কাব্য ও জীবন
আধুনিক কালে য়ুরোপীয় সাহিত্যে যে কাব্য-বিজ্ঞানের সূত্রপাত হইয়াছে, তাহাতে বহু মনীষী কাব্য সম্বন্ধে যে সকল উপাদেয় তত্ত্বের বিচার বিশ্লেষণ করিতেছেন, সে সকলের মধ্যে একটা কথা বিশেষ ভাবে সকলকেই আলোচনা করিতে দেখি। সে কথা এই যে, সকল উৎকৃষ্ট কাব্য জীবনেরই সত্য ও সুন্দরতম প্রতিরূপ—জীবন—দীপিকা। কাব্য কল্পনামাত্র নয়, জগতের বিপুল বিস্তারের মধ্যে যে সত্য-সুন্দরের প্রতিবিম্ব শতখন্ড দর্পণে ভগ্ন ও অসংলগ্নভাবে বিকীর্ণ হইয়া আছে—অতি চঞ্চল ঊর্ম্মি-বন্ধুর নদীবক্ষে চন্দ্র-বিম্বের ন্যায় যাহা পূর্ণাবয়ব হইতে পারিতেছে না—তাহারই একটি পূর্ণ প্রতিচ্ছবি কবি কল্পনায় ধরা পড়ে; কবি-প্রতিভাই সেই প্রজ্ঞা, যাহার বলে সৃষ্টির এই অশান্তলীলার—এই দিকভ্রান্ত-কারিণী কামরূপা প্রকৃতির কটাক্ষ ঈক্ষণের অন্তরালে ক্ষণিকের জন্য একটা গভীরতর অর্থ প্রকাশ পায়, জীবন ও জগতের স্বরূপ উপলব্ধি হয়। এজন্য ম্যাথু আর্ণড় কাব্যের একটি প্রধান লক্ষণ নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন—Criticism of Life; কিন্তু এই বাক্যের সুগভীর তাৎপর্য্য বুঝিতে না পারায় আজও পর্য্যন্ত এ-সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্কের অবসান হয় নাই। এজন্য ম্যাথু আর্ণকে দায়ী করা যায় না; নানা উদাহরণ সহযোগে তিনি নিজেই এই বাক্যের যে অর্থ নির্দ্দেশ করিয়াছিলেন তাহাতে criticism-কথাটির আভিধানিক অর্থ ধরিয়া আপত্তি করিবার কোনও কারণ নাই। সকল কবি সৃষ্টির মধ্যে একটা আত্মগত criticism যে থাকে, ইহা সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে, এবং জীবনের criticism বলিতে যাহা বুঝায়, কবির সৃষ্টিধর্ম্মের সহিত তাহার বিরোধ নাই। হোমার, শেক্সপীয়ার, গেটে প্রভৃতি মহাকবিগণের কাব্য যে কারণে উৎকৃষ্ট বলিয়া ধারণা হয়—তাহাকে ‘criticism of life’ বলিয়া অভিহিত করিলে এই বাক্যের অর্থ সম্বন্ধে কোনওরূপ গোলযোগ হইতে পারে না। মানুষ আপনার কল্পনাবলে যে জগৎ সৃষ্টি করে তাহা যতই মনোহর হউক, তাহাতে মানুষের স্বতন্ত্র কল্পনার মাহাত্ম্য যতই প্রমাণিত হউক, তাহার সঙ্গে ভাগবতী সৃষ্টির গভীরতর সামঞ্জস্য যদি না থাকে, তাহা হইলে এমন একটা সঙ্গতি বা সত্যের হানি হয়, যাহার জন্য মানুষের অন্তরতম চেতনা আশ্রয়হীন হইয়া পড়ে; সে কাব্য সত্যকার বেদনা, আশ্বাস ও সান্ত্বনায় উজ্জ্বল হইয়া উঠে না। আবার, এই ‘criticism of life’ কথাটার তাৎপর্য্য এই নয় যে, যাহা কিছু প্রত্যক্ষ ও পরিদৃশ্যমান, সেই ব্যবহারিক বাস্তব জীবনকেই কাব্যে যথাযথ চিত্রিত করিতে হইবে, অথবা তাহারই সম্বন্ধে কতকগুলি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। কারণ ম্যাথু আর্ণড্ একথাও বলিয়াছেন যে, কাব্যে যেমন “truth of substance” থাকা চাই, তেমনই ‘high poetic seriousness’ না থাকিলে তাহা উৎকৃষ্ট কাব্য হইতে পারে না। যথাদৃষ্ট জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক কতকগুলি Ideal থাকিলেই কাব্য হইবে না, জীবনের গভীরতম সত্য কবির গভীরতম চেতনায় উদ্ভাসিত হওয়া চাই। “The high seriousness which comes from absolute sincerity”—এই যে কথাটি ম্যাথু আর্ণড্ অতি সংক্ষেপে বলিয়াছেন, ইহার সম্যক অর্থ করিলে তাঁহার ‘criticism of life’ কথাটির সম্বন্ধে আপত্তির কারণ থাকিবে না।
যে কল্পনায় বাস্তব-জীবন সম্বন্ধে কোনও গভীর বেদনার অনুভূতি নাই, যাহা—সম্পূর্ণ নির্ভাবনায় জীবনের যতটুকু ভোগ করিতে পারে তাহা হইতেই— নানা রসরূপের সৃষ্টি করে, তাহা যে মিথ্যা, এমন কথা ম্যাথু আর্ণড্ বলেন নাই। কিন্তু সেরূপ কাব্যে জীবনসম্বন্ধে ‘absolute sincerity’ নাই, এজন্য ‘high seriousness’-ও নাই। যাহা কবির নিজস্ব খেয়াল-কল্পনার ফল, তাহাতে ‘truth of substance’ নাই বলিয়া, তাহা ভাগবতী সৃষ্টির রহস্যে অনুপ্রাণিত নয়—তাহাতে sincerity নাই, ‘adequate poetic criticism of life’ নাই। এই প্রসঙ্গে এই কথাও তিনি বলিয়াছেন—
“For supreme poetical success more is requried than the power—ful application of ideas to life; it must be an application under the conditions fixed by the laws of poetic truth and poetic beauty.”
অবশ্য এই কথা মনে রাখিতে হইবে যে, কবি কাব্যরচনাকালে সজ্ঞানে এমন একটা নিয়ম-পালনের সংকল্প করিয়া বসেন না—কাব্যসৃষ্টির মধ্যেই কবি প্রতিভার এই গূঢ় প্রবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এই কারণে ম্যাথু আর্ণলড্ শেলীর মত কবির সম্বন্ধে এমন কথা বলিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই—”that beautiful spirit building his many—coloured haze of words and images”–“pinnacled dim in the intense inane.”
অবশ্য শেলীর কাব্যসম্বন্ধে ম্যাথু আর্নল্ডের এই মত কতখানি কি অর্থে যুক্তিসঙ্গত, মূল কাব্য-জিজ্ঞাসার পক্ষ হইতে সে বিচারের প্রয়োজন আছে, এবং ইহাও সত্য যে, কাব্যে যদি কোনও হিসাবে “criticism of life” না থাকে, তবে তাহাকে উৎকৃষ্ট কাব্য বলা যাইবে না। কিন্তু সে বিচার এস্থলে অপ্রাসঙ্গিক।
ম্যাথু আর্ণল্ড্-নির্দ্দিষ্ট এই sincerity—কথাটির অর্থ কি? তিনি প্রমাণস্বরূপ যে সকল কাব্যের উল্লেখ করিয়াছেন, এবং এই হিসাবে যে সকল কাব্য অপকৃষ্ট বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, তাহাতে এই কথার একটা স্পষ্ট অর্থ পাওয়া যায়। জীবন ও জগৎ ব্যাপারে যে কবির হৃদয় সাড়া দেয় নাই, যিনি এই সৃষ্টির রহস্যকে উপেক্ষা করিয়া, জাগ্রৎ প্রত্যক্ষকে অবহেলা করিয়া, আত্মরতির মোহবিকারে স্বপ্ন—প্রলাপ রচনা করেন, তাহার কাব্যে সত্যকার অনুভূতি নাই; তিনি মিথ্যারই মায়াজাল রচনা করেন। জীবনের চেয়ে সত্যকার কিছু নাই—কবিধর্ম্মও জীবনধর্ম্ম। প্রকৃতির নেপথ্য-গৃহে যাঁহার দৃষ্টি প্রবেশ করে নাই, যিনি এই জীবন-যজ্ঞের হোতারূপে আপনাকে আহুতি করিয়া সেই জল স্থল আকাশ বিসর্পী বিশ্বপ্রাণ অগ্নির হবিঃশেষ পান করিয়া দিব্যানুভূতি লাভ করেন নাই, তাহার কাব্যে যেমন “truth of substance” নাই, তেমনই sincerity-ও নাই, কারণ তাহা ভাববিলাস, কল্পনাবিলাস, সূক্ষ্ম চিন্তারসবিলাস মাত্র, তাহার মধ্যে সেই দিব্যশক্তি নাই যাহার বলে কবিই বহির্জগৎ ও অন্তরের অহং-এই উভয়ের দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান অতিক্রম করিতে পারেন, যাহাতে subject ও object-এর মধ্যে অপূর্ব্ব উপায়ে সেতু—যোজনা হয়, এবং কাব্যসৃষ্টির কতটুকু subjective ও কতটুকু objective—এ প্রশ্নের সমাধানে Psychology-র মূঢ়তা প্রকাশ পায়। কাব্যে আমরা সেই অহং-অনুবিদ্ধ অথচ অহং-নিরপেক্ষ চিরবিস্ময়কর সত্তাকে একটি অপূর্ব্ব অনুভূতির সাহায্যে উপলব্ধি করি, এজন্য কাব্যই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানযোগ। যে কবির কল্পনা এই সৃষ্টিরহস্যের অনুগত নয়, যাঁহার বাঁশীর রন্ধ্রগুলি এই জগজ্জীবন প্রশ্বাসবায়ুতে পূর্ণ নয়, যিনি এই রহস্যের নিকটে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়া “make me thy lyre”-মন্ত্রে দীক্ষিত হইতে পারেন নাই, তাঁহার কাব্যসৃষ্টি সন্ধ্যাকাশের বর্ণচ্ছটার মতই ক্ষণস্বপ্নের ইন্দ্রজাল —চিরন্তন হরিত-নীলিমার অমৃতরসে সিঞ্চিত নয়।
আমাদের দেশে বহুকাল পূর্ব্বে যে ধরনের কাব্যবিচার প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহাকে Metaphysic of Aesthetic Sentiment বলা যাইতে পারে। কাব্যবস্তুকে প্রাধান্য না দিয়া, কাব্যের বহিরঙ্গটাকেই মুখ্য স্থির করিয়া কাব্যের যে স্বাদ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল তাহাতে ভারতীয় মনীষার গৌরব বৃদ্ধি হইয়াছে; কিন্তু সেই বিচারের মধ্যে মধ্যযুগের scholasticism— বিষয়নিরপেক্ষ যুক্তি-প্রবণতাই—সমধিক প্রকাশ পাইয়াছে। কাব্যের শাঁস-খোসা বাদ দিয়া তাহার দেহগত details-কে কতকগুলি সাধারণ সূত্রে বাঁধিয়া আলঙ্কারিকগণ কাব্যের আত্মার সন্ধান করিয়াছিলেন। এ বিচার কাব্য অপেক্ষা Aesthetics-এর অধিকতর উপযোগী। কারণ, classification বা generalisation কাব্য-জিজ্ঞাসার পক্ষে কতটুকু আবশ্যক তাহা, আধুনিক কাব্য-সাহিত্যের রস যাঁহারা আস্বাদন করিয়াছেন, তাঁহারা বুঝিবেন। এই প্রাচীন কাব্যবিচারে কবি-মানসের পরিচয় নাই—যে সৃষ্টিশক্তি বা Imagination আধুনিক কাব্য-জিজ্ঞাসার একটি প্রধান বিচার্য্য বিষয় আলঙ্কারিকগণ কুত্রাপি তাহার মূল্য নির্ধারণ করেন নাই। কাব্যের সকল উপাদান ও উপকরণকে একটি নির্ব্বিশেষ রসতত্ত্বের অধীন করিয়া লইলে, একটা philosophy of art দাঁড়াইতে পারে, কিন্তু তাহা যথার্থ কাব্য-জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য সাধন করে না। কাব্য শুধুই একটা mode of art নয়, a mode of higher interpretation-ও বটে। জগতের প্রাচীনতম উৎকৃষ্ট কাব্য হইতে আধুনিক শ্রেষ্ঠ কাব্যগুলির সম্বন্ধে একথা খাটে। কবির কাব্যনির্মাণে যে সৃষ্টি-প্রেরণা আছে রসসৃষ্টিই তাহার সজ্ঞান উদ্দেশ্যে নয়। তবে এ প্রেরণা আসে কোথা হইতে? এবং সে প্রেরণার sincerity কোথায়? এই জীবন ও জগতের সঙ্গে কবি-হৃদয়ের যে নানারূপ স্পর্শ ঘটে তাহাতেই কাব্যসৃষ্টির বীজ অঙ্কুরিত হয়। এই স্পর্শহেতু যে গভীর ও বিচিত্র বেদনা, যে আকুল রহস্য—বিস্ময় কবিকে অভিভূত করে, তাহাতেই কবিচিত্তে সৃষ্টিপ্রেরণা জাগে; কারণ, বাস্তবের যে নিগূঢ় স্বরূপ তখন কবিকল্পনায় প্রকাশিত হয়, সেই রূপটিকে ধরিবার বা রূপ দিবার যে প্রবৃত্তি, তাহা এত সহজ ও এত প্রবল যে, তাহার জন্য কোনও সজ্ঞান উদ্দেশ্যের প্রয়োজন হয় না। এই যে সৃষ্টি—ইহা প্রত্যেক কবির নিজস্ব; ইহা এতই স্বতন্ত্র, ইহার রূপ ও ভঙ্গি এতই বিচিত্র যে, ইহাকে কোনও কতকগুলি বাঁধা-ধরা emotion-এর মার্কা দিয়া classify করিলেই জিজ্ঞাসার শেষ হয় না। যে কোনও কাব্য বিশ্লেষণ করিলে যে একই রসতত্ত্বে উপনীত হওয়া যায়, একথা আমি অস্বীকার করিতেছি না; কিন্তু কাব্যবিচারে কাব্যের সেই বৈচিত্র্য—কাব্যবস্তু ও তাহার রূপভঙ্গির অসাধারণ স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করিয়া দিলে কাব্যের কাব্যত্বই থাকে না। প্রত্যেক কাব্যের এই যে বৈশিষ্ট্য, ইহার কারণ কি? জীবন বা কাব্যবস্তুর অসীম বৈচিত্র্য এবং তাহার সঙ্গে প্রত্যেক কবির কবিমানসের স্বাতন্ত্র্যই এই বৈশিষ্ট্যর কারণ। শেক্সপীয়ার, মিলটন, ব্রাউনিং এই তিন কবির কবিমানস যেমন স্বতন্ত্র, তাঁহাদের কাব্যও সেইরূপ স্বতন্ত্র; আবার একই কবির বিভিন্ন কাব্যও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বিচিত্র বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিচিত্র ভাবের এই যে সম্মিলন, এবং তাহার ফলে প্রত্যেক কাব্য যে অভিনব সৃষ্টিসৌন্দর্য্যে মন্ডিত হইতেছে, যুগে যুগে যে নব নব রূপ গ্রহণ করিতেছে—এমন কি, রসিকের রসবোধেও যে স্বাদবৈচিত্র্য ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহারই রহস্য—সন্ধান আধুনিক কাব্য-জিজ্ঞাসার অভিপ্রায়।
কাব্যরস-উপভোগের মধ্যে জগৎ ও জীবনসংক্রান্ত বস্তুবিশেষের emotion সর্বত্র প্রবল। রসবাদীদের মতে তাহা যদি নিম্নাধিকারীর কথা হয়, তথাপি বলিব—কাব্যরস আস্বাদনে এই বস্তুবিশেষের চেতনা universal-এর অনুভূতির মধ্যেও জাগ্রত থাকে, এবং থাকে বলিয়াই একটি অপূর্ব্ব সংবেদনার সঞ্চার হয়। যাহা particular, তাহা particular থাকিয়াই, একটি অসীমতার ব্যঞ্জনা করে বলিয়া কাব্যরস অনির্বচনীয়। কাব্যবস্তুর সম্পর্কে কাব্যরসের বিচারে একজন সমালোচক বলিতেছেন—
“It will be part of our theory that poetry with varying intensity reveals to us a world which answers to the gravest and deepest requirements of the mind, a world ideal in its harmony and its permanence, in its security and, above all in its significance, but nevertheless a world real in its substance. That is to say, we must raise our speculation of this art until we can see every poem as the capture and preservation of some perfection of experience.”
ম্যাথু আর্ণলড্ যাহাকে ‘poetic of substance’ বলিয়াছিলেন, এখানে তাহাকেই ‘perfection of experience’ বলা হইয়াছে। ইহাই কবির অপূর্ব্ব imagination-এর ফল, ইহারই নাম—খন্ড, অস্পষ্ট ক্ষুদ্র বাস্তবকে পূর্ণ ও অখন্ড করিয়া তোলা। ইহাই ম্যাথু আর্ণডের কথায়—“powerful poetic application of ideas to life”, “a criticism of life under the conditions fixed by the laws of poetic truth and poetic beauty.”। এইজন্য সত্যকার কবিসৃষ্টি যেমন জীবন ও জগৎকে অতিক্রম করিয়া অবাস্তবের সাধনা করে না, তেমনই জীবনের মর্ম্মর্গত রহস্য—বাস্তবের গভীরতর reality-কে প্রকাশিত করাই শ্রেষ্ঠ কবিকৰ্ম্ম। জীবনের সহিত কাব্যের এই সম্বন্ধ—কবি-প্রতিভার এই সত্যকার সৃষ্টিধর্ম—কাব্যবিচারে সর্ব্বাগ্রে গণনীয়। এই অর্থেই অপর একজন রসবিদ্ কাব্যসমালোচক বলিয়াছেন—
“if the technical art of poetry consists in making patterns out of languages, the substantial and vital function of poetry will be analogous, it will be to make patterns out of life”—“The poetry of each age must re—interpret and re-incarnate life anew.”
আমাদের দেশীয় কাব্যবিচারে রসের উচ্চতত্ত্বের সন্ধান থাকিলেও কাব্যের এই “substantial and vital function”-এর দিকটা উপেক্ষিত হইয়াছে। এজন্য, Modern Study of Literature বলিতে যাহা বুঝায়, তাহার পক্ষে এই ধরণের কাব্যজিজ্ঞাসা অনেকটা নিষ্ফল হইয়াছে। বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারী—কাব্যের রসপরিণাম-প্রক্রিয়া বুঝাইবার জন্য এই সকল ভাবের পর্য্যায় নির্দেশ করা হইয়াছে বটে, কিন্তু scholasticism-এর প্রভাবে এগুলিকে (চিন্তাপ্রণালীর পথে) পশ্চাতে ফেলিয়া, আমাদের আলঙ্কারিকেরা একটি তত্ত্বের উপরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। এই প্রসঙ্গে আমি মহাকবি ও মহামনীষী গেটের কয়েকটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করিব।
“In aesthetics it is hardly correct to speak of the Idea of the Beautiful, for by so doing we dissever the Beautiful which after all cannot be conceived as being detached.”
“It matters a great deal whether the poet is seeking the particular for the universal or seeing the universal in the particular. The latter is the nature of poerty. It gives expression to the particular without in any way thinking of or referring to the universal. And he, who vividly grasps the particular will at the same time also grasp the universal, and will either not become aware of it at all, or will only do so long afterwards.”
—শেষের কথাটিতে, পূর্ব্বে যে কবিদৃষ্টির কথা বলিয়াছি, যাহার বলে খন্ড, ক্ষুদ্র ও পরিচ্ছিন্নের মধ্যেই অসীমের আভাস ফুটিয়া উঠে-বাস্তব experience perfect হইয়া দাঁড়ায়—তাহারই ইঙ্গিত রহিয়াছে।
আমাদের আলঙ্কারিকেরা এই particular-কে উচিত মৰ্য্যাদা দেন নাই—দিলে, তাঁহারা যাহাকে ‘সঞ্চারী’ ভাব বলিয়াছেন, রসবিচারে তাহাকেই মুখ্য বলিয়া বিবেচনা করিতেন; এ সম্বন্ধে গেটের আর একটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়া এ আলোচনা শেষ করিব। গেটে বলিতেছেন—
“In a work of art, the question ‘what’ interests a man far more than the ‘how’, hence comes the practice of laying stress upon particular parts in which if we pay particular attention, we shall ultimately find that the effect of totality is not wanting, even though it remained unnoticed by every one.”
আলঙ্কারিকের কাব্যজিজ্ঞাসায় এই how-টাই বড় হইয়াছে, what-কে তাঁহারা —আমল দেন নাই;-এজন্য কাব্যবিচারে, সকল রসগ্রাহী পাঠকের পক্ষে যে প্রশ্ন সহজ ও স্বাভাবিক, কবিকর্ম্মের সকল সৌন্দর্য্য যাহাকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে—তাহার সমাধান বা বিশ্লেষণ নাই; জীবনসমুদ্রের ছায়া লোক-বিচিত্র উৰ্ম্মিমালায় যে ক্ষণ-সৌন্দর্য্য কাব্যের ভিতর দিয়া চিরন্তনের ইঙ্গিতরূপে রসিকচিত্ত আকুল করিয়া তোলে, কবি প্রতিভার সেই সর্ব্বপ্রধান কৃতিত্বের কথা ইহাতে নাই।
কেন নাই? এ প্রশ্নের বোধ হয় উত্তর আছে। অন্ততঃ আমাদের সাহিত্যে কাব্যের এই substantial ও vital function-এর স্পষ্ট লক্ষণ না থাকার একটা কারণ নির্দ্দেশ করা দুরূহ নয়। কিন্তু তাহার পূর্ব্বে সাহিত্য সম্বন্ধে একটা কথা বুঝিয়া লইবার প্রয়োজন আছে। অন্যান্য ইতিহাসের মত সাহিত্যের ইতিহাসেও Mediaevalism বলিয়া একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। শেপীয়ারের Hamlet বা গেটের Faust কাব্যের সম্বন্ধে একটা কথা সকলেই বলিয়া থাকেন যে, ওই দুই কাব্যে মানব-মনের Modern রুপটি বিশেষ করিয়া প্রকাশ পাইয়াছে। সাহিত্যের এই Modern ভাবধারা বিশ্লেষণ করিলে, যে একটি প্রধান লক্ষণ ধরা পড়ে তাহারই অভাবত্মক ধারনাই Mediaevalism। য়ুরোপে পঞ্চদশ শতাব্দীতে মানুষের ভাবরাজ্যে যে যুগান্তর সুস্পষ্ট রূপে দেখা দেয়, যাহার নাম দেওয়া হইয়াছে Renaissance—একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক তাহার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা নির্দেশ করিয়াছেন— “Discovery by mankind of himself and of the world”. ইহার পর হইতেই য়ুরোপের সর্ব্ববিদ্যাবাৰ্ত্তাবিধি —Modern বলিতে যাহা বুঝায়—তাহারই দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিল। গ্রীক সাহিত্য, কলা ও দর্শনের সঙ্গে আকস্মিক পরিচয়ে মানুষ জগৎ ও জীবনকে আর এক চক্ষে দেখিতে লাগিল।
“Human life which the mediaeval Church had taught them to regard but as a threshold and stepping stone to eternity, acquired suddenly a new momentousness and value: the promises of the Church paled like its lamps at sunrise and a new paganism ran like wild-fire through Italy.”
—এই যুগান্তের পূর্ব্বে সকল বিষয়ে seriousness হয়ত ছিল, কিন্তু schoslsticism-এর চাপে জীবনের স্ফূর্ত্তি কুত্রাপি ছিল না। আমাদের দেশেও এইকালে সাহিত্যরচনায় যেমন, তেমনি তাহার আদর্শবিচারে, জীবনের গভীরতম অনুভূতির স্থান বড় বেশী ছিল না। সেকালে কাব্যসৃষ্টিতে সত্যকার imagination বা “perfection of experience”-এর প্রয়োজন হয় নাই; জীবনকে কতকটা আড়ালে রাখিয়া বাস্তব-মুক্তির সাধনাই ছিল রসর্চ্চার নিপুণতম কৌশল। আমাদের দেশে, এ যুগে একদিক দিয়া কাব্যের একটা বৃহত্তর মূল্য ছিল—it was a means of escape from the ills of life—কিন্তু এই monasticism-এর দ্বারা যে মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যায় তাহা তৈলধারাবৎ অবিচ্ছিন্ন নয়—এ অবস্থা বেশিক্ষণ টিকে না, তাই জার্মান দার্শনিক Schopenhauer খাঁটি Asceticism-র পক্ষপাতী। তাহার মতে—”The Hindu Sannyasin shows the way”। জীবন ও জগতের সম্বন্ধে যে মনোভাবের ফলে ভারতীয় কাব্য-বিচারে রস-বাদের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল, ঠিক সেই কারণেই, Imagination-এর পরিবর্তে Fancy, এবং স্বাভাবিকতার পরিবর্তে conceit কাব্যের অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া আছে। কাব্যরচনার জন্য কবিগণ যেন একটু সাজসজ্জা করিয়া বসিতেন— মানস চক্ষে বাস্তব-বিস্মৃতির অঞ্জন পরিয়া লইতেন। যে personality ও ব্যক্তিগত জীবনের গভীরতম experience-এর বাস্তব পরিচয় আমরা সকল উৎকৃষ্ট কাব্যে পাই বলিয়া একটি সুগভীর আনন্দ—বেদনায় মুগ্ধ হই, এবং কবির সেই ব্যক্তিগত ভাবদৃষ্টির সাহায্যেই পাঠকের মনেও একটি সুগভীর আত্মপরিচয়ের আশ্বাস জাগে, সে রস এ সাহিত্যে বিরল।
এই বাস্তব-চেতনা বলিতে আমি কি বুঝি এবং বুঝাইতে চাই, তাহা পাশ্চাত্য সাহিত্যের ইতিহাস হইতে এক উদাহরণ দিয়া দেখাইব। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে ফরাসী দেশে একজন কবির উদয় হইয়াছিল, ইঁহার নাম Francois Villon-এ নাম বোধ হয় অনেকেরই পরিচিত। একজন সাহিত্য-সমালোচক Villon-এর সম্বন্ধে বলেন—
“He is the first poet in France and the greatest rogue in the history of Literature.”
ইহার পরেই বলিতেছেন—
“With the advent of Villon mediaevalism breathed its last and with the death of mediaevalism was born the modern poetry of France.”
এমন কথা বলার কারণ কি? তাহার উত্তর—
“The two hundred verses of the Grand Testament present for the first time in the literature of France, a distinct and striking personally, a personality distinct because he is alone a being of real flesh and blood, among a crowd of shadows.”
“It is from the contemplation of his own experience that the poet speaks……he looked in his heart and wrote, and his life is the theme of his writing.”
সমালোচক আরও বলেন যে, Villon-র কাব্যে মৃত্যু সম্বন্ধে যে গভীর বাস্তব—অনুভূতি ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাই তাঁহার কবি-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য—Villon -এর কবি-যশ ইহার উপরেই প্রতিষ্ঠিত :
“In death he can see nothing but the horrors of dissolution. In brighter moments he may seek to console himself by a kind of philosophy, that all beauty must perish, that life is but fleeting, and so on; but even while he speaks his teeth are chattering, and there rise up before his eyes the creaking gibbers of Montfaucon with his own place prepared and ready, and he hears the hollow croaks of the magpies rising upon the night air. “ (Villon নিজের জীবনে বহুবার গুরুতর দুষ্কৃতির জন্য কারাবাস এবং একাধিকবার মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হইয়াছিলেন।)
উপরি-উক্ত উদাহরণের দ্বারা আমি কাব্যের আদর্শ নির্ণয় করিতেছি না —Villon—র কাব্যই যে আদর্শ কাব্য, এমন কথা বলিতেছি না। আমার প্রধান বক্তব্য এই যে, গভীরতম বাস্তবানুভূতি বা সত্যকার হৃৎস্পন্দনের উপরেই কাব্যপ্রেরণা নির্ভর করে। এই Villon-এর কাব্য সম্বন্ধে ম্যাথু আর্ণল্ড্ যাহা লিখিয়াছেন তাহাই উদ্ধৃত করিয়া দিলে, এ বিষয়ে কিছুই বলিবার প্রয়োজন হইবে না। ম্যাথু আর্ণড্ লিখিয়াছেন—
“A voice from the slums of Paris, fifty or sixty years after Chaucer, the voice of poor Villon out his life of riot and crime has, at its happy moments more of this important poetic virtue of seriousness than all the productions of Chaucer. But its apparition in Villon, and in men like Villon is fitful, the greatness of the great poets, the power of their criticism of life, is that their virture is sustained.”
এই কথারই পুনরুক্তি করিয়া বলি, Hamlet ও Faust-কাব্যে, এই experience, truth of substance, criticism of life, high and excellent seriousness দ্বারা মন্ডিত হইয়াছে; তাই সে কাব্যের মূল্য এত বেশী। এই perfection of experience-ই কাব্যের প্রাণ, ইহাকেই ম্যাথু আর্ণল্ড্ criticism of life বলিয়াছেন। পরবর্তী সমালোচকেরা এ বাক্যের ভিন্ন অর্থ করিয়া নানা বিতর্কের সৃষ্টি করিয়াছেন। এই criticism of life epic, drama বা narrative কবিতায় concrete কাব্যনিৰ্ম্মাণেই যে প্রকাশ পাইবে, এমন কথা কেহই বলিবেন না; উৎকৃষ্ট ‘লিরিক’ কবিতায় ভিন্ন ভঙ্গীতে ইহার প্রকাশ দেখা যায়—Villon-র কবিতাও ‘লিরিক’। আবার, শুধু ভাবে বা রূপে নয়, ভাবনামূলক কবিতার মধ্যেও উৎকৃষ্ট কাব্য লক্ষণ থাকিতে পারে। যাঁহারা কবিতাপাঠ কালে ভাবনালেশহীন রসাস্বাদের পক্ষপাতী, তাঁহাদের মনে হয়ত এই শেষোক্ত শ্রেণীর কবিতা কবিতাই নয়—কিন্তু এ সকল কবিতার ভাবনাও যে ভাবহীন নয়, ছন্দ ও সুরের সহিত বাক্য যোজনার আবেগেই তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমি কালিদাসের একটি নিছক কবিতা ও তাহারই সঙ্গে সুইনবার্গের কয়েকটি ভাবনা—প্রধান শ্লোক এস্থলে উদ্ধৃত করিব, ইহার কোনটি কাব্যহিসাবে কতখানি সার্থক হইয়াছে, পাঠক সে বিচার করিবেন। কালিদাসের শ্লোকটি এই
শ্যামাস্বঙ্গং চকিতহরিণীপ্রেক্ষণে দৃষ্টিপাতম্
বহুচ্ছায়াং শশিনি শিখিনাং বর্হভারেষু কেশান্।
উৎপশ্যামি প্রতনুষ নদীবীচিষু ভ্রূবিলাসান্
হন্তৈকস্মিন্ কচিদপি ন তে চন্ডি সাদৃশ্যমস্তি।
(মেঘদূতের বিরহ যক্ষ প্রিয়ার উদ্দেশে বলিতেছে— হে চন্ডি, আমি শ্যামা—লতায় তোমার অঙ্গসৌষ্ঠব, চকিত হরিণীর নয়নে তোমার দৃষ্টি, চন্দ্রে তোমার মুখকান্তি, শিখিপুচ্ছে তোমার কেশরাশি, এবং ক্ষুদ্র নদীতরঙ্গে তোমার জবিলাস দেখিতে পাইতেছি; কিন্তু হায়! কোনও একটির মধ্যে তোমার সমগ্র রূপসাদৃশ্য নাই।)
সুইনবার্গের কাব্যের কয়েকটি লাইন এইরূপ—
Love, that for very life shall not be sold,
Nor bought nor bound with iron nor with gold;
So strong that heaven, could love bid heaven farewell,
Would turn to fruitless and unflowering hell
Tre So sweet that hell, to hell could love be given
Would turn to splendid and sonorous heaven
Love that is fire within thee and light above,
And lives by grace of nothing but of love;
Through many and lovely thoughts and much desire
Led these twain to the life of tears and fire;
Through many and lovely days and much delight
Led these twain to the lifeless life of night.
এই দুইটি কবিতার কাব্যবস্তু স্বতন্ত্র হইলেও—একটি যেমন প্রিয়া-বিরহিত প্রেমিকের একখানি ভাবচিত্র, অপরটি তেমনিই প্রেম সম্বন্ধে কবির অতিশয় আবেগমূলক ভাবনার উৎসার। তথাপি সুইনবার্গের কবিতায় মানবজীবনের একটি মুখ্য experience-কে যে ভাবনার দ্বারা মন্ডিত করা হইয়াছে, সেই ভাবনার মূলে এমন একটি দিব্যানুভূতির আবেগ ভাষায়, ছন্দে ও সুরে দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে যে, তাহাতে জীবন-রস-রসিকের চিত্তেও সাড়া জাগে; অর্থাৎ এই ভাবনায় অতিমাত্রায় ভাব-তান্ত্রিক হইলেও ইহাতে sincerity ও seriousness আছে। অপরপক্ষে, কালিদাসের কবিতাটিতে বিশুদ্ধ কল্পনাবিলাসই আছে, বাস্তবের নামগন্ধও নাই; এরূপ প্রেমোন্মাদ যদি সত্যকার জীবনে ঘটে, তবে তাহা কাব্যের বিষয় না হইয়া চিকিৎসাশাস্ত্রের অধীন হওয়াই উচিত, কিন্তু বাস্তবের নামগন্ধ নাই বলিয়াই রসবাদী আলঙ্কারিকের মতে ইহাই একটি উৎকৃষ্ট রস-রচনা।
আধুনিক কালের কাব্যে এই জীবনের অনুভূতি গভীরতর হইয়া উঠিলেও, সকল যুগের শ্রেষ্ঠ কাব্যগুলিতেই, criticism of life, is higher interpretation of life আছে। কেবল, যখনই কোনও জাতির মধ্যে জীবনধর্ম্ম, যে কোন কারণেই হোক, ক্ষীণ হইয়া আসে, অথবা মানসবৃত্তির অতিরিক্ত প্রাধান্য ঘটে, তখনই সেই জাতির কাব্যে Sincerity ও Seriousness-এর অভাব হয়। কবিকল্পনা, হয় কেন্দ্রাতিগ ভাব-মার্গে স্বপ্নপ্রয়াণ করে : নয় প্রাণহীন পঙ্কবিলাসে অধঃপতিত হয়। মধ্যযুগের পারলৌকিকতা ও বৈরাগ্যের অন্ধকার হইতে য়ুরোপ বহুদিন মুক্তি পাইয়াছে। কিন্তু ভারতবর্ষে এই জীবন-ধৰ্ম্ম আজ পর্যন্ত স্তম্ভিত হইয়াছে। কি কারণে, এবং কতকাল ধরিয়া এই অবস্থা ঘটিয়াছে সে অনুসন্ধান ঐতিহাসিক করিবেন, কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই যে, জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে একটা Passive, পাশব চেতনা –একটা তামসিক দেহধৰ্ম্মই—আমাদের মধ্যে আজও টিকিয়া আছে; জড়ের সহিত সংঘর্ষে আত্মার যে সজীবতা—হৃদয়কে অবারিত ও প্রসারিত করিয়া, ইন্দ্রিয়দ্বারে বাহিরকে সম্পূর্ণরূপে অন্তরে গ্রহণ করিয়া যে আত্মোপলব্ধি—তাহা হইতে আমরা বহুদিন বঞ্চিত আছি। মধ্যে মধ্যে যে দুই চারিজন মনীষী আবিভূর্ত হইয়া জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে সত্য প্রচার করিয়াছেন, তাহাতে এই রক্তমাংসগঠিত দেহের মধ্যে যে প্রাণদেবতা রহিয়াছেন, তাঁহাকে নিষ্ক্রিয় ও নিস্তেজ করা হইয়াছে; দেহের মধ্যেই দেহহীন হইয়া থাকিবার—স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি নিরোধ করিয়া অস্বাভাবিক মনোবৃত্তির অনুশীলন করিবার—মানুষ না হইয়া অতিমানুষ হইবার পন্থা আবিষ্কৃত হইয়াছে। আজিকার দিনেও এই অতীন্দ্রিয়বাদ, এই ভূমা, এই দেহতত্ত্ববর্জিত অধ্যাত্মজ্ঞান একটি নূতন রূপে দেখা দিয়াছে। যে monasticism এতকাল ধর্ম্মেকর্ম্মে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে, শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল—সেই নিঃসঙ্গ গুহাবাসীর ধ্যানবিলাসই আজ আবার সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ভারতীয় কালচারের দুষ্প্রধর্ষ Idealism য়ুরোপীয় কাব্যকলাকে আত্মসাৎ করিয়া—ভারতীয় ভাববাদ য়ুরোপীয় রূপবাদকে আশ্রয় করিয়া—যে আশ্চর্য্য নবজন্ম লাভ করিয়াছে, তাহাতেও জীবন ও জগতের সঙ্গে দেহগত পরিচয় নাই; ‘discovery by mankind of himself and of the world’ বলিতে যাহা বুঝায়, সেই জগৎ-সাক্ষাৎকার ও জীবন-চেতনার পরিচয় নাই; তাই এ সাহিত্য প্রাণের উদ্বোধন করিল না। কবির বাঁশিতে অর্দ্ধশতাব্দী ধরিয়া যে রাগিণী উৎসারিত হইয়াছে, সে সঙ্গীত একটি অপ্রাকৃত সৌন্দর্য্যলোক সৃষ্টি করিয়াছে; তাহাতে কাব্যের দিক দিয়া ভারতীয় রসবাদের হয়ত হানি হইবে না, কিন্তু জীবনের দিক দিয়া এমন একটি আদর্শের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে যাহাতে, বাস্তবকে অগ্রাহ্য করিয়া মানুষ একটি পরম সত্যের ভাবস্বর্গে নিশ্চিন্ত হইয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতে পারে।
আমাদের Mediaevalism ঠিক য়ুরোপের Mediaevalism নয়; সেখানকার পারলৌকিকতা কখনও এমন একটি সুদৃঢ় অদ্বৈত-ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারে নাই—ইহলোকের উপর চাপিয়া বসিয়াছিল মাত্র, তাহাকে শেষ করিতে পারে নাই। এজন্য প্রাণের দ্বন্দ্ব কখনও ঘুচে নাই, মানুষ অবশেষে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল। তাই যেমনই সহসা দুয়ার একটু খুলিয়া গেল, অমনি য়ুরোপ ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল। প্রকৃতির নিষ্ঠুর পীড়নে সেখানে প্রাণধৰ্ম্ম বা দেহচেতনা কখনও অলস হইতে পারে নাই—প্রাণকে ঘুম পাড়াইয়া মনের অদ্বৈত-মহিমা জয়ী হইতে পারে নাই। এখানে প্রকৃতির শাসন অতিশয় শিথিল হওয়ায় জীবন-সমস্যা অপেক্ষা মৃত্যুর সমস্যাই বড় হইয়াছে; বাস্তবপ্রত্যক্ষের সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম করিতে হয় নাই বলিয়া, অবাস্তব অপ্রত্যক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়া করিবার অবসর মিলিয়াছে; যে বীর্য্য জীবনযুদ্ধের জন্য প্রয়োজন হয় নাই তাহাই অধ্যাত্ম-সংগ্রামে নিয়োজিত হইয়াছে। এখানকার মানুষ কল্পনায় আত্মজয় তথা বিশ্বজয় করিয়াছে; বহুপূর্ব্বকাল হইতেই দলে দলে সন্ন্যাসীর প্রাদুর্ভাব হইয়াছে; দিগ্বিজয়ী গ্রীকবীরকে ভারতীয় নগ্নক্ষপণক সঘৃণ কৃপাকটাক্ষের দ্বারা পরাস্ত করিয়াছে। এই মনোভাব আমাদের অস্থিমজ্জাগত। জগতে বাস করিব অথচ জগৎকে ভ্রূক্ষেপ করিব না, দেহ ধারণ করিয়া দেহকে মানিব না—এই প্রবৃত্তি বহুদিন প্রশ্রয় পাইয়া একদিন এমন অবস্থায় দাঁড়াইল যে, তখন প্রাণ-ধৰ্ম্মকেই সবচেয়ে প্রয়োজন, কিন্তু সে আর সাড়া দেয় না। ভারতবর্ষ, দেহ ও আত্মা, অর্থ ও পরমার্থ এই দুইয়ের মধ্যে সন্ধি করিয়া নিৰ্ব্বিবাদে বাস করিতেছিল; কিন্তু একদিন বাহিরের দুর্দ্ধর্ষ প্রাণবান জাতি এই ঘুমন্ত পুরীতে আপতিত হইয়া তাহার সুখ-স্বপ্ন নষ্ট করিল। কিন্তু তখন আর উপায় নাই, প্রাণ স্বাস্থ্য হারাইয়াছে। সেই দিন হইতে ভারতের ইতিহাসে যে অধ্যায়ের আরম্ভ হইয়াছে আজ তাহারই শেষ পৃষ্ঠা খুলিয়াছে। আজ সেই প্রাণ-ধর্ম্ম যাহাদের মধ্যে জ্ঞানে ও বীর্য্যে পূর্ণবিকশিত হইয়াছে, পশ্চিমের সেই প্রকৃতি-উপাসক জাতি, ব্রহ্মের অভব্যবসায়ীদের শেষ পিণ্ডের ব্যবস্থা করিতেছে। এই মৃত জাতি মৃত্যু-ধৰ্ম্মকেই আঁকাড়াইয়া আছে, কবির মুখ দিয়া জগৎকে শুনাইতেছে—দেহের চেয়ে আত্মা বড় প্রকৃতির শান্ত আনন্দময়ী মূর্তির ধ্যান কর; জাতীয়তা বর্জ্জন করিয়া মহামানবের আসন প্রস্তুত কর; মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া অমৃতে প্রস্থান কর। এখনও সেই কথা, সেই উচ্চ চিন্তার শূন্যবাদ, সেই বাস্তব-ব্যভিচারী শাশ্বত-সনাতনের পূজা!
ভারতবর্ষ যে-সত্যকে চাহিয়াছিল সে-সত্য প্রকৃতির সত্য নয়, সে-মন্ত্র জীবনের মন্ত্র নয়। প্রকৃতিও সনাতনী; তাহার ধ্বংস ও সৃষ্টি-লীলার মধ্যে যে চিরন্তনী ধারার আভাস পাওয়া যায়, সে তত্ত্ব স্বতন্ত্র—তাহাকে ধ্যানের দ্বারা নয়, মূক—মুগ্ধ জীবনাবেগের দ্বারাই উপলব্ধি করিতে হয়। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্’—এই বাক্যে যে সত্যের ধারণা আছে, তাহার জয় যে জগতে ঘটে, তাহা মানুষের জীবন—রঙ্গভূমি নয়। সে সত্যের পূজা করিতে হইলে শ্মশানকেই তীর্থভূমি করিতে হয়, সৰ্ব্বনাশকেই সৰ্ব্বপ্রাপ্তি বলিয়া মানিতে হয়। যতদিন সৃষ্টি থাকিবে ততদিন শ্মশানচারী দিগম্বরের প্রভুত্ব চলিবে না, তাহার বক্ষে কালীই নৃত্য করিবে; ততদিন উন্মাদবিন্তিত শাশ্বত-সত্য বা দেশকালাতীত অবাস্তবের সাধনা কখনও জয়ী হইবে না।
এই অবাস্তব ভাব-বিলাস জীবনকে পঙ্গু করে বলিয়াই সাহিত্যেকেও প্রাণহীন করিয়া তোলে; সকল সাহিত্যেই ভাব যখন বস্তুকে ছাড়াইয়া উঠে, তখনই কাব্যের অধঃপতন হয়। আমাদের বর্তমান জীবন এইরূপ ভাববিলাসের অতিশয় অনুকূল। কিন্তু, একে জীবনীশক্তি ক্ষীণ, জীবনের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় বহুকাল যাবৎ ঘটে নাই, তাহার উপর ভাবস্বর্গের কল্পধে দোহন—ইহার ফলে জীবন-চেতনার মত সাহিত্য-চেতনাও অসাড় হইয়া উঠিতেছে; তাই আমাদের কাব্য কেবল ছন্দ ও বাক্যের কসরৎ-অর্থহীনতাই তার রস, এবং অস্বাভাবিকতাই তাহার মৌলিকতা। জার্মান রোমান্টিকগণের ভাববিলাস যখন অতিচারী হইয়া পরিশেষে প্রাণহীন হইয়া পড়িয়াছিল, কবি Heine তখনকার সেই সাহিত্যের যে সমালোচনা করিয়াছিলেন, আমাদের আধুনিক কাব্য সেরূপ সমালোচনার উপযুক্ত হইতে পারিলেও ধন্য হইত বরং গেটে এই যে কথাগুলি একস্থানে লিখিয়াছেন, আমাদের কবিদের সম্বন্ধে তাহাই অধিকতর সত্য—
If feeling does not prompt, in vain you strive;
If from the soul the lauguage does not come,
By its own impulse, to impel the hearts
Of hearers, with communicated power,
In vain you strive-in vain you study earnestly,
Toil on for ever; piece together fragments,
Cook up your broken scraps of sentences,
And blow, with puffing breath, a struggling light,
Glimmering confusedly now, now cold in ashes
Startle the schoolboys with your metaphors :
And, if such food may suit your appetite,
Win the vain wonder of applauding children.
But never hope to stir the hearts of men,
And mould the souls of many into one,
By words which come not native from the heart.
—কিন্তু Words আসিবে কোথা হইতে?-heart কোথায়? তাই এ সকল কবিতা সম্বন্ধে গেটের ভাষাতেই বলিতে হয়—
Oh! these fine holyday phrases,
In which you robe your worn-out common-places,
These scraps of paper which you crimp and curl,
And twist into a thousand idle shapes,
These filigree ornaments are good for nothing,
Cost time and pains, please few, impose on no one;
Are unrefreshing as the wind that whistles
In autumn, ‘mong the dry and wrinkled leaves.
কিন্তু এই ব্যাধি একটি নূতন রূপে দেখা দিয়াছে আধুনিক ছোকরা-কবিদের কাব্যে। ইহারা নাকি এই বিলাসের বিরোধী—ইহারা জীবনেরই পূজারী। কিন্তু জীবন কোথায়? পিতৃপিতামহের মধ্যে তাহার যেটুকুও অবশিষ্ট ছিল, ইহাদের মধ্যে সেটুকুও আর নাই। তবু জীবন চাই-ই। য়ুরোপীয় সাহিত্যে জীবনের এত স্ফূর্ত্তি!—আমাদের ভিতরে খুঁজিয়া তাহার এতটুকুও কি মিলিবে না? কিন্তু মেলে না যে! অগত্য দেহের শেষদশান্তেও যাহা একেবারে শেষ হয় না, সেই যৌন—প্রবৃত্তিকেই ইহারা জীবনধর্ম্ম বলিয়া ঘোষণা করিল; এবং অতিশয় অকথা—কুকথাপূর্ণ ব্যাকরণ-অভিধান-বর্জিত ভাষায় কাম-বিদ্রোহ প্রচার করিল—শীর্ণ শবদেহকে দানোয় পাইল। ইহারই নাম হইল সাহিত্যের জীবনধর্ম্ম! এই সম্পর্কে Faust হইতে আরও কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করা চলে—
“The night and Churchyard posts are engaged in an interesting conversation with a newly arisen vampire, from which they antici—pate the development of a new school of poetry.”
জীবনের নামে এ যুগের তরুণদের এই যে বিকারজনিত পিপাসা —সৰ্ব্বাঙ্গে পঙ্কলেপন ও ধূলিভক্ষণ—জাতির পক্ষে ইহা যে কত বড় মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, সে কথা হৃদয়বান ও চক্ষুষ্মান ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করিবেন। জীবনকে চাই, এ জ্ঞান জন্মিয়াছে—পরের জীবন, পরের সাহিত্য দেখিয়া; কিন্তু সত্যকার জীবনধর্ম্ম হইতে যাহারা বঞ্চিত, জীবন যে কি বস্তু তাহার প্রত্যক্ষ অনুভূতি যাহাদের নাই, তাহারা পরের অনুকরণে যে জীবন-ধর্ম্মের পরিচয় দিতেছে তাহা কুৎসিত স্বপ্নবিলাস ও নির্জীব কাম-জ়ন্তণ মাত্র। যাহা নাই, কল্পনায় তাহার ছায়া ধরিয়া একটা উন্মাদ—উল্লাসের মর্মভেদী দৃশ্য আমরা সম্প্রতি রাজনীতির ক্ষেত্রেও দেখিয়াছি। হায় জীবন! বড় বিলম্ব হইয়া গিয়াছে; আরও পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বে এ পিপাসা জাগে নাই কেন? তখন জাতির দেহটা অন্ততঃ সবল ছিল, এমন মস্তিক-বিকৃতির সম্ভাবনা ছিল না।
জীবনের সহিত কঠিন প্রত্যক্ষ পরিচয়ের বেদনা আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেও তেমন করিয়া কবি-প্রেরণার সাহায্য করে নাই; যে বেদনা কবিচিত্তে প্রতিফলিত হইয়া মৃত্যুকেও অমৃত করিয়া তোলে, ভারতের তত্ত্বজ্ঞান তাহাকে অবস্তু বলিয়া চিরদিন দূরে ঠেলিয়া রাখিয়াছে, জীবনকে জীবনের দিক হইতে দেখিবার চেষ্টাই করে নাই। তাই ভারতীয় কাব্যে ট্র্যাজেডির স্থান নাই। কিন্তু জীবন ও জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের এই যে বেদনা ইহাই সুরময় হইয়া কাব্যসৃষ্টি করে; এই সুরই মানুষের চিত্তকে আনন্দলোকে উত্তীর্ণ করে—যাহা কঠিন, কর্কশ, রুদ্র ও নিৰ্ম্মম তাহারই শোণিত-মাংস-লব্ধ বেদনায় মানুষ দেবত্বের সন্ধান পায়। কবি যথার্থই বলিয়াছেন—
Who ne’er in weeping ate his bread,
Who ne’er throughout the night’s sad hours
Hath sat in tears upon his bed,
He knows you not ye Heavenly Powers!
এই যে দুঃখ, মনুষ্যজীবনে ইহা ত নিত্যনৈমিত্তিক, তথাপি ইহা জাতিবিশেষের বা ব্যক্তি-বিশেষের কাব্যপ্রেরণার বস্তু হয় না কেন? তাহার কারণ, এই দুঃখ যদি শুধু passive পাশব-চেতনার স্তরেই থাকিয়া যায়, তবে তাহার Seriousness কোথায়? আবার যদি ইহা অবস্থাগুণে দেহচেতনারও আড়ালে থাকিয়া যায়, এবং প্রবল মানসিকতার চাপে চিন্তাবিলাসের বস্তু হয়, তবে তাহার Sincerity কোথায়? আজ আমাদের দুঃখ পাইবার শক্তিও নাই, Idea-র জগতে বাস করিবার উপায়ও নাই। আজ সব ফাঁকি ধরা পড়িয়াছে, বঞ্চিত জীবন বহুকালসঞ্চিত ঋণের পরিশোধ দাবী করিতেছে, কিন্তু সে দাবী মিটাইবার ক্ষমতা নাই। আজ সেই ক্ষুধিত ব্যাধিগ্রস্ত জীবন বাস্তবেও যেমন, কাব্যেও তেমনি, তার সেই vital substantial function—এর অভাবে আলেয়ার মত দিকভ্রান্ত করিতেছে। একদিন এই জীবনকে উপেক্ষা করিয়া যে স্বতন্ত্র কাব্যজগৎ গড়িয়া উঠিয়াছিল আজ তাহা যেমন নিষ্ফল হইয়াছে, তেমনি এই জীবনেরই নামে যে অক্ষম মেরুদন্ডহীন বাস্তব-বিলাস দিন দিন প্রসার লাভ করিতেছে তাহার ফলও শোচনীয় হইয়াছে।
কাব্য ও জীবন সম্বন্ধে আমি যে আলোচনা করিলাম তাহাতে কাব্য-জিজ্ঞাসার সকল প্রশ্নের মীমাংসার দাবী করি না। আধুনিক কাব্যজিজ্ঞাসার প্রধান প্রয়োজন কি, তাহারই একটা ধারণা খাড়া করিবার চেষ্টা করিয়াছি। Literature as a mode of art—বিচার করা এ প্রসঙ্গের উদ্দেশ্য নয়। Literature as a higher interpretation of life and nature-বিচার করিবার যে বিশেষ প্রয়োজন আছে, তাহাই আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কেবল Aesthetics ধরিয়া কাব্য-বিচার করিলে কাব্যের যথার্থ বিচার হয় না; জীবনের সঙ্গে কাব্যের কোথায় কতখানি যোগ আছে তাহা বুঝিতে না পারিলে কাব্য-বিচারে নানা অনর্থের সূত্রপাত হয়—সমাজ-নীতি ও ধর্ম্মের কচকচি, অথবা তত্ত্ববিশেষের কুহেলিকায় কাব্যকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আমার মনে হয়, কাব্যের সঙ্গে জীবনের এই নিগূঢ় সম্বন্ধ বুঝিতে পারায়, এতদিনে কাব্যের প্রকৃত সংজ্ঞা ও মূল আদর্শ ধরা পড়িয়াছে—ইহাতে বহু বিতর্কের অবসান হইবে। জীবনের প্রকাশ ও বিকাশ যেমন বিচিত্র, কাব্যের আদর্শও তেমনি সচল। কাব্য জীবন-ধৰ্ম্মী বলিয়াই নবনবোন্মেষশালী। আবার রসসৃষ্টিতে যেমন, রসবোধের মধ্যেও তেমনি, এই বিকাশধর্ম্মের লক্ষণ আছে—অভিনব কাব্যসৃষ্টির প্রভাবে রসিকেরও চিত্তবিকাশ হয়। তাই, গেটের মত রসিকও অসঙ্কোচে স্বীকার করেন—
“I begin to find new qualities in the work, and new faculties in myself.”
অতএব কাব্যবিচারে কাব্যের এই vital and substantial function-এর কথা যদি বুঝিয়া লওয়া হয়, তবে একদিকে যেমন তাহার বৈচিত্র্য ও স্বাধীন স্ফূর্ত্তির ধারণা অক্ষুণ্ণ থাকে, তেমনই আর একদিকে তাহার স্ব-প্রকৃতির ব্যভিচার সহজেই ধরা পড়ে। কি প্রাচীন কি আধুনিক—সকল কাব্যের উৎকর্ষ-বিচারে ইহার যে প্রামাণ্য লক্ষণ আমরা নির্দ্দেশ করিতে পারি, তাহা এই—
“Poetry with varying intensity reveals to us a world which answers to the deepest and gravest requirements of the mind: a world ideal in its harmony and its permanence, in its security, and above all, in its significance, but nevertheless a world real in its substance.”
আর একটা প্রমাণ এই যে, আমাদের দেশে আজকাল কাব্য-বিচারে যে বাদবিসংবাদ ও ভ্রান্ত ধারণা প্রবল হইয়া উঠিয়াছে—কাব্যকে এইদিক দিয়া দেখিলে, তাহা মুহূর্ত্তেই দূর হইতে পারে। একটা দৃষ্টান্ত দিব। অভিজাত সাহিত্য বা সাহিত্যের আভিজাত্য বলিয়া যে কথাটা কাব্যবিচারে আজকাল মাঝে মাঝে শুনিতে পাই, সে কথাটা যে কতখানি ভুল, তাহা সহজেই ধরা পড়িবে। কাব্যের উৎকর্ষ বিচারে ইহাই দেখিলে চলিবে না যে, তাহার মধ্যে Idea-র perfection বা Idealism কতখানি আছে, দেখিতে হইবে তাহাতে perfection of experience আছে কি না। যে কল্পনা কাব্যের আভিজাত্য রক্ষা করিবার জন্য জীবনের কায়াকে ত্যাগ করিয়া তাহার ছায়া লইয়া একটি সূক্ষ্ম মায়াজাল রচনা করে, সে কল্পনা কাব্যের পক্ষেও মিথ্যাচার। কাব্যবিচারে আভিজাত্য কথাটাই নিরর্থক। কাব্যে সৌন্দৰ্য্যই তাহার শুচিতা—সেই শুচিতা রক্ষা করিবার জন্য কবিকে ছুৎমার্গ অবলম্বন করিতে হয় না; কেন না, চাই perfectio of experience; তাহা যদি হয়, তবে কাব্য সুন্দর হইতে বাধ্য; সেই সৌন্দর্য্যেই তাহার শুচিতা। অপর পক্ষে, কল্পনার শুচিতা রক্ষা করিয়া যে সৌন্দর্য্যসৃষ্টি, তাহাতে Idealism-ই থাকিবে, perfection of experience না থাকাই সম্ভব, এবং তাহা উৎকৃষ্ট কাব্য হইবে না। এইরূপ বৃথা তর্কের অবসান যাহাতে হয় সেই উদ্দেশেই বর্ত্তমান প্রসঙ্গের অবতারণা—নিজে যেমন বুঝিয়াছি তেমন করিয়া বুঝাইতে হয়ত পারি না; তথাপি আশা করি, এ আলোচনা একেবারে ব্যর্থ হইবে না।