সামাজিক গলদ
“সমাজমাত্রই অতি গুরুতর বস্তু। সমাজ শাসনে পিতা, পোষণে মাতা, দুঃখে সহোদর, সুখে মিত্র।”
মুসলমান-সমাজটি একটি অতি গৌরবের বস্তু। এর ইতিহাস অপূর্ব। এর বন্ধন- প্রণালী অভিনব এবং অনন্য সাধারণ। এর আদর্শ পবিত্র এবং আভ্যন্তরিক বল এত অধিক যে যত গরীবই হোক না কেন, এর মৃত্যু অসম্ভব। এ প্রাচীন মিশরীয় আসীরীয় পারসীক গ্রীক এবং রোমীয় সমাজের কবর থেকে উঠে নূতন জন্ম নূতন দৃষ্টি ও নূতন শক্তি নিয়ে সমগ্র জগতকে মোহিত স্তম্ভিত করেছে। এর বয়স অল্প; কিন্তু “সিংহ-শাবক ক্ষুদ্র হলেও মদবিমলীন হাতীরে টানে।” তাই শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত সুসভ্য ইংরাজ লর্ড স্বেচ্ছায় মুসলমানের ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বাস্তবিক ইসলামের সাম্য এমন চমৎকার, এর practice (পালন) এত সহজ, সুন্দর ও স্বাভাবিক যে আশা করা যায় যে এমন একদিন আসবে যখন সকল মানুষই ইসলামকে বরণ ক’রে নিতে বাধ্য হবে, যেমন বাধ্য হয়েছেন গুরু নানক, রাজা রামমোহন, স্বামী দয়ানন্দ প্রভৃতি সমাজ-সংস্কারকগণ, অবশ্য তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সমাজ গঠন করেছেন। কিন্তু তাঁরা যে পথে চলতে চেয়েছেন সে পথ নির্দিষ্ট হয়েছে ইসলামের দ্বারা। এ দেশের অত্যন্ত রক্ষণশীল অতি প্রাচীন ও বিরাট হিন্দুসমাজও ইসলামের প্রভাবে অনেকখানি বিচলিত। হিন্দু সমাজের মূল-ভিত্তি জাতিভেদ আজ ইসলামের সংঘর্ষে টলটলায়মান। আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে এই জাতিভেদ চলে যাবে এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃসম্বন্ধ স্থাপিত হবে। নামের জন্য কিছু এসে যায় না। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান শিখ ব্রাহ্ম এগুলি শুধু নাম। নাম যদি বাদ দেওয়া যায় তাহলে ইসলাম কতখানি কাজ করেছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।
ভবিষ্যতে কি হবে না হবে সে ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। আপাততঃ আমরা দেখতে চাই হজরত মুহম্মদ জগতে শান্তি স্থাপনের জন্য যে পথ নির্দেশ ক’রে গিয়েছেন আমরা ঠিক সেই পথে চলছি কি না। বর্তমানে যাঁরা ইসলামের খলিফা এবং যাঁরা এই সমাজভুক্ত তাঁদের কার্য কলাপের ওপর আমাদের মুসলিম-সমাজের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। শুধু একটা delicious hope নিয়ে সুখে নিদ্রা দিলে ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা কাউকে বলে দিতে হবে না। আজকাল মুসলমান সমাজ যে রাহুগ্রস্ত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছে এ সত্য গোপন ক’রে কোনো লাভ হবে না। এ দেশে অতীতে মুসলমান- শাসনকালে যে সমস্ত অনাচার ও অত্যাচার হয়েছে তার ফল যেমন ভোগ করছি আমরা আজকাল, আমরা যদি না শোধরাই তাহলে আমাদের পরবর্তী সমাজের যে কি অবস্থা হবে তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। অতীতের অনাচারের ফলে যে আমাদের এই দুর্দশা এ কথা কেউ কেউ স্বীকার করতে নাও পারেন, কিন্তু বর্তমানের সুকৃতির ফলে যে আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে এ কথা বোধহয় কেউ অস্বীকার করবেন না।
বর্তমানে আমাদের সমাজে পিতার শাসন, মাতার পোষণ, ভ্রাতার সহানুভূতি, বন্ধুর প্রীতি এ সবের কিছুই নাই; তাই সমাজ একেবারে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দায়িত্বজ্ঞান, সততা, অর্থ ও একতা, এর কিছুই নেই। যে- সমাজে এ সমস্তের অভাব সে-সমাজ কখনো উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। শুধু যে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না তা নয়, এই জীবন-সংগ্রামের জগতে তাঁর বেঁচে থাকার আশা করা অন্যায়। এখানে যে যোগ্য সেই টিকে থাকতে পারবে, যে অযোগ্য সে টিকবে না। আমাদের সমাজকে যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই তবে আমাদের সমাজকে বেঁচে থাকার যোগ্য হতে হবে।
আমাদের যোগ্য হওয়ার কতকগুলি অন্তরায় আজকাল দেখতে পাওয়া যায়। প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমাদের শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীনতা। বাংলার মুসলমান-সমাজের বয়স নিতান্ত কম নয়; কিন্তু এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাদের মধ্যে একজন রুশো, একজন পেট্সালট্জী, একজন হারবার্ট স্পেনসার জন্মান নাই। আমাদের সমাজ একজন রাজা রামমোহন, একজন বিদ্যাসাগর, একজন বঙ্কিমচন্দ্র, একজন পিয়ারীচরণ, একজন রামতনু লাহিড়ী, একজন রাজনারায়ণ বসু কি একজন স্যার আশুতোষ তৈরি করতে পারে নি। এর একমাত্র কারণ আমরা শিক্ষা চাই না, আমরা বিদ্যা চাই না, জ্ঞানের মর্যাদা বুঝি না, সাহিত্যের আদর করি না, তাই আমাদের মধ্যে বিদ্বান্ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই, সাহিত্যিক দার্শনিক ঐতিহাসিক নাই। আমরা দান ভালবাসি তাই আমাদের মধ্যে দাতা আছে, এবং দাতা আছে বলেই ভিক্ষুকের অভাব নাই। সেইরূপ আমরা যদি শিক্ষা ভালবাসতাম তবে শিক্ষাদাতা, শিক্ষিতজন ও শিক্ষান্বেষী কোনোটির অভাব হ’ত না।
শিক্ষার আদর আমরা করি না এ কথা সত্য। শিক্ষা আমরা চাই না এ কথা আরো সত্য। উচ্চ গভর্ণমেন্টের কর্মচারী ১০০০ টাকার উপর বেতন পান; তিনি সরকারী বাড়ীতে থাকেন; তাঁর দুগ্ধপোষ্য ছেলেকে পরের বাড়ীতে রেখে দিয়েছেন; কেন না তিনি বলেন যে ছেলে যে-স্কুলে পড়ে সে স্কুল তাঁর কোয়ার্টার্স (সরকারী বাড়ি) থেকে অনেক দূরে। জন স্টুয়ার্ট মিলের পিতা কুসংসর্গ থেকে বাঁচিয়ে সুশিক্ষার জন্য ছেলেকে কখনই কাছ ছাড়া হতে দেন নাই। এই দুই পিতার নিজ নিজ সন্তানের শিক্ষার জন্য আগ্রহ তুলনা করলে কি বলা উচিত যে আমরা শিক্ষা চাই বা শিক্ষা ভালবাসি? আমাদের অভিভাবকগণ শিক্ষা সম্বন্ধে উদাসীন। তাঁদের অনেকেই বালকদের শিক্ষার জন্য কেবল স্কুল কলেজের ওপর নির্ভর ক’রেই নিশ্চিন্ত। বালিকাদের শিক্ষার কথা মনেও স্থান পায় না।
একদল অভিভাবক আছেন যাঁরা এখনও স্কুল কলেজে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সে শিক্ষার বিরুদ্ধে। তাঁরা যে কোন্ শিক্ষার স্বপক্ষে তা ঠিক ক’রে বলা কঠিন। প্রথমে তাঁরা ইংরাজী শিক্ষা কাফেরী এলেম ব’লে বর্জন করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। তাঁরা ধর্ম শিক্ষা চান। ধর্ম শিক্ষার জন্য কলকাতা, ঢাকা ইত্যাদি স্থানে মাদ্রাসা ছিল। মাদ্রাসা পাশ ক’রে পেটের অন্নের সংস্থান হয় না, তখন কি করা যায়? অধুনা নূতন ধরনের মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। এখানে ইংরাজী শিখতে বাধা নেই। তবে বেশী ইংরাজী শিখলে হয়তো গোনা হবে এরূপ ভাব মনের কোণ কাচি খুঁজলে বোধ হয় বেশ কিছু কিছু পাওয়া যাবে। যা হ’ক এই সমস্ত নূতন মাদ্রাসা থেকে পাস ক’রে আমাদের যুবকগণ জীবন-সংগ্রামে কতটুকু জয়লাভ করতে সক্ষম হবে তা এখনো বলা যায় না। তবে মোটের ওপর বোঝা যাচ্ছে যে আমরা বুদ্ধির মুক্তি চাই না। আমরা সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, দর্শন, বিজ্ঞান আর যত যা-কিছু সব বাদ দিয়ে শিক্ষাটুকু হলেই বস্ বলতে চাই। তাও কি কখনো হয়? কবি বলেছেন-
“দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?”
বুদ্ধির মুক্তি না হলে ধর্মশিক্ষা হতে পারে না। ধর্মের আদেশ ও নিষেধ পালন করার জন্য বুদ্ধির দরকার। বুদ্ধির অভাবে আজকাল আমাদের ভিতর প্ৰকৃত ধর্মভাব লোপ পেয়েছে। এখন গোঁড়ামিই আমাদের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোঁড়ামির দরুণ আমাদের অবস্থা যা হয়েছে তা ভাবলে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। কোনো কিছু বলবার জো নেই। সমাজের প্রচলিত অর্থহীন কোনো সংস্কারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে যে বলবে তাকে তখনই কাফের, জাহের, গোমরাহ, গাঁওয়ার ইত্যাদি বলা হবে। আমাদের এই গোঁড়ামির প্রধান কারণ এই যে আমরা ধর্মের সব বিধিনিষেধের কতকগুলো সহজ অর্থ ক’রে নিয়েছি। এইরূপ সহজ অর্থ করার দরুণই যে আমাদের এই দুর্দশা একথা অস্বীকার করার সময় চলে গেছে। ফলাফল চেপে বিচার করা মানুষের স্বভাব। নিরপেক্ষ চোখ দিয়ে দেখলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে অর্থহীন কঙ্কালসার সংস্কারের স্তূপ আমাদের উন্নতির পথে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না।
সহজ অর্থ করার দরুণ আমাদের ধর্মের সার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই–রসুলোল্লাহর নামে দরুদ পড়া, রসুলোল্লাহর না’আত, মিলাদ শরীফ, ঈদ-বকর ঈদের সময় কিছু ঘটা, আর বক্তৃতায় নামাজ, রোজা, হাজ্জ্ব, যাকাৎ, ফেত্রা এগুলির প্রশংসা করা। এগুলোর পিছনে যে আরো কিছু থাকতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেবার কোনো দরকার সমাজ অনুভব করতে চান না। আমাদের মানুষ হতে হবে-বলবান্, জ্ঞানবান্, বুদ্ধিমান্ মানুষ হতে হবে একথা আমাদের মনেও হয় না। নামাজ রোজা যদি অর্থশূন্য হয় তবে সে নামাজ রোজায় কতটুকু ক্ষতি বৃদ্ধি? যদি নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহো আর বলার সময় সেই “রহমানুর রহিম মালিকি ইয়াও মিদ্দিন”–এর ধারণা মনে না জাগে; যদি “মালিকি ইয়াও মিদ্দিন”–বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অপরাধের কথা মনে ক’রে ভয়ে শরীর ও মনে শিহরণ না জাগে; যদি সেই শিহরণের সঙ্গে সঙ্গে “ইয়াকানা আবোদো ওয়া ইয়াকানাস্তঈন” বলে সচকিত হয়ে সেই জীবন- স্বামীর কৃপা ভিক্ষার কথা মনে না জাগে; যদি প্রাণের গভীরতম নিকেতন থেকে “এহদেনাস সেরাতাল মোস্তাকিম” না বলতে পারি, তবে সে-নামাজের সার্থকতা কোথায়? যদি “সোবহানা রব্বেল আজীম ও সোবহানা রব্বেল আলা”র অর্থ না বুঝি তবে রুকু ও সেজদার সার্থকতা কোথায়? প্রতি ওয়াক্তে নামাজের সময় যদি নিজের দোষগুণের হিসাব না নিই, যদি অনুভব না করি যে তাঁরি সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরি কাছে আমার দুঃখ বেদনা নিবেদন করছি, নিজ কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছি; নিজের দুর্বলতা অনুভব ক’রে অনুতপ্ত হৃদয়ে যদি সেই করুণাসিন্ধুর করুণা ভিক্ষা না চাই, তবে সে-নামাজের মূল্য কতটুকু? আর যদি “ফাওয়াএলুল্লেম মোসাল্লিনাল্লাজিনা হুম আন্ সালাতিহিস সাহুন” মানে এই হয় যে দিনের মধ্যে পাঁচবার স্থানবিশেষে দাঁড়িয়ে কিছু কস্ত্রৎ কর, তাহলে সেই মহাপবিত্র মহান পয়গাম্বর হজরত রসুলেকরিম সাল্লাল্লাহো আলায়হেসালামের প্রতি ঘোর অবিচার করা হবে। নামাজের এইরূপ সহজ অর্থে গোঁড়া মুসলমান সন্তুষ্ট হতে পারে কিন্তু জগৎ সে মুসলমানকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে না। ফলেও দাঁড়িয়েছে তাই, বর্তমান জগৎ মুসলমানকে কাঁটা মনে করছে। এ দিকে এই সহজ অর্থের ফলে মুসলমান নিজেও ধর্মে কোনো স্বাদ পাচ্ছে না।
মানুষের জীবন নানা স্বাদের জন্য লালায়িত। শারীরিক বলের অধিকারী হওয়ার যেমন স্বাদ আছে, মানসিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বলের অধিকারী হওয়ায়ও ঠিক সেইরূপ বা ততোধিক স্বাদ আছে। মানুষ আপনাআপনি সে সব স্বাদ পেতে চায়। শুধু হুকুম পালনে সে স্বাদ পাওয়া যায় না–বিশেষ ক’রে যদি হাকিমকে পুরোপুরি না জানা যায় আর তাঁর গুণে পুরোপুরি মুগ্ধ হওয়া না যায়। আমাদের হজরত ১৩০০ বৎসর দূরে প’ড়ে আছেন। সমাজের নেতাদের উচিত সমাজভুক্ত জনগণকে সেই পবিত্র পয়গাম্বরের সম্যক্ পরিচয়ের সুবিধা ক’রে দেওয়া। তা না ক’রে শুধু হাওয়াই প্রশংসা সামাজিক গলদ ক’রে, আর কেতাবে আছে কোরাণে আছে পড়ে দেখ, এই সোজা পথ দেখিয়ে দিলে তারা তা মানবে কেন? সত্যকে পাবার জন্য কঠোর সাধনা, ত্যাগ, জীবনব্যাপী আবেগ, তপস্যা, জগতে শান্তি স্থাপনের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা, এসবের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সেই মহাপুরুষের জীবনে বর্তমান। নিজেদের জীবনে সেই ত্যাগ সেই সাধনা সেই তপস্যা বাদ দিয়ে যদি আমাদের সমাজের নেতারা জনগণের কাছ থেকে প্রকৃত ভক্তি আশা করেন তবে সে আশা বৃথা। আমাদের যাঁরা ধর্মগুরু হওয়ার দাবী রাখেন উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাঁদের অনেকের জীবন সুন্দর নয়; তাঁরা নিজেরা খুব সুস্থ-চিত্ত, জ্ঞানবান্, বলবান্, বুদ্ধিমান্ মানুষ নন। তাঁদের মুখের কথার দামও তাই খুব বেশী নয়। নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মৌলভী মৌলানারা জনগণের উপযুক্ত আহার যোগাতে পারছেন না। ফলে ধর্মের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জন্মাচ্ছে না। আমাদের মধ্যে অনেক স্থলেই নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকটা একেবারে লোপ পেতে বসেছে। এসব দিকে স্বাদ পাবার সুবিধা ও সুযোগ না পেয়ে পাশবিক ধর্ম পালন ক’রে স্বাদ মিটাতে হচ্ছে। মানুষ স্বাদ মিটাতে বাধ্য।
অনেক সময় দেখা যায় যে আমাদের অনেকেরই বেলায় জীবনে নীতি বা শ্লীলতা বলে যে জিনিষটা তার অনেকখানি অভাব। “আদিম দিনে নারী ছিল তাহার (পুরুষের) প্রথম ও প্রধান সম্পত্তি, তাহার ইন্দ্রিয়-ক্ষুধার খাদ্য, তাহার পরিশ্রম করার যন্ত্র, তাহার বাণিজ্যের জন্য তাহার আদান প্রদানের শ্রেষ্ঠ উপহার।” যদি আপনারা অনুমতি করেন তবে আমি বলতে চাই যে আমাদের সমাজ সেই আদিম দিনের অবস্থায় উপনীত হয়েছে। অনেক স্থলে দেখা যায় যে আমাদের মধ্যে ও পশুর মধ্যে মূলতঃ কোনো পার্থক্যই নাই। পশুর মতো কেবলমাত্র আহার নিদ্রা ও আর একটা ব্যাপারই হচ্ছে আমাদের কার্য এবং শুধু বংশ-বিস্তারই আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র সার্থকতা। খবরের কাগজে যে সমস্ত অনাচারের কথায় জগতের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হচ্ছে সেগুলো বাদ দিলেও অনেক সম্ভ্রান্ত ও অর্ধ-সম্ভ্রান্ত পরিবারেও এ কথা অনেকখানি সত্য। বিনা কারণে দুই তিন চার বিবাহও অনেক স্থলেই দেখতে পাওয়া যায়।
পশু-প্ৰকৃতি এত প্রবল হয়েছে যে অনেক সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতিবেশী সমাজের পতিতা নারীদের ‘কলমা’ ক’রে নিয়ে আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এই সব ভ্রষ্টচরিত্র পতিতা নারীরা কি কখনো বলবান্, জ্ঞানবান্, বুদ্ধিমান্, চরিত্রবান্ সন্তানের জননী হতে পারে? তবে কেন সমাজ এর জন্য লালায়িত? আমার মনে হয় ভ্রষ্ট-চরিত্র নরনারীদের বাইরে থেকে এনে আমাদের সমাজের বোঝা বাড়ানোর মতো শক্তি বর্তমানে আমাদের নাই। সমাজে যারা আছে তাদের হেদায়েত করা, প্রথমে নিজের ঘর সামলানো, সমাজের প্রধান কর্তব্য। অবশ্য যদি কেউ আশ্রয় চায় ইসলাম এত নির্মম নয় যে আশ্রয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করবে।
আমাদের মধ্যকার আজকালকার পীর সাহেবদের সম্বন্ধেও নানা কথা কানে আসে। এ সম্বন্ধে দুঃখ নিবেদন ক’রে সহানুভূতি পাবার আশা কম। পীর সাহেবদের বদ-দোয়া, তাঁর বংশধরগণের লাআনৎ, সমাজের অন্যান্য জনগণের অভিশাপ এগুলো তো আছেই। তার উপর আবার কথা হচ্ছে যে আমরা দুর্বল মানুষ, পদে পদে ভুল, পদে পদে বিপদ তো লেগেই আছে। যখনই একটা বিপদ এসে উপস্থিত হবে তখনই সমাজ বলবে এবং বিশ্বাস করবে যে পীরের বদ-দোয়াতেই এরূপ হয়েছে। সমাজের কার্য-কারণ সম্বন্ধজ্ঞানহীন জনগণের ভক্তি ক্রমেই বেড়ে যাবে। এই ভয়েও পীর সাহেবদের বিরুদ্ধে কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও বলতে বাধা বোধ হয়। আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান পীর সাহেবরা এবং তাঁদের আল-আওলাদরা সমাজকে উন্নতির পথ দেখান তো দূরের কথা, জলে ডুবাতে যে বসেছেন, সে-কথা ভাবতে চোখে জল আসে না এমন নির্বোধ জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাবে শুধু আমাদের এই বাংলার মুসলিম-সমাজে।
অবশ্য পীর ফকীর ও’লি দরবেশেরও ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা জগতে ইসলামের যতগুলি দান তার অন্যতম। এ জিনিষটা কাজে লাগাতে পারলে খুবই ভালো। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রকৃত শাসন না থাকার দরুণ আমরা পীর ফকীরকে যাঁচিয়ে নিতে পারছি না। তাই অনেক মেকী চলে যাচ্ছে। বুদ্ধির মুক্তি হলে এ সব মেকী সহজেই ধরা পড়বে। অনাচার অত্যাচার ব্যভিচারের উপযুক্ত শাসন তখন সম্ভবপর হবে।
ধর্ম সম্বন্ধে মোটের উপর আমার বক্তব্য এই যে আমাদের প্রিয় পয়গাম্বর হজরত রসুলে করিম সাল্লাল্লাহো আলায়হেস্ সালাম ধর্মের যে এমারৎ রচনা ক’রে গিয়েছেন তা আমরা ভেঙে চুরমার ক’রে দিয়েছি। তিনি পুতুল ভেঙে যে নিরাকার অথচ চেতনশক্তি আল্লাহ্তাআলার পূজা করতে বলছেন তা আমরা ভুলে গিয়েছি। এখন আমরা আবার কতকগুলো অনুশাসনরূপী অর্থহীন পাষাণ প্রতিমার পূজায় নিযুক্ত। এরূপভাবে আমাদের দুর্দশা ঘুচবে না এবং ইসলামকে জীবন্ত রাখতে পারব না। ইসলামকে জীবন্ত রাখার জন্য আমাদের সমাজে যে যে গোঁড়ামি ঢুকেছে তা সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
একতাই হচ্ছে সমাজের বন্ধন। ইসলামের একতা ভ্রাতৃভাবের উপর নির্ভর করে। আমরা বলি আমরা সকলেই বাবা আদম ও হাওয়া মা-র বংশধর। কিন্তু আজকাল আমাদের ভিতরে জাতিভেদ এসে ঢুকেছে। এটিই সমাজের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। আমাদের ভিতরে একতার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে বংশের বড়াই। যে ভ্রাতৃত্বের উপর নির্ভর ক’রে মুসলমান সমাজ সমস্ত জগতকে মুগ্ধ স্তম্ভিত ও দিশাহারা করেছিল সে ভ্রাতৃভাব আজ আমাদের মধ্যে নাই। ভারতবর্ষে এসেই শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান এই চার বর্ণের পরিচয় তো পাওয়া গিয়েছিলই। এখন তো দেখা যায় হাজার রকমের পদবী, –আতরাফ, আশরাফ, শরীফ, রাজীল, সৈয়দ, খোন্দকার, কাজী, মোল্লা, মুফতী, মুনশী, শাহ, পীর, সিদ্দিকী, হুমায়নী, হাশেমী, ফারুকী, সরদার, জোৎদার, বিশ্বাস, গোলদার, মণ্ডল, দফাদার আরো কত কী তার অন্ত নাই। দুই বাহু বিস্তার ক’রে পরম আবেগে ভাই মুসলমান বলে যাদের শাহান্ শাহ্ বাদশাহ্ বুকে বুকে ভিক্ষুকের সঙ্গে আলিঙ্গন দিয়েছেন সেই মুসলমান আমরা বলি কিনা, ওরা আতরাফ আমরা আশরাফ, আমরা শরীফ আর ওরা রাজীল। গোলামের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দেওয়ার মতো উদারতা যে জাতির রাজাদের ছিল, যে জাতি যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে বিজাতীয়ের কন্যাকে রাজরাণীত্বে বরণ ক’রে নিয়েছে আজ অধঃপতনের দিনে তাদের মধ্যে এত সঙ্কীর্ণতা ঢুকেছে এ দেখে না জানি সেই মানব প্রেমিক পবিত্র পয়গাম্বর কত আফসোস করছেন। অবশ্য আমি মানি যে পরিচয়ের জন্য কিছু তারতম্যের দরকার হতে পারে, কিন্তু তাই বলে মানুষ মানুষকে ঘৃণার চক্ষে দেখবে, হেকারৎ করবে এ আমার বুদ্ধির বাইরে। এ সম্বন্ধে বেশী আলোচনা করতে ইচ্ছা নাই। কারণ সংস্কার এত দৃঢ় হয়ে আছে যে যত কিছু বলা হ’ক না কেন উপযুক্ত শিক্ষা না পেলে এ সংস্কার থেকে মুক্তি পাবার ভরসা করা বিড়ম্বনা মাত্র।
ভ্রাতৃভাবের অভাবের দরুণ পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহানুভূতির অভাব হয়েছে। দ্বেষ হিংসায় সমাজ ক্রমেই অবনতির দিকে চলেছে। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা concession বা সরকারের দান বা অনুগ্রহের উপর। পরের দয়ার দানে প্রকৃত শক্তি অর্জন সম্ভবপর হবে না। পরে কতটুকু দিতে পারে! আর তাতে কি পেট ভরে? আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলতে চান যে অবস্থা অনুসারে কিছু special treatment বা বিশেষ ব্যবস্থা দরকার; না হলে চলে না। এমন চলা আমার মতে না চলা অপেক্ষা লজ্জাকর। বহুকাল ধরে তো আমরা concession করছি। পেয়ে ওছি তা কিছু কিছু; কিন্তু অগ্রসর হয়েছি কতটুকু? সরকারের দয়ার (concession) আশায় প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমাদের মধ্যে একদম নাই; থাকতে পারে না। যাদের কনসেশনের দিকে দৃষ্টি তাদের আত্মসম্মান-জ্ঞান জন্মাতে পারে না। যাদের আত্মসম্মান-জ্ঞান নাই তারা পর প্রত্যাশী হতে বাধ্য। পর প্রত্যাশীর অন্য নাম ভিক্ষুক। ভিক্ষুক সমাজের লজ্জা, সমাজের বোঝা, উন্নতির কাঁটা। ধনী আত্মীয়ের উপর উদরানের জন্য নির্ভর করা যেমন ভিক্ষাবৃত্তিরই নামান্তর, সরকারের দিকে কনসেশনের (দয়ার) জন্য তাকিয়ে থাকাও সেইরূপ ভিক্ষুকতা। আমাদের বিদ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমশীলতা কোনোরূপ যোগ্যতা নাই বরং এ সমস্ত বিষয়ে অন্যের চাইতে কম, অথচ সরকারের দয়ার উপর নির্ভর ক’রে শতকরা ৮০ জনের চাকুরী চাই এ ভাবটা যত শীগগির আমাদের মধ্য থেকে দূর করা যায় ততই আমাদের মঙ্গল, প্রতিবেশীর মঙ্গল, জগতের মঙ্গল। নচেৎ আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকব। জগত অঙ্গুলি নির্দেশ ক’রে বলছে ও বলবে–ঐ যে সব ভিক্ষুকের দল।
আমাদের কেউ কেউ বলবেন, চাকুরী ভিন্ন উপায় কি? বেশ তো, চাকুরী যদি আমরা চাই তবে উপযুক্ত হয়েই চাই না কেন? উপযুক্ত হওয়ায় আপত্তি কেন? এইরূপ কনসেশন পেয়ে আমাদের মধ্যে যাঁরা চাকুরী পেয়েছেন তাদের অনেককেই দেখা যায় যে তাঁরা হীনবীর্য খোশামুদে বা cipher হয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। তাঁদের ভিতরের দারিদ্র্য ঢাকার জন্য বাইরের আড়ম্বর পোষাক পরিচ্ছদ আহার বিহারের ঘটায় তাঁদের টাকা পয়সা উড়ে যায়। নিজেরা অযোগ্য, ঘরে ও বাইরে তাঁদের সন্তান- সন্ততিরও উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা নাই। ফলে দাঁড়াচ্ছে, এক পুরুষ দুই পুরুষেই সব উন্নতি খতম। ঘরের খুঁটি না থাকলে প্যালা দিয়ে কতকাল ঝড় থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়? ও সব কনসেশনে আমাদের মুক্তি নাই। আমাদের নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে শিখতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, কিছু টাকা পয়সা না হ’লে স্কুলে কলেজে পড়ান যায় না। ছেলে মেয়ে কি ক’রে মানুষ করা যাবে? কিন্তু মানুষ যে হতে চাইবে তাকে কেউ রুখতে পারে না। বিদ্যাসাগরকে কে রুখেছিল? নবীন সেনকে কে রুখেছিল?
চাকুরী ভিন্ন অন্য উপায়ের দিকে দৃষ্টি দেবার সময় এসেছে। চাকুরী কটা আর কজনে পাবে? অন্য উপায় আছেও যথেষ্ট। চাষবাস, ব্যবসা, বাণিজ্য কি আমাদের ভরণপোষণের উপায় ক’রে দিতে পারে না? এই সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বঙ্গভূমির ক্রোড়ে বসে বঙ্গমাতার স্তন্য পীযূষ অবহেলা ক’রে মেলিন্স্ ফুড (Mellins food) খেয়ে স্বাস্থ্যরক্ষার আশা কি উচিত, না সম্ভব? ব্যবসায় বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিদেশী মাড়োয়ারী, সূরতী, পার্শী, ইত্যাদি বড় বড় সওদাগরেরা যদি এদেশে ঐ পথ অবলম্বন ক’রে ক্রোড়পতি হয়ে বহু বি-এ, বি-এসসি, এম-এ, এম-এসসি-কে চাকর নকর ক’রে রাখতে পারে, তবে আমরা কেন পারি না? আমাদের সমাজে হাফেজ মোহাম্মদ হুসেন সাহেবের মতো আরো ঢের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। এসব দিকে আমরা যেতে চাই না, কারণ আমাদের দৃষ্টি রয়েছে ঐ কনসেশনের দিকে। যতদিন কনসেশনের মোহ না কাটবে, ততদিন আমরা এদিকে কৃতকার্য হতে পারব না। যেদিন ঐ মোহ কেটে যাবে সেই দিনই আমরা বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে উন্মুক্ত গগনের মুক্ত আলোকে দেখব যে, মাতা বসুন্ধরা মোটেই কাঙালিনী নন, মোটেই কৃপণা নন। স্বাধীন চেষ্টা করলেই বুঝতে পারব, সৃষ্টিকর্তা আমাদের কিছুই কম ক’রে দেন নি; আর তখন আমাদের মাথা হাত পা চক্ষু কর্ণ সকলেই আমাদের সাহায্য করবে; উপায় আপনিই এসে হাজির হবে। তখনই আমরা “ইন্না আতয়না কাল কাওসার” কোরাণ শরীফের এই মহাবাণীর প্রকৃত সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারব।
অবশ্য যদি দু’এক জন লোক নূতন পথে চলেন এবং সমাজ তাদের গতি-বিধি সম্বন্ধে সহানুভূতি না দেখায় তা হলে এই দু’একজনকে হয়তো হাবুডুবু খেতে হবে; হয়তো তাঁরা সফলকাম হতে পারবেন না। তাঁদের সফলতার জন্য সমাজের সাহায্য এবং উৎসাহ একান্ত দরকার। সমাজে একতা ও ভ্রাতৃভাব না থাকলে সে উৎসাহ অসম্ভব।
আমাদের প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের প্রতি বিদ্বেষ আমাদের সমাজের আর একটি গলদ। প্রতিবেশীর সহিত শত্রুতা করা কোনোও মতে উচিত নয়। ইসলাম জগতে শান্তির বার্তা বহন ক’রে আনার দাবী করে। কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করলে শান্তি স্থাপন করা যায় না। তা ছাড়া হিন্দু মানুষ। হিন্দুকে ভালবাসতে শিখতে হবে। মানুষকে ভালবাসতে না শিখলে মানুষের উপকার করা যায় না। আর হিন্দুরা নিজেদের মধ্যে একরূপ সুখে শান্তিতেই আছে বলে মনে হয়, তাই বলে তাদের দুঃখ দারিদ্র্য আমাদের চেয়ে কিছু কম নয়। তাদের হিংসা ক’রে আমাদের নিজেদের শক্তিক্ষয় ভিন্ন অন্য কোনো লাভ হবে না।
আপাততঃ ধর্মান্ধ মুসলমান মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে যে অশান্তির সৃষ্টি করেছেন তা কখনই প্রশংসনীয় নয়। এদেশে মুসলমান বাদশারা নিজেদের প্রাসাদেও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন, মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? আমাদের নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধা হয় এতে, কিন্তু এতে আমাদের গোনাহ্ হবে একথা আমি স্বীকার করতে রাজী নই। হিন্দুরা বাজনা বাজাবে, আমরা তো বাজাব না? তাদের সবিনয়ে অনুরোধ করা গেল তারা যদি না শুনে তাতে আমাদের কেন গোনাহ্ হবে? যদি কেউ বলেন, তাতেও আমাদের গোনাহ্ হবে তবে তাঁদের কাছে আমি সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি, কি করতে বলেন তারা এর জন্য? এর জন্য কি সব মুসলমানের জান দিতে হবে? যদি তাই হয় তবে তার জন্য কি সকলেই প্রস্তুত? আর এর জন্য জান দিতে যাওয়াটা কি প্রকৃত পক্ষে উচিত? তাছাড়া যেটা কাজে পরিণত করা হবে না সেটা বলে শুধু গোঁড়ামির পরিচয় দেওয়ার সার্থকতা কি? এই লড়াইয়ে যে সব মুসলমান অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে তাদের পরিবারের অবস্থা কি? আর যেসব গরীব মুসলমান কাঁথা কাপড় বিক্রি ক’রে স্ত্রী পুত্রের মুখের অন্ন বন্ধ ক’রে টাকা পয়সার শ্রাদ্ধ ক’রে জেলের হাত এড়িয়ে সপরিবারে অনাহারে মরতে বসেছে তাদের অবস্থা কি তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
গান বাদ্য আমরা বলছি আমাদের ধর্ম-বিরুদ্ধ; কাজের বেলায় কি আমরা তা মানছি? যাত্রা, থিয়েটার বায়োস্কোপ, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ধর্ম-বিরুদ্ধ ব্যাপারে মুসলমানরা কি কম ভিড় করেছেন? শিক্ষিত মুসলমান পরিবারের মধ্যে এমন ক’টি আছে যেখানে হারমোনিয়াম গ্রামোফন কখনও শোনা হয় নি, সেতার বা এসরাজ নিয়ে গান বাজনা হয় নি? নাই বললে মোটেই বেশী বলা হয় না। তা হলে এ গান বাজনায় এত আপত্তি কেন? যারা নিজেরা চুরি করে তারা পরকে চুরি করতে নিষেধ করলে শোনায় কেমন? আর এ নিষেধের মূল্য কতটুকু? মুসলমান যদি গান বাজনা হারাম করত তা হলে মসজিদের সামনে বাজনা বন্ধ করার যে দাবী আমরা করতে চাচ্ছি সে দাবীর জোর বেশী হত–না এখন বেশী? মুসলমান নিজের বাড়িতে বাজনা বাজাচ্ছেন, অনেকেই নানারূপ গোনাহ্ কাজে সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, সে সম্বন্ধে সমাজ একেবারে চুপ, কিছু বলছে না; অথচ অন্য ধর্মাবলম্বী লোক তাদের ধর্মপালন করবে তাতে আমাদের আপত্তি! যাঁরা বাজনা বাজানোতে আপত্তি করছেন বা দেখছেন তাঁদের দৃষ্টি হার-জিতের দিকে, কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত “ইন্নাল্লাহা লা-ইয়োহেবুল মোফসিদীন।”
আমাদের অনেকে মনে করেছেন, হিন্দুরা আমাদের গরু কোরবানীতে আপত্তি ক’রে অনেকস্থানে জয়ী হয়েছে। এখন যদি তারা তাদের বাজনা বাজিয়ে যায় তাহলে ক্রমে ক্রমে সর্ব বিষয়ে ওদের কাছে আমাদের হেরে যেতে হবে; শেষে মুসলমান- সমাজ একেবারে বিলুপ্ত হবে। আমাদের গোঁড়ামির দরুণ আমাদের অবস্থা যা হয়েছে তাতে বিলুপ্ত হতে কতটুকু বাকী ঠিক করা দায়। অবশ্য যদি এ সমাজ বিলুপ্ত হবার উপযুক্ত হয় তবে বিলুপ্ত হওয়াই যে জগতের মঙ্গল!
আমাদের সমাজের পুরুষেরা অযোগ্য অক্ষম কনসেশন-প্রত্যাশী, পরমুখাপেক্ষী। মেয়েরাও তেমনি অশিক্ষিতা, বিলাসিনী, গৃহিণীপনায় অপটু। সংসারে সর্ববিভাগে সুবন্দোবস্তের অভাব, সময়মত স্নান, সময়মত আহার অসম্ভব; ঘর দোর বিছানা বালিশ সব নোংরা, কাপড় জামার অযত্ন, টাকা পয়সা কোনো কিছুতে বরকত নাই, চারিদিকে বিশৃঙ্খলা; এক একটি পরিবার যেন এক একটি জমাট নিরানন্দের পাহাড়। হাড়ভাঙা মেহনত ক’রে বুকের রক্ত জল ক’রে অর্থ উপার্জন করে পুরুষ। সেই অর্থের যদি সদ্ব্যবহার না হয় তাহলে মানুষের শরীর মেজাজ চরিত্র কেমন হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ দিকে ছেলেপিলেরা শাসন মানে না, তাদের চাকরবাকরের হাওয়ালা ক’রে দেওয়া হয়; গরীব হলে তো কথাই নাই–বাড়ী থেকে দূর ক’রে দেওয়া হয়। রাস্তার এই সব ছেলেপিলেরা শোনে ও শেখে সহধর্মী বালকগণের মধুর গীত ঝঙ্কার, যাতে তারা কারও মা বোনকে পর্যন্ত বাদ দেয় না, স্থলচর জলচর সকল জন্তুর সঙ্গে সম্বন্ধ পাতিয়ে দেয়।
এই সমস্ত ছেলেদের আর শাসনে আনা যায় না। অবশ্য মারের ভয়ে তারা সামনে বেশ জড়সড় লেহায-তমীজ-দোরস্ত, কিন্তু পড়াশুনার বেলায় একেবারে উল্টা। বাবা গালি দেন ‘যেমন মা তেমনি ছা’; মা বলেন ‘ও ওদের রক্তের গুণ’। ঝগড়া-ঝাটি কথা- কাটাকাটিতে সময় কেটে যায়, বাড়ীতে সবার মেজাজ রুক্ষ। ছেলেপিলেদের ভালবেসে আদর যত্ন ক’রে পড়ানোর চেষ্টা হয় না। তারাও মা বাপের উগ্র চেহারা দেখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। দু একদিন হয়তো বাবা বসলেন ছেলেদের নিয়ে পড়াতে। ছেলে পড়াশুনা কিছু হয়তো বলতে পারলে না, আর অমনি প্রহার! এত মার মুসলমান ছেলেরা খায় যে তা ভাবলে তাদের জীবনটা যে চোর ডাকাতের (crimi- nal) জীবনের মতো হবে না এ আশা করা অন্যায়। সন্তানের প্রতি এমন নির্মম ব্যবহার অন্য কোনো জাতের লোকে করে বলে আমার ধারণা নাই। এ নির্মমতা আবার ব্যাপক হয়ে পড়ে। যে স্ত্রী পুত্র পরিবারকে ভালবাসতে পারে না সে কাকেও ভালবাসতে পারে না। তাই সহিষ্ণুতা প্রেম প্রীতি সবই হারিয়ে বসে সে। দেখতে পাওয়া যায় মতের একটু বিরুদ্ধে একটা কথা কেউ বললেই অমনিই সে হিন্দু-ঘেঁষা, নয়ত আতরাফ বা রজীল কওমের লোক, নয়ত একদম জাহেল ইত্যাদি গালিতে যদি সে না শোধরায় তা হলে সে একেবারে কাফের। সামান্য মতের বিরুদ্ধে কথা বললে সাত পুরুষের সম্পর্ক ভুলে যাই। যাদের প্রাণে ভালবাসার এত অভাব তারা কেমন ক’রে বড় বা ভালো হবে!
ছেলেপিলেকে লেখাপড়া শেখাতে হলে তাদের ভালবেসে শিক্ষা দিতে হবে; তাদের কিছু স্বাধীনতাও দরকার। সমাজেও স্বাধীনতা দরকার। নিজের জন্য নিজের ভাববার অধিকার মানুষকে দিতে হবে। বুদ্ধির মুক্তির দরকার। কেবল বিধি-নিষেধের স্তূপের চাপে কাহিল থাকলে বুদ্ধির মুক্তির সম্ভাবনা নাই। কেবল Authority র দোহাই দিয়ে বা কেতাবের উপর নির্ভর ক’রে চললে আমাদের উন্নতি হবে না। আমি অবশ্য বলছি না যে কেতাব অমান্য করতে হবে। আমি বলতে চাই, কেতাব পড়ে তার অর্থ বা’র করতে হবে। অর্থ মানে সহজ অর্থ নয়। আমার নিজের জীবনের মধ্যে কেতাবের বাণীর অর্থ খুঁজতে হবে। এটুকু স্বাধীনতা দিতে হবে। সমাজকে তা সহ্য করার মতো উদারতা (Toleration) শিখতে হবে। না হলে ফল এই দাঁড়াবে যে আমরা মিথ্যাবাদী বা কপটচারী হব, অথবা সমাজচ্যুত হব। সমাজচ্যুত হওয়া বরং ভালো তবু মিথ্যাবাদী বা কপটচারী হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু এইরূপ এক একজন ক’রে যদি বাদ দেওয়া যায় তবে সমাজ থাকবে না। কেউ কেউ বলবেন যে ওরূপ একগুঁয়ে ২/৪ জন লোক সমাজচ্যুত হলে সমাজের কিছুই এসে যায় না। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। ক্রোড়পতিও পথের কাঙাল হয়, বাদশাদের বংশধরেরাও ভিক্ষুক (কনসেশন-প্রত্যাশী) হতে বাধ্য হয়েছে। বাস্তবিকই মুসলমান-সমাজ এইরূপ ক’রে অনেকখানি দুর্বল হয়েছে। এক সময় জাস্টিস আমীর আলী কাফের আখ্যা পেয়েছিলেন এবং সমাজ থেকে তিনি দূরে দূরে বাস করেছেন। এইরূপ আরো ছোট বড় অনেকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যারা সমাজকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। সমাজের বন্ধন অনেকখানি শিথিল হয়ে পড়েছে। শিয়া সুন্নির ঝগড়ায় এবং সমস্ত বঙ্গদেশ জুড়ে হানাফী ও মোহাম্মদীদের লজ্জাকর ঝগড়ায় সারা সমাজটা অতিশয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাতের পাঁচটি আঙুল সমান নয় তবু সর্ব কর্মে দেখতে পাওয়া যায় তাদের ভিতর কি চমৎকার মিল। যে কোনও কাজে সবাই মিলে একে অন্যের সাহায্য করছে এবং প্রত্যেকটি আঙুলের অস্তিত্বের সার্থকতা ফুটে উঠছে যেমন অন্যের সঙ্গে সহযোগিতায় তেমনই তার আপন আপন কাজেও। মানুষের বেলায়ও ঐ রূপ পাঁচ জনের পাঁচটা মত সহ্য ক’রে নিতে হবে। এরই নাম toleration। এই toleration এর অভাবেই আমাদের বন্ধুত্ব ভ্রাতৃত্ব নাই। একে অন্যের সাহায্য করতে কমই দেখতে পাওয়া যায়। একে অন্যের জন্য ভাবে না। মোটের উপর আমাদের চাল-চলন রীতি-নীতি দেখে আমাদের সমাজকে একটি সমাজ বলতে ইচ্ছা হয় না। সমাজ বলতে যে বন্ধন বোঝা যায়, যে বন্ধন ব্যক্তিকে ব্যক্তির সঙ্গে বাঁধে, সে বন্ধন নাই। আমাদের সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেকের চাইতে অনেকখানি দূরে। আত্মীয়তা নিকটসম্বন্ধ নাই। এখানে ঢাকায় দেখি যুনিভার্সিটীর প্রফেসারেরা তাঁদের ছাত্রদের সঙ্গে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। শিক্ষক-ছাত্রে যদি এতখানি আত্মীয়তার অভাব থাকে সেখানে যুবকগণের কাছে কি আশা করা যায়?
আমাদের সমাজের গলদ সমূহের কথা যখন মনে হয়, যখন কনসেশনের কথা ভাবি, যখন শাদী নেকাহ্ পোলাও কোর্মা আর শারাফতের কথা শুনি; খবরের কাগজে নারীর উপর অত্যাচারের কথা চোখে পড়ে; মসজিদের সামনে বাজান নিয়ে খুন খারাবাতের দৃশ্য মনে পড়ে; তখন মনে মনে লজ্জিত হই। এসব কথা মনে হলে বলি, ইসলাম যে শান্তির জন্য লালায়িত বলে দাবী করে সে-দাবী আল্লাহর দরবারে গ্রাহ্য হবে কি না জানি না তবে মানবসমাজের দরবারে যে তা সন্দেহ করা হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
সব হারিয়ে আমরা এখন চাচ্ছি লাঠি ছোরা তরবারি ও সরকারের দয়ার দানের সাহায্যে জিততে। লাঠি ছোরা তরবারি এমনকি গোলাগুলির সাহায্যে যে-জয় সে টেকে না একথা আমাদের (মুসলমানদের) অনেক পূর্বে বোঝা উচিত ছিল। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যায় যে মুসলমান এ সবের কোনোটা বাদ দেয় নাই। বাদশাহদের হুকুমে দেশে দেশে রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে; আর্তের আর্তনাদে গগনমণ্ডল প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু কৈ সে প্রতাপ? কোথায় আজ সেই হীরামুক্তা মণি-মাণিক্যের ঘটা; কোথায় আজ সেই দিল্লীশ্বরোবা জগদীশ্বরোবা!
“রাজ্য তার স্বপ্ন সম গেছে ছুটে,
সিংহাসন গেছে টুটে।
সব সৈন্যদল
যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল
তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে
উড়ে যায় দিল্লীর পথের ধুলি ‘পরে।
বন্দীরা গাহে না গান,
যমুনা কল্লোল সাথে নহবৎ মিলায় না তান;
পুর-সুন্দরীর নূপুর-নিক্কন
ভগ্ন প্রাসাদের কোণে
মরে গিয়ে ঝিল্লীস্বনে
কাঁদায় রে নিশার গগন”
এই ত হয়েছে; এর পর আরো কি হবে তা জানেন তিনি যিনি “আলেমুল গায়েব রাব্বিল আলামীন মালিকি ইয়াওমিদ্দীন”।
তাই বলি, যদি থাকে প্রাণ তবে আসুন আমরা সবাই একবার সমাজকে বলি :
ওরে তুই ওঠ আজি
আগুন লেগেছে কোথা!