কলির অঙ্ক
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে আক্রমণকারী বিভিন্ন জাতি যখন আর্যাবর্তে বসবাস করল তখন গ্রিকদের সময়ের পর থেকেই নারীর অন্য একটা সামাজিক অবস্থান ভারতীয় নারীদের চোখে পড়ল। এই কাল-সীমার মধ্যে খোদাই করা ও আঁকা নারীচিত্রে নারীরা পুরুষের দলে মিশে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য নিয়ে যাচ্ছে। এ দেশে প্রত্ন খননে এমন সব এমফোরা, পানপাত্র, ছোট বড় মাঝারি সুরাভাণ্ড বহু পাওয়া গেছে। ভারতীয় নারী নৃত্যপরা গ্রিক নারীর মূর্তি দেখল। আলেকজান্ডারের পরে গ্রিক প্রতিনিধিদের রাজত্বকালে বহুবার যেমন গ্রিক নাটক গ্রিক অভিনেতা অভিনেত্রীর দ্বারা মুক্তমঞ্চে অভিনীত হত, তাতে নারী অনেক বেশি স্বতন্ত্র, স্বনির্ভর, এমনকী মধ্যে মধ্যে পুরুষ-পীড়কের ভূমিকাতেও দেখা দিত (নিউ অ্যাটিক কমেডির মুখ্য নাট্যকারদের মধ্যে টেরেন্স, মেনান্ডার, প্লটাস প্রমুখর নাটকে এমন নারীদের বার বার দেখা যায়)। মধ্য এশিয়া ও মিশর থেকে এল সিংহবাহিনী দেবী, আইসিস, ইনান্না, এস্টার, অর্ধোক্ষা ও অন্যেরা। প্রত্যয়ের প্রতিমূর্তি কোনও দেবতার স্ত্রীরূপে নয়, স্ব-মহিন্নিপ্রতিষ্ঠিতা দেবী রূপে। মহালক্ষ্মী, দুর্গা ও কালিকারূপে মহাদেবীর আবির্ভাব এই সময়েই। এঁরা স্বয়ং অসুর-মর্দিনী, অতএব পুরুষ-প্রধান দেবমণ্ডলীর তথা পুরুষ-শাসিত সমাজের পক্ষে আতঙ্কস্থল।
শাস্ত্রে যখন পুরুষ এঁদের আলেখ্য সৃষ্টি করেন তখন তার পশ্চাতে থাকে নবসমাগতা ভিন্ন জাতির উপাস্যা দেবীরা, যাঁদের আর্যায়ণ বা ব্রাহ্মণায়ন সাধিত হচ্ছে শাস্ত্রকারদের হাতে (গ্রিক পল্লাস আথেনে হন ‘অপালা’, গ্রিক ইরিনে হন ইরিণী)। ভারতীয় নারী এক দিকে তখন বৃহত্তর পরিসরে স্বাধীন-সঞ্চারিণী নারীকে দেখল, অন্য সমাজের ধর্মে, নাটকে, সাহিত্যে, শিল্পে এবং প্রত্যক্ষত সমাজে, তেমনই নারী-অবদমনের অন্যবিধ চিত্রও দেখতে পেল অন্যান্য সমাজ। শক রাজাদের মৃত্যুর পর রাণীরা ‘সতী’ হতেন, তূন নারীরাও মৃত স্বামীর অনুগমন করতেন। হয়তো প্রাগার্যদের মধ্যেও এ প্রথা বর্তমান ছিল। অথর্ব বেদে দুটি উল্লেখে (১৮:৩:১,৩) তাই মনে হয়। প্রাগার্যদের মধ্যেও এ প্রথা বর্তমান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ডিওডোরাস সেক্যুলাসের বর্ণনায় ‘সতী’ হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। মহাভারত-এর ভার্গব প্রক্ষেপে সতীর আদিকল্প রচিত হয়, হিমালয় ও মেনকার দুহিতা সতী স্বামী-নিন্দায় দেহত্যাগ করেন। এ সতীত্ব স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি; কাজেই পতি-ভক্তির এবং পাতিব্রাত্যের আদি-কল্পটি নির্মাণ করেন এক দেবী। তা হলে দেখছি স্বাধীন-চারিণী নারীর চিত্রকল্প— যেমন বৈদেশিক নাট্য সাহিত্য, ভাস্কর্য চিত্র ও সামাজিক আচরণ দেখে আর্যাবর্তের নারী প্রভাবিত হচ্ছে এবং সে কারণে আতঙ্কিত হচ্ছেন সমাজপতিরা। তাই রামায়ণ মহাভারত উভয় মহাকাব্যেরই ভার্গব প্রক্ষেপে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে, কলিকালের উপযুক্ত এ আচরণ বলে কলিকে সর্বদেশের আধার বলা হচ্ছে, তেমনই অন্য দিকে শক হুনদের মধ্যে ‘সতী’ হওয়া এবং মহাভারত-এ সতী উপাখ্যানে (ও অন্যত্র শত শত উপাখ্যানে) পতিব্রতা নারীর যথোচিত আচরণের আদর্শ সৃষ্টি করে সমাজ আত্মরক্ষা অর্থাৎ সমাজের স্বীকৃত কাঠামোটি রক্ষার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় নারী যাতে কোনও রকম স্বাধীন (লক্ষণীয় ‘স্বাধীনা’ শব্দটির অর্থ গণিকা) হয়ে উঠতে না পারে, তার পরিব্রাত্যে, পতিসেবায় যেন বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি না ঘটতে পারে সেই জন্যে তো তার স্বামীকে কঠোর হাতে শাসন করতে হবে। চরিত্র-লঙ্ঘনের আশঙ্কাতেই তাই দণ্ড দিতে হচ্ছে। এই আদর্শ স্বামী, যিনি তিনি স্ত্রীকে সর্বতো ভাবে আত্মসম্পত্তি জ্ঞান করেন এবং পরপুরুষের কলুষ স্পর্শমাত্রকেই চরিত্রভ্রংশের কারণ বলে গণ্য করে দণ্ডবিধান করেন, যাতে প্রজা অর্থাৎ সমাজ নিশ্চিন্ত হতে পারে যে, ওই নারীতে কলির কালিমা লাগেনি। এই আদর্শ স্বামী রাম। এবং শাস্ত্ৰ বলে ‘রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ’, রামের মতো আচরণ করা উচিত, রাবণের মতো নয়। রাবণ এক দিকে কামুক, স্বেচ্ছাচারী এবং লোভী ছিলেন, কিন্তু মন্দোদরীর প্রতি তাঁর আচরণের কোনও মালিন্য স্পর্শ করেনি, কোনও অকারণ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়নি, এ কথা মন্দোদরীর বিলাপ থেকেই বোঝা যায়।
কলিতে শুদ্র দ্বিজাতির প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে এ কথা রামায়ণ মহাভারত উভয় মহাকাব্যের ভার্গব প্রক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট। কাজেই এমন আদর্শ রাজার আকল্প নির্মাণ করতে হবে যিনি কঠোর হাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্রকে দমন করেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা চিন্তায়। সেই আদর্শ রাজা রামচন্দ্র, যিনি শম্বুককে হত্যা করলে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করে বলেন— তুমি দেবতাদের কাজ করেছ। বর্ণগুলোর ক্রম যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা রাজার কর্তব্য। রাম সেই আদর্শ রাজা, যাঁর এক খঙ্গাঘাতে প্রতিস্পর্ধী শূদ্র মরল এবং বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের অকালমৃত পুত্রও বাঁচল। কলির আসন্ন সংক্রমণ থেকে যিনি প্রজাকুলকে বাঁচালেন, সমাজকে আশ্বস্ত এবং সুস্থির করলেন।
আতঙ্ক ছিল নারীদের নিয়ে। শাস্ত্র একবাক্যে উচ্চস্বরে বলছে, কলিকালে নারী পতিব্রতা থাকবে না, পুরুষের বশে থাকবে না, সস্বন্তর এবং স্বাতন্ত্র্য্যপরায়ণ হয়ে উঠবে। (দ্রষ্টব্য যুগপুরাণ, শ্লোক ৮৩-৮৬; মহাভারত, ৩:১৮৮:৭৭) নারী কৃষিকাজ পর্যন্ত করবে (যুগপুরাণ, শ্লোক ৮৩); অর্থাৎ, আর্থিক ভাবেও আর সে পুরুষ-নির্ভর থাকবে না। সহজেই বোঝা যায়, কোনও কোনও অঞ্চলে স্বয়ংসম্পূর্ণা বিদেশিনীরা স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করত না এবং আর্থিক ভাবেও কতকটা স্বনির্ভর ছিল এবং এর দ্বারা আর্যাবর্তের কিছু নারী প্রভাবিত হয়েছিলেন। মহাভারত বনপর্বে (ভার্গব সংযোজনের অংশ) সত্যভামার প্রশ্নের উত্তরে দ্রৌপদী নিজেকে পাঁচ স্বামীর ভূমিকায় চিত্রিত করে বলেন— স্বামীদের ক্রুদ্ধ সর্পজ্ঞানে সেবা করি। অন্যত্র দ্রৌপদী চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন, তিনি স্বনির্ভর এবং তাঁর স্বামীরা বহু ভাবে তাঁর ওপরে নির্ভরশীল। ওই উপমার মনোভাব স্বামী-স্ত্রী কারওর পক্ষেই সম্মানের নয়, কিন্তু ভার্গবসংযোজনে নারীর জন্যে এই স্থানই নির্ধারিত হল। নারীর বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা তখন মেনে নেওয়া হচ্ছে না, সে পরপুরুষের সকল রকম সাহচর্য সর্বতোভাবে বর্জন করবে। কেন? পূর্বে যে ঐশ্বর্যবৃদ্ধির কথা বলেছি, সেই ঐশ্বর্য সঞ্চিত হচ্ছিল সমাজের উপরের স্তরে মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণির হাতে। তাঁরা সে সম্পত্তি নিজেদের ছেলেদের ও তার দ্বারা নিজেদের বংশ সংরক্ষণ করবার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলেন। সম্পত্তিমান ব্যক্তি কী করে নিশ্চিত হবেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর যে ছেলে বা ছেলেরা সম্পত্তি পাবে তারা নিঃসংশয়ে তাঁরই ঔরসজাত ছেলে? তাঁর স্ত্রীর যদি স্বাধীনতা থাকে, অন্য পুরুষের সংস্পর্শে আসবার, তা হলে এ নিশ্চিতি ধ্রুব হতে পারে না। কাজেই নারীর সব রকম স্বাধীনতা হরণ করা হল; বার বার নানা শাস্ত্রে বলা হল, কৈশোরে তার রক্ষক পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্ররা, নারী স্বাধীনতার যোগ্যই নয়।
বন্ধন এত দৃঢ় হল যে, পরপুরুষকে স্পর্শ করা বা তার সান্নিধ্যে আসা নিতান্ত গর্হিত বলে গণ্য হল। স্বামীকে অন্য নারী স্পর্শ করলে স্ত্রীর সে জন্যে স্বামীর কাছে জবাবদিহি চাওয়ার কোনও অধিকার নেই। কেমন করেই বা চাইবে? বহুবিবাহ, বহু-উপপত্নী গ্রহণ ও গণিকাগমনে যার অধিকার, সে পুরুষ ওই অর্থে তো একনিষ্ঠ নয়ই। ‘সতী’ শব্দের সমার্থক কোনও পুংলিঙ্গ শব্দই তাই নেই। কিন্তু নারী যে বংশধর গর্ভে ধারণ করে সে যে একান্ত ভাবে স্বামীরই, সে আশ্বাস পেতে গেলে নারীকে কঠোর ভাবে অন্তঃপুরচারিণী হতে হবে, যাতে পরপুরুষের সংস্রবের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও না থাকে।
তাই বিরাধ রাক্ষস যখন সীতাকে তুলে নেয় তখন রাম বিচলিত হন, নরমাংসভোজী রাক্ষসের হাতে স্ত্রী পড়েছে বলে নয়, পরপুরুষ তাকে স্পর্শ করেছে বলে। ওই একই কারণে, রাবণ স্পর্শ করে সীতাকে বিমানে তুলেছিল— এ চিন্তা রামকে এত গভীর অস্বস্তিতে ফেলে। তিনি কোনও মতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে, সীতা আপন শুচিতা রক্ষা করেছেন। রাম তো বলেই ফেলেন, তোমার মতো সুন্দরী নারী পেয়ে রাবণ তোমাকে ভোগ করতে নিশ্চয়ই দীর্ঘকাল বিলম্ব করেনি। তাই পরহস্তগতা নারীকে আমি ভোগ করতে পারি না। অর্থাৎ, নিশ্চিত হতে পারব না, তোমার যে সন্তান হবে সে রাবণের না আমার; সে ইক্ষ্বাকু কুলের সম্পত্তির আইনসিদ্ধ উত্তরাধিকারী কিনা। সব আসামিকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দেওয়া হয়; আদর্শ রাজা রামের বিচারপদ্ধতি অন্য রকম, সেখানে আসামি প্রতিপন্ন হয়েছে সমাজের চাপে। প্রায় কাজির বিচার। এখানেও, শম্বুকের ক্ষেত্রেও।
এ আতঙ্ক ওই কলির আতঙ্ক, যে কলির প্রধান ভয় নারী ও শূদ্র যথাক্রমে স্বামী এবং উচ্চবর্ণের প্রভুকে লঙ্ঘন করবে। বিদেশি আক্রমণে অরক্ষিত নারীর পরহস্তগতা হওয়ার একটি রূপক চিত্র রাবণের সীতাহরণ। এই সব অবহৃতা নারীদের ফিরে নেওয়ার ব্যবস্থা সমাজ রাখেনি। অথচ মহাভারত-এ বৃহস্পতির স্ত্রী তারা চন্দ্রের সহবাসে দীর্ঘদিন থেকে চন্দ্রের পুত্র বুধকে জন্ম দিয়ে এবং সে কথা নিজমুখে স্বীকার করবার পরও বৃহস্পতি তারাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। গৌতমও অহল্যাকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। যেমন গ্রিক পুরাণে দেখি অপহৃতা স্ত্রী হেলেনকে মেনেলাওস ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ধর্মশাস্ত্রেও বলা আছে পরপুরুষের দ্বারা অপহৃতা ও ভুক্তা নারীকে স্বামী মাসান্তে শুচি জ্ঞান করবে এবং স্বগৃহে তার সঙ্গে বাস করবে। তবে? তবে ইক্ষ্বাকু কুলের বংশমর্যাদা এমনই সুউচ্চ যে, সন্দেহের ছায়ামাত্র স্পর্শ করলেই তা ম্লান হয়ে যায়? অগ্নিসাক্ষী করে গ্রহণ করা স্ত্রীকে নিছক সন্দেহবশে বিসর্জন দিলে কিন্তু সে মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না, ইক্ষ্বাকু কুলের বংশধরদের গর্ভে ধারণ করে আছেন যে নিষ্পাপ নারী তাঁকেও নিষ্করুণ ছলনা করে নির্বাসন দিলে কোনও গ্লানি স্পর্শ করে না বংশগৌরবকে। সহস্র বর্ষতপস্বী যখন নিজের সমস্ত তপস্যা পুণ্যফল গচ্ছিত রেখে আজন্ম দেহে মনে বাক্যে সত্যাচরণের পুরস্কার থেকে স্বেচ্ছাবঞ্চিত হতে প্রস্তুত হয়ে শপথ করেন, সীতা নিষ্পাপা, তখন রাম লক্ষ্মণ যদি তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতেন যে লঙ্কায় দেবতারাও প্রমাণ দিয়েছেন যে সীতা নিষ্কলঙ্ক, তা হলে সন্দিহান অযোধ্যার প্রজাদের ঘাড়ে ক’টা মাথা ছিল ঋষি রাজা ও রাজভ্রাতার যৌথ প্রমাণের বিরুদ্ধে মাথা তোলবার?
তা নয়, ভয়টা ওই কলির। তখনই সমাজে নারী বিদ্রোহিণী। প্রথম শতাব্দী থেকে নিজের হাতে চাষ করছে কোনও কোনও নারী, স্বোপার্জন তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, চতুর্থ শতকে কার্টিয়াস বলেন— রণক্ষেত্রে আর্য নারী যুদ্ধ করছে। বিদেশি নারীদের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন আচরণ তাদের স্বনির্ভর করেছে। অনেক সময়ে স্বামীরা, বিশেষত বিদেশি স্বামীরা, নিগড়শৃঙ্খল হয়তো খুলে দিয়েছেন, পেয়েছেন দাসীর বদলে চিত্তসঙ্গিনীকে। হয়তো সম্পত্তি ঔরস সন্তানের হাতে পড়বে কি না এর চেয়েও উভয়ত খোলাখুলি মেশা ও দাম্পত্য-সুখ তাদের কাছে অধিক কাম্য মনে হয়েছে। কিছু ‘অহল্যা’ হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করে সংসারে পুনঃপ্রবেশ করেছেন। কিন্তু তাঁরা, হয়তো প্রায়শ্চিত্ত না করেও স্বামীর গৃহে ঢুকেছেন হেলেনের মতো। কিছু শৈথিল্য ও মুক্ত বাতাস হয়তো আগন্তুক বিদেশি নারী-পুরুষ সঙ্গে করে এনেছিলেন, সমাজের বিকারদুষ্ট আবহাওয়ায় হয়তো কতকটা সংশোধিত হচ্ছিল কোথাও কোথাও। যোদ্ধা নারী, তপস্বী নারী, অনূঢ়া নারী, পুনর্ভবা, গান্ধর্ব মতে বিবাহিতা নারী, এমনকী রাক্ষস, পৈশাচ বিবাহে বিবাহিতাকেও ‘অনুলোম’ বলে স্বীকার করা হচ্ছিল। যেমন কানীন সন্তান, উঢ়পূর্বা নারী প্রমুখরাও সমাজে স্থান পাচ্ছিলেন, তাই শাস্ত্রকারেরা আরও কঠিন নিগড়ের গ্রন্থিবন্ধন করলেন, তার জানালা দরজা বন্ধ করে দিলেন।
রামরাজ্যে প্রজারা নাকি অতি সুখে বাস করত। রামায়ণে তিনটি জাতির চারটি রাজার কথা পাই: দশরথ, সুগ্রীব ও রাবণ এবং অবশেষে রাম। ভুল, স্বার্থবিরোধী ও ধর্মবিরোধী প্রতিজ্ঞার ফলে মনঃকষ্টে দশরথের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অযোধ্যায় তাঁর রাজত্বের যে বর্ণনা পাই তা প্রজাদের পক্ষে হিতকর, সমৃদ্ধি ও শান্তির রাজত্ব। তেমনই বর্ণনা পাই কিষ্কিন্ধ্যায় সুগ্রীবের এবং লঙ্কায় রাবণের। গুণগত মানে তিন জনের রাজত্বই আদর্শ। এর মধ্যে আর্য মূল্যবোধ রামের আগেই দেখেছি, দশরথের কালে এবং ভরতের পাদুকারাজ্যে। রামচন্দ্রের রাজত্বের ছকটিও ওই দুই পরবর্তী রাজ্যের অনুরূপ। বৈশিষ্ট্য দু’ জায়গায়, এক শম্বুক হত্যায়, দুই সীতা নির্বাসনে। প্রথমটি ব্রাহ্মণের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে শূদ্রের প্রাণহানি, দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রজারঞ্জনের জন্য নিষ্পাপ সন্তানসম্ভবা ধর্মপত্নীর বনবাসদণ্ড। প্রথম যে রাজা দশরথ, তাঁর রাজত্বের বর্ণনায় শুনি প্রজারা সুখী, বর্ণসংকর নেই (১৬:১২), শূদ্ররা স্বকর্মনিরত অর্থাৎ, উচ্চ তিনবর্গের সেবায় নিয়ত। (১:৬:২৯) দ্বিতীয়, নন্দিগ্রামে ভরত সব রাজকার্য পাদুকা দুটিকে নিবেদন করে সম্পাদন করতেন। এ এক প্রতীকী রাজ্য, কিন্তু সহজেই অনুমান করা যায় দশরথের মতোই সফল রাজত্ব ছিল এই প্রতীকী রাজার। বানর রাজ্যে প্রথম রাজা বালী তেজস্বী যোদ্ধা এবং স্বেচ্ছাচারী। তাঁর নিধন হলে পর লঙ্কায় যুদ্ধ সমাপ্তির পরে রাম সুগ্রীবকে বানর-রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। বানরদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল না। তাই বর্ণসংকর থেকে প্রজাদের রক্ষা করার দায় রাজার ছিল না; কিন্তু নারী যে ভোগ্য পদার্থ এ নিয়ে দ্বিমত ছিল না, তাই বালী নিরুদ্দিষ্ট হলে সুগ্রীব ভ্রাতৃবধূ তারাকে গ্রহণ করেন এবং বালীর বধের পর আবার তাঁকে এবং নিজের স্ত্রী রুমাকে নিয়ে এক সঙ্গে বাস করেন। বালীর পর তাঁর অনুরোধে পুত্র অঙ্গদ অভিষিক্ত হয়ে কিষ্কিন্ধ্যায় রাজত্ব করেন, কিন্তু বানর রাজ্যের বিস্তৃত বিবরণ পাই না। মনে হয়, যখন সমস্ত প্রধান বানর ও সেনাপতিরা হৃষ্ট ও তুষ্ট ছিলেন তখন রাজ্য বিধিমতই চলত, প্রজারা সুখে ছিল। রাবণের যে প্রতাপ ও ঐশ্বর্যের পরিচয় হনুমান ও বিভীষণের কথায় পাওয়া যায় তার মধ্যে বর্ণসংকরের প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু কামার্ত রাবণ বহু নারীর প্রতি অসম্মান ও অত্যাচার করেছেন একথা পাওয়া যায়। অবশ্য মন্দোদরীর বিলাপে আভাসে বোঝা যায় রাজা হিসাবে রাবণ ভালই ছিলেন।
রাম রাজত্ব পেলেন উত্তর-যৌবনে এবং পিতা এবং বংশের সম্মান রক্ষার জন্যে যথাবুদ্ধি রাজত্ব করেছিলেন। প্রজাদের মুখে সর্বদাই রামনাম। ফলমূল সারা বছর ধরে পাওয়া যেত। যথাকালে (বা প্রয়োজন মতো) বৃষ্টি হত, বায়ু ছিল সুখস্পর্শ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নির্লোভ ছিল, প্রত্যেকে যথানির্দিষ্ট কর্ম করত এবং তাতেই সুখী ছিল। সকলে সুলক্ষণ, ধর্মপরায়ণ, মিথ্যাবর্জিত ছিল। এগারো হাজার বছর রাম রাজত্ব করেছিলেন, ভাইদের সঙ্গে। ধর্ম, যশ ও আয়ুর বর্ধক রাম অন্য রাজাদের জয় করে রাজত্ব করেছিলেন। (৬:১২৮:১০২-৭) এই বর্ণনা অতিরঞ্জিত কিন্তু অতিরঞ্জন বাদ দিলেও মনে হয় প্রজারা সুখে ছিলেন। সেই প্রজারাই সন্দেহ করল সীতার চরিত্রে, এবং দূতদের ডেকে রাম বললেন প্রজাদের সন্দেহ মোচনের জন্য এবং ‘আমারও সন্দেহ মোচনের জন্য’ সীতা সর্বসমক্ষে নিজের শুদ্ধি প্রমাণ করুন। (৭:৯৫:৬)
এই রামরাজ্যে শূদ্র ও নারীরা কখনও মানুষের মর্যাদা পায় না। শাস্ত্র বলে শূদ্রের কর্ম হল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের সেবা। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সেবায় মর্যাদা আছে, শাস্ত্র-নির্দেশিত সেবায় নেই, কারণ তার মধ্যে বাধ্যবাধকতা আছে, বিকল্প নেই। অসহায় ভাবে এই সেবা করে শূদ্র রামরাজত্বে সুখী ছিল এটা ততটাই সত্য যতটা সারা বছর গাছে ফল থাকা বা এগারো হাজার বছর রামের রাজত্ব করা!
পিতৃভক্ত, বন্ধুবৎসল, প্রজাহিতৈষী ভ্রাতৃবৎসল দেবদ্বিজে ভক্তিমান সুবিচারক, যজ্ঞকারী— অতএব আদর্শ যুগোচিত নায়ক। শূদ্র যদি ত্রিবর্ণের সেবা ছাড়া অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে তবে বর্ণ-ধর্মরক্ষাকারী রাজা তো তাকে মেরে ফেলবেনই। স্ত্রী যদি অনিচ্ছাতেও পরপুরুষের দ্বারা সৃষ্ট বা অপহৃত হয়— তবে যতই সচ্চরিত্রা হোন না তিনি, অগ্নিপরীক্ষা, নির্বাসন, পুনর্বার পরীক্ষা এই সব অবমাননা তাঁতে নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতেই হবে। সমাজ কখনওই নারীকে ব্যক্তি বলে স্বীকার করেনি, ভোগ্যবস্তু পণ্যদ্রব্য এই সব আখ্যা দিয়েছে। স্বর্গারোহণের পূর্বে রাম ভরতকে অযোধ্যার সিংহাসন দিলেন, তাঁর ও সীতার দুই পুত্র কোশল ও উত্তর কোশলের রাজত্ব পেলেন। সীতার সচ্চরিত্রবত্তা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁর গর্ভজাত সন্তানদের ইক্ষ্বাকু কুলের রাজসিংহাসনে অধিকার দেওয়া গেল না। প্রজারা নিশ্চয়ই পুলকিত হল, আদর্শ রাজা রাজকুল-মর্যাদায় এতটুকু লুষের বা তার সন্দেহেরও স্পর্শ লাগতে দিলেন না।
এই যে নতুন আদর্শের প্রজাপালক রাজার নির্মাণ হল, ইনি কিন্তু মহাকাব্যের নায়ক নন। সে নায়ক ক্ষত্রিয় যোদ্ধা বীর, আদর্শ রাজা হওয়া তাঁর কাছে প্রতীক্ষিত ছিল না। ক্ষত্রিয় নায়কের অঙ্গীকার ও কর্তব্য শেষ হয়েছে যুদ্ধ-জয়ে রাবণ-বধে। তার পর শুরু হল মহাকাব্যটিকে ঢেলে সাজানো: আদিকাণ্ডের প্রথমার্ধে ও উত্তরকাণ্ডে এঁর নবকলেবর রূপায়ণ ঘটল। এখন ইনি বর্ণধর্মের পরিপালক রাজা। শূদ্র ও নারীর কোনও রকম স্বাধীনতা, স্পর্ধা বা অধিকার স্বীকার করলে রাজ্যে পাছে কলির স্পর্শদোষ ঘটে, তাই ইনি সমাজের স্থিতাবস্থা রক্ষা করেছেন অতন্দ্রভাবে। এর কিছু মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে, একপত্নীক রাজা সীতাকে হারালেন। সমাজে নারীর সতীত্ব শুচিতা নিয়ে যে নতুন নিরিখ তৈরি হয়েছে তার কাছে বলি দিতে হল আপন দাম্পত্য-সুখ। কিন্তু এর মূল্য দিতে তাঁর বিশেষ বাজেনি, কারণ সীতাকে যখন তিনি প্রথম কঠিন কথাগুলো বলেন লঙ্কায়, তখন তা তাঁর হৃদয়ান্তর্গত ভাব অর্থাৎ, সমাজের নির্মম নির্দেশ তিনি নিজ অন্তরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বলেই ওই কথাগুলি বলতে পারলেন। এইখানে শাস্ত্রকারদের কাছে মহাকাব্যের পরাজয় ঘটল।
আজ যখন এ দেশের লোকমানসে ‘রামরাজ্য’ সম্বন্ধে একটা স্বপ্নকে পুনর্বার কৃত্রিম ভাবে সৃষ্টি করার একটা উদগ্র চেষ্টা হচ্ছে, তখন যেন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি: নারী শূদ্রের ওপর অত্যাচার যে তন্ত্রে অপরিহার্য ভাবে গৃহীত, যেখানে ধর্মাকাঙ্ক্ষী শূদ্র ব্রাহ্মণ-পুত্রের জন্য প্রাণ দিতে বাধ্য হয়, নিষ্পাপ অন্তঃসত্ত্বা নারী অকারণে যেতে বাধ্য হয় নির্বাসনে, এ যুগের দেওরালা-আরওয়ালের পরও আমরা কি সেই রাজতন্ত্রই চাই? এরই নায়ক কি ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’? অর্থাৎ পুরুষের সর্বোত্তম আদর্শ অসহায়কে, বিপন্নকে ও নারীকে রক্ষা করাই তো এতদিন আদর্শ পুরুষদের অবশ্য করণীয় ছিল, তাকে বর্জন করে যে রাজতন্ত্র, তা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে চুড়ান্ত অভিশাপ হয়ে উঠবে না?