সংযোজন–অপ্রকাশিত গল্প
নেড়ে
পুজোর ছুটির পর কলকাতায় ফিরছিলুম। চাঁদপুর স্টেশনে আসবার একটু আগেই জিনিসপত্র গোছাতে লাগলুম। সঙ্গে ছিল শুধু একটি বেতের বাক্স আর সতরঞ্চি জড়ান বিছানা। যাদের সচল অচল অনেক লাটবহর থাকে, তাদের ট্রেন ছেড়ে জাহাজে উঠতে দেরি হয়। কাজেই আমার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিবিহীন ব্যক্তি মাত্রেই ছুটে গিয়ে জাহাজ দখল করে বসে। এ অবশ্য আমি গান্ধি-ক্লাসের যাত্রীদের কথা বলছি।
চাঁদপুরে গাড়ি থামল। তাড়াতাড়ি নেবে পড়লুম। কুলি না ডেকে মোট ঘাড়ে করে ছুটে চললুম। বিস্তর যুদ্ধের পর জাহাজে উঠলুম। ভেবেছিলুম বেশ খালি পাব; কিন্তু দেখলুম পৃথিবীতে একমাত্র হুঁশিয়ার লোক আমিই নই। অনেকেই আমার ঢের আগে এসে ভালো জায়গাগুলো দখল করে বসে আছেন। আরও দেখলুম আমার অপেক্ষাও অল্প লাটবহর বিশিষ্ট বঙ্গসন্তান। তাদের সম্পত্তির মধ্যে একখানা খবরের কাগজ খানা বিছিয়ে হাতে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন।
থাক্, অনুতাপ করে লাভ নেই। বেশ কসরত করে সিঁড়ির পাশে জায়গা দখল করে বিছানা বিছিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লুম। তার পর জামার বোতাম খুলে, ডান পা-খানা সোজা করে, বা পা তার উপর তুলে নাচাতে শুরু করে বিজয়গর্বে চারিদিকে তাকাতে লাগলুম। হঠাৎ মনে হল ব্যুহ তো তৈরি করা হয়নি। তাড়াতাড়ি উঠে বিছানার একপাশে জুতা আর একপাশে বাক্স ও মাথার দিটা রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখলুম। এইবার ঠিক হল। আর কোনও সামন্ত-যাত্রী-রাজা আক্রমণ করতে পারবেন না। চৌহদ্দি ঠিক করে নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়ে বিজয়গর্বে আবার ঠেঙ নাচাতে শুরু করলুম। চারিদিকে তখন হৈ হৈ কাণ্ড। জায়গা দখল নিয়ে ঝগড়া, কুলির সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। নানা প্রকারের চিৎকারে চারিদিক তখন বেশ সরগরম।
জাহাজ ছাড়ে ছাড়ে– ভাবলুম যাক একটু কবিত্ব করা যাক– অমনি।
হে পদ্মা আমার
তোমায় আমায় দেখা—
বাকিটা আর আওড়ানো হল না। দেখি একটা ভদ্রলোক মরিয়া হইয়া সিঁড়ি দিয়া উঠতে চেষ্টা কছেন। পেছনে তার আবরু-অবগুণ্ঠিতা স্ত্রী কিছুতেই তাল সামলে তাঁর সঙ্গে চলতে পাচ্ছেন না। ভদ্রলোকের সে-দিকে দৃষ্টি নেই।
এগিয়ে চলার আনন্দে তিনি তখন মশগুল। আনন্দ বললুম বটে কিন্তু থাচ্ছো কেলাসের যাত্রী মাত্রেরই এ আনন্দের ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।
যাক্। শেষ পর্যন্ত তিনি উপরে উঠলেনই। বাঙালির ধৈর্য নেই, যুদ্ধ করতে পারে না– একথা ডাহা মিথ্যে। সেই ভদ্রলোককে দেখলে উপরোক্ত কুসংস্কার কারুরই থাকবে না। উপরে উঠেই তিনি চারিদিকে তাকাতে লাগলেন।
কিন্তু–
স্থান নেই স্থান নেই ক্ষুদ্র সে তরী
মেড়ো, খোট্টা, বাঙালিতে সব গেছে ভরি।
ততক্ষণে তার স্ত্রী এসে পেছনে দাঁড়িয়েছেন। বাবু তখন পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলেন। বুঝতে পারলুম কুলি চম্পট–বললুম কী মশাই, কী হয়েছে?
ভদ্রলোকটি কাঁদ কাঁদ হয়ে বললেন, কুলি-কুলি, কোথায় গেল, এই—
আমি বললুম, নম্বর মনে আছে?
আমার কথায় কান না দিয়ে বলতে লাগলেন, অ্যাঁ, তাই তো, কুলি কোথায় গেল– বাক্স-টাক্স সব নিয়ে গয়নার বাক্স হায় হায়।
গয়নার বাক্সর কথা মনে হতেই তার শোক দ্বিগুণ হয়ে উঠল, আমি বিরক্ত হয়ে বললুম,
নম্বর কত ছাই বলুন না?
এ্যাঁ, তাই তো নম্বর, হা নম্বর! নম্বর এই– তাই তো! ভুলে গিয়েছি।
বেশ কোরেছেন! এইবার তার স্ত্রীর গলা থেকে গড়গড় কোরে একটা আওয়াজ বেরুল। কিন্তু, সেটা কি কোনও ভাষা না শুধু আওয়াজ মাত্র তো বোঝা গেল না।
ভদ্রলোকটি তাড়াতাড়ি সেই দিকে ঝুঁকে বললেন।
কী, কী, মনে আছে?
আবার একটু গড়গড়। তার পর শুনতে পেলুম এগারো।
আমি আর অপেক্ষা না করে একপাটি জুতা পায়ে ঢুকিয়ে অন্যটা ঢুকাতে ঢুকাতে ছুটে চললুম। ফিতে বাঁধা ছিল না বলে ডান পায়ের জুতোর নিচে ফিতে আটকে যাওয়ায় দড়াম করে সিঁড়ির উপর মুখ থুবড়ে পড়লুম। জুতোর ওপর ভীষণ চটে গেলুম। কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দিলুম পরোপকার কি বিনা মেহনতে হয়। যা হোক আবার উঠে ভিড় ঠেলে গ্যারহ নম্বর কুলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চললুম। কিন্তু কোথায় গ্যারহ নম্বর কুলি। প্রত্যেক কুলির নম্বর যদি খুঁজতে যাই তবে সে কাজটি আর সেদিন শেষ হবে না। কাজেই শুধু চেঁচিয়ে চললুম।
নদীর পারে উঠে চেঁচাতেই কুলি বললে- ক্যা বাবু। কোঁও চিল্লাতে হো? আমি বললুম তুমি গ্যারূহ নম্বর কুলি? সে বলল, হ্যাঁ, ক্যা চাইতে হো?
আমি বললুম,– জলদি চলো– বাবুকা মাল লেকর কোঁও ইতনা দেরি করতা হ্যায়?
সে বলল, ক্যা চিল্লাতে হো, মেরা পাস্ তো ইন্ সাহেবকা মাল হ্যায়। বাবুকা মা ওঁহা রাখ ছোঁড়া। দেখলুম আগে একটি সাহেব যাচ্ছে। আর বাবুর বাক্স নদীর পারে গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমি বললুম, চলো য়্যহ মাল লেকর জেয়াদা পয়সা দেগা।
কুলি কোনও কথা না বলে চলে গেল। ভারি মুশকিলে পড়লুম, কী করা যায়? পাশে কোনও কুলিও নেই। জাহাজও তখন ছাড়বার জন্য ফোঁস ফোঁস কোরছে। কী আর করি। নিজেই বিছানা ট্রাঙ্ক ঘাড়ে ও গয়নার বাক্স হাতে করে চললুম। খানিকটা যেতেই ঘাড় টনটন কোরতে লাগল। মনে হল কেন এই কুবুদ্ধি চেপেছিল।
সিঁড়ির সামনে আসতেই বাবু তাড়াতাড়ি বাক্স ধরে বললেন, হা হা, করেন কী। আপনি কেন কষ্ট কোরছেন? কুলি বেটারা- আমি এক্ষুনি স্টেশনমাস্টারের কাছে যাচ্ছি। পাজি ব্যাটারা মাল নিয়ে শেষকালে ফেলে দেয়! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, বলে তক্ষুনি ঝুপ করে আমার বিছানায় বসে পড়লেন। আমি শুধু না, না বলে দাঁড়িয়ে রইলুম।
ভালো করে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে ভদ্রলোক তার গিন্নি সমেত আমার বিছানায় জাঁকিয়ে বসেছেন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, বসুন, বসুন।
এই তো একটুক্ষণ থাকতে হবে, কোনও রকমে চলে যাবে। বিছানার একপাশে বসে পড়লুম।
বাবুটি বললেন–কোথায় যাওয়া হবে।
কোলকাতা।
সেখানে পড়েন বুঝি?
প্রশ্ন এড়াবার জন্য শুধু মাথা নাড়লুম। তাতে হা-না দুই-ই বোঝাল। বাবু বললেন না, আমার একটি ভাইপোও কলকাতায় পড়ে। ছেলেমানুষ– গেল বছর মেট্রিক পাস্ করে গিয়েছে। পড়াশুনায় বেশ ভালো। আপনার বাবা কী করেন?
চাকরি।
বেশ বেশ। আমিও সরকারি চাকরি করি। মাইনে নেহাত কম। কোনও রকম কায়ক্লেশে চলে যায়। আমার যে ভাইপোটির কথা বললুম তার বাবা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ছ শো টাকা পায়। তার বিয়ে হয়েছে ফেনীতে। তার শ্বশুর… ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা জ্বালায় পড়লুম! কী করা যায়! ফেরিওলা যাচ্ছিল। একটা কাগজ নিয়ে মুখ ঢেকে পড়তে লাগলুম।
বাবু বোললেন–কী পড়ছেন? আমি শুধু মাথা নাড়লুম।
তিনি বললেন আনন্দবাজার? বলেই- দেখি কাগজখানা। ভাবলুম বাঁচা গেল। বাবু কাগজ পড়বেন। কিন্তু ভদ্রলোক প্রথম লাইন চেঁচিয়ে পড়েই আবার বক্তৃতা জুড়ে দিলেন।
জগৎগুরু মহাত্মা গান্ধীর কারাবাস- আজ ২২৫ দিন। তাহার বিদায়বাণী, খদ্দর পরিধান—ছুঁৎমার্গ পরিহার।
দেখলেন মশাই, দেখলেন। এই দুটো জিনিস বলে গেছেন– তাও হতভাগা দেশে কেউ কোরবে না। খদ্দর পরলে কী দোষ রে বাবা! টেকেও তো বেশি; দামও কম।
আমাকে তার কাপড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জিত হয়ে বললেন, কী কোরব! ছাপোষা মানুষ। খদ্দর কিনে কুলিয়ে উঠতে পারিনে, আবার অফিসের সাহেব দেখলে চটে। বেটা যেন কসাই। সে কথা যা। কিন্তু আমি ছোঁয়াছুঁয়ি মানিনে। ওতে তো আর কোনও খরচ নেই। কেনই বা মানব? কেন মুচি-মুসলমান কি মানুষ নয়? ওদের সঙ্গে বসে কেন খাব না? খুব খাব– আলবৎ খাব।
তার পর এদিকে ওদিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বললেন- তা হলে জলখাবার
স্ত্রী তাড়াতাড়ি বাক্স খুলতে লাগলেন। ততক্ষণ তার ঘোমটা প্রায়ই আড়াই ইঞ্চি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। একখানা প্লেটে হাঁড়ি থেকে বের করে সন্দেশ রাখতে লাগলেন। আমি তখন উঠবার বন্দোবস্ত করতে শুরু করেছি। বাবু তা দেখে বললেন, বসুন, বসুন, জলখাবারটা এখানেই সেরে নিন।
আমি মাথা চুলকাতে লাগলুম। তিনি থালাখানি গিন্নির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আমার দিকে একটু এগিয়ে খান বলে টপ করে একটি রসগোল্লা আমার মুখে ফেললেন। আমিও আস্তে আস্তে খেতে লাগলুম। তিনি অনর্গল বকে যেতে লাগলেন।
খাওয়া শেষ হলে বললেন, আমাদের তো এসে পড়ল– নেক্সট স্টেশন–তারপাশা। আপনার তো কোলকাতা পৌঁছুতে অনেক দেরি হয়ে যাবে- তা আপনি কোথায় উঠবেন? সোজা মেসে যাবেন বুঝি?
আমি হুঁ বলে উঠে পড়লুম। প্রতিজ্ঞা করলুম তারপাশা স্টেশনে না আসা পর্যন্ত আর ও-মুখো হবে না।
দূর থেকে দেখলুম বাবু গিন্নির সঙ্গে খুব আলাপ জুড়ে দিয়েছেন।
ঘণ্টাখানেক পরে তারপাশা দূরে দেখা গেল। ভাবলুম এইবার বাবুর খোঁজ নিই। গিয়ে দেখি তিনি তখন কাগজ পড়ছেন। আমাকে দেখে বললেন– এই যে তারপাশা। তার পর স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ওগো সব গুছিয়ে নাও।
জাহাজ থামল। তিনি পারের দিকে আধঘণ্টা ধরে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি লোককে দেখে– যুগপৎ হাত-পা নেড়ে চেঁচাতে শুরু করলেন। লোকটি কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। বাবু দুই হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কুলি ডেকে মালগুলো তুলে দিয়ে আমিও সঙ্গে সঙ্গে নাবলুম। পারের লোকটি তখন জাহাজে উঠেছে। বাবুটি পারে নাবতে যাবেন এমন সময় ফিরে বললেন- চিঠিপত্র লিখুবেন আপনার ঠিকানা? তাই তো নামই জানা হল না। আপনার নাম?
আবদুল রসুল।
থমকে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলেন- কী?
আবদুল রসুল।
তুমি মুসলমান?
আমি বললুম, হ্যাঁ, কেন?
দ্রলোক মুখ খিঁচিয়ে বললেন, কেন?–কেন জাতটা মারলে? খাবার সময় বললে না কেন তুমি মুসলমান? উল্লুক!
আমি অবাক হয়ে বললুম, আপনি যে বললেন, জাত মানেন না!
তিনি তেড়ে এসে আমার নাকের কাছে হাত নেড়ে বললেন, মানিনে, খুব মানি। আলবৎ মানি। সাত পুরুষ মেনে এসেছেন আর আমি মানিনে। আবার প্রাচ্চিত্তির ফেরে ফেললে! হতভাগা– নেড়ে!