শিক্ষিতা নারীর বিবাহ
কতকগুলি idea আমাদের জীবনের প্রধান সম্বল। এসব idea যদি আমরা পরীক্ষা ক’রে দেখি তবে দেখা যায় যে, তাদের পরস্পরের মধ্যে অনেক বিরোধ বর্তমান।
সীতাও সতী, দ্রৌপদীও সতী। এখানে idea য় দ্বন্দ্ব বর্তমান। এই দ্বন্দ্বের reconciliation করবার জন্য justification (দোষ খণ্ডন) এই কথাটির সৃষ্টি হয়েছে।
সত্যবাদী হওয়া, প্রিয়বাদী হওয়া এই দুইটি আদর্শের মধ্যেও দ্বন্দ্ব যথেষ্ট। অথচ আদর্শবাদী দুইই চান; কিন্তু একটিকে অনুসরণ করতে হলে অন্যটিকে অন্ততঃ কখনও কখনও আংশিকভাবে বিসর্জন দিতে হয়।
সতীত্ব, নারীত্ব, মাতৃত্ব এগুলির মধ্যেও অনেক সময়ে দ্বন্দ্ব লক্ষিত হয়। প্রত্যেকের জীবনে এই সব দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফেলা দরকার। দুঃখের বিষয় সমাজ, ধর্ম এবং আইন এসব সমস্যা বা দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফেলার জন্য কোনো পরিষ্কার formula (সূত্র) দিতে পারে নাই। অনেক সময়ে সতীত্বের নামে নারীত্ব এবং মাতৃত্বকে অস্বাভাবিকভাবে খর্ব করা হয়। আবার কখনও কখনও নারীত্ব এবং মাতৃত্ব এমন অস্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয় যে সতীত্ব তাতে অপমানিত হয়। অবশ্য শেষোক্ত ব্যাপারে সমাজ, ধর্ম এবং আইন এই তিনের কোনোটির অনুমোদন নাই।
সতীত্ব জিনিষটির Physical (দৈহিক) এবং Mental (মানসিক) দুটি দিক। Physical সতীত্ব অপেক্ষা Mental সতীত্বের মূল্য বেশী। Mental chastity কিন্তু ধরা মুস্কিল। ওখানে হয়তো অনেকেরই পদস্খলন হয়। কথাটি পদস্খলন বলেছি; কথা কথাই; অনেক সময়ে এই পদস্খলনের মধ্যে থাকে একটি স্নেহ প্রবণতার ভাব, যেমন শরৎ বাবুর পল্লীসমাজে রমার অথবা চরিত্রহীনের সাবিত্রির চরিত্রে। এই স্নেহ প্রবণতা যে খুব খারাপ তা বলা যায় না। একে খারাপ বলা হয় কেবল সমাজের ভয়ে বা ideaর খাতিরে।
গোলাপ ফুল গন্ধ বিলিয়ে দেয়। তা সবাইকে দেয়–সেখানে সে অসতী; অসতী আমাদের তৈরি একটি কথা মাত্র। গোলাপ ফুল তার রূপ রস ও গন্ধ অকাতরে পাত্রাপাত্র বিবেচনা না ক’রে বিলিয়ে যায়–ওই তার ধর্ম। সেই রকম যে সমস্ত নর-নারীর মধ্যে রূপ রস ও গন্ধ আছে, তারা তা না বিলিয়ে পারে না। রোগীর শুশ্রূষায় অনেক সময়ে নার্সরা যে রকম স্নেহ বিলায় অনেক সতী-সাধ্বী স্ত্রী তার কাছে হার মানতে বাধ্য। এ সব নার্স কি অসতী?
কল্যাণী নারীর স্নেহপ্রবণতা তার ধর্ম। নারীত্ব, মাতৃত্ব এ দুটিও তার ধর্ম। সঙ্গিনী হওয়া, মাতা হওয়া এ সবে তার সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অধিকার। সৃষ্টিকর্তার দেওয়া এই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা এবং সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা একই কথা। সমাজ নারীর এই অধিকারের উপর অনেকখানি হস্তক্ষেপ করেছে বলে অনেক সময়ে সমাজকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে এবং কোন্ সুদূর ভবিষ্যতে যে সমাজ তার লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পাবে তা আমরা বলতে পারি না।
এই প্রসঙ্গে লজ্জাহীনতার কথা এসে পড়ে। লজ্জাও নারীর একটি স্বাভাবিক ভূষণ এবং ধর্ম–ওটি নারীত্বের একটি রূপ; ওটিকে বিসর্জন দেওয়া যায় না; ওকে বিসর্জন দেওয়া আর নারীত্বের পক্ষে আত্মহত্যা করা একই কথা। তাই নারীর নারীত্বকে মাতৃত্বকে সার্থক করবার জন্য দোরে দোরে প্রার্থী হওয়ায় নারীত্বের অপমান করা হয়।
আজকাল আমাদের দেশের দুর্ভাগ্যবশতঃ বহু নারী এমন অসহায় অবস্থায় পতিত যে তাদের নারীত্বের সার্থকতা উপলব্ধি করবার জন্য অনেকখানি অপমান স্বীকার করতে হয়। যে সমাজে এই বিপদ উপস্থিত হয় সে সমাজের ভবিষ্যৎ কল্যাণ সম্বন্ধে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক।
স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার কথা আমরা সব সময়ে বলি; কিন্তু শিক্ষিতা নারীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা বেড়েছে বলে আমার তো মনে হয় না। অনেক শিক্ষিতা নারী আজীবন কুমারী অবস্থায় জীবন কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন। শিক্ষিত হবার জন্য এদের নারীত্ব এবং মাতৃত্ব অপমানিত হয়েছে।
শিক্ষিতা নারীদের অনেকেই শিক্ষয়িত্রী হয়ে সমাজের কিছু সেবা করছেন বটে, কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষয়িত্রীদের মান নাই। শ্রদ্ধা, সত্যিকারের স্নেহ,
সত্যিকারের স্নেহ, কিছু appre ciation, না হলে জীবন সার্থক হবে কেমন ক’রে? মেয়েদের মঙ্গলের জন্য শিক্ষয়িত্রীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম একেবারে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে অভিভাবকদের অশ্রদ্ধার বিষে। সব বিসর্জন দিয়ে ওঁদের এই ব্যবসা– সেখানেও এই বিড়ম্বনা; তবে কি শুধু প্রাণধারণের গ্লানি-সরমের ডালি–এই এঁদের পুরস্কার?
এই সব শিক্ষিতা নারীদের অসহায় অবস্থা যে আমাদের সমাজের স্ত্রী-শিক্ষার কতখানি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা উপলব্ধি করবার জন্য আমরা একটুও চিন্তা করি না। শিক্ষিতা নারীর প্রতি অশ্রদ্ধার দরুণ আমাদের সংসারের বধূ মাতা এঁরা অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত অশিক্ষিতা। তাঁদের সতীত্বের দরুণ তারা নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তাদের যেসব গুণ আছে তার সঙ্গে উচ্চশিক্ষা থাকলে আরও যে সুন্দর হতো! তারা সন্তান-সন্ততিদের লালন পালন শিক্ষা ইত্যাদি সম্বন্ধে অধিকতর পারদর্শী হয়ে সমাজের অধিকতর কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হতেন।
শিশু-পালন ও শিক্ষা ব্যাপারে যে সংযম ও স্নেহ-মমতার আবশ্যক শিক্ষিতা নারীদের মধ্যে তা অধিক পরিমাণে বর্তমান। তাই শিশু-পালন ও শিশু-শিক্ষা ইত্যাদি ব্যাপারে শিক্ষিতা নারীরা অধিকতর পটু একথা অস্বীকার করা যায় না; এমন অবস্থায় শিক্ষিতা নারীদের প্রতি সমাজের উদাসীনতা কখনই বাঞ্ছনীয় নয়।
অনেক সময়ে দেখা যায় এই সব শিক্ষিতা নারীরা নিজেরাই বিবাহ ব্যাপারে উদাসীন। তার অনেকগুলি কারণের মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
সমাজের উদাসীনতার দরুণ উপযুক্ত পুরুষ এঁদের পাণিপ্রার্থী হয় না। যারা এঁদের চায় তাদের শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে এঁদের শিক্ষা-দীক্ষায় খাপ খায় না। এমন অবস্থায় এঁদের বিবাহ ব্যাপারে আত্মসম্মান-জ্ঞান বাধা দেয়। এ সম্বন্ধে সমাজের দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া দরকার। শিক্ষিতা নারীকে বধূরূপে বরণ ক’রে নিতে সমাজের যত রকম বাধা আছে সেগুলিকে পরীক্ষা ক’রে অর্থশূন্য সংস্কার এবং মোহ থেকে মুক্তি পাবার জন্য চেষ্টাবান হওয়া আবশ্যক। তা না হলে এই (dying race) মুমূর্ষু জাতির মুক্তির দোর সঙ্কীর্ণ হয়েই থাকবে।
এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে সতীত্বের কথা। অনেক সময়ে দেখা যায়, যে সমস্ত মেয়েরা স্কুল কলেজে পড়ে তারা যখন যৌবনে পদার্পণ করে তখন কোনো কোনো পরিচিত শিক্ষাভিমানী ভাবপ্রবণ সংস্কারপ্রয়াসী যুবক হয়তো কোনো একটি সরলার প্রতি একটু বিশেষ মনোযোগ দিতে আরম্ভ করে। বালিকারা সাধারণতঃ সরল প্রকৃতির এবং স্নেহ প্রবণ। স্নেহ পেলে মেয়েরা কেমন যেন হয়ে যায়। এই সমস্ত যুবকদের মধ্যে অধিকাংশেরই অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করবার ক্ষমতা নাই। সুতরাং অনেক সময়ে এই সব যুবকেরা কাপুরুষের মতো মেয়েদের সঙ্গে গোপনে আলাপ চালায় এবং পরে সম্বন্ধ ছিন্ন ক’রে অন্য নারীর পাণিগ্রহণ করে। এদিকে এই সরলা বালিকার অবস্থা যা হয় তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের দেশে নিন্দুকের অভাব নাই, পরের কুৎসা রটাবার বেলায় আমরা সব পঞ্চমুখ। এমনকি আমাদের দেশের বোবা কালারাও কুৎসা রটাবার বেলায় বোবা নয়। বোবার সাক্ষ্যের উপর নির্ভর ক’রে নারী-নির্যাতনের কথা কানে এসেছে। যাক, মেয়েটির দুর্নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার বিষাদময় পরিণামের জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হয়। এইসব নারীদের ক্ষমা করবার মতো উদারতা সমাজের থাকা নিতান্ত দরকার। অবশ্য ব্যাপার যেখানে গুরুতর হয়ে দাঁড়ায় সেখানে কতখানি ক্ষমা করা সম্ভব সে-সম্বন্ধে শান্তভাবে বিবেচনা করা উচিত।
অনেক সময় নাটক-নভেল-ভক্ত শিক্ষিতা নারীরা অত্যধিক তীব্র সতীত্বের উপাসক হয়ে পড়েন। কবে কোনো একদিন কোনো যুবক একটু স্নেহ দেখিয়ে মনকে আকৃষ্ট করেছিলেন, সেই স্মৃতিকে মনোমন্দিরে প্রতিষ্ঠা ক’রে আজীবন কুমারীব্রত অবলম্বন করে সতীত্বের আদর্শ রচনা করবার জন্য নিজেকে কল্পনায় উৎসর্গ ক’রে ফেলেন। এই উৎকট সতীত্ব যে একটি খেয়াল এ সম্বন্ধে শিক্ষিতা নারীদের সচেতন হওয়া দরকার। সংসারে যে যার পথে চলে যায়। এঁদের উৎকট সতীত্বের মূল্য এঁদের কাছে যত বেশী, অন্যের কাছে তা না হতেও পারে। প্রত্যেক নারীর নারীত্ব তখনই সার্থক হয়, যখন তিনি বধূরূপে মাতারূপে প্রীতি বিলিয়ে গৃহে বিরাজ করেন। সতীত্বের উচ্চ আদর্শকে আমি সম্মান করি; তাই বলে মোহকে খেয়ালকে সম্মান করতে নারাজ।
এই শ্রেণীর নারীর আত্মপরীক্ষায় নিযুক্ত হওয়া আবশ্যক। যদিও কারও কোনো স্মৃতি থাকে তবে সেই স্মৃতিকে বিসর্জন দিতে হবে, না তাকে প্রতিষ্ঠা ক’রে পূজা করতে হবে, সে বিষয়ে মন ঠিক করা আবশ্যক। সব দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে ফেলতে হবে। যদি পূজা করতে হয়, তা হলে মনকে দৃঢ় ও সরল করতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায় মন টলছে, কিন্তু সেই যেমন আব্দেরে ছেলে ভাত খাব না বলে জিদ ক’রে বসেছে, এখন ক্ষুধাও পেয়েছে, খাবারও ইচ্ছে বেশ প্রবল, অথচ জিদের খাতিরে ‘খাব না’ এই ভাবটা প্রকাশ করে। নারীনিগ্রহের এমন নিষ্ঠুর ব্যবস্থা সমাজ ক’রে রেখেছে যে স্নেহপ্রবণা নারীর তপ্ত প্রেম তৃষ্ণা যখন কূল ছাপিয়ে ওঠে–যখন পশুপক্ষীর প্রতি তাদের স্নেহের ধারা বয়ে যায়, তখনও সেই উৎকট সতীত্বের মোহ দিয়ে তাকে চেপে রাখতে হবে। স্নেহপ্রবণা নারীর স্নেহের বন্যার গতিরোধ করবার জন্য অনেকখানি সংযম দরকার। বহু নারীর এই সংযমের অভাব, তাই অনেক সময়ে উৎকট সতীত্বের মোহ অনেক বিষময় পরিণামের জন্য দায়ী। উপরোক্ত অবস্থায় স্মৃতিপূজা মিথ্যা–এখানে স্মৃতিকে মুছে ফেলবার জন্য মনের জোর আবশ্যক। স্মৃতিকে পূজা করবার জন্য সংযম আবশ্যক, আবার স্মৃতিকে মুছে ফেলবার জন্যও সংযমের প্রয়োজন। স্মৃতিকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখবার জন্য যে সংযম আবশ্যক তা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি পূজনীয় জনের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধার অভাব থাকে, অর্থাৎ ব্যাপারটি যদি শুধু একটি খেয়াল বা মোহ ভিন্ন আর কিছুই না হয়। এখানে নারীকে প্রশ্ন করতে হবে, স্মৃতিতে কি তার সব ক্ষুধা মিটেছে? যদি সত্যি তার মন কখনই চঞ্চল না হয়, তা হলে ভিন্ন কথা। নইলে ওটা একটি মোহ মাত্র। ওর থেকে মুক্তির জন্য চেষ্টা পাওয়া উচিত। এই সব নারীকে বিবেচনা করতে হবে যে, সংসারে তাঁদের স্বেচ্ছাচরিণী হবার কতটুকু অধিকার আছে। প্রত্যেকেরই ভেবে দেখতে হবে, পিতামাতা ভাই ভগিনী ইত্যাদি আত্মীয় আত্মীয়াদের প্রতি তাঁদের কোনো কর্তব্য আছে কিনা। হয়তো তাদের এইসব স্বেচ্ছাচারিতার দরুণ ভবিষ্যতে তাঁদের ভাই ভগিনীর পরিণামও বিষাদময় হয়ে উঠবে। হয়তো তাদের একটুখানি বিবেচনাহীনতার দরুণ অনেকগুলি আত্মার ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হবে।– শুধু ক্ষণিকের উত্তেজনা, শুধু একটা খেয়ালের জন্য সতীত্বের নামে অসতীত্বের স্তূপ গড়ে তোলা হবে।
এই লেখা পড়ে হয়তো কেউই কিছু বিবেচনা করবেন না। শুধু ভেবে দেখতে অনুরোধ করা গেল। ‘Every idea is a prison’–এই কারাগৃহ থেকে মুক্তি কি অসম্ভব?