নাস্তিক

নাস্তিক

এক

ধন্যবাদ হে অমর হাদিস, ধন্যবাদ বিশ্ব-কুরান! হে মৌলভী মৌলানা, হাফ মোল্লা, ফুল মোল্লা আপনাদের সকলকেই হাজার শুকরিয়া।

ধন্যবাদ এইজন্যে যে, এ কাহিনীর আসল স্রষ্টা তো আপনারাই—আপনাদের মছলা মোতাবেক, শলা-সওয়াল-মাফিক যতদূর সম্ভব আমি এই কাহিনীর কথকতা করছি মাত্র।

ভাগ্যিস আমি ধর্মে মুসলমান, আমার পিতামাতা মুসলমান, হামিদুল এবং রাবেয়া, তারাও তো মুসলমান, তাদের পিতামাতাও পরহেজগার সুন্নী, অতএব এ গল্প এই শর্ত ছাড়া কোনোভাবেই শুরু হতে পারত না।

আমি যদি হতাম হিন্দু, রাবেয়া যদি হতো শর্মিলা, হামিদুল যদি হতো নিৰ্মল কিম্বা অনিমেষ—তবে কি এ কাহিনী সৃষ্টি হতে পারত?

কস্মিনকালেও আর যাই হোক, রাবেয়াকে নিয়ে তিন মাস আমি যে ঘর করলাম, তা কি সম্ভব হতো?

এই দেখুন, প্রথমেই ঘর করার কথা লিখে ফেললাম। আসলে আমার প্রথমেই ঘর-ভাঙার গল্পই বিবৃত করা উচিত, নতুবা হামিদুলের ষোল আনা চটে যাবার সম্ভাবনা। হামিদুল এমনিতেই হয়তো মনঃক্ষুণ্ণ হবে, তার এই লজ্জাকর, হয়তো খানিক কলঙ্কিতও বলতে পারি, কাহিনীর আদ্যোপান্ত আমার গোপন রাখাই কি উচিত ছিল না? আমার দিক থেকে উচিত হয়তো ছিল, কারণ লজ্জা কি কেবল তার? লজ্জা তো রাবেয়ার, আমারও। কিন্তু এ এমনই এক অবমাননাকর, লজ্জায় লজ্জিত চমকপ্রদ কিস্সা, যা গোপন করতে চাইলেও মানুষের কাছে গোপন থাকে না।

এত যে লজ্জা, তবু তো আমার পক্ষে এ-এক রোমাঞ্চকর নাটক যেন, আর সে কারণেই শুকরিয়া! সে কারণেই আমার বেশ লাগে, ভাগ্যিস আমি মুসলমান ঘরে জন্মাতে পেরেছি।

কথাটা একটু ভেঙেই বলি।

ভাঙব, কিন্তু কোথা থেকে ভাঙি? আমার হাতে এ যেন একটা রহস্যময় গোলাকার বস্তু, যার মুখ নেই, কিন্তু মোড়ক খোলামাত্রই যা এক ঝলকে ছড়িয়ে পড়ে।

আমি জানি, সাধারণ কাহিনীগুলোর তিনটে ভাগ। গোড়ার ভাগে থাকে পাত্রপাত্রীর পরিচয় এবং তার পর মধ্যভাগ অব্দি তার শৃঙ্খলাপূর্ণ বিন্যাস, যেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে নাটক জমে ওঠে। আবার এমন কাহিনীও রয়েছে, যে কাহিনী মধ্যভাগ থেকে শুরু করে গোড়ায় আসে এবং তার পর শেষভাগে পৌঁছয়। আবার শেষ থেকেও কাহিনী শুরু হতে দেখেছি।

.

এ গল্পেও শেষভাগে একটা জায়গা আছে, যেখান থেকে শুরু করলে আমাকে এইভাবে শুরু করতে হবে—সকাল বেলা হামিদুল টাঙ্গা নিয়ে আমার বাসাবাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। আজ রাবেয়ার তিন মাস পূর্ণ হলো। এই তিন মাসে রাবেয়া যে সোয়েটারটা প্রায় বুনে শেষ করে এনেছিল, সহসা একটানে সমস্ত বুনন খুলে ফেলে দিল। আশ্চর্য এক চমকে চেয়ে দেখলাম, চোখের জলের মতো টলটলে একটি স্বপ্ন গাল বেয়ে গড়িয়ে গলে ঝরে পড়ছে। আমিই কি শুধু এই একটি স্বপ্নের বুনন দিয়ে একটা রহস্যময় গোলাকার বস্তু রচনা করেছি, যার মুখ নেই, কিন্তু মোড়ক খোলামাত্রই যা এক ঝলকে ছড়িয়ে পড়ে?

এভাবেও শুরু করা যেত। কিন্তু আসলে এ কাহিনীর শুরু মধ্যভাগ থেকে এর গোড়ার কথা গোড়াতেই বলে নেওয়ার নিয়ম নেই।

.

আষাঢ় মাসের আজ ১৪ তারিখ। রেডিওর ঘোষণা মতো তিন-চার দিন আগেই বর্ষা নেমে যাওয়ার কথা। আকাশ এবং প্রকৃতি সে-কথা রাখেনি। আজ ১৪ তারিখ সন্ধ্যায় আকাশে গাঢ় হয়ে মেঘ জমল। চার দিক ঘোর অন্ধকার করে হাওয়া উঠল। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির দানা আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগল। তার পর ঘন হয়ে ঝরতে লাগল। সাঁই সাঁই টানা দমকা বেগ দিয়ে বর্ষার ঘন-ঘোর সংকেত বাজতে লাগল। আকাশে বিদ্যুৎ খেলতে খেলতে দিগন্ত ঝিকিয়ে ঝিকিয়ে মেঘ ডেকে গেল। কোথাও বজ্রপাত হলো।

আমি দরজা জানলা সব বন্ধ করে দিয়ে মোমবাতি জ্বাললাম। গাছপালা উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের তার নিশ্চয়ই ছিঁড়ে গেছে। ঝড় বইছে টানা দু ঘণ্টা। ঘড়ি দেখে বুঝলাম, সন্ধ্যা অনেকক্ষণ উৎরে গেছে। রান্নাঘর শোবার ঘরের সংলগ্ন। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম, থালা ঢাকা দেয়া ভাত-তরকারি রয়েছে। ফুলমতি রান্না করে ঢেকে রেখে বর্ষার পূর্বাভাস বুঝেই বাড়ি চলে গেছে। ফুলমতি আমার ঠিকে ঝি।

একতলা বাড়ি। দুখানা শোবার ঘর। বৈঠক নেই। রান্নাঘর আছে। পায়খানা আছে। বাড়ির সামনে এক চিলতে সবুজ মাঠ। বাগান করতে হলে প্রাচীর তুলতে হবে। একটা টিউবওয়েল আছে। ঘরে বিদ্যুৎ-বাতি রয়েছে। পেছনে দেয়াল-তোলা প্রাচীর। পুব-পশ্চিম খানিক বেড়ে রয়েছে, কিন্তু সামনের মাটিটুকু ঘিরে দেয়নি, ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মালিককে বলেছিলাম

— ঘিরে দিন। বাগান করব। মালিক বলেছে—ঘিরে নিন। ভাড়া থেকে কাটান হয়ে যাবে।

আবার একদিন বলেছে—কলেজে পড়াচ্ছেন! টাকা জমছে নিশ্চয়। পারেন তো কিনে নিন মাটিটা। বানানো ঘর পাচ্ছেন মশাই। অতি সুলভে ফাঁকার উপর এমন সৌধ দ্বিতীয়টি হবে না।

বলেছি, চাকুরিটা সদ্য সদ্য হয়েছে, টাকা জমতে সময় লাগে মশাই। সময় দিন।

মালিক আমাকে সময় দিয়েছে, বলেছে, বাড়ি তৈরি করে বিক্রি করে দেওয়াই আমার ব্যবসা। আর একটা বাড়িতে হাত দিয়েছি, পয়সার খুব তাগাদা রয়েছে। তবু দিলাম সময়। বলি কি, টাকা জমিয়ে নয়, গাঁয়ে বাপের কাছে হাত পাতুন গিয়ে। কাঁচা ট্যাঁক পেয়ে যাবেন।

আমার হাসি পেল। হাসলাম। কিন্তু অনাবশ্যক মনে করেই মুখ ফুটে বললাম না, আপনি ঠিক বুঝবেন না, আমার বাপজান কতটা দরিদ্র। গ্রামের মানুষের কাছে ভিক্ষে করেই এক রকম আমায় পড়িয়েছেন। হামিদুল টাকা না পাঠালে আমার এম এ পরীক্ষাই দেওয়া হতো না।

আমার ঋণ সবার কাছে, কেউ হয়তো আমার কাছে ঋণী নয়। সবাই দেয় আমাকে, আমি কাউকেই কখনো দেওয়ার সুযোগ পাইনি, সংগতিই বা কোথায়? আজ অধ্যাপনার কাজ পেয়েছি, এ যুগে এই পেশাও ঠিক আর মানুষের আদর্শসম্মত নয়। এই পেশায় নিযুক্ত থেকে মানুষের ঋণ কতটুকু আর শোধ দিতে পারি? বিশেষ ঐ হামিদুলের ঋণ কি শোধ করা যায়? ভেবেছি, ওর বাচ্চা হলে, জানি না অ্যাদ্দিন তার বচ্চাকাচ্চা হলো কিনা, নিজের কাছে রেখে আপন সন্তানের মতো মানুষ করে দেব। হামিদুলকে একদিন কথাটা চিঠিতে লিখে জানাতে হবে। ভাবছিলাম, হামিদুলের সন্তান মানে তো রাবেয়ার সন্তান, রাবেয়া আমার প্রস্তাবে কখনো কি না করতে পারে?

পারে না।

হামিদুলও নিশ্চয় খুশি হবে।

.

বর্ষার এই উন্মত্ত প্রকৃতি, অঝোর বর্ষণের সন্ধ্যায় স্মৃতি বড় দুঃখ দেয়, আনন্দও।

এমন সময় দরজায় জোর ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। বাতাস কি? হয়তো ঝড়। হয়তো মানুষ। এই ঝড়ে বাদলায় মানুষের খুব বিপদ না হলে সামান্য কারণে কেউ কি অন্যের দরজায় ধাক্কা দিতে আসে?

দরজা খুলে দিলাম। ওরা চারজন জলের ছাটের সাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ঢুকে পড়েই হামিদুল দ্রুত হাতে দরজা ভেজিয়ে খিল তুলে দিল। বাকি তিনজনের একজনকে চিনতে পারি, রাবেয়ার বড় ভাই এবং আমার সহপাঠী, রুস্তম। আর একজন বোরকা পরা মহিলা। অন্য আর একজন সম্ভবত মৌলভী সাহেব, গাঁয়ের লোক, মোল্লাজিও হতে পারেন।

.

আমি রীতিমতো বিস্ময়-বিমূঢ়, হতবাক হয়ে গেছি। একটু আগেই তো আমি হামিদুলের কথা ভাবছিলাম।

হামিদুল সেই গাজীপুরের সিকদারের একমাত্র পোলা। আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমার যৌবনের প্রথম বেলার সবার বড় আত্মীয়। রক্তে নয়, বন্ধুতায়। সে আমার কি এবং কে, আর কি এবং কে নয়, তার হিসেব দিই কী করে? কিন্তু এ কেমন ধারা হামিদুল, যাকে এক নজরে চিনতে এত কষ্ট হচ্ছে আমার! চেনা যায় কী উপায়ে? চেহারায় বাইরের ঝোড়ো দুর্গতির ছাপ

অন্তরেও কি স্বাভাবিক? এক পলকেই মনে হলো, কোনো এক অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় সে আটকাতে পারেনি। সে মুচড়ে ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।

বললে, এলাম। তোর কাছেই এলাম, একান্তই তোর কাছে। ভয় পেয়েছিস, না?

বললাম, ভয় কিসের? ভয় কেন পাব? তোর তো আমার কাছে অ্যাদ্দিন একবারও অন্তত আসা উচিত ছিল।

উচিত ছিল। ঠিক বলেছিস, উচিত ছিল। রাবেয়াও বলেছে, উচিত ছিল। আমারও মনে হলো—যাই। তোর কাছেই যাই। চলে এলাম। যা উচিত মনে হলো, তাই করলাম। কতটা ঠিক করেছি, তোকেই এখন ভেবে দেখতে হবে।

শুধালাম, রাবেয়া কেমন আছে?

ওরা তিনজনই এক সাথে বোরকা পরা মহিলার দিকে চাইল। হামিদুল খিক্ খিক্ করে হেসে উঠল। বোরকা পরা মহিলা এক টানে মুখের কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললে, ভালো আছি বলেই তো ওদের সাথে অ্যাদ্দুর আসতে পেরেছি। চেয়ে দ্যাখ; কী মনে হয়, ভালো নেই?

.

রাবেয়াকেও চেনা যায় না। দু চোখ কেমন ফোলা ফোলা, মনে হচ্ছে অসুস্থ।

বললাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কেন তোমরা এভাবে, ঐরকম…

রুস্তম বললে, সুটকেসটা পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড় ছেড়ে আয় রাবেয়া। মৌলভী সাহেব! আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন। পরার মতো এক্সট্রা কাপড় আছে তোর কাছে, মামুন?

ওরা বাকি দুজন গামছায় মাথা হাত পা মুছে আলতো জড়োসড়ো হয়ে খাটে বসল। আমি দ্রুত পাশের ঘর থেকে ওদের তিনজনের জন্যই ধুতি পাজামা আর লুঙ্গি এনে দিলাম। রুস্তম লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরলে। হামিদুল পাজামা। মৌলভী সাহেব ভেজা লুঙ্গি ছেড়ে শুকনো লুঙ্গি পরে ফেললেন। ওদের পরবার মতো তিনটে পাঞ্জাবি দিলাম।

রাবেয়া পাশের ঘরে কাপড় বদলাতে চলে গেছে। মৌলভী সাহেব প্রশ্ন করলেন—আমায় চিনতে পার না? আমি শরীফ! গাজীপুরের খতিব।

বললাম, আপনি অনেক বুড়িয়ে গেছেন। আশ্চর্য! আপনিই সেই শরীফ সাহেব!

বললেন, হ্যাঁ, খতিব! আমার পীর হচ্ছেন ফুরফুরার হজরত কতুবদ্দিন

সাহেব।

বললাম, ও, হ্যাঁ। মনে পড়ছে।

—পড়ছে? খুদা কী মেহেরবানি। না পড়ে উপায় নেই।

-কিন্তু!

—কিন্তু আর কি? আমিও এলাম ওদের সাথে। ওরা ছাড়ল না। হামিদুলের বাপও আমায় ঠেলে পাঠিয়ে দিলে। কথা হচ্ছে, ঐ যে ঔরৎ সাথে দেখছ, তিন মাসের জন্য আমরা ওকে তোমার এখানে তোমারই হেফাজতে রেখে যাব।

-কেন? চমকে উঠলাম।

খতিব সাহেব বললেন, তিন মাস। তার পর ফের নিয়ে যাব। এই তিন মাসের ভরণপোষণ তোমার। হাদিস মুতাবেক যেহেতু তোমরা আহলে হাদিস, ফরাজী। তাই তিন মাসে তুমি তিন তালাক দেবে। তিন হায়েজে তিন।

—তালাক দেব? আঁৎকে উঠি।

—হ্যাঁ। তালাক দেবে। তার পর আরো তিন মাস রাবেয়ার ইদ্দৎ।

—কিসের ইদ্দৎ? আমি বোকা হয়ে যাই।

–ইদদৎ কিসের জান না? হাদিস কুরান কিছুই বোঝ না দেখছি।

-না এসব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

-তোমার বুঝে কাজ নেই। তুমি মুসলমান, নাকি নাস্তিক? খতিব সাহেব হেসে ওঠেন। কেমন একটু বাঁকা, দুর্বোধ্য হাসি।

বললাম, ঠিক জানি নে। কী হলে আপনার উপকার হয় বলুন?

তিনি বললেন, এতে আমার বিশেষ কোনো উপকার নেই। উপকার তোমার বন্ধুর।

হামিদুলের দিকে চেয়ে দেখলাম, সে কেমন কাতর চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। ভিখারি যেমন মানুষের করুণার দিকে আকুল হয়ে চেয়ে থাকে। রুস্তম বললে, তুমি যদি নাস্তিক হও, আমরা তবে ফিরে যাব। যদি মুসলমান হও আমার বোন রাবেয়াকে আমি তোমার সাথে নিকে দিয়ে তিন মাসের জন্য তোমার হাতে সঁপে দিয়ে যাব।

রাবেয়া পাশের ঘর থেকে এ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে জল টলটল করছে। সে কথা বলল, নাকি কেঁদে উঠল, বোঝা যায় না।

বললে, ঐ মূর্খ আমায় জোর করে তালাক দিয়েছে মামুন। তোমার মতো নাস্তিক হলে, ওর তালাক খাটত না।

চেয়ে দেখলাম, হামিদুলের মাথা নিচু হয়ে বুকের উপর ঝুলে পড়েছে। আমি ভালো করে রাবেয়ার দিকে চেয়ে দেখতে পারলাম না। শুধু কিছুক্ষণ নিস্পন্দ নির্বাক থেকে বললাম, শুনলেন তো খতিব সাহেব, রাবেয়া বলছে, আমি নাস্তিক।

খতিব সাহেব বললেন, সে কথা শিকদারও বলেছে। কিন্তু এ কথাও বলেছে, তুমি নাস্তিক কিন্তু নিমকহারাম নও। তোমাকে মানুষ বিশ্বাস করে। ঘাড় তুলে হামিদুল আকুতি-ভরা চোখে আমার পানে তাকালো।

মুহূর্তে মনের মধ্যে তোলপাড় করে গেল। মাথার মধ্যে সমস্ত কোষগুলি নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল। একজন মুসলমান অধ্যাপকের সমস্ত রুচি এবং সুস্থ সংস্কারের বৃত্তিবোধে চূড়ান্ত ঘা লেগে চৈতন্যের ভূ-ভাগ জোর প্রকম্পনে আন্দোলিত হতে লাগল। হামিদুলের দিকে চেয়ে দেখতে ঘৃণা বোধ হচ্ছিল। রাবেয়ার শুকনো-সজল মুখে চোখে চেয়ে অন্তরাত্মা শিউরে শিউরে উঠছিল, তার করুণা-পীড়িত মুখচ্ছবি দেখতে দেখতে মনে হলো, নিজেকে যদি মুসলমান বলি, এর চেয়ে লজ্জাজনক পরিচয় সভ্য মানুষের কাছে আর কিছু নেই।

কিন্তু আমার এ সময় নাস্তিক হয়ে ধর্মদ্রোহিতারও কোনো মানে হয় না। এভাবে রাবেয়াকে তার দুর্গত বিপন্ন জীবন থেকে রক্ষা করা যায় না। নেমকহারাম নই, অকৃতজ্ঞ নই, এই সত্যের উপর বিশ্বাস করে যে হামিদুল আমারই শরণাপন্ন, তাকে কি লাথি মেরে ফেরাতে পারি? জীবনে কখন কবে ছেলেবেলায় ধর্মানুরাগে বশীভূত ছিলাম, তা যেন আজ মধ্যযুগের স্মৃতি, বিবর্ণ তৈলচিত্রে বাঁধানো

গণতান্ত্রিক শিক্ষাদীক্ষায় লালিত যে মানুষ, তার জন্য এ-রকম শাস্তি আর হাদিসী জুলুম কত যে পীড়াদায়ক এ-সময় হামিদুল নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবে না। ধর্মশাস্ত্রে আমার ঘোর উন্নাসিকতার দুর্নাম গাজীপুরে এক সময় আন্দোলন তুলেছিল। আশা করি, কেউ তা বিস্মৃত হয় নি

আজ যে হাদিস আদিমযুগের কুসংস্কারের ডিপো হয়ে উঠেছে, তার নিগড়ে আধুনিক সভ্য-মন বাঁধা পড়তে পারে না। অথচ এ বাঁধন আজ অক্টোপাসের মতোই আমাকেও জড়িয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। কেমন ভয় পেয়ে আমি সহসা গর্জে উঠলাম, এ যে সাংঘাতিক পাপ! প্রচণ্ড ভণ্ডামি খতিব সাহেব। হামিদুল বললে নিচু স্বরে, হ্যাঁ, আমি ভণ্ড, মামুন! এ তো আমারই পাপ। তুই প্রায়শ্চিত্ত করে দে ভাই!

খতিব সাহেব বললেন, হামিদের পাপ, তোমার পুণ্য মামুন।

শুধালাম, আর রাবেয়ার কী?

বললেন, তার দুর্ভাগ্য! বদনসীব!

রাবেয়া ডুকরে কেঁদে উঠল।

হামিদুল অবরুদ্ধ গলায় বলে উঠল, তুই তো রাবেয়াকে একদিন ভালোবেসেছিলি মামুন! বিয়ে করতেও চেয়েছিলি। তোর সাথে বিয়ে হলে আজ তার আর এই দশা হতো না।

রাবেয়া আরো জোরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। রুস্তম চেঁচিয়ে উঠল, তুমি থাম তো হাদিম! আর অত আদিখ্যেতা দেখিও না। অন্যায় করেছ, সে কথা ঢাক পিটিয়ে না বললেও চলবে।

হামিদুল কেমন বিহ্বল হয়ে চুপ করে গেল। আস্তে আস্তে তার মাথাটা ফের বুকের উপর ঝুলে পড়ল।

বাইরে বৃষ্টির দাপট কিঞ্চিৎ স্তিমিত হয়েছিল। আবার চেপে এল

বললাম, হ্যাঁ হামিদুল, ভালোবেসেছিলাম। সেই খুব ছেলেবেলায়, আমরা তিনজনে কতদিন বর-কনে খেলেছি। একদিন তুই আমার শ্বশুর হয়ে রাবেয়াকে মেয়ে বানিয়ে আমার হাতে সঁপে দিয়েছিস তো, অন্যদিন আমাকে তোর শ্বশুর হতে হয়েছে। কতদিন এই বিয়ে-বিয়ে খেলতে গিয়ে তোর সাথে মারামারি করেছি, মনে পড়ে?

হামিদুলের নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল।

বললাম, শ্বশুর হওয়ার চেয়ে বর হওয়াতেই আমরা বেশি সুখ পেতাম। সহজে কেউ মেয়ের বাপ হতে চায়? তোর গায়ে জোর বেশি, তুই পর পর দু-তিন দিন বর হয়ে আমায় জোর করে শ্বশুর করে দেওয়াতে আমার মন খারাপ হতো। রাবেয়া বলত, হামিদ আজ তো তোমার শ্বশুর হওয়ার কথা, বর হচ্ছ কেন? আমি আজ তোমার মাগ হব না। হা হা হা! মনে পড়ে?

বললাম, তার পর কতক্ষণই বা বর-কনে খেলা! খেলা ভেঙে যেত। তিনজনে গলা মিলিয়ে ছড়া গাইতাম। হেলাফেলা হয়ে এল মামুর বিয়ে ভেঙে গেল! রাবেয়া বলত, মামু নয় মামুন! হামুর বিয়ে বল না কেন? আমি আর হামুর ভাত খাব না মামুন! আমি তোমার ভাত খাব! …তুচ্ছ একটা খেলা। খেলতে খেলতে, যতক্ষণ মন বসে খেলি, খেয়াল হলেই ধূলিখেলা সাঙ্গ করে দিই। কেতাব কুরান, হাদিস-পুঁথি, কালমা-কলম সবই ঐ খেলারই নিমিত্ত মাত্র।

খতিব বললেন, ঐ নিমিত্তের জোরেই আজও এই মুসলমান সমাজটা টিকে আছে।

বললাম, টিঁকে নেই। জোর করে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। একদল মোল্লাগাজী মৌলানার খেয়াল আর স্বার্থপরতার হাতে ঐ নিমিত্তকে সুবিধাবাদের অস্ত্ররূপে তুলে দেওয়া হয়েছে। হজরতের ধর্মে আজ আর প্রাণ নেই খতিব সাহেব! আপনারাই তার গলা টিপে নিঃশেষ করেছেন। প্রাণটা উবে গেছে, এখন শিকলটাই পড়ে আছে, আজ মানুষ সেই শিকলেরই স্তবগান করছে, অনুশাসন আর বাইরের প্রথা-কানুন, তার জোরেই সেই গাজীপুর থেকে এই দুর্যোগের রাতে দুটি নরনারীকে আপনারা এতদূর ছুটিয়ে এনেছেন।

খতিব সাহেব রেগে ওঠেন, জানতাম তুমি নাস্তিক। তুমি ধর্মের দোষ দেখ, কিন্তু যে নিজের থুতু রাস্তায় ফেলে জিভ দিয়ে চেটে তোলে, তার দোষ দেখ না! তার শাস্তি হওয়া উচিত নয়?

বললাম, শাস্তি কি ইদ্দৎ-পালন? একটি বৈধ সুন্দর নারীজীবনকে বেশ্যাবৃত্তির পাঁকে নিক্ষেপ করা? তার দোষ কোথায়? নারী কেন শাস্তি পাবে?

খতিব বলেন, চোর না শোনে ধর্মের কিস্সা। ইদ্দতের তাৎপর্য বোঝার তোমার সাধ্য কি মামুন? শুনেছি, তুমি কলেজে হিন্দু নরনারীর অবৈধ মুহব্বতের নাটক কিস্সা পড়াও। হিন্দু নরনারীর জেনাকে বল প্রেম, তাদের অবাধ মেলামেশাকে বল প্রগতি! বেপর্দা মেয়েদের নিয়ে কারবার তোমার।

বললাম, পর্দার আড়ালে রেখে নারীর ইজ্জৎ লুট করার মন্ত্র ঐ নাটক-কিস্‌সায় নেই খতিব সাহেব। সেখানে নারীর মর্যাদার কথা লেখা রয়েছে। আপনার সাথে তক্ক করে, বাহাস করে লাভ নেই। বরং যা করতে এসেছেন করে যান।

রুস্তম বললে, তাই করুন খতিব সাহেব। নিকেটা পড়িয়ে দিয়ে চলুন উঠে পড়ি। বাজে তক্কে সময় নষ্ট হবে।

খতিব বললেন, তা বলে লেখাপড়া শিখেছে বলে সে আমার ধর্ম তুলে অপমান করবে?

রুস্তম বললে, সে তো অপমান করেনি। সে তার আপন মত বলেছে, আপনি আপনার কথা বলেছেন, এতে অপমানের কি আছে?

—নেই? সে নাস্তিকের মতো আচরণ করছে। জানতাম সে তা করবে। কিন্তু শিকদারের কথা ঠেলতে পারলাম না, নইলে গাজীপুরে কি লোক ছিল না?

রুস্তম বললে, নিশ্চয় আপনার পছন্দ মতো লোক ছিল বৈকি! কিন্তু তাদের উপর হামিদুলের ভরসা ছিল না।

খতিব বললেন, হামিদুলের উপরও কি ভরসা করা যায়? সে তো মস্ত হঠকারী। আমার ইচ্ছে ছিল তারিকৎ হাজীর সাথে রাবেয়ার নিকে হয়ে যাক। বুড়া হাজী এই জিন্দেগীতে আর রাবেয়াকে ফেরত দিত না।

রাবেয়া সহসা বলে উঠল, আমার সেই ভালো ছিল খতিব সাহেব! ঐ পাষণ্ড বর্বরের সংসারে আমার আর ফিরে যেতে এতটুকু প্রবৃত্তি হয় না। হামিদুল একবার চমকে উঠে রাবেয়ার ক্রুদ্ধ অপমানিত নিঃসহায় চোখের দিকে চেয়ে দেখে চোখ নামিয়ে বুকের উপর মাথা এলিয়ে দিল, মনে হলো ঘাড় থেকে মাথাটা এক কোপে কে যেন ঝুলিয়ে দিয়েছে।

আমি খতিব সাহেবের কথার সূত্র ধরে বললাম, আমিও যদি রাবেয়াকে ফেরত না দিই!

হামিদুল মাথা তুলল। এত করুণ, এতটা পুড়ে যাওয়া মুখচ্ছবি কখনো দেখি নি। এ যেন এক বৃদ্ধের প্রতিমূর্তি, অন্তর্দাহে ঝলসিত, বজ্রপাতে দগ্ধ মর্মাহত খাঁ খাঁ তাল-তমালের শুখা শূন্য চেয়ে-থাকা দিগন্ত, চেয়ে দেখলেই বুকটা খালি হয়ে যায়।

সে বললে, ফেরত না দাও, কখনো জোর করব না। রাবেয়া তো তোমারও, তুমিও তাকে নিচ্ছ, এই ভেবে আমি কি সান্ত্বনা পাব না?

বললাম, দেখছেন খতিব সাহেব, ড্রামা, মানে নাটক কেমন জমে উঠেছে। আসলে ও ফেরত পাবার আশাতেই আমার কাছে এসেছে, ফের বলছে সান্ত্বনার কথা। তুই কখনো নিজেকে এতটুকু চিনতে পারিস নি হামিদুল! যে দুঃখ এতটুকু সইবার যো এবং যোগ্যতা নেই, তুই বরাবর সেই দুঃখকে আপন দোষে বয়ে এনেছিস।

রুস্তম বললে, মানুষ তাই নিয়ে আসে। নিজের দুঃখ নিজেই বয়ে আনে। এই তার আসল ট্রাজেডি। মুসলমানের তালাকের মধ্যে পুরাতন সেই গ্রীক ট্রাজেডির একটা পাকা রস রয়েছে—চরিত্রের চোরা দুর্বল ছিদ্র পথ ধরে অদৃশ্য জীবাণুর মতো সেই ট্রাজেডির অনুপ্রবেশ ঘটে। আমি এ কথা অনেককেই অনেকদিন বোঝাতে চেয়েছি। যাই হোক। সেই এক ট্রাজেডির বোঝা আমরা আজ তোমার কাঁধেও চাপিয়ে দিতে চাই, প্রফেসর!

আমি চমকে সচকিত হলাম। বাইরে বৃষ্টি এতক্ষণে থেমে এসেছে। হয়তো রেণু-বৃষ্টি হচ্ছে। মোমবাতি পুড়ে গলে শেষ হয়ে এল। পাশের ঘরের তাকে মোমবাতি, মোমবাতির বাণ্ডিল রয়েছে।

রাবেয়া বলল, মোমবাতি কোথায় বল, নিয়ে আসছি। বরং পাশের ঘরের মোমটাই ততক্ষণে নিয়ে আসি। ওটা অতটা পোড়েনি। রাবেয়া আপনা থেকে তাক চিনে ও-ঘরের জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে করে, অন্য হাতে আরো দুটি তাজা মোম নিয়ে ফিরে এল।

আমি বললাম, আমার এই প্রথম বিয়ে করা, অথচ ছেলেবেলার বর-কনের খেলাধূলায় যে বিয়ে হতো, আজকের এই বিয়েও যেন তাই। তবুও প্ৰথম, মানুষ বলবে, এ এক সত্যকার বিয়ে। এ বিয়েতে আমার কী কী খরচ হবে বলুন!

রুস্তম বললে, কিছুই না। সেই খোলামকুচি, পিটুলিপাতার নোট আর জিভে চুক চুক করে নকল ভোজ খাওয়া। অবিশ্যি তুমি এখন আমাদের তিন কাপ সত্যিকার চা করে দিতে পার না?

রাবেয়া টি-পয়ে মোম বসাচ্ছিল। বললে, ঠিক আছে, আমি চা করে দিচ্ছি। বলেই সে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আমি বললাম, চা কোথায়, চিনি কোথায়, তুমি তা জানবে কী করে? দাঁড়াও, আমি দেখে দিচ্ছি।

সে বলল, তোমার আর কষ্ট করে উঠে আসতে হবে না! সে আমি দেখে নিচ্ছি।

-স্টোভে তেল নেই।

—টিনে তো কেরোসিন রয়েছে! বললে রাবেয়া।

বললাম, তা আছে।

হামিদুল বললে, এই তিন মাস, তোর কোনো কষ্ট হবে না মামুন। দেখে নিস! রাবেয়া যে পাক্কা গিন্নি, সে তো বর-কনে খেলার সময়ই আমরা বুঝেছিলাম! আজ পাঁচ ছ বচ্ছর বিয়ে হলো, ঘরকন্নার কাজে রাবেয়ার তিলার্ধ পরিমাণ ত্রুটিও চোখে পড়েনি।

বললাম, তবে ওকে তালাক দিলি কেন?

রুস্তম বললে, সে কথা তোমাতে আমাতে একটু আগেই আলোচনা হয়ে গেছে।

বললাম, তবু তালাকের একটা প্রত্যক্ষ কারণ থাকে; আমি সেই কথা বলছি।

রুস্তম বললে, সে কারণ জেনে কী লাভ? রাবেয়ার কাছেই জেনে নিও।

হামিদুল বললে, আমিও কারণটা পষ্ট করে এখন আর বলতে পারি নে। কেন দিলাম? তাই তো, কেন দিলাম? আমি খুব পাপী রে মামুন। শয়তান! হামিদুল কেঁদে ফেললে।

রাবেয়া চা নিয়ে এসে ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে বললে, তোমরা নিজে হাতে তুলে নাও। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে। একাই আমি পাঁচখানা ক্রিম বিস্কুট খেয়েছি। তোমাদের একখানার বেশি ভাগে হলো না।

চা খেতে খেতে খতিব সাহেব বললেন, বিয়ে যখন, গুরুত্বটা বিয়ের মতোই হওয়া দরকার। তারও একটা গাম্ভীর্য লাগে। তোমরা সবাই ঠিক মতো স্থির হও। মামুন, তুমি ভালো পোশাক পরে এস।

রাবেয়া বললে, এতক্ষণে বুঝলাম কথাটা! যে সাধের বিয়ে, তার পায়ে আলতা দিয়ে! খতিব সাহেব, আপনি এ অনুষ্ঠানের যত মাহাত্ম্য বাড়াবেন, আমার বুকে ততই শেলের মতো বিধবে। এ জিনিস যে কত ছিনিমিনি, এ সমাজ আমাদের সে কথা মুখ ফুটেও বলতে দেয়নি।

বললাম, কিন্তু রাবেয়া, এই বিয়ে যে আমার সত্যি বিয়ে রাবেয়া, আমি তো এর আগে কখনো বিয়ে করিনি।

পরিবেশ আমার এই কথায় কেমন বিষণ্ণ আর গম্ভীর হয়ে উঠল। খতিব সাহেব বললেন, জানি, তোমার ঘরে টুপি নেই। নাও এই টুপিটা মাথায় পরে ফেল। বল, আছতাগ্‌-ফে-রুল্লাহা…

খতিব সাহেব দোয়া কালাম দিয়ে শুরু করে বললেন, মা তবালাকুম! বিয়ে হচ্ছে চুক্তি, সোসাল কনট্রাক্ট। নরনারীর

যৌন সম্পর্কের বৈধতাকে স্বীকৃতি দেয় যে চুক্তি, মা তবালাকুম, সেই চুক্তির নামই নিকাহ। এই চুক্তির জন্য চাই দেনমোহর। এই দেনমোহর সম্পর্কে দু ধারামত রয়েছে। তাই আবু হানিফার মতে ন্যূনপক্ষে দু টাকা দশ আনা, অর্থাৎ দু টাকা বাষট্টি পয়সা দেনমোহর কম্পালসারি, তার কমে চলে না। অবিশ্যি ইমাম শাফির মতে যৎসামান্য দেনমোহরেও নিকাহ সিদ্ধ হতে পারে।

রুস্তম বললে, সে কথায় আমাদের কাজ কি শরীফ সাহেব! যে ভাবে সম্ভব তাই করুন না কেন?

খতিব সাহেব বললেন, দেখ বাপু! হাদিস কুরানকে উল্টে দিয়ে আমি তো এক পা-ও চলতে পারিনে। কেউ একজন ছেলেছোকরা মোল্লাজিকে ধরে আনলেই তো পারতে! শিকদারকে তখনই বলেছিলাম, গাঁয়েই কারো সাথে নিকে দিয়ে সাথে সাথে ছাড়িয়ে নিয়ে ফের হামিদুলের সাথে নিকাহ দিন। কিন্তু শিকদার আসল সুন্নী, তিনি তা শুনবেন কেন?

রুস্তম বললে, সবই ঠিক। শিকদারের কথা মতোই তো কাজ হচ্ছে। পান থেকে চূন তো কোথাও খসে নি। নিন শুরু করুন।

খতিব সাহেব শুরু করলেন, গাজীপুরনিবাসী তৈমুর মণ্ডলের কন্যা রাবেয়া খাতুনের সহিত দু টাকা বাষট্টি নয়া দেনমোহরে উক্ত গ্রামবাসী আলামৎ সেখের পুত্র, তুমি মামুন রহমান—ইত্যাদি।

মন্ত্র পাঠ শেষ হলে, খতিব বললেন, নিকাহ সুসম্পন্ন হয়েছে। এবার আমি উঠব। কিন্তু হ্যাঁ, ওহে মামুন সাহেব, তোমার সাথে গোপনে আমার দুটি কথা আছে।

বলেই তিনি আউড়ে উঠলেন—’হাত্তা তন কি হা জওয়জন গাইরা হু…অর্থাৎ ইঁহাতককে দুসরা জওজাকো কবুল না করে তর্ তক আওয়াল জওয়জ জায়েজ না হোগা।

আউড়ে যেতে থাকেন ফুরফুরা শরীফের কুতুবুদ্দিন পীর সাহেবের শিষ্য মৌলানা মুহম্মদ আবু শরীফ সাহেব। হাত্তা তন কি হা জওয়জন গাইরা হু…অর্থাৎ…। পাশের ঘরে এলাম। খতিব সাহেব ঢুকলেন

বললেন, এটাই হচ্ছে আসল খবর মিয়াজান। হামিদুলের সাথে রাবেয়া যেরূপ স্ত্রীর স্বাভাবিক আচরণ করেছে, ঠিক সেরকম অনুরূপ ব্যবহার তোমার সাথে করবে। অন্তত একটি রাত্রিও একই বিছানায় তোমাদের শুতে হবে, সহবাস করতে হবে।

বললাম, জানি, তবেই নিকাহ সিদ্ধ হবে, ইদ্দতের ষোলকলা পূর্ণ হবে। খতিব সাহেব মোলায়েম হেসে উঠে বললেন, এটাই হচ্ছে আসল খবর মিয়াজান! চলি ভাই! শর্তটা তোমায় বুঝিয়ে দিয়েছি, এবার চলি। ফের তিন মাস দশদিন বাদে দেখা হবে। চল হে রুস্তম, ভোর রাত নাগাদ নিশ্চয় আমরা গাজীপুর পৌঁছে যাব। চল, আর তো দেরি সয় না। ওহে হামিদুল, তোমার কোনো কথা থাকলে চট করে সেরে নাও ভাই! আর হ্যাঁ।তিনমাসে তিন। এই ফরমূলাটা মনে রেখো মামুন সাহেব! ফরাজী তুমি। আহলে হাদিস। চলি? মিঠে হেসে ঘাড় কাত করলেন খতিব।

.

হামিদুলের বিদায় আসন্ন হয়েছে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে রাবেয়া ফুঁপিয়ে ফাঁপিয়ে উঠছে, এ এক আশ্চর্য দৃশ্য।

হামিদুল বললে, আমার এঁটো-চুক্ খেতে তোর কখনো আটকাত না জানি! কিন্তু যে আম-পেয়ারা আধেক খেয়ে তোর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতাম, খাস্ নে মামুন, ধরে থাক্। গাছ থেকে আরো দুটি ডাঁসা পেড়ে আনি, মনে আছে তোর? তুই কখনো তাতে দাঁত বসাতে সাহস পাস নি। কিন্তু আজ কি তোকে তেমন করে কোনো কিছু ধরে রাখতে বলতে পারি মামুন?

বললাম, নারীও মানুষ হামিদুল, আম পেয়ারার মতো ভোগের পণ্য শুধু নয়। এই কথাটা তোকে বলতেও এখন আমার ঘেন্না হয়। যা, তুই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা। পাষণ্ড! জানোয়ার!

হামিদুল এমন-এক শুকনো হাসতে হাসতে বিদায় নিল, যার কোনো বর্ণনা দেওয়া মুস্কিল, মানুষকে অমন অপদার্থ কাঙালের মতো হাসতে কখনো দেখিনি।

.

রাবেয়া সারা রাত পাশের ঘরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে আর মুখ তোলেনি। অন্য ঘরে, কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।

এইভাবে আমার ফুলশয্যার বাদল রাত্রি কেটে গেল। ভোরে উঠেই প্রথম মনে পড়ল, রাবেয়া গত রাত্রে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

দুই

রাত্রি হয়তো তিনটে নাগাদ আমি জেগেছিলাম। নিদেন দুটো আড়াইটা তো বটেই। কেমন এক দিশাহীন উত্তেজনা, বিহ্বল আত্মপীড়ন অনুভব করেছি। মনে হয় গত রাত্রিটা দুঃস্বপ্ন-কবলিত প্রেতচ্ছায়ার অভিনয় মাত্র, অথচ যা ছায়া শুধু নয়। মানুষের কাছে এই ঘটনা-অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাও কত-না মুশকিল! সাধারণ অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের ধর্মীয় কুসংস্কারলালিত জীবনে প্রত্যহ যে নাটক অভিনয় হয়, আমি সে নাটকের নায়ক হতে পারি বলে কখনো কল্পনাও করিনি।

কলেজ-লাইফে তালাক প্রথার বিরুদ্ধে কত-না যুক্তি এবং তথ্যপূর্ণ প্ৰবন্ধ রচনা করেছি। রেডিও-তে কলকাতা থাকার সময় কথিকা পাঠ করেছি। সব আজ কেমন অবিশ্বাস্য মনে হয়। গ্রামের কথায় আছে এক পাপী পাপ করে, হাজার পাপী পুড়ে মরে! হামিদুলের পাপ আমায় দগ্ধ করল।

কিন্তু শুধু কি তাই! আমার মনে কি রাবেয়ার জন্য আকৈশোর এক দুঃসহ লোভ মনের মধ্যে তৃষ্ণা এবং ভালোবাসার ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে এতদিন জর্জরিত করেনি? কত নারীর সান্নিধ্য এ জীবনে সম্ভব হয়েছে, কিন্তু তাতে কি রাবেয়ার তৃষ্ণা সখ্য প্রীতি স্নেহ নিবারিত হয়েছে?

আজও কেন বিয়ে করব বলে হাজার প্রস্তুতি মনের মধ্যে নিষ্ফল হয়ে গেছে, বাস্তবের সংসারে তার কোনো রূপায়ণ হতে পারে নি? এই সব মনের অচেনা কামনার স্পষ্ট দিশে পাইনি বলেই তো কাউকে বোঝাতে পারি নি, রাবেয়ার রূপ মন থেকে মুছে ফেলে অন্য কোনো নারীর কল্পনা করা দুঃসাধ্য না হলেও, তাতে কোনো মনের তাগিদ ছিল না।

এই হয়, কার মনে কিসের সুদূর কামনা অস্পষ্ট হয়ে বসবাস করে, তার গূঢ় প্রকৃতি সে হয়তো সচেতন মনের ভাষায় নিজেকেই স্পষ্ট করে শোনাতে পারে না।

অনেক দিনই তো মন দিয়ে মনের অসম্ভবকে শাসন করেছি। বলেছি, রাবেয়া তোমার তো একার ছিল না। তার রূপে তার হৃদয়ে তোমার প্রথম যৌবনের আকুতি মিশিয়ে তোমার আপন ভালোবাসাকে তুমি আপন হাতে আঁকা ছবির মতো সেই কবে দূর অতীতের স্মৃতির ওপারে বসে প্রত্যক্ষ করেছিলে। আর একজনও, তোমারই পরমাত্মীয় হৃদয়ের বালক বেলা, সেই রূপে অস্তিত্বে বয়ঃসন্ধির কামনা বাসনায় শিল্পীর মতোই মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে রাবেয়ার আরাধনা এবং স্তবগান করেছে। সে দেহের ভাগীদার তুমি তো একাই ছিলে না। হামিদুলের পয়সা ছিল, সে সহজেই রাবেয়াকে কিনে নিয়েছে। তোমার মেধার বিনিময়ে সেই অসম্পূর্ণ অপ্রস্তুত সময়ে, (তখন তুমি অনার্স নিয়ে বি. এ. প্ৰথম বর্ষের ছাত্র) রাবেয়াকে দখল করতে পার নি। কিন্তু সেই কিশোরকাল আর বয়ঃসন্ধির অধিকারবোধ কত-না মারাত্মক! সে সহজে একজন মানুষকে স্মৃতি ও কামনার হাত থেকে নিস্তার দেয় না, সহজে তার নিবৃত্তি নেই।

ভাবতে ভাবতে কেমন শিউরে উঠলাম আমি।

এমন সময় ফুলমতি এল

কে জানে, রাবেয়াকে দেখে কেমনধারা প্রতিক্রিয়া হবে! সে কি বিশ্বাস করবে, আমি সত্যিই বিয়ে করেছি।

রাবেয়া কখন কোন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে, স্নান করেছে। আমার ঘরে ধূপবাতি জ্বেলে দিয়েছে। চায়ের জল চড়াবার আগে থালাবাসন মেজে ঘষে ফেলেছে, ঘর ঝাঁট দিয়েছে।

রাবেয়ার ডান হাতে চায়ের প্লেট, বাঁ হাত ফুলমতির এক হাতের জামা আঁকড়ে ধরা। ফুলমতিকে টেনে নিয়ে এল সামনে। বললে, ফুলমতি তোমার ঝি?

বললাম, হ্যাঁ! কেন, কি হয়েছে?

রাবেয়া খাটের মাথার কাছে টেবিলে ছড়ানো বইগুলো হাত দিয়ে গুছিয়ে দ্রুত ঠেলে দিয়ে চায়ের প্লেট রেখে বলল, বেশ হয়েছে! বিয়ে করলে রাতারাতি, ঝি-কে একখানা কস্তা-পেড়ে কাপড়ও দিলে না!

বললাম, দু টাকা বাষট্টি পয়সার বিয়েতে ক পয়সার কাপড় দেওয়া যায়, তুমিই বল?

রাবেয়া বললে, ক পয়সার বিয়ে মানুষ তা বুঝবে কী করে? মানুষের পাওনা, মানুষকে দিতে হবে!

বললাম, দুপুরবেলা তুমি বাজার থেকে কিনে নিয়ে এস! টাকা দিয়ে যাব।

-কোথায় যাবে এখন?

-কেন, কলেজ যেতে হবে না?

-ও, তাই?

বলেই রাবেয়া দ্রুত গলায় বললে, এই ফুলমতি, যা তো বুবু, সাহেবের জল তুলে দে!

ফুলমতি লজ্জা পাচ্ছিল, তবু যাবার সময় লজ্জার মাথা খেয়েই যেন বলল, একটা কথা বুলতাম সাহেব!

বললাম, বল কী বলবি? শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। ফুলমতি আমায় অবাক করে দিয়ে বলে উঠল, অ্যাদ্দিন এ বুবুমনি, কোথায় ছেল সাহেব, আসমানে?

-কেন? আসমানে থাকবে কেন? এ তো মাটিরই দুলালী!

—না সাহেব, মাটিতে হুর থাকেনে, আসমানে থাকে। আল্লা তোমারে এত রূপই দিয়েছে বুবুজান!

ফুলমতির বাক্যি-ঢঙ নকল করে বুবুজান বললে—তা আর দেবে নে! মনিব-পত্নী কি কখনও অসুন্দর হয়? বেশ তো কস্তা-পেড়ে শাড়িই তুই পাবি! হলো তো!

রাবেয়া হো হো করে হাসতে লাগল।

দেখলাম, গত রাত্রির অসুস্থতা তার নেই। রূপ তার সত্যিই প্রজ্বলিত হয়ে নবনীর মতো বিগলিত হচ্ছে।

ফুলমতি চলে যেতেই রাবেয়া শুধায়, তোমার কলেজ কটায়?

বললাম, সে তো সুদূর এগারোটায়।

রাবেয়া বিছানার পাশে বসে বলল— এগারোটা আর সুদূর কোথায়, আটটা বাজতে চলল। যাও স্নান করে এস। আমি ততক্ষণ গুছিয়ে নিই কিছুটা। দুপুরবেলা ঝুল ঝাড়তে হতো, আজ হবে না। ফেরার সময় বাজার থেকে ঝাড়ুনি এনো। না-হয়, আমায় কিছু টাকা দিয়ে যেও, টুকিটাকি অনেক কিছু কিনতে হবে। চা ছাঁকবার ছাঁকনাটা একদম ফেঁসে গেছে, নুন রাখবার একটা কাঠের বাক্স দরকার। ফুলমতি বড্ড নোংরা, লঙ্কাগুঁড়োর কৌটোতে মাছের শুঁটকি আর বড়ি রেখেছে। তুমি শুঁটকি খাও?

-না তো!

—তাই তো বলি, তুমি তো কখনো ওসব খেতে না!

বললাম, ওসব অখাদ্য ফুলমতির প্রিয় খাদ্য, আমায় লুকিয়ে রান্না করে! আদুরে ঝিকে নিন্দে করতে পারি?

রাবেয়া বললে, কিন্তু ওসব দেখেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। আচ্ছা তামাশা তো!

—হ্যাঁ, তাই। বলেই আমি হাসতে লাগলাম। হাতে প্লেট তুলে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।

চা খেতে খেতে চোখ তুলে দেখলাম, রাবেয়া নিষ্পলক হয়ে আমায় চেয়ে চেয়ে দেখছে, যেন সস্নেহে আমায় গিলছে।

বললাম, কী দেখছ অত? সেই ছেলেবেলার মামুনকে চেনা যায় কিনা! রাবেয়া বলল, ঠিক তাই! তুমি কত শুকিয়ে গেছ! ভালো করে খাও না বুঝি! ঝিয়ের হাতে রান্না খেয়ে কি আর শরীর ঠিক থাকে? আচ্ছা মামুন?

-বল!

-সেই ছেলেবেলার একটা কথা তোমার মনে আছে?

-কোন কথা?

-সেই যে! একবার নদীতে তুমি আর আমি মাছ ধরতে গেলাম, মনে আছে?

বললাম, তা আর নেই, কতদিন আমরা গামছা ছেঁকে পুঁটি মাছ ধরেছি।

—নদীপাড়ে একটি দুটি জলভর্তি গর্ত থাকত আমাদের। মাছ ধরে আমরা সেই গর্তে রেখে দিতাম। মনে পড়ে?

বললাম, পড়ে বৈকি! কতদিন তোমার হাত থেকে মাছ ফস্কে গেছে রাবি, সেই অপরাধে কত মেরেছি! একদিন তো…

—একদিন আমায় ছুটে মারতে গিয়ে তুমি পা ফস্কে নদীর পাড়ে পিছলে পড়ে গেলে। তোমার কপাল পাড়ের খোলামকুচিতে কেটে গেল। সে কী রক্ত! নদীর জল লাল হয়ে গেছিল। আমার সে কী ভয় আর কান্না। তুমি যতই বল, কিছু হয়নি চুপ কর রাবি, ততই আমি চিৎকার করে কাঁদি। তুমি আমায় কিছুতেই থামাতে পারলে না। আমি কাঁদতে কাঁদতে কচুর ডাঁটা এনে কপালে আন্টিসেপটিক রস লাগিয়ে দিলাম। নদী থেকে উঠে এসে জামগাছের ছায়ায় তুমি শুয়ে পড়লে। তোমার গায়ে হুহু করে জ্বর এল। মনে পড়ে?

-পড়ে।

-তখন আমি কী করলাম, মনে পড়ে?

—না।

—তখন আমি তোমায় জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম, মনে হলো…

-কী মনে হলো?

—তুমি বোধ হয় মরে যাবে!

-ধেৎ‍!

—হ্যাঁ, তাই! বিশ্বাস কর তুমি।

—এই মরে যাওয়ার কথাটা তোমার এখন মনে হচ্ছে। অতীতের সব কথাই তো আর ঠিক ঠিক মনে হয় না। বর্তমানটাও তার মধ্যে ঢুকে যায়!

—তুমি প্রফেসর! তোমার কথাই হয়তো ঠিক! কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সেই ছেলেবেলার সব কথাই আমার হুবহু মনে পড়ে!

—কিন্তু সেই স্মৃতি-দুর্গে আজ প্রবেশ করে হৃদয়কেই শুধু রক্তাক্ত হতে হয় ফর নাথিং আমরা কেবল বিপন্ন হই। রাবেয়া বললে, তবু সেই স্মৃতিই আমার জীবনের অধিকাংশ। স্মৃতিভুক এই অন্তরকে অ্যাদ্দিন তো এভাবেই রক্ষা করেছি মামুন!

বললাম, তোমার কথাগুলো সাহিত্যের মতো সুন্দর!

রাবেয়া বললে, হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষায় বাংলায় আমার সিক্সটির উপর মার্কস ছিল ভুলে যাওনি বোধ হয়! ১৬ বছর বয়সেই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলি গলাধঃকরণ করেছি, অত সাত তাড়াতাড়ি পেকেছিলাম কি সাধে?

—তাই?

—হ্যাঁ মশাই! ঠিক তাই।

রাবেয়া মাথা কাত করে মৃদুস্বরে হাসতে লাগল।

বললাম, তার পর তোমার তো আর কলেজে পড়া হলো না।

রাবেয়া বললে, হবে কোত্থেকে! তুমি কলেজে এক বছর আগে হয়েছিলে, পরের বছরই আমার কলেজ যাওয়ার কথা। পাশও করলাম। কিন্তু সাথে সাথে হামিদুলের সাম্রাজ্যবাদী আচম্বিত আক্রমণ এবং জোরদখল, সবই বরাত! নসিব!…সবই তো জানতে তুমি। আমার বিয়ের খানাও তুমি খেয়েছিলে, হামিদুলের পাশে বরের দোসর বসেছিলে। শুনেছি, এমনই তুমি সেজেছিলে, লোকে তোমায় বর ভেবে ভুল করছিল। তাই কিনা বল?

বললাম, তাই। ঠিক তাই। লোকে ভুল করছিল, ভাবতেই পারেনি, আমার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে না। গাঁয়ের লোক এক রকম স্থির করেই ফেলেছিল…

রাবেয়া বাধা দিয়ে ‘বাদ দাও ওসব কথা’—বলেই উঠে দাঁড়ালো। বললে, এতক্ষণ জল দেওয়া হয়েছে, চল স্নান করবে, চল।

আমিও উঠে পড়লাম।

খেতে বসে ফের সেই অতীত জীবনের স্মৃতিকে টেনে টেনে তুলতে লাগল রাবেয়া। খাবার থালায় পাখার বাতাস দিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে সেই স্মৃতির দিকে চোখ ফেরানো।

সে তলিয়ে যেতে চায় আমাকে নিয়ে, কিন্তু গহনে নামতে ভয় পায়, তার যেন দম আটকে আসে। সে আমাকে পাতালের দিকে ঠেলে দিয়ে ভোঁস করে স্মৃতির উপরিভাগে জেগে উঠে নিশ্বাস টানে। তখন আমি গভীর সমুদ্রে, বড় একা মনে হয়। তার এই অদ্ভুত স্মৃতি-চর্চার জন্য তাকে রহস্যময় এবং নিষ্ঠুর মনে হয়। এই ভাবেই স্মৃতি-কণ্টকিত অস্থায়ী দাম্পত্য জীবনের দিন-রাত্রিগুলি প্রবাহিত হয়, দ্রুত এবং স্বস্তিহীন, কখনো বা মধুর এবং স্বপ্নমাখানো। দিন যত ফুরিয়ে আসে, আমি তত অস্থির হয়ে উঠি।

তিন

দাম্পত্য জীবনের মিঠে-অম্লমাদক রসে এক ধরনের স্বাস্থ্যকর অনুভূতি আছে, বিশেষ যখন ভালোবাসার রূপবতী কন্যাটি দিনরাত আমারই ভালোমন্দের হিসেব নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে রয়েছে।

টুকিটাকি গৃহের আসবাব, চা-চামচ, চিনি, টুথপেস্ট, চিরুনি, এমন কি একটা সোয়েটারের উলের বল এই সব অতি তুচ্ছ আয়োজন দিয়ে রাবেয়ার গৃহিণীপনার আর্ট যে রকম পল্লবিত হতো, বালিশের ওয়াড়, টেবিলের নকশা তোলা ঢাকনা-চাদর, ধনে-মৌরীর ভাজা মসলার ছোট্ট কৌটোটির সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার পরিচ্ছন্নতা, আমায় বিস্মিত না করে পারেনি।

গৃহিণীর গাম্ভীর্য আর প্রসন্নতা, স্ত্রীর আদুরে গলার নানা ভাববাচ্যের সম্বোধন এবং আবদার, সমস্ত ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মধ্যে কোথাও কখনো জল্লাদ-রূঢ় ভাব দেখতে পাইনে।

একদিন বললে, সোয়েটারটা এই বেলা শুরু করে দিই, সামনে শীতে গায়ে পরবে তুমি, আমি তখন আর থাকব না। আমার হাতে-বোনা সোয়েটার থাকবে। একটু একটু বুনে তুলব রোজ, পাখি যেমন নারকেল গাছে উল্টো কুঁজোর মতো বাসা বুনে তোলে। বাবুই পাখির নামটাও চমৎকার! কিন্তু বাসাটি এমনই ঝুলে থাকে, আমাদের জীবনের মতোই অস্থায়ী ভঙ্গুর এবং অনিশ্চিত! চেয়ে দেখতে ভয় পাই, তুমি পাও না?

বললাম, তোমার কথাগুলো গল্পের মতো সুন্দর।

রাবেয়া বললে উলের কাঁটা চালিয়ে, গল্পই তো! জীবন মাত্রই কোনো না কোনো গল্পের পাঠ। প্রত্যেক মুসলমান নারী-জীবন এক একটি উপন্যাস। শরৎবাবু লিখেছিলেন, হিন্দু বিধবাদের নিয়ে, তেমন কেউ নেই, যিনি আজকের তালাক নিয়ে লেখেন, মুসলমান মেয়েদের অন্তর্বেদনার ছবি আঁকেন! গ্রামে যাও, দেখবে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই ছিনিমিনি চলছে। দরিদ্রদের মধ্যে তালাক যেন ডালভাত হয়ে গেছে, কথায় কথায় তালাক, গালিগালাজের মতো অবলীলায় উচ্চারিত হয়। আমরা মেয়েরা বুঝে পাইনে, বিংশ শতাব্দীর ফুরিয়ে আসা সাঁঝবেলাতেও সত্যিকার মুসলমান জাতটা কোথায় রয়েছে!

বললাম, তুমি সাহিত্য করলে অনেক ভালো করতে রাবেয়া!

রাবেয়া সে কথায় কান না দিয়ে বললে, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, মুসলমান পুরুষ কতখানি পশ্চাদপদ, ধর্মের আদিম সংস্কারে মনটা বিকল হয়ে রয়েছে, ধমনীর রক্তে তাদের একটা জিঘাংসার নেশা লেগে থাকে, আরব্য উপন্যাসের বাদশা সব এক একটা!

বললাম, আজও অ্যারাবিয়ান নাইটসের শাহাজাদী যেন গল্প শুরু করতে পারে, অধুনা তুমিই সেই উজির-কন্যা শাহাজাদীর নব্য সংস্করণ।

রাবেয়া চোখ তুলে বললে, ঠাট্টা করছ! করবে নাই বা কেন? তুমি তো সেই পুরুষই!

আমি বোকার মতো হাসতে হাসতে বললাম, আত্মপক্ষ সমর্থন করে তোমায় একটা কথা বলি রাবেয়া।

রাবেয়া বললে, তুমি কি বলবে জানি! বলবে, এমন কিছু মুসলমান ছেলে ও রয়েছে, যারা কুসংস্কারমুক্ত, সভ্য এবং মুসলমান মেয়েদের প্রতি করুণাপরায়ণ!

-করুণাপরায়ণ বলছ কেন? তারা কি মেয়েদের দুঃখ বোঝে না?

–বোঝে বৈকি? এই তো তোমার বন্ধু, টাকার জোরে আমায় জবর-দখল করে আমার মনের সব দুঃখ মোচন করে দিয়েছে। সে কি আমায় কোনো মুহূর্তে এতটুকু বুঝতে চেষ্টা করেছে?

বললাম, সে-ও কি তোমায় আমারই মতো আশৈশব ভালোবাসে নি? আমরা দু জন তোমার ভিতর দিয়ে একটি পূর্ণ এক ও অভিন্ন সত্তার মতো নিজেদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পূর্ণতা খুঁজেছি।

রাবেয়া বললে, তুমিও কম সুন্দর কথা বল না! কিন্তু তা শুনতেই সুন্দর, আসলে তা মস্ত ফাঁকির কথা। ভালোবাসার ধর্মই হচ্ছে এক হয়ে ওঠা, কিন্তু এক হতে চাইলেই কি পূর্ণ এক ও অভিন্ন সত্তা হওয়া যায়, না, মানুষ তা পারে? ধর্মে রুচিতে সংস্কারে, মতে আদর্শে, এক না হয়ে ভালোবাসায় এক হওয়া আত্ম-প্রবঞ্চনা i

বললাম, ওটা একটা বইতে পড়া তত্ত্বকথা।

রাবেয়া বললে, সে তত্ত্বকথা তুমিই শুরু করেছ। ‘পূর্ণ এক ও অভিন্ন সত্তা’, কথাটা কি আমার? ভেবেছিলে, তোমরা দিনে দিনে এক হয়ে উঠছ, কিন্তু যত দিন গেছে, বাইরে বাইরে এক হয়ে থাকলেও অন্তরের ব্যবধান বেড়েই গেছে। যে সংসারে হামিদুল মানুষ, সেখানে পুঁতি-পাঁকে কেবলই ধর্মের কুসংস্কার আর তার কোলাহল। মন সেখানে স্বাভাবিক স্বাধীন স্ফূর্তি ভুলে সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। তোমার সাথে ব্যবধান তো বাড়বেই।

বললাম, তবু আমরা এক ছিলাম। তোমায় ঠিক বোঝাতে পারব না, ঠিক কেমন এক ছিলাম একদিন।

রাবেয়া বললে, একদিন ছিলে বৈকি! নিশ্চয় ছিলে। কিন্তু যত দিন গেছে, তোমরা দুজনই আপন গতিতে তিলে তিলে ক্রমশ নিজেদের বদলে তুলছিলে। টের পাও নি। বন্ধুত্বের রঙ পাছে ফিকে হয়ে পড়ে, তাই মানুষ এই পরিবর্তনের কথা ভেবে ভয়ে তা গোপন রাখে, নিজের কাছেও সে কথা খুলে ধরে না, আত্ম-বিচার করে না।

বললাম, তুমি এ-সব জানতে?

রাবেয়া বললে, এ-সব লক্ষ করতাম! না হলে ভালোই যদি বাসতে পরস্পর, আমাকে ঘিরে যদি স্বপ্নই ছিল, এক সত্তা এক প্রাণ হয়েছিলে, তবে হামিদুল তোমায় ঈর্ষা করত কেন? তোমার নাম তার সামনে মুখে উচ্চারণ করাও যেত না কেন? তার এত সংকীর্ণতা কেন? বল?

আমি আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠি, এ-সব কি বলছ তুমি রাবেয়া? রাবেয়ার চোখে জল স্ফুরিত হয়ে টলটল করছে। সে আত্মবিশ্বাসে জোর দিয়ে বলে ওঠে, ঠিকই বলছি আমি।

বললাম, তবু আমরা এক ছিলাম, অন্তত একই বিশ্বাস থেকে আমরা তোমায় ভালোরাসতাম। বিশ্বাস করতাম হামিদুল মামুনকে এবং মামুন হামিদুলকে ভালোবাসে, এই বিশ্বাস আজও অক্ষুণ্ণ আছে।

—বাজে কথা। এক তোমরা ছিলে না। গায়ের জোরে সত্য প্রমাণ হয় না। তাই যদি হয়, একই বিশ্বাস বুকে নিয়ে আমায় যদি তোমরা ভালেবেসে থাক, তবে আমিও যে তোমায় ভালোবাসি, সে ভালোবাসার মূল্য দিলে না কেন হামিদুল? সে তবে তোমায় ঈর্ষা করত কেন? ঈষাই শুধু নয়। সে তোমায় ভয় করত।

-ভয়? আমি প্রশ্ন করি।

রাবেয়া বললে, হ্যাঁ ভয়। সে ভয়ের কথা অন্য সময় হবে। কলেজ থেকে এলে, দুটো কিছু মুখে দেবে তো। তোমার মুখটা ভীষণ শুকনো দেখাচ্ছে। চল, ওঠ এবার! হাত-মুখ ধুয়ে নাও। জকে জল রয়েছে।

বললাম, সে না-হয় হলো। কিন্তু সে আমায় ভয় করতে যাবে কেন? বরং আমিই তো তাকে ভয় করতাম! এঁটো-চুক আম-পেয়ারা হাতে তুলে দিয়ে বলত, ধরে থাক মামুন। খাস নে! আমি তাই ধরে থাকতাম।

রাবেয়া উলের বল কাঁটা একটা ছোট্ট চামড়ার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে এ ঘরের তাকে তুলে রাখতে রাখতে বললে, বরাবরই তার একটা তোমার উপর জোর ছিল। তোমার উপর বলেই নয়, জোর তার নিজস্ব মনের। তার কোনো কাজে কখনো দ্বিধা ছিল না এবং অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনাও ছিল না। সেই জোরেই সে আমায় দখল করে নিল। তুমি চিরকাল তার জোরকে প্রশ্রয় দিয়ে গেলে। আজও জোর করেই সে আমায় তোমার ঘরে তুলে দিয়ে গেল, তুমি তাকে প্রশ্রয় দিলে।

-না। সে জোর করে দেয়নি। বিশ্বাস করে দিয়েছে।

—তুমি বল বিশ্বাস আমি বলি জোর, যা দিয়ে সে তার মনের লোভ বাসনা, হীন আকাঙ্ক্ষাকে স্যাটিস্ফাই করে। আর এ কারণেই তোমাকে তার জীবনভর প্রয়োজন। বলতে বলতে রাবেয়া ঘর পেরিয়ে ভেতর বারান্দায় চলে গেল। ডাক দিল সেখান থেকে হাতে জক তুলে নিয়ে—নাও এস। পানি ঢেলে দিই।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। খেতে বসে বললাম, তবু বলছ সে আমায় ভয় করত! তবে সে জোর করত কোন্ সাহসে? রাবেয়া বললে, সাহস নয় মামুন! ভীরুতা, দুর্বলতা। পরাজিত হওয়ার ভয়, হারিয়ে ফেলার ভয়। তাই সে বলত, ধরে থাক মামুন! খাস নে!

আমি চমকে উঠলাম, গলায় খাবার আটকে গেল, আর খুক খুক কাশি শুরু হলো।

তাড়াতাড়ি রাবেয়া জলের গেলাস সামনে এগিয়ে দিয়ে হাত পাখার বাতাস দিতে দিতে মাথায় মৃদু মৃদু হাতের তালুর চাপড় দিলে, ফুঁ দিলে টেনে টেনে, যেমন সে ছেলেবেলায় করত। খাওয়া শেষ করে মুখশুদ্ধির মৌরী মুখে ফেলে শখ করে খাওয়া সিগারেট ধরালাম। বিছানায় কাত হয়ে আধ-শোয়া ভঙ্গিতে টান দিলাম সিগারেটে। রাবেয়া এসে আমার কোলের কাছে বিছানায় বসল।

বললে, তুমি কি জানতে। সে ইচ্ছে করলেই তোমার সাথে আমার বিয়ে দিতে পারত। তার জন্যই আমার কলেজে পড়া হলো না। ভাইকে উদ্বুদ্ধ করে আমার কলেজে পড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব করল। বললে, তুমি আমায় এখন বিয়ে করতে চাও না, কোনোকালে করবেও না, তোমার অ্যাম্বিশন অত্যন্ত হাই! তা ছাড়া তুমি হয়তো মুসলমান মেয়েই বিয়ে করবে না। জানি না, সত্যিই তুমি তা চাইতে কিনা!

হাসতে হাসতে বললাম, সে তো দেখতেই পাচ্ছ, অ্যাদ্দিনও আমি অপেক্ষা করে আছি।

রাবেয়া বলতে লাগল, সে যাই হোক, হামিদুল ভয়ে ভয়ে এই কাজ শুরু করে দিলে। ভাইয়ের মন ভাঙিয়ে দিলে। ভাই দেখল, হামিদুলও তো রাবেয়াকে ভালোবাসে। লোকে জানল, তুমি আমাকে বিট্রে করলে বলে বন্ধু বন্ধুর কাজ করছে। অত বড়লোক হামিদুল, আমরা কত গরিব! এক কানাকড়ি পণ চায় না শিকদারের পো। লোকে জানল, হামিদুল কত-না করুণাপরায়ণ মেয়েদের জন্যে, কত মহৎ এবং বড় মনের মানুষ। ভেতরে ভেতরে তার জোরাজুরির স্বভাবটা তো কেউ টের পেল না। তোমার মেধা, তোমার মস্তিষ্ক তাকে বরাবর ভয় দেখায়, তোমার অন্ধ ভালোবাসা তাকে সাহস জোগায়। এই তো দেখছি মামুন, আমি তোমায় ভালোবাসি এ জিনিস সে একদম সইতে পারে না! অথচ সত্য ভালোবাসার ধর্ম এ নয়।

বললাম, বুঝতে পারছি রাবেয়া, তুমি ওকে সুখী হতে দিচ্ছ না।

রাবেয়া কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমি নই মামুন। তুমিই সব শান্তি নষ্ট করেছ। তোমার জন্যে সে আমায় তালাক দিয়েছে।

.

এই বিকালবেলায় এই দুর্বিষহ দ্বন্দ্বের আঘাত মস্তিষ্ককে ক্লান্ত করে তুলেছিল। আমি ধীরে ধীরে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম, বাইরে মেঘ ডেকে বৃষ্টি শুরু হলো। রাত্রি তখন ঢের হয়েছে, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।

আমার বুকের উপর মাথা রেখে রাবেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে, এবং এমনভাবে জড়িয়ে অসংবৃত হয়ে শুয়েছে, তাকে ছাড়াতে গেলে, ছাড়ে না। তার শরীরের রক্ত-স্পন্দন এবং সুরভিত ঘ্রাণ একাকার হয়ে আমার দেহে মনে প্রবাহিত হয়েছে।

তাকে জোর করে ছাড়িয়ে উঠে পড়লাম আমি। সুইচ অন করে দিতেই আলো জ্বলল ঘরে। দেখলাম, উপুড় হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে রাবেয়া, হাতের মুঠিতে কোচকানো বিছানার চাদর, সমস্ত শরীর ঘামে সিক্ত। ফুলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

ডেকে তুললাম তাকে। বললাম, খেতে দাও। রাত হয়েছে!

রাবেয়া উঠে বসে বাচ্চাবেলার মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানা থেকে নেমে গেল, তার গায়ের আঁচল মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছিল, লুটিয়ে টেনে নিয়ে চলল সে। চোখ-মুখ ধোয়া-টোয়ার জল-শব্দ শুনলাম। তার পর রাবেয়া ডাকল, এস।

কেমন কড়া গলায় ডেকে উঠল সে।

এ গল্পের পরিণাম আগেই কি লিখে ফেলেছি? বোধ হয় গল্পটা শেষ থেকেই শুরু করেছি। আবার মনে হয়, এ গল্পের শুরু শেষ কিছুই নেই। যেখানে শেষ করি, সেখানেই গল্প সমাপ্ত হয়ে যায়। এর পরই যদি লিখি, তার পর তিন মাস বাদে হামিদুল এসে রাবেয়াকে টাঙ্গায় তুলে নিয়ে গাজীপুর রওনা দিল, তবে কি গল্প শেষ হয় না? হামিদুল এবং রাবেয়া তার পর সুখে শান্তি এবং সাবধানতায় সংসার করতে লাগল, আমিও কলেজ করতে এবং ডক্টরেট লাভের থিসিস লিখতে লাগলাম। কেবল মনে হলো, এই কয় মাস, ৯০টা দিন আমি এক দাম্পত্য জীবনের অনবদ্য বিলাস ও সুখ সমারোহে কাটালাম। মানুষ কি ভাববে, আমি ভুল লিখছি?

মানুষ আমার কাছে যে আচরণ আশা করেছিল, আমি কি তার অন্যথা করেছি? মনের মধ্যে কোনো কোনো মানুষের, যারা ঠিক লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চেয়েছে, রুচিধর্মের বালাই যাদের মনের আঙিনা পাহারা দেয়, তাদের মনে গণ্ডি কেটে রাখা রয়েছে, সীতার মতোও তাদের মতিভ্রম হওয়ার জো নেই।

রুচি, শিক্ষা, বিবেক, মনুষ্যত্ব, প্রেম-প্রীতি, করুণা, মানবিকতা সবই যেন এক একটি গণ্ডির দাগ। তাকে অতিক্রম করে শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে রাবেয়াকে স্বামীর সম্পূর্ণ ভোগে অনুরাগে, দাবি দাপটে উত্যক্ত কি করা যায় না? আমি কি বলতে পারি নে, নিয়তিই সীতার সর্বনাশ করেছে, এই নিয়তিবাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারি নি তাই ইদ্দতের ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। রাবেয়া বা আমার, কারো কোনো দোষ ছিল না!

মানুষ কি বলবে? জগতের কাছে আমার কথাগুলো কেমন শোনাবে? আমি যখন কলেজে গিয়ে ছাত্রদের হিউম্যানিজম, রজার বেকন, কমিউনিজম, লেনিনের নাম দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতার অগ্রগতির কথা বলব, যখন আমি শেকসপীয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসের গল্প শুরু করব এবং যখন বলব শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীর কথা, বড় প্রেম কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে ইত্যাদি, তখন আমার আপন বিবেক রুচিধর্মের কাছে আমার কি কৈফিয়ত থাকবে?

মন কি বলে উঠবে না, বন্ধু তোমায় বিশ্বাস করে তার স্ত্রী এবং স্বপ্ন ভালোবাসা এবং বিশ্বাসকে রক্ষা করতে দিয়ে গেছে, তুমি তার সব কিছুই লুট করলে কেন?

রাবেয়া অত্যন্ত এলোমেলো হয়ে আমারই বিছানায় এই দুপুর বেলা ঘুমিয়ে রয়েছে। কোনো এক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মৃত্যুতে এই দুপুরেই কলেজ ছুটি হয়ে গেল। দরজা খোলাই ছিল, নিঃশব্দে ঢুকে পড়েই ঘুমন্ত রাবেয়াকে দেখছি। বর্ষার দিন ফুরিয়ে এসেছে। হিমের ছোঁয়া লেগেছে পৃথিবীর প্রকৃতিতে, সংসারের তাবৎ মহিমায় শরৎ এসেছে আকাশে পেঁজা তুলোর পাহাড় তুলে।

কিছুদিন থেকেই লক্ষ করছি, রাবেয়া এমনি এলোমেলো হয়েই শুয়ে থাকছে। আমি ওর মাথার কাছে বসলাম। ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লাম। ওর উপর ঠোঁটের ভূ-ভাগে বিন্দু বিন্দু ঘাম, যা অনেক রূপসীদের জমতে দেখেছি, তখন তাকে আরো রূপসী আর কামিনী করে তোলে।

মনে হলো, চুমু খেয়ে ফেলি। অন্যায় হবে না। রাবেয়া বাধা দেবে না। সে যে আজও আমায় ভালোবাসে, আজও সে মনে করে, আমিই তার প্রকৃত প্রেমিক। শুধু কি কলমা-হাদিসের জোরে, ফতোয়া মল্লার দাপটে হামিদুলের একান্ত হয়ে সে আমার স্পর্শসুখ থেকে বাইরে দাঁড়াবে? আমার কাছে, আজ এই ইদ্দতের পুণ্য-ক্রিয়ার তার কোনো যৌন দায় নেই?

.

রাবেয়া একটু নড়ে উঠল। কোথায় একটা খুট করে শব্দ হলো। আমি সভয়ে আঁৎকে উঠে মুখ তুলে নিলাম। নিজেই আশ্চর্য হলাম, আমার কত ভয়! চোখের সামনে মনের কিনারে ভেসে উঠল ছেলেবেলার হামিদুল। ধরে রাখ মামুন! খাস নে!

দেখলাম, স্বাস্থ্যময়ী নিদ্রাবতী রাবেয়ার কাপড় আলগা হয়ে খসে পড়া কোমর, তলপেট, বুকের চূড়া থেকেও কাপড় সরে গেছে, রাবেয়া জামার ভিতরে অন্য কোনো আবরণ দেয়নি।

.

এও কি ঠিক হচ্ছে? নিজেও কেমন চমকে উঠে দাঁড়ালাম। রাবেয়া, আবার নড়ে উঠে চিত থেকে কাত হয়ে গেল।

আমি ঘর ছেড়ে ভিতর বারান্দায় চলে এলাম। জামা-কাপড় ছেড়ে মুখ হাত পা ধুয়ে ঠাণ্ডা পানি খেলাম এবং ইজিচেয়ারে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে ছড়িয়ে বসে সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেলে ইদানীং মাথাটা সাফ হচ্ছে বলে মনে হয়। বুঝলাম, নেশায় ধরেছে। আস্তে আস্তে গা এলিয়ে শুয়ে গেলাম চোখ বুজে। সময় অতিবাহিত হতে থাকল। এবং ক্রমশ নিজেকে সমস্ত ঘটনা পূর্বাপর ভেবে নিয়ে মনে হলো, আমি একটা ব্যক্তিত্বহীন নির্জীব প্রাণী। হামিদুলের কাছে আমার দেনাদায়ের অন্ত নেই, ঋণের পর ঋণ করে গেছি, কখনো সে শোধ নেয় নি, হাতে যা তুলে দিয়েছে, তাকে বলেছে দান, বলেছে এ দেওয়া বন্ধুর কর্তব্য, কখনো সে ফেরত নেয় নি, কখনো সে তার এই দেওয়া-থেওয়া কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমায় পীড়া দেয়নি।

.

আজ তিন মাস হতে চলল, হামিদুল তিনখানা চিঠি লিখেছে কেবল। এম ও করে মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছে রাবেয়ার নামে, আমার প্রযত্নে। টাকাগুলো খরচ না করে বাক্সে ফেলে রেখেছি। সাদামাটা ফর্মাল চিঠি, টাকা পাঠালাম, দরকার মতো খরচ করবে, আরো যদি প্রয়োজন মনে করো লিখবে, আমি ভালো নেই, তোমরা কেমন আছ লিখে জানাবে। চিঠি এসেছে, সে-চিঠি খুলেও দেখেনি রাবেয়া, টাকা স্পর্শ করেনি। বলেছে, এই তিন মাসের ভরণ-পোষণ তোমার, আমি অন্যের টাকা ছোঁব কেন?

আমি বলেছি, এ টাকায় কী করবে না করবে, আমি কিছুই বলতে পারি নে, তোমার নামে পাঠানো টাকা, রেখে দিলাম, প্রয়োজন মনে করলে ফেলেও দিতে পার, এই নাও বাক্সের চাবি।

চাবিটা খাটের উপর ফেলে দিয়ে কলেজ চলে গেছি, ফিরে এসে দেখেছি, চাবিটা তাকে তোলা রয়েছে, চাবি দিয়ে বাক্স খোলা হয়নি। টাকা যেমন ছিল, তেমনিই পড়ে আছে।

এই তিন মাসে হয়তো বড় জোর তিনদিন রাবেয়া আমার মানিব্যাগ খুলে কাছের দৈহাট্টার বাজারে সংসারের টুকিটাকি সামান-আসবাব, ছোটখাটো তেল-তোয়ালের মতো নিত্যদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র কিনে এনেছে। মন্টি নামে একটি অ্যাংলো রিকশা চালককে বলে রেখেছি, মিসেসকে তার ইচ্ছে মতো শহরটায় ঘুরিয়ে আনবে, কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে, সিনেমায় গেলে, নিয়ে যাবে, রাবেয়া কিন্তু দৈহাট্টার বাজার ছাড়া কোথাও কিছু দেখল না।

.

একদিন কথায় কথায় বললাম, কোথাও গেলে তো পার! সারাদিন একলা থাকা!

ফুলমতি সকালের রান্না করে রেখে চলে যায়। হাটবারে হাটে যায় আপন হাতে ফলানো সবজি নিয়ে বকুলতলার হাটে, সেদিন আর বিকালে আসে না। বিকালের রান্না পুরোটাই রাবেয়াকে করতে হয়। কিন্তু দুপুরটা ভীষণ নির্জন নিঃসঙ্গ, ঘুমিয়ে কাটানো কিংবা বইপড়া আর উলের বল কাঁটা, এতে মনটা তো খাঁ খাঁ করবেই।

রাবেয়া বলেছে, তিন মাস তোমার এই ঘরে হাজত বাস করছি, ছুট কয়েদির মতো কোথায় পালাব? বিনে সুতোয় তিন কথায় যতটুকু বাঁধবার বেঁধেছ, ফের যেদিন তালাক দিয়ে ফিরিয়ে দেবে, এই সুন্দর খাঁচা ছেড়ে উড়ে যাব আর এক পিঞ্জিরায়, মেয়েদের কোথাও মুক্তি নেই!

বলেছি, মনেরও কিছু আলো বাতাস চাই, রাবেয়া। এখানে একটা চমৎকার কবিতার মতো নদী আছে। দেখেছ?

রাবেয়া খুশি হয়ে বলেছে, দেখিনি। আভাস পেয়েছি। এই জানলাটায় চোখ রাখলে একটা ঝলক আসে, গন্ধ পাই। চিতি। সত্যিই বড্ড মিঠে নাম নদীটার।

-ইয়েস! ভেরি সুইট! যাবে?

—গাঁয়ের মেয়ে আমি, নদী কি দেখি নি? রাবেয়া কথা বলে।

-দেখেছ বলেই তো গন্ধ পাও, ঝলক পাও। চোখ জুড়াবে তোমার। একঘেয়েমিও কাটবে। কোথাও গেলে না, চল, এট্টু নদী দেখে আসি!

সেদিন রাবেয়া রোজকার মতো জানলার আধ-খোলা কপাট পুরো খুলে উদাস হয়ে চিতির পলিজল মেশানো তটভূমির দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে বললে, যাব! তার পর পেছনে ফিরে বললে, শহরে শুনেছি, অনেক মেলা-খেলা হয়! কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও কোনো উৎসাহ পাই না। তোমার কি মনে হয়, আমরা দুজন আত্মগোপন করে আছি? তুমি তো সব সময় চোরের মতো থাক। একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে।

-কী কথা?

রাবেয়া মুচকি হেসে জানলা ছেড়ে সরে আসে। বলে, তুমি রাগ করবে না?

বললাম, রাগ কেন করব? রাগের কথা বললে নিশ্চয় করব।

—এই তো! আগেই তুমি রেগে উঠেছ! তবে থাক। আরো দু দিন ভাবতে দাও।

বললাম, মিছেই কেন দুঃখ পাচ্ছ! আগে বলই না শুনি?

রাবেয়া বললে, আগে কথা দাও। তুমি রাগ করবে না? রাগের কথা হলেও রাগবে না। গা ছুঁয়ে বল!

-বেশ তো! কথা দিলাম। এবার বল।

রাবেয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, সত্যি করে বল, তোমার এই জীবন ভালো লাগছে?

—কোন্ জীবন?

—এই যে তোমার আমার জীবন। এই ঝুট দাম্পত্য। মিছিমিছি বানানো ছায়াবাজি।

বললাম, বুঝেছি। তোমার খুব মনস্তাপ হচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছ।

রাবেয়া বলে, কষ্ট নয়। ভাবছি, আমরা দুজন কোনো মুখোশ পরে নেই তো?

বলেই আমার একখানা হাত চট্ করে চেপে ধরে রাবেয়া। রাগ কোরো না লক্ষ্মী! আমার ভুলও হতে পারে!

দেখলাম, রাবেয়া যা বলতে চেয়ে এগিয়েছিল, তা চেপে যাচ্ছে।

বললাম, ভুল কেন হবে। ঠিক কথাই বলেছ পিয়ারী। মুখোশ। একটি মুখোশ স্বামীর। একটি স্ত্রীর। মুখোশ তিন মাস বাদে খুলে ফেললেই আমি মামুন রহমান, অধ্যাপক। তুমি হামিদুল-পত্নী গাজীপুরী, শিকদারের বউমা। ছায়াবাজিই বটে!

হা হা করে কখন নিজের মনের অজান্তে হেসে উঠি। রাবেয়া অসহায়ের মতো কেঁদে ফেলে। বলে, তোমাকে জেনেশুনে কষ্ট দিচ্ছি মামুন! আর কখনো এমন করে বলব না। এস আমরা আমাদের সামনের এই কয়টা দুর্লভ দিনরাত্রি যেমন করে পারি সুখে সুষমায় ভরিয়ে তুলি। আমি যাব, নিশ্চয়ই বেড়াতে যাব। চিতির খেয়াঘাটে নৌকা চড়ব। নদীর ওপারে ফুলমতির বাড়ি। সেখানে গিয়ে একটা মেয়েলি ভাবের আসর বসবে।

বললাম, মেয়েদের ভাবের আসর। সে এক বিষম বস্তু। ওতে আমার ভারি লোভ।

রাবেয়া বললে, লোভ যতই থাক। ফুলমতি আর আমার দোস্তালিতে তুমি পুরুষমানুষ, ঢুকবে কেন? তোমায় আমরা নেব না।

বললাম, না নাও, আমি তখন চিতির সাথে ভাব করব। একলা একলা ঘুরব। মেয়েদের হেঁসেল-ঘরের কাব্য যতটা ভাবছ, আমার ওতে ততটা রুচি নেই। আটক কাজে যাও তুমি, লাউ কুটতে বসি আমি। ওরকম খুনসুটির কষাটে রসে ভিয়ান দেয়া মেয়েরাই পারে। বলতেই আমার সাথে রাবেয়াও হেসে উঠে বলে, তুমি অনেক তথ্যই জান দেখছি। কিন্তু এটা তো জান না, মেয়েরা সংসার-জীবনে পড়শি না পেলে হাঁপিয়ে ওঠে।

বললাম, হাঁপিয়ে ওঠে বলছ কি, একদম ঢেঁসে যায় বল। সেইজন্যে বলছি, মনে একটু আলোবাতাস দাও। চল, বেরিয়ে পড়ি।

—এখনই যাবে নাকি?

–কাল রোববার। কাল যাব। বেলাবেলি গিয়ে ফিরে আসব। কথাটা ফুলমতিকে আগে জানিয়ে রাখলে ভালো হতো।

রাবেয়া বললে, তার কোনো দরকার করবে না। আমরা তো নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি না। হাওয়া খেতে খেতে উঠব গিয়ে। বাঘাই-এর দুধে পায়েস রাঁধবে ফুলমতি। সরষের তেলে পরোটা। আর এক গেলাস দুধেল চা। কিন্তু এই বেলা গুঁড়ো দুধে চা দেব এখন। বিরক্ত হলে পারব না।

—গুঁড়ো দুধ কেন?

—সে এক চিত্তির হয়েছে। বাঘাইয়ের দুধ লেলকি বাছুরে নিংড়ে চুষে খেয়ে ফেলেছে। ফুলমতি দুধ দেয়নি। বলতে বলতে রাবেয়া রান্নাঘরের দিকে চলে গেছিল সেদিন। ফিরে এলে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলেছিলাম—যাই বলো রাবি! মুখোশ পরেই থাকি আর আত্মগোপন করে ভয়ে-ডরেই থাকি, আমি আমার বিবেকটা সাফ রাখতে পারলেই খুশি।

রাবেয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, তুমি ফের আবোলতাবোল ভাবতে শুরু করলে! এইজন্যেই আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলতে পারি না। আজ মনটা এত ভালো ছিল, ভেবেছিলাম, তোমাকে একটা সুন্দর স্বপ্নের কথা শোনাব, তা আর হলো না।

-স্বপ্নের কথা? বেশ তো! শোনাও না!

—এখন তুমি বিরক্ত হবে। বাস্তবে মানুষ যা পায় না, স্বপ্নে তা খুঁজে বেড়ায়।

বললাম, সচ্ বাহ্। ষোলআনা সত্যি। আমি কী ভেবেছি জানো! দুঃখে-কষ্টে পড়ে মানুষ কবি কিংবা দার্শনিক হয়ে যায়, এটাও কিন্তু সচ্ বাহ্। আজকাল সস্তা কাব্য করার বাতিক হয়েছে আমার। স্বপ্নের কথা বললে তো! সেদিন ভাবছিলাম, এই তিন মাস কোনো বাস্তব বিষয় নয়। স্রেফ একটা স্বপ্ন। ভাবতে বেশ। কিন্তু আসলে এর চেয়ে রূঢ় বাঁকা কুটিল বাস্তব ব্যাপার আর কিছু নেই। এর স্মৃতি, এর সোয়াদ, এর তৃষ্ণা, অতৃপ্তি মানুষকে ফৌৎ করে। চোরাগোপ্তা একটা স্রোত তলে তলে নাড়া দেয়, ইমোশানে ঘাই মারে। পাকে পাকে জড়িয়ে দেয়। যেহেতু মানুষ আফটার অল মানুষই। মেশিন নয়। তাই এই তিন মাসে মানুষকে বিস্তর স্বপ্ন দেখতে হয়।—তোমার স্বপ্নটা কি শুনি?

রাবেয়া গম্ভীর হয়ে বললে, তুমি মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বল, মনে হয়, অন্যের মনের শেষ কিনারায় তোমার দৃষ্টি পৌঁছে গেছে। সেখানে এইমাত্র যে আবেগের ছোট্ট বুদবুদটা উঠে ফেটে গেল, সেটুকুও তোমার নজর এড়ায় নি।—যাই হোক। স্বপ্ন দেখলাম। একটা মেলায় গেছি আমি। বিনোদপুরে পৌষ মাসে প্রতি শনি-মঙ্গল মেলা বসত, মনে পড়ে? সেই রকম মেলা। মনের মধ্যে একটা নাগরদোলা ঘুরছে আমার। মেলার সেই নাগরদোলায় বাচ্চারা সব চড়েছে। দোলা ঘুরছে। আমি ওদের খোপে খোপে সাজিয়ে তুলে দিচ্ছি। নামিয়ে নিচ্ছি। আমার কোনো ক্লান্তি নেই। কোনো বিরাম নেই। এ স্বপ্নের কোনো মানে হয়? এই দোলার মধ্যে আমার মুন্না কোথাও লুকিয়ে আছে।

-মুন্না? তোমার মুন্না?

—হ্যাঁ গো। আমার খোকা। আমাদের ছেলে।

-কোথায় সে? কখনো বলনি তো!

-বলব কি! ও তো স্বপ্নের মধ্যেই রয়েছে। স্বপ্নটা মিষ্টি, কি মিষ্টি! তাই না? কিন্তু সে একদিন বাস্তবেও ছিল।

—ছিল?

—রক্তেমাংসে ছিল। এখন স্বপ্ন ছাড়া কোত্থাও তাকে পাওয়া যায় না একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমারও। বললাম, স্বপ্ন আর বাস্তবটা এত মাখামাখি আগে জানা ছিল না। দাও, আর একটু চা দাও!…

.

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। চিতির খেয়াঘাটে পৌঁছতে সময় বেশি লাগে নি। একটু একটু শীতালি হাওয়া দিচ্ছে প্রকৃতি। রাবেয়া তার মনের মতো করে সেজেছে। আমার পছন্দ করা সন্ধ্যামণি ফুলের মতো স্নিগ্ধ রঙের শাড়ি, কালচে লাল ব্লাউস। অপ্সরা খোঁপায় রাবেয়াকে অচেনা নারীর মতো আপন সৌন্দর্যে কুণ্ঠিত মনে হচ্ছে। এমন-এক অচেনা বিস্ময় কোথা থেকে আসে, এই দুই চোখ তার ব্যাখ্যা পায় না। এই অচেনাকে স্পর্শ করলে স্পর্শভার সে উপেক্ষা করে না, এর চেয়ে ভালোলাগা অনুভূতি আর কী আছে? হাতের সোনালী চিকণ চুড়ি একবার ছুঁয়ে দেখি। যেন ঠিক শিশিরের সৌন্দর্যকে স্পর্শ করছি এইভাবে কেঁপে ওঠে রাবেয়া। শিহরিত হয়। মনে মনে বলি, তুমি ঠিক হুরীর মতো অলৌকিক রাবেয়া! ছুঁয়ে ছেনে দেখতে বড় সাধ হয়!

হঠাৎ কবিত্ব করে রাবেয়া বলে, নদী ছাড়া তোমার কি কোনো বন্ধু ছিল না?

চমৎকার প্রশ্ন। বললাম, এ শহরে আমি একজন কোরা বাসাড়ে। আধুনিক নাগরিক কবির মতো একলা। আমার জীবনে গীতি-কাব্যের নির্জনতা বিষণ্ণতা, এক ধরনের ব্যথিত বিষাদ আছে। মানে বোঝ?

রাবেয়া বললে, প্রত্যেক অতৃপ্ত প্রেমে ব্যথিত বিষাদ অবধারিত প্ৰসঙ্গ – এই বুঝি! এত স্বচ্ছন্দে এত সুন্দর কথা বলতে পারে রাবেয়া, ভেবে অবাক হই। নদীর এপারে কিনারে ঝুঁকে থাকা বিশাল বট-পাকুড়ে জড়াজড়ি গাছের শিকড়ে বসি দুজন। দুপুরের নির্জন ঘাট। মাঝি নেই। ওপারে নৌকো বাঁধা। পেছনেও ফসল কেটে নেওয়া ফাঁকা মাঠের শূন্যতায় দু-চারটে বিরল বাবলা তাল খেজুরের নির্জনতা। দু-চারটে উন্মনা গোরু চরছে। পেছনে তাকালে চোখে পড়ে ইলেকট্রিক তার আর তার শাল কাঠের খুঁটির দূরত্ব, পাকা সড়কে ছুটন্ত শহরমুখো লরি। রাবেয়ার দিকে চেয়ে দেখি, মুখে ক্লান্ত ঘামের ফোঁটা। পায়ে ধুলো-মাখা চটি। নদীর স্রোতের দিকে চেয়ে আছে যেন এক বিষণ্ণ প্রতিমা। মানুষ ভাবতে পারে, এই রকমই তুচ্ছ কাব্যের লোভে আমি তাকে চিতির কূলে কাঙালের মতো টেনে এনেছি। কবুল করব আমি লোভী। এর জন্য মানুষ সংসারের তিরস্কার সইতে দুঃখ পায় না। এ মুহূর্তে আমি সুখী। এ সুখের অবধি নেই।

ওপারের নৌকোর দিকে চেয়ে বললাম, মাঝি নৌকো বেঁধে বাড়ি গেছে। স্নান-খাওয়া করে তামাক টেনে জিরোবে, তারপর ফিরবে।

রাবেয়া ব্যথিত বিষাদে তন্ময় হয়ে হয়তো কোনো অকূলে নিজেকে হারিয়ে বসেছিল, চমকে উঠে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললে, তাই বুঝি?

বললাম, তালেব মিঞার নাও, বুঝলে! ধান পাটের মরশুমে ধান পাট, গমের মরশুমে গম মসুরী, সরষে তিসির পাঁজা দেয় লোকে। চাকুরে যারা, বৎসরান্তে দশ পনেরো বিশ পাঁজা বাবদ মেটায়।

রাবেয়ার তন্ময়তার ঘোর এখনো যায়নি। আপন মনে বললে, তাই বুঝি!

বললাম, ঐ যে কুঁড়েঘর দেখছ, ওটাই হচ্ছে ডেরা। এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলেও শুনতে পাবে না। শুনতে পেলেও সাড়া দেয় না। তামাক টানার সময় বেটা মাঝি কানে তুলো দেয়। কোনো তোয়াক্কা রাখে না।

রাবেয়া ফের বলে, তাই?

বললাম, তা ছাড়া কী!

—তবে তো বেশ লোক। সব খেয়াঘাটই কি এ রকম? সব মাঝিই কি সমান? সব নদীই মনে হয় চেনা। এতে যারা পারে যায়, তারাও কি সব এক? ঐ দেখ দু জন এসেছে।

পেছনে চেয়ে দেখলাম, একজন পাকা প্রৌঢ় আর একটি নব্য যুবতী এসে বট পাকুড়ের শেকড়ে ঠেক নিল।

লোকটির কানে আধ-খাওয়া পোড়া বিড়ি। মুখে প্রাচীন বসন্তের দাগ। ফুটকি ফুটকি নকশা। মাথার চুলে দাড়িতে গোঁফে রুপোর ঝিলিক। তোবড়ানো গালে প্রৌঢ়ত্বের ভাঙা নিরাশা। চোখে কঠিন ক্রূর দৃষ্টিতে কেমন বিহ্বলতা। পরনে তার সস্তা নতুন কেনা ঝিলমিলানো নকশাদার লুঙ্গি, গা-পিছলানো রঙ। গায়ে পুরনো সাদা জ্যাকেট, কাঁধের কাছে পট্টি মারা। পায়ে টায়ারের ছেঁড়া মাখন-চটি।

লোকটি বিড়ির কৌটো থেকে নিজে হাতে বাঁধা কাঁচা বিড়ি বার করে লাইটারের চাকতি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সলতে মুছে ধরিয়ে নেয়, চোখে পিচুটির সাথে বিষণ্ণ ক্ষুধার্ত জল চিকচিক করছে।

রাবেয়া বললে, দেখতে কার মতো বল তো? সরদীঘার শাদা মিঞার মতো, হুবহু এক দেখতে। আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। শাদা মিঞা এখানে কেন আর শাদা মিঞা ভাববে আমি এখানে কেন। খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। দেখ না ভালো করে, আদলে ছবিতে সেই একই লোক।

আমাদের থেকে বিশ-পঁচিশ বিঘৎ দূরত্বে ওরা বসেছিল। আমাদের কথা হয়তো ওরা একটু শুনতেও পাচ্ছিল। লোকটি বিড়ি টানছিল আর আমাদের দিকে বার বার চেনা মানুষের মতো চেয়ে চেয়ে দেখছিল। লোকটির দু বার বিড়ি নিভে গেল, দু বারই ধরিয়ে নিল।

পা ছড়িয়ে বসেছে মাথায় ঘোমটা টানা কাঁচা যুবতী। কোলে ন্যাকড়ায় জড়ানো মাংসপিণ্ড। বুকের মায় কালো ব্লাউজ থেকে আলগা করে সব্‌জী পাড় শাড়ির আঁচলে বাচ্চার মাথা-গা ঢেকে দুধ দিচ্ছে। বাচ্চা চিন্‌ চিন্‌ করে কাঁদে। কান্নার সুরে কী দুর্বোধ্য অভিযোগের ধারালো চিৎকার। আমরা কিছু কৃপণ সুখের তল্লাশে তিন মাসের অপুষ্ট স্বপ্নের হাত ধরে চিতির দিগন্তে এসেছি, এখানেও কান্নার নিষ্ঠুরতা।

ভালোবাসার চকিত রহস্যকে খুঁজে দেখার আকুলতা মনে যে তাগিদ দিচ্ছিল, এখন তা কান্নার দাপটে খানিক বোকা হয়ে গেছে।

বললাম, ওদের সাথে একটু কথা বলি? সেই সব গ্রাম-ঘরের চাচা ফুপার গুষ্টি, বেদের বাঁশ-নলার মতো সম্পর্ক ধরে এগোলে গেঁথে ফেলতে কতক্ষণ! গাঁয়ের মানুষ গায়ে পড়ে ঢলানি করে, শহুরে শিক্ষিতরা বলে, এরা হচ্ছে ভাব-বেশ্যা, এ অপবাদ একদম মিছে নয়। কিন্তু এর যে কী আঠালো রস, শহর তার হদিস পায় না। সম্পর্কের বিশুদ্ধ প্রণয়ে গাঁয়ের কোনা বিশেষ ভক্তি নেই। সম্পর্ক একটা পেলেই হয়, ব্যস থিতু হয়ে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে আলাপে আলাপে বেলা বাড়ে, ফোঁটায় ফোঁটায় রসে কোনো খামতি হয় না। কিন্তু শহরে এ রকম গা আলল্গা দেয়ার সময় কোথায়, ঘাসের আস্তরণের তলায় তলায় ট্রামের লাইন পাতা, কখন যে পেছনে এসে ট্রাম ঘণ্টি বাজায়, গাঁয়ের চাষা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বোকা হয়ে ভাবে, এই হচ্ছে শহর! সতর্ক না থাকলেই টেসে যাবে তুমি!

রাবেয়া বললে, বাঃ, চমৎকার বলেছ! শহরে এলে বোঝা যায়, মানুষের জীবনটা কতটা সূক্ষ্ম সুতোর উপর ঝুলছে। শহর বলতে অবিশ্যি কলকাতা। তোমার এ শহর গাঁয়ের জমিদারের মতো ঢেকুর হাই তুলে চলে, পায়ে কাদা মেখে জংলায় নামে। বিশাল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ শহর আপ্রাণ শহর হতে চাইছে, সাধ্য তার সামান্যই। থাক ওসব বাজে কথা। ওদের একটু গাঁথো দেখি। কোথায় যাবে ওরা?

শুধালাম, তোমরা চললে কোথায় চাচা? এলে কোথা থেকে?

চাচা বলে ডাকতেই চাচার মনের ভেতর নাড়া খেয়ে গেল। বিড়িতে সুখটান মেরে বোঁটা ফেলে দিল ছুঁড়ে। তারপর গড়গড় করে বলে যেতে থাকল, আলাম আপনার তেঁৎলে থেগে, যাচ্ছি তক্তিপুর। মেইছেলিডারে লিয়ে যাচ্ছি সোয়ামীর বাড়ি। সোয়ামী আজ আট মাস লয় মাস খোঁজ লিলে না। বাচ্চা হলো, তবো আসে না।

প্রৌঢ় দাঁতের ফাঁক দিয়ে চিরিক করে থুতু ফেলে বললে, হাওয়া মুরগের পানা পুরুষ-চাষার মন, মছলমানের গেরস্তালীতে হামেশা যা হচ্ছে বাবাজীবন! কেউ তালাক দিয়ে লেয় না, কেউবা তালাকও দেয় না, ভাত দিবারও নাম লেয় না, বোঝেন বাবা! এ কেমুনধারা ছাস্তি একবার জরিপ লেন দেহি! রাবেয়ার দিকে চেয়ে দেখলাম, চোখমুখের সজীব মাধুরী কোন এক অদৃশ্য ধূমল অন্ধকার চুষে নিষ্প্রভ করে দিচ্ছে। চোখের সামনে দেখা এ দৃশ্যের একটা নিদারুণ প্রতিক্রিয়া আছে।

প্রৌঢ় তখনও বলে চলেছে, তক্তিপুরের মোড়ল শাবান মিঞা এট্টু ভরসা দিয়েছে আমারে, দেখি যাই! যতি মেইডার এট্টু হাত-পা ধরে গতি করতে পারি! বললাম, বাচ্চার টানে যদি নেয়, নিতে পারে। মেয়ের স্বামী কি ফের নিকে করেছে?

প্রৌঢ় বললে, সেই রকমডাই শুনছি বাপধন

বাচ্চাটি তীক্ষ্ণ রেয়াজে ফের বেজে উঠল। ওপারে নৌকয় মাঝি এসে গেছে দেখা যায়। লোকটি এবার উঠে দাঁড়ায়। বউটিও খাড়া হয়। বাচ্চাকে ঘাড়ে পাট করে বুকের সাথে চেপে ধরে নৌকোর দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে সামনে পা বাড়ায়। রাবেয়া কখন দ্রুত এগিয়ে গেছে বউটির পেছনে।

আমার পেছনে আধ-বুড়া বিপর্যস্ত লোকটি। দেখলাম খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটছে। বললে, শেষ জুয়ারের পানি, তারই ফসল এই মেয়ে, বাবাজী! দামাদ যেতি না লেয়, কুন গাঙে ভাসাব এই মুখপুড়িকে, ভাবেন তো মিঞা!

—কী করেন আপনি? জমি জায়গা কিছু?

—কিচ্ছু নাই বাবা। শুদ্দু এই জ্বালা-পুড়া করা গতর। এই হচ্ছে সিমিস্যা, চলে না বাপ! লিজে খাব, না, তারে খাওয়াব, কহেন বাবাজীবন! এ গতরে আর ঘামও নাই, লোহুও নাই। বেচব কী? চোখের জ্যোতি, সে-ও কেউ কিনবে না। রাবেয়া এই কথা শুনে পেছন ফিরে চকিতে তাকাল। মুখে এক ঘোর তমসা ছেয়ে আছে, ঠোঁট দুটি তার শুকিয়ে খরখর করছে।

ফের শুধালাম, জামাই কি করে?

বললে, ঝাঁকা-অলা, মুরগীর ব্যাপারী। ধূর্ত। কথায় কথায় কছম খায়। দামাদের মুখে নুড়ো দিতে হয় বাপ। কছম করে মজলিসে সেদিন কইলে মেয়ে লিবে, আবার কছম খেয়ে কইছে মেয়ে লিবে না। মানুষের কিরা-কছমের কী দাম, কহেন তো বাপধন!

.

নৌকোয় চেপে বউটির দিকে বার বার দৃষ্টি ছুটে যেতে লাগল। রাবেয়া ওর খুব পাশে বসে ওরই ঘোমটার আড়ালে থাকা লাজ-লজ্জার মিঠে ভীরুতা আর অসহায় সারল্যের মুখখানি চেয়ে চেয়ে দেখছিল, চাপা সুরে কি সব কথা চোখের ইশারায় বিনিময় হচ্ছিল জানি নে। দেখছিলাম, পায়ে আলতার পোঁচে গার্হস্থ্যের নিশানা, দাম্পত্যের আহ্লাদ। ভাবছিলাম, ধূলায় মলিন পা দুখানি হয়তো পথেই হারিয়ে যাবে। কোথাও পৌঁছবে না।

.

আরো দেখছিলাম, মনের চিন্তার চাপে চেহারা কি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায়। অচেনা হয়ে ওঠা রোমান্টিক মেয়েটি দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে গেল। তার হৃদয়ের গোপন স্পন্দন এখন আর ধরতে পারছি না। এতক্ষণে সে সত্যিকার অচেনা হয়ে উঠেছে। একটা সামান্য দৃশ্যে মনের তাবৎ পরিস্থিতি ভূ-কম্পনের মতো ওলটপালট হতে পারে, প্রকৃতির এই স্বাভাবিক বিপর্যয়ের নিয়ম কখনো কখনো চৈতন্যের পৃথিবীতে চোখেও দেখা যায়।

আমার খুব ভয় করতে লাগল।

বউটি ন্যাকড়া দিয়ে বাচ্চাকে ভালো মতো জড়িয়ে নিচ্ছে, নৌকো ভিড়ছে চিতির অন্য কূলে। তালেব মিঞা নয়, তালেব মিঞার ছেলে ইদ্রিশ নৌকো বাইছে। আকাশে পান-চুনের মতো সাদা মেঘ। আকাশের রঙ মটরশুটির ফুলের মতো নীল। আশ্বিনের বিকাল এসে গেল। রোদের উত্তাপে স্নিগ্ধ আমেজ, হিমের ওম। চোখে বাতাসের মৃদু ধারালো স্পর্শে জল ভাঙে দুঃখিত মানুষের। মানুষের দুঃখ বেড়ে ওঠে।

নৌকো থেকে নেমে বউটি আর লোকটি অন্য দিকে চলে গেল। আমরা পশ্চিমমুখো হাঁটতে লাগলাম। পলিমাটির থলথলে চোরা বিপজ্জনক মাটির কিনারা। বিধ্বস্ত খাড়ি। অনাবাদী ঘেসো জমিতে গোরু ছাগল মোষের দঙ্গল। পশ্চিমে এক বাঁশ উঁচুতে সূর্য দীপ্যমান। রাবেয়ার চোখে গাঢ় জল আর সূর্যের কিরণে ঝিলিমিলি। খুব পশ্চিমের দিগন্তে গাঢ় কালো মেঘের মাথা তুলে ওঠা ছোট্ট পাহাড়। ঠেলে ঠেলে উঠছে। সাদা মেঘের হালকা ডিঙার পাশে আলকাতরার মতো কালো পালতোলা একটি ডিঙির ভয়াবহ প্রস্তুতি। একটি মোষ ঘাস ছিঁড়ে খেতে খেতে হঠাৎ পশ্চিমের মেঘের দিকে চেয়ে রইল, তার পর পা ঝামড়ে ফোঁৎ করে উঠল।

.

রাবেয়া এখন আমার গা ঘেঁষে হাঁটছে। মোষটির রকম দেখে আমার বাঁ হাতখানা সজোরে চেপে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। মোষটির বুকের ভিতর একটা অচেনা ভয় পাক দিয়ে গোঁত্তা মেরে উঠল। কালো মেঘ। ওটা কি? আরো দু-বার ফোঁৎ করে উঠে সামনের দু পা সামনে শূন্যে তুলে লেজ নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে উন্মাদের মতো দিকভ্রান্তির নেশায় পালাতে শুরু করল গোঁ গোঁ আর্তনাদ ছড়িয়ে। পেছনে রাখাল ছুটেছে।

.

মানুষও এ রকম ভয় পায়, বুকে ত্রাস লাগে। সব কিছু শূন্যে ঘুরতে থাকে। রাবেয়া বললে, আমরা এভাবে বেড়াতে বেরিয়ে ভালো করিনি মামুন! চলো ফিরে যাই!

—ফিরে যাব? কেন? ভয় পেয়েছ?

—পেয়েছি বৈকি! কথা না বাড়িয়ে আমি বলছি, তুমি ফিরে চলো।

—আর একটু গেলেই ফুলমতির বাড়ি। ওখানে গিয়ে সন্ধ্যার চাঁদ উঠত আকাশে, আমরা তখন ফিরে আসতাম।

–না!

–কি না! তোমার হয়েছে কি বলবে তো!

রাবেয়া আমার দিকে কঠিন চোখে চেয়ে দৃষ্টির শাসন হেনে বললে, জানতে চেও না, আমি কেন ফিরতে চাই। বললেও তুমি বুঝবে না। মানুষের মন একটুও যদি বুঝতে, নিজে থেকেই এতক্ষণ ফিরে যেতে চাইতে।

-বেশ, ফিরেই যাচ্ছি। কিন্তু তুমি অকারণ দুঃখ পেয়েছ। বউটা দেখতে যেমন মিষ্টি, তেমনি করুণ।

-মর্মান্তিক। পুড়ে যাওয়া সাদা রুমালের একাংশ। পৃথিবীতে কোথাও সুন্দর কিছু নেই। ওদের চেয়ে দেখে আমার কি হয়েছে বোঝাতে পারব না। তুমি একটা ভুল পথে আমাকে ফুসলে এনেছ। আমি আসতে চাইনি।

—ফুসলে এনেছি? আসতে চাও নি?

-না। একদম না। এটা চোরা পথ। এটা কোনো পথই নয়। এ নদী অভিশপ্ত।

—নদীর ওপর রাগ করছ কেন?

—চিতি একটি সাপের নাম। এটা কোনো কবিতা নয়, আমি ভুল বলেছি।

-বেশ, বেশ। তাই সই। কিন্তু সব ঘটনাকে একটু অন্যরকম করে ভাবলে ভয়ের কিছুই ছিল না। রোজকার একটা সাধারণ ঘটনা…

ক-দিন আগে এই নদীর দকিজলে (পলিজলে) একটি নধর গাই পুঁতে মরেছে, গাইটার দকি-সমাধি হয়েছে। ফুলমতি বলেছে আমাকে।

—এ কথা আগে বলনি কেন? দকি থাকলেই সমাধি হতে পারে। সব নদী সমান। তুমিই বলেছ।

—বলেছি বেশ করেছি। তুমি বেছে বেছে সেই নদীতে কেন এনেছ, জানি না?

-কেন এনেছি?

—এখানে এভাবে বেড়াতে তোমার ভয় করছে না? বুকে হাত দিয়ে বল! একটু আগেই ঐ বুড়োটাকে আর বউটিকে আমাদের খুব চেনা মনে হয়েছিল। হয় নি?

—হয়েছিল। কিন্তু ওরা কেন, কেউ আমাদের এখানে চেনে না।

—ইয়েস, চেনে না। চিনলে কী করতে? চেনা হলে নিশ্চয় তুমি আসতে না? কেন আসবে, আমাকে নিয়ে সব সময় তুমি কাঁপছ, লজ্জা পাচ্ছ। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার কারণে তুমি ছোট হবে, আমি তা চাই নে মামুন! লোকচক্ষে, কেন তুমি বিড়ম্বিত হবে! সত্যি তো তোমার কোনো দোষ নেই। এইজন্যে কোখাও কখনো কোনোদিন বাইরে যাওয়ার আবদার করিনি। আমি এক্ষুনি ফিরব। একদণ্ডও আর নয়। বলেই রাবেয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে খেয়াঘাটের দিকে ছুটে চলল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম পিছু হাঁটতে হাঁটতে, দেখ রাবেয়া! তুমি মস্ত ভুল করছ। নদীকে ঘিরে আমার ইমোশন তুমি বুঝতে পারনি। যে কোনো মানুষের কবি হওয়া আজকের পৃথিবীতে নিতান্ত দুঃখজনক। ভাবছিলাম, এতক্ষণ তুমি এই নদী আর প্রকৃতিকে নিয়ে আর্ট-হিউমার করছিলে, এতটা সিরিয়াস হবে, ভাবি নি।

—সব কিছুই তোমার কাছে আর্ট, সব কিছুই হিউমার। আমরা তেমন করে চলতে পারি নে।

—তুমি যেমন করে চলছ, সেটাও কিন্তু স্বাভাবিক নয়। নিজের জীবনটাকে সইতে পারছ না বলেই কি আমার ওপর এ রকম অত্যাচার করবে?

—আমি অত্যাচার করছি? এর নাম অত্যাচার? আশ্চর্য! মেয়েমানুষকে তার দুঃখের কথাটাও বুঝে নিতে দেবে না তোমরা? ঠিকই তো, তোমার পক্ষে যতটা স্বাভাবিক সংগত তাই তুমি করেছ। সেদিন চায়ের নেমন্তন্নে সুমন্তবাবু এসেছিল, তোমার প্রফেসর বন্ধু, তখন আমায় গোপন চিঠির মতো আড়ালে সরিয়ে দিলে। তুমি চাইলে না আমি সামনে যাই। তোমার মর্যাদা তো আমি নষ্ট করিনি। আড়ালে থেকে কেঁদেছি। ইদ্দাতের কলঙ্কিত সীমানা লঙ্ঘন করিনি।

ব্যস, ব্যস, ব্যস। নো মোর রাবেয়া! আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঠিক এই কথাটাই আজ কয়দিন ধরে বলতে চেয়েও চেপে চেপে যাচ্ছিলে। কিন্তু এসব বলার জন্য নদীর মতো স্বচ্ছ প্রবাহকে দোষ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন তো দেখি না। ঘরে বসে বললেও তো পারতে। কিন্তু একটিও সত্য কথা বল নি।

—ঠিক বলেছি। সব সত্য।

ম্লান হেসে বললাম, অবিচার হচ্ছে রাবেয়া! কী কারণে জানি না, আমার ভালোবাসাকে তুমি বার বার অপমান করছ। তোমাকে পাওয়ার মধ্যে আমার আড়ষ্টতা আছে, ভীরুতা নেই।

—মিথ্যে কথা। এসব কথায় বাঁধন আছে। আঁটুনি নেই। মুহূর্তের জন্য মন হয়তো ভোলে, কিন্তু মন ভরে না।

—যা কিছু ভাবতে পারো। মনটা কিন্তু তোমার বিকল হয়ে গেছে। সুমন্তবাবু একজন সিনিক। যে কোনো স্বাভাবিক সৌন্দর্যেই তার অবিশ্বাস, ঘৃণা এমনিতেই সে বুঝেছে, তুমি আমার বউ। এ ব্যাপারে তার কোনো কৌতূহলই নেই। তোমাকে সামনে এনে তাকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না।

–আমি যে বউ, জগতকে এ কথা বোঝাতে পারবে তুমি?

—বাড়ির ঝিটা কি জানে না একথা? তুমি হীনমন্যতায় ভুগছ। বললাম, তুমি সত্যিই আমার কাছে কী চাইছ, সাফ সাফ বললেই তো পারো? প্যাঁচপ্যাঁচ বুঝি না আমি। আর এতই যখন জ্বালাপোড়া যে কথা সহজে বুঝবে, সেটাই তবে বলি এবার। হ্যাঁ, ঠিক, তোমার মনে যা ধরবে এখন সেটাই বলি।

নৌকো এল। নৌকোয় চেপে বসলাম।

—ধর্মধ্বজীরা যতই বলুক, এই তিন মাসের পুণ্যফল, কিছুই নেই। জীবনের খানিকটা দায় বলতে পারো। নিরুপায় বাঁধন একটা। না আছে সুখ, না আছে স্বস্তি। সংস্কারের জঞ্জীরকে ভয় হয়।

রাবেয়া মনে হলো ঠিক এ রকমই একটা কিছু তার চিন্তার সমর্থনে আমার মুখে শুনতে চাইছিল। ক্ষেপে উঠে সে বললে, ঠিক বলেছ, সংস্কার এত সহজে নড়ে না। তুমি ছাড়লেও এর একটা সামাজিক অনুভূতি আছে। নেই?

বললাম, আছে বৈকি?

-এই অনুভূতি বার বার ভয় দেখায় একটি শিক্ষিত মনকেও। এই সামাজিক অনুভূতির সামনে ব্যক্তির মর্যাদা সোস্যাল প্রেসটিজ ভালোবাসার খাতিরে কতটা মাথা নোয়াবে আমি তোমাকে দিয়ে তার একটা পরিমাপ করেছি। কেন জানি না, আমি কেমন আঁৎকে উঠলাম।

রাবেয়া বললে, ভেবেচিন্তে দেখলাম, খুবই সত্য কথা, আমার জীবনের এই দুর্বিষহ ভার অনেক বড় মনও বইতে গিয়ে দুঃখ আর ক্লান্তিবোধ করে। এখানে সুখ কোথায়? সুখের জন্য এসেছিলাম এমন তো নয়, পাপমোচন করতে এসেছি মামুন! তোমার স্পর্শে যদি জীবনটা শুদ্ধ হয়! দায় খালাস হলেই তুমি মুক্ত, এও কি জানি নে?

.

সারা পথ দুজনে কোনো কথা হলো না। সন্ধ্যা নামল। চাঁদ উঠল। কালো মেঘটা মাথা ঠেলে উঠে পশ্চিম দিগন্তেই মিলিয়ে গেল। শুধু মনের মধ্যে ভাসতে লাগল, বাজতে লাগল—চিতি কোনো নদী নয়। সাপ।

বাজতে লাগল কানে, শেষ জুয়ারের পানি, তারই ফসল এই মেয়ে, বাবাজী! দামাদ যেতি না লেয়, কুন গাঙে ভাসাব এই মুখপুড়িকে, ভাবেন তো মিঞা!

.

আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। পাশের ঘরে রাবেয়া কী করছে দেখতে গিয়ে দেখি তার হাতে একটি ফোটো। সেটা দেখছে এক মনে। আমাকে দেখে দ্রুত বালিশের তলায় লুকিয়ে ফেলল। সে কি তবে হামিদুলের ছবি দেখছিল? খাটে বসতেই আমার কোলে মুখ গুঁজে ফুলে ফেঁপে কাঁদতে লাগল। বললে কান্না ভেঙে পড়া সুরে, চিতি নামটা খুব মিষ্টি মামুন! বউটাও কত ভালো। নরম, বোকা। দুনিয়ার কিচ্ছু বোঝে না।

আমার এখন বালিশের তলার ছবিটা কেমন দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কেন এমন তীব্র কৌতূহল হচ্ছে, বুঝতে পারছিলাম না। রাবেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ফেললাম, তোমার সব কথাই হয়তো ঠিক রাবেয়া, কেঁদো না। রাবেয়া কোল ছেড়ে মুখ তুলে একবার আমায় দেখে নিয়ে, আবার মুখ গুঁজে আর্তকান্নায় গুঁড়ো হতে লাগল।

পাঁচ

সময় বইছে, সময়ের টানে। তিন মাস, অর্থাৎ গাণিতিক হিসেবে মাত্র ৯০ দিন জীবনের পক্ষে এত তুচ্ছ সময়, এত ক্ষুদ্র পরিসর, ভাবলে হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু রাবেয়া এবং আমার জীবনে এই ৯০টা দিন নানাবিধ আবেগের আবর্তে টেনশনে সরোষে ক্ষীপ্ত হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে।

.

আরো একদিন। দুপুর বেলা। ছুটির দিন। পাশের ঘরে রাবেয়া। আমি এ ঘরে। হঠাৎ চোরের মতো উঠে গিয়ে দেখি, রাবেয়া সেই ফোটোটি হাতে ধরে উদাস হয়ে বসে আছে। লজ্জা পাবে ভেবে ফিরে এলাম নিঃশব্দে চুপি চুপি, রাবেয়া টের পেল না। আরো এক ঘণ্টা পর আবার গেলাম। রাবেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখে কান্নার বিন্দু, চোখের কোণে জমে আছে। বালিশের তলায় হাত ঢুকাতেই রাবেয়া নড়ে উঠল। আবার ভয়ে ফিরে এলাম। এবং নিজের এই আচরণে নিজেই কেমন সংকুচিত হয়ে গেছি। হামিদুলকে রাবেয়ার মনে পড়াই তো স্বাভাবিক, কিন্তু তার মনের এই দুঃখবোধকে সংগত মনে করে চুপ করে থাকলেই তো পারি, কেন অযথা অস্থির হই? আমার মধ্যে কি কোনো ক্ষুদ্ৰ ঈৰ্ষা জেগে উঠছে?

.

পরের দিন এই কথা ভাবতে ভাবতে কলেজ গেলাম। কলেজে মন টেকে না, কোথায় যেন পালিয়ে গিয়ে নিরালায় বসে থাকতে ইচ্ছে করে। বয়ঃসন্ধির উগ্র প্রেমিকের নেশার মতো তরল ভাবাবেগ তাড়া দিয়ে ফেরে। ঠিক একটি স্বপ্নবেষ্টিত কাল্পনিক স্বাধীন ভূখণ্ড আবিষ্কার করি মনে মনে। যেখানে হারিয়ে গেলে কোনো বাধা থাকে না। পায়ে পায়ে শেকলে টান ধরে না। মোল্লাগাজী হাজী মৌলানা পীরজাদা কারো কোনো কুটিল ভ্রুকূটি নেই। হাদিস মছলার ফতোয়া যে পৃথিবীকে পঙ্কিল করেনি। বাস্তবকে মোকাবিলা করার যখন কোনোই পথ থাকে না, তখনই সে স্বপ্নিল ভূখণ্ড জলের তথা থেকে মাটির আস্তরণে আভাষিত হতে থাকে। সমাজের বাধানিষেধে চাপা পড়ে ভেঙে যাওয়া ব্যক্তির মন এইভাবে স্বপ্নের রাজ্যে পালাবার পথ খোঁজে।

তবে কি আমি হেরে যাচ্ছি?

একটিমাত্র ক্লাশ নেবার পর কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম পথে। কলেজ ক্যান্টিনে ভিড় দেখে সেদিকে গেলাম না। বুড়া রসিদ রিকশা-অলাকে পথে পেয়ে গেলাম। মন খারাপ থাকলে বুড়া রিকশা-অলাকে আমার ভালো লাগে। ঠুকঠুক্ করে পথে পথে ঘুরতে মনে আরাম পাই। দুঃখের ভার তাতে খানিক হালকা হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষের হয় কিনা জানি না, এ রকম টানা রিকশায় পথে পথে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর একটা কিন্তু নেশা আছে, খানিকটা পালিয়ে বাঁচার স্বস্তি মেলে তাতে।

খানিক দূর আসার পর নন্দীর কাপড়ের দোকানের সামনে রসিদকে দাঁড় করিয়ে নেমে পড়লাম। বললাম, দাঁড়াও আসছি, বলে দোকানে ঢুকে স্বল্প সময়ের পছন্দে দামী সায়া ব্লাউজ কিনলাম। কিনতে ভালো লাগল, তাই কিনলাম। না কিনলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। আবার উঠলাম রিকশায়।

বললাম, চলো!

—কোথায় যাব? তহ বাজার?

—যেদিকে খুশি। চল তো!

রসিদ বেঁটেখাটো মানুষ। ডান পা ঘায়ে পুঁজে বিষাক্ত, পঙ্গু, ওতেই নেচে নেচে রিকশা টানে। দেখলেই মনে হয়, হাঁপাচ্ছে, ধুকছে। রসিদ ঘণ্টি বাজিয়ে দিয়ে চলতে লাগল।

প্রায় একঘণ্টা চলার পর শহরের দক্ষিণপ্রান্তে কলেজ পাড়ার প্রাচীন রেস্তোরাঁ অনিন্দিতায় এসে থামল রসিদ। বললাম, স্ট্যাণ্ডে গিয়ে চা খাও। এই নাও, টাকা নাও। খদ্দের পেলে চলে যেও। ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা পর একবার পারো যদি আসবে। এখানেই থাকব।

অনিন্দিতায় চায়ের দর একটুবেশি। নানা রকম টোস্ট, সিঙাড়া, চপ, রোল খেতে পারি। রসিদ সস্তা দোকানে চা খেয়ে নেবে। আমি দোকানে ঢুকলাম, হাতে কাপড়ের বড় প্যাকেট, ‘নন্দী বস্ত্রালয়’ সাথে রইল। এখন দুপুর একটা। কেবিনে ঢুকেই চমকে গেলাম। আজ ৫/৭ বছর বাদে দেখলাম ওকে। চিনতে একটু কষ্ট হয়েছিল। চোখে চশমা আগে ছিল না। মাথায় এত চুলও ছিল না। কবি কবি দেখাচ্ছে ওকে। ভারিক্কি মাংসল হয়েছে আদল। বয়সেরও ছাপ পড়েছে সামান্য। সামনাসামনি বসলাম। হাতে হীরের আংটি মনে হলো। ঘড়িটা চকচক করছে সোনালী আভায়। বসতেই চোখ তুলে তুলে নরম করে দেখল আমাকে। চোখের ইশারা করে শুধালো, ভালো তো?

এ রকম করে অপরিচিত, ঘনিষ্ঠ কেউ ঢের দিন বাদে ইশারায় দূরত্বে রেখে কুশল শুধালে বন্ধুকে অহংকারী এবং নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়, আঘাত লাগে। তবুও বসলাম। বন্ধু এবার দোকানের ছেলেগুলোকে ডাক দিয়ে কি সব মূল্যবান খাবারের নাম করলে। ছেলেটা প্লেট সাজিয়ে ফিরবে এখনই। চন্দন সোম শুধালো, এই কলেজে চান্স পেয়ে গেলে, শুনেছি। কোথায় আছ? খুঁজছি অনেক মনে মনে। বাড়ি ভাড়া করে আছ, খবর পাই! শুধালাম, তুমি এখন কী করছ? বিজনেস?

—হ্যাঁ। বাবা আরো একখানা নতুন বাস কিনলেন। আমি অবশ্য লরিতে থাকি। সেই বোহেমিয়ান ভূতটা এখনো তোমাদের সেই মনকির নকীর ফেরেস্তার মতো ঘাড়ে বসে আছে। শরৎচন্দ্র পড়ে ছেলেবেলায় নষ্ট হয়েছি। তোমরা বলতে না, ভ্যাগাবণ্ড দি গ্রেট! সে-সুবাদে আমি জগতকে চিনেছি। নেশা কাটে নি। তোমাকে পেয়ে, আজ খুব ভালো হলো। ভেব না, টাকা থাকলেই মানুষ এরকম হয়। জানো আজও আমি বিয়ে করে উঠতে পারলাম না। অনেক কথা আছে তোমার সাথে। ডায়েরীতে তোমার ঠিকানাটা টুকে দাও। ইয়ে মানে লিখে দাও।

আস্তে আস্তে দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিচ্ছে সোম। বন্ধুর বুকের উত্তাপ পাচ্ছি। এই ওর স্বভাব, মুহূর্তে মানুষকে আপন করে নেয়। খাবার এল।

খেতে শুরু করে বললাম, মানিকতলায় থাকি। ওখানে গেলেই যে কেউ আমার বাসা দেখিয়ে দেবে। যেও নিশ্চয়। আমারও অনেক কথা আছে।

—কথা থাকারই কথা। কলেজে পড়তাম এক সাথে। স্কুলেও এক সাথে। ছাড়াছাড়ি হলো, সেই কবে যেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তুমি। ‘না, তারও আগে। কলেজ থেকে ভাগলাম। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। তার পর সব ছন্নছাড়া, কে কোন দিক ছিটকে পড়েছি। তুমি কিন্তু জীবনে ঢের উন্নতি করেছ। ভালো লাগছে ভাবতে, তুমি একজন সাহিত্যের অধ্যাপক। খাও! খাচ্ছ না কেন?

—খাচ্ছি তো। এই তো! বললাম মৃদু হেসে। সোম চশমার কাঁচের ওপর দিয়ে তাকালো। কিছুক্ষণ আমার মুখের ওপর চেয়ে থেকে বললে, তুমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছ। বাড়িতে কোনো অশান্তি করেছ নাকি?

বললাম, নিজেকে আড়াল করে, তা একটু হচ্ছে বৈকি!

সোম বললে, সংসারটাই ঐ। ঝকমারি। খাণ্ডার বউ হলে তো কথাই নেই। প্রফেসর বোলারকে তোমার মনে পড়ে! কাঁধের কাছে বেরিয়ে থাকত ছেঁড়া ন্যাতার মতো গেঞ্জি, বউ-এর অনাদর স্পষ্ট দেখতে পেতাম।

বললাম, না, সে সব কিছু নয়। বউ খুব সতর্ক।

সোম হঠাৎ খানিক চুপ করে থেকে শুধালো, তোমার সেই রাবেয়ার খবর কি?

–আমার কাছেই আছে এখন!

-আছে মানে? চমকালো চন্দন সোম। রাবেয়ার হামিদুলের সাথে বিয়ে হয়েছিল, নয়?

—হয়েছিল।

-তবে?

–বলছি কী! এখন আমার কাছেই রয়েছে। হামিদুল ওকে তালাক দিয়েছে।

—সেকি! মুহূর্তে সোমের চেহারা আরো গম্ভীর আর স্তব্ধ হয়ে গেল। পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক হয়ে চশমার মধ্য দিয়ে নিষ্প্রাণ চেয়ে রইল দেওয়ালের নেতাজীর ক্যালেণ্ডারে।

আমিও আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ হলে পথে নামলাম দু জন। দামী সিগারেট খেতে দিল সোম। ভাজা মসলার সুরভিত পান দিল। তার পর বললে, আবার আসছি এ মাসের শেষের দিকে। ২৭-২৮ তারিখে দেখা করবো এসে। মানিকতলা, না? আজ কত তারিখ?

আঙুলের গ্রন্থি গুনে দেখলাম, আমাদের দাম্পত্যেরও আজ ৮০ দিন চলছে। বললাম, আজ ১৭ তারিখ।

সোম বললে, তার মানে আর দশ দিন।

বললাম, হ্যাঁ। মাত্র দশ দিন।

সোম বললে, আফটার টেন ডেজ আই মাস্ট কাম। সিওর। ২৭ অর ২৮। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সোম রিকশায় উঠে পড়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। রসিদ এদিকে আসছে। কাছে এলে রিকশায় পা তুলে উঠতে যাব, এমন সময় বাঁদর খেলানো ভিড়ে হামিদুলকে দেখে চমকে উঠলাম। পা নামিয়ে বললাম, থাক রসিদ। এখন যাচ্ছি না।

কিন্তু হামিদুল শহরে কেন এল! সেকি আমার বাসায় গিয়েছিল? হামিদুল আমাকে কি দেখতে পেয়েছে? ভিড়ের মধ্যে থেকে বাইরে বেরিয়ে ওদিকে কোথায় যাচ্ছে, আর এত দ্রুতই বা ছুটছে কেন? হাতে ওটা পলিথিনের ব্যাগ, জামাকাপড় আছে। নিশ্চয়ই রাবেয়াকে দেখা করতে এসেছে। কলেজের দিকেই তো যাচ্ছে মনে হচ্ছে। নাহ্, এভাবে দাঁড়িয়ে বোকার মতো চেয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। ওর নাম ধরে ডেকে উঠলেই বা ক্ষতি কি ছিল? কিন্তু এখন তো আর শুনতে পাবে না। চেঁচিয়ে ডাকলে লোকে অসভ্য ভাববে। ছাত্ররা এদিকে এতদূরে কোথাও ছিটিয়ে অফ পিরিয়ডে হাওয়া খেতেও চলে আসে। চিৎকার শুনলে হাসাহাসি করবে। দৌড়ে যাব নাকি? দৌড়লে তো চোরের পেছনে ছোটা হয়। ছুটলে পর ছাত্ররা ‘কি হয়েছে স্যর’ বলে ছুটে আসবে। রসিদও হাওয়া হয়ে গেছে। যত দ্রুত হয় পায়ে হেঁটেই ওকে ধরতে হবে। কলেজে গিয়ে নিশ্চয়ই আমার খোঁজ করবে।

ছুটলাম। কলেজের চৌমাথায় এসে হামিদুল বাঁয়ে ঘুরল। এ পথে কেন? কোথায় যাবে? ও নিশ্চয়ই আমাকে দেখেছে, নইলে এত জোরে ছুটছে কেন? সে কি আমাকে দেখা দিতে চায় না? অভিমান? লজ্জা? অপরাধবোধ? ছুটতে ছুটতে কম পথ আসা হলো না? এদিকে চিতির রাস্তা। চিতির ওপারে কোথায় যাবে হামিদুল? কেন যাবে? ফুলমতির কাছে যাবে কি? কেন? নাহ্! ভাবা যায় না। ভাবা ঠিকও না। কিন্তু ও কেন বুঝছে না, আমি ওর পিছু পিছু ছুটে আসছি!

ছুটতে ছুটতে আমি চিতির কিনারায় এসে পড়লাম। ততক্ষণে হামিদুল নৌকোয় চেপে নদীর মধ্যভাগে চলে গেছে। ডেকে উঠলাম, হামিদুল! হামিদ!

হামিদুল সাড়া দিল না। ওপারে নৌকো থেকে নেমে ফিরেও চাইল না।

হামিদুল কেন এ রকম করলে বুঝে পাইনি। ফিরে এলাম বাড়ি। আমার মনের প্রকৃত অবস্থা কারোকে বলে বোঝাতে পারব না। কেউ ঠিক বুঝবে না। হামিদুলের সাথে আমার কত যে কথা ছিল, হামিদুল শুনল না কেন? বাড়িতে ঢুকে দেখলাম, রাবেয়া ঘুমিয়ে রয়েছে আমার খাটে। বালিশের পাশে সেই ফোটোটা। ঝুঁকে পড়ে দেখি, হামিদুল নয়, এটি একটি বাচ্চার ছবি। আশ্চর্য এক বিমূঢ় বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে চেয়ে দেখলাম। হঠাৎ রাবেয়ার চোখ খুলে গেল। কিছুক্ষণ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বালিশ থেকে মাথাটা আমার কোলে তুলে দিয়ে দু হাতের আবেষ্টনীতে আমার কোমর জড়িয়ে দুই চোখ বন্ধ করে নিঃসাড় হয়ে রইল। এমনই শক্ত করে চেপে ধরেছে! মনে হলো, সে কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে না। সে এতক্ষণ আমারই মুখ মনে করে চোখ বুজে কাঠ হয়ে পড়ে ছিল।

মাথার চুলে আঙুল ডুবিয়ে রাবেয়াকে মুস্বরে ডাক দিই। রাবেয়া ‘উঁহু’ বলে পাতলা সাড়া দেয়। বুঝতে পারি, রাবেয়া উঠতে পারছে না। চিতি থেকে ফিরে এসে আমায় ভালো করে কথা বলেনি। অন্যমনা উদাসীন হয়ে কোথায় নিজের মধ্যে নির্বাসিত হয়েছে। মৃত পুত্রের স্মৃতি আঁকড়ে আছে।

ডাকলাম, উঠবে না তুমি?

-উঁহু!

-উঠবে না?

কোনো কথা নেই। চোখ খুলে মেঝেয় নিষ্পলক চেয়ে আছে। ওর মাথাটা আস্তে করে বালিশে নামিয়ে দিয়ে বললাম, ওঠো?

-উঠছি!

—তিনটে বেজে বিশ। একটু মুড়িটুড়ি দাও, খিদে পেয়েছে।

-দেব।

উঠে বসল রাবেয়া। মাথার এলোমেলো চুলগুলো টেবিলের চিরুনি টেনে আয়না ধরে পরিপাটি করে বাঁধল। তার পর খাট থেকে নেমে গেল নিঃশব্দে। খাটে ছড়ানো উলের বল সুতো কাঁটার বিশৃঙ্খলা। একটু গুছিয়ে দিলাম। কিন্তু নিজের মনটাকে এত অগোছালো করে তুলেছি, যাকে আর কিছুতেই গোছানো যায় না। ভাবছিলাম, অ্যাদ্দিনেও সোয়েটারটা কেন রাবেয়া বুনে উঠতে পারল না। ও কি বোনে আর খুলে ফেলে? রাবেয়া মুড়ি মেখে নিয়ে বাটিতে এনে রাখল। মুখ ধুয়ে তোয়ালেয় মুছে পরিষ্কার হয়েছে। বাটিটা খাটের উপর রেখে টেবিলের কাছে সরে গিয়ে একটু স্নো ঘষল মুখে।

বললে, এই তিন মাসে আমার বয়েস অনেক বেড়ে গেছে, মামুন!

আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে হাসলাম। মুড়ি মুখে দিয়ে বললাম, তুমি খাবে না?

-না। তুমি খাও।

—ফুলমতি বিকালে আসবে না?

—আজ বকুল তলার হাট। বলেই একটু থেমে রাবেয়া বলে উঠল, আমি আর দশদিন বাদেই ফিরে যাচ্ছি। দে উইল কাম। ফুলমতিকে বলতেই, না ইংরেজিতে নয়, বংলাতেই বললাম, বলতেই আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে মুখটা ওর পাংশু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললে, তুমার দুঃখে বুবুজান, বনের পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ, আসমানের তারা, নবীর কেতাব কুরানও কাঁদবে! গাছগাছালীরও শোগ চাপে বুবুমনি!

—পথের শেয়াল কুকুর কী দোষ করলে, ওরা কাঁদবে না? রাবেয়া এই কথাটা জুড়ে দিয়ে বললে, শুধালাম, কাঁদবে না, ফুলমতি? কাঁদবে নবীর কেতাব কুরান! হুঁ!

রাবেয়া হাসতে লাগল। স্বর্ণালী কিরণ সন্ধ্যার পশ্চিম থেকে এসে মুখে লেগেছিল, ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল। রাত্রি এল ঘরের দুয়ারে।

.

আমার মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। রাবেয়া মধ্যরাত অবধি কপাল টিপে দিল। কখন ঘুমিয়ে গেলাম! রাত্রে একবার ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছিলাম, রাবেয়া আমার পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে রয়েছে, ঘুমিয়ে রয়েছে।

ছয়

ছবিটা পকেটেই ছিল। স্টুডিও অজন্তায় ঢুকলাম এসে। দেখিয়ে বললাম, এটা এনলার্জ করে দিতে হবে। জানতে চাইলে কবে নেব। বললাম, কাল পেলে কালই।

এক সপ্তাহের আগে দেয়া যাবে না। আজ সোম, পরের সোমবার এনলার্জ করে বাঁধিয়ে রেখে দেব, নিয়ে যাবেন, ৩৫ টাকা লাগবে।

কলেজে এলাম। দুটি পিরিয়ড বাদে আমার কোনো ক্লাশ ছিল না। বেরিয়ে পড়লাম। পায়ে পায়ে হেঁটে এলাম প্রায় এক মাইল। মন ভালো না থাকলে যা হয়। স্কোয়ার ফিল্ড এর কাছে পথিক-গাইয়েরা আসর বসিয়েছে। দাঁড়িয়ে শুনছি, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন নাম ধরে ডেকে উঠল। পিছন ফিরে অবাক হয়ে দেখি, শরীফ সাহেব, গাজীপুরের খতিব। গতকাল হামিদুল। আজ খতিব। নিশ্চয় কোনো ব্যাপার চলেছে ভেতরে আড়ালে। হাত ধরে টেনে এনে তুললাম একটি রেস্টুরেন্টে। প্লেট ভর্তি খাবার খতিবের সামনে। বললাম, ভালো তো খতিব সাহেব?

—মাশাল্লাহ্!

—এখানে কী মনে করে, বাজার-টাজার করতে বুঝি? আজ ২ মাস ২০/২১ দিন হয়ে গেল, একবারও আমাদের খোঁজ নিতে পারতেন?

খতিব আরাম করে খেতে খেতে বললেন, এই সময়টাই গাঁ পল্লীতে বিয়েটিয়ের ঝুম লাগে, পাটফাট উঠেছে, বুঝলে না? তা ছাড়া পাচ-পাঁচটা কুলখতমের, ঐ শ্রাদ্ধ আর কি, তার খানাপিনা, বুঝলে না? তবে, তোমাকে তো আমি একটা ফরমূলা দিয়ে গেছি ভাই! সেই মতো কাজ হচ্ছে তো? শিকদার আমাকে এইজন্যেই পাঠালে।

—আপনার ফরমূলাটা কী?

-তার মানে? তুমি দেখছি আমার কোনো কথাই মনে রাখনি!

-কি বলেছিলেন আপনি?

-দেখ! তালাক হচ্ছে শত প্রকার! আর তুমি হলে ফরাজী, আহলে হাদিস! আর ইদ্দৎ হচ্ছে, জায়গা খালি করা, অপেক্ষা করা, দিন গুনে গুনে চলা। একটি পবিত্র সময়ের জন্য অপেক্ষা করা এবং সেই সময়টিকে ব্যবহার করা। রাবেয়ার ইয়ে হয়! হায়েজ, মিস্‌!

বললাম, জানি নে তো!

-কেন জান না? সে তোমার বিবি। জানা উচিত ছিল। তুমি কি চাও না, মেয়েটি হামিদুলের গেরস্থালীতে ফিরে যাক! হামিদুল তোমার দোস্ত। আল্লার দোস্ত নবীজী। তোমাকে মাসে মাসে তালাক দিতে নির্দেশ করে গেছি। তুমি ফরাজী, আহলে হাদিস! হানাফী হলে এক রাত সহবাস করতে, ছেড়ে দিতে।

-দেখুন খতিব সাহেব, আমি ফরাজী নই, হানাফীও নই। আমি মানুষ। আপনার হাদিসে আমার জন্য ভালো কোনো শালীন কিছু রয়েছে কি?

ক্ষেপে উঠলেন খতিব। বললেন, দেখ মামুন ভাই! তোমার সাথে কোনো তক্ক করতে আসিনি। জানতে এসেছি, তুমি কতদূর এগোলে। দু মাসে দুটি তালাক দিতে পেরেছ কিনা! অথবা রাবেয়ার পেটে বাচ্চা দাঁড়িয়ে গেছে কিনা! দাঁড়িয়ে গেলে, আমি আর দাঁড়াব না ভাই! তা হলে শিকদার রাবেয়াকে নেবে না। রাবেয়া তখন পার্মানেন্টলি তোমার। হামিদুল ফক্কা। তখন আর ইদ্দাতের অপচয় করে লাভ কী?…হামিদুলের পয়সায় তুমি মানুষ হয়েছ, তোমার বাচ্চাও কি মানুষ হবে? কাগের বাসায় বগের ডিম। কিন্তু তুমি নেমকহারাম নও!

আশ্চর্য হয়ে শুধালাম, এ কথা কার? আপনার নাকি শিকদারের?

খতিব বললেন, কথা হচ্ছে হাদিসের। এ কারো চৌদ্দ পুরুষের কথা নয়।

—তাই যদি হয়, এক রাত্রির পর রাবেয়াকে নিয়ে গেলেই তো হতো!

-কেন তুমি বুঝলে না মামুন! তুমি ফরাজী। হানাফী নও। হুট্ করে কারুকে তুমি ছাড়তে পার না। ইমাম শাফী রহমতুল্লা আলাহে…

-থাক। খতিব সাহেব। আপনার’ আর দাঁড়িয়ে থেকে ফায়দা নেই। আপনি আসুন। হামিদুল কোথায়?

-সে কোথায়, বাড়িতে খবর নেই। কোথায় কোথায় ঘুরছে! এর আগে .তিন মাস দশ দিন তার ইদ্দাতে গেছে। ইদ্দাৎ মানে হচ্ছে শোক করা, মনস্তাপ করা, ওয়েট করা, যাকে বলে প্রতীক্ষা, দ্যাট ইজ হার্ডার দ্যান ডেথ। তাই সে পাগলের মতো ঘুরছে। তোমার দোস্ত। আল্লার দোস্ত নবীজী!

রেগে উঠে বললাম, শিকদারের কত টাকা খেয়েছেন, আপনি? এখন আমি আপনাকে কত টাকা দেব? একটা ভালো ফতোয়া দিন। রাবেয়াকে রক্ষা করুন খতিব সাহেব!

-রক্ষা তুমিই করবে, শোন, মামুন! ইট ইজ ইওর ইনসাফ! তালাক যদি না দিয়ে থাক, আজই গিয়ে তালাক দাও। দুটি দাও এক সাথে। আমরা যেদিন নিতে আসব, সেদিন দেবে একটি। আমি পয়সার ভুখা নই। আমি আল্লার গুলাম। নবীর উম্মত্।…  

খতিবের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। চা এল। চায়ে চুমুক দিলেন তিনি। তাঁর মুখের দাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। স্বর্গীয় বিভূতি উৎসারিত হচ্ছে। নিষ্পাপ সারল্যের পেছনে সাপের মতো চেরা জিভের লকলকে ছায়া ভাসছে যেন। এদের মুখে অশ্লীল কোনো কথাই আটকায় না। মুসলিম নারীদের নিয়ে ফতোয়া দেয়ার কুটিল ব্যবসায় এদের সুখ্যাতি প্রচুর। এদের উপর সমস্ত আক্রোশ নিষ্ফল হয়ে যায়, বার বার এরা জেতে। কেন জেতে সমাজ তা জেনেও কিছুই করতে পারে না। আমাকে এই লোকটি ফাঁদে ফেলে বেঁধেছে। হামিদুলকেও খেলিয়ে নিয়ে ফিরছে। শিকদারকে নাচাচ্ছে। শিকদারও আপন মহিমায় নেচে চলেছেন। আর এদিকে আমার খেয়ালই ছিল না, আমি ফরাজী, আমি একই মুহূর্তে তিন তালাক দিতে পারি না। রসুলের হাদিসে নাকি এক সাথে তিন তালাকের সমর্থন নেই। থাকলেও কোথায় কেমন হয়ে রয়েছে, তার ফতোয়া আমার মতো মূর্খ অধ্যাপকের জানা নেই। আমি আসলে নেমকহারাম নই, এই সুবাদে আত্মহননে লিপ্ত হয়ে নিজেকে খুঁড়ছি আর মন্থন করছি ব্যথিত হৃদয়, বিপন্ন করছি নিজেকে নিজে।

পথে নেমে এসে খতিবকে একটা পান দিলাম কড়াগুণ্ডি মসলার। মুখে পুরে পিচ করে পিক্ ফেললে শরীফ সাহেব। থুতনির দাড়িতে পানের পিকের পোচ লেগে গেল। শুধালো খতিব—তা হলে, আমরা কবে আসব?

-আপনি নিজেই জানেন আপনাকে কবে আসতে হবে। আমি ফরমূলা মতো কাজ যদি নাই করতে পারি, তবে তার শুদ্ধি হবে কী ভাবে, তাই ভাবছি। আর ভাবছি, পরকালে কুলখতমের খানাপিনার হালটা কেমন হবে? সেখানে শুনেছি পুরুষ-প্রতি ৭০ জন হুরীর বরাদ্দ থাকবে। সেখানকার ইদ্দাটাই বা কোন্ ফরমূলায় পালন করা হবে! একজন জান্নাতবাসীর জন্য কী অঢেল আয়োজন, ভাবলেই তাক লাগে। পরকালে সত্তরজন হুরী আর ইহলোকে স্বামীর পদতলে লুণ্ঠিত হচ্ছে স্ত্রীর বেহেস্ত। একজন পুরুষের বিস্ময়কর সেক্স-অ্যাবিলিটি, পশুর চেয়ে বীভৎস। সত্তরজন হুরী। অপ্সরী। ভয়াবহ কামবিকার, মাফ করবেন খতিব, এত অশ্লীল কথা।

.

বলেই চলেছি আপন খেয়ালে, হঠাৎ খেয়াল হলো, গাজীপুরী মোল্লা উধাও হয়ে জনস্রোতে হারিয়ে গেছেন, তাঁর ফরমূলাটা আমার আরো নিখুঁত করে বুঝে না নিয়ে এভাবে চটিয়ে পটিয়ে তাড়িয়ে দেয়া বোধ হয় ঠিক হলো না। ফাঁদে পড়েছি, ফের আহামকী হলো!

পায়ে পায়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। এদিকটায় কখনো আসি না। পুরাতন বাজার এদিকে। সোনাপট্টির মার্কেট। ছাগল গোরুর হাট। পাশেই মেছো বাজারের মোড়। আরো খানিক গেলে সবচেয়ে পুরাতন প্রেক্ষাগৃহ উদয়ন। তার পাশে ওমেগা প্রেস। ঠিক এইখানেই একটি উলের দোকানে দাঁড়িয়ে ও কে? হামিদুলই তো! কী করছে? উল কিনছে? হাতে সেই পলিথিনের ব্যাগ। কেমন উসকো-খুসকো চেহারা। তবে কি ওরা দু জন এক সাথে এসেছে? হামিদুল উলের দোকান ছেড়ে রিকশায় চড়ল। আজ ওকে কিছুতেই হারাতে পারি না। একটি রিকশা ডেকে নিয়ে দ্রুত লাফিয়ে উঠে পড়ে বললাম, সামনের রিকশাটা দেখছ?

—কোটা?

-ঐ যে সবুজ কাপড়ের ডালা তোলা, আটশো কত যেন নম্বর।

-খলিলের গাড়ি ওটা।

-ধরো তো।

খলিল অনেক দূর এগিয়ে গেছে নিমেষে। হামিদুল নিশ্চয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কেন বুঝছে না, তাকে আমার কত প্রয়োজন। তাড়াতাড়ি চলো ভাই। টেনে চলো একটু।

রিকশা আরো তেজে হাঁকিয়ে চলল রিকশা-অলা। পাঁচ রাহার মোড়ে এসে লোকটি রেস্ট্রি অফিসের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি গলির মধ্যে ঢুকে গেল। আমাকে ঢুকতে হলো গলির মধ্যে। এ গলিটা তো নাকড়তলা আর লাটাইপুরের চৌমাথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, তার পরেই তো বালির ঘাট। যাবে কোথায় হামিদুল, ওপারে দুর্লভপুরে তার কোনো আত্মীয়-টাত্মীয় আছে কি?

নাকড়তলা, লাটাইপুরের চৌমাথায় চায়ের দোকানে হামিদুল দাঁড়িয়ে পান কিনছে। পেছন থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ডাকলাম, হামিদুল?

ঘুরে দাঁড়াল সে। কিন্তু একি! কার পেছনে এতক্ষণ ছুটে মরছি আমি? এসব কী করে বেড়াচ্ছি পাগলের মতো? এতটা বিভ্রমে পড়ার কারণ কী হতে পারে? এ যে অন্য লোক, একটুও কেন ধরতে পারি নি? পেছন থেকে দেখতে এত হুবহু মিল হয় কী করে? মনে হলো, আপন মনের ছায়াকে দেখে ভয় পেয়েছি আমি। গায়ে ঘাম দিচ্ছে। গলা শুকিয়ে গেছে। পেছন থেকে দেখতে হামিদুলের মতো কোনো একটি লোক পৃথিবীতে আছে, যে আমার মনের ছায়ার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে বাঁদর খেলার ভিড়ে, উলের দোকানে, গলিতে মোড়ে চৌমাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি তাকে কী বলতে চাই? কী কথা আছে, তার সাথে? দেখ হামিদুল, তুই কি সত্যিই আর রাবেয়াকে চাস না? শিকদার তোকে কি বলে কনভিন্স করছে? তোর নিজস্ব কোনো অভিমত নেই? যে-রাবেয়াকে পেলে আমি জীবনভর বর্তে যেতাম, তাকে তুই পেয়েছিস, কেন তবে দুঃখ তোর? তুই কি আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাস? উত্তর দে, চুপ করে থাকিস নে!

মনের ছায়াকে এই সব কথা শুনিয়ে উত্তর মেলে না। রক্তমাংসের হামিদুল হলে নিশ্চয়ই আমাকে বিশ্বাস করত! ছায়া কখনো মানুষকে বিশ্বাস করে না। আমার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না পেতে লাগল। এই যে মনের আবর্ত, ঘোর বিমূঢ়তা, বুকে পিনফোটানো আর্ত আকুল কান্না, এর কোনো সাক্ষী নেই। রাবেয়াকে কি কোনো কথা বলা যায় এখন? সে আমাকে ভুল বুঝবে না তো? বাড়িতে ঢুকতেই আমার চোখ মুখের অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে শিউরে গেল রাবেয়া। কী হয়েছে আমার? জানতে চাইল। দ্রুত হাতপাখার বাতাস দিতে লাগল। এই হালে পড়ে প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে লাগল। বার বার প্রশ্ন করে, কী হয়েছে তোমার, বলবে না? কোথায় ছিলে এতক্ষণ, কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? কেন তুমি ওদের সাথে কথা-কাটাকাটি করতে গেলে? গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি কারো সাথে কথা-কাটাকাটি করিনি!

—দরকারই বা কি! আর মাত্র ক-টা দিন। এই দিনগুলো ভালোয় ভালোয় যেতে দাও।

—আচ্ছা! খতিব এসেছিল, দুপুর বেলা!

-না তো!

-দেখো রাবেয়া, আমার কাছে কোনো কিছু গোপন করো না।

—কী বলছ তুমি মামুন! কী হয়েছে, আমাকে খুলে বলো। খতিব কেন আসবে?

—আসে নি?

-না।

–তবে?

-তবে কি?

–কিছু না! কোনো কথা জানতে চেও না।

-বেশ। জানব না। আগে একটু স্থির হও তুমি! এক-টা দিন একটু ভালো থাকো!

—ভালো থাকব কি? তোমাকে এখন আমি তালাক দিচ্ছি রাবেয়া! দুই মাসের দুই তালাক এক সাথে দিচ্ছি। তালাক। তালাক। হলো তো!

—বেশ হয়েছে। তালাক হলো। আর এক তালাক তোমার হাতে রইল। ওটাও দেবে সময় মতো।

রাবেয়ার চোখে কান্না চিক চিক করছে। ঠোঁটে হাসির প্রলেপ।

বললে, তোমার ভালোর জন্যে, তুমি আমাকে হাজার তালাক দিতে পার মামুন!

বললাম, তোমাকে আমি অত্যাচার করছি।

-করছ, ঠিকই করছ! আমি মুখ বুজে সইছি।

-রাবেয়া?

-বলো!

-তোমাকে আমি সইতে পারছি না। আই হেট ইউ।

—ঘৃণা করে সুখ পেলে, তাই করো!

এই সব কথা শুনতে শুনতে আমার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথচ কেঁদে উঠতে পারি না।

রাবেয়া বলে, আর মাত্র আট নয় দিন তোমার সংসারে থাকব। কখনো অসম্মান করনি। এখন বিরক্ত হলে, দোষ দেব না। জানি, আমার জন্যে পথেঘাটে অনেক নির্যাতন সইতে হচ্ছে। সামান্য বুদ্ধির মানুষও এ কথা ধরতে পারে।

রাবেয়া দ্রুত ছুটে গিয়ে চা করে আনল। একটু চা খাও। চা ছাড়া আর কী দেব তোমাকে? শান্ত হয়ে একটু শুয়ে থাক। শুয়ে পড়?

চা খেয়ে সটান শুয়ে গেলাম। চোখের প্রান্তে গাল বেয়ে কান্না নামতে লাগল। রাবেয়াকে আমি তালাক দিলাম। দুই তালাক দিলাম। ভেতরের দুর্দমনীয় অস্থিরতা ঐ দুটি শব্দের উচ্চারণে থুৎকারের মতো বাইরে ছিটকে এল। কিন্তু কোনো যন্ত্রণা প্রশমিত হলো না।

রাত্রে খেতে বসে মাথাটা খানিক জুড়িয়ে এসেছিল। বললাম, আমি তোমাকে দুই তালাক দিয়েছি। মাইণ্ড দ্যাট।

চোখ নামিয়ে পিঁড়িতে বসে থাকা রাবেয়া মেঝেয় নখ ঘষতে লাগল। সত্যিকার তালাকের প্রতিক্রিয়া কি এই রকম নিঃসহায়? এই রকমই প্রতিবাদহীন, বধির?

-রাবেয়া?

-বল?

—তুমি কিছু বলবে না?

—কি বলব বল? তোমার কষ্ট দেখে, আমি কি বলব, বুঝতে পারছি না, মামুন! মাথা তুলল না রাবেয়া। আমি থালাতে জল ঢেলে হাত-মুখ ধুয়ে আমার নিজের খাটে চলে এলাম। আমাকে ভুল বুঝলেও, আমার কোনো উপায় ছিল না। রাবেয়া অনেকক্ষণ আমার কাছে এল না। যখন এল, দেখলাম, চোখ দুটো ফোলা, অসুস্থ হয়ে উঠেছে।

মেঝেয় সপ বিছিয়ে বসল রাবেয়া। হাতে প্রায় বুনে শেষ হয়ে আসা সোয়েটার, বল-কাঁটা, পাশে ছোট চামড়ার ব্যাগ। বুনতে শুরু করল। চেয়ে দেখতে দেখতে কেমন মায়ায় আপ্লুত হচ্ছিল মনের তাবৎ পটভূমি। তালাক দিলাম। যে তালাককে এতটুকু সহ্য এবং বিশ্বাস করতে পারি না। আমাকে সেই অশুদ্ধ শব্দের নাম মুখে বলে একটা পাষাণ ভার নামাতে চাইলাম কেন? কেন মনে হলো, রাবেয়াকে আমায় এইভাবেই ত্যাগ করতে হবে? রাত বাড়তে লাগল। রাবেয়া কোনো কথা না বলে বুনে যাচ্ছে আপন মনে নির্বিকার। বাইরে প্রস্ফুটিত দুধেল জ্যোৎস্না। শূন্য আকাশে গেঁথে আছে শরতের চাঁদ।

বললাম, আমি হামিদুলের পয়সায় মানুষ হয়েছি, এই কৃতজ্ঞতায় মনটা আজ ভরে গেছে, রাবেয়া!

রাবেয়া অবাক হয়ে মুখ তুলল একবার। একটুখানি হাত থেমে গিয়ে আবার চলতে লাগল। কোনো সাড়া দিল না।

বললাম, সারাটা দিন আজ কি যে হলো, পাগল হয়ে গেলাম। একলা একলা কোথায় যে ছুটে ছুটে গেলাম!

কেন এমন হচ্ছে, মামুন! কিসের যেন কষ্ট পাচ্ছ! আমাকে খুলে বল, আরাম পাবে। আমি সব সইতে পারব।

—সওয়া না সওয়ার কথা নয়। আমি যা বিশ্বাস করি না আমাকে তা করতে হচ্ছে কেন?

—ভালোবাস বলে! কারো কোনো খাতিরে কিছু করনি তো! করেছ? ভালোবেসে মানুষ তো এ রকমই দুঃখ পায়। তুমি হামিদুলকে ঘৃণা করলেও পারতে!

—আমার এখন ঘৃণা করতেই ইচ্ছে হচ্ছে। সে আমার সাথে একবার দেখা করতে কি পারে না?

—বুঝেছি, হামিদুলের জন্যে মন খারাপ। সে তো এল বলে। –তোমার মন খারাপ হয় না? শুধালাম আমি।

—এখন আমার কি হয়, কি হয় না, কিছুই বুঝতে পারি না। কেবল বুঝি, একটা পাঁকে পড়ে তলিয়ে যাচ্ছি, তুমি আমাকে টেনে টেনে তুলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আর আজ স্মরণ করিয়ে দিলে, আমাকে ফিরতে হবে, তুমি আর পাঁক ঘাঁটতে পারছ না। তালাক শব্দটার প্রকৃত মানে যে কী মর্মান্তিক হামিদুল যখন তালাক দেয় বুঝতে পারি নি, আজ বুঝলাম। এবং আশ্চর্য হলাম, তুমি আমাকে সত্যি সত্যিই অন্তর থেকে তালাক দিয়েছ! আমি যে তোমার হই নি, কখনো হব না, কথাটা এত সত্য, জানা ছিল না। আমি হামিদুলের। হামিদুলের কাছেই ফিরে যাব। কিন্তু যদি না ফিরতে চাই, তুমি কি করবে?

বললাম, এখনো একটি তালাক বাকি আছে, সেটা দেব।

কথাটা বলতে গিয়ে এমনভাবে কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল! রাবেয়া বল-কাঁটা ফেলে দিয়ে খাটে উঠে এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে হঠাৎ বুকের উপর মাথা রেখে আমার বুকের প্রত্যেকটি স্পন্দন শুনতে লাগল। বাইরে নিমগাছ বাতাসে দুলছিল। তার চিরল ফাঁকে চাঁদের ঝিলিমিলি। আরো রাতে পাশের ঘরে, রাবেয়ার ঘরে, রাবেয়ার আর্তচিৎকার শোনা গেল। ধসমসিয়ে উঠে ছুটে এলাম। দরজা বন্ধ। খিল তোলা ছিল না। আলো জ্বেলে দিলাম সুইচ অন করে দিয়ে। রাবেয়া বসে আছে বিছানায়। ফুলে ফুলে কাঁদছে। চোখে আতঙ্ক।

–কি হয়েছে রাবেয়া?

—বাইরে কেউ এসেছিল, মামুন। জানলায় টোকা দিচ্ছিল।

–কে, এসেছিল?

—জানি না।

বুঝলাম, রাবেয়া স্বপ্নে ভয় পেয়েছে। এক গেলাস জল গড়িয়ে দিলাম কলসী থেকে। ঢকঢক করে জল খেল। সমস্ত শরীরে যাতনার স্পষ্ট লক্ষণ। কে যেন তার শরীরের উপর অত্যাচার করে গেছে।

সাত

পরের দিন কলেজে এসে মনে হলো, বাড়ি ফিরে যাই। ভাবছি, এমন সময় পিয়নটা এসে খবর দিলে, একজন মহিলা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে চায়। প্রফেসর রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, রাবেয়া দাঁড়িয়ে।

—চলে এসেছি। থাকতে পারলাম না।

—বেশ করেছ। চলো। ওহো, দাঁড়াও; প্রিন্সিপালকে বলে আসি একটু।

-কী বলবে?

-কী বলব? বলব, আমার মিসেস এসেছেন। ওঁকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। গেটের বাইরে এসে রিকশা ডেকে দু জনে উঠে বসলাম।

রাবেয়া বললে, একলা খুব ভয় করতে লাগল।

—স্বাভাবিক।

–দিব্যি কেমন চমকে দিয়েছি!

—একটু আগেই ভাবছিলাম, বাড়ি ফিরে যাই। জানো, অনেক ভেবে দেখলাম, এ ক-টা দিন, তোমার কথাই ঠিক, আমাদের ভালো থাকতে হবে।

-এ কয়দিন ছুটি নাও!

—তবে এক সপ্তাহ ছুটিই নেব।

-কোথায় যাবে এখন?

-যেদিকে দু চোখ যায়।

-আমাকে নিয়ে পালাতে পার না?

-কোথায়?

-যেদিকে দু চোখ যায়!

দু জনেই হেসে উঠলাম। শুধালাম, কী খাবে বল?

—খাওয়া-দাওয়া এখন থাক্। চলো, কোথাও ফাঁকে মাঠে বসব। কলেজের ছেলে-মেয়েদের মতো। বকবকম করব। অজস্র অর্থহীন কথা হবে আমাদের।

—ঠিক বলেছ! আমরা কিছু না পারি প্রেম করতে তো পারি! এই রিকশা দাঁড়াও।

রিকশা থেমে গেল। নেমেই বললাম, ব্রিজের ওপারে ফাঁকা রাস্তা। খানিক গেলে কানা একটা স্টেশন। লোকজন থাকে না।

রাবেয়া বললে, মুন্নার ছবিটা কোথায়, পাচ্ছি না। তুমি নিয়েছ?

—নিয়েছি।

-কী করবে?

-দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব। এনলার্জ হচ্ছে।

কিছুক্ষণ আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকল রাবেয়া। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজ পার হলাম।

—ওটা কী পাখি মামুন? এ সব প্রেমে দু-একটা উড়ন্ত পাখি লাগে, জানো?

বললাম, খানিকটা নীল আকাশ আর হালকা মেঘ লাগে। ফুল লাগে কিছু।

-ফেরার পথে কিনে নেব।

চারি দিকে গাছপালা। ঘনছায়া। পাখি। নির্জনতা। বসলাম। এ দিকে বাস চলে খুব কম। লরি চলে। এ দিগন্ত প্রেমের। এ অবসর ভালোবাসার। সমস্ত দুঃখকে ভুলে পেছনে ফেলে আসার। রাবেয়া আচম্বিতে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ফেললে। তার পর কিছুক্ষণ ঘাড়ে মাথা রেখে নিঃসাড় পড়ে থাকল। তার পর একটি ইনল্যান্ড খোলা খাম সামনে মেলে ধরল।

প্রিয় মামুন,

সাতাশ তারিখ আসছি। তুমি যদি রাবেয়াকে আমার হাতে তুলে দাও, নতজানু হয়ে গ্রহণ করব। না দিলে ফিরে আসব। আমার সাথে কেউ যাবে না। তুমি ভালো থেক। আমি এ চিঠি জেলার বাইরে থেকে লিখছি। এতদূরে এসে মনে পড়ছে, আমরা দু জনই একদিন রাবেয়াকে ভালোবেসেছিলাম। আজও তেমনিই ভালোবাসি। ইতি তোমার হতভাগ্য বন্ধু-

হামিদুল।

.

রাবেয়া বললে, চলো উঠি।

বললাম, চলো!

কিন্তু এখান থেকে উঠে কোথায় যাব? কেনই বা উঠে যাব? রাবেয়া কেন উঠে যেতে চায়? হঠাৎ তার কি এমন হলো, যাতে সে উঠে যেতে চাইছে? হামিদুলের চিঠিটা পিয়ন দিয়েছে যখন, তার পরই রাবেয়া আমার কলেজে চলে এসেছে, বাড়িতে টিকতে পারেনি। তার ভয় করেছে। আমাকে দেখতে ইচ্ছে করেছে। আমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে চেয়েছে। এই একটি ক্ষুদ্র চিঠির ক্ষমতা অনেক। শমনের মতো পাওয়ারফুল। কিংবা এ হঠাৎ নতুন হয়ে ওঠা ভালোবাসার মতো শৌখিন। স্বাদু এবং বর্ণময়। এ যেন পুরাতন রাস্তার অস্পষ্ট আলো-অন্ধকারে ডেকে ওঠা চির-চেনা বন্ধুত্ব। সমস্ত হৃদয়াবেগকে এ চিঠি মুহূর্তে স্তব্ধ অনড় লীলায়িত তরঙ্গের মতো চিত্রার্পিত করে দেয়। সমস্ত স্পর্ধাকে রুখে দিয়ে বলে, আমি আসছি। আমি এসে গেছি।

অথচ কী আশ্চর্য! আমাদের অতৃপ্ত, ভয়ে-ঠাসা, নম্র-শঙ্কিত, অশ্রুজলে মাখামাখি যেন বা সামান্য দৈব অর্পিত ভালোবাসার পায়ে নতজানু হয়ে আছে। ভিখারীর মতো এ চিঠি করুণায় উজ্জ্বল, বিরহ-নিষিক্ত একটি ক্ষুধার্ত ভালোবাসার অশ্রুপাত। এর ক্ষমতা অনেক। অথবা এ তুচ্ছ। ঘাস ফুল। এ কিছু নয়। কোনো কিছুই নয়। ‘চলো!” বলে উঠতে গিয়ে বাধা পাই। রাবেয়া আবার তার বুকের উষ্ণ আবেগে টান দেয়, আলিঙ্গনে তপ্ত প্রখর হতে চায়। বাধা দিয়ে বলি, না! লক্ষ্মী মেয়ে! না!

রাবেয়া আরক্ত ঠোঁটে ঘন নিশ্বাসে অবাধ্যের মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আমি এক রকম জোর করে টেনে তুলি ওকে। টেনে নিয়ে পার হই ব্রিজ। ও যেন এলোমেলো আহ্লাদে আমার পাশে হেঁটে চলতে চলতে কেমন ঢলে গলে পড়তে চায়। এভাবে হাঁটা ঠিক হচ্ছে না, বুঝতে পারি। তাই রিকশা পেতেই উঠে পড়ি রিকশায়। এসে নামি ফুলের দোকানে। ফুল কিনি। রাবেয়াকে তার ইচ্ছে মতো ফুল কিনবার অধিকারে সুখী করি। একটি রঙিন কাগজের প্যাকেটে নানারকম সুগন্ধি গোলাপ কেনা হয়। সাদা কিছু ফুলও কিনে ফেলে রাবেয়া।

বলি, এত ফুল কি হবে? সবই তো শুকিয়ে যাবে।

-তা যাক। তা বলে কিনব না?

-কেনো। কেনো। যত খুশি কেনো।

—একটু আতর আর গুলাবপানি কিনতে হবে।

-কেন?

-আতর তোমার ভালো লাগে না?

—লাগে।

—গুলাবপানির শরবত?

— লাগে।

আর কি লাগবে যেন? এই যা, ধূপবাতি?

আতরের দোকানে আতর। ধূপবাতির দোকানে ধূপবাতি।

সব কেনা হয়। সুমা কেনে এক শিশি। তার পর রাবেয়া বলে, আর কি বাকি রইল?

আরো কি সব টুকিটাকি কেনে সে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কেনাকাটার বহর দেখে যাই। পথে নেমে রাবেয়া বলে, এইটুকু হেঁটে যাব।

আমি বলি, এইটুকু কোথায়? ঢের পথ। যেতে যেতে সূর্য ঢলে যাবে।

-তা যাক! তবু হাঁটব।

রাবেয়া ক্রমশ উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। আজ এই মুহূর্তে তাকে ছেলেমানুষী খেয়ালে চালিত রূপসীদের মতো অবাক লাগে। সে যেন আমাকে নিয়ে দূরন্ত আবেগে কোথায় পালিয়ে হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চায়। জীবনের দুই মুখে মোমবাতি যেভাবে পোড়ে, এ যেন তাই। নিজেকে জ্বালিয়ে দেয়ার নেশার মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে নিজের পরিধি। কোথাও পালানো যায় না, অথচ পালানোর মতো একটা মজা করে যাওয়া। কিচ্ছু না। স্রেফ একটা অলৌকিক তৃষ্ণা নিয়ে আপন অস্তিত্বকে বুঝতে চেষ্টা করা। এই বিপন্ন বিপর্যস্ত জীবনের দিকে যারা এবং যে ঘটনা, যে-সব অনিয়ম ঠেলে দিয়েছে আমাদের দু জনকে, তার প্রতি একটি ব্যাখ্যার অতীত আক্রোশ দানা বেঁধে উঠেছে। যেন দু জনের দুখানি হাত পেছনে মুড়ে মুচড়ে বেঁধে দুই চোখে পট্টি বেঁধে একটি জটিল বাঁকা পথের দুই বিপরীত প্রান্তে ছেড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, দুজন দুজনকে খুঁজে নাও, স্পর্শ কর। এই খেলার নাম ইদ্দাৎ কিংবা তালাক-শাসিত দাম্পত্য। গর্হিত লুকোচুরি খানিক, খানিকটা আত্মপীড়নের সুখ দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে এই নাটক, এখন কেবল শূন্যে দু হাত প্রসারিত করে ভুল লক্ষে স্পর্শ খুঁজে ফেরা। তাই এখন নিজেকে ক্রুদ্ধ করে তুলছে রাবেয়া। এ এক আশ্চর্য বেপরোয়া ক্রোধ নিজেরই মধ্যে দংশন করছে। নিজেকে রক্তাক্ত করে তুলতে এত বড় নিষ্ঠা কেউ কখনো ভাবতে পারে না।

বুকে ধরে রাখা একটি হালকা প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে রাবেয়া বললে, নাও। ফুলের প্যাকেটটা তুমি নাও। হাতটা প্রসারিত করতেই চেয়ে দেখলাম এই প্রথম হাতের তালুতে মেহেদির নকশা। এতক্ষণ লক্ষ হয়নি কেন ভেবে আশ্চর্য হলাম। মেহেদির রঙে ছোপানো হাত পাতলা সুরভিতে কামার্ত দেখায়। জানতে চেয়ে বলি, আজ তোমার সবই কেন যেন ইয়ে মনে হচ্ছে। কী ব্যাপার গো? কী উৎসব আজ? হাতে মেহেদি লাগিয়েছ কখন?

—তুমি কলেজে চলে আসার পর, ফুলমতির এনে দেয়া রঙের নির্যাস, সাধ হলো! বেটে লাগিয়ে দিলাম। মনে পড়ে?

-কী?

–সেই যে সেবার তুমি হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করলে, রেজাল্টের দিন তোমার পড়ার ঘরে দেখা করতে এলাম, ভাবীর নতুন বেনারসী পরে, হাতে মেহেদি। অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, হবে।

—হবে কি গো! দিব্যি সেই সব মনে পড়ছে আমার!

-কী সব?

—সেই যে তুমি হাতখানা হাতের মুঠোয় তুলে নিলে।

—তার পর?

—তালুতে মুখ নামিয়ে নিশ্বাসে গন্ধ টানলে। বললে, কী মিষ্টি।… মেহেদির গন্ধ সত্যি তোমার ভালো, লাগে?

-কী জানি!

—এই! তুমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছ?

—মেহেদি বোধ হয় কোনো কিছুর প্রতীক।

–কিসের?

—জানি নে ঠিক। সানাইয়ের সুর আর মেহেদির ঘ্রাণ, কোথায় একটা মিল আছে।

—তুমি মস্ত কবি। হয়তো খানিক পাগলও বটে। এ-সবের কোনো মানে আছে?

—তুমি একটা মানে চাইছ বলে মনে হচ্ছে।

–তাই?

-হুঁ! মেহেদি-রাঙানো হাতের স্বপ্ন কোন পুরুষ না দেখে যৌবনের দিনে!

-সে স্বপ্ন তোমার পূর্ণ হলো না।

-বলতে পার চিরদিনের মতো ভেঙে গেল

-কেন? চিরদিন কেন?

-আসলে এ ব্যাপারে আমার আর কোনো স্বপ্ন দেখাই চলে না।

—দুঃখ করো না মামুন! আজ অন্তত সুখী হও।

—তাই হোক।

ফুলের প্যাকেট থেকে ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগে। আমি চুপ করি। বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাদদেশে চৌমাথায় একটি রিকশা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে এসে রিকশায় উঠে পড়ে বললাম, কালীবাড়ির পার্কে গিয়ে বসব দু-দণ্ড। চলো। রাবেয়া কিছুটা ইতস্তত করে উঠল রিকশায়। পাশে বসে কোলের উপর প্যাকেট-ফ্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখলে। কপালের পাশে চোখের উপর চূর্ণ চুলের এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা উদাসীনতা। কপালে রক্তাক্ত টিপ। হাতে মেহেদি, পায়ে গাঢ় রঙের আলতার ছোপ। বাসন্তী রঙের শাড়ি। সবই কেমন এক পরিপাটি ব্যাপার।

.

রাবেয়া সেজেগুজে কলেজে চলে এল। এভাবে কলেজে আসা তার কথা নয়। কোথায় এক অস্বাভাবিক দৌরাত্ম্যের ইচ্ছে ঝলকে উঠছে তার রূপে, মুখের উপর ভাসছে খুশি খুশি কুচি ঢেউ।

হঠাৎ রিকশা থেকে নামার সময় ঝনাৎ করে একটা শব্দ হলো। পার্কে বেঞ্চে বসার সময় আর একবার। রাবেয়ার আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা। সবই অদ্ভুত। সবই গেরস্তালীর চমক। ঠাটবাটের নিখুঁত পালিশ লাগানো। ঘরণী যেন তার ঘরকে সঙ্গে এনেছে, যেখানে যাবে ঘর তার সঙ্গে যাবে।

বললাম, এতগুলো চাবি নিয়ে ঘুরছ! কোথাও যদি পড়ে যায়?

—পড়লেই হলো আর কি! সব সময় শব্দ পাই। সর সময় মনে হয়, আমার ঘর আছে। স্বামী আছে। আমি ঘরণী। আমি গৃহিণী। আমার অনেক ব্যস্ততা, অনেক কাজ।

—বাঃ। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গোরু, এরকম একটা সংসারেই তো ছিলে তুমি, কিছুদিনের জন্য সে সংসার তোমার হারিয়ে গেছে। সেই সোনার সংসারকে আবার ফিরে পেতে ইদ্দাতের কঠিন তপস্যা করছ তুমি। তোমার তপস্যা নিষ্ফল হতে পারে?

—তাই কি হয় নাকি? কখনো না। আমার সংসার আমারই। আমার সিংহাসন খালি পড়ে আছে।

কেবল দু দিনের জন্য অন্যের সংসারকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখালে, দেখ, সংসার কত সুখের, এই তার সৌন্দর্য! লোভ জাগিয়ে তুলে পালাবে এবার।

—যদি না যাই! যদি থেকে যাই! এই চাবিগাছা যদি চিরকাল আঁচলে বাঁধি! তুমি তাড়িয়ে দেবে না তো মামুন? চুপ করে থেকো না। উত্তর দাও।

বললাম, তুমি কেবল সাজাতে এসেছ। থাকতে আস নি। এ সংসার তোমার নয়। আমারও নয়। এ কোনো গার্হস্থ্যই নয়। এটা তার গল্প মাত্র। এ গল্প তুমি আমাকে, আমি তোমাকে শোনাচ্ছি। গল্পের সংসার দেখে বাস্তবের সংসারকেও অনেক সময় চেনা যায়।

-যায় নাকি? এ সংসার দেখে, তুমি বলতে পারো, হামিদুলের সংসার কেমন ছিল, ভবিষ্যতে কেমন হবে?

—পারি না। বললাম একটু চুপ করে থেকে—সে সংসার তোমাদের, তোমরা যেমন করে সাজিয়ে তুলবে, তেমনিই হবে। আমি বলব সুখে থেকো। জীবনকে অপমান করো না!

-আশীর্বাদ করছ?

—কামনা করছি।

-কেন?

—তাই উচিত।

-কেবল উচিত বলে? আর কিছু নয়?

–আর কি?

-আর কিছু নয়? স্রেফ উচিতের পেছনে ছুটছ তুমি?

-তোমার পেছনেও ছুটছি। আমিও শব্দ শুনি। ভালো লাগে। চাবির শব্দ। ‘মেহেদির রঙ!

—তুমি বোকা! বোকা! বোকা! স্রেফ বোকা! বলতে বলতে রাবেয়া আমার কোলের পাশে থেকে কাত হয়ে মুখ গুঁজে মৃদুস্বরে ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর পিঠে হাত রেখে ডাকলাম, রাবেয়া! কেঁদো না! কেঁদে কোনো লাভ নেই।

-তুমিই তো বার বার আমাকে কাঁদাচ্ছ। রাবেয়া একটু ফুঁসে উঠে মুখ তোলে। তার পর আবার মুখ গুঁজে দেয়।

এইভাবে বসে থাকতে থাকতে কান্না স্তিমিত হয়। হঠাৎ কেমন এক লোভ জাগে। বুঝতে পারছি, রাবেয়া গাজীপুর যেতে চায় না। আমি ওকে ত্যাগ করতে নাও পারি। ও চায় আমি ওকে ছিনিয়ে নিই। হামিদুল একদিন সুযোগ বুঝে ছিনিয়ে নিয়েছিল। আজ আর এক সুযোগে আমি স্ন্যাচ করলাম। সে দখল করেছিল, আমি তাকে উচ্ছেদ করলাম। অন্যায় কোথায়? হামিদুল আসবে। শূন্য টাঙ্গা ফিরে যাবে।

রাবেয়া বলবে, আমি হামুর ভাত খাব না মামুন! আমি তোমার ভাত খাব! ঘটনা কি অস্বাভাবিক হবে? হামিদুলের চোখের কোনা কি চিকচিক করে উঠবে? বুকে ব্যথায় টান ধরবে?

আমি বলব, রাবেয়া তো আমারও। তুই বলেছিস! আমি তাকে নিলাম! হামিদুল বলবে, তুই যে বলেছিস মামুন! যে দুঃখ সইবার জো এবং যোগ্যতা আমার নেই, নিজের দোষে আমি সেই দুঃখকে বরাবর বহে এনেছি। আমি এ দুঃখ সইতে পারি, তুই বল?

—কী ভাবছ গো! রাবেয়া সহসা উঠে বসে প্রশ্ন করে

আমি চমকে উঠে রাবেয়ার মুখের দিকে চেয়ে দেখি। কান্নার পাতলা করুণ ছায়ায় সন্ধ্যা নেমেছে ওর চোখে। এতক্ষণের সব সংঘাত থেকে আর একটি নতুনতর সংঘাতের আবেগে সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।

বললাম, না। কিছু না। চলো ওঠা যাক।

—তাই বেশ। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে!

–এই সাঁঝবেলায়?

—খুব ক্লান্ত লাগছে মামুন!

আমরা উঠে পড়ে রিকশা ধরলাম। আকাশে চাঁদ উঠল। পুবদিগন্তে একখণ্ড মেঘ উঁকি দিচ্ছে। আশ্বিন ফুরিয়ে আসছে। কেমন একটা ক্ষ্যাপা হাওয়া নামছে আকাশ থেকে। ঝড় উঠবে বোধ হয়। আঁধির বাদলার পূর্বাভাস পাচ্ছি। একটি ঘনঘোর বাদলার রাতে রাবেয়া এসেছিল। রাবেয়া চলে যাবে। এক সপ্তাহ বাদে আমি একলা থাকব আমার এই শহুরে বাসবাড়িতে। তার আগে আঁধির প্রলয়ে ছেয়ে যাবে প্রকৃতি আর মানুষ। আচ্ছন্ন এই জগতের বুকে আমি আঁধির আকাশে শুনতে পাব আমারই বুকের তীক্ষ্ণ তীব্র বোবা আর্তনাদ। ঘুরে ঘুরে ঘূর্ণীর উল্লাসে এক নিরাকুল আবর্তে তোলপাড় করবে দিশাহীন একটি প্রেম। যে প্রেমের বৈধতা অবৈধতার কোনো সীমারেখা আমি নিরূপণ করতে পারিনি।

.

সন্ধ্যার পর। মেঘ ডেকে উঠল। মাতাল হাওয়া লেগে দরজার শেকল নাড়া খেল। ঘর অন্ধকার করে বিদ্যুৎ চলে গেল। মোমালোকে সাজিয়ে তোলা হলো রাত্রির আঁধিবেষ্টিত গৃহখানি। প্রকৃতি রোষে ফুলে ফেঁপে আছাড় খাচ্ছে নিয়ত। কী সব ভাঙছে। টানা বিহ্বল গোঙানিতে উচ্চকিত করছে তাবৎ বিশ্ব। রাবেয়ার চোখে সুমা। পরনে রূপ ঠিকরে তোলা পোশাক। খাওয়া দাওয়া হোটেলে সাঙ্গ করে এসেছি। রাবেয়ার হাতে পান। রাবেয়া এগিয়ে এল। বিছানায় ছড়ানো ফুলের ছড়াছড়ি। আতর সুরভিত বালিশ চাদর। ধূপবাতির সুগন্ধি ফোয়ারা। টেবিলে গুলাবপানির শরবৎ আর দুধ। এ-সব কিসের প্রস্তুতি?

রাবেয়া বললে হাসতে হাসতে, আজ আমাদের ফুলশয্যার রাত। রেডিওতে আজ এক ঘণ্টার রবীন্দ্রসংগীতের আসর। যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে।

রাবেয়ার চোখে ভয়ংকর সর্বনাশ তমসার পেছনে সলতের মতো পুড়ছে। দুলছে। ধিক্‌ধিক্ করছে তার ক্রুর নিস্তব্ধতা। চোখের পেছনে নড়াচড়া করছে কেঁপে কেঁপে ওঠা কিসের দুর্বোধ্য আকৃতি! এই আগুন কামনার জিভ বার করে চেয়ে আছে।

রাবেয়া আরো এগিয়ে এল। বিছানায় বসে ছিলাম আমি। ভয় পেয়ে বালিশে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে মুখ গুঁজলাম। রাবেয়া বিছানায় বসল চেপে। গায়ে হাত রেখে বললে, নাও। পান খাও।

—আমি পান খাই না।

-ভালো পান। খাবে না কেন?

—পান খেয়ে কী হবে?

–খাও। তার পর বলছি। ইস্! এত দেরি করে?

তাড়াতাড়ি পান নিয়ে মুখে পুরলাম। রাবেয়া বললে, বাসর রাতে বউ যা বলে, শুনতে হয়।

-আজ বাসর রাত হতে যাবে কেন? এসব কী খেয়াল হয়েছে তোমার?

—ইদ্দাতে একটি সার্থক সুন্দর বাসর রাত্রি প্রয়োজন। দুটি তালাক দিতে এবং একটি তালাক হাতে রাখতে যার ভুল হয় না, তার বাসর রাতের কথা ভুল হয় কেন?

—তুমি, রাবেয়া হাসালে দেখছি! ঐ সব তালাক-টালাক বিশ্বাস কর তুমি?

-করি।

-কর?

-নিশ্চয় করি। নইলে এই তিন মাস কি বেশ্যার মতো ‘জিনাত করব বলে বসে আছি? আছি যখন, আছি কোন্ সাহসে? তুমিও বিশ্বাস কর বৈকি! লোকদেখানো বিশ্বাস করতেই হয়। ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি করো না মামুন, আমি তোমার হাদিস কুরানের বউ।

—আমায় মাফ কর রাবেয়া! তুমি আমার, কেউ না। কিচ্ছু না।

—তাই বুঝি! রাবেয়া আমার মুখের উপর ঝুঁকে আসে। চোখে চোখ রেখে কঠিন করে চেয়ে থাকে। বলে, আর মাত্র সাত দিন। চলে যাব। চলে যাব, বিশ্বাস হয়? কষ্ট হয় না?

বললাম, সে কথা কি মুখ ফুটে বলতে হবে?

—আমার একটা স্বপ্ন ছিল যে মামুন? অ্যাদ্দিন তোমার ঘর করলাম। কতরকম স্বপ্ন দেখলাম। চলে যাব। কখনো আর আসব না। এই মুখপুড়ি কখনো আর জ্বালাতন করবে না! শুধু একটি স্বপ্নকে বুকে করে ফিরে যাব। বলব, এ কোনো বাস্তব বিষয় নয়। স্রেফ একটি স্বপ্নের ঘটনা। দাও আমাকে।

-কী চাও তুমি?

—একটা কোনো চিহ্ন।

-অভিজ্ঞান?

—হ্যাঁ, অভিজ্ঞান! স্বপ্ন দিয়ে মোড়া। স্মৃতিচিহ্ন। রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে যেমন দিয়েছিল।

-তেমন কিছু তো নেই আমার। কী দেব তোমাকে? তা ছাড়া অভিজ্ঞান কী হবে? শকুন্তলার দরকার ছিল। পুনর্মিলনের জন্য জরুরি ছিল। চির-বিচ্ছেদের জন্য কোনো চিহ্ন তো দরকার করে না।

রাবেয়া বললে, বিচ্ছেদ কে চায় বল? আমি দূরে চলে যাব, কিন্তু আমৃত্যু তোমার অভিজ্ঞান বুকে করে রাখব। সেই আমার চির-মিলনের সাধ। দাও না? কোল আলো করে থাকরে।

-কোল আলো করে থাকবে? আমি চমকে উঠি।

—হ্যাঁ গো। কোল আলো করে, যেমন করে মুন্না একদিন ছিল। তেমনি একটা বাচ্চা দাও আমাকে। তোমার আমার রক্তমাংসে গড়া স্মৃতির পুত্তলি। ড্রিম-চাইল্ড। খোয়াবের পোলাপানে কার না লোভ! বিনোদপুরের মেলার মতো অজস্র নয়। একটি মাত্র কণা! জীবন্ত প্রাণবন্ত অভিজ্ঞান! তুমি দুষ্মন্তর মতোই রাজা। আমি হতভাগিনী ঋষি-কন্যা। তুমি প্রফেসর! আমি অর্ধশিক্ষিত মুসলমান নারী! তবু এরা অসম্ভব স্বপ্নে একদিন মিলিত হয়েছিল। তার প্রমাণ দাও। কোনো পাপ হবে না মামুন! মাতৃত্বের কামনাকে তুমি আঘাত করো না। এই?

আমি চোখ টেনে নিই—। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অস্ফুটে বলি, না!

-কেন নয়, প্রফেসর? মুন্না বার বার স্বপ্নে আসে। হাত ধরে টানে। কোথায় টানে, কেন টানে, তুমিই বল?

– আপন সংসারে হামিদুলের কাছে ফিরে যাবার জন্যে টানে।

—কোলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

—সুখের সংসার চায় স্বপ্নের শিশু।

-অ্যালবামে তোমার ছবির পাশে মুন্নার ছবি আটকে রেখেছে হামিদুল। রোজ খোকাকে বলত, প্রফেসরের মতো বিদ্বান হ বাবা?

—আপন সন্তান বড় হোক কে না চায়?

-তুমি চাও না?

রেগে উঠে বলি, এ-সব কি বলছ তুমি রাবেয়া? তুমি পাগল হয়ে গেছ! রাবেয়া বলে, তবে কি তুমি পাপের ভয় করছ?

-তাই যদি মনে কর, তবে তাই!

—ভণ্ড তুমি! পাপ-পুণ্যে পরলোকে বেহেস্ত দোজাখে এই বললে বিশ্বাস কর না।

—এখন করি। এই মুহূর্তে করি।

—তবে তাই হোক। পাপ ভয়। পুণ্যের কামনা।

-হ্যাঁ তাই!

—ইদ্দাৎ?

—হ্যাঁ। ঠিক তাই। পাগলের মতো বলে ফেলি। বোকার মতো।

–তবে সে পাপ পুণ্য ধর্মের বচন। সেই ধর্মমতেই আমি তোমার সহধর্মিনী। আমি স্বপ্নের শিশুকে ভালোবাসি। তুমি সেই মাতৃত্বকে অপমান করতে পার না। লক্ষ্মী সোনা, আগে ভালো করে বোঝ ব্যাপারটা। আমি সোজা হামিদুলের কাছে ফিরে যাব। আরো তিন মাস দশ দিনের ইদ্দাৎ দরকার করবে না। এই তিন মাসেই সব কিছু লালন-পালন হয়ে যাচ্ছে। শরীফ সাহেব এই বলে আশ্বাস দিয়েছে। এবার ভাবো! কেউ জানবে না মামুন! কেউ না। আমি কখনও ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দেব না, স্বপ্নের শিশু কোথায় পেয়েছি।

-না। এ হয় না।

-দেবে না?

না গো না। এটা অনুচিত।

মনে হলো, রাবেয়া ক্রমশ লুব্ধ এবং তপ্ত হয়ে উঠছে। আমি যেন তাকে তার ন্যায্য পাওনা ইচ্ছে করেই দিচ্ছি না, এ যেন মস্ত কৃপণতা।

গম্ভীর হয়ে বললাম, তুমি একটু সরে বস রাবেয়া!

—কী!

ধ্বক করে জ্বলে উঠল রাবেয়ার চোখ। তমসার পেছনের নগ্ন আগুন। আমি সরে যাব? কেন, কী হয়েছে? এত ঘেন্না কিসের? তুমি কি ভাব শুনি? ভাব, এই ভাবেই সংসারকে তুষ্ট করবে, তাই না? কিন্তু জেনে রেখো, সংসার তোমায় বিশ্বাস করে না। হামিদুলও আমায় চিরকাল সন্দেহ করবে। তুমি ওকে চেন না। তোমার চরিত্রের পবিত্রতা একটা ঠুনকো সেন্টিমেন্ট। মানুষের কাছে তার কোনোই দাম নেই।

বললাম, না থাক। কেউ না বিশ্বাস করুক। তবু আমি আমার বুদ্ধি জ্ঞান মনুষ্যত্ব বিবেকের কাছে দায়ী হতে পারব না।

কেন তবে তুমি আমায় বিয়ে করলে, বিয়ের সময় তোমার বিবেক কি লোভমুক্ত ছিল? আমাকে তুমি সাত দিন বাদে ফিরিয়ে দেবে, তখন আমার কী হবে? হামিদুল বিশ্বাস করবে না। ফের সে আমায় তালাক দেবে, তখন কী হবে, বল?

বললাম, তা সে দেবে না।

-দেবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?

বললাম, আমি কি তার গ্যারান্টি দিতে পারি? সে গ্যারান্টি ইহলোকে নেই। কুরানে হাদিসে সে গ্যারান্টি নেই। আমি দেব কোত্থেকে?

-ও! আর এদিকে তোমার নিজেরও কোনো ভয়ডর নেই। চিতির কুলে দাঁড়িয়ে শুধিয়েছিলাম, বুকে হাত দিয়ে বল, ভয় করে না? সেই একই প্রশ্ন আবার করি, সত্যিই কি তোমার ভয় করে না, মামুন?

-না।

—মানুষ তোমাকে ঘৃণা করবে। কামুক এবং লম্পট ভাববে। ভাববে গাঁয়ের একটা সরল মেয়েকে নিয়ে ফুত্তি-ফাত্তা মেরেছ। তুমি প্রফেসর। ভয় করে না, তোমার?

–না, করে না।

—তবে তুমি কী একটা? কী তুমি? পাথর নও?

-হ্যাঁ। পাথর।

—ভেবেছিলাম, সেই দুর্যোগের রাতে তুমি আমাদের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে।

—পারি নি।

—আসলে তোমার চরিত্রে, সে শক্তিই ছিল না।

বললাম, তুমি পাগল হয়ে গেছ রাবেয়া! তুমি পাগল হয়ে গেছ। তুমি থামো। তুমি চুপ কর।

—চুপ করব? কেন চুপ করব? বল? কেন?

.

রাবেয়া এবার আমার মুখের উপর তার পাথরের মতো ঠাণ্ডা ঠোঁট চেপে ধরল। তার পর বুকের উপর মাথা রেখে ককিয়ে উঠল কান্নার আবেগে। তার পর কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে কিল ঘুষি ছুঁড়ল। তার পর বুকের উপর মাথা ঠুকতে ঠুকতে শান্ত হয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। হঠাৎ খেয়াল হলো, রাবেয়ার চোখ বন্ধ, রাবেয়া ঢুলছে। ওকে ধরতে গেলাম। সে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় গড়িয়ে গেল। আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে যেন বা নিঃশব্দ নিস্পন্দ হয়ে গেছে। ঠিক এসময় কানের কাছে খতিবের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পেলাম, হামিদুলের পয়সায় তুমি মানুষ হয়েছ। তোমার বাচ্চাও কি মানুষ হবে? কাগের বাসায় বগের ডিম! কিন্তু তুমি নেমকহারাম নও।

.

রাবেয়াকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার বিছানায় পাশের ঘরে শুইয়ে দিলাম। রাত্রি বাড়ার সাথে সাথে তার গায়ে মৃদু জ্বর দেখা দিল। আকাশ যেন ভেঙে পড়তে লাগল। জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে ঘোর বাদলার এই আকাশের কালিমালিপ্ত নিশীথে রাবেয়া চমকে চমকে উঠল। মাঝে মাঝে চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। ঘরের মধ্যে কাকে যেন খুঁজতে লাগল! আমি এগিয়ে গিয়ে চোখের সামনে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে চোখ বুজে ফেলল। শেষ রাত্রি অবধি সে জ্বর আর কমল না। দিনের বেলা ডাক্তার ডেকে আনলাম। সকালের দিকে বৃষ্টির দাপানী কিছু কমে এলেও, বিকালের দিকে আকাশ বার্নিশ করা মেঘে থমথম করতে লাগল। হাওয়া উঠল।

ডাক্তার বললে, স্নায়বিক উত্তেজনা। সব সময় পাশে থাকবেন। রোগী প্রলাপ বকতে পারে।

.

তাই হলো, পরের দিন রাত্রে জ্বর আরো বাড়ল। আশ্বিনের আঁধি আরো পরিব্যাপ্ত হয়ে অবিশ্রান্ত ঝড় আর বর্ষণে পৃথিবীকে যেন নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল। হু হু বাতাসে কত কী মনে পড়তে লাগল। রাবেয়া প্রলাপ বকে চলেছে : আসছি খোকা দাঁড়া! খোকাবাবু যায় লাল জুতুয়া পায়। তার পরই, দেবে না আমায়? দাও?

এবং তার পর পাগলের মতো হেসে ওঠে। আমি বিছানার পাশে বসে থাকি। ফুলমতি বলে, এই বাদলে পানিতে বিষ থাকে সাহেব! জ্বর-জ্বালা পাঁচ রকম অসুখ-বিসুখ হয়ই। এট্টু ভালো মুতন ওষুধপথ্য কল্পেই সেরে যাবে বুবুমনি। এই ক দিনেই সুরৎ দেখেচেন, মিশির মুতন পুড়ে গেইচে, কালো হয়ে গেইচে। চেয়ে দেখতে দেখতে কখন আমার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। রোগীর মাথায় জলপট্টি দিয়ে বসে থাকি। তেতো বড়ি খেতে দিই। রাত্রি জেগে শিশি থেকে দাগ মেপে ওষুধ দিই। একদিন আচ্ছন্ন অবস্থায় রাবেয়া বলে ওঠে, টাঙ্গা এসেছে? আমি টাঙ্গায় চড়ব! ডুলি বিবিরা আমার মুখ দেখবে। এক লাখ চব্বিশ হাজার পীরপয়গম্বর আমার বিয়ের সাক্ষী দেবে। আল্লার ১০১টি নাম, খতিব সাহেব, তছবীতে গুনে গুনে আমার হাতে দোয়া, তাবিজ বেঁধে দেবে। আমাকে জিন-পরী কেউ ছোঁবে না। পাপও না। পুণ্যও না। মুন্নার হাত ধরে আমি পুলসে রাত পার হব। বেহেস্তের দরজা খুলে/ডাকবে নবী উম্মৎ বলে/যে উম্মৎ সে যাবে চলে, ইয়া আল্লা, রছুল আল্লা!

আমি রাবেয়ার মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে দেখি। দুই চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসে।…

.

অবুঝ মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা একটি মাত্র রাত্রির কামনা দিয়ে নিজেকে পরিতুষ্ট করতে পারে কি পারে না, তা যে কতখানি অনিশ্চিত, রাবেয়া এই বাস্তব ব্যাপারটা তার অবুঝ আকাঙ্ক্ষার কারণেই হয়তো বা বুঝতে চায়নি। তার কামনা যেমন বিমূঢ়, তার মাতৃত্বের সাধও তেমনি দিশেহারা। রাবেয়াকে শুধাবার ছিল, একটি অসম্ভব স্বপ্নে মিলিত হওয়ার জন্য তোমারই আপন ভালোবাসার কাছে আপনাকে এত খাটো করলে কেন? এ কথা তাকে কখনও জিজ্ঞাসা করার অবকাশ পাই নি। ধীরে ধীরে ওষুধপথ্যি করে সে সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সাতটি দিন চোখের সামনে ফুরিয়ে এসেছিল।

আট

২৭ তারিখ ভোরবেলা আকাশ পরিষ্কার। মেঘ কেটে গিয়ে শরৎ বিদায় নিচ্ছে। সূর্যে ধোয়া সজল প্রকৃতি গ্রামের শান্ত রূপসীর মতো স্থির, ছবির মতো তন্ময়। আজ হামিদুল আসবে। কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করি। আসবে হামিদুল। আয় হামিদুল, নিয়ে যা। তোর বিশ্বাস, তোর ভালোবাসা আমি আগলে বুকে করে রেখেছি, তুই এসে নিয়ে যা। যেমন করে ধরে রাখতে বলে গেছিস, আমি তেমনি করেই ধরে আছি। তুই কতক্ষণে ফিরে আসবি, তারই অপেক্ষায় আমি অধীর হয়ে রয়েছি। তুই এলেই দেখবি, আমার চোখে মুখে শাস্ত নির্লিপ্ত প্রতীক্ষা। ভালো করে চেয়ে দেখ, চোখে কোথাও দুঃখ কষ্ট আছে কিনা, তুই সবই যখন ফিরিয়ে নিবি, আমি বোকার মতো ব্যথিত হই কিনা, আমার ব্যথায় লোভ এসে জড়ো হয় কিনা? আমিও তো তোরই মতো রক্ত-মাংসের মানুষ। ভালো আমিও বেসেছি। আমারও কিছু অংশভাগ রয়েছে তোদের ভালোবাসার ভেতর। এইটুকু তোকে আর একবার মনে রাখতে বলি। তোদের ভালোবাসার দাম্পত্যে আমার ভালোবাসা চিরজীবী হবে, প্রতিদিনের চলাচলে আমি একটি ভাঙা-কলির গানের সুরে উঁকি দেব। তোদের সংলাপের ভেতর অতর্কিতে ঢুকে গিয়ে জ্বালাতন করব। দুঃখ দেব। বিশ্বাস দেব। অবিশ্বাস হানব। মাফ কর হামিদুল, আমি অবিশ্বাসের কোনো কাজ করিনি, তবু কেন অবিশ্বাস এসে তোদের সুখের জীবনকে বিপন্ন করবে, জ্বালাপোড়ার ব্যথা দেবে? এইটুকু কথা দে। তুষের আস্তরণে আমার ভালোবাসা এক টুকরো আগুনের মতো তোদের ধিকিধিকি জ্বালিয়ে দেবে না? আমি যেন বইয়ের পাতার ভাঁজে গোলাপের শুখা পাপড়ির মতো সুদূর-ছোঁয়া হালকা ঘ্রাণ হয়ে তোদের ভালোবাসায় মিশে যাই, আমি যেন তুষের সাঁজালো তীব্র অগ্নিকণা না হই!

তখন পৃথিবীতে ঢের রোদের ছড়াছড়ি। ভোর আটটা। স্নান করল রাবেয়া। আমায় স্নান করালো। আপন হাতে রান্না করে হাতপাখার বাতাস দিতে দিতে খাওয়ালো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাবেয়া সোয়েটারটা এখনও শেষ করতে পারেনি। এমন সময় বাইরে টাঙ্গা এসে লাগল।

হামিদুল এসেছে।

রাবেয়া একটানে খুলে ফেলল সোয়েটার। কতকগুলো ঘর একদম ভুল হয়েছে। ফলে এমনই টান দিল যে তা জট পাকিয়ে গেল।

সোয়েটারটা যে ঠিক কোথা থেকে শুরুহয়েছিল, তার মুখ-মোখড়া আর স্থির থাকল না।

.

পর পর দেখলাম সেই বোরকা-পরা কুহেলিময় নারী। অতৃপ্ত কালো একটি ভালোবাসার মূর্তি! রাবেয়াকে বোরকা পরা অবস্থায় চেয়ে দেখে ভয় পেয়ে আঁৎকে উঠলাম। সুটকেশ হাতে ভয়ার্ত বোরকা-ঢাকা রূপসী রাবেয়াকে মনে হলো, আমার ভালোবাসা একটি অন্ধকারে ঢুকে গিয়ে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, আলো নেই, আছে ঘোর অন্ধকারে প্রস্তরীভূত স্তব্ধতা, নিরেট আহত, দলিত ভাস্কর্য, আমি যেখানে চোখের আলো ফেলে খুঁজছি, পাগলের মতো খুঁজছি। কী খুঁজছি আমি?

একটি শেকলের ছড়াচ্ছড় শব্দ হয়। একটি করুণ নারীকণ্ঠের নিষ্পেষিত আর্ত আকৃতি, কান্নার ধূমল অবরুদ্ধতা, অস্পষ্ট হাহাকার!

কী খুঁজছি আমি?

আমার চোখের সামনে হামিদুল দাঁড়িয়ে। বাইরে টাঙ্গা। সময় প্রস্তুত। এবার ওরা যাবে। আমি খুঁজব।

এই অতৃপ্ত অনুসন্ধান কেউ টের পাবে না। কাল হয়তো চন্দন সোম আসবে। এসে বসবে আমার ঘরে প্রস্তুত চেয়ারে। কথা হবে। অনেক কথা।

কিংবা হয়তো কোনো কথাই হবে না। কেবল সে শুধাবে, রাবেয়া কোথায়?

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলব, নেই!

-কোথায় গেছে?

—গতকাল তার আপন সিংহাসনে পুনর্বার অভিষেক হয়েছে, রাণীর মতো।

—কি সব হেঁয়ালী করছ, মামুন! আমি রাবেয়ার সাথে কথা বলতে এসেছি, কনগ্র্যাচুলেশন দেব না?

-কাকে দেবে, সে তো নেই!

-কেন নেই?

—ওকে তালাক দিয়েছি।

-সে কি!

চন্দন দেয়ালের এনলার্জ করা মুন্নার ছবির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে।

আমি তখন একটি বোরকা পরা মহিলার অতৃপ্ত প্রেমের কাহিনী শুরু করব। আহত দলিত একটি ভাস্কর্য অন্ধকার পাষাণে খোদিত হবে। শৃঙ্খলের ছড়াচ্ছড় শব্দ হবে। দারুণ আর্তনাদ শোনা যাবে, তৃষিত ক্ষুধিত একটি প্রেম উচ্চকিত হয়ে পৃথিবীর বাতাসে ভেসে যাবে।

আমার কাহিনী শেষ হবে। আমার কথকতা – ফুরিয়ে যাবে হে মৌলভী মৌলানা সাহেবগণ!

রাবেয়া, বোরকা পরা বাদল রাতের মহিলা। আমায় টাঙ্গায় ওঠার আগে পায়ে হাত ছুঁয়ে নিচু হয়ে কদমবুলি (প্রণাম) করল। বললে, শেষ তালাকটি দাও এবার।

বললাম, ওটা থাক। ঐ একটি বাঁধন চিরকাল মুসলিম জাহানের কাছে অজ্ঞাত অশ্রুত থাক রাবেয়া। তুমি আর আমি জানব। আমি তোমায় ত্যাগ করতে পারি নি। মুখের কথায়, একটি শব্দে এই সম্পর্ক মিথ্যা হয় না।

রাবেয়া বললে, তাই হোক।

তার পর বললে, যাবার আগে মনে মনে আবৃত্তি করি, তুমি সুন্দর। তুমি পবিত্র। মানুষ তোমাকে ভুলতে পারে না।

চিতির দিগন্তে দ্রুতগামী, গাজীপুর অভিমুখী একটি টাঙ্গা জানলা থেকে দেখতে পাই। মিলিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ চোখের আড়ালে বিন্দুর মতো চলে যাচ্ছে।…

হ্যাঁ, মৌলানা সাহেব, হাফ ও ফুল মৌলভী সাহেব! আমি এবং রাবেয়া দুজনই চেষ্টা করেছিলাম বিস্তর। আপ্রাণ এবং আন্তরিক। পারি নি।

হে অমর হাদিস, বিশ্ব-কুরান!

তোমার অমোঘ নির্দেশ আমরা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করতে পারি নি।

শরীফ সাহেব! হজরত পীরজাদা কতুবুদ্দিন সাহেব। আমরা দুজনে ইদ্দাতের ষোলকলা পূর্ণ করতে পারি নি। ঢের ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে গেছে।

আপনারাই ভালো বুঝবেন দোষঘাট কতটা। মাফ করবেন।

এ কাহিনীর স্রষ্টা তো আপনারাই। ধন্যবাদ, শুকরিয়া!

এই তিন মাসের দাম্পত্যজীবনের জন্য রাবেয়াকে পেয়েছিলাম। আপনারাই হাতে দিয়েছিলেন। রাবেয়াও আমাকে পেয়েছিল।

লক্ষবার শুকরিয়া। ধন্যবাদ।

আলহামদোলিল্লাহ্! শুকুর আলহামদোলিল্লাহ্!

হে রাব্বুল আল আমিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *