সীতা সম্পর্কে রাম

সীতা সম্পর্কে রাম

সীতাকে লঙ্কায় এনে রাবণ তাঁকে অশোকবনে রাখেন, রাক্ষসীদের নিযুক্ত করেন তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য। নিজে প্রায়ই এসে সীতাকে লঙ্কার সমস্ত ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে অনুরোধ করতেন রাবণকে গ্রহণ করতে। সীতা রাজি না হওয়ায় শেষবারে এক মাস সময় দিয়ে বলেন এক মাস পরেই তাঁকে কেটে রান্না করা হবে। এর মধ্যেই বানর সেনা চতুর্দিকে সীতার সন্ধানে গিয়ে হতাশ হল। হনুমান লাফ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে লঙ্কায় এসে ঘুরতে ঘুরতে অশোকবনে এক গাছের উপরে বসে নীচে সীতাকে দেখতে পেলেন। রামের অদর্শনে বন্দিনী সীতার অবস্থা কী রকম? ‘উপবাসে কৃশতনু, দীনহীন, দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন বারেবারেই, যেন নির্মল প্রতিপদের চন্দ্রকলাটি।’ (৫:১৫:১৯) হনুমানের সঙ্গে রামের প্রথম দেখার সময়ে রাম সীতাবিরহে আর্ত, বহু বিলাপ করেছেন তার আগে, কিন্তু সেই অবস্থায় হনুমান রাম লক্ষ্মণকে দেখেন, শ্রীযুক্ত, রূপবান, বিক্রমে বৃষভশ্রেষ্ঠের ন্যায়, করিকরের মতো তাঁদের বাহু, উজ্জ্বলকান্তি নরবৃষভ দুটি।… বিশালবক্ষা, সিংহস্কন্ধা দুই বীর। তাঁদের দুই হাত আয়ত, গোল যেন প্রাচীরের মতো।’ (৪:৩:১০, ১২, ১৪) এই বর্ণনায় আর যাই থাক, বিরহক্লিষ্ট শীর্ণতা নেই। সেই হনুমান সীতাকে দেখে প্রথমেই যা লক্ষ্য করলেন তা হল, কৃশতনু, দীনহীনবেশ, ক্রমাগত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন। হনুমান সীতাকে আশ্বস্ত করলে সীতা রামের প্রত্যয়ের জন্য একটি ছোট দাম্পত্য কাহিনি বলে নিজের চূড়ামণিটি তাঁকে দিলেন অভিজ্ঞান হিসাবে। সে মণি হনুমানের হাতে দেখে রাম বললেন, ‘সেই কৃষ্ণায়তনেত্রাকে না দেখে এক মুহূর্তও বাঁচব না।’ (৫:৬৬:১০) বললেন, ‘ঘন কালো যার চোখ দুটি, সে রাক্ষসদের মধ্যে থেকে কোনও পরিত্রাতার সন্ধান পাচ্ছে না, আমিই তার নাথ, এখন সে অনাথার মতো আছে।’ (৬:৫:১৫) কিন্তু হনুমানকে সীতা রামের বিষয়ে যখন কুশল প্রশ্ন করেন, ‘দীন ভ্রান্ত অবস্থায় তিনি কর্তব্য ধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন না তো? সেই রাজপুত্র পুরুষোচিত কাজগুলি সব করছেন তো?’ (৪:৩৬:১৮) বলে— তখন এ প্রশ্ন শুধু স্বামীর শারীরিক মঙ্গলবার্তার জন্য নয়, এ হল কর্তব্যনিষ্ঠ ক্ষত্রিয়বীর, মর্যাদাবান রাজার শ্রেষ্ঠসত্তার কুশল সম্বন্ধে প্রশ্ন। এ প্রশ্নে রামের প্রতি সীতার সেই প্রেম দেখি, যে প্রেম সম্মুখপানে চলিতে, চালাতে জানে; যার মধ্যে দিয়ে প্রেমিকযুগলের সত্তার উত্তরণ ঘটে। এ কথা বলতে হল এ জন্যে যে, এ প্রেমের জাত আলাদা এবং কাহিনির শেষ দিকে বারবার সীতার এই প্রেমকেই অপমানিত, ধুলি-লুণ্ঠিত করা হয়েছে।

রাম সম্বন্ধে সীতার আশঙ্কাও ছিল। হনুমানকে বললেন, ‘আমার এই নির্বাসনে রাম আমার ওপরে স্নেহ ত্যাগ করেননি তো? এই বিপদ থেকে আমায় উদ্ধার করবেন তো?’ (৮:৩৬, ৪০) এর প্রথমাংশে হয়তো কতকটা সত্য ছিল; যুদ্ধ শেষে স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাতে দেখা গেল দীর্ঘ অদর্শনে রামের মনে সীতা সম্বন্ধে আশঙ্কা জন্মেছিল, স্নেহ যেন বিলীন হয়েছিল। প্রশ্নের দ্বিতীয়ার্ধের বক্তব্য— এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করবেন তো?— সত্যও হয়েছিল, মিথ্যাও হয়েছিল; সীতা লঙ্কাপুরীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জন্য যুদ্ধ হয়নি, সে কথা রাম স্পষ্টই বলেন, এবং মুক্তি এল বঞ্চনার রূপ ধরে। সে কথা পরে।

লঙ্কায় প্রবেশ করে রামের মনে হয়েছিল, মৃগশাবকের মতো চোখ যার, সেই বৈদেহী কৃশ দেহে ভূমিশয্যায় শুয়ে আমার জন্যে শোকাতুরা হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। (৬:২৪:৮,৯) ‘দেবকন্যার মতো যে সীতা, সেই সাধ্বী কখন উৎকণ্ঠিত হয়ে আমার কণ্ঠ আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করবেন?’ (৬:৫:২০) যুদ্ধ শেষে হনুমান রামকে বলেন, সীতা রামকে দেখতে চান। শুনে ধার্মিক-শ্রেষ্ঠ রাম, ঈষৎ অশ্রুপ্লুত-নেত্রে যেন ধ্যানাবিষ্ট হলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারিদিক দেখে বিভীষণকে হুকুম দিলেন সীতা যেন স্নান করে সাজসজ্জা করে সভায় আসেন। (৬:১১৪:৪,৫) এখানে রাম চাইলেন যেন, রাজবধূ বেশে সীতা সভায় অবতীর্ণ হন ও রামের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে। দীর্ঘ অদর্শনের পর সীতাকে দেখবার অধীর আগ্রহ এর কাছে গৌণ হয়ে গেল। দীর্ঘ অদর্শনে অধীরা সীতা অবশ্য যেমন ছিলেন সেই ভাবেই দেখা করতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর হুকুম মেনেই যেতে হল। সীতা শিবিকায় করে আসছিলেন, চারিদিকে অসম্ভব ভিড়; বিভীষণ লোকদের সরিয়ে শিবিকাটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাম তা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, সীতা পায়ে হেঁটে আসুন। (৬:১১৪:৩০) এতে হনুমান, লক্ষ্মণ, সুগ্রীব মনে করলেন, রাম যেন সীতার প্রতি অপ্রীত, এই দারুণ ইঙ্গিত দিয়েছেন। (৬:১১৪:৩৩) জনাপবাদের ভয়ে রামেরও চিত্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ জনসমাকুল সভাগৃহে পায়ে হেঁটেই স্বামী সন্দর্শনে গেলেন।

সীতা রামের কাছে এসে প্রণাম করে দাঁড়ালে নতমুখী মৈথিলীকে দেখে রাম তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গত ভাব ব্যক্ত করতে শুরু করলেন। (৩:১১৫:১) এ কথাটির উল্লেখ করছি এই জন্যে যে, সীতার তথাকথিত অগ্নিপরীক্ষার পরে রাম বলেছিলেন, সীতার শুদ্ধতা নিয়ে তাঁর কোনও সংশয় ছিল না, শুধু প্রজাদের অপবাদের ভয়েই তিনি তাঁকে পরিত্যাগ করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি যা বলেন তা তাঁর ‘হৃদয়ের অন্তর্গত ভাব’ এ কথা বাল্মীকি স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন।

কী সেই ভাব? যে-সীতাকে না দেখতে পেয়ে বনে বনে হা-হুতাশ করে বেড়িয়েছিলেন রাম, তাঁকে দেখতে পেয়েই কী বললেন?

যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি, তোমাকে মুক্ত করেছি, ভদ্রে। পৌরুষ দিয়ে যা করবার ছিল তা আমি করেছি। বৈরভাবের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি, ধর্ষণ প্রমার্জনা করেছি। শত্রু এবং অপমান এক সঙ্গেই শেষ করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আমার শ্রম আজ সফল। প্রতিজ্ঞা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, নিজের প্রভুত্ব ফিরে পেয়েছি। (৬:১১৫:১-৪)

এ কথা শুনে সীতার চোখ দুটি মৃগীর মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠল, জলে ভরে এল চোখ। (৬:১১৫:১০) তার পর, তা দেখেও রাম বলতে লাগলেন:

তোমার কুশল হোক, জেনে রাখ, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। প্রদীপ যেমন চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে পীড়াদায়ক হয় আমার সামনে তুমি তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও, আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে— তোমাকে আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ সেই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবে যে বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব? যে জন্যে যুদ্ধজয় করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার অভিলাষ নেই, যেখানে খুশি চলে যাও তুমি: বুদ্ধিমান আমি তোমাকে বলছি, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও। তোমার মতো দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে, রাবণ নিজগৃহে খুব বেশি দিন চুপচাপ সহ্য করেনি। (৬:১১৫:১৫-২৪)

এর উত্তরে বাল্মীকি রামায়ণে সীতা বললেন, ‘তুমি যেমন ভাবছ, মহাবাহু, আমি তেমন নই। নিজের চরিত্র দিয়ে আমাকে বিশ্বাস কর, এই শপথ কর।’ (৬:১১৬:৬) Gorresio সংস্করণের রামায়ণে এবং মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্গত রামোপাখ্যানে একটু অন্য পাঠ আছে। দু’জায়গাতেই রাম সীতাকে বলছেন: ‘যাও বৈদেহি, তুমি মুক্ত। যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। আমাকে স্বামী পেয়ে তুমি রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে যাবে এটা হয় না, তাই রাক্ষস (রাবণ)-কে হত্যা করেছি। আমার মতো ব্যক্তি ধর্ম ও অধর্মের ভেদ জেনেও পরহস্তগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্ত ধারণ করবে? তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, মৈথিলি, তোমাকে আমি ভোগ করতে পারিনে, (তুমি) যেন কুকুরে চাটা ঘি।‘ (৩:২৭৫:১০-১৩)

এখানে কতকগুলি লক্ষণীয় ব্যাপার আছে: পুরো কথোপকথনে রাম বা সীতা কেউই অপরকে প্রিয় সম্ভাষণ করেননি, স্বামী-স্ত্রী বলেও উল্লেখ করেনি। সীতা ‘মহাবাহু’ বলেছেন রামকে, রাম সীতাকে ‘বৈদেহী’, ‘মৈথিলী’, ‘ভদ্রা’ সম্বোধন করেছেন। রাম স্পষ্টই বলেছেন সীতার চরিত্র ভাল হলেও তাঁকে গ্রহণ করা যায় না, কারণ তিনি ‘পরহস্তগতা’ হয়েছিলেন। অতএব, কুকুরে চাটা ঘি দিয়ে যেমন যজ্ঞীয় কর্ম করা যায় না, তেমনই সীতাকে তিনি ‘পরিভোগ’ করতে পারেন না। প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের উচ্চারিত মূলমন্ত্র হল, ‘পরিভোগ’। খুব নির্মম ভাবে রাম সীতাকে বলেছেন যে, সীতা উদ্ধারের জন্যে তিনি মোটেই যুদ্ধ করেননি, করেছেন ইক্ষ্বাকু কুলের রাজবধূ রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে গেলে তাঁর বংশ মর্যাদা হানি হয়, তাই। লক্ষ্মণ বনগমনের পূর্বে সুমিত্রাকে প্রণাম করতে এলে সুমিত্রা বলেন, ‘রামকে দশরথ মনে করবে, সীতাকে আমি (সুমিত্রা—জননী) মনে করবে।’ এখন সীতাকে পরিত্যাগ কালে রাম অনায়াসে বলছেন, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব, বিভীষণ যাকে ইচ্ছা পতিত্বে বরণ কর। শাস্ত্রে বিধবা নারীর পক্ষেই শুধু বিধান ছিল, দেবরকে বরণ করার। তবে কি রাম বলতে চান, সীতার পক্ষে তিনি মৃত? স্বামী পরিত্যক্তা নারী কি বিধবার তুল্য? আর সুগ্রীব, বিভীষণ? বানর রাক্ষসকেও সীতা গ্রহণ করতে পারেন? এ অপমান করবার অধিকার রাম কোথা থেকে পেলেন? শূর্পণখাও রামকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তবে কি রামও কুকুরে চাটা ঘি? সীতার জন্যে এত যে বিলাপ তা কি শোকোচ্ছ্বাস না পরিভোগ-বঞ্চিত কামুকের আর্তনাদ? বহুপত্নীক দশরথের পুত্র রাম একপত্নীক, সীতাকে নিয়েই তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু এটা এমন কিছু বড় কথা নয়, কারণ লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নও একপত্নীকই ছিলেন। বরং রামের অভিষেক প্রসঙ্গে মূল বাল্মীকি রামায়ণে একটা উক্তি আছে: তখন রামের ‘পরমা স্ত্রীরা’ হৃষ্টা হলেন, (বহুবচন, স্ত্রিয়ঃ)। (২:৯:১২) যদি ধরে নিই, সেকালে রাজপুত্রদের বহু বিবাহের বিধি ছিল, তাই রামের আরও পত্নী ছিল এবং সীতা মহিষী ছিলেন বলেই অশ্বমেধ যজ্ঞ করবার সময়ে রাম আর বিয়ে না করে সোনার মহিষী দিয়েই যজ্ঞীয় প্রয়োজন সাধন করেছিলেন, তবু এ কথাটা থেকে যায় যে, চার রাজপুত্রই একপত্নীক ছিলেন, এ গৌরব একা রামের নয়। সীতাকে ভালবাসতেন এ কথা বৈশিষ্ট্য পেল সীতা হরণের পরে রামের উন্মাদপ্রায় আচরণে এবং ঠিক সেই কারণেই বহুদিন অদর্শনের পরে প্রথম দর্শনে ‘গচ্ছ বৈদেহি, মুক্তা ত্বম্’ বেশি রকম বিসদৃশ লাগে। পরে দেবতারা সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করবার পর রাম বলেন, তিনি ঠিকই জানতেন, শুধু লোকাপবাদের ভয়ে ওই সব কথা বলেছিলেন। এতে প্রশ্ন ওঠে: প্রথমত, বাল্মীকি ওই সব কথার ভূমিকায় বলেছিলেন রাম ‘হৃদয়ান্তর্গতভাব’ বলেছেন। দ্বিতীয়ত, সন্দেহ হয়ে থাকলে সীতাকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারতেন। তৃতীয়ত, হনুমান দেখেছিলেন, রাবণের প্রলোভন এবং ভয় দেখানো সত্ত্বেও সীতা অবিচলিতা ছিলেন। চতুর্থত, সন্দেহের প্রশ্ন উঠলে সীতাও রামের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে পারতেন। পঞ্চমত, সন্দেহ হলেই স্ত্রীকে ত্যাগ করতে হবে, এমন কথা কোনও শাস্ত্রে নেই। ষষ্ঠত, ত্যাগ করার জন্যে বানর রাক্ষস ছোটভাই সকলের সামনে কুকুরে-চাটা ঘি বলবার প্রয়োজন ছিল না। সপ্তমত, ত্যাগ করে সকলের সামনে তিন দেবর, বানররাজ, রাক্ষস-রাজকে, সম্ভাব্য পতিরূপে উল্লেখ করার কোনও প্রয়োজন বা অধিকার তাঁর ছিল না। অষ্টমত, চক্ষু-ব্যাধিগ্রস্ত লোকের পক্ষে প্রদীপ যেমন অসহ্য, তেমনই অসহ্য সীতা রামের দৃষ্টিতে। ব্যাধিটি কার? দোষটা কার?

রামের মর্মন্তুদ কথা শুনে সীতা বললেন:

আমার গাত্র যে স্পর্শ করা হয়েছে তখন তো আমি বিবশা দুর্বল বলে প্রবলের বশে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। স্বেচ্ছায় আমি সেটা ঘটাইনি, এখানে অপরাধ দৈবের। আমার অধীন যেটা, আমার হৃদয়, সেটা তো তোমাতেই সমর্পিত। দেহটা পরের অধীনে গেলে অসহায় আমি কী করব? হে মানদ, তোমার সঙ্গে এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তাও যদি তুমি আমাকে না জেনে থাক, তাহলে চিরদিনের মতোই আমি অভিশপ্তা। …লঘুচিত্ত মানুষের মতো তুমি আমার নারীত্বকেই সামনে রাখলে, জনকের সামনে পৃথিবী থেকে উত্থিত হয়েছিলাম সে কথাটা, আর, হে চরিত্রজ্ঞ আমার চরিত্রের বহুতর যে নিদর্শন ছিল তাকে কোনও প্রাধান্য দিলে না। স্বীকার করলে না যে, আমার বালিকা বয়সেই তুমি আমার পাণিগ্রহণ করেছিলে, আমার ভক্তি, চরিত্র এ সব পিছনে ফেলে দিলে।’ (৬:১১৬:৬,৯,১০,১৫,১৬)

বালিকাবয়সে বিবাহের উল্লেখের তাৎপর্য হল, সীতার যৌবন কেটেছে রামের সান্নিধ্যে, তাতে রাম কখনওই কি কিছু সন্দেহের লেশ মাত্র পেয়েছেন? আর একটা বড় তাৎপর্য আছে দেহ ও মনের পার্থক্যে। যে দেহটাকে পরের স্পর্শ থেকে বাঁচানোর বল বা সামর্থ্য ছিল না সেইটেই বড় হয়ে উঠল? যে-মনটা আকৈশোর অবিচল ভাবে রামের উদ্দেশে সমর্পিত থেকেছে, তার কোনও মূল্য নেই?

আগেই বলেছি রামের সঙ্গে বনে আসার কোনও দরকারই সীতার ছিল না। শুধু রামকে ছেড়ে থাকা তাঁর পক্ষে দুঃসহ ছিল বলেই জোর করে সঙ্গে এসেছিলেন। এ সব তুচ্ছ হয়ে গেল, শুধু তাঁর গায়ের জোরটা রাবণের চেয়ে কম ছিল বলে? লক্ষ্মণকে সীতা চিতা প্রস্তুত করতে বললেন, কারণ, রামের প্রেম ও বিশ্বাস থেকে যখন বঞ্চিত হয়েছেন, তখন বেঁচে থাকার কী সার্থকতা আছে? বাল্মীকি বলেছেন, চিতা নির্মাণের ব্যাপারে রাম কোনও আপত্তি করলেন না দেখে লক্ষ্মণ চিতা নির্মাণ করলেন। চিতা তিনবার প্রদক্ষিণ করতে করতে সীতা বললেন, ‘রামের থেকে আমার মন যখন সরে যায়নি তখন অগ্নি আমাকে সর্বতো ভাবে রক্ষা করুন।’ বৈদিক যুগ থেকে আত্মশুদ্ধি প্রমাণের এই উপায়টি প্রবর্তিত ছিল, একে বলে ‘সত্যক্রিয়া’। নিজের শুদ্ধির প্রমাণ দিতে দেবতাদের আহ্বান করা। প্রথমে অগ্নি, পরে অন্য দেবতাদের আহ্বান করলেন সীতা। তাঁরা এসে তাঁকে নিষ্পাপ ঘোষণা করলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সীতার অগ্নিপ্রবেশের কারণ হিসাবে রামের সীতা-চরিত্রে সংশয় সম্বন্ধে প্রায়ই বলা হয় যে, প্রজাদের সংশয় নিরসনের জন্যেই রাম সীতাকে নিষ্পাপ জেনেও সন্দেহ ব্যাক্ত করেন। এর উত্তরে দুটি কথা বলা যায়, প্রথমত, বাল্মীকির মতে রাম ‘হৃদয়ান্তর্গতভাব’ প্রকাশ করেছেন; সে ভাব হল সীতার নিষ্পাপতায় রামের অবিশ্বাস। আর দ্বিতীয়ত, লঙ্কায় লক্ষ্মণ ছাড়া অযোধ্যার প্রজা একজনও ছিলেন না, এবং লক্ষ্মণ কখনওই সীতা-চরিত্রে সন্দিহান ছিলেন না। দেবতারা সীতাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করার পর রাম বললেন, ‘লোকসমাজে সীতার অগ্নি প্রবেশের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল, (কারণ) ইনি রাবণের অন্তঃপুরে দীর্ঘকাল বাস করেছেন।’ (৬:১১৮:১৩) আরও বললেন, ‘ত্রিলোকের প্রত্যয়ের জন্যে সত্যব্রত আমি এঁর হুতাশনে প্রবেশ উপেক্ষা করেছিলাম।’ (৬:১১৮:১৭)

প্রমাণের পরে অযোধ্যায় ফিরে এলেন। কিছুকাল আনন্দে কাটল। সীতাকে সন্তান-সম্ভবা জেনে রাম তাঁর ‘দোহদ’ বা সাধ পূরণ করতে চাইলে সীতা বাল্মীকির আশ্রম দেখতে চাইলেন, রাম সম্মত হলেন। ইতিমধ্যে প্রজারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, ‘পূর্বকালে রাবণ যাঁকে বলপূর্বক হরণ করে কোলে বসিয়েছিল, সেই সীতার সম্ভোগে রামের কেমন সুখ হয়? আমাদের স্ত্রীদেরও এমন আচরণ সহ্য করতে হবে। রাজারা যেমন আচরণ করেন প্রজারা তারই অনুবর্তন করে।’ (৭:৪৩:১৭,১৩) শুনে রাম চিন্তা করে সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু বললেন, ‘আমার অন্তরাত্মা জানে যে সীতা শুদ্ধা এবং যশস্বিনী।’ (৭:৪৫:১০) ভাইদের ডেকে বললেন, ‘অপবাদ ভয়ে ভীত আমি নিজের প্রাণ দিতে পারি, পুরুষর্ষভ তোমাদেরও ত্যাগ করতে পারি, জনকাত্মজাকে ত বটেই।’ (৭:৪৫:১৪, ১৫) সংস্কৃত পাঠটির মধ্যে একটা যেন পর্যায় বিভাগ আছে— সবচেয়ে দামি মানুষের নিজের প্রাণ, তার পর বীর ভাইরা, তার পরে স্ত্রী— ‘কিং পুনর্জনকাত্মাজাম্’-এর মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য নিহিত আছে।

এখানে ভেবে দেখতে হবে, স্ত্রীকে বনবাস দেওয়ার সপক্ষে কোনও শাস্ত্র নেই। দ্বিতীয়ত, অগ্নিসাক্ষী করে যার পাণিগ্রহণ করেছেন তাকে অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ ছাড়া ত্যাগ করা যায় না, তেমন অপরাধে ত্যাগ সকল শাস্ত্রকার সমর্থন করেন না। তৃতীয়ত, যে ইক্ষ্বাকুকুলের সম্মানের জন্য লঙ্কার যুদ্ধ, সেই ইক্ষ্বাকুকুলের ভাবী সন্তান যাঁর গর্ভে, তাঁকে ত্যাগ করা অত্যন্ত গর্হিত। চতুর্থত, সীতা অন্তঃসত্ত্বা নারীর দোহদ বা সাধ হিসাবে বাল্মীকির আশ্রম দেখতে চেয়েছিলেন, সেই আশ্রমে রাম তাঁকে পাঠালেন ছলনাকে আশ্রয় করে; সীতার প্রতি এ এক মর্মান্তিক বিদ্রূপ। রাম তাঁর জ্ঞাতসারে সীতাকে চিরতরে বিসর্জন দিচ্ছেন। তাঁদের দাম্পত্যের অন্তিমপর্বে স্ত্রীকে একটি মিথ্যা বলে বিদায় দিলেন। বনে সীতা লক্ষ্মণকে বললেন, ‘আমার এই দেহটি নিশ্চয় শুধু দুঃখের জন্যে সৃষ্টি হয়েছিল, লক্ষ্মণ।’ (৭:৪৮:৩) বললেন, ‘ধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই রাজাকে বোলো, রাঘব তুমি যথার্থই জান, যে সীতা শুদ্ধা, পরম ভক্তিমতী, তোমার মঙ্গলে নিবিষ্টাচিত্তা, সেই আমাকে তুমি সমাজে অযশের ভয়ে ত্যাগ করলে।’ (৭:৪৮:১২,১৩)

এ ত্যাগ দ্বিতীয়বার। প্রথম পরিত্যাগ এবং দেবতাদের দ্বারা সীতার শুদ্ধি ঘোষণার সাক্ষী ছিলেন রাম, লক্ষ্মণ দু’জনেই। সীতার কথাগুলি লক্ষণীয়, লক্ষ্মণ ধর্মে সুসমাহিত (বা সুপ্রতিষ্ঠিত) রাজাকে জানিও, তিনি যথার্থই (বা স্পষ্টই, ‘তত্ত্বেন’) জানেন যে প্রজাদের অভিযোগ মিথ্যা, তিনি জানেন সীতার একনিষ্ঠতা, রাম সম্বন্ধে তাঁর হিতৈষণা; তথাপি লোকাপবাদের ভয়ে তিনি নির্দোষ অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বনবাস দিচ্ছেন। নিত্যদিন প্রেমের একনিষ্ঠতা নিয়ে যে নারী স্বামীর সহচারিণী ছিলেন, তাঁকে ত্যাগ করবার আগে প্রজাদের কাছে নিজে একবার বলাও দরকার মনে করলেন না যে, সীতা লঙ্কায় অগ্নিশুদ্ধা, রাম ও লক্ষ্মণ তার সাক্ষী। সমস্ত কর্তব্য শুধু ভ্রান্ত সন্দেহে সন্দিহান প্রজাদের প্রতি, দীর্ঘদিন নিষ্কলুষ অন্তঃশুদ্ধা সঙ্গিনীর প্রতি কোনও কর্তব্য নেই?

এর কিছু দিন পরে এক ব্রাহ্মণের বালকপুত্র অসময়ে মারা যায়। রাজপুরোহিতরা রামকে বলেন, রাজ্যে কেউ পাপ করেছে, যার ফলে এই অঘটন ঘটল। খোঁজ করতে করতে দেখা গেল শম্বুক নামে এক শূদ্র সশরীরে দেবত্ব পাওয়ার জন্য তপস্যা করছে, সে নিজেই সে কথা স্বীকার করল। (৭:৬:২) ‘সেই শূদ্রটি কথা বলতে বলতেই কোষ থেকে উজ্জ্বল খঙ্গ বের করে রাঘব তার মুণ্ড ছেদ করলেন।’ তখন দেবতারা সাধুবাদ দিয়ে রামকে বললেন, ‘রাম তুমি দেবতাদের কার্যসাধন করলে, তোমার জন্য এই শূদ্র স্বর্গর্ভাক্ হতে পারল না।’ (৬৭:২,৪,৭,৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *