ধারণা হল, গোপনে কেউ যেন তাকে অনুসরণ করে চলেছে। প্ৰথম ক-দিন সে ধারণাটাকে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল মন থেকে। কিন্তু ঠিক পেছন দিকে জেগে রয়েছে অধরা দুটি অপলক চোখ, এ-অনুভূতি বড়ো অস্বস্তিকর, দুরদুর করলেও তাকে মন থেকে দূর করে দেওয়া অসম্ভব।

অনেক বার সে ঘুরে ঘুরে সারা মাঠটা দেখেছে, চোখে পড়েনি কিছু। রাস্তায় একবার হঠাৎ পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে মনে হয়েছে, দূরে ছাদের আড়ালে মেয়েলি একটি সাদা ঘাঘরা যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আর-একদিন একটি তাঁতির ঘর থেকে বার হয়েই মনে হল রাস্তার বাঁকে একটি ত্রস্ত মূর্তি যেন সরে গেল। তৃতীয় দিন বনের মধ্যে ছবি আঁকছিল, মাঝে তেষ্টা পাওয়ায় ইজেলে ক্যানভাসটি রেখে অদূরে একটি পুকুরে জল খেতে সে গেল। ফিরে এসে দেখে নিজের রঙের ওপর কার আঙুলের ছাপ।

প্রায় দু-সপ্তাহের চেষ্টার পর মেয়েটিকে সে ধরল। ফাঁকা মাঠে লোকেরা মাটি খুঁড়ছিল, ভিনসেন্ট স্কেচ করছিল তাদের। একটু দূরে ভাঙা একটা গাড়ি। মেয়েটি ওই গাড়ির পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখছিল তার ওপর। হঠাৎ ইজেল ক্যানভাস তুলে ভিনসেন্ট হনহন করে চলতে শুরু করল বাড়ির দিকে। মেয়েটিও ছুটতে লাগল সামনে। সে যে এখন মেয়েটিকে অনুসরণ করছে এমনি সন্দেহ যাতে মেয়েটির না হয়, এমনিভাবে সে পেছনে পেছনে চলল। মেয়েটি ঢুকে পড়ল ঠিক তাদের পাশের বাড়ির দরজা দিয়ে।

রাত্রে ভিনসেন্ট আনা কর্নেলিয়াকে জিজ্ঞাসা করল—আমাদের ও-পাশের বাড়িটাতে কারা থাকে মা?

বিজম্যান পরিবার।

কারা ওরা?

ওদের কর্তা বেঁচে নেই, বিধবা মা আর তার পাঁচ মেয়ে। এর বেশি কিছু জানিনে। বড়ো কুনো ওরা, বিশেষ মেশে না কারও সঙ্গে।

ক্যাথলিক?

না, প্রোটেস্টান্ট।

মেয়েদের বিয়ে হয়েছে?

কোথায়! সব কটাই আইবুড়ো। কেন, ওদের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন রে?

না, এমনি মনে হল। সংসার চলে কী করে?

কেউ তো কিছু করে না। লোকে বলে অনেক পয়সা বুড়ো রেখে গেছে।

কোনো মেয়ের নাম তুমি জান মা?

আশ্চর্য চোখে আনা কর্নেলিয়া একবার তাকালেন ছেলের দিকে। বললেন–না, তা তো জানিনে।

পরের দিন ঠিক আগের জায়গাতে গিয়েই ইজেল পাতল ভিনসেন্ট। এতদিনে স্কেচটা প্রায় শেষ হয়েছিল, আজ সে রং চড়াল ক্যানভাসে। নিবিষ্ট মনে কতক্ষণ কাজ করেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ মনে হল মেয়েটি বুঝি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ মুখ ফেরাতেই ভাঙা গাড়ির পেছনে চোখে পড়ল তার পোশাকের একটু আভাস।

কী যন্ত্রণা! মনে মনে বললে–ছবি শেষ না হয় না হোক, ওকে আজ আমি ধরবই।

ইজেল সামনে নিয়ে কাজ না করে ভিনসেন্ট পারে না, আস্তে আস্তে রং বোলানোও তার পক্ষে অসম্ভব। যখন সে কাজ করে তখন সবকিছু ভুলে যায়, হাত চলে নক্ষত্রবেগে। দৃশ্য সে আঁকে না, চোখে দেখার পেছনে মনের যে-অনুভূতিটা রয়ে যায়, তাকেই সে বাঁধতে চায় রঙে আর রেখায়। তার শিল্পকর্ম অদম্য আবেগে ছুটে চলে ওই অধরা অনুভূতিটিকে বাঁধবার বাসনায়।

ভুলে গেল সে মেয়েটিকে। ঘণ্টা খানেক পরে পেছনে ফিরে দেখে মেয়েটি গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবল, একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে ছুটে গিয়ে ওকে ধরবে, কৈফিয়ত চাইবে এমনি ব্যবহারের। কিন্তু ছবির টানে ওঠা হল না। আবার কিছুক্ষণ পরে পেছন ফিরে দেখে, মেয়েটি আরও রু-পা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেন, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তারই দিকে।

সৃজনপ্রেরণার দুরন্ত আবেগে সে কাজ করতে লাগল। অবসর নেই ছবি ছেড়ে ওঠার। আবেগ তার যত বাড়ে, মেয়েটিও ততই এগিয়ে আসে। যত উন্মাদনায় ক্যানভাসে রঙের ওপর রং চড়ে, ততই যেন পশ্চাদ্ববর্তিনীর দৃষ্টির উত্তাপ বাড়তে থাকে। আবার একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল, মেয়েটি প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। আর স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে নেই, কীসের সম্মোহনে যেন নিশি-পাওয়ার মতো এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। নিজেকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু পারে না, পারে না পদক্ষেপকে শাসন করতে, এমনই অমোঘ আকর্ষণ।

এসে দাঁড়াল ঠিক তার পেছনে, একেবারে পিঠের কাছে। ভিনসেন্ট ঘুরে তাকাতেই চোখাচোখি হল দুজনের। ত্রস্ত হরিণীর মতো দৃষ্টি মেয়েটির চোখে, যেন কোন বিভ্রান্ত বাসনায় সে দিশেহারা। চোখ থেকে সরিয়ে মেয়েটি তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। ভিনসেন্ট একটু অপেক্ষা করল, কিন্তু কথা নেই মুখে মেয়েটির, শুধু নির্বাক এক নিবিষ্ট দৃষ্টি। ভিনসেন্ট আবার •মুখ ফিরিয়ে রং নিল তুলিতে। ছবিটা যখন শেষ হল তখনও তেমনি পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। আরও একটু ঘেঁষে এসেছে বুঝি, তার বসনপ্রান্তের স্পর্শ যেন লাগছে ভিনসেন্টের গায়ে।

গড়িয়ে এসেছে বিকেল। সারাদিনের কাজের পর ক্লান্ত ভিনসেন্ট, তবু সৃষ্টির খুশিতে উত্তেজিত। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে সে ফিরল।

সারাদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। শুকিয়ে গেছে মুখ, ডান হাতটি গলার কাছে, নিশ্বাস যেন নিতে পারছে না, কম্পিত ওষ্ঠে ভাষাহারা ব্যাকুলতা।

ভিনসেন্ট বললে—আমার নাম ভিনসেন্ট ভ্যান গক, তোমাদের বাড়ির পাশেই থাকি। জান বোধ হয়?

শোনাই যাচ্ছে না এমনি ফিসফিস উত্তরে মেয়েটি বললে—হ্যাঁ।

ভিনসেন্ট’ বললে—তোমরা তো বিজম্যান। বোনদের মধ্যে কোনটি তুমি?

দুলে উঠল মেয়েটির দেহ, ভিনসেন্টের হাত ধরে চকিতে নিজেকে সামলে নিল সে। জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে নিল একবার, তারপর অনেক চেষ্টায় যেন বললে—আমার নাম মার্গট।

বেশ। তা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমাকে মার্গট বিজম্যান, তুমি এমনি করে আমার পেছনে পেছনে ঘুরছ কেন বলো তো? ভেবেছিলে আমি বুঝি বুঝতে পারিনি? দু-সপ্তাহের ওপর ধরে আমি দেখছি তোমার এই কাণ্ড।

অব্যক্ত একটা আর্তনাদ বার হয়ে এল মেয়েটির মুখ থেকে, নিজেকে সামলাবার চেষ্টায় ভিনসেন্টের হাতটা চেপে ধরল সে। তারপর মূর্ছিত হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাঠের মধ্যে।

ভিনসেন্ট হাঁটু গেড়ে বসে বাঁ বাহুর ওপর মেয়েটির মাথা রাখল, কপাল থেকে সরিয়ে দিল বিস্রস্ত চুল। সারা মাঠ জুড়ে সূর্যাস্তের সোনালি, কৃষাণেরা ঘরমুখো। কেউ নেই চারিদিকে। ভিনসেন্ট ভালো করে মেয়েটিকে দেখল। সুন্দরী নয়, ত্রিশের কম নয় বয়স, দু-একটি স্পষ্ট রেখা মুখে। চোখের কোণে বিষণ্ণ কালিমা। নিষ্প্রভ গায়ের রং।

সঙ্গে জল ছিল। অঞ্জলি ভরে ছিটিয়ে দিল চোখে-মুখে, রং মোছবার ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিল কপাল। চোখ খুলল মেয়েটি। ভিনসেন্ট দেখল, বড়ো বড়ো ব্রাউন রঙের সুন্দর দুটি চোখ, ছায়া ছায়া পল্লব, কেমন যেন কোমল অলৌকিক দৃষ্টি। হাতের তালু ভিজিয়ে নিয়ে আর-একবার সে ওর মুখে হাতটা বুলিয়ে দিল। থরথর করে কেঁপে উঠল বাহুবন্দিনি।

ভিনসেন্ট জিজ্ঞেস করলে—একটু ভালো লাগছে মার্গট?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল মার্গট, ভিনসেন্টের চোখে চোখ রেখে। তারপর তার সমস্ত অন্তর মথিত করে বেরিয়ে এল একটা করুণ কান্না, দু-হাতে ভিনসেন্টের গলা জড়িয়ে তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ দুটি চেপে ধরল তার মুখে।

পরদিন গ্রাম থেকে দূরে পূর্বনির্দিষ্ট একটা জায়গায় দুজনের দেখা হল। মার্গটের পরনে একটি ধবধবে সাদা কেমব্রিক পোশাক, হাতে একটি রৌদ্র এড়ানোর বড়ো টুপি। এখনও ভীরু কম্পিত তার বুক, তবে কালকের চাইতে অনেকটা সংযত।

ভিনসেন্ট ইজেল পেতে বসেছিল, মার্গটকে দেখে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল। কে-র রূপের এক কণাও মার্গটের নেই, তবে ক্রিস্টিনের তুলনায় তাকে সুন্দরী বলতে হবে বই কী। ভিনসেন্ট কীভাবে তাকে সম্ভাষণ করবে স্থির করে উঠতে পারল না।

মার্গট সামনে এসে সোজাসুজি চুম্বন করল ভিনসেন্টকে, তাকে দু-হাতে জড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত টেনে রাখল বুকের কাছে, যেন কতদিনের একান্ত আপনার প্রিয়জন। ভিনসেন্ট মাটিতে তার কোটটা পেতে মার্গটকে বসাল। পাশে টুলের ওপর বসল নিজে। মার্গট কাছে ঘেঁষে বসে দু-হাঁটু জড়িয়ে ধরল। মুখ তুলে চেয়ে রইল তার দিকে। সে-চাওয়ায় চরম আত্মনিবেদনের অব্যক্ত ভাষা। এই দৃষ্টির সঙ্গে ভিনসেন্টের জীবনে প্রথম পরিচয়।

কথা এখানে অর্থহীন, তবু নামটি ধরে ডাকতে বড়ো ভালো লাগে। মার্গট ডাকল—ভিনসেন্ট!

কী করবে কী বলবে কিছুই ভেবে উঠতে পারে না ভিনসেন্ট। শুধু বললে–কী মাৰ্গট?

কাল বাড়ি ফিরে তুমি আমাকে খুব খারাপ ভেবেছিলে?

কেন? খারাপ ভাবব কেন?

বিশ্বাস করো ভিনসেন্ট, কাল আমি যে তোমাকে চুমু খেয়েছি, তার আগে আর কোনো পুরুষকে চুমু খাইনি।

সে কি! কাউকে কখনও ভালোবাসনি তুমি?

না।

এ তো বড়ো দুঃখের কথা মার্গট!

একটুখানি চুপ করে থেকে মার্গট বললে—ঠিকই বলেছ। আচ্ছা, তুমি ভালোবেসেছ?

বেসেছি মাৰ্গট।

অনেক মেয়েকে?

না, তিনজনকে মাত্র।

তারাও ভালোবেসেছিল তোমাকে?

না মার্গট, তারা বাসেনি।

সে কি? সে আবার হয় নাকি?

সত্যি মার্গট, ভালোবাসার ভাগ্যটাই আমার খারাপ।

মার্গট আরও নিবিড় হয়ে এল কাছে। একটি হাত তার কোলে রেখে অপর হাতটি বুলিয়ে দিতে লাগল ভিনসেন্টের মুখে। পুষ্ট দুটি খোলা ঠোঁট, খাঁড়ার মতো নাক, ভরাট চিবুক, চওড়া কপাল সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে লাগল তার আঙুল। বলতে লাগল অস্ফুট স্বরে—কী জোর তোমার, কত শক্তি! তোমার মতো পুরুষ জীবনে আমি আর দেখিনি!

ভিনসেন্ট দু-হাতের মাঝখানে ভরে নিল মার্গটের মুখ। প্রেমের উত্তাপে নতুন অনুভূতির উত্তেজনায় সে মুখের পাণ্ডুরতায় নতুন আভা।

ত্রস্ত গলায় মার্গট শুধোল—আমাকে কি একটুও ভালো লাগে না ভিনসেন্ট?

লাগে বই কী মার্গট।

তাহলে একবার একটি চুমু খাও!

চুম্বন করল ভিনসেন্ট।

আমাকে তুমি খারাপ ভেবো না ভিনসেন্ট। নিজেকে শত চেষ্টাতেও ধরে রাখতে পারলাম না। মনে মনে এত ভালোবেসেছি তোমাকে, সে মনকে কত বেঁধে রাখি বলো! কতদিন আর দূরে সরে থাকব!

ভালোবেসেছ? সত্যি তুমি ভালোবেসেছ আমাকে? কিন্তু কেন বলো তো? হাঁটুতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে মার্গট চুমু খেল ভিনসেন্টের ঠোটের কোলে। বললে–এই জন্যে।

দুজনে বসে রইল চুপ করে। কিছু দূরে গ্রাম্য সমাধিক্ষেত্র। কৃষাণের জীবনের মতো তার মৃত্যুও ভিনসেন্টকে টানে। যে-মাঠটি তারা চষে, সেই মাটির নীচেই কাজকর্ম সেরে তারা বিশ্রাম নেয়। এই চলেছে যুগ যুগ ধরে। মাটি থেকে গাছ ওঠে, শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতেই। ভিনসেন্ট ভাবছে ছবির বুকে এই সহজ সরল মৃত্যুটির স্বরূপ কেমন করে দেবে, শরৎ-শেষের নিশ্চুপ পাতা-ঝরার মতো যে মৃত্যু!

মৃদু গলায় মার্গট বললে—আমার কথা কী তুমি জান ভিনসেন্ট?

কিছুই না বলতে গেলে!

মানে, ওরা, ওরা আমার কথা কিছু তোমাকে বলেনি? ধরো, আমার বয়েস–

না, কেউ না।

শোনো তবে, বয়েস আমার উনচল্লিশ। আর ক-মাস পরেই চল্লিশে পড়ব। গত পাঁচ বছর ধরে আমি মনে মনে বলে আসছি, চল্লিশে পড়বার আগে একবার আমি ঠিক বাসব, বাসব, ভালোবাসব, নইলে আত্মহত্যা করব।

কিন্তু ভালোবাসা তো শক্ত নয় মার্গট!

তা-ই বুঝি তোমার ধারণা?

নিশ্চয়ই। ভালোবাসাটি ফিরিয়ে পাওয়াই শক্ত।

না। এখানে, এই নিউনেনে, ভালোবাসাও সোজা নয়। গত কুড়ি বছর ধরে আমি প্রাণপণ কামনা করেছি কাউকে ভালোবাসব। পারিনি তো!

কখনও না?

মুখ ঘুরিয়ে নিল মার্গট। কত দূর থেকে যেন বললে—হ্যাঁ, একবার। তখন বয়স আমার অল্প, বড়ো ভালো লেগেছিল একটি ছেলেকে!

ভিনসেন্ট মার্গটের হাতটি স্পর্শ করে বললে—কী হল?

সে ক্যাথলিক ছিল। তাই ওরা তাকে তাড়িয়ে দিল।

ওরা কারা?

আমার মা আর আমার বোনেরা।

মাঠের নরম মাটিতে হাঁটু গেড়ে মার্গট বসল। নোংরা হয়ে যাচ্ছে সুন্দর সাদা পোশাকটা। ঊরুর ওপর কনুই দুটো রেখে দু-হাতে মুখ ঢাকল।

ভালোবাসাতেই যদি না ভরে, তাহলে মেয়ের জীবন শূন্যই থেকে যায় ভিনসেন্ট।

জানি।

রোজ ভোরে যখন ঘুম ভাঙত, মনে মনে বলতাম, আজ নিশ্চয়ই আমার প্রেমিক আসবে। সব মেয়েরই আসে, আমার কেন আসবে না? দিন কেটে যেত, দিনের পর ব্যর্থ দিন, সারারাত্রি-ভরা দুঃস্বপ্ন আর হতাশা। এমনি কেটে চলেছে পায়ে পায়ে নিষ্ফলা সময়, দাম না-পাওয়া বছরের পর বছর রিক্ত জীবনের। শেষ পর্যন্ত তুমি এলে ভিনসেন্ট, তোমাকে পেলাম। সব বঞ্চনা ঘুচল, মিলল আমার ভালোবাসার সেই চির-চাওয়া মানুষটি।

কথা নয়, যেন জয় ঘোষণা। বাসনা নয়, যেন চরম অধিকার। রুভুক্ষু দুই হাত দিয়ে বেঁধে রাখল ভিনসেন্টকে, ভরিয়ে দিল তার মুখ তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠের সহস্র চুম্বনে স্তব্ধ হয়ে তার ছবি আঁকার টুলটির ওপর বসে রইল ভিনসেন্ট, পাশে মাটিতে পড়ে রইল রংমাখা প্যালেট আর তুলি। শূন্য প্রান্তর, অদূরে মৃত মানুষের সমাধি, কোলের মাঝে প্রেমাস্পদা নারী, জীবনের সমস্ত নিরুদ্ধ কামনাকে যে একটিমাত্র পরম অঞ্জলিতে নিঃশেষ করে ঢেলে দিয়েছে তার পায়ে। ভিনসেন্টের মনে হল—দুঃখ নেই, ব্যর্থতা নেই, পূর্ণ হয়েছে তার জীবনপাত্র। ধন্য এই মুহূর্ত, ধন্য এই মাটি, যেখানে বসে সর্বসমর্পিত প্রেমে অভিষিক্ত হল তার ভাগ্য। বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল তারও।

তার হাঁটুতে মাথা হেলিয়ে তার দুই পায়ের ফাঁকে শরীর এলিয়ে বসে রইল মার্গট। চোখে ওর আলো, গালে ওর আরক্ত আভা। ফুলে ফুলে উঠছে বুক দুটি, যেন কত কষ্ট করে নিশ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রথম প্রেমের গৌরবে যেন যৌবনের নব-উজ্জীবন ওর অঙ্গে অঙ্গে। দেখে কে বলবে বয়স ওর ত্রিশের বেশি! ভিনসেন্ট আস্তে আস্তে ওর মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, যতক্ষণ না ও তার হাতটি ধরে উত্তপ্ত গালের ওপর চেপে রাখল।

একটু পরে কথা শুরু করল আস্তে আস্তে।

আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাস না। তুমি আমাকে ভালোবাসলে সে হতো দুরাকাঙ্ক্ষা, তা নিয়ে দুঃখ নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম, ভালো যেন কাউকে বাসতে পারি নিজে। বিনিময়ে কারুর ভালোবাসা যে পাব সে আশা করিনি কখনও। ভালোবাসাটাই বড়োকথা, তা-ই না ভিনসেন্ট? ভালোবাসা ফিরে পাওয়া নয়।

ভিনসেন্টের মনে পড়ল উরসুলার কথা, কে-র কথা। বললে—ঠিক বলেছ।

ভিনসেন্টের হাঁটুতে মুখ ঘষতে ঘষতে মার্গট বললে—বলো, রোজ এমনি তোমার সঙ্গে আমাকে আসতে দেবে! একটি কথা বলব না, একটুও বিরক্ত করব না, শুধু চুপ করে তোমার কাছে বসে থাকব!

নিশ্চয় মার্গট, রোজ আসবে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। নিউনেনে যদি কোনো সাথি পাওনি, অন্য কোথাও চলে যাওনি কেন? টাকা ছিল না?

টাকার অভাব আমার নেই। ঠাকুরদার কাছ থেকে অনেক টাকা আমি পেয়েছি।

হেগ-এ তবে যেতে পারতে, আমস্টার্ডামে যেতে পারতে, সেসব জায়গায় কত নতুন নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারতে।

ওরা পথ আগলে রেখেছে আমায় সারাজীবন।

তোমাদের পাঁচ বোনের কারুরই বিয়ে হয়নি?

না লক্ষ্মীটি, কারুর না।

হঠাৎ কেমন একটা বেদনার আঘাত লাগল ভিনসেন্টের বুকে সম্বোধনটা শুনে। এমনি সম্বোধনে কোনো মেয়ে তাকে ডাকেনি কোনোদিন। ব্যর্থ ভালোবাসার বেদনার সঙ্গে তার গভীর পরিচয়, কোনো নারীর এমনি একান্ত ভালোবাসা পাওয়া তার নতুন। এতক্ষণ মার্গটের আত্মনিবেদনের উচ্ছ্বাসকে অনেকটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে সে যেন দেখছিল। এখন ওই একটি আদরের কথায় তার মনটা যেন বদলে গেল। দু-হাতে সে মার্গটের কম্পিত দেহটি বুকের কাছে টেনে নিল।

ভিনসেন্ট, ভিনসেন্ট! মার্গট বলল চুপিচুপি কানে কানে—ভালোবাসি, কত ভালোবাসি তোমাকে!

আমাকে ভালোবাস, এ-কথা যখন বল, আশ্চর্য লাগে শুনতে।

মার্গট বললে—জীবনের এতগুলো বছর কেটেছে চাওয়ায় আর না-পাওয়ায়। দুঃখ নেই তাতে। সার্থক হয়েছে আমার প্রতীক্ষা। ভালোবাসার যত স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে পাবার, তোমাকে সত্যি করে ভালোবাসার তুলনায় সেসব স্বপ্ন কিছু না।

আমিও তোমাকে ভালোবাসি মার্গট।

বোলো না, বোলো না ও-কথা। মন ভোলানোর কথায় কী দরকার আমার বলো? আশা আছে একদিন-না-একদিন একটু ভালো হয়তো লাগবে তোমার আমাকে। সেটুকুই হবে যথেষ্ট। তার আগে আমাকে শুধু ভালোবাসতে দাও।

আগের মতোই ছবি আঁকতে বাইরে বার হয় ভিনসেন্ট, মার্গট প্রায় প্রতিদিনই তার সঙ্গে থাকে। পছন্দমতো দৃশ্যটির সন্ধানে মাইলের পর মাইল ভিনসেন্ট হাঁটে। গরমে ক্লান্তিতে মার্গটের শরীর ভেঙে পড়তে চায়, তবু আপত্তি নেই। তার দেহে লেগেছে নতুন জোয়ার, দীপ্তিহীন শুষ্ক কেশে লেগেছে সোনালি আভা, শীর্ণ বিবর্ণ ওষ্ঠে রক্তিম পূর্ণতা। গায়ের চামড়া ছিল ফাটা ফাটা খসখসে, ক-দিনের মধ্যেই এসেছে তাতে লালিত্য আর মসৃণতা। চোখে নতুন আলো, দুটি বুকে পুরম্ভ চন্দ্রকলা। উচ্ছল কণ্ঠস্বর, পদক্ষেপে বিজয়িনীর গর্ব। প্রেম এসে ওর অন্তরের কোন সুপ্ত ফল্গুধারাকে যেন মোচিত করেছে, সেই অমৃতধারায় ওর নিত্য নব স্নান।

ভিনসেন্টকে খুশি করার জন্যে বাস্কেটে করে নতুন নতুন খাবার বানিয়ে নিয়ে আসে। যখন ভিনসেন্টের কাছে চুপটি করে বসে থাকে, সৃষ্টির আবেগে ভিনসেন্ট রঙের ওপর রং চড়ায়, সেই রঙে রাঙিয়ে ওঠে ওর মন।

ছবির বিষয়ে মার্গটের কোনো জ্ঞান নেই, কিন্তু ওর মার্জিত বুদ্ধি আছে, আর আছে স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি। ঠিক কথাটি ঠিক জায়গাতে ও বলতে পারে, না জেনেও অনেকটা ও বোঝে। ভিনসেন্টের মনে হয়; ও যেন একটি চমৎকার বীণা, অক্ষমের হাতে পড়ে মরচে ধরে গেছে যার তারে তারে।

মনে মনে বলে—আহা, দশটা বছর আগে যদি ও আসত!

একদিন ইজেলের সাদা ক্যানভাসে তুলির প্রথম আঁকটি যখন দেবে ঠিক করেছে, এমনি সময়ে মার্গট শুধোল—আচ্ছা, চোখের সামনের যে-দৃশ্যটিকে তুমি পছন্দ করে নাও, ছবিতে সেই দৃশ্যটি যে ঠিক আসবে তা তুমি বুঝতে পার কী করে?

মুহূর্ত কয়েক ভাবল ভিনসেন্ট। তারপর বললে—সব সময় যে ঠিক হয় তা নয়। কখনও ভুল দৃশ্য নির্বাচন করি, কখনও-বা হার মানি ছবি আঁকায়। তবু তো থামলে চলবে না, সাদা ক্যানভাস চোখের সামনে ধরলেই আমার পাগলামি আসে, মনে হয় যত তাড়াতাড়ি পারি রং দিয়ে ভরে তুলতেই হবে।

তা তুমি পার। তোমার ছবির মতো তাড়াতাড়ি ঘাসও গজায় না।

কী করি বলো! সাদা ক্যানভাস যেন আমাকে দুয়ো দেয়, বলে, রোকা, কিচ্ছু জানে না! আমি মনে মনে বলি, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি। জীবনটা তো, মাৰ্গট, ‘ঠিক এই সাদা ক্যানভাসের মতো। সর্বদা তার আশাহারা দুঃখভরা শূন্য হতাশায় মুখটা মানুষের দিকে ফেরানো। কিন্তু যে-মানুষের নিষ্ঠা আছে, সে ওই শ্বেত শূন্যতা দেখে ভয় পায় না। চুপ করে বসে থাকে না সে। সে কাজ করে, গড়ে তোলে, সৃষ্টি করে, মুহূর্তের অপব্যয় সে করে না। এরই ফলে জীবন তার আর শূন্য সাদা পাতা থাকে না, জীবন চিত্র হয়ে ওঠে।

মার্গটের এই বিহ্বল প্রেম চমৎকার লাগে ভিনসেন্টের। এ-প্রেম বিচার করে না, বিশ্লেষণ করে না, আত্মদানে আপন আনন্দে বিভোর হয়ে থাকে। কর্কশ রেখাবহুল ভিনসেন্টের মুখ, রুক্ষ তার গলার স্বর, অমার্জিত আচার-ব্যবহার, মার্গটের তা চোখে পড়ে না। সে যে খালি ছবি আঁকে, পুরুষ হয়ে একটি পয়সা উপার্জন করে না, এ নিয়ে ওর বলার নেই কিছু। দিনশেষে নির্জন সায়াহ্নে দুজনে যখন বাড়ি ফেরে, মার্গটের কোমরে হাত জড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে কত কথা বলে ভিনসেন্ট। প্রাণ খুলে বলে যায়—কেন সে কাজকর্ম আর লৌকিক সফলতার পাকা রাস্তা ছেড়ে নেমে এসেছে শিল্পকর্মের ধূসর পথে, কেন তার শিল্পীচোখে রাজার চেয়ে চাষিকে ভালো লাগে, বিলাসিনী নাগরিকাকে এড়িয়ে তালি-দেওয়া ঘাঘরা-পরা গ্রামকন্যার রূপে মন মজে। মার্গটের কোনো চাহিদা নেই, প্রশ্ন নেই ভিনসেন্ট যেমন ঠিক তেমন ভিনসেন্টেই তার মন আছে।

তবু ভিনসেন্টের অন্তরে অন্তরে অস্বস্তি। রোজ সে ভাবে, এবার ভুল ভাঙবে মার্গটের, নেশা কাটবে ক্ষণবসন্তের, ওর স্বচ্ছ চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠবে তার নিতান্ত অকিঞ্চিৎকরতা। কিন্তু তা হয় না। গ্রীষ্মের উত্তাপের সঙ্গে সঙ্গে উত্তাপ বাড়ে ওর রক্তের। প্রকৃতি অর্ঘ্য সাজায় ফুলে ফুলে, ও দেয় ভিনসেন্টের হাতে তুলে ওর পরিপূর্ণ নারীত্বের অকৃপণ অকুণ্ঠিত অঞ্জলি।

ভিনসেন্ট মনে মনে কুণ্ঠিত হয়। ভাঙুক, ভাঙুক ওর মোহ। তাই নিজের দীনতাকে ও ঘোষণার সঙ্গে প্রকাশ করে ওর কাছে, সম্ভাবনাবিহীন নিজের জীবনচরিত্রকে কালো করে তুলে ধরতে চেষ্টা করে ওর সামনে।

আমস্টার্ডামে আর বরিনেজে তার যা হয়েছিল মার্গটকে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনায়। বলে—জান মার্গট, কীভাবে নষ্ট করেছি নিজেকে! কত আশা ছিল বড়ো হবার সফল হবার, সব খুইয়েছি নিজের ভুলে।

মার্গট শুধু মৃদু হাসে, বলে—রাজা তুমি আমার, রাজা কি কখনও ভুল করে?

এরপরে মার্গটকে চুমু খেয়ে কী না করার আছে? এই চুম্বনেই হার স্বীকার।

আর-একদিন মার্গট বলে—জান, মা বলেছে তুমি নাকি খারাপ লোক। তুমি নাকি হেগ-এ নোংরা মেয়েমানুষদের সঙ্গে থাকতে। আমি কিন্তু খুব ঝগড়া করেছি মার সঙ্গে এ নিয়ে।

ভিনসেন্ট ওকে ক্রিস্টিনের কাহিনি শোনাল, গোপন করল না কিছুই। শুনতে শুনতে মার্গটের দৃষ্টিতে অপরূপ এক করুণ বিষণ্ণ ছায়া নেমে এল।

সবশেষে বললে—আমার কী মনে হয় জান ভিনসেন্ট? খ্রিস্টের সঙ্গে তোমার কোথায় যেন মিল আছে। সবাই তা বুঝবে না, আমার বাবা বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয় বুঝতেন।

ভিনসেন্ট বললে—একটা ঘৃণিত বেশ্যার সঙ্গে দু-বছর আমি কাটিয়েছি। সব শুনে এ ছাড়া আর-কিছু বলতে পারলে না!

ও বেশ্যা ছিল না ভিনসেন্ট, ও সত্যিই ছিল তোমার স্ত্রী। ওকে যে তুমি কিছুতেই তুলে নিতে পারলে না শেষ পর্যন্ত, সে কি তোমার দোষ? বরিনেজের কয়লাশ্রমিকদের যে ভাগ্যের হাঁ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারনি, সে-অপরাধ কি তোমার? এই সভ্যতার সর্বগ্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একলা একটা মানুষ কতটুকু করতে পারে?

ঠিক বলেছ মার্গট। ক্রিস্টিন আমার স্ত্রীই ছিল। আর-কিছু তাকে ভাবিনি। মনে পড়ে, ছেলেবেলায় ছোটোভাই থিয়োকে একবার বলেছিলাম—বউ আমার চাই, ভালো বউ না পাই, খারাপ বউই আমার ভালো।

কেমন একটু আড়ষ্ট স্তব্ধতা। বিয়ের প্রসঙ্গ তাদের কথাবার্তায় কোনোদিন, ওঠেনি। তারপর মার্গট বললে—তোমার আর ক্রিস্টিনের ব্যাপারে একটিমাত্র দুঃখ আমার মনে জাগল। পুরো দুটি বছরের এত কষ্টের তোমার ভালোবাসা, এ যদি আমি পেতাম!

মার্গটের ভালোবাসাকে স্বীকার করে নিল ভিনসেন্ট, নিতে বাধ্য হল। বললে—যখন আমার বয়েস অল্প ছিল মার্গট, মনে হতো জীবনে অনেককিছু বুঝি হঠাৎ–হঠাৎই ঘটে যায়, আকস্মিক, অকারণ। বয়েস বেড়েছে, মনে হচ্ছে আকস্মিকের পেছনে আসলে আছে গভীর কোনো রহস্য। অধিকাংশ মানুষই অন্ধকারে আলো খুঁজে খুঁজে ফেরে। দৈবের লীলা যখন তাকে স্পর্শ করে, তখনই রশ্মি ফুটে ওঠে তার চোখে।

ঠিক, আমি যেমন অন্ধকারে এতদিন খুঁজে খুঁজে মরেছি তোমাকে।

ভিনসেন্ট নিঃশব্দে মার্গটের ডান হাতটি ভরে নিল তার দুই হাতে।

শরৎকাল গেল, এল পাতা-ঝরার দিন। সারা নিউনেনে মার্গট আর ভিনসেন্টকে নিয়ে কানাকানি। পড়শিরা সবাই মার্গটকে স্নেহ করে, অবিশ্বাস করে ভিনসেন্টকে, ভয় পায়। ওদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতে চেষ্টা করল মার্গটের মা-বোন, মাৰ্গট তাদের প্রবোধ দিল এই বলে য়ে শুধু বন্ধুত্ব ওর ভিনসেন্টের সঙ্গে, নিতান্ত নিরীহ নিরাপদ বেড়িয়ে-বেড়ানোর সাথিত্ব। বিজম্যান পরিবার জানত ভিনসেন্ট নিষ্কর্মা বাউন্ডুলে, আজ আছে, দু-দিন পরেই আবার চলে যাবে কোথাও। বাড়ির লোকের যত না দুশ্চিন্তা, তত ভাবনা প্রতিবেশীর। রাহুতে পেয়েছে মেয়েটাকে, এখনও যদি না ছাড়ে, তাহলে একেবারে অন্ধকারে ডোবাবে—সকলের মুখে এই এক কথা।

ভিনসেন্ট প্রথম প্রথম বুঝতে পারেনি শহরের লোকের তার ওপর এমনি বিতৃষ্ণা-কেন। কাউকে সে বাধা দেয়নি, ক্ষতি করেনি কারও। তার ধারণাই হয়নি এই গ্রাম্য জনপদের চির-সংস্কার-ঘেরা গোষ্পদে তার অদ্ভুত জীবনযাত্রা কতটা আলোড়ন তুলবে। চোখ ফুটতে তার দেরি হয়নি অবশ্য। একদিন সকাল বেলা সে মাঠের দিকে চলেছে, সারা শহরের মুখপাত্র হয়ে হাঁক দিয়ে তাকে ডাকল একজন দোকানি। দাঁত বের করে একগাল হেসে বললে—–যাই বলেন দাদা, গরমকালটা ছিল ভালো। শীত এসে গেল, এখন বেড়িয়ে-বেড়ানোর সুখটাই মাটি

ভিনসেন্ট দু-কথায় উত্তর দিলে—তা ঠিক।

তা, বলি অনেক তো বেড়ালেন, এবার কাজকর্ম কিছু একটা করুন। পিঠের ইজেলটাকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঠিক করে নিয়ে ভিনসেন্ট বললে–সেইজন্যেই তো চলেছি।

আহা, কী যে বলেন, আমি কাজের কথা বলছি, সত্যিকারের কাজ।

আস্তে আস্তে ভিনসেন্ট বললে—ঠিকই বলেছি, ছবি আঁকাই আমার সত্যিকারের কাজ।

কী মুশকিল! আরে, সত্যিকারের কাজ কাকে বলে জানেন দাদা? যাতে কিনা পয়সা আসে। চাকরি কিংবা মনে করুন পেশা।

এই যে আমাকে সকাল বেলা উঠেই মাঠে যেতে দেখছেন এই আমার পেশা, ঠিক যেমন সকালে উঠেই দোকান খুলে জিনিস বিক্রি করা পেশা আপনার

বটে? আমি তো বিক্রি করি এ-জিনিস ও-জিনিস। আপনি যা করেন তা কি বিক্রি করেন?

এখানে এসে পর্যন্ত চেনা-অচেনার এমনি প্রশ্নের উত্তর যে সে কতবার দিয়েছে তার ঠিক নেই। ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।

বললে—করি বই কী মাঝে মাঝে। আমার ভাই ছবির ব্যাবসা করে, সে কেনে।

মাথা নেড়ে দোকানদার বললে–না মিনহার, সত্যি, কাজকর্ম শুরু করুন এবার। নইলে বুড়ো বয়েসে দেখবেন তহবিল ফাঁকা। এ-বয়েসে এমনি কুঁড়েমি কি ভালো?

কুঁড়েমি? জানেন, আপনার এই দোকান যতক্ষণ আপনি খোলা রাখেন তার ডবল সময় আমি খাটি?

খাটেন? বসে বসে রঙের ছোপ লাগানো, ওর নাম খাটুনি? ও তো ছেলেখেলা! হ্যাঁ, একটা দোকান করুন, মাঠে গিয়ে লাঙল ঠেলুন, সেই তো জোয়ান মরদের কাজ। কোনটে কাজ আর কোনটে ফাঁকি তা বোঝবার সময় নিশ্চয় হয়েছে। বলি, বয়েসটা তো আর কমের দিকে যাবে না!

দোকানদারের যা মন্তব্য সারা গ্রামের মত তা-ই। এদের ধারণায় শিল্পী আর কর্মী দুজনের মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। লোকে কী বলে, কী ভাবে, তা গ্রাহ্য করা ভিনসেন্ট ছেড়েই দিল। তার ওপর লোকের সন্দেহ আর বিতৃষ্ণাও বেড়েই চলতে লাগল দিনের পর দিন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছুটা পরিবর্তন ঘটল একটি দুর্ঘটনার ফলে।

হেলমন্ড স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে আনা কর্নেলিয়া পড়ে গিয়ে পা ভাঙলেন। তাড়াতাড়ি তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসা হল। আত্মীয়স্বজনকে না বললেও ডাক্তার মনে মনে ভয় পেলেন—রোগীর জীবনসংশয়। ভিনসেন্ট দ্বিতীয় বার–চিন্তা না করে ছবি আঁকা দূরে সরিয়ে মার বিছানার ধারে এসে বসল। পীড়িতের সেবা কাকে বলে বরিনেজে থাকতে তা শিখেছিল। ডাক্তার তার শুশ্রূষাপদ্ধতি দেখে তাজ্জব হয়ে গেলেন।

নিউনেনের অধিবাসীরা রোগীকে দেখতে আসতে লাগল–ফুল, বই এমনি নানা উপহার নিয়ে। দিন কাটতে লাগল উৎকণ্ঠায়। তারা নির্বাক বিস্ময়ে লক্ষ করতে লাগল ভিনসেন্টকে। একা সে দিনরাত মার শয্যার পাশে, মাকে না সরিয়ে অদ্ভুত নিপুণতার সঙ্গে সে বিছানা পাতে, জামাকাপড় পরায়, প্লাস্টার-বাঁধা ভাঙা পায়ের যত্ন করে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তার সম্বন্ধে সকলের ধারণা একেবারে বদলে গেল। কে বললে লোকটা সন্দেহকর চরিত্রের? সে তো সকলেরই মতো সহজ আর স্বাভাবিক। রোগীর শয্যা-স্ফোট কী করে বন্ধ করা যায়, কী পথ্য দেওয়া উচিত, কতটা গরম রাখা দরকার রোগীর ঘর—সকলের সঙ্গে সহজভাবে এসব আলোচনা করে কী করে তাহলে? তা ছাড়া পুরুষমানুষ হয়েও এতখানি একনিষ্ঠ সেবার গুণ যার মধ্যে রয়েছে, তার সম্বন্ধে এতদিনের কল্পিত মন্দ ধারণা ভুল ছাড়া আর কী? মা যখন একটু ভালো হলেন, তখন মাঝে মাঝে ভিনসেন্ট ছবি আঁকতে বার হতে লাগল। গ্রামের লোকে আর দূর থেকে বাঁকা চোখে তাকায় না, নাম ধরে কাছে ডাকে, নানা কথা শুধোয়, গালগল্প করে।

মার্গট সবসময় পাশে পাশে থাকে, পথে বা রোগীর ঘরে। ও-ই কেবল তার সুকোমল সেবাবৃত্তি দেখে আশ্চর্য হয়নি। একদিন রোগীর ঘরে চুপি চুপি কজনে গল্প করছে। কথা প্রসঙ্গে ভিনসেন্ট বললে—মানুষের দেহটাকে যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা যায় তাহলে অনেক কিছুই জানা যায়। তবে তাতে অনেক পয়সা খরচ। এ-বিষয়ে জন মার্শালের খুব সুন্দর একটা বই আছে। বইটার নাম ‘অ্যানাটমি ফর আর্টিস্টস’। প্রচুর দাম বইটার।

মার্গট বললে—কেনো না কেন বইটা?

ভিনসেন্ট বললে—টাকা কই? দাঁড়াও দু-একটা ছবি বিক্রি হোক, তখন কিনব।

আমার অনেক টাকা। আমি দেব, তুমি কেনো বইটা এখুনি।

লক্ষ্মীমেয়ে মার্গট, খুব ভালো তুমি। কিন্তু তোমার টাকা নিতে পারিনে। জোর করলে না মার্গট।

কয়েক সপ্তাহ পরে সে ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে এসে তার হাতে তুলে দিলে একটি প্যাকেট।

ভিনসেন্ট শুধোলে—কী আছে এতে?

খুলে দেখোই না।

মার্শালের সেই বইটা। ফিতে দিয়ে বাঁধা, ফিতের সঙ্গে আটকানো একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা শুধু দুটি কথা—মধুরতম জন্মদিনে।

অবাক হয়ে গেল ভিনসেন্ট, বললে—বাঃ, আমার জন্মদিন আজ কে বললে?

মধুর হেসে উঠল মার্গট—তোমার কেন হবে? আমার জন্মদিন। চল্লিশ বছরে পড়লাম আজ। জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি আমাকে দিয়েছ ভিনসেন্ট, আমার এই সামান্য উপহারটুকু তুমি নেবে না? আজ আমার খুশির শেষ নেই, তুমি একটু খুশি হবে না আমার সঙ্গে?

বাগানের মাঝখানে স্টুডিয়ো। কেউ নেই কাছাকাছি কোথাও। বাড়িতে মার কাছে শুধু উইলেমিন বসে আছে। গড়িয়ে এসেছে বিকেল, দেয়ালে শেষসূর্যের একফালি পড়ন্ত রোদ। ভিনসেন্ট সযত্নে হাত বোলাতে লাগল বইটার ওপর। তার শিল্পীজীবনে অন্তর থেকে ভালোবেসে কেউ তাকে সাহায্য করেছে, থিয়োর পর এই প্রথম। বইটাকে বিছানায় ফেলে সে দু-হাতে আলিঙ্গন করল মাৰ্গটকে। পাছে লোকে দেখে তাই মাঠের মধ্যে মার্গটকে আদর করতে তার ভয় করে। এই নিঃসঙ্গ গৃহান্তঃপুরে মার্গট নিজেকে সমর্পণ করতে চায় ভিনসেন্টের হাতে উদার অকৃপণতায়। প্রেমের পুলকে বাষ্পাকুল, মুদিত ওর চোখ। ভয় করে ভিনসেন্টের। ক্রিস্টিনকে ছেড়ে আসার পর পুরো পাঁচটা মাস কেটেছে। বিশ্বাস নেই নিজের ওপর। মার্গটের ক্ষতি হয় এমন-কিছু যেন সে করে না ফেলে!

ভিনসেন্ট চুম্বন করে ওকে—খোঁজে ওর আধখোলা যুগল আঁখির ভাষা। মুখে ওর তৃপ্ত হাসির আভা, চুম্বন-শেষেও স্ফুরিত ওর ওষ্ঠ নবচুম্বনের আমন্ত্রণে। নিবিড় আবেগে ঘনিয়ে আসে আরও কাছে, মুখ থেকে পা পর্যন্ত দুজনের আলিঙ্গনে কোথাও কোনো ছেদ থাকে না। দুজনে বসে পড়ে বিছানায়, আকুল বাহুবন্ধনে ভুলে যায় যৌবনের বিদায়ী বসন্তের যত বেদনা, যত আক্ষেপ।

সূর্য অস্ত গেল, মুছে গেল শেষ রৌদ্ররশ্মিটুকু। ঘরভরতি নরম নরম অন্ধকার। মার্গট হাত বুলিয়ে দেয় ভিনসেন্টের মুখে—কম্পিত সে-হাত, কম্পিত দুটি স্তন। কণ্ঠে ভাষাহারা অস্ফুট ধ্বনি। ভিনসেন্ট বোঝে, ডুবছে সে বাসনার অতল অবগাহনে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পায়, জোর করে ছিনিয়ে নেয় নিজেকে মার্গটের বাহুপাশ থেকে। উঠে দাঁড়ায়, ইজেলে আঁটা অর্ধেক-আঁকা ছবিখানা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চাপা, ঝংকৃত দেহের প্রতিটি স্নায়ু।

কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু বাইরে বৃক্ষশাখায় নীড়ে ফেরা পাখির পাখা ঝাপটানি, আর দূরের পথে গৃহমুখী গাভীর গলার ঘণ্টাধ্বনি। কাটে কয়েকটি মুহূর্ত, তারপরে কথা বলে মার্গট। মৃদু শান্ত গলায় সহজ আহ্বান—

নাও ভিনসেন্ট, যদি চাও তো নাও আমাকে!

ওর দিকে মুখ না ফিরিয়ে ভিনসেন্ট বলে—কেন, কেন ডাকছ অমন করে?

ভালোবাসি যে, সব যে দিতে চাই!

অন্যায় হবে যে?

অন্যায়? কী বলো তুমি? রাজার কি কখনও অন্যায় হয়?

হাঁটু গেড়ে বসে ভিনসেন্ট বিছানার পাশে। বালিশে এলানো মার্গটের মাথা। মুখের বাঁ-ধারে ওর স্পষ্ট একটি রেখা, সেইখানে ঠোঁট রাখে ভিনসেন্ট। চুম্বন করে নাকে, চোখে, গলায়, ঘাড়ের কেশরেখাতটে, জিভটি বুলিয়ে বুলিয়ে দেয় গালের ওপর দিয়ে। কে বলে ও যৌবনপ্রান্তবর্তিনী? গ্রহণ ও আত্মদানের উম্মুখ আবেগে শিহরিত প্রথম মিলনসুখে মূর্ছিত শ্লথ ভঙ্গিমায় দু-হাতে ভিনসেন্টের গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে, ও যেন আত্মবিসর্জিতা নবযৌবনা কামিনী!

ভিনসেন্ট ওর কানে কানে বলে—আমিও তোমাকে ভালোবাসি মার্গট। আগে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝেছি।

স্বপ্নালু কণ্ঠে মার্গট উত্তর দেয়—ভারি মিষ্টি করে তুমি কথা বলতে পার। আমি জানি একটুখানি অন্তত আমাকে তোমার ভালো লাগে। আর তার বদলে আমার সবকিছু দিয়ে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাতেই আমার তৃপ্তি।

মার্গটকে ভালোবাসল ভিনসেন্ট। উরসুলা আর কে-কে যেমন ভালোবেসেছিল এ-ভালোবাসা সেরকম নয়। ক্রিস্টিনকে যেমন ভালোবেসেছিল, তেমনও নয়। কেমন যেন চিত্তবিগলিত করুণা ওই মেয়েটির ওপর, অকুণ্ঠিত আত্ম-উপঢৌকনে যে চরিতার্থ, তৃপ্তিস্তব্ধ যে তার বাহুবন্ধনে। এমনি করে যে-মেয়ে নিজেকে দেয়, তার জন্যে সে কেন পাগল হতে পারে না, এই ভেবে কোমল বিষাদে ভিনসেন্টের মন ভরে গেল, মনে পড়ল উরসুলা আর কে-র প্রতি উপেক্ষিত ভালোবাসার কী যন্ত্রণা সে একদা পেয়েছে। মার্গটের এই ভালোবাসার অঞ্জলি পরম শ্রদ্ধায় সে মাথায় ধরুক, কিন্তু মুখে তুলতে গেলে সত্যি কেমন যেন বিষাদ লাগে। এমনি বিশ্বাসেই কি উরসুলা তাকে উপেক্ষা করেছিল, কে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল—যখন সে এমনি ভালোবাসার অর্ঘ্য নিয়ে গিয়েছিল তাদের কাছে?

মার্গটকে ভিনসেন্ট বললে—অতি দীন আমার জীবন, তবু বলি, এ-জীবনে তুমি কি আসবে?

হ্যাঁ প্রিয়, তুমি যদি ডাক।

নিউনেনেই থাকব, না বিয়ের পর অন্য কোথাও যাবে আমার সঙ্গে? ভিনসেন্টের বাহুমূলে সোহাগে মুখ ঘষতে ঘষতে মার্গট উত্তর দিল—যেখানেই তুমি যাবে, আমি যাব তোমার সঙ্গে ভিনসেন্ট।

কথাটা তারা ভাঙল নিজের নিজের পরিবারে। ঝড় উঠল।

ভ্যান গক পরিবারের আপত্তিটা সরাসরি ব্যবহারিক। বাবা বললেন–বিয়ে অমনি একটা করলেই হল? রোজকার করো, নিজের পায়ে দাঁড়াও, জীবনটাকে সোজা পথে চালাও, তারপর বিয়ের চিন্তা।

ভিনসেন্ট বললে—জীবন আমার সোজা পথেই চলেছে। আমার শিল্পকর্মের মধ্যে দিয়ে আমি সত্যকে আবিষ্কার করে চলেছি। টাকা রোজগার যথাসময়ে হবেই।

বাবা বললেন—বিয়েটাও তোমার তাহলে সেই যথাসময়েই হবে। অবিলম্বে নয়।

এ-বাড়িতে বাতাসের কিছুটা ঝাপটা মাত্র, আসল কালবৈশাখী মেয়ের বাড়িতে। পাঁচ বোনের প্রত্যেকেই যদি অবিবাহিত থাকে, সমাজে পাঁচজনেরই মাথা উঁচু। আর তাদের মধ্যে একজনের যদি বিয়ে হয়ে যায়, লোকের চোখে বাকি চারজনের দৈন্য ধরা পড়ে যাবে যে! একজনের জন্যে বাকি চারজন হার মানবে? বললেই হল? মাদাম বিজম্যান ভাবলেন, এক মেয়ের সুখের রাস্তা খুলবে, আর বাকি চার মেয়ে অসুখী থাকবে চিরদিন? তার চেয়ে ওই এক মেয়ের সুখের আশায় জলাঞ্জলিই মঙ্গল।

মার্গট সে-দিন দিনের বেলা ভিনসেন্টের সঙ্গে যায়নি, সন্ধ্যা বেলা এল স্টুডিয়োতে। চোখ দুটো তার ফুলো ফুলো, চেহারাটা দেখাচ্ছে সত্যিই চল্লিশ পার–হওয়া বুড়ির মতো। কেমন এক হতাশ আকুলতায় সে জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্টকে। বললে—ওরা সারাদিন যা-তা কথা বলছে তোমার নামে। কারুর নামে এত খারাপ কথা কোনোদিন আমি শুনিনি।

এ তো তোমার আশা করাই উচিত ছিল মার্গট।

আশা যে করিনি তা নয়, তবে ওরা যে এতটা হিংস্রভাবে তোমাকে আক্রমণ করবে তা ভাবিনি।

ভিনসেন্ট ওকে কাছে টেনে একটি মৃদু চুম্বন করল। বললে–ওদের কথা ভেবো না! আমি রাত্রে খাবার পর তোমাদের বাড়ি যাব। আমার খুব বিশ্বাস আমি যে খুব সাংঘাতিক লোক একটা নই তা আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে পারব।

বিজম্যানদের চৌকাঠ পার হয়েই ভিনসেন্টের মনে হল, সে যেন শত্রুব্যূহের মধ্যে পা দিয়েছে। ছ-টি স্ত্রীলোক থাকে এ-বাড়িতে, পুরুষের কণ্ঠস্বর এর চৌহদ্দিতে কখনও বাজে না, কেমন যেন অশুভ আবহাওয়া।

চার বোন আর মা একসঙ্গে এসে দাঁড়াল দরজায়, ডেকে নিয়ে গেল তাকে বসবার ঘরে। ঠান্ডা স্যাতসেতে ঘরটা। মার্গটও উপস্থিত হল। ভিনসেন্ট বাকি চার বোনের নাম জানত, জানত না কোন নামটি কার। সবচেয়ে বড়ো যে-বোন সেই শুরু করল প্রশ্নবাণ।

—মার্গট আমাদের বলছে আপনি নাকি তাকে বিয়ে করতে চান। হেগ শহরে আপনার এক স্ত্রী ছিল বলে আমরা শুনেছি, আপনার সে স্ত্রীর কী হল জানতে পারি কি?

ভিনসেন্ট সংক্ষেপে ক্রিস্টিনের কাহিনি বলল। শীতলতর হল ঘরের আবহাওয়া। দ্বিতীয় প্রশ্ন—আপনার বয়েস কত জানতে পারি মিনহার ভ্যান গক?

একত্রিশ।

মার্গট কি আপনাকে বলেছে যে তার বয়েস—

হ্যাঁ। মার্গটের বয়েস আমি জানি।

এবার কি জিজ্ঞাসা করতে পারি আপনার আয় কত?

মাসিক দেড়শো ফ্র্যাঙ্ক।

আয়ের সূত্রটা কী, জানতে পারি কি?

আমার ছোটোভাই আমাকে পাঠায়।

ও। তার মানে আপনি বলতে চান, আপনার ভরণপোষণ চলে আপনার ছোটোভাই-এর সাহায্যে?

না, সে আমাকে মাসমাহিনা দেয়, তার বদলে যা-কিছু আঁকি সব তার প্রাপ্য।

আপনার ছবিগুলো বিক্রি হয় কেমন?

তা আমি ঠিক বলতে পারিনে।

ও। তা, আপনি না পারলেও আমরা পারি। আপনার বাবার কাছ থেকে আমরা জেনেছি যে আপনার একখানা ছবিও আজ পর্যন্ত বিক্রি হয়নি।

এখন না হোক পরে হবে। যে-টাকা এখন ভাই আমাকে দিচ্ছে, সময়ে তার অনেক গুণ সে ফিরে পাবে।

সেটা সম্ভাবনা, দুরাশাও হতে পারে। যা বাস্তব, তার মধ্যে আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখাই এখন ভালো। কী বলেন?

বড়োবোনের শুষ্ক কঠোর মুখটা ভিনসেন্ট ভালো করে লক্ষ করল। এই হৃদয়হীনার কাছ থেকে কোনো সহানুভূতির আশা নেই।

ভগ্নী আবার প্রশ্ন করল—সত্যিকারের উপার্জনের যদি ক্ষমতা আপনার না থাকে, তাহলে বিয়ে করে স্ত্রীকে খাওয়াবেন কী বলতে পারেন?

ভিনসেন্ট বললে—আমার ভাই আমার পেছনে মাসে যে দেড়শো ফ্র্যাঙ্ক করে খরচ করে, সেটা তার খেয়াল হতে পারে, আপনার নয়। আমার পক্ষে এ-টাকাটা মাসমাহিনা। এটা আমি অমনি পাইনে, প্রচণ্ড খেটে উপার্জন করতে হয়। একটু হিসেব করে চললে এই টাকাতেই আমার আর মার্গটের খুব চলে যাবে।

এতক্ষণে কথা বললে মার্গট। প্রতিবাদ করল সে—তাই-বা কেন? আমার নিজের টাকা নেই নাকি?

বড়োবোন ধমক দিয়ে উঠল—চুপ করো মার্গট, তোমাকে কথা বলতে হবে না এখানে।

মা বললে—মনে রেখো মার্গট, আমাদের পরিবারের সম্মানহানি হয় এমন কোনো কাজ যদি তুমি করো, তাহলে ও-টাকা আমি বন্ধ করে দেব। সে-অধিকার আমার আছে।

হাসি পেল ভিনসেন্টের। এবার সে প্রশ্ন করলে—মার্গট যদি আমাকে বিয়ে করে তাতে কি আপনাদের পরিবারের সম্মানহানি হবে?

মা ঘুরিয়ে বললে—আপনাকে আমরা খুব কমই জানি, মিনহার ভ্যান গক, আর যেটুকু শুনেছি তা খুব সুখকর নয়। ক-দিন থেকে আপনি ছবি আঁকছেন?

তিন বছর হল।

এতদিনে আপনি যে সফল শিল্পী হয়েছেন তা বলা যায় না। তা হতে

আপনার আর কতদিন লাগবে?

তাও বলা যায় না।

আচ্ছা, ছবি আঁকার আগে আপনি কী করতেন?

অনেককিছু। ছবির ব্যাবসা করেছি, শিক্ষকতা করেছি, বই বিক্রি করেছি, ধর্মপ্রচারকের কাজ করেছি।

এসবের কোনো কাজেই আপনি টিকতে পারেননি?

তা নয়। নিজেই আমি ছেড়ে দিয়েছি।

কেন?

ওসব কাজের আমি উপযুক্ত ছিলাম না বলে।

ছবি আঁকা ছাড়বেন আর কতদিনে?

মার্গট চেঁচিয়ে উঠল—কখনও না!

বড়োবোন আলোচনায় সমাপ্তি টানবার ভার নিল। বললে—আমাদের মনে হয় মিনহার ভ্যান গক, মার্গটের মতো মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়া আপনার পক্ষে ধৃষ্টতা ছাড়া আর-কিছু নয়। আপনার কোনো আভিজাত্য নেই, একটা পয়সা নেই বা রোজগার করবার ক্ষমতা নেই। কোনো ভদ্র রকমের কাজে লেগে থাকবার মতো ধৈর্য আপনার নেই। আপনার মতো বাউন্ডুলের হাতে আমাদের বোনকে আমরা তুলে দেব এ-কথা ভাববার সাহসটুকু কী করে পেলেন তা-ই আশ্চর্য!

ভিনসেন্ট ক্লান্ত স্বরে বললে—সব কথার পরে যে-কথাটা থাকে সেটা হচ্ছে এই যে মার্গট আমাকে ভালোবাসে, আমি মার্গটকে ভালোবাসি। আমার কাছে ও সুখীই হবে। বছর খানেক এখানে আমরা থাকব। তারপর ওকে নিয়ে আমি বিদেশে চলে যাব। ভালোবাসা ছাড়া আর-কিছু ও জীবনে আমার কাছে পাবে না। ভয় নেই আপনাদের।

তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল আর একটি বোন—বুঝেছি। তারপর ওকে আপনি দূর করে দেবেন হেগ-এর সেই মেয়েমানুষটার মতো। নতুন একজনকে জুটিয়ে নেবেন তারপর, তা-ই না?

তৃতীয় বোন বললে—আসল কথা টাকার লোভ। মার্গটকে বিয়ে করে ওর টাকা ক-টা বাগাতে চান, তা-ই না?

চতুর্থ বোন বললে—অত সোজা না! মার্গট যদি ওকে বিয়ে করে, সব টাকা মা আটকে রাখবে আমাদের জন্যে। তখন দেখা যাবে মজা!

জল এল মার্গটের চোখে। উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। এদের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সোজাসুজি মার্গটকে নিয়ে ইন্ডহোভেনে গিয়ে সেখানে তাকে বিয়ে করে প্যারিস যাত্রা করা ছাড়া উপায় নেই। এত শীঘ্র ব্রাবান্ট ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে নেই, এখানে তার কাজ এখনও বাকি। কিন্তু এই নিষ্ফলা নারীদের কবলে মার্গটকে পড়ে থাকতে হবে ভেবে তার মন শিউরে উঠল।

পরের কটা দিন মার্গটের কাটল অসহ্য যন্ত্রণায়। বরফ-পড়ার দিন এল, ভিনসেন্টের সারাদিন কাটতে লাগল স্টুডিয়োর মধ্যে। ওরা মার্গটকে ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে যেতে দেয় না। সকাল-সন্ধ্যা চব্বিশ ঘণ্টা ওর কানে শোনায় ভিনসেন্টের দুর্নাম আর নিন্দা। মার্গটের জীবনের চল্লিশটা বছর কেটেছে নিজের পরিবারের সঙ্গে। সে তুলনায় ভিনসেন্টের সঙ্গে ওর পরিচয় ক-দিনেরই-বা। বোনদের ও ঘৃণা করে, জানে তারা ওর জীবনটাকে ব্যর্থ করে দিতে চলেছে। তবে প্রচণ্ড ঘৃণা বোধ হয় ভালোবাসারই এক বিকৃত রূপান্তর, বরং ভালোবাসার চেয়ে এমনি ঘৃণার আকর্ষণ কর্তব্যক্ষেত্রে আরও অনেক তীব্র

একদিন নিভৃতে সাক্ষাৎ হতে ভিনসেন্ট মার্গটকে বললে—আমি বুঝিনে তুমি আমার সঙ্গে এখান থেকে চলে যেতে চাও না কেন। কিংবা এখানে থেকেই-বা আমাকে বিয়ে করতে তোমার কেন এত দ্বিধা।

মার্গট বলে—ওরা যে তা দেবে না!

তোমার, মা?

না, আমার বোনেরা। মার কোনো মত নেই, ওরা যা বলে তাতেই তাঁর সায়।

তোমার বোনদের মত আছে কি নেই, কী এসে যায় তাতে তোমার –মনে আছে তোমাকে বলেছিলাম—অল্প বয়সে একটি ছেলের প্রেমে আমি পড়েছিলাম?

মনে আছে।

তাতেও বাধ সেধেছিল আমার বোনেরা। জানিনে কেন, সারাজীবন যা–কিছু করতে চেয়েছি ওরা করতে দেয়নি। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেতে চেয়েছি, যেতে দেয়নি। বই পড়তে চেয়েছি, বাড়িতে বই আনা বন্ধ করেছে। কখনও-বা কোনো পুরুষ আমার আমন্ত্রণে বাড়িতে এসেছে, ওরা তাকে এমন করে কুটি কুটি করে ছিঁড়েছে যে দ্বিতীয় বার সে আর আমার দিকে চোখ তুলে চায়নি। কতবার ভেবেছি কিছু করি, জীবনটাকে কোনোভাবে সার্থক করে তুলি। পারিনি ওদের জন্যে। কখনও পারিনি ওদের বজ্রমুষ্টি এড়াতে।

আর এখন?

এবারেও ওরা দেবে না তোমাকে বিয়ে করতে।

নবজাত প্রেমের সুষমা ইতিমধ্যেই অনেকটা মুছে গেছে ওর অঙ্গ থেকে। ঠোঁট দুটি শীর্ণ, বিবর্ণ গায়ের রং।

ভিনসেন্ট প্রবোধ দিল, বললে—ওদের অত ভয় কর কেন? ওরা তোমার কী করবে মার্গট? আমার ভাই আমাকে কতবার বলেছে প্যারিসে যেতে। চলো এখান থেকে, প্যারিসে আমরা সুখে থাকব।

উত্তর নেই মুখে। শুধু বিছানার ধারে শ্লথ ভঙ্গিতে বসে রইল মার্গট ডান হাতে রক্তহীন মুখটা ঢেকে

হাতটি টেনে নিয়ে ভিনসেন্ট বললে—ওরা যদি মত না দেয়, তাহলে কি আমাকে বিয়ে করতে তুমি ভয় পাও?

না, ভয় কীসের?

গলার সুরে কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ের লেশ নেই। একটু পরে ডুকরে উঠল মার্গট—মরব আমি, তোমার কাছ থেকে ওরা যদি আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়, আমি

তাহলে আত্মহত্যা করব!

ছিঃ, পাগল! ওরা পারবে কেন? আগেই তো আমরা বিয়ে করব, পরে ওদের জানালেই হবে।

পারব না, পারব না আমি ওদের সঙ্গে লড়াই করে। আমি একলা, ওরা অনেকগুলো। ওরা যে আমাকে হারিয়ে দেবে ভিনসেন্ট!

কে বলেছে তোমাকে লড়াই করতে? বিয়েটা হয়ে গেলেই তো সব লড়াইয়ের শেষ। তখন তো শুধু তুমি আর আমি।

না। তখনই হবে লড়াইয়ের শুরু। আমার বোনদের তুমি জান না।

বয়ে গেছে আমার জানতে। তবু বেশ, আজ রাত্রে আবার আমি তোমাদের বাড়ি যাব। দেখি কী হয়

বৃথা আশা, তবু সে গেল প্রস্তরকঠিনা পঞ্চনারীর শীতল সান্নিধ্যে। বোঝাল অনেক করে।

বড়োকন্যা শেষ পর্যন্ত বললে—এসব আগেই অনেক শুনেছি মিনহার ভ্যান গক, ভেবেও আমরা দেখেছি অনেক। মার্গট সুখী হোক তা আমরা সকলেই চাই, তা-ই বলে হাত-পা বেঁধে আমরা ওকে জলে ভাসিয়ে দিতে পারিনে। আমরা স্থির করেছি যে এখন থেকে দু-বছর পরেও যদি আপনি ওকে বিয়ে করতে চান তাহলে আমাদের আপত্তি আমরা ফিরিয়ে নেব।

দু-বছর!

মার্গট শান্তস্বরে বললে—দু-বছর পরে আমি এখানে থাকব না।

থাকবে না! যাবে কোথায়?

থাকব ও-পারে। ওকে বিয়ে করতে যদি আমাকে না দাও তাহলে নিজের হাতে মরব আমি।

সমস্বর প্রতিবাদে ভেঙে পড়ল পঞ্চনারীকণ্ঠ।

ভিনসেন্ট বিদায় নিল নীরবে। আর-কিছু তার করার নেই।

মার্গটই-বা কী করবে? কতটুকু শক্তি ওর পরিবারের এই সংহত প্রতিরোধকে ব্যাহত করার? বয়স ওর অল্প নয়, স্বাস্থ্য ওর ভালো নয়, উদ্যমহীন ভ্রষ্ট মনোবল। আত্মপ্রত্যয়ের কণাটুকু দিনে দিনে সংসার নিংড়ে নিয়েছে ওর বুক থেকে। বয়স যদি অল্প হতো, সম্ভাবনার মন্ত্রে পেত যুদ্ধের প্রেরণা। আজ বড়ো দেরি। চোখে ফিরে এল আগেকার ভীরু করুণ হতাশ দৃষ্টি, মুখের নবোদ্ভাসিত লাবণ্য গেল মুছে, ত্বকে ফুটে উঠল নিহিত বলিরেখা। দেহ থেকে বিদায় নিল ক্ষণবসন্তের আভা।

ভিনসেন্ট বোঝে না মার্গটকে নিয়ে সে করবে কী। ওর রূপের নির্বাপিত ক্ষণদীপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি আকর্ষণও লুপ্ত হতে চলেছে। সত্যিই যে সে ওকে ভালোবাসতে বা বিয়ে করতে মন থেকে চেয়েছিল তা নয়। সামান্যতম আসক্তিটুকুও এখন অবসিত। নিজেকে দোষী মনে হয় এই জন্যে, তাই সে জোর করে আরও উদগ্র করে তোলে প্রেমের অভিব্যক্তিকে।

একদিন কয়েক মিনিটের জন্য মার্গট লুকিয়ে তার স্টুডিয়োতে আসে। ভিনসেন্ট বলে—তুমি কি আমার চাইতে তোমার মা-বোনদের বেশি ভালোবাস, মার্গট? চমকে ওঠে মার্গট, তারপর ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়—এ-কথা কেন বললে, ভিনসেন্ট?

তাহলে আমাকে তুমি ত্যাগ করছ কেন?

ক্লান্ত শিশুর মতো মার্গট আশ্রয় নিল ভিনসেন্টের বাহুবন্ধনে। কণ্ঠে তার সর্বহারার সুর। বললে—আমি তোমাকে যত ভালোবাসি তুমিও আমাকে তত ভালোবাস, এই নির্ভর যদি আমার থাকত তাহলে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে আমি দাঁড়াতাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা, তোমার কাছে এর দাম কতটুকু ভিনসেন্ট?

মার্গট, তুমি ভুল করছ, আমি তোমাকে ভালোবাসি–

ভিনসেন্টের ঠোটে আঙুলের কোমল স্পর্শ রাখল মার্গট। বললে—না প্রিয়, ভালোবাসতে হয়তো চাও, এইমাত্র। দুঃখ কোরো না এজন্যে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এইটেই সত্য, এইটেই বড়োকথা।

তাহলে তুমি ওদের ছেড়ে দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াও না কেন? ভয় পাও কেন তোমার ভালোবাসাকে?

তোমার পক্ষে এ-কথা বলা সহজ। তুমি শক্তিমান, তুমি যোদ্ধা। কিন্তু আমার সে-শক্তি কোথায়? চল্লিশ বছর বয়েস যার, এই নিউনেনের গণ্ডির মধ্যে সারাজীবন যে কাটিয়েছে, সে কি আর যুদ্ধ করতে পারে! ভাঙবার সাহস কখনও যে পায়নি, আজ সে ভাঙতে যাবে কোন ভরসায়?

তা বটে।

—শোনো ভিনসেন্ট, এ যদি হতো যে তুমি চাও, তোমার চাওয়ার জন্যে আমি প্রাণ দিতাম। কিন্তু এ যে আমি চাই ভিনসেন্ট! কত দেরি হয়ে গেছে তুমি কি তা বুঝবে! নিজের চাওয়ার দাবিতে প্রাণ দেবার মতো প্রাণ আর কি আমার আছে? ফিসফিসিয়ে এল মার্গটের গলা। চিবুকে আঙুল দিয়ে ভিনসেন্ট ওর মুখখানি তুলে ধরল। অশ্রুভারাক্রান্ত দুটি করুণ আঁখি।

মার্গট, প্রিয়তমা আমার, ভিনসেন্ট বললে—কেন দ্বিধা কর? তোমার আমার দুটি প্রাণ সারাজীবনের জন্যে এক হতে কি পারে না? তুমি শুধু হ্যাঁ বলো, তাহলেই হবে। আজ রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ি থেকে বার হয়ে এসো। রাত্রি বেলা হেঁটে হেঁটে আমরা ইন্ডহোভেনে যাব, ভোরের ট্রেন ধরব প্যারিসের। কোনো লাভ নেই ভিনসেন্ট। ওরা যেমন আমার অংশ আমিও তেমনি ওদের অংশ, অচ্ছেদ্য বন্ধন। তবে হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আমি যা চাই তা পাবই। শেষ পর্যন্ত যাব আমার একলা পথে

ওরকম করে বোলো না মার্গট। তোমার দুঃখ আমি সইতে পারিনে। ভিনসেন্টের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মার্গট অশ্রুবিধৌত চোখে। প্রশান্ত হাসি হেসে বললে—না ভিনসেন্ট, দুঃখ আমার নেই। এতদিন ধরে যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি। জেনেছি ভালোবাসার সুখ কাকে বলে।

ভিনসেন্ট চুম্বন করল—ওর ওষ্ঠে অশ্রুর লবণাক্ত স্বাদ।

একটু পরে মার্গট বললে–তুষার পড়া তো বন্ধ হয়েছে, কাল সকালে মাঠে ছবি আঁকতে যাবে না?

হ্যাঁ, যাব।

কোন দিকে যাবে? বিকেলে দেখা করব তোমার সঙ্গে।

পরদিন ভিনসেন্ট মাঠে কাজ করল সারাদিন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ধূসর আকাশে সূর্যাস্তের সোনা, প্রান্তর প্রান্তে কোথাও লাল গুল্মের আভা, চক্রবালকে আড়াল করে কোথাও অন্ধকার অরণ্য কোথাও ছায়া ছায়া কুটিরের কালো রেখা। সামনে সবুজ মাঠ, মাঝে মাঝে চষা খেতের কালো মাটি, খানাখন্দের ধারে ধারে নলখাগড়ার রাশি। আকাশপানে বাহু বাড়ানো শীর্ণ পপলারের ডাল।

মার্গট এসে পৌছোল। প্রথম যে-দিন দেখা হয়েছিল সে-দিনের মতো শুভ্র পোশাক তার পরনে, কাঁধে জড়ানো একটি রঙিন স্কার্ফ। গালে লেগেছে সামান্য রক্তিমাভা। হঠাৎ যেন আবার তাকে ছুঁয়েছে পুরোনো যৌবনজ্যোতি। হাতে তার ছোট্ট একটি সেলাইয়ের বাস্কেট।

দু-হাতে ও গলা জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্টের। উদ্দাম ওর বুক। চোখ থেকে ঘুচে গেছে বিধুর বেদনার আভাস,

কী হল মার্গট, ভিনসেন্ট শুধোয়—কিছু একটা ঘটেছে নাকি?

কিছু না, কিছু না। আবার তোমার কাছে এসেছি, বড়ো খুশি লাগছে।

কিন্তু এমনি পাতলা পোশাক পরে বার হয়েছ কেন? ঠান্ডা লাগবে যে। এ-কথার কোনো উত্তর দিল না মার্গট। একটু থেমে বললে—ভিনসেন্ট, যতদূরে তুমি যাও, যতদূরে আমি যাই তোমার কাছ থেকে, একটি কথা কিন্তু চিরদিন মনে রেখো। বলো, রাখবে তো?

কী কথা মার্গট?

ভালোবেসেছিলাম তোমাকে, এত ভালোবাসা কোনো মেয়ে তোমার সারাজীবনে তোমাকে বাসবে না। শুধু এই কথাটি।

কাঁপছ কেন এত তুমি!

ও কিছু না। কত দেরি হয়ে গেল, ছুটতে ছুটতে আসছি যে! তোমার কাজ শেষ হয়েছে?

একটু বাকি।

বেশ তো, সেরে নাও। আমি চুপটি করে তোমার পেছনে বসে থাকি। বাধা দেব কেন তোমার কাজে? কখনও তোমাকে বাধা দিতে কি চেয়েছি? চেয়েছি শুধু চুপটি করে ভালোবাসতে, তা-ই না?

কী উত্তর দেবে? কথা খুঁজে পেল না ভিনসেন্ট। বেপথুমতী মার্গট স্কার্ফটা গলায় জড়িয়ে নিল, বললে—কাজে মন দেবার আগে একবার শুধু একটি চুমু খাও, সেই সে-দিন তোমার স্টুডিয়োতে যেমনি করে চুমু খেয়েছিলে, যে-দিন সব ভালোবাসা নিয়েছিলে আমার, তেমনি করে!

সূর্য অস্ত গেল। দিগন্তব্যাপী প্রদোষান্ধকার। নিবিড় নিস্তব্ধ শান্তি। ভিনসেন্ট তুলির শেষ রেখা ক-টি বোলাতে লাগল ক্যানভাসে। পশ্চাতে প্রতীক্ষমাণা মাৰ্গট।

হঠাৎ সামান্য একটু শব্দ, বোতল খোলার। মার্গট একটা চাপা আর্তনাদ করে হাঁটুতে ভর দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল, পরমুহূর্তে প্রচণ্ড আক্ষেপে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। লাফিয়ে উঠে ওর সামনে এসে ঝুঁকে পড়ল ভিনসেন্ট। চোখ দুটি ওর বন্ধ, নীরব ঠোঁটে কেমন একটি বিচিত্র হাসি। ওর সারা শরীরটা ক-বার যেন বিদ্যুৎযন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল, তারপরেই খাড়া, শক্ত হয়ে গেল।

ভিনসেন্ট বোতলটা তুলে নিল। সাদা সাদা কিছুটা চূর্ণ বোতলের মুখটাতে অবশিষ্ট রয়েছে। কোনো গন্ধ নেই তার।

মার্গটকে দু-হাতে বুকে তুলে নিয়ে মাঠ ভেঙে পাগলের মতো দৌড়োতে লাগল ভিনসেন্ট। আতঙ্ক গ্রামে পৌঁছোবার আগেই যদি ও মারা যায়! অবাক বিস্ময়ে কত লোক তাকিয়ে রইল গ্রামের রাস্তায়। বিজম্যানদের বাড়ি পৌঁছে এক লাথি মেরে সে সামনের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল। মার্গটকে শুইয়ে দিল

বসবার ঘরের সোফায়।

মা আর বোনেরা ছুটে এল।

মার্গট বিষ খেয়েছে! আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি!

আবার সে ছুটে গেল রাস্তায়।

খাবার টেবিল থেকে ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এল সে। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন—ঠিক বলছেন স্ট্রিকনিন?

আমার তো তা-ই মনে হল।

বাড়িতে যখন নিয়ে পৌঁছোলেন তখন বেঁচেছিল তো?

হ্যাঁ ডাক্তার, হ্যাঁ। আশা করি এখনও আছে। চলুন আপনি দৌড়ে।

সোফায় শুয়ে ছটফট করছে মার্গট। খিঁচুনি শুরু হয়েছে দেহের প্রত্যেকটি মাংসপেশিতে। ডাক্তার পরীক্ষা করতে লাগলেন।

ঠিক বলেছেন, স্ট্রিকনিন। তবে যন্ত্রণা কমাবার জন্যে সঙ্গে খানিকটা আফিমও খেয়েছে। এতে বিষে বিষক্ষয় হতে পারে।

মা বললে—তাহলে বাঁচবে ডাক্তার?

আশা আছে। তবে এখুনি উট্রেকট-এ নিয়ে যেতে হবে। এখানে কিছু উপায় নেই। আমার গাড়িটা ডাকুন। এক মিনিট দেরি নয়।

ভিনসেন্ট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। গাড়ি এল। ডাক্তার একটা কম্বলে অচৈতন্য মার্গটের সারা দেহ জড়িয়ে নিয়ে দু-হাতে তুলে শুইয়ে দিলেন গাড়িতে। মা আর বোনেরা এগিয়ে এসে উঠল গাড়িতে। চারদিকে নির্বাক শোকাচ্ছন্ন জনতা। ডাক্তার উঠে লাগাম ধরলেন। গাড়ি ছাড়বার মুখে ভিনসেন্টের দিকে মার্গটের মার চোখ পড়ল, আর্ত ক্রুদ্ধ কণ্ঠ ফেটে পড়ল তাঁর—তুমি, তুমি, তুমিই এই কাজ করেছ, তুমিই মেরেছ আমার মেয়েকে! খুনে কোথাকার!

জনতার চোখ পড়ল ভিনসেন্টের ওপর। ঘোড়ার পিঠে চাবুক, গাড়ি চলল।

ভিনসেন্টের মার হাঁটু ভাঙার আগে গ্রামের লোক তাকে সন্দেহের চোখে দেখত, তার কারণ তার জীবনযাত্রাকে তারা বুঝতে পারত না। এর বেশি নয়। তার ওপর প্রত্যক্ষ বিতৃষ্ণা কারুর ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার পর তাকে ঘিরে তার চারিদিকে ভেঙে পড়ল ক্রুদ্ধ আক্রোশের সর্পিল তরঙ্গ। কেউ তার সঙ্গে কথা কয় না, মুখ ফিরিয়ে নেয় সে, যেন পথের ঘৃণিত কুকুর।

এতে তার দুঃখ ছিল না, কেননা কৃষাণ আর তাঁতিদের সঙ্গে তার সদ্ভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু ক্রমে লোকে তার বাড়িতে আসা গির্জাতে আসা বন্ধ করল। ভিনসেন্ট বুঝল, বাবার এখানে আর থাকা তার সম্ভব নয়।

কোথায় যাবে সে? সবচেয়ে ভালো হতো যদি বাবা-মাকে শান্তিতে রেখে একেবারে ব্রাবান্ট অঞ্চল ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ব্রাবান্টই তার মাতৃভূমি, তার চিরদিনের আবাস। এখানকার কৃষাণ আর তন্তুজীবীদের শিল্পী সে, ওরাই তার শিল্পসাধনার উপজীব্য। শীতে এখানে গভীর তুষার, শরতে পত্রে পত্রে পাকা সোনার রং, গ্রীষ্মে মাঠভরা শস্য আর বসন্তে তৃণপুষ্পের সমারোহ। লাঙল-ঠেলা কৃষাণ আর ফসল-কাটা কৃষাণী—কী ভালো এদের জীবনের মধ্যে মিশে যেতে, কী ভালো এখানে প্রহরের পর প্রহর মিলিয়ে সারাজীবন কাটাতে, উষ্ণ দিনে নীল আকাশের নীচে আর পর্ণকুটিরে আগুনের ধারে হিমরাত্রে!

মানুষের হাতে স্বর্গীয় শিল্পসৃষ্টির উদাহরণ, ভিনসেন্টের মতে মিলেটের ‘অ্যাঞ্জেলাস’। তার বিশ্বাস মাটির বুকে যারা শস্য ফলায় তাদের সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার মধ্যেই জীবনলীলার সত্য পরিচয় মেলে। এই সত্যকে ধরবার মোহেই সে মাঠে মাঠে ছবি আঁকতে চায়, যেখানে প্রবহমাণ জীবনলীলা। দেয়ালে ঘেরা স্টুডিয়োতে নয়। শীত আছে, বর্ষা আছে, ঝড় আছে, তুষার আছে, কিন্তু প্রকৃতি সেখানে প্রত্যক্ষ সারল্যে আপনার অন্তগূঢ় সত্যকে উন্মোচন করেছে। শুধু রং নয়, শুধু রূপ নয়, পাকা ফসলের গন্ধ এসে লাগুক, অরণ্যমঞ্জরীর সুবাসের স্বপ্নচিহ্ন পড়ুক তার ছবিতে, মনে মনে এই তার ভাবনা।

আশু সমস্যাটার সমাধান হল এইভাবে। বাড়ি থেকে কিছু দূরে ক্যাথলিক গির্জা, তার পাশেই গির্জার রক্ষকের বাড়ি। নাম তার জোহানস শাফরাথ। পেশায় দর্জি, বাড়তি সময়ের কাজ গির্জা দেখাশুনো করা। স্ত্রীর নাম অ্যাড্রিয়ানা, ভারি ভালোমানুষ। সারা গ্রাম যে-লোকটির পেছনে, তার প্রতি কেমন একটা করুণামিশ্রিত অনুকম্পা সে-নারী অনুভব করল। জায়গা দিল ভিনসেন্টকে। দিল দু-খানি ঘর ছেড়ে। প্রথম ঘরটি বড়ো, সেটা স্টুডিয়ো। পেছনের ঘরটি ছোটো, জিনিসপত্রের গুদাম। ছাদের চিলেকোঠায় ঠাসা মালপত্রের পাশে শোবার একটা খাট।

স্টুডিয়োতে ভিনসেন্ট সাজাল তার আঁকা নানা ড্রয়িং আর জলরঙের ছবি। কৃষাণ আর তাঁতি মেয়ে-পুরুষের বলিষ্ঠ সুখের নানা বিচিত্র স্টাডি। বন্ধুত্ব করল ভাই কর-এর সঙ্গে। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করল প্রায় ত্রিশরকম পাখির বাসা, ছোটো ছোটো গদি আর নানা রঙের শ্যাওড়া আর নুড়ি, মাকু, চরকা, কাস্তে, কোদাল, শ্রমিকের পুরোনো টুপি, বুটজুতো, কয়েকটা গ্রাম্য বাসনপত্র। সাজিয়ে রাখল স্টুডিয়োর এক দেয়ালে একটা হাতে তৈরি খোলা আলমারিতে। ঘরের এক কোণে টবে পুঁতে দিল ছোটো একটা চারাগাছ। গ্রাম্য জীবনের ছোটোখাটো অসংখ্য নিদর্শন যেন স্টুডিয়োতে ঢুকলেই চোখে ভাসে।

কাজ করতে শুরু করল অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে। তবু বাইরে যখন কাজ করে, প্রকৃতিতে বাজে হাহাকার। ঘরে ফিরলে মনে হয় নিঃসঙ্গ স্টুডিয়ো যেন কারাগার।

মার্চ মাসে একটা মস্ত দুর্ঘটনা ঘটল। কর্নেলিয়াস অনেক পথ হেঁটে একজন অসুস্থ গ্রামবাসীকে দেখতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে বাড়ির দরজার সিঁড়িতে তিনি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না। আনা কর্নেলিয়া ছুটে এসে দেখেন দেহে প্রাণ নেই।

গির্জার পাশের গোরস্থানেই কর্নেলিয়াসের সমাধি হল। এই ব্যাপারে থিয়ো এল প্যারিস থেকে।

.

রাত্রি বেলা দু-ভাইয়ে কথা হচ্ছিল ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে বসে। সাংসারিক কথাবার্তা শেষ হওয়ার পর কাজের কথা এল।

থিয়ো বললে—জান, একটা নতুন কোম্পানি আমাকে চাইছে, হাজার ফ্র্যাঙ্ক মাইনে দেবে বলছে।

ভিনসেন্ট বললে—নেবে নাকি?

বোধ হয় না। আমার ধারণা নতুন কোম্পানিটার আসল লক্ষ্য পয়সা লোটা, সে ছাড়া কিছু নয়।

কিন্তু তুমি যে লিখেছিলে যে আজকাল গুপিলসও—

হ্যাঁ, মোটা লাভের পেছনে লে মেসিয়ুর্সও ছুটছে বই কী। তবে কিনা এদের সঙ্গে আমি বারো বছর আছি। কয়েকটা ফ্র্যাঙ্কের লোভে নতুন মনিবের কাছে কেন যাব? হয়তো ক-দিন পরে ওদের কোনো ব্রাঞ্চ আপিসের ভার আমার ওপর পুরোপুরি ছেড়ে দেবে। তা যদি করে তাহলে আমি ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি বিক্রি করতে পারব।

ইম্প্রেশনিস্ট? কোথায় যেন নামটা পড়েছি। কারা ওরা?

ওরা হচ্ছে প্যারিসের তরুণ চিত্রকরের দল। এডোয়ার্ড মানে, ডেগাস, রেনোয়াঁ, ক্লড মনে, সিসলে, কোরবেট, লোত্রেক, গগাঁ, সেজান, সিউরাত—এরা সব।

ইম্প্রেশনিস্ট নামটা পেল কোথায়?

১৮৭৪ সালে নাদারের একটা প্রদর্শনী *থেকে। ওতে মনের একটা ছবি ছিল, নাম ‘ইম্প্রেশন’। লুই শ্রেয় বলে একজন সমালোচক লিখেছিল, ওটা ইম্প্রেশনওয়ালাদের একজিবিশন ..সই থেকে ইম্প্রেশনিস্ট নামটা চালু হয়ে গেল।

কীরকম রঙে ওরা কাজ করে? ঘন, না পাতলা?

পাতলা বললে ভুল হবে। জ্বলজ্বলে রং। অন্ধকারকে ওরা ডরায়।

তাহলে ওদের সঙ্গে আমার পোষাবে না। আমি যদি রং বদলাই তো আরও ঘন রঙের দিকেই যাব।

প্যারিসে গেলে হয়তো তোমার মত বদলাবে।

তা হয়তো বদলাবে। বিক্রি হয়?

মানের দু-একটা ছবি কেটেছে। আর কারুর নয়।

বাঃ! চলে কী করে ওদের?

তা বলা শক্ত। নানাভাবে বুদ্ধি বেচে খায় অনেকে, এটুকু বলা যেতে পারে। রুসো বলে একজন শিল্পী ছোটো ছেলেমেয়েদের বেহালা বাজানো শেখায়, গগাঁ তার স্টক এক্সচেঞ্জের পুরোনো বন্ধুদের কাছে ধারকর্জ করে, সিউরাতের মার কিছু পয়সা আছে, সেজানকে খাইয়ে পরিয়ে রেখেছে তার বাবা। আর সবাই কোথা থেকে কী জোটায় বলতে পারব না।

তুমি এদের সবাইকে চেন থিয়ো!

আস্তে আস্তে আলাপ করছি। লে মেসিয়ুর্স-এর কর্তাদের অনেক করে ধরেছিলাম গুপিল গ্যালারির একটা কোণে ওদের কয়েকটা ছবি রাখতে। তা ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি লাঠির আগা দিয়ে ছুঁতেও ওরা রাজি নয়।

এইসব শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করতে পারলে বেশ হতো, ভিনসেন্ট বললে—সত্যি, অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় করবার কোনো ব্যবস্থাই তুমি কিন্তু–করছ না থিয়ো।

থিয়ো বললে–বাঃ, তাহলে প্যারিসে থাকবে চলো আমার সঙ্গে। শেষপর্যন্ত যেতেই তো হবে।

না, এখন আমি তৈরি হইনি। এখানে কিছু কাজ আমার বাকি আছে।

তাহলে আমাকে দোষ দিয়ো না।

এবারে ভিনসেন্ট কাজের কথা পাড়ল। বললে—কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারিনে থিয়ো। তুমি আমার একটা ছবি বা একটা ড্রয়িংও আজ পর্যন্ত বিক্রি করনি। চেষ্টাই করনি বোধ হয়।

সত্যিই করিনি।

কেন বলো তো?

আমি তোমার কাজ ওখানকার ভালো ভালো চিত্রসমালোচকদের দেখিয়েছি। তাঁদের মতে—

ওঃ, রেখে দাও তোমাদের সমালোচকদের কথা। তাদের মত আর মন্তব্যের ধরন আমার জানা আছে। ছবির সত্যিকারের অন্তর্নিহিত যা গুণ তা কখনও ওদের চোখে পড়ে? তারা তো শুধু বাঁধা বুলি কপচায়।

আমার ঠিক তা মনে হয় না। তোমার ছবি প্রায় বিক্রির উপযুক্ত হয়ে এসেছে ভিনসেন্ট, তবে কিনা—

উঃ, আর তো পারিনে। ভিনসেন্ট, ইটেন থেকে প্রথম যখন তোমাকে স্কেচ পাঠিয়েছিলাম তখন ঠিক এই কথাই তুমি আমাকে চিঠিতে লিখেছিলে, মনে পড়ে?

কথাটা মিথ্যে নয় ভিনসেন্ট। প্রত্যেক বার তুমি আমাকে তোমার কাজ পাঠাও, প্রত্যেক বার আমি উৎসুক আগ্রহে সেগুলো দেখি। প্রত্যেক বারই আমার মনে হয় এই তুমি পৌঁছোলে বলে। কিন্তু প্রত্যেক বারই আবার মনে হয় আর–একটু যেন দেরি আছে।

বাধা দিয়ে বললে ভিনসেন্ট—থাক থাক, বিক্রি হবার কি হবার নয়, এই প্রশ্নের সামনে মাথা খুঁড়তে আর আমি পারিনে। যা ভালো তা-ই তুমি কোরো।

থিয়ো বললে—ব্যাস। না তো কী? তুমি বলছ এখানে তোমার এখনও কাজ আছে। বেশ, কাজ করে যাও। যত শীঘ্র পার প্যারিসে আসবার চেষ্টা কোরো। ওখানে গেলেই ঠিক হবে অনেককিছু। ইতিমধ্যে গোটা কতক ছবি পাঠাও, স্টাডি নয়। স্টাডি আজকাল কেউ কেনে না।

ভিনসেন্ট বললে—হায় রে! কোথায় যে স্টাডির শেষ, আর ছবির শুরু তা যদি বুঝতাম!

বাবার মৃত্যুর আগে ভিনসেন্ট মাঝে মাঝে রাত্রের খাবারের সময় ঘণ্টা খানেকের জন্যে বাড়ি যেত। কর্নেলিয়াসের শেষকৃত্যের পর বোন এলিজাবেথ স্পষ্টই জানিয়ে দিল এ-বাড়িতে তার পা না দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কেননা হাজার হোক, বাবা না থাকলেও তাঁর পরিবারের সম্ভ্রমটা আছে। মাও দেখলেন, ছেলে তো তার নিজের ভাগ্যের জন্যে নিজেই দায়ী, পিতৃহীনা মেয়েদের দিকেই তাঁকে এখন দেখতে হবে।

ফাঁকা হয়ে গেল, নিউনেনে আর বন্ধু বলতে কেউ রইল না। আবার অসহ্য একাকিত্ব। মানুষ আঁকা ভিনসেন্ট ছেড়ে দিল, চেষ্টা করল শুধু প্রকৃতিকে আঁকতে। সব ভুল হতে লাগল প্রথম প্রথম। প্রকৃতিকে অনুসরণ করার প্রয়াস শুধু ব্যর্থ সংগ্রাম। পরে সে নিজের প্যালেটের রঙের সঙ্গে সন্ধি করল, আঁকতে লাগল খেয়ালখুশিমতো, প্রকৃতি হার মেনে নিজেই আসতে লাগল তার সাধনার পেছনে পেছনে। কিন্তু প্রকৃতি মানুষ নয়। মানুষ থেকে সে বিচ্ছিন্ন কি সমাজে, কি শিল্পসমাজে। এই বার্ষিক একাকিত্বের বেদনা যখন যন্ত্রণার মতো বাজে তখন উইসেনব্রাকের স্টুডিয়োতে পুরোনো সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে উইসেনব্রাকের দুঃখ-প্রশস্তির তিক্ত কঠোর কথা। উইসেনব্রাকের এই দার্শনিক তত্ত্ব তার প্রিয় শিল্পী মিলেটের ভাষাতেও স্পষ্ট উচ্চারিত—বেদনাকে রুদ্ধ করতে আমি চাইনে, কেননা আমি জানি এই বেদনাই শিল্পীর বলিষ্ঠতর আত্মপ্রকাশের উৎসমুখ।

ডি গ্রুট নামে একটি কৃষক পরিবারের সঙ্গে ভিনসেন্টের আলাপ হল। পরিবারে আছে মা, বাবা, একটি ছেলে ও দুই কন্যা, সবাই মাঠে কাজ করে। নিগ্রোজাতীয় এদের মুখ, মোটা বড়ো নাসারন্ধ্র, চ্যাপটা নাক, ফুলো ফুলো ঠোঁট, লম্বা কান। সরু ছুঁচলো মাথা, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত সারা মুখটা যেন মাথা থেকে সামনের দিকে ঝুলে এসেছে। বাড়ি বলতে একটিমাত্র ঘর, তাতেই সারা পরিবারের আস্তানা।

আলুসৰ্বস্ব জীবন ডি গ্রুট পরিবারের। তারা আলুর চাষ করে, আলুই তাদের প্রধান আহার্য। রাত্রি বেলা হয়তো দু-একটুকরো মাংস ওই আলুর সঙ্গে পেটে পোরে, গলায় ঢালে কিছুটা কালো কফি।

বড়ো মেয়েটি সপ্তদশী, মোটামুটি মিষ্টি চেহারা—নাম স্টিয়েন। ভিনসেন্ট প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ওদের বাড়ি যায়। ওদের আঁকে। সবচাইতে খুশি স্টিয়েন এতে।

বলে—দেখো কাণ্ড, আমাকে আঁকবেন? শহুরে বিবি নাকি আমি? দাঁড়ান, দাঁড়ান, নতুন বনেটটা তাহলে চড়িয়ে আসি মিনহার।

ভিনসেন্ট বলে—না স্টিয়েন, এমনিতেই তুমি খুব সুন্দর।

সুন্দর? আমি? হাসিতে ফেটে পড়ে দেহাতি মেয়ে। চকচক করে ওঠে দাঁত, ঝলকিয়ে ওঠে বড়ো বড়ো চোখ

যে-জীবন মাটির সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত তারই প্রতিচ্ছবি মেয়েটির মুখের বলিষ্ঠ সরল ভাবে। ও যখন হেঁট হয়ে মাটি থেকে আলু খুঁড়ে খুঁড়ে তোলে, ওর দেহরেখায় ভিনসেন্ট যে স্বভাবজ লালিত্যের আভাস দেখে, তা কে-র মতো সুন্দরীর মধ্যেও সে পায়নি। ভিনসেন্ট হৃদয়ঙ্গম করেছে যে মনুষ্যদেহ আঁকার অন্তর্নিহিত গুণটা হচ্ছে তার চলমানতা। স্থাণুত্ব দেহের ভূষণ নয়, কর্মের মধ্যে চঞ্চলতার মধ্যেই দেহের বাস্তব বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। প্রাচীন শিল্পীদের দোষ ছিল যে তাঁদের আঁকা মনুষ্যদেহগুলি ছিল কর্মহীন, জীবনসম্পর্কহীন, প্রস্তরস্থাণু। এই ডি গ্রুট পরিবারের কত যে স্কেচ ভিনসেন্ট করল তার ইয়ত্তা নেই। যখন তারা মাঠে কাজ করছে, যখন তারা ঘরের কাজ করছে, দিনান্তে যখন টেবিলে সবাই মিলে বসে আলুসেদ্ধর নৈশভোজ খাচ্ছে, এমনি স্কেচের পর স্কেচ। যখনই সে আঁকে স্টিয়েন মেয়েটা তার পিঠের কাছে ঝুঁকে পড়ে দেখে আর ঠাট্টা-গল্প করে। রবিবার দিন কখনও কখনও ফরসা জামা পরে ভিনসেন্টের সঙ্গে সে মাঠে বেড়াতে যায়। চাষির মেয়ের পক্ষে এই আনন্দটা কম নয়।

একদিন এমনি বেড়াতে বার হয়ে সে প্রশ্ন করল ভিনসেন্টকে—আচ্ছা, মার্গট বিজম্যান আপনাকে সত্যি ভালোবাসত?

সত্যি বই কী।

তাহলে আত্মহত্যা করতে গেল কোন দুঃখে?

তার কারণ, ওর পরিবার কিছুতেই আমার সঙ্গে ওর বিয়ে হতে দিল না।

বাঃ, এইজন্যে? চটুলা যুবতী কটাক্ষ হেনে বললে—আমি হলে কী করতাম জানেন? বিয়ে হল না তো বয়েই গেল! তার জন্যে আত্মহত্যা করতাম বুঝি? তার বদলে প্রেমটাই কষে করতাম। বলুন তো, তা-ই ঠিক হতো না?

ভিনসেন্টের মুখের ওপর খিলখিল হাসির ঝংকার তুলে স্টিয়েন দৌড় দিল পাইনকুঞ্জের দিকে।

পাইন বনে তারা সারাদিন কাটাল, কখনও শুয়ে বসে, কখনও ছুটোছুটি করে। উচ্চকিত হাসি স্টিয়েনের, কারণে-অকারণে খুশির দমকে সে লুটোয়, হাসির চিৎকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অন্য সব পথচারীর।

ভিনসেন্টের সঙ্গে দিনে দিনে স্টিয়েনের সম্পর্কটাই হয়ে উঠল এমনি হাসির আর খেলার, সোহাগের আর ছেলেমানুষি আবদারের। মাঠে বেড়াতে গিয়ে খেলার খেয়ালে সে কুস্তি লড়ে যায়, চেষ্টা করে ভিনসেন্টকে চিত করে তার বুকে চড়ে বসতে। ঘরে যখন থাকে, ভিনসেন্টের কোনো আঁকা পছন্দ না হলে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে হয় তার ওপর কফি ঢেলে দেয়, নাহয় সেটাকে ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় আগুনের মধ্যে। কখনও কখনও সে তার স্টুডিয়োতে পোজ করতে আসে, যখন ফিরে যায়, সারা স্টুডিয়োতে তখন সম্পূর্ণ হেলাগোছা বিপর্যস্ত অবস্থা।

.

গ্রীষ্ম থেকে শরৎ শেষ পর্যন্ত কাটল। তারপর শীত। বাইরে তুষার। আবার শুধু ঘরে বসে কাজ করার দিন। নিউনেনের মতো গ্রামে স্টুডিয়োতে এসে তার সামনে পোজ করবার মতো লোকের সংখ্যা বিরল বললেই চলে, পয়সা দিয়েও মেলে না। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে সাহায্য সে পেল ডি গ্রুট পরিবারের কাছ থেকে। সন্ধ্যা বেলা পরিবারের সকলে যখন খাওয়ার টেবিলে জড়ো হয়, তখন ভিনসেন্টও প্রায়ই গিয়ে স্কেচ করে ওদের।

যে-লোক স্বধর্মবিশ্বাসী নয়, তার ওপর আবার ছবি-আঁকিয়ে, এমনি লোক গির্জার পরিদর্শকের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে থাকে, ক্যাথলিক ধর্মযাজক গোড়া থেকেই ব্যাপারটা পছন্দ করেননি। কিন্তু ভিনসেন্টের ভদ্র, সম্ভ্রমপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে স্পষ্ট আপত্তি করারও তাঁর উপায় ছিল না। একদিন খুব উত্তেজিত অবস্থায় আড্রিয়ানা শাফরাথ ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে এসে ঢুকলেন। বললেন—ফাদার পাওয়েলস এসেছেন, এক্ষুনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

ফাদার অ্যান্ড্রিয়ান পাওয়েলস ক্যাথলিক গির্জার পাদরি, মস্ত বড়ো চেহারা, লাল টকটকে মুখ। স্টুডিয়োতে ঢুকে চারদিকে তাকিয়েই একটু ঘাবড়ে গেলেন তিনি। এমন অদ্ভুত জায়গায় তিনি কখনও পা দেননি জীবনে।

ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি সামনে এসে খাতির করে বললে—আসুন, আসুন ফাদার, কী করতে পারি আপনার জন্যে?

কিছুই পার না। তবে আমি তোমার জন্যে কিছু করব বলেই এখানে এসেছি।

বলুন ফাদার।

বললে শুনবে? যা বলব তা মানবে? আমার দিক থেকে যা করবার আমি

তাহলে করব। কোনো বাধা তোমার হবে না।

কী ব্যাপার? কীসের বাধা?

শোনো। মেয়েটা ক্যাথলিক আর তুমি প্রোটেস্টান্ট। তবু বিশপের কাছ থেকে বিশেষ বিধান আমি নিয়ে আসব। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বিয়েটা শেষ করে ফেলতে হবে, কেমন?

আরও দু-পা সামনে এগিয়ে এসে ফাদার পাওয়েলসের মুখের দিকে ভালো করে তাকাল ভিনসেন্ট। একমুহূর্ত পরে বললে—আপনার কথা আমি কিছুই তো বুঝতে পারছিনে!

খুব পারছ! ধমকে উঠলেন ধর্মযাজক—এখন আর ভান করে বোকা সেজে থাকতে হবে না। স্টিয়েন ডি গ্রুটের পেটে সন্তান এসেছে। পরিবারটার মানসম্মান পথের ধুলোয়।

কী সর্বনাশ! কী অন্যায়!

সর্বনাশ? অন্যায়? শুধু মুখের কথা? এর প্রতিবিধান করতে হবে না?

কিন্তু, আপনি ঠিক জানেন ফাদার? কোথাও ভুল হয়নি তো?

প্রত্যক্ষপ্রমাণ হাতে না নিয়ে আমি কাউকে অভিযুক্ত করিনে।

আর স্টিয়েন….তাহলে স্টিয়েন আপনাকে বলেছে যে আমিই এজন্যে দায়ী?

না, তা অবশ্য বলেনি। নিজের মুখে কিছুতেই সে নামটা ভাঙতে চায়নি।

তবে তার গর্ভের সন্তানের পিতৃত্বের সম্মানটা আপনি আমাকে কেন দিচ্ছেন ফাদার?

গ্রামসুদ্ধ লোক তোমাদের একসঙ্গে দেখেছে। তোমার স্টুডিয়োতে ও প্রায়ই

আসে না?

হ্যাঁ, আসে।

রবিবারে রবিবারে ওকে নিয়ে তুমি মাঠে বেড়াতে যেতে না?

হ্যাঁ, তাও যেতাম বই কী।

এর বেশি প্রমাণের আর দরকার করে?

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল ভিনসেন্ট। তারপর আস্তে আস্তে বললে—খুব দুঃখিত হলাম ফাদার, বিশেষ করে স্টিয়েন মেয়েটি বড়ো ভালো, খুব আমার বন্ধু, তার এমনি বিপদের কথা শুনে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক, তাতে এমনি অঘটনের কোনো সম্ভাবনা নেই।

তুমি আশা কর যে এ-কথা আমি বিশ্বাস করব?

না—ভিনসেন্ট আলাপ শেষ করল—সে-আশা অবশ্য করিনে।

দিনের শেষে আলু খেত থেকে ডি গ্রুটরা ফিরে দেখে, তাদের কুটিরের দরজায় ভিনসেন্ট দাঁড়িয়ে। আর সবাই বাড়ির মধ্যে গেল, স্টিয়েন ঝুপ করে বসে পড়ল ভিনসেন্টের পাশে দরজার চৌকাঠের ওপর। দাঁত বার করে বলল—আপনার ছবি আঁকার জন্যে একটা নতুন জীব এবার আমি দেব।

ভিনসেন্ট বললে—কথাটা তাহলে সত্যি স্টিয়েন?

ভিনসেন্টের ডান হাতটা টেনে নিয়ে সে নিজের তলপেটের ওপর চেপে ধরলে। সত্যিই সে অন্তঃসত্ত্বা।

ভিনসেন্ট বললে—ফাদার পাওয়েলস একটু আগে আমার কাছে গিয়েছিলেন। তিনি বলে গেলেন আমিই নাকি এর জন্যে দায়ী।

হি হি! হলে তো বেশই হতো, খুব ভালো হতো। কিন্তু আপনি যেন একটা কী! চাইলেনও না, পারলেনও না!

ভিনসেন্ট তাকাল স্টিয়েনের দিকে। নবযৌবনে কানায় কানায় পুরত্ত দেহ, সারাদিনের পরিশ্রমে ঘামের সঙ্গে আলু খেতের মাটি জড়িয়ে আছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, প্রকৃতির নিজস্ব লাবণ্যে উচ্ছলিত তনুরেখা। ভয় নেই ভাবনা নেই, চোখে-মুখে জীবনের হাসি।

বললে ঠাট্টা করে—সত্যি! বেশ হতো, এখন আফশোস হচ্ছে। ফাদার তাহলে আপনাকে ধরেছে? ভারি মজার তো!

এর মধ্যে মজাটা কোথায় স্টিয়েন?

লোকটা কে বলব? কাউকে বলবেন না বলুন? দিব্যি দিন!

দিলাম।

ওই গির্জেরই লোক। ফাদার পাওয়েলসের সহকারী ওই ছেলেটা, সে। চমকে উঠল ভিনসেন্ট। বললে—তুমি বলনি কাউকে বাড়িতে?

ছিঃ! তা বুঝি বলা যায়? তবে আপনি যে নন তা সকলেই জানে।

ভিনসেন্ট কুটিরের ভেতর গেল। আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তন নেই। অবিবাহিতা চাষির মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে, মেয়ে না হয়ে গোয়ালের গাভীটাও তো হতে পারত। ভিনসেন্টের প্রতি তাদের ব্যবহারও যেমন ছিল তেমনি। ভিনসেন্ট ধরতে পারল ওরা বুঝেছে সে এ জন্যে দায়ী নয়।

কিন্তু সারা গ্রামের কথা আলাদা। আড্রিয়ানা শাফরাথ স্টুডিয়োর দরজার ফাঁকে আড়ি পেতেছিলেন, প্রতিবেশীদের কানে কথাটা তুলে দিতে তাঁর একটুও সময় লাগল না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সারা নিউনেনের ছাব্বিশশো অধিবাসীর কাছে রাষ্ট্র হয়ে গেল যে ডি গ্রুটদের স্টিয়েন মেয়েটার পেটে ভিনসেন্টের বাচ্চা, ফাদার পাওয়েলস এখন মাথা ঘামাচ্ছেন কী করে দুজনের বিয়েটা সেরে ফেলা যায়।

বছর শেষ হয়ে আসছে। ভিনসেন্টের এবার যাবার পালা। নিউনেনে বসবাসের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখানে যা-কিছু আঁকবার সে এঁকেছে, কৃষাণজীবনের যা-কিছু জানবার সে জেনেছে। সারা গ্রাম জুড়ে তার বিরুদ্ধে জিঘাংসার যে-প্লাবন শুরু হয়েছে, এতে সে ডুবতে চায় না। সময় এসেছে তল্পি গোটাবার। কিন্তু এবার যাবে কোথায়?

দরজায় খুটখুট শব্দ। আড্রিয়ানা ঘরে ঢুকে বিষণ্নমুখে বলেন—মিনহার ভ্যান গক, ফাদার পাওয়েলসের হুকুম, আপনি এখুনি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও বাসা নিন।

আপত্তি করে না ভিনসেন্ট।—বেশ তো, তিনি যা চান তা-ই হবে।

পায়চারি করে বেড়ায় স্টুডিয়োর মধ্যে। পুরো দুটি বৎসরের অশ্রান্ত দাসত্বের ফল জমা হয়ে রয়েছে এখানে। তাঁতি আর তাঁতিনি, তাদের তাঁত আর মাকু, ঘর আর উঠোন, মাঠের কিষাণ-কিষাণী, বাগানের বেড়ার ছাঁটা গাছের সার, অরণ্যপ্রান্তরে সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আলো-ছায়ার পরিবর্তমান লীলা। কত ছবি, কত অসংখ্য স্কেচ, কত বিচিত্র বর্ণালি।

অবসাদে ভরে গেল মনের ধূসর এ-পার থেকে ধূসর ও-পার। টুকরো টুকরো ছবি। জীবন নেই, শুধু জীবনের টুকরো টুকরো পাতা। অনুভূতি আছে, নেই অনুভূতির সম্পূর্ণতা। ব্রাবান্টের কৃষাণকে সে চিনতে চেয়েছিল, চিনেছে তার টুকরো টুকরো অভিব্যক্তিকে, তার দিনযাপনের শত খণ্ডিত প্রচেষ্টাগুলি সে টুকে টুকে নিয়েছে। কিন্তু তাকে তো সে প্রকাশ করতে পারেনি তার সমগ্রতায়, যেখানে দিনান্তের কর্মশেষে ঘরে ফেরা, আপন হাতে মাঠের থেকে তুলে আনা গুঁড়ি আলু সেদ্ধ করে খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তির চরিতার্থতা, কৃষাণজীবনের শ্রম আর সার্থকতার সাধনা আর সাফল্যের পূর্ণ পরিচয়। ব্রাবান্টের কৃষাণকে নিয়ে অ্যাঞ্জেলাস সৃষ্টি করতে কই সে পারল? তার আগে কেমন করে সে বিদায় নেবে এখান থেকে?

ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখল—মাস শেষ হতে এখনও বারো দিন। আড্রিয়ানাকে ডেকে বললে—ফাদার পাওয়েলসকে বলবেন আমি পুরো মাসের ভাড়া দিয়েছি, অতএব মাস শেষ হলে তবে আমি যাব, তার আগে নয়।

ইজেল, রং, ক্যানভাস, তুলি সব গুছিয়ে নিয়ে ভিনসেন্ট চলল ডি গ্রুটের কুটিরে। কেউ তখন বাড়ি নেই। ঘরের ভেতরটার একটা পেনসিল স্কেচ করতে শুরু করল সে। পরিবারের সবাই ঘরে ফিরে এলে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল। টেবিলে গরম গরম সেদ্ধ আলু, বেকন আর কালো কফি সাজিয়ে চারিদিকে গোল হয়ে খেতে বসল ডি গ্রুটরা! ভিনসেন্ট ইজেলে ক্যানভাস সাজিয়ে আঁকতে আরম্ভ করল। সবাই যখন শুতে গেল তখন সে ফিরে এল বাড়িতে। সারারাত ওই ছবিটা নিয়ে খাটল। ঘুমিয়ে পড়ল সকালের দিকে। জেগে উঠে হিংস্র হতাশায় ছবিটি ছিঁড়ল কুটি কুটি করে। আবার চলল ডি গ্রুটদের আস্তানায়।

সন্ধ্যা বেলায় ওই আলু আর কফি খাওয়া, ওই ডি গ্রুটদের প্রাত্যহিক পরিশ্রমের ফসল। সারাজীবন ধরে অমনি একই ভঙ্গিতে টেবিলের ধারে বসে খেয়ে এসেছে, খাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। তারা চিরন্তন ওই কৃষিজীবী মাটির সন্তানের দল। তারা পরিশ্রমী, তারা সৎ, মাটির ধনকে তারা শ্রমের মূল্য দিয়ে তুলে আনে, অপরের ধনকে হরণ করবার জন্যে হানাহানি করে না। অকিঞ্চিৎকর তাদের লভ্য, তাতেই তারা খুশি। সততা ও শ্রমের এই সহজ জীবনছন্দ, একে রঙে রেখায় প্রকাশ করবে ভিনসেন্ট, করবেই করবে।

ক্যানভাসের ওপর ত্বরিত গতিতে রং চড়ানোর অভ্যাসটা এবার কাজে লাগল। প্রচণ্ড বেগে সে কাজ করে চলল। ভাববার সময়টুকু দিতে সে রাজি নয়—এমনি কৃষাণ, তার কুটির আর তাদের দিনান্তের জটলা তো সে এর আগে হাজার হাজার এঁকেছে।

স্টিয়েনের মা বললে—ফাদার পাওয়েলস আজ এখানে এসেছিলেন। চমকে ভিনসেন্ট শুধোলে—কেন? কী দরকারে?

এই বলতে যে, আমরা যদি আপনাকে আমাদের ছবি আঁকতে না দিই তো তিনি টাকা দেবেন আমাদের।

আর, আপনি কী বললেন?

আমি বলেছি আপনি আমাদের বন্ধু।

স্টিয়েন আরও খবর দিল—এখানকার প্রত্যেক চাষির বাড়ি আজ তিনি ঘুরেছেন। কিন্তু সবাই তাঁকে এক উত্তরই দিয়েছে। আপনার জন্যে ‘পোজ’ করে বরং একটা আধলা তারা নেবে তবু তাঁর ভিক্ষের টাকা কেউ ছোঁবে না।

পরদিন সে আবার ক্যানভাসটা ছিঁড়ল। এ কি ব্যর্থ শ্রম! এ কি ক্লীবত্ব! কিন্তু আর মাত্র দশটি দিন বাকি। তারপর নিউনেন ছেড়ে চলে যেতেই হবে। মিলেটের কাছে তার নীরব প্রতিশ্রুতি তাকে যে রাখতেই হবে!

প্রত্যেক রাত্রে সে ডি গ্রুটদের বাড়ি যেতে লাগল। ওরা টেবিলে বসে বসে যতক্ষণ না ঘুমে ঢুলে পড়ে, ততক্ষণ সে কাজ করতে লাগল। রং নিয়ে ভঙ্গি নিয়ে মূল্যবোধ নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল প্রতি রাত্রে ভোর না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু দিনের আলোয় ফাঁকি ধরা পড়ে, প্রকাশ হয়ে পড়ে অসম্পূর্ণতা।

মাসের শেষ দিন। উন্মাদের মতো অবস্থা ভিনসেন্টের। বিনিদ্র রক্তচক্ষু, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। প্রচণ্ড একটা স্নায়বিক তাড়না তাকে খাড়া করে রেখেছে, ছুটিয়ে চলেছে অবিশ্রান্ত প্রতিটি মুহূর্তে। যতবার সে ব্যর্থ হচ্ছে, তীব্রতর হচ্ছে এই তাড়না। ইজেল সাজিয়ে রং গুলে সে প্রতীক্ষা করতে লাগল, কখন ডি গ্রুটরা মাঠ থেকে ফিরবে। আজ শেষ চেষ্টা। কাল সকালে নিউনেনের পাট তার উঠবে, চিরদিনের মতো।

নিঃশব্দে সে কাজ করে চলল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডি গ্রুন্টরাও বুঝল, খাওয়া শেষ হবার পর তারা টেবিল ছেড়ে উঠল না, বসে রইল হাত গুটিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চুপি চুপি কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে। যন্ত্রের মতো সে কাজ করে চলেছে, আঙুল ছুটছে নিশি-পাওয়ার মতো। কী সে আঁকছে, কোন রং সে চড়াচ্ছে তার যেন কোনো বোধ নেই, চেতনা নেই। দশটা বেজে গেল। ঘুমে ঢুলে এল সারাদিনের কর্মক্লান্ত কৃষাণ-কৃষাণীদের চোখ। ভিনসেন্টের সারা অঙ্গও যেন ক্লান্তিতে ভেঙে এল। উঠে পড়ল সে, গুছিয়ে নিল জিনিসপত্র। বিদায় নিল সে নিউনেনের এই পরম বন্ধু পরিবারের সকলের কাছ থেকে, স্টিয়েনকে করল চুম্বন। পথে বার হয়ে স্টুডিয়োর দিকে হাঁটতে লাগল যন্ত্রচালিতের মতো।

স্টুডিয়োতে ফিরে এসে ক্যানভাসটা একটা চেয়ারের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখল। পাইপটা ধরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করল তার এই শেষ সন্ধ্যার কাজ। ভুল, সব ভুল হয়েছে। কিছুই হয়নি, আসল অনুভূতিটাই তাকে ফাঁকি দিয়ে দূরে সরে গেছে, প্রকাশকে এড়িয়ে গেছে উপলব্ধি। আবার তার হার। ব্যর্থ তার ব্রাবান্টের পূর্ণ দু-বছরের পরিশ্রম।

পাইপের তামাকটা শেষ পর্যন্ত সে টানল। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল ব্যাগের মধ্যে। ছবিগুলো ভরল একটা কাঠের বাক্সে। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

এমনিভাবে কতক্ষণ সময় কেটেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ চমক লাগার মতো সে উঠে বসল। ক্যানভাসটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ইজেলের ফ্রেমে নতুন একটা ক্যানভাস পরাল। নতুন রং গুলে আবার কাজ আরম্ভ করল।

প্রকৃতিকে শুধু অনুকরণ করবার জন্যে শিল্পী যত উন্মাদের মতো তার পেছনে ছোটে, ততই সে ভুল করে, প্রকৃতি ততই এড়িয়ে যায়, দূরে সরে যায়। কিন্তু শিল্পী যখন তার সমস্ত উপলব্ধিকে সংগ্রহ করে রঙে আর রেখায় তার সমস্ত অনুভূতি মিশিয়ে আঁকে, প্রকৃতি তখনই হার মানে, কাছে এসে ধরা দেয়। মনে পড়ল পিটারসেনের উপদেশ। সে বড়ো কাছে পেতে চেয়েছিল প্রকৃতিকে, বড়ো কাছাকাছি বসিয়েছিল তার মডেলকে। তাই সে পারেনি, যতবার সে এঁকেছে, চিত্রবস্তুর আকার সম্বন্ধেই সঠিক সচেতনতা তার হয়নি। আর এই মৌলিক বিভ্রান্তিকে কাটাতে পারেনি বলেই সব ভুল হয়েছে তার। প্রকৃতির ছাঁচে নিজের শিল্পকর্মকে ঢালতে গিয়েছিল, ব্যর্থ হয়েছে। এবার সে প্রকৃতিকে ঢেলে দেখবে নিজের শিল্পকর্মের ছাঁচে।

রং? মূল রংটিকে সে আবিষ্কার করল এতদিনে, জমি থেকে সবে তোলা ধুলোমাটি-মাখা নধর একটি আলুর মেটে রং। সব ছবিটি সে আঁকল এতদিনের দেখার এতদিনের অভ্যাসের জীবন্ত স্মৃতি থেকে। ধোঁয়া আর ঝুল পড়া ধূসর দেয়াল, মলিন টেবিলক্লথ, কুটিরের কালো কাঠের বরগা থেকে ঝুলছে তেলের একটা সেজ। স্টিয়েন সেদ্ধ আলু পরিবেশন করছে, মা কেটলি থেকে কালো কফি ঢালছে, ভাই মুখে ধরেছে একটা পেয়ালা। প্রত্যেকের মুখের ভাবে এই অপরিবর্তনীয় জীবনধারার শান্ত সহজ স্বীকৃতি।

প্রভাতসূর্য উঠল পূর্ণ আকাশে, জানলা দিয়ে স্টুডিয়োর ঘরে এল তার প্রথম আভা। ভিনসেন্ট তুলি রেখে টুল থেকে উঠে দাঁড়াল। গত বারো দিনের নিত্য–নিয়ত উত্তেজনার অবসান। সারা মন জুড়ে এই প্রত্যুষের মতো শান্তি। চোখ মেলে ভালো করে তাকাল কৃতকর্মের দিকে, দেখল পুঙ্খানুপুঙ্খ করে। বেকন আর কফি আর গরম আলুর ধোঁয়াটে গন্ধ ঠিক যেন ছবিটা থেকে ভেসে উঠে নাকে এসে লাগছে। সাফল্যের খুশিতে বুক ভরে গেল তার। তার অ্যাঞ্জেলাস সে এঁকেছে। পরিবর্তমান জীবনলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিরন্তনকে সে বেঁধেছে শিল্পের স্বর্ণসূত্রজালে। অবিনশ্বর হয়ে রইল ব্রাবান্টের কৃষাণ, চিরকাল, চিরদিন।

ডিমের সাদা অংশ দিয়ে সে ছবিটার ওপর ভালো করে ‘ওয়াশ” দিল। পুরোনো ছবিভরতি বাক্সটা সে মার কাছে রেখে এল, সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়ে এল তাঁর কাছ থেকে। স্টুডিয়োতে ফিরে ক্যানভাসটার নীচে লিখল, ‘আলুভোজীরা’। এটার সঙ্গে আর কয়েকটা খুব পছন্দসই স্টাডি ব্যাগের মধ্যে পুরে নিয়ে সে বার হল ঘর ছেড়ে।

নিউনেনের পালা ফুরোল। এবার চলো প্যারিস… প্যারিস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *