মুদ্রারাক্ষস
ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দেখছিলেন। নোটটা ভারী অদ্ভুত। আর পাঁচটা নোটের সঙ্গে বিচিত্র দুটো তফাত।
প্রথমত, নোটের যে-দিকে ৫০ সংখ্যাটা ইংরেজিতে লেখা রয়েছে তার ডান পাশে অশোকস্তম্ভের নীচে সত্যমেব জয়তে কথাটা লেখা নেই। আর দ্বিতীয় আশ্চর্য হল, নোটটার উলটোপিঠে পার্লামেন্ট ভবনের যে-ছবি আছে, তার ছাদে শুধু পতাকাদণ্ডটি দাঁড় করানো রয়েছে– জাতীয় পতাকা উধাও।
একটু দূরে দাঁড়ানো বছর পঁয়তাল্লিশের বেঁটেখাটো চেহারার স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক অশোকচন্দ্র গুপ্তের কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, সাধারণত পঞ্চাশ টাকার যেসব নোট বাজারে পাওয়া যায় তাতে সত্যমেব জয়তে কথাটাও পাবেন, আর উলটোদিকে পার্লামেন্ট ভবনের মাথায় ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে ফ্ল্যাগটাও দেখতে পাবেন।
অথচ এই নোটটার ফ্ল্যাগ উধাও! তা ছাড়া নোটটার অশোকস্তম্ভের দিকটার রং কেমন যেন অস্বাভাবিক নীলচে।
অশোকচন্দ্র গুপ্তসংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি–নোটটাকে তুলে ধরলেন ঘরের খোলা জানলার দিকে। আবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ওটাকে।
এইবার কথা বলল ইনস্পেক্টর রঘুপতি যাদব, না, স্যার, যা ভাবছেন তা নয়। এই নোটটা জাল নয়–একেবারে অলি।
রঘুপতি যাদব একসময়ে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে এসিজির ছাত্র ছিল। এসিজি তখন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। তারপর জীবনের নানা পথ ঘুরে রঘুপতি যাদব কীভাবে যেন লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ইনস্পেক্টর হয়ে গেছে। আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত বয়সে পঁয়ষট্টির ঘর পেরিয়েও তার গোয়েন্দাগিরির শখ ছাড়তে পারেননি।
এসিজি নোটের নম্বরটা দেখলেন : ২ সিবি ৫৪৭৫৪১ গভর্নরের জায়গায় ইংরেজি আর হিন্দিতে সই করেছেন কে. আর. পুরি।
রঘুপতি ঠিকই বলেছে, নোটটা জালনোট নয়। অথচ কী বিচিত্র!
জয়দেববাবু… মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মেরে কাছাকাছি এসে দাঁড়ানো স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন অশোকচন্দ্র, বললেন, এটাকে কি রেয়ার নোট বলা যায়?
ভদ্রলোকের নাম জয়দেব সরকার। থাকেন টালা পার্কের কাছে। কাগজের ব্যবসা করেন। তবে খুব অল্প বয়েস থেকেই তাঁর রেয়ার কয়েন আর নোটের দিকে ঝোঁক। এ-সম্পর্কে অনেক জানেন। অন্তত রঘুপতি যাদব সেরকমই জানিয়েছে এসিজিকে।
আর যদি তা সত্যি না হত, তা হলে সকাল নটায় জয়দেববাবুকে বাড়ি থেকে তুলে এসিজির বাড়িতে নিশ্চয়ই সে নিয়ে আসত না।
জয়দেব সরকার সামান্য হেসে বললেন, তা যৎসামান্য রেয়ার বইকি। এ নোট আপনি সহজে খুঁজে পাবেন না।
এসিজি নোটটা জয়দেব সরকারের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে জিভে অস্পষ্ট একটা শব্দ করলেন। ফ্ল্যাটের খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন দু-পাঁচ সেকেন্ড। তারপর রঘুপতিকে লক্ষ্য করে বললেন, মাই ডিয়ার রঘুপতি, জয়দেববাবুর হেল্প পেলে আর কোনও চিন্তা নেই। তোমার মার্ডারার একেবারে সোজা ক্যাচ কট কট।
এসিজি, প্লিজ, মজাক করবেন না। বলরাম চৌধুরীর মার্ডার কেস আর এক উইকের মধ্যে সভ করতে না পারলে আমার পজিশন ঢিলে হয়ে যাবে।
এসিজি একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সিগারেটে জম্পেশ করে টান দিয়ে জয়দেব সরকারকে বললেন, আপনারা বসুন–একটু কফি খান। তারপর নিজেই এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
রঘুপতি এসিজিকে কমদিন চেনে না। প্রাক্তন স্যারের শ্যামবাজারের এই ফ্ল্যাটে সে মোটেই নতুন নয়। এসিজির স্ত্রী কিডনির সমস্যায় কাবু হয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছেন প্রায় দশ বছর। আর একমাত্র মেয়ে ঊর্মিলার বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। তারপর থেকে এই সাদা চুল বৃদ্ধ মানুষটি এই ফ্ল্যাটে একা-একা থাকেন। দিনরাত মেতে থাকেন পাখি আর পাখির ডাকের রহস্য নিয়ে। এ ছাড়া রহস্য-গোয়েন্দা কাহিনির পোকা। সেই কবে থেকে ওই রসে ডুব দিয়ে চুপটি করে বসে আছেন–এখনও মাথা তোলেননি।
ফাইফরমাসের একটা বাচ্চা ছেলে বিশু আর রান্নার একজন ঠিকে লোক নিয়ে দিব্যি আছেন এসিজি। মাঝে-মাঝে স্যারের এই জীবনকে হিংসে করে রঘুপতি যাদব। পড়াশোনা, সিগারেট, আর কফির নেশায় বেশ মেতে আছেন রোগা লম্বা মানুষটি।
রঘুপতি যা ভেবেছিল তাই। কফির ফ্লাস্ক আর তিনটে কাপ হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এসিজি। রঘুপতিকে বললেন, রঘুপতি, এই নাও, আমাদের জন্যে কফি ঢালো– আর তুমিও নাও।
তিনটে কাপ আর ফ্লাস্ক পড়ার টেবিলের কাছাকাছি একটা টি-টেবিলে রেখে এতক্ষণ ধরে ঠোঁটের কোণে ঝোলানো জ্বলন্ত সিগারেটটা হাতে নিলেন এসিজি। একটা চেয়ার টেনে বসলেন ওদের কাছাকাছি। তারপর সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, রঘুপতি, কাল তোমার টেলিফোন পাওয়ার পর থেকে আমার মাথা ঘুরছে। কেন জানো?
তোমার যে কয়েকটা স্পেশাল কথা আমার কানে লেগে আছে সেগুলো এইরকম : ফেমাস বিজনেসম্যান বলরাম চৌধুরি মার্ডার হয়েছেন, ওঁর বড় ছেলে বিশাল পলিটিক্যাল লিডার, লক্ষ কোটি টাকা দামের রেয়ার কয়েন, আর সবার ওপরে ক্লোজড রুম প্রবলেম–বন্ধ ঘরের রহস্য। দরাজ গলায় হাসলেন অশোকচন্দ্র ও বলো, মাথা ঘুরবে কি না?
রঘুপতি যাদব হেসে বলল, স্যার, এতেই থিঙ্কিং মেশিন বিগড়ে গেল! তো আমার হালত কীরকম একবার ভেবে দেখুন।
এসিজি কথায় কথায় প্রায়ই নিজেকে থিঙ্কিং মেশিন বলেন। আর ব্যাপারটা বোঝাতে আঙুল দিয়ে সাদা চুলে ঢাকা মাথায় টোকা মারেন।
রঘুপতি কফি ঢালার কাজ শেষ করতেই একটা কাপ তুলে নিয়ে কফিতে চুমুক দিয়ে এসিজি বললেন, রঘুপতি, জয়দেববাবুকে নিয়ে আমরা স্পটে যাওয়ার আগে তুমি ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে আমাদের শোনাবে? অবশ্য আজকের আনন্দবাজার আর টেলিগ্রাফ আমি পড়েছি। জয়দেববাবুও খবরটা পড়েছেন নিশ্চয়ই?
জয়দেব সরকার শব্দ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। এসিজির প্রশ্নে তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলেন, হ্যাঁ, হা–পড়েছি। ওই রেয়ার কয়েনের ব্যাপারটা ছিল বলেই একটু ইন্টারেস্ট নিয়ে পড়েছি।
রঘুপতি ঝটপট চুমুক দিয়ে কফির কাপ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ করে দিল। কাঁচা পাকা গোঁফে আঙুল বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল।
আজ শুক্রবার। বলরাম চৌধুরী মার্ডার হয়েছেন সোমবার দিনদুপুরে। উনি চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ-এর মালিক ছিলেন। ওঁর ব্যবসার অ্যানুয়াল টার্নওভার প্রায় তিরিশ কোটি টাকা। ব্যবসা ছাড়া ভদ্রলোকের তেমন কোনও শখ ছিল না। লেকিন রিসেন্টলি নাকি পুরোনো নোট আর কয়েনের দিকে ঝোঁক গিয়েছিল।
বলরাম চৌধুরীর বয়েস কবির সত্তর-বাহাত্তর, বিপত্নীক, তবে জানদার আদমি ছিলেন। ওঁর দু-ছেলে। বড়জন তো মোটামুটি নামি পলিটিক্যাল লিডার। লাস্ট ইলেকশানে জেতার পর অল্পের জন্যে মিনিস্টার হতে পারেননি। নাম শুনলে আপনি হয়তো চিনতে পারবেন, স্যার। সতীনাথ চৌধুরী।
এসিজি মন দিয়ে রঘুপতি যাদবের কথা শুনছিলেন আর মাঝে-মাঝে মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রের কথায় হাত বাড়ালেন নিজের বই আর কাগজপত্র-ছড়ানো অগোছালো টেবিলের দিকে। সেখানে একটা রুবিক কিউব পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে লাল-নীল হলদে-সবুজ খুদে কিউবগুলোকে কয়েকটা মোচড় দিলেন। রুবিক কিউবের নকশা বদলে গেল। ওটা বাঁ-হাতে নিয়ে ডান হাতে ঠোঁটের সিগারেট নামিয়ে টি-টেবিলে রাখা একটা অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়লেন। তারপর হেসে বললেন, সরি, রঘুপতি। আমার কাছে যেসব ইনফরমেশান জরুরি নয় সেগুলো আমি মাথায় রাখি না। বলরাম চৌধুরী, চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ, সতীনাথ চৌধুরী–এসব নামের চেয়ে কোনান ডয়েলের মিস্টার শার্লক হোমস, কিংবা রুথ রেন্ডেলের ইন্সপেক্টর ওয়েক্সফোর্ড আমার কাছে অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। যাকগে, তুমি বলে যাও
জয়দেব সরকার এই দুটি মানুষকে লক্ষ করছিলেন। ওঁদের কথাবার্তা শুনতে তার খারাপ লাগছিল না। একজন বন্ধুর মারফত ইন্সপেক্টর যাদব গতকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। অনেক আশ্বাস দিয়ে বলেছিল, কোনও ভয় নেই। একটা মার্ডারের ব্যাপারে রেয়ার কয়েনের বিষয়ে কিছু মতামত দরকার। তাতে তদন্তের কাজে অনেকটাই সাহায্য হবে।
তাই আজকের দিনটা জয়দেব সরকার ছুটি নিয়েছেন ব্যবসা থেকে। খুব কম বয়েস থেকে ব্যবসায় ঢুকেছেন, ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন, বড় করেছেন। সেইসঙ্গে বয়েসটাও একটু-একটু করে বেড়েছে। বিয়ে-থা করা হয়ে ওঠেনি। তবে রেয়ার কয়েন আর নোটের নেশায় ডুবে গেছেন। আর নেশার টানেই আজ এই অদ্ভুত বৃদ্ধের বাড়িতে ছুটে এসেছেন ইন্সপেক্টর যাদবের সঙ্গে। আসার সময় পকেটে করে বেশ কিছু জিনিসও নিয়ে এসেছেন–যদি কোনও কারণে দরকার পড়ে।
রঘুপতি যাদব ঠোঁট উলটে হাত নেড়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যার মানে অনেকটা রামজির লীলা রামজিই জানে গোছের। তারপর আবার বলতে শুরু করল।
বলরাম চৌধুরী মার্ডার হয়েছেন দুপুর দুটো থেকে চারটের মধ্যে, ওঁর সল্ট লেকের বাড়িতে, একতলায় নিজের বেডরুমে। ওঁর মুখের ওপরে বালিশ চেপে ধরেছিল মার্ডারার। বালিশে থোড়াসা ব্লাডও লেগেছে। কিন্তু খুনির সঙ্গে সেরকম লড়াই হয়নি। মানে, বাড়ির কেউ কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। তবে বাড়িটা বেশ বড়সঙ্গে বাগানও আছে। তা ছাড়া বাড়ির সবাই তখন খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুরের ঘুম লাগিয়েছে।
বাড়িতে তখন কে-কে ছিল? প্রশ্নটা করে শেষ-হয়ে-যাওয়া সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন এসিজি।
প্রায় সবাই। কারণ, বলরামবাবুর দু-ছেলের কেউই নোকরি করেন না। বড়জনের কথা তো একটু আগেই বলেছি। আর ছোটজন, মণিনাথ চৌধুরী, গানবাজনা-পাগল মানুষ। বাবার ব্যবসা দুজনের কেউই বসেন না। তবে দুজনেই ফ্যামিলি ম্যান। বড়ছেলের একটি ছেলে আছে কুন্তল ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর পুজোর হলিডে চলছে। তো সেদিন বাড়িতে সবাই ছিল। মণিনাথ গানবাজনা করছিলেন। ওঁর এক গানের ওস্তাদ সেদিন ছিল ওঁর সঙ্গে। ওস্তাদের নাম অশোক জানা। রোগা, কালো, পান চিবোনো চেহারা। ড্রেস দেখে গানের ওস্তাদ বলে মনে হলেও চেহারা দেখে সন্দেহ হয়। মনে হয়, চ্যাংড়া, লাফাঙ্গা, মাওয়ালি। মাঝে-মাঝেই থেকে যায় চৌধুরীদের বাড়িতে।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ওদের বাড়ির ঠিকে কাজের বউ সুখীর মা বাগিচায় রোদে ছড়ানো জামাকাপড় তুলছিল। তখনই সে জানলা দিয়ে দেখতে পায় বড়বাবু কেমন পিকিউলিয়ার স্টাইলে বিস্তরায় শুয়ে আছেন। সুখীর মা গিয়ে চেঁচামেচি করতে সবাই এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। এই হচ্ছে ব্যাপার।
কথা থামিয়ে কিছু একটা শোনার প্রত্যাশায় রঘুপতি স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। কয়েকবার ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, বলরামবাবুর ঘরের জানলায় গ্রিল বসানো আছে নিশ্চয়ই?
রঘুপতি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে চাইল। তারপর ও সেইজন্যেই তো ক্লোজড রুম প্রবলেম। আর সতীনাথ চৌধুরী ভীষণ পলিটিক্যাল প্রেশার তৈরি করেছেন। তাই তো লালবাজারকে নাক গলাতে হয়েছে। এখন আপনি যা করার করুন। আই ওয়ান্ট দ্য ব্লাডি মার্ডারার।
রঘুপতি কখনওই খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল না। কিন্তু ভীষণ সৎ আর পরিশ্রমী। তাই এসিজি বরাবরই ওকে পছন্দ করতেন, এখনও করেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এসিজি একটা অসহায় ভাব খুঁজে পেলেন। ওর মুখের বসন্তের দাগ কিংবা ছোট করে ছাঁটা চুল সেই ভাব লুকোতে পারেনি।
আর রেয়ার কয়েনের ব্যাপারটা? এতক্ষণ চুপ করে শোনার পর জয়দেব সরকার আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলেন। জানলা দিয়ে আসা আলো ওঁর কপালের ডান দিকে হাইলাইট তৈরি করেছে।
রঘুপতি অস্পষ্ট একটা শব্দ করে তারপর বলল, ওটা স্পটে গেলেই বুঝতে পারবেন। বডি রিমুভ করে ঘরটা লক করে রাখা হয়েছিল। ঘরের সব জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনই আছে। আমি চাবি নিয়ে এসেছি। আর লোকাল থানাকেও ইনফর্ম করা আছে যে, আমরা স্পটে আজ সকলে যাব। কিউ, গুপ্তাসাব, অব চলে? শেষ প্রশ্নটা চোখ বুজে সিগারেটে টান দেওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটিকে লক্ষ্য করে।
চোখ খুললেন এসিজি। বললেন, চলো, যাওয়া যাক। ব্যাপারটা একটু-একটু বোঝা গেল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে অশোকচন্দ্র বললেন, রঘুপতি, একটা ব্যাপার কেমন মজার দ্যাখো। যে-ঘরে ওরা সবাই গায়ের জোরে দরজা ভেঙে ঢুকেছে, সেই ঘর থেকে খুনি পালিয়েছে বুদ্ধির জোরে। হাসলেন বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন।
রঘুপতি পালটা হেসে ডান হাতের মাল ফুলিয়ে বলল, এখন তো আমার গায়ের জোর আর আপনার বুদ্ধির জোরদুটো নিয়েই আমরা যাচ্ছি। অব দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু এ কাতিল মে হ্যায়।
প্রাক্তন ছাত্রের কথা শুনে প্রাক্তন স্যার হো-হো করে হেসে উঠলেন। আর সেই আচমকা হাসিতে তার ঠোঁট থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা খসে পড়ে গেল–তিনি চেষ্টা করেও সেটা সামলাতে পারলেন না।
*
সল্টলেক জায়গাটা কলকাতার কত কাছে, অথচ কত দুরের বলে মনে হয়। কলকাতা শহরের যানজট, গাড়ির হর্নের তীব্র শব্দ, কালো ধোঁয়া, ভিড়, চিৎকার, কিছুই এখানে নেই। তা ছাড়া বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই কেমন চোখ জুড়িয়ে যায়।
বলরাম চৌধুরীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক এই কথাটাই মনে হচ্ছিল এসিজি-র।
প্রকাণ্ড মাপের বাড়ি। নাম চৌধুরী ভিলা। সাদা আর বাদামি রং। বড় লোহার গেটের ওপাশে বড় উঠোন। তার একপাশে সারি-সারি টবে ফুলগাছ। আর বাঁদিকে বেশ বড় মাপের বাগান।
বাড়িতে ঢুকতে-না-ঢুকতেই ফরসা মতন একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এল বাগানের পাশ দিয়ে। তার নাদুসনুদুস চেহারা। মাথায় গামছা দিয়ে তৈরি পাগড়ি। গায়ে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি, পায়ে সরু পাজামা, আর কোমরে বেল্ট৷
বাচ্চাটা সাবু! সাবু! বলে চিৎকার করছিল। এসিজিদের দেখামাত্রই চিৎকার করে উঠল, সাবু! জলদি এসো। দেখে যাও কারা এসেছে।
রঘুপতি যাদব অশোকচন্দ্রের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, কুন্তল।
এসিজি ইশারায় ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন, জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী?
কুন্তল বেশ স্মার্টভাবে উত্তর দিল, এখন আমি চাচা চৌধুরী।
এসিজি অবাক হয়ে বললেন, চাচা চৌধুরী মানে?
খিলখিল করে হেসে উঠল কুন্তল ও এ মা, চাচা চৌধুরীর নাম জানে না! চাচা চৌধুরীর কমিক্স বই পড়োনি?
এসিজির অতিকষ্টে মনে পড়ল যে, ম্যাগাজিনের স্টলে এই নামে কমিক্স দেখেছেন, এবং সেই চৌধুরী বানানে কোনও উ-কার ছিল না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি। সাত-তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন তিনি।
জানো, চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর!
এসিজি সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বাগানের দিক থেকে ছুটে এল আর-একটি ছেলে। বয়েস ষোলো-সতেরো। ময়লা রং। পরনে শুধু একটা হাফ প্যান্ট। পাঁজরা গোনা যাচ্ছে।
হুকুম করুন, চাচা চৌধুরি– বলতে-বলতে ছুটে আসছিল ছেলেটা। কিন্তু তিনজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কথা আটকে গেল মাঝপথেই।
ও হচ্ছে সাবু– নতুন বালকটির দিকে আঙুল দেখিয়ে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল কুন্তল।
রঘুপতি বিড়বিড় করে বলল, এর নাম বিলু। এ-বাড়িতে ফাইফরমাশের কাজ করে।
অশোকচন্দ্র কুন্তলকে জিগ্যেস করলেন, সবসময় তোমরা এমনই খেলা করো?
না, না। যখন বিলুদার কোনও কাজ থাকে না তখন খেলি।
চাচা চৌধুরী আর সাবু সেজে কী করো?
সারা বাড়ি আর বাগানে ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। দেখি কোথাও কোনও বিপদ হচ্ছে কি না। জানো তো, চাচা চৌধুরী সবার খুব উপকার করে। কাউকে ভয় পায় না। আর সাবুর গায়ে এমন জোর যে, উড়ন্ত এরোপ্লেনকে ধরে আছাড় দিতে পারে…।
শেষ কথাটা শুনে বিলু সাদা-সাদা দাঁত বের করে সরল হাসি হাসল।
জয়দেব সরকার একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে ফেলে রেখে বাচ্চাদের সঙ্গে এই গালগল্প! এ-গল্প তো পরেও করা যেত!
অধৈর্য হয়ে পড়েছিল রঘুপতিও। ও চাপা গলায় বলল, স্যার গপসপ পরে হবে। আগে চলুন, বলরাম চৌধুরীর কামরাটা দেখবেন চলুন।
অশোকচন্দ্র শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে কুন্তলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রঘুপতির কথায় সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ওর দিকে তাকালেন মায়ার চোখে। তারপর হেসে বললেন, মাই ডিয়ার রঘুপতি, কতবার তোমাকে বলেছি যে, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়, সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া গোঁফও আমার নেই। এ ছাড়া দেবেন্দ্রবিজয়, হুঁকাকাশি, রবার্ট ব্লেক বা ব্যোমকেশের মতো ক্ষুরধার বুদ্ধিও নেই আমার। তবে আমি অতি সাধারণ এক হুনুর–মানে, গোয়েন্দা–যে মোটামুটিভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোনওরকমে কাজ চালিয়ে নেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশোকচন্দ্র কুন্তলের দিকে ফিরে বললেন, এখন চলি, চাচা চৌধুরী। পরে তোমার সঙ্গে আবার গল্প করব। তারপর রঘুপতিকে : চলো, কোথায় নিয়ে যাবে চলো-।
ওঁরা তিনজনে উঠোন পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে পৌঁছে গেলেন একটা সুদৃশ্য কাঠের দরজার সামনে। রঘুপতি যাদব কলিংবেলের বোতাম টিপল। কুন্তল আর বিলু দৌড়ে চলে গেল বাগানের দিকে।
এ-বাড়িতে আসার পথে রঘুপতি আরও অনেক খবর দিয়েছে এসিজিকে। প্রত্যেকের জবানবন্দির সারমর্ম জানিয়েছে। এসিজির কিছু এলোমেলো প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে।
অশোকচন্দ্র বেশ বুঝতে পারছিলেন রঘুপতি টেনশনে ভুগছে। ধৈর্য ব্যাপারটা ওর বরাবরই একটু কম। এখন সেটা বোধহয় আরও কয়েক দাগ কমে গেছে।
বলরাম চৌধুরির শোওয়ার ঘরে এসে রঘুপতির টেনশানটা আরও স্পষ্ট হল। ও হাত-পা নেড়ে খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু বলতে শুরু করল। ওর মুখে লালচে ভাব ফুটে উঠল একইসঙ্গে।
গুপ্তাসাব– কখনও কখনও অশোকচন্দ্রকে এই নামেও ডেকে থাকে রঘুপতি : ঘরের সবকিছু সেদিনের মতোই আছে। শুধু ডেডবডি আর রক্তমাখা বালিশটা সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও চিজ ইধার-উধার করা হয়নি।
ঘরে ঢোকার সময় রঘুপতি বলরাম চৌধুরীর দু-ছেলেকেই ডেকে নিয়েছে। সতীনাথ চৌধুরী গম্ভীর মুখে এসে দাঁড়ালেও মণিনাথ বেশ বিরক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন। মণিনাথের সঙ্গে তাঁর গানের গুরু অশোক জানাও এসে হাজির।
রঘুপতি চাপা গলায় সকলের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে এসিজিকে।
মণিনাথ ভুরু কুঁচকে হাই-পাওয়ার চশমার কাচ দিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, বড়দা, আমার এখানে হাজির থাকাটা কি খুব জরুরি? নতুন একটা সুর তৈরি করছিলাম…মানে, যা বলার পুলিশকে তো আগেই জানিয়েছি…বাবা তো আর ফিরে আসবেন না…।
সতীনাথ চৌধুরী শুধু স্থির ঠান্ডা চোখে তাকালেন ছোট ভাইয়ের দিকে। সে-দৃষ্টিতে নীরব শাসন ছিল। মণিনাথ তৎক্ষণাৎ কথা থামিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। সেই অবস্থাতেই বন্ধু এবং গুরু অশোক জানার দিকে আড়চোখে তাকালেন।
গানের মাস্টারমশাইয়ের গলার শিরা কণ্ঠা ইত্যাদি বেশ স্পষ্ট। কে জানে, প্রতিদিন গানের চর্চা করে এই অবস্থা হয়েছে কি না! আর গলায় দৈর্ঘ্যও নেহাত ফেলনা নয়।
তিনি গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজছিলেন। কালো ঠোঁট পানের রসে লালচে। বন্ধুর দৃষ্টি লক্ষ করে তার পিঠে হাত রেখে জড়ানো গলায় বললেন, বড়দার কথা অমান্য করতে নেই, মণিভাই। ও-সুর আমি পরে তুলিয়ে দেবখন–।
বলরাম চৌধুরীর ঘরের দরজা যে আবার মেরামত করা হয়েছে সেটা লক্ষ করলেন এসিজি। আর একইসঙ্গে নতুন হাজির হওয়া তিনটি মানুষকে খুঁটিয়ে জরিপ করলেন।
তালা খুলে রঘুপতি যাদব বলরাম চৌধুরীর ঘরে আমন্ত্রণ জানাল এসিজিকে। জয়দেব সরকারকেও ডাকল ও আসুন, জয়দেববাবু।
কিন্তু সতীনাথ ও মণিনাথকে অনুসরণ করে যখন অশোক জানা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন তখন মুখিয়ে দাঁড়াল রঘুপতি ও আপ কিঁউ আ রহে হ্যায়, মাস্টারজি?
অশোক জানা কয়েকবার তেঁাক গিলে ইতস্তত করে বললেন, না, মানে, মণিভাই খুব সেন্টিমেন্টাল তো…হঠাৎ যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায়…পিতৃশোক বলে কথা…।
তার জন্যে আমরা আছি। আপ দফা হো যাইয়ে—
মানে!
মানে আপনি আসতে পারেন– বলেই দরজাটা মাস্টারজির মুখের ওপর বন্ধ করে দিয়েছে রঘুপতি।
তারপর উত্তেজিতভাবে শুরু করেছে ওর ধারাবিবরণীর রাজধানী এক্সপ্রেস।
এসিজি একহাতে সিগারেটে টান মারছিলেন, আর অন্য হাতে টানছিলেন সাদা চুলের গোছা। চশমার ফাঁক দিয়ে তার অভিজ্ঞ চোখ ঘরের প্রতিটি জিনিস প্রায় গোগ্রাসে গিলছিল।
ঘরে বড়-বড় দুটো জানলা-দুটোই বাগানের দিকে। জানলায় ঘিয়ে রঙের সুদৃশ্য গ্রিল বসানো। গ্রিলের ওপাশে ঘষা কাচের শার্সি বসানো পাল্লা। গ্রিলের লোহাগুলো প্রায় আট মিলিমিটার পুরু। এ-গ্রিল কাটার বা ভাঙার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
জানলা দিয়ে বাগানের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ আর আলো এসে পড়েছে ঘরে।
একটা জানলায় সোজাসুজি বলরাম চৌধুরির খাট। আর-একটা জানলায় সামনে বসানো রয়েছে একটা বড় টেবিল। টেবিলে প্রচুর ফাইল আর কাগজপত্র। আর তার সামনে একটা গদি আঁটা স্টিলের চেয়ার-টেবিলের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরানো।
এ ছাড়া ঘরে টিভি, আলনা, আলমারি, টেলিফোন, কোয়ার্টজ দেওয়াল-ঘড়ি আর একটা বুককেস রয়েছে।
স্টিলের চেয়ারটা ছাড়া অতিথিদের বসার জন্য ঘরে দুটো লাল রঙের প্লাস্টিকের কিউব রয়েছে। আর তার সঙ্গে মানানসই প্লাস্টিক আর কাঁচে তৈরি একটা শৌখিন টি-টে।
টেবিলের কাছে গিয়ে ডানদিকের ওপরের ড্রয়ারটা টেনে খুলল রঘুপতি যাদব। জয়দেব সরকারকে ইশারায় ডেকে বলল, মিস্টার সরকার, সেই সকাল থেকে আপনি বোধহয় বোর হয়ে গেছেন। এইবার আপনার সাবজেক্টে এসে গেছি। ইধর আইয়ে। দেখিয়ে বলে খোলা ড্রয়ারের ভেতরে আঙুল দেখাল রঘুপতি ও রেয়ার কয়েন্স। তবে জেনুইনলি রেয়ার কি না আপনি বলতে পারবেন।
ড্রয়ারটার কাছে এসে জয়দেব সরকার মানুষটা যেন মুহূর্তে বদলে গেল। এতক্ষণ যার কথাবার্তায় চেহারায় তেমন কোনও বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না এখন সে যেন শিকারি চিতা হয়ে গেল পলকে।
ড্রয়ারে একটা সাদা কাগজের ওপরে অন্তত পনেরো-বিশটা বড় মাপের তামার পয়সা পড়ে আছে। তার বেশিরভাগই বদখত চেহারায়, গায়ে সবুজ কপার সালফেটের দাগ-ধরা।
জয়দেব সরকার গোটা ড্রয়ারটাকে বাইরে বের করে নিয়ে টেবিলের ওপরে রাখলেন। তারপর থিঙ্কিং মেশিনকে তাজ্জব করে দিয়ে পকেট থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তামার পয়সাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
রঘুপতি আর এসিজি ভদ্রলোকের দুপাশে দাঁড়িয়ে ওঁর কাজকর্ম লক্ষ করছিলেন।
একটা একটা করে প্রত্যেকটা কয়েন দেখলেন জয়দেব সরকার। একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে পকেট থেকে পেন বের করে কীসব লিখে নিতে লাগলেন মাঝে-মাঝে।
রঘুপতি যাদব আবেগহীন গলায় মন্তব্য করল, আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন, মিস্টার সরকার। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টের টিম তাদের কাজ কমপ্লিট করে গেছে।
অ্যাঁ– জয়দেব সরকার আচমকা মনোযোগ ভেঙে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর বোধহয় রঘুপতির কথার সারমর্ম তাঁর মাথায় ঢুকল। তাই ও, ঠিক আছে বলে আবার মাথা নামিয়ে কাজ করতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর জয়দেব সরকার আতসকাচ টেবিলে রেখে মাথা তুলে এসিজি আর রঘুপতিকে দেখলেন। একটু দূরে সতীনাথ আর মণিনাথ চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। সেদিকে একবার দেখে নিয়ে ভদ্রলোক ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন এসিজিকে, ওঁদের সামনেই বলব?
বলুন।
এসিজি হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা হাতে নিয়ে জানলার গ্রিলের দিকে এগোলেন। টুকরোটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলার সময় কয়েকটা গাছগাছালির পাশে কুন্তলকে দেখতে পেলেন।
হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকলেন এসিজি।
কুন্তল ছুটে গ্রিলের কাছে এসে দাঁড়াল। মাথার পাগড়ি তখনও একই ঢঙে বসানো। ওর কয়েক হাত পিছনে সাবু, ওরফে বিলু।
কী করছ, চাচা চৌধুরী?
কুন্তল চোখ বড়-বড় করে বলল, বাড়ির ওপরে ওয়াচ রাখছি…কখন কী বিপদ হয়।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাচ্চাটার সরল চোখ দেখলেন অশোকচন্দ্র। তারপর বললেন, ঠিক আছে, খেলা করো গিয়ে।
এসিজি গ্রিলের নকশাটা বেশ ভালো করে দেখলেন। সত্যি, এ-গ্রিল কারও পক্ষে কাটা বা বেঁকানো বেশ কঠিন ব্যাপার। তা ছাড়া সেরকম কোনও চেষ্টার ছাপ কোনও গ্রিলেই দেখেনি রঘুপতি।
এসিজি টেবিলের কাছে ফিরে এসে নতুন একটা সিগারেট ধরাতেই জয়দেব সরকার গলাখাঁকারি দিলেন, বললেন, স্যার, মিস্টার চৌধুরী ইদানীং বোধহয় রেয়ার কয়েন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন।
কেন? রঘুপতি জিগ্যেস করল।
কারণ, আমি জানি একজন বিদেশি বায়ার–মানে, খদ্দের–এখন বিশেষ কয়েকটা কয়েনের জন্যে হন্যে হয়ে কলকাতা আর তার আশেপাশে চষে বেড়াচ্ছে। একইসঙ্গে প্রচুর দালালও ঘুরছে বাজারে। মিস্টার চৌধুরীর পয়সাগুলোর মধ্যে সেরকম কয়েকটা কয়েন দেখতে পাচ্ছি।
সতীনাথ আর মণিনাথ খুব তাড়াতাড়ি ওঁদের কাছে চলে এলেন। প্রায় হাঁ করে জয়দেব সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ওদের নজর ছিটকে যাচ্ছিল কয়েনগুলোর দিকে।
আপনাদের বাবার কাছে কয়েনের খোঁজে কোনও লোকজন আসত? রঘুপতি দু-ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
মণিনাথ বললেন, কীসের খোঁজে আসত জানি না, তবে বেশ কিছুদিন ধরে দেখতাম উলটোপালটা ধরনের লোক বাবার কাছে আসত।
বেশ কিছুদিন বলতে? এসিজি জানতে চাইলেন।
এই মাস চার, সাড়ে চার উত্তর দিলেন সতীনাথ। অবশ্য উত্তর দেওয়ার আগে মণিনাথের নীরব সমর্থন খুঁজেছেন।
জয়দেব সরকার বলে উঠলেন, প্রায় মাসছয়েক ধরে এই কয়েন খোঁজার ঢেউ উঠেছে। কলকাতা থেকে ব্যাপারটা এখন গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে।
রেয়ার কয়েনের কথা কী বলছিলেন– সতীনাথ আসল প্রসঙ্গ পালটাতে চাইলেন না।
জয়দেববাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এসিজিকে লক্ষ্য করে বললেন, যেসব রেয়ার কয়েনের খোঁজ চলছে তার মধ্যে বেশিরভাগই হল ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির হাফ আনা, মানে, আধ আনা। কয়েনগুলো বাজারে ছাড়ার বছরগুলো হল : ১৬১৬, ১৭১৭, ১৮০৬, ১৮১৮, ১৮৩৯, ১৮৪০, ১৮৪২, ১৮৪৪। এতে যেসব ছবির ছাপ আছে সেগুলো হল : জোড়া ডাব, রাজা রামচন্দ্রের দরবার, হনুমান, জোড়া সাপ এইসব। পয়সাগুলো মেইনলি তামার তৈরি, তার সঙ্গে বোধহয় কিছুটা করে ইরিডিয়াম মেশানো আছে।
ইরিডিয়াম! ওটা তো রেয়ার মেটাল! অশোকচন্দ্র গুপ্ত অবাক হয়ে বললেন।
জয়দেব সরকার মাথা নেড়ে হাসলেন? হয়তো সাধারণ ইরিডিয়াম নয়, তার কোনও রেডিয়োঅ্যাকটিভ আইসোটোপ। মানে ইরিডিয়াম-১৯১ আর ইরিডিয়াম-১৯৩। তেজস্ক্রিয় হলেও ইরিডিয়ামের এই দুটো আইসোটোপ খুব স্টে –মানে, হাফ লাইফ অনেক বেশি।
তা হলে তো সেই কয়েনের রেডিয়োঅ্যাকটিভিটি থাকবে! একটু ভয়ের গলায় বললেন এসিজি।
জয়দেব সরকার জোর দিয়ে বললেন, থাকবেই তো! তবে তার এফেক্ট কী হবে সেটা বলতে পারব না। বাজারের খবর হচ্ছে, এ-ধরনের পয়সা নাকি আতপ চাল টানে। মানে, চুম্বক যেমন লোহা টানে আর কী! তারপর কেউ-কেউ বলছে, তাতে নাকি আতপ চালের দানার রংও পালটে যায়। তবে একটা ধান ভেঙে সঙ্গে-সঙ্গে তার চালের দানাটা দিয়ে টেস্ট করতে হবে–এতে নাকি চালের দানাটায় কোনও ময়েশ্চার জমে না।
বলেন কী, মশাই! মণিনাথ তার হাই-পাওয়ার চশমা নাকের ডগায় ঠিক করে বসাতে বসাতে বললেন।
জয়দেব সরকার মণিনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, বললাম তো, এসব খবর আমার কানে এসেছে। গুজব না সত্যি বলতে পারব না। কারণ, এই চালের দানা টেনে নেওয়ার ব্যাপারটা আমি স্বচক্ষে দেখিনি।
সতীনাথের গম্ভীর মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। তিনি এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবাকে আমি বেশ কয়েকবার ধানের শিস নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেছি।
বাবা কি চালের দানা নিয়ে কয়েন টেস্ট করছিলেন? মণিনাথ যেন আপনমনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন।
হতে পারে। রঘুপতি বলল, তবে ইয়ে সচ হ্যায়, গুপ্তাসাব, আমরা ঘরের মেঝেতে বেশ কয়েকটা চালের দানা দেখেছিলাম। ওগুলোকে আমরা তেমন কোনও ইম্পর্ট্যান্স দিইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেসটা কী–।
বাবার কালেকশানে কি ওরকম রেয়ার কয়েন সত্যি-সত্যি আছে? সতীনাথ জয়দেব সরকারের কাছে জানতে চাইলেন।
আছে। ১৭১৭, ১৮৩৯, আর ১৮৪০ সালের তিনটে আধ আনা এখানে আছে– আঙুল দিয়ে টেবিলে রাখা কয়েনগুলোর দিকে দেখালেন জয়দেববাবু।
সত্যি? বিস্ময় মেশানো প্রশ্নে যেন ফেটে পড়লেন মণিনাথ আর সতীনাথ।
এসিজি বেশ অবাক হয়ে তাকালেন জয়দেব সরকারের দিকে। রঘুপতির চোয়ালের রেখা শক্ত হল, চোখ ছোট হয়ে এল।
কয়েক সেকেন্ড সবাইকেই উৎকণ্ঠায় রেখে তারপর হাসলেন জয়দেব সরকার ও সাল তারিখ ঠিক থাকলেও এই তিনটে পয়সাই নকল। তা না হলে এগুলোর এক-একটার দাম কম করেও কয়েক লক্ষ টাকা হত।
একথায় কয়েকটা বেলুন যেন চুপসে গেল ঘরের মধ্যে।
এরকম প্রচুর নকল কয়েন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে কিনে ঠকছেও। আবার কেউ কেউ কয়েন হাতে পেয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাচ্ছে। কথা বলতে-বলতে টেবিল থেকে আতসকাচটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকালেন জয়দেব সরকার।
রঘুপতি যাদব সতীনাথ আর মণিনাথের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনারা কয়েনের ব্যাপারে কিছু জানেন না?
দুজনেই মাথা নাড়লেন।
এসিজি সিগারেট হাতে নিয়ে ঘরটা ঘুরে-ফিরে দেখছিলেন। কখনও দরজার কাছে, কখনও বিছানার পাশে, আর কখনও বা জানলায় গ্রিলের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন।
মিস্টার সরকার জয়দেববাবুকে লক্ষ্য করে বলল রঘুপতি, দেখুন তো, টেবিলের এইসব কাগজপত্রে কয়েনের ব্যাপারে আর কিছু পান কি না–।
একটুও ব্যস্ত না হয়ে জয়দেব সরকার টেবিলের কাছে এলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে একটা-একটা করে কাগজ দেখতে লাগলেন।
সতীনাথ চৌধুরী রঘুপতি যাদবকে লক্ষ্য করে সামান্য রুক্ষস্বরে জানতে চাইলেন, কবের মধ্যে আপনি কেসটা সম্ভ করছেন, ইন্সপেক্টর যাদব?
রঘুপতি অশোকচন্দ্রকে দেখিয়ে বললেন, কোশিশ তো করছি। সেইজন্যেই আজ আমার স্যারকে নিয়ে এসেছি।
তাচ্ছিল্যের চোখে এসিজির দিকে দেখলেন সতীনাথ। তারপর ও বাবা আমাদের পার্টিকে বিরাট ডোনেশান দিতেন। আমার ওপর খুব চাপ আসছে।
মণিনাথ যেন দাদাকে সায় দিতেই বলে উঠলেন, সভ করতে না পারেন, অন্তত কাউকে অ্যারেস্ট তো করুন।
রঘুপতির বসন্তের দাগ-ধরা মুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। ও অভদ্র স্বরে জবাব দিল, অ্যারেস্ট তো ম্যায় আভি ইসি বক্ত কর সকতা । লেকিন সে আপনার হেলথের পক্ষে ভালো হবে না।
মণিনাথ স্পষ্ট শিউরে উঠে নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেলেন।
এই কাগজটা দেখুন– জয়দেব সরকার একটা কাগজ দেখিয়ে সকলের মনোযোগ চাইলেন, এটা একটা কয়েনের টেস্ট রিপোর্টের জেরক্স কপি।
রঘুপতি আর এসিজি কাগজটা দেখার জন্য জয়দেববাবুর খুব কাছে এসে ঝুঁকে পড়লেন।
ম্যাড্রাসের জুপিটার নামের কোনও এক কম্পিউটারাইজড এয়ার কন্ডিশন্ড ল্যাবরেটরিতে এই টেস্টটা করা হয়েছে। ১৬১৬ সালের কপার-ইরিডিয়াম হাফ আনা কয়েন। হাতে পাঞ্চ করে তৈরি। ভর ৮২ গ্রাম ৭০০ মিলিগ্রাম। আর কয়েনটা এক সেন্টিমিটার পুরু। রিপোর্টটা আর-একবার দেখে নিয়ে জয়দেব সরকার বললেন, এ ছাড়া রেডিয়োঅ্যাকটিভিটিও বেশ আছে দেখছি।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, এই জেনুইন কয়েনটা হাতে পেলে তার দাম মোটামুটিভাবে কত হতে পারে, মিস্টার সরকার? লাখ টাকা?
রিপোর্টটা টেবিলে রেখে দিয়ে একটু হেসে জয়দেববাবু বললেন, যে সত্যি-সত্যি অ্যান্টিক কয়েনের কদর বোঝে, তার কাছে এর দাম অনায়াসে কয়েক কোটি টাকা হতে পারে।
ঘরে যেন বাজ পড়ল। অনেকক্ষণ সবাই চুপ। শুধু কোয়ার্টজ ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা নড়ার টিকটিক শব্দ।
ওই নোংরা চেহারার কয়েনগুলোর এত দাম! ভাবল রঘুপতি।
অশোকচন্দ্র স্পষ্ট স্বরে বললেন, রঘুপতি, এবার তুমি বোধহয় বলরামবাবুর মার্ডারের জেনুইন মোটিভের হদিস পেয়ে গেছ।
হঠাৎই সতীনাথ ও মণিনাথের দিকে ফিরে এসিজি বিনীতভাবে বললেন, আপনারা যদি একটু বাইরে অপেক্ষা করেন তা হলে ভালো হয়। আমরা একটু আলাদা কথা বলতে চাই।
ওঃ, শিয়োর বলে সতীনাথ দরজার দিকে এগোলেন।
মণিনাথ দাদাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে টেবিলের কয়েনগুলোর দিকে কয়েকবার দেখলেন।
ওঁরা চলে যেতেই রঘুপতি দরজাটা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে। তারপর বলল, গুপ্তাসাব, এবার বলুন, কী বুঝলেন?
একটা ব্যাপার আমি বোধহয় সম্ভ করতে পেরেছি, রঘুপতি।
কোন ব্যাপার?
তোমার ক্লোজড রুম প্রবলেম। বন্ধ ঘর থেকে খুনি কীভাবে পালাল সেটা আমি বোধহয় ধরতে পরেছি।
রঘুপতি প্রত্যাশা-ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল প্রাক্তন স্যারের দিকে।
জানলায় কাছে গিয়ে সিগারেটের শেষ হয়ে আসা টুকরোটা বাইরে ফেলে দিলেন এসিজি। তারপর ঘাড়ের কাছে নেমে আসা সাদা চুলের গোছায় বারকয়েক টান মেরে বললেন, চলো, রঘুপতি। এবারে যাওয়া যাক। তবে যাওয়ার আগে চাচা চৌধুরীর সঙ্গে একবার কথা বলে যাব–খুব জরুরি কথা।
রঘুপতি বেশ অবাক হলেও কিছু বলল না।
ঘরটা শেষবারের মতো দেখে নিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত বেরিয়ে এলেন বাইরে। ওঁকে অনুসরণ করে জয়দেব সরকার ও রঘুপতি যাদব।
রঘুপতি, এই রেয়ার কয়েনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে তুমি একটু নতুন অ্যাঙ্গেল থেকে তদন্ত শুরু করো। আর আমি তোমাকে বাড়তি কিছু ইনফরমেশান দেব। মনে হয়, এ-থেকে তুমি দিনসাতেকের মধ্যেই মার্ডারারকে খাঁচায় পুরতে পারবে। প্রাক্তন ছাত্রের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে এসিজি জিগ্যেস করলেন, কী, খুশি তো?
কথা বলতে-বলতে ওঁরা মোজেইক করা চাতালে বেরিয়ে এসেছিলেন। সতীনাথ আর মণিনাথ কোথা থেকে যেন ওঁদের দেখতে পেয়ে ব্যস্ত পায়ে কাছে চলে এলেন।
রঘুপতি সতীনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের কো-অপারেশানের জন্যে ধন্যবাদ।
সতীনাথ সৌজন্য দেখিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজির কথায় সেটা আর বলে উঠতে পারলেন না।
আপনার ছেলেকে একবার পাঠিয়ে দেবেন, কয়েকটা কথা বলব–
তার মানে! বাবার মার্ডারের ব্যাপারে ওইটুকু বাচ্চার কী বলার আছে। বেশ বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন সতীনাথ।
মণিনাথ অবাক হয়ে এসিজির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চাচা চৌধুরী আর সাবুর গল্প করব। সে আপনি বুঝবেন না। হেসে বললেন এসিজি। তারপর রঘুপতিকে চোখের ইশারা করলেন। যার মানে, কুন্তলকে ডেকে নিয়ে এসো।
রঘুপতি বাড়ির ভেতর দিকে রওনা হতেই সতীনাথ আহত গলায় বললেন, থাক, আমিই পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সতীনাথ চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কুন্তল চলে এল লাফাতে লাফাতে। এখন ওর মাথায় পাগড়ি নেই, কোমরের বেল্টও উধাও।
আমাকে ডেকেছ?
হ্যাঁ, তোমার দাদুর মার্ডারের ব্যাপারে একটু চাচা চৌধুরীর সাহায্য চাই। চলো, বাগানে চলো।
ভ্যাবাচ্যাকা মণিনাথকে চাতালে দাঁড় করিয়ে রেখে এসিজি কুন্তলকে নিয়ে বাগানের গাছপালার মধ্যে চলে এলেন। ওঁকে অনুসরণ করে সঙ্গী হলেন জয়দেব সরকার আর রঘুপতি যাদব।
নানান গাছের ফাঁক দিয়ে বলরাম চৌধুরীর ঘরের জানলা দুটো দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে আঙুল তুলে এসিজি কুন্তলকে জিগ্যেস করলেন, বলো তো, চাচা চৌধুরী, লাস্ট সোমবার দুপুরে তুমি কি কাউকে ওই জানলার কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ?
দাঁড়াও, ভেবে বলছি– বাচ্চা ছেলেটা আঙুলে কর গুনতে লাগল আর ধীরে ধীরে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, শুক্র, বৃহস্পতি, বুধ…।
কুন্তলবাবু, চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের মতো প্রখর। চাচা চৌধুরী একবার যা দ্যাখে তা কখনও ভোলে না– অশোকচন্দ্র কুন্তলকে উৎসাহ দিতে চাইলেন।
মনে পড়েছে! মনে পড়েছে! কুন্তল আচমকা লাফিয়ে উঠে বলল, গানকাকু ওই ডানদিকের জানলায় গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন করছিল।
গানকাকু!
হ্যাঁ। কাকুমণিকে যে গান শেখায়।
এসিজি চকাৎ শব্দে একটা চুমু খেলেন কুন্তলের গালে। তারপর বললেন, থ্যাঙ্ক য়ু, চাচা চৌধুরী। তুমি আমার চেয়েও বড় হুনুর।
হুনুর মানে! অবাক চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকাল কুন্তল।
এটা ফারসি শব্দ–বাংলায় ঢুকে পড়েছে। এর মানে হল, খুব বুদ্ধিমান–এককথায় গোয়েন্দা বলতে পারো। আজ আমরা চলি। পরে একদিন এসে তোমার সঙ্গে খুব গল্প করব।
চৌধুরি ভিলার বাইরে এসে রঘুপতি এসিজিকে জিগ্যেস করল, ব্যাপারটা কী হল, গুপ্তাসাব?
এসিজি নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ড্যাম সিম্পল, রঘুপতি। গানের মাস্টারমশাই অশোক জানা-ই হচ্ছে কালপ্রিট–তোমার রেয়ার বার্ড। তবে সেরকম কোনও প্রমাণ তো নেই। তুমি ওকে খাঁচায় পুরে ছত্রিশ রকম পুলিশি দাওয়াইয়ের সাঁইতিরিশটি ডোজ অ্যাপ্লাই করলেই বোধহয় কনফেশান পেয়ে যাবে।
কিন্তু জানলার কাছে উনি কী করছিলেন? জয়দেব সরকার জানতে চাইলেন।
ওঁরা কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে পড়লেন।
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে এসিজি বললেন, রঘুপতি, রামভক্ত হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত বয়ে নিয়ে আসার গল্পটা তোমার মনে আছে তো! বিশল্যকরণী চিনতে না পেরে গোটা পর্বতটাই বয়ে নিয়ে এসেছিল পবন-নন্দন। সিগারেটে পরপর দুটো লম্বা টান দিয়ে তারপর ও এও অনেকটা সেইরকম। জানলার গ্রিলটা কাটতে বা ভাঙতে না পেরে অশোক জানা হনুমানের মতো গোটা গ্রিলটাই খুলে নিয়েছিল জানলার ফ্রেম থেকে। এই কাজের জন্যে খানিকটা নারকোল তেল আর একটা ভারী স্ক্রু-ড্রাইভারই যথেষ্ট। আমার ধারণা, ও আগে থেকেই গ্রিলের বেশ কয়েকটা স্ক্রু খুলে রেখেছিল। ঘটনার দিন শেষ একটা কি দুটো ভ্রু খুলে গ্রিল সরিয়ে ও বলরামবাবুর ঘরে ঢোকে। তারপর নিজের কুকর্ম আড়াল করতে জানলার ঘষা কাচের পাল্লা ভেজিয়ে দেয়। কাজ সেরে বেরিয়ে এসে যখন ও গ্রিলটা আবার জায়গামতো বসিয়ে স্ক্র এঁটে দিচ্ছিল, তখনই বোধহয় কুন্তল ওকে দেখতে পায়। ব্যস, এই হল তোমার ক্লোজ্বড রুম প্রবলেম।
একটু থেমে এসিজি রঘুপতিকে জিগ্যেস করলেন কী, এবার খুশি তো? এবার পারবে তো জাল গোটাতে?
রঘুপতি চওড়া হেসে বলল, স্যার, ভাগ্যিস আপনি শার্লক হোমসের মতো পাইপ টানতে পারেন না, আর এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া গোঁফ আপনার নেই!
কেন, তা হলে কী হত? কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
তা হলে আপনি গল্পের বইয়ের পাতায় ঢুকে যেতেন। বলরাম চৌধুরীর মার্ডার কেস আর সভ হত না।
ওঁরা তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন জোর গলায়।