সুখের সংসার ডট কম

সুখের সংসার ডট কম

ভোরের আলো ফুটেছিল অনেক আগেই, কিন্তু সেটা দেখেও বিছানা ছেড়ে উঠতে চাননি লাবণ্য। কেমন একটা আলসেমি ওঁকে জড়িয়ে ধরেছিল আজ। রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোন তার জন্য একটা ঝিমুনিভাব থাকেই, কিন্তু গত রাতে কয়েকটা স্বপ্ন কেমন একটা বাড়তি ঘুমের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। স্বপ্নের গল্পগুলো মনে নেই, তবে তাতে প্রমথনাথকে যে দেখেছেন, সেটা মনে আছে।

স্বামী প্রমথনাথ চলে গেছেন প্রায় আটবছর। একটা অভাব তার জন্য থাকবেই সেটা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু অন্য আরও যেসব অভাবের গল্প নানানজনের কাছে শোনেন…।

মা, উঠে পড়ুন…অনেক বেলা হয়ে গেছে।

ঘরে ঢুকে পড়েছে মধুমিতা–এ-বাড়ির একমাত্র বউ। মিষ্টি মুখ, স্বভাবও। রোগা তরতরে চেহারা। সবসময় একাজ সে কাজ নিয়ে ছটফট করছে। এখন পুবের জানলাদুটোর পরদা সরিয়ে দিল। তারপর খুলে দিল পুবের ঝুলবারান্দার দরজা।

সঙ্গে-সঙ্গে কত কী যে ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে! পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ, হুটোপুটি রোদ্র। প্রমথনাথের এগুলো খুব প্রিয় ছিল। বড় শখ করে পুবের এই বারান্দা তৈরি করেছিলেন। সূর্য উঠলে প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়বে বারান্দায়, এবং সেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যস্তবের মন্ত্র আওড়াবেন প্রমথনাথ।

তিনবছর চুটিয়ে শখ মিটিয়েছিলেন। তারপর চলে গেলেন। এখন লাবণ্যর এই ঘরের মার্বেল পাথরের মেঝে থেকে আলো ঠিকরে পড়ে দেওয়ালে। সেখানে টাঙানো আছে প্রমথনাথের রঙিন ফোটো। এভাবেই ভোরের আলোর শখ মিটছে মানুষটার। হয়তো মনে-মনে আওড়াচ্ছেন সূর্যস্তবের মন্ত্র। কে জানে!

মুখটা ধুয়ে নিন, মা, আমি চা করে নিয়ে আসছি।

শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। লাবণ্য জড়ানো গলায় বললেন। ধীরে-ধীরে উঠে বসলেন বিছানায়।

সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় ছুটে কাছে চলে এল মধুমিতা। লাবণ্যর কপালে-গালে হাত রাখল : কই, জ্বর তো নেই! ঠিক আছে, ডক্টর মুখার্জিকে একবার কল করে দিচ্ছি। ওঁকে বলছি।

মধুমিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ল দীপ্তিমান। চুল উশকোখুশকো, পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা। ফরসা চেহারা, ভারী গাল, গেঞ্জির গলার বৃত্তচাপের ওপর দিয়ে লোমশ বুক উঁকি মারছে।

ঘরে ঢুকেই সটান মায়ের কাছে চলে এল দীপ্তিমান। পা ছুঁয়ে প্রণাম করল মা-কে। তারপর বিছানায় বসে পড়ল।

দীপ্তিমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন লাবণ্য, বললেন, তোর যে কী এক ছেলেমানুষি স্বভাব। রোজ-রোজ প্রণাম করার কী আছে!

দীপ্তিমান হেসে বলল, ও তুমি বুঝবে না, মাদার। সকালবেলা তোমাকে প্রণাম করে আমি সারাদিনের কাজের এনার্জি পাই।

মধুমিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিল। চট করে লাবণ্যকে প্রণাম করে ফেলল ও।

লাবণ্য বললেন, দ্যাখ তো, দিপু, তুই প্রণাম করিস বলে বউমাকেও প্রণাম করতে হয়। তোরা এখনও সেকেলে রয়ে গেলি!

কী যে বলো, মা। তোমার পা ছুঁয়েই কি আধুনিক হওয়া যায়! আধুনিক হওয়া কী এতই সহজ ব্যাপার।

মধুমিতা দীপ্তিমানকে বলল, অ্যাই, ডক্টর মুখার্জিকে একবার কল করে দাও মায়ের শরীরটা ভালো নেই।

সে কী! প্রায় আঁতকে উঠল দীপ্তিমান। লাবণ্যর কপালে হাত দিয়ে উষ্ণতা আঁচ করতে চাইল। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, আমি এক্ষুনি ডক্টর মুখার্জিকে রিং করছি। উনি কলে বেরোনোর আগে আমাদের এখানে হয়ে যাবেন। তুমি আয়া-মাসিকে বোলো সবসময় মায়ের কাছে-কাছে থাকতে।

লাবণ্যর ঘর ছেড়ে ড্রইং-ডাইনিং-এ গেল দীপ্তিমান। টেলিফোনটা সে-ঘরে একটা কর্নার টেবিলে রাখা আছে।

রিসিভার তুলে নম্বরের বোতাম টিপতে টিপতে ও চেঁচিয়ে মধুমিতাকে বলল, আজ আমি একটু আর্লি অফিসে বেরোব–অ্যাবাউট সাড়ে আটটায়। আর বাবুনকে ঘুম থেকে তুলে দাও। নইলে ওর স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।

মধুমিতা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে ছুটল। চায়ের জল বসিয়ে বাবুনকে চটপট ডেকে তুলতে হবে।

আয়া-মাসি সারদা টয়লেটে গেছে। ও লাবণ্যর সবসময়ের সঙ্গী। অল্পবয়েসে স্বামী হারিয়েছে। গরিব হলেও চেহারায় একটা আভিজাত্যের প্রলেপ রয়েছে। ভীষণ কম কথা বলে। আর সেইজন্যই লাবণ্যর ওকে বেশি ভালো লাগে। লাবণ্যর যে-কোনও প্রয়োজন সারদা যেন টেলিপ্যাথিতে টের পায়। ওকে ছাড়া লাবণ্য বেশ অসহায় বোধ করতেন।

মধুমিতা চা দিয়ে গেল লাবণ্যকে। বলল, মা, চুমুক দিয়ে দেখুন তো ঠিক আছে কি না।

লাবণ্য শব্দ করে চুমুক দিলেন। তৃপ্তির একটুকরো শব্দ বেরিয়ে এল ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। বোঝাই যায় না চিনির বদলে স্যাকারিন দিয়ে তৈরি। ইকোয়াল না কী নাম যেন। প্রথম-প্রথম বিস্বাদ লাগত ডাক্তারের কথা মানতে ইচ্ছে করত না। এখন সয়ে গেছে।

চা খাওয়ার সময় প্রথমনাথকে মনে পড়ে। পুবের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে দুজনে চা খেতেন। চুমুকে শব্দ হলেই প্রমথনাথ বিরক্ত হয়ে বলতেন, কী যে বিশ্রী শব্দ করে চা খাও! চা খাবে, কোনও শব্দ হবে না–এটা এটিকেট।

লাবণ্য হাসতেন। বলতেন, যতই এটিকেট হোক, চায়ে চুমুকের শব্দটাই হচ্ছে আসল! ও না হলে আমেজ আসে! শব্দ না করে চা খাওয়া মানে মনে-মনে চা খাওয়া।

স্মৃতিবিধুর হাসি লাবণ্যর ঠোঁট ছুঁয়ে গেল। মধুমিতাকে বললেন, চা-টা দারুণ হয়েছে।

মধুমিতা বলল, সেটা আপনার মুখের হাসি দেখেই বুঝেছি। আমি যাইবাবুনকে রেডি করি গিয়ে। পরে এসে জেনে যাচ্ছি আজ আপনার কী-কী রান্না খেতে ইচ্ছে করছে।

মধুমিতা প্রায় দৌড়ে চলে গেল।

লাবণ্য ওর চলে যাওয়া দেখতে-দেখতে ভাবলেন, বউমা তো নয়, মেয়ের চেয়েও বেশি! সারাদিন শুধু মা আর মা!

সারদা ঘরে এল। বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারটাকে ঠিকঠাক করে গুছিয়ে দিল। লাবণ্য রোজ এই চেয়ারে বসে চা খাওয়া শেষ করেন। সেই ফাঁকে সারদা বিছানাটা তুলে পরিপাটি করে দেয়।

লাবণ্য ইজিচেয়ারে বসে চা খাওয়া শুরু করতেই দীপ্তিমান মায়ের কাছে এল।

মা, ডক্টর মুখার্জি ঠিক সাড়ে নটায় আসবেন। আমি তো অফিসে বেরিয়ে যাব মিতা থাকবে। তোমার কী কী কষ্ট হচ্ছে ডক্টর মুখার্জিকে ফ্র্যাঙ্কলি বলবে। আমি দশটা নাগাদ অফিস থেকে ফোন করে খবর নেব।

পাকানো লাঠির মতো খবরের কাগজটা বারান্দায় ছিটকে এসে পড়ল।

দীপ্তিমান ওটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে লাবণ্যর হাতে দিল।

লাবণ্য বললেন, তুই আগে চোখ বুলিয়ে নে না–অফিসে বেরোবি…।

না, তুমি আগে পড়ো। আমি পরে সময় পেলে দেখব।

লাবণ্য এক অদ্ভুত তৃপ্তি পেলেন। প্রমথনাথ চলে যাওয়ার পরেও দিপু বা মধুমিতা লাবণ্যর সিংহাসনে এতটুকু চিড় ধরতে দেয়নি।

দীপ্তিমান চলে যাওয়ার সময় সারদাকে বলল, মাসি, আপনি মায়ের কাছে কাছে থাকবেন। ছেড়ে এদিক-ওদিক যাবেন না। শুনলেন তো, মায়ের শরীরটা ভালো নেই।

সারদা ঘাড় নাড়ল।

লাবণ্য আলতো করে বললেন, না, না–সেরকম সিরিয়াস কিছু নয়।

দীপ্তিমান বলল, সিরিয়াস কি না সেটা ডাক্তারবাবু বুঝবেন। কোনও শরীর খারাপকেই হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়।

দীপ্তিমান চলে গেলে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল লাবণ্যর ঠোঁটে। এই বয়েসে এরকম সুখী জীবনের কথাই কল্পনা করে সবাই–তবে কেউ পায় কি না কে জানে! লাবণ্য পেয়েছেন। ছেলে, ছেলের বউ, নাতি, মেয়ে, জামাই, নাতনি সব্বাই যেন লাবণ্যকে ঘিরে রয়েছে সূর্যকে ঘিরে পাক খাওয়া গ্রহের মতো। সূর্যকে টুক করে সরিয়ে নিতে যদি কেউ পারে, তা হলে গ্রহগুলো সেই মুহূর্তে ওদের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে ছত্রখান হয়ে যাবে। সেইজন্যই ওদের কাছে সূর্যের এত কদর।

লাবণ্যও কি অনেকটা সেইরকম?

মনে-মনে ভগবানকে প্রণাম করলেন লাবণ্য। এ অপরূপ সুখ তারই দান।

একটু পরে চা খাওয়া শেষ হল, খবরের কাগজ পড়াও।

সারদা ঘরে গিয়ে ট্রানজিস্টার রেডিয়োটা নিয়ে এল। ও জানে, লাবণ্য এখন রোজকার মতো এফ. এম. চ্যানেল শুনবেন। বাইরের রাস্তা দেখবেন, দেখবেন গাছের পাতা, ফুল, পাখি। আর একইসঙ্গে বোধহয় পুরোনো কথাও ভাববেন।

একটু পরে দীপ্তিমান বাবুনকে সঙ্গে নিয়ে অফিসে বেরোবে। অফিসে যাওয়ার পথে ওর গাড়ি বাবুনকে স্কুলে নামিয়ে দেবে। আর দুপুরে ছুটির সময় মধুমিতা গিয়ে ওকে নিয়ে আসবে।

সকালে এই সময়টা স্মৃতিচারণ করতে বেশ ভালো লাগে লাবণ্যর। বিয়ের পরপর হঠাৎই প্রমথনাথের চাকরি চলে গিয়েছিল। লোকসান দিয়ে দিয়ে কোম্পানি ডকে উঠেছিল। তারপর কী কষ্ট, কী কষ্ট! প্রমথনাথ বললেন, আর চাকরি করবেন না ব্যবসা করবেন।

কম করেও বারোটা বছর চলল লড়াই আর লড়াই। দীপ্তিমান আর অনুরিতা বড় হয়ে উঠতে লাগল। দুঃখ-কষ্ট কেটে গিয়ে সচ্ছলতা ধীরে-ধীরে ঢুকে পড়তে শুরু করল সংসারে। ঠাকুরকে দিনরাত কত ডেকেছেন লাবণ্য! লুকিয়ে লুকিয়ে কত চোখের জল ফেলেছেন।

আজ আর-একবার মনে হল, সেগুলো বৃথা যায়নি। লাবণ্যর জীবন-পাত্র থেকে মাধুরী সত্যিই যেন উথলে পড়ছে।

দীপ্তিমান আর বাবুন কখন এসেছে লাবণ্য টের পাননি। সারদার হঠাৎ ঘোমটা টানা থেকে ব্যাপারটা আঁচ করতে না করতেই বাবুন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোলে। লাবণ্যর দু-গালে টপ-টপ করে চুমু খেয়ে বলল, দিদুন, টা-টা..স্কুলে যাচ্ছি। রাতে হোমওয়ার্ক কমপ্লিট হলে তোমার কাছে গোস্ট স্টোরি শুনব, ও. কে.?

ওকে চুমু খেয়ে লাবণ্য ইংরেজি ঢঙে বলতে চেষ্টা করলেন, ও. কে.।

ঠিক দীপ্তিমানের মতোই সুন্দর আর দুরন্ত হয়েছে ছেলেটা।

 দীপ্তিমান বলল, মা, অফিসে বেরোলাম। ডক্টর মুখার্জি ঠিক সাড়ে নটায় আসবেন।

লাবণ্য হেসে তাকালেন ছেলের দিকে। সবসময় সবদিকে এত খেয়াল! ঠিক বাবার স্বভাব পেয়েছে।

ওরা চলে যেতেই লাবণ্য উঠে পড়লেন। এখন হাত-মুখ ধোওয়া, বাথরুম ইত্যাদি সেরে নেবেন। তারপর জলখাবার। বাবুন এই শব্দটা শুনলেই বলে, দিদুন, তুমি একটা হোপলেস ব্রেকফাস্ট বলতে পারো না!

মধুমিতা ছেলেকে ডাক দেয় সঙ্গে-সঙ্গে : বড়দের সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে! তা ছাড়া জলখাবার বলো আর ব্রেকফাস্ট বলো, খাবারটা তো একই থাকবে!

বাবুন বলে, সরি, দিদুন…।

মনে-মনে হাসলেন লাবণ্য। সুখের যে কতরকম চেহারা থাকে!

.

ব্রেকফাস্ট শেষ করার কিছুক্ষণ পরেই অনুরিতার ফোন এল।

 হাই মাম্মি, হাউ আর য়ু?

ভালো, তুই কেমন আছিস?

ভালো, তবে গুডডুটা দিনকে দিন ভীষণ দস্যি হয়ে উঠছে–সে তুমি ভাবতে পারবে না।

বেশ কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বললেন লাবণ্য। সকলের খোঁজখবর নিলেন। তবে নিজের গা ম্যাজম্যাজ করার কথা বললেন না–বললে অনু ব্যস্ত হয়ে উঠবে। হয়তো এক্ষুনি বালিগঞ্জের ফ্ল্যাট ছেড়ে ছুটে আসবে এখানে।

এই হাই মাম্মি-টাম্মিগুলো অনুর বিয়ের আগে ছিল না–পরে হয়েছে। লাবণ্য এ নিয়ে ওকে একদিন ঠাট্টাও করেছিলেন। তাতে অনু বলেছিল, কী করব বলো! আমার বরটা যে সাহেব কোম্পানির টপ এক্সিকিউটিভ! তা ছাড়া তিন-চারবার স্টেটু ঘুরে এসে আমারও কেমন অভ্যেস হয়ে গেছে।

লাবণ্য হেসেছিলেন। ওঁর ছেলে আর মেয়ে বড় হয়েও কেমন ছেলেমানুষ রয়ে গেল।

অনুরিতা রোজ এ সময়টাতেই ফোন করে। আর প্রতি রবিবার সন্ধের সময় অরুণাভ আর গুডুকে নিয়ে লাবণ্যর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বলে, উইকে একবার তোমাকে সামনাসামনি না দেখলে ভীষণ মনখারাপ লাগে। আর গুডুও বায়না করে বলে, দিদুনের কাছে যাব।

অনুরিতার ফোন শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ডক্টর মুখার্জি এলেন। ভালো করে লাবণ্যকে পরীক্ষা করলেন। মধুমিতা ওঁদের কাছে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত মা-পায়রার মতো ছটফট করছিল।

পরীক্ষা শেষ করে ডক্টর মুখার্জি হেসে বললেন, কিছু হয়নি। আপনারা শুধু-শুধু উয়ারিড হয়ে পড়েছেন। বুকে সামান্য কফ আছে। এই সিরাপ আর ট্যাবলেটটা লিখে দিলাম। ইন্সট্রাকশন মতো খাওয়াবেন। ব্যস নিশ্চিন্ত।

ডক্টর মুখার্জি চলে যাওয়ার পর মধুমিতা হাঁফ ছাড়ল? উঃ, যা চিন্তায় পড়েছিলাম! আপনার কিছু হলেই আমার দুশ্চিন্তা হয়।

কথাটা সত্যি। লাবণ্যর কিছু হলেই দিপু আর মধুমিতা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে লাবণ্যকে ঘিরে ধরে। অনুরি-অরুণাভ জানতে পারলেও সেই একই ব্যাপার।

ঠিক দশটায় দীপ্তিমান ফোন করে লাবণ্যর খবর নিল।

মধুমিতা যখন জানাল, ব্যাপারটা মোটেই সিরিয়াস কিছু নয়, তখন ও বলল, থ্যাংক গড। তুমি ওষুধগুলো এক্ষুনি আনিয়ে নাও।

তারপর আরও দু-চারটে কথা বলে মা-কে ফোন দিতে বলল।

 কর্ডলেসের রিসিভারটা লাবণ্যর হাতে তুলে দিল মধুমিতা, বলল, আপনার ছেলে।

মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল দীপ্তিমান। তারপর ফোন রেখে দেওয়ার সময় বলল, ফিরতে ফিরতে আমার সাতটা হবে।

মধুমিতা বলল, যাই, আপনার ওষুধগুলো আনানোর ব্যবস্থা করি।

লাবণ্য এবার টিভি দেখবেন। সারদা সেটা জানে। তাই ও টিভির সুইচটা অন করে দিয়ে রিমোটটা লাবণ্যর হাতে এনে দিল।

বাবুন আর দীপ্তিমান বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটা বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। লাবণ্যর এটা ভালো লাগে না। তাই সবসময় রবিবারের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। সেদিনটা দারুণ হইহই করে কাটে।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর দীপ্তিমানের দুটো শার্ট নিয়ে বসলেন লাবণ্য। একটায় বোতাম বসাতে হবে, অন্যটায় দুটো বোতাম-ঘর তৈরি করতে হবে। রেডিমেড শার্টগুলোর কবজির কাছটা যা ঢিলে থাকে!

নাকের ওপরে সোনালি ফ্রেমের চশমা বসিয়ে উঁচ-সুতো কঁচি নিয়ে কাজ করছিলেন লাবণ্য। সেলাই করতে ওঁর ভালোই লাগে। অল্পবয়েসে সেলাইয়ের শখ ছিল। প্রমথনাথের প্রশংসাও পেয়েছেন বহুবার। তাই এখনও বাড়ির সমস্ত সেলাই-ফেঁড়াইয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে ভালোবাসেন। মধুমিতাও বলে, মায়ের মতো সেলাই আমি জীবনেও করতে পারব না! আচ্ছা-আচ্ছা দরজি মায়ের কাছে হার মেনে যাবে।

কিছুক্ষণ সেলাইয়ের পর চোখে একটু কষ্ট হচ্ছিল। তাই সেলাই রেখে লাবণ্য বিশ্রাম নিতে চাইলেন। সারদার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। ও বিছানাটা ঠিকঠাক করে দিল।

বিছানায় শরীর গড়িয়ে লাবণ্য বেশ আরাম পেলেন। অথচ একটা সময় ছিল যখন দুপুরে মোটেই ঘুমোতেন না। সময় নিজেও বদলায়, মানুষকেও বদলায়।

ঘুম যখন ভাঙল তখন বিকেল প্রায় গড়িয়ে গেছে। সারদাকে বললেন, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, আমাকে ডাকোনি!

সারদা মিনমিন করে বলল, আপনার শরীরটা ভালো নয়…বিশ্রাম দরকার…তাই…।

বিকেলের চা নিয়ে আবার বারান্দায় বসলেন।

মধুমিতা বাবুনকে নিয়ে কাছেই পার্কে গেছে। ছটা নাগাদ ফিরবে।

বিকেলের আকাশের রং দেখতে লাবণ্যর ভালোই লাগছিল। একটা বিকেল মরে যায় পরদিন একটা নতুন সকাল জন্ম নেবে বলে। নতুন একটা দিন এসে আগের দিনটাকে স্মৃতিকোঠায় ঠেলে দেয়।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেওয়ার আগেই শুনলেন একতলায় বাবুনের হইচই। পার্কে বেড়ানো সেরে মধুমিতা আর বাবুন ফিরে এসেছে।

লাবণ্য ঘরে চলে এলেন। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে দুদ্দাড় করে ঘরে ঢুকল বাবুন। ছুটে এসে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরল ও দিদুন, দিদুন, বলো তো তোমার জন্যে কী এনেছি?

ছাড়, ছাড় পড়ে যাব… বলতে-বলতে লাবণ্য কোনওরকমে বিছানায় গিয়ে বসলেন।

বাবুন একটা ক্যাডবেরি চকোলেট বাড়িয়ে দিল লাবণ্যর দিকে ও বলতে পারলে না তো! এই নাও…।

মধুমিতা হেসে বলল, নিজে চকোলেট কেনার বায়না ধরল। তারপর কেনার সময় বলে, দিদুনের জন্যেও একটা কিনতে হবে নইলে আমি চকোলেট খাব না। তখন…।

লাবণ্য বাবুনের চিবুকে হাত দিয়ে আদর করলেন। চকোলেটের মোড়ক ছাড়িয়ে একটুকরো ভেঙে নিলেন। তারপর বাকিটা নাতির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও, বাবুসোনা। আমি তো বুড়ো মানুষ–তাই বেশি চকোলেট খেতে নেই।

বাবুন চকোলেটটা নিয়ে বলল, তোমাকে চকোলেট দিলাম, থ্যাংক য়ু বলো!

ও হ্যাঁ, হ্যাঁ–থ্যাংক য়ু, বাবুসোনা।

মধুমিতা বলল, এখন ওকে নিয়ে গিয়ে হোমটাস্কে বসাই। সাড়ে সাতটার সময় আপনাকে চা করে দেব।

দিদুন, হোমটাস্ক হয়ে গেলে গোস্ট স্টোরি–মনে থাকে যেন!

 লাবণ্য হেসে মাথা নাড়লেন : হ্যাঁ রে বাবা, মনে আছে।

বাবুন পড়তে চলে যাওয়ার পর লাবণ্য আবার দীপ্তিমানের শার্ট নিয়ে বসলেন। সেলাইয়ের কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে।

কিন্তু সেলাই করতে করতে একটা অঘটন ঘটল।

কীভাবে যেন ছুঁচটা ফুটে গেল লাবণ্যর আঙুলে। বাঁ-হাতের তর্জনীর ডগায় রক্তের ফোঁটা দেখা দিল–ঠিক যেন একটা ছোট্ট চুনি।

সারদা তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এল পরিচর‍্যা করতে। আসার সময় একটা ছোট টেবিলে সামান্য ধাক্কা খেল। একটা স্টিলের বাটি টেবিল থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। ঝনঝন করে শব্দ হল।

সঙ্গে-সঙ্গে মধুমিতা দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।

কী হয়েছে, মা! কী পড়ল?

বিছানায় বসে থাকা লাবণ্যর আঙুলের দিকে তাকিয়ে মধুমিতা একেবারে আঁতকে উঠল। লাবণ্যর আঙুলটা চট করে টেনে নিল মুখে। খানিকটা রক্ত চুষে বের করে দিল। তারপর ছুটল স্যাভলন মলম আর ব্যান্ড-এইড নিয়ে আসতে। বারবার বলতে লাগল, সন্ধেবেলা কেন যে সেলাই নিয়ে বসলেন! দেখুন তো, কী সব্বনেশে কাণ্ড হল!

লাবণ্যর আঙুলটা ব্যান্ডেজ করেই দীপ্তিমানকে অফিসে ফোন করল মধুমিতা। সব শুনে। দীপ্তিমান বলল, ও মাই গড! আমি এক্ষুনি বাড়ি আসছি।

তারপর সে এক হইহই কাণ্ড।

ছেলে, ছেলের বউ, নাতি, সারদা, ডাক্তার! অনুকে ব্যাপারটা জানাতে বারণ করলেন লাবণ্য।

সত্যি, একফোঁটা রক্তের জন্য এত উৎকণ্ঠা, এত যত্ন, এত ভালোবাসা! না, না, লাবণ্যর আর কিছু চাই না। প্রমথনাথের ছবির দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বললেন, তুমি সব দেখছ তো! আমার কোনও দুঃখ নেই।

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল হুলস্থূল।

ছেলের কথায় সেলাই-ফেঁড়াই বন্ধ করতে হল লাবণ্যকে। মধুমিতাও ওঁকে কম-বেশি বকুনি দিল।

এই শাসন যে কী মধুর!

রাত দশটায় রাতের খাওয়া শেষ হলে লাবণ্যকে বলে মধুমিতা আর দীপ্তিমান ওদের ঘরে চলে গেল। বাবুন ভূতের গল্প শুনে দিদুনের গালে চুমু দিয়ে গুডনাইট বলে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে গেল।

সারদা লাবণ্যর শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। তারপর মেঝেতে নিজের বিছানা পাততে শুরু করল।

একটা দিন শেষ হল।

বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাবণ্য আচমকা হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। ওঁর বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। শরীরটা বারবার ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল।

সারদা একবার লাবণ্যর দিকে দেখল, তারপর নিজের মনেই বিছানা করতে লাগল–যেন কিছুই হয়নি। কারণ, এটা রোজকার ব্যাপার-সারদার সয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর কান্না সামলে উঠে দাঁড়ালেন লাবণ্য। চোখের জল মুছে ঘরের দরজার দিকে এগোলেন।

সারদা হাঁটুগেড়ে বসে বিছানা ঠিক করছিল, আলতো করে জিগ্যেস করল, কোথায় যাচ্ছেন, মা?

পিছন ফিরে না তাকিয়েই লাবণ্য বললেন, কম্পিউটার রুমে।

 সারদা আর কোনও কথা বলল না।

.

লম্বা বারান্দা ধরে হেঁটে দোতলার শেষ প্রান্তের ঘরটায় এসে পৌঁছলেন লাবণ্য।

ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, সেটা ঠেলে খুললেন। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোর একটা চিলতে ছিটকে ঘরে ঢুকে অন্ধকার মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

বাইরে নরম বাতাস বইছিল–তাতে বোধহয় একপশলা বৃষ্টির গন্ধও ছিল। লাবণ্য একটা শ্বাস নিলেন, তারপর মন শক্ত করে ঘরের আলো জ্বাললেন।

কথা-বলা পুতুলগুলো ঘরের একপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে।

মধুমিতা, দীপ্তিমান, বাবুন, ডক্টর মুখার্জি, অনুরিতা, অরুণাভ, গুডু–সবাই হাজির। চেহারায় মানুষের মতো কথা-বলা এই রোবটগুলো লাবণ্য একটা কম্পিউটার কোম্পানিকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছেন। তাদের আচার-ব্যবহার কেমনতরো চান সেটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন সেই কোম্পানিকে। তারা লাবণ্যর পছন্দসই সফ্টওয়্যার ঢুকিয়ে দিয়েছে এই অ্যানড্রয়েডগুলোর ভেতরে। ফলে সারাটাদিন এই নকল মানুষগুলো প্রোগ্রাম অনুযায়ী কথা বলে, হাঁটা-চলা করে। এই রোবটগুলোর ভেতরে সপ্তাহের সাতটা দিনের জন্য সাতরকম প্রোগ্রাম ভরা আছে। যখন ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে যায় তখন লাবণ্য সেই কোম্পানিকে একটা ই-মেইল করে দেন। যেমন এখন করবেন।

ঘরের দেওয়াল-ঘেঁষে রাখা কম্পিউটার টেবিল। তাতে সাজানো রয়েছে মনিটর, স্পিকার, কিবোর্ড, মাউস, সিস্টেম ইউনিট সব।

কম্পিউটার অন করে চেয়ারে বসলেন লাবণ্য। কোম্পানিকে ই-মেইল করে জানালেন সফ্টওয়্যারগুলো এবার বদলে দিতে হবে নইলে একঘেয়ে লাগছে।

কাজ শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। দরজার কাছে এসে আলো নেভানোর আগে যন্ত্র মানুষগুলোকে আর-একবার দেখলেন। আসল মানুষগুলোর ফটোগ্রাফ দেখে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই মডেলগুলো তৈরি করা হয়েছে। লাবণ্যকে ঘিরে ওরা আসল মানুষের মতো ঘোরাফেরা করে, লাবণ্যর ফাঁকা বুকটা ভরাট করার চেষ্টা করে।

কিন্তু আসল মানুষগুলো কোথায়? কী করছে ওরা এখন?

আবার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল।

বিয়ের পর-পরই দীপ্তিমান আলাদা হয়ে গেছে। তার দু-বছরের মধ্যেই চলে গেছে আমেরিকায়। কার মুখে যেন খবর পেয়েছিলেন আইওয়াতে আছে। প্রথম-প্রথম দু-চারবার ফোন টোন করেছিল। তারপর…তারপর সব শেষ।

অনুরিতার গল্পটাও অনেকটা একইরকম। বালিগঞ্জে থাকলেও ব্যাপারটা আমেরিকায় আইওয়ার মতন। একটা দিনও খোঁজ নেয় না, মা কেমন আছে। মাসদুয়েক আগে একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিল টাকার দরকার আছে কি না।

না, দরকার নেই। প্রমথনাথ মারা যাওয়ার সময় ওই একটা জিনিসের অভাব রেখে যাননি। কিন্তু তা ছাড়া লাবণ্যর জীবনের বাকি দিকগুলো খাঁখাঁ করছে। এই শূন্যতার কথা লাবণ্য আর সারদা ছাড়া আর কেউ তেমন জানে না।

আলো নিভিয়ে পায়ে-পায়ে শোওয়ার ঘরে ফিরে এলেন লাবণ্য।

সারদা ততক্ষণে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে।

লাবণ্যর খাটের পাশে একটা ছোট টেবিলে একটা ট্যাবলেটের পাতা আর এক গ্লাস জল রাখা ছিল। একটা ট্যাবলেট ছিঁড়ে নিয়ে জল দিয়ে গিলে ফেললেন লাবণ্য। খাওয়ার আগে একবার ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছেন–এখন আর-একটা। তাতে যদি ঘুম আসে!

আলো নেভানোর সময় প্রথমনাথের ছবির দিকে চোখ গেল। ছবি থেকে লাবণ্যর মৃত স্বামী চাপা গলায় জিগ্যেস করল, বউ, কেমন আছ?

লাবণ্যর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। অতি কষ্টে চোখের জল রুখে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ভালো আছি…সুখের সংসার নিয়ে দারুণ আছি…।

তারপর সুইচ টিপে অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *