চন্দনকাঠের বাক্স

চন্দনকাঠের বাক্স

কাল রাতে মা-কে আবার স্বপ্নে দেখল সুমন।

ধূপের ধোঁয়ায় সব আবছা হয়ে গেছে। সাদা চন্দনের গন্ধে ভরে গেছে চারদিক। তারই ভেতর দিয়ে ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল মায়ের সুন্দর মুখটা। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ, ফরসা মুখে গোলাপি আভা। নাকে নাকছাবি। চোখ আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। কালো, সবুজ আর সাদায় কাজ করা চওড়াপাড় একটা শাড়িতে ঘোমটা দিয়ে রয়েছেন মা। সুমনকে যেন বলছেন, দুষ্টুমি কোরো না, বাবা। মন দিয়ে লেখাপড়া কোরো। অনেক বড় হতে হবে তোমাকে।

ভোরবেলা কাকের ডাকে ঘুম ভাঙল সুমনের। মাথার কাছে ছোট্ট জানলা দিয়ে ভোরের নরম রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। জানলার পাল্লায় বসে একটা কাক থেকে-থেকে ডাকছে। রোজই এই কাকটা এসে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আর সুমন জেগে উঠলেই ওটা উড়ে যায়–হয়তো অন্য কারও ঘুম ভাঙাতে।

বিছানায় কিছুক্ষণ চোখ মেলে শুয়ে রইল সুমন। স্বপ্নের ছবিটা ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এখনও। এতটুকু ঝাপসা হয়নি। এই একই স্বপ্ন ও যে কতদিন ধরে দেখে আসছে মনে নেই। স্কুলের বন্ধুদের স্বপ্নের কথাটা শোনালে অলক বলেছিল, তোর কথা এতটুকু বিশ্বাস করি না। আমার ছোটকাকু বলে, স্বপ্নে কখনও রং দেখা যায় না। আর তুই কী করে ধূপের গন্ধ পেলি? চন্দনের গন্ধ পেলি? শাড়ির রং দেখলি?

অন্যান্য বন্ধুও একইসঙ্গে অলকের দলে হয়ে সুমনকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে। কিছুক্ষণ প্রতিবাদ করেছে সুমন। তারপর অত বড় দলের সঙ্গে আর পেরে ওঠেনি। ভীষণ কান্না পেয়েছে। ওর। মনে-মনে মা-কে ডেকে বলেছে, মা, মাগো, তুমি তো একবার এসে ওদের বলতে পারতে আমি সত্যি কথা বলছি! তারপর থেকে আর কোনওদিন ও স্বপ্নের কথা কাউকে বলেনি।

সেদিন থেকে চুপচাপ হয়ে গেছে সুমন। ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা আর বলে না। পড়ার সময় পড়া করে, অন্য সময় মায়ের কথা ভাবে। বুকটা কেমন আনন্দে ভরে যায় ওর।

বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল সুমন। বাবা আগেই উঠে পড়েছেন। সাড়ে সাতটার মধ্যে বাবা তৈরি হয়ে মেঝেতে মাদুর পেতে বসে পড়েন। অপেক্ষা করেন ছাত্রদের জন্য। সকালে অরূপ, বিকাশ আর দেবাশিস–এই তিনজন পড়তে আসে বাবার কাছে। ওদের বাড়ি খুব দূরে নয়। বাবার কাছে ওরা পড়ছে আজ প্রায় তিন বছর ধরে। অরূপ আর দেবাশিস অন্য স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে। বিকাশ সুমনের স্কুলেই পড়ে। ক্লাস নাইন-এ। সুমনের চেয়ে এক ক্লাস নীচুতে।

হাত-মুখ ধুয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল সুমন। বাবা পুরু কাচের চশমা চোখে দিয়ে ঝুঁকে বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছেন। বাবা চোখে ভীষণ কম দেখেন। তবে এদিকে চোখ না ফেরালেও বাবা জানেন সুমন এখন কী করবে। সেটা সুমনের রোজকার কাজ।

রং-ওঠা নীলচে-সাদা দেওয়ালে ছবিটা টাঙানো রয়েছে। একদিন হয়তো ছবির সবকটা রং উজ্জ্বল ছিল। কারুকাজ করা ফ্রেমের রং ছিল ঝকঝকে সোনার মতো। কিন্তু আজ, সময়ের স্রোতে, কারুকাজ করা ফ্রেম মলিন হয়ে গেছে। ছবির রং হয়ে এসেছে ফ্যাকাসে। তা সত্ত্বেও সুমন যেন রোজ ছবিটাকে নতুনের মতোই দেখতে পায়। জ্ঞান হওয়া থেকেই ও একইরকম দেখে আসছে। স্বপ্নে ঠিক যেরকমটা দেখে।

ছবির কাচটা বাবা রোজ ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেন। দুটো চন্দন-ধূপ জ্বেলে গুঁজে দেন ফ্রেমের কোণে। আর নয়নতারা ফুলের মালা গেঁথে পরিয়ে দেন। এই ফুল আসে ওদের সদর দরজার পাশে রাখা দুটো টবের নয়নতারা গাছ থেকে। বাবার মুখে সুমন শুনেছে, মা নাকি এই ফুল খুব পছন্দ করতেন। পছন্দের একটা কারণ সুমন বাবার কাছ থেকে জেনেছে ও মায়ের নামের সঙ্গে এই ফুলের নামের মিল আছে।

ছবির নীচেই লেখা মায়ের নাম : শ্ৰীমতী নয়নকণা রায়। এই নামটা রোজই মনে-মনে গুনগুন করে সুমন। কী সুন্দর নাম! নাম থেকে শুরু করে ছবির প্রতিটি অংশ ওর ভীষণ ভালো লাগে। ইশ, মা যদি বেঁচে থাকতেন। ভাবে সুমন। ওর দু-বছর বয়েসে মা মারা গেছেন। বাবাই বলেছেন। তা হলে মায়ের সত্যিকারের মুখটা কেন সুমনের মনে পড়ে না! ভাবতে গেলেই কেন এই ছবির মুখটা খালি ভেসে ওঠে! বাবাকে প্রশ্ন করলে বাবা হেসে বলেন, দু-বছর বয়েসের কথা কি কারও মনে থাকে রে! তবে তোর মা হুবহু এই ছবিটার মতো ছিল।

বাড়িতে মায়ের আর কোনও ছবি নেই। বাবার কাছেও না। এর কারণ বাবাকে জিগ্যেস করলে বাবা উত্তর দেন না। চুপ করে থাকেন।

ধূপের ভারী ধোঁয়ায় গভীর করে শ্বাস নিল সুমন। ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে এল। হাত জোড় করে চোখ বুজল ও। তারপর চোখ খুলে ধীরে-ধীরে তাকাল ছবির ঠিক নীচে একটা টুলের ওপরে রাখা জিনিসটার দিকে।

খুব সুন্দর কারুকাজ করা একাট ছোট্ট চন্দনকাঠের বাক্স।

বাক্সটা সেই ছোটবেলা থেকে এই একই জায়গায় দেখে আসছে সুমন। ডালা বন্ধ। তাতে ছোট্ট একটা তালা লাগানো। কৌতূহল ওর প্রথম দিনই হয়েছিল। ফলে বাবাকে সোজা গিয়ে জিগ্যেস করেছিল, বাবা, ওই ছোট্ট বাক্সটায় কী আছে?

তখন সুমন ক্লাস থ্রি-তে পড়ত। ওর বড়সড়ো চোখের দিকে তাকিয়ে বাবা বলেছিলেন, আগে বড় হও, তারপর জানতে পারবে।

অবাক হলেও আর কিছু বলেনি ও। তবে সুমন মাঝে-মাঝে মায়ের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, মা, মা-মণি, এই বাক্সটায় কী আছে?

মায়ের ছবি কোনও উত্তর দেয়নি। শুধু হেসেছে।

বুকের ভেতর কৌতূহল নিয়ে আরও তিন বছর কাটিয়ে দিয়েছে সুমন। তারপর আর থাকতে পারেনি। একদিন তালাটা ধরে চুপিচুপি টেনে দেখেছে। না, খোলেনি ছোট্ট তালাটা। তখন বাবাকে গিয়ে বলেছে, বাবা, এবার বলো। এখন আমি তো বড় হয়েছি।

বাবা বিছানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। ঘুরে তাকিয়ে চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে ভালো করে দেখলেন সুমনকে। ক্লাস সিক্সের ছেলেটা ঘাড় বাঁকিয়ে সামান্য জেদি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। হাতের কাগজটা নামিয়ে রেখে বাবা ওকে ডাকলেন কাছে। বললেন, আয়, এখানে আয়।

সুমন ধীরে-ধীরে কাছে গেল। বসল বাবার পাশে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন, খোকা, তুই তো আমার সব। এ-সংসারে আমার আর কেউ নেই।

বাবা কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন। শীর্ণ হাতে ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে রূপকথার মতো করে শোনালেন ওই বাক্সের গল্প।

তোর মা বিয়ের সময় পেয়েছিল ওই চন্দনকাঠের বাক্সটা–তোর দিদিমার কাছ থেকে। ওঁদের পরিবারের রীতি ছিল, সবচেয়ে প্রিয় আর দামি জিনিসই ওই বাক্সে রাখা হবে। বিয়ের পর তোর মা সমস্ত গয়নাগাটি রেখেছিল ওই বাক্সে। আমি তখন ইস্কুলে মাস্টারি করি। এরপর তোর জন্ম হল। বেশ কিছুদিন হইহই করে খুশিতে কাটল। তারপরই এক ভয়ংকর ঘটনা বোবা করে দিল আমাকে। তোর মা পেটে ব্যথা নিয়ে ভরতি হল হাসপাতালে। পরীক্ষা করে ডাক্তার বলল, অপারেশান করা দরকার। অপারেশান করতে গিয়ে দেখা গেল পেটের ভেতরটা ক্যানসারে শেষ হয়ে গেছে। ডাক্তার বলল, কোনও আশা নেই। এভাবেই যতদিন বাঁচে। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম রে তোর মা-কে বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। তোর মা বুঝতে পেরেছিল যে, তার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাই একদিন তোকে দেখতে চেয়েছে, বলেছে, সুমনকে নিয়ে এসো। আর চন্দনকাঠের বাক্সটাও নিয়ে আসবে, দরকার আছে…।

বাবা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। হয়তো বৃষ্টি হবে। সুমনের পিঠে হাত রেখে বাবা বললেন, অবাক হলেও তোর মায়ের অনুরোধ আমি রেখেছিলাম। তোকে কোলে নিয়ে শেষ দেখা দেখতে গেলাম তাকে। আমাকে লুকিয়ে বাক্সটা নিয়ে কী যেন করল তোর মা। তারপর সেটা নিয়ে আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এটা রেখে দাও। আর, এই নাও চাবি। সুমনের যেদিন পনেরো বছর পূর্ণ হবে, সেদিন চাবিটা দেবে ওর হাতে। তার আগে নয়। তুমি কথা দাও আমাকে।

মন্ত্রমুগ্ধ সুমনের মাথায় হাত বুলিয়ে সুমনের বাবা বললেন, আমি কথা দিয়েছিলাম রে…

সুমন আন্দাজ করে বলল, বাক্সে কি তা হলে গয়না আছে?

দুঃখের হাসি হেসে বাবা বললেন, না রে, বোকা। সেগুলো তোর মা আলাদা করে আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, তোর লেখাপড়ার জন্যে, তোকে মানুষ করার জন্যে সেগুলো যেন আমি কাজে লাগাই।

তা হলে কী আছে ওই বাক্সে? সুমন আগ্রহের চোখে তাকাল বাবার মুখের দিকে।

আমি জানি না। সময় হলে চাবিটা তোকে দেব। তখন তুই নিজেই খুলে দেখিস।

সুমন তখন খুশির গলায় বলল, নিশ্চয়ই খুব প্রিয় আর দামি জিনিস আছে, না বাবা? তাই তো রাখার নিয়ম ছিল ওই বাক্সে?

উদাস স্বরে বাবা বললেন, হবে হয়তো।

এরপর আরও বড় হয়ে উঠতে লাগল সুমন। ক্লাসের পর ক্লাস ডিঙিয়ে উঠতে লাগল ওপরে। আর একইসঙ্গে মা-কে স্বপ্নে দেখতে শুরু করল–প্রায়ই। তখন একদিন রাতে খেতে বসে হঠাৎই স্বপ্নের কথাটা বাবাকে বলল ও।

বাবা খাওয়া থামিয়ে তাকালেন। বললেন তোর মা তোকে ভীষণ ভালোবাসত। তোকে ছেড়ে মোটেই যেতে চায়নি। কিন্তু কঠিন অসুখ..রাখা গেল না। সেইজন্যেই বোধহয় স্বপ্নে অমন ফিরে ফিরে আসে। তোকে নিয়ে অনেক আশা ছিল তো।

সুমনের মনটা ব্যথায় মুচড়ে উঠল। বাবা অনেকদিন রিটায়ার করেছেন স্কুলের চাকরি থেকে। চোখে ভালো দেখতে পান না, তাই সময়ের আগেই রিটায়ার করতে হয়েছে। সারাদিন বাড়িতে থেকে সব কাজ করেন আর সময় করে সুমনের পড়া দেখিয়ে দেন রোজ। সুমনের লেখাপড়া যে কত কষ্টে চলে তা ও খুব ভালোভাবেই জানে। মায়ের অভাব বাবা যে বুঝতে দিতে চান না।

এই বছর ক্লাস টেন-এ উঠে সুমন আর থাকতে পারেনি। বাবাকে গিয়ে বলেছে, বাবা, আমার বয়েস এখনও পনেরো হয়নি?

দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো ক্যালেন্ডারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন বাবা। চোখ কুঁচকে তারিখ দেখে বলেছেন, এখনও প্রায় ছমাস বাকি রে।

ওর জন্মদিন কবে সুমন জানে না। বাড়িতে ওর জন্মদিনের উৎসব কিছু হয় না। হয়তো সেই উৎসব শুরু হবে ওর পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পর–যেদিন খোলা হবে ওই চন্দনকাঠের বাক্স। সুমন সেদিন জিগ্যেস করেছে বাবাকে, আমার জন্মদিন কবে, বাবা?

সাতই জুলাই।

উত্তর শুনে সুমনের মনটা একটু দমে গেছে। তবু ভেবেছে, আর তো মাত্র ছটা মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

.

আজ সেই দিন এসেছে। ছয় জুলাই। সুমন যেন সুস্থির হয়ে কোনও কাজ করতে পারছে না। স্নান-পড়া-খাওয়া সবকিছুতেই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। বাবা সবকিছু লক্ষ করলেও, নিজের কাজ নিয়মমতো করে গেছেন। মনের বিচলিত ভাব বুঝতে দেননি।

আনমনা হয়ে স্কুল থেকে ফিরে এল সুমন। চুপচাপ বসে রইল বাড়িতে। ইশ, আর একটা মাত্র দিন। তারপরই ওর পনেরো বছর পূর্ণ হবে! ও জানতে পারবে ওই চন্দনকাঠের বাক্সে মা ওর জন্য কী অমূল্য জিনিস রেখে গেছেন। আজকের রাতটা পেরোলেই।

রাতে স্বপ্নে মা আবার এলেন। যেন হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন সুমনকে, অনেক বড় হ, খোকা। তোর বাবা যে তোর মুখ চেয়ে আছে। তারপর ধূপের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ও যেন দেখল, একটা ছোট্ট চাবি কোথা থেকে এসে গেছে ওর হাতে। সুমন ধীরে-ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বাক্সটার দিকে। ওটা খুলে এবার দেখবে ও। অপেক্ষা শেষ হবে।

এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল সুমনের। বাবা ওকে ডাকছেন, সুমন, ওঠ, ভোর হয়ে গেছে।

ঘুম-চোখ মেলে তাকাল সুমন। পুবের আকাশ সবে ফরসা হয়ে এসেছে। কাকটা এখনও আসেনি ওর ঘুম ভাঙাতে। ও ধীরে-ধীরে উঠে পড়ল। বাবা বললেন, যা, স্নান করে আয়। নতুন জামা-প্যান্ট বের করে রাখছি, এসে পরবি। আজ যে তোর জন্মদিন!

আঙুল দিয়ে চোখ ঘষে ও বলল, আমার বয়স আজ পনেরো পুরো হল, তাই না, বাবা?

হ্যাঁ। এখন যা, চটপট স্নান সেরে নে।

নতুন জামা-প্যান্ট বাবা কবে কখন কিনে এনেছেন সুমন টের পায়নি।

স্নান করে এসে দেখল ঘরের গোটা ছবিটাই পালটে গেছে। সারা ঘরময় ঘন ধূপের গন্ধ, মিষ্টি ধোঁয়া। এক ঝক নয়নতারা ফুলের মালা মায়ের গলায় পরানো। চন্দনের ফোঁটা আর সিঁদুরের টিপ দিয়ে কত দরদ দিয়ে বাবা সাজিয়েছেন মা-কে। আর একটা ছোট্ট পিতলের চাবি রাখা হয়েছে টুলের ওপর–চন্দনকাঠের বাক্সটার ঠিক সামনে।

নতুন পোশাকে বাবার হাত ধরে মায়ের ছবির সামনে এসে দাঁড়াল সুমন। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বাবা ভারী গলায় বললেন, তোমার চলে যাওয়ার দুঃখ সইতে না পেরে সব ছবি আমি নষ্ট করে ফেলেছিলাম। শুধু এইটা পারিনি খোকার মুখ চেয়ে। তা হলে ও যে আমাকে কোনওদিন ক্ষমা করত না।

বাবার চোখে জল এসে গেছে। শীর্ণ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুরেখা। সুমনের মাথায় হাত রেখে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, তোমার কথামতো আজ এই বাক্সের চাবি আমি তুলে দিচ্ছি খোকার হাতে। তোমার প্রিয় দামি জিনিস তুমি নিজের হাতে ওকে দাও। সুমনের দিকে ফিরে বাবা বললেন, বাক্স খোল। দ্যাখ, তোর মা তোর জন্যে কী রেখে গেছে।

সুমনের হাত-পা কাঁপছে। বুক দুরুদুরু। গায়ে যেন কাটা দিচ্ছে। ধীরে-ধীরে হাত বাড়িয়ে চাবিটা তুলে নিল ও। হাতজোড় করে নমস্কার করল–কে। তারপর গুপ্তধনের সিন্দুক খোলার মতো রোমাঞ্চ অনুভব করে বাক্সের তালা খুলে ফেলল।

ধূপের ঘন ধোঁয়া সরে গিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার হল। ও দেখল, সেই বাক্সের ভেতরে নীল মখমলের ওপর একটা বিবর্ণ হলুদ কাগজ। কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিল সুমন। তারপর ধীরে-ধীরে ভাঁজ খুলল। কিছু কাগজের টুকরো ভেঙে ঝরে গেল মেঝেতে। অতি সাবধানে কাগজটা মেলে ধরতে বিবর্ণ তামাটে লেখাগুলো নজরে পড়ল সুমনের। সুন্দর অক্ষরগুলো যেন কোনও শিল্পীর হাতে আঁকা। তেরো বছরেও ওদের সৌন্দর্য এতটুকু নষ্ট হয়নি। সুমনকে লেখা ওর মায়ের চিঠি! এক ও একমাত্র চিঠি! এটা নিঃসন্দেহে সুমনের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। সবচেয়ে দামি।

সুমনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। থরথর করে ঠোঁট কাঁপছে। ও পড়তে শুরু করল ও

বাবা সুমন, ইচ্ছে না করলেও অনেক কষ্টে তোকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। রে। তোর বাবা রইলেন, ওঁকে দেখিস। লেখাপড়া করবি মন দিয়ে। কারণ, অনেক বড় হতে হবে তোকে, অনেক বড়। এখন তুই বড় হয়েছিস, আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝবি। অনেক ত্যাগ স্বীকার করে তোর বাবা তোকে বড় করেছেন। সেই ত্যাগের মর্যাদা তুই দিস। আমি অকালে চলে গেলাম। তোর জন্যে কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। শুধু অনেক সাধ নিয়ে লেখা এই চিঠিটা ছাড়া। তোকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে রে। ভালো হয়ে থাকিস, সোনা আমার। আজ তা হলে আসি।

ইতি–মা-মণি।

একটা হলদে বিবর্ণ কাগজে এতখানি স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা থাকতে পারে ভাবতে পারেনি সুমন। ও চোখ তুলে মায়ের ছবির দিকে তাকায়। চোখের জলে ছবিটা ঝাপসা হয়ে গেছে। চোখ দুটো জ্বালা করছে। ও টের পেল বাবা ওকে কাছে টেনে নিয়েছেন। মাথায় পিঠে হাত বোলাচ্ছেন। বাবার কোলে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সুমন, মা, মা-মণিগো, তোমার কথা আমি রাখব। নিশ্চয়ই রাখব। তুমি দেখে নিয়ে!

সুমন টের পায়, ওর বাবার শরীরটাও ওর মতো থরথর করে কাঁপছে। ওর ছোট্ট মাথা ভিজে ওঠে বাবার চোখের জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *