সিমার

সিমার

এক

সুখবাসের বুকে একটিও লোম নাই। লোহা দিয়ে ঢালাই করা তবিয়ত। ইস্পাতে ঘাস গজায় না। সুখবাসের বুকে লোম গজানোর নরম ভেজা শ্যামলী মৃত্তিকা খোদা দেয়নি। সুখবাসের বুকখানাই বুঝি বা এক ঊষর কারবালা। হেথায় সিমার এক আশ্চর্য অধিপতি। এই বুকের ইস্পাত-নগরীতে বাজার বসিয়েছে সিমার। ভাবলে, সুখবাসের বুক ভেঙে যায়। মুসলমান বলে, সিমারের বুকে লোম ছিলনা। সিমারই তো কারবালার হোসেনকে পানির বদলে উপুড় ক’রে পিঠে চেপে জবাই করেছিল। ‘এ কেমন কাফেরের দেশ গো/জহর মিলে পানি মিলে না।’ সেই সিমার। জারিগান সারিগান। সর্বত্র সিমারের কথা আছে। এক ফোঁটা পানির জন্য কাতরাচ্ছে বুকের শিশু। এক আঁজলা জল। হোসেনের কণ্ঠনালি শুকিয়ে গিয়েছে। এজিদ সেই পানির বদলে অস্ত্র হাতে সিমারকে হোসেনের কাছে পাঠিয়ে দিল। তারও বুকে একটিও লোম নেই। কী নির্মম! কী নিষ্ঠুর! কী দয়াহীন বুকখানা! সুখবাস আপন বুকের দিকে চেয়ে চেয়ে বিচার করেছে, তবে কি সে সিমারই বটে? সুখবাসের ভরা যৌবনের সূচনা তখন। লম্বাচওড়া এক দানব যেন বা। হাতের পেশি ব্যায়াম-করা বীরদের মতন শক্ত, উদ্ধত, ফুল্ল। পা দু’খানি বটবৃক্ষের কাণ্ডের মতন মাটিতে খাড়া, দৃঢ়। পায়ের পাতা থেঁৎলো, ছড়ানো, ভরাট। পায়ের ছাপ পড়ে ধুলোয়, যেন জন্তুর দাগ। মানুষের মাপে মেলে না। পায়ের মাপে জুতো মেলা ভার। দোকানে কেনা যায় না। মাপ কষে মুচিকে দিয়ে বানাতে হয়। আর গেঞ্জি? ইঞ্চি কত? মাপের বাইরে ফেটে পড়ছে বুক। সর্বনাশ! একি মানুষ?

.

সুখবাস হা হা ক’রে হেসে ফেলে। ভাবে, তার গায়ে যদি ভালুক-লোম থাকত, তবে লোকে তাকে আদম বলে সম্মান করত। কারণ আদম হল পৃথিবীর প্রথম নবী। মুসলমান বলে, আদম আলাহে ছালাম। নবী। পয়গম্বর। আর সে কিনা, সিমার?

দাদীমা তার বুকে হাত বুলিয়ে বলেছিল— চুল কৈ বাছা! হায় পাপী! সিমারের বংশ রে সুখবাস। বড়ই নিদয়া।

আঠারো বছরের কিশোর আঠাশ বছরের যুবকের মতন তাগড়া। গোঁফ গজিয়ে যাচ্ছে, বুকে রোম নেই। পায়ে চুলের কালিমা। বুক একেবারে শুদ্ধ। ফাঁকা। সাদা। পাপের রঙ কি সাদা? পাপের রঙ কি শূন্য? খালি? সুখবাস কেঁদে ফেলে। চোখে চিকচিক করে জল। দাদীমা তাকে ঘৃণা আর ভয় করছে। দেশবাসীও সিমার বলে ডাকে। সুখবাস নামটা তলিয়ে যায়।

আসলে সুখবাসের বিয়ের বয়স হয় তখন। বাপ জানে, সুখবাস ছেলেমানুষ। গায়ে গোস্তে বাড়ন্ত বলে পুরুষ মনে হয়। দাদীমা বলল—পরহেজগার মেয়ে আনবে ঘরে। পুণ্যবতী। ঋতুমতী। ঠাণ্ডা।

বিয়ের কথা চলছে। সুখবাসের মনে সুখ নাই। সারাদিন কোথায় কোথায় পালিয়ে ফেরে। একদিন দুপুরবেলা বাড়ি ফিরেই দাদীর কাছে মাথা নিচু করে বসল। দাদীমা শুধাল— কোথায় ছিলি সারাদিন?

সুখবাস মৃদু উচ্চারণ করল—ঘোড়া। গরু। মোষ।

দাদীমা খলখল ক’রে হেসে ফেলল। বলল – বুঝেছি। কার ঘোড়া?

-লেবাসতুল্লার ঘোড়া! বরকতের গরু। চাহারুদ্দির মোষ।

—ভালো কথা। ক’টাকা দিয়েছে?

—চাট্টাকা করে আট। আর ঘোড়ার দশ।

—নেকাপড়া শিকেয় তুললি বাপ। জন্তু ফিরিয়ে বেড়ালি। মানুষ হলি নে।

-কী হবে মানুষ হয়ে, আমি তো সিমার। পাপী। তুমিই বুলেছ।

—হ্যাঁ। ঠাট্টা করেছি বাপ রে। মুসলমান কি সিমার হয়?

-হয়। লিশ্চয় হয়।

সুখবাস ডুকরে উঠল। বলল—স্কুলের ফার্সি-স্যার সাদেক মৌলবী আমাকে বুলে দামড়া। মুখের ভাষার ভুল ধরে। ‘কালাপাহাড়’, ‘সিমার’ বুলে গাল দেয়। জামা তুলে সকলকে দেখায় বুকে চুল নাই। সবখানে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে, আমি খারাপ। আমি যাব না। এইট অব্দি ঠেলে ঠুলে গিয়েছি, ওতেই চোখমুখ হয়েছে। আর না।

দাদী সমর্থন করে—তাই হবে। যাস না।

সুখবাস বলে—গরু মোষ ফিরাবো। ঘোড়া তাঁরে করব। মাটি চষবো। মুনিশ খাটব। আমার কাম। মুসলমানের নেকাপড়া মক্তবী নেকাপড়া আমপারা পড়ব। কুরান পড়ব। তা লয়, গিয়েছি সিমারী করতে। ইসকুলের নেকাপড়ায় খুদা নাই। বেহেস্ত দুযখ নাই। আমার বয়স হয়ে গিয়েছে। সব ছাত্র আমার হাঁটুর বয়েসী। আমি যেন একটা ফেউ। পেছনে লাগে মাস্টার অব্দি। শালা বুকের বুতাম খুলে…

হাউ হাউ ক’রে কেঁদে ফেলে সুখবাস। সুখবাসের গায়ে হাত বুলিয়ে দাদী বলে—শাদী কর্ বাছা। ধৰ্ম্মে মতি হবে।

সেকথা কানে গেল না সুখবাসের। হঠাৎ করে বলে উঠল—আচ্ছা দাদী! মেয়েমানুষের বুকেও তো চুল থাকে না।

দাদী ম্লান হেসে জবাব করল – তারা যে মায়ার জিনিস ধন, মায়াবতী সিমার যে পুরুষ। একটু দম ফেলে দাদী ফের বলল—বউকে ভালোবাসলে খুদা তোর বুকে দয়ামায়া দিবে। তুই সিমার, সেডা ভারি মিছে কথা সুখবাস!

সুখবাস দাদীর কোলে মুখ গুঁজে দিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল—আমাকে তুই মুসলমান ক’রে দে দাদী! বড় কষ্ট দাদী। খুব কষ্ট আমার!

নামাজ শিক্ষা শুরু হল সুখবাসের। মক্তব মাদ্রাসা যেতে শুরু করল। ভালো মতন মুখস্ত হয় না। খানিক মুখে আসে তো বাকি ভাগ পেটে থেকে যায়। আগায় পড়ে তো গোড়া ভুলে যায়। একদিন সে লক্ষ করল, ইসকুলের ফেলমারা কমবুদ্ধির ছেলেগুলো সব একে একে মক্তব মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। মাথা-অলারা সহজে মক্তব-মুখো হয় না। ভালো মাথা দু’একটি যে না থাকে তা নয়। খুব গরিব বলে হাইস্কুল যেতে পারেনি। তারপর আস্তে আস্তে কোরান হাদীস ভালোবেসে আপন কউম (গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়)-এর মুখ উজালা করে! তখন কারো কারো চোখে মুখে নূরের আলো পাকপবিত্র ঢেউ তুলে মানুষকে ফেরেস্তার মতন দামী মানুষ ক’রে দেয়। সেই শোভা দেখলে মনে হয়, আবে জমজমে গোছল হয়ে গেল। সত্যিই হয়।

তাহের সাহেব কারী। কোরান খুব সুন্দর ক’রে সুরে পড়ল। তাঁকে গায়ের জামা খুলে সুখবাস দেখালে—দেখুন, কারী সাহেব, আমি সিমার? বুলেন? সবাই মিথ্যুক কিনা বুলেন?

প্রাণ-খোলা হাসি হাসেন কারী। তারপর বলেন—বুকখানা সিমারের মতন বটে, মুখখানা তো নয়। হায় বাপ! আজও ফাতেহা সুরা মুখস্ত হল না তোর!

তারপর কেমন রহস্য ক’রে কানের কাছে মুখ এনে সুখবাসকে বলেন—কে তুমি বটে! আই ডোন্ট নো। হাঃ হাঃ হাঃ!

কারীর দু’একটি চমৎকার ইংরেজি বলার স্বভাব আছে। সুখবাস বুঝল, মুসলিম দুনিয়ায় সে যে কে, সেই ধন্দের সাফ জবাব কেউ দেবে না।

কারী আরো দু’দিন বাদে বললেন—মক্তবে দারুণ রাজনীতি চলছে সুখবাস। দেশে লোক দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। ভেরি কমপ্লিকেটেড অবস্থা। তুই কোন পক্ষে খুদা মালুম। সিমার বললে দোষ, নাকি না বললে দোষ বুঝতে পারছি না।

সুখবাস বাড়ি ফেরে। ফিরেই শুনতে পায় তার বিয়ের কথা চলছে। বাপ-চাচারা আসর ক’রে আলোচনা চালাচ্ছে। মগরাহাটের মৌলবী গিয়াসজীর মেয়ে জাহেদা সেই বিয়ের কনে। গিয়াসঙ্গী মক্তবের মৌলবী এখন। ভদ্রলোক বিপত্নীক। একমাত্র সন্তান জাহেদাকে সঙ্গে ক’রে পাঁচ বছর আগে তিনি সুখডহরি আসেন। সঙ্গে আসে ১১/১২ বছরের অনাথ দরিদ্র ভাইপো ঈশা। ঐ মাদ্রাসারই তালবিলিম। থাকে পাশের গাঁ সুখানটি। ইব্রাহিম আনসারীর বাড়ি। জায়গীর। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মাদ্রাসায় আসে। যাই হোক। খুব বড় পাশ-করা মৌলবী গিয়াসজী নয়। কিন্তু পড়ানোর সুনাম যথেষ্ট। সমস্যা হয়েছে তাঁকে নিয়েই। মক্তবকে সরকারী মঞ্জুরি পাইয়ে আলিয়া মাদ্রাসায় উন্নীত করানোর একটা গোপন তদারক তদ্বির চলছে। কিছুকাল যাবৎ। মক্তবের যিনি সেক্রেটারি, সইফুল্লা মণ্ডল, তাঁর ইচ্ছে সদ্য বিয়ে হওয়া এবং এফ. এম. পাশ জামাই কুদ্দুস মাদ্রাসায় ঢুকে যাক। তা করতে গেলে গিয়াসজীকে সরিয়ে দিয়ে সেই শূন্যপদে কুদ্দুসকে বসাতে হবে। গিয়াসজী অবশ্য এফ. এম. পাশ করা মৌলবীই। কুদ্দুস এখনো পড়াশুনা করছে, আরো বড় ডিপ্লোমা সে শিগগির যোগাড় করবে ইনশাল্লাহ। সেকথা সেক্রেটারি পাঁচ মুখে প্রচার ক’রে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। তাছাড়া কুদ্দুস বি. এ. পার্টওয়ান পাশ ক’রে উত্তর প্রদেশে আরবী দীনিয়াতী শিক্ষা করতে গিয়েছিল। গিয়াসজী ম্যাট্রিক পাশ করেননি। অতএব কুদ্দুসকেই কমিটির রেজলিউশন করিয়ে শিক্ষকের পদে নিয়োগ করা সমীচীন। মাদ্রাসার বয়স নয় বছর। পাঁচ বছর যাবত সামান্য বেতনে (জনসাধারণের কাছে সংগৃহীত অর্থ থেকে দেয়) গিয়াসব্জী মাদ্রাসা চালাচ্ছেন। সংগঠক মৌলবী তিনি, তাঁকে বাদ দিয়ে ধর্মস্থান না-পাক হয় নাকি? তাতে যদি মাদ্রাসা মঞ্জুরি না পায়, দেশের লোক যেমন এতদিন টাকাপয়সা গম ধান পাট দিয়ে মাদ্রাসা চালিয়ে আসছে, তাই চালাবে। মক্তব যদি মক্তবই থাকে, মাদ্রাসা না হয়, তবু ভালো। গিয়াসজীকে বাদ দেওয়া চলবে না।

দুই বিপরীত নীতি চর্চার ফলে জনগণ দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। কুদ্দুসের নিয়োগ যে মাদ্রাসার উন্নতির কতবড় সহায়ক একপক্ষ তা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। তারা গিয়াসজীকে ভালোবেসে ফেলেছে। নবীর ঘরে স্বজন পোষণের চালিয়াতি স্বার্থপরতা লোকে বুঝে ফেলেছে বটে, কিন্তু সেক্রেটারির তাঁবেদার গোষ্ঠিও কম জিন্দা নয়। মাদ্রাসার ঘণ্টা বাজানোর পিয়নী চাকরি দেবার লোভ দেখিয়ে সইফুল্লা গাঁয়ের একজন মোল্লাকে কাৎ করেছেন। তার, সেই মোল্লার গুষ্টি খুব বর্ধিষ্ণু আর সতর্ক আর মালদার। কেবল সেই মোল্লা সোভানী খতিবই দরিদ্র। ফলে মক্তব এখন চাপা অসন্তোষের জিম্মায় ভাসছে। একটা কিছু ঘটবে। সামনে মক্তব ইন্‌সপেকশন হবে।

এই অবস্থায় সুখবাসের বিয়ের কথা উঠল। গিয়াসজী রাজি হয়েছেন। জাহেদার বয়স এগারো বছর। রোগা পাতলা গড়ন, কিন্তু মুখশ্রী অপূর্ব। ভয়ানক মিষ্টি আদল। কাঁচা সোনার রঙ। মক্তবে পড়ে। বাপের সঙ্গে থাকে। তার একটা হিল্লে দরকার ছিল। গিয়াসজীর আত্মপ্রতিষ্ঠার কারণেও সুখডহরিতেই বড় গুষ্টি দেখে মেয়ের শাদী দেওয়া এই মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠল। নইলে তাঁর চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ। সুখবাসের গুষ্টি গিয়াসজীর হয়ে লড়বে। দরকার হলে লাঠি অব্দি চলবে। তাই বেশ। কথা কি বুঝলে সুখবাস?

সুখবাস বাপ-চাচার আলোচনা শুনতে শুনতে অনুভব করছিল, তার বুকের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। জাহেদার নরম ভেজা হাসিখুশি মুখখানা মনে পড়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে অসহায় গিয়াসজীর মুখটাও মনের ভেতর ভেসে উঠছে। গিয়াসজীর বয়েস হয়েছে। জাহেদা তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম ও দ্বিতীয় দু’টি বউই কপাল গুণে ঢেঁকেনি। মরে গিয়েছে। প্রথম বউয়েরও একটি মেয়ে আছে শোনা যায়। বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘর করছে। দীর্ঘদিন পর গিয়াসজী দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তারই মেয়ে জাহেদা।

জাহেদার জন্মের চার বছর পর দ্বিতীয় বউ মারা যায়। বউয়ের মৃত্যুর দু’বছর বাদে গিয়াসজী মেয়েকে সঙ্গে ক’রে সুখডহরি চলে আসেন। মেয়ের বিয়ে দিয়ে তিনি সুখডহরিতেই স্থায়ী বসবাস করবেন এমন বাসনার কথা সুখ হরির সকলেই জানে। মগরাহাট ফিরে যাওয়ার কোনো চাহিদা গিয়াসজীর নেই। মগরাহাটে সামান্য জমি জিরাত আছে, সেইসব বিক্রী ক’রে দিয়ে তিনি সুখড়হরিতেই থেকে যাবেন। কেউ যদি দয়া ক’রে বয়স্থা কোনো মেয়ের সঙ্গে গিয়াসঙ্গীর নিকে দেয়, সেই ব্যাপারেও মৌলবীর কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। সুখবাসদের গুষ্টি মধ্যেই তেমন স্বামী পরিত্যক্তা রাড়ী (বিধবা ) মেয়ের সন্ধান আছে। সেইসব কথাবার্তাও উঠছে ক্রমশ।

সুখবাস মনে মনে গিয়াসজীর দামাদ হয়ে গিয়েছে এই মুহূর্তে। সকলেই যখন আলোচনায় মশগুল সুখবাস তখন ছোট ভাবীর ঘরে ঢুকে পকেট ট্রানজিসটরখান টেবিল থেকে উঠিয়ে নেয়। গতবছর অগ্রজ ছোটভাইজান আরিফতের বিয়ে হয়েছে, ওর বুকে অনেক চুল আছে। ছোট বউ বড়ই রসিকা, চোখে ঠমক দিয়ে হাসে। সেই হাসি দেখে সুখবাস লজ্জা পায়। ঘর থেকে এক লাফে উঠোনে নেমে আসে। পেছন থেকে খিলখিল হাসি। পথে পালিয়ে আসে সুখবাস। ট্রানজিসটর খুলে দেয়। জোরে দম বাড়িয়ে দিয়ে কানে চেপে ধরে। রেডিও গাইছে :

আকাশের মিটিমিটি তারার সাথে
কইব কথা।
নাইবা তুমি এলে।

গান শুনতে শুনতে এগিয়ে চলে সুখবাস। আকাশে প্রকাণ্ড চাঁদ ঝুলছে, জ্যোৎস্নায় প্লাবিত পথ। কেমন নেশা জেগে যায়। হাঁটতে হাঁটতে সুখবাস মক্তবের কাছে চলে আসে। বিরাট বাড়ি। লম্বা দোতলা। মক্তবের নিচের তলা বহিরাগত তালবিলিম (ছাত্র) আর মৌলবী মৌলানায় পূর্ণ। নিচের তলায় বাস। উপর তলায় পড়াশুনো। সকাল সাড়ে নয়টা অব্দি ক্লাস চলে। শতকরা সত্তর ভাগ মেয়ে, তিরিশ ভাগ ছেলে। এইসব ছাত্রছাত্রীর চল্লিশ ভাগ দশটার পর স্থানীয় জুনিয়র হাইস্কুলে সাধারণ শিক্ষার জন্য পড়তে যায়। ফলে মক্তব মর্নিং। হাইস্কুল ডে। এইভাবে চলছে। বাকি ষাট ভাগ মক্তব ছাড়া অন্য কোনো শিক্ষা নেয় না। যাই হোক, মক্তবের কাছে চলে আসে সুখবাস। আজ তার এশা (মধ্যরাত্রির আগের নামাজ) পড়া হয়নি এখনো।

এখন রাত সাড়ে দশটা। পথ নির্জন। হঠাৎ মক্তবের নিচের তলার ঘর থেকে সোভানী খতিবের কড়া ধমক শুনতে পায় সুখবাস। খতিব মৌলবীদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আড্ডা (হাদীসী আড্ডা) দিচ্ছে। তাহাজ্জুদ (মধ্যরাত্রির নামাজ ) পড়বে মসজিদে গিয়ে, তারপর কোনোদিন বাড়ি ফেরে, নয়ত মসজিদেই শুয়ে যায়। খতিব গর্জন ক’রে ওঠে—রেডিও থামাও সুখবাস। জ্যোৎস্নায় সুখবাসকে চিনে ফেলেছে খতিব। রাগে গরগর করছে। বলছে—তুমি মুসলমানের ছেলে, তালবিলিম। মাদ্রাসার (যদিও আসলে মক্তব) পাশ দিয়ে নোংরা গান বাজিয়ে যাও, ভয় করে না? এভাবে গান শুনলে চল্লিশ বছরের এবাদত (উপাসনা) নষ্ট হয়, জানো না? এজিদের বংশ নইলে এই শখ কার হবে, আসলে যে সিমার। হাতে পাওয়ার থাকলে মাদ্রাসায় ঢুকতে দিতাম না। ছিঃ।

সশব্দে জানালা বন্ধ হয়। রেডিও থেমে যায়। সুখবাসের মনে হয়, বুকের মধ্যে কেউ নিশ্চয় বসে আছে। বন্দী হয়ে আছে। আপন মনে গানটা শুনছিল। রেডিও-য় সুখবাস নব ঘুরিয়ে যায়। আরব থেকে আরবী কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে না। ঢাকা থেকে নাতে রছুল বা খোদাকে হম্দ শোনা যায় না। হঠাৎ কেন যেন তার খতিবের গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। নিজেকে এখন তার সিমারই মনে হয়। খুব দ্রুত সে বাড়ি ফিরে নামাজে দাঁড়ায়। তাবত গা থরথর ক’রে কাঁপে। যেন জ্বর এসে গিয়েছে।

বিয়ের রাত। মনে পড়ছে সন্ধ্যাবেলা উঠোনে পাশাপাশি দু’টি চেয়ারে বর-কনে বসেছে। মিঠাই শরবত পানি খাওয়ানো হচ্ছে। একটা ছোট রসগোল্লার আধখানা বরকে খাইয়ে বাকি ভাগ জাহেদার মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে। বাঁকা চোখে সুখবাসকে দেখছে জাহেদা। কাপড়ে জড়ানো কিশোরীকে কলাবউয়ের মতন দেখাচ্ছে। সুখবাস কালো পশমের কিস্তিটুপি, সাদা ইস্তিরিবিহীন পা-জামা জামা পরেছে। বাংলাদেশি জাপানি টেরিকটন। পায়ে জাফরি ফিতে চামড়ার স্যাণ্ডেল আর ধলো মোজার তলায় ধুলোর দাগ। মুখে গন্ধীরুমাল, মুখে ঘামতেলের মতন হিমানী। এঁটোজল খাওয়ানো হচ্ছে কনেকে। গিয়াসজী সুখবাসের হাতে মেয়েকে সঁপে দিচ্ছেন। খাইয়ে না-খাইয়ে এতদিন সাথে ক’রে আগলে রেখেছি। মানুষ করতে পারিনি। তবে মেয়ে আমার দশ পারা কুরান কণ্ঠস্থ করেছে। তার দেহ পবিত্র। তার যেন অসম্মান না হয় সুখবাস বাবাজীবন। জাহেদার নিঃশ্বাসে ফেরেস্তার গায়ের গন্ধ পাবে বাপজী। কখনো কোনো যাতনা দিও না। আদর দিয়ে মুহব্বত দিয়ে সুখি করবে, তার বেশি কামনা করি না। তার জীবনমরণ তোমার হাতে। তার ভালোমন্দ তোমারই হাতে। তোমারই পায়ের তলায় তার জান্নাত (স্বর্গ)। মা জাহেদা, সুখবাসই তোমার সব মা। ইহকাল পরকালের সাথী। সুখদুঃখের শরীক। স্বামীর কথা কখনো অমান্য কোরো না। যখন যা চাইবে, সাথে সাথে পালন করবে। যত কষ্টই হোক, কোনো কিছুতেই না বলবে না। (হাদীসে আছে উটের পিঠে যেতে যেতে স্বামীর যদি কামনা জাগে, স্ত্রী তা সেই উটের পিঠেই নিবৃত্ত করবে।) কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারলেন না গিয়াসজী। আটকে গেল। কেন না জাহেদার এখনো সারা বুকে স্ফুট পূর্ণিমা আসেনি। হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) হয়নি। কাঁচা নরম গা। হাড়গুলো পুরোপুরি শক্ত হয়নি। এসব কথাও তো বলতে হয়। বলতে পারেন না তিনি। কারণ তিনি পিতা। চুপ ক’রে থাকেন। কিছুক্ষণ পর ফের বলে যেতে থাকেন—যখন যা চাইবে দিতে হবে। তার সমস্ত ইচ্ছাই তোমার ইচ্ছা। তার ভালো লাগাই তোমার ভালো লাগা। তার দেহই তোমার দেহ। তার মনই তোমার মন। এক আত্মা, এক প্রাণ। আর তোমাদের সুখেই আমাদের সুখ। থেমে পড়লেন মৌলবী। অস্ফুট ডুকরে উঠল কণ্ঠস্বর। সেইদিকে চেয়ে রাড়ী বেওয়া নাদিরার চোখ ছলছল ক’রে উঠল। তিনি বারান্দায় মেয়েদের জটলায় দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। সুখবাসের ফুপু।

বিয়ের রাত। বর কনে এক ঘরে শুয়েছে। বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়েছে কে বা কারা। মধ্যরাত্রে কেমন একটা আর্ত মেয়েলি স্বর উচ্চকিত হয়ে থেমে যায়। কেউ কিছু বুঝতে পারে না। মা চাচী আর বউরা এসে সুখবাসকে নরম ক’রে ডাকে। কোনো সাড়া পায় না। সব নিঃশব্দ। হঠাৎ কিঞ্চিৎ ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ। মেয়েরা পরস্পর চোখে চোখে চেয়ে লজ্জা পায়। বাইরের শেকল নামিয়ে দিয়ে তারপর ঘাড় নিচু ক’রে আপন আপন ঘরে ফেরে। ভোর হয়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সুখবাস। বারান্দার মেঝেয় দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। চোখমুখ ফুলো ফুলো। লাল রক্তজবার মতন চোখ। পরনের সাদা লুঙ্গিতে রক্ত লেগে আছে। বাড়ির সবাই সুখবাসের ঘরে জড়ো হয়। জাহেদার মুখের মধ্যে ঠেসে ঠেসে কাপড়ের আঁচল ঢোকানো। তাবত বিছানা রক্ত মাখা। জাহেদা মৃত। মুখের ভেতর থেকে কাপড় টেনে বার করা হয়। চোখ দু’টি খোলা। হিম। স্থির।

দুপুর নাগাদ জাহেদার কাফন হয়। গোর হয়। তারপর সইফুল্লার হেফাজতে পুলিশ আসে। সুখবাসের বাপের কাছে ঘুষ খেয়ে পুলিশ ফিরে যায়। পুলিশ যখন গিয়াসজীর কাছে ঘটনা জানতে চায়, গিয়াসজী চুপ ক’রে থাকেন। পীড়াপীড়ির ফলে কেবলই বলেন—সবই নসীব দারোগা বাবু। জানি না কী ঘটেছে। কেউ কি বিয়ের রাতে ইচ্ছে ক’রে বউ মারে! ওরা দু’জনেই যে ছেলেমানুষ।

তারত গাঁয়ে মৃদু উত্তেজনা হয়। পুলিশ ফিরে গেছে শুনে উত্তেজনা গাঢ় হয়। কিন্তু গিয়াসজীর নীরবতা সকলকে ঘটনার গুরুত্ব সম্বন্ধে ক্রমশ নিরুচ্চার ক’রে দিতে থাকে।

সেইদিন বিকালে সুখবাস রতন নন্দীর বাড়ি এসে বলে – দ্যান নন্দীবাবু ঘোড়াখানা, ফিরিয়ে (বশ মানানোর ট্রেনিং) দিই। লাগাম পরাই। তারপর সুখবাস লাফিয়ে ওঠে ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া ছুটে যায় শিলাডিহির জঙ্গল বরাবর। সন্ধ্যা নেমে আসে। জঙ্গলে ছুটতে গিয়ে লতার জটে গাছের কাণ্ডে ধাক্কা খেয়ে সুখবাস ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। ঘোড়া তখন ছুটে যায় অন্য দিকে। অন্ধকার নিবিড় নয়। কেননা আকাশে চাঁদ উঠেছে। কিন্তু পাতায় ডালে আচ্ছন্ন জঙ্গলের আকাশ। পাতার ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্নার উঁকি ঝুঁকি। মাটিতে পাতার আস্তরণ। জ্যোৎস্না আর অন্ধকারের মিলিমিশি ভাব। সুখবাস ঘোড়া খুঁজতে থাকে। ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পায়। তার নিজের পায়ে শুকনো পাতার শব্দ শোনে। ঘোড়ার সাথে সারারাত তার লুকোচুরি চলে। শব্দ শোনে। ঘোড়া পায় না। তারপর সে ক্লান্ত হয়ে একটি আমগাছের গোড়ায় চুপচাপ বসে। গা এলিয়ে শুয়ে যায়। ঘুম আসে। রাত্রি অতিবাহিত হতে থাকে। চাঁদ ডুবে যায়। তখনো অন্ধকার থাকে। মৃদু শীত পড়ে। হাওয়া বয়। ক্রমশ পুব আকাশ ও অরণ্য ফিকে আঁধারে অদ্ভুত স্তব্ধ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে ঘোড়াটা সুখবাসের কাছে ফেরে। সুখবাস তখনো ঘুমন্ত। ঘোড়া সুখবাসের গায়ে মুখ ঠেকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে। হিম উষ্ণ মুখ। সুখবাসের ঘুমন্ত গা শিরশির ক’রে ওঠে। ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ ঘোড়ার ছায়া দেখে আঁৎকে ওঠে। ঘোড়াটাকে আশ্চর্য ভয় করে তার। মনে হয় এ ঠিক ঘোড়া নয়। জাহেদা। জাহেদার মৃত্যু। সেই মৃত্যুর এক প্রবল আকৃতি। সুখবাসের স্পর্শে জাহেদা এই ধারা সিঁটিয়ে আঁৎকে বলেছিল—হায় খুদা খুদাবন্দ!

দু‍ই

লজ্জায় আর মক্তব যেতে পারে না সুখবাস। ঘটনার পর একদিন মাত্র গিয়েছিল। মৌলবীরা খুব ভালো ক’রে কথা বলেননি। ছাত্রছাত্রীরা কেমন চোখ বড় বড় ক’রে তাকে দেখছিল।

বরং গিয়াসজী তাকে কাছে ডেকে পড়া বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভালো ব্যবহার করেছিলেন। বলেছিলেন—মন দিয়ে পড়াশুনো করে পরহেজগার হও। খোদাভীরু হও। ইমাম হও। ভালো মওলানা হও। যদি কোনো বদি (পাপ) ক’রে থাকো খোদার কাছে মাফ চাও। কাঁদো। ইত্যাদি অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সুখবাস লক্ষ করছিল, মুসলমানের জামাতে তার স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। কিছুদিন সেই ধারা মনে হলেও ক্রমশ সুখবাস টের পাচ্ছিল তার দুর্ঘটনার কথা লোকে ভুলে যাচ্ছে। জাহেদা এক তুচ্ছ জীব। অমন মৃত্যু কখনো ঘটে না এমন নয়। বন্ধুদের সে গোপনে শুধিয়ে দেখেছে, কমবয়সী বউরা স্বামীর ভয়েই বিয়ের পর কিছুদিন বাপের ঘর পালিয়ে বেড়ায়। গাঁয়ের রাস্তায় কত কচি মেয়েকে চুপচাপ পালিয়ে যেতে দেখেছে তারা

যাই হোক। সাত মাস বাদে সুখবাসের দ্বিতীয় বিয়ে হয়। দাদীমা বলেছিল, তাজা মেয়ে এনো। তাগড়া জাহাঁবাজ মেয়ে এনো। পুরুষ্ট গোলগাল মেয়ে এনো। যুবতী মেয়ে এনো।

দাদী মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে মান্য করা হয়েছিল। মদিনা ছিল জাহাঁবাজ মেয়ে। তাগড়া। তাজা। পুরুষ্ট আর ভয়ানক যুবতী। মদিনার বাপ ছিল গামছা-বোনা জোলা। ভীষণ দরিদ্র। গাঁয়ে গামছা বিক্রি করতে এসে সুখবাসের বাপ-চাচার সাথে বিয়ের কথা পাকা হয়। লোকটি ভালোমানুষ। সুখবাসকে ঘৃণা করেনি। কারণ দরিদ্ররা ভালোমানুষই হয়। যথাতথা ঘৃণা করে না। তাছাড়া মেয়ের বাপকে নাক উঁচু করলে চলে না। অতএব বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

বিয়ের রাত। তখন গরম কাল। বাসর ঘরে ঢোকার আগে বারান্দায় জামা কাপড় খুলে হাওয়া খাচ্ছিল সুখবাস। এক ফাঁকে নামাজ পড়ে নিয়েছিল। তারপর ঘাড়ে জামা ফেলে ঘরে ঢুকেছিল। সুখবাসের খালি গা, ফাঁকা বুক দেখে চমকে উঠেছিল মদিনা। একটিও রোম নেই। ভয়ানক খালি। ঘন হয়ে কাছে এগিয়ে যেতেই মদিনা সুখবাসের বুকে হাত রেখে ককিয়ে উঠেছিল—কে বলে তুমি সিমার। আমার বেহাল কোরো না। মেরো না। পাষাণের তলায় পানি থাকে। আমি জানি। আমি ভালোবাসব তোমাকে। ঘেন্না করব না। সিমারও তো মুসলমান।…তুমি আমাকে ভালোবাসবে তো?

সুখবাস কথা বলতে পারছিল না। সিমারও যে মুসলমান এ-কথা সে প্রথম শুনল। শুনল পাষাণের তলায় পানি থাকে। এবং ভালোবাসার কথা প্রথম এক নারীকণ্ঠে শুনতে পেল। আজ অব্দি সে কারুকে তার পাপের কথা বলতে পারেনি। ভেবেছে তার কথা কেউ শুনবে না। ঘৃণা করবে। সুখবাসের বুকের ভেতরটা কেমন এক ভয়ে আনন্দে কাঁপছিল। বলল—আমি সিমার ঠিক কথা মদিনা। লোকের বচন আমাকে সিমারই করেছে। আমি জাহেদার মুখে কাপুড় ঠেসে দিনু, কী একটা যে ভর করল গায়ে। একিন হয় তুমার? লরম পাখির পারা মেয়েলোকের পরাণ আমি ঠুকরে খেয়েছি, হায় গো! একিন হয় মদিনা? কাপুড় ঠেসে দিনু আর…

মদিনা বলল–হয়। তারপর সুখবাসের বুকে আঙুলের তুলিতে লিখল আলিফ লাম মিম। দু’টি চোখে তার প্রগাঢ় ভালোবাসার ঘনতা ঠিকরে ওঠে। বলল—দম আটকে গেল’ জাহেদার?

সুখবাস সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়না না। তা লয়। তেমুন তো লয় গো। দম আটকেছে ভেন্ন জুলুমে। সে কথা বুলা যাবে না বউ। রক্তে ভেসে গেয়েছে জাহেদা। পাপের লোহু। হায় হায়!

বুকের উপর থেকে মদিনার হাত মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে সুখবাস আপন বুকে সজোরে কিল মারতে থাকে। বুকের মধ্যে কে যেন তার হায় হুসেন হায় হুসেন করছে। সান্ত্বনাহীন আর্তনাদ করছে। হোসেন (বা হুসেন)-কে হারিয়ে যেমন ক’রে মুসলমান কাঁদে। শিয়ারা শোক পালনের ব্রতে মরিয়া হয় কারবালার যুদ্ধর স্মৃতি-উৎসবে মহরমের দিন। এ যেন তেমনি পাগল।

সুখবাস বলে—আমি জাহেদার বদনখানা কিছুতেই মুনে আনতে পারি না মদিনা। পারি ন্যা! কেমুন ছিল পাক-সুরত তোকে বুঝাব কেমনে বউ! আবার বুকে ঘুসি আছড়ে ফেলে। সিজদার মতন বালিশে মাথা রেখে ছটফটিয়ে কেমন মাথার চাপে ঘষটে ঘষটে বালিশ দলিত করে। তারপর সে ভয়ের কথা বলতে শুরু করে। নন্দীর ঘোড়ার কথা। অরণ্যে ঘোড়া হারিয়ে যাওয়ার কথা। তারপর গা চেটে দেওয়ার কথা। পাতার শব্দ। চাঁদ। অন্ধকার। শিরশিরে হাওয়া। ঘোড়ার জিহ্বায় মৃত্যুর স্বাদ। যেন জাহেদাই ফিরে এসেছে। বা ভয়ংকর কেউ। ঘোড়া তীব্র চিৎকার করল। খোদার আসমান আর জঙ্গল কেঁপে উঠল। কী অসম্ভব শাস্তি হয়েছিল সেই রাত্রিতে। সুখবাস বলল—কেউ জানে না বউ কেউ বুঝবে না।

মদিনা স্বামীর পিঠে আঙুল বুলিয়ে লিখল—কাফ ফে রে। কাফের। তারপর আঁচল দিয়ে রগড়ে রগড়ে তুলতে থাকল সিমারের পিঠ।

গফুর জোলা, মদিনার বাপ, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর মনে পরম সন্তোষ আর শান্তি পেয়েছিল। গামছা-বোনা গরিব লোক, গামছা কাঁধে এ-হাট ও হাট ফিরি করত। এমন কি ওপারে বাংলাদেশে চলে যেত গামছা বিক্রির জন্য। এক দিন শোনা গেল, লোকটি কী এক খেয়ালবশে নিজের বিবিকে সাথে ক’রে ওপারে চলে গিয়ে আর ফেরেনি। সংবাদ এল মদিনার কাছে, মদিনা গুনগুন ক’রে কাঁদল খানিক। তারপর স্বামীকে বলল—ইহজন্মে আমার আর কেউ নেই গো, তুমি ছাড়া। তুমি ফেলে দিলে কোথাও যাওয়ার ঠাঁই নাই। আমায় ফেলে দিও না। তুমি যখন যা চাও, যত কষ্টই হোক, আমি দেব।

কথা শুনে সুখবাসের প্রথম বিয়ের ঘটনা মনে পড়তে লাগল। গিয়াসজী যত কথা বলেছিলেন, সব মনে পড়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই সে জাহেদার মুখ মনে করতে পারল না। তার সমস্যা হয়েছিল, জাহেদাকে মনে করা। মনে করতে না পারা। সে চাইছিল, জাহেদাকে মনের মধ্যে স্পষ্ট করে দেখবে। মৃত্যুর পর এতদিন হল কখনো জাহেদা দেখা দিল না। কেন দেখা দিল না? মনের মধ্যে কোনো ছবি নেই কেন? সিমার কি কোনো ছবি মনে রাখে না? নাকি জাহেদা পাক-পবিত্র ছিল বলে, তার নিঃশ্বাসে ফেরেস্তার গায়ের গন্ধ ছিল বলে সুখবাসের কাছে একদিনও এল না? মদিনা বলল—মনে করার চেষ্টা করো। শান্ত মনে ভাবনা করো। ধ্যান করো। জাহেদা আসবে।

একদিন হঠাৎ সুখবাস একটা স্পষ্ট কথা বিচার করতে শিখল। কেন আসবে জাহেদা? মদিনা বললেই কি আসবে? লেখাপড়া জানা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা না-দেওয়া বউ বলছে বলেই কি আসবে? তার তো দু’মুঠো ভাতের জন্য এখন আর পেট কাঁদে না। সে এখন আল্লার কাছে থাকে। তার খিদে লাগে না। আর যখন বেঁচে ছিল, মাটিতে ছিল, গোরের উপর দুনিয়ায় ছিল, তখন তার আশ্রয় দরকার ছিল। গিয়াসব্জী তার মেয়েকে দিয়ে আত্মীয় হতে চাইলেন কেন? না, তাঁর কেউ নেই। সইফুল্লা চাকুরি ছিনিয়ে নেবে। তাড়িয়ে দেবে। পথে বসাবে। তাই জাহেদাকে ঘুষ দিলেন তিনি। কিন্তু তারপর?

মদিনাও একটু আশ্রয় আর দু’মুঠো ভাতের জন্য পাষাণের তলায় পানি দেখতে পায়। সিমারকে ক্ষমা করে দেয়। দিনের বেলা সহবাসে রাজি হয়। সহবাস নয়। যৌন-ক্রিয়া। শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঘরের মধ্যে থাকে না। উঠে পড়ে। দরজা খুলে বাইরে চলে গিয়ে দ্রুত হাতে কীসব কাজ করতে থাকে। কোনো কাজ না পেলে অযথা ঝাঁট দেয়। মুখ গম্ভীর। অপমানিত। অ-খুশি। কিন্তু মদিনা যত কষ্টই হোক মরবে না। সেই প্রতিজ্ঞার শিখা মদিনার চোখে জ্বলতে দেখা যায়। মদিনা সবল পুষ্ট দুর্দান্ত যুবতী। সে কি বুঝবে? বুঝবে না। জাহেদা কী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল সুখবাসকে তৃপ্ত করার। সুখবাস বিড়বিড় করে—জানো, কেমন ক’রে মেরে ফেলি? নীরবে মুখ বুজে অত্যাচার সইছিল। তার শরীর ছিল ঠাণ্ডা আর ভদ্র। হাল্কা আর ফুলের মতন। গন্ধিত আর পলকা। প্রথমে একটু আর্তনাদ করছিল। বিপদে ভয়ে যেমন মানুষ আল্লা আল্লা করে, তাই করছিল। বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পড়ছিল। ভাবছিল কোরানের আয়াতে বোধহয় মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ যুবতী হয়ে ওঠার শক্তি আছে। কিন্তু খোদা তাকে বাঁচাতে পারেনি। একসময় সে জোরে আর্তনাদ করেছিল। তখন সুখবাস মুখে কাপড় ঠেসে দিয়েছিল। এক সময় হঠাৎ খেয়াল হল, জাহেদা কেমন নিঃশব্দ। ঠাণ্ডা। কাঁদছে না। জাহেদা মরে গিয়েছে। কিন্তু সে চেষ্টা করেছিল সুখবাসের বাসনা পূরণের। যা তার কর্তব্য ছিল। গিয়াসঙ্গী কি সে-কারণেই সুখবাসকে ক্ষমা করতে পেরেছেন? সমাজ কি সে-কারণেই এই ঘটনার তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি? আচ্ছা এটাই কি নিয়ম? জাহেদা কি সত্যিই খুব তুচ্ছ জীব? তার মৃত্যু কি কিছু নয়? সুখবাস ভাবে, কিছু নয়। কোনো ঘটনা নয়। অমন হয়ই। হতেই পারে। লোকে কিছু ভাবে না। অতএব মদিনা বলছে, জাহেদা আসবে। ধ্যান করলে আসবে নিশ্চয়। দু’মুঠো ভাতের জন্য নয়। তবু কেন আসবে সে? আমি তো প্ল্যান ক’রে মারিনি। সিমার, তাই মেরে ফেলেছি। ভেবেছিল সুখবাস। জীবনের চাপে যেমন আদিম নিস্তরঙ্গ মস্তিষ্কেও অযুত অস্পষ্ট ভাবনা নড়ে উঠেছিল।

মদিনা চেষ্টা করছিল তার বিশ্বাস ও সাধ্যমতো। একটা পবিত্র বাতাবরণ রচনা ক’রে তুলত মধ্যরাতে। তাহাজ্জুদ নামাজে স্বামীকে প্রতিষ্ঠিত ও ধ্যানস্থ করতে চাইত। আগরবাতি জ্বেলে দিয়ে বলত—নামাজে খোদার কাছে হাত তুলে কাঁদো। মোনাজাত (প্রার্থনা) করো। জাহেদাকে ডাকো। ও আসবে।

সুখবাস চেষ্টা করেও স্বপ্নে জাহেদাকে দেখতে পেত না। নামাজে মোনাজাত করেও নয়। সুখবাসের ঘুম আসত না। এক সময় সে মদিনার সাথে মিলিত হতো। মদিনার পুষ্ট সবল দেহ জাহেদাকে আড়াল করে দিচ্ছিল।

সুখবাস ভোরের নামাজ পড়ে প্রতিদিন অন্ধকার ঝাপসায় মক্তবে আসত। গিয়াসজীর পাশে চুপচাপ বসে থাকত। পায়ে হাত দিয়ে কদমবুশি (প্ৰণাম) ক’রে সামান্য বেলা হলে বাড়ি ফিরে আসত। মক্তবে পড়াশুনার আর কোনো চাহিদা তার ছিল না। সুখবাস মনে করত, গিয়াসজীকে দেখলে তার কারা দেখার মতন পুণ্য হয়। সুখ হয়। এইভাবে চলছিল। একদিন সহসা সেই ঘটনাটি ঘটাতে পারল সইফুল্লা।

সেদিন দুপুরবেলা জোহরের নামাজের কিছু আগে একবার দেখা করতে এসেছিল সুখবাস। প্রশ্ন করেছিল—কীভাবে জাহেদাকে দেখতে পাব আব্বাজী? স্বপ্ন যে দেখি ন্যা!

গিয়াসজী বললেন—পাবে। আমি পাই। কতদিন মেয়ে আমার কাছে আসে বাবাজীবন। বসে। গল্প করে। খেতে চায়। ভালো ক’রে কোনোদিনই খেতে দিতে পারিনি তো! খেতে চায়! দু’মুঠি ভাতের জন্য সেই কোন দূর দেশ থেকে সুখডহরি এসেছি বাপ। পরের অন্নে কষ্ট আছে বাপজী। এই দ্যাখো, এতক্ষণও সইফুল্লার মেয়ে ভাত নিয়ে এল না। ভাবছি, এরপর থেকে তোমাদের বাড়িতেই স্থায়ীভাবে খাব। তোমরা আমার জায়গীর (এক্ষেত্রে আশ্রয়) হও। সেক্রেটারির অন্ন ভয়ানক সুখবাস। আর, চুনতী, মানে সায়রা, সেক্রেটারির মেয়ে, যে আমাকে ভাত দেয় রোজ। ভারি ফাজিল মেয়ে। খুব সেয়ানা! দাঁড়াও। দেখবে? কাউকে বলতে পারি না। তোমাকে দেখাই। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। গিয়াসজী চৌকির তলা থেকে বাক্স হাতড়ে সাদা চিরকুট তুলে এনে সুখবাসকে দেখিয়ে বলেন— দ্যাখো, কী লিখেছে!

সুখবাস স্তম্ভিত হয়ে দেখে, একছত্র কাঁচা হাতের লেখা। ‘আমি আপনাকে শাদী করব ওস্তাদজী। ইতি আপনার প্রেমিকা চুনতী।’ সুখবাসের চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে ওঠে। মৌলবী বলেন—দেখছ স্বভাব। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে, চুনতী ও-কথা লেখেনি। কেউ লিখে দিয়েছে। কী মনে করো? সুখবাসেরও বিশ্বাস হয় না। এ-কথা চুনতী ওরফে সায়রার নয়। পেছনে কোনো গূঢ় মতলব আছে। সুখবাস জানালা দিয়ে দেখতে পায় সালোয়ার-কামিজ পরে উড়নি উড়িয়ে ঢাকনা ঢাকা ভাতের থালা নিয়ে চুনতী এদিকেই আগুয়ান। সাথে সাথে চৌকি ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুখবাস। বলে—লেখাড়া আমার সাথে থাকুক আব্বাজী! মদিনাকে দেখাব। পরে চুনতীকে মদিনা ডেকে শুধিয়ে দেখবে। যাই আব্বা?

সুখবাস দ্রুত মক্তব ছেড়ে পথে নামে। বাড়িতে এসে কথাটা মদিনাকে বলতে যাবে এমন সময় পাড়ার একটি মেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে বলে—সইফুল্লার দল গিয়াসজীকে মেরে ফেললে গো! সুখবাস ভাই, দাঁড়ায়ে কর কি, লাঠি নিয়ে চলো।

সাথে সাথে সুখবাসের বাপ-চাচারাও মক্তবমুখো ছোটে। সুখবাসও একখানা লাঠি হাতে ছুটে আসে। ঘটনাস্থলে এসে দেখে চারিদিক থেকে ভিড় ক’রে গিয়াসজীকে গোল ক’রে ঘিরে ফেলেছে ওরা। টানাটানি চলছে। গিয়াসজী নাকি চুনতীকে উলঙ্গ করতে চেয়েছিলেন। এর আগেও নাকি এমন ঘটনা ঘটতে গিয়ে ঘটেনি। আজ শালোয়ার-কামিজ ছিল বলে রক্ষে! সুখবাসরা এসে পড়ায় উত্তেজনা কিঞ্চিৎ থেমে আরো বেড়ে যায়। সুখবাসের লাঠি গিয়ে সইফুল্লার মাথায় আছড়ে পড়ে। অন্য কারো হাতে লাঠি ছিল না। সইফুল্লার দলের হিম্মৎদার সুখবাসের মতন প্রকাণ্ডদেহী দু’চারজন আছে, উনিশ বিশ। তারা নিরস্ত্র। ফলে সইফুল্লার সামান্য রক্তপাত হয়। অদম্য সিমারের লাঠির বিজলি ঘাত সকলকে অপ্রস্তুত ক’রে দেয়। ঘটনা আরো উত্তেজক হয়ে ওঠে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বেশিদূর গড়ায় না। সুখবাসরা ফিরে আসে। গিয়াসজীকে সাথে ক’রে টেনে আনে। অতঃপর সইফুল্লা কড়া সিদ্ধান্ত করে, মিটিং ক’রে গিয়াসজীকে বরখাস্ত করবে। সুখবাস হাতের চিরকুট দেখিয়ে বলে—ঘটনা ভেন্ন। আমার শ্বশুর নিদোষী।

সমাজের দু’টি ভাগ স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্যান্য দেশের (গ্রাম )মাতব্বররা জড়ো হয়ে বিচার বসায়। তাকে বাইশী সভা বলে। বাইশখানা গ্রামের মানুষ – যোগ দেয় সেই বিচার সভায়। সেই বিচারে একটি দিন ধার্য করা হয়। উক্ত দিন এই ধরনের জনসমাবেশের মধ্যে মসজিদে উঠে গিয়াসজী কোরান হাতে ক’রে বলবেন—চুনতীকে তিনি স্পর্শ করেননি। মৌলবীর চরিত্র সর্ম্পকে সন্দেহ দেখা দিলে মাদ্রাসা টিকবে না। কারণ, অধিকাংশই মেয়েছেলে ছাত্রী। এক সপ্তাহ বাদে সেই দিনটি ধার্য করা হয়। মক্তব আবাস থেকে বিতাড়িত গিয়াসজী সুখবাসদের বৈঠকে আশ্রয় নিয়ে চলে আসেন। তাঁর ঘাড় সেই যে নিচু হয়ে গেল, তিনি আর কারো সামনে স্পষ্ট ক’রে মুখ তুললেন না। মনে হতো সব সময় তিনি ঢুলছেন। প্রায়ই চোখ মুদে থাকতেন। যেন কী সব তিনি ধ্যান করতেন বোবার মতন।

সেই নির্দিষ্ট ধার্য দিন এল। সেইদিন সুখবাস বাড়ির নতুন বলদ জোড়া জুড়ে দৌলতডিহির ক্ষেতে গিয়েছিল ধান আনতে। ভেবেছিল দুপুর নাগাদ ফিরবে। আছরের নামাজের (বিকাল বেলার নামাজ) পর মসজিদে উঠবেন গিয়াসজী। কোরান হাতে ক’রে কসম করবেন, চুনতীকে তিনি স্পর্শ করেননি। কোনো গোলমালও হয়ত হতে পারে। ভেবেছিল সুখবাস। এইসব ভাবনার চাপে তার মাথা গরম হয়েই ছিল। কাদাপাঁক ঠেলে, গাড়ি ঠেলে আনতে হয়েছিল। গায়ে পানি-কামড়ি পোকায় কুটকুট ক’রে জ্বালা করছিল। হাঁটু অব্দি কাদায় লিপ্ত দেহ। পরিশ্রমে অবসন্ন হয়েছিল সুখবাস। জিভ ঝুলে পড়ছিল। ধোঁকাচ্ছিল ঘনঘন। গরু জোড়াও কথা শুনছিল না। মাঝে মাঝেই বেচাল চলছিল। সব মিলিয়ে সুখবাস তখন ভয়ানক উত্তেজিত। দিশেহারা। বাড়িতে এসে বাহির পালাঙ্গায় (বাহিরের উঠোন) গাড়ি দাঁড় করালো। গা ঘামে জবজব করছে। চোখে মুখে . বুকে ঘামের স্রোত। নিঃশ্বাস টানছে জন্তুর মতো। ডাকল—মদিনা?

মদিনা আর দাদী দুপুর বেলায় ঘরের মধ্যে রসালাপ করছিল। ডাক শুনে সাথে সাথে উত্তর দিতে পারে না। তখনো ওদের কথার পূর্ণচ্ছেদ হয়নি। ওরা খিলখিল করে হাসছিল। এদিকে ভেতর উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে সুখবাস। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। মসজিদে লোক জমে গিয়েছে কল্পনা করতে পারছে সুখবাস। তার ধৈর্য হারিয়ে যেতে থাকে। মনে হয়, এমন অবাধ্যতা করার কথা ধর্মে নাই। মদিনা তাকে যেন পরোয়া করছে না। আবার ডাক দেয় গলা তুলে মদিনাকে। মদিনা তখন দাদীকে হাসতে হাসতে চোখ টিপে গলা চেপে বলে—সিমার এসে গেল দাদী! দাদী বলে—ও! সিমার এলো বুঝিন! যাও বহিন তৈয়ার হও। ঠাণ্ডা করো, যাও!

কথাটা সুখবাস শুনতে পায়। ভয়ানক অবাক লাগে তার। তাহলে কানের আড়ালে এরা তাকে সিমারই মনে করে। তাকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করে। গল্প মারে। মনে হতো, ভালবাসে। আসলে ঘৃণা করে। ছোটলোক ভাবে। সহ্য হয় না সুখবাসের। বুকের মধ্যে সত্যিই সহসা সেই সিমার, নির্বোধ সিমার জেগে ওঠে। কাপড় চোপড় ঠিক ক’রে গুছিয়ে বেরিয়ে আসতে তখনো দেরি হয় মদিনার। সুখবাস ক্ষেপে যায়। সিমার ভয়ংকর হয়ে ওঠে। পায়ে কাদা। গায়ে জ্বালা। গা ধোয়া, পা ধোয়া, গোছল ইত্যাদির কোনো ব্যবস্থাই রাখেনি মদিনা। মদিনা বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতেই মস্তিষ্ক পশুর মস্তিষ্কে রূপান্তরিত হয়। সিমারের ঘাতক-বৃত্তি চূড়ান্ত সীমায় ওঠে। সুখবাস তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ চিন্তা করে না। এক বদনা পানি এগিয়ে দেয় মদিনা। এক বদনা পানিতে কী হবে? হাত-পা জুড়োবে? গোছল হবে? পানি-কামড়ি নিস্তার দেবে? অসম্ভব রাগ হয় সুখবাসের। বলে—তুমি আমাকে ঘেন্না করছ?

মদিনা অবাক হয়। বলে—কেন? ঘেন্না করব কেন?

—তাই দেখছি।

-না। ঠিক দেখছ না।

–ঠিকই দেখছি। তুমি ঘেন্না করো। আমাকে সিমার বুলে গাল দেও।

-ঠাট্টা করেছি।

-তুমি আমাকে ঠাট্টা করো?

-ভুল করেছি।

-এক বদনা পানি! এখন বুঝিন ঠাট্টা মারানোর টাইম?

-ডোল ক’রে এনে দিচ্ছি পানি।

-না। আনতে হবে না। আমি তুমাকে তালাক দিচ্ছি। তুমি চল্যা যাও।

-সে কি?

ভয়ানক অবাক হয় মদিনা। হঠাৎ আর স্বামীকে আর চিনতে পারে না। স্বামীরা কেমন ক’রে তালাক দেয় নানান গল্প শুনেছিল সে। আজ বুঝতে পারে, তালাক আসলে পুরুষের হাদীসী অসুখ। হিস্টিরিয়া। দাঁত-খিচুনি বদ-হাওয়ার দোষ।

‘তালাক’ বলে ওঠে সুখবাস। সাথে সাথে মদিনা ছুটে গিয়ে স্বামীর মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরতে চেষ্টা করে। সুখবাস ওকে ধাক্কা দিয়ে উঠোনে ছিটকে ফেলে দেয়। তারপর আরো জোরে ‘তালাক ‘তালাক’ ক’রে ওঠে। পাশের পড়শীদের গলা তুলে ডাক দেয়—এসো। শোনো। আমি তালাক দিচ্ছি গো। তালাক। তালাক। বায়েন তালাক।

মুহূর্তে উঠোন পাড়ার লোকজনে ভর্তি হয়ে যায়। তখনো উঠোনে পতিত মদিনা হতবুদ্ধি। বিশ্বাস করতে পারছে না। সুখবাসের বাপ লাঠি হাতে ছুটে এসে সুখবাসকে বেদম মারতে শুরু করে। শালা সিমারই বটে। শুয়োর কোথাকার। মাথা-গরম, হট-টেম্পার শালা। বেবুঝ। বদমাস! শালার বেটা শালা, নিমদ্দা। দুলা মেয়েদের ওপর মর্দানি করে। আজ উকে আমি মেরেই ফেলাব।

বেদম মার খেয়ে সুখবাস উঠোনে শুয়ে পড়ে। কষ ছিঁড়ে রক্ত পড়ছে। পিঠে লাঠির দাগ বসে গেছে। হতবুদ্ধি মদিনা ছুটে গিয়ে শ্বশুরের লাঠি চেপে ধরে সবেগে। বলে—মারবেন না। ও তো বোঝে না কিছু। ও যে ঠাট্টাও বোঝে না গো! বলেই মদিনা দু’হাতে মুখ ঢেকে উচ্চকণ্ঠে কেঁদে ওঠে। তার কণ্ঠ আকাশে উঠে খোদার আরশ (সিংহাসন) অবধি ছুটে যায়।

তিন

মসজিদে ওঠেন গিয়াসজী। কোরান হাতে আজান দেওয়া সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। তিনি সুখবাসকে তালাক দিতে শুনেছেন। দেখেছেন। তিনিও বৈঠক থেকে ভেতরের উঠোনে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন মদিনার তীক্ষ্ণ কান্না লম্ব হয়ে উঠে খোদার সিংহাসনের দিকে ঝলমল ক’রে বর্শার মতন উঠে যাচ্ছে। তারপরই তিনি মসজিদে চলে আসেন। লোক সমাগম হয়েছে প্রচুর। ভিড়ের মধ্যে গিয়াসজী লক্ষ করেন, সুখবাসও এসেছে। গায়ে পাতলা চাদর জড়ানো। চোখ মুখে প্রহারের চিহ্ন স্পষ্ট। মনে হয় পুরনো যুগের একটা নির্বাক মূর্তি। আদি মানব। সেই দিকে চেয়ে দেখেন গিয়াসজী। হাত-পা প্রবল কেঁপে ওঠে। ছোট কোরান খানা পরম মমতায় সবেগে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। তারপর কাঁপা গলায় বলতে থাকেন—আমি কোনো পাপ করিনি পিয়ারে হাজেরিন (প্ৰিয় উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলী)। আপন বিবি ছাড়া কোনো স্ত্রীলোককে ছুঁইনি। সায়রা আমার মেয়ের মতন। আল্লাহ আমার ও সায়রার ইজ্জত রক্ষা করবেন। বলতে বলতে গিয়াসজী আজানের সিঁড়ি ভেঙে টলমল করা পায়ে নিচে নেমে এসে সইফুল্লার পায়ের কাছে বসে পড়েন। পকেট থেকেএকখানা সাদা লিখিত দরখাস্ত বার করে এগিয়ে ধরে বলেন—আমার ইস্তফা। বলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন। সাদা টুপি মাথায়, সাদা কলিদার, পরনে সবুজাভ লুঙ্গি, নরম অসহায় আদল ঈশা চাচাকে ছুটে গিয়ে জাপ্টে ধরে কাতর গলায় ডেকে ওঠে—চাচা! চাচা! চাচা গো! …

সভা ভেঙে যায়। সেই থেকে গিয়াসজী মসজিদেই থেকে যান। তাঁকে মসজিদের বাইরে খুবই কম দেখা যেত। তাঁর কাছে সুখবাসদের বাড়ি থেকেই আগের মতন ভাত যেত। কিন্তু বহে নিয়ে যেত অন্য লোক। সুখবাস নয়। কেন নয়? কারণ সুখবাস তালাকের সভা শেষে আর বাড়ি যায় না। বাড়ির পেছনের বাগানে এসে ঢোকে। আম লিচু কাঁঠাল বহড়া জামের বাগান। ফল ফুরিয়েছে। কিন্তু গাছের ডালে এখনো মাচা বাঁধা। বাঁশ (লগি) বেয়ে সেই মাচায় উঠে আসে সুখবাস। আজ থেকে এই মাচাই তার পালংক।

মদিনা তার পর হয়ে গিয়েছে। মদিনার চোখে চোখ পড়লে পাপ হবে। মদিনার কোথাও যাওয়ার ঠাঁই নাই। মদিনা থাকবে বাড়িতে, সুখবাসের ঘরে। সুখবাস থাকবে জঙ্গলে, অন্যের ঠেকে বা কোথাও। মদিনা আর সুখবাস সামনা সামনি হওয়া ধর্ম বিরুদ্ধ। তালাকের সাথে সাথেই মদিনার উচিত ছিল বাপের বাড়ি চলে যাওয়া। মদিনা কোথায় যাবে? বাপ কোথায়! মদিনা সুখবাসের ঘরেই আছে।

সুখবাসের বুদ্ধি বেড়ে গেছে। বিচার ক্ষমতা শক্তিশালী হয়েছে। সে আর কিছুতেই বাড়িতে ঢুকতে চাইল না। কখনো যদি বাড়ি যাবে স্থির করত, তবে জঙ্গল থেকে খবর পাঠাত, সে আসছে। ভাইরা মায়েরা মাচায় গিয়ে তার সাথে কথা বলে আসত। খাবার পৌঁছে দিত। সুখবাসকে ঘরে টেনে আনতে পারেনি। গভীর বেদনা পেলে মানুষ যেমন নরম আর ভারী গলায় কথা বলে সুখবাস সেইভাবে কথা বলত। বলত—তোমরা কেনে দুঃখ পাও। কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি মদিনাকে ছাড়তে পারব না। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। ওরই ঘর, ওকে দিয়ে আমি বনবাসী হয়েছি। তিন মাস পর আমি যাব

জঙ্গলে মশার কামড় সইতে হয়। ভয়ও করে একলা। মদিনাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই। সইফুল্লার দল পাহারা দিচ্ছে। সুখবাসদের পালাঙ্গায় মাচার উপর মধ্যরাত অব্দি আজকাল লোক গুলজার হয়। সইফুল্লার লোক এসে বসে থাকে। ভোরে দুপুরে সাঁঝে লোক ঘুরে বেড়ায়। সুখবাস বাড়িতে ঢুকছে কিনা লক্ষ করে। কারণে অকারণে সইফুল্লার লোক বাড়িতে বিড়ির আগুন দরকার বলে ঢুকে পড়ে।

এই অত্যাচার বাবা সইতে পারে না। তার ধৈর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছেলের জন্য মায়া হয়। আবার তার আদিখ্যেতা দেখে রাগ হয়। এই বাড়ির আগের তেজ নষ্ট হয়ে যায়। বাপ চাইছিল, ছেলে জঙ্গল থেকে ফিরে এসে ঘরে থাক। মদিনার দায়িত্ব খোদার। যেথা খুশি সে চলে যাক। ফুরিয়ে যাক। শেষ হয়ে যাক। ভিখিরি হয়ে যাক। বেশ্যা হয়ে যাক। মদিনাকে বাড়ির কেউই আর তেমন সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মদিনা পাগল সুখবাসের কথা ভেবে, মুখ চেয়ে এই যাতনার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সংসারে পড়ে থাকে। বুঝতে পারে পাগল সুখবাস, নিষ্ঠুর সিমার তাকে ভালোবেসেছে। তারই জন্য জঙ্গলে পড়ে আছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তিনমাস সময় তো কম নয়। এতদিন ধৈর্য থাকবে তো সুখবাসের? গভীর রাত্রে স্ত্রী-দেহের জন্য সুখবাসের কষ্ট হবে না? বাড়ির লোক মাচায় গিয়ে নানারকম ক’রে বোঝাচ্ছে। চাপ দিচ্ছে। অথচ মনের যে জোরে লোকটা অমন ক’রে পড়ে আছে তার পক্ষের একমাত্র মানুষ মদিনাই।

গভীরতর রাতে একদিন মদিনা জঙ্গলের মাচায় এসে ওঠে। দেহদান করে। কোনো কথা হয় না। কোনো কথা বলে না। দেহদানের মধ্যেই থাকে মানুষের আর এক ধর্মশক্তি। যা কেতাবী ধর্মের চেয়ে গূঢ়। যেকথা মদিনা জীবন ও জৈব প্রাণে অনুভব করে। পর্দা হাদিস কোরান ঈমান সে রাত্রির অন্ধকারে জলাঞ্জলি দিয়ে অদ্ভুত ক’রে নিঃশব্দে হেসে ওঠে। পাগলের মতন। তার কোনো উপায় থাকে না। কোনো বিচার থাকে না। সমাজ থাকে না। সে ভাবে, সে তো সিমারের ছেড়ে দেওয়া বউ। বড় জোর দোযখের জ্বালানি বই নয়।

এইভাবে তিনমাস কেটে যায়। মাচায় একলা কয়েদি অন্ধকারে শুয়ে থাকে। পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের নক্ষত্র চোখে পড়ে। চাঁদ চোখে পড়ে। মনে পড়ে আর এক গভীর অরণ্যের কথা। একটা ঘোড়ার কথা। পাতায় পায়ের শব্দের কথা। সব মনে পড়ে। সে কান পেতে থাকে পাতায় কোনো পায়ের শব্দ উঠছে কিনা! রাত্রি বেড়ে যায়। ঘুম আসে তার। তখন সে একদিন এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে। তার তিনমাস পূর্ণ হয়। স্বপ্ন দেখে কেমন এক পাতলা জলের মধ্যে মৃতপ্রায় মাছের মতন একটি মেয়ে ভাসছে। তার একখানা হাত জাহেদার মতন, অন্যখানা মদিনার। সেই জলে নেমেছে সুখবাস। জলের তলা থেকে দু’খানি হাত তার দিকে ছুটে আসছে। কী বিচিত্র দু’খানি হাত ছুটে আসছে। সুখবাসের পা জড়িয়ে ধরে জলের গভীরে টানছে। পা ছাড়িয়ে নিতে পারছে না। জাহেদা তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যেতে চায়? ভয়ে চিৎকার করে ওঠে সুখবাস। জাহেদাকে দেখল সে। কী ভয়ংকর! একখানা হাত মোটা বলিষ্ঠ। অন্যখানা লিকলিকে। ভয়ে সুখবাসের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। জাহেদার লিকলিকে হাত অসহায় হয়ে জলের মধ্যে সুখবাসকে হাতড়াচ্ছে। ভয় পায় সুখবাস। ঘুম ভেঙে দেখে মাচার উপর সে শুয়ে আছে। কেউ নেই। পায়ের শব্দ নেই পাতার উপর। ভীষণ ভয় পায় সুখবাস। মাচা ছেড়ে নিচে নেমে আসে। শুকনো পাতা মাড়িয়ে সেদিন অন্ধকারে চোরের মতন সে গাঁয়ের মসজিদে এসে ওঠে। তারপর গিয়াসজীর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে বলে—আব্বাজী!

চমকে উঠে ফ্যালফ্যাল ক’রে কুপির আলোয় গিয়াসজী সুখবাসকে দেখতে পান। গায়ে হাত দিয়ে সস্নেহে বুকের কাছে টেনে বলেন—তুমি এসেছ!

চার

সুখবাসের চেহারা ছবি দেখে শিউরে ওঠেন গিয়াসজী। কেমন শুকিয়ে গিয়েছে, বন্য মোষের মতো স্বাস্থ্য আর নেই। চোখের কোলে কালির পুরু দাগ। সুখবাস বলে—আমাকে ঘরে ফিরিয়ে দ্যান বাপজী! আমি ঘরে যাব। তিনমাস দশ দিন কেটে গেল। মদিনার একটা বিহিত করেন।

সেকথা ভেবেছেন গিয়াসঙ্গী। বললেন—কার সাথে শাদী দিই মদিনার? কে করবে? করলেই তো হয় না, দয়া ক’রে ফের তালাক দেবে কিনা তেমন কারুকে যোগাড় করতে হবে! তোমার কোনো দোস্ত…..

সাথে সাথে সুখবাস বলে—না বাপজী! কারুকে বিশ্বাস নাই। মানুষের মুন তো চাখতে পারি ন্যা। দোস্ত বলেন, বন্ধু বলেন, আপনিই সব আমার! আচ্ছা, ঈশা কি রাজি হয় না?

—ঈশা! অস্ফুট উচ্চারণ করেন গিয়াসজী। তারপর কিছুক্ষণ দম ধরে চিন্তা ক’রে বলেন—বেশ তাই হবে। ঈশার সাথেই নিকে পড়িয়ে মেয়েকে হালাল করিয়ে তোমার হাতে তুলে দিব। ঈশা ভালো ছেলে। চাচার কথা ঠেলতে পারবে না। যাও। নিশ্চিন্ত থাকো তুমি!

সুখবাস অরণ্যে ফিরে যায়।

পরদিন ঈশাকে প্রস্তাব করতেই ঈশা দীর্ঘসময় মাথা নিচু ক’রে থাকে। গিয়াসজী বলেন—বিয়ের পরদিন ভোরে মদিনাকে ত্যাগ করবে। তালাক দেবে। রাতটুকুর মতন…

ঈশা চাচার কাছে থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই গিয়াসজী ধমক দিয়ে ওঠেন—কী হল তোমার? কথা বলছ না যে? তুমি রাজি নও? আমার হুকুম, তুমি নিকে করবে। যাও। সুখবাসের বাড়ি সন্ধ্যায় আসবে। আমি অপেক্ষা করব।

রাত দশটা নাগাদ বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়। ঈশা সেজেগুজে এসেছে। চোখে সুমা অব্দি টেনেছে। গায়ে ধোয়া কলিদারে আতরশুদ্ধ মেখেছে। খুব ধীর স্থির ভাবে মন্ত্র-কলমা ইত্যাদি বয়ান পড়ে গেল ঘাড় কাত ক’রে। বিয়ে গিয়াসজীই পড়ালেন। তাবত প্রাঙ্গণ লোকে গিজগিজ করছে। বৈঠকখানায় মুখোমুখি বর-কনে বসে আছে। হ্যাজাক জ্বলছে থামের পাশে ঝুলন্ত। মাঝে মাঝে লোকজন বৈঠকের বারান্দায় বর-কনেকে ঘিরে উপছে গিয়ে ঢেউয়ের মতন ছুঁয়ে সরে আসছে। ভিড়ের মধ্যে সুখবাস কোথাও নেই। গিয়াসজী চিন্তা করলেন, সুখবাস নিশ্চয়ই জঙ্গলে মাচায় শুয়ে আছে। আসলে সুখবাস হ্যাজাকের আলোর বাইরে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সব অনুষ্ঠান লক্ষ করছিল। জাহেদার বিয়ের মতন এ-অনুষ্ঠান নয়। সুখবাস কান খাড়া ক’রে শুনবার চেষ্টা করে গিয়াসজী ঈশাকে কী বলেন। লোকের কথার গোলমালে, চাপা গুঞ্জনে, এলোমেলো শব্দের মধ্যে কোনো কথাই সে শুনতে পায় না। শীত পড়েছে। গায়ের জামার বোতাম আটকায়। মোটা চাদরখানা জড়িয়ে নেয়। অপেক্ষা করে। গিয়াসজী শরবত খাওয়াচ্ছেন ভাইপোকে। সেই এঁটো শরবত মদিনার মুখে তুলে দিচ্ছেন।

ভিড়ের মধ্যে সইফুল্লার দলও রয়েছে। তারাও দেখছে। গিয়াসজী ভাইপোর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন—মনে রেখো তুমি মুসলমান। মুসলমানের ইমান খুব কড়া। তুমি সিমার নও। তুমি ঈশা। আজ তোমার পরীক্ষার রাত। মুসলমানকে একা যুদ্ধ করতে হয়। চলো। তোমরা দু’জনে ঘরে চলো।

দু’জনই ঘরে ঢুকে যায়। দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে চৌকাঠের গোড়ায় একখানা চেয়ার টেনে এনে প্রহরীর মতন বসে পড়েন গিয়াসব্জী। এত দিনের মন-মরা মানুষটি যেন সহসা তাজা হয়ে উঠেছেন। বলেন—আমি কথা বললে প্রতিটি কথার জবাব দেবে ঈশা। দেরি করবে না।

ঈশা জবাব দেয়—জী! খুব নম্র উত্তর। সেই স্বর দূরবর্তী বাইরের মানুষ শুনতে পায় না।

এরপর ধীরে ধীরে ভিড় পাতলা হতে থাকে। সবাই বুঝতে পারছিল, ঐভাবে লোকটি সারারাত পাহারা দেবে। অতএব আড়ি পেতে ঘটনা শোনা বা দেখা যাবে না। পুরো রসটা বেহেড মৌলবী মাঠে মারলেন। চলে যেতে থাকে লোকজন। দু’একজন তখনো অতি উৎসাহী লোভী ছেলেমেয়ে ঘুরঘুর করে। গিয়াসজী তাদের কড়া ক’রে বলেন—যা দেখবার শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন ওরা ঘুম যাচ্ছে। যাও। চলে যাও।

অগত্যা তারাও বিদায় নেয়। কেবল বৈঠক থেকে একটু দূরে বিচ্ছিন্ন বাড়ির জানালায় দু’টি চোখ জেগে থাকে। নাদিরা ফুপু। তিনি গিয়াসজীর মতন একজন মুসলমানকে দেখছেন। ঘুমুতে পারছেন না। রাত্রি বেড়ে চলে। গিয়াসজী ভেতরের দিকে প্রশ্ন করেন—তোমার কি কষ্ট হয় ঈশা?

ঈশা উত্তর দিতে দেরি করে। একটু উষ্ণতা মেশানো গলায় গিয়াসজী ফের শুধান—কষ্ট হয়? উত্তর আসে—জী না! কিন্তু চাচা! সুখবাস আমার বোনকে এইধারা রাত্তিরে মুখে কাপড় গুঁজে মেরেছে।

—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি মদিনাকে স্পর্শও করবে না। প্রমাণ করবে তুমি আমার রক্তের পুত্তলি, তুমি ইসলামের সেবক। খাদেম। তুমি সিমার নও। দুর্বল অসহায় যে তার দেহে আঘাত কোরো না। এক ফোঁটা রক্ত যেন না ঝরে! বলতে বলতে হাউ হাউ ক’রে বৃদ্ধ ডুকরে উঠলেন। তারপর কান্না ভেজা গলায় ডেকে ওঠেন—মা জাহেদা! মা গো!

ঠিক এইসময় ভিতরের দৃশ্যপট অন্যরকম। ঈশা মদিনার দিকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে এসেছিল। গায়ের কাপড় টান দিয়ে খুলে ফেলেছিল। মদিনা কিছু বলেনি। মুখ তার শুকিয়ে গিয়েছে। কণ্ঠে কথা ফুটতে চাইছে না। সহসা সে দ্রুত অসহায় হয়ে কেমন যেন উত্তর দেয়—জী! আব্বা! আমি এই তো! আপনার জাহেদা!

ঈশা ভয় পায়। সংবিত হয় তার। পেছনে সরে এসে ঘামতে থাকে। তারপর চিৎকার ক’রে ওঠে—’না!’ না-মদ্দা চাচা। গরিব। খেতে পায় না। জোর নাই। জানের ভয়ে যে ইসলাম ইসলাম করে, তার ইসলাম কেউ নেয় না। আমি মদিনাকে ছাড়ব না। তালাক দিব না। কিছুতেই না।

কিন্তু সে কিছুই বলতে পারে না। মদিনার চোখে চেয়ে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকে। রাত্রি আরো গভীর হয়।

একসময় গিয়াসঙ্গী দেখতে পান, মাটির উপর দিয়ে মাটির বুক ছুঁয়ে একটি হ্যারিকেন এদিকে এগিয়ে আসছে। মাটির এক হাত উঁচু বুক ছুঁয়ে চলে আসছে। হ্যারিকেন তা প্রথমে বোঝা যায় না। এক ফোঁটা আলো দেখতে পাওয়া যায়। কাছে এলে দেখা যায় একখানা ছইতোলা গরুগাড়ি। সাথে আট-দশ জন লোক। সইফুল্লার দল। সইফুল্লা গিয়াসঙ্গীর সামনে এগিয়ে এসে বলে- -খুব অনাচার করেছেন। এবার চলুন। ঈশার সাথে আমাদের সব কথা হয়ে গিয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী যাচ্ছে। আপনিও ওদের সাথে চলে যান। ভোর পাঁচটায় বাস। পাকা রাস্তা অব্দি তুলে দিয়ে আসবে।

দেখতে দেখতে আবার লোকজনে তারত উঠোন স্রোতের মতন ভরে যায়। সইফুল্লার গলা শুনে দরজা খুলে বাইরে ছিটকে বেরিয়ে আসে ঈশা। গিয়াসজী চমকে ওঠেন। হঠাৎ একটি সঙিন বাঁধে জলের চাপ বেসামাল হয়ে ছোট ছিদ্র দেখা দেয়। সেই ছিদ্রপথে জল পিচকারির মতন ছুটে বার হতে থাকে। ঈশাকে তাঁর সব কথা বলা শেষ হয়নি। তিনি খুশি হয়েছিলেন, মদিনা খুব বুদ্ধিমতি। মা বলতেই সাড়া দিয়েছিল। ভালো করেছে। কিন্তু সেই ডাকও যে নিষ্ফল হয়ে যায়।

লোকের ভিড় আরো বেড়ে যাচ্ছে। দূরের ঝোপটা নড়ে কেঁপে ওঠে। কেউ তা লক্ষ করে না। ঈশা সটান গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়ে। মদিনাকে সইফুল্লার লোক জোর ক’রে টেনে হিঁচড়ে আনে। বাইরে এনে ঠেলতে ঠেলতে গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। মদিনা তখন আকাশে মুখ তুলে আর্তনাদ ক’রে ওঠে। সুখবাসের বাড়ির এসবের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। কেউ বাধা দিতে ছুটে আসে না। কেউ না। দূরের জানালায় ফুপু ডেকে ওঠেন প্রবল কাতরতায়—সুখবাস! ঝোপ নড়ে ওঠে।

সুখবাস ছুটে আসে না। দূরের ঝোপ থরথর করে কেঁপে ওঠে! সইফুল্লা বলে—যাও। হাঁকিয়ে যাও। তিন ক্রোশ পথ। মাঝরাত এখনো সবখানি গড়ায়নি। কে চালিয়ে যাবি রে?

এই সময় মাথায় পাগড়ি বাঁধা একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে ঠেলে এসে গাড়িতে এক লাফে উঠে বসে গরু খেদিয়ে দেয়। গাড়ির সাথে চার অনুগামী। সইফুল্লার লোক। গাড়ি ছাড়বার একটু আগে গিয়াসজীকে জোর ক’রে ছইয়ের ভেতর ঠেলে দিয়েছে তারা। চারজন পায়ে হেঁটে। একজন দেদার বক্স মৌলবী। বাকি তিনজন তালবিলিম। তালেবুল এলেম। ছাত্ৰ।

গাড়ি চলছে দ্রুত। এক মাইল নিঃশব্দ আসার পর গিয়াসব্জী চোখ খুললেন। চরাচর কালো ভয়াল অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। গাড়ির তলায় ঝুলন্ত কালি-পড়া অস্পষ্ট হ্যারিকেনের ভৌতিক আলো। সেই আলোর ধাক্কায় চার অনুগামীর ছায়া দুলছে। তাদের এখন মানুষ মনে হচ্ছে না। অবাস্তব কিছু মনে হচ্ছে। দূরে দিগন্তের দিকে চাইলেন গিয়াসজী। কিছুই দেখতে পেলেন না। কোথায় চলেছেন এই ভয়াবহ রাত্রিতে? বললেন—সইফুলা সাহেব এমন সম্মান ক’রে পৌঁছ দেবেন, ভাবিনি।

দিদার বক্স মৃদু গলায় জবাব করেন—জী! মানীর মান খোদার হাতে। গিয়াসজী বলেন—আপনারা সাথে আছেন, ভালোই হল।

-কেন? দিদার জানতে চান।

গিয়াসজী কোনো উত্তর করেন না। গাড়ি চলতে থাকে। দেখতে দেখতে এক ক্রোশ পথ অতিক্রান্ত হয়। অকস্মাৎ গিয়াসজী গুনগুন ক’রে ওঠেন। আরবী সুরা। কোরানের সুদীর্ঘ আয়াত। একেবারে কণ্ঠস্থ। গলা থেকে মন্দ্রসুরে উদ্‌গত হয়। মাঝে মাঝে শ্বাসাঘাতে উচ্চকিত হয়ে ওঠেন তিনি। অনর্গলিত চিকণ ফোয়ারা অক্ষরে অক্ষরে জড়িয়ে তীব্র বেগে প্রকাশিত হতে থাকে। মুহূর্তে থেমে তিনি নির্দেশ করেন—তুমিও বলো বাপজী! ঈশা হক। বলো বাপ!

ভীষণ আদুরে অলৌকিক আর্তি ঝরে পড়ে গলায়। ঈশার নাকে মদিনার সুবাসমিশ্রিত শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে গিয়েছিল। মদিনার শরীরের গভীরে পৌঁছতে বাসনা হয়েছিল। তাকে সহবাসের মরণে কতদূর টানা যায় পরীক্ষা করতে ইচ্ছা হয়েছিল। সব মিথ্যা হয়ে গেল। মনে হল চাচার কণ্ঠে নবী যেন কথা বলছেন। সুরার সুর সংক্রামিত করল ১৭/১৮ বছরের কিশোর ঈশাকে। সমস্ত পরিবেশ সুরে গুঞ্জনে অপার্থিব হয়ে উঠতে লাগল। ঈশা এক সময় গুনগুন করতে শুরু করল। কেমন সম্মোহিত হয়ে যেতে লাগল।

সেই আবিষ্ট ভাইপোকে গিয়াসজী নরম সুরে বললেন—তালাক দাও। এক তালাক দাও। আমরা এক ক্রোশ এসেছি।

ঈশা হক্ তন্ময়তার মধ্যেই বলে উঠল—তালাক! তারপরই আবার কোরান পাঠ ক’রে যেতে লাগল। দিদার বক্স আঁৎকে উঠলেন। বললেন—এ কী করছেন গিয়াসজী!

গিয়াসজী উত্তর দিলেন না। অনুগামী তিন ছাত্রকে বললেন— মিজান, মকবুল, ঈদ্রিশ! তোমরাও পড়ো। আল্লার কালাম পড়ো।

তিন ছাত্র সাথে সাথে প্রস্ফুটিত হয়ে গেল। দিদার আর্তনাদ করে উঠলেন—সর্বনাশ! করেন কী? আমার যে ভয় করছে! সইফুল্লা সাহেব বলেছিলেন…দেখুন, আমার চাকরির কথাটা ভাবুন, মানে আমার দায়িত্ব…

কোনো কথাই শোনেন না গিয়াসঙ্গী। আরো জোরে খোদার কালাম – ধ্বনিত ক’রে চলেন। এ এক অদ্ভুত অভিযাত্রা তাঁর। যেন অলৌকিক অপার্থিব মোহগন্ধহীন সুখকর দেশান্তর। জীবনের সব অপমানের অমৃতময় গ্রহণে তিক্ততার প্রত্যাখ্যান। তিনি গুঞ্জরিত মুকুলিত। প্রস্ফুটিত হয়ে নিজেকে গেঁথে গেঁথে মহাকাশে খাড়া ক’রে তুলছেন।

নদীর কিনার দিয়ে গাড়ি চলেছে। জলে প্রতিধ্বনিত হয় খোদার কণ্ঠস্বর। ফিরে এসে মানুষকে প্লাবিত করে। দুই ক্রোশের মাথায় দ্বিতীয় ‘তালাক’ ঘোষিত হয়।

হঠাৎ দিদার বক্স মকবুলের কানের কাছে গলা নামিয়ে বলেন—কে রে গাড়োয়ান? সিমার না? মকবুল থেমে যায়। দাঁড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। ঈদ্রিশের কানেও একই বার্তা পৌঁছে দেন দিদার বক্স। ঈদ্রিশও থেমে পড়ে। ভয় পায়। এইভাবে সিজানও আয়াত থামায়। পা থামায়। ওদের খেয়াল হয়, সেক্রেটারি কী কথা বলছিলেন! ওরা আর অগ্রসর হয় না। দিদার ওদের সাথে ক’রে সুখডহরির দিকে চেয়ে থাকেন। তারপর গাঁয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।

গিয়াসজী তখন গাড়োয়ানকে শুনিয়ে বলেন—গাড়ি দাঁড় করালে কেন? চলো। দুই তালাক তো হয়ে গেছে। তুমি নিজে কানে শুনলে! শোনোনি? সুখবাসকে গিয়ে বলবে, আমি তিন তালাকই দিয়েছি। হ্যাঁ, বলবে। আর মাত্র এক ক্রোশ পথ বাকি। তুমি মদিনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা বাস ধরব। কী গো ছেলে, পারবে না? চালাও গাড়ি!

গাড়োয়ানের গলায় কেমন কান্না আর আনন্দের মেশানো বিকৃত স্বর। অবুঝের আদিম আনন্দ যেমন। ভাষাহীন চাপা উল্লাসের আদিমতা। গরুর পিঠে লাঠি ভাঙে সে। গরু জোড়া লাফিয়ে ছুটতে থাকে। আবার গুঞ্জন শুরু হয়। আয়াত গুঞ্জরিত হয়।

কিছুদূর এসে ফের গাড়ি থেমে পড়ে। গাড়োয়ান নেমে পড়ে। অন্ধকারে পেছনে চেয়ে দেখে ওরা কোথায়। ওদের চিহ্ন দেখা যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে।

সহসা লণ্ঠন হাওয়ার ধাক্কায় নিভে যায়। নিভে যাওয়ার আগে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়োয়ানকে মুহূর্তে কেমন চেনা মনে হয় গিয়াসজীর। চকিতে মনে হয়, কিন্তু বিশ্বাস হয় না। ভাবেন, তিনি ভুল দেখছেন। নাম ধরে ডাকবেন কিনা বুঝতে পারেন না। তিনি প্রবল আকুতি মিশিয়ে বলেন—চলো বাবা। আর মাত্র একক্রোশ পথ। বায়েন তালাক এখনো হয়নি। তুমি সেটা শুনবে। ওরা তো পালিয়ে গেল। শোনার ভয়ে পালালো। সাক্ষীর ভয়ে পালালো। তুমি শুনবে! তুমি সাক্ষী থেকো। বায়েন তালাকে এক সাক্ষী, নাকি কোনো সাক্ষী নেই বাপরে। কিছুই যে বুঝছি না। আসমানের ফেরেস্তা দেখছে, আমার ছেলে মদিনাকে স্পর্শ করেনি। আঘাত করেনি। সুখবাসকে বলবে তুমি। গিয়ে বলবে জাহেদা বেঁচে আছে। আমার মেয়ে মরেনি। বলবে তো? গাড়োয়ান?

হাহাকার ক’রে ওঠেন গিয়াসজী। দ্রুত আয়াত পড়তে থাকেন। মদিনা ফেটে কেঁদে ওঠে। ঠিক তখনই সুখবাস অদ্ভুত বিকৃত ভয়াবহ গলায় কেঁদে ওঠে অন্ধকারে। পুরুষের বিকৃত গলায় কান্না চেনা যায় না। চরাচর কী অসম্ভব কালিমায় ভরে আছে। গিয়াসজী সচকিত প্রশ্ন করেন—কে তুমি বটে?

গাড়োয়ান কান্না থামিয়ে উত্তর করে—আই ডোন্ট নো। তারপরই হো হো ক’রে হেসে ওঠে। হেসে উঠেই অন্ধকারে ছুটে যায়। হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে এবং নিজেকেই প্রশ্ন করে—কে বটে তুমি! নিজেই উত্তর দেয়—আই ডোন্ট নো। তারপর ছুটতে শুরু করে। ধোঁকায়। হাঁপায়। থামে। প্রশ্ন করে। উত্তর দেয়। এবং থামে না। ছোটে। ছুটতে থাকে। পাগল সুখবাস নিঃসীম গহন অন্ধকারের অস্তিত্বে দ্রুত ধাবমান এখন

ঈশা গাড়ি ছেড়ে দেয়। বাকি ক্রোশ শেষে শুধায়—তালাক দিব চাচা? গিয়াসজী কড়া গলায় জবাব করেন—না। দিও না।

গাড়ি চলতে থাকে। মদিনা ঈষৎ ব্যাকুল গলায় ডুকরে কাঁদে। তখন আয়াতের সুরকে মনে হয় শোক-সংগীত। একটি অন্ধকারের পারাবার পার হতে থাকে গাড়ি। দিক-চিহ্নহীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *