আমাদের দুঃখ
হিন্দু মুসলমানকে আপন মনে করে না; মানুষের সঙ্গে মানুষের যা কিছু বন্ধন সব ভুলে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকে না। মুসলমানের সামান্য ত্রুটিও ক্ষমা করতে সে নারাজ! সামান্য মতের মিলের অভাব হলেই দেশ-কাল-পাত্র সমস্তই অগ্রাহ্য করে। মুসলমানও হিন্দুকে আপন মনে করে না। মুসলমান মনে করে, হিন্দুকে জব্দ করাই তার ধর্ম। মুসলমান মনে করে, যদি দেশ স্বরাজ পায় হিন্দুরা এখন সব বড় ও প্রবল, কাজে কাজেই তারা আর মুসলমানদের রাখবে না। হাতে না মারুক ভাতে মারবে এবং ইসলাম এদেশ থেকে চলে যাবে; মুসলমানদের মধ্যে যাদের ধর্মের প্রতি ভক্তি ও মমতা কম, তারা হিন্দু হয়ে হিন্দুর একটি নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হবে; আর যারা ইসলামের সুসন্তান ও ইসলামকে প্রাণের অধিক ভালোবাসে তারা না খেয়ে ম’রে যাবে বা হিজ্রাত করতে বাধ্য হবে। অতএব এমন সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ভারতভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার চেয়ে কোনোও প্রকারে যেমন অবস্থায় আছি তাই ভালো। গবর্ণমেন্টের কৃপার ওপর নির্ভর করা ও Communal Representationটা যেন বজায় থাকে তার জন্য চেষ্টা ও আন্দোলন করলেই যথেষ্ট। এই দুটা জিনিসের বলে যা হয় কিছু চাকরি বাকরি পাওয়া যাচ্ছে, সপ্ত পুরুষের ভিটার চেরাগটা অন্ততঃ জ্বলছে। যেমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে স্বরাজ-ফরাজ ফেসাদে কাজ কী!
মুসলমানদের মধ্যে আবার যারা একটু মাথাভাঙা গোছের তারা মনে করছে হিন্দুরা কিছু না। ওরা একটু লেখাপড়া শিখেছে বটে কিন্তু ভেতরে ওরা অন্তঃসারশূন্য, ওদের আচার আছে বটে কিন্তু বিচার মোটেই নাই। মানুষকে ওরা ভালোবাসতে জানে না। শুধু কথার জোরে ওরা বড় হতে চায়, কিন্তু মোটের উপর ওরা সব কাপুরুষ, একবার স্বরাজ পেলেই ওদের সব ঠিক ক’রে দেওয়া যাবে। ওদের সব ভয় দেখিয়ে, চোখ রাঙিয়ে এবং দরকার হ’লে ঠেঙিয়েই সোজা করা যাবে। সব মুসলমান ক’রে নেওয়া যাবে। তখন আর ভাবনা কী?
হিন্দুরা সংখ্যায় বেশী এবং তারা এ দেশটাকে তাদেরই দেশ মনে করে। তাদের ভিতরকার যারা নেতা তাদের একদল মনে করছে, তাই তো, মুসলমানদের জ্বালায় তো আর কিছুই করা যাবে না। তারা সব ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে, এ যে বড় আপদ! এরা এদেশে আসা অবধি হিন্দুদের উপর নানারূপ জুলুম করেছে। শেষটায় রাজত্ব হারিয়েও যে একটু নরম হবে তাও হবে না। এখনও সেই নবাবী চাল, নবাবী মেজাজ, কর্তৃত্বের নেশা এদের মধ্যে ষোল আনা বিদ্যমান। বিদ্যা ধর্ম থাক বা না থাক এরা শতকরা ৮০ জন সর্দার হবেই–তা উপযুক্ত না হলেও সে সর্দারী তারা চাইছে। সর্দার হওয়াতে তো আপত্তি নাই; তবে দেশের কাজ যে তাদের দ্বারা ভালো চলবে না। তা যাই হ’ক এদের সঙ্গে একটা রফা ক’রে নেওয়া যাক। সবাই মিলে স্বরাজের চেষ্টা ক’রে যদি দেশে স্বরাজ পাওয়া যায় তার পরে যা হয় একটা কিছু হবে।
হিন্দুদের আর একদল মনে করছে চিরকাল ধরে মুসলমান মন্দির ভেঙেছে, মূর্তি ভেঙেছে, নারীর উপর জুলুম করেছে, আবার এখনও ছাড়ছে না। তা কতকাল আর ওদের অত্যাচার সহ্য করা যাবে। যখন রাজা ছিল তখন না হয় স’য়েছি। এখন তো আর ওরা রাজা নয়, তাছাড়া শিক্ষায় দীক্ষায় সর্ব বিষয়েই ওরা হীন, এমন কি সংখ্যায়ও কম। শুধু গুণ্ডামির জোরেই ওরা জিতে যাবে সে হবে না। আমরাও গুণ্ডা হবো আর ওদের সমূলে বিনাশ করেই দেশের মঙ্গল সাধন করব।
দেশের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের এই যে মনের ভাব–এ ভাবটা কোনোদিন যাবে কিনা তা ঠিক বলা যায় না। তবে এমন ক’রে যে স্বরাজ পাওয়া শক্ত তা সকলেই বুঝছেন। এর প্রতিকার কোথায়?
হিন্দু-মুসলমান উভয়েই বেশ গরিব। মুসলমান হিন্দুকে যতো বড় মনে করছে হিন্দু আদৌ তত বড় নয়। হিন্দু তার “চোখা চোখা বাক্যবাণ” দিয়ে “সগোষ্ঠী লাটসাহেবকে ক্ষতবিক্ষত” ক’রে তুলতে পারে কিন্তু এই বাক্যবাণ আর তত্ত্ব তাদের নিজেদেরও যথেষ্ট ক্ষতবিক্ষত ও কাবু ক’রে রেখেছে। তাছাড়া হিন্দুদের ভিতরে যে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত আছে সেটা হিন্দুদের বড় নাকাল ক’রে রেখেছে। ওখানটা এমন একটা সমস্যা যার মীমাংসা শুধু কঠিন নয়। অসম্ভবের কাছাকাছি। হিন্দুর ব্রাহ্মণ জগতের একটি শ্রেষ্ঠ জাতি। আচার ব্যবহার রীতিনীতিতে ব্রাহ্মণ মানুষের মধ্যে একটি বড় আদর্শ। আকৃতি প্রকৃতিতে ব্রাহ্মণ বড়, একথা স্বীকার করলে কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন, কিন্তু সত্যের খাতিরে একথা স্বীকার করতে আমার শুধু আনন্দই লাগে। এই ব্রাহ্মণের যে উচ্চ আসন ছিল ভারতবর্ষে, নানা জাতি এসে ব্রাহ্মণকে সেই উচ্চ আসন থেকে নামিয়ে দিতে চেয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে ব্রাহ্মণ এখনও ততটা নাবেনি। তাপস ব্রাহ্মণকে আমি নমস্কার করি; ত্যাগী ব্রাহ্মণকে আমি ভক্তি নিবেদন করি; অধ্যয়ন-অধ্যাপনারত শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণকে আমি ভালোবাসি।
কিন্তু মানুষের রুচি যে বদলে গেছে। হিন্দুর জাতিভেদের কথা ভাবলে মনে হয় অন্যান্য দেশে democracy যেমন খাপ খায় এখানে যেন ঠিক তেমনটা নয়। এখানে গৌরবর্ণ, উন্নত-নাসিকা, প্রশস্ত ললাট, বীর-বপু, বিশাল বক্ষের পাশেই ঘোর-কৃষ্ণ- বর্ণ, চেপ্টা-নাক, বর্তুল-চক্ষু, বিরল শ্মশ্রুগুম্ফ চোয়াড়ে চৌকা চৌকা চেহারায় এক দেশে বাস। এদের পরস্পরের মিল কবে হবে এবং কেমন ক’রে হবে তা এদের ভগবানই জানেন। যাই হ’ক এর মীমাংসা করার মতো জ্ঞান ও বুদ্ধি যাঁর আছে তিনি চেষ্টা করুন। মোটের উপর এ অত্যন্ত কঠিন সমস্যা। এর জন্য হিন্দুরা নাকাল হ’য়ে আছে। সুতরাং তাদের ভয় করা মুসলমানদের উচিত নয়। সে যে মড়ার উপর খাঁড়া।
মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত কাজের লোক। কিন্তু হ’লে হবে কি? আজকাল মুসলমানদের মধ্যেও জাতবিচার বেশ প্রবল হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। বাহ্যিক কতকগুলি আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিলে মুসলমানদের মধ্যে যারা শরাফতের দাবী করে তাদের মনের ভেতরকার হামবড়া ভাব এত প্রকট যে পৈতাধারী ব্রাহ্মণ শূদ্রকে যতখানি তুচ্ছ মনে না করে এরা অপেক্ষাকৃত গরীব মুসলমানরা তার চেয়েও বেশী তুচ্ছ মনে করে। ফলে পূর্বকার মুসলমানদের সে ভ্রাতৃভাব এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না।
এ ছাড়া ধর্মান্ধতা মুসলমানদের মধ্যে এত বেশী যে কোনো রূপ স্বাধীন চিন্তার দরজা একেবারে বন্ধ। মুসলমানদের মধ্যে যারা একটু ঘরানা বা উচ্চবংশের বলে দাবী করতে চায়, তারা চাচ্ছে যে তারা যা বুঝেছে সবাইকে তাই বুঝতে ও মানতে হবে। তা না মানলেই তারা একদম কাফের। আর সব মুসলমান ঠিক একছাঁচে গড়া হবে। খোদা এক, রসুল এক, সব মুসলমানও তাই ঠিক একভাবাপন্ন হবে।
জগতে দেখতে পাই ফুল ফল গাছ পাতা সব ভিন্ন ভিন্ন রকমের। একই জাত গোলাপ ফুল তার মধ্যে রকমারি। আবার একই গাছের দুটি গোলাপ ফুল ঠিক একরকম নয়। দুটি জীবন্ত চলন্ত চেতনাযুক্ত মানুষ একরকম পাওয়া দায়। আর সমগ্র মুসলমান সমাজের লোকগুলি সব একই রকম হওয়া চাই! হচ্ছে না তবু হওয়াতেই হবে এই যে দুরাশা, এতে খেয়ে সেরেছে মুসলমানকে। লাঠির আঘাতে সব হিন্দু যদি মুসলমান হ’য়েও যায় তার পরক্ষণেই দেখতে পাওয়া যাবে আবার হিন্দুর বীজ গজিয়ে উঠেছে। আবার সেই দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছে। কি হবে হিন্দুকে মুসলমান ক’রে? মানুষ– মানুষ।
দেশের লোক না খেয়ে মরচে, পেটে অন্ন নাই, পরিধানে বস্ত্র নাই। “স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হ’তে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া। “
এমন দুর্দশার দিনেও দেশের নেতাদের এইরূপ মনের ভাব! এ ভাব কি চিরস্থায়ী হবে?