বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ট্র্যাজেডি-তত্ত্ব

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ট্র্যাজেডি-তত্ত্ব

[বঙ্কিমী-উপন্যাসের ট্র্যাজেডি-তত্ত্ব; বঙ্কিমচন্দ্র ও শেক্সপীয়ার; উপসংহার। ]

এইবার সত্যই আমি একটা দুঃসাহসের কাজ করিব, এমন একটি বিষয়ের আলোচনায় অগ্রসর হইতেছি, যাহা আমার মত অ-পণ্ডিতের রীতিমত অনধিকার—চর্চ্চাই বটে, আমি শেক্সপীয়ারের নাটকের ট্র্যাজেডি-তত্ত্ব সন্ধান করিব, তাহাও আবার বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সম্পর্কে; এ যেন সেই “আদার ব্যাপারী”র জাহাজের খবর লওয়া। কিন্তু আমি সেই সমুদ্র হইতে আমার ক্ষুদ্র ঘট ভরিবার মত অতিসামান্যই লইব, শেক্সপীয়ার-সমালোচনার সেই বিরাট ভাঙারে প্রবেশ করিব না—মাত্র একজন সমালোচকের দুইচারিটি বাক্যই আমার প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট; তাহাও আমি আমার মত করিয়া বুঝিব। অধ্যাপক এ. সি. ব্র্যাডলি তাঁহার “Shakespearian Tragedy” নামক সুবিখ্যাত শেক্সপীয়ারের নাটক-সমালোচনার চূড়ান্ত করিয়াছেন, আমি তাহারই ছিটা-ফোঁটা’ লইয়া বঙ্কিমচন্দ্ৰকে বুঝিবার চেষ্টা করিব। অধ্যাপক ব্র্যাডলির সমালোচনায় এমন কয়েকটি কথা আছে যাহা শেক্সপীয়ার সম্পর্কেই পূরাপূরি প্রযোজ্য হইলেও, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্নের মীমাংসার অবকাশ তাহাতে আছে। বলা বাহুল্য, আমি অধ্যাপক ব্র্যাডলির শেক্সপীয়ারকে পূর্ণতম শেক্সপীয়ার বলিয়া গ্রহণ করিব না—তাঁহার আলোচনায় কাব্য অপেক্ষা তত্ত্বই বড় হইয়াছে; ঠিক সেই কারণেই তাঁহার কয়েকটি কথা আমার কাজে লাগিবে, কারণ আমি এক্ষণে কাব্যরসের পরিবর্তে ট্র্যাজেডির তত্ত্ব-বিচার করিতে বসিয়াছি।

অধ্যাপক ব্রাডলি শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজেডিগুলির এই কয়টি প্রধান লক্ষণ নির্দ্দেশ করিয়াছেন—

“Story of exceptional calamity produced by human actions, ending in the death of a man in high estate.”

—অর্থাৎ, “একটি অতিনিদারুণ দুর্ভাগ্যের কাহিনী; সেই ঘটনা মানুষের নিজের কর্ম্মফলেই ঘটে, এবং তাহার পরিণামে একজন বড় পুরুষের মৃত্যু হয়।”

অধ্যাপক ব্র্যাডলির মতে—সবচেয়ে বড় লক্ষণ এই যে, ঐ অপরিণাম কারণে বা দৈবকারণে ঘটে না—নায়কের নিজ কৰ্ম্মই তাহার জন্য দায়ী। কোন দুৰ্ত্তেয় অন্ধনিয়তি সে ট্র্যাজেডির নিয়ন্তা নহে। যদি সেই পুরুষ একটা অসহায় হস্তপদবদ্ধ জীব হইত—বলির পশু হইত, যদি তাহার পৌরুষের পুর্ণস্ফূর্ত্তির অবকাশ উহাতে না থাকিত, তবে দর্শকচিত্তে, দারুণ দুঃখবোধের মধ্যেও নায়কের অসাধারণ শক্তি ও তাহার বীরবীর্য্যের একটি মহিমাবোধ জাগিত না। অতএব, ঐরূপ ট্র্যাজেডির নায়ককে অতিশয় দৃঢ়কর্ম্মা এবং অসীম প্রবৃত্তিবলের অধিকারী হইতে হইবে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক মহাশয় অনেক সূক্ষ্ম বিচারও করিয়াছেন। একথাও বলিয়াছেন যে, ট্র্যাজেডিতে যে একটা ঘটনাশৃঙ্খল গড়িয়া উঠে, তাহাতে কার্যকারণের দুশ্ছেদ্য নিয়মও যেমন, তেমনি দৈব বা আকস্মিক অপ্রত্যাশিত ঘটনার যোগও আছে। তথাপি, সেই ঘটনাধারায় নায়কের চরিত্রের প্রভাব আছে; অতিশক্তিমান্ নায়কের চরিত্রেও এমন একটি রন্ধ্র থাকে—প্রধানতঃ যাহার জন্যই ঐরূপ পরিণাম অনিবাৰ্য্য হইয়া উঠে। অতএব নায়ক মুখ্যতঃ নিজেরই কার্য্যের ফলস্বরূপ ঐরূপ সর্বনাশের ভাগী হয়; এইজন্য তেমন পরিণামকে এক অন্ধনিয়তির ক্রুর অত্যাচার বলিয়া মনে করিবার কারণ নাই।

অধ্যাপক ব্র্যাডলি, অতঃপর ঐ ট্র্যাজেডির জগৎ বা মানব জীবনের ঐ ট্র্যাজেডি—রূপ আমাদের চিত্তে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত করে, তাহার মীমাংসাই বা কি, সে সম্বন্ধে অতিগভীর দার্শনিক আলোচনা করিয়াছেন। তিনি ইহাও স্বীকার করিয়াছেন যে, ট্র্যাজেডির নায়ককে যতই, “স্বকৰ্ম্মফলভুক্” বলিয়া আমরা সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করি না কেন, তথাপি, উহাতে সৎ ও অসতের দ্বন্দ্ব, এবং তাহাতে অসৎ কর্তৃক সতের ধ্বংসই আপাত-সত্য বলিয়া মনে হয়; এবং তাহার একটা বুদ্ধিসম্মত ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। অথচ তেমন ব্যাখ্যা না পাইলে শেষ পর্যন্ত ঐ অসৎ বা অমঙ্গলকেই সেই জগতের প্রভু বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু নাটকের অভিনয় শেষে আমাদের চিত্তে যে একটি অনির্ব্বচনীয় ভাবের উদ্রেক হয়—সাধারণ যুক্তিতর্কের ভাষায় যাহা বুঝানো যায় না—তাহাও ঐরূপ সিদ্ধান্তের অনুকূল নয়; আমরা ততখানি নিরাশ্বাস হইয়া পড়ি না। তাহা হইলে, ঐ শক্তি কেমন শক্তি? উহা নিশ্চয় একটা অধর্ম্ম-শক্তি নয়; কেবল, আমাদের সংস্কারে যে ধর্ম্মাধর্ম্মবোধ আছে, তাহা অপেক্ষা উচ্চতর একটা কিছু নিশ্চয়ই ঐ ট্র্যাজেডির জগৎ শাসন করিতেছে। সেই যে একটা শক্তি, তাহাতে আমাদের ঐ সৎও যেমন, তেমনই অসৎও কোন এক প্রকারে মিলিয়া আছে। এমন কথা বলিলে চলিবে না যে, ডেসডিমোনার মধ্যে যে সৎ রহিয়াছে তাহাই সেই শক্তি, আর ইয়াগোর মধ্যে যে অসৎ রহিয়াছে তাহা সেই শক্তির বহির্ভূত—তাহা ইয়াগোরই নিজের একটা পৃথক শক্তি, অতএব, ঐ অসৎ সেই বিধানের বাহিরে নয়, তাহার অন্তর্গত; সৎ ও অসতের এই দ্বন্দ্ব বা দ্বৈতকে স্বীকার করিতে হইবে। ইহাও সত্য যে, যাহা সৎ তাহা ঐ অসতের দ্বারা নিহত হয় বলিয়া আমাদের চিত্তে একটা বিরাট ব্যর্থতাবোধ জাগে।

তথাপি অধ্যাপক ব্র্যাডলির মতে ঐ ট্র্যাজেডির জগৎ অবিচার বা অধর্ম্মের জগৎ নহে—উহা ন্যায়-নীতির জগৎ। তাহা হইলে, অসৎ কর্তৃক সতের ঐ ধ্বংসসাধন—উহার ব্যাখ্যা কি? অধ্যাপক মহাশয় অনেক বিচার বিতর্কের পর শেষে স্বীকার করিয়াছেন, আমাদের সংস্কার অনুযায়ী কোনরূপ ব্যাখ্যা অসম্ভব। সৰ্ব্বশেষে তিনি হাল ছাড়িয়া দিয়া তর্কের পরিবর্তে কাব্য প্রয়োজনের দোহাই দিয়াছেন, যথা—

“But should we expect a solution? Shakespeare is not attempting to justify the ways of God to man-to show the universe as a Divine Comedy. Tragedy would not be tragedy if it were not a painful mystery.”

অর্থাৎ “ব্যাখ্যারই বা প্রয়োজন কি? শেক্সপীয়ার তো মানুষের প্রতি ভগবানের সুবিচার দেখাইবার জন্য ঐ নাটকগুলি রচনা করেন নাই—এই সৃষ্টিকে একটা ভাগবতী লীলারূপে প্রতিপন্ন করাও তাঁহার উদ্দেশ্য নয়। ট্র্যাজেডি জাতীয় নাটক যদি একটা দুঃখময় প্রহেলিকাই না হইবে—তবে উহার ট্র্যাজেডিত্ব কোথায়?”

ইহার পর তিনি ট্র্যাজেডির তত্ত্ব এইরূপ নির্দ্দেশ করিয়াছেন—

“We remain confronted with the inexplicable fact or the appearance of a world, travailing for perfection, but bringing to birth an evil, which it is able to overcome only by self-torture and self-waste. This fact or experience is Tragedy.”

অর্থাৎ “আমরা শেষ পর্য্যন্ত যে একটা দুর্বোধ্য সত্যের সম্মুখীন হই তাহা দৃশ্যতঃ এই যে—এই জগৎ যতই একটা পূর্ণতার অভিমুখে অগ্রসর হইবার আয়াস করিতেছে, ততই অমঙ্গল বৃদ্ধি পাইতেছে; সেই অমঙ্গল নিবারণের জন্য তাহাকে আত্মনিগ্রহ ও আত্মনাশ করিতে হয়।” শেষ পর্য্যন্ত অধ্যাপক ব্র্যাডলি শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির ব্যাখ্যায় এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন—

“The whole order against which the individual part is powerless, seems to be animated by a passion for perfection there is no other explanation of its behaviour towards evil.”

অর্থাৎ—”অংশতঃ বা খণ্ডভাবে সেই শক্তি অক্ষম হইলেও, ইহাই মনে হয় যে, সমগ্রভাবে তাহার অন্তরে পরমোৎকর্ষ লাভের একটা প্রবল প্রেরণা রহিয়াছে; নহিলে অসৎকে ঐরূপ প্রশ্রয় দেওয়ার অন্য কোন সদুত্তর মেলে না।”

অধ্যাপক ব্র্যাডলির পরে আরেকজন মনীষী সমালোচক শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির যে তত্ত্বটি অতি সংক্ষেপে ও অর্থ-গভীর করিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, উপরকার ঐ উক্তিটির সহিত তাহার তুলনা করা যাইতে পারে, যথা—

“The purest reality, the purest beauty, the purest love, cannot by its own nature, manifest itself on earth without disaster, but in disaster it can.” (J. Middleton Murry)

অর্থাৎ, “পরম সৎ, পরম সৌন্দর্য্য, পরম প্রেম—এ সকলের প্রকৃতিই এমন যে, কোন একরূপ সর্ব্বনাশ ব্যতিরেকে ইহারা সংসারে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে না-ঐ সর্বনাশের দ্বারাই পারে।”

আমার মনে হয়, এই উক্তি আরও যথার্থ,–এইজন্য যে, ইহাতে কোন যুক্তি বা তর্ক নাই, ইহা একটি সহজ উপলব্ধির মত।

অধ্যাপক ব্র্যাডলির মতে, ট্র্যাজেডির জগৎটা একটা ‘moral order’ বা ন্যায়—বিধানের জগৎ; তাহাতে good ও evil থাকিবেই। কিন্তু evil-এর দ্বারা good যে পরাস্ত হয়, শেষে good ও evil দুইই ধ্বংস হইয়া যায়—তিনি ইহার অর্থ করিতে পারেন নাই; সৎ ও অসতের একটা অদ্বৈত প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়াও অকৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন। আমি পরে যথাস্থানে এ সম্বন্ধে কিছু বলিব। তাঁহার আরও কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করিব—তিনি বলেন, ঐ ট্র্যাজেডির অভিনয়দর্শনে এই ভাবগুলি জাগে—(১) “নায়কের অসীম হৃদয়বল ও শৌর্য্যদর্শনে আমাদের প্রাণ যে পুলক—বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হয়, তাহাতেই সেই দারুণ দুঃখবোধ তুচ্ছ হইয়া যায়।” (২) ঐ সকল দেবপ্রতিম মানুষ-বীরের পক্ষে এই জগৎ বড়ই ক্ষুদ্র—যেন একটা কারাগার বলিয়া মনে হয়; মৃত্যুতে তাহারা মহাশূন্যে মিলাইয়া যায় না—মহামুক্তি লাভ করে; এবং (৩) এই যে সংগ্রাম—এত দুঃখ, এত নিষ্ফলতা, এ সকল মিথ্যা মায়ামাত্র, যেন একটা বিরাট দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই শেষের কথাগুলি—ঐ মায়া ও দুঃস্বপ্নের কথা লইয়াই আমাদের কথা আরম্ভ করি। শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির রস-পরিণাম যদি উহাই হয়, তবে ঐ যে ভাবাবস্থার তিনি উল্লেখ করিয়াছেন, আমাদের শাস্ত্রমতে, উহাই ‘শান্তরস’। কারণ, নাটকের অন্তর্গত ঐ প্রাণান্তিক সংগ্রাম ও ঝড়-ঝঞ্ঝার শেষে সে সকলই মায়া বা স্বপ্ন বলিয়া প্রাণ যেন গভীর আশ্বাস অনুভব করে। ঐরূপ রসসৃষ্টিই কি শেক্সপীয়ারের অভিপ্রায় ছিল? তাহা হইলে এত কাণ্ড না করিয়া, একজন সন্ন্যাসী-বৈরাগীকে নাটকের নায়ক করিয়া তিনি অতি সহজেই সেই রস সৃষ্টি করিতে পারিতেন। কিন্তু ঐ ট্র্যাজেডির নায়ক যে, সে সকল ঝড়-ঝঞ্ঝার উর্দ্ধে অবস্থিত, মহাসংযমী আত্মজয়ী পুরুষ নয়; তাহার জীবনে, ভিতরে ও বাহিরে একটা সংগ্রাম চলিতে থাকে, সেই সংগ্রামে তাহার যে শক্তির বিকাশ আমরা দেখিয়া থাকি, এবং শেষ পর্য্যন্ত জয় নয়, পরাজয়ের মধ্যেই তাহার যে অপরাজেয়তা উপলব্ধি করি, তাহাতে শুধুই শান্তরসের উদ্রেক হয় না, সেই শক্তির মহিমাও আমাদিগকে মুগ্ধ এবং উদ্দীপ্ত করে, আমরাও নায়কের মারফতে একটা আত্মগৌরব—মানবাত্মার অসীম গৌরব অনুভব করি; পপপপাল ইহাই ঐ ট্র্যাজেডির মুখ্য রসপ্রেরণা।

শ্রুতি যে বলিয়াছেন “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ”—তাহার অর্থ, আত্মাকে যখনও লাভ করা যায় নাই, ততক্ষণ ঐ বল বা শক্তির সাধনা, ততক্ষণই বলের পরীক্ষা; লাভ হইয়া গেলে সেই আত্মা নিষ্কাম ও নিস্পৃহ হইয়া, এই জীবন ও জগতের রণক্ষেত্র হইতে বাহির হইয়া যায়, তাহাকে জীবনের সহিত আর কোন সম্পর্ক করিতে হয় না। ভারতবর্ষ সেই শক্তির সাধনায়, প্রথম হইতেই রণক্ষেত্র ত্যাগ করিয়া একটা ভিন্ন পন্থায় আত্মাকে লাভ করিবার উপায় সন্ধান করিয়াছিল; য়ুরোপ এই জীবন-সমুদ্র মন্থন করিয়া, দেহমনের যতকিছু উৎপাত-উপদ্রবকে নির্ভীকভাবে বরণ করিয়া, সেই শক্তিকে আর এক পন্থায় পূর্ণ প্রবুদ্ধ করিয়া তোলে—আত্মাকে লাভ করিতে না পারিলেও জীবনকে জয় করে, পুরুষের সেই পৌরুষ-মহিমার দ্বারাই আত্মার বরমাল্য রচনা করে। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজেডিতে পুরুষের পুরুষ-আত্মার সেই জয়ঘোষণা আছে; এই দেহাধিষ্ঠিত প্রাণ-মনের যতকিছু প্রবৃত্তি ও পিপাসা, ভ্রান্তি ও মোহ, রিপুর উন্মত্ত আক্ষেপ প্রভৃতির মর্মান্তিক পীড়নে পুরুষের সেই শক্তি—তাহার সেই দুর্জয়তা-ধ্বংস ও মৃত্যুর অগ্নিশিখায় ভাস্বর হইয়া উঠে। সেই শক্তির স্ফুরণে কু বা সু বলিয়া কিছু নাই, আত্মার সেই সংগ্রাম-শক্তির পক্ষে দুইয়েরি মূল্য সমান; একমাত্র সত্য বা সৎ-পুরুষের সেই আত্মবল। শেক্সপীয়ার ঐ শক্তিকে—বলীয়ান্ আত্মার সেই বলকে—জীবনের জবানীতে, দেশকাল ও পাত্রের বিবিধসজ্জায়, নর-নারীর দেহ-মনের বিচিত্র ও অন্তরগভীর ভঙ্গিমায়, যতকিছু নির্ব্বন্ধ ও প্রতিবন্ধের জটিল জালবেষ্টনীতে রূপায়িত করিয়াছেন। শেষ পর্য্যন্ত সেই পুরুষ-আত্মার মহত্ত্ব ভিন্ন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। জীবনের অর্থ করিতে হইলে ঐ আত্মার দিকে দৃষ্টি করিতে হইবে; সেই দৃষ্টি তিনি তাঁহার নাটকগুলিতে স্বয়ম্প্রকাশ করিয়া রাখিয়াছেন, তাহা বাক্যার্থের গোচর নয়—অন্তরগোচর, তাই তাহার অর্থ করিতে গিয়া অনর্থের অন্ত নাই।

অধ্যাপক ব্র্যাডলিও অর্থ করিতে গিয়া বিপন্ন হইয়াছেন। ইহার কারণ, তিনি ঐ শক্তিকে সর্ব্বসংস্কারমুক্ত হইয়া নিরীক্ষণ করিতে পারেন নাই; সৎ-অসৎ, ন্যায়—অন্যায়ের যে অতিদৃঢ় নীতি-সংস্কার খৃষ্টান য়ুরোপের পক্ষে স্বাভাবিক, তাহা তিনি বর্জন করিতে পারেন নাই; যদি পারিতেন তাহা হইলে, ঐ সৎ ও অসৎ good and evil-এর দ্বন্দ্ব লইয়া মাথা ঘামাইতেন না; যে-শক্তি সত্ত নয়, অসৎও নয়, যাহা আমাদের ঐ সত্য ও মিথ্যাকে সমান উপহাস করিয়া, তাহারই মায়াজালে পুরুষকে জড়াইয়া, সেই জাল ছিঁড়িয়া ফেলিতে আহ্বান করিতেছে, এবং বলহীনকে বাঁধিয়া রাখিয়া বলবানকে মুক্তি দিতেছে, সেই শক্তিকে তিনি শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির রসরূপে প্রত্যক্ষ করিয়া সর্ব্বসংশয়মুক্ত হইতেন। তিনি frustration ও waste—ও যেমন স্বীকার করিয়াছেন, তেমনই moral order এবং justice কেও তাঁহার চাই। Evil এবং good-এর দ্বন্দ্বে evil জয়ী হয়, এবং শেষে দুই-ই ধ্বংস হইয়া যায়—এমন একটা তত্ত্বের সম্মুখীন হইয়াও তিনি বলিতে পারেন নাই যে, ঐ দুই—ই অসৎ, কোনটাই সত্য নয়। ঐ সৎ ও অসৎ good and evil-এর একমাত্র মূল্য এই যে, ঐ দুইটার সংঘাতে যে স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাহাতেই সেই পুরুষ—আত্মার বৈশ্বানর-রূপ পূর্ণপ্রভায় প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠে। সত্য একমাত্র সেই বলীয়ান্ আত্মা, যে সৎ-অসতের কোনটাকে গ্রাহ্য না করিয়া, উদ্দাম অন্ধপ্রবৃত্তির আগুন জ্বালাইয়া, সেই আগুনেই সকল দুর্ব্বলতা ও অশুচিতা ভস্ম করিয়া ফেলে। ম্যাকবেথের অনুশোচনাই সেই প্রবৃত্তিকে অন্ধ করিয়া তোলে; ওথেলোর প্রেম মাত্রাতিরিক্ত হইয়া বিপরীত রিপুর অনলদাহে তাহাকে জ্যোতিষ্মান করিয়াছে। হ্যামলেটে সেই শক্তি জগৎ ও জীবনের প্রতি প্রবল ধিক্কারে অন্তনিরুদ্ধ হইয়া, একটা আকস্মিক বিস্ফোরণে আত্মাকে মুক্ত করিয়া দেয়। অ্যান্টনিতে দেহাধিষ্ঠিত কামই শ্মশানচারী মহেশ্বরের মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজেডি সেই বলীয়ান্ আত্মার মহিম্নস্তব।

কিন্তু আত্মার ঐ জয়লাভ তো জীবনকে আড়াল করিয়া নয়, বরং ঐ দেহে— জীবনকে আশ্রয় করিয়াই তাহার সেই শীর্ষ এত উর্দ্ধে উঠিতে পারে। তৎসত্ত্বেও শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডিতে জীবনের দিক দিয়া একটা মহাশূন্যই অবশিষ্ট থাকে। শেক্সপীয়ারই এই জীবন ও জগতের যে অসীম সম্পশোভা—বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ—দুই জগতেরই শোভা উদ্ঘাটন করিয়াছেন, তেমন আর কোন কবি পারেন নাই;-মানবজীবনের ঊর্দ্ধ ও অধস্তল এমন করিয়া আর কেহ আমাদের দৃষ্টিগোচর করেন নাই। তথাপি ঐ ট্র্যাজেডিগুলিতে সেই জীবন শেষে একটা অলীক মায়া, একটা দুঃস্বপ্ন বলিয়া যে মনে হয়, ইহাও সত্য। তবে কি জীবনের কোন মূল্য নাই? শেক্সপীয়ার সেই প্রশ্নের কোন উত্তর দেন নাই। এইজন্য কবি-সমালোচক ম্যাথু আর্নল্ড শেক্সপীয়ারের উদ্দেশে বড় যথার্থ কথা বলিয়াছেন—

“Others abide our question-Thou art free!
We ask and ask-Thou smilest and art still,
Out-topping knowledge.”

শেক্সপীয়ার যেন সকল প্রশ্নের উত্তর আমাদের অনুভূতির উপরেই ছাড়িয়া দিয়াছেন। তিনি জীবনকে যে দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন, তাঁহার মত বিশুদ্ধ কবিদৃষ্টি আর হইতে পারে না। সেই দেখা তিনি আমাদিগকেও দেখাইয়াছেন; কিন্তু তাহার পরে কি? ততঃ কিম্? ঐ যে অসীম সম্পশোভা জীবন আমাদের সম্মুখে বিস্তার করে, উহার এমন ব্যর্থতা, এমন অন্তহীন অপচয় বিশ্ববিধানের অনুমোদিত নয় বলিয়াই একটা সংশয় জাগে। শেক্সপীয়ার যেন সেই প্রশ্নটাকে চির-উদ্যত রাখিয়াছেন—সেই প্রশ্নকাতরতা ও উত্তরের পিপাসা তাঁহার ঐ নাটকের কাব্যরসকে এমন গভীর করিয়া তোলে। এইজন্য ঐ রস আমাদের ‘ব্রহ্মাস্বাদসহোদর’ সেই রসের মত সমাধি-রস নয়; সে কাব্য জীবনের ঐ বিশাল বিরাট্ বাস্তবকেই সেই প্রশ্নের রসে, অসীম ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করিয়াছে। ঐ জীবন হইতেই তিনি এমন একটা কিছু উদ্ধৃত করিয়াছেন যাহা জীবনের গণ্ডিকে ছাড়াইয়া গেলেও, জীবনই তাহার মূল। আবার, কোন তত্ত্ব—নীতি বা ধৰ্ম্মাধর্ম্মবিচারে পক্ষপাত নাই বলিয়াই উৎকৃষ্টতম কাব্যহিসাবে উহা অতুলনীয়। ঠিক সেই কারণেই—অর্থাৎ, উহা বিশুদ্ধতম কাব্য বলিয়াই জ্ঞানী-ঋষিদের চক্ষে মূল্যহীন। ঋষি টলষ্টয় শেক্সপীয়ারের নাটককে মানুষের ধর্ম্মজীবনের পক্ষে অতিশয় অস্বাস্থ্যকর কুপথ্য বলিয়া ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন। ঋষি এমার্সনও (Emerson) শেক্সপীয়ারের কবিপ্রতিভার যৎপরোনাস্তি প্রশংসা করিয়া অবশেষে যাহা বলিয়াছেন, তাহা ঋষি-মনীষীদের না বলিয়া উপায় নাই; তিনি বলিয়াছেন—

“And now, how stands the account of man with this bard and benefactor, when in solitude, shutting our ears to the rever—berations of his fame, we seek to strike the balance?” (Representative Men)

অর্থাৎ—”মানুষের জীবনের একটা হিসাব মানুষের সুহৃদ্ এই মহাকবি কেমন দিয়াছেন? যখন তাঁহার জগৎব্যাপী প্রশংসার ধ্বনি ও প্রতিধ্বনিতে কর্ণ রুদ্ধ করিয়া আমরা নির্জনে সেই জমা-খরচের খতিয়ান করি, তখন কি দেখিতে পাই?”

“ Shakespeare, Homer, Dante, Chaucer saw the splendour of meaning that plays over the visible world……
Shakespeare rested in their beauty and never took the step which seemed inevitable to such genius, namely, to explore the virtue which resides in these symbols.”

অর্থাৎ—শেক্সপীয়ার এই জগতের উপরকার দৃশ্যগুলিই দেখিয়াছেন— সেই সাঙ্কেতিক লেখাগুলি পড়িয়াছেন মাত্র, তাহাদের গূঢ় অর্থ আবিষ্কার করেন নাই।

“As long as the question is a talent, and mental power, the world of men has not his equal to show. But when the question is to life, and its materials and its auxiliaries, how does he profit me? What does it signify?”

অর্থাৎ—”প্রতিভা ও মনীষায় মানুষের মধ্যে তিনি অদ্বিতীয়, কিন্তু যখন এই জীবনের অর্থ জানিতে চাই তখন তাঁহার এই কাব্যগুলি কোন্ কাজে লাগিবে? তাহাদের মূল্যই বা কি?”

এমার্সন এমনও বলিয়াছেন যে, শেক্সপীয়ার জগতের প্রমোদশালায় উৎসবের আয়োজনকর্তা মাত্র —“He was master of the revels to mankind”; তাঁহার ঐ কাব্যগুলির এইরূপ বিজ্ঞাপন দেওয়া যাইতে পারে—“ very superior pysotechny this evening”; অর্থাৎ “অদ্য রজনীতে অত্যুৎকৃষ্ট আতসবাজি দেখানো হইবে।”

আমি এমার্সনের উক্তি একটু সবিস্তারেই উদ্ধৃত করিলাম, তাহার কারণ, তাঁহার এই মত যেমনই হৌক—ঐ যে প্রশ্ন তিনি করিয়াছেন—তাহা বঙ্কিমচন্দ্রের সেই জীবন—জিজ্ঞাসার মত, যদিও সেই জিজ্ঞাসার উত্তর না দেওয়ার জন্য বঙ্কিম শেক্সপীয়ারকে দায়ী করেন নাই। এমার্সনের ঐ উক্তিগুলি হইতে ইহাও দেখা যাইতেছে যে, যে—কবি সেই রসব্রহ্মকে সৃষ্টির এই অনন্ত বৈচিত্র্য ও বহু রূপের মধ্যেই আস্বাদন করিয়াছেন—সর্ব্ববিধ দ্বন্দ্বের মধ্যেই সেই দ্বন্দ্বাতীতকে আমাদের অন্তরগোচর করিয়াছেন, তাঁহাকেও মানুষ এই কারণে সত্যদর্শী বলিয়া স্বীকার করে না যে, তিনি শেষ পর্য্যন্ত এই মর্ত্যজীবনকে মহিমাদান করেন নাই, বরং জীবনকে পূর্ণ—উদঘাটিত করিয়াই, তাহা যে কত অন্তঃসারশূন্য এমনই একটা ধারণা সৃষ্টি করিতে চান। কিন্তু ইহাও সত্য নয়—অৰ্দ্ধসত্য; তিনি যদি জীবনকে অতখানি নস্যাৎ করিয়া দিতেন, তাহা হইলে তাঁহার ঐ কাব্যগুলি মোহমুদ্‌গরের মতই যোগী-সন্ন্যাসীদের পাঠ্য হইয়া থাকিত। শেক্সপীয়ার মানবজীবনের কোন অর্থ করিতে না চাহিলেও, তাহার যে একটি রূপ ঐ নাটকগুলিতে উদ্ঘাটিত করিয়াছেন, তাহা শুধু চমকপ্রদ নয়—সত্য; তিনি মায়াবাদী বৈদান্তিক নহেন—প্রকৃতিবাদী তান্ত্রিক। ধরিত্রীর উপরকার শ্যামশম্পাবরণের তলে ভূগর্ভস্থ অনলপ্রবাহের মত, জীবনের মূলে তিনি প্রবৃত্তির যে ভৈরবীলীলা আবিষ্কার করিয়াছেন তাহার মত পরম-বাস্তব আর কি হইতে পারে? মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান বা কতকগুলি অভ্যস্ত সংস্কারের দ্বারা তিনি সেই বাস্তবের ব্যাখ্যা করিতে চাহেন নাই, বরং সে আপনাকে আপনিই ব্যাখ্যা করুক— ইহাই ছিল তাঁহার কবিমানসের নিশ্চিন্ত অভিলাষ। উহার পরেও যদি কোন প্রশ্ন জাগিয়া থাকে তবে সে দায়িত্ব তাঁহার নহে; সকল তত্ত্বকে নিরস্ত করিয়া সে প্রশ্নেরও সমাধান হইবে অন্তরে-শেক্সপীয়ারের নাটক ও তাহার দর্শকের মধ্যে কোন ব্যাখ্যাকার দাঁড়াইবে না; অভিনয়ই উহার একমাত্র ব্যাখ্যা। উহার সমালোচনাও উহাকে রূপময় করিয়া দেখানো; রূপকে রূপের দ্বারাই বুঝাইতে হয়। আর এক উপায় আছে—উহার ঐ রসকে আর এক পাত্রে ঢালিয়া আরেক রূপে আস্বাদন করা, বঙ্কিমচন্দ্র তাহাই করিয়াছিলেন—তাঁহার উপন্যাসগুলিতে তিনি উহা নিজের মত করিয়া আস্বাদন করিয়াছেন।

আমি অধ্যাপক ব্র্যাডলির উপরেও এই যে একটু তত্ত্বালোচনা করিলাম, ইহা আমার পক্ষে—অর্থাৎ এই নিতান্তই বাংলা-সাহিত্য-ব্যবসায়ীর পক্ষে দুঃসাহসিক, এমন কি স্পর্দ্ধাপূর্ণ হইলেও, ইংরেজীর অধ্যাপকগণ আমাকে ক্ষমা করিবেন। উপায় নাই, আমি এমনই অনাচারী যে, একদিকে সংস্কৃত কাব্যশাস্ত্রের ‘রস পণ্ডিত’ এবং অপর দিকে ‘ইঙ্গ-বঙ্গীয়’, অর্থাৎ আধাফেরঙ্গ—পণ্ডিত উভয়ের নিকটে সমান অপাংক্তেয়। কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের মত শক্তিমান্ ও উচ্চাশয় কবি যে শেক্সপীয়ারের নাটকগুলির মধ্যে তাঁহার নিজস্ব কল্পনার পুষ্টি ও পাথেয় সংগ্রহ করিবেন, তাহা কেবল ঐ ব্যক্তির পক্ষেই নয়—যুগের পক্ষেও স্বাভাবিক। আরও বড় কারণ এই যে, বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলার ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই রেনেসাঁসের অধিনায়ক—কবি ও ঋষি। সেই রেণেসাঁসের প্রধান ভাবভিত্তি ছিল—মানব—-জীবনের মহিমাবোধ; কিছুতেই, কোন আধ্যাত্মিক আদর্শকে বড় করিয়া, এই দেহজীবনের—মানুষের এই মর্ত্যলীলার গৌরব লাঘব করা যাইবে না। শ্রুতি যাহাকে মৃত্যু বলিয়াছেন—”অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীত্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্রুতে”—মরজীবনের সেই যতকিছু সঙ্কট, দুর্দশা ও লাঞ্ছনাকেই, জ্ঞানের নয়-প্রেমের-মনুষ্য—হৃদয়ের সেই অসীম পিপাসার অনুরঞ্জনে অমৃতে পরিণত করিতে হইবে; উহাই একাধারে বিদ্যা ও অবিদ্যা। কবি-বঙ্কিমের ইহাই ছিল অন্তরের অন্তরতম আকুতি। সেইজন্য তিনি জীবনের—উপরিতলের বিস্তারে নয়, গভীরতম তলদেশে সে সঙ্কট—সেই মৃত্যুর প্রকৃত রূপ সন্ধান করিয়াছিলেন। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজেডিতে তিনি সেই মৃত্যুকে বিবিধ রূপে দেখিয়াছিলেন, এবং স্বকীয় প্রতিভা ও কবিপ্রকৃতির অনুযায়ী তাহার একটা তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন। এখানে বঙ্কিমের নিজেরই যে কথাগুলি উদ্ধৃত করিতেছি, তাহাতে দুইটি বস্তুর প্রমাণ আছে—(১) বঙ্কিমচন্দ্রের কবিমানসে শেক্সপীয়ারের প্রভাব; (২) সেই শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির তিনি একটা অর্থও করিয়াছেন। কথাগুলি এই—

“এখন হইতে আমার বোধ হইতে লাগিল যে মনুষ্যমাত্রেই পতঙ্গ। সকলেরই এক একটি বহ্নি আছে— সকলেই সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরিতে চাহে, সকলেই মনে করে, সেই বহ্নিতে পুড়িয়া মরিতে তাহার অধিকার আছে—কেহ মরে, কেহ কাচে বাধিয়া ফিরিয়া আসে। জ্ঞান-বহ্নি, ধন-বহ্নি, মান-বহ্নি, রূপ-বহ্নি, ধৰ্ম্ম-বহ্নি, ইন্দ্রিয়-বহ্নি—সংসার বহ্নিময়। আবার সংসার কাচময়। যে-আলো দেখিয়া মোহিত হই—মোহিত হইয়া যাহাতে ঝাঁপ দিতে যাই—কই তাহাতো পাই না-আবার ফিরিয়া বোঁ করিয়া চলিয়া যাই—আবার আসিয়া ফিরিয়া বেড়াই। কাচ না থাকিলে, সংসার এতদিন পুড়িয়া যাইত। যদি সকল ধৰ্ম্মবিৎ চৈতন্যদেবের ন্যায় ধর্ম্মকে মানসনেত্রে দেখিতে পাইত, তবে কয়জন বাঁচিত? অনেকে জ্ঞান-বহ্নির আবরণ-কাচে ঠেকিয়া রক্ষা পায়—সক্রেতিস, গ্যালিলিও তাহাতে পুড়িয়া মরিল। রূপ-বহ্নি, ধন-বহ্নি, মান-বহ্নিতে নিত্য নিত্য সহস্ৰ পতঙ্গ পুড়িয়া মরিতেছে,—আমরা স্বচক্ষে দেখিতেছি। এই বহ্নির দাহ যাহাতে বর্ণিত হয়, তাহাকে কাব্য বলি। মহাভারতকার মান-বহ্নি সৃজন করিয়া দুর্য্যোধন-পতঙ্গকে পোড়াইলেন, জগতে অতুল্য কাব্যগ্রন্থের সৃষ্টি হইল। জ্ঞান-বহ্নিজাত দাহের গীত ‘Paradise Lost’। ধর্ম্ম-বহ্নির অদ্বিতীয় কবি, সেন্ট পল। ভোগ-বহ্নির পতঙ্গ ‘আন্টনি, ক্লিওপেট্রা’। রূপ-বহ্নির ‘রোমিও ও জুলিয়েত, ঈর্ষা-বহ্নির ‘ওথেলো’।….স্নেহ-বহ্নিতে সীতা-পতঙ্গের দাহজন্য রামায়ণের সৃষ্টি। বহ্নি কি, আমরা জানি না। রূপ, তেজ, তাপ, ক্রিয়া, গতি, এ সকল কথার অর্থ নাই। এখানে দর্শন হারি মানে, বিজ্ঞান হারি মানে। ধর্ম্মপুস্তক হারি মানে, কাব্যগ্রন্থ হারি মানে। ঈশ্বর কি, ধর্ম্ম কি, জ্ঞান কি, স্নেহ কি? তাহা কি, কিছু জানি না। তবু সেই অলৌকিক, অপরিজ্ঞাত পদার্থ বেড়িয়া বেড়িয়া ফিরি। আমরা পতঙ্গ না ত কি?” [কমলাকান্ত ]

—উপরের ঐ কথাগুলি হইতে বেশ বুঝিতে পারা যায়—বঙ্কিমচন্দ্র মনুষ্যজীবনের ঐ ট্র্যাজেডিকে পূর্ণমাত্রায় স্বীকার করিয়াছিলেন—ঐ বহ্নির আরতি তিনিও করিয়াছেন। কিন্তু তিনি ঐরূপ দগ্ধ হওয়ার মাহাত্ম্য স্বীকার করেন নাই—বরং সেই বহ্নি হইতে রক্ষা পাইবার জন্য কাচের আবরণ চাহিয়াছেন। তিনি সেই ট্র্যাজেডির রসাস্বাদ করিয়াই চরিতার্থ হইতে পারেন নাই। তার কারণ—তাঁহার সেই মর্ত্তজীবন—প্রীতি, মৃত্যুকেই জীবনের আজ্ঞাবহ করিবার আকাঙ্ক্ষা। তিনি শেক্সপীয়ারের নাটকে সেই প্রবৃত্তির—সেই বহ্নির লীলা গভীর করিয়াই দেখিয়াছিলেন, শেক্সপীয়ারের দৃষ্টিই পূরাপূরি অনুসরণ করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও নিরাশ হইতে চান নাই, ঐ মৃত্যু হইতে রক্ষা পাইবার একটা বড় উপায় আছে, এ বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই। আমরা সে প্রয়াস দেখিয়াছি। বঙ্কিমচন্দ্র ঐ প্রবৃত্তি ও তাহার পরিণাম কোনটাকে ছোট করেন নাই—বরং পুরুষ-জীবনের সেই শোকাবহ নিষ্ফলতাই তাঁহার কবিজীবনকে অভিভূত করিয়াছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র ঐ প্রবৃত্তিজীবনেরও মূল সন্ধান করিয়াছিলেন—একেবারে সৃষ্টির আদি—রহস্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়াছিলেন। প্রবৃত্তিময় জীবনের দ্বন্দ্বকে তিনিও বড় করিয়া দেখিয়াছেন, কিন্তু আরও গভীরে। উহা সেই প্রবৃত্তি, যাহার মত প্রবল ও সর্ব্বগ্রাসী, পুরুষের জীবনে—মহদাশয় পুরুষের জীবনেও আর কিছু হইতে পারে না; সৃষ্টির আদি-প্রবৃত্তিও তাহাই। তিনি সেই কামপ্রেমের দ্বন্দ্বকেই দেহ-আত্মার দ্বন্দ্বরূপে, মানুষের প্রবৃত্তিজীবনে সর্ব্বোচ্চ স্থান দিয়াছেন, এবং উহাতেই যে জয়লাভ, তাহাকে, অর্থাৎ প্রেমকেই মৃত্যুর একমাত্র পরম ঔষধ বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস করিয়াছিলেন। এ প্রেম জীবনেরই দান, অতএব জীবন মূল্যহীন নহে। আর সকল প্রবৃত্তিই রিপুমাত্র; কিন্তু এই যে প্রবৃত্তি, ইহাতে আত্মার সহিত দেহের দ্বন্দ্ব প্রথম হইতেই বিদ্যমান থাকে—কোথাও সজ্ঞানে, কোথাও অজ্ঞানে। এক ‘ম্যাকবেথ’ ছাড়া শেক্সপীয়ারের সকল বড় ট্র্যাজেডিতেই ঐ আত্মার পিপাসা—ঐ প্রেমই কতরূপে, কত অবস্থায় বিকারপ্রাপ্ত হইয়া সর্ব্বনাশের হেতু হইয়াছে। সর্বত্র তাহা সমান প্রাধান্য লাভ করে নাই বটে—কোন একটা অপর প্রবৃত্তির বেগ প্রবল হইয়াছে, কিন্তু আরও গভীরে উহাই প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। ‘হ্যামলেটে’ এই প্রেম অন্তর-রুদ্ধ; ‘ওথেলো’য় মুগ্ধ, আত্ম-বিড়ম্বিত; ‘আণ্টনি’তে আত্মঘাতী; ‘লীয়রে’ উহাই রূপান্তরিত।

ঐ এক প্রবৃত্তিকে বড় করিবার আরও কারণ—তিনি যেমন পুরুষকেই সেই আত্মিক পিপাসায় কাতর করিয়া ট্র্যাজেডির দ্বন্দ্বকে বাহির হইতে আরও ভিতরে লইয়াছিলেন, তেমনই শুধুই পুরুষের শক্তি নয়—তাহার সহিত নারীর শক্তিকেও জীবনে একটা বড় স্থান দিয়াছিলেন। ঐ দৃষ্টি আমাদের দেশেই সম্ভব। পুরুষের অন্ধপ্রবৃত্তির বেগ আমাদের জীবনে ঐ নারীর দ্বারাই অনেক পরিমাণে দমিত ও প্রশমিত হয়; তাহার মোহিনী কামিনী-মূর্ত্তিও যেমন পুরুষের সেই আদি-প্রবৃত্তির ইন্ধন, তেমনই তাহার যে সর্বংসহা স্নেহময়ী, কল্যাণী মূর্ত্তি, তাহাও পুরুষের প্রমত্ততাকে শান্ত ও প্রকৃতিস্থ করে। তেমন মূর্ত্তি য়ুরোপের উন্মদা-প্রকৃতির লীলায় সাধারণতঃ সুগোচর হইয়া উঠে না। অতএব, বঙ্কিমচন্দ্র শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির সেই কাঠামোখানা, সেই বাস্তব-গভীর প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব ও তাহার পরিণাম, এবং এক দুয়ে নিয়তির দুর্লঙ্ঘ্য শাসন—এই কয়টিকে আশ্রয় করিয়া যে নূতনতর ট্র্যাজেডি রচনা করিলেন, তাহার মূল লক্ষণ হইতেছে এই দুইটি : প্রথম, পুরুষের অন্ধপ্ৰবৃত্তি নয়, অতিশয় আত্মসচেতন—এবং সেই কারণেই আরও দুর্ব্বল, আরও অসহায় সে কাম—প্রেমের দ্বন্দ্ব। আর সকল প্রবৃত্তির উপরে তিনি যে ঐ কাম-প্রেমের প্রবৃত্তিকে মুখ্য করিয়াছেন, তাহাতে জীব-জীবনের সেই মূল নিয়তিকে যেমন বরণ করা হইয়াছে, তেমনই, জীবনকে, শেক্সপীয়ারের মত, একটা আত্মজ্ঞানহীন দুর্ব্বার প্রবৃত্তি—লীলার দুর্ভেদ্য রহস্যরূপে উপস্থাপিত করা হয় নাই; শুধুই প্রকৃতি-পারবশ্য নয়, পুরুষের সচেতন আত্মানুভূতিও তাহাতে আছে। দ্বিতীয়তঃ, তিনি সেই শক্তির লীলায় নারীকে একটা বড় অংশের অধিকারিণী করিয়াছেন, তাই তাঁহার ট্র্যাজেডিতে নায়কের যে পরিণাম সংঘটিত হইয়াছে, তাহা কেবল নায়কের কর্ম্মফলই নহে, তাহাতে নায়কের কর্তৃত্বাভিমানই প্রবল হইতে পারে নাই। অতঃপর বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস-ট্র্যাজেডিতে অধ্যাপক ব্র্যাডলি-ধৃত সেই শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা প্রয়োগ করিয়া দেখিব।

এই সংজ্ঞা অনুযায়ী এখানেও একটা শোকাবহ পরিণাম আছে, এবং তেমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না। সেই পরিণাম নায়কেরই পরিণাম—বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেও তাহাই। নায়ক একজন উচ্চস্থানীয় ব্যক্তি হইবে; বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়ক রাজা, রাজপুত্র বা খুব বড় ইতিহাস—প্রথিত বীর না হইলেও সকলেই সাধারণ হইতে উচ্চস্তরের পুরুষ। তারপর, ঐ নায়কের মৃত্যু হওয়া চাই। বঙ্কিমচন্দ্রের ট্র্যাজেডি-কল্পনায় ঐরূপ মৃত্যু অত্যাবশ্যক নয়, এইখানে কল্পনার একটা মূলগত পার্থক্য আছে, পরে তাহা দেখিব। অধ্যাপক ব্র্যাডলি আরও একটি বিশেষ লক্ষণ উহাতে যোগ করিয়াছেন—সেই পরিণামের যে ঘটনা-শৃঙ্খল, তাহা মুখ্যতঃ নায়কেরই শক্তি ও অশক্তির দ্বারা গঠিত হয়, অর্থাৎ কোন দৈব বা নিয়তির দাস সে নহে। এইখানেই সবচেয়ে বড় পার্থক্য; বোধ হয় এই একটি কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ও শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডি অতিশয় স্বতন্ত্র। কিন্তু শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির এই যে কয়েকটি লক্ষণের উপরে জোর দেওয়া হইয়াছে, ইহা দ্বারা ঐ ট্র্যাজেডিগুলিকে একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করিয়া বিচার করা হইয়াছে। সেইরূপ বিচারের সাহিত্যিক প্রয়োজন যেমনই থাকুক, তাহাতে শেক্সপীয়ারের কবিকল্পনাকে গণ্ডিবদ্ধ করা হয়। কারণ, যদি তাহাই হয়, তবে শেক্সপীয়ারের দৃষ্টি ব্যাপকভাবে মানবজীবনের উপরে প্রসারিত হয় নাই, তিনি এক শ্রেণীর ট্র্যাজেডিমাত্র রচনা করিয়াছেন, জীবনকে সেই ট্র্যাজেডির গণ্ডিমধ্যে দেখিয়াছেন। একটা ছাঁচ বা আদর্শ তাঁহার মনে নিশ্চয় ছিল, কিন্তু সেই ছাঁচের মধ্যেই কি তাঁহার মুক্ত স্বাধীন কবি-দৃষ্টি জীবনকে ব্যাপক ও পূর্ণতররূপে দেখে নাই? যে কৰ্ম্ম মানুষ স্বেচ্ছায় করে তাহাই কি শেষে তাহার একটা বন্ধন হইয়া দাঁড়ায় না?—তাহার সেই কর্তৃত্বের প্রতিবন্ধক হইয়া সেই কৰ্ম্মই তাহার একরূপ নিয়তি হইয়া উঠে না? একজন প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখিকাও লিখিয়াছেন—

“Our deeds are like children that are born to us; they live and act apart from our own will; nay, children may be strangled, but deeds never.” (George Eliot : Romola)

অর্থাৎ—”সন্তান যেমন পিতামাতা হইতে স্বতন্ত্র জীবন যাপন করে, তাহাদের বশ্যতা স্বীকার করে না, আমাদের স্বকৃত কর্মগুলোও সেইরূপ; একবার করিয়া ফেলিলে তাহার উপরে আর কোন কর্তৃত্ব থাকে না। সন্তানকে যদি বা শিশুঅবস্থায় হত্যা করা যায়—কর্ম্মকে হত্যা করিবে কে?” আমাদের ঋষিরাও বলেন, “গহনা, কৰ্ম্মণো গতিঃ।” অতএব শক্তিমান্ পুরুষের জীবনেও স্বকর্তৃত্বের অধিকার সীমাবদ্ধ। ঐ কৃতকর্ম্মগুলোর যে বন্ধন তাহাও একপ্রকার destiny বা অদৃষ্ট। শেক্সপীয়ারের মত কবি যে তাহাকে কোথাও অস্বীকার করিবেন—এমন হইতে পারে না। তাঁহার নাটকগুলি পড়িলে কি মনে হয় না যে, নায়কের সেই পুরুষকার যত বড়ই হউক, তাহার ভিতরেও যেমন, বাহিরেও তেমনই, নিষ্ফলতার বীজ উপ্ত হইয়া আছে? নিয়তি, দৈব ও কৃতকর্ম্মগুলার নিজস্ব স্বাধীন গতি—এ সকলই সেই পরিণামের নিয়ামক নহে কি? বরং এতগুলা মিলিয়াই তো সেই পরিণামকে আরও ভয়াবহ করিয়া তোলে। এতগুলা কারণের মিলিত ফল যাহা, পুরুষের আত্মবল যে তাহারও অধিক—ইহাই তো তাহার গৌরব; ইহাই তো শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির আধ্যাত্মিক সঙ্কেত।

কিন্তু য়ুরোপীয় জীবনে ঐ প্রবল প্রবৃত্তিমূলক পুরুষকার এতই প্রত্যক্ষ—শেক্সপীয়ারের নাটকেও তাহাই হইয়াছে— যে, সেই কারণেই morality বা সু ও কু-এর সংস্কার সেখানকার চিন্তায় একরূপ বলিলেই হয়; তাই অধ্যাপক ব্রাডলি শেক্সপীয়ারের সেই সর্ব্বসংস্কারমুক্ত কল্পনার একটা ‘moral’ অর্থ না করিয়া সুস্থ হইতে পারেন নাই। ঐ যে নায়ক তাহার স্বকর্ম্মেরই ফলভোগ করে, তাহার ভাগ্যের অধিপতি সে নিজেই—সে নিজের শাস্তি নিজেই বহন করে, তাহাতেই পুরুষের দুর্জয় আত্মাভিমানের মর্য্যাদা রক্ষা হয়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র অন্যরূপ বুঝিয়াছিলেন, তিনি ঐরূপ moral নয়—spiritual বা গভীরতর আত্মিক সিদ্ধিলাভকেই পুরুষের গৌরব বলিয়া বুঝিয়াছিলেন। তাই তিনি তাঁহার উপন্যাসগুলিতে, নায়ক-পুরুষকে ঐ একটি সঙ্কটে, অর্থাৎ—অপরা শক্তি যে নারী, তাহার সহিত আত্মিক কাম-প্রেমের দ্বন্দ্বে, চরিত্রগত ও অবস্থাগত বিভিন্ন সংস্থানে স্থাপিত করিয়া, এক নূতনতর ট্র্যাজেডি রচনা করিলেন। সেই ট্র্যাজেডি দুই কারণে শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডি হইতে স্বতন্ত্র : প্রথম, শেক্সপীয়ার বঙ্কিমচন্দ্রের মত কোন জিজ্ঞাসা বা সমস্যার চিন্তা করেন নাই; তাই তাঁহার কাব্য সৃষ্টিকাব্যের মতই সীমাহীন রহস্যের আধার হইয়া আছে। দ্বিতীয়তঃ, ঐ একই কারণে, বঙ্কিমচন্দ্র শেক্সপীয়ারের মত নির্লিপ্ত থাকিতে পারেন নাই,—তাঁহার উপন্যাসগুলিতে নায়কজীবনের যে ট্র্যাজেডি আছে তাহার সহিত নিজের ব্যক্তিহৃদয়ের উৎকণ্ঠাও যুক্ত হইয়াছে; আমি সেই উপন্যাসগুলিতে তাঁহার কবিমানসের অভিব্যক্তির যে ধারা নির্দ্দেশ করিয়াছি, তাহা এই কারণেই সম্ভব হইয়াছে। এই দুই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে শেক্সপীরীয় নাটকের মত অত্যুৎকৃষ্ট নাটকীয় কল্পনার অবকাশ ঘটে নাই।

অতঃপর আমি বঙ্কিমচন্দ্রের একখানিমাত্র উপন্যাস হইতে বঙ্কিমী ট্র্যাজেডির স্বরূপ সন্ধান করিব।

“বিষবৃক্ষে’র নায়ক নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে নাই; কিন্তু তাই বলিয়া ‘বিষবৃক্ষ’ কি বঙ্কিমী আদর্শের একখানি উৎকৃষ্ট ট্র্যাজেডি নয়? শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির অধ্যাপক ব্র্যাডলি ধৃত সংজ্ঞা অনুসারে উহা সত্যকার ট্র্যাজেডি নয়, কারণ, উহার নায়ক যে অতবড় আত্ম-পরাজয় বা দুষ্কৃতি-চেতনার পরেও বাঁচিয়া থাকিতে পারিল, তাহাতে প্রমাণ হইতেছে, যে, উহার সেই ট্র্যাজেডি-সম্মত চরিত্রমহিমা নাই; সে যেন সংসারে সহিত—সেই দুর্ভাগ্য-শক্তির সহিত সন্ধি করিয়া তাহার ঐ ঘৃণ্যতম পরাজয়কে মানিয়া লইল। কিন্তু এমন কথাও বলা যাইতে পারে যে, মৃত্যু-বরণই পুরুষ আত্মার একমাত্র গৌরব নয়—তাহাতে পুরুষের যে জয়লাভ হয় তাহাই আত্মার নিঃশ্রেয়স নয়—অন্য গৌরবও আছে, প্রেমের নিকটে আত্মসমর্পণের গৌরব। ‘বিষবৃক্ষে’র যে ট্র্যাজেডি তাহাতে শেক্সপীরীয় লক্ষণও যেমন আছে, তেমনি সেই ট্র্যাজেডির বিষ-বিসর্পের অতিসান্নিধ্যে কবি একটি অমৃত-বর্তিকাও স্থাপন করিয়াছেন—সূর্য্যমুখীর পতিপ্রেম; সেই অমৃতই নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু-নিবারণ করিল। কাহিনীর ঐ ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে কবি—বঙ্কিম মানব-মানবীর হৃদয়-সাগর মন্থন করিয়া, দারুণ বিষ ও শীতল অমৃত দুই-ই প্রবাহিত করিয়াছেন; তাহাতে আর কিছু না হৌক, মানুষের জীবন-সত্যকে একটা পূর্ণতর রূপে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। অথচ ট্র্যাজেডির ভীষণতা তাহাতে কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই, বরং আরও দীপ্তোজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। পাঠান্তে, একদিকে কুন্দ ও হীরা, এবং অপরদিকে সূর্য্যমুখী ও নগেন্দ্রনাথ, এই দুইয়ের কোনপক্ষের পরিণাম কম শোচনীয় বলিয়া মনে হয় না। একদিকে হীরার প্রবল প্রবৃত্তিবেগ, নারী-হৃদয়ের সেই বিপ্লবাগ্নি, অপরদিকে আর দুই নর—নারীর—উভয়েরই ক্ষণিক আত্মভ্রষ্টতা, এই দুইয়ের মধ্যে পড়িয়া, এক অতি নিরপরাধ, অতিসরল, কুসুমকোমল মানব-দুহিতার যে হৃদয়ভেদী পরিণাম তাহার মত সৰ্ব্বাঙ্গসম্পন্ন ট্র্যাজেডি আর কি হইতে পারে? শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির তুলনায়, এই উপন্যাসের অতিসামান্য—নিতান্তই এক ক্ষুদ্র পরিবেশে, আমরা যে ঘটনা—চরিত্র ও নিয়তিজটিল কাহিনীজাল রচিত হইতে দেখি, তাহাতে সেই শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডি-রস মাত্রাভেদে নিশ্চয় আছে, উপরন্তু আরও কিছু আছে; উভয়ে মিলিয়া এমন একটি রসের সৃষ্টি হইয়াছে যাহাকে সম্পূর্ণ অভিনব বলা যাইতে পারে। ‘বিষবৃক্ষে’র বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, তথাপি, এই কয়টি কথা বলিতে হইল, তাহার কারণ, অধ্যাপক ব্রাডলির সংজ্ঞা অনুসারে উহা যে খাঁটি ট্র্যাজেডি—অন্ততঃ শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডি হয় নাই, ইহা মানিতে হইবে; নায়ক নগেন্দ্রনাথের চরিত্র যে কত দুর্বল তাহা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি। নগেন্দ্ৰনাথ বাঁচিয়া গেল—মরিল কুন্দ; তথাপি নগেন্দ্র স্বকর্ম্মের ফলভোগ করিল না। কিন্তু তাই বলিয়া ‘বিষবৃক্ষে’র ট্র্যাজেডি যে ক্ষুণ্ণ হইয়াছে তাহাও নহে। বরং ইহাই দেখি যে, ঐরূপ মৃত্যুই পুরুষের একমাত্র শোকাবহ পরিণাম নয়। বিষবৃক্ষ-উপন্যাসে— “স্বকৰ্ম্মফলভুক পুমান্’ এই বাক্যও যেমন আর একটা অর্থে সত্য হইয়াছে, তেমনই, দৈব ও ঘটনার দুশ্ছেদ্য কার্য্য-কারণ-শৃঙ্খলও সেই ট্র্যাজেডিকে গড়িয়া তুলিয়াছে। আরও একটা বড় প্রভেদ আছে। এই ট্র্যাজেডিতে পুরুষের পৌরুষ-মহিমার পরিবর্তে নারীর প্রেমশক্তির গৌরব-ঘোষণা আছে। সেই শক্তির কাছে পুরুষের পরাজয় তাহার আত্মাভিমানের পক্ষে লজ্জাকর বটে, কিন্তু তাহার গভীরতর আত্মচেতনায় সেই প্রেমের নিকটে পরাজয় স্বীকারই কি মর্ত্তজীবনের নিঃশ্রেয়স নয়? উহাই সেই শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির নিরন্ধ্র অন্ধকারে অকটু আলোকের আশ্বাস। এই নারী-প্রেমের অমৃত-রশ্মি শেক্সপীয়ারের নাটকেও আছে—সেখানেও কর্ডেলিয়া, ডেসডিমোনা আছে, কিন্তু পুরুষের দুরন্ত প্রবৃত্তির ঝটিকান্ধকার তাহাকে–হয় নিৰ্ব্বাপিত, নয় ম্লান করিয়া দিয়াছে। এতএব বঙ্কিমচন্দ্র শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির এক প্রান্তে এই যে একটি পাড় বুনিয়া দিয়াছেন, তাহাতে অধ্যাপক ব্র্যাডলি-কৃত সমালোচনা অপেক্ষা, সেই ট্র্যাজেডির অধিকতর মর্ম্মগ্রাহিতা প্রকাশ পাইয়াছে।

আমি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির একটা পরিচয় শেষ করিলাম; এই উপলক্ষ্যে ইহার অধিক বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নাই। ইহাতে কবি বঙ্কিমের কাব্যকল্পনা ও কাব্যগুলির সাক্ষাৎ পরিচয়ের পরিবর্তে আমি আমারই বিদ্যা, বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়াছি; বঙ্কিমকে আমি যে সম্পূর্ণ ও অভ্রান্তভাবে বুঝিয়াছি, এমন কথা বলিবার স্পর্দ্ধা আমার নাই। আমি জানি, আমার এই সমালোচনা শাস্ত্রমত সম্পূর্ণ হইল না–উপন্যাসগুলির গঠন, তাহাদের নিৰ্ম্মাণকৌশল, বঙ্কিমী উপন্যাসের কয়েকটি বিশেষ ভাবগ্রন্থি প্রভৃতি অনেক কিছুই আলোচিত হইল না। কিন্তু আমি একটি বিশেষ দিক হইতে এই আলোচনা করিয়াছি—কবি-মানসের দিক। সেই দিকটির আলোচনা এখানে এই পর্য্যন্ত করিলাম। অপর দিকগুলি—যদি ইতিমধ্যে মেয়াদ না ফুরায়-একখানি গ্রন্থে* সবিস্তারে আলোচনা করিবার ইচ্ছা আছে; উপস্থিত ইহাই আপনাদের নিকটে আমার কৈফিয়ৎ। সৰ্ব্বশেষে সাধারণভাবে কবি-বঙ্কিম সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলিয়া এই আলোচনা শেষ করিব।

[* লেখকের ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য]

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ট্র্যাজেডির কাব্যরস যেমনই হউক, তাহাতেও সেই চিরন্তন সত্যই সকল বহিরাবরণ ভেদ করিয়া উদ্ভাসিত হইয়াছে—পুরুষ আত্মার জয় বা পরাজয় কোনটাই জীবনের শেষ কথা নয়; সেই সংগ্রামও সত্য নয়, সকলই শেষ পৰ্য্যন্ত একটা মায়া বা দুঃস্বপ্ন বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু একটা বস্তু সেই মিথ্যা—সেই মায়াকে—জীবনের ঐ প্রহেলিকাকেও অর্থপূর্ণ করিয়াছে—তাহা প্রেম; সেই প্রেমের বিকার বা বিমূঢ়তাই সকল ব্যর্থতার নিদান। এই বাণীই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে নিরাশা ও সংশয়ের অন্ধকার ভেদ করিয়া মেঘান্তরালচ্যুত সূর্য্যরশ্মির মত, নানা ছন্দে ও নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। অতএব, শ্রেষ্ঠ কবিকর্ম্মের যে লক্ষণ একজন মনীষী-ইংরেজ-সমালোচক নির্দ্দেশ করিয়াছেন—বঙ্কিমচন্দ্রের কাব্যগুলির নামে তাহা দাবী অসঙ্গত হইবে না; যথা—

“The supreme artist is not he who reproduces the common place and the trivial, but he who gives bodily forms to the noblest capacities of man, to ‘the thought which wanders through eternity’, to the will which breaks the way through every obstacle to the love that triumphs over death.’

(C. E. Vaughan: Types of Tragic Drama, pp. 9-10)

বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁহার উপন্যাস-কাব্যে, শুধুই পুরুষ নয়—পুরুষ ও নারীর যুগ্মজীবনে ঐ প্রেমের দুরূহ তপস্যাকে, এবং তাহা হইতেই— ‘the thought that wanders through eternity’—সেই ভাববস্তুকে শরীরী করিয়া তুলিয়াছেন, অর্থাৎ, জীবনেরই জবানীতে, মানুষের দেহাধিষ্ঠিত প্রাণ-মনের সলিলমরুৎ ও মৃত্তিকায় তাহার প্রতিমা গড়িয়াছেন। এইজন্যই তাঁহার উপন্যাস রোমান্সও নয়, নভেলও নয়; তাহা উপন্যাসের আকারে শেক্সপীরীয় আদর্শের নাটক। আবার তাঁহার ট্র্যাজেডি-কল্পনায়, নর-নারীর চরিত্রসৃষ্টিতে অন্তর্যামীর মত যে কবিদৃষ্টির পরিচয় আছে, সে দৃষ্টি একাধারে বস্তুভেদী ও তত্ত্বসন্ধানী। জীবনের সেই বাস্তবকেই—মানুষের পশুজীবনের বাস্তবকে নয়—মহৎ জীবনের বাস্তবকে—এমন গভীর করিয়া দেখা, আমাদের সাহিত্যে শুধুই বিরল নয়, একরূপ অভাবনীয় বলিলেই হয়, তার কারণ, এ সাহিত্য গানের সাহিত্য—সর্ব্বত্র ভাবরস-বিগলিত; জীবন-জিজ্ঞাসা নয়, জীবন—বিস্মৃতিই ইহার পরমার্থ। এ জাতির পক্ষে জীবনের তরঙ্গমুখর খরস্রোতে ঝাঁপ দিয়া তাহার আদি-অন্ত-নিরূপণ নিতান্তই নিরর্থক। জ্যোৎস্নাকাশতলে নিস্তরঙ্গ নদীবক্ষে তরী-বাওয়া, বুক-জলে দাঁড়াইয়া জলকেলি করা, অথবা কূলে বসিয়া বৃন্দাবনী আবেশে বংশীবাদন——ইহার অধিক তাহার সহ্য হয় না; কীৰ্ত্তি নয়—কীৰ্ত্তনই তাহার প্রাণের আরাম। এহেন জাতির সাহিত্যিক প্রতিভা কেমন হওয়া স্বাভাবিক তাহা সহজেই অনুমেয়। বাংলার মাটিতে ঐ একটিমাত্র সাহিত্যিক দেওদার-বৃক্ষ জন্মিয়াছিল,—তাল আছে, তমালও আছে, কিন্তু পার্ব্বত্য মহীরুহ ঐ একটিই। ঐরূপ পুরুষ-প্রতিভা বাংলাসাহিত্যে আর উদয় হয় নাই—তাই বিমূঢ়তা স্বাভাবিক; কিন্তু সেই বিমূঢ়তাই যদি পাণ্ডিত্যের লক্ষণ হয়, তবে তেমন পাণ্ডিত্যের সম্মানরক্ষার জন্য বঙ্কিম-প্রতিভাকে ছোট হইতেই হইবে, কারণ সেই সকল পণ্ডিত উদ্বাহু হইলেও বঙ্কিমচন্দ্রের উন্নত স্কন্ধের নাগাল পাইবে না।

এই বক্তৃতায় আমি উপন্যাসগুলির যে পরিচয় দিয়াছি, তাহা নানা কারণে সুবিস্তারিত ও সুবিচারিত হইতে পারে নাই, তাহা বলিয়াছি; যে সকল তত্ত্বের উত্থাপন করিয়াছি তাহার পূর্ণতর ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল, এবং উপন্যাসগুলি হইতে তাহার সাক্ষাৎ প্রমাণ আরও অধিক উদ্ধৃত করিলে ভালো হইত; আরও অনেক ত্রুটি ইহাতে আছে। তথাপি আমি ঐ উপন্যাসগুলি হইতে যে-একটা জগৎ আপনাদের চিত্তে প্রতিভাত করিবার উদ্যম করিয়াছি, তাহার মত কিছু বাংলাসাহিত্যে আর কোথাও নাই—ইহা সাহিত্য-রসিক সজ্জনমাত্রেই স্বীকার করিবেন। ঐ জগতে আমাদের চিত্ত একটা উচ্চভূমিতে বিচরণ করে, এবং জীবনের এমন এক রহস্য—গভীর এবং অ-পূর্ব্ব-অনুভূত, অথচ প্রাণ-মনের গূঢ়তম উৎকণ্ঠা-সঞ্চারী রূপের সম্মুখীন হয়, যাহার মত এ সাহিত্যে আর কোথাও নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ নাটকীয় কল্পনাকে আমি যে শেক্সপীরীয় ট্র্যাজেডির সহিত তুলনা করিয়াছি, তাহা যদি কোন অংশে যথার্থ হইয়া থাকে, তবে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে, এতবড় মৰ্যাদা বাংলাসাহিত্যে আর কোন কাব্য দাবী করিতে পারে না। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে ও শেক্সপীয়ারের নাটকে তারতম্য অল্প নহে, আমি তাহা বার বার স্বীকার করিয়াছি; তবু ঐ যে তুলনা সম্ভব হইয়াছে, তাহাতে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের সমালোচনাও যে স্তরে উঠিতে পারে—সেইগুলিকে অবলম্বন করিয়া, জীবন ও কাব্যের মধ্যে যে ধরণের অন্তরঙ্গযোগ আবিষ্কার করা যায়,—এক কথায়, কাব্য জিজ্ঞাসাকে যেরূপ জীবন-জিজ্ঞাসায় পরিণত করা যায়—সমালোচনার সেই অবকাশ বাংলায় ঐ বঙ্কিম—সাহিত্যেই আছে। আমি তাহারই একটু আভাস দিলাম।

উপসংহারে, একদা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলির যে কাব্যপরিচয় আমি একটি কবিতায় লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম, তাহাই আপনাদিগকে শুনাইয়া এই আলোচনা শেষ করিব। কবিতাটি এই—

বঙ্কিমচন্দ্ৰ

বাঁশী আর বাজিল না কতকাল অজয়ের কূলে!
কীৰ্ত্তনের সুরে শুধু ভরি’ উঠে আকাশ বাতাস
বাঙ্গালার—সব গানে প্রেমেরি সে দীর্ঘ হাহাশ্বাস
নদীয়ার নদীপথে মর্ম্মরিল বঞ্জুল মঞ্জুলে!
রুটি। ওক ত্যজিয়া তমালতল রাধা জ্বালে তুলসীর মূলে
নানা প্রাণের আরতি-দীপ; আঁখির সে বিলোল বিলাসী
ভুলিয়াছে—কাঁদে, আর হরিনাম জপে বারো মাস;
কল্পবৃক্ষে ফোটে প্রেম, ফোটে না সে মনের মুকুলে!
এমনি সে সারা বঙ্গ অঙ্গে পরি’ হরিনামাবলী
বাদল-বসন্ত-নিশি গোঙাইল উদাসীন সুখে!
রাখালের বেণুরবে গোঠে-মাঠে কাননে-কান্তারে
ধ্বনিল যে মধু-গীতি, তাহারি সে সরস ঝঙ্কারে
কৃচিৎ উন্মনা কেহ—ঘটে বারি উঠিল উছলি’,
গাঁথিতে পূজার মালা কোন্ ব্যথা গুমরিল বুকে!

মুক্তবেণী জাহ্নবীর ক্রমে লুপ্ত হ’ল সরস্বতী
শাস্ত্র-বালুকার বাঁধে, মন্ত্রে-তন্ত্রে শুকাইল শেষে
প্রাণের সে প্রীতি সহজিয়া; এমন মাটির দেশে
জীবনের ছাঁচে কেহ গড়িল না প্রেমের মূরতি!
মাতা পুত্র পিতা আছে, আছে পতি, আর আছে সতী—
দম্পতী নাহিক কোথা! নারী শুধু সহচরী-বেশে
পতির চিতায় ওঠে বৈকুণ্ঠের সুদূর উদ্দেশে!
পুরুষ স্বামীই শুধু—নাহি তার প্রেমে অধোগতি।
সন্ধ্যা হ’লে শঙ্খ বাজে গৃহে গৃহে মন্দিরে মন্দিরে,
ঘাট হ’তে ঘরে ফিরে’ দীপ জ্বালে ত্বরায় বধূরা;
একে একে উঠে আসে তারকারা আকাশের তীরে,
সমীরণ শ্বসে মৃদু, ফুলগন্ধে রজনী মধুরা।
নিদ্রার নিশীথ-স্বপ্নে জেগে ওঠে বিরহ-বিধুরা
জীয়াইতে মৃত-প্রেম, তনু তার বীজনিয়া ধীরে!

এমনি কাটিল যুগ; যুগান্তের নিশা-অবসানে
দিদি দখিনা পবন সাথে ভাগীরথী বহিল উজান—
দুয়ারে দাঁড়াল সিন্ধু, তার সেই আকুল আহ্বান
স্বপনেরে ছিন্ন করি’ কি বারতা বিতরিল প্রাণে!
উছসি উঠিল ঢেউ বাঁধা ঘাটে সোপান-পাষাণে,
কূল সে অকূল হ’ল, পিপাসার নাহি পরিমাণ!
আকাশ আসিল নামি’—অন্তরীক্ষে কারা গায় গান!
দেবতা কহিল কথা চুপি চুপি মানুষের কানে!
স্বপনে ছিল না যাহা ধরা দিল তাই জাগরণে—
পুরুষের চোখে রূপ—হর-চক্ষে উমা হৈমবতী!
সে নহে কিশোরী বালা, শ্যাম-শোভা নবীনা ব্রততী—
ননুজ্ঞাবদনী রাধা যমুনায় গাগরি-ভরণে।
সে রূপের ধ্যান লাগি’ যোগী করে শ্মশানে বসতি—
পান করে কালকুট মহাসুখে, ডরে না মরণে!

সতত স্বাধ্যায়শীল আত্মভোলা গৃহী-ব্রহ্মচারী
“পুঁথি হ’তে চোখ তুলি’ একদা সে নিজ নারী-মুখে
নেহারি’ কিসের ছায়া জলাঞ্জলি দিল সব সুখে,
ক্ষুধায় আকুল হ’ল—প্রাণ যার ছিল নিরাহারী!
গৃহ যার স্বর্গ ছিল সেও সাজে পথের ভিখারী—
মজিল শেফালী ফেলি’ রাগরক্ত রূপের কিংশুকে,
মন্দারের মালা ছিঁড়ি আশীবিষ তুলি’ নিল বুকে—
যত জ্বালা তত সুখ, তত ঝরে নয়নের বারি!
সর্ব্বত্যাগী বীর-যুবা আত্মজয়ে করি’ প্রাণ পণ
সকল সাধনা তার বলি দিবে নারী-পদমূলে-—
মৃত্যুর অনলে শেষে সেই দাহ করিল নির্ব্বাণ!
নিজেরি সে পত্নী, তবু আজ দূর দেবীর সমান!
কিছুতে দিবে না ধরা, পতি-প্রেম গিয়াছে সে ভুলে—
তারি লাগি’ রাজা রাজ্য ঘুচাইল, সর্ব্বস্ব আপন!

বাল্য-প্রণয়ের সুধা বিষ হ’ল নবীন যৌবনে!
সাঁতারি অগাধ জলে দোঁহে মিলি’ করিল উপায়—
নির্ভয়ে ডুবিল যুবা, আর জন দেখে ভয় পায়;
পুরুষ মরিল, নারী ফিরে চলে পতির ভবনে!
শিবিরে নামিছে সন্ধ্যা-অন্ধকার মনে ও ভুবনে,
“কেন বা মরিবে, প্রিয়?” প্রণয়িনী কাতরে সুধায়;
হেনকালে কার ছায়া হেরি’ বীর মুহু মূরছায়–
“মরিতেই হবে!” বলি’ হানে কর ললাটে সঘনে!
এ নহে কবির ভ্রম—নহে চন্দ্র পথের পল্বলে,
অথবা সে মৃত্যুলোভী পতঙ্গের নব বহ্নিস্তুতি;
যেই শক্তি নারীরূপা—বিধি-বিষ্ণু-হরের প্রসূতি—
সেই পুনঃ নিবসিল পুরুষের চিত্ত-শতদলে
জীবনেরি যজ্ঞে সে যে স্বাহা মন্ত্রে প্রাণের আহুতি-
মরা গাঙে ডাকে বান, মৃত্যু মাঝে অমৃত উথলে।

আঁধার শ্রাবণ-রাতে কাঁদে কেবা আর্দ্র বায়ুশ্বাসে?—
ধূলায়-ধূসরস্তনী, প্রিয়-প্রাণহন্ত্রী—পাগলিনী!
পতিরে করিতে সুখী অশ্রুহীনা কোন্ অভাগিনী—
নিমীলিত আঁখি, মুখ বিষ-নীল—সুখহাসি হাসে!
শারদীয়া জ্যোৎস্নারাতি, ভরা নদী, স্রোতে তরী ভাসে—
তারি ‘পরে কাঁদে বীণ, স্বপ্নে তাই শোনে নিশীথিনী!
ভৈরবী-পালিতা যেই—কামে-প্রেমে সম-উদাসিনী—
কি স্নেহে, মশানে তার ভাগ্যহত স্বামীরে সন্তাষে!

****

মাঠ, বাট, গোষ্ঠ হ’তে এ বঙ্গের জীবন-জাহ্নবী
বহিল উজানে পুনঃ সুদুর্গম দূর হিমাচলে—
যেথায় তারকা-তলে দেওদার-নমেরু-অটবী
রতি-বিলাপের গাথা স্মরে আজও শিশিরের ছলে;
হর তবু হেরে যথা মুগ্ধনেত্রে গৌরী-মুখচ্ছবি—
বঙ্কিম-চন্দ্রের কলা ভালে তাঁর অনিমেষে জ্বলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *