ভুলুণ্ঠিত মর্যাদা

ভুলুণ্ঠিত মর্যাদা

সীতা বিসর্জনের কিছু দিন পরে রাম অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন ঠিক করলেন। সীতার স্বর্ণমূর্তি গড়িয়ে পাশে বসিয়ে যজ্ঞ সমাধা হল। বাল্মীকির আশ্রমে সীতার যে যমজ পুত্র জন্মেছিল, লব ও কুশ, তারা ততদিনে কিশোর। বাল্মীকি তাদের নিজের রচনা রামায়ণ কাহিনি গাইতে শিখিয়েছেন। বাল্মীকির আজ্ঞায় যজ্ঞের সময় ব্রহ্মচারীর বেশে তারা সমবেত জনতাকে রামকাহিনি শুনিয়ে শুনিয়ে বেড়াচ্ছিল। রাম দেখতে পেয়ে ডেকে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জেনে বাল্মীকিকে বলে পাঠালেন। সীতা যেন প্রকাশ্য রাজসভায় এসে নিজের শুচিতা প্রমাণ করেন। বাল্মীকি রাজি হয়ে বললেন, ‘লোকাপবাদভীত হে মহাব্রত রাম, তুমি অনুমতি করলেই সীতা তোমার প্রত্যয় উৎপাদন করবেন। আমি কখনও মিথ্যাবাক্য বলেছি বলে মনে পড়ে না। এ দুটি তোমারই পুত্র।’ (৭:৯৬:১৭:১৯) আর বললেন, ‘আমি বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করেছি। মৈথিলী যদি দুষ্টা হন তো আমি যেন সেই দীর্ঘ তপস্যার ফল না ভোগ করি। মনে, কথায়, বাক্যে কখনও পাপ করিনি, মৈথিলী যদি নিষ্পাপ হন তবেই যেন তপস্যার ফল ভোগ করি।’ (৭:৯৬:২০,২১) বাল্মীকির কথাগুলি শপথ, অর্থাৎ বাল্মীকি নিজের সমস্ত তপস্যার ফল বন্ধক রেখেছেন সীতার শুচিতার প্রমাণ হিসাবে। কায়মনোবাক্যে নিষ্পাপ বাল্মীকি এই নিষ্পাপতার সমস্ত পারলৌকিক পুরস্কার ও পুণ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে রাজি আছেন, যদি সীতার মধ্যে কোনও পাপ থাকে। শুধু রামায়ণের রচয়িতা নন, শুদ্ধাচারী নিষ্পাপ তপস্বী, যিনি সুদীর্ঘকাল তপস্যার দ্বারা বহু পুণ্য অর্জন করেছেন তিনি রামকে বলছেন, ‘সীতা নিষ্পাপ না হলে আমি যেন সারাজীবনের কঠিন সাধনার কোনও পুণ্যফল না পাই।’ এই শপথই তো রামের পক্ষে যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। হল না।

এ বার নিজের ছেলেদের সামনে, অযোধ্যার কৌতূহলী সন্দিগ্ধ জনতার সামনে, ঋষি পুরোহিতদের সামনে, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে আমন্ত্রিত বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে আজন্ম শুদ্ধাচারিনী সীতাকে তৃতীয় বার পরীক্ষা দিতে হল। প্রথম বার লঙ্কায়, রামের প্রত্যাখ্যানের পরে; দ্বিতীয় বার সন্তানসম্ভবা অবস্থায় শুধুমাত্র জনশ্রুতির ভয়ে, তৃতীয় বার এই রাজসভার মধ্যে রাজনন্দিনী রাজকূলবধূ সীতা পরীক্ষা দিতে এগিয়ে এলেন। গুরুজনদের ও স্বামীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করবার পর তিনি বললেন: ‘যদি রাম ভিন্ন অন্য কাউকে মনেও চিন্তা না করে থাকি, যদি মনে কাজে কথায় রামকেই অভ্যর্থনা করে থাকি, এ সব কথা যদি সত্য বলে থাকি, তা হলে দেবী ধরিত্রী আমাকে স্থান দিন।’ (৭:৯৭:১৪,১৬) এ কথা বলার পরই পৃথিবী দু’ভাগ হল এবং দেবী বসুন্ধরা সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় আবির্ভূত হয়ে সীতাকে কোলে নিয়ে অন্তর্হিত হলেন।

সীতা যে কথাগুলি বললেন তার মধ্যে কতকগুলি কথা লক্ষ্য করা উচিত। রাম যে শুচিতা প্রতিপাদন চাইছিলেন, সীতা তিনটি উক্তির দ্বারা তা সাধন করলেন। এ তাঁর শেষ সত্যক্রিয়া এবং তিনি যে প্রার্থনা করলেন শপথের সঙ্গে তা সফল হল অর্থাৎ, তাঁর শুচিতা প্রমাণিত হল এবং ধরিত্রী দেবী তাঁকে স্থান দিলেন। প্রাচীন পরিপ্রেক্ষিতে রামের চেয়ে জন্মস্বত্বে সীতা অধিক গৌরবের অধিকারিণী, তিনি দেবীকন্যা। অথচ রামায়ণে বারবার রাম সগৌরবে ইক্ষ্বাকু বংশের কথা বলেন, ধরিত্রীকন্যা সীতার কথা কোথাও উল্লেখ করেন না। আরও লক্ষ করার বিষয়, রাম বা তাঁর প্রজারা স্থূল ধরনের শুচিতার কথা বারবার বলেন অর্থাৎ পরপুরুষের সংস্পর্শ। সীতার শপথ তার চেয়ে অনেক উঁচু স্তরের; মনে, কথায়, কাজে রাম ভিন্ন আর কাউকে স্থান দেননি, এই তাঁর শপথ। লঙ্কাতেও বলেছিলেন, ‘অবলা বলে দেহটাকে রাক্ষসের স্পর্শ থেকে রক্ষা করতে পারিনি, কিন্তু যে মনটা অকৈশোর তোমার উপর একনিষ্ঠ থেকেছে তার কোনও দাম দিলে না তুমি?’ আজও সেই কথাই বললেন, ‘মনেও যদি কখনও আর কাউকে ভেবে থাকি…।’ এ কথাগুলি দাম্পত্য প্রেমের অনেক উচ্চতর মানদণ্ড থেকে বলা, রাম ও প্রজারা শুধু দেহের শুচিতা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সীতা যে অন্তরের শুচিতায় উজ্জ্বল, সে কথা এখানে প্রতিপন্ন হল।

এখন অযোধ্যার প্রজাদের রাম বলতে পারতেন, লঙ্কায় দেবতারা স্বয়ং অগ্নি শুদ্ধ সীতার শুচিতা প্রতিপাদন করে গেছেন, আমরা দুই ভাই তার সাক্ষী এবং আমরা মিথ্যাবাদী নই, তা তোমারা মানো। দ্বিতীয়ত, পরের প্রজন্মের লোকেরা তো আবার কোনও কারণে সন্দিহান হয়ে বলতে পারত যে, সীতা আবার শুচিতার প্রমাণ দিন; এ তো বারেবারেই ঘটতে পারত। তৃতীয়ত, বাল্মীকির শপথের পরে রাম সমস্ত অযোধ্যাকেই বলতে পারতেন, এই তপস্বীর বাক্যই চূড়ান্ত প্রমাণ বহন করে যে সীতা নিষ্পাপ, সেটা বললে প্রজাসাধারণ নিশ্চয়ই আশ্বস্ত হত, কিন্তু খুব সম্ভব রাম নিজের প্রজারঞ্জকতার প্রমাণ দিয়ে ধর্মভীরু রাজার খাতিরটা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এটা পাওয়ার উপায় নির্দোষ সীতার প্রকাশ্য অসম্মান এবং বাল্মীকির কথাকেই চূড়ান্ত ভাবে প্রামাণ্য বলে না স্বীকার করা, সেই সঙ্গে বাল্মীকিকেও এই বিরাট জনসমাবেশে অপমান করা।

এ বার সীতা আর কিছুতেই রামের ফাঁদে পা দিলেন না। বললেন না যে, যদি শুচি হয়ে থাকি তো দেবতারা এসে সে কথা প্রমাণ করুন। বললেন, যদি কায়মনোবাক্যে একমাত্র রামকেই জীবন জেনে থাকি, তা হলে দেবী বসুমতী স্থান দিন। মৃত্তিকার কন্যা মৃত্তিকাতে বিলীন হয়ে যেতে চাইলেন। চাইলেন না শুচি প্রতিপন্ন হয়ে আবার সিংহাসনে রামের পাশে মহিষী হয়ে বসে রাজপুত্রদের জননীর সম্মান পেতে। এটা শুধু অভিমানে নয়, আতঙ্কে এবং আত্মসম্মান রক্ষায় বলা কথা। আতঙ্ক, পুনর্বার এমন পরীক্ষা দেওয়ার সম্ভাবনার; সেটাকে প্রতিহত করলেন এবং নারী হিসেবে নিজের ধর্মনিষ্ঠতা প্রমাণ করে এ বার মানুষ হিসেবে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য পৃথিবী থেকে সরে যেতে চাইলেন। স্ত্রী হিসেবে তাঁর শুচিতা শেষবার প্রমাণিত হল কিন্তু তাঁর মানবিক মর্যাদার সম্মান রক্ষা করার জন্যে তো কেউ ছিল না। স্ত্রীকে সব রকম অসম্মান থেকে রক্ষা করা স্বামীর একান্ত কর্তব্য, রামায়ণে স্ত্রীকে চরমতম অসম্মানে ঠেলে দেওয়াই রামের ভূমিকা। তাই পরম অনীহা এবং জুগুপ্সায় তিনি জীবন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে সরে গেলেন। লঙ্কায় রাম বলেছিলেন, ‘তোমার শুচিতায় আমি সন্দিহান, তোমাকে ভোগ করতে পারি না।’ এ বার সীতা বিনা কথায় বললেন, ‘আমি শুচি, কিন্তু আমি আর তোমার ভোগ্যবস্তু নই। স্ত্রীর কর্তব্য যা তার অনেক বেশিই করেছি, কোনও মূল্য পাইনি তার, ইক্ষ্বাকু বংশই তোমার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে আছে, সেই বংশের দুটি উত্তরাধিকারী দিয়ে গেলাম। ধর্ম-ক্রিয়ায় স্বর্ণসীতা দিয়েই কাজ চলবে। শুচিত্ব প্রমাণিত হলে আমাকে তোমার প্রয়োজন থাকবে, কিন্তু তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই!’ এই এক বার সীতা সমস্ত নারী জাতির হয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করলেন। এর পরে রাম আবার বিলাপ করলেন, বসুমতীকে কটু কথা বললেন সীতাকে প্রত্যর্পণ না করার জন্যে, কিন্তু সত্যিকারের শুচিতার যে একটা অলঙ্ঘনীয় তেজ আছে তা এ বার তাঁকে ‘চড়া দাম’ দিয়ে বুঝতে হল। বুঝতে হল, নারীকে অকারণে সন্দেহ করলে এবং সে সন্দেহের ভিত্তিতে দণ্ড দিলে সে দণ্ড ফিরে এসে লাগে।

এর পর বেশ কিছুকাল রাজত্ব করার পরে ব্রহ্মা এসে রামকে জানালেন যে বিষ্ণুরূপে তাঁর স্বর্গে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। তখন তিনি ধীরে ধীরে সরযূর জলে নেমে গেলেন এবং দেবতারা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন, সেখানে তিনি বিষ্ণু, সীতা লক্ষ্মী।

স্বভাবতই রাম উপাখ্যানে কতগুলো প্রশ্ন জাগে। প্রথমত, বালী বধ বিষয়ে। স্পষ্টতই ক্ষত্রিয় বীরের পক্ষে কাজটা গর্হিত, এক বানররাজাকে আড়ালে লুকিয়ে থেকে হত্যা করা, এটা কোনও নীতিতেই সমর্থন করা যায় না। উত্তরে যদি বলি, সীতাকে খুঁজে পাওয়ার জন্যে সুগ্রীবের সাহায্য অত্যাবশ্যক ছিল, তা হলেও প্রশ্ন ওঠে যে, এতে রামের বীরত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে। সম্মুখ-সমরে তা হলে বালীকে হারাবার শক্তি বা সে শক্তি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস রামের ছিল না। এটা এক যশস্বী ক্ষত্রিয়বীরের পক্ষে গ্লানিকর। কাজটা কাপুরুষোচিত, সম্পূর্ণ স্বার্থপ্রণোদিত। এবং আরও কলঙ্ককর হল, বালীকে নিজের প্রজা হিসাবে শাসন করেছেন বলা, বানর মাংস অভক্ষ্য, তবুও বালী হত্যাকে মৃগয়া বলা এবং আনুষঙ্গিক বিস্তর কুযুক্তির অবতারণা করা।

গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে। ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম বেশ কয়েকজন মুনিঋষির আতিথ্যও নিয়েছেন। গুহক চণ্ডাল, তাই তার কাছে শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন।

অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শূদ্রা। (২:৫৭:৬৩) তিনি নিজেকে ‘বানপ্রস্থী’ বলছেন কী করে? তা হলে শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এক ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রকে বাঁচাতে। তা হলে প্রাণের মূল্য রামরাজত্বে বর্ণগত ভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শূদ্রের প্রাণের চেয়ে দামি? এটা মেনে নেওয়া হয়েছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে। রামরাজ্যে চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায়? যে ফল জল ব্রাহ্মণ ঋষিদের কাছে নেওয়া যায় তা চণ্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না? শূদ্র শম্বুক তপস্বী, কৃচ্ছ্রসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই।

বালীকে বধ করা, শম্বুককে হত্যা করা ছাড়াও যেটি আমাদের বেশি ভাবায় তা হল সীতা প্রত্যাখ্যান। সুন্দরকাণ্ডে সীতাহরণের পরে রামের যে বিলাপ তার ভাব সম্পূর্ণতই বিরহার্ত প্রেমিকের, কিন্তু সে কি শুধু আলঙ্কারিক বিরহ? শুধু সীতাসম্ভোগ-বঞ্চিতের বিলাপ? নতুবা দীর্ঘ অদর্শনের পরে রামের ‘হৃদয়ান্তর্গত ভাব’ এমন হল কেন যে সীতাকে দেখা মাত্রই তাঁর দুই চক্ষু পীড়িত বোধ করল এবং রাজনন্দিনী রাজকুলবধূ সীতাকে শিবিকা থেকে নেমে হেঁটে আসবার হুকুম দিলেন; সীতা আসামাত্রই বললেন, ‘গচ্ছ বৈদেহি’ তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, করেছি ইক্ষ্বাকু বংশের গৌরব রক্ষার জন্য? কোথায় ছিল সে ইক্ষ্বাকু কুলের গর্ব যখন লঙ্কায় প্রকাশ্য সভায় অপ্রমাণিত, অসত্য আশঙ্কায় রাজকুলবধূকে কটু কথা বলেছিলেন? কোথায় ছিল সে কুলগর্ব যখন দেবতাদের সাক্ষ্য, ঋষি বাল্মীকির শপথ সব অগ্রাহ্য করে পুত্রদের, প্রজাদের, অতিথিদের সামনে ইক্ষ্বাকু কুলবধূ সীতাকে আবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন? কোথায় রইল সে গর্ব যখন দেবী বসুমতী বারংবার সন্দেহে পীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত কন্যাকে কোলে নিয়ে অন্তর্ধান করলেন? কে অপরাধী প্রমাণিত হল? অকারণ সন্দেহ এবং তার বশে দণ্ডদানের অপরাধে কলঙ্কিত হলেন না ইক্ষ্বাকু-কুলতিলক রামচন্দ্র? সীতা লক্ষ্মণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘রামকে বোলো, আমাকে চিরদিনই সম্পূর্ণ নির্দোষ জেনে, রামের হিতব্রতিনী জেনে, শুধু লোকাপবাদের আতঙ্কে ভয় পেয়ে ত্যাগ করলেন তিনি।’ এতে কি ইক্ষ্বাকু কুলের গৌরব বাড়ল? গৌরব বাড়ল অন্যায় দণ্ডদাতা রাজার? এ-ই রাম রাজ্যের নমুনা?

আইল্যান্ডের রামকিয়েন-এ ‘হিকায়েৎ সেরি রাম’ (zeis ২6২7) এবং ‘কম্বন’ রামায়ণে (২:১,৫) বলা হয়েছে, মন্থরা রামের প্রতি প্রতিকূল ছিল। অর্থাৎ, কৈকেয়ী নিজের থেকে রামের বনবাস চাননি। কৈকেয়ীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলেও দশরথের অন্যায় খণ্ডিত হয় না কিন্তু কৈকেয়ীকে দেওয়া বর দুটির গুরুত্ব কমে যায়। কিন্তু এই সব ও অন্যান্য সংস্করণেও রামের তিনটি প্রধান অন্যায়, বালীকে বধ করা, শম্বুককে বধ করা ও সীতা-পরিত্যাগ এগুলো প্রায় সর্বত্রই আছে। বাল্মীকির তৃতীয় অধ্যায়ে রামায়ণের যে চুম্বকটি দেওয়া আছে তাতে লঙ্কায় রামের সীতার পরিত্যাগ ও অগ্নিপ্রবেশ নেই, কিন্তু অযোধ্যায় সীতা-বিসর্জন আছে (৩:১:৩৮)। বাল্মীকি লবকুশকে যে রামায়ণ গাইতে শিখিয়েছিলেন তাতে রাবণবধ পর্যন্তই ছিল (পৌলস্ত্য-বধমিত্যেবম্)। অর্থাৎ, ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ঋষিও পুত্রদের শেখাননি তাদের গর্ভধারিণীর প্রকাশ্য অসম্মানের কাহিনি, কারণ তখনও সেটা ঘটেনি।

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর সব মহাকাব্যই যুদ্ধবিজয়ে শেষ হল (তুলনীয় মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, এল সিড্‌ কালেভ্লা, নীবেলুঙ্গেনীয়েড, ইত্যাদি)। এক সময়ে রামায়ণও রাবণ বধ পর্যন্তই ছিল। ভাস-এ বালকাণ্ড এবং উত্তর কাণ্ডের উল্লেখ নেই। লক্ষণীয়, ষষ্ঠ শতকে, বাল্মীকি রামায়ণে শেষতম সংযোজনের অনেক পরে ভট্টি তাঁর মহাকাব্য লিখছেন, ‘রাবণবধম্’ নাম দিয়ে। তাতে অগ্নিপরীক্ষা আছে, কিন্তু কালিদাসের ‘রঘুবংশে’ লঙ্কায় সীতার প্রত্যাখ্যান নেই। অবশ্য একটি মাত্র দ্ব্যর্থক শব্দে সীতার অগ্নিশুদ্ধির ইঙ্গিত আছে (জাতবেদো-বিশুদ্ধাম্। রঘুবংশ ১২:১০৪; এর অর্থ, অগ্নি দ্বারা পরিশুদ্ধও হতে পারে, আবার অগ্নির মতো বিশুদ্ধাও হতে পারে); কিন্তু সেখানেও চতুর্দশ সর্গে সীতা এই উপমিত রূপক সমাসের অবকাশ রাখলেন না, লক্ষ্মণকে দিয়ে রামকে বলে পাঠালেন ‘চোখের সামনে আমাকে অগ্নি দ্বারা শুদ্ধ দেখেও’ (বহ্নৌ বিশুদ্ধামপি যৎ সমক্ষম্ ১৪/৬৯); অর্থাৎ রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডের অগ্নিপরীক্ষার বিবরণ কালিদাসের অরুচিকর ঠেকেছিল তাই তার বর্ণনা করেননি। কিন্তু সীতার আত্মসম্মান রক্ষার জন্য সে ঘটনাটির তীক্ষ্ণ উল্লেখের দ্বারা তিনি সীতার প্রতি তাঁর সমস্ত সহানুভূতি জানিয়েছিলেন।

রামের চরিত্রের যে-সব অসঙ্গতি চোখে পড়ে তার কারণ কী? ক্ষত্রিয়কুলোচিত বীরত্বের আদর্শে দীক্ষিত ও শিক্ষিত রাম মানবিক নৈতিক আদর্শে মর্যাদা রক্ষার জন্য পিতৃসত্য রক্ষার জন্য অকুণ্ঠ চিত্তে বনে গেলেন সিংহাসনের আশা ত্যাগ করে। তার আগে ঋষিদের তপোবিঘ্ন নিবারণ করবার জন্যে, এবং বনবাসকালেও সেই কারণেই বীরের মতো বহু রাক্ষস তিনি বধ করেন; পিতৃবন্ধু জটায়ুর প্রতি যথাকর্তব্যে শেষকৃত্য সমাধান করেন; এই মানুষ পরপর তিনটি গর্হিত অন্যায় আচরণ— বালীবধ, সীতাপরিত্যাগ ও শম্বুক বধ করলেন কেন?

একপত্নীক হওয়া সত্ত্বেও সীতার প্রতি তাঁর যথেষ্ট আসক্তি থাকা সত্ত্বেও, সীতাহরণের পর সাময়িক উন্মাদনা হওয়া সত্ত্বেও, সীতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মুখ্যত সম্ভোগের; সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। সম্পর্কটা প্রধানত কামনার বলে মেনে নিলে সীতা তাঁর ভোগ্যবস্তু হয়ে ওঠেন, তাই প্রত্যাখ্যানের সময়ে বলতে পারেন তোমাকে আর পরিভোগ (সর্বপ্রকারে ভোগ) করতে পারব না। সীতার জন্যে রামকে কখনও কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি; হলে তাঁর প্রেমের পরীক্ষা হত। শূর্পণখা প্রলোভন ছিল না, কিন্তু রামের সঙ্গে পুনর্মিলন অসম্ভব জেনেও রাবণকে বিমুখ করা ছিল সীতার দিক থেকে সত্যকার প্রলোভন জয় করা। সেই অপহরণের সময়ে রাবণের প্রতি তাঁর কটূক্তি-পরম্পরা এবং লঙ্কায় রাবণের শৌর্য যশ সমৃদ্ধি এবং তাঁর আগ্রহাতিশয্য এই সবই সীতা অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেছেন, মাসান্তে তাঁকে কেটে ফেলা হবে জেনেও। আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে এ ত্যাগ স্বীকার তাঁর গভীর প্রেমের পরিচায়ক। রাম যে সীতার জন্য নয়, ইক্ষ্বাকু কুলের মর্যাদা রক্ষার জন্যেই যুদ্ধ করেছিলেন তা তিনি নিজেই উচ্চারণ করে বলেছেন। সীতা যে ত্যাগ স্বীকার ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তা কেবলমাত্র রামেরই জন্যে। কিন্তু রামের নিজস্ব সন্দেহই প্রকাশ করে যে সীতা পাপিষ্ঠা। না হলে সীতার হরণের পর যিনি উন্মত্তবৎ আচরণ করেন, দীর্ঘ এক বৎসর অদর্শনের পরে প্রথম দর্শনেই তিনি বলেন, ‘তুমি যাও, তোমাকে আমার কোনও প্রয়োজন নেই?

সীতাকে বহু বৎসর ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার পর, হনুমানের কাছে তাঁর প্রলোভন জয় করার এবং বিরহক্লিষ্ট অবস্থার বর্ণনা শোনবার পর, নিঃসন্দিগ্ধ অভিজ্ঞান ও নিবিড় দাম্পত্য জীবনের প্রামাণ্য উপাখ্যান শোনবার পরে, সীতাকে দীনবেশে দেখে, রাম-দর্শনে উৎফুল্ল তাঁর মুখ দেখবার পরেও রামের মনে এ সন্দেহ জাগল কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *