সাহিত্যের ষ্টাইল

সাহিত্যের ষ্টাইল

আধুনিক সাহিত্য-বিচারে সবচেয়ে বড় কথা মূল প্রশ্ন যাহা তাহার বিলাতী নাম—‘ষ্টাইল’। আমাদের দেশে যাঁহারা ইংরেজী সাহিত্যের রীতিমত চর্চ্চা করিয়া থাকেন, এই ষ্টাইল কথাটি তাঁহাদের নিত্যব্যবহার্য্য, অতএব অতি পরিচিত শব্দ। আবার পারিভাষিক অর্থ ছাড়াও অন্যবিধ অর্থে শব্দটির প্রয়োগ আমাদের বৈঠকী আলাপেও হইয়া থাকে— সাহিত্যপ্রসঙ্গে তো কথাই নাই। সাহিত্য-বিচারে আমাদের পক্ষেও, এই শব্দটির প্রয়োগ যেমন অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠিয়াছে, তেমনই এই কথাটির গূঢ় তাৎপর্য্য উত্তমরূপে ধারণা করিয়া না লইলে, যে বস্তুকে আধুনিক সাহিত্য বলা যায় তাহার সম্যক বিচার হইবে না। আমাদের আধুনিক সাহিত্য আধুনিক সমালোচনা-পদ্ধতির আমলে যতদিন না আসিতেছে ততদিন সাহিত্যের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের ভ্রান্তি দূর হইবে না; এজন্য আমি এই ষ্টাইল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিব, এবং এ আলোচনায় আমি মুখ্যত বিদেশী পণ্ডিতের সাহায্য লইব।

ষ্টাইল কথাটির কোনও বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করিবার চেষ্টা করিব না; ইংরেজী শব্দটিকে রক্ষা করিতে বিশেষ আপত্তি নাই, তাহার কারণ ইতিমধ্যেই এই শব্দটি আমাদের শিক্ষিত সমাজে, যে অর্থেই হউক, সুপরিচিত হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, এই শব্দের দ্বারা যাহা বুঝায় তাহা আমাদের দেশীয় সমালোচনাশাস্ত্রে সম্পূর্ণ নূতন; আধুনিক সাহিত্যও যেমন একালের জিনিস—সেই সাহিত্যের বিশিষ্ট গুণও তেমনি একটি সম্পূর্ণ আধুনিক ধারণা; অতএব তাহার জন্য নূতন শব্দ গ্রহণ করিতে আপত্তি নাই—বিদেশাগত বহু নূতন বস্তু তাহাদের নাম-সহ আমাদের দেশে বসতি স্থাপন করিয়াছে। তথাপি সংস্কৃত ভাষার দৌলতে ইহারও একটা উপযুক্ত প্রতিশব্দ সৃষ্টি করা যাইতে পারে, এবং করিলে আমাদের ভাষার শব্দসম্পদ বৃদ্ধি পাইবে। আমি উপস্থিত, নামের পরিবর্তে বস্তুটির ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইতেছি, তাহা হইতে একটি নাম পরে তৈয়ারী লওয়া দুরূহ হইবে না—সে ভার আমি শব্দশাস্ত্রবিদ্ পণ্ডিতগণের উপরে দেওয়াই সমীচীন মনে করি।

একটি সংস্কৃত শব্দ আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে এবং তাহার অনুসরণে অনেকে ষ্টাইল অর্থে ‘রীতি’ শব্দটি ব্যবহার করিয়া থাকেন। কিন্তু ‘রীতি’ শব্দটি বিশেষ করিয়া ভাষারই দোষগুণবাচক। রচনার ভাষাগত ভঙ্গিকেই রীতি বলা হইয়াছে। কিন্তু ষ্টাইল ভাষার ভঙ্গিই নহে। আমাদের দেশে এখনও, সাহিত্যামোদী শিক্ষিত ব্যক্তি কাহারও লেখার প্রশংসা করিতে হইলে যাহা বলিয়া থাকেন, তাহা সাধারণত এইরূপ—”অমুক লেখে বেশ! অমুকের ভাষাটি চমৎকার!” তাহা ছাড়া বিদ্যাসাগরী ভাষা, বঙ্কিমী ভাষা–প্রভৃতি নানা ভাষার উল্লেখও আমরা করিয়া থাকি। এই সকলের মধ্যে ঐ রীতিগত ষ্টাইলের ধারণাই প্রচ্ছন্ন আছে; এবং এইরূপ স্থলে আমরা ভাষা বা রীতি না বলিয়া ইংরেজী ষ্টাইল কথাটিও ব্যবহার করি। কিছুকাল পূর্ব্বে—বঙ্কিমচন্দ্রের যুগেও রচনার উৎকর্ষ প্রমাণ করিতে সেকালের সমালোচকেরা এই ভাষারই দোষ-গুণের উল্লেখ করিতেন; ষ্টাইল বলিতে যে-গুণ বুঝায়, তাহার ধারণাও যেমন ছিল না, তেমনই সাহিত্যবিচারে ভাষাকেই সর্বপ্রধান মনে করা হইত। একালেও এই ধারণা প্রবল আছে; জনৈক সমালোচক বাংলা গদ্যের উৎকর্ষ প্রদর্শনকালে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিদ্যাসাগরের রচনা তুলনা করিয়া, যে আদর্শে বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করিয়াছেন, তাহাতে স্পষ্টই মনে হয়, সাহিত্য-বিচারে ষ্টাইলকে তিনি অগ্রাহ্য করিয়াছেন; অগ্রাহ্য করিবার কারণও এই মনে হয় যে, ভাষার দোষ-গুণের ঊর্দ্ধে যে বিশিষ্ট গুণ রচনার সর্ব্বস্ব, সেই গুণ সম্বন্ধে লেখকের কোনও ধারণা নাই। এইজন্য এই সকল সমালোচকেরা রচনার ভাষার বিশুদ্ধি ও পারিপাট্যবিচারেই ব্যাপৃত থাকেন।

কিন্তু ভাষার সম্বন্ধে এইরূপ অতিরিক্ত মনোযোগ সত্ত্বেও সেকালের সাহিত্য—রসিকের মনে ষ্টাইল জিনিসটার একটা ধারণা যে অজ্ঞাতসারেও বিদ্যমান ছিল, তাহা অনুমান করিতে পারি। তারাশঙ্করের ‘কাদম্বরী’ সম্বন্ধে স্বর্গীয় অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখিয়াছেন—

“তারাশঙ্করের ঝঙ্কার খুব। ঝঙ্কারে সুরতাল ডুবিয়া থাকে। শুনিতে মধুর, কাজে লাগে বড় কম। কাদম্বরী পাঠে মুগ্ধ হইতাম, বিস্মিত হইতাম—কিন্তু কখনও জিনিষ বলিয়া মনে করিতে পারিতাম না। কাদম্বরী চমক দিত কিন্তু প্রাণে লাগিত না।”

লেখকের অভিপ্রায় বোধ হয় এই— ‘কাদম্বরী’র ভাষার শব্দগত মাধুৰ্য্য বা ধ্বনিচাতুর্য্য কানে ভাল লাগিলেও চিত্ত স্পর্শ করে না, –কেন যে, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই। ভাষার মধ্য দিয়াই, ভাষাকে অতিক্রম করিয়া, যে গুণ সাহিত্যকে সত্যকার সাহিত্য করিয়া তোলে, প্রাণকে স্পর্শ করে-সে গুণ ‘কাদম্বরী’র নাই; তাহার কারণ উহার ভাষা খাঁটি নয়, কৃত্রিম; ব্যাকরণ, অভিধান, অলঙ্কার বাক্যঝঙ্কার সবই উহাতে আছে, কিন্তু তথাপি উহার রচনা-রূপ খাঁটি নয়, তাই রসিকের রস-পিপাসা মিটাইতে পারে না। লেখক বোধ হয় ইহাই বলিতে চান, কিন্তু পাকের দোষ কোথায়, তাহা ধরিতে পারেন নাই—ভাষার এত গুণ সত্ত্বেও রচনা কেন মনোহারী হয় না, তাহাতে বিস্ময় বোধ করিয়াছেন, কিন্তু কারণ বুঝিতে পারেন নাই—কথাটা বলিয়াও বলিতে পারেন নাই। আবার, লেখক তাঁহার মনোমত উৎকৃষ্ট রচনার গুণ ব্যাখ্যা করিয়াছেন এইরূপ—

“কিন্তু অন্নদামঙ্গলের ছন্দ, ঈশ্বর গুপ্তের লহর, অক্ষয়কুমারের গাম্ভীর্য্য, বিদ্যাসাগরের প্রসাদগুণ তখন হইতেই প্রাণে বাজিত, প্রাণে লাগিত, প্রাণে বসিয়া যাইত।”

—প্রাণে বাজিত, –লাগিত, –বসিয়া যাইত, ব্যাখ্যা করিবার কি প্রাণান্ত চেষ্টা! ছন্দ, লহর, গাম্ভীর্য্য ও প্রসাদগুণ—এক এক লেখকের এক এক বৈশিষ্ট্য; অথচ, ইহার প্রত্যেকটি এবং একাধিক বা সবগুলি যেকোনও অপর লেখকের থাকিতে পারে; কারণ এই গুণগুলি লেখকের গুণ নয়, ভাষারই গুণ। ভাল লাগে না কেন, তাহাও যেমন লেখক ভাল করিয়া বুঝাইতে পারেন নাই, ভাল লাগে যে কেন বুঝাইতে গিয়া তেমনই যে সকল গুণের উল্লেখ করিয়াছেন তাহা আধুনিক সাহিত্য—বিচারে অতিশয় তুচ্ছ। আধুনিক কালেও সমালোচনার আদর্শ ইহা অপেক্ষা উন্নত হয় নাই, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি—সাহিত্য-সৃষ্টির মূলে যে তত্ত্ব বা রহস্য রহিয়াছে তাহার সম্বন্ধে কোন ভাবনা নাই বলিলেই হয়। ষ্টাইলের তত্ত্বই সেই তত্ত্ব, আমি যথাসাধ্য তাহারই আলোচনা করিব।

প্রথমেই ইংরেজী ষ্টাইল শব্দটি সাহিত্যিক সমালোচনায় যতগুলি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে তাহাই দেখা যাক। এ সম্বন্ধে একজন বিশিষ্ট ইংরেজ সমালোচকের প্রবন্ধ হইতে আমি প্রমাণ সংগ্রহ করিব এবং মূলত এই ষ্টাইলের বিচারণায় তাঁহারই অনুসরণ করিব।

ষ্টাইল শব্দটি তিনটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। প্রথম ভাষায় ব্যক্তিবিশেষের বিচিত্র বাক-ভঙ্গি। ইহাও আমাদের সেই ‘রীতি’ নহে। রীতি যেমন হউক—সাধু বা প্রাকৃত, সমাসবহুল বা সমাসবর্জ্জিত—যেমনই হউক, এক এক লেখকের লেখায় যে—personal idiosyncrasy of expression, ভাষায় যে ব্যক্তিঘটিত লক্ষণ দ্বারা আমরা অনায়াসে লেখককে চিনিতে পারি—লেখার সেই ভঙ্গি-চিহ্নকে ষ্টাইল বলে। কিন্তু এই অর্থে ষ্টাইল কোনও লেখার উৎকর্ষ প্রমাণ করে না—মাত্র ব্যক্তিটিকে ধরাইয়া দেয়। কিন্তু ইহাতে যে ব্যক্তিত্বের চিহ্ন রহিয়াছে—ঐ ব্যক্তিত্বই যখন গভীরতর ভাবে রচনায় প্রকাশ পায়, শুধুই ভাষার ভঙ্গিরূপে নয়—তখন আসল ষ্টাইলের কথা আসে, এবং ষ্টাইল সম্বন্ধে তাহারই বিস্তারিত আলোচনা পরে আবশ্যক হইবে।

দ্বিতীয় যে অর্থে ষ্টাইল কথাটি প্রযুক্ত হইয়া থাকে, তাহা এইরূপ উক্তির মধ্যে আছে, যথা—”লেখকের পাণ্ডিত্য আছে, ভাবচিন্তার ঐশ্বর্য্য আছে, কিন্তু ষ্টাইল নাই।” অর্থাৎ তাঁহার রচনা সুসম্বন্ধ সুপরিস্ফুট সুডৌল নহে; তিনি ভাল করিয়া গুছাইয়া সাজাইয়া আপনার বক্তব্য প্রকাশ করিতে পারেন নাই। এখানে ষ্টাইলের অর্থ—রচনানৈপুণ্য— “the power of lucid exposition of a sequence of ideas”। ষ্টাইলের এই অর্থকে একটু গভীর করিয়া দেখিলে কয়েকটি মূল্যবান সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এই যে অর্থে ষ্টাইল শব্দটি ব্যবহার করা হয়, ইহাতে লেখকের মেধা বা মানস-শক্তি-চিন্তাবস্তুকে সুপরিস্ফুটভাবে প্রকাশ করিবার শক্তি—বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করা হয়। যে সকল রচনায় লেখকের মুখ্য অভিপ্রায় থাকে— the expression of intellectual ideas, সেখানে ষ্টাইলের পক্ষে ভাষার যে গুণ আবশ্যক, তাহা বাক্য-ভঙ্গির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা অপরূপত্ব নয়; অতএব যাহাকে সৃষ্টিধর্মী রচনা বা খাঁটি সাহিত্য বলা যায়—যেমন কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি, তাহার ষ্টাইল এ ষ্টাইল নয়। এখানে লেখকের সাধনা হইবে বিষয়টিকে সুস্পষ্ট ভাষায় যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিপন্ন করা। অতএব, এইরূপ রচনার সম্বন্ধেই ভাষার দোষ বা গুণ, দুৰ্ব্বোধ্যতা বা প্রাঞ্জলতা প্রভৃতির কথা উঠিতে পারে; সে ভাষার আর কোনও উৎকর্ষ-লক্ষণ নাই। এইরূপ রচনার ভাষাই রীতিগত দোষগুণের আকর হইতে পারে, এবং ইহার যে ষ্টাইল, তাহা আভ্যাসিক বা শিক্ষণীয় হইতে পারে; অন্তত কতক পরিমাণে শিক্ষা করা যায়। ইহারই প্রয়োজনে, ভারতবর্ষে ও য়ুরোপে, প্রাচীনকালে হইতে আদর্শ-ভাষা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা চলিয়া আসিয়াছে। ষ্টাইলের ভাল-মন্দ বিচার, ভাষার বিশুদ্ধ মার্জিত সুসংস্কৃত রূপ, ও রচনারীতির আদর্শ—এইরূপ রচনার পক্ষেই খাটে। কিন্তু কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি সাহিত্যকর্ম্মের পক্ষে এরূপ আদর্শ যে খাটে না, তাহার কারণ, সে ক্ষেত্রে ভাষার ভাষাগত কোনও আদর্শ নাই; সেখানে চিন্তা নয়, ভাব; argument নয়, intuition, perception—ভাব, কল্পনা, অপরোক্ষ অনুভূতি বা আন্তর-দৃষ্টির অভিজ্ঞতাই—রচনার বিষয়বস্তু যদি সেই অনুভূতি বা দৃষ্টি অব্যর্থ হয়, ভাব-বস্তু সুকল্পিত বা লেখকের সম্যক আত্মগোচর হয়, তবে তাহার যে বাঙ্ময় প্রকাশ ঘটে, তাহার ষ্টাইল তাহারই, কোনও বহির্গত আদর্শ দিয়া তাহার বিচার চলে না। কারণ এ-জাতীয় রচনা—is not concerned with ideas in the logical sense, এখানে ভাবই ভাষার মূর্ত্তি পরিগ্রহ করে—অর্থসমন্বিত হওয়া অপেক্ষা মূর্তিধারণ করাই তাহার অধিকতর প্রয়োজন; এবং সেই ভাব এতই বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র, যে ভাষা তদনুরূপ বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র হইতে বাধ্য। সে ভাষা মানস ক্রিয়া বা মস্তিষ্কচালনার ভাষা নয় বলিয়া—তাহার গুণও প্রাঞ্জলতা নয়, দোষও দুৰ্ব্বোধ্যতা নয়; একেবারে কবির অন্তঃকরণ হইতে পাঠকের অন্তঃকরণে সেতু-নির্ম্মাণ করাই তাহার সার্থকতা; যে কোনও প্রকারে, শব্দ অর্থের সাহায্যে, অশরীরী ভাবকে শরীরী করিয়া তুলিতে পারিলেই—সেই রূপকে পাঠকের চিত্তগোচর করাইতে পারিলেই—তাহার কাজ শেষ হইয়াছে বুঝিতে হইবে। রূপের সেই বৈশিষ্ট্যই তাহার সর্ব্বস্ব, তাই তাহার ভাষাও অসাধারণ, এবং ভাব ও ভাষার অভেদত্বই তাহার ষ্টাইল—ভাষাগত কোনও স্বতন্ত্র বস্তু নয়। কোনও কাব্য যদি সত্যকার সুকাব্য হয়, তবে তাহার সকল অঙ্গেই একটি বৈশিষ্ট্য জাজ্বল্যমান থাকিবে—সে কাব্যের সব কিছু তাহারই মত, তাহার ষ্টাইল ভাল বা মন্দ নহে— “the novel or the poem has the excellence proper to it”। মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ’ যদি কাব্য হইয়া থাকে, তবে তাহার ষ্টাইলও তাহারই মত—অর্থাৎ সার্থক হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস যদি সত্যকার কাব্য হইয়া থাকে, তবে তাহার ষ্টাইল ভাল নহে, এমন কথা হাস্যকর; কারণ, “the novel or the poem that is well conceived and badly written is a chimera”। অতএব, ষ্টাইলের এই যে দ্বিতীয় অর্থ, যাহা চিন্তাধর্মী রচনার পক্ষে খাটে, সে অর্থে খাঁটি সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যের ষ্টাইল-বিচার চলে না।

এই ষ্টাইল কথাটি তৃতীয় এক অর্থে প্রয়োগ করা হইয়া থাকে, যেমন, যদি বলি—কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের রচনায় অতিরিক্ত ভাবপ্রবণতা, অসংযম ও উচ্ছৃঙ্খলতা, এবং হাস্যকর কল্পনা থাকিলেও, তাঁহার লেখায় স্টাইল আছে, তাহা হইলে ষ্টাইলের আর একটি অর্থ দাঁড়ায়। বাংলায় আমরা ইংরাজী ষ্টাইল শব্দটি এখনও এইরূপ অর্থে প্রয়োগ করিতে শিখি নাই; তথাপি ইংরেজী হইতেই এই অর্থটি গ্রহণ করিবার প্রয়োজন আছে—কারণ এই অর্থে ষ্টাইলের দৃষ্টান্ত সকল সাহিত্যেই সুলভ। আমরা পূর্ব্বে ষ্টাইলের দুই অর্থ পাইয়াছি—(১) লেখক ও রচনা, এক বা উভয়ের, অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য; এই অর্থে ষ্টাইলের গভীরতর লক্ষণ—ভাব ও শব্দার্থের ঐকান্তিক সারূপ্য। (২) মনঃপ্রধান রচনার সুস্পষ্টতা ও প্রাঞ্জলতা। কিন্তু এই তৃতীয় অর্থে, ষ্টাইল ইহার কোনটাই নয়—কাব্য সাহিত্যে অবশ্য দ্বিতীয়টার প্রয়োজন নাই, কিন্তু প্রথমটির যে লক্ষণ—বাক্যের সহিত ভাবের সুসামঞ্জস্য—তাহাও এখানে রচনার গুণ নহে; বরং ভাব এখানে এমনভাবে প্রকাশ পাইয়াছে, যে, উপমাই হউক বা সহজ ভাষাই হউক, তাহা যেন ভাবের শব্দার্থসঙ্গত রূপ নয়—সে ভাষা ভাবকে তির্যকভাবে প্রকাশ করিয়াছে। এই অর্থে ষ্টাইল যে কি বস্তু তাহা স্পষ্ট নির্দ্দেশ করিতে না পারিলেও দেবেন্দ্রনাথের কবিতার এমন সকল পংক্তি হইতে তাহার কতকটা আভাস পাওয়া যাইবে, যথা—

দাও দাও একটি চুম্বন—
মিলনের উপকূলে, সাগর-সঙ্গমে
দুর্জ্জয় বানের মুখে ভাসাইয়া দিব সুখে
দেহের রহস্যে বাঁধা অদ্ভুত জীবন।

এ ভাষা উপমার ভাষা বটে, তথাপি যে ভাবটি ইহাতে প্ৰকাশ পাইয়াছে সেই ভাবের তুলনায় এই উপমাও নিরুপমা। উপমা কবি-ভাষার একটা বড় উপাদান, এবং দেবেন্দ্রনাথের ভাষারও বৈশিষ্ট্যের একটা কারণ তাঁহার উপমাগুলি। তথাপি উদ্ধৃত উপমাটি যদি কেবল তাহাই হইত, তবে ইহাকে প্রথম অর্থের ষ্টাইল বলিতাম, অর্থাৎ “personal idiosyncrasy of expression”। কিন্তু এই উপমার ভঙ্গি ব্যক্তিগত ভঙ্গিকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছে—অতি গভীর অনুভূতির আবেগে ব্যক্তিত্বের বন্ধন ভাঙিয়া ভাষাকে অপরূপ করিয়া তুলিয়াছে। সাধারণত উপমা যত যথাযথ হয়, ততই তাহা সার্থক; উপমান ও উপমেয়, এই উভয়ের মধ্যে একটি সর্ব্বাঙ্গীণ সৌসাদৃশ্য থাকাই উচিত। এখানে ভাব উপমায় রূপ পাইয়াছে বটে, কিন্তু যাহার সম্পর্কে এই উপমা তাহার সহিত ইহার রূপগত, এমন কি গুণগত সাদৃশ্যও নাই—অনুভূতির গভীর তল হইতে হঠাৎ কেমন করিয়া তাহার রূপ ভাষায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। ইংরেজ সমালোচক এই জাতীয় ষ্টাইলের উদাহরণস্বরূপ Marlowe-র কয়েকটি পংক্তি করিয়াছেন—

See where Christ’s blood streams in the firmament…….

অথবা

Sweet Helen, make me immortal with a kiss.
Her lips suck forth my soul: see where it flies.

ইহার কোনও ব্যাখ্যা না করিয়া তিনি কেবল বলিয়াছেন— “when we say, Marlowe had style, we are refering to a quality which transcends all personal idiosyncrasy, yet needs or seems to need—personal idiosyncrasy in order to be manifested. Style in this absolute sense is a complete fusion of the personal and the universal”। এই যে সর্ব্বগুণনিরপেক্ষ ষ্টাইল, ইহাতে লেখকের বিশিষ্ট ব্যক্তিগত ভঙ্গি থাকিলেও, এবং সেই ভঙ্গির দ্বারাই তাঁহাকে চিনিয়া লইতে পারিলেও অনুভূতির গভীরতা ও ব্যাপকতার জন্য ইহা ব্যক্তিসীমা পার হইয়া যায়—বাক্যবিশেষের মধ্যে নির্বিশেষের ব্যঞ্জনা ফুটিয়া উঠে। দেবেন্দ্রনাথের ওই পংক্তি কয়টির মধ্যেও সেই ষ্টাইল রহিয়াছে।

এতক্ষণে, ষ্টাইল-প্রসঙ্গের একটা গোড়া পত্তন হইল মাত্র; অতঃপর ষ্টাইলের নানা অর্থ ত্যাগ করিয়া উহার স্বরূপ সন্ধান করিবার জন্য বিস্তারিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতে হইবে।

রচনার ভাষাগত যে লক্ষণকে লেখকের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বলা হইয়া থাকে, তাহাই যদি ষ্টাইলের সর্ব্বস্ব হইত, তবে ষ্টাইল বলিতে বিশেষ কিছু বুঝাইত না। কারণ, এই ব্যক্তিত্ব লেখকের ভাষাতেও যেমন পরিস্ফুট, তেমনই তাহা মৌলিক ভাব-কল্পনার—ভিতরকার বস্তুটিরই—অনিবার্য্য ভঙ্গি। লেখার যে ঐশ্বর্য্য ষ্টাইল-রূপে প্রতিভাত হয়, তাহা কেবল ভাষার ভঙ্গি-বৈচিত্র্যই নয়। অনেক সময়ে ভাষার এইরূপ ভঙ্গি ভিতরকার দৈন্য ঢাকিবার একটা কৃত্রিম কৌশলমাত্র হইতে পারে; অনেকে ইচ্ছা করিয়াই তাহাদের ভাষাকে এমন একটি ভঙ্গিমা দিবার চেষ্টা করে যাহাতে পাঠকসাধারণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, এবং রচনার শেষে নাম স্বাক্ষরের মত, রচনার ভাষাতেই আপনাকে জাহির করিবার সুবিধা হয়; ষ্টাইল এই ধরণের ব্যক্তিত্ব প্রচারের কৌশল নহে, কেবল লেখককে চিনাইয়া দিবার মত কোনও লক্ষণ ভাষায় থাকিলেই তাহা ষ্টাইল পদবাচ্য নয়—একথা পূর্ব্বে বলিয়াছি।

তথাপি ষ্টাইল-তত্ত্ব বুঝিতে হইলে, এই ভাষার ব্যক্তিগত ভঙ্গি হইতেই আরম্ভ করিতে হইবে; কারণ ষ্টাইল যাহাই হউক, এবং সেই ব্যক্তিত্ব যতই গভীর যউক, ষ্টাইলের আদি ও চরম পরিচয় ভাষায়। ব্যক্তিগত বাক্-ভঙ্গি ষ্টাইলের সহিত নিত্যসংযুক্ত—এই লক্ষণ লেখকের প্রতিভার শক্তিভেদে উৎকৃষ্ট বা অনুৎকৃষ্ট ষ্টাইলের সূচনা করে। সাধারণত আমরা যখন বলি, ইহা বিদ্যাসাগরী ভাষায় বা ইহা বঙ্কিমী ভাষা, তখন তাহা ভাষারই সম্পর্কে হইলেও—একরূপ ষ্টাইলের ইঙ্গিতও তাহাতে আছে। সেই দুই ভাষাতে লেখকের ব্যক্তিত্ব-চিহ্ন আছে; যদিও একটু পরীক্ষা করিলেই দেখা যাইবে, বিদ্যাসাগরের ষ্টাইল যতটা ভাষাগত, বঙ্কিমের তাহা নহে—আসল ভাবগত ব্যক্তিত্বের পরিচয়, বা সত্যকার ষ্টাইলের লক্ষণ, বঙ্কিমের রচনাতেই অধিকতর পরিস্ফুট। তথাপি আমি এখানে ভাষার সম্পর্কেই ষ্টাইলের গুণ বিচার করিতেছি—মনে রাখিতে হইবে, ইহাও বাহ্য। বিদ্যাসাগরের ভাষায় এই বাহ্য লক্ষণ যত প্রকট, বঙ্কিমচন্দ্রের পরিণত রচনায় তত নহে, তথাপি বিদ্যাসাগরের ভাষায় সত্যকার ব্যক্তি-ভঙ্গিও আছে। তাহার কারণ, বঙ্কিমের মত তাঁহার রচনাগুলিতে একটি মৌলিক ভাবদৃষ্টির প্রকাশ-চেষ্টা না থাকিলেও, বাংলা গদ্যের যে ছাঁদটি তিনি ধরিতে পারিয়াছিলেন তাহাতে তাঁহার নিজেরই ভাষা-বোধ রুচির অভিব্যক্তি ঘটিয়াছে। তাঁহার বাক্-পদ্ধতিতে—শব্দের চয়ন ও গ্রন্থনে—একটা ব্যক্তি—মানসের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়া উঠিয়াছে; শুধু তাহাই নয়, কতকগুলি বিশেষ শব্দ ও প্রয়োগরীতির প্রতি তাঁহার পক্ষপাত আছে দেখা যায়। এইজন্য তাঁহার রচনা পড়িলেই চেনা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাতেও এই ভাষাগত ভঙ্গি তো থাকিবার কথা; কিন্তু তাহার বৈশিষ্ট্য কেবল বাক্যযোজনপদ্ধতির নয়—এত সহজে তাহাকে চিনিয়া লওয়া যায় না; কারণ, সে ভাষায় একটা অতি মৌলিক মানস উপাদান বা ভাব-ভঙ্গি আছে—ইহাই ভাষাকেও অতিক্রম করিয়া পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করে; পড়িবার সময় ভাষাই আমাদিগকে মুগ্ধ করে বটে, কিন্তু খুব প্রকট চাক্ষুষভাবে নহে; ভাষার অন্তরালে যে বক্তি রহিয়াছে—যে অনন্য সাধারণ personality বা চিৎ সত্তা রহিয়াছে—তাহাই আমাদিগকে সমধিক পাইয়া বসে। আমি এই দুইজনের রচনা হইতে দুইটি নিদর্শন উদ্ধৃত করিতেছি—এমন দুইটি স্থান নির্ব্বাচন করিলাম, যাহাতে উভয়ের ভাষার স্বাতন্ত্র্য সহজেই লক্ষ্যগোচর হইবে, এবং সেই সঙ্গে, ভাষার ভঙ্গি ও ষ্টাইল, এই দুই বস্তুর পার্থক্যের একটা স্থূল ধারণাও হইবে।

বিদ্যাসাগর–রাম পম্পাশব্দ শ্রবণগোচর করিয়া সীতাকে বলিলেন, প্রিয়ে পম্পা পরম রমণীয় সরোবর, আমি তোমার অন্বেষণ করিতে করিতে পম্পাতীরে উপস্থিত হইলাম; দেখিলাম প্রফুল্ল কমলসকল মন্দ মারুত দ্বারা ঈষৎ আন্দোলিত হইয়া সরোবরের নিরতিশয় শোভা সম্পাদন করিতেছে; উহাদের সৌরভে চতুৰ্দ্দিক আমোদিত হইয়া রহিয়াছে; মধুকরেরা মধুপানে মত্ত হইয়া গুন গুন স্বরে গান করিয়া উড়িয়া বেড়াইতেছে; হংস সারস প্রভৃতি বহুবিধ বারিবিহঙ্গগণ মনের আনন্দে নিৰ্ম্মল সলিলে কেলি করিতেছে। তৎকালে আমার নয়নযুগল হইতে অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা বিনির্গত হইতেছিল; সুতরাং সরোবরের শোভার সম্যক্ অনুভব করিতে পারি নাই; এক ধারা নির্গত ও অপর ধারা উদগত হইবার মধ্যে মুহুর্ত্তমাত্র নয়নের যে অবকাশ পাইয়াছিলাম, তাহাতেই কেবল এক এক বার অস্পষ্ট অবলোকন করিয়াছিলাম।

বঙ্কিমচন্দ্র–রজনী ঘোর তমোময়ী, তাহাতে সেই অরণ্য অতি বিস্তৃত। একে জলশূন্য, অতিশয় নিবিড়, বৃক্ষলতা দুর্ভেদ্য বন্য পশুরও গমনাগমনের বিরোধী—বিশাল, জনশূন্য, অন্ধকার, দুর্ভেদ, নীরব। রবের মধ্যে দূরে ব্যাঘ্রের হুঙ্কার, অথবা বন্য শ্বাপদের ক্ষুধা, ভীতি বা আস্ফালনের বিকট শব্দ। কদাচিৎ কোন বৃহৎ পক্ষীর পক্ষকম্পন, কদাচিৎ তাড়িত এবং তাড়নাকারী বধ্য ও বধকারী পশুদিগের দ্রুতগমন শব্দ। সেই বিজন অন্ধকারে, ভগ্ন অট্টালিকার উপর বসিয়া একা ভবানন্দ। তাহার পক্ষে যেন পৃথিবী নাই, অথবা কেবল ভয়ের উপাদানময়ী হইয়া আছেন। সেই সময়ে ভবানন্দ কপালে হাত দিয়া ভাবিতেছিলেন; স্পন্দ নাই, নিশ্বাস নাই, ভয় নাই। অতি প্রগাঢ় চিন্তায় নিমগ্ন। মনে মনে ভাবিতেছিলেন, যাহা ভবিতব্য তাহা অবশ্য হইবে। আমি ভাগীরথীজলতরঙ্গসমীপে ক্ষুদ্র গজের মত ইন্দ্রিয়স্রোতে ভাসিয়া গেলাম—ইহাই আমার দুঃখ।

কেবলমাত্র ভাষাহিসাবে বিচার করিয়া দেখিলে বিদ্যাসাগরের ভাষা-সরল, শুদ্ধ, মসৃণ, অতিশয় বিশদ ও প্রসাদগুণবিশিষ্ট। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা যে উপাদানে গঠিত, সেই বাক্ বা শব্দভাণ্ডার—বিদ্যাসাগরের সমগোত্রীয়, কিন্তু রীতি সেইরূপ বিশুদ্ধ ও মসৃণ নহে। শব্দযোজনায় উভয়ের রুচি এক নয়; তাহার কারণ, উভয়ের প্রয়োজন ভিন্ন। বিদ্যাসাগরের প্রয়োজন ছিল সম্পূর্ণ বহির্গত বা objective; তাঁহার রচনায় কোনও মৌলিক কল্পনা বা স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি—এক কথায়, কোনরূপ প্রবল ও গভীর আত্মভাব-প্রকাশের, অথবা একটা কিছু নূতন-সৃষ্টির অভিপ্রায় নাই। যে অতিশয় সুপ্রচলিত ও সহজ সাহিত্যের রীতি ও রচনার আদর্শ তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে পাইয়াছিলেন—বাংলা গদ্যনির্মাণের প্রয়োজন তাহাতেই সুসম্পন্ন হইয়াছিল; সেই পূৰ্ব্বসৃষ্ট সাহিত্যকে আদর্শ করিয়া তাহার রচনারীতি এবং কাব্যভাব পর্য্যন্ত তিনি যে ভাবে বাংলা গদ্যের সেই অতিশয় অপরিপুষ্ট দেহে যোজনা করিয়াছিলেন, তাহাই তাঁহার অসাধারণ কৃতিত্ব; কেবলমাত্র ভাষার বিশুদ্ধি ও সৌন্দর্য্য, সাবলীল গতি ও স্বচ্ছন্দ শব্দার্থ, ইহাই ছিল তাঁহার সাহিত্যিক সাধনা। রামমোহন রায় প্রভৃতি পূর্ব্ববর্ত্তিগণের নিষ্ফল প্রয়াসের সহিত তুলনা করিলেই বুঝিতে পারা যায়, তিনি সে সাধনায় কতখানি সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন; তিনি ভাষাকে অসাহিত্যিকের কৃচ্ছ্র-সাধনা হইতে উদ্ধার করিয়া বাংলা গদ্যসাহিত্যের পথ মুক্ত করিয়াছিলেন—তাঁহার ষ্টাইল সাহিত্যের ষ্টাইল নয়, ভাষার ষ্টাইল। এই ভাষার ষ্টাইল অতঃপর বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ষ্টাইলে উন্নীত হইল বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভায়। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাতেই আমরা সর্ব্বপ্রথম অতি উৎকৃষ্ট ষ্টাইলের দেখা পাইলাম। অতএব ভাষাহিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুবর্ত্তী, তাঁহার নিকটে ঋণী বটে; কিন্তু সেই ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিত্বই সর্ব্বপ্রথম সাহিত্যসৃষ্টি করিয়াছে—এ জন্য ভাষা একটি ষ্টাইল—রূপ ধারণা করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বাহ্য ব্যক্তি-ভঙ্গি যেমনই থাকুক, তাহা ঐ ব্যক্তিভাব বা ব্যক্তি-সত্তার সহিত এমনই দৃঢ়সংপৃক্ত যে, সেই ভঙ্গিকে ভাষা হইতে পৃথক করিয়া রচনামাত্রের আদর্শরূপে নির্দ্দেশ করা যায় না। বিদ্যাসাগরের ভাষায় সে ব্যক্তিত্ব নাই, তাই তাঁহার ভাষা এক পক্ষে বড় উপকারী হইয়াছে—বাংলা গদ্যের আদ্যরীতিরূপে বহু লেখকের উপজীব্য হইয়াছে। এইজন্যই ‘বিদ্যাসাগরী ভাষা’ কথাটার যে অর্থ হয়, ‘বঙ্কিমী ভাষা’ কথাটির ঠিক সেই অর্থ হয় না; বিদ্যাসাগরের ভাষা একটি অনুকরণযোগ্য আদর্শ, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা সে হিসাবে কার্য্যকরী নহে—সে ভাষা একটা রীতিমাত্র নহে বলিয়া তাহার অনুকরণ অসম্ভব।

উপরি-উদ্ধৃত উদাহরণ দুইটিই বর্ণনামূলক। বিদ্যাসাগরের রচনায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য-সৃষ্টির লক্ষণ নাই, উহা আমাদের চিত্তে কোনও অভিনব অনুভূতি বা ভাবের একটি অতিশয় নূতন, অসাধারণ, অপূর্ব্বকল্পিত রূপের প্রতিষ্ঠা করে না-এক কথায়, উহা particular নয়, উহা সাধারণ। তাহার কারণ, লেখক যাহা বর্ণনা করিয়াছিলেন তাহা তাঁহার নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা আত্মভাবদৃষ্টির ফল নহে—উহার মধ্যে ব্যক্তি-চৈতন্যের সেই নিবিড় স্পর্শ নাই, ভাবকল্পনার সেই রহস্যময় বিদ্যুৎ চমক নাই—সকল সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যের যাহা বিশিষ্ট লক্ষণ। বিদ্যাসাগরের সাহিত্য—সাধনায় সে প্রেরণা বা উদ্দেশ্য ছিল না—তাঁহার প্রতিভা বা শক্তি সে স্তরের নহে। অতএব বিদ্যাসাগরের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের তুলনা করাই অসঙ্গত, আমি কেবল আলোচনার সৌকর্য্যার্থে এই তুলনা করিয়াছি। আমার প্রতিপাদ্য ইহাই যে, যে লেখার মূলে বস্তুর সহিত ব্যক্তির যথার্থ সাক্ষাৎকার-জনিত প্রেরণা নাই, তাহাতে ভাষার রীতি-সৌন্দর্য্য থাকিতে পারে, ষ্টাইল থাকিতে পারে না—অন্তত যে ষ্টাইলের সন্ধান আমরা এক্ষণে করিতেছি। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা হইতে যে দৃষ্টান্ত দিয়াছি, তাহার মূলে আছে স্থানকালপাত্রগত একটি বিশিষ্ট ভাবের প্রেরণা; সে ভাব লেখকের কল্পনাবলে তাঁহারই মানসে এমনই একটা প্রত্যক্ষ মূৰ্ত্তি হইয়া উঠিয়াছে যে, তাহা অনন্যসদৃশ্য, অসাধারণ; এজন্য সেই ভাব আপনাকে যথাযথ প্রকাশ করিবার জন্য—আপন রূপায়তন দেহ ধারণ করিবার জন্য—প্রতি ছত্রে প্রতি কথায়, বর্ণনার প্রত্যেক উপকরণকে আশ্রয় করিয়া এবং ভাষাকে যেন নিজ দাসত্বে নিযুক্ত করিয়া যুগপৎ এমন ধ্বনিময় ও অর্থানুভূতিময় হইয়া উঠিয়াছে। যেখানে যে শব্দ বা বাক্য সংযোজিত হইয়াছে—যে উপমা, পুনরুক্তি, বাগবাহুল্য, এমন কি, বাক্যের অমসৃণতাকে পর্য্যন্ত এই ভাষায় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহার একমাত্র লক্ষ্য সেই ভাবকে যথাযথ রূপ দেওয়া—ভাষার বিশুদ্ধতা, বা রীতি সৌষ্ঠবেরও উপরে স্থান পাইয়াছে ভাবের স্বচ্ছন্দ ও সুসঙ্গত প্রকাশ। এ পংক্তিগুলিতে কবি স্থানকালোদ্দিষ্ট একটি বিশিষ্ট মানবহৃদয়ের নির্জ্জন নিশীথান্ধকার ভাষায় সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছেন, তাহার মূলে আছে একটি ব্যক্তির একাগ্র ও অনন্যসুলভ ভাবদৃষ্টি। এজন্য এই রচনার যে ষ্টাইল, তাহাকে কোনও একপ্রকার বাক্যরীতিরূপে রচনা হইতে পৃথক করিয়া ধারণা করা যায় না। অথচ ইহাও ঠিক যে, লেখকের এই ভাবদৃষ্টি একটি বিশিষ্ট বাকভঙ্গিকে আশ্রয় করিয়া আছে। অতএব ষ্টাইল অর্থে ব্যক্তিগত বাকভঙ্গি বা ‘idiosyncrasy of expression’-ও বুঝায় তাহা এখানে কেবল ভাষাতেই প্রকট নহে—ভাবে ও ভাষায় মিলিয়া তাহা এমন হইয়া আছে যে, দুয়েরই অন্তর্গত সে যেন একটা তৃতীয় বস্তু, এবং ইহাকেই নির্দেশ করিয়া বলা যাইতে পারে—“Style is the man himself”।

অতএব দেখা যাইতেছে যে, ব্যক্তিগত বাক্-ভঙ্গিকে এক অর্থে ষ্টাইল বলা গেলেও—যেমন, বিদ্যাসাগরী বা বঙ্কিমী ভাষা, কোনও রচনার উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক লক্ষণ কেবল তাহাই নহে; বরং তাহাকে ‘এহ বাহ্য’ বলিয়া আরও ভিতরে আসল ষ্টাইলের সন্ধান করিতে হয়। মনে রাখিতে হইবে যে, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য দুই কারণে হইয়া থাকে; এক—ভাষাকে লইয়া কলাকৌশলের অভিলাষ; সেখানে প্রয়োজনটা সম্পূর্ণ বহির্গত। দুই—অতিশয় মৌলিক ব্যক্তিগত প্রেরণার বশে, লেখকের যাহা নিজস্ব অতএব অনন্যসাধারণ অনুভূতি তাহাকে বাক্যে যথাযথরূপে প্রকাশ করার প্রয়োজনে ভাষায় একটি অনুরূপ অঙ্গ অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠে। প্রথমটির সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক হইবে না —সাধারণ লেখকের ঐরূপ হইয়া থাকে, এবং অলঙ্কার-শাস্ত্রোক্ত রীতি প্রভৃতি উহার সম্বন্ধেই খাটে। এই রীতি ও ষ্টাইলের প্রভেদ সম্বন্ধে আরও কিঞ্চিৎ আলোচনা পরে করিব। কিন্তু দ্বিতীয়টির ব্যাখ্যা ও বিচার সাহিত্য-সমালোচনার প্রায় সমগ্র ক্ষেত্রটি জুড়িয়া আছে—আমি অতঃপর যতদূর সম্ভব তাহারই কথা বলিব।

যে রচনা সৃষ্টিধর্মী, অর্থাৎ যাহাকে আমরা খাঁটি সাহিত্য বলি—যেমন, কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি, তাহার প্রধান লক্ষণ এই যে, তাহাতে ভাবকেই রূপ দেওয়া হয়। সেই রূপ আমাদিগকে আকৃষ্ট করে এজন্য যে, তাহা অতিশয় স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট, অনন্যসদৃশ্য; তাহা particuler, সামান্য বা একাকার নয়; তাহা তাহারই মত, তাহার তুলনা সে-ই। ভাগবতী সৃষ্টির লক্ষণও তাহাই—কোনও দুইটি বস্তু একরূপ নহে, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র সত্তায় অন্যটি হইতে পৃথক। সাহিত্যে ও বিজ্ঞানে—কবি ও বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে—মূল প্রভেদ এই যে, একজন সর্ব্বত্র অসামান্যকে আবিষ্কার ও প্রকাশ করিতেছে, অপর জন সর্বত্র সামান্যের সন্ধান ও প্রতিষ্ঠা করিতেছে। বিজ্ঞান মানুষ—জাতির সামান্য ধর্ম্ম উদ্ধার করিয়া ফিজিয়লজি, সাইকলজি প্রভৃতি প্রণয়ন করিতেছে; কবি মানুষ-ব্যক্তির অসামান্যতায় মুগ্ধ হইয়া ‘চরিত্র’ সৃষ্টি করিতেছে, ওখানে তত্ত্ব, এখানে রূপ। বিজ্ঞানের মতে মানুষের একই নাম—সর্ব্বনাম ‘মানুষ’; কাব্যে মানুষের ঐরুপ সর্বনাম নাই, সেখানে এক এক জনের এক এক নাম—রাম, যুধিষ্ঠির, অ্যাকিলিস, হ্যামলেট। ইহার নাম—রূপ, ইহাকেই বলে—সৃষ্টি। এইজন্য একজন আধুনিক মহামনীষী বলিয়াছেন, যাহা সাহিত্যের সৃষ্টি, আর্টের সৃষ্টি—যে সকল রূপ কবিমানসপ্রসূত, তাহাদের সম্বন্ধে Zoology-র শ্রেণীবিভাগ চলে না। এইরূপ কেবল চরিত্রসৃষ্টিতে নয়, যাহা কিছু সাহিত্যে রূপ পরিগ্রহ করে, তাহাই—particular বা—

অনন্যসদৃশ্য, অসামান্য। কবি যদি কোনও সন্ধ্যার বর্ণনা করেন, সে সন্ধ্যার রূপ সত্য ও সার্থক হইতে হইলে তাহা সর্বনামের সন্ধ্যা হইবে না, আর সকল সন্ধ্যা হইতে তাহা বিলক্ষণ ও স্বতন্ত্র হইবে; এবং হয় বলিয়াই তাহার রূপ লক্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক হয়; আমরা বলি, হাঁ, ইহা একটি সৃষ্টি বটে! রসতত্ত্বের কথা এখানে তুলিব না, নতুবা বলিতাম, এইরূপ স্বাতন্ত্র্যের জন্যই তাহা রসিকের চিত্তে রসোদ্রেক করে—নির্ব্বিশেষ নয়, বিশেষের দ্বারাই রসোদ্রেক হয়, রসরূপে যাহা নির্বিশেষে সৃষ্টিরূপে তাহাই বিশেষ; এবং সাহিত্যের রসাস্বাদ বিশিষ্ট-রূপেরই রসাস্বাদ। এই প্রসঙ্গে আমি আমাদের বর্তমান শ্রেষ্ঠ কবির সাক্ষ্য উদ্ধৃত করিতেছি—

আজ এই দিনের শেষে
সন্ধ্যা যে ঐ মাণিকখানি পরেছিল চিকণ-কালো কেশে,
গেঁথে নিলেম তারে
এই তো আমার বিনি-সুতার গোপন গলার হারে।
একটি কেবল করুণ পরশ রেখে গেল একটি কবির ভালে;
তোমার অনন্তমাঝে এমন সন্ধ্যা হয় নি কোনো কালে,
আর হবে না কভু।
এমনি করেই প্রভু,
এক নিমিষের পত্রপুটে ভরি
চিরকালের ধনটি তোমার ক্ষণকালে লও যে নূতন করি।

—এ কবিতায় রস-রহস্যের বা সৃষ্টিরহস্যের যে একটু সন্ধান মেলে তাহাতেই বুঝিতে পারা যায় যে, যাহা চিরন্তন, যাহা দেশে ও কালে খন্ডিত নয় বলিয়া কেবল ভাবের মধ্যে উঁকি দেয়—রূপে ধরা দেয় না, তাহা কেমন করিয়া কবির দৃষ্টিতে অসামান্য হইয়া উঠে।

তোমার অনন্তমাঝে এমন সন্ধ্যা হয় নি কোনো কালে,
আর হবে না কভু।

—এই অসামান্যের রসাবেশে, ‘এই আর হবে না কভু’র বিস্ময়ানন্দে, কবির পক্ষে রূপসৃষ্টি সম্ভব হয়।

কিন্তু রূপের এই অসামান্যতার কারণ কি? অতি সংক্ষেপে বলিতে গেলে প্রত্যেক অনুভূতির ব্যক্তিগত বলিয়া অনন্যসদৃশ। আমি যাহা যেমন দেখি, তুমি তাহা ঠিক তেমন দেখ না, তাই প্রত্যেক দেখায় এক একটি বিশেষ রূপের জন্ম হয়। ইহার মধ্যে আরও গভীর কথা আছে। প্রথম, দেখিবার যে শক্তি দ্রষ্টার না থাকিলে কোন সত্যকার রূপ ধরা পড়ে না, তাহা সকলের নাই; তাহাকেই দিব্যদৃষ্টি বা কবিপ্রতিভা বলা যায়। সেই সাক্ষাৎকার যখন সম্পূর্ণভাবে হয়, তখন লেখকের মানসে তাহা যেমন স্পষ্ট, তেমনই নূতন অনুভূত হয়—ইহাই স্বাভাবিক; সে দেখা তেমন করিয়া আর কেহ দেখে নাই, এবং তাহাকে প্রকাশ করিতে হইলে রচনার রূপও অতিশয় নূতন ও অনন্যসদৃশ হইতে বাধ্য। যাহার সে দিব্যদৃষ্টি নাই, যাহার মানসে এইরূপ ঘটনা ঘটে নাই, তাহার দ্বারা কিছুই ‘সৃষ্টি’ হইতে পারে না; সেইজন্য তাহার বর্ণনা প্রাণহীন, মামুলী ও সাধারণ হইয়া থাকে। তাহার রচনার ভাষায় চাতুরী যতই থাকুক তাহাতে ষ্টাইল থাকিবে না। অতএব এই যে প্রকাশ-ভঙ্গিমা বা ভাবের ভাষারূপ, তাহা এমন একটি সৃষ্টি, যাহা লেখকের ব্যক্তিসত্তা বা আন্তর—দৃষ্টির সহিত অবিচ্ছেদ্য হইয়া আছে, লেখা হইতে তাহাকে পৃথক করিয়া লওয়া যায় না; এই জন্য আসল idiosyncrasy of style অনুকরণ করিবার নয়; তাহা যদি সম্ভব হইত, তবে একজনের ব্যক্তিত্ব অনায়াসে অপরের হইতে পারিত—চোখ মুখ ভিন্ন, কিন্তু কণ্ঠস্বর এক হইতে পারিত।

এই যে ষ্টাইল, ইহা ভাষারই লক্ষণ বটে, এমনকি ভাষা হইতে ইহা যে অভিন্ন তাহা বলাই বাহুল্য; কারণ যাহা সাহিত্যের গুণ, তাহাকে ভাষা হইতে পৃথক করিবে কেমন করিয়া? ষ্টাইলকে যেমন ভাষা হইতে পৃথক করা যায় না, তেমনি ভাষাও ষ্টাইলের সমাবয়বী,—এ কথা বুঝিয়া লইবার পর, যাহাকে Psychology of Style বা সাহিত্যসৃষ্টিতে ব্যক্তি ও নির্ব্যক্তির তত্ত্ব বলা হইয়া থাকে, তাহারই আলোচনা মতত্ত্ব করিতে হইবে।

যাঁহারা দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক, তাহাদের রচনার প্রেরণা কোনও চিন্তা নয়—পরন্তু একটি ভাব বা অনুভূতি, একথা ইতিপূর্ব্বে অনেকবার উল্লেখ করিতে হইয়াছে। এই ভাব বা অনুভূতির কারণ—কোন কিছুর সাক্ষাৎকারজনিত একটা অতিশয় প্রবল চিত্ত-স্ফূর্ত্তি। সেই অনুভূতি একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ-পরিণামী সংবাদের আকারে ধরিয়া দিবার নয়; কবিচিত্ত ও সেই ভাবোদ্দীপক বস্তু, এই দুইয়ের মিলন অতিশয় অপরোক্ষ—তাহাদের মধ্যে কোনরূপ চিন্তার মধ্যস্থতা নাই; কবির কাজ এই চিন্ময়কে বাঙ্ময় করিয়া তোলা— যাহা বাক্যের অগোচরে ধরা দিয়াছে তাহাকেই বাক্যের দ্বারা গোচর করা। অতএব কবির ভাষা বিজ্ঞান-দর্শনের ভাষা নয়—এইভাবকে মূৰ্ত্তি দিতে হইলে ব্যাখ্যা বা বিবৃতিই যথেষ্ট নয়, তাঁহার বাক্যযোজনা—ভাবেরই অঙ্গযোজনা, তাঁহার ভাষা ভাবেরই প্রত্যক্ষ প্রতিরূপ; তাহা expository নয় creative; সেই বস্তুকে কেবল ব্যাখ্যা অথবা নির্দেশ করা নয়, তাহাকে ঠিক যেমন তেমনি করিয়া দেখাইতে হয়—অপরেরও অনুভূতি গোচর করিতে হয়। He is not really defining but compelling you to feel in a certain way, অতএব রচনাকালে কবির প্রধান সমস্যা— How shall he compel others to feel the particularity of his emotion? ‘Particularity of emotion’ কথাটাই সবচেয়ে বড় কথা, এবং ষ্টাইলেরও প্রধান সার্থকতা এই precise communication—পরচিত্তে তাহার অতিশয় যথাযথ সংক্রামণ। Particular—ity—এর কথা আগে বলিয়াছি; তাহার কারণও বলিয়াছি। বস্তু এক হইলেও ব্যক্তির দৃষ্টিতে তাহার যেটুকু অসামান্য তাহা যেমন particular, তেমনই তাহাই emotion-এরও কারণ। যেখানে এই particularity নাই সেখানে বুঝিতে হইবে, প্রেরণা নিষ্ফল হইয়াছে—তাহা দ্বারা যথার্থ সৃষ্টি সম্ভব নয়। ইহাই—Psychology of style। কিন্তু ইহার সঙ্গে আর একটা বড় প্রশ্ন জড়িত হইয়া আছে। এই যে Particularity বা দৃষ্টি ও সৃষ্টির বিশেষত্ব—ইহা কি সর্বত্র ও সর্বাংশে ব্যক্তিগত বা personal?

ষ্টাইল personal না হইয়া পারে না, তাহা বুঝিলাম, কিন্তু সেই ষ্টাইলের যে রচনা তাহা কি জীবন ও জগতের একটা অতিশয় সংকীর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একদেশবদ্ধ রূপ? এ কথার উত্তরে বলা হইয়া থাকে, বিশুদ্ধ ষ্টাইল-তত্ত্বের দিক দিয়া আমরা ঐ ব্যক্তিতত্ত্বকেই বিশেষ মূল্য দিয়া থাকি বটে, এবং সকল সাহিত্যসৃষ্টির মূলে যে particularity আছে তাহার কারণ ঐ ব্যক্তিগত অনুভূতি বা mode of experience বটে; কিন্তু উৎকৃষ্ট রসসৃষ্টির আর একটা রহস্য আছে, তাহা রহস্যই। কবির সেই দৃষ্টি যদি অসাধারণ দিব্যদৃষ্টি হয় তবে তাহা জগৎ ও জীবনকে আপনার সেই অনুভূতিকেন্দ্রে এমন সমগ্রভাবে মন্ডলায়িত করে যে, অতিশয় particular—এর ভিতর দিয়াই universal বা নির্বিশেষের ব্যঞ্জনা সম্ভব হয়। যেখানে এইরূপ ঘটে, সেখানে ষ্টাইলের পরাকাষ্ঠা হয়; আমরা সাহিত্যসৃষ্টিতে সাধারণত দুইটি প্রবৃত্তি লক্ষ্য করি-realistic ও romantic; একটিকে বস্তুনিষ্ঠ, অপরটিকে ভাবনিষ্ঠ বলা যায়। লেখকের দৃষ্টিকেও Subjective ও objective—তন্ময় ও মন্ময় বলিয়া একটা ভেদ নির্দ্দেশ করিয়া থাকি, এবং তদনুসারে ষ্টাইল কথাটিও দুই বিভিন্ন অর্থের দ্যোতনা করে। কিন্তু —the highest style is that wherein the two current meanings of the word blend; it is combination of the maximum of personality with the maximum of impersonality; এইরূপ যেখানেই হয়, সেখানে কাব্যের রূপ-বিশেষে—subjective বা objective যে কোনও ভাবের প্রকাশে— a perfect condensation of a whole universe of experience ঘটে; কয়েকটি ছত্রে বা শতখানেক শব্দে, কবির বিশ্বানুভূতি যেন কেন্দ্ৰীভূত হইয়া উঠে—কাব্যের স্থানকালপাত্রগত বিশেষ ভাবটির মধ্যেই জীবন ও জগতের বৃহত্তম ও গূঢ়তম নিয়তি ক্ষণবিম্বিত হইয়া উঠে। এই যে ষ্টাইল, ইহার ব্যক্তিত্ব-গুণ যেমন অবিসংবাদিত, তেমনই ইহার ভাষারও কোন জাতি নাই—সেখানে precise communication যেন বাক্পদ্ধতির সকল ভঙ্গি অগ্রাহ্য করিয়া personal ও impersonal-এর মিলনভূমি হইয়া দাঁড়ায়; ইহাকেই বলে “complete projection of personal emotion into the created thing”—সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার পূর্ণ আত্মা-প্রবেশ। সেখানে ভাষার কোনও নির্দেশযোগ্য লক্ষণ নাই—অতিশয় আলঙ্কারিক ভাষা, গুরু-গম্ভীর উদাত্ত বাক্যবিভূতি হইতে অতিশয় সাধারণ গদ্যময় কথ্য ভাষার স্তরে, সে ষ্টাইলের উঠিতে ও নামিতে বাধে না। ইহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শেকসপীয়ারের ‘অ্যান্টনী ও ক্লিওপেট্রা’ নাটকের শেষ দৃশ্যে মৃত্যু-স্বয়ম্বরা ক্লিওপেট্রার উক্তি—ভাষা সেখানে কোথায় উঠিতেছে ও নামিতেছে!—

Give me my robe, put on my crown; I have
immortal longings in me. Now no more
The juice of Egypt’s grape shall moist this lip.

ইহার কিছু পরেই—

The stroke of death is as a lover’s pinch
Which hurts and is desired.
Dost thou not see my baby at my breast,
That sucks the nurse asleep?

অথবা লীয়ারের সেই আর্তনাদ—

Thou wilt come no more,
Never, never, never, never, never!
Pray you, undo this button.

—এখানে ভাষার নীতির তো কথাই নাই—ভাষা একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে; অসহ্য অরুন্তুদ বেদনার ভাষা নাই, তাই নির্ভাষাকেই কবি এখানে কাজে লাগাইয়াছেন; ইহাই ষ্টাইলের পরাকাষ্ঠা। ষ্টাইলের অনেক রূপ আছে বটে যাহা—individual mode of experience বা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ফল; কিন্তু তাহারও উৎকর্ষ অপকর্ষ নির্ভর করে—according as the mode of experience expressed is more or less significant and universal; অর্থাৎ সেই ষ্টাইল তত শ্ৰেষ্ঠ যাহা মানব-জীবন বা মানবহৃদয়জগৎকে গভীর ও সমগ্রভাবে প্রতিফলিত করিবার যত অধিক উপযোগী। এইরূপ ষ্টাইলের সহিত আর কোনও প্রকার ষ্টাইলের তুলনাই হয় না। “This is the style that is the very pinnacle of the pyramid of art…at once the supreme achievement and the vital principle of all that is enduring in literature, the surpassing virtue that makes for many of us some few dozen lines in Shakespeare the most splendid conquest of the human mind.” এখানে ইহার অনুবাদ দিলাম না; পরে ভাষার রীতি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনায় ইহার মর্ম্ম আপনিই পরিস্ফুট হইয়া উঠিবে। Psychology of Style সম্বন্ধে ইহার অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন-এমনিই প্রসঙ্গের একটু বাহিরে আসিয়া পড়িয়াছি, কারণ ইহার সহিত কাব্যতত্ত্ব বা রসতত্ত্বের যোগ রহিয়াছে, আমার প্রসঙ্গ তত গভীর নহে। এক্ষণে, Problem of Style বা ষ্টাইলের মূল সমস্যা—আন্তর-অনুভূতিকে বাঙ্ময় করিয়া তোলার যে সমস্যা—সেই সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।

পূর্ব্বে সাহিত্যের প্রধান ধৰ্ম্ম কি তাহা বলিয়াছি—ভাবকে ভাষায় রূপ দেওয়া, তাহাই ষ্টাইলের আসল সমস্যা। কারণ, যাহাকে রূপ দিতে হইবে তাহা লেখকের অত্যন্ত নিজস্ব দৃষ্টির ফল, অতএব তাহার ভাষাও লেখককে নিজেই প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে, শব্দ-যোজনা ও শব্দার্থ-ব্যঞ্জনায় সেই ভাবকে তাহার সম্পূর্ণ অনুরূপ মূৰ্ত্তি দিতে হইবে; ভাবও যেমন অভিনব ও মৌলিক, শব্দবিন্যাস ও বাপদ্ধতিতে সেইরূপ অভিনবত্ব অবশ্যম্ভাবী। আবার যাহাকে ভাষায় রূপ দিতে হইবে তাহা কোনরূপ চিন্তাবস্তু নয়—একটা ভাব বা ভাবাবস্থাকে এক চিত্ত হইতে অপর চিত্তে সংক্রামিত করাই সাহিত্যসৃষ্টি। এরূপ ভাবকে কোনও সুস্পষ্ট সুনিৰ্দ্দিষ্ট অর্থবাচক শব্দে বাঁধিয়া দেওয়া যায় না, তাহা হইলে তাহা ভাব না হইয়া একটা অর্থ-সমন্বিত তত্ত্ব হইয়াই দাঁড়াইবে—কোনও একটা চিন্তার আকার ধারণ করিবে। সকল তত্ত্বই একটা নির্ব্বিশেষ সাধারণ কিছুকেই প্রকাশ করে, কিন্তু ভাব তাহার ঠিক বিপরীত, বিশেষত্ব বা particularity-ই উহার সর্ব্বস্ব। অতএব বাক্যের সেই নিৰ্দ্দিষ্ট অর্থ—বন্ধন শিথিল করিয়া কোনও একটি অতিশয় বিশিষ্ট ভাবের ভাষা-রূপ নিৰ্ম্মাণ করাই সাহিত্যের সমস্যা; তাহাই ষ্টাইলের সমস্যা। এই ভাষা যে কিরূপ হইবে তাহা বাহির হইতে নির্দ্দেশ করা সম্ভব নয়—এই সাহিত্যিক রচনার যে গুণকে ষ্টাইল বলে তাহা কোনও শাস্ত্রবিধির অধীন নহে। রচনার ষ্টাইল কি হইবে তাহা লেখকের আন্তর অনুভূতিই নির্ণয় করিয়া লয়, এবং যখন ভাষায় লেখকের সেই অনুভূতি আমাদেরও পূর্ণপ্রত্যক্ষ হইয়া উঠে, তখনই আমরা বুঝিতে পারি—এ রচনার ইহাই যথার্থ ভাষা, যথাযথ বাণী-রূপ। যখন তাহা বুঝি, তখন আমরা সেই রচনার সমগ্র বাঙ্ময় রূপকে ভাবের সমগ্রতার সঙ্গেই মিলাইয়া দেখি—শব্দ বা বাক্যের কোনও পৃথক মূল্য স্বীকার করি না; ভাবটিকে কেন্দ্র করিয়া তাহাদের পারস্পরিক সম্বন্ধ যদি সুসমঞ্জস ও অঙ্গাঙ্গী হয়, তবেই তাহাদের চয়ন ও যোজনা সার্থক হইয়াছে মনে করি। যে ভাষায় সত্যকার ষ্টাইল আছে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা করিয়া—সমগ্র ভাবরূপের কেন্দ্র হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া—তাহার শব্দগুলিকে ব্যাকরণ, অভিধান বা শব্দশাস্ত্রের কষ্টিপাথরে পৃথকভাবে যাচাই করিতে যাওয়া সাহিত্যনীতি—বিরুদ্ধ। লেখকের আন্তর-অনুভূতি যদি সুস্পষ্ট ও সুসম্পূর্ণ হইয়া থাকে, তবে ভাষায় তাহার যে প্রকাশ—সেই ষ্টাইল অনবদ্য হইবেই। সাহিত্যের ভাষা ভাব-রূপের ভাষা, তাহা পাঠকের অপরোক্ষ অনুভূতি বা প্রত্যক্ষ অনুভূতির সহায়; এজন্য সাধারণ শব্দসম্পদের সাহায্যেই সেই ভাষা নির্ম্মাণ করিবার—অর্থবাচক বাক্যকেই রূপসৃষ্টির উপাদান করিবার—কৌশল সম্বন্ধে, কিঞ্চিৎ বিস্তারিত আলোচনা করিব; ইহাও বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাইবার নয়, মুখ্যত কতকগুলি দৃষ্টান্ত পাঠকের দৃষ্টিগোচর করিব।

ভাষার উপাদান—কথাটা ঠিক হইল না; কারণ তাহা হইলে উপাদানগুলিকে পৃথক করিয়া তাহাদের সম্বন্ধে কতকগুলি নিয়ম বিধিবদ্ধ করা সম্ভব হইত; অলঙ্কারশাস্ত্র তাহাই করিয়াছে, উহা এক রকম বৈয়াকরণ-বৃত্তি, সাহিত্য-বিচার নয়। এ কথা কখনও বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, ভাষা অংশত ও পূর্ণত সেই এক বস্তু—ষ্টাইল। অতএব এই ষ্টাইলের উপাদান বলিতে নানারূপ বাগন্ধ বুঝিব বটে, কিন্তু কোনরূপ বাঁধা-বুলি বুঝিব না। যেহেতু, অপরোক্ষ অনুভূতিকে পরোক্ষ ভাষার উপাদানে মূৰ্ত্তি দেওয়াই ষ্টাইলের সমস্যা, অতএব সেই ভাষানির্মাণে বাক্যগুলিকে যতদূর সম্ভব রূপাত্মক করিয়া ব্যবহার করিতে হয়—ভাবকে অবিকল যথাযথরূপে প্রকাশ করিবার জন্য ভাষাকে সাধারণ ধৰ্ম্ম হইতে একটা ভিন্ন ধর্ম্ম গ্রহণ করাইতে হয়; শুধু বস্তু-নির্দেশ বা তথ্যবর্ণন নয়—কেবল বিবৃতি বা জ্ঞাপন মাত্র নয়—মূল বস্তুকে তাহা দ্বারা একেবারে চক্ষুর সম্মুখে উপস্থিত করিতে হয়, ভাবকে এক চিত্ত হইতে অপর চিত্তে সংক্রামিত করিতে হয়। এক্ষণে সেই উপায়গুলির কয়েকটি, দৃষ্টান্ত সহযোগে বুঝাইবার চেষ্টা করিব।

কবিচিত্তে ভাবের উদ্রেক নানা কারণে হয়; তাহার মধ্যে বাহিরের বস্তু, ঘটনা বা দৃশ্যই একটা অতি সাধারণ কারণ। ভাব যদি এইরূপ ইন্দ্রিয়ার্থঘটিত হয়, তবে তাহার রূপসৃষ্টির জন্য সেই বস্তুকেই ভাবমণ্ডিত করিয়া ভাষায় তুলিয়া ধরা যায়। বস্তুর সঙ্গে ভাবের যে সম্বন্ধ সেই সম্বন্ধসুত্রেই বস্তুর সেই ভাব-রূপ ভাষায় উজ্জ্বল হইয়া উঠে। নিম্নোদ্ধৃত কবিতার লাইনগুলিতে কবি একটি চিত্র আঁকিয়াছেন, তাহাতে একটা দৃশ্যবস্তু কয়েকটি রেখামাত্রে ফুটিয়া উঠিয়াছে—যেন কোন চেষ্টা নাই, কেবল কয়েকটি বস্তু সাজাইয়াছেন মাত্র—

মাঠের পরে মাঠ, মাঠের শেষে
সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে।
এধারে পুরাতন শ্যামল তালবন
সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায় ঘেঁসে।
বাঁধের জলরেখা ঝলসে, যায় দেখা,
জটলা করে তীরে রাখাল এসে।
চলেছে পথখানি কোথায় নাহি জানি,
কে জানে কত শত নূতন দেশে।

কবির ভাবদৃষ্টি বাহিরের বস্তু-রূপের কয়েকটি এমন রেখা নির্বাচন করিয়াছে, যাহাতে সেই দৃষ্টি আমাদের চক্ষেও লাগে; যেখানে ভাব আরও ঘন ও গাঢ় হইয়া বস্তুকে ঘেরিয়া থাকে, সেখানে এইরূপ চিত্রাঙ্কনে বস্তুর রূপ ভাষাতেও এমন ভাবমণ্ডিত হয় যে, সেখানে সেই বস্তু শুধুই বস্তু নয়, ভাবেরই যেন বিগ্রহ বা symbol হইয়া দাঁড়ায়— The object becomes at once the cause and symbol of the emotion : যেমন—

নামিছে নীরব ছায়া ঘন বন-শয়নে,
এদেশ লেগেছে ভাল নয়নে।
স্থির জলে নাহি সাড়া, পাতাগুলি গতিহারা, ম
পাখী যত ঘুমে সারা কাননে,—
শুধু এ সোনার সাঁঝে বিজনে পথের মাঝে
কলস কাঁদিয়া বাজে কাঁকনে।
এ দেশ লেগেছে ভাল নয়নে।

এখানে বস্তু অপেক্ষা ভাবের ব্যঞ্জনাই অধিক, এবং চিত্রগত দৃশ্যগুলি—ভাবের প্রতীক বা symbol রূপে গ্রথিত হইয়াছে।

ভাব যদি মূলে অশরীরী বা অবাস্তব হয়, অর্থাৎ তাহা যদি অন্তর হইতেই উদ্ভিক্ত হয়, তবে তাহাকেও রূপ দিতে হইলে লেখকের মানস-ভাঙারে প্রচুর ইন্দ্রিয়ার্থঘটিত রূপ-স্মৃতি সঞ্চিত থাকা আবশ্যক—তাহা হইতেই, অতি ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য—সন্ধানে, ভাবের রূপ-রচনা করিতে হয়; সেখানে ভাষা রূপকাত্মক হইয়া উঠে, এবং কাব্য-সাহিত্যের প্রায় বারো আনা এই রূপক, রূপক-খণ্ড, বা উপমার ভাষা আশ্রয় করিয়া থাকে। উপস্থিত এইরূপ ভাষার দুইটি মাত্র উদাহরণ দিলাম—

রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি,
ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।
তিনি সময় যেন হয় রে এবার ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার,
সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি’

অথবা

জীবন আমার
এত ভালবাসি বসে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্ত্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।

রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’, ‘বালিকা বধূ’ প্রভৃতি বহু কবিতা পূর্ণ রূপকের দৃষ্টান্ত।

এই দ্বিতীয় ধরণের ভাবপ্রকাশরীতিই কাব্যের ভাষাকে কতকগুলি বিশেষ উপাদান-উপকরণের ভাষা করিয়া তুলিয়াছে—নানা উপমা, সাদৃশ্য-যোজনা ও চিত্রকল্পনা (imagery) ভাবপ্রকাশের উপায়স্বরূপ ভাষার অঙ্গীভূত হইয়াছে। Rhetoric বা অলঙ্কারশাস্ত্র এগুলিকে ভাষা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহার ভূষণরূপে গণ্য করিয়াছে, এবং ইহাদের নানা শ্রেণীবিভাগ ও প্রয়োগবিধি নির্দ্দিষ্ট করিয়াছে; অর্থাৎ ইহারা যে ভাষার অলঙ্কার নয়, ভাবেরই অব্যর্থ বাণী-রূপ-বিশিষ্ট ভাবের বিশিষ্ট ভাষা, তাহা না বুঝিয়া এগুলিকে লইয়া একটি শাস্ত্র খাড়া করিয়াছে—নানাবিধ অলঙ্কার-রচনার কলা-কৌশলই কবিত্বের প্রমাণ বলিয়া ধাৰ্য্য হইয়াছে। বলা বাহুল্য, আমরা ষ্টাইল ঘটিত যে সমস্যার আলোচনা করিতেছি তাহাতে ভাষার এই সকল উপাদান কোনও প্রকার অলঙ্কার নহে— ভাবপ্রকাশের যথাযথ উপায়মাত্র; ভাবের ভাষা-হিসাবেই তাহাদের যাহা কিছু মূল্য।

সাহিত্যসৃষ্টির—অর্থাৎ ভাবকে ভাষায় রূপ দিবার ইহা একটি প্রকৃষ্ট উপায়। অশরীরী ভাবকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের ভাষায় অনুবাদ করিতে না পারিলে সাহিত্যসৃষ্টি অসম্ভব; কারণ—the whole of literature consists in the communication of emotion। আমরা যাহাকে কাব্যগত thought বা ভাবনা বলি, তাহাও “systematised emotion,” অর্থাৎ নানা ভাবের সংযোগে উৎপন্ন একটি ভাব—পদ্ধতি বা ভাববন্ধ; এই ভাব মুখ্যত রূপধর্মী—রূপাভিমুখী; কারণ ভাব অপরোক্ষ অনুভূতির ব্যাপার চিন্তাসম্পর্করহিত; এ জন্য ইহা ক্রমাগতই রূপ হইয়া উঠিতে চায়; রূপানুভূতিই প্রত্যক্ষ অনুভূতি; কবির ভাষায়—”ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ, রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।” ভাব যত সরল ও একমুখী তাহার শব্দাবয়বও তেমনিই ঋজু ও স্বল্প— গীতি-কবিতা তাহার দৃষ্টান্ত; একটি উপমা, একটি পদ বা একটি শ্লোকেও তাহা সম্পূর্ণ হইয়া থাকে। আবার এই ভাব যদি জটিল বহুব্যাপক হয়—ভাষাতে তাহা একটি জটিল বৃহৎ বহুঅঙ্গপ্রত্যঙ্গবিশিষ্ট শরীর ধারণ করে—the writer’s emotions are systematised into a self—consistent whole; ভাব তখন আপন প্রয়োজনমত ক্ষুদ্র বা বৃহৎ আখ্যান, নাটকীয় রূপ প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়া লয়; সেই তাহার বাঙ্ময় দেহ; এবং ভাব ও দেহের-বিম্ব ও প্রতিবিম্বের মধ্যে যদি অংশত বা সমগ্রত কোনও অসামঞ্জস্য কোথাও না থাকে, তবে ভাষাগত যত কিছু উপাদানের সেই সামঞ্জস্যকেই খাঁটি ষ্টাইল বলিতে হইবে।

কিন্তু এই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ কাব্যদেহ-নিৰ্ম্মাণকল্পে শব্দ ও বাক্যই আদি উপাদান; সেই শব্দ ও বাক্য মুখ্যত রূপাত্মক কেন তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। আমাদের মনে হইতে পারে, এমনভাবে বাক্যযোজনা নিশ্চয় অতিশয় দুরূহ ব্যাপার—ভাবকে রূপময়ী ভাষায় প্রকাশ করা কবির পক্ষে একটা কৃচ্ছ্রসাধন। কিন্তু আসলে, কবি শক্তির পরীক্ষা ভিতরেই হইয়াছে—ভাব যদি কবিচিত্তে সুস্পষ্ট ও সুসম্পূর্ণ হইয়া ধরা দেয়, তবে তাহার ভাষা সে আপনিই সৃষ্টি করিয়া লয়। যে ভাব এইরূপ রূপসম্পর্করহিত তাহা ঠিক ভাব নয়, তাহা একটা চিন্তাবস্তু, তাহাতে সৃষ্টিকামনা থাকে না। অতএব এই যে ভাবের ভাষা-রূপ-সৃষ্টি, ইহা আমাদের আলোচনার পক্ষে একটি সমস্যা হইলেও, কবির পক্ষে তাহাই একপ্রকার শক্তির স্ফূর্ত্তি—একাধারে পরিশ্রম ও পরুস্কার। পূর্ব্বে বলিয়াছি, লেখকের মনোভাণ্ডারে পর্যাপ্ত পরিমাণ sensuous perceptions বা রূপরসাত্মক বস্তু পরিচয় সঞ্চিত থাকা প্রয়োজন—সেই রূপখণ্ডগুলির দ্বারা লেখক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবানুভূতি ভাষায় প্রকাশ করিতে সমর্থ হন; কারণ এই রূপখণ্ডগুলিকেই বাক্যে কতক পরিমাণে নির্দ্দেশ করিতে পারা যায়, তাহা symbol বা সঙ্কেতের কাজ করে। এই সঙ্কেত যত সুপ্রযুক্ত হয়, ততই সেই অনুভূতি, যাহা মূলে রূপাতীত, তাহা পাঠকচিত্তে সংক্রামিত হয়। সাহিত্যসৃষ্টিতে ভাষা সৰ্ব্বত্রই অনুভূতি-উদ্রেকের ভাষা হইবে, এবং অনুভূতি উদ্রেক করিতে হইলে রূপ-সঙ্কেতেই তাহা করা যায়; অতএব ভাষার উপাদান যে বাক্য বা শব্দবন্ধ তাহা, কোথাও খণ্ডভাবেই, কিন্তু সৰ্ব্বত্র সমগ্রভাবে, একটা রূপকেই প্রকাশ করিবে; প্রত্যেক শব্দই যে রূপাত্মক বা রূপের সাঙ্কেতিকতায় পূর্ণ হইবে এমন কোন কথা নাই—কিন্তু শব্দ-চয়ন ও যোজনার ফলে ভাব যেন একটি অনুভূতিগোচর রূপ হইয়া উঠে; কারণ, “the essence of all style worthy the name is to visualise”. ইহার প্রয়োজনে সাহিত্যিক ভাষায়—শব্দের চয়ন, প্রয়োগ ও যোজনায়—কত অপ্রচলিত ও অতর্কিত ভঙ্গির আবির্ভাব হয়। বর্ণনার বর্ণগরিমা যে কারণে, বর্ণবিরলতাও সেই কারণে; অতিশয় সাড়ম্বর কল্পনার প্রয়োজন যে কারণে অনাড়ম্বর বিবৃতিও সেই কারণে; উপমাবাহুল্যও যে কারণে, উপমাবর্জ্জনও সেই কারণে—কোনটাই অনাবশ্যক নয়। উপমার কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; উপমায় রূপের দ্বারা গুণ নির্দেশ হইয়া থাকে—কোনও একটি বিশেষ গুণকে হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্য সাদৃশ্য-সঙ্কেত করিতে হয়; অন্য উপায়ে তাহা অনুভূতিগোচর হইবে না, তাহা জ্ঞানগোচর হইবে মাত্র। সেই সাদৃশ্য-সঙ্কেত ভাষার অলঙ্কার নহে—ভাবের যথাযথ বাণী-রূপ; ভাব তাহা দ্বারা সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হয় নাই, স্বরূপে প্রকাশিত হইয়াছে।

ভাষাকে রূপময়ী করিবার জন্য লেখক যে সব উপায় অবলম্বন করেন তাহার মধ্যে এই উপমাই প্রধান; ভাব যখন বস্তুকে অতিক্রম করে, অর্থাৎ বস্তুর রূপ কল্পনায় বৃহত্তর হয়, তখনও উপমার সৃষ্টি হয়; এই উপমা বস্তুকে রূপান্তরিত করিয়া আমাদের চিত্ত চমকিত করে। কবি একটি পথের ছবি আঁকিতেছেন—

বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে
শস্যক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে স্রোতে
তৃষার্ত্ত জিহ্বার মত;

এখানে পথের ছবিকে অতিক্রম করিয়াছে কবিচিত্তের ভাব-রূপ;–উপমাই এখানে সৰ্ব্বস্ব, এবং ভাব ঐ উপমারূপেই জন্মিয়াছে। কিন্তু যখন বস্তুর বস্তুগত সৌন্দৰ্য্যই লেখকের অনভূতিতে একটি বিশিষ্ট রূপ ধারণ করে, অর্থাৎ ভাব যেখানে বস্তুপ্রীতিমূলক বা objective, সেখানে কোনও রূপক বা সাদৃশ্যকল্পনার প্রয়োজন হয় না, যথা—

গ্রামপথে ধূলা,
সাপ গেছে পার হ’য়ে;
কোথাও পাখীর নখের ভঙ্গি
চোখে পড়ে র’য়ে র’য়ে।

—এখানে এই রূপের উপাদান হইয়াছে কয়েকটি picturesque details—বস্তুর রূপের কয়েকটি প্রেক্ষণীয় লক্ষণ ভাষাকে চিত্রধর্মী করিয়াছে। এই বস্তুপ্রীতিমূলক ভাব লেখকের মানস-প্রকৃতিভেদে সম্পূর্ণ objective না হইয়া খানিকটা আত্মভাবরঞ্জিত হইয়া উঠে। Objective ও subjective দৃষ্টির প্রভেদ এই যে, একটিতে কবি বস্তুর রূপেই মুগ্ধ; অপরটিতে বস্তুর মধ্যে একটা ভাবসঙ্কেত-দর্শনে মুগ্ধ; কিন্তু দুই দৃষ্টিই অনুভূতিসাপেক্ষ, নতুবা তাহাতে সাহিত্যসৃষ্টি হইত না। এইবার আমি কয়েকটি রূপসৃষ্টির উদাহরণ দিব, তাহাতে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্যও যেমন প্রকাশ পাইবে, তেমনিই ষ্টাইল বলিতে ভাষার যে গুণ বুঝায়, রচনায় তাহা সঞ্চার করিতে হইলে শব্দচয়ন ও বাক্যযোজনা কত রকমের হইতে পারে, তাহাও লক্ষ্য করা যাইবে। প্রথমেই যে দুইটি রচনা উদ্ধৃত করিলাম, তাহাতে ভাব ও বস্তু এই দুয়েরই অপূৰ্ব্ব মিলন ঘটিয়াছে—ভাষা কেবল চিত্রই আঁকে নাই লেখকের অনুভূতিমূলক কল্পনা সেই চিত্রকে একটি অবাস্তব রূপব্যঞ্জনা দান করিয়াছে।

“একদিন প্রথম শরতের সন্ধ্যায় মনোরমাকে লইয়া আমাদের বরানগরের বাগানে বেড়াইতেছি। ছম্‌ছমে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। পাখীদের বাসায় ডানা ঝাড়িবার শব্দটুকুও নাই, কেবল বেড়াইবার পথের দুই ধারে ঘনছায়াবৃত ঝাউগাছ বাতাসে সশব্দে কাঁপিতেছিল। ….

সেখানে অন্ধকার আরও ঘনীভূত, যতটুকু, আকাশ দেখা যাইতেছে একেবারে তারায় আচ্ছন্ন; তরুতলের ঝিল্লিধ্বনি যেন অনন্ত গগনবক্ষচ্যুত নিস্তব্ধতার নিম্নপ্রান্তে একটি শব্দের সরু পাড় বুনিয়া দিতেছে।…

এমন সময় অন্ধকার ঝাউগাছের শিখরদেশে যেন আগুন ধরিয়া উঠিল; তাহার পরে কৃষ্ণপক্ষের জীর্ণপ্রান্ত হলুদবর্ণ চাঁদ ধীরে ধীরে গাছের মাথার উপরকার আকাশে আরোহণ করিল—সাদা পাথরের উপর সাদা শাড়ী পরা সেই শান্তশয়ান রমণীর মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িল।”

বস্তুর রূপ ও রূপোদ্ধৃত রসকল্পনায় এই বর্ণনাটি ভাষাগত রূপ-রসের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমি একটি অনুরূপ চিত্র ইংরেজী হইতে উদ্ধৃত করিলাম, উভয়ের সাদৃশ্য ও বৈলক্ষণ্য লক্ষ্য করিবার মত।

Sweet are the shy recesses of the woodland. The ray treads softly there. A film athwart the pathway quivers manyhued against purple shade fragrant with warm pines, deep mossbeds, feathery ferns. The little brown squirrel drops tail and leaps; the inmost bird is startled to a chance tuneless note. From silence into silence things move………

The tide of colour has ebbed from the upper sky. In the west the sea of sunken fire draws back, and the stars leap forth and tremble and retire from the advancing moon, who slips the silver train of cloud from her shoulders and with her foot upon the pine-tops, surveys heaven.

এই দুইটি চিত্রেরই রূপ, রং, রেখা কেবল নিখুঁত অনুচিত্রগ নয়—তাহারা যেন লেখকের রূপরসানুভূতির আবেগে স্পন্দিত হইতেছে; এই ভাবাবেগ প্রবল দৃষ্টির বসে প্রাকৃতিক দৃশ্যবর্ণনায় রূপকের আমেজ লাগিয়াছে, জড় চিন্ময় হইয়া উঠিয়াছে। এখানে picturesque details তো আছেই, তাহা ছাড়া ভাবকল্পনার একটি সূক্ষ্ম মায়াজালে বাস্তবকে অবাস্তব-রমণীয় করিয়া তুলিয়াছে, ইংরেজী চিত্রখানিতে লেখকের বাস্তবনিষ্ঠা যেমন গভীর—ইংরেজী ভাষার সমৃদ্ধিবশত, শব্দচয়ন ও বাক্যযোজনাও তেমনি অতিশয় যথাযথ হইয়াছে; আমাদের ভাষার শক্তি এখনও এতদূর পৌঁছায় নাই। এখানে ভাবানুভূতি যেমন সূক্ষ্ম—একদিকে যেমন, “from silence into silence things move”, তেমনই শেষের চন্দ্রোদয়-দৃশ্য একটি জীবন্ত চিত্র হইয়া উঠিয়াছে।

এইরূপ রচনায় আমরা ভাষার যে ভঙ্গি দেখি তাহাতে বুঝিতে পারি যে, ভাবপ্রধান চিত্রের ভাষায় উপমা ও রূপক ষ্টাইলহিসাবেই সত্য ও সার্থক। আবার, যেখানে কোন ঘটনা বা দৃশ্যবস্তুকে পাঠকের চক্ষুগোচর করাই একমাত্র অভিপ্রায়, সেখানে ভাষার নৈপুণ্য অন্যরূপ—নিম্নোদ্ধৃত রচনাটি তাহার সাক্ষ্য দিবে।

“ডাক্তার ডাকে চলিয়াছে। শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, তাহার উপরে আকাশে দুৰ্য্যোগ। ডিস্ট্রিক্ট-বোর্ডের পাকা রাস্তার নুড়ি পাথরের কঠিন বন্ধুরতার উপর দিয়া গাড়িখানা মন্থর গতিতে চলিয়াছে।… দূরে যেন একটা জোনাকী অনির্ব্বাণ দীপ্তিতে জ্বলিতেছে, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সেটা এই দিকে আসিতেছে।…

হাঁ, আলোই ওটা, বিন্দুর আকার হইতে ক্রমশ আকারে বড় মনে হইতেছে। আলোটা দ্রুতবেগে এই দিকেই আসিতেছে।

ঝুন ঝুন ঝুন ঝুন—মৃদু ঘণ্টার শব্দ ডাক্তারের কানে আসিল। ডাক্তার হাঁকিল, কে? কে? কে আসছে?

উত্তর আসিল-ডাক। সরকার বাহাদুরের ডাক। ডাক-হরকরা আমি।—বলিতে বলিতে লোকটা নিকটে আসিয়া পড়িল। ঘণ্টাধ্বনি স্পষ্টতর হইয়া উঠিল, লোকটির হাতের আলোতেই ডাক্তার দেখিল…

ডাক্তার প্রশ্ন করিল, কে রে দীনু?
সচল দীনু উত্তর দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
কতটা রাত্রি হ’ল বল দেখি দীনু?

আজ্ঞে তা—রাত ভেঙ্গে এসেছে, তিন প্রহর গড়িয়ে এল আর। দীনুর কথার শেষ অংশের সাড়া আসিল গাড়ির পিছন দিক হইতে। মেল-রানার সমান বেগে ছুটিয়া চলিয়াছে; ঘণ্টার শব্দ ক্রমশঃ মৃদুতর হইয়া আসিতেছিল, আলোর শিখাটা ক্রমশঃ আবার পরিধিতে হ্রাস পাইয়া বিন্দুতে পরিণত হইতে চলিয়াছে।”

এ রচনার কোনও বিশেষ ভাবের আবেগ নাই, লেখক কেবল নিজের চোখের দৃষ্টি আমাদের চোখে পরাইয়া দিয়াছেন—একটি দৃশ্যকে বাক্যের সাহায্যে প্রেক্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছেন। এখানে যে শব্দচিত্র রচিত হইয়াছে তাহাতে শব্দের অতিরিক্ত কোনও ব্যঞ্জনার প্রয়োজন হয় না, কেবলমাত্র বাক্যযোজনার কৌশলেই রূপসৃষ্টি হইয়াছে।

সাহিত্যের ভাষা বিশ্লেষণ করিয়া ভাবের যথাযথ বাণী-রূপ বা ষ্টাইল, ও তাহার সমস্যার কথা আলোচনা করিতেছি; এইরূপ আলোচনায় কিন্তু একটা কথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে—যে-রচনা একটি সাহিত্যিক সৃষ্টি তাহা একটি সমগ্র বস্তু, এবং ভাষায় তাহাকে মূর্তি দিবার কালে বাক্-ভঙ্গি যত প্রকারই হউক—বাক্যযোজনা রূপাত্মক হউক বা নাই হউক, সকল সাহিত্যসৃষ্টিই একপ্রকার রূপক। নাটক উপন্যাস হইতে ক্ষুদ্রতম রসাত্মক বাক্যটি পর্য্যন্ত—যদি উৎকৃষ্ট সাহিত্যগুণোপেত হয়—তবে তাহা আয়তনভেদে একটি জটিল বা সরল ভাবগ্রন্থির—অশরীরী ভাবকল্পনার—রূপক—রূপ। ‘মেঘনাদবধ’ ‘চন্দ্রশেখর’ ‘রাজা ও রাণী’-ও যেমন, তেমনই ক্ষুদ্রতম কবিতা ও গান মূলে একটি ভাবপ্রেরণা মাত্র—একটা অরূপ অনুভূতি, কবিপ্রাণের একটা আকুতি; তাহাকেই যথাযথ রূপ দিবার জন্য, বাহিরের বস্তু ঘটনা বা নানা খণ্ড রূপ-বস্তুকে আশ্রয় করিয়া, প্রয়োজনানুরূপ সংস্থানে সংস্থিত করিয়া, আমাদের পরিচিত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার যে ভাষা সেই ভাষায় তাহাকে প্রকাশ করা হইয়াছে। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ রচনা খন্ড খন্ড ভাবে ও সমগ্রভাবে এই রূপকে গড়িয়া তোলে—আমরা তাহা হইতে যে বস্তুর অনুভূতি লাভ করি তাহা এই রূপকেরই রূপসঙ্কেতনিহিত ভাব। ভাষায় তাহার সমগ্রতা নানা খণ্ডে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে বিভক্ত ও বিস্তৃত না হইয়া পারে না—যাহা মূলে ছিল দেশকালহীন, সৃষ্টিতে তাহাই দেশ—কালে ব্যাপ্ত হইয়া থাকে।

এ পৰ্য্যন্ত আমি শব্দ ও বাক্যগত ষ্টাইল-সমস্যার আলোচনা করিয়াছি, তাহাতে ভাষাকে রূপাত্মক করিবার নানা উপায় ও উপকরণের উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু সেগুলি ছাড়াও আর একটি উপাদান ষ্টাইলের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া থাকে—তাহা বাক্যের ধ্বনিগুণ। শব্দমাত্রেই ধ্বন্যাত্মক, আমি সেই ধ্বনিমাত্রের কথা বলিতেছি না; ঐ ধ্বনি হইতে যে নানা বাক্যচ্ছন্দের সৃষ্টি হয় এবং সেই ছন্দ অলক্ষ্যে ভাবকে রূপ দিবার যে সহায়তা করে আমি তাহার কথাই বলিতেছি। ইহা গদ্যচ্ছন্দ বা পদ্যচ্ছন্দও নয়, কারণ তাহাদের একটা সাধারণত্ব আছে; ইহা প্রত্যেক রচনার নিজস্ব ষ্টাইলগত বিশিষ্ট ধ্বনিরূপ। পদ্য ও গদ্যের কথা পরে বলিব। এই ধ্বনি কেবল আবেগমূলক নয়—শব্দযোজনায় যেমন ভাব রূপ পায়, এই ধ্বনিও তেমনিই ভাবের সেই রূপের অনুযায়ী; ভাষার অন্য গুণের সঙ্গে একযোগে এই ধ্বনিগুণও ভাবানুভূতিকে রূপ দান করে, এজন্য ইহা ষ্টাইলের অন্তর্গত বলিয়ছি। প্রত্যেক সাহিত্যিক রচনার একটা বিশিষ্ট ধ্বনিগুণ আছে। এই বস্তুকে ষ্টাইলের অঙ্গ বলিবার কারণ এই যে, ইহা বাহির হইতে আমদানি করা একটা অলঙ্কার নয়। আমি বঙ্কিমচন্দ্রের যে লাইনগুলি ইতিপূর্ব্বে উদ্ধৃত করিয়াছি তাহার সহিত নিম্নোদ্ধৃত রচনাটির ধ্বনিগুণ তুলনা করা যাইতে পারে; সেখানে যে ধ্বনিগাম্ভীৰ্য্য ভাষায় প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা ঐ বর্ণনার একটি বিশিষ্ট উপাদান এবং ভাবকে ভাষায় রূপ দিবার সহায়তা করিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষার যে একটা বিশিষ্ট ধ্বনিপ্রকৃতি আছে, ঐ রচনায় তাহা আরও বিশিষ্ট হইয়া উঠিয়াছে—ভাবানুরূপ বাক্য যোজনায়। সেই ধ্বনি কিন্তু রূপাত্মক নয়, ভাবাত্মক। নিম্নোদ্ধৃত দৃষ্টান্তটির মধ্যে ধ্বনি কিন্তু শুধুই ভাবাত্মক নয়, রূপাত্মকও বটে—দৃশ্যটিকে দেখিবার পক্ষে সহায়তা করিতেছে।

“সঙ্গীত আরম্ভ হইয়াছে। রায় চোখ মুদিয়া গম্ভীরভাবে বসিয়া আছেন। গানের দীর্ঘ-মন্থর গতির সমতায় বিশাল দেহ তাঁহার ঈষৎ দুলিতেছে। থাকিতে থাকিতে তাঁহার বাম হাতখানি উদ্যত হইয়া পাশের তাকিয়াটির উপর একটি মৃদু আঘাত করিল। ঠিক ঐ সঙ্গে তবলচীর চর্ম্মবাদ্য ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। রায় চোখ মেলিলেন, বাইজীর পায়ের ঘুঙুর মৃদু সাড়া দিয়াছে। নৃত্য আরম্ভ হইল। কলাপীর নৃত্য। আকাশে মেঘ দেখিয়া উতলা কলাপীর নৃত্যভঙ্গি। গ্রীবা ঈষৎ বাঁকিয়াছে, দুই হাতে পেশোয়াজের দুই প্রান্তে আবদ্ধ পেখমের মত তালে তালে নাচিতেছে। চরণে ঘুঙুর বাজিয়া উঠিল।”

এখানে বাক্যধ্বনি বাক্যের রূপ-চিত্রকে আরও পরিস্ফুট করিয়াছে—বাক্যগুলি নৃত্যসঙ্গীতের অনুসরণ করিয়া আপনা হইতেই যতি-তালে বিভক্ত হইয়া সমগ্র রচনাটির মধ্যে একটা গতি তরঙ্গ সৃষ্টি করিয়াছে। তাহা না হইলে গানের মজলিস আমাদের চক্ষুগোচর হইয়া উঠিত না-এ রচনার ষ্টাইল অঙ্গহীন হইত।

ষ্টাইলের ভাষাঘটিত সমস্যার যেটুকু আলোচনা করিলাম, তাহা যথোপযুক্ত হইল না; কিন্তু ইহার অধিক আলোচনার স্থান এখানে নাই। এই আলোচনা যেমন জটিল, তেমনই বিস্তারযোগ্য। আমার উদ্দেশ্য—ভাষা ও ষ্টাইলের একাত্মতা-নির্দ্দেশ, এবং ভাষায় যে গুণ থাকিলে তাহা ষ্টাইল-পদবাচ্য হয় সে গুণ যে বাহির হইতে সংক্রামিত হয় না, ভিতরের প্রয়োজনে তাহার উদ্ভব হয়—ইহারই একটা ধারণা পরিস্ফুট করিয়া তোলা। উৎকৃষ্ট ষ্টাইল কোনও একটি অঙ্গুলিনির্দেশযোগ্য ভঙ্গি, বা ভাষার নানাবিধ শব্দপ্রয়োগরীতি নয়। প্রত্যেক সাহিত্যস্রষ্টার কল্পনা ও ভাবদৃষ্টির আত্যন্তিক স্বাতন্ত্র্য হইতেই ষ্টাইলের জন্ম হয়। যাহারা সংবাদপত্রের ভাষায় সাহিত্য রচনা করে তাহারা সাহিত্য সৃষ্টি করে না; কারণ, তাহাদের আত্মানুভূতিও যেমন দুর্ব্বল, তেমনই তাহাদের অভিপ্রায়ও স্বতন্ত্র—তাহারা অতি-সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর সাধারণ মানস-ক্ষুধার খাদ্য সরবরাহ করে। যাহারা দ্বিতীয় শ্রেণীর সাহিত্যিক তাহাদের ভাষার কোনও মৌলিক ষ্টাইল থাকে না বটে, কিন্তু তাহারা একটা বড় কাজ করে—তাহারা প্রতিভাবান সাহিত্যিকের নব-সৃষ্ট বাক্যগুলিকে আপনাদের ভাষায় ব্যবহার করিয়া সেগুলিকে যেমন জীবন্ত রাখে, তেমনই ভাষার স্বাস্থ্য ও শক্তি রক্ষা করিয়া তাহার বিকৃতি নিবারণ করে। উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক প্রতিভার সবচেয়ে বড় দান—এই ভাষা; তাহার কারণ, এই ভাষার সাহায্যেই সহজ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ আপনার প্রাণের অস্ফুট ভাবরাজিকে কতকটা স্ফুটতরভাবে অনুভব করিয়া চরিতার্থ হয়—কবি যেন মূককে মুখর করিয়া তোলেন। শব্দের এই যে যাদুশক্তি—ইহা শ্রেষ্ঠ কবিগণেরই আয়ত্ত। ভাব যত অনির্বচনীয়, ভাষায় তাহাকে প্রকাশ করা ততই প্রতিভাসাপেক্ষ। যাহার মূলে ভাবের সেই গাঢ়তা, গভীরতা ও অনির্ব্বচনীয়তা নাই, তাহার ভাষারও তেমনই কোনও বিশিষ্ট গৌরব নাই। এই জন্যই—

Poetry alone can tell her dreams;
With the fine spell of words alone can save
Imagination from the sable chain
And dumb enchantment.

—“মানুষের মনের অসীম আকুতি (Imagination) যেন এক কঠিন কালো মায়াশৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হইয়া আছে; স্বপ্নকে ভাষায় ব্যক্ত করিবার শক্তি একমাত্র কাব্যেরই আছে; কাব্যই, শব্দের যাদুমন্ত্রে, বন্দী ভাবরাজির সেই মায়াশৃঙ্খল মোচন করিতে পারে।”

আমাদের কবিও বলেন—

না পারে বুঝাতে আপনি না বুঝে,
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে,
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে—
মাগিছে তেমনি সুর;
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু ঘুচাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের কালে দু’চারিটি কথা
রেখে যাব সুমধুর।

অতএব ইহাও সত্য যে, এই যে শক্তি—ইহা ভাবকে ভাষার অধীন করিবার শক্তি নয়, ভাষাকেই ভাবের অধীন করিবার শক্তি;—“every work of enduring literature is not so much a triumph of language as a victory over language”.

ষ্টাইল ও ভাষার এই সম্বন্ধের কথা ভাল করিয়া বুঝিয়া লইবার পর সেই পুরাতন ‘রীতি’-বাদের অসারতা প্রতিপন্ন করিবার অবসর আসিয়াছে। রীতি বলিতে যাহা বুঝায় তাহা ষ্টাইলের ঠিক বিপরীত বাক্যরচনার একটা বহির্ভূত আদর্শকেই রীতি বলে। এই রীতি যে ষ্টাইল নয়, তাহা বোধ হয় নূতন করিয়া বলিবার আবশ্যকতা নাই। শব্দের অর্থ, ধ্বনি ও প্রয়োগবিশুদ্ধি, এবং নানা অলঙ্কার প্রভৃতির কারণে ভাষার যে দোষগুণ-নির্দেশ, এবং তাহা হইতে যে এক বা অধিক আদর্শের প্রতিষ্ঠা হয়—তাহাতে প্রত্যেক রচনার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আর বিচারযোগ্য থাকে না। এই মধ্যযুগীয় পদ্ধতি এখনও আমাদের দেশে কাব্যবিচারে প্রশ্রয় পাইয়া থাকে। সাহিত্যের ভাষা লইয়া যে আন্দোলন কিছুকাল যাবৎ চলিয়াছিল, এবং ভাষাকে একটা কোনও ভঙ্গিতে ভাঙ্গিয়া লইয়া তাহার একটা নূতন নামকরণ করিয়া ব্যক্তি ও সম্প্রদায়বিশেষের যে কৃতিত্ব ঘোষণা হইয়াছিল, তাহার মূলে এইরূপ একটা রীতি-প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ছিল। বাংলা ভাষার এই নূতন রীতির কথা পরে বলিব। ষ্টাইল ও রীতি যে কেন এক নয়, এবং সাহিত্য-সৃষ্টিতে রীতিহিসাবে ভাষার কোনও মূল্য নাই কেন, এক্ষণে সে সম্বন্ধে আরও কিছু বলিব। ইতিপূৰ্ব্বে দেখাইয়াছি যে, খাঁটি সাহিত্য-রচনায় কবিকে আপন ভাব অনুযায়ী ভাষা সৃষ্টি করিতে হয়; তাহার কারণ, প্রত্যেক রচনার প্রেরণা এত স্বতন্ত্র—লেখকের সেই অনুভূতি এতই অনন্যসদৃশ—যে তাহাকে রূপ দিতে হইলে তাহার সেই particularity এমন নিখুঁতভাবে বজায় রাখিতে হয় যে, পূর্ব্ব হইতে নির্দিষ্ট কোনও ভঙ্গি বা ছাঁচ তাহার কাজে লাগিতে পারে না। একে তো প্রত্যেক শক্তিমান লেখকের রচনায় একটা ব্যক্তিত্বলক্ষণ প্রকাশ পাইবেই—এই জন্যই ‘style is the man himself; তাহার উপর, একই লেখকের বিশেষ বিশেষ প্রেরণা অনুসারে প্রত্যেক রচনার ভাষাগত রূপ স্বতন্ত্র হইতে বাধ্য—অবশ্য যদি তাহা একটি সত্যকার মৌলিক সৃষ্টি হয়। কোনও রচনায় ভাষার যাহা গুণ বলিয়া গণ্য হইবে, অপর কোনও রচনায় তাহা দোষ হইয়া দাঁড়াইতে পারে। কোথাও ভাষার তরলতা ও মসৃণতাই হয়তো সেই রচনার অবশ্যম্ভাবী গুণ, অর্থাৎ তাহাই তাহার ষ্টাইল; অন্য কোথায়ও অমসৃণতাই তাহার যথার্থ ষ্টাইল। কোন রচনাতে বাগন্ধ গাঢ় হওয়াতে ভাব যথাযথ প্ৰকাশ পাইয়াছে, আবার অন্যত্র শব্দবিন্যাস একটু শিথিল বলিয়াই তাহা অন্তর্গত ভাবকে যথাযথ রূপ দিতে পারিয়াছি। অতএব ষ্টাইল-বিচারে রীতি-ঘটিত দোষ-গুণের কোনও কথাই উঠিতে পারে না। মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ যে ভাষায় রচিত হইয়াছে তাহা কোনও আদর্শ-রীতির ভাষা নিশ্চয়ই নহে, তাহা সেই কাব্যেরই ভাষা—কবিকে তাঁহার বিশিষ্ট ভাবপ্রেরণার প্রয়োজনে ঐ ভাষা গড়িয়া লইতে হইয়াছে। আবার, রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষণিকা’র ভাষাও কোনও রীতির উৎকর্ষ প্রমাণ করে না, তাহা সেই কবিতাগুলির অন্তর্নিহিত ভাবকল্পনার যথাযথ বাণীরূপ-হিসাবেই অনবদ্য ষ্টাইল হইয়া উঠিয়াছে। এই দিক দিয়া দেখিলে ষ্টাইল বহু নয়—এক। কবির ব্যক্তিত্ব যেমনই হউক, রচনার রূপ যতই বিচিত্র হউক—যেখানে যেমন সেখানে ঠিক তেমনটিই যদি ভাষায় রূপ পাইয়া থাকে, তবে ভাষা ও ভাবের সেই সাযুজ্যের এক সাধারণ নাম— ষ্টাইল। ইহা হইতে এমন সিদ্ধান্ত করা চলিবে না যে, খাঁটি সাহিত্যের ভাষা স্বেচ্ছাচারের ভাষা, ভাষার কোনও ধৰ্ম্মই নাই—কোনও বন্ধন নাই। বরং ভাষার ধর্ম্ম অক্ষুন্ন রাখিয়াই তাহাকে এমনভাবে স্ব-স্ব ভাবকল্পনার ছাঁচে ঢালিয়া ষ্টাইল করিয়া তোলাই প্রতিভার অসাধ্য সাধন। এবং যেহেতু ভাষার বর্হিগত ভঙ্গিই ষ্টাইল নয়—ষ্টাইলের মূলে আছে শক্তিমান লেখকের সত্যকার মৌলিক ভাব-প্রেরণা, অতএব স্বেচ্ছাচারের কথা উঠিতেই পারে না; কারণ, কবি আরও গভীরতর বন্ধনে—তাঁহার সেই অন্তরের বিশিষ্ট প্রেরণার বন্ধনে এমনই আবদ্ধ যে, স্বেচ্ছাকৃত অনাচার তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। তাঁহার ভাষায় যথেষ্ট স্বাধীনতার লক্ষণ থাকে বটে, কিন্তু সে রচনা সৃষ্টিধর্মী বলিয়া তাহাতে ভাষার সমৃদ্ধি ও শক্তিবৃদ্ধিই হয় নব নব ভাবের নব নব রূপ ভাষার আয়ত্ত হইয়া উঠে, এবং ব্যাকরণ ও অভিধান সেই সঙ্গে পুষ্ট হইয়া থাকে। ভাষার বিষয়ে যে শিল্পী-মন কবি-প্রতিভার নিত্যসহচর, সেই মন ভাষার আত্মাটিকে অপরোক্ষ করিতে পারে বলিয়াই—কবি-ভাষা কখনও ভাষার আত্মাকে লঙ্ঘন করে না।

ষ্টাইল ও রীতির প্রভেদ বুঝিবার পক্ষে আর একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাইতে পারে। রীতি যেমন ভাষার বহিরঙ্গ-সৌষ্ঠব মাত্র, তেমনই তাহা লেখকের আন্তর—অনুভূতির গভীরতা ও মৌলিকতার পরিপন্থী; অথবা এমনও বলা যায়, যেখানে রচনায় কোনও একটা রীতির ভঙ্গি স্পষ্ট হইয়া থাকে সেখানে লেখকের ভাবকল্পনা তাঁহার নিজস্ব নয়, তাঁহার স্বকীয় দৃষ্টি অতিশয় দুর্ব্বল—যাহাকে উচ্চাঙ্গের সাহিত্যসৃষ্টি বলে তাহা সেখানে হয় নাই। অনেক লেখক ভাষার নবত্ব-সম্পাদনের জন্য নানাবিধ কৌশল করিয়া থাকেন। ভিতরের ভাববস্তুর কোনও বৈশিষ্ট্য থাকে না বলিয়াই ভাষার এইরূপ ভঙ্গিমাই তাঁহাদের একমাত্র কৃতিত্ব। এইরূপ রচনাভঙ্গি বা ভঙ্গিমাযুক্ত ভাষায় যে ব্যক্তিত্ব ফুটিয়া উঠে তাহা খাঁটি লক্ষণ নয়—তাহা অতিশয় superficial idiosyncrasy—সে যেন ভাষার মধ্যে লেখকের নিজ নামের মুদ্রাচিহ্ন। ইহা এত সুস্পষ্ট যে, ইহাকে সহজেই জাল করা চলে—সেই বাক্যভঙ্গি সকলেই অনুকরণ করিতে পারে, এবং সেই কারণে তাহা একটা রীতি হইয়া উঠিতেও পারে। নিম্নোদ্ধৃত রচনায় ষ্টাইল নাই—আছে একটা অতিশয় প্রকট বচন-ভঙ্গিমা—অতিশয় তুচ্ছ কথাকে বচন-ভঙ্গিমার দ্বারা গুরুত্ব দিবার চেষ্টা।—

“কিন্তু কাল তোমার মুখে শুনলুম যে, ব্যাজার হবার এদানিক একটু বিশেষ কারণ ঘটেছে। তুমি সম্প্রতি আবিষ্কার করেছ যে, খবরের কাগজে নিত্য কথা লেখে, তাও আবার প্রায়ই এক ভাষায়; শুধু তাই নয়, কাগজওয়ালাদের যত বকাবকি যত রোখারুখি কিছুদিন ধরে, সব নাকি হচ্ছে একটা কথা নিয়ে এবং সে কথাটা হচ্ছে diarchy; অথচ ও-কথার মানে জানা দূরে থাক, নামও তুমি ইতিপূর্ব্বে শোন নি, যদিচ ইংরেজী ভাষার সঙ্গে তোমার বহুদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। ও কথার অর্থ যে জান না তাতে আশ্চর্য্য হবার কিছুই নেই। দুদিন আগে আমরা কেউ জানতুম না, কথাটা গ্রীক কিন্তু জন্মেছে ভারতবর্ষে। Monologue—এর সঙ্গে dialogue-এর যা প্রভেদ, monarchy-র সঙ্গে diarchy-রও সেই প্রভেদ, অর্থাৎ একের সঙ্গে দুইএর যে প্রভেদ, সেই প্রভেদ। এখন বুঝলে ত?”

অথবা—

“রাজনৈতিক আন্দোলন অবশ্য একমাত্র কথার সাহায্যেই করতে হয়, এবং কথারও যে একটা শক্তি আছে, সে সত্য কিছুতেই অস্বীকার করা চলে না। বাগযুদ্ধও ত একটা যুদ্ধ বটে, এবং এ যুদ্ধে কথাই হচ্ছে মানুষের গুলি-গোলা, এমন কি স্থলবিশেষে তা poisonous gas-ও হতে পারে। তবে কথার কোনই শক্তি থাকে না, যদি না তার কোনো অর্থ থাকে। রাজনীতিতে আমরা বিলেতি কথা নিয়ে কারবার করি, সম্ভবতঃ সেই কারণে আমাদের দেশী নেতাদের মুখে সে সব কথা অনেক সময়ে নিরর্থক হয়ে পড়ে। এবং এই কারণেই তাদের কথার প্রতি আমাদের আস্থা দিন দিন কমে আসছে।”

এ ভাষা—নিছক কথারই কারবার; এক ধরণের মানসিকতা—যাহা অনেকেই চেষ্টা করিলে অভ্যাস করিতে পারে–তাহাই প্রকাশ করিবার পক্ষে এই রীতির উপযোগিতা আছে। এ ভাষায় যাহা রচিত হইতে পারে তাহা সাহিত্যসৃষ্টি নয়—তাই ইহা ষ্টাইল নয় একটা রীতি মাত্র; এই রীতিকে আয়ত্ত করিয়া প্রতিভাহীন ব্যক্তিও এক ধরণের সাহিত্য চর্চ্চা করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারে। ষ্টাইল বলিতে কেবলমাত্র বাক্‌চাতুরী বা বাগ্‌বৈদগ্ধ্যই বুঝায় না-বহির্গত ভঙ্গিমাই ষ্টাইল নয়; সেই ভঙ্গিমা যাহার–তাহার যেমন মৌলিকতা, তেমনই গুরুত্ব ও গভীরতা চাই, নহিলে ষ্টাইল অর্থে একটা তুচ্ছ লিখন-চাতুরী মাত্র বুঝাইবে; অতএব, এইরূপ রীতিকে ষ্টাইল বলিতে সাহিত্যের মর্য্যাদাহানি হয়। উপরি-উদ্ধৃত রচনায় ভাষার যে ভঙ্গিমা দেখা যায় তাহা ব্যক্তি-বিশেষের বচন ভঙ্গিমা মাত্র—বৈঠকী আলাপ—হিসাবে উহা উপভোগ্যও হইতে পারে; কিন্তু যে-লেখকের অন্তরে সত্যকার সাহিত্যসৃষ্টির প্রেরণা আছে, তাহার পক্ষে ওই ভাষা যেমন কৃত্রিম, তেমনই ঐশ্বর্য্যহীন। এই ভাষাকে ‘চতি’ ভাষা নাম দেওয়াই ঠিক, কারণ প্রথমত, উহা সাহিত্যের ভাষা নয়; দ্বিতীয়ত, উহা একটা রীতিই বটে—সে রীতি যেমনই হউক। অতিশয় ছোট লেখক যাহারা তাহারাই উহাকে আপনাদের ষ্টাইলরূপে গ্রহণ করিতে পারে—কারণ, ষ্টাইলের যে ভাষাগত সমস্যার কথা পূর্ব্বে আলোচনা করিয়াছি, সেই সমস্যা তাহাদের নাই; তাহারা সংবাদপত্র-জাতীয় সাহিত্য রচনা করে; একটি অতি সহজ সাধারণ ভঙ্গি হইলেই হইল— সাধারণ তথ্য বা তত্ত্বকে সংবাদ আকারেই তাহারা সাধারণের বুদ্ধিগোচর করে। Style is the man— ইহা যদি সত্য হয়, তবে এখানে ষ্টাইলের বালাই নাই; কারণ, ভাব-কল্পনার স্বাতন্ত্র্যের জন্য, কোনও গভীর ও মৌলিক অনুভূতি প্রকাশের সমস্যা এখানে নাই। বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে ষ্টাইলের প্রয়োজন, সে প্রয়োজনই এই সকল লেখকের নাই।

ষ্টাইল ও রীতির প্রভেদ বুঝাইবার জন্যই আমি যে আলোচনা করিলাম সেই আলোচনার প্রসঙ্গে এইখানেই, বিশেষ করিয়া বাংলা ভাষার সম্পর্কে, আরও দুই একটি কথা বলিবার আছে—বাংলা ভাষারই অধুনা যে দুই রূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহারই কথা। এই প্রসঙ্গে আমি অন্যত্র কিঞ্চিৎ আলোচনা করিয়াছি, এখানে ঠিক সেই আলোচনা করিব না।

উপরে আমি যাহাকে একটা রীতি বলিয়াছি, তাহাকে একটা রীতি না বলিয়া খাঁটি বাংলা গদ্যের ভাষা বলিয়া দাঁড় করাইবার যে আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে এইরূপ সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করিয়াছে, এবং ফলে ভাষারই দুই আদর্শ দাঁড়াইয়াছে, তাহা কতদূর যথার্থ সে বিচার এখানে অপ্রাসঙ্গিক নহে। আসলে, ঐ আদর্শভেদ যে ভাষাঘটিত নয়, রীতিঘটিত—তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। যদি কথ্য ভাষা বা চলতি-ভাষা বলিয়া একটা ভিন্ন ভাষা স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলেও সাহিত্যে তাহার একাধিপত্য দাবি করা চলে না। কথ্য ভাষায় লোকে কথাই কহে, বৈঠকী আলাপ-আলোচনা করে—সেই ভাষায় সাহিত্যরচনা সম্ভব নয়—হইলে, সকল উপভাষাগুলিই এক একটি সাহিত্যিক ভাষা হইত—কোনও ভাষায় তাহা হয় নাই। সাহিত্যের ভাষা অধিকাংশের ভাষাও নয়—কারণ, অধিকাংশই সাহিত্যের ধার ধারে না। লোক-সাহিত্য বলিয়া একটা সাহিত্য মুখেমুখে গড়িয়া উঠে বটে, কিন্তু তাহাও সাহিত্য নয়, কারণ ছড়া ও গানই কোনও সাহিত্যের সর্ব্বস্ব নয়, সবং সাহিত্যের আদর্শ আরও বৃহৎ ও ব্যাপক। যে ভাষাকে ‘চতি’ ভাষা বলা হয় তাহাও চলতি বা মুখের ভাষা নয়, সাহিত্যের ভাষার মতই তাহাও কৃত্রিম। এমন কি, “চলতি ভাষা” নামটাই সাহিত্য-বিরোধী, কারণ সাহিত্য যে-মনের সৃষ্টি সেই মনই ‘চতি’ মন নয় সে মন যতই উচ্চসমাজের শিক্ষিত মন হউক। সকল চলতি বা কথ্য—ভাষার সম্বন্ধে একজন মহামনীষীর উক্তি এইরূপ—

Every style of writing should bear a certain trace of relation—ship with the monumental style, which is indeed the ancestor of all styles: so that to write as one speaks is just as faulty as to do the reverse, that is to say, to try and speak as one writes. (Schopenhauer : On Authorship and Style’)

এখানে লেখক ষ্টাইল অর্থে রীতিই ধরিয়াছেন— আমিও এই ভাষাকে একটি রীতি বলিয়াই মনে করি। উহা কোনও সত্যকার কথ্য ভাষা নয়। কথ্য ভাষা হইলেও তাহা সাহিত্যের ভাষা হইত না—ইহা তর্ক করিয়া বুঝাইবার প্রয়োজন নাই। এখানে খাঁটি কথ্য ভাষার একটি উদাহরণ দিব, লেখক সেই ভাষায় যাহা রচনা করিয়াছেন, তাহার সাহিত্যিক মূল্য নিরূপন করা আদৌ দুরূহ নয়।—

“চিৎপুরের বড় রাস্তা মেঘ কল্লে কাদা হয়—ধূলোয় ধূলো, তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েছে। প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশ বেঁদে কাঁদে করেছে—কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ি বাজাতে বাজাতে চলেছে—তার পেছনে এলমেলো নিশেনের শ্রেণী। মধ্যে হাড়িরা দল বেঁদে ঢালের সঙ্গতে “ভোলা বোম্ ভোলা বড় রঙ্গিলা লেংটা ত্রিপুরারী শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা” ভজন গাইতে গাইতে চলেছে। তার পেছনে বাবুর অবস্থামত তকমাওয়ালা দরওয়ান, হরকরা, সেপাই, মধ্যে সর্বাঙ্গে ছাই ও খড়িমার্খা, টিনের সাপের ফণার টুপি মাথায় শিব ও পার্ব্বতী সাজা সং। তার পেছনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকী ফুঁড়ে ধুনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেছে। পাশে বেণোরা জিবে হাতে বাণ ফুঁড়ে চলেছে। লম্বা লম্বা ছিপ, উপরে শোলার চিংড়ি মাছ বাঁদা। সেটকে সেট ঢাকে ড্যানাক্ ড্যানাক্ করে রং বাজাচ্ছে। পেছনে বাবুর ভাগ্নে, ছোট ভাই বা পিসতুতো ভেয়েরা গাড়ী চড়ে চলেচেন —তাঁরা রাত্রি তিনটের সময় উঠেচেন, চোক লাল টক্ টক্ কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে ও কালীঘেটে ধূলোয় ভরে গিয়েছে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখচেন, মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া খেপেছে—হুড়মুড় করে কেউ দোকানে কেউ খানার উপরে পড়েছেন, রৌদ্রে মাথা ফেটে যাচ্ছে—তথাপি নড়চেন না।”

এই ভাষা আদৌ মাৰ্জ্জিত নহে, ইহা slang মিশ্রিত অতিশয় চলতি বুলি—যেন লেখ্য ভাষার একটি প্রবল প্রতিবাদ। তথাপি অতিশয় ব্যাপক অর্থে ইহাও একরূপ ষ্টাইল হইয়াছে—কারণ বক্তব্য বস্তুর সহিত ইহার সামঞ্জস্য আছে; ইহা শুধু ভাষারই ভঙ্গি নয়—এ ভঙ্গি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনুরূপ; এবং সেই দৃষ্টি অতিশয় সংকীর্ণ ও সাধারণ মনোবৃত্তিমূলক বলিয়া ইহা সাহিত্যহিসাবে নিম্নস্তরের রচনা। তথাপি এ ভাষা খাঁটি, ইহাতে ভান নাই, এবং ভাব-কল্পনার গভীরতা না থাকিলেও ইহার মূলে একটা বাস্তব-প্রেরণা আছে।

কথ্য ভাষায় ইহার অধিক কিছু আশা করা যায় না। কথ্য ভাষা যখন ছন্দোবদ্ধ হয় তখন তাহা তো আর কথাই থাকে না—অতএব সে দৃষ্টান্ত এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু ‘চলতি ভাষা’ নামে এই যে নূতন বাংলা ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে, ইহা কি সত্যই একটা পৃথক ভাষা? ইহার শব্দযোজনা পদ্ধতির যে পার্থক্য তাহা ভাষার নহে—রীতির। তাহার ফলে যাহা ঘটে তাহা ধ্বনির বৈষম্য, আর কিছুই নহে। ষ্টাইল ও ভাষার আলোচনায় আমি ভাষার ধ্বনিকে ষ্টাইলের একটি অঙ্গ বা উপাদান বলিয়াছি। এখানে তাহারই একটি বিশিষ্ট প্রমাণ মিলিবে। এই চলতি ভাষার ধ্বনি এমনই যে, তাহার বৈশিষ্ট্য বা বৈচিত্র্যসম্পাদন কষ্টসাধ্য; ইহার ধ্বনিও, একটা বাঁধা রীতির মত, ষ্টাইলের পক্ষে অনুপযোগী। অপর পক্ষে যাহাকে সাধু ভাষা বলা হয়, তাহার ধ্বনি-বৈচিত্র্যের শেষ নাই। এ জন্য ঐ ভাষা উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন সর্ব্বপ্রকার ষ্টাইলকে ধারণ করিতে পারে। লেখকের ব্যক্তিত্ব-মূলক বিশিষ্ট ভাব—প্রেরণা যখন অনুরূপ ভাষায় ব্যক্ত হইতে চায়, তখন অনুরূপ ধ্বনিরও সন্ধান করে—কোনও একটি নির্দ্দিষ্ট ধ্বনিরীতিকে আশ্রয় করিলে তাহার চলে না। বাংলা ভাষায় এ যাবৎ ষ্টাইলের এই স্বেচ্ছাবিচরণ ঘটিয়াছে সাধু ভাষায়—এই সাধু ভাষায় ভাবের উপযুক্ত ধ্বনি যে কতরূপ হইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। তাহা ছাড়া, সাহিত্যের যাহা সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ ষ্টাইল, যাহাকে “monumental” বলা যাইতে পারে, রচনার সেই ভাব-গভীর অনবদ্য রুপ সাধুভাষাতেই সম্ভব হইয়াছে— সে পক্ষে দৃষ্টান্ত অনাবশ্যক। ভাবমাত্রেই যেখানে ভাষায় যথাযথ রূপ পায় সেখানেই তাহা একরূপ ষ্টাইলের সৃষ্টি করে বটে এবং এই ষ্টাইলের গুণেই তাহা অতি নিম্ন অথবা মধ্য স্তরের সাহিত্য আখ্যা পাইতে পারে, তথাপি এ সকল ষ্টাইল ঐ শ্রেষ্ঠ ষ্টাইলের তুলনায় তুচ্ছ। সেই যে ষ্টাইল, যাহার গুণে—শেকসপীয়ারের দুই চারি ডজন লাইন— ‘a splendid conquest of the human mind’ বলিয়া মনে হয়-বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের দুই-দশ ছত্র বাংলা সাহিত্যের গৌরব বলিয়া মনে হয়—তাহার মত কিছু সৃষ্টি করা ঐ চলতি ভাষায় সম্ভব নহে-রসিকমাত্রেই ইহা স্বীকার করিবেন। অতএব চতি ভাষা আর যাহাই হউক, বাংলা সাহিত্যের আদর্শ-ভাষা বলিয়া গণ্য হইতে পারে না।

সাহিত্যের সম্পর্কে রীতি কথাটা যদি কোনও অর্থে খাটে তবে তাহা একমাত্র পদ্য ও গদ্য—এই দুইয়ের ভেদ নির্দ্দেশ করিবার জন্য। কারণ পদ্য বা গদ্য-ষ্টাইল ভেদ নয়—রীতি ভেদ মাত্র। আধুনিক সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্যের এই রীতিভেদ ভাবের উপর নির্ভর করে না। যাহা পদ্যে প্রকাশ যোগ্য তাহা গদ্যেও প্রকাশ করা যায়, দুই-ই সমভাবে খাঁটি কাব্যপ্রেরণার উপযোগী হইতে পারে। বরং আধুনিক সাহিত্যের সৃষ্টিসম্ভার লক্ষ্য করিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, গদ্য পদ্য অপেক্ষা ভাব-বৈচিত্র্যের পক্ষে আরও অধিক উপযোগী—’it is an instrument of many stops’। প্রাচীনকালে মহাকাব্য ও নাটক যে কাব্যরসের আধার ছিল, আধুনিক কালে সেই রসই আরও গূঢ় ও দূরসঞ্চারী হইয়া গদ্য-উপন্যাসে ও গদ্য-নাটকে সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে; ইহার জন্য পদ্যচ্ছন্দের প্রয়োজন হয় নাই, বরং পদ্যের পয়ঃপ্রণালী সে রস-প্রবাহের পক্ষে সংকীর্ণ বলিয়াই তাহা পরিত্যক্ত হইয়াছে। গদ্য নিজের স্বতন্ত্র কাজ তো করেই, তদুপরি গদ্য উৎকৃষ্ট কাব্যসৃষ্টির পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী হইয়াছে, আমাদের সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস—কাব্যগুলিই তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক বাংলাসাহিত্যের জনক বাংলা গদ্য—সাহিত্যেরই প্রতিষ্ঠা করিলেও, সেই গদ্যকে অতি উচ্চ ভাব-কল্পনার বাহন করিয়া তিনি যাহা রচনা করিয়াছিলেন, তাহাই আমাদের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গদ্যকাব্য—এপিক ও নাটকীয় কল্পনার কাব্যরস তাঁহার কয়েকখানি উপন্যাসেই উৎসারিত হইয়া বাংলা সাহিত্যকে মহিমান্বিত করিয়াছে। পদ্যে না হইলে কাব্যরচনা হয় না, এবং পদ্যকাব্যরচয়িতাই কবিপদবাচ্য—এইরূপ একটা সংস্কারের বশবর্তী হইয়া আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকে কবি বলিয়া মনে করি না—ইহার মত ভুল আর কিছুই নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা হইতে এক টুকরা গদ্যকাব্য উদ্ধৃত করিলাম, তাহাতেই, কাব্যসৃষ্টির পক্ষে গদ্য ও পদ্য যে একটা রীতি-ভেদ মাত্র, তাহা সহজেই বুঝা যাইবে

“অপ্সরোগণের ভ্রূবিলাসযুক্ত কটাক্ষের জ্যোতিঃ লইয়া অতি যত্নে নিৰ্ম্মিত যে সম্মোহন শর পুষ্পাধন্বা তাহা পরিণীত দম্পতির প্রতি অপব্যয় করেন না। ……যেখানে গাঁটছড়া বাঁধা হইল—সেখানে আর তিনি পরিশ্রম করেন না, প্রজাপতির উপর সকল ভার দিয়া, যাহার হৃদয়শোণিত পান করিতে পারিবেন, তাহার সন্ধানে যান। কিন্তু আজ বোধ হয়, পুষ্পাধন্বার কোনও কাজ ছিল না—হঠাৎ দুইটা ফুলবাণ অপব্যয় করিলেন। একটি আসিয়া জীবানন্দের হৃদয় ভেদ করিল—আর একটি আসিয়া শান্তির বুকে পড়িয়া প্রথম শান্তিকে জানাইল যে, সে বুক মেয়েমানুষের বুক-বড় নরম জিনিস। নবমেঘনির্মুক্ত প্রথম জলকণানিষিক্ত পুষ্পকলিকার ন্যায় শান্তি সহসা ফুটিয়া উঠিয়া উৎফুল্ল নয়নে জীবানন্দের মুখপানে চাহিল।” (আনন্দমঠ)

বিশেষ করিয়া এই স্থানটি উদ্ধৃত করিলাম এই জন্য যে, এখানে গদ্য স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত আছে—ভাষাও গদ্য, চিন্তাও গদ্যময়, কিন্তু তাহারই মধ্য দিয়া যে কাব্যরস ফুটিয়া উঠিয়াছে—তাহার আধার এতদপেক্ষা উৎকৃষ্ট হইতে পারিত না। নিম্নোদ্ধৃত অংশটি গদ্য হইলেও একটি কবিতা। —

“বেলা অবসান হইয়া গেল। গাছের সর্ব্বোচ্চ চূড়া হইতে অস্তোন্মুখ সূর্য্যের শেষ রক্তাভা কোথায় সরিয়া গেল, সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি গ্রামের ভিতর হইতে ভাসিয়া তাহার কাণে পৌঁছিল, সেই সঙ্গে তাহার নিমীলিত চোখের সুমুখে অপিরিচিত গৃহস্থবধূদের শান্ত মঙ্গল মূর্ত্তিগুলি ফুটিয়া উঠিল। এখন কে কি করিতেছে, কেমন করিয়া দীপ জ্বালিতেছে, হাতে দীপ লইয়া কোথায় কোথায় দেখাইয়া ফিরিতেছে, এইবার গলায় আঁচল দিয়া নমস্কার করিতেছে, তুলসীতলায় দীপ দিয়া কে কি কামনা ঠাকুরের পায়ে নিবেদন করিতেছে—এ সমস্তই চোখে দেখিতে লাগিল, কানে শুনিতে লাগিল। আজ অনেক দিন পরে তাহার চোখে জল আসিল। কত সহস্র বৎসর যেন শেষ হইয়া গিয়াছে, সে কোন গৃহে সন্ধ্যাদীপ জ্বালিতে পায় নাই, কাহারও মুখ মনে করিয়া ঠাকুরের পায়ে আয়ু ঐশ্বৰ্য্য মাগিয়া লয় নাই। এই সমস্ত চিন্তাকে সে প্রাণপণে সরাইয়া রাখিত, কিন্তু আজ পারিল না। শাঁখের আহ্বানে তাহার ক্ষুধিত তৃষিত হৃদয় কোনো নিষেধ না মানিয়া গৃহস্থবধূদের ভিতরে গিয়া দাঁড়াইল। তাহার মনশ্চক্ষে প্রতি ঘরদোর প্রতি প্রাঙ্গণপ্রান্তর বাঁধান তুলসীবেদী, প্রতি দীপটি পর্যন্ত এক হইয়া গেল—এ যে সমস্তই তাহার চেনা; সবগুলিতে এখন যে তাহারই হাতের চিহ্ন দেখা যাইতেছে। আর তাহার দুঃখ রহিল না, ক্ষুধাতৃষ্ণা রহিল না, সে তন্ময় হইয়া নিরন্তর বধূদের অনুসরণ করিয়া ফিরিতে লাগিল। যখন তাহারা রাঁধিতে গেল, সঙ্গে গেল; রান্না শেষ করিয়া যখন স্বামীদের খাইতে দিল, সে চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখিল; তারপরে সমস্ত কাজকর্ম সমাধা করিয়া অনেক রাত্রে যখন তাহারা নিদ্রিত স্বামীদের শয্যাপার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল, সেও কাছে দাঁড়াইতে গিয়া সহসা শিহরিয়া উঠিল—এ যে তারই স্বামী! আর তাহার চোখের পলক পড়িল না, একদৃষ্টে নিদ্রিত স্বামীর মুখপানে চাহিয়া রাত্রি কাটাইয়া দিল।”

(বিরাজ বৌ)

কিন্তু নিম্নোদ্ধৃত লাইন কয়টি গদ্য হইলেও ইহা যেমন কাব্যপ্রধান, তেমনই ইহার সুরও পদ্যাত্মক।

“আমার ইচ্ছা হইতে লাগিল, সমস্ত হৃদয়ভার, সমস্ত যৌবনভার, সমস্ত অনাদৃত ভক্তিভার লইয়া সেই অদৃশ্য নৌকার অভিমুখে জোড়কর করিয়া সেই নিস্তব্ধ নিশীথে সেই চন্দ্রালোকপুলকিত নিস্তরঙ্গ যমুনার মধ্যে, অকালবৃন্তচ্যুত পুষ্পমঞ্জরীর ন্যায় এই ব্যর্থ জীবন বিসর্জ্জন করি। কিন্তু পারিলাম না। আকাশের চন্দ্র, যমুনাপারের ঘনকৃষ্ণ বনরেখা, কালিন্দীর নিবিড়-নীল নিষ্কম্প জলরাশি, দূরে আম্রবনের উর্দ্ধে আমাদের জ্যোৎস্নাচিক্কণ কেল্লার চূড়াগ্রভাগ সকলেই নিঃশব্দগম্ভীর ঐকতানে মৃত্যুর গান গাহিল; সেই নিশীথে গ্রহচন্দ্রতারাখচিত নিস্তব্ধ তিন ভুবন আমাকে একবাক্যে মরিতে কহিল। কেবল বীচিভঙ্গহীন প্রশান্ত যমুনাবক্ষোবাহিত একখানি অদৃশ্য জীর্ণ নৌকা সেই প্রসারিত জ্যোৎস্নারজনীর সৌম্য সুন্দর শান্ত শীতল অনন্ত ভুবনমোহন মৃত্যুর আলিঙ্গনপাশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাকে জীবনের পথে টানিয়া লইয়া চলিল।” (গল্পগুচ্ছ)

গদ্যই আধুনিক জীবনের বিচিত্র রসসংবেদনার অতি নিপুণ ও বৈচিত্র্যময় বাকভঙ্গি হইয়া উঠিয়াছে—ইহাই যেন কবি সরস্বতীর কামধেনু। তথাপি পদ্যচ্ছন্দের প্রয়োজনীয়তা বোধ হয় কখনও দূর হইবে না-ভাবানুভূতির একটা স্তর আছে যেখানে পদ্যচ্ছন্দই তাহার স্বচ্ছন্দ ও একান্ত উপযোগী প্রকাশরীতি। আধুনিক কালে প্রায় সকল ভাবই জ্ঞানাত্মাক—সকল অনুভূতির মধ্যেই মনের বিশ্লেষণী বৃত্তি সজাগ হইয়া থাকে; এ জন্য, ভাষা যেমন রূপরসাত্মক না হইয়া অতিসূক্ষ্ম মানস—ক্রিয়ার প্রতিবিম্ব হইয়া উঠিতেছে, তেমনই সরল ও প্রবল আবেগমূলক সুরও তাহার বিশিষ্ট উপাদান হইতে পারিতেছে না। আধুনিকতম সাহিত্যের আদর্শ-ভাষা শুধুই গদ্য নয়—রূপানুভূতিব্যঞ্জক না হইয়া অতিসূক্ষ্ম ও জটিল জ্ঞানানুভূতিমূলক হইয়া উঠিতেছে। এইরূপ ভাষা আমাদের সাহিত্যে এখনও প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে নাই, এখনও তাহা অতিশয় প্রাথমিক অবস্থায়, অর্থাৎ অনুকরণের অবস্থায়, আছে— যাহাদের সাহিত্যিক প্রতিভা নাই, অর্থাৎ কোন কিছু সৃষ্টি করিবার মত দৃষ্টিশক্তি নাই, তাহারাই ‘ভাবের ঘরে চুরি’ ঢাকিবার জন্য এইরূপ মানস-রস-রসিকতার দোহাই দিতেছে, এবং ভাষাকে একেবারে বিরূপ ও বি-আকার করিয়া তুলিতেছে। রসসৃষ্টির এই নব আদর্শ সবচেয়ে প্রকট হইয়াছে আধুনিক নিশ্ছন্দ কবিতায়; এখানে কাব্যের খাতিরে ভাবানুভূতির ভান করিতেই হয়, কিন্তু সে বস্তু একেবারে ‘নাস্তি’ বলিয়া তাহার কোনও রূপই না থাকায়, কতকগুলি অসম্বন্ধ শব্দের চকমকি ঠুকিয়া ভাবের সরিষাফুল সৃষ্টি করিতে হয়। এই সকল রচনায় যেমন ছন্দও নাই তেমনই ভাষাও নাই, অতএব ইহাদের ষ্টাইলের বালাইও নাই। আধুনিক চিন্তাধারা যেমনই হউক, আধুনিক মানুষের ভাব-জীবন অতিশয় রুগ্ন ও নিস্তেজ; কাজেই এ যুগে কবিতার স্বাস্থ্য আর নাই। সাহিত্যে পদ্য-রীতির অপ্রচলনের ইহাও একটা কারণ।

ষ্টাইল কথাটির যতগুলি অর্থ সম্ভব তাহার উল্লেখ প্রথমেই করিয়াছি—এবং যে অর্থে তাহার বিশেষ প্রয়োগ, ও নানা সমস্যা উপস্থিত হইয়া থাকে, সে সম্বন্ধে যথাসম্ভব বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি। ষ্টাইলের মূল কারণ যে লেখকের ভাবকল্পনার বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই—শেষ পর্যন্ত ‘Style is the man’ বাক্যটিই যথার্থ। কিন্তু এই ব্যক্তিত্ব সকল শ্রেষ্ঠ লেখকের রচনায় অবশ্যম্ভাবী হইলেও, তাহা একটা আন্তরঅনুভূতি বা বিশিষ্ট ভাব-কল্পনাকেই আশ্রয় করিয়া থাকে— ষ্টাইলের যে ব্যক্তিত্ব তাহা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বই নয়, সেরূপ ব্যক্তিত্বের কোনও মূল্য নাই। এইজন্য অতিশয় বাহ্যিক ব্যক্তিগত ভঙ্গিকে সত্যকার ষ্টাইল বলা চলে না—ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। উৎকৃষ্ট প্রতিভা যেমন একটা ষ্টাইল সৃষ্টি করে, সেই ষ্টাইলই যেমন তাহার সকল সৃষ্টির অন্তগর্ত একটা অভিনব দৃষ্টির পরিচয় দেয়, ও সেই কারণে আমাদের চিত্তেও একটা নূতন রস-সংবেদনা ও নূতনতর রুচির বিকাশ করে—আমাদের চক্ষে একরূপ নবদৃষ্টি দান করে, তেমনই একথা ভুলিলে চলিবে না যে, সে কেবলমাত্র একটা প্রকাশ-ভঙ্গি বা বাণী-নির্মাণের অভিনব চাতুরীই নয়—কবির প্রাণে একটা সত্যকার জীবন্ত অনুভূতি, একটা সুগভীর বস্তু-রসপ্রেরণাই সেই ষ্টাইলের জনয়িতা। কিন্তু আমরা প্রায়ই এ বিষয়ে অবহিত হইতে পারি না—ষ্টাইলকে যে-কোনও ভাষা—ঘটিত কারুকলা বা কৌশলময় ভঙ্গি বলিয়াই উপভোগ করি। কোনও কবির কবিশক্তি যখন নিস্তেজ হইয়া পড়ে—তখনও তাঁহার ব্যক্তিগত ভঙ্গিমাটিকেই আমরা ষ্টাইল মনে করিয়া কবির অক্ষম রচনাকে শিরোধার্য্য করি। অনেক সময় কবিগণেরও আত্মবিভ্রম ঘটে—ভাব-প্রেরণার নবত্ব আর থাকে না, তখন যে-ভঙ্গি এককালে সত্যকার ষ্টাইল ছিল, এবং যাহা এক্ষণে ভঙ্গিমামাত্র হইয়া কবির ব্যক্তিত্বাভিমান চরিতার্থ করে, সেই ভঙ্গিমাকে নানা নূতন রূপে ভাঙ্গাইয়া বিগত-শক্তি কবিগণ মিথ্যার মায়াজাল সৃষ্টি করেন, এই আত্মপ্রবঞ্চনা তাঁহার ভক্তগণকেও প্রবঞ্চিত করে। ইহার দৃষ্টান্ত আমাদের কালেও জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিয়াছে—অতি উচ্চদরের প্রতিভাই এইরূপ ব্যাধিগ্রস্ত হয়; কারণ, ষ্টাইল বলিতে ভাব ও ভাষার মধ্যে যে সুস্থ ও সবল সম্বন্ধ বুঝায় সেই সম্বন্ধ ছিন্ন হইয়া গেলেও, লেখক তাঁহার idiosyncrasy বা ব্যক্তিগত ভঙ্গিটি তখনও প্রকাশ করিতে থাকেন। ইহার ফলে, লেখকের যতই সত্যকার প্রেরণার অভাব হয়, ততই ভঙ্গিমার প্রতিই শ্রদ্ধা বাড়িতে থাকে—শেষে এমন মোহ উপস্থিত হয় যে, সর্ব্বশেষের রচনাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট বলিয়া তাঁহার বিশ্বাস জন্মে, এবং সত্যকার প্রেরণার অভাব যেমন ভঙ্গিচাতুর্য্য, technique বা প্রকাশকলার নিত্য-নূতন কৌশল-উদ্ভাবনেই পূরণ করিবার প্রবৃত্তি হয়, তেমনই পূর্বতন রচনাগুলিকেও ভাঙ্গিয়া তাহাদের ছাঁচ সংশোধন করিবার প্রবৃত্তিও জাগে। সাহিত্য-জগতে ইহা অভূতপূর্ব্ব বা অসম্ভব নয়, তাহার প্রমাণ-স্বরূপ আমি একজন সুবিখ্যাত ইংরেজ সমালোচকের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি। যখন সেই আদি অকৃত্রিম কবিপ্রেরণা আর থাকে না, তখন অতিশয় শক্তিমান লেখকেরাও ভাববস্তুর পরিবর্ত্তে technique বা প্রকাশকলাকেই, তাঁহাদের সহজাত ও অভ্যস্তব্যক্তিত্বগুণের সাহায্যে, যে ভাবে লীলায়িত করিয়া নানা কায়াহীন ছায়ার সৃষ্টি করেন, তাহা উল্লেখ করিয়া এই সমালোচক বলিতেছেন—

Meredith and Henry James suffered a similar atrophy of the central, originating power……paid the penalty of an undue preoc—cupation with technique. With the decline of his power of receiving a direct emotional impulse from the life he desired to represent, he (H. James) transfered the object of his interest to the process of representations … Technique begins to assume a life of its own; it is graced by complications and subtleties and economies which dance inextricable patterns in the void……For a barren idiosyn—crasy of style may have recondite forms; instead of being obviously hollow and lifeless, it may present the appearance of luxuriant growth…… Or you may have the condition in which a writer’s impulse is derived from his delight in contemplating the formal beauty of the intricate design he is engaged in constructing.

উপরে যাহা উদ্ধৃত করিলাম, তাহার সবগুলিই আমাদের কালের শ্রেষ্ঠ লেখকের সম্বন্ধে সত্য—সেরূপ প্রতিভা আমাদের সাহিত্যে বিরল বলিয়াই, উৎকৃষ্ট ষ্টাইল হইতেই যে অপূর্ব্ব ব্যাধির উৎপত্তি হয় তাহার দৃষ্টান্ত ঐ একটি বই আর নাই। রবীন্দ্রনাথের আধুনিক রচনা, এমন কি বাংলা ভাষার নব্যরীতির প্রতি তাঁহার যে অনুরাগ, ও বানানেরও নব ভঙ্গি-প্রবর্তন তাঁহার যে উৎসাহ-এ সকলের মূলে ঐ এক কারণ রহিয়াছে। গদ্য ও পদ্য লইয়া তাঁহার যে অফুরন্ত টেকনিক-লীলায় আমরা মুগ্ধ হই, তাহারও মূলে রহিয়াছে নির্ব্বাপিত কল্পনা-বহ্নির বিচিত্র অঙ্গার—দীপ্তি। তাঁহার অঙ্কিত ছবিগুলিতে যে “ ghostly almost supra-sensual emotion”. -এর আভাস পাওয়া যায়, আধুনিক রচনাগুলিতেও তাহাই আর এক রুপে প্রকাশ পাইয়া থাকে; কারণ, যখন সত্যকার ভাব-প্রেরণার খাঁটি ষ্টাইল হারাইয়া যায়, তখন— “this ghostly, almost supra-sensual emotion will take the place of the primary, originating emotion upon which a real vitality of style depends”; রবীন্দ্রনাথের গদ্য-কবিতাগুলি ইহার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। সমালোচক আরও যাহা বলিয়াছেন তাহাও এই সম্পর্কে অক্ষরে অক্ষরে সত্য—

For if original genius must create its own taste, it generally creates its own sycophants. The coterie is formed of those who mistake the accidents for the essentials of true individuality in style; the esoteric cult is portentously inauguarated; and unles the master is one of those rare spirits, not too common even among masters……he may be easily convinced that there is a law of nature to ensure that his last work must inevitably be his finest, as his devotees are bound to assure him.

ষ্টাইল সম্বন্ধে যে সূক্ষ্ম ও অব্যর্থ দৃষ্টির ফলে লেখকের এই কথাগুলি প্রায় প্রত্যেকটি আমাদের সাহিত্যের একটি ঘটনার প্রতিই উদ্দিষ্ট বলিয়া মনে হয়, তাহাতে সাহিত্য-সমালোচনার এই ষ্টাইল-বাদ যে কত বড় সাহিত্যিক সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত, তাহা বুঝিতে পারা যাইবে। আমি অতঃপর ষ্টাইল সম্বন্ধে কয়েকটি বিশেষ উক্তির আলোচনা করিব, এবং যাহা বলিয়াছি সংক্ষেপে তাহার পুনরুক্তি করিব।

প্রথমেই, ষ্টাইল কথাটির সর্ব্ববাদী-সম্মত অর্থ আর একবার বুঝিয়া লওয়া যাক। একজন প্রসিদ্ধ সমালোচকের মতে, ষ্টাইল বলিতে একই বস্তু বুঝায়—ষ্টাইল-শব্দটি বহুবচন নয়, একবচন; ষ্টাইলের প্রাণ— রচনাগত ‘fineness of truth’ বা ‘absolute accordance of expression to idea’: এজন্য কোনও রচনার ভাষা রঙ্গীন হউক বা সাদা হউক, অতিশয় সরল অথবা বহু আয়াসযুক্ত হউক, তাহার ষ্টাইল-লক্ষণ এই যে, ভাবের সঙ্গে ভাষার সম্পর্কে লেশমাত্র ব্যভিচার ঘটে নাই। এই একমাত্র প্রয়োজন-সিদ্ধির জন্য স্থলবিশেষে ভাষা যেমন অলঙ্কারমন্ডিত হইতে পারে, তেমনই অন্যত্র সকল আলঙ্কারিকতা বর্জ্জন করাই তাহার পক্ষে সঙ্গত হইবে। এই কারণে ভাষার রূপবৈচিত্র্য ঘটিবে বটে, কিন্তু ষ্টাইল অর্থে সৰ্ব্বত্র সেই একই গুণ বুঝিতে হইবে।

সকল আর্টের মত সাহিত্যও একটি আর্ট বা শিল্পকৰ্ম্ম। এই শিল্পকার্য্যের দিক দিয়া ষ্টাইলের সমস্যা বিচার করিলে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করা অত্যাবশ্যক। আমি ইতিপূর্ব্বে ষ্টাইলের সম্পর্কে ভাষার আলোচনা করিয়াছি—এক্ষণে এই ভাষার সম্বন্ধে আরও দুই চারি কথা অপর এক সমালাচকের উক্তি হইতে তুলিয়া দিলে ভাল হয়। তিনি বলেন, এই –expression বা ভাষা লইয়াই যত কষ্ট; কারণ, উহা সকল রচনার পক্ষেই Fine ও true হওয়া চাই—অতিশয় নিপুণ ও যথাযথ হওয়া চাই; শব্দ-নির্ব্বাচনেও পান্ডিত্য চাই, অর্থাৎ শব্দশাস্ত্রে বুৎপত্তি থাকা চাই; ভাষাকে তাহার স্বধর্ম্ম ত্যাগ না করাইয়া সকল ভাব ও ভাব পরিবেশের (atmosphere) উপযোগী করিয়া লওয়া চাই, এবং সত্যকার সাহিত্য-শিল্পী হইতে হইলে এ বিষয়ে সংযম ও নির্মমতা চাই।

ভাষার এই পান্ডিত্য-সুলভ শ্রী ও সৌষ্ঠব, সংযমজনিত নৈপুণ্য, ও মিতাক্ষর—গাঢ়তা উপভোগ করিতে হইলে, পাঠকের পক্ষেও অনেকখানি তৈয়ারী থাকা চাই। সব কথা, চিন্তার সকল সূত্র, ধরাইয়া দিতে হইবে–পাঠক হাতটি ধরিয়া ধীরে ধীরে চলিবেন—এমন প্রথা উৎকৃষ্ট আর্টের প্রথা নয়। লেখার সংযম ( restraint), বাহুল্যবৰ্জ্জন (economy of means), এবং ভাষার মিতাক্ষর-গাঢ়তা (frugal closeness of style)—এ সকলের একটি বিশিষ্ট সৌন্দর্য্য আছে; তাহাতেই একপ্রকার রসোল্লাস হয়, ও পাঠকের চিত্তে, দুরূহ সাধনায় সিদ্ধিলাভের মত, একটা আনন্দের উদ্রেক হয়। এই প্রসঙ্গে আমাদের একটা সংস্কারের কথা বলিব। প্রায়ই শোনা যায়, “অমুক বড় ভাল লেখেন, উহার ভাষা বড় সহজ ও প্রাঞ্জল.” এবং এই কারণে গ্রাম্য গানও কথা-কাহিনীর ভাষাই আদর্শ-ভাষা বলিয়া প্রশংসিত হয়; ভাষার বৈদগ্ধ্য বা পান্ডিত্য থাকিলে, অর্থাৎ তাহা যদি সাধারণ পাঠকের সুবোধ্য না হয় তাহা হইলে, সে রচনা নিকৃষ্ট বলিয়া বিবেচিত হয়। ইহার কারণ, প্রথমত—মহাকবি যে “আপরিতোষাৎ বিদুষাম্” বলিয়াছিলেন, এই সমালোচক সেই “বিদুষাং”-শ্রেণীর অন্তর্গত নহেন; সাহিত্য যে একটা বড় আর্ট, এবং তাহার সৃষ্টি ও রসাস্বাদন উভয়পক্ষে, সুমার্জিত রুচি ও শিক্ষিত রসবোধের প্রয়োজন আছে, সে ধারণাও ইহাদের নাই। ইহাদের রসবোধও যেমন আদিম, তেমনই স্বচ্ছন্দবনজাত স্বভাব-কবিতাই ইহাদের রুচিকর। দ্বিতীয় কারণ, ইহারা রচনার ষ্টাইল সম্বন্ধে একেবারে নাস্তিক। প্রসাদগুণ প্রভৃতি গুণের কথা রীতির সম্বন্ধেই খাটে, ভাষার এইরূপ কোনও পূর্ব্বনিৰ্দ্দিষ্ট বহির্গত লক্ষণ ধরিয়া থাকিলে ষ্টাইলকে বিদায় করিতে হয়। উৎকৃষ্ট রচনার ভাষা তাহারই অন্তর্গত ভাবের প্রতিবিম্ব হইবে—ভাবের ছাঁচে ভাষাকে গড়িতে হইবে, সেই ছাঁচ ভাষায় থাকা চাই—তাহাই রচনার উৎকর্ষের প্রমাণ; এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি, এখানে তাহার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। রচনার যে দুর্ব্বোধ্যতা তাহাও ষ্টাইলের দোষ, ভাষার নয়—এজন্য ষ্টাইলের অন্তর্গত আর একটা লক্ষণের আলোচনা এইবার করিতে হইবে।

প্রসঙ্গের আরম্ভেই ষ্টাইলের নানা অর্থের যে উল্লেখ করিয়াছিলাম তাহার একটি ছিল—প্রাঞ্জলতা; “অমুকের রচনায় পান্ডিত্য আছে, ভাবুকতা আছে, কিন্তু ষ্টাইল নাই”—এখানে ষ্টাইল নামে যে গুণের অভাব লক্ষ্য করা হইতেছে, তাহা ভাব বা চিন্তার পরিস্ফুটতা; অর্থাৎ রচনার যে গুণ থাকিলে কোনও চিন্তাবস্তু পাঠকের মনে একটি সুসম্বদ্ধরূপে ধরা দেয়, ইহা সেই গুণ; ভাব-প্রধান যে সাহিত্য, যাহাকে সৃষ্টিধর্মী সাহিত্য বলা যায়, তাহার পক্ষে এই গুণ যে কেন প্রধান নয়— সে-সাহিত্যের উৎকর্ষ কিসের উপর নির্ভর করে—তাহা পূর্ব্বের আলোচনা হইতেই বুঝিতে পারা গিয়াছে। তথাপি সাধারণ ভাবে সকল রচনাতেই একটি যে গুণ থাকা দরকার, তাহা ঠিক সাহিত্যিক অর্থে ষ্টাইল না হইলেও একটা আবশ্যকীয় গুণ, এই গুণ ষ্টাইলের মত ভিতর হইতেই রচনায় সংক্রামিত হয়, ভাষার কোনও বহির্গত আদর্শের প্রভাবে নয়। ইহাকেই “ mind in style” বলা হইয়াছে, ইহা লেখকের একপ্রকার মনন-শক্তি—চিন্তাগুলিকে সুসম্বন্ধ করিবার শক্তি। ইহার ফলে, লেখার মধ্যে চিন্তার ধারবাহিকতা, যুক্তিনিষ্ঠা, পরিমাণ-বোধ, অখন্ডতা, রচনাগত বিভিন্ন অংশের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ, শব্দ ও বাক্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক যোগ এবং বিষয়বস্তুর সহিত তাহাদের সামঞ্জস্য—এই সকল গুণ বৰ্ত্তমান থাকে। এই জন্য ইহার নাম—” mind in style” ইহার জন্য রচনার সুবোধ্যতা আপনা হইতে ফুটিয়া উঠে; নতুবা, ভাবই যদি গূঢ় ও গভীর হয়, অথবা তাহার মধ্যে যদি অতি সূক্ষ্ম চিন্তাও থাকে, তবে তাহা যে কথ্য-ভাষার মত সরল ভাষায়, অথবা অতি প্রচলিত বাক্যগুলির দ্বারাই প্রকাশ করিতে হইবে, তাহা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়।

“Mind in Style” -এর মত ষ্টাইলের আর একটি লক্ষণ আছে—তাহা “Soul in Style” বা ষ্টাইলের অধ্যাত্ম-গুণ, লেখকের দিব্যানুভূতির ফলেই ইহা ঘটিয়া থাকে। এই গুণ পূর্ব্বোক্ত গুণের ঠিক বিপরীত বা বিরোধী। প্রথমটির বলে লেখক আমাদের মনের মধ্যে বেশ একটি স্পষ্ট উপায়ে প্রবেশ করেন, দ্বিতীয়টির বলে কেমন যেন অতর্কিতে আমাদের বোধ-বুদ্ধিকে হঠাইয়া দিয়া, কোনও যুক্তি—এমন কি শব্দার্থের কোনও সুসঙ্গতি ব্যতিরেকেই, একেবারে আমাদের গভীরতম অনুভূতিকে স্পর্শ করেন। Soul-প্রধান ষ্টাইলে, ভাষা ও তাহার অভিপ্রেত ভাবের মধ্যে একটা সহজ সরল সম্বন্ধ নাই—কেমন করিয়া সে ভাব ভাষায় প্রকাশ পাইল তাহা নিরূপণ করা কঠিন হইয়া পড়ে। ইংরেজ সমালোচক ইহার দৃষ্টান্তস্বরূপ ইংরেজ কবি ব্লেক-এর (Blake) কবিতার উল্লেখ করিয়াছেন। আমার মনে হয়, সকল উৎকৃষ্ট কবিতার ভাষায় এই লক্ষণ আছে,—শব্দগুলি সেখানে যাদুমন্ত্রের মত শক্তিশালী। অতিশয় সরল সহজ শব্দ, অথবা কোনও একটি বিচিত্র উপমা এমন ভাবে আমাদিগকে চমকিত করে, এমন অর্থাতিরিক্ত ভাবের দ্যোতনা করে যে, আমরা বারবার সেই পংক্তি বা বাক্য আবৃত্তি করিতে থাকি; তাহার ভিতরের কোন্ বস্তু যে চিত্ত-চমৎকারের কারণ, তাহা বুঝিতে চেষ্টাও করি না। এই হিসাবে সকল উৎকৃষ্ট কাব্য-ভাষাই ‘soul in style’-এর উদাহরণ। কিন্তু আর একপ্রকার কাব্য আছে যাহাকে আমরা মিষ্টিক তত্ত্বরসের কাব্য বলিয়া থাকি—এইরূপ কাব্যের ভাবে ও ভাষায় একপ্রকার অধ্যাত্ম-প্রেরণার পরিচয় পাই। ব্লেক-এর কবিতা সেইজাতীয়; আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিহারীলালের অনেক শ্লোক এই শ্রেণীর অন্তর্গত; যাঁহারা ফার্সী কবি হাফিজের কবিতা পাঠ করিয়াছেন তাঁহারাও ষ্টাইলের এই গুণ বুঝিতে পারিবেন। এই সকল কবিতায় ভাবের অর্থ বা আকারগত ঐক্য না থাকিলেও একপ্রকার ভাবাবেশের ঐক্য থাকে, মনঃপ্রধান ষ্টাইলে রচনা যেমন একটি সুপরিস্ফুট আকার লাভ করে, এইরূপ দিব্যানুভূতি-প্রসূত কবিতায় তেমনই যেন একটি বর্ণ ও সৌরভমাত্র আমাদের চিত্তে রসোদ্রেক করে।

ভাষার আর্ট বা কলানৈপুণ্যের কথা বলিতেছিলাম। সাহিত্য-শিল্পীর প্রধান গুণ—সর্ব্বপ্রকার বাহুল্যবর্জ্জন। প্রসিদ্ধ জার্মান কবি Schiller বলেন—The artist is known by what he omits, অর্থাৎ রচনা-নৈপুণ্যের একমাত্র প্রমাণ, লেখক কতখানি বলিয়াছেন তাহা নয়, কতখানি বলেন নাই। ইহাতে লেখার ব্যঞ্জনা—গুণ বৃদ্ধি পায়, ভাব অর্থের সীমা ছাড়াইয়া যায়। যাহা কিছু অতিরিক্ত তাহারই নাম অলঙ্কার, যাহা অত্যাবশ্যক তাহা আর অলঙ্কার নহে। রচনার ভাষায় ভাব—অর্থের অতিরিক্ত প্রসাধন যদি কিছু থাকে তবে তাহা অলস প্রকৃতি পাঠকের মনকে বিশ্রাম দেয় মাত্র—বিষয় হইতে বার বার অন্য বিষয়ে আকৃষ্ট করিয়া তাহাদিগের প্রমোদ-পিপাসা চরিতার্থ করে। এই অলঙ্কার সম্বন্ধে একটি কথা মনে রাখিতে হইবে; অলঙ্কার যেমন নূতন করিয়া নির্ম্মাণ করা যায়, তেমনই প্রচলিত ভাষায় বহু অলঙ্কার লুকাইয়া থাকে—সতর্ক শিল্পী সেগুলিকে সযত্নে পরিহার করিবেন—রঙ্গীন কাচকে সাদা কাচ বলিয়া ভ্রম না করেন, প্রত্যেক বাক্যের অব্যর্থ প্রয়োগ না হইলে তাহার গৌরবহানি হয়, এবং রচনার truth ও fineness ক্ষুণ্ণ হয়।

শব্দ-প্রয়োগ ও বাক্য-যোজনার আর্ট সাহিত্য-শিল্পীর পক্ষে কতখানি সাধনার বস্তু, বাক্যকে ভাবের অবিকল প্রতিরূপ করিবার যে ষ্টাইল-নিষ্ঠা তাহার একটা দৃষ্টান্ত—বিখ্যাত ফরাসী লেখক Gustave Flaubert-এর বাণী-সাধনা। ইনি সাহিত্যসৃষ্টিতে ভাষার যে সাধনা করিতেন, তাহাতে মাত্রাধিক্য ছিল বলিয়া মনে হইলেও, তদ্দ্বারা ষ্টাইল-তত্ত্ব বুঝাইবার একটু সুবিধা হইবে। গুস্তাভ ফ্লোবেয়ারের মতে—”There are no beautiful thoughts without beautiful forms, and conversely”; অর্থাৎ ভাব-মাত্রেরই রূপ আছে, তেমনই রূপমাত্রেরই একটা ভাব আছে; কিন্তু ভাবের রূপ আছে বলিলেই ঠিক বলা হইবে না, ঐ রূপ যাহার যাহা—তাহা একেবারে তৎসদৃশ, অতএব একটিমাত্র; সেই এক ভাবের একমাত্র রূপকে আবিষ্কার করাই সাহিত্যশিল্পীর ইষ্ট-সাধনা। আগে সেই ভাবকে লেখক সম্পূর্ণরূপে আত্মগোচর করিবেন, পরে তাঁহার অভিপ্রায় হইবে —“I want you to see precisely what I see”। এই সকল কথা পুনরুক্তি হইলেও—শিল্পকৰ্ম্মহিসাবেও ষ্টাইলের মূল—তত্ত্ব যে এক, তাহাই বুঝাইবার জন্য আমি একজন বিখ্যাত সাহিত্য-শিল্পীর সাক্ষ্য উদ্ধৃত করিলাম। ফ্লোবেয়ারে বলেন, রচনার মধ্যে লেখকের প্রাণপণ চেষ্টার পরিচয় থাকুক অথবা তাহা অবলীলাকৃত মনে হউক—ঐরূপ সিদ্ধিলাভই ষ্টাইলের সর্ব্বস্ব।

গদ্য ও পদ্যের আপেক্ষিক মূল্য বা উপযোগিতা সম্বন্ধে, এই কয়েকটি কথাও অনুধাবনযোগ্য। গদ্যই আধুনিক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রীতি। আধুনিক মনের ভাব—চিন্তার অশেষ বৈচিত্র্যকে ছন্দোবদ্ধ করা যায় না; কাব্যের পক্ষে যে সংযম প্রয়োজন, ভাবের যে একাগ্রতা বা একমুখীনতার প্রয়োজন, এই বৈচিত্র্যের মধ্যে তাহা রক্ষা করা অসম্ভব। সুরের দ্বারা যেমন প্রাণের সকল তারগুলিকে আয়ত্ত করা যায়, এক্ষণে ভাষার দ্বারা তেমনই মনের সকল ভাবকে সহজ ও যথাযথরূপে প্রকাশ করা সাহিত্য-কলার পক্ষে প্রয়োজন হইয়াছে। সঙ্গীত-কলাই সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ কলা এই জন্য যে, তাহাতে শব্দ ও অর্থের বিরোধ সমস্যা নাই, ভাব একেবারে ধ্বনি-রূপ ধারণ করিয়াছে—অপর কিছুর মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয় না। আধুনিক জীবনের নিত্যনূতন অপরিসীম চিন্তারাজিকে ভাষায় এই অন্বর্থ রূপ দেওয়া গদ্যেই সম্ভব হইয়াছে, কাব্য-কলার গন্ডীর মধ্যে তাহা সম্ভব নয়, তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর সকল কবিতাই এত অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল। সঙ্গীতে যেমন ধ্বনির মধ্যে ভাব অপরোক্ষ হয়, তেমন সাহিত্যেও শব্দ ও অর্থের কেবল হরগৌরী—মিলন হইলেই চলিবে না, একেবারে এক হইয়া যাওয়া চাই। মনের মধ্যে যেমন ভাবের ভিড় লাগিয়া গিয়াছে, তেমনই ভাষায় তাহার প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র ও সম্পূর্ণ অভিব্যক্তি চাই; ইহার জন্য পদ্য অপেক্ষা গদ্যই অধিকতর উপযোগী; কারণ, ভাষার বাঁশিখানিকে অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হইতে হইবে–বিবৃতি, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ, ধ্যান, আবেগ, আবেদন—ভাষা হইতে সকল সুরই আদায় করিতে হইবে।

ষ্টাইল সম্বন্ধে সৰ্ব্বশেষ কথা এই যে ভাব ও ভাষার পূর্ণ-সাযুজ্যই ষ্টাইল বটে, এবং যে-রচনায় ইহা ঘটিয়াছে তাহা সাহিত্যকলা-সম্মত রসসৃষ্টি বটে, কিন্তু সেইজন্য সকল রচনাই সমান শ্রেষ্ঠ নয়। ভাবের যথাযথ প্রকাশ Good Art বা রস-রচনা বটে, কিন্তু Great Art হইতে হইলে ভাব-কল্পনার বিশিষ্ট গৌরব চাই। মানবহৃদয়-বিশ্বের ব্যাপ্তি ও গভীরতা যাহার মধ্যে যতখানি প্রতিবিম্বিত হইয়াছে—Mind এবং Soul, উভয়ই যাহার ষ্টাইল পুষ্ট করিয়াছে, যে রচনায় অতিশয় জটিল বিষয়-বিস্তার যেমন সুসম্বন্ধ আকারে পরিণত হইয়াছে, তেমনই colour ও mystic perfume বাদ পড়ে নাই, এবং যাহার মধ্যে soul of humanity, বিশ্ব-মানবের প্রাণ-স্পন্দন, অনুভূত হইয়া থাকে, তাহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট রস-সৃষ্টি, তাহাই Great Art— অতএব তাহাই শ্রেষ্ঠ ষ্টাইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *