এক টুকরো চিঠি

এক টুকরো চিঠি

এক

আমার কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ভ্যানিটির মধ্যে এক টুকরো চিঠি আছে খুব মারাত্মক। আমার মা লিখেছেন তাঁর মাসির মেয়ে শিরিনকে। শিরিন আমার মায়ের সতীন ছিলেন। আমার বাবা প্রাক্তন মুসলিম লীগ এম. এল. এ.। শিরিন তাঁরই দ্বিতীয় পক্ষ ছিলেন। মাসি আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো। আমাদের খুব বন্ধুত্ব ছিল। মা শিরিনমাসিকে স্নেহ করতেন। শিরিনমাসির পড়াশুনোয় যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর বাবার সাথে বিয়ে হয়েছিল। ওই অব্দিই পড়াশুনোর ইতি। শিরিনমাসি মায়ের চেয়ে সুন্দরী। বোধহয় আমিও তাঁর মত সুন্দরী নই। বাবা সেই রূপেই মুগ্ধ হয়ে শিরিনকে বিয়ে করেছিলেন। তারপর পাঁচ বছর যেতে না যেতে বাবার সাথে মাসির বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কেন যে বিচ্ছেদ হয়েছিল, সে এক অতর্কিত বিস্ময়।

আমি তখন ক্লাশ নাইনের ছাত্রী। পুজোর ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষা। রাত জেগে পড়াশুনা করতে হয়। শিরিন অঙ্কে এত ভালো ছিলেন যে মনে হত মহিলা যেন-বা অঙ্কের জাহাজ। উনি বলতেন, অঙ্কের জন্য মেধার খবরদারি লাগে না, চাই অভ্যাস। যদিও হায়ার ম্যাথমেটিক্স্ ইজ নট এভরিবডিজ কাপ অব টী। তথাপি প্র্যাকটিস চালিয়ে গেলে খোদাও ফেল করাতে পারে না। ইউ মাস্ট অবটেইন অ্যাট লীস্ট এইটি পারসেন্ট ইন এরিথমেটিকস। আই অ্যাম এ “শিওর সাকসেস” ইন ইওর হ্যানড। বাট আই অ্যাম নট ইওর টীচার। আই অ্যাম এ পুওর গার্ল, ফুল অর কনট্রাডিকশনস, মাই পয়েন্ট ইজ জিরো, রেজালট ইজ জিরো, মাই আনসার ইজ নীল। এই ধারায় ইংরাজি বলা তাঁর অভ্যাস ছিল।

বলতে-বলতে শিরিন কেঁদে ফেলতেন। আমি কাঁচা অঙ্কের ছাত্রী, পরীক্ষায় সে বছর ৮২ নম্বর পেয়ে থার্ড হয়েছিলাম। আজ ইলেভেন ক্লাশে আর্টস-এর ছাত্রী উইমেনস কলেজে। আই অ্যাডমিট, আই নো, হায়ার ম্যাথমেটিক্স্ নট ইজ এভরিবডিজ কাপ অব টী। কিন্তু শিরিনের কাছে অঙ্ক ছিল এক গেলাস মিছরির শরবত। হায়! অথচ শিরিনের বিদ্যের দৌড় কলেজ অব্দি পৌঁছতে পারেনি। আমার বাবাই ছিলেন তাঁর হায়ার ম্যাথমেটিকসের শেষ মাইলস্টোন, তার সংখ্যা ছিল জিরো। এবং মজাটা এই, অঙ্কের রাজত্বে জিরোরও নাকি একটা অদ্ভুত মানে আছে। শিরিনমাসি সেই স্টোন অতিক্রম করে কোথায় পৌঁছেছেন, আমি তার সামান্য জরিপ করেছি। বাকি রহস্য এই চিঠির আড়ালে লুকিয়ে। সেটাই এই গল্পের ভবিষ্যৎ। তার রেজাল্ট আমার জানা নেই। যাই হোক। মাসি বলতেন, তাঁর জীবনটা, তাঁর লাইফ, ফুল অব অ্যাডভারসিটিজ অ্যানড ফুল অব কনট্রাডিকশনস। একটা উলোটপালট আবর্ত। তখন সবখানি বোঝার সাধ্য ছিল না। ক্লাশ নাইনে পড়ি। বয়স মানুষকে কিছু অঙ্ক শেখায়। আমি তখন অঙ্কের আসল ভ্রান্তি এবং নকল সাফল্য বুঝতাম না। শিরিনের দুঃখ পয়েন্ট-বোর্ডে কতদূর উঠেছিল জানা নেই। শুধু সেই বিচ্ছেদের ধোঁয়াশা-লিপ্ত রাত্রিকে মনে পড়ে। মাসি যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে এলেন। সেই এক নারীর রক্ত-ফোঁসানো রাত্রি আজ মনের তলে কুণ্ডলী পাকায়। সামুদ্রিক জলকম্পনের দীর্ঘনিশ্বাস লাগে। সেদিন মানব-মানবীর বিচ্ছেদের একটা ক্রুর আকৃতি দেখতে পেয়েছিলাম। তার একটা ভিজুয়াল এফেক্ট হয়েছিল আমার মধ্যে। একজন কিশোরীর বুকের কুঁড়ি যৌবনের ভারি বুকের জগদ্দলবন্দী হয়ে হয়তো হাঁসফাঁস করে উঠেছিল। ঘুমজড়ানো চোখে বিছানায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেছি। কে যেন বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। দোতলার বারান্দায় বাবা মধ্যরাত্রির নামাজ পড়ছেন জোরে-জোরে। তাঁর কণ্ঠে কেমন একটা বিরক্তি আর ঈষৎ উদ্বেগ মেশানো। নামাজের মধ্য দিয়ে তিনি কোথায় যেন পালিয়ে যেতে চাইছেন। সেতারের এলানো তারে কে যেন বেসুরো আঘাত করে যাচ্ছে। সেই সুর কালো আকাশের গড়ানে নেমে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ-ভাঙা ঘুমের জড়িমায় বাস্তব তখন অস্পষ্ট।

দুই

শিরিনমাসি বিয়ের এক বছরের মাথায় হঠাৎ একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ধূপঘন সন্ধ্যার অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে দড়ি হাতে করে একাকী গিয়েছিলেন সিঁদুরে আমগাছের কাছে। ডালে লটকে ঝুলছিলেন তিনি। পা দুখানি আলতালিপ্ত এবং ঝুলন্ত ছিল, বাবার হাতের টর্চের আলোয় সাদা ধবধবে পা আমিও দেখেছি। শিরিনের গোঁঙানি শুনে (প্রথমে বুঝিনি সে অমন করে গোঁঙাচ্ছে এবং কোনদিকে ডাকছে) আমরা সবাই দৌড়ে গিয়েছিলাম বাগানের মধ্যে, বাবার হাতের জোরালো টর্চ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। গাছ থেকে নামিয়ে মাসিকে যখন শোয়ানো হল খাটের ওপর, মাসির গলায় নীল শিরা তখনও দপদপ করছে। কিছুক্ষণ প্রায় সংজ্ঞাহীন মাসি। পরে সহসা কী এক বিদঘুটে গলায় প্রেতাত্মার মতন কাঁদলেন। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। মাসির মুখে ফেনা উপচে পড়ছিল। মাসি কেন ওইভাবে দড়ি হাতে ছুটে গেলেন, আজও ভাবি। শিরিনের পেটে তখন বাচ্চা এসেছে। গায়ে তাঁর ভরন্ত সুষমা, চোখে টলটলে মাতৃত্ব। সেই দিনই কি মাসির পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়? বাচ্চা ম্যাচিওর্ড হতে পারেনি। অপুষ্ট মৃত মাংসপিণ্ড প্রসব করেছিলেন মাসি। আমরা ভাবতেই পারিনি, মাসি এইরকম কাজ করতে পারেন। মায়ের সাথে ছোটোবোন শিরিনের কোনো বিরোধ ছিল বলে মনে হয়নি। মা তাঁকে বোনের মতন দেখতেন, সতীন ভাবতেন না। তবু কেন মাসি ওইভাবে দুম করে মরতে চেয়েছিলেন? শিরিনের মুখে কখনও পাপের চিহ্ন দেখিনি। তা ছাড়া ওঁকে সবসময় হাসি খুশিই দেখেছি। দুঃখের কথাটাও উনি হাসতে হাসতে বলতেন। এমনকি হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলতেন। সেই শিরিন অমন কাজ করতে চাইলেন কেন? মাসি আত্মহত্যায় ব্যর্থ হয়ে আগের চেয়ে আলাদা মানুষ হয়ে উঠলেন। ভীষণ শৌখিন ছিলেন তিনি। দামি সাবান, গন্ধতেল এবং বিদেশি সেন্ট্ ব্যবহার করতেন। সেইসব গন্ধিল পারফিউমের মিশ্রিত গন্ধ ছিল বড়োই উতল। এমনকি আত্মহত্যার সেই সন্ধ্যায় তাঁর গায়ে সেইসব গন্ধ লেগে ছিল। গন্ধটা এখনও নাকে লেগে আছে। সেই দুর্ঘটনার পর মাসি অন্যরকম হয়ে গেলেন। জানালা খুলে সেই সিঁদুরে গাছটার দিকে চেয়ে থাকতেন। কথা বলতেন খুবই কম। আমি জানালা বন্ধ করে তাঁকে ঘরের খাটে টেনে এনে বসাতাম। বলতাম—অমন করে চেয়ে থাক কেন? তুমি কি মৃত্যুর কথা ভাব? কেন তুমি মরবে? আমরা তো রয়েছি। তোমার কষ্টের কথা আমায় বলতে পার না?

উনি বলতেন—তুমি সব কথা বুঝবে না, মিনু!

শুধাতাম—কেন বুঝব না?

মাসি কোনো উত্তর না করে নিঃশব্দ ‘হেসে চুপ করে থাকতেন। কিন্তু আমি তাঁকে বন্ধুর মতো মনে করতাম। সেই দুর্ঘটনা উনি ভুলতে চাইতেন। আমরাও চাইতাম, উনি ভুলে গিয়ে সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু ওই সিঁদুরে গাছ, সেই গাছের মালিক, ঘটনাকে অন্য জায়গায় টেনে নিয়ে চললেন। বাগানের মালিক ছিলেন এক হিন্দু প্রতিবেশী, আমার চাচাদের ভাগে ছিল ওই বাগান। এখান থেকে তাঁরা অন্যত্র উঠে গিয়ে দালান করেছেন। যাবার সময় বাগান বিক্রি করে গেছেন। কিনেছেন গোলোক সমাজদার। চাচারা বাবার ওপর হিংসে করে বাগান গোলোকবাবুদের দিয়ে গেছেন। গোলোকবাবুর সাধের সিঁদুরে গাছে ওই দুর্ঘটনার পর কী এক দুঞ্জেয় কারণে বউল আসা বন্ধ হয়ে গেল। মুকুল ধরে না। গুটি হয় না। পর-পর দুই বছর এইরকম হল। ধীরে-ধীরে কথা উঠল—গাছে শাপ লেগেছে। অপয়া বউ পেটের বাচ্চা মেরেছে। গাছকে করেছে বন্ধ্যা। গাছ ভয় পেয়ে বোল দিচ্ছে না। কথাটা নানারকম গলায় নানান সুরে খেলিয়ে-খেলিয়ে বলা হতে থাকল। বেশির ভাগ সময় গোলোকবাবুর স্ত্রী পাশের বাড়ি থেকে ওই কথা পাচার করতেন, গলা বাজিয়ে শিরিনকে অভিসম্পাত দিতেন। বলতেন—আমাদের কেষ্টপুরের বাগানে একবার কাঁঠাল চুরি হল। সোনামুখী গাছ গো। সে কি কাঁঠাল! কোয়া দেখে চোখ ধরে যায়। জোয়ালের সমান সাইজ। চুরি করল এক মুসলমান ছিঁচকে, নফর শাহু নাম। শালা ছুঁচকি চোর। অমাবস্যায় চুরি তো। গাছ ডরিয়ে গেল। আর ফল দিলে না। ওইভাবে চুরি হলে গাছের সতীত্ব চলে যায়। গাছেরও তো প্রাণ আছে। মান অভিমান আছে। আমার সিঁদুরি গাছটার সেই হাল করল ওই অপয়া মেয়ে। গাছের বুকে ডর ধরিয়ে দিয়েছে।

এইভাবে দোষারোপ চলত। নানা সুরে কথা পল্লবিত হত। বউল আসার সময় হলে বাগানের পরিচর্যার বহর বেড়ে যেত। গোলোকবাবু নল উঁচিয়ে পাম্প মেশিনে ওষুধ স্প্রে করতেন বউলের পুঞ্জে-পুঞ্জে। সিঁদুরি গাছের কাছে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতেন। মাসি জানালা খুলে সেই দৃশ্য দেখতেন। একবার গাছের তলায় ঘট প্রতিষ্ঠা করে তেলসিঁদুর-পাতাপল্লব দিয়ে পূজা দেয়া হল। ঢাক বাজানো হল। মন্ত্র পড়ে মুসলমানের গাছের হিন্দুত্বপ্রাপ্তি ঘটানো হল। বাবা সেইসব দেখে খেপে উঠলেন। গাছ বিক্রি হয়ে গেল বটে, কিন্তু গাছের চারা তাঁর বাপের হাতে লাগানো। তিনি সহ্য করতে পারলেন না। দাদাজী বেঁচে থাকলে কষ্ট পেতেন ভেবে বাবা কষ্ট পেতে থাকলেন। একদিন গোলোকবাবুর সাথে ওই নিয়ে বিবাদ হয়ে গেল। গোলোকবাবু তলে-তলে নিখিলবিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য হয়েছেন। মা দুঃখ পেয়ে বাবাকে বললেন—ওদের গাছ ওরা যা খুশি করুক, তুমি ঝগড়া করছ কেন? —বাবা রেগে গিয়ে বললেন—ওদের গাছ? কে বলেছে ওদের গাছ? আব্বাজী নিজে হাতে ওই গাছ বহাল করে গেছে। ওইরকম ঢোল বাজালে আব্বাজী কবরে শুয়েও শান্তি পাবে না। আব্বাজীর রুহ্ (আত্মা) কতখানি কষ্ট পায় তুমি জান? মা বললেন——বউল ধরে না বলে ওরা ঢাক বাজায়। পুজো দেয়। আমরাই তো দোষ করেছি। শিরিন কেন ওই গাছে দড়ি দিতে গেল?

বাবা-মায়ের তক্কাতকি আমি আর মাসি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। বাবা গরম গলায় বললেন—ওই মেয়েকে আমার তালাক দেয়া দরকার। ও আমার সন্তান খেয়েছে। হিন্দু প্রতিবেশীর সাথে ওরই কারণে বিবাদ-বিসংবাদ হচ্ছে। আমি লীগ করি, হিন্দু রাষ্ট্র, দার-উল- র্বি, এদেশ দার-উল-ইসলাম নয়। এখানে ধৰ্ম্ম বাঁচে না। ওই শালা সমাজদার কতখানি সাংঘাতিক বামুন জান না তো! পারে না যে গাছের গলায় পৈতে পরায়।

শিরিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। ফস করে জ্বলে উঠলেন।—আপনিই বা ওই গাছের মাথায় ইসলামি টুপি পরাতে চাইছেন কেন?

বাবা বললেন—তুমি পাপ করেছ, তাই। লজ্জা করে না তোমার? তোমার জন্যে এইসব, ফের কথা বলতে এসেছ!

শিরিন ধীরে-ধীরে অন্য ঘরে চলে গেলেন। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, সামান্য একটি গাছকে কেন্দ্র করে কী কুচ্ছিত সংস্কার বার-বার শিরিনকে আঘাত করে যাচ্ছিল। বাবা এই দেশকে কখনও নিজের দেশ মনে করেন নি। কথায়-কথায় বলতেন, এই দেশ বিধর্মীর দেশ। দার-উল-হার্ব। এদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। বিধর্মীদের, কমিউনিস্টদের শাসন জারি হয়েছে। ফতোয়া-ই-আলমগীরিতে রয়েছে, দেশে যখন ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকে না, বিধর্মীর শাসনজারি হয়, আদালত ইসলামকে অপমান করে, নাস্তিক মার্কস সাহেবের পূজা করে মানুষ, তখন দেশ দার-উল-হার্ব নয় তো কী? তাই বাধ্য হয়ে উনি জামাত-ই-ইসলামকে পছন্দ করেন। মাঝে-মাঝে সংসার ছেড়ে জামাতে চলে যান। দেশে-দেশে ইসলামি জীবন-বেদ প্রচার করে বেড়ান। একটা বিরাট অংশের ইসলামি যুবশক্তি জোর কদমে এই প্রচার অভিযানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ছাত্রদের মধ্যে ইসলামি নবজাগরণ ঘটছে। এই দেশের বিধর্মী নেতাদের বিরোধিতার কারণে একদিন ওহাবী আন্দোলন মার খেয়েছে।

এই বিষয়ে তক্ক করতে ভালোবাসেন বাবা। সাদিকুল সাহেব আসেন বাবার কাছে। মার্কসের ভক্ত। রাজনীতি করেন। চাকরি পাননি বলে শহরে একটা টিউটোরিয়াল হোম খুলেছেন। উনি এলে বাবার সাথে ‘বাহাস’ হয়। বাবা বোধহয় সাদিকুলকে সহ্য করতে পারেন না। মায়ের দিক থেকে উনি আমাদের অতি দূর সম্পর্কে আত্মীয়। আমি মামা বলি। আমার ভাইবোনদের উনি আদর করেন। একমাত্র উনিই শিরিনের সাথে গল্প করার জন্য অন্দরে ঢুকে পড়তে পারেন। মায়ের সাথে নানান কথা বলেন। চা খান। কখনও-বা বাবাকে নিয়ে আমাদের সামনে টিপপনি করেন। বাবা সাদিককে আমল করেন না। বাবারও ধারণা, ছেলেটি ভালো। তবে বিভ্রান্ত। এই দেশের আসল বিপাক কোথায় ধরতে পারে না। বেকুফ। ভ্যাগাবন্ড।

সাদিক একদিন গাছের প্রসঙ্গ শুনে হেসেই আকুল। খানিক চড়া গলায় হেসে হাসি নিভিয়ে ফেললেন, ওটাই ওঁর স্বভাব। তারপর বললেন—তবে শোনো…

তিন

‘তবে শোনো’ বলা মানেই ধরতে হবে, উনি এবার খুব মজা করে গল্প শুরু করবেন। সবাই উৎসুক হয়ে উঠলাম, আমি চট করে একটা বুদ্ধি করলাম, বললাম—এক মিনিট। শিরিন-খালামাকে ডেকে নিয়ে আসি। উনিও শুনবেন।

তড়াক করে খাট ছেড়ে নেমে পাশের ঘরে এলাম। দেখলাম, শিরিন জানালা ধরে বাগানের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন। ওইভাবে মাসিকে দেখলে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। হাত ধরে টেনে জানালার পাল্লা ঠেলে দিলাম, চেয়ে দেখি, শিরিনের চোখে জল টল্টল করছে।

-এ কী, কাঁদছ?

–না। কিছু না। তুমি আমায় ছেড়ে দাও। আমি ও-ঘরে যাব না। ওই লোকটির রগুড়ে কথা সব সময় ভালো লাগে না।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম—মনকে যত খারাপ রাখবে, মন তত খারাপ থাকবে। আমাদের মধ্যে মামাই একমাত্র রঙিন মানুষ। ওঁকে তোমার ভালো লাগে না?

না। একদম না। এখন আমার একটাই রঙ পছন্দ। সিঁদুরি গাছ –বেশ তো। মামা তো গাছের কথাই বলতে চাইছেন। কী হল, যাবে না? শিরিন পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে এঘরে খাটের একপ্রান্তে বসলেন। শিরিনকে দেখে মামা বললেন সচকিত গলায়—ও! আপনিও এসে পড়েছেন? এবারে বুবুকে (মানে মাকে) ডেকে আনো, মিনু। বোটানিক্যাল গার্ডেনের দুটি গাছের গল্প আমি শোনাব। একটি হল ফুল। নাম হল লিলি। দুই হচ্ছে একটি হতভাগ্য খেজুর। যাও।

বললাম—মা আসবেন না। রান্নায় ব্যস্ত।

মামা বললেন—বেশ, তবে শুরু করি। কথা হল, গাছেরও প্রাণ আছে, বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন। গাছ অনুভূতিপ্রবণ প্রাণী। ওর হিংসা আছে। ভালোবাসা আছে। ঘৃণা করে গাছ। গাছ আহ্লাদিত হয়। শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে সেবার গেলাম। গাইড একটা ডোবার সামনে এনে বললে—ওই যে দেখছেন পদ্মপাতার মতন বিশাল পাতা, ওটা পদ্ম নয়। ঐ ফুলও পদ্মফুল নয়। দেখতে পদ্মপাতার মতনই বটে। ওটা একজাতের লিলি। পদ্ম পাতা অতখানি প্রকাণ্ড হয় না। ওই পাতায় একটি এক বছরের মেয়ে-বাচ্চা বসে থাকতে পারে। ডুববে না।*

[* বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাইডদের মুখে এই ধরনের জ্যান্ত উক্তি বাস্তবিক প্রচলিত। সেটা কি শুধুই গল্প?]

প্রশ্ন করলাম—মেয়ে-বাচ্চা কেন? ছেলে হলে কি ডুবে যাবে? গাইড বলল—অবশ্যই ডুববে।

-কেন?

-সেটা বলতে পারব না। কারণ একটা আছে নিশ্চয়। তবে বোধহয়, লিলি মেয়েদের ভালোবাসে। পুরুষদের সহ্য করে না।

বলতে-বলতে গাইড এগিয়ে গেল। গাইডের কথা কেউ-বা বিশ্বাস করছিল, কেউ করছিল না। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমাদের মনোভাব টের পেয়ে গাইড নদীর ধারে একটি বটগাছের কাছে এনে বলল—দেখুন। গাছ কেমন হিংস্র হয়। ঝুরি দিয়ে খেজুরটাকে জড়িয়ে কেমন করে মেরে দিয়েছে। দেখি তাই, শূন্য খাঁ খাঁ করছে গাছ। মস্তকহীন নিষ্পত্র খেজুর। মরে গেছে। মৃত অবস্থায় বটের নিষ্পেষণে দাঁড়িয়ে কী করছে গাছ? খেজুরের মাথায় একটা শকুন চুপচাপ বসে ঝিমোচ্ছে। দেখে, ভেতরটা চমকে যায়।

.

শুনতে শুনতে শিরিন দুহাতে মুখ ঢেকে শিউরে একধারা আর্ত-অস্ফুট শব্দ করলেন। সেই শব্দ কান পেতে শুনে ম্লান হাসলেন সাদিক। তারপর বললেন— বিজ্ঞাণীরা একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। তাতে গাছের হার্ট বীট, পাল্স-বীট ধরা পড়ে শুনেছি। শোনা কথা। এক বিজ্ঞানী ওই যন্ত্রে চেয়ে দেখে নাকি গাছের উল্লাস এবং বিষাদ অনুভব করতে পারেন। উনি গাছ ভালোবাসেন বলে গাছও তাঁকে ভালোবাসে। যেখানে তিনি গবেষণা করেন, সেখানে সেই যন্ত্রটা আছে। তার কাঁটা বিজ্ঞানীকে দেখতে পেলে কেঁপে ওঠে আহ্লাদে। সেই বাগানে কাঁচি হাতে মালি ঢুকলেই ঐ কাঁটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এই ঘটনা স্টাডি করে বিজ্ঞানী বুঝলেন, গাছেরও খুশি-হওয়া, ভয়-পাওয়া বলে একটা ব্যাপার রয়েছে। অতএব শিরিনকেও সিঁদুরি গাছটাকে খুশি করতে হবে। কথা শুনে শিরিন সাদিকের দিকে চোখ তুলে স্পষ্ট করে তাকালেন। মামাকে আমি আগেই মাসির মনের সব অবস্থা বলে দিয়েছিলাম। মামা বললেন—দেখুন, মেয়েদের শুধু মামাশ্বশুর-ভাগনেবউ (লাজুকলতা) হয়ে থাকলেই তো চলে না, মেয়েদের কিঞ্চিৎ লিলিও হতে হয়। সিঁদুরি গাছের কাছে গভীর রাতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে বলবেন, আমায় ক্ষমা করে দাও, আমি তোমারই মতন অসহায়। আমি কখনও আত্মহত্যা করব না। আমি আখতার হাজীকে একটা সন্তান উপহার দেব। তুমি পুষ্পিত হও। বলতে-বলতে সাদিকুল উঠে দাঁড়ালেন, শিরিন সাথে-সাথে বাধা দিয়ে বললেন—উঠছেন কেন? বসুন, চা খেয়ে যাবেন।

শিরিন হঠাৎ যেন খুশি হয়ে উঠেছেন। খাট ছেড়ে নেমে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ছোটোরাও খেলতে চলে গেল। বিকাল হয়ে আসছে। চা খেতে-খেতে মামা আরো কিছু গভীর কথা তুললেন। বললেন—লিলির একটা প্রতীকমূল্য আছে মেয়েদের জীবনে। গাছের নিজস্ব কোনো সংস্কার নেই। ধৰ্ম যা তা-ও খুব প্রিমিটিভ। ক্ল্যান যুগেরও ওপারে পড়ে আছে বৃক্ষ লতাপাতা। কারণ ওরা মানুষের চেয়েও পুরনো প্রাণ। ওদের আমাদের মতন কোনো গোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক ধর্ম কখনও ছিল না। আজও নেই। বুঝলে মিনু, একথা গোলোকবাৰু কিংবা তোমার বাবা বুঝতে চাইবেন না। কেন বলো তো?

শুধালাম—কেন?

সাদিক বললেন—কারণ উনি মনে করেন শবেকদরের রাতে বৃক্ষলতাপাতা আল্লাকে সিজদা (প্রণাম) করে। মোনাজাত (প্রার্থনা) করে। যাঁরা পরহেজগার (নৈষ্ঠিক পুণ্যাত্মা) তাঁরা গভীর রাতে, স্বচক্ষে নাকি সেই নামাজপড়া দেখতে পান। তোমার বাবা হাজী আখতার এম. এল. এ. (মুসলিম লীগ) আমায় পরম বিশ্বাসের সাথে একথা বলেন। আমি সেকথার প্রতিবাদ করিনি কেন জান?

–কেন? প্রশ্ন করি।

মামা বলেন—কারণ মানুষ বরাবরই গাছপালার মধ্যে নিজের চৈতন্যকে আরোপ করে। যে যেমন সে ঠিক তেমনি করেই করে। মানুষ সব সময় তার নিজস্ব ক্যাটেগরি অব থট্স, চিন্তার রকমের মধ্যে রয়েছে। তার সব অনুভূতি ওই চিন্তার রকমের মধ্যে বিরাজ করে। লালন ফকির থেকে আইনস্টাইন সবার বেলা একই কথা। জীবনানন্দও গাছের মধ্যে নিজের চৈতন্যকে দেখতে পেতেন। তাঁর একটি গল্প বলি শোনো। উনি অন্য কবিদের একবার অদ্ভুত একটা কথা শুনিয়ে বললেন, আমি অন্ধকারের তরঙ্গ দেখেছি। তোমরা দেখবে? সত্যিকার তরঙ্গ দেখা যায়। এটা কবিকল্পনা নয়, চাক্ষুষ ঘটনা সেটা। অন্য কবিরা চাক্ষুষ করতে চাইলেন। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা পায়ের কাছে মেঝেয় রেখে সাদিকুল সটান হয়ে চেয়ারে বসলেন। রুমাল বের করে ঘাড় গলা মুখ মুছে প্যান্টের পকেটে ফের ঢুকিয়ে রাখলেন। চশমাটা ঠিকমতন নাকে বসিয়ে আমাদের দিকে প্রসন্ন হয়ে চেয়ে দেখলেন। শিরিন দুই চোখে কথাগুলি গিলে নিচ্ছিলেন। শিরিনের চোখ থেকে চোখ টেনে সাদিক আমার দিকে চেয়ে বললেন——জীবনানন্দ তারপর কবিদের দল বেঁধে গভীর রাতে এক গাছতলায় নিয়ে গিয়ে ফেললেন। বিষম অন্ধকার। গাছের তলায় গিয়ে জীবনানন্দ একখানা শুকনো ডাল, ওই গাছেরই ডাল, কুড়িয়ে নিয়ে গাছের দিকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারলেন। গাছের ডালে পাতায় গিয়ে আঘাত করা মাত্র সেই গাছের বাসিন্দা পেঁচা আর বাদুড় সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে উড়াল দিয়ে শূন্য আকাশে উড়ে গেল। তাদের পাখার ঝাপটা লেগে চারপাশের অন্ধকার কেঁপে উঠল! জীবনানন্দ আঙুল তুলে দেখালেন, দ্যাখো, কী চমৎকার ঢেউ উঠছে। দেখলে?

আমরাও মনে-মনে সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। মামা বললেন—ঘটনাটা একই। গাছকে যাঁরা নামাজ পড়তে দেখেন, তাঁরা প্রাচীন। আর অন্ধকারের গায়ে যাঁরা ঢেউ আছড়ে পড়তে দেখেন, তাঁরা আধুনিক। এই যা তফাত। কিন্তু কবির তরঙ্গ দেখার মধ্যে কোনো স্বার্থ ছিল না। জীবনানন্দ গাছের কাছে ফল চেয়ে কাঁদেন নি। চেয়েছিলেন নিঃস্বার্থ সৌন্দর্য। অন্য কবিরা শুধিয়েছিলেন, গাছে যে শুকনো ডাল ছুঁড়ে মারলেন, সেটা কেন? কবি বললেন—ঠিকই করেছি। গাছ তো এখন ঘুমিয়ে। আমি ওরই ডাল দিয়ে ওকে ছুঁয়ে দিলাম। গাছ জাগল না। কষ্ট পেল না। আমারও তরঙ্গ দেখা হল। অন্যরা প্রশ্ন করলেন—পাখিগুলো যে উড়ে পালাল, তাতেও তো ঘুম ভেঙে যেতে পারে? কবি বললেন—না। তা নয়। ঘুমের মধ্যে প্রিয়জনের হাত-পা এসে আমাদের গায়ে পড়ে, আমরা দিব্যি ঘুমিয়ে থাকি, এ-ও ঠিক তাই। চলো, গাছ ঘুমিয়ে থাক। আমরা যা দেখবার দেখে নিয়েছি।… তাই বলছিলাম। বলে সাদিক চুপ করে রইলেন।

-বলুন! অস্ফুট বললেন শিরিন।

সাদিক বললেন—গাছের কাছে ক্ষমা চাইবেন। প্রার্থনা করবেন গাছ যেন ফুটে ওঠে। বলবেন, আমি তোমার ফল নেব না। আমি শুধু দূর থেকে চেয়ে-চেয়ে দেখব। ব্যস! গাছ তখন খুশি হয়ে…

বলে আর কথা শেষ করলেন না সাদিকুল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে-পায়ে বারান্দায় এলেন। হঠাৎ কী মনে পড়াতে ঘুরে দাঁড়ালেন। আমরাও ওঁর পিছু-পিছু এগিয়ে এসেছি। শিরিন শুধালেন—আচ্ছা সাদিক, লিলির প্রতীকমূল্যটা কী সেটা তো বললেন না?

সাদিক নিঃশব্দে হেসে ফেলে বললেন—আপনার মনে আছে দেখছি। অল্প কথায় বলব। হাতে আর সময় নেই। কালই শহর চলে যাব। একটু এখন তাড়া আছে।

—বেশ। তাই বলুন। শিরিন সম্মত হলেন।

সাদিক তখন এতক্ষণ বাদে একটা সিগারেট ধরিয়ে ধুয়ো ছেড়ে বললেন—লিলি পুরুষকে ঠিক সহ্য করে না। বইতে পারে না। গাইডের কথার মধ্যে এইরকম একটা ইঙ্গিত ছিল। তাই না? আবার একটা টান দিলেন উনি। সিঁড়ির দিকে এগোলেন। সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে থেমে গিয়ে বললেন—ইউরোপের দেশগুলোর মতন, আমেরিকার মতন, এদেশেও মেয়েদের একশ্রেণীর মধ্যে একটা ট্রেন্‌ড্ দেখা যাচ্ছে। সেটা ফিমেল লিব নামে চলছে। মেয়েরা তাদের নিজেদের মধ্যে একটা সর্পিল যুদ্ধ, প্রচণ্ড আগ্নেয় নারীসত্তাকে শ্রদ্ধা করতে চাইছে। স্বাধীনতার একটা তুমুল কনসেপট বলা যায়। সেটা ঠিক কিনা জানি না। হয়তো নয়। কারণ সেই ক্ষোভ, নিজেকে সম্পূর্ণ এক রক্তাক্ত জীবন-পিণ্ডে পরিণত করা এবং পুরুষকে দলিত করার ইচ্ছে, যৌন-দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যৌনতার স্বাধীন উচ্ছ্বাস পেতে চাওয়ার অভিপ্রায়, এই আন্দোলনের মধ্যে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েদের জৈব বৈশিষ্ট্য আর দেহের নারীলক্ষণগুলোর মধ্যেই রয়েছে তার চিরকালের অপমান। তা সেইসব কথাগুলো ঐ শিবপুর গার্ডেনে গিয়ে লিলিকে দেখে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল, ওই বিরাট গোলপাতা, সেই রক্তাক্ত ফুল, বেশ প্রতিবাদী, পুরুষ বাচ্চাদের ডুবিয়ে দেয়। নেয় না।

বলতে-বলতে সাদিকুল হো-হো হেসে উঠলেন। হাসতে-হাসতে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে চলে গেলেন।

চার

তারপর থেকে শিরিনের সত্যিকার তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। একদিন মাঝরাতে ঘর ছেড়ে বাইরে এলেন। আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন—চলো। সিঁদুরি গাছকে সাদিকের কথাগুলো বলে আসি

আমি চমকে উঠলাম। সাদিক তো মজা করে গল্প বলে গেছেন। হতভাগিনী সেইসব গল্পকে সত্যি মনে করেছেন। সাদিকের কথার এত দাম দিতে হয়? আমি যেতে রাজি না হলে একাই এই অন্ধকারে চলে যেতে চাইলেন। অগত্যা আমাকেও যেতে হল.। এই অবস্থায় গোলোক-পত্নী দেখলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যাওয়ার কথা। ভয়ও হচ্ছিল খুব। গাছের কাছে নতজানু হয়ে পাগলের মতন বিড়বিড় করতে লাগলেন শিরিন। ওঁর কেমন নিশির দশা হয়েছিল। কয়েক রাত এইরকম চলল। সাদিকের সব কথা আমি স্পষ্ট বুঝতাম না। সব কেমন অ্যাবসার্ড মনে হত। ধরে নিতাম ওগুলো গল্প। কিন্তু আসলে সাদিক শিরিনকে কী এক দুর্ভেদ্য চৈতন্য দিয়ে বিদ্ধ করেছিলেন। সাদিক শিরিনকে বড়ো জোর আমারই মতন খুকি মনে করতেন। মাঝে-মাঝে এমন কথা বলতেন, যা আমার সামনে বলা উচিত নয়। কিন্তু বোধহয় তিনি ফুলের গল্প, গাছপালার গল্প বলে চিন্তার একটা রকম বা পরিমণ্ডল গড়ে কাঁচা কাঁচা কথার আদলে জীবনের একটা কনসোলেশন খুঁজে দিতে চাইতেন। ভাষার চমকপ্রদ বাক্যবন্ধে গুরুতর সেক্স নিয়েও আলোচনা করতেন। মানুষটা একারণেও আমার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কখনও অশ্লীল কথা বলতেন না। আবার শিরিনকে যে ভালোবাসেন সে-ইচ্ছেও কখনও ধরতে দিতেন না। উনি যখন চলে যেতেন, শিরিন বড়ো কাহিল হয়ে পড়তেন। তার কথার একটা ম্যাজিক-এফেক্ট ছিল। কিন্তু তখন ধরতে পারিনি, ফিমেল লিব বলে কথাটা যে উনি বলে গেলেন, বললেন, লাজুকতা নয়, লিলি বিদ্বেষ, দৃঢ়তা, তার বিদ্রোহ, সবই একজনের অন্তরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া এনে দিয়েছিল।

.

বাবা যেদিন শিরিনের ঘরে ঢুকতেন তাহাজ্জুদের নামাজশেষে, সে রাত ছিল অত্যন্ত পাশবিক। শিরিন কাঁদতেন। মনে হত, শিরিনের গায়ে জোর করে কে যেন সুঁচ ফুটিয়ে দিচ্ছে। এক ধরনের বোবা কান্না শোনা যেত। ধর্ষণের সময় মেয়েরা বোধহয় অমনি করে কাঁদে। মাঝে-মাঝে পশুর মতন গোঁঙাতেন শিরিন। মা কেবল কপালে করাঘাত করে বলতেন—মেয়েটাকে শেষ করে দিলে হাজী। মেরে ফেললে গো।

আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতাম, কিন্তু শিরিন চাইতেন ফুল ফোটাতে, পারতেন না। একদিন বললেন—আমি পারব না, মিনু। আমি পাগল হয়ে যাব।

-কেন পারবে না খালামা? তোমায় পারতেই হবে।

—না, মিনু। হয় না। সাদিক আমার সব ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছে। ওই গাছ আমায় মৃত্যুর কথা বলে। সমাজ আমাকে অভিশাপ দেয়, আমি কোথায় যাব? আমি দেখেছিলাম, শিরিনের কনট্রাডিকশন সাদিকের ক্যাটেগরি অব থ-এর মধ্য থেকে সংক্রামিত। লিলির বিদ্বেষ এবং বউলের প্রার্থনা একসাথে মেলে না। লোকটিকে আমার ভয়ও হয়েছিল। তাঁর সফিসটিকেশন, একটা মায়াজড়ানো জাল, বিভ্রান্ত দর্শনের ছায়া, পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধের মিশেল, যা মানুষকে সাময়িক মুগ্ধতা এবং সান্ত্বনা দেয়। আখেরে কোথায় টানে কে জানে। পরে একথা আমার কাছে আরো স্পষ্ট হয়েছিল।

পাঁচ

শিরিন-মাসির কথা বলতে গেলে আমায় অনেক টুকরো-টুকরো দৃশ্যের আশ্রয় নিতে হয়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে মাসির সাথে সিনেমায় যাওয়ার প্রোগ্রাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম, মাসি কোলের ওপর বোরকা ধরে উদাসীন চেয়ে আছেন জানালার শূন্যতায়। সেজেছেন মাসি। কানে দুল। পায়ে আলতা। নাকে সাদা পাথরের ফুল। গলায় চিকনহার। তার ওপর এখন বোরকা চাপাতে হবে। শাড়িখানাও বেনারসি। সব বৃথা। সব সৌন্দর্য অন্ধকারে ঢাকতে হবে। দেখে বড্ড মায়া হচ্ছিল। অথচ আমার বেলা বোরকার কোনো আবশ্যকতা নেই। এর কারণ বুঝতে পারতাম। একদিন নিশিপিসির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম সবাই মিলে। বাবাও সাথে ছিলেন। সাধারণত আত্মীয়ের খানাপিনাতেও শিরিনকে সাথে নেওয়া হত না। বাড়িতে এক বুড়ি দাসীর হেফাজতে তাঁকে রেখে যাওয়া হত। সেদিন কী মনে করে ওঁকেও নেওয়া হয়েছিল। বাসে যাচ্ছি আমরা। আমরা বসেছি মেয়েদের আসনে। শিরিন আছেন সব-শেষ প্রান্তে একজন মহিলার পাশে। কিছুক্ষণ বাস চলার পর পাশের মহিলা বোরকার পাশে থেকে উঠে স্টপে নামলেন। জায়গাটা খালি ছিল বলে একজন পুরুষ শিরিনের পাশে বসে পড়লেন। সাথে সাথে বাবা পুরুষ-আসন ছেড়ে উঠে এসে লোকটিকে বললেন—আপনি যান, আমার সিটে গিয়ে বসুন। লোকটি বেকুফ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—ঠিক আছে, আমি আর বসব না। লোকটি রড ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাবা শিরিনের পাশে আগলে জেঁকে বসলেন। আমার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। আমার ছোটো ভাই বেশ বড়ো হয়েও মায়ের দুধ খেত বলে বাবার নির্দেশ ছিল, দুধ খাওয়ানোর সময় বাচ্চার দুহাত পেছনে যেন দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। নইলে ছেলে মায়ের বুকে হাত দেবে। এই দৃশ্য শিরিনও দেখেছেন। প্রথম যেদিন দেখেন সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়েছিল তাঁর। অস্ফুট বলেছিলেন—হায়! কী নিষ্ঠুর! দুধের বাছাও মায়ের শরীর স্পর্শ করতে পায় না। এ কোথায় এলাম আমি? এ তোমরা কোথায় পাঠালে, মা! ভাইয়া গো! এ কোন্ দুনিয়া,!

শিরিন-মাসি বোরকা-কোলে বসে ছিলেন। আমায় দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। নিঃশব্দ সেই কান্না। কোনো শব্দ নেই, একটু অনুকার অব্দি। খানিক পর শক্ত হয়ে বললেন— আমি যাব না, মিনু। তুমি একা যাও।

বলে উনি কানের দুল খুলে ফেললেন ড্রেসিং টেবিলের বড়ো কাঁচের আয়নার সামনে টুলে বসে। গলার হার শাড়ি ইত্যাদি সবই খুলতে থাকলেন। আজও সেই দৃশ্য মনে ভাসে। আজও শিরিনের কান্না আমি দেখতে পাই।

ছয়

মাঝে একদিন আবার সাদিকুল এসেছিলেন। বাবা ধর্মপ্রচারে বেরিয়েছিলেন সেই সময়। অনেক রাতে উঠে টিফিন ক্যারিয়ার ভরতি করে টিন ভরতি করে খাবার তৈরি করতে হয়েছিল শিরিনকে। বাবা শিরিনের তৈরি খাবার ছাড়া নেবেন না। শিরিন অসহ্য হয়ে উঠতেন। পাঁচ বেলা নামাজ পড়তে চাইতেন না। তা নিয়েও বাড়িতে বাবার সাথে অশান্তি। অবশ্য আমি ছাত্রী বলে সবকিছুরই বাইরে থাকার অধিকার ছিল আমার। যাই হোক। বাবা কোন্ এক পীরের কাছেও গিয়েছিলেন সেবার। লীগের লোকেরা বাড়িতে এসে বাবাকে না পেয়ে মন খারাপ করেছিলেন। রাত্রিভর ওঁরা আলোচনা করেন। ঘন ঘন চা দিতে হয়। খাবার দিতে হয়। সবই দিতে হয় শিরিনকে রাত্রি জেগে। বোরকা খুলতে হয়, আর পরতে হয়। শিরিন দম বন্ধ করে কেবলই বলেন, মাই লাইফ ইজ হেল। জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। কী করে হাসি, মিনু?

শিরিনকে মাঝে-মাঝে বাবাকে পুঁথি পড়ে শোনাতে হত—আহারে দুলদুলি ঘোড়া, জোর করো থোড়া-থোড়া, যেতে হবে টুঙ্গির শহর। সেই কথাগুলো আবৃত্তি করে শিরিন আপন মনে বলে উঠতেন, কিন্তু কোথায় যাব আমি? সেই সময় সাদিকুল এলেন। তাঁকে দেখেই শিরিনের প্রথম প্রশ্ন—ফিমেল লিবটা আমি বুঝতে পারিনি। আর-একবার বুঝিয়ে বলবেন?

সাদিক বললেন—মিনু বরং ওদিকে যাক।

-কেন? ও-ও শুনে রাখুক। কাজ দেবে। অবশ্য সাবধানে বলবেন।

—আমি কি অসাবধানে কিছু বলেছি কখনও? সাদিকুল চোখ বিস্ফারিত করে হাসলেন। শিরিন বললেন—না না, তা কেন? তবে কিনা; আরো বেশি সন্তর্পণে, সতর্ক আর সজাগ হয়ে শুনতে চাইছি তো!

আমি শুধালাম—এইসব কথা শুনে তুমি কী করবে খালামা? জ্ঞান মানুষকে দুঃখ দেয় জান না?

শিরিন বললেন—আমি যে দুঃখই চাই, মিনু। জেনে দুঃখ পাওয়াও আনন্দের। না জেনে কেবল তারাই সুখী হয়, যাদের মস্তিষ্ক মানুষের নয়।

-বাঃ চমৎকার বলেছেন। আমি বলি, নলেজ ইজ পাওয়ার। বললেন সাদিক। শিরিন তখন হঠাৎ করে প্রস্তাব করলেন—চলো আমরা ছাতে যাই। চৈত্রের বিকাল। ভালো লাগবে। তিনখানা বেতের মোড়া নিলেই চলবে। কী বলেন? বাইরে রাস্তায় আইসক্রীম হেঁকে যাছিল—বললাম—চট করে নিয়ে আসি। খেতে-খেতে গল্প করা যাবে। বলেই আমি নীচে নেমে আইসক্রীম নিয়ে ছাতে উঠলাম। খেতে গিয়ে ছেলেমানুষের মতন তিনজনেরই খুব হাসি পাচ্ছিল। শিরিন মুগ্ধ হয়ে সাদিকের চোখে কিসের ভাব বিনিময় করতে চাইছিলেন। আমি লক্ষ করেছি। চৈত্রের শেষ বিকালের আলো আমাদের গায়ে এসে লাগছিল, একটু মিষ্টি হিম লেগেছিল বাতাসে। মা একবার ছাতে উঠে এসেছিলেন। মাকে বললাম—তুমি একটা আইস খাবে, মা? মা মিঠে হেসে বললেন—তোমরাই খাও, বাছা। সবই তোমাদের ছেলেমানুষি। নেহাত আজ তোমাদের বাপজান নেই।

বলতে-বলতে মা নীচে চলে গেলেন। তখন কথা শুরু হল। আমি কিছুক্ষণ বসে শোনার পর মোড়া ছেড়ে ছাতের অন্যপ্রান্তে সরে এসে পায়চারি করে ঘুরতে লাগলাম। সব কথা আমার শোনা উচিত নয়। মাসির যৌন-জীবনের কিছু সমস্যা আছে বুঝতে পারতাম। সাদিক কথা বলে যাচ্ছিলেন, বারবার আমারও কান উৎকর্ণ হচ্ছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম উনি বলছেন, মানুষের সমাজবিকাশের সাথে-সাথে মানুষের সেক্সুয়াল লাইফ কীভাবে স্তরে স্তরে উন্নত হয়ে কীভাবে সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। সেটা এখন অনুভূতির এক অতি সূক্ষ্ম স্তরে একটা আর্টিসটিক অ্যাপ্রোচ, লাইফ অ্যাপ্রোচ তৈরি করেছে। পশুত্বের পর্যায়ে মানুষের সেক্স পড়ে নেই। নারী-পুরুষের এই সম্পর্ক শুধু দেহগত নয়, তার অনেকখানিই মানসিক।

শুনতে-শুনতে শিরিনের মধ্যে যৌন-জীবনের এক সুন্দর আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। সেটা নিবারণ করবে কে? সাদিকুল বলছিলেন—শুনেছি অনেক পুরুষের মধ্যে একটা পাশবিক খাই-খাই ভাব থাকে। নারীর দেহ পেলেই তাদের জিভ কুকুরের মতন ঝুলে পড়ে। এসবই শোনা কথা। আবার এমন মানুষ ও আছে, যার স্পর্শ অবধি খুব আর্টিসটিক। সবটাই নির্ভর করছে নারীপুরুষের রুচি-অনুভূতির একটা সমান তরঙ্গের ওপর। আমি বই-পড়া কথা বলছি কিন্তু। আপনিই হয়তো ভালো বুঝবেন। এখন কথা হল, কার যে লাজুকলতায় আসক্তি এবং কার লিলির মেরুদণ্ডে মুগ্ধতা, সেটাই প্রশ্ন। মেয়েদের দেখবেন, হাঁটাচলার মধ্যে, বসার মধ্যে একটা কেমন শরীর গোপন করার ব্যস্ততা, চোখ যেন নিজেরই দিকে, এটা ইংরাজ মহিলার হয় না। কারণ বহুকিছু। ওখানেও সেক্স-এর আপীল থাকে। কোনোটা সামন্ততান্ত্রিক, কোনোটি গণতান্ত্রিক ভ্যালুজ থেকে আসে। মেয়েদের চলার ছন্দেও ঢলানি থাকে। থাকে একটা দৃপ্ত ভাব। তা আমি বলছিলাম, আপনাকে সব জেনেও মানিয়ে চলতে হবে। ফুল ফোটানোই আপনার কাজ। আমি উঠব।

.

আমি লক্ষ করলাম, মাসি হতভম্ব হয়ে গেছেন। ওঁরা নেমে পড়ছেন আগে-আগে, আমায় ওঁরা লক্ষই করেননি। পেছনে আমি। সব আগে সাদিকুল। অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। সিঁড়িতে ওদের দেখা যাচ্ছে খুবই অস্পষ্ট। ছাতের সিঁড়ি বলে একটা জায়গা খুবই অন্ধকার। মাসি একটা বড়ো রকম ঝাঁপ দিয়ে টপকে নামলেন সাদিকের সিঁড়িতে। বোধহয় সাদিককে স্পর্শ করলেন। সাদিক বললেন—শুনেছি মানুষের একটি চুম্বনের পরমায়ু সারা জীবনের সমান। কী জানি, কথাটার কী মানে? তুমি জান শিরিন?

শিরিন বললেন—তুমি আমায় দেবে?

-কি দেব তোমায়?

-ওই যে বললেন সারা জীবনের সমান যার পরমায়ু?

–না, শিরিন। এই অবস্থায় ওটা বড্ড ছেলেমানুষি হবে। তুমি ঘরের বউ। আমি ভ্যাগাবনড। আমার কাছে কথা ছাড়া কিছুই চেও না।

ওই অন্ধকারেই সাদিক সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন। আমি পিছু হটে ছাতে ফিরে এসেছিলাম। জোর হাওয়া দিচ্ছিল ছাতে। পাতলা একফালি চাঁদ ছিল সন্ধ্যায়। হাতে ঘুরতে-ঘুরতে আমার বুক খালি হয়ে গিয়েছিল। স্বল্পশিক্ষিতা, কিন্তু প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়েটি সাদিকুলের চিন্তার দান গ্রহণ করে করে মনের একটি এমনই গড়ন তৈরি করে নিয়েছিলেন যে আমাদের সংসার তাঁর পক্ষে কারাগার হয়ে উঠেছিল।

সাত

সেদিনও রাত্রে বাবা মাসির ঘরে ঢুকেছিলেন। সেই চাপা ক্রুদ্ধ ভয়ার্ত চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। আমি মানুষের যৌন-জীবনের কোনো বিকৃতির কী রহস্য জানি না। মাসি কেন চিৎকার করেন, জানতাম না। কেবলই বুকটা শুকিয়ে যেত। এই অসহনীয় ঘটনা বাবার সম্পর্কেও আমায় বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল। বাবা বরাবর মাসিকে তাঁর ভুক্তাবশেষ খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। থালায় খেতে-খেতে কিছু অবশেষ রেখে দিয়ে বলতেন, তুমি খেও, শিরিন। মাসি সেই থালা উঠিয়ে এনে গোরুর নাদায় ফেলে দিতেন দেখেছি। একবার আমারই চোখের সামনে পেঁপের ফালি কুকুরের মুখে ফেলে দিলেন। কুকুর পেঁপে খায় না। শুঁকে দেখল। খেল না। উঠোনে পেঁপের ফালি পড়ে রইল। তা নিয়ে বাবা মাসির ওপর অনেক তম্বি করেছিলেন। মারতেও কসুর করেন নি। বাবার বয়েস হয়েছিল। মাসিকে মারার পর ঘেমে নেয়ে উঠলেন। ধুঁকতে লাগলেন। মাসিকে হাতপাখার ডাঁটি দিয়ে পেটালেন। মাসির গায়ে কালশিটে রক্তাক্ত দাগ হয়েছিল। বাবা মারার পর চেয়ারে বসে ঘন-ঘন পাখা নেড়ে নিজেকে হাওয়া দিচ্ছিলেন আর ধোঁকাতে-ধোঁকাতে বলছিলেন—টাকায় ষোলোটা মেয়ে। একটা ফাউ। মনে রেখো। আলাউদ্দিন খিলজির আমলে তিনটি ছাগল বেচে একটা মেয়ে খরিদ করা যেত হাট থেকে। একটা ছাগল তিন টাকা। একটা মেয়ে ন-টাকা। আমি তোমাকে পাঁচ বিঘে জমি দিয়ে কিনেছি। শহরের মাটি দিয়েছি। মেড়োরা সেখানে বাড়ি বানিয়ে ব্যবসা করছে। শুনছি লস খেয়েছে বলে আড়ত তুলে দিয়ে দেশে চলে যাবে। তখন সেই বাড়ি তোমারই। এত সুখ কে দেয়? আরবের শেখেরা হলে তোমার মতন কসবিকে এই হাটে কিনে ওই হাটে তালাক দিত। তখন তিন টাকাতেও তোমায় কেউ কিনত না। তা বলে, আমি তোমাকে সাদিকের হাতে ফাউ-তোলা দিতে পারি না। শালা যে লোভে-লোভে আসে, সব মতলব চিনি। তবে কিনা, জালি ছোকরা বলে মাপ পেয়ে যাচ্ছে। ঘরের বউ পরপুরুষের সাথে এত কথা কিসের বলে? বাবা আড়ালে সাদিককে এই ধারা বলতেন। সামনে পেলে আরব মুলুকের গল্প করতেন, কাফেরদের কেচ্ছা শোনাতেন। ইব্রাহিমের পাথর মক্কায় রয়েছে। নাম হাজারে আসুয়াদ। তাতে হাজীরা চুমু দেয়। এতই তার আকর্ষণ, মুখ তুলতে ইচ্ছে হয় না। এতই তার টান। দুই ঠোঁট শক্ত আঠার মতন লেগে যায়। বুঝলে সাদিক, সংসারটাই এইরকম। ছোটো বউ হল সেই হাজারে আসুয়াদ। টেনে ধরে আছে। ছাড়ে না। ছাড়াতে পারি না। হেঃ হেঃ! সবই খোদার কুদরত। মেয়েরা হল, তোমাদের ইংরাজি ভাষায়, ম্যাজিক-স্টোন। হাজারে আসুয়াদ। তাই কিনা?

বাবার কথা শুনে সাদিক নিজেকে কাহিল করে হাসতেন। বলতেন—শুনেছি, হাজীরা যখন ঐ পাষাণে পাগলের মতন চুমু খায়, ছাড়তে চায় না, তখন পুলিশ ওদের জোর করে তুলে দেয়। গুঁতোয়। গলায় ধাক্কা দিয়ে তোলে। ভেরি ডিসটারবিং।

–ঠিক বলেছ সাদিক। মোক্ষম কথা।

—আমি তবে সেই পুলিশ।

-অ্যাঁ! হ্যাঁ হ্যাঁ তাই।

বলেই দুজন চোখাচোখি চোখ মটকে হাসতেন। আমারও মনে হয়, আমাদের সংসারের সাদিকুল সত্যিই ডিসটারবিং এলিমেনট। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য।

সেই রাতেও ধীরে-ধীরে একসময় কান্না স্তিমিত হয়। তারপর সব ঠাণ্ডা। তারও কিছু পরে পড়া ছেড়ে মায়ের ঘরের দিকে জল খাওয়ার জন্য গিয়ে দেখি মেঝেয় ওরা বসে। মা আর মাসি। মাসির শাড়ি এলোমেলো। চোখ মুখ থমথমে। যেন সর্বাঙ্গে ঝড় বহেছে। গালে গলায় আঁচড়। আমি বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মাসি বলছেন—আমাদের নিম্নাঙ্গের যে নারী-চিহ্ন, তোমায় বলি বুবু, ওটা একটা কদর্য কুৎসিত জন্ম-দাগ। আমার কোনো রোমাঞ্চ নেই, বুবু। আনন্দ পাই না। কেন বুড়ো আমায় জ্বালাতন করে! একজন গোঁড়া সাম্প্রদায়িক লোক, আমায় গমন করুক, আমি চাই না। খাব-দাব আর রস বিলোব, আমি পারব না। আমার ঘেন্না করে। আমার ঘরে বুড়ো কেন খোমেইনির ফটো টানিয়েছে? ওই তছবির দেখে কখনও নামাজ হয়? আমায় সেদিন নজরুলের ফটো টানাতে দিলে না। কেন? বলো? গাছে ফল হয় না বলে আমায় দোষী করা কেন? ওই গাছ যেমন ভয় পায়, আমিও পাই। যেদিন বুড়ো আমায় প্রথম ছুঁয়েছে, সেইদিন থেকেই আমার ভয়ের শুরু, বুবু। এই ব্যাপারটা দুনিয়ার কেউ বুঝবে না।

বলতে-বলতে মাসি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন।

.

বাবার কড়া নামাজি গলা শোনা যাচ্ছিল। তখনও ঘুমের জড়িমা জড়িয়ে আছে চোখে। কে যেন বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। আমি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এলাম। অন্ধকারে দাঁড়ালাম চুপচাপ। মাসিই কাঁদছে। কোথা থেকে খানিকটা আলো মাসির কুণ্ডলী-পাকানো দেহে এসে পৌঁচেছে। মাসি বারান্দায় পড়ে আছে। লুটিয়ে পড়েছে। কী হল আজ? আজ কি অন্যরকম কিছু? বাবার নামাজ শেষ হল। বাবা জায়নামাজ গুটিয়ে রাখলেন চাঙ্গারিতে বারান্দার। মায়ের ঘরে এলেন। মাকে বাবার সেই খাদালো নরম তুলোর ভেজা-ভেজা গলায় বললেন—কুলসম! যা হবার হল। কেউ যেন না শোনে। মুখ ফসকে গেছে। তুমি তাবৎ জিন্দেগি এই ঘটনা চেপে থেকো। যদি কখনও ফাঁস হয়, তুমিও রেহায় পাবে না। আগাম এক তালাক তোমায় দিয়ে রাখলাম।

এইটুকু বলেই বাবা নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। মাসি বারান্দায় পড়ে রইলেন। কাঁদতে লাগলেন, অনেক রাতে একলা অন্ধকারে শিরিন কখন এই সংসার ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন, আমরা জানি না।

আট

শিরিনের কোন খবর ছিল না কিছুদিন। বাবা খোঁজ করে জানলেন শিরিন ওঁর বড়ো ভাইয়ের কাছে রয়েছেন। বড়োভাই কোর্টের মুহুরি। ধাত-কড়া মানুষ। হাজীর সাথে বোনের বিয়ে দিয়ে তাঁর কিছু আফশোস ছিল। বাবা ভরসা করে সেখানে যেতে পারলেন না। মাকে পাঠালেন। মা বহু সাধাসাধি করেও শিরিনকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। মা এসে বাবাকে বললেন—আমাকে কেন পাঠাচ্ছ তুমি? আমি কী করতে পারি?

আমি মাকে প্রশ্ন করলাম—শিরিনখালামাকে কেন তুমি অমন করে ফিরিয়ে আনতে চাইছ, মা?

মা বললেন—তোর বাপের জন্য, মিনু। তুই তো দেখেছিস, তোর বাপ কেমন করছে। মন থেকে তালাক তো উনি দেননি।

আমি বললাম—মন থেকে তালাক কজনই বা দেয়?

মা বললেন—ওটাই পুরুষের ধর্ম।

বললাম—পুরুষ বোলো না। বলো মুসলমানের দাপ।

মা চুপ করে রইলেন। বাবা মাকে আবার পাঠালেন বউতলির রজব মুহুরির কাছে। মা বিরস মুখে ফিরলেন। অসহায় শিশুর মতন বাবা একটা মন-পাগলামির আব্দার ধরে মায়ের আঁচলের তলায় ফিরতে লাগলেন। দুজন পাশাপাশি বসে কেবলই মনস্তাপ করছেন বলে মনে হত। দেখতে-দেখতে একটা বছর গড়িয়ে গেল। আমি মাধ্যমিকের ফাইনাল দেবার জন্য শহরের বাড়িতে এলাম। মাকেও সাথে বেঁধে আনলাম। মা দিনে-দিনে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিলেন। পরীক্ষার সময়টায় একজন অঙ্কের গৃহশিক্ষক দরকার ছিল। আমার এক শহুরে বন্ধু আমায় একদিন একটা চমৎকার খবর বহে এনে বললে—ঘরে এসে পড়িয়ে যাবে, আমি তোমাকে তেমনি একজন শিক্ষিকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এবং ভদ্রমহিলা মুসলমান। ওঁরা এই শহরে একটি টিউটোরিয়াল হোম খুলেছেন। ওখানকার প্রধান শিক্ষকের নাম সাদিকুল খান। ভালোমানুষ। দারুণ ইংরাজি, ইতিহাস পড়ান। সপ্তাহে তিনদিন করে ছয়দিন দুজনে পড়াবেন। লোকটি একটু খ্যাপাটে গোছের। সে যাই হোক, পড়া নিয়ে কথা। তুমি যদি পড় শিওর ফার্স্ট ডিভিশন পাবে। শহরে সবার মুখে-মুখে নাম। হোমে গিয়েও পড়তে পার। বাড়িতে এলে ফী একটু বেশি, প্রায় দুই-তিন গুণ। তা-ও আগেভাগে না বললে, আসবেন না। আমি চেষ্টা করব? আমি রোজই তো হোমে যাই।

বন্ধুটিকে মুখে কিছু না বলে চুপচাপ পোশাক পালটে মুখে একটু ক্রীম ঘসে মায়ের কাছে গেলাম। তখন সকাল দশটা বেজে গেছে। বললাম—মা, আমরা একটু সাদিকমামার কাছে যাচ্ছি।

মা তো অবাক। বললেন—সাদিক মামা! কোথায় থাকে ছেলেটা?

–এখানে, এই শহরেই থাকেন। ছেলেমেয়েদের পড়ান। আমি ওর কাছে একটু ইংরাজিটা দেখিয়ে নোব।

—বেশ যাও। ওকে জিয়াফত করে এসো। বলবে, মা ডেকেছে। ওর সাথে পরামর্শ আছে।

শুধালাম—খালামার কথা তুলবে নাকি? ওসব তুলো না।

মা বললেন—বিপদের সময় আত্মীয়ের পরামর্শ নিতে হয়। সাদিক যদি চেষ্টা করে শিরিন ফিরতেও পারে। আমি ওকে বউতলি পাঠাব।

আমার খুব রাগ হচ্ছিল। বন্ধুর সামনে নিজেকে সংযত করে বললাম—যা করবে আমার পরীক্ষার পর করবে। নইলে ফেল করলে আমার দোষ দিও না।

মা বললেন—বেশ-বেশ, তাই হবে। তুমি এখন যাও।

বন্ধুর সাথে রাস্তায় নেমেই মনে হল, মা শিরিনের দুর্বল জায়গাটা বোঝেন। ঘটনার পরিণাম ভাবতে গিয়ে আমার মাথা ঘুরছিল। বন্ধু পাশে থেকে অবাক গলায় শুধাল—মাস্টারমশাই তোর মামা বুঝি? তোর কী ভাগ্য! ভদ্রলোকের প্রফেসর হওয়া উচিত ছিল।

আমরা একটা রিকশা করে মামার ছোটো বাড়ির কাছাকাছি এসে থামলাম। বন্ধুটি রিকশা থেকে না নেমে বলল—আমি স্যরের সামনে যাব না, মিনু। বকবেন। বাঘের মতন করে চোখ পাকিয়ে বলবেন—রাস্তায় এতক্ষণ খোলামকুচি দিয়ে এককা দোককা খেলছিলে বুঝি? তুমি ভাই একলা যাও, তোমারই তো মামা।

বন্ধু কিছুতেই যেতে চাইল না। রিকশা ছেড়ে দিল। অগত্যা একাই আমি। এক বছরেরও বেশি সময় সাদিকমামা আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। ছোটো বাড়ি। পাশে প্রকাণ্ড ডোবা। ডোবার ওপারে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের ওধারে কমার্স কলেজ। তার ঠিক উলটো উত্তরে জলঙ্গী বাস স্ট্যান্ড। একখানা মাত্র ঘর। নীচু ছাদ। প্রাকৃতিক ক্রিয়া কোথায় করেন, স্নান খাওয়া? ঘরে তালা বন্ধ। ফিরে আসছিলাম। এমন সময় দেখি পাকা সড়ক ধরে মামা এদিকেই এসে গলিতে ঢুকলেন। পাঁচ মিনিট পর মুখোমুখি। দেখেই সোৎসাহে বললেন—ইউ সুইট লেডি, কাম ফ্রম মুন। গতকাল পূর্ণিমার চাঁদের দিকে চেয়ে তোমায় মনে পড়ছিল।’ ভালো আছ?

সেই সাদিক মামা। ভীষণ রোমান্টিক ভদ্রলোক। কথায় কথায় যিনি গল্প ফাঁদতে পারেন। যাঁকে আমার ভীষণ ভয়ও করে। অথৈ একটা মানুষ। আমাদের মনে করেন খুকি। এই প্রথম তাঁর মুখে লেডি কথাটা শুনলাম। বুঝলাম, আমি বড়ো হয়েছি। মামা তালা খুললেন। ডাকলেন—এসো। মামার মুখে প্রচুর দাড়ি গজিয়েছে। গোঁফে আচ্ছাদিত মুখ। যেন এক ইংরেজ কবি। দুই চোখ উন্মনা। চোখে এখন চশমা নেই। ছোটো একখানা চৌকি। অতিশয় ছোটো টেবিল। ক্ষুদ্র শেলফ-এ কিছু বই। দেয়ালে ঝুল-লাগা রবীন্দ্রনাথ। বিছানার চাদরটা আধ-ময়লা হয়েছে। দড়িতে জড়ো করে ঝোলানো একটি সাদা জামা আর পানজাবি। চৌকির তলায় একটা টিনের বাকস। একটা স্টোভ। বোঝাই যাচ্ছে, উনি হোটেলে খান। সরকারি রাস্তার ট্যাপ থেকে বালতি করে জল এনে রঙিন মগে স্নান করেন। গোলাপি তোয়ালে আর টুথব্রাশ আছে। সাবান-কৌটোয় শস্তা সাবান। সিনেমাতারকাদের প্রিয়। ব্যস। এই হচ্ছে একটি মানুষের আস্তানা। এত বড়ো মানুষটার এই হাল! কখনও জীবনে চাকরির চেষ্টা করলেন না। রাজনীতি করেন এমনই যে সেই রাজনীতি জীবনে কখনও তাঁর প্রতিষ্ঠা দিতে পারে না। প্রতিষ্ঠা মানে, চাকরি বাকরি ইত্যাদি। চৌকিতে বসে বললাম—আমি আমার বন্ধুর কাছে খবর পেয়ে আপনার কাছে এলাম। সামনে আমার পরীক্ষা। আমায় ইংরাজিটা একটু দেখিয়ে দেবেন? শুনলাম, আপনার হোমে একজন মুসলিম শিক্ষিকা ভালো অঙ্ক করান। একটু বলে দিন না, উনি আমায় পড়িয়ে আসবেন। তারপরেই বললাম—আপনি কেমন আছেন?

উনি বললেন—আই অ্যাম অলওয়েজ ইন ফ্লেবার। চায়ের অনুষঙ্গে মেশানো এই ইংরাজি তাঁর নিজস্ব। একটু থেমে বললেন—তোমাদের দেখতে পাই না, এই যা দুঃখ।

শুধালাম—আপনি আর গাঁয়ে যান না কেন?

—সময় হয় না। তা ছাড়া হোমটা চালাচ্ছি। চারজন শিক্ষক। সবাই আমার মতন আঁটকুঁড়ে হতভাগ্য। আমার আরো ছাত্রছাত্রী দরকার। সব স্টুডেন্টদের বলছি, ওরা ওদের বন্ধুদের আমার হোমে নিয়ে আসুক। বেশ, তুমি পড়বে বই কি। আমি সময় পাব না। পড়তে হলে হোমে আসতে হবে। তবে মহিলাটি তোমার বাড়িতে গিয়েই পড়িয়ে আসবে।

—আপনি না পড়ান, মায়ের কাছে একবার দেখা করতে…

-হ্যাঁ। অবশ্যই। যাব। উনি কি এখানেই আছেন?

-আমাদের এখানেই বোধহয় পারমানেনট থাকতে হবে। গোলোকবাবুরা যাচ্ছেতাই করছে। বাচ্চা-বাচ্চা হিন্দু ছেলেদের ট্রেনিং দিচ্ছে। সকাল বেলা আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল করে যায়। বাবাও খুব ভয় পাচ্ছেন। আমাদের শহরে এসে থাকাই ভালো। অন্তত কিছুদিন।

সাদিকমামা বললেন—তোমরা শিরিনের কোনো খোঁজ নিয়েছিলে?

—নিয়েছি। মা শিরিনকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। উনি আসেন নি।

-তোমরা ওকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন?

—আব্বাজী চাইছেন, শিরিন ফিরে আসুক।

-কেন?

বলেই মামা কেমন একধারা হেসে ফেলে বললেন—বুঝেছি। কিন্তু ও-যদি সত্যিই না ফেরে, তোমরা কী করবে?

আমি বললাম—না ফেরাই উচিত। কলাগাছ একবার কেটে ফেললে, তাতে আর কোনো কাজ হয় না। নতুন করে ট্যাঁক গজাতে হয়। মা বলেন, মেয়েরা কলাগাছ। ঠিকই বলেন। তবু কেন যে মা—

—বলো।

–না। থাক। আপনি একবার মায়ের সাথে দেখা করুন। যাচ্ছেন তো? মা আপনাকে আজ রাতে নেমন্তন্ন করেছেন।

– আজ?

-কেন? কোনো প্রোগ্রাম?

-না। ঠিক আছে। যাব। –আমি তবে উঠছি।

—হ্যাঁ। এসো।

আমি চলে এলাম। সন্ধ্যায় সাদিকুল এলেন। মা ওঁকে চানা মাখিয়ে মুড়ি আর তেলেভাজা বড়ো বাটিতে এগিয়ে দিয়ে বললেন— তোমার সাথে আমার বড্ড জরুরি দরকার, সাদিক।

মামা বললেন—জানি।

মা বললেন—জানবে বৈকি। শুনেছি, ওই তালাক শুনলে নবীর রেহেল কেঁপে যেত। আল্লার আরশ কুর্সি (সিংহাসন), সাত তবক (স্তর) আশমান থরথর করে কেঁপে যায় ভাই রে। তবু বে-আক্কেলে বুড়ো ওই নোংরা কথা মুখে আনলে। ওকে তোমরা ক্ষমা করে দাও।

মামা মুড়ি চিবিয়ে যাচ্ছিলেন। দ্রুত চিবিয়ে ফেলে জল খেলেন। সব মুড়ি খেলেন না। বললেন——চা খাব, বুবু

মা বললেন—চা হচ্ছে তোমার জন্যে। আগে একগেলাস দুধ আর মণ্ডা খাও। সাগরপাড়ার মণ্ডা। তুমি আমার অতিথি। মেহমান।

-উদ্দেশ্য?

হঠাৎ মামার কথা আমিও বুঝতে পারলাম না। মামা তখন ভেঙে বললেন—এত মেহমানি আদরের বহর কেন বুবু? রফা? আপস-রফা? ওকালতি? আমি শিরিনকে বুঝিয়ে তোমার সংসারে ফিরিয়ে দেব? আমি ফিরিয়ে দিতে পারি, এটা তোমার মনে হচ্ছে কেন?

মা ঠাণ্ডা গলাতেই বললেন—কেন মনে হচ্ছে, সেটা মনেই থাক সাদিক। ভেঙো না। আমি সবকিছুর সাক্ষী। আমি তো ছেলেমানুষ নই। বিদ্যে নেই। কিন্তু বুদ্ধি তো ছিল, ভাই।

মামা মণ্ডা খেতে-খেতে বললেন—কিন্তু সবই তো একজনের ব্যক্তিগত অভিরুচি, পারসোনাল অ্যাফেয়ার, ডিসিশন, বুবু। ও এই শহরেই আছে। ওকেই কনভিন্স কর না কেন। আমি আজই ওর সাথে দেখা করে ওকে তোমার কথা বলে দিচ্ছি।…বুবু বুঝবেন কিনা সেদিকে কোনো খেয়ালই ছিল না। ইংরাজি মিশিয়ে, বলার ঝোঁকে বলে, মামা তাঁর কথাগুলো শেষ করলেন। তখন শিরিনখালামা এই শহরেই আছেন শুনে মা আমার চোখে কেমন রহস্য করে তাকালেন।

মা বললেন—আমি কী বোঝাব ওকে? তুমিই বোঝাও। তোমার কথা বুঝবে! আমি বুঝিয়ে পারি নি। আমি কি শিরিনকে বড়োবোনের ভালোবাসা দিইনি, সাদিক? আমার কি কোনো দাম নেই? তুমিই ওর সব হলে? এতদিনের সংসার কিছু না? সংসারে থাকতে গেলে অমন একটু হয়ই। বুড়ো তো ওকে তালাক দিতে চায়নি। বুড়োর হাল একবার চোখে দেখবে না তুমি?

মামা দুধের সাথে মণ্ডা শেষ করলেন। তারপর জল খেলেন আরো এক গেলাস। আমি এনে দিলাম। রুমালে কষ রগড়ে পকেটে রাখলেন। বললেন—কথাটা সেখানে নয়, বুবু। তালাক হাজী দিতে চাননি। কেন দিতে চাইবেন? তালাকটা শিরিনের বড়ো প্রয়োজন ছিল?

-কী বললে, প্রয়োজন ছিল?

-ছিল না? নিশ্চয় ছিল। তোমাদের খুদা ওকে আশীর্বাদ করেছেন। রাত্রে যেদিন পালিয়ে আমার কাছে এল। তার সেদিন বড়ো সুখের রাত্রি। তাবৎ দিন কী আশ্চর্য ঘুমিয়ে রইল মেয়েটা। তবু তোমার খাতির, সব ওকে বলব।

মা রাগত গলায় বললেন—কে কাকে খাতির করছে, বাছা। তুমি তোমার আপন তালে বলে চলেছ। সবই তোমার বইয়ের ভাষা, নিজের ভাষা বলতে পার না? গোদা বাঙলায় বলো, তালাকের প্রয়োজন ছিল না। ছিল তোমার। ওই চাহিদা তুমিই ওর মধ্যে খাড়া করেছ। গল্প পেলে দিন সারি, পালকি মেরে করব ফিকিরি। তোমার ফিকির কেউ ধরতে পারত না, মনে কর? আমার আর হাজীর স্নেহ তোমায় খাল কাটতে সুযোগ দিয়েছে। তার প্রতিদান দিলে এইরকম। ছিঃ, ভাবতেও ঘেন্না হয়!

—আহ্ মা! তুমি এসব কী বলছ? চুপ করো। আমি আর সইতে পারছিলাম না। মা কিন্তু থামতে চাইলেন না। বললেন—ঠিকই বলছি, মিনু। ওই ছেলে সব সর্বনাশের মূল। কত ঘরের বউয়ের চোখের পানি ঝরিয়েছে আমি জানি না? ছেলেবেলা থেকে ওর সব ইতিহাস মুখস্ত। বরাবর ওর বিয়ে-হওয়া মেয়েদের দিকে লোভ। একবার বড়ো বাড়ির ছোটো বউকে নিয়ে ছেলেবেলায় কী কেলেঙকারি না করেছে। আমিই সব নিরস্ত করেছি। এবারও শিরিনকে তোমায় ফেরত দিতে হবে। মেয়েদের চোখে যত পানি ফেলেছ তুমি, সব একদিন ওই দুইচোখ দিয়ে ঝরাতে হবে। কেন, তুমি একটা কুমারী মেয়েকে প্রেম করতে পার না? সেটা বুঝি রোচে না তোমার? চরিত্রহীন ছেলে!

সাদিকুল আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। মাকে কোনো কথা না বলে আমার হাত ধরে টানলেন। বললেন—আয়। আয় মিনু। তোর সামনেই কথা হবে। মামার গলা কাঁপছিল।

-না। না। সে কী! আমি অস্ফুট গলায় মায়ের চোখে চাইলাম। মায়ের চোখে সন্ধ্যার আলো পড়ে চকচক করছিল। মা চোখের ইশারায় সাদিকুলের সাথে যেতে বললেন। মামা এক ঝটকায় আমায় রাস্তায় টেনে এনে ফেললেন। রিকশা করলেন দ্রুত। উঠে পড়লাম। প্রায় বিশ মিনিট পর একটি গলিতে রিকশা ঢুকল। আমি চিনতে পারলাম, বাড়িটা আমাদেরই, মাড়োয়ারি পরিবার থাকত। দোতালায় উঠে কলিং বেল টিপলেন মামা। শিরিন ঘর থেকে সাড়া দিলেন—এসো। এতক্ষণে সময় হল বুঝি! তুমি কিন্তু নিজেই দুখানা, টিকিট করেছিলে, ছবিখানা মন্দ ছিল না। এলে না দেখে…

সিনেমার কথা বলছিলেন শিরিন। কথা থেমে গেল। আমরা ঘরে ঢুকে পড়েছি। আমায় দেখে ভূত দেখার ভয়। মুখ শুকিয়ে গেল। অস্ফুট বললেন—তুমি এসেছ! রিকশায় কোন কথা বলেন নি মামা। চুপচাপ গম্ভীর ছিলেন। শিরিন একখানা শাড়ি -ভাঁজ করছিলেন। সেটা আলনায় রেখে বাথরুমের দিকে চলে গেলেন। বুঝলাম, আমায় দেখে খুশি হননি। মামা একটি চেয়ারে বসে আমায় খাটে বসবার ইঙ্গিত করলেন। তারপর বললেন—দেখো মিনু, প্রবলেমটা আমাদের সবার। তুমিও কথা বলবে। মানে কনভিনস করবে। তবে তুমি বিশ্বাস করতে পার, আমি তোমার খালামার কোনো ক্ষতি করিনি। ও নিজেই এই বাড়িতে এসেছে। আমি ওর দুটি অন্নের ব্যবস্থার জন্য হোমে অঙ্কের মাস্টারি দিয়েছি। তোমাকে কাল থেকেই পড়াতে যাবে। ও তো তোমাদেরই। তবে তোমাকে আমি আমার দোষের কথাও বলব একদিন। আমি কুমারী মেয়েদের প্রেম করতে পারি না, কিন্তু শ্রদ্ধা তো চাই। ইউ হ্যাভ কাম ফ্রম মুন। তোমরা রুপালি মানবী। চন্দ্রলোকের কুসুম। তাই কিনা?

বলেই সাদিকুল আপন মনে হাসতে লাগলেন। শিরিন ঢুকলেন ঘরে। শুধালেন—তোমরা ভালো আছ মিনু?

বললাম—আব্বাজীর বুকের হাঁফটা বেড়েছে?

মামা বললেন—ওরা তোমায় আকাশ-পাতাল খুঁজছে, শিরিন। তাই মিনুকে নিয়ে এসেছি।

-কেন? আমায় খোঁজার কী আছে!

মামা বললেন—কাল থেকে মিনুকে অঙ্ক শেখাতে যাবে। বুবুও এসেছেন। বড্ড কান্নাকাটি করছেন। তোমায় যে কী ভালোবাসেন…

শিরিন ফোঁস করে উঠলেন—মিছে কথা। একদম মিছে কথা। ভালোবেসে যে লোক মানুষকে খানিক নোংরা বিষ্ঠা এগিয়ে দেয়, তার ভালোবাসাকে কী নাম দেবে? আমার কষ্টের কথা সবচেয়ে ভালো করে তাকেই বলেছি আমি। সেকথা তুমিও জান না। তারপরেও সে আমায় বোঝাতে আসে পাঁকের নাম পদ্মফুল সবচেয়ে ঘৃণার কথা কী জান? বুড়ো ওকে তালাকের ভয় দেখিয়ে আমার কাছে পাঠাচ্ছে, আর ও দিব্যি চলে আসে আমার হাত ধরতে! ওর বহিনগিরি অসহ্য।

আবার শিরিন এ ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেেেলন। বোধহয় রান্নাঘরে। খুব চমৎকার করে সাজানো এই ঘর। প্রশস্ত খাট। ভারি তোশক। ধপধপে বিছানার চাদর। সুন্দর টেবিল। প্রকাণ্ড দামি কাঠের আলমারি। সোফা। চেয়ার। সব আছে। সব পালিশকরা। মেঝেয় মোজায়েক। মাড়োয়ারি খুব পয়সা ঢেলে গড়েছিল। মাসিক ভাড়া থেকে তৈরির খরচ কাটানো হচ্ছিল। নিদেন এই বাড়িতে ওরা ভাড়া না দিয়ে পনের-বিশ বছর থাকতে পারত। যাই হোক, এখন সেই বাড়ি সম্পূর্ণ খালামা শিরিনের। আমাদের এই বাড়িতে কোনো অধিকার নেই। এখানে জীবনকে নিয়ে গুছিয়ে বসা যায়। শিরিনের চোখে জীবনের সেই ইচ্ছে দানা বেঁধে গেছে। মাসি একদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন— কোনো মেয়েই বোধহয় আবদুল মাঝি টাইপের বরের স্বপ্ন দেখে না। ছুঁচলো তার দাড়ি। গোঁফ তার কামানো। মাথা তার নেড়া। ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। রবি ঠাকুরের ইলিশ আর কচ্ছপের ডিম ধরা আবদুলের গল্প। পদ্মার মাঝি আবদুল। তোমার বাপকে দেখে আমার সেই আবদুল মাঝির আদল মনে পড়ে। তুমি কখনও জীবনে এমন বরের স্বপ্ন দেখতে পার মিনু?

কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। খুব তন্ময় হয়ে শিরিন-খালামায়ের বরের গল্প শুনতে পাচ্ছিলাম। হঠাৎ মামার কথায় অন্যমনস্কতা নষ্ট হয়ে গেল। সম্বিত পেয়ে শুনলাম, শুনলাম মামা বলছেন—— দেখলে মিনু, কেমন অবুঝ হয়ে গেছে। ও ভয় করছে, আমিও বুঝি কখন ওর শত্রুতা করব,

আমি বললাম—আমার হঠাৎ করে এখানে আসা ঠিক হয়নি সাদিকমামা। আমায় আপনি রিকশায় তুলে দিন। আমি চলে যাই।

সাদিকুল কিছুক্ষণ চুপ করে হাতের নখ খুঁটতে থাকলেন। ঘাড় গোঁজ করে রইলেন। দু-একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন অন্যমনস্ক। গভীর চিন্তা করছেন উনি। হঠাৎ বলে উঠলেন—আমার একটা দোষের জায়গা আছে। আমি শিরিনকে প্রলুব্ধ করেছি। কেন করেছি, সেটা তোমায় বলব, মিনু। একদিন নিশ্চয় জানতে পারবে। আমি চরিত্রহীন, কথাটা একদম মিথ্যে নয়। আমার পারভারশন আছে। একটা খুব নীচু রুচির প্রবৃত্তি আছে আমার মধ্যে আমি অসুস্থ।

কথা শুনে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। দেখলাম, উনি মায়ের কথায় ভীষণ দুঃখ পেয়েছেন। বললাম—এভাবে বলছেন কেন? আপনার দোষ কী ছিল? খালামাকে সাহস দিয়ে একটা পাঁক থেকে তুলে আনলেন। মানুষকে সেন্স দেয়া তো অন্যায় নয়। তাছাড়া, শুধু সেকারণেই খালামা এখানে এসেছেন, তা-ও নয়। খালামার আজকের জীবন দৈব-লব্ধ ব্যাপার। যাকে ইরাজিতে গড-গিফটেড বলে। আপনি একদিন এইরকম একটা গল্প বলেছিলেন আমাদের। ছাতের ওপর মাদুর বিছিয়ে সেই গল্প আমরা শুনেছি।

মামা খুশি হয়ে বললেন—তোমার মনে আছে? নাউ ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি এই জীবন-এর সপক্ষে এতদিন একটা স্ট্রং যুক্তি খুঁজছিলাম। গল্পটা মনেই ছিল না। সেই রাজকুমারীর গল্পটা, তাই তো?

শিরিন আবার এলেন। বললেন—দুজনে চোরের মতন কথা বলছ কেন? আমরা কারো ঘরে সিদ করিনি।

মামা মাসিকে মৃদু ধমক দিয়ে উঠলেন—তুমি এত উত্তেজিত হও কেন? সমস্যা অনেক গভীর। লঘু করে দেখা ঠিক নয়। বুবুর ধারণা, আমি, কেবল আমিই তোমাকে হাজীর সংসারে ফেরত পাঠাতে পারি।

-পার নাকি?

—বুবু বলছেন।

—বুবু যা খুশি বলুন। তুমি নিজে কী বলছ? তাড়িয়ে দেবে? ভিখিরি করে দেবে? এখন দেখছি, কথা ছাড়া সত্যিই তুমি কিছুই পার না। আমি জানতাম, বুবু তোমায় প্রেসার দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইবে। বলি নি তোমায়? এতদিনেও কোর্টে মামলাটা তুমি করলে না। আমি ওই বুবুকে আদালতে তুলব। আমার একমাত্র সাক্ষী ও। জীবনের পুরোটাই বাজি ধরেছি, সাদিক। শুধু তোমার মুখের কথায় ভুলিনি। একজন মেয়ে, একজন মেয়ের জন্য কতখানি করে, মিনু তুমি বুবুকে বলবে, সাধের বোন, পরানের পরান, বলবে বুবুকে, আমি সেই বোনের কাছে দাবি করছি, আমার আপীল, বুবু কোর্টে সত্য কথা বলুক। একটি মেয়ে, অবলা, আর-একজন জীবন-অভিজ্ঞ মেয়ের কাছে, জীবনের মুক্তি চাইছে। বুবুই আমার আদালত। হ্যাঁ সাদিক, আমি সেই আগ্নেয় জীবনপিণ্ড। দাহ ছাড়া কিছুই নেই আমার।

বলতে-বলতে শিরিনের বোধহয় মাথা ঘুরে উঠল। ধপ করে উনি সোফায় ঢলে পড়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন— তোমায় বলি। প্রার্থনা করি, কারুকে বলে দিও না, আমার বিদ্যে নেই। স্কুল ফাইনাল পাশ করা টীচার। হোমের ছাত্র-ছাত্রী কমে যাবে। দুমুঠো অন্ন পাই। আমাদের ভাতে মেরো না, মিনু। বলে উনি ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজলেন।

আমার প্রায় কান্না পেয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারছিলাম না। মাসির গা ছুঁয়ে বললাম—আমি তোমার বন্ধু ছিলাম খালামা। হয়তো কখনও কোনো ব্যাপারে তোমার অনিষ্ট আশঙ্কা করেছি, নিজে কখনও অনিষ্ট করিনি।

মাসি হঠাৎ আমার হাত দুখানি জড়িয়ে পাগলের মতন ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ চুপ-চাপ সেই কান্না গলে-গলে ঝরল। মাসি একসময় চুপ করলে আমি বললাম—আমি যাচ্ছি, খালামা।

মাসি মুখ তুললেন। বললেন—যাবে? আমি একলা থাকি। রোজ যদি একবার এসে দেখা দাও, আমার মন ভালো থাকে। এখানে এলে আমি তোমায় পড়াতে পারি। বুবুর কাছে কখনও যাব না, মিনু। যেতে বোলো না।

আমি উঠে পড়লাম। সাদিকুল কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। রাস্তায় নেমে রিকশা ডাকলেন। আমি রিকশায় উঠে পড়লাম। মামা সহসা বলে উঠলেন—আমার কথার ধার পড়ে গেছে। শিরিন নিজের মনের মতন চিন্তা করতে শিখেছে। বলেই উনি রিকশায় আমার পাশে উঠে বসলেন। রিকশা চলতে শুরু করলে বললেন—সামনেই আমি নেমে যাব। তারপর পথে-পথে অনেক রাত অব্দি একলা ঘুরে বেড়াব। পার্টি অফিস যাব একবার। রাত্রে আমি অন্ধকারের তরঙ্গ দেখতে পাই। প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে একদিন অন্ধকার ভালো লাগে। শ্রীকান্ত পড়েছ?

-হ্যাঁ।

—প্রথম পর্বের গোড়ার দিকেই কোথাও এক জায়গায় শ্রীকান্ত কবিত্ব সম্পর্কে জোর অনীহা দেখিয়ে বলছে, শ্রীকান্ত লোকটি কবিত্বের বাষ্পশূন্য একজন খাঁটি গদ্যের মতন শুকনো মানুষ। পোড়া চোখে গাছকে গাছ দেখে, পাথরকে পাথরই দেখে। মেঘকে মেঘই মনে হয় তার। মেঘের দিকে চেয়ে থেকে ঘাড় ব্যথা করে ফেলেছে, মেয়েদের মাথার একরতি চুল অব্দি দেখতে পায়নি। চাঁদের মধ্যে প্রিয়ার মুখ উদ্ভাসিত হয়নি। বড়ো বেড়ে বলেছেন শরৎবাবু। আবার সেই লোকই জীবনে একদিন শ্মশানে গিয়ে অন্ধকারের রূপ দেখে মুগ্ধ। এই দেখতে পাওয়াটাও জীবনে সব সময় হয় না। আমি যেমন অবিবাহিত মেয়েদের মধ্যে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পাই না।

-সে কী! কেন?

—ওটাই আমার দোষ, মিনু। একদিন সব বলব। কিন্তু শিরিন তেমনি এক অন্ধকার। অবধি নেই। শেষ নেই। বড্ড অবাক করে দুই চোখ টেনে রাখে।

মামা চুপ করে রইলেন। খানিক বাদে আমিও কেমন নিজেকে কোথায় নিঃসঙ্গ এক ভাবনার আবর্তে হারিয়ে ফেলেছিলাম। রিকশা কি থেমে ছিল? হঠাৎ পাশে দেখি মামা নেই। অন্ধকারে কোথায় মিশে গেছেন। বাঁ হাতে মামার সেই বিশাল অন্ধকার মাঠ খাঁ খাঁ করছে। এই অন্ধকারে একলা চলতে-চলতে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল আমার। আবিষ্কার করলাম, আমি কাঁদছি। খুব গোপন এক আকুলতা আমায় কাঁদাচ্ছে।

নয়

বলাই বাহুল্য, আমি পরীক্ষা ভালো দিতে পারিনি। পরীক্ষার পর মা গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। আমিও শহরে একা। ঘরে একজন রান্নার মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। শহরের এক লাইব্রেরির মেমবার হয়ে গেলাম। সেখানেই একদিন মাসির সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। মাসি বা সাদিক কারো সাথেই উপরের ঘটনার পর দেখা করিনি। ওঁরাও কেউ আমার খোঁজ করেননি। মাসিকে বললাম—তোমার সাথে দেখা করিনি বলেই যেটুকু হবার হল, ভালোমন্দ একরকম। নইলে সেটুকুও যেত। আমি পরীক্ষার কথা বলছি। এইভাবেই সেদিন মাসির সাথে কথা শুরু হল। মাসি একখানা নতুন প্রকাশিত উপন্যাস ইস্যু করিয়ে আমার হাত ধরে বললেন—তুমি বই নিয়েছ? চলো একটু দুজনে ঘুরব। বলে লাইব্রেরির করিডোর ডিঙিয়ে রিকশায় জটলার চৌমাথায় এসে থামলেন মাসি। মাসিকে জীবনানন্দের কবিতার কোনো এক নায়িকার মতন করুণ উজ্জ্বল রূপসী মনে হচ্ছিল, এবং গোধূলি মদির। সূর্য তখন ডুবুডুবু। আমরা এক মনোহারি দোকানে এসে থামলাম। মাসি তার নির্দিষ্ট প্রিয় সেন্ট আর সাবান কিনলেন। তারপর মিষ্টি করে হেসে বললেন— মেয়েরা যখন রোজগার করে সেই পয়সায় নিজের প্রিয় জিনিস কেনে, তখন তার রোমাঞ্চ আলাদা। আমি কিছু পয়সা জমাচ্ছি, বুঝলে? সেই পয়সায় একটুকরো মাটি কিনব। ঘর করব।

-কেন, সাদিকমামা?

-ওর কথা বাদ দাও। তোমাদের মেড়োর বাড়িতে তো চিরকাল থাকা যাবে না।

-ওটা তোমারই বাড়ি।

-কে বলেছে আমার বাড়ি! যে হাজী ঐ বাড়ি আমায় দিয়েছে, সেই হাজী তো আমার নেই। অতএব ওই বাড়িও ঠিক আমার নয়। ওই বাড়িতে বেশি দিন থাকলে, তোমাদের খোঁটা লাগবে। আমি চাই না।

হাসতে-হাসতেই বললাম— তুমি বেশ মেয়ে!

-কেন? এতে বাহবার কী আছে, যা সত্যি তাই বললাম।

আমি কোনো কথা না বলে মাসিকে রিকশায় ফেরার পথে বারবার চোখের কোণে দেখতে থাকলাম। শেষে প্রস্তাব করলাম—মা নেই। বাড়ি ফাঁকা। চলো ওখানে গিয়ে খানিক আড্ডা মেরে তোমার বাড়ি চলে যাব দুজনে।

-যাবে?

—নিশ্চয় যাব। যাব না কেন?

–আমার কাছে রাতে থাকবে?

-থাকব বৈকি!

-কথা দিচ্ছ?

– হ্যাঁ।

আমরা রিকশা থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকে কাজের মেয়েটিকে বললাম—রাতে একা থাকতে হবে। দরজা এঁটে কষে ঘুম দেবে। আমি খালামার কাছে যাচ্ছি। সন্ধ্যার পর আমরা বেরিয়ে যাব।

মাসিকে বললাম—মা নারকোলনাড়ু করে রেখে গেছে। মুড়ি দিয়ে খাবে? টাটকা সরষের তেল আছে। মাখিয়ে আনব?

মাসি ঈষৎ কড়া হয়ে বললেন—না থাক। আমি শুধু কফি খাব। তুমি কফি ভালোবাস বলে চাইছি। নিজে হাতে করে দিতে হবে।

-এই গরমে কফি ঠিক জমে না।

-গরম কোথায়? শীত এখনও যাই-যাই করছে, যাচ্ছে না।

-নাইস বলেছ। তবে তাই হোক। বলে আমি কফি বানাতে গেছি, এমন সময় বাবার কণ্ঠস্বর। বুক হিম হয়ে গেল। মাসিকে এখানে এনে কী ভুল করেছি আমি? মাসি আমায় হয়তো ভুল বুঝবেন। কাজের মেয়েটাকে বানাতে বলে বাইরে এলাম। দেখি দেয়ালে পাঁচখানা সাইকেল। ক্যারিয়ারে বেডিং বাঁধা। ওরা পাঁচজন উঠে এলেন। পাঁচজনই লীগের লোক রাজনীতিতে, ধর্মে বিশেষ জামাত করেন। তবলীগ করে বেড়ান। বেশির ভাগ সময় সাইকেল করে ঘোরেন। রাত্রে এখানে থাকবেন বোঝাই যাচ্ছে। প্রত্যেকে মুসলমানি পোশাক পরেছেন। চুস্ত আর কলিদার। গলায় জড়ানো লম্বা রুমাল। মক্কা-মদিনার ছাপ। মাথায় গোল টুপি। মুখে কারো কাঁচাপাকা দাড়ি। কারো ভীষণ কালো সুন্নত।

—দুজনের মধ্যে কোন্‌টা আপনার ছোট গিন্নি? প্রশ্ন একজনের।

মাসিকে দেখালেন বাবা। দ্বিতীয় জনের মন্তব্য- এ তো বাড়িতেই রয়েছে দেখছি। পালিয়ে গেছে বলছিলেন?

বাবা বললেন—পালিয়ে আর যাবে কোথায়! একটু বিরাগ মতন হয়েছে। আপনারা দোয়া করুন। ভালো-ভালোয় সুমতি করে উনি যেন কালই বাড়ি ফেরেন। আমার সংসার উরাল যাচ্ছে বড়েমিঞা। কালই সবাই মিলে কিসের যেন হোম হয়েছে, ওখানে গিয়ে মাস্টারদের মেহেরবানি চাইব। আর্জি করব। কী বলেন? একটু থেমে, এই হচ্ছে আমার একমাত্র মেয়ে মনোয়ারা, ডাক নাম মিনু। বললেন বাবা। বললেন—আমার প্রথম তিন ছেলে মারা গেছে হঠাৎ-হঠাৎ। এক মেয়ে, সে-ও গেছে কলেরায়। তারপর এই মেয়ে। পরের দুই ছেলে বাড়িতে দেখলেন। এই আমার একমুঠো সংসার। কেন যে আলগা হয়ে গেল। সবই খোদার মর্জি। এবার শিরিন, তোমাকে ঘরে ফিরতে হবে।

কাজের মেয়েটি কফি এনেছিল। ভেবেছিলাম, মাসি খাবেন না। কিন্তু দিব্যি খেয়ে যেতে লাগলেন চুপচাপ। নিংড়ে খেয়ে টেবিলে কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালেন। আমায় বললেন, চললাম মিনু। কাল দেখা করো।

মাসি একবারও পেছনে ঘুরে চাইলেন না। অন্ধকারে রিকশার ঘণ্টি দ্রুত রাস্তায় চলে গেল মিলিয়ে যেতে-যেতে। আমি বললাম হোমে যাবেন কেন আপনারা?

-কেন যাব, সে কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে নাকি? যা ভালো বুঝছি, আমরা করছি। তুমি চুপ করে থাকো। রাবা গর্জন করলেন। রাত্রে আর কোনো কথা হল না।

খুব সকালেই ওঁরা বেরিয়ে গেলেন। রাতে ওঁদের কী যুক্তি হয়েছিল জানি না, সেদিন ওঁরা হোমে না গিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন। সাতদিন পর টিউটোরিয়াল হোমের সামনে পাঁচ মুরুব্বির উদয়। তখন ক্লাস চলছে। অঙ্ক কষাচ্ছিলেন মাসি। বোর্ডে হাতে ধরা চক ভেঙে পড়ল। মাসির সমস্ত চেতনা থরথর করে কেঁপে উঠল। ওঁদের দেখে ছাত্রছাত্রী অধিকাংশ হিন্দু, প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল।

সাদিক বললেন—কী চাই আপনাদের?

একজন বললেন—আমরা আমাদের মেয়ে চাই। ঘরের বউ চাই। তুমি ওকে ছিনিয়ে এনে রাস্তায় ব্যবসা খুলেছ। একটা অর্ধ শিক্ষিত মেয়েকে ফুঁসলে এনে ভালো-ভালো ছেলেমেয়েদের মাথা খাচ্ছ তুমি। বেইমান। চোর। নির্লজ্জ। এ কেমন পণ্ডিতি তোমার সাদিক? ওই অবস্থাতেই মাসি চৈতন্য হারিয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়লেন। সাদিক নির্বাক। অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। দুটি ঠোঁট কেবল থরথর করে কাঁপছিল। মাসি সেই থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হোমে যেতে পারলেন না। ফলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হঠাৎ দ্রুত বন্যার জলের মতন কমে গেল। ফেরার পথে লীগের রাজনীতি-করা শহুরে মোল্লা মৌলানাদের চাউর করে গেলেন, ওই হোম অপবিত্র হয়ে গেছে। ফলে মুসলিম ছেলের সংখ্যা আরো কমে গেল। মাসি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছাত্রদের মধ্যে সাদিক সম্পর্কে যে প্রবল শ্রদ্ধা ছিল, তা কিছুটা নষ্ট হয়েছিল এই ঘটনায়। কিন্তু প্রকৃত আঘাত এল অন্যদিক থেকে। আরো দুইজন যে শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা হিন্দু। কুন্তল রায় আর জনার্দন সেনগুপ্ত। হোমের বাড়িটা ছিল জনার্দনের। জনার্দন সহসা বেঁকে বসলেন। বললেন—আমরা আরো কোয়ালিফায়েড টীচার পাচ্ছি, সাদিক। শিরিন অঙ্কেও খুব ভুল করেন। তা ছাড়া মুসলিম মেয়ে বলে দেখলে তো, কী কাণ্ড হয়ে গেল। ঘরের বউ ঘরে ফিরে যাক।

একটু থামলেন জনার্দন। বললেন—এটা গোঁড়া মুসলিম এলাকা, অথচ মুসলিম ছেলে বরাবরই কম। শিরিন আসার পর সেই সংখ্যা আরো কমে গেল। ওটা আর উঠবে না। রুটিমহলের ওদিকে জমিদারপট্টি। প্রচণ্ড গোঁড়া সব। লীগকে ভোট দেয়। আমি ওদের বোঝাতে পারছি না, ভাই। ওরা কখনও এই রকম হোমে মেয়ে টীচারই দেখেনি, তারপর তোমরা মুসলমান। তারপর ঘর-পালানো বউ। ঢি ঢি পড়ে গেছে, আমার হোমের বদনাম হয়ে গেল। তুমি থাকো। কারণ তুমিই হোম গড়েছ, শিরিন বরং…

সাদিকুল ম্লান হেসে বললেন—তোমারও সংস্কার কম নয়, জনার্দন। যাকে টীচার করে আনতে চাইছ, সে-ও কিন্তু লেডি। তোমার এক পরিচিতা। তাই নয়? হিন্দু হলে, ওইরকম ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে না। তুমি ভালো করেই জান, হাজীর সাথে শিরিনের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ঘটনা হিন্দুর হলে, শিরিনের পক্ষেই ছাত্রছাত্রী অভিভাবকের সহানুভূতি পাওয়া যেত। হাজীর জবরদস্তিকে তুমি ঘৃণা করবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এটা তোমারই মধ্যে সংস্কার, জনার্দন, ঘরের বউ ঘরে যাবে। মুসলমানের বউ, হাজীর পত্নী, পরহেজগার। ধৰ্ম্মে লাগে। তাই না?

-এসব কথা বলতে পারলে, সাদিক? আমি অতশত ভেবে বলেনি। আমি হোমটা রক্ষা করতে চাইছি। হোম উঠে যাক, তুমিও চাও না।

অভিমান বাজিয়ে কথা বললেন জনার্দন। তারপর কুন্তলের সমর্থন চাইলেন— তুমি কী বল কুন্তল?

কুন্তল এতক্ষণে মুখ খুললেন। বললেন—আমি আর কী বলব? যার হোম সে-ই তো বলছে। যাকে রাখবার রাখবে, ফেলে দেবার হলে ফেলবে। এটা তো গবমেন্ট-রিকগনাইজড চাকরি নয়। তবে আমার কথা হল, মান-ইজ্জতের কোশ্চেন যখন উঠেছে, সব দিক ভেবেই বলছি, সাদিক ভাই, তুমি আর আমাদের মধ্যে থেকো না। রাখতে হলে দুজনকেই রাখতে হবে। শিরিন তো চলে যাবে, ফিরে যাবে বলে আসেনি।

একটু দম ফেলে বললেন কুন্তল—কিন্তু জনার্দন চাইছে, সুচেতা হোমের টীচার হোক। বি. কম. পাশ করেছে, এমন কিছু কোয়ালিফিকেশন নয়। এই সাদিক ডবল এম. এ. সেটা কেন ভুলে যাই? কোয়ালিফিকেশনের কথা তোল কেন? একটা সামান্য প্রাইভেট হোম, এখানেও বিদ্যের বহর নিয়ে কথা? তুমি বলছ, শিরিন অঙ্ক ভুল করে, কোথায় ভুল করে অঙ্ক? ইলেভেন টুয়েলভ অব্দি ….ও নির্ভুল অঙ্ক কষায়। ডিগ্রিটাই সব হয়ে গেল তোমার? আমি এই কূট তক্কে ঢুকতে চাইছিলাম না। সুচেতা আসবে, তার জন্য শিরিনকে যেতে হবে কেন? ওপরের অঙ্কগুলো সুচেতা করাবে। নীচে থাকবে শিরিন। অ্যাকর্ডিং টু কোয়ালিফিকেশন। সমস্যা ছাত্র। ছাত্র কি বাড়ানো যায় না? সুচেতা জনার্দনের বন্ধু, বেশ তো বন্ধুর উপকার হোক। সেটাই যখন কথা।

জনার্দন খেপে গেলেন, তবু কেঁপে-কেঁপে বললেন—সেটা কোনো কথা নয়, কুন্তল। কে কার উপকার করে? আমি অত হীন ইচ্ছে নিয়ে কথা তুলি নি। আমি শুধু হোমটাকে বাঁচাতে চেয়েছি।

পাশের ঘরে কথা হচ্ছিল শিরিনের বাড়িতে। আমরা এ-ঘরে থেকে সবই মোটামুটি জানালা দিয়ে শুনছিলাম। মাসি শুয়ে ছিলেন। ভীষণ রোগা হয়ে গেছেন। হঠাৎ দুম করে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন। আমি সভয়ে ওঁর পিছু-পিছু গেলাম। মাসি বললেন— জনার্দনবাবু, আপনার হোম আপনারই রইল। আমরা আর যাচ্ছি না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে শুনে যান, আমি আসলে এখন কারো বউ নই। আমায় কেউ ছিনিয়ে আনে নি। আমি একাই এসেছি। স্রেফ একা। যান, চলে যান আপনারা। আমি অসুস্থ, একলা থাকতে দিন।

জনার্দন উঠে পড়লেন। কুন্তলও। যাবার সময় কুন্তল শিরিনের কাছে এসে বললেন—যুদ্ধ তো কেবল শুরু, শিরিন। দেখতে চাই সোনাভান কেমন অসি চালায়।

—আমার যুদ্ধ বোধহয় শেষ হয়ে এল, কুম্ভল। আমি যে হেরে যাচ্ছি।

কুন্তল বললেন—হারলে তো চলবে না। এই শহরে তোমাদের দুজনকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যেদিন তোমরা বিয়ে করবে, আমি সেদিন আধমন বাতাসা কিনে রাস্তায় ছড়াতে ছড়াতে যাব। আমার এক মামা, ভালো মোক্তার, ডিভোর্সের মুসাবিদা ভালো করেন। একদিন তুমি আর সাদিক এসো, আমি ব্যবস্থা করে দেব। আজ যাই। পরে আসব আবার। লাথির ঢেঁকি চড়ে ওঠে না শিরিন। যেমন কুকুর, তেমনি মুগুর দিতে হবে। চলি।

.

আদালতে মামলা উঠল।

দশ

দুদিন পর মাড়োয়ারির কোথাকার এক ভাগ্নেকে এনে, সেই মাড়োয়ারির চিঠি দেখিয়ে শিরিনমাসিকে রাস্তায় নামিয়ে দিলেন বাবা। যেদিন ওঁকে নামিয়ে দেয়া হল, সেদিন মা আবার এই শহরে ফিরে এলেন। এসেই শুনলেন, মাসি ও-বাড়িতে নেই। মা কথাটা শুনে খুশিই হলেন মনে হল। পৃথিবীর এক নতুন নাটক দেখলাম আমি। মায়ের কি এই ছিল সতীন-বিদ্বেষ? নাকি মানুষের স্বামী-ভক্তির রূপটাই এমন নির্মম?

তারপর তিন মাস কেটে গেছে। আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। কলেজে একাদশ ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। জানতাম না, আদালতে মামলা হয়েছে। একদিন বাড়িতে কোর্ট থেকে নোটিশ এল। তার বয়ানে বোঝা গেল, মাকে কোর্টে সাক্ষী দিতে হবে। খালামায়ের একটিই সাক্ষী, একমাত্র বিশ্বাসের ঠাঁই। কিন্তু ওঁদের আমরা আর দেখতে পাই না। শিরিন কিংবা সাদিকুল। কোথায় ওঁরা চলে গেছেন। একদিন হোমে গেলাম। কুন্তল কিছুই বলতে পারলেন না। দুঃখ করে বললেন—ওই মেয়েটির নাম সুচেতা, মাথায় সিঁদুর। দশ দিন আগে জনার্দন বিয়ে করেছে। বোঝো!

একটু ক্ষণ চুপ করলেন কুন্তল। তারপর বললেন, আমি এই হোমে আর থাকব না। সাদিকুল কোথায় আছে, ঠিক জানতে পারব। মোক্তারমামাও কিছু বলতে পারছেন না। সামনে সাত তারিখ কোর্টের ডেট। তুমি ওইদিন যেও

—না। আমি গেলে বাবা গলা কেটে ফেলবে। ওর এখন ইজ্জতের সওয়াল। বাবা কোরান হাতে করে লীগের মওলানাদের সামনে কসম খেয়েছে তালাক দেয়নি বলে। গত রাতেও মাকে বলছিল, কুলসম, তোমার হাতে আমার ইজ্জত বাঁধা। কসম খেয়েছি, সেই কসমের মান রেখো। নইলে আমি সংসার জ্বালিয়ে দেব। রাস্তার কুকুর বেড়াল করে দেব। আমি উসমান জমাদারের পোতা। মা ভয়ে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।

কুন্তল বললেন—তবে তো ‘কেস’ ফেভারে আসবে না। শিরিন হেরে যাবে। মুসাবিদায় তোমার মাকে সাক্ষী করে হাজী তালাক দিয়েছে বলা হয়েছে। অতএব শিরিন হারছে। আমি অন্যভাবে ‘কেস তৈরি করতে বলেছিলাম। শিরিন তা কিছুতেই শুনলে না। এখন কী হবে?

-কী হবে, আপনিই বলুন? অসহায় শোনাল আমার গলা।

কুন্তল বললেন—আমি কী বলব, মিনু? বলবেন তোমার মা। যাক গে, এখন কী হয়, দেখো

বলে কুন্তল সিগারেটের বোঁটা জুতোর তলায় পিষলেন। তারপর অন্যমনস্কের মতন ক্লাসে চলে গেলেন। আমি আর দাঁড়ালাম না।

.

দিন পনেরো পর হোমে আবার গেলাম। দেখলাম, কুন্তল চাকরি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। মাসিকে জানবার সামান্য শেষ সূত্রও ছিড়ে গেল। বুকের ভেতরটা কেমন করে কাঁদত আমার, কাউকে বোঝাতে পারব না। একদিন পার্টি অফিসে গিয়ে খোঁজ করলাম। শুনলাম, সাদিকুল পাটনা গিয়েছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই। শিরিনের কথা পার্টির লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হল। সেদিন আমি ভুল করেছিলাম। ওঁরা শিরিনের খবর জানতেন। এরপর আমার সামনে কেবল মা আর মা। মায়ের চেহারায় বার্ধক্য নেমেছে স্পষ্ট হয়ে হঠাৎ-ই কয়দিনে। মাকে আব্বার পাশে বেমানান লাগত। মনে হত, মা আর্ধেকবয়েসী বউ। স্বামীর বয়স ডবল। শিরিনকে মনে হত আব্বার মেয়ে। কিন্তু মা এত বুড়িয়ে গেলেন কেন? বিকাল হলে মা একটা রিকশা করে আমায় সাথে নিতেন। মায়ের চোখে চেয়ে বুঝতাম উনি যেতে-যেতে রাস্তার ভিড়ের মধ্যে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে কাকে যেন খুঁজছেন। একদিন ভিড়ের মধ্যে কাকে দেখে মা ‘শিরিন’ ‘শিরিন’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। সত্যিই তো! শিরিন-মাসি। ভুল করে রিকশা চলার বেগে অনেকখানি মাসিকে ছাড়িয়ে চলে এসেছিলাম। রিকশা থেকে নেমে, আমরা মাসিকে আর দেখতে পেলাম না। তারপর থেকে মায়ের রিকশা চড়ার দম বেড়ে গেল। মা বেশি-বেশি কোরান আর নামাজ পড়তে লাগলেন। তছবি গুনতে শুরু করলেন। ছোটো ভাই রাজাকে সাথে রাখতেন। নামাজ পড়ে তছবি গুনে রাজাকে কাছে ডেকে মাথায় ফুঁ দিতেন। গায়ে হাত বোলাতেন। মায়ের চোখে জল ভরে আসত। থুতনিতে হাত রেখে রাজার চোখে ভীষণ করুণ করে চাইতেন। এই দৃশ্য মনের ওপর একটা আশ্চর্য ছাপ ফেলেছিল আমার। বুঝতে পারতাম, শিরিন-খালামায়ের জন্য মায়ের বড্ড কষ্ট হয়। কিন্তু সেকথা মুখে প্রকাশ করতে পারেন না। আবার ভারতাম, এই কষ্টেরই কি কিছু মানে আছে?

একদিন আমাদের শহরের এই বাড়িতে কুন্তল এসে আমায় ডাকলেন। কুন্তলকে মা চেনেন না। বললাম—উনি আমার বন্ধুর দাদা। এই বলে পথে নেমে আসতেই কুন্তল বললেন— খোঁজ পেয়েছি, মিনু। শিরিন ভাকড়ি ছাড়িয়ে ওদিকে একটা বস্তিতে থাকে। একটা পাঠশালা খুলেছে। কী দুরবস্থা কল্পনা করা যায় না। সাদিক কেমন হয়ে গেছে। ঠিকমতন ছেলেপিলে পড়ায় না। পার্টির কাজে মেতে থাকে।

স্টপে এসে বাস ধরলাম আমরা, মিনিট বিশ-পঁচিশ পর বাস ছেড়ে হাঁটা পথ। দুপুরবেলা, গরমও পড়েছে দাউ দাউ। একটা কাঁচা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘর থেকে শিরিন বেরিয়ে এসে মিষ্টি হেসে আমাকে দেখলেন। খুব নরম করে শুধালেন—ভালো আছ?

আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ করলাম। কুন্তল বললেন—মোক্তারমামা বলেছেন, মাড়োয়ারির তালা ভেঙে ঘরে ঢুকতে। লোকটা ফল্স্ লোক। তুমি চলে আসার এক মাসের মধ্যে পালিয়েছে। ঐ তালা আখতার হাজী ‘ফিট’ করেছে। তোমরা না পার, ছেলেদের নিয়ে গিয়ে আমি ভেঙে ফেলব।

মাসি বললেন—ওই বাড়িতে যেতে আমার পা সরে না।

-পা সরাতে হবে, দরকার হলে, বাড়ি বেচে সেই টাকা কোনো অনাথ আশ্রমে দেবে। তবু দখল রাখবে না, তা হয় না।

কুম্ভল গজগজ করতে লাগলেন। মাসি নরম করে বললেন—ঠিক আছে। ও আসুক। বলব।

কুন্তল গলায় জোর দিয়ে বললেন –বলব নয়। শীগগির গিয়ে দখল নিতে হবে। লড়তে নেমেছ, কোমর সিধে করে থাকো। মামলায় কী হয় দেখে, একটা যা হোক স্থির করব। কিন্তু তার আগেই এই বস্তি ছেড়ে ঐ বাড়িতে যেতে হবে। আমরা দাঁড়াব না। সাদিককে বলবে, আমরা এসেছিলাম। কী মিনু, তোমার কোনো কথা নেই?

বললাম—না। না তো!

মাসি আমার খুব কাছে এগিয়ে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুধালেন—তুমি সত্যিই কিছু বলবে না, মিনু?

বললাম—তোমায় মা খুঁজছে খালামা। মায়ের বড়ো কষ্ট।

শিরিন এই কথা শুনেই দ্রুত ভাঙা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভেতর থেকে শেকল তুলে দিলেন। কুন্তল কতবার ডাকলেন। মাসি সাড়া দিলেন না। মাসি একদম ছেলেমানুষ। এত শস্তা অভিমান কোথাও দেখিনি।

বাড়ি ফিরতেই মা বারবার আমার আশেপাশে ঘুরতে লাগলেন। শুধালেন—তোর খালা-মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল? সাদিক কেমন আছে? কথা বলছিস না কেন?

আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন—তুমিও আমাকে বিশ্বাস কর না বুঝি? আমি কি সবখানিই খারাপ, মা? এই বুক কি এতই পাষাণ? তবু চুপ করে আছি দেখে বলে উঠলেন—পেটের মেয়ের কাছেও আজ আমি ছোটো হয়ে গেছি। হায় খুদা! সব আমার পর হয়ে গেল।

বললাম—কোর্টে সবার সাথেই দেখা হবে। এখন খুঁজে কী করবে? আমি অন্য কাজে গিয়েছিলাম।

এগারো

আজ কোর্টে মায়ের সাক্ষী হয়ে গেল। মাকে সাথে করে আমি আদালতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মা আদালতে দাঁড়িয়ে কোরান হাতে শপথ করলেন, যা বলবেন, সত্য বলবেন, সত্য বই মিথ্যে বলবেন না। এই কোরান হাতে ছুঁয়ে বাবা লীগের লোকেদের সামনে কসম খেয়ে বলেছেন, শিরিনকে উনি ত্যাগ করেননি। দুনিয়ার কাকপক্ষী তালাক শব্দটি তাঁর মুখে উচ্চারিত হতে শোনেনি। অতএব স্বামী যখন কসম খেয়ে সব অস্বীকার করেছেন, সেখানে স্ত্রী কেন পাপের ভয় করবেন। মা আদ্যোপান্ত সব ঘটনা স্বীকার করলেন, শুধু বললেন, হাজী সাহেব তালাক দিলেও আমি শুনিনি, আমি সে সময় ঘুমিয়ে ছিলাম।…

শিরিনখালামাকে আদালত উকিলের মুখে প্রশ্ন করেছিলেন—হাজীসাহেব আপনাকে তালাক দিয়েছেন বলছেন, আপনাকে তালাক দিলেন কেন?

শিরিন বললেন— সেটা হাজীই বলতে পারেন। আমার অপরাধ আমি জানি না।…তখন উকিল প্রশ্ন করলেন – সাদিকুলকে আপনি ভালোবাসতেন, অবৈধ সম্পর্ক গড়েছিলেন, এটা কোনো অপরাধ নয়? হাজী সাহেবের সাংসারিক মান সম্মান সবই তো খুলোয় লুটিয়ে দিচ্ছিলেন। তারপর আপনি একরাতে চুপ করে সাদিকুলখানের কাছে শহরে পালিয়ে গেলেন। এই ঘটনা কি মিথ্যা? সাদিকুলকে প্রশ্ন করা হল— হাজী সাহেবের বাড়িতে আপনি কিসের আকর্ষণে যেতেন? একটা পদানসীন বাড়ি। কুলসম আপনার দূর সম্পর্কের বোন, সেই সূত্র ধরে যেতেন। তাই তো? তারপর ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। আপনি শিরিন আখতারকে কানে মন্ত্র দিলেন। শহরে পালিয়ে গিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন, স্বাধীন জীবনের লোভ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই কিনা! বলুন? তারপর উকিল গলা চড়িয়ে ‘ইওর অনার’ বলে আদালত কাঁপিয়ে বললেন—শিরিন একটা গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। কারণ হাজীসাহেবের নামে তাঁর কোন অভিযোগের উল্লেখ আমরা পাচ্ছি না। তাঁর অভিযোগ একটাই, বক্তব্য একটাই, হাজীসাহেব তাঁকে সুস্থ মাথায় সজ্ঞানে পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার কোনো সাক্ষী ইহলোকে নেই। কেন তালাক দিলেন, তার উপযুক্ত কারণও ফরিয়াদী পক্ষ উপস্থিত করছেন না। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায়, উপযুক্ত কোনো কারণ শিরিনের জানা নেই। মুহুর্তের উত্তেজনায়, সামান্য একটা স্বপ্নের তাড়নায় উনি গৃহত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় টিউটোরিয়াল হোমে গিয়ে আপন স্ত্রীর খোঁজ নেওয়া দায়িত্বশীল স্বামীর কাজ বলে মনে করলে অপরাধ হয় না।

ঠিক এই সময়, দেখা গেল, শিরিন কাঠগড়ায় অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন। এইদিন আদালত রায় দিলেন না। দিন পনেরো পর আবার আদালত এই মামলার তারিখ ঘোষণা করলেন। মাকে রিকশায় করে আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আগাগোড়া বেশ রঙ মিশিয়ে আদালতের এই কাহিনী “ইসলামী দুনিয়া পত্রিকায় সবিস্তারে ছাপা হল। লীগের মুখপত্র এই ‘ইসলামী দুনিয়া’ বাবার পক্ষে এক নির্ভরযোগ্য দোস্ত। প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো-বড়ো হরফে ছেপেছেন, হাজীপত্নী অপহৃতা, মুসলমান যুবকের বেইমানি, সাক্ষী কুলসম বিবি।

পরের দিন ভোরে বাবা মুড়ি চিবোতে চিবোতে এই উপাখ্যান পাঠ করছিলেন। একটু আগে কোরান পাঠ করছিলেন। আমি ভাকড়ির বস্তির দিকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মা তছবি গুনে রাজার মাথায় ফুঁ দিচ্ছিলেন।

বস্তির কাছে এসেই চোখ পড়ল বাড়ির সামনে একখানা ঘোড়াগাড়ি। মালপত্র ওঠানো হচ্ছে। কুন্তল আর সাদিকুলকে দেখা যাচ্ছে। একটু পর শিরিন ।বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। আমি এগিয়ে গেলাম। ওঁরা আমায় প্রথমে কেউ কোনো কথা বললেন না। গাড়িতে স্বল্প কিছু বাক্সপেটরা ওঠানো হলে শিরিন উঠলেন। কুন্তলও উঠে বসলেন। তারপর সাদিকমামা আমার দিকে চেয়ে বললেন—তুমিও ওঠো।…আমি কোনো কথা না বলে নিশ্চুপ গাড়িতে গিয়ে বসলাম। শেষে মামা আমার পাশে এসে বসলেন। গাড়ি ছেড়ে দিল। মামা বললেন—অনেক দিন তোমায় খুঁজছি। ঢের কথা আছে তোমার সাথে। কোর্টে কথা বলবার ফুরসত হয়নি। আমরা এখন প্রথমে থানায় গিয়ে ডাইরি লেখাব। পরে মাড়োয়ারির ঘরে গিয়ে তালা ভাঙব। সবই কুন্তলের ইচ্ছে। মোক্তারমামার নির্দেশ। আমাদের মামলাটা গোড়াতেই কাঁচা ছিল। হেরে যাব জানতাম। শিরিনও কোর্টে দাঁড়িয়ে মাথা ঠিক, রেখে উপযুক্ত জবাব দিতে পারেনি। তোমার মা যে ওইধারা বলতে পারেন, ও নাকি এখনও সেকথা ভাবতে পারছে না।

কুন্তল পাশে থেকে তেতো করে বললেন—হাজী যে কত বড়ো জল্লাদ সেকথা একবারও শিরিন বলতে পারত, ওকে একদিন মেরেছে পাখার ডাঁটি ভেঙে, সেকথা বলা কি যেত না?

শিরিন বললেন—ওটা কোনো অত্যাচার নয় কুন্তল। ওর অত্যাচারের আসল চেহারা কেউ দেখেনি।

-তবে সেটা কেন বললেন না?

-সেকথা বলা যায় না, কুন্তল!

-কেন যায় না?

—তুমি ঠিক বুঝবে না। বুবু কোর্টে এসে রিকশা থেকে নেমেই রাজাকে আমার কাছে ইশারায় ঠেলে দিলে, সে-দৃশ্য কেউ তোমরা দেখনি। রাজার মুখ দেখে আমার ভেতরটা কেমন হয়ে গেল, সাদিক।

সাদিক বললেন—কিন্তু তোমার মুখ দেখে বুবুর তো কিছু হল না?

শিরিন আর কোনো কথা বললেন না। কুন্তল বললেন—তুমি চেয়েছিলে বুবু তোমার সব ফয়সালা করে দেবে! দরকার হলে সাদিকের সাথে বিয়ে দিয়ে ফুলশয্যার বিছানা পেতে দেবে। চমৎকার!

গাড়ি এসে থানার কাছে থামল। কুন্তল আর সাদিক নেমে গেলেন। পনেরো মিনিট সময় লাগল ওঁদের। সেই ফাঁকে মাসির সাথে আমার কিছু কথা হয়েছিল। বললাম—তুমি সাদিকমামাকে নিয়ে খেলা করলে, খালামা। বেচারি এখন কী করবেন?

—তুমিও এমনি করে বলছ, মিনু? মাসি অস্ফুট ডুকরে উঠলেন। বললেন—সব দোষ আমারই হল? কোর্ট যে আমার কথা ভালো করে শুনতেও চায়নি।

ওরা ফিরলেন। গাড়িতে উঠে কেউ আর কোনো কথা বললেন না অনেকক্ষণ। কুন্তল একসময় আনমনা বলে উঠলেন—কোর্ট কারো ইমোশন দেখে না। কোর্ট চায় প্রমাণ।

গাড়ি এসে শিরিনের বাড়িতে দাঁড়াল। দরজা খোলা হল। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। সাদিক বললেন—আমরা চলে যাব, শিরিন। তোমরা দুজনে মিলে সাজিয়ে-গুছিয়ে নাও। পরে কথা হবে। মিনু, তুমি এখানেই থাকো। বিকালে যেও। আমি বিকালে এসে তোমার সাথে কথা বলব। চলো কুন্তল, আমরা যাই। কুন্তল আর সাদিক চলে গেলেন। ঘর গোছানোই ছিল। বাক্সপেটরা থেকে কিছু কাপড়-চোপড় বার করে আলনায় রেখে ফ্যানের হাওয়া ছেড়ে বিছানায় চিত হয়ে পড়ে গেলেন শিরিন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে একসময় চোখ খুলে ফ্যানের ঘুরন্ত পাখার দিকে চেয়ে রইলেন। পরে উঠে কুঁজোয় রাখা বাসি জল খেলেন। এবং পরে বাক্স থেকে একখানা ডাইরি বার করে আমায় এগিয়ে দিয়ে বললেন—পড়ো। দিন বিশেক হল, এই ডাইরি আমি আবিষ্কার করেছি। ডাইরিতে সাদিক লিখেছেন :

কোনো-কোনো ছেলের বিবাহিত রমণীর দিকে আকর্ষণ হয় বেশি। বিবাহিতার দেহ এবং মন দুইই খুব ভেতর থেকে টানে। আমি নিজেকে বারবার এই পরীক্ষা করে দেখেছি। কেন এমন হয়, কখনও বুঝতে পারিনি। বারবারই এই মনে হয়েছে, দেহের রহস্যে বিয়ে-হওয়া মেয়েরা কুমারীদের চেয়ে বেশি ভরম্ভ, বেশি গভীর। কুমারী মেয়েরা নিজের শরীরকেই ভালোমতো চেনে না। চেনে না বলেই দেহের ভাষা ব্যবহার হয় না তেমন যুৎ-জাত ও সূক্ষ্ম রহস্যলীন। ফলে তাদের মনের মধ্যে থাকে না কোনো সমুদ্র। সেই মন বড়ো জোর একটি লেজ-নাচানো ক্ষুদ্র পাখি। টি-টি। তাই আমি শিরিনকে দুঃসহ ভালোবাসায় উত্তেজিত করতে চেয়েছি ক্রমশ। এর বেশি এই ভালোবাসায় কিছুই ছিল না। নইলে একটি গ্রাম্য মেয়ে আমায় টানবে কেন? তার অসহায় দুটি চোখের চেয়ে অসহায় শরীরখানি আমার বেশি ভালো লাগত। ভয় হয়, যদি একদিন এই শরীর আমার আর ভালো না লাগে! কোনো অবস্থায় এই দেহ যদি আর অসহায়’ না থাকে, আমি সেদিনও কি ঐ দেহে রহস্য খুঁজে পাব?

.

পড়তে-পড়তে আমি বার বার চমকে উঠছিলাম। মাথার মধ্যে সব উলট-পালট হয়ে যাচ্ছিল। আমি মাসির দিকে চেয়ে দেখলাম, মাসি আমার মুখ পানে দুটি অসহায় বড়ো-বড়ো চোখ মেলে নিষ্পলক চেয়ে আছেন। ভালোমতন করে তাঁর চোখে চাইতেই উনি গাঢ় স্বরে কেঁপে-কেঁপে উঠলেন—পুরুষের এই মন নিয়ে আমি কী করব বলে দে, মিনু। তুই বলে দে। বলতে-বলতে মাসি বিছানায় ভেঙে পড়লেন। দুহাতে খামচে ধরলেন বিছানার চাদর। উপুড় হয়ে বুকের সাথে কী যেন আঁকড়ে ধরতে গিয়ে পারলেন না মাথার চুল বিপর্যস্ত হয়ে সামনে ঝুলে পড়ল। চোখে শুকনো কান্নার খিন্ন কালিমার ছাপ ভিজে উঠছে মাত্র কোনোমতে। কণ্ঠস্বরে কী কষ্ট ঝরছে, কী নিষ্ঠুর চাপা খেদ ঘুলিয়ে উঠছে, বোঝাতে পারব না। পাগলের মতন বলছেন

আহা রে দুলদুলি ঘোড়া
জোর করো থোড়া থোড়া
যেতে হবে টুঙ্গির শহর।

বারো

আমি সাদিকের জন্য বিকাল অবধি অপেক্ষা করিনি। চলে এসেছিলাম। সারা রাত ছটফট করেছি। আমার কষ্ট দেখে মা এসে বিছানার কিনারে বসে ছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বারবার শুধিয়ে ছিলেন—কী হয়েছে। আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। আমার অবস্থা দেখে মায়ের চোখে মুখে আশ্চর্য অপরাধের ছাপ জেগে উঠেছিল। এই ভাবে একটা-একটা দিন কেটে গেল। আগামী কাল রায় বেরুবে আদালতে। আজ এই বাড়িতে আমি একা হয়ে যাব। মা চলে যাবেন গাঁয়ের বাড়ি। বাবাও তৈরি হচ্ছেন মাকে ট্রেনে তুলে দেবেন, তাই। দাড়িতে আতর মাখছেন। কৌটোয় পান সাজিয়ে নিচ্ছেন। চোখে খুশির উজ্জ্বল স্রোত হাওয়ার মতন কাঁপছে। আমি দিনের বেলায় দুঃস্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠলাম। দেখছিলাম, আমি একটা ছোট্ট টি-টি পাখি আকাশপথে একলা উড়ে যাচ্ছি। অবধিহীন আকাশের পথে আমি বড়ো একা। আমি চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছি মানুষকে। ঘুমন্ত নগরী, গাছপালা-প্রান্তর ঘুমিয়ে। কেউ আমার কান্না শুনছে না। বুকের তলায় বুদবুদ করছে ভয়। প্রবল এক ভয়ের তাড়নায় বুক আমার ভেঙে যাচ্ছে। ভয়েই কেঁদে উঠে জাগলাম। বিকাল হয়ে এসেছিল। হঠাৎ কী মনে করে চোখে মুখে জল দিয়ে চা খেয়ে শাড়ি বদলে বাইরে পথে একলা হাঁটতে শুরু করলাম। মা জানালেন, চলে যাবেন উনি। বাপ-মেয়ে একসাথে থেকো বলে ভালো থাকার শুভেচ্ছা জানালেন। মায়ের চেহারা কী করুণ দেখাচ্ছিল, মুখটা এতটুকু হয়ে গেছে। বারবার আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলাম। পেছনে চেয়ে দেখলাম, মায়েরা রিকশা করে স্টেশনের দিকে চলে গেলেন। রাজা আমার নাম ধরে মিনুআপা বলে। রাজা আমায় ডেকে-ডেকে কী বলছিল রিকশায় চড়ে, শুনতে পেলাম না। ….

শিরিনের ঘরে গিয়ে উঠলাম। শিরিন দরজা খুলে আমায় ভেতরে ডেকে নিলেন। সন্ধ্যার সময় মনে করলাম, আমি এখানেই থেকে যাব। সেকথা মাসিকে জানালামও। মাসি খুশিই হলেন। সন্ধ্যার আরো কিছু পরে সাদিক এলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে শুধালেন—আমার কথা তো শুনলে না, মিনু।

বললাম—আপনার সব কথা আমি জানি।

—সব জান? কোথা থেকে? কে বলেছে? আমি তো তোমায় যা বলব বলেছিলাম, শুনলে না, না শুনেই কী করে জানলে আমার সব কথা?

—আপনার ডাইরি পড়েছি সাদিক-মামা।

-ও!

মামা ধীরে-ধীরে উঠে পড়লেন। আমি ওঁর পিছু-পিছু এগিয়ে এলাম বারান্দায়। সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালাম। মামা কয়েক ধাপ নীচে নেমে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন—ওসব কথা আমি নিজের ওপর রাগ করে খুব এক ইমোশনাল সময়ে লিখেছি মিনু। বিশ্বাস করো, আমি যা লিখেছি সেসব আমার মনের কথা নয়। শিরিন কখন ওই ডাইরি চুরি করে নেয় জানতে পারিনি। আরো দু ধাপ নামলেন মামা। আবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন—একটি জটিল নারী-জীবনে আমার আকর্ষণ ঠিক কথা। কিন্তু দেহই আমার কাছে সব ছিল না। তুমি শিরিনকে বলবে। বলবে তো?

দৃঢ় গলায় বললাম—না। কখনও নয়। কখনও নয়। কিছুতেই না। আমি অত গ্রাম্য নই। তুচ্ছ একটা টি-টি পাখি নই সাদিক মামা।

—তাই বুঝি?

বলে সাদিকুল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছিলেন। পেছনে, আমার পেছনে এসে মাসি দাঁড়িয়েছেন। সাদিকুল আর উঠলেন না। হো হো করে হেসে উঠে ঘরে গেলেন। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নীচে চলে গেলেন। মাসিও পেছন থেকে সরে চলে গেলেন ঘরের মধ্যে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার সহসা দুই চোখে কান্না এসে দুলতে লাগল। কিছু পর বাইরে বাবার কড়া গলা শোনা গেল। মিনু, নেমে আয়। একলা বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। মাসি এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। আকুল হয়ে বললেন—যেও না, মিনু। একলা আমার ভয় করছে।

আমার উপায় ছিল না। বাবার হুকুম। চলে গেলাম নেমে। বাড়িতে এসে খেয়ে নিয়ে বালিশে মাথা দিতে গিয়ে দেখি তলায় চিঠি। মায়ের লেখা। মাসিকে।

স্নেহের শিরিন /

আদালতে আমি ভুল,সাক্ষ্য দিয়েছি, বোন। আমি স্পষ্ট তালাক দিতে শুনেছি হাজী সাহেবকে। আমাকে ক্ষমা করে দিও। তুমি কখনও এই সংসারে ফিরতে চেও না। সাদিকুলকে শাদি করে সুখী হওয়ার চেষ্টা করবে। আমার আশীর্বাদ রইল। সাদিক ভালো ছেলে। ঘরের বউদের সে কেবল ভালোই বাসেনি। শ্রদ্ধাও করেছে। এই চিঠি যদি তোমার কোন ব্যবহারে লাগে, লাগিও। আমার স্নেহ জেনো। ইতি

তোমার বড়ো বোন
কুলসম

সেই এক মারাত্মক চিঠি এখন আমার ব্যাগের মধ্যে। সারারাত ছটফট করেছি এক দিশাহীন উত্তেজনায়। রাত গভীর হয়েছিল। পথে ভয়ে নামতে পারিনি। ভোরের জন্য অপেক্ষা করেছি। অনেক রাতে হঠাৎ দেখেছি, বাবা বিছানায় নেই। সারারাত তোলপাড় হয়েছে আমার। বাবা কোথায় গেলেন?

অন্ধকার থাকতেই বাড়ির গেটে তালা লাগিয়ে পথে নেমে এসেছি। বুকটা আমার অসম্ভব আনন্দে টনটন করছে। রিকশা এখনও ঠিকমতন পথে নামেনি। পায়ে হেঁটে ছুটছিলাম। চৌমাথায় গেলে রিকশা পাওয়া যেত। এতক্ষণে খেয়াল হল। আমি এবার মাঠে নামলাম। আকাশে লালিমা ঈষৎ ফুটেছে। মামার দরজায় টোকা দিলাম। ঘরে হ্যারিকেনের আলোয় মামা পোশাক পরে তৈরি। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ। অন্য হাতে অ্যাটাচি। আমায় এখন এই অবস্থায় দেখে আশ্চর্য হলেন। কী ব্যাপার, তুমি?

–বলছি। আগে আমার সাথে খালামার ওখানে চলুন। ওখানে গিয়ে সব বলব। উত্তেজনায় কথা বলতে গিয়ে আমি বোধহয় মৃদু-মৃদু হাঁপাচ্ছিলাম।

মামা বললেন—আমি তো আজ পাটনা চলে যাচ্ছি, মিনু। পার্টি আমাকে পাটনা পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি যেতে চাইনি। আমি নিজেকেই ঠিক চিনতে

পারলাম না।

—আপনি খালামাকে ফেলে চলে যাবেন?

-তোমার খালামা যাবেন কী করে, মিনু? পথ যে বন্ধ হয়ে গেল!

রিকশা এসে গেল দ্রুত। পরে রাস্তায় আমরা রিকশা পেয়েছিলাম, মারাত্মক চিঠিটা এখন আমার হাতের মুঠোয়।

আমরা উঠে এলাম সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত। দরজা বন্ধ। কলিং বেল বাজল। একটু বাদে দরজা খুলে গেল। সামনে বাবা দাঁড়িয়ে। হাতে গোঁফ ছাঁটার কাঁচি। আমাদের দেখে ভেতরে পাশের ঘরে চলে গেলেন। খাটে শিরিন। সেদিকে চেয়েই বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। পরনের কাপড় একপায়ে হাঁটু অব্দি উঠে আছে। বুকের ব্লাউজ মেঝেয় পড়ে। ছেঁড়া। বুকের ওপর গলার কাছে কাপড় জড়ো করা। গলায় ছেঁড়া দাগ। গাল নখরে বিক্ষত। ঘুমন্ত কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বোধহয় চোখ তোলারও ক্ষমতা নেই। একটু পর কাতর খুব অস্ফুট একটা শব্দ বেরুল গলা থেকে। সাদিকুল একটু ঝুঁকলেন। আমিও আরো কাছে এগিয়ে এলাম।

ডাকলাম—খালামা!

কোনো সাড়া পেলাম না। পায়ের দিকে একটু সরে যেতেই খালামা মৃদু নাড়া খেলেন নিজেরই মধ্যে। আমি সাদিকুলের মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে দেখলাম, তাবৎ মুখ কেমন সংকুচিত, রেখাময়। থুতনি ঝুলে গেছে।

বাবা এসে হঠাৎ পায়ের কাপড় টেনে নামালেন। কোনো কথা বললেন না। আবার পাশের ঘরে গেলেন, আবার এলেন। আমাকে বললেন—আজই আমরা বিকালে বাড়ি চলে যাব। তোমার ছোটোমাকে নিয়ে একসাথে যেতে হবে। তুমি এখন এখানেই থাকো। আবার চলে গেলেন পাশের ঘরে। আমি সেই মারাত্মক চিঠিখানি হাতের মুঠোয় ধরে আছি। সাদিকুল ডাকলেন অস্পষ্ট গলায়—শিরিন! আর একুবার! আর একবার তুমি পালিয়ে আসতে পার না?

খালামা চোখ তোলার চেষ্টা করতেই চোখের পাতা থরথর করে কেঁপে গেল। সাদিকুল একটা ঢোঁক গিললেন। তারপর কোনো কথা না বলে সহসা তীরের মতন বেগে ঘর ছেড়ে সিঁড়ি টপকে নেমে গিয়ে রাস্তায় পড়লেন। রিকশায় উঠে পড়লেন। আমি চিৎকার করে সাদিকমামাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম, গলায় কোন শব্দ ফুটছে না। আমার হাতের মুঠোয় সেই মারাত্মক চিঠি নিঃশব্দে পড়ে রইল প্রতিবাদহীন।

তেরো

সেই থেকে শিরিন-মাসি বিছানায় শুয়ে থাকেন দিনরাত্রির অধিকাংশ মুহূর্ত। তাঁর মনের মধ্যে চিন্তার তরঙ্গ আছড়ে পড়ে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতন। কিন্তু বাইরে সেই ক্ষুব্ধ তরঙ্গায়িত সমুদ্রের কোনো পরিচয় ফুটে ওঠে না। শুধু চিন্তারই কিছু ক্ষয় তাঁকে তলে-তলে পিষে ফেলে মানুষের একটি প্রায় সমাহিত আকৃতির মধ্যে জগৎ থেকে নির্বাসিত করে দেয়। একটি রক্তাক্ত জীবনপিণ্ড স্থবির হয়ে জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হচ্ছে চোখের ওপর, পৃথিবীর হিম-অস্ত্র থেকে একটি মৌন ম্লান ছায়া উঠে এসে তাঁর দেহের চারপাশে জড়িয়ে দেয় এক আশ্চর্য আবরণ। মাসিকে আমি নিজেও যেন ঠিক আর চিনতে পারি না।

মাসির শরীরের নিম্নভাগ অবশ হয়ে এলিয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে গেলে তাবৎ প্রত্যঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠে। দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকেন। ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত মাসি দেওয়াল আঁকড়ে পা টেনে-টেনে চলবার চেষ্টা করেন। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেতে গিয়ে পারেন না। হাত কেঁপে গেলাস খসে যায়। জল গড়িয়ে পড়ে মেঝেয়। রাজা কাছে এলে সহ্য করতে পারেন না। কোলে উঠতে চাইলে, গায়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। তা সত্ত্বেও সিঁদুরি গাছে এ বছর অজস্র বউল পুঞ্জিত হয়ে ওঠে।

গোলোকবাবু নল উঁচিয়ে পাম্প মেশিনে মেডিসিন স্প্রে করতে থাকেন। পুঞ্জে-পুঞ্জে অসংখ্য মৌমাছি গুঞ্জন করে। আঠালো মধু ঝরে পড়ে ডালে পাতায়, সবুজ গন্ধে ম-ম করে বাগান। নির্মম সেই সৌন্দর্য মাসি কি সহ্য করতে পারেন? জানালা খুলে দিয়ে মাসিকে দেখানোর চেষ্টা করি—খালামা! কত বউল এসেছে দেখো। একদিন তুমি প্রার্থনা করেছিলে।

.

অন্ধকার-গোপন পৃথিবীতে মাসির মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। মাসি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। দেওয়াল ধরে ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে এসে সেই রাতে পায়ে-পায়ে এগোবার চেষ্টা করেন। ক্রুদ্ধ মিয়ানো গলায় শিরিনের রাতভর এক আশ্চর্য যুদ্ধ চলতে থাকে।

আমরা কেউ কিছুই বুঝিনি। দারুণ নিস্তরঙ্গ মাসি মনে-মনে কী দুঃসহ আচরণ করেছেন নিজেরই সাথে। এভাবে উঠে দাঁড়ানো যদিও তাঁর স্বাস্থ্য ও শক্তি বিরুদ্ধ, তবু তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। হাঁটতে পারেন না, তবু হেঁটে এসেছেন সারা ঘর, তাবৎ বারান্দা, সিঁড়ি এবং বাগানের চিকন পথ। তারপর হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছেন। মাথা তুলতে পারেন নি। আমি ওঁর ঘরে গিয়ে তিনি নেই দেখে মাকে ডেকেছি। আব্বা উঠেছেন। খুঁজতে খুঁজতে বাগানে এসেছি আমরা। দেখি, মাসি মুখ থুবড়ে মাটিতে শুয়ে, চোখে মুখে ধুলো, চুলে লুটিয়ে থাকা ধুলোর ছোপ। মাসি চোখ তুলে আমাদের দিকে পাগলের মতন চাইলেন। ভোর হচ্ছে তখন। রোদের রেখায় পূব-আকাশ ফরসা হচ্ছে। মাসি আমাদের কারুকেই ঠিক যেন আর চিনতে পারছেন না।

হাতে ধরে আছেন সেই চিঠির মারাত্মক টুকরো-খানি। এবং তিনি সারারাত যা-যা করেছেন, তারও স্পষ্ট মানে তাঁর জানা নেই। তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্ক এই সকালে আস্তে-আস্তে ফের ঘুমিয়ে গেল। এইভাবে তাঁর সব সত্তা হঠাৎ করে ঘুমিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাবা ওঁকে কোলে তুলে পাঁজা করে খাটে এনে ফেললেন। মাসি আর চোখ তুললেন না

তাঁর সেই শ্রান্ত শরীরে, ঘুম-মাখানো অবয়বে পৃথিবীর সবচেয়ে কুটিল ক্রূর অভিশাপ তলপেটে দাপিয়ে নড়ে উঠল : যার সাথে শিরিন মনের সব সংযোগ হারিয়ে এখনও বেঁচে রইলেন, পাগল হতে চেয়েও পারলেন না। এবং মৃত্যুও তাঁর এই শরীরের পক্ষে অনুচিত। সেই ক্ষমতাও হারিয়েছেন শিরিন।

কেবল সিঁদুরি গাছ পৃথিবী আলো করে হাসছে। চোখের সামনে। জানালার ওপারে জীবনের বিপরীত সৌন্দর্য এক হয়ে মিশে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *