অপ্রকাশিত পত্রাবলি
(১)
শান্তিনিকেতন,
২০।১।৬০
স্নেহের দীপংকর,
আমার আশ্চর্য বোধ হয়, রাজশেখরবাবু যে বাড়িতে আছেন, একদিন যে বাড়ির গদিতে তুমি বসবে, অর্থাৎ তিনি যে বেঞ্চিটায় বসেন সেটাতে বসে তুমি তারই মতো অতিথি অভ্যাগতকে আপ্যায়িত করবে তখন অন্য লোকের অটোগ্রাফ সঞ্চয় করার তোমার কী প্রয়োজন? ফার্সিতে বলে এক বাচ্চা-ই-বাবুর বস্ অস্ত (এর সবকটা শব্দই তোমার জানা থাকার কথা : বাবুর = সিংহ; বস্ = ব্যস = যথেষ্ট; অ = সংস্কৃত অস্তি) সিংহের একটি বাচ্চাই যথেষ্ট, কুকরীর মতো সে লিটার প্রসব করে না। আমাদের গুরুদেবও মধুরতর করে 261694, The rose which is single need not envy the thorns which are many! (কবি হাইনে আরেক কদম এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, এবং সিংহশিশু যখন কুকুরের চেয়েও ছোট থাকে তখনও তার ক্ষুদ্র আঁচড় থেকে বোঝা যায় ওটা সিংহের আঁচড়! এক বুড়ো রাবিশ কবি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, গ্যোটের ছেলেবেলার কবিতা থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায় এটা সিংহ-শিশুর আঁচড়, অমুকের বৃদ্ধ বয়সের কবিতা থেকেও বোঝা যায় ওটা ইঁদুরের আঁচড়।)।
তাই রাজশেখরবাবুকে একখানা ডাইরি দিয়ে বললো, তাঁর মনে যখন যা কিছু আসে সেইটে যেন তোমার জন্য লিখে রাখেন। তুমি বড় হয়ে প্রতিদিন তারই মাত্র একটি করে পড়বে, এবং তাঁর অনুপস্থিতিতেও তাঁর সান্নিধ্য লাভ করবে।
আর শশিশেখরবাবুর* লেখা পড়ে আমার নিজের লেখার প্রতি ঘৃণা ধরে। এ লোকটা অত দেরিতে কলম না ধরে যদি যৌবনে আরম্ভ করতেন তবে আর সবাইকে কানা করে দিতেন। শুনেছি ওঁর পিতাও নাকি একটি খাণ্ডার ছিলেন। আমি যেদিন প্রথম রাজশেখরবাবুর নাম শুনি তখনই সন্দেহ করেছিলুম যে নামদাতা পণ্ডিত এবং রসিক লোক। তবু ভাবলুম, এটা হয়তো accident. তার পর যখন অন্যান্য ভাইদের নাম শুনলাম তখন আর মনে কোনও দ্বিধা রইল না।
[* শশিশেখর : শশিশেখর বসু। রাজশেখর বসুর অগ্রজ। ইনি পরিণত বয়সে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই সরস ও তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তাঁর সবরকম লেখা অত্যন্ত উপভোগ্য ও পাঠকসমাজে আদৃত হয়। তার যা দেখেছি যা শুনেছি গ্রন্থখানি বিপুল সমাদর লাভ করে।]
আজ এখানেই শেষ করি। তুমি যখন বেআইনিভাবে রাজশেখরবাবুকে লেখা আমার চিঠি পড়েছ, তখন, সাধু সাবধান, খেয়াল রেখো, তিনি যেন বেআইনিভাবে তোমাকে লেখা আমার চিঠি না পড়েন।
শিগগিরই কলকাতাতে টেস্ট আরম্ভ হবে। তার প্রস্তুতির জন্য তোমাকে একটি কবিতা বেতারের ভাষায় স্বরচিত কবিতা) পাঠালুম। গত মার্চ মাসে ঢাকায় দেখি আমার এক ভগ্নী (এম.এ. পড়ে বাঙলায়, তবে রাতারাতির চিংড়ির মতো চটপটে নয়, লেখক মনোজবাবুর সঙ্গে তার দোস্তি) ঘড়ি ঘড়ি রেডিয়ো খুলে West Indies vs Pakistan খেলার স্কোর শুনছে। অথচ ক্রিকেটের ক অক্ষর তার কাছে গোমাংস কিংবা শূয়রের। তাকে এই কবিতাটি দিয়েছিলুম। ঢাকাতে লেখা বলে আরবি-ফার্সি শব্দের প্যাজ-ফোড়নটা কিঞ্চিৎ ঝাঝালো।
–আশীর্বাদক
সৈয়দ মু. আলী
.
(২)
শান্তিনিকেতন
১৫। ৩। ৬০
স্নেহাস্পদেষু,
তোমার তাবৎ লিখনই পেয়েছি। উত্তর কেন দিতে পারিনি সেটা বলতে গেলে আসল মহাভারত না হোক, রাজশেখরীয় মহাভারত নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে যাবে। উর্দুতে বলে,
মুসিবৎ কা অহওয়াল্ হর এক্ এক্ সে কহ না–
মুসিবৎ সে হৈ অহ্ মুসিবৎ জ্যাদহ!
বিপদের কাহিনী প্রত্যেককে বয়ান করে বলার হ্যাপা আসল বিপদের চেয়েও বড় বিপদ।
তোমার দাদুকে একটু বাজিয়ে নিয়ে তো, আমি তাঁকে একখানা বই উৎসর্গ করতে চাই। তার অনুমতি আছে কি না? টাপে-টোপে ঠারেঠোরে শুধিয়ো। বেশ খুশিমনে যখন থাকেন। তোমাকে বলছি, বইখানা আমার সমজদার বন্ধুদের প্রশংসা পেয়েছে বলেই এ প্রগল্ভতা করছি।
রবীন্দ্রকাব্যের নতুন নতুন অর্থ শুধু নয়, এমন সব কঠিন প্যাসেজও আমি মোলায়েম করতে পারি যা অন্যে পারে না। আমি একটা দিগগজ নই– পারি অন্য কারণে। সেটা দেখা হলে বাতলে দেব।
ইতিমধ্যে এটার মানে কী বলো তো!
ওরে, এতক্ষণে বুঝি/তারা-ঝরা নিঝরের স্রোতঃপথে পথ খুঁজি খুঁজি/গেছে সাত ভাই চম্পা। যাত্রা, পূরবী, রচনাবলী ১৪ খণ্ড, পৃ-১৯। এখানে সবাই কাৎ। পূর্বেই বলেছি, আমি মেলা মুসিবতে আছি। আশীর্বাদ জেনো–
—সৈয়দ মু. আলী
.
(৩)
শান্তিনিকেতন,
১৯।৩।৬০
স্নেহাস্পদেষু,
আমি যখন লন্ডনে ছিলুম তখন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও সেখানে ছিলেন। আমাকে শুধিয়েও ছিলেন, আমার কোনও-কিছু করে দেবেন কি না। বললেই তিনি খুশি হয়ে বার্ট্রান্ড রাসল বার্নার্ড শর নামে আমাকে চিঠি দিতেন। আমি চাইনি।
দলের দু একজন আমার ক্লাস-ফ্রেন্ড ছিল। হিটলার। যখন খ্যাতি-প্রতিপত্তির মগডালে তখন তারা চেপে ধরেছিল আমাকে হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে। বলেছিল, ফুরারের মেলা গুণ আছে কিন্তু ভাষা বাবদে তুই জর্মন ভাষাতে যা জমাবি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যাইনি। আমি কোনও কালেই হিটলার-ভক্ত ছিলুম না।
তোমার দাদুকে কিন্তু দেখবার বাসনা আমার ছিল কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি বলে বাসনাটা ধামাচাপা দিয়ে তার উপর শিল-চাপা দিয়েছিলুম। ইতিমধ্যে আমার এক বন্ধু বললেন, ওহে, রাজশেখরবাবু তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
আমার ভয়ে মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি তাকে ফোন করে শুধালুম, কখন এলে দর্শন পাব।
আমার বিশ্বাস তোমার দাদু পূর্বোক্ত কোনও ইচ্ছাই প্রকাশ করেননি। আমার বন্ধু আমার মনের গতি জানতে পেরে ধাপ্পা মেরে আমার রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়েছিল।
সেদিন যতীনবাবুও তার ঝোলা নিয়ে বসেছিলেন। আমি দু জনারই ন্যাটাই ভক্ত অর্থাৎ এঁদের কোনও দোষ-ত্রুটি আমার চোখে পড়ে না।
আমি এমনই nervous হয়ে গিয়েছিলুম যে, সেটা ঢাকবার জন্য আপন অজানাতে জাত-ইডিয়েটের মতো বক্র করতে আরম্ভ করেছিলুম এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বেশ বুঝতে পারছিলুম, ভারি অন্যায় হচ্ছে, বড় বাঁচালতা হচ্ছে, বেহদ্দ পাগলামি হচ্ছে, অথচ কিছুতেই থামতে পারছিলুম না।
হয় তোমার দাদু পয়লা নম্বরের অভিনেতা, নয় তিনি অতিশয় সহৃদয়, সহিষ্ণু শ্ৰীকণ্ঠবাবু। বেশ হাসিমুখে আমার বকবক শুনেছিলেন, এমনকি বললে বিশ্বাস করবে না, ভাই, আমার মনে হচ্ছিল আমার বকবকানিটা তাঁর অপছন্দ হচ্ছে না। যতীনবাবুকে আমি অতটা ডরাইনি। সেটা অবশ্য তাঁরই প্রশ্ন শুধোবার সহৃদয়তা থেকে।
তার মানে তোমার দাদু একটা কিছু কট্টর হাম-বড়া লোক? আদপেই না। কিন্তু আমার এটা অহেতুক ভয়। তাঁর কাছে তো আমি কিছুই গোপন রাখতে পারব না। তিনি ধরে ফেলবেন আমার দম্ভ, আমার আত্মস্তুতি প্রচেষ্টা, আরও সাতান্ন রকমের মানসিক এবং চরিত্রগত দুর্বলতা এবং ব্যাধি আমার যা আছে। আমি জানি তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল—- একমাত্র ভণ্ডামি জিনিসটা তিনি আদপেই বরদাস্ত করতে পারেন না। শুধু ধর্মরত ভণ্ড বিরিঞ্চি বাবা নয়, মোলায়েমির ভণ্ড পেলব রায় দোদুল দে গয়রহ বিস্তরে বিস্তর– এমনকি গল্পেীর খোলাখুলি জোছুরি তিনি প্রশংসার চোখেই দেখছেন, হয়তো ভাবছেন বুদু বাঙালি ব্যবসায়ী এর কিছুটা পেলে বর্তে যেত।
আমি ভণ্ড নই। বড়ফাট্টাই করার লোভ একেবারে কখনও হয় না, সে-কথা বলব না। কিন্তু সেটা রসিয়ে বলতে পারি বলে কেউ বড় গায়ে মাখে না। পাছে অপরিচিত লোক misunderstand করে তাই আমি কারও সঙ্গে দেখা করিনে, পারতপক্ষে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিই না, মিটিঙে পার্টি-পরবে যাই না অতিশয় নিতান্ত unavoidable না হলে। কাউকে বলো না, বাজারে রটিয়েছি, আমার আনজিনা খ্রমবসিস (দুটো হার্ট ট্রাবলকে মিস্ করে এই ঘাটটি তৈরি করেছি), ডাক্তারের সখৎ মানা ভিড়ে মেশা। তৎসত্ত্বেও শুনে আনন্দিত হবে– অন্তত আমি তো বটি বাজারে আমার ভয়ঙ্কর দুর্নাম, আমি দম্ভী, বদরাগী ইত্যাদি, তাই কারুর সঙ্গে মিশিনে। যখনই খবর পাই, অমুক এসব রটাচ্ছে, অমনি তার কাছে লোক পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানাই, সে আমার উপকার করছে বলে (অর্থাৎ এই বদনাম শুনে visitor-রা আমাকে জ্বালাতন করবে না বলে) এবং আমার বইয়ের এক খণ্ড তাকে present করি!
ঠিক তেমনি যারা আপনজন তাদের সঙ্গ পেলে আমার সব দুঃখ উপশম হয়। আমার দাদাদের সঙ্গে আমি দিনের পর দিন পরমানন্দে কাটাতে পারি। আমার মেজদা অনেকটা তোমার দাদুর মতো। আমি ব করলে শুধু যে শোনেন তাই নয়, চোখ দিয়ে উৎসাহও দেন।
যতীনবাবুকে* আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ো।
[*যতীন্দ্রনাথবাবু– শিল্পী যতীনকুমার সেন। রাজশেখর বসুর দীর্ঘকালের বন্ধু ও নিয়মিত সঙ্গী।]
আমি কলকাতায় আসি অতিশয় কালে-কম্মিনে। আমি জানি, তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি সত্যই অত্যন্ত কুনো লোক। যেটুকু ভ্রমণ করেছি সেটা নিতান্ত বিপদে পড়ে, গরজের ঠেলায়। কাবুল গিয়েছিলুম সহজে টাকা রোজগার করে সেই টাকা দিয়ে জর্মনি গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। ঠিক সেই কারণেই মিশর, প্যারিস, লন্ডন যাই– অর্থাৎ পড়াশোনা research করার জন্য। একবার মাত্র স্বেচ্ছায় ভ্রমণ করেছি। ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলামের সঙ্গমভূমি প্যালেস্টাইন গিয়েছিলুম অতিশয় স্বেচ্ছায় মিশরে যখন ছিলুম। আমার ছোট বোনেরা বলে, ছোড়দার longest walk হচ্ছে তার deck Chair (আমি ডেকচেয়ারে পড়াশোনা করি) থেকে বাথরুম অবধি। ব্যবস্থা থাকলে সেখানেও taxi নিতেন। কলকাতায় এলে তোমার দাদুকে দেখতে অত্যন্ত ইচ্ছা হয়। কিন্তু বিরক্ত করতে বড় ভয় পাই। তবে এবারে ঠিক ঠিক আসব। আমি অন্তত ছটা কই মাছ খাব। দাদু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছে। তুমি স্মরণ করিয়ে দিয়ো। ৪৮ ঘণ্টার নোটিশ দেবার কথা। তৎসত্ত্বে যদি বাজারে কই না পাওয়া যায় তবে চিংড়ি, season হলে তোপসে। দেখ দিকিনি, কী রকম expensive taste –বাঙালের ঘোড়া রোগ। আমাদের এখানে এর একটাও পাওয়া যায় না।
তারা ঝরা নির্ঝরের স্রোতঃপথ, =milky way, আর সাত ভাই চম্পা হল কৃত্তিকা নক্ষত্রের খাঁটি বাংলা নাম। ইংরেজিতে (আসলে গ্রিক) Pleiad অর্থাৎ milky way-এর পিছনে পিছনে পথের খোঁজে খোঁজে যেতে যেতে কৃত্তিকাও অস্ত গেছে। শরঙ্কালের প্রতি রাত্রেই হয় বেশ কিছুদিন ধরে। আর milky way-কে তারা নিৰ্ব্বর বলে রবিবাবু তাঁর physics এবং astron omy জ্ঞান দেখিয়েছেনও বটে। শুনেছি সৃষ্টির আদিতে নাকি বিস্তর তারা ঠিকরে পড়ে ছায়াপথ milky way সৃষ্টি করেছে। আসলে কিন্তু সক্কলেরই Waterloo ওই সাত ভাই চম্পা। ওটা যে কৃত্তিকা সেটা হরিবাবুর অভিধানে আছে। আমার যে গুরুর কাছে আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি তিনি ছিলেন আইরিশম্যান, নাম (ঈশ্বর) মার্ক কলিন্স। বিশ্বাস করবে না, আমি জীবনে কোনওদিন দেখিনি যে, কোনও একটা text-এর সামনে এসে বললেন, এ ভাষা আমি জানিনে।তা সে chinese-ই হোক, আর ওঁরাওঁ-ই হোক। আমাকে ইংরেজি ফরাসি জর্মন পড়াতেন। আর ইংরেজি শব্দতত্ত্ব শেখাবার সময় দুনিয়ার কুল্লে ভাষার সঙ্গে (কারণ ইংরেজি দুনিয়ার কোন ভাষা থেকে শব্দ নেয়নি বলতে পারব না) পরিচয় করিয়ে দিতেন। একদিন রাত্রের অন্ধকারে মাঠে দাঁড়িয়ে কন্সটেলেশন চিনছি এমন সময় তিনি পিছন থেকে আমার পরীক্ষা নিতে নিতে কৃত্তিকার খাঁটি বাংলা নাম শেখালেন। সে প্রায় ৪০ বছর হল। তখন ওর ফার্সি নাম পরওয়িজও শিখিয়েছিলেন। Omar Khoyyam-এর যে ইংরেজি অনুবাদ (Fitzgerald করেছেন তাতে parwiz শব্দটি আছে। সেটি The vine has struck a fibre দিয়ে আরম্ভ। পার্সিদের মধ্যে এ নামে এখনও নামকরণ হয়। এই কলিনসের মতো মহাপণ্ডিত পূর্ব-পশ্চিম কোথাও আমি পাইনি। অথচ কেউই তাকে চেনে না। কারণ যৌবনে লিখেছিলেন ডক্টরেট থিসিস, এবং বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথের চাপে একখানা চটি প্যামলেট- ব্যস। এবং দ্বিতীয়খানা পড়ে কেউই বুঝল না, ওটা সাপ না ব্যাঙ। নাম ছিল On the Octoval System of Reckoning In India, প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে প্রাক-আর্য দ্রাবিড়রা, আর্যদের মতো decimal sys tem অর্থাৎ দশের স্কেলে গণনা করত না– তাদের scale ছিল আটের। ৮ x ৮ = চৌষট্টিতে তাদের শ–তাই চৌষট্টি যোগিনী ইত্যাদি (এর বাইপ্রডাক্ট– দুর্গা আর চৌষট্টি যোগিনী অনার্যা– অবশ্য এটা মূল বক্তব্য নয়)। এই গোনার স্কেল যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়, এবং duodecimal-টাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ, অর্থাৎ ১২-র স্কেল– এটা না জানা থাকলে তোমার দাদুকে জিগ্যেস করে নিয়ো। আমি এসব জানি অতি অল্পই। দেখা হলে কলিনসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ো। তাঁর পাণ্ডিত্য যে কী অতল অগাধ ছিল সেইটে সালঙ্কার শোনাব।
এবারে বল তো বত্স, রবীন্দ্রনাথ তার গানের অন্তর মন বিকশিত করো-তে নন্দিত করো, নন্দিত করো হে কোত্থেকে লোপাট চুরি করেছেন? (উত্তর শেষ পৃষ্ঠায় উল্টো করে লেখা)।
ধর্মশিক্ষা এখনও পাইনি। নিশ্চয়ই পড়ব। ধার্মিকরা চটুন, কোনও আপত্তি নেই। আর আমরাও মহেশ বা হরিনাথ নই। আর তোমরা তো কায়স্থ। তোমাদের মহা সুবিধে কোনও ধর্মকর্ম করার আদেশ তোমাদের ওপর নেই। কিঞ্চিৎ আতপ চাল আর দুটো কাঁচকলা বামুনকে ডেকে দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। হিন্দুধর্ম বড় Specialist-দের ধর্ম। বামুনরা Specialist- (যে রকম ধর Cancer-এর স্পেশালিস্ট হয়) সেই Specialist যখন রয়েছে তখন তুমি-আমি খামকা অত তকলিফ বরদাস্ত করে আনাড়ির মতো এমেচারি করতে যাব কেন? Specialist মোটর মেরামত করে, তবে Specialist-ই স্বর্গে যাবার সিঁড়ি তৈরি করে দেবে না কেন? ভূশণ্ডীর মাঠে খামকা ক্ষীরি বামনীর ভিটেতলা থেকে সোজা যেখানে দেবদূতরা গোলাপি উড়ুনি পরে ফটাফট সোডার বোতল খুলছে, সেখানে যাবার পথ ওরা যখন জানে তখন ওদের হাতে দু পয়সা ঠেকিয়ে দিলেই হয় বাংলা কথা! আমার অবশ্য সমূহ বিপদ। একে তো সব মুসলমানকেই পাঁচ বেকৎ নামাজ করতে হয়, তার ওপর আমি আবার সৈয়দ, মুহম্মদের বংশধর (সাবধান! চাট্টিখানি কথা নয়– তোমার দাদু এ বাবদে প্রশ্ন শুধোলে আমি বলেছিলুম, ক্যান মশায়, আপনারা যদি চন্দ্রবংশ, সূর্যবংশ হতে পারেন–অর্থাৎ চন্দ্র-সূর্যের পুত্র হতে পারেন তবে আমার claim তো অনেক modest. আমি একজন মানুষ মাত্র পূর্ব-পুরুষ হিসেবে চাইছি!), তার ওপর আমাদের বংশ শুরুবংশ (যদিও থিয়েটারে আবদালা সাজিনে– খল্বিদং দ্রষ্টব্য ওটা দিলীপ রায়– নাঃ) Religiosity-র worst example ওই লোকটা! বাপস!), এবং finally কাইরোর ভুবন-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝাড়া দেড়টি বছর সুদ্ধমাত্র স্মৃতি (মাকড় মারলে ধোকড় হয়– নবমীতে অলাবু ভক্ষণ, পশ্চিমে যাত্রা নাস্তি) নিয়ে research করেছি।
আমার মতো জ্ঞানপাপী এ জগতে দুর্লভ। আমার কী গতি হবে, বল তো। জাবালি? মহেশ?
আচ্ছা, বল তো, আমি কেন অত শত ধর্মগ্রন্থ পড়েছি, এবং এখনও পড়ি? আমার ডক্টরেটও History of Religion-এ। জর্মন মাল, বাবা, চালাকি নয়– ছে ছে পয়সা জাপানি মাল নয়। বলতে পারলে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম।
তোমার দাদু রসিক লোক, রসজ্ঞ ব্যক্তি, তাঁর রসবোধ আছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু রসশিল্পী বা রসসাহিত্যিক বলার কোনও অর্থ হয় না। শিল্পী রস বানাবে না, তবে কি কচুপোড়া তৈরি করবে! রম্যরচনা-ও ওই একই দরের কথা। এখানকার গাড়লরাও লেখে বিশ্বভারতী University। বিশ্বভারতী মানেই তো University!!
তদুপরি, নিছক রস সৃষ্টির জন্যই তো রাজশেখর কলম ধরেননি। তিনি কি গোপাল ভাঁড়! তওবা, তওবা!!
আমার বইটার নাম শবনম্। অর্থাৎ শিশিরবিন্দু, হিমিকা, গৌরী। উপন্যাস। অতি মোলায়েম। নির্ভয়ে প্রিয়জনের হাতে তুলে দেওয়া যায়।
আমি অবসর সময়ে আস্তে আস্তে পূরবীর টীকা লিখছি। কবে শেষ হবে আল্লায় মালুম!
আশীর্বাদ জেনো।
শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর থেকে : পরমে ব্রহ্মণি যোজিত চিত্ত, নন্দতি নন্দতি নন্দত্যেব। যার চিত্ত পরব্রহ্মে যুক্ত, তিনি নন্দিত হন, নন্দিত হন, নন্দিত হন।*
[*লেখক এই পত্রের উল্টোদিকে এই অংশ উল্টো করে লেখেন।]
.
(৪)
শান্তিনিকেতন
৩০।৩৬০
স্নেহাস্পদেষু,
কয়েকদিন পূর্বে তোমাকে চার পৃষ্ঠার একখানা চিঠি লিখি, ইতিমধ্যে তোমার দাদুর লেখাটি পাই। তিনি এত বেশি চমৎকার লেখেন যে, আমরা চমৎকৃত হয়েও চমৎকৃত হইনে। তিনি আমাদের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছেন।
যা বলেছেন, সে সম্বন্ধে আমি আর কী বলব?
তবে ওই যে বলেছেন, কর্ণেজপন সেইটে যে হয়ে উঠে না। Prophet-রা সেই কর্ণেজপন নিজেরাই করে যান, Politician-রা তার হদ্দ রাখে না। হিটলার চূড়ান্তে পৌঁচেছিল। কিন্তু প্লাতো, কিংবা এ যুগের রবীন্দ্রনাথ এঁরা আদর্শ রাষ্ট্র সম্বন্ধে যা বলেছেন তার কর্ণেপন তো কেউ করে না। বিশেষ করে প্লাতো।
বিশেষ করে আমরা সব blase হয়ে গিয়েছি। একটা গল্প শোন। বর্মার যুদ্ধে একটা লোকের মাথা উড়ে গেল। সে মাটিতে পড়ে গেল। খানিকক্ষণ পর আরেকজন সেপাইয়ের আঙুলের ডগাটি উড়ে যাওয়াতে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাপ্তেন বললে, তুই কী কাপুরুষ রে! ওই লোকটার মাথা উড়ে গেল, আর সে একটি শব্দ না বলে চুপ করে শুয়ে পড়ল। তুই কি না একটা আঙুলের ডগা যেতেই হাউমাউ করে উঠলি!
ট্রাম ঠিকমতো থামায়নি বলে একটা লোক চোট পেল (মনে কর, আমাদের চিকিত্সাসঙ্কটের হিরো যে রকম)। আমি তাই নিয়ে মৃদু কোলাহল করতে একটা লোক ভেংচি কেটে বললে, ও! মশাই বুঝি মফস্সলের লোক। দেখেননি কত লোক না খেয়ে মরে গেল, কত রেফুজি মর মর– আর আপনি চোটপাট লাগিয়েছেন একটা লোকের সামান্য চোট লেগেছে বলে।
ছোট হোক, বড় হোক, তুমি কিছু একটা আপত্তি করলেই, বড় বড় পাপের ফিরিস্তি শোনানো হবে তোমাকে। অর্থাৎ পাপাচার দেখে দেখে সবাই এমনি ব্লাজে হয়ে গিয়েছে যে কারও কানে আর জল যায় না।
ভেজালের কথাটা অতিশয় আঁটি। যে যুগে আইন করা হয়েছিল তখন ভেজাল ছিল অতি সামান্যই ওটা নিয়ে তখনকার চাণক্যরা বিশেষ ভাবিত হননি। তারা তখনকার জমিদারি প্রথার ফল জালের জন্য ফাঁসি, পরে চোদ্দ বছর জেল আইন করেন। এখন জাল খুবই কম, ভেজাল বেড়েছে– আইন সেই মান্ধাতা আমলের।
এখন উচিত খুনের বেলা যে আইন সেইটে চালানো। তিনজন লোক যদি পিস্তল নিয়ে কাউকে খুন করতে গিয়ে, মাত্র একজন গুলি চালায় এবং তার একটা গুলিতেই লোকটা মরে তবে তিনজনেরই ফাঁসি– আদালত শুধোয় না, কার গুলিতে অকু-টা ঘটল। ভেজালের বেলাও তাই হওয়া উচিত। অর্থাৎ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের আদ্যন্তমধ্য– Managing Director থেকে চাপরাসি পর্যন্ত– সক্কলেরই তখন জেল-জরিমানা হওয়া উচিত।
এবং জানেনা, এখনও আইন– ভেজালের যে জিনিস পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছিল সেটা ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী না হলে ফেরত দিতে হয়!
আরও কত কী!
ক্ষিতিমোহনবাবুর শেষ রসিকতা! বর্ধমান হাসপাতালে মৃত্যুর দু দিন আগের কথা। তাকে দেখতে এসে এক বন্ধু শুধালে, রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীর ব্যবস্থা কী হচ্ছে? তিনি বললেন, সিলেট অঞ্চলে শ অক্ষর উচ্চারণে হ হয়। কাউকে শতায়ু হও বলতে গেলে হয়ে যায় হতায়ু হওয়া।
বাকিটা তিনি আর বলেন নি। হতবার্ষিকীই হবে বলে মনে হচ্ছে।
গুরুদেব বলে গেছেন তার শতবার্ষিকীতে ২৫ টাকা খরচ হবে। শত বার সিকি, চার আনা x ১০০ = ২৫ টাকা।
তোমার বয়স কত?
কী পড়?
ভাই-বোন কটি?
তাদের বয়স কত?
—আশীর্বাদ জেনো।
সৈ. মু. আ
কাটিঙটা ফেরত চাই?
.
(৫)
C/o Inspectress of Schools,
P.O. Ghoramara, Rajshahi. E. Bengal.
স্নেহের দীপংকর,
হঠাৎ যেন চোখের সামনে একটা বিরাট সমুদ্র শুকিয়ে গেল।
যবে থেকে এখানে এসে খবর পেয়েছি, আমার নিজের মনই কিছুতেই সান্ত্বনা মানছে না। আমি যেন কিছুই ভেবে উঠতে পারছিনে। এখানে রওনা হওয়ার আগের দিন সন্ধ্যার সময় রাজশেখরবাবুকে সভাতে দেখে কী আনন্দই-না হয়েছিল। ইনি তা হলে অনেকটা সুস্থ হয়েছেন সভাতে যখন আসতে পেরেছেন। এবারে তা হলে রাজশাহী থেকে ফিরে এসে নির্ভয়ে দেখা করতে যেতে পারব। এখানে এসে এই খবর। আমার স্ত্রী কাগজ এনে দিলেন। তিনি শ্রীযুক্তা আশা* পালিতের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছেন।
[*রাজশেখর-দৌহিত্রী]
এত দিন ধরে রোজই ভাবছি, তোমাকে লিখি। কিন্তু কী লিখি? পরমাত্মীয় বাড়ির মুরুব্বি গত হলে কী হয় সে কি আমি জানিনে? তার ওপর তার সেই বিরাট ব্যক্তিত্ব। বাড়িখানা যেন ভরে থাকত। আর আমার চোখের সামনে তিনি অহরহ ছিলেন প্রত্যক্ষমাণ। কতবার ক্ষোভ করে ভেবেছি, যদি ওঁর মতো একটা গল্পও লিখতে পারতুম।
বাঙলা দেশের সব লেখক একজোট হলেও তার মতো একটি ছত্রও লিখতে পারবে না। তিনি চলে গেলেন। এখন এই অর্বাচীনদের রাজত্বে বাস করতে হবে।
আজ থাক। আমার সত্যই কোনও কথা বেরুচ্ছে না।
কলকাতায় ফিরেই তোমার খবর নেব। তোমাকে আমার প্রাণ খুলে সব বলব। ইতিমধ্যে তোমাকে একটি কথা বলি। আমি পৃথিবীর কোনও সাহিত্য আমার পড়া থেকে বড় একটা বাদ দিইনি। রাজশেখরবাবু যে কোনও সাহিত্যে পদার্পণ করলে সে সাহিত্য ধন্য হত। একথা বলার অধিকার আমার আছে।
—আশীর্বাদ জেনো
সমশোকাতুর
সৈয়দ মুজতবা আলী
[এই পত্রটি রাজশেখরবাবুর পরলোক গমনের সংবাদ পেয়ে লেখা।]
.
(৬)
C/o Mrs Rabeya Ali
Inspectress of Schools, P.O. Ghoramara
Rajshahi. East Bengal.
স্নেহাস্পদেষু,
রাজশেখরবাবু সম্বন্ধে আমি অফুরন্ত কথা বলতে পারি। কারণ তাঁর লেখা আমি এত শ্রদ্ধার সঙ্গে এত অসংখ্যবার পড়েছি যে, এমন একটা লাইনও কেউ বলতে পারবে না যেটার আগের এবং পরের ছত্র আমার অজানা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার একটা গভীর দুঃখ আছে যার ইতিহাস তোমাকে আমি বলি।
বছর পাঁচ পূর্বে দোল না নববর্ষ না কি যেন কিসের উপলক্ষে …যথারীতি আমার লেখা চায়। আমি উত্তরে জানাই- যদিও কোনও প্রয়োজন ছিল না যে আমি রাজশেখরবাবু সম্বন্ধে একটি প্রামাণিক লেখা লিখব। তখন ওই বিশেষ সংখ্যার সম্পাদক ছিল কে যেন এক গাড়লস্য গাড়ল। উত্তরে লিখলে, আমরাও জীবিত কোনও লেখক সম্বন্ধে আলোচনা করিনে; কারণ অন্যেরা চাপ দেয় ইত্যাদি। আমি তো রেগে টং। আমি ব্যাটাকে তখন হাতের কাছে পেলে তার গোঁফ ধরে কোদাল দিয়ে মুণ্ড চাচতুম– যদিও এটা ভীষণ মোগল যুগ নয় এবং আমিও কোফতা খান নই।
কী অদ্ভুত যুক্তি! তা হলে প্রথম রবিবাবুকে যদি আমি তাঁর জীবিতাবস্থায় তার সম্বন্ধে লিখতে চাই– ডাঙশ মেরে ঘায়েল করে তবে তাঁর সম্বন্ধে লিখতে পারব।
পরে অবশ্য জানতে পারলুম, এর পিছনে কী একটা ছুঁচোমি ছিল। আমি অবশ্য ওই শ্বশুরনন্দন (রাগ কর না, শশিশেখরবাবু তালেবর লোক ছিলেন; তিনি এর সাতগুণ লিখতেন) যতদিন সম্পাদক ছিল ততদিন ওদের চিঠির উত্তর পর্যন্ত দিইনি।
১৯৫৯-এর শেষের দিকে কী করে সাগর (-ময় ঘোষ– দেশ সম্পাদক) তাবৎ ব্যাপার জানতে পেরে আমাকে ওই প্রবন্ধ লিখতে বলে। রাজশেখরবাবুর দু একখানা বই আমার তখন ছিল না (প্রতি বই অন্তত তিনবার কিনেছি ও ধার দিয়েছি–যা দেখেছি–ও তদ্বৎ), তাই সাগর উদযোগী হয়ে কলকাতা ফিরে গিয়েই সেগুলো পাঠায়। আমি সব বই (মায় হিতোপদেশ) আমি যেখানটায় বসে দিনযামিনী কাটাই তারই পাশে রাখলুম। শবনম লিখি আর ওগুলো পড়ে পড়ে নোট নিই, ছকে ফেলি (যেমন ভণ্ডামি, বারি, কুসংস্কার, Commonsense vs. religious bunkum, Versatility in linguistics –বিহারি, মেডোর বাঙলা উচ্চারণ, দিলতোড়বাগ, কে রেভেজভুস (by the way আমার ছোট ছেলের নাম ভজু (৬.৫) আর বড় ফিরোজ (৮) : বড়টা প্রায়ই চা-রা-রা– ভজুয়াকি বহিনিয়া গান গায়, আপন সূরে অবশ্য দু জনার hot favourite সেই উচাটন মন্ত্র মারো জোয়ান হেঁইয়া আম্মো কোরাসে জোয়ান করি) etc.etc.
ইতিমধ্যে সাগর ঘন ঘন চিঠি দেয়, আমারও উৎসাহের কমতি নেই কিন্তু কলম ধরতে গেলেই মুখ শুকিয়ে যায়।
ভাবি, আমার অন্য লেখা খুব সম্ভব তিনি পড়েন না বা অল্পই পড়েন, কিন্তু এটা তো দুশমন সাগর ওঁকে দেখাবেই, আর উনি পড়ে ভাববেন– সর্বনাশ, অন্য পাঁচজনকে ডেকে কী বলবেন– আরও সাড়ে সর্বনাশ! শশিশেখরবাবুর review লিখতে গিয়ে আমি একবার মার খেয়েছি আবার! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই review আমার too very worst performance। রাজশেখরবাবু ওটা আমায় review করতে বলেছিলেন (আসলে কিন্তু আমি আগেই কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ওটা কিনে পড়ে সাগরকে লিখেছিলুম ওটার review আমি লিখব, বাজে লোক যেন না লেখে, আর রাজশেখরবাবু তো লিখবেন না), আমি এত nervous হয়ে যাই যে পরীক্ষার হলে যে রকম আকবর-আওরঙ্গজেবে গুবলেট হয়ে যায়, আমার তাই হয়েছিল। এখন আবার না তাই হয়। মার্চের গোড়াতে সাগরকে লিখলুম ১০।৩।৬০-এর ভিতরে ওটা তৈরি হবে না– ওর বাসনা ছিল ১৮।৩।৬০-এর সঙ্গে ওটা যেন সিনক্রোনাইজ করে শুনেছি, সাগর মাথার চুল ছিঁড়েছে, নিতান্ত অগ্রজসম বলে অভিসম্পাত দেয়নি। আমায় লিখলে, আপনি মহা অন্যায় করেছেন; জানেন না, উনি অত্যন্ত অসুস্থ, উনি আপনার লেখাটা পড়লে জানতে পারতেন অন্তত একটা লোক তার লেখার সঠিক সমঝদার, আপনার মতো ওঁর সম্বন্ধে আর কে লিখতে পারে–আরও কী সব আবোল তাবোল লিখেছিল আমাকে আসমানে চড়িয়ে এখন একমাত্র ভরসা আপনার যদি সুবুদ্ধি হয়, লেখাটা বিলম্বেও শেষ করেন, যাতে করে উনি অন্তত দেখে যেতে পারেন।
ইতিমধ্যে আমি চিন্তা করলুম, এ লেখা লিখতে না পারলেও উপস্থিত আমার পুরনো বাসনাটা পূর্ণ করি। একটা বই উৎসর্গ করার বাসনা, কিন্তু প্রত্যেক বই শেষ হলে বলি, না, এটাও পাতে দেওয়া যায় না–next-টা যদি ভালো হয়।
শবনম তখন শেষ হতে চলেছে। আমার পছন্দ হয়নি। তবু বললুম, আর তো অপেক্ষা করা যায় না। দুর্গা বলে ঝুলি। তোমাকে লিখলুম। ওই সময় ক্ষিতিবাবু চলে গেলেন। সবকিছু একেবারে তালগোলা পেকে গেল। জানো, সে শক আমার এখনও যায়নি। কঠিন কঠিন প্রশ্ন নিয়ে ওঁর কাছে তাঁর অপারেশনের দিন তিনেক পূর্বেও গিয়েছি। ওসব প্রশ্ন নিয়ে এখন কার কাছে যাই?
তার পর এই।
এখন শবনম যখন পুস্তকাকারে বেরুবে তখন যতদূর পারি সংক্ষেপে উৎসর্গপত্রে বলব যে উৎসর্গটা তার সদয় আশীর্বাদ পেয়েছিল। সংক্ষেপে এই কারণে, যে আমি ও রবীন্দ্রনাথ, আমি ও বাইশে শ্রাবণ এরকম মানুষ যখন মহাপুরুষের সঙ্গে নিজের নাম জড়াতে চায় তখন আমার বড় সঙ্কোচ বোধ হয়। ওদের আমি দোষ দিইনে, কিন্তু আমার করতে বাধে।
*** প্রথম ছত্রটা আমার খারাপ লেগেছে। রাজশেখরবাবু জীবনে ঈশ্বরকে কোনও importance দেননি। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেটা এমনই মারাত্মক important হয়ে গেল যে তাই দিয়ে প্রবন্ধ আরম্ভ করতে হল! মরি, মরি! যেন রাজশেখর কলেজের ছোকরাদের মতো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভগবানকে dare করে বেড়াতেন। তার attitude (লেখা থেকে যা জানি– ভগবান নিয়ে আমাদের কখনও আলোচনা হয়নি, ভূত নিয়েও হয়নি, স্বর্গের দেবদূত ছোকরারা ১১ মাঘের বেহ্মোৎসবের মতো বাসন্তী না বেগুনি রঙের উড়নি গায়ে দেয় তা নিয়েও হয়নি– এক শো বার দেখা হলেও হয়তো হত না) ছিল completed indiffer ence to things & concepts (70GT rationality-s TT i The rational par excellence ভগবানকে অতখানি importance দিতে অত্যন্ত লজ্জাবোধ করবে।
আর শেষ sentence রীতিমতো defamatory of course তিনি ঈশ্বরকে মানেননি। এবং বেশ করেছেন! কী যুক্তির বহর! শ্রীকে মানলে ভগবানকে মানা হয়। বটে! আর কুশ্রীকে মানলে? তখনও ভগবানকে মানা হয়, কারণ কুশ্রীও ভগবানের তৈরি (তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছে আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে which is কুশ্রী, ছলনা=অমঙ্গল=কুশ্রী = ভগবান–মহেশের মতো to= দিয়ে ইকোয়েট করতে পারলুম না বলে অপরাধ নিয়ো না)। আর যদি বল কুশ্রী ভগবানের তৈরি নয়, তবে তার independent seperate per se existence আছে। তা হলে তারও ভগবানের মতো প্রধান essence আছে সেটা existence, অতএব কুশ্রীও ভগবান। এবং A forteriori এ সংসারে কুশ্রীই বেশি, মানুষের আচরণ কুশ্রী, মানুষের চিন্তা কুশ্রী, কুশ্রী বই বেশি বিক্রি হয়,- ad infinitum! Q. E. D, a la Mahesh!…
***
বুজরুকি, বুজরুকি, বুজরুকি। কোনও জিনিস যদি রাজশেখর সত্যই ঘেন্না (ঘৃণা নয় ঘেন্না) করে থাকেন তবে সেটা ওই বুজরুকি। Be simple, be honest, কী ভয়? যা আছ তা স্বীকার করতে লজ্জা কী? For Heavens sake (রাজশেখর হয়তো বলতেন For mans sake) do not pretend! এই তো রাজশেখরের message যদিও তিনি স্যাকরার বানি ছাড়া অন্য কোনও বাণী দেওয়াটা রীতিমতো insolence বলে মনে করতেন– আমি যতটুকু বুঝেছি। আর আমি তো ভুল বুঝিনি। He was too great to be mistaken.
এ বছরে নববর্ষ সংখ্যা বসুমতী দেখেছ? ওতে মডার্ন আর্ট সম্বন্ধে আমার একটি লেখা বেরিয়েছে। ওটা রাজশেখরবাবুর নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগত কারণ ওই বাবদে তার মতামত তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় (যষ্টিমধু না কী জানি একখানা কাগজে) একটি চিঠিতে প্রকাশ করেন। মডার্ন আর্টের প্রধান লক্ষণ, তার Obscurantism এবং রাজশেখর সর্বক্ষেত্রেই Obscurantism অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। ফরাসিরা যে রকম বলে, ce qui nest pas claire, nest pas Francais- whatever is not clear is not French … WITTS 4 প্রবন্ধে অবশ্য বুজরুকির দিকটাই বেশি বিকাশ পেয়েছে।
শবনম পড়ে তোমার ভালো না লাগলেও তার একটা জিনিস তোমার ভালো লাগার কথা। বিস্তর খেটেখুটে অনেক সুন্দর সুন্দর ফার্সি দোহা চৌপায়ী জোগাড় করে বাঙলায় তার অনুবাদ করে এ উপন্যাসে লাগিয়েছি। অনুবাদে একটিমাত্র শব্দ বাড়াই-কমাইনি, শুধু বাঙলায় দীর্ঘস্ব নেই বলে ফার্সি ছন্দ বজায় রাখা অসম্ভব।
আমার চিঠি ছাপাবে, তার আর কী? কিন্তু তোমাকে আত্মজনরূপে মেনে নিয়ে হয়তো নিজের কথা, নিজের দম্ভ প্রকাশ করে বসে আছি। সেটা ছাপানো কি যুক্তিযুক্ত হবে? অবশ্য কলকাতার সাহিত্যিকবৃন্দের ভিতর আমি এমনিতেই মারাত্মক রকমের popular নই– কাজেই মড়ার উপর এক মনও মাটি একশ মনও মাটি (এটা খাস মুসলমানি-প্রবাদ–কারণ মুসলমানেরই গোর হয়)। তবে অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দিয়ে তুমি edit করে ছাপিয়ে দিতে পার। আমার কণামাত্র আপত্তি নেই।
ছেলেবেলায় যখন কোনও কৃতী পুরুষের মৃত্যু হত তখন সেটা মনের ওপর কোনও দাগ কাটত না– কারণ তাঁর কৃতিত্ব সম্বন্ধে ছেলেমানুষ অচেতন। এখন যখন বিধুশেখর, হরিচরণ, ক্ষিতিমোহন, রাজশেখর চলে যান তখন এঁদের মূল্য বুঝি বলে বড় বাজে। বিধুশেখর নেই- বেদ এবং আবেস্তা তথা বীজধর্ম সম্বন্ধে কাকে প্রশ্ন শুধাই? হরিচরণ নেই–ছাতাটা বগলে নিয়ে চটিটা টানতে টানতে মাস্টারমশাই, বলুন তো–?
[ সাগর = সাগরময় ঘোষ, দেশ পত্রিকার সম্পাদক। ক্ষিতি = ক্ষিতিমোহন সেন। বিধুশেখর = বিধুশেখর শান্ত্রী। হরিচরণ = হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাবেয়া = রাবেয়া আলী, লেখকের পত্নী। ফিরোজ = সৈয়দ মুশাররফ আলী, ফিরোজ ডাকনাম, লেখকের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ভজু = সৈয়দ জগলুল আলী, ভজু ডাকনাম, আর এক প্রচলিত ডাকনাম কবীর, লেখকের কনিষ্ঠ পুত্র।]
এই যে সৈয়দ, এস এস। এক্ষুণি তোমার কথা ভাবছিলাম। কাল সন্ধেয় তোমার বউ এসেছিল তোমার দুই ছেলে নিয়ে। বউমা আমায় বললে, আশীর্বাদ করুন, আমার ছেলে যেন আপনার মতো পণ্ডিত হয়। হাঃ, হাঃ। আমি কী বললুম, জানো–
সে কথা থাক্। বলুন তো, জলপাই শব্দটা- ইত্যাদি।
তাঁর বয়স তখন নব্বই। সম্পূর্ণ অন্ধ। Headcrystal clear.
রাজশেখরবাবু সম্বন্ধে লিখব। লিখব বইকি, লিখব। কিন্তু কী কঠিন তুমি জান না। তাঁর, ক্ষিতিমোহনবাবুর যেখানে পাণ্ডিত্য সেটা বরঞ্চ চৌহদ্দিতে ফেলা যায়, কিন্তু রাজশেখর যেখানে বুজরুক, effeminiate (কচি সংসদ) অর্থগৃধনু (সিদ্ধেশ্বরীর অগা রায় বাহাদুর), corrupt politician (দক্ষিণ রায়) ইত্যাদিকে আর্টের পর্যায়ে তোলেন তাকে sum up করা বড় কঠিন। তাছাড়া পদে পদে bizarrerie–যত্রতত্র ছড়ানো যে রকম-সায়েব মেম নাচছে, চাটুয্যে ধরলেন রামপ্রসাদী। Bizarrie জিনিস বাঙলায় অতি কম। Grotesque আছে, anachronistic humour-ও আছে, এমনকি weird-ও আছে (ফ্রেমে কেন বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?)। আরও বহু বহু বিদকুটে রস। বড় কঠিন, বড় কঠিন। তুমি বুঝবে না।
তোমাকে প্রথম চিঠি লেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ভেবেছিলুম যতীনবাবুকে লিখব (ওঁকে আমার বড় ভালো লেগেছিল। কিন্তু ঠিকানা জানতুম না। এখন লেখা যায়? আমার দ্বিতীয় চিঠি পেয়েছিলে?
এখানে আরও দিন পনেরো তো থাকতে হবে। এখানে আমি মালিক নই। (রাবেয়া তোমার মায়ের সহপাঠিনী) বিবি আমাকে প্রায় সূ সূ সূ (রাতারাতি) করে ডাকেন।
–সৈ. মু. আ.
.
(৭)
শান্তিনিকেতন স্নেহাস্পদে,
আমি অতিশয় দুরাবস্থার* ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। অবর্ণনীয়। আমি দু মাস বাইরে থাকার সময় আমার উঠতি এবং উড়ুক্কু বয়সের ছোকরা পাঁচক cum ভৃত্যটি রসাতলে গেছেন। এমনই চরমে পৌচেছে যে একাধিক প্রতিবেশী আমার কাছে ফরিয়াদ করে গেছেন। সে-ও না হয় সামলাতে পারি কিন্তু রাত দুটোয় বেলেল্লাপনা করে ফিরলে পরের দিন কাজ কী রকম হয় সে তো বুঝতেই পারছ। আগে রান্নাটা অন্তত মন দিয়ে করত– এখন সে ইয়ারদের সঙ্গে দোকানে চপ-কাটলিস খেয়ে বাড়ির খাবার অবহেলায় রাঁধে। অসহ্য সে খাদ্য। সবচেয়ে বিপদ ওকে বিশ্বাস করে কলকাতা যাওয়া অসম্ভব। সে সঙ্গে সঙ্গে অষ্টপ্রহর বাইরে কাটাবে। রেডিয়ো, টাইপকল, সাইক্ল চুরি যাবে। ব্যস্।
[*দুরাবস্থা– দুরবস্থা শব্দের অশুভ রূপ। জনৈক ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলেন, তিনি খুব দুরাবস্থায় আছেন। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তরে বলেন, তা আকারেই (অর্থাৎ–কারের অশুদ্ধ প্রয়োগে) বুঝতে পারছেন। এই রসিকতাটি লেখকের প্রিয় ছিল। মাস্টার– লেখকের পোষা কুকুর]
মাস্টার অযত্নে থেকে সর্বাঙ্গে পোকা নিয়ে বসে আছে। অষ্টপ্রহর তার খেদমত করছি। বাড়িময় পোকা- flit, gemaxin D.D.T. তিন বন্ধু Spray powder করছি অবিরাম।
তুমি মেয়েছেলে হলে তোমাকে স্বয়ংবরী করে এই বৃদ্ধ বয়সে বলতুম, ভাই, দুটো ভাত সেদ্ধ করে দে।
চরমে চরমে!
তোমার কাছে বিশ্বাসী cook আছে পাঠিয়ে দাও না। আমি তা হলে অন্তত কিছুদিনের জন্য হাজরা রোড যাই। সে খাবে দাবে, বাড়ি আগলাবে, আর মাস্টারকে দেখবে। রান্নাঘর আলাদা। আমি সেখানে ঢুকি না। তার জাত যাবে না। আর মসলা হলে তো কথাই নেই। জাতভাই।
শবনমের শেষ কিস্তি বেরুবে ২০ আগস্ট। সঙ্গে সঙ্গে বই। ত্রিবেণী প্রকাশনী শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট। তোমার মাকে যেটা পাঠাব সেটা একটু দেরিতে পৌঁছবে। কলকাতা থেকে আসবে– তা-ও প্রকাশক বই দেয় author-কে প্রথম বিক্রির ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর আবার এখান থেকে যাবে।
তোমার sentence ব্যাকরণের দৃষ্টিবিন্দু থেকে জমি। কিন্তু শরৎবাবু এ রকম বিস্তর sentence লিখেছেন। অর্থ পরিষ্কার। উহ্যটাও প্রাঞ্জল, কিন্তু
বড় তাড়াতাড়িতে লিখছি।
–আশীর্বাদ জেনো
সৈ. মু. আ.
.
(৮)
Santiniketan
১৬।৫।৬১
স্নেহের দীপংকর,
এবারে কলকাতায় মাত্র ২৩ দিন ছিলুম বলে সব ভণ্ডুল হয়ে গেল।
তুমি বুঝলে না ১০০০ টাকা নিয়ে আমি কোথায় যাব? এ্যান্ডে বার নেই? সেখানে অনেকক্ষণ ছিলুম।
রঞ্জন*, তুমি আমি একমত। সম্পূর্ণ একমত।
[*রঞ্জন– কথাসাহিত্যিক নিরঞ্জন মজুমদার, রঞ্জন ছদ্মনাম। এর শীতে উপেক্ষিতা গ্রন্থটি প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
দিল্লির পুরস্কার– আকাঁদেমি পুরস্কার। ১৯৬১ সালে সাহিত্য আকাঁদেমির পুরস্কার কমিটির বিচারে বাংলায় কোনও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ না থাকায় পুরস্কার দেওয়া হয়নি।]
তার সঙ্গে যোগ দিই। এই দিল্লিওয়ালাদের ন্যাজ মোটা করে দিল কে?
তোমরা সাহিত্যিকেরাই। তবে এখন কেন?
এবং দিল্লি তো শুনলুম, বাঙলা দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকদ্বয়ের (কারা জানিনে) উপদেশেই তারা পুরস্কার না দেবার মীমাংসায় পৌঁছন।
এখানে যা হয়েছে তা অবর্ণনীয়। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথকে কেউ স্মরণ করেনি। করেছে পোয়েট টেগোরকে। প্রধান পুরোহিত ছিলেন পণ্ডিতজি ও রাধাকৃষ্ণ। এঁরা তো সোনার বাংলার কবি রবিঠাকুরকে চেনেন না; এঁরা চেনেন গিট্যানজলি, চিট্রা, স্যাড়নার (সাধনা) লেখক মিস্টার টেগোরকে। আর তাবৎ কার্যক্রম ইংরেজিতে! আমি অবশ্য কোনও পরবে যাইনি– বেতারে যা শুনেছি তার থেকে বলছি।
অনেক কাজ, অনেক লেখা বাকি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি আর ভাবি শান্তি কোথায়? কাজ থেকে নিষ্কৃতি পাই কী কৌশলে!
কলকাতা আসার আশু সম্ভাবনা তো দেখছিনে।
তুমি একবার শান্তিনিকেতন হয়ে যাও না? Weekend-এ নয়! শনি রবি সোম আমি ব্যস্ত থাকি। অন্য যে কোনও দিন তিনেক। সঙ্গে শুধু toothbrush এনো। আর সব এখানে আছে।
আ—
.
(৯)
শান্তিনিকেতন
৩।৮।৬১
বাবাজি,
তেতো দিয়ে ভোজন আরম্ভ করতে হয়; তাই শুরু কেচ্ছা আরম্ভ করি, চিঠি লিখি না কেন? যার যেটা পেটের ধান্দায় করতে হয়, সেটা তার Hobby হয় না। যেমন মনে কর জজ সাহেব মাটি কুপিয়ে বাগান করেন, কিন্তু চাষা শখের বাগানের জন্য মাটি কোপাতে একদম নারাজ। তদুপরি আমি আবার অনিচ্ছুক, পয়লা generation-এর চাষা। বাপঠাকুর্দা কেউই সাহিত্য রচনা করে পয়সা কামাননি। তার অর্থ, পেটের জন্যও যেটুকু মাটি কোপাই সেটাও অতিশয় অনিচ্ছায়। আমি সাহিত্য রচনা করে কোনও আনন্দ পাইনে। সেই অপ্রিয় কাজ সমাধান হওয়া মাত্রই, আবার পড়ি খ্রি, মুহম্মদ, বুদ্ধকে নিয়ে। ধর্ম এবং তত্ত্বজ্ঞানের জন্য নয়। এঁরা যে ঘোরতর সাংসারিক ছিলেন সেইটে সপ্রমাণ করার জন্য।
শুনেছি, সাঁওতাল ছোকরা সকালবেলা কাঁথার নিচের থেকে হাত বাড়িয়ে হাঁড়িতে হাত দিয়ে দেখে, চাল আছে কি না। থাকলে পাশ ফিরে ফের কথামুড়ি দেয়। আম্মা সকালবেলা চা খেতে খেতে চিন্তা করি, মানিব্যাগে যা আছে তাতে চলবে কি না। বাকিটা বুঝতেই পারছ।
পত্রোত্তর না দিয়ে আমি পৃথিবীতে যত শত্রু সৃষ্টি করেছি, দুর্ব্যবহার, গালমন্দ করেও অত সৃষ্টি করিনি। অমিশন যে কমিশনের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে, এটা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ঠিক সেই রকম আমি ভ্রমণ জিনিসটা যে কী রকম cordially detest করি সেটা শুধু আমিই জানি। গৃহিণী পর্যন্ত বুঝতে পারেন না। তাই গেছোদাদাকে আমি অতিশয় শ্রদ্ধা করা সত্ত্বেও তার পদাঙ্কানুসরণ করতে চাইনে– লিটারিলি ও মেটাফরিক্লি। জীবনে মাত্র একবার স্বেচ্ছায়, ব-হাল-ব-খুশ তবিয়তে বেড়াতে বেরিয়েছিলুম– কাইরো থাকাকালীন প্যালেস্টাইন বেড়াতে গিয়েছিলুম। (সেই কারণেই বোধহয়, ওই নিয়ে কোনও ব্যাপক ভ্রমণ-কাহিনী লিখিনি।) তারই খোয়ারি এখনও চলছে– খোয়ারিটা, by the way মাতাল অনিচ্ছায় করে, স্বেচ্ছায় নয়। সেই যে অমর খৈয়াম বলেছিলেন, মদ তো খেয়েছি বাবা, জীবনে কুল্লে একবার, বাকি জীবন তো খোয়ারি ভাঙতে ভাঙতেই গেল।
আমি ভ্রমণের খোঁয়ারি ভাঙ্গি মদ্যপান করে। সাদা চোখে পাটনা, কলকাতা, হেথাহোথা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। অবশ্য স্পেশাল সলুনে যদি আমার কেতাবপত্র কেউ গুছিয়ে দেয় তবে অন্য কথা। কিংবা এবং যদি অসাধারণ কোনও গুণীর সঙ্গ পাই। তিনি তখন এমন সব কথা বলবেন যে আমার জ্ঞানবুদ্ধি-অভিজ্ঞতা তখন furiously তার সঙ্গে fight দেবে। অর্থাৎ আমার মনটা ভূতের মতো। তাকে সর্বক্ষণ কাজ না দিলে সে আমার ঘাড় মটকাতে চায়। তখন তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে দিই।
তোমাদের সঙ্গে যখন কথা বলি, তখন হয় কোনও কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি করি, কিংবা কোনও ঘটনা বা বস্তুর সরেস বর্ণনা দেবার চেষ্টা করি। তাতে আমার চৈতন্য-ভূত কাজ পায়। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ চালানো যায় না, পক্ষান্তরে বুদ্ধ চৈতন্য বলে যাচ্ছেন, আমি শুনছি, মনে মনে ঘুমোঘুষি হচ্ছে- আকছারই আমিই মারটা খাই সেইটেই আমার কাছে পরম আনন্দদায়ক। এটা আমার বিশেষত্ব নয়। আমার দুই দাদা ওই নিয়ে সমস্ত দিনরাত কাটায়। বড়দা তো আদপেই লেখে না– যদিও অতি সরল, সুন্দর, ছোট ছোট কাটা কাটা sentence-এ, প্রায় naive বলতে পার, বাঙলা লিখতে পারে। মেজদা লেখে প্রায় যখন সত্যই কোনও অন্ধকার জিনিসের উপর আলোক ফেলতে পারে, কিংবা মেলা লোক যেখানে ভালো-মন্দ শুচ্ছের কথা বলছে সেখানে ওগুলো sum up করে পতঞ্জলির মতো সূত্রাকার standardize করে দেয়।
তুমি একবার এখানে এলেই পার, বাপধন! যা বলার বলে দেব, যা শোনার শুনে নেবে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কার প্রভাব আছে, কার নেই সে নিয়ে বুদ্ধদেব* মাথা ফাটাফাটি করেছে। তার কতটা যুক্তিযুক্ত প্রাসঙ্গিক সে-কথা বাদ দিচ্ছি, কারণ it is all barking up the wrong tree. রবীন্দ্রনাথ অজরামর হয়ে থাকবেন তার গানের জন্য (সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে বলছি, তিনিও সেটা জানতেন ও বহুবার দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন। তাই আলোচনা করতেই যদি হয়, তবে কর না তার গান নিয়ে। প্রথম, রবীন্দ্রনাথ বাঙলা গান কোন্ জায়গায় পেলেন, কোন্ জায়গায় পৌঁছালেন, দ্বিতীয় কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, ১৮৬০-৬১ সালের ব্রহ্মসঙ্গীত, তখনকার দিনের প্রচলিত অন্যান্য বাঙলা গান (ওস্তাদি এবং শব্দপ্রধান উভয়) থেকে তিনি কী নিলেন, তৃতীয়ত কোন্ কোন্ অনুভূতি প্রকাশ করলেন (লক্ষ করেছ কি, প্রেমের সবচেয়ে বড় বেদনা যে Jilted love– জোয়ান জিল্টার মনে আছে?) সেটাই সর্বপ্রধান স্থান পেয়েছে আমাদের হাজার হাজার পদাবলী কীর্তনে, মাথুর পর্যায়ে। রবীন্দ্রনাথ সেই অনুভূতি নিয়ে একটি গানও রচনা করেননি। তাঁর মূল সুর, আমি তোমাকে ভালোবাসলুম, তুমিও আমাকে ভালোবাসলে। তার পর তুমি মরে গেলে। এখন আমি কী করে এই বিরহ বেদনা সই? মাথুরের সুর, হে কৃষ্ণ, তুমি আমাকে ভালোবাসলে, আমিও তোমাকে ভালোবাসলুম। আমি কী দোষ করলুম, আমার প্রেমে এমন কী অসম্পূর্ণতা ছিল যে তুমি তাকে অপমান করে, পদদলিত করে চলে গেলে? আমার মনে হয়, jilted love সম্বন্ধে যে রবীন্দ্রনাথ লেখেননি তার একমাত্র কারণ আমরা খুব ভালো করেই জানি, তিনি কখনও jilted হননি, সে অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। সুদ্ধমাত্র কল্পনা দিয়ে এরকম একটা most eternally tragic অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না। প্রেম নিবেদন করলুম, অথচ আমার দয়িত সেটা গ্রহণ করল, এ অনুভূতিও রবীন্দ্রনাথের নেই– একমাত্র গৃহপ্রবেশ (শেষের রাত্রি গল্পের নাট্যরূপ চিত্রাঙ্গদায় সামান্য) ছাড়া। ভালোবেসেছিলুম– কিন্তু প্রকাশ করতে পারলুম না, সমস্ত জীবন দগ্ধে মরলুম, এটাও নেই। কিন্তু এগুলো jilted love-এর কাছেই আসে না। অবশ্য এগুলো প্রকাশ করেননি বলে তিনি মহান কবি নন, এ বলাটা পাগলামি। তবু অনুসন্ধান করাটা Quite interesting! চতুর্থত, শেলি-কিটস থেকে তিনি যে অনুপ্রেরণা পেলেন সেটা তাঁর গানে কতখানি সঞ্চারিত হল? এবং পঞ্চমত, এমন ধারা বিস্তরতঃ প্রশ্ন আছে।
কিন্তু গান নিয়ে আলোচনা কর, গান নিয়ে। বেড়াল উঠেছে গাব গাছে, আর কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করছে উপরের দিকে তাকিয়ে জামগাছ তলায়।
সুপার ট্র্যাম্পকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। তার প্রধান কাজ ছিল, নিছক পরোপকারার্থে সে জনপদবাসিনীদের দেহরঞ্জন করতে করতে এগোত, সেটা লিখি কী প্রকারে।
তুমি যে আমার লেখা অতুলনীয়, অপূর্ব এইসব বল, আর তো কেউ বলে না। আমি রোক্কা পয়সা ঢেলে একখানা দেশ কিনে নিরালায় ফিরলুম। পুটপুটি সেটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করল, কড়ি দিয়ে কিনলাম।– পঞ্চতন্ত্রটার দিকে তাকালেই না।
আমার বঁধুয়া আন-বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া।
যদি রাগ না কর তো বলি। আমার প্রায়ই মনে হয়, তুমি (এবং হয়তো মিত্তির, অংশত) আমার ভালোবাসা পেয়েছ বলেই হয়তো আমার লেখার প্রশংসা কর। অচিন্ত্য বা বুদ্ধদেবের সঙ্গে এই সম্পর্ক স্থাপিত হলে তাদেরও হয়তো ওই কথাই বলতে। আবার মাঝে মাঝে ভাবি, আজকের দিনে রাজশেখরবাবুর nearest approach তো আমিই, অবশ্য diluted to .00000001-এর thinness-এ! তাই হয়তো লেখার প্রশংসা কর। তা হলে অবশ্য এর খানিকটে আমার প্রাপ্য।
Instalment-এর চাপ আছে বলেই তো আমার সব লেখা বেরোয়। একমাত্র দেশে-বিদেশে (তা-ও শেষের চাপটারগুলো তাই) এবং শবনম (অংশত) একনাগাড়ে লেখা। তাতেই লেখা ভালো হয়, কিন্তু আমার হাড়-আলসেমি ওরকম sustained effort করতে দিল কই।
৮ তারিখ পাটনা যাচ্ছি। ফিরে আসব এখানে। তার পর কলকাতা হয়ে রাজশাহী। কলকাতায় ক-ঘণ্টা থাকব, জানিনে। তবে খবর দেবার চেষ্টা করব। ফেরার মুখে দীর্ঘতর।
এখানেই উপস্থিত থাক। পুজোর লেখা এখনও একটাও আরম্ভ করিনি। ওদিকে পাওনাদারের ঠ্যালায় প্রাণ যায় যায়।
মিত্তির কুটিল অতি, না কি যেন, সে আমায় লিখবে কেন?
—আশীর্বাদ জেনো
মুজতবা
[অচিন্ত্য = কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। বুদ্ধদেব = কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু। পেঁচি রায় = Dr. P C. Roy (আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়)। নিরালা = দক্ষিণ কলকাতায় লেখকের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। পুটপুটি = প্যারিমোহনের এক কন্যা। পুটপুটি ডাকনাম।]
পেঁচি রায়ের (PC.Roy-কে আমরা তাই বলতুম) cover-এর জন্য অনেক ধন্যবাদ। ওটা আমার এক সুই বান্ধবীর কাজে লাগবে। পেঁচি রায় আমার autograph-এ লিখেনে– Islam, the most perfed equalizer of men. ভারি মাইডিয়র লোক ছিলেন। এখানে এসেছিলেন। যেই শুনলেন, আমি মুসলমান অমনি জাবড়ে ধরে যা পিঠ চাপড়াতে আরম্ভ করলেন। এবং বিরাশি সিক্কা মাপে।
.
(১০)
২।১০।৬১
স্নেহের দীপংকর,
আশা করি আমার দু খানা পি. সি.-ই পেয়েছ।
চো করে এক চুমুকে নিশ্বাসে বই পড়া কাকে বলে জান? তাই হল কাল আমার। মোড়ক খুলে এবং নিশ্বাসে পড়লুম, পরশুরামের কবিতা। কী চমৎকার অদ্ভুত বই। কবিতাগুলো এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। তুমি যদি আমায় বেরসিক না ভাব, তবে বলব, সতীর তো কবিতা হয় না। মাইকেলের গাম্ভীর্য এবং রবীন্দ্রনাথের মাধুর্যের পিছনে অতি গোপন পরশুরামের দুষ্টু হাসি। সে হাসিটা কোন্ জায়গায় লুকনো আছে ধরতে পেরেছ, ভয় করি। তোমাকে লেখা কবিতাটির উপদেশ মেনে চলছ তো? তবে হ্যাঁ, সে-রকম গুণীজ্ঞানী কলকাতা কোথায়? আর আশ্চর্য ১৮৯৯- তখনও তিনি টীনে– কী বাহারে কবিতাই না লিখেছেন নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়িতে শালি-বাহন নাম সপ্রমাণ করতে! দুলাল, গৌতম, গোরাচাঁদ এরা সব কোথায়?
বাঙলায় বলে, বিবিজান চলে যান লবেজান করে। আমার বিবিজান আসি আসি করে, আসার বেলাতেই আমাকে লবেজান করে ছাড়ছেন। এখনও পাকা খবর পাইনি।
আঃ আঃ
এইমাত্র তোমার পি.সি. পেলুম। বিবি না এলে আমাকে যে রাজশাহী যেতে হবে সেটা ওই কলকাতা হয়েই যেতে হবে। কিন্তু নানাবিধ কঠিন কারণে ১৪।১০-এ তোমাদের বাড়ির প্রোগ্রামটা হবে না। তার আগেও হতে পারে, পরেও হতে পারে। সেটা তোমাকে যথাসময়ে জানাব। নিশ্চিত থাকো।
–সৈ. মু. আ.
.
(১১)
৩০।১১।৬১
ভ্রাতঃ,
তোমার পাঠানো কভার ঠিক সময়েই পেয়েছি। এটা আমার বান্ধবীর জানটা নিশ্চয়ই ত– করে দেবে। আগেরটা ফিরোজ মেরে দিয়েছে। বান্ধবীর দেওয়া জিনিস ব্যাটা মেরে দিলে এর রাজসিক উদাহরণ কাব্যলোকে আছে। ভিক্টোরিয়া (বিজয়া) ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথবে দেওয়া একখানা চেয়ার যখন বুয়েনোস আইরেস থেকে শান্তিনিকেতন পৌঁছল তখন রথীন্দ্রনাথ সেটি গ্যাড়া মেরে দেন–১৯২৬ খ্রি.-তে। তার ঝাড়া পনেরো বছর পরে ১৯৪১ খ্রি.-র মার্চ মাসে বাপ সেটা ব্যাটার কাছ থেকে চেয়ে নেন। শেষ লেখা পুস্তিকার চার এবং পাঁচ নম্বর কবিতা পশ্য। পাঁচ নম্বর কবিতার দোসরা লাইনে আছে খুঁজে দেব; কিন্তু হওয়া উচিত খুঁজে নেব। ওই সময়ে কবি আর লিখতে পারতেন না ডিটেট করতেন। তাই বোধ হয় গুবলেট হয়েছে। চেয়ারখানার ছবি পাবে (বৃহৎ) রবীন্দ্র রচনাবলীর পূরবী পুস্তকে। ফটোতে তিনি সেই চেয়ারে বসে, ভিক্টোরিয়া (বিজয়া) মাটিতে। বইখানা ওকেই উৎসর্গ করা হয়েছে, বিজয়া নামে।
আর্চ-ভবঘুরে আরও একটু পরে বেরুবে। দুটো চারটে উটকো লিখে নিই। একবার ওই দয়ে মজলে লবেজান। আসলে উচিত ভবঘুরে দেশে ও পঞ্চতন্ত্র আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে লেখা।
চাকরি নিয়ে ন্যাজেগোবরে। প্যোঁজপয়জার কথাটা জান? আমার হয়েছে তাই। অন্য কোনও প্রশ্ন মনে পড়ছে না, তোমার চিঠিতে।
আশা করি কুশলে আছ। আশীর্বাদ জেনো।
—সৈয়দ মু. আলী
.
(১২)
শ্মশান, শান্তিনিকেতন
২৩।৪।৬৩
ভাই সাহেব,
সেন পিসিটি কে বটেন?
আমাদের গরমের ছুটি। ১৫ থেকে ৩০৬। আমি ৪ তারিখ নাগাদ কলকাতা আসব। আজকাল উঠি মনোজ বসু*, P. 560 Lake Road, Tel. 461054-এ, কিংবা Great Eastern-এ কিংবা যততত্র। অর্থাৎ এখন আর কিছু ঠিক নেই। খবর দেব। তার পর রাজশাহী যাব।
[*মনোজ বসু = কথাসাহিত্যিক মনোজ বসু]
ইতিমধ্যে আসতে পারবে কি? তা হলে রইল মাত্র ২৭২৮ এপ্রিল। কিন্তু না এলেই ভালো। ভীষণ গরম! বরঞ্চ বর্ষায় এস। জায়গাটি বর্ষায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ ধরে।
Oscar Wild বলেছিলেন, আমাদের এমন অনেক কিছু আছে যা আমরা অবজ্ঞায় রাস্তায় ফেলে দিতুম, কিন্তু ফেলি না, পাছে অন্য কেউ কুড়িয়ে নেয়। তোমার দেখি তারই উল্টো পিঠ। অনেকেরই আছে, তাই এটা আমি রাখি কেন, ফেলে দিই। অর্থাৎ যদি ধরা পড়ে, আমি ডজন খানেক নববর্ষ শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাই, তা হলে তুমি তোমারটা ফেলে দেবে। এই তো? না, ভুল বুঝলুম?
মোদ্দা কথা, তোমার কাছে আছে শুধু scarcity value. জল বাতাসা তোমার কাছে মূল্যহীন। কিংবা বলি, আল্লা যদি দুনিয়ার সর্ব বাতাস বন্ধ করে শুধু তোমাকেই দম নিতে দেন তবেই তুমি খুশি হবে।
আমি অন্য পন্থায়। একবার কুরান-পুরাণ ঘেঁটে দেখি, কাল গঙ্গাজল দুষ্ট হয়ে যাবে। খেলে মানুষ পাগল হয়ে যাবে। চাষাদের বারণ করলুম। তারা আবার শোনে নাকি। জানে, আমি পণ্ডিত বটি, কিন্তু আস্ত গবেট। পরদিন খেল সবাই জল। হয়ে গেল বদ্ধ পাগল।
আমি আর কী করি? ছুটে গিয়ে এক আঁজলা খেয়ে নিলুম। কারণ it is mad to be same in a mad world!
অতএব সঞ্চয় করবে শুধু তাই, যা অন্য সব্বায়ের আছে। তা হলে তোমাকে কেউ হিংসে করবে না। পছন্দ করবে ফিল্মি গানা, খাবে পাইস-হোটেলের খানা, বিয়ে করবে কানা।
ব্যস! safe as the Bank of England.
কী সব আপ্তবাক্য বলে গেলুম। আরেকবার বললে নিজেই বিশ্বাস করে ফেলব।
এক বন্ধু জানালেন, শনিবারের চিঠি আমাকে impotent বলেছে। মনে পড়ল, Von Platter নামক জনৈক লেখক একবার Heine-কে আক্রমণ করেন। উত্তরে Heine লেখেন–
It is good so, that Von Platter is an open enemy of mine in front of me. I would be genuinely alarmed if I were to know that he is a friend of mine behind my back.
Von Platter–বলা উচিত– homosexual ছিলেন।
কী অশ্লীল! তোবা তোবা বলেও তৃপ্তি হয় না।
—সৈয়দ মুজতবা
.
(১৩)
P.O. Santiniketan
Birbhum
৯।৮।৬৩
ভদ্র,
ধর্মগ্রন্থ– বিশেষ করে মূল text –মাত্রই oceans of salt water. পানীয়-জল বের করতে হলে জানটা পানি হয়ে যায়। কাজেই জরথুস্ত্রি বাবদ অত খাটনি কি সইবে? তবু বলি, প্রথম পড়বে Encyclopaedea of Religion & Ethics-এ Zoroastrianism সম্বন্ধে প্রবন্ধ। তাতে যে biblography আছে সেটা তখন follow up করতে হবে। কিন্তু ERE মোটামুটি ১ম যুদ্ধপূর্ব। পরে ভালো বেরিয়েছে, E. Herzfeld, Zoroaster & his world, Punceton 1947 (USISকে বললে এনে দিতে পারে)।
আর ধর্মচর্চায় যেদিন interest হবে সেদিন কর। ধর্ম আচরণ অন্য জিনিস। সেটাতে যেদিন inte:est হবে সেদিন করবে। অযথা, তেষ্টা না থাকলে, জল খাবার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি বড় দুর্বল হয়ে পড়েছি। প্রায় সমস্ত দিন বিছানায় কাটাই। চোখেও ব্যামো। না থাকলেও প্যতুম না। অর্থাৎ চাকরি বজায় রাখার জন্য নিতান্ত যেটুকু কাজ করতে হয় তাই করি। in pain Bengali, আমি এখন দ্বিজেন্দ্রনাথকে অনুকরণ করছি। ভয় শেষটায় না হনুকরণ (arving) হয়ে দাঁড়ায়। শুয়ে থাকি, ক্লাস করি,– (rickshaw যোগে)–ব্যস্!
কবে আসছ? এখন এখানে ভারি সুন্দর। ফিরোজ ভালো আছে।
–আশীর্বাদ জেনো
আ
[দ্বিজেন্দ্রনাথ = দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।]
.
(১৪)
১৪।৮।৬৩
স্নেহাস্পদে,
ধর্মবাবদে সদাই সর্বপ্রথম পড়বে, Encyclopaedea of Religion and Ethics-এ যা জানতে চাও, তা। তখনও তেষ্টা না মিটলে ERE-এ যে bibliography দেবে সেটা follow up করা। তবে দুঃখের বিষয় ইনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে প্রকাশিত হন তার পরের খবর দিতে পারেন না। যদিও এ রকম একখানা Encyclopaedea ত্রিসংসারে নেই। অতি অতি অত্যুত্তম।
অতএব সর্বপ্রথম ওই কেতাবে Zoroastrianism প্রবন্ধটি পড়ে নেবে। বেলভেডেরেতে আছে।
শ-ছয় বোধ হয় দাম। Instalment-এ কেনা যায়। Standard Literature, Esplanade-এ এদের দোকান। বছর পাঁচেক পূর্বে, নতুন কী এক কায়দায় reprint বেরিয়েছে প্রায় ৩০ বৎসর out of print থাকার পর।
নিটশের Zorathustra তার আপন সৃষ্টি। তার সঙ্গে জরথুন্ত্রের কতখানি মিল সেটা আল্লায় মাসুম।
তুমি বোধহয় পাকিস্তান থেকে লেখা– জুন মাসে আমার একখানা চিঠি পাওনি। ফিরোজ এখানে ইস্কুলে পড়ে। মিত্তির এখানে অন্তত দশবার এসে আমার খবর নেয়নি। 1 have been cut, ওকে আর খুঁচিয়ো না। মাস আড়াই ধরে আমি অসুস্থ। ২২ ঘন্টা দিনের বিছানায় কাটাই। হপ্তায় তিন দিন ক্লাস নিই–নান্যপস্থা বিদ্যতে বলে। Organic কোনও trouble নয়। Rest, worst physical weakness, আহারে সম্পূর্ণ অরুচি বলে খেতে পারি না। Weakness-ও যায় না।
—আশীর্বাদক
আ
.
(১৫)
শান্তি
৭।৯।৬৩
স্নেহের দীপংকর,
আমার শরীর ও মন ভালো নয় তাই দীর্ঘ আলোচনাতে কী করে ঢুকি। সত্য বলতে কি পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় লিখতে কষ্ট হয়। না হলে পঞ্চতন্ত্র বন্ধ কেন?
দুই মতই correct যারা তোমার দাদুর শেষদিকের লেখা পছন্দ করতেন না, তারা কোনও রকম serious জিনিস পছন্দ করেন না। অর্থাৎ আমাদের কুসংস্কার, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, সামাজিক অনাচার, শাস্ত্রের প্রতি মূঢ় বিশ্বাস, ইত্যাদি বহুবিধ জিনিস নিয়ে তারা আদৌ আলোচনা করতে চান না। দাদু আসর জমিয়ে নিয়ে সেগুলোর hollowness দেখানো, অন্তত তাই নিয়ে একবার চিন্তা করতে প্রলোভিত করার চেষ্টা দেন এবং সেটা pure humour, কভু সামান্য satire, কভু বা reduction ad absurdum পদ্ধতিতে। কাজেই তারা সেগুলো পড়ে সুখ পায়নি।
আর যারা এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে তাদের sense of humour নেই। কাজেই এসব জিনিস আদৌ পড়ে না।
অন্য লেখকদের কপালেও দুর্ভোগ হয়েছে অন্যান্য দেশে। এদেশে, মনে কর, বিদ্যাসাগরের serious বই এখনও প্রচুর লোকে পড়ে, কিন্তু যেসব লেখা তিনি কস্যচিৎ ভাইপোস্য বেনামিতে লিখেছিলেন সেটা ক-জন পড়ে? সেখানে তিনি ওই রকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ (দাদুর চেয়ে অনেক রূঢ়, heartless; বস্তৃত রাজশেখরকে কখনও আমি সামান্যতম রূঢ় বা বেদরদী হতে দেখিনি) করে বিধবা-বিবাহের বিরুদ্ধ মত খণ্ডন করেছেন; মে-মতবাদীদের যেন সমাজের সামনে উলঙ্গ করে নাচিয়েছেন। ঈশ্বরচন্দ্র। তোমার দাদুর মতোই অতিশয় দয়াশীল ছিলেন কিন্তু যেখানে তিনি missionary সেখানে তিনি surgeon-এর মতোই মহেশ ন্যায়রতের (বিধবাবিবাহের দুশমন) পা দু খানা কপাক এম্পুটেটু করেন। দাদু তো মিশনারি নন। তার তো কোনও বিশেষ মতবাদ নেই। তিনি চান মানুষকে liberal হতে, মনের জানালাগুলো খুলে দিতে, একটু re-evaluate করতে, একটুখানি চিন্তা করতে।
Conan Doyle–এরও প্রায় তাই হয়েছিল অন্য ভাবে।
Tolstoy–এরও —। এবং দাঁড়াও না, নিতান্ত unexpected কিছু একটা ঘটলে এদেশে aesthetic sense যে রকম নেমে যাচ্ছে তার ফলে humour সম্পূর্ণ উপে যাবে। গড্ডলিকা, চলীও আর কেউ পড়বে না। Blunt লোকের পক্ষে humour serious, serious in humour, humour in serious, কোনওটাই পড়া হয়ে ওঠে না। এমনকি শার্লক হোম না পড়ে পড়বে মোহন সিরিজ!
এবং শেষ পর্যন্ত লোকে হয়তো বা ব্যবহার করবে একমাত্র চলন্তিকা!
আমি মোর কেটে আশা করতে পারি আমার দেশেবিদেশে হয়তো-বা লোকে পড়বে।
তবে East bengal এখনও খানিকটে পদে আছে। সেখানে আরও বেশ কিছুকাল অন্তত গড্ডলিকা, কজ্জলী পড়বে। কিন্তু তোক এখনও তার পরের লেখাগুলো পড়ে, যদিও বহু বিষয় typically হিন্দু problems বলে তার perspective পায় না।
Shakespearean dramatist-রা India-তে show দেখিয়ে বলেছিল, এখানে বিলেতের চেয়েও আদর পেলুম। সেটা ইংরেজির বেলা। সেটাও লোপ পাচ্ছে। রাজশেখর কলকাতার চেয়ে বেশি খাতির পাবেন ঢাকায়।
আরও কত কী বলার আছে। প্রচুর, এন্তের, কিন্তু আমার ইতিমধ্যেই প্রাণবায়ু নিঃশেষ।
অত্যন্ত জরুরি চিঠি যেমন ফিরোজের ভিসা renewal, আমার royalty-র reminder বিবিকে ফিরোজের নিতে আসার জন্য এদেশে আসার programme ঠিক করে দেওয়া, in the light of পুজোর liquid timing, সেপ্টেম্বর না অক্টোবর কোনও correspondence-ই করতে পারছি না।
.
(১৬)
শান্তিনিকেতন,
১৫।১১ কালীপূজা
ভদ্র,
চিত্ত চুলবুল করছে (পরশুরাম পশ্য!) যে আমি বৃদ্ধ, তায় মফস্বলের লোক, — তুমি চ্যাংড়া, অপটুডেট শহুরে তুমি কি না জানতে চাইলে, আমার কাছে, কালো বপইন্ট কোথায় পাওয়া যায়!!!
গত বছর যখন জর্মনি যাই তখন আমার এক প্রাচীন দিনের বান্ধবী– তাঁর বয়স ৫৬ আমাকে একটি বল্পইন্ট কলম দেন। চার রঙের কালি। এবং মেকানিজমটি এমনই চমৎকার যে একটা movement-এই রঙবদলাবদলি হয়। যেমন নীল দিয়ে লিখেছিলে লালের দরকার হল, সেটা underline করার জন্য– অমনি লালে পুশ করলে; সঙ্গে সঙ্গে নীল সুরুত করে উপরে চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে লাল বেরিয়ে এল!! –কিন্তু বিধি বাম, এদেশের শুকনো গরমেই হোক, বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, সবুজ বাদে তিনটি রঙই গেল শুকিয়ে। বান্ধবীকে বাধ্য হয়ে জানাতে হল, নইলে তিনি ভাববেন, আমি কোনও চিংড়িকে Present করে বসে আছি। বান্ধবী refill পাঠালেন এবং আমার কী বরাত– খামে ছিল কিন্তু পোস্টপিস সিল মেরে জখম করতে পারেনি, জর্মন ভাষার হিজিবিজি Customs বুঝতে না পেরে চারডবল মাশুলও চায়নি!!
স্টেটসমেনে বিজ্ঞাপনে দেখেছিলুম মাস দুই আগে যে কলকাতায় জর্মন বপইন্ট এসেছে। খুব সম্ভব Canning Street– মুর্গিহাটা? –না কোথায় যেন। কিন্তু alas! ঠিকানাটা লিখে রাখিনি। এখন কী করি, কও। তদুপরি এ refill এদেশে যে standard ball point বিক্রি হয় তাতে fit করে না।
স্ট্যাম্পের প্রতীক্ষায় রইলুম বড়দিনের পরে হলেও চলবে।
তুমি কি ভেবেছিলে আমি চারটে কলম নিয়ে লিখতে বসেছিলুম! হা ধৰ্ম! ভালোবাসা জেনো। আর জান, কালো রঙটাই চারটের সর্বোত্তম।
—আ
.
(১৭)
শান্তিনিকেতন,
২৭।১২।৬৩
স্নেহাস্পদেষু,
এখনও কি বড়দিন? আমার দিন তো কেটে গিয়ে হোট হয়ে গেছে। এখন আর ফুর্তি নয়–শান্তি। সোম রস এখন মঙ্গল লোকে।
তোমার পরীক্ষা কী রকম গেল? প্রায়ই সে কথা ভেবেছি। লিখি লিখি করে লিখে উঠতে পারিনি।
পরে সবিস্তর–
—আ
1) তুমি লিখলে, তোমার কালিটা (ball-point-এর) দিশি। এ-দেশে ও-মাল হচ্ছে কি? আমার মনে হয়, তোমার কালির (কালো) shade-টা lighter. Else it is same staff.
2) এর কালি বন্ধ হলে সেটাকে পুনরায় flow করবার কোনও কল জান কি? স্টাম্প একসঙ্গে এবমণ পাঠাবে? কিস্তিতে ২ কি দোষ?
মদ্যবাদে X’mas হয় না। সেটা ছেড়েছি সেপ্টেম্বর finally.
.
(১৮)
১৭।৬।৬৪
ভদ্র,
তুমি যে আমার ওপর অপ্রসন্ন সেটা জলবত্তরলং।* কিন্তু কারণটা হয় অতিশয় সুল, নয় আমার বুদ্ধি স্থূল– অথবা উভয়ই।
এবারে মরা ১০৫ ডিগ্রী থেকে ১১৫ ডিগ্রীর কী গেণ্ডেরিই না খেললুম। মাত্র পরশুদিন থেকে খেলা বন্ধ–মন্তিকার্লোতে যে রকম বলে rienne va plus, আমি রোজই ভাবতুম, এমন মারাত্মক গরমও আকাশ একটুখানি ঘামে না কেন?
রাজশাহী যাইনি। ফিরোজ গেছে। ১ জুলাই নাগাদ ফিরবে। এইবারে শান্তিনিকেতনে তার Sunday best পরবে। তুমি একবার এসো না।
আমি মাস কয়েক খুব ভুগলুম। অন্দ্রিা। এখন আগের চেয়ে ভালো।
আশা করি কুশলে আছ।
—আঃ
[*বোধহয় অনেকদিন চিঠি লিখিনি বলে।]
.
(১৯)
4, Andrews Palli,
৪ দীনবন্ধু পল্লী,
ঠিকানায় লিখতে হবে না–
যদি কখনও আসো তার জন্য;
৩০।৬।৬৪
ভদ্র,
অপরাধ নিয়ো না। আমি গত পুজো থেকে অসুস্থ। ফলে আমি এখানে নানাবিধ পুস্তক, ডাইরি ইত্যাদির মধ্যিখানে বিরাজ করতুম সেটা ত্যাগ করে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছি ও রাধাকৃষ্ণের (কৃষ্ণণের) উপদেশমতো তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করছি– অর্থাৎ গোটা চারেক বালিশে ভর করে সামান্যতম লেখাপড়া করি। তাই ডাইরিটি কাছে ছিল না বলে তোমার জন্মদিন– alas!–miss করি।
তোমার দু খানা খামই পেয়েছি। ফিরোজ ফিরে এলে তাকে দেব। সে দমদমায় নামছে। ৫।৭।৬৪ সকালের দিকে। Her Majestys Service থেকে কট্টর-কঠিন ফরমান এসেছে, আমি কলকাতা গিয়ে যেন তাকে ইস্তিল (receive) করি। অতএব আমি তিন কিংবা চার কলকাতায়। তুমি চারের সাঁঝে (কিংবা তিনের) যদি ফোন কর, নিরালা, Tel 473419 or/and 26/1 Dover Rd, Tel 475969 (দুটো বাড়িই কাছাকাছি) তবে খবর পাবে। ইস্কুল খুলছে ২৭৬৪ অতএব ফিরোজকে নিয়ে ৫৭/৬৪ই রওনা হতে হবে।
বাদবাকি কলকাতা এলে।
—প্রীতি জেনো
সৈ মু আলী)
.
(২০)
শান্তিনিকেতন
১২।৭।৬৪
স্নেহের দীপংকর,
আমার তো পাঁচ কলম ভোতা। তুমি কোন কালো কালিটা ব্যবহার কর জানিয়ে তো? সেটাও তো খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আমি যে bal point কালো ব্যবহার করতুম, সেটা ভি ফুরিয়ে গিয়েছে– refill এদেশে পাওয়া যায় না– কাজেই তুমি আর শোক করো না। Joneses donot have it either– যে কত বড় সান্তনা সেটা বিপ্লসন্তোষী হলে পরে জানাব।
আমি তোমাকে শুধিয়েছিলুম এবং তুমি আমার প্রশ্নটি বুঝতে পারনি যে, কোন ball point কলমের barrel-এর কালি হাফ ভরা থাকা সত্ত্বেও যদি সেটা শুকিয়ে যায়, অর্থাৎ flow বন্ধ হয়ে যায় তবে কি এমন কোনও substance আছে যেটা তার পশ্চাদ্দিকে ভরে দিলে তারই চাপে, কিংবা glycerine জাতীয় কোনও solvent কিংবা/এবং অন্য কোনও-কিছু জান কি, যার ফলে ফের flowটা সজীব হয়। Refill-এর প্রশ্নই ওঠেনি। অর্থাৎ সেই 1/10np-র barl-টা যদি খালিই হয়ে যায়, তবে সেটা refill করতে যাবে কে? অবশ্য সেই measure-এর refill size যদি এদেশে না থাকে তবে অন্য কথা।
আমার হয়েছে কী, কোনও জিনিস মনে থাকে না–লেখা-পড়ার কথা হচ্ছে না। এই তো, কিছুতেই মনে পড়ছে না, তোমার পত্রের উত্তরে পূর্বেই বলেছি কি না, আগে আমি একটা আরাম চেয়ারে দিনের ১৫।১৬ ঘন্টাটাক কাটাতুম। চতুর্দিকে হরেক রকম শেল ছিল। তারই উপর একখানা বইয়ে তোমার জন্মদিন– inter alia –অর্থাৎ ফিরোজ ভজু etc টোকা ছিল। সেটা মাঝে মাঝে দেখে নিতুম। গত ব্যামো থেকে এখন দিনের ২৩ ঘণ্টা কাটে বিছানায়। সে শেলফশুলো দূরে পড়ে আছে। তাই তোমারটা miss করেছি; যেমন ভজুরটা।
এবার ভাবছি ফিরোজকে তোমার বাড়িতে ২/৩ দিনের জন্যে পাঠাব। বড় হয়ে সে যখন কখনও সখনও-কলকাতায় আসবে, যেন তোমার খোঁজ নিতে পারে।
আমি মে মাসে ১৯ দিন কলকাতায় ছিলুম– চিকিৎসাধীনে। পাষণ্ড ডাক্তার কারওর সঙ্গে দেখাঁটি পর্যন্ত করতে দেয়নি বাড়ির লোক ছাড়া। তার অবশ্যি ইচ্ছা ছিল আমি যেন হোটেলে উঠি। Bar-এর ভয় ছিল না। সে কথা ডাক্তার জানত। কিন্তু তা হলে ১৫০০ নাগাদ খর্চা হত। সেটা যে সওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু Great Eastem-এর খাওয়া দিন পাঁচেক পরেই আর রুচে না। তদুপরি, আমি ছিলাম– অন্তত কিছুটা পথিতে।
– রবীন্দ্রনাথের শুটিকয়েক কবিতা পেয়েছি, ilt১-ঠিকানা তবে তারই কাছাকাছি। শুনেছি বৈজ্ঞানিকরা বলেন একেবারে নাস্তি থেকে অস্তি হয় না– ভারতীয় দর্শন তো বলেই, এবং commonsense তো বলেই। তা হলে প্রশ্ন, সেটা রবীন্দ্রনাথ দেখলেন কোথায়? পথে? তা হলে অত vivid হয় কী করে? skill ছিল বলে? মন সাড়া দেয় না। তিনি তো চিরকাল থাকতেন ivory tower-এ। আমরা যে অর্থে অন্তরঙ্গ সখা বুঝি তার তা কখনও ছিল না। জমিদারি করার সময় অতখানি tower-এ থাকা যায় না বলে জীবনের কিছুটা দেখেছন। কিন্তু মোটামুটি যে-সময় থেকে এখানে বাসা বাঁধলেন? ছোট মেয়ে রাণীকে আলমোড়া নিয়ে যাওয়া আসা ওই ধরনের ছিটোফোঁটা পথের বিপদ চতুর্দিকে– একে ওকে ধরাধরি।….
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যার চতুর্দিকে তখন ধুন্দুমার। বেহ্মজ্ঞানী ফেম্মজ্ঞানীতে ছয়লাপ। ওদিকে হেঁদুাও রয়েছে। রামানন্দ আসছেন (অবশ্য তিনিও বৃদ্ধবয়সে হিন্দুমহাসভার প্রেসিডেন্ট হয় পূর্ব পাপ ক্ষয় করছেন) বেহ্মমন্তর পড়াতে ওদিকে হেঁদুরা এনেছে বিধুশেখর শারীকে। আমি থাকলে নিশ্চয়ই তসবি হাতে কলমা শুনিয়ে দিতুম। যাকগে! এসব বলো না। দু জাতে মিলে আমার মুণ্ডুটি চিবোবে।
—-আলী
.
(২১)
২৪/৫।৭।৬৪
স্নেহের দীপংকর,
তোমার মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছে না, এ তো ভালো কথা নয়। তার বয়েস কীই-বা হয়েছে। ফিরোজের মায়ের চেয়েও ছোট; অর্থাৎ ৪৫। তারও কম হতে পারে। দেখায় আরও কম। আমি কী বলি, শোনো। মনটাকে তার কী প্রকারে প্রফুল্ল রাখতে পার তার জন্য deliberate throughout well-planned চেষ্টা দাও। বিলাতের বড় ২ হাসপাতালে এখন প্রত্যেক ward-এ একজনের ডাক্তার থাকে, specially to relieve pain & generate cheerfulness- সে রোগের treatment আদৌ করে না। এদেশের সর্বশাস্ত্র আছে, অপ্রসন্ন জনের কোনও সফল সিদ্ধি হয় না। এই যে যোগীদের (moden) photo দেখ, পুঁইডাটর মতো কাষ্ঠকঠিন শুষ্কমুখ– এটা হতেই পারে না। তার মুখ থেকে প্রসন্নতা ঠিকরে পড়ার কথা। মার্কিন জাতের প্রধান গুণ তাদের চিরপ্রসন্নতা : হার মানে না, বলে। Gee lets try again.
কই, তোদর সেই সস্তায় inserted letter –অর্থাৎ bearing post-এর চিঠি তো এল না? সেটাতে বুঝি ঠিকানা দিয়েছে, Ali, Heaven knows where, Sender-এর ঠিকানা না থাকলে পুরো ঠিকানায় চিঠি আসে না, থাকলে স্বল্প ঠিকানায়ও আসে– বেয়ারিং চিঠির বেলা।
… …
জর্মনে বলে good nerves কারে কয়? যে যত বেশি disorderliness সইতে পারে। তোমার ঠাকুর্দা disorderliness সইতে পারতেন না। তাই ভুগেছেন। তুমি এই বয়সেই সেটা এত বেশি রপ্ত করে বসে আছ যে, তোমাকে অনেক দুঃখ সইতে হবে। আমিও সয়েছি। এখন অনেকখানি চেপে যাই।
.
(২২)
4 Andrews, Santiniketan,
July, 29th, 64.
ভদ্র,
আমার মতো বুড়ো-হাবড়াদের সঙ্গে লেখালেখি করার ওই তো বিপদ। যাই বল না কেন, বুড়ো বলে ওসব জানা কথা।
রাজার প্লটটা জাতক থেকে নেওয়া। কিন্তু ঠাকুর এটাকে অন্যভাবে ব্যবহার করেছেন। রাজা= God, কেউ তাকে দেখতে পায় না। শুধু যে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে নাস্তিকদের নিন্দাবাদ না শুনে– এস্থলে রানি অর্থাৎ ভগবদভক্ত (খ্রিস্টও বলেছেন বোধহয় মোটামুটি Blessed are those who donot see, but believe!) তার কাছে রাজা = আল্লা অন্ধকারে হৃদয়ে হৃদয়ে, হৃদয়ের অন্তস্তলে দেখা দেন। আরও মেলা রূপক আছে, আমার মনে নেই। আসলে acting-এর সময় double meaning, অর্থাৎ face meaning and allegorical meaning দুটো সকলে বের করতে পারেন না। অলঙ্কারশাস্ত্র বলেন, নাট্য এমন হবে যে কেউ যদি allegory-টা আদৌ ধরতে না পারে, তার কাছেও যেন নাট্যটি charming মনে হয়। আবার ভক্তজন হয়তো শুধু allegory-টাই দেখল– পার্থিব দিকটা আদৌ লক্ষ করল না তার কাছেও যেন নাট্যটি equall charming মনে হয়। এবং প্রকৃত গুণীজন দুটোই চাখবে। তবে সার্থক acting very much, therefore, depends on how the actors express, pronounce their speech. colats 1607, avarage, normal সুবুদ্ধিমান যখন গোপন অর্থের কিছুটা আমেজ পেয়ে হাতড়ে মরেছ, তখন বুঝতে হবে ড্রামাটি দুই অর্থের মাঝখানে লিলিক করে মাঠে মারা গ্যাছেন। তুমি যদি allegory-র কোনও গন্ধটুকুন পর্যন্ত না পেয়ে শুধু face value-টুকুতেই আনন্দ পেয়ে বাড়ি ফিরতে, তবু বলতুম নাট্যটি সার্থক অভিনীত হয়েছে।
কীর্তনের বেলাও হুবহু তাই। রাধার বিরহ-বেদনা যদি যুবক-যুবতীর প্রেম অর্থে নাও তবে কিসটি আপত্তি নেই। যদি বল, আহা, যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কদম্ববন-বিহারিণী বিরহিনী শ্রীমতাঁকে– বিলকুল দুরস্ত। পক্ষান্তরে যদি বল, এমন প্রেম, এমন ব্যাকুল্যা, এমন একাগ্রতা তো মানুষের তরে মানুষের হতে পারে না– এ তো আমার কাছে অন্য ভুবনের রূপরসগন্ধস্পর্শ এনে দিচ্ছে– সে-ও অত্যুত্তম। আর দুটোই যদি পাও, simultenously তবে তুমি সুরসিক,– কীর্তনিয়া সার্থক। এ দুনিয়াটাতে এখন আর কীর্তনিয়া নেই। ব্যাটারা শুধু আখর সারে, টেকনিকল skill দেখায়, মৃদঙ্গের খচখচানি শোনায়। আমি কেত্তন শুনতে যাইনে। ওই একটা জিনিস বড়ই miss করি।
আ—
[ঠাকুর্দা ভুলে লিখেছেন। বলতে চেয়েছেন দাদু (আসলে আমার মায়ের মাতামহ, রাজশেখর বসু)।]
.
(২৩)
১০/৮/৬৪
স্নেহাস্পদেষু,
তোমার insured letters এখনও পাইনি। তবে এই ভেজাল insurance-এর অপর একটা দোষ, দেরিতে আসে। তবে tempo ওদের bookpost-এর পিছনে। Bearing এবং Express দিলে কী হয়, জানিনে। তবে সেটা হবে ছাগলকে insure করা হাতির দাম দিয়ে। ভুল বললুম, সেটা হবে, ছাগল হারিয়ে গেলে হাতি মানত করা।
Bearing ছিঁড়ে ফেলা গ্রামাঞ্চলে প্রযোজ্য। তিন মাইল ঠেঙিয়ে ওটার জন্য কয়েক পয়সা রোজগার করতে পিয়ন নারাজ। সচরাচর তারা হাটবারে ওই গায়ের কাউকে (paid) চিঠিটা দিয়ে দেয়। সে লোক ও bearing-এর পয়সা দিয়ে নেবে কেন?
Express চিঠির বেলাও তাই। বিশেষ করে কলকাতায়। গোটা দশেক চিঠি নিয়ে পিয়ন বেরুল। একটা পড়েছে ধরো একটু বেশি দূরে। সেটা সে ছিঁড়ে ফেলে। Ordinary letter-এর লো তা হয় না। কারণ তার beat-এর শেষ পর্যন্ত দু একখানা চিঠি থাকেই। তাই আমার কলকাতার বন্ধুরা পই পই করে বলেছেন, express যেন না লিখি। যদি লিখি তবে সঙ্গে যেন আরেকখানা plain লিখি। যেরকম Voltaire বলেছিলেন, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মারা যায় বইকি! তবে to make sure, আগে ঠেসে arsenic খাইয়ে দেওয়াই ভালো।
তোমার বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। Disorderliness সইতে পারার ক্ষমতাকে good news বলে –এটা একটা general principal. আমার চিঠি disorderly ছিল বলে বলিনি।
A propos আমার চিঠি, সেই general principal-টা বাতলে ছিলুম।
তোমার মাতা 100% না হলেও 99% wrong!* আমি নিজে দেহলী বাড়ির নিচের পাশের নূতন বাড়িতে ঝাড়া একটি বছর ছিলুম। রাত্রের অন্ধকারে কবিকে গুনগুন করে গান গাইতে গাইছে (সুর এবং কথা একসঙ্গে) এবং মাঝে মাঝে থেমে থেমে গিয়ে সেটা ওই অন্ধকারেই কাগজে টুকে নিতে (এটা inference–কারণ অন্ধকারে তার গলা শুনতুম, কিছু দেখা যেত না) দেখেছি; rather শুনেছি। পরের দিন সকালেই (সম্ভব না হলে বিকেলে) তিনি দিনুবাবু সঙ্গে সেইটি গুনগুন করে গেয়ে তাঁকে শিখিয়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথের ডজন ডজন গান একই সুরে আছে। বিশেষত বাউলে। কিন্তু প্রায় প্রতি গানেই কিছু না কিছু আচমকা twist থাকে; কিংবা তালে আড়ি থাকে (আপাত দৃষ্টিতে বেতালা– যার জন্য তার বদনাম, তিনি বেতালা) তাই দিনুবাবুকে সেটা রপ্ত করতে হত। দিনুবাবু না থাকলে প্রাচীন কালে অজিত চক্রবর্তী। একদিন তিনিও ছিলেন না, তখন বারো বছরের সুধীরঞ্জন দাশ (তস্য পুস্তক পশ্য)। শুনেছি very very rarely indeed, দিনুবাবু change in a very minor point suggest করতেন। ব্যস। দিনুবাবু এখানে আসেন about 1907. তার পূর্বে কে ছিল? জ্যোতিবাবু ২০/২৫ বৎসর রবিকে চরে খা বলে ছুটি দিলেন। মধ্যিখানে, কে, কারা? বিশেষত এই ভারতের tradition যে কথা রচে সে-ই সুর দেয়। রামপ্রসাদ, অতুলপ্রসাদ, জ্যোতিঠাকুর, নজরুল ইসলাম, লালন ফকির, হাসন রাজা, সত্যেন ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, ব্রাহ্মসঙ্গীতে গণ্ডাগণ্ডায় কত বলব? মাথা ঘামিয়েও exception খুঁজে পাচ্ছিনে। এবং যেখানে অনন্য সুর দিয়েছে গোটা দুত্তিন by পঙ্কজ, শান্তি ঘোষ, পূর্ব যুগে জ্যোতিঠাকুর। সে তো পষ্টই mention করা আছে। জানো, তেজেশচন্দ্র সেন নামক একটি লোক এখানে ৫০ বৎসর বাস করেন। এর নাম কেউ করে না। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে শেষ রোগশয্যায় ইনিই তার সেবা এখানে করতেন। আমি অন্তত হলপ খেতে রাজি আছি, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। যদিও কেউ তার নাম করে না। ইনিই আমার মতে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গভাবে চিনতেন। কখনও কাছে যেতেন না, না ডেকে পাঠালে। তাই নিয়ে কবি বিস্তর অভিমান করেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন তাঁর প্রতিজ্ঞায় অটল অচল। আমার সামনে বছর চারেক পূর্বে, কে যেন এই প্রশ্নটি (!) তোলে। তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে যা বলেন, তার সঙ্গে আমার বক্তব্য মেলে। আমি supplementary শুধোই, তিনি কি কখনও দিনুবাবুর কোনও suggestion accept করেন নি? পরিষ্কার বললেন, না। উনি করেননি। দিনুবাবুর চলে যাওয়ার পর এখানে ভূতের নৃত্য আরম্ভ হয়। যাদের হাতে দিনুবাবুর কাজ পড়ে তারা ছিলেন most thoroughly incompetent। ওই finer twistগুলো miss করে যেতেন। যার কথা পূর্বে বলেছি। তার পর আরম্ভ হয় regular জোচ্চুরি। শার্সদেব জানে।
আমি এখন কিছুদিন চিঠি লেখার পাট তুলে দিচ্ছি। তুমি তোমার মনে প্রশ্নের উদয় হলে টুকে রেখো। দেখা হলে উত্তর দেব। বলা সোজা; লেখা কঠিন। যে কারণে আমি controversy-তে ঢুকি না। Love & bliss!
—আ
[আমার মা হঠাৎ একদিন বলেছিলেন সব রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর আসলে দিনু ঠাকুরের দেওয়া। চমকে গিয়ে এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলুম।]
.
(২৪)
C/o Inspectress of Schools
PO. Ghoramara. 22. 10. 64
স্নেহের দীপংকর,
বিজয়ার আলিঙ্গন গ্রহণ কর ও আশীর্বাদ জেনো। তোমার মাসীরও আশীর্বাদ জেনো। ফিরোজ ভজু ব্যাপারটা এখনও কী ঠিক বুঝতে পারেনি। তোমার চিঠি পেলুম। ওরা স্ট্যাম্প নিল।
এ বাড়িটার দশ হাত পরেই বিরাট পদ্মা। পাড়াটা উঁচু নয় বলে শহরের সবকটি প্রতিমা বিসর্জন হয় এখানে, মেলা বসে, তেলেভাজার গন্ধে আমার ঘরটা ম-ম করে। এ বাড়ির বারান্দায় বসে পদ্মার যে দৃশ্য দেখা যায় সেটি দেব-দুর্লভ। এর বর্ণনা আমার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও পদ্মাপারে, পদ্মার বুকে বহু বৎসর কাটিয়ে পারেননি। এর এমন একটা bewildering grandeur আছে যেটা মানুষের চৈতন্যকে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়। এর সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলা যায়, শুধু এই বিরাট grandeurটা কিছুতেই impart করা যায় না। আর পারা যায় না, যখন রাতদুপুরে নিরস্ত্র নৈস্তব্ধ্যের মাঝখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখবে চাঁদের আলোয় মাখা পদ্মার জল, অনেকদূরের চড়া, তারও অনেক দূরে চরবাসীদের দু একটি ক্ষীণ আলো অন্ধকার রাত্রে সেগুলো তারা না প্রদীপ ঠাহর করা যায় না– এবং তার পর যেন কুয়াশার যবনিকা। দিনের বেলা সেখানে দেখা যায় একটি আসমানি রঙের খেলা– যার নাম india; এপার পাকিস্তান। আর সমস্তটা সামনে বিস্তৃত বিস্তীর্ণ অর্ধচন্দ্রাকার– দুপুররাত্রে সাহারায় যে রকম দেখেছি। কী যে গভীর রহস্য, কেমন যেন আতঙ্কে ভরা। এই রহস্য, এই আতঙ্ক কিছুতেই কলমের ডগার একফোঁটা কালিতে প্রতিবিম্বিত হতে চায় না। গোম্পদ যে-রকম without effort অনন্ত আকাশ বিম্বিত করে, কলমের কালির ফোঁটা তেমনি পারে না কেন?
তুমি তোর পরীক্ষা নিয়ে যেরকম fuss করছ, সেরকম প্রথম গর্ভবতী সন্তান প্রসবের সময়ও করে না। আমার হাসি পায়, তার পরের কথা ভেবে। ধর তুমি 1st class-ই পেলে। তার পর প্রফেসরি পেলে। তার পর যে কোনও কারণ বা কারণ সমন্বয়ে হলে thoroughly disgusted তখন বললে, দুত্তোছাই, কেনই-বা মরতে 1st হলুম। IInd class পেলে এদ্দিনে অন্য কোনও ধান্দায় ডুবে গিয়ে এর চেয়ে ঢের বেশি আরাম পেতুম।
জীবনের big gambling battle-এর সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছ, এই M.Sc. পাসটা যেন one mighty big stake! Alas! It is one of the smallest. হাতের সামনে আপন হাতের বন্ধু মুষ্টি বিরাট হিমালয়কে ঢেকে ফেলে।
আসল বেদনা পরীক্ষা পাশের পর আরম্ভ হয়। এতদিন সামনে ছিল একটা সুনির্দিষ্ট aim– এর পর সামনে বিরাট ব্লাঙ্কো void! ওই সামনের পদ্মাটার মতো। ওপারের নীলাঞ্জন রেখাঁটিও দেখা যায় না। কিংবা তার পরে ঢোকো জাতিলের ভিতর along with millions & millions loossing completely all your indentity! স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের ভিতরও যেটুকু individuality ছিল– for good or bad– সে-ও তখন কদুর!
And perhaps it is good so. লাওৎসে বলেছেন, আর পাঁচজনের যেটা নেই সে রকম কোনও বৈশিষ্ট্য যদি তোমার থাকে, তবে তোমার প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য সেটাকে প্রাণপণে লুকিয়ে রাখা। নইলে সবাই মিলে তোমাকে টেনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
আমি বুঝি একটি কথা : a steady income from ancestors আর ঘরের এক কোণে বসে পুতুল সাজিয়ে, খেলনা গড়ে জীবনটা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। সেটা পছন্দ না হলে, আর কাড়া কাড়া foreign exchange থাকলে round the world trip-এর কোনও একটা জাহাজে বাকি জীবনের জন্য টিকিট কাটা। A bigger merry-go-round, round the world.
আশা করি এর থেকে খাঁটি তত্ত্বটি বুঝে যাবে।
পরিবারস্থগণকে সেলাম বিজয়ার জানিয়ো।*
–আ
[** এই চিঠির প্রথমাংশ এক অকল্পনীয় কাব্য।
পরের অংশে হঠাৎ প্রখর বাস্তবে এসে তার পর্যালোচনা করেছেন তার আকাশ-ছোঁয়া পণ্ডিত্যের দর্পণে।
এবং সমাপ্তি এমনই anti-climax-এ, যার একমার্থ পরিচয়, Logo- মুজতবা আলী।]
.
(২৫)
45. Quarters, Andrews Palli.
দীনবন্ধু পল্লী। আমি ইংরেজিতে লিখি
Andrews Shire,
বাংলায় দীনবন্ধু বস্তি। এটা ঠিকানায়
লেখবার দরকার নেই। যদি কখনও
আসো তার জন্য। ঠিকানা পূর্বের মতো;
Plain শান্তিনিকেতন।
25.3.65
স্নেহের দীপংকর,
কোনও খবর নেই। বিশ্বজগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতই কম যে তোমার শেষ পরীক্ষা কবে হল, তার পর কী হল কিছুই জানিনে। আমাদের common enemy-ও কেউ নেই যে অন্তত দুঃসংবাদটাও জানায়। আর friends সংসারে কম; common friend-এর কথাই ওঠে না। তবু mood-এ থাকলে খবর দিয়ো। পরীক্ষাতে ভালো ফল করে থাকলে ভালো, না করে থাকলে আরও ভালো। কেন, দেখা হলে বুঝিয়ে বলব। এত বড় gamble পৃথিবীতে মাত্র আর একটি আছে। বিয়ে। It is the only gamble which humanity has discovered where both parties can loose.
তুমি এতদিন ফিরোজকে স্ট্যাম্প দিয়েছ; এবারে আমি তোমাকে মোম এক সেট পাঠাচ্ছি। আশা করি পছন্দ হবে। যাদের ছবি তারা Hitler-কে মারবার চেষ্টা করেছিল, কিংবা ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল। এর মধ্যে Sophill scholl অতি অদ্ভুত মেয়ে ছিল। তার আন্দোলনের নাম ছিল White Rose। মেয়েটিকে জেলে এমনই অত্যাচার করেছিল যে ক্রাচেস-এর উপর ভর করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফাঁসির দিকে এগোয়। সমস্ত জৰ্মনি যখন ভয়ে স্তব্ধ তখন মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বেআইনি পত্রিকা নির্ভয়ে বিতরণ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কতই-বা বয়েস ছিল তার। জর্মনরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তার জীবনী লিখেছে, এবং এখনও তার জীবন নিয়ে special research-এর ব্যবস্থা আছে।
আর যে বোমাতে হিটলারের Conference room went sky high killing outright nearly 1/2 dozen সেটা টেবিলের নিচে রেখেছিলেন Stenffenberg. যুদ্ধে ইতিপূর্বেই তার একখানা হাত ও একটি চোখ গিয়েছিল। বোমার পিন খোলার জন্য এক হাতে তাকে একটা বিশেষ opener যোগাড় করতে হয়েছিল।
Dem deuponer etc অর্থে :
On the anniversary on 20th July of German Resistance.
আমি এদের শ্রদ্ধা করি কিন্তু antinazi- ইরেজের মতো নই বলে মাতামাতি করিনে।
ফিরোজ তার album-খানা ছোট ভাই ভজুয়াকে দান করেছে। এখন তাবৎ ইষ্টাম্বো একটা থামে ভরে রাখছে। কলকাতায় নাকি album পাওয়া যাচ্ছে না। আমি Newman-কে একটা চিঠি লিখেছিলুম। সরেলোগ (হিন্দিতে কটুবাক্য বলতে হলে শ্বশুরেরা বলে) উত্তরই দিলে না। তুমি কোথাও পেলে তাদের ডাক খরচাটা (only on this condition) দিয়ে আমাকে VPP করে পাঠিয়ে দিতে বলো। নইলে হয়তো ফেরত যাবার ভয়ে পাঠাবে না। কিন্তু এই স্বার্থপর উদ্দেশ্য নিয়ে ও চিঠি লিখতে বসিনি। কথায় কথায় এসে গেল যখন তখন সঙ্কোচ আর করলুম না।
তোমার পিতৃদের মাতাঠাকুরাণীকে আমার নমস্কার জানিয়ো।
একশো বছ; আগে সোনারবেনেরা যখন গঙ্গার পারে বাগানবাড়ি করতে যেত তখন সেখানকার পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে কাট্যা ফালাইলেও কথা বলত না, পাছে কীর্তিকলাপ শহরে পৌঁছে যায়। মিত্তির সেই তোপা ঐতিহ্যটি বেড়ে বজায় রেখেছে। আমার সন্ধান করে না। ওকে বলো, আমি ভর্সা দিচ্ছি।
–আশীর্বাদ জেনো: আ
উল্টোপিঠের ছবিটা Fusiang Island-এর Sylt নামক জায়গায় Danish-German বর্ডারের কাছে। এদের ভাষা bridge between English & German. Philologist-দের চোখের মণি ভাষা।
.
(২৬)
শান্তিনিকেতন
৬।৪।৬৫
বাবাজী,
চেখফের রুশ থেকে অনুবাদ করতে কোনও বাধা নেই; কারণ তিনি গত হয়েছেন ১৯০৪। কিন্তু ৫ লোকটি ইংরেজি অনুবাদ করল, তার ইংরেজি থেকে ফরাসি বা বাংলা অনুবাদ করলে তার Copyright transgress করা হয়। অবশ্য আদালতে তার পক্ষে সেটা প্রমাণ করা সুকঠিন। কিন্তু তার অন্য Protection-ও আছে অর্থাৎ তুমি তার ওই ইংরেজি অনুবাদ তোমার কোনও anthology-তে ছাপাতে পারবে না, ড্রামা হলে act করতে পারবে না, কিংবা এমনি ছাপিয়ে (বড় বই হলে) বেচতে পারবে না।
Copyright 1914 অর্থ, বই ওই সময়ে বেরোয়, কিংবা Scribner অন্য প্রকাশকের কাছ থেকে যদি ওই বছরে copyright কিনে থাকে তবে সে-সময় থেকে তার copyright, কিন্তু তোমার খুঁজে বের করা উচিত এ-দেশে কোনও লেখকের বই ক-বছর পরে অনুবাদ করা যায়। আমার যতদূর জানা, বই প্রকাশের ২০ বছর পরে (এটা maximum. কোনও কোনও দেশে ১০ বছর) অনুবাদ করা যায় even if the author is alive at that time. এদেশে বিদেশি কোনও প্রকাশক যদি মোকদ্দমা করে তবে তাকে এদেশের আইন মানতে হবে– তার দেশের নয়। অতএব, তুমি নির্ভয়ে অনুবাদ করতে পার। কারণ এদের সক্কলেরই বই, বা তার ইংরেজি অনুবাদের পর ২০ বছর কেটে গেছে।
পার যদি Encyclopaedea Br.-তে copyright প্রবন্ধটি পড়ে নিয়ে।
তুমি দেখছি এসব চিন্তা করে করে মেঘে মেঘে বেলা ঘনিয়ে আনবে। নিতান্ত মাসিক সাপ্তাহিকের মাল বাদ দিয়ে মোটামুটি যে-কোনও মাল অনুবাদ কর। অত ভাবনা কিসের!
U.S.A-এর সঙ্গে আমাদের বোধহয় কোনও চুক্তি নেই। অন্তত এক কালে ছিল না। Russia-র সঙ্গে এখনও নেই।
—আশীবাদ জেনো। আ
ভারতকোষ নতুন যে বিশ্বকোষ বেরিয়েছে তাতে খুব সম্ভব কপিরাইট covered হয়েছে। থাকলে তাতে ভারতীয় copyright-এর আইন থাকার কথা।
পুরনোটাও কাজে লাগতে পারে।
.
(২৭)
C/o Dr. Samar Chowdhury
Merryland Nursing Home
P 46 C.I.T. Road Scheme L 11
Calcutta-14
April 14/15-4-66
ভদ্র,
সব মালই* পেয়েছি। কিন্তু যবে থেকে আমরা যে দিল্লি দূর অস্ত–সেই দিল্লিতে থানা গেড়ে হুঙ্কারিয়া বেরোলুম, লাহোর দূর নি–তবে থেকে ফিরোজ-ভজুকে এ-সব অমূল্য সরেস চিজ পাঠাই কী প্রকারে? বস্তুত মাসদুই পরিপূর্ণ নীরবতার পর বাবাজিদ্বয়ের পত্র পেলুম, জর্মনিতে প্রতিষ্ঠিত এক চেলা মারফৎ! What a short cut!** কে বলে নাক ঘুরিয়ে দেখানো একুশে আইনে মানা? আর জর্মনরাই বলে, Warum einfach machen wenn es kompleizierd geho? Why make it simple, if it can be made complicated?
উপরের ঠিকানায় আছি সাতিশয় acute তথা chronic অনিদ্রা ম্যারামতীর তরে। But alas, no visitors, no phones, not even mails without censoring! Voita–lala, say the Franc, ais!
মিত্তিরকে*** বলো, এটা তো সরল। প্রথম করে এল বাখ-এর etc etc… তখন শব্দটা যে Bach, Bache (বাখে) নয় সেইটে বোঝাবার জন্য লিখলুম বাখ-এর। তার পর প্রতিবার বাখ-এর লেখার কী প্রয়োজন? বাখের লেখাতে বাধা কি?
এতসব সরল বস্তু যদি মিত্রাদি মিত্রের মতো সুবুদ্ধিমানরা না বোঝেন তবে লেখা চালু রাখি কোন ভর্সায়?
আজ থাক নারদে**** সঙ্গে ভেট হলে আমার বোহ বেবাহৎ সালাম- তসলিমাৎ জানিয়ো।
শুনতে পেলাম পূর্ব পার্কে প্রতিষ্ঠিত নব Harrow-Eton-এ ফিরোজভজৌ পুরোপাক্কা residential পে প্রবেশ করেছেন দুজনাই test-এ প্রথম হবার পর। তোমার মায়ের দোস্তনীটি বড়ই একা পড়ে গেল। কিন্তু মেয়েটার সর্ববিশ্ব ওই দুটো মর্কটকে নিয়ে।
–Love & blessings
সৈয়দ
[*ছেলেদের জন্যে ডাকটিকিট।
**১৯৬৬-র যুদ্ধের ফলে রাজশাহী থেকে শান্তিনিকেতনে চিঠি বন্ধের জন্যে তা ঘুরে আসতে হয়েছিল জর্মনি হয়ে।
*** মিত্তির- আমর পিসতুতো ভাই, দর্জিপাড়ার অনিল মিত্র।
****যতীন্দ্রকুমার সেন।]
.
(২৮)
০১.
C/o Mrs. R. Ali,
Inspectres of Schools
ফুটকি পাড়া
Po. Ghoramara, Rajshahi
East Pak, Dec. 25th 66
স্নেহের ভদ্র দীপংকর,
অনেক কাল তোমার কোনও খবর নিতে পারিনি।
এ বছরটা আমার আদৌ ভালো কাটেনি। দু দুবার নার্সিং হোমে ঢুকেছি। তবে সিংহের বিবর হতে দিনি সেই হোম-কে যদ্যপি একথা অতীব সত্য যে সেখানে বড় নিশ্চিন্দি কাটিয়েছি। ডাক, ফোন, ভিজিটর তিনই ছিল সৎ বারণ।
এক মাসের বাদে হেথায় এসেছি– ডাক্তারেরই আদেশে।
তোমার মাতর সখী পুত্রদ্বয়সহ সানন্দে দিন কাটাচ্ছেন। তারা উভয়েই থাকে হস্টেলে। রোজার পাঁচ সপ্ত হের ছুটিতে দ্যাশে ফিরেছে। যদিও তাদের residential school (ইটন হ্যাঁরোর হনুকরণে নির্মিত) মাত্র ১৫ মাইল দূরে।
কী জানি কী হয়েছে বোধহয় nerves-এর ব্যাপার একটি হরফ ত লিখতে ইচ্ছে করে না। প্রবন্ধাদি তো ন-সিকে শূকর-গো মাংস। তথাপি যখন আমার-আনা, তোমার-দেওয়া first day cover-গুলো বাবাজি ভজুরামকে দিলুম, সে সোল্লাসে একখানা অত্যুত্তম stamp তোমার তরে দিলে।
বু আলী সিনা, আবু সিনা Advicenna (লাতিনে আভিচেন্না; আভিসেনা উচ্চারণ) ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত বাগদাদে। তিনি তাঁর গ্রন্থে চরক সুশ্রুত ইত্যাদি উত্তমরূপে ব্যবহার Posilcatal- on the foundation of Greek medicine which the Arabs learnt from the Jews. দু শো বচ্ছর আগেও এর বই ইয়োরোপীয় Medical College মাত্রেই পড়ানো হত। গজনির মাহমুদ এবং তার সভাপণ্ডিত অলবিরুনি ছিলেন তাঁর সমসাময়িক।
তোমার মাকে ফিরোজ-ভজুর মার ভালোবাসা দিয়ে, তোমাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছি আমরা উভয়ে।
—সৈ. মু. আলী
০২.
বিবর সম্বন্ধে।
বিভারলি নিকলস, মিস মেয়ো ইত্যাদির পলিসি ছিল মার্কিনি খবর-কাগজদের :- Kick up Hell, & Sell!
ভয়ঙ্কর কুৎসিত বীভৎস লেখো, কিংবা অথবা কোনও গাড়লস্য গাড়ল দেশ বা জাতিকে গালাগাল দাও। গাড়ল ক্রিটিকরা ভায়োলেন্টলি রিঅ্যাক্ট করবে, ফলে গাড়লতররা বইটা কিনবে; তোমার দু পোসা হবে। আমি এ পলিসির নিন্দা করিনে, কারণ টাকাই যদি কামাতে হয় তবে সেখানে মরালিটির প্রশ্ন ওঠে না–মেজর বারবারা (বার্নার্ড শ) ও চার্লির মসিয়ো ভের্দু পশ্য। তবে এর ভিটি হতে আমি রাজি নই; তথা এ পলিসির হিস্যেদার হতেও আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত আপত্তি আছে। তাই যখন প্রকাশক তারাপুরওলা আমাকে নিকসের বইয়ের তুখোড় উত্তর লেখবার জন্য মোটা টাকা অফার করেছিল আমি রাজি হইনি।
তুমি লিখেছিলে এবং যদি লেখার মধ্যে সার কিছু থাকে তা হলেও সাহিত্যে নোংরা মিডিয়মের প্রয়োজনীয়তা কী? সার্থকতা কী?
ওইখানেই তো মামীর ব্যামো গল্পটা জানো কি? মারাত্মক অশ্লীল but with a point, তবু লিখলুম না।
তা হলে যে কার্যসিদ্ধি হয় না।
এ সুবাদে বলি :
সন্তোষ ঘোষকে একদা আমরা প্রায়-শিষ্যরূপে কাছে পেয়েছিলুম। সেই সময় সে একটা বীভৎস তথা অশ্লীল গল্প লেখে। আমি অবিশ্বাস্য শুদ্ধমাত্র ওর এবং ওই সম্প্রদায়ের পথপ্রদর্শনরূপে লিখি। ওতে খুন ব্যভিচার তাবৎ বাৎ আছে শুধু বোধহয় bestiality নেই। কিন্তু মিডিয়মটি পশ্য।
—আশীর্বাদ জেনো
সৈ. মু. আ
.
টেলিফোন : ৪৮-৩৫৯১
৭২, বকুলবাগান রোড, কলিকাতা-২৫
ডা. শ্রীযুক্ত সৈয়দ মুজতবা আলী
শান্তিনিকেতন
প্রীতিভাজনেষু।
আপনার ১৪।১-এর চিঠি পেয়ে আনন্দিত হলাম। আগামী ১৮ মার্চ আমার ৮০-তম জন্মদিন। আপার শুভেচ্ছা ২ মাস আগে পেয়েছি তা ভালোই, কারণ এর মধ্যে কী ঘটে বলা যায় না।
দৃষ্টি অতি ক্ষীণ, সেজন্যে পড়া খুব কমাতে হয়েছে, কিন্তু আপনার রচনা পেলে চক্ষুপীড়ন করেও পড়ি। আপনার বিচিত্র অভিজ্ঞতা বিচিত্র ভাষায় আপনি আরও লিখুন, এই প্রার্থনা করি।
আমার বয়স এমন ভয়ঙ্কররূপে বেড়ে যাচ্ছে তা সবসময় মনে থাকে না। শতায়ু হবার ইচ্ছা নেই। অহ বা পক্ষাঘাগ্রস্ত হয়ে বেঁচে থাকা জীবন্ত নরকভোগ। এর আগেই যাতে নিষ্কৃতি পাই সেই শুভেচ্ছা করুন।
–আপনার একান্ত অনুরক্ত
রাজশেখর বসু
[এটাই– যতদূর মনে পড়ছে– সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে পাওয়া শেষ চিঠি।
তবে আগের আরও কিছু ছিল। হারিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে একটাই বিশেষ করে মনে আছে, পুরশুরামের ভূষ পাল গল্প সম্বন্ধে লিখেছিলেন, … আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর লেখা সমস্ত গল্পের মধ্যে এই একটিই, এবং একমাত্র একটিই করুণ রসের গল্প কী করে ছিটকে বেরোল। ও রস তিনি আর কখনও আনেননি।…
মুজতবা আলীর জীবনের শেষ ৭।৮ বছর আর আমার সঙ্গে কোনও পত্রালাপ বা দেখা হয়নি। কী করে যে কোনও ঝগড়া না করেও এতদিনের অন্তরঙ্গতা হারিয়ে গেল… এটাই বোধহয় জাগ্রত বাস্তব।
॥ দীপংকর বসু ॥]
.
রাজশেখর বসুকে লেখা
০১.
শান্তিনিকেতন,
৪।১।৫৯
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
জন্মদিনে তাপনাকে আমার ভক্তিপূর্ণ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। আপনি বঙ্গসাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করুন, আমাদের আনন্দ বর্ধন করুন। আপনার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ, আপনি শতায়ু হোন, সহস্ৰায়ু হোন।
—গুণমুগ্ধ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[এই পত্রটি সৈয়দ মুজতবা আলী রাজশেখর বসুকে লেখেন। পরের পত্রটি রাজশেখর বসুর উত্তর। এই দুটিও শ্রীযুক্ত দীপংকর বসুর সৌজন্যে পাওয়া গেছে।]
০২.
শান্তিনিকেতন,
১২।১।৬০
শ্ৰদ্ধাস্পদেষু,
আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানবেন, শুনে শঙ্কিত হলুম, আপনি অসুস্থ। তবু বসুধারা পত্রিকায় যখন আপনার লেখা বেরুচ্ছে তখন বিবেচনা করি, আপনার বাড়ির অগণিত বাচ্চা-কাচ্চাদের কেউ না কেউ হয়তো আপনাকে এ চিঠিখানা পড়ে শুনিয়ে দিতে পারে। একদা আপনারই আদেশ অনুযায়ী এদের গল্প শুনিয়েছিলুম– এ উপকারটা করে দিতে তারা হয়তো নারাজ হবে না।
কিন্তু ইতিমধ্যে আমার মনে আরেকটা শঙ্কার উদয় হল। তুলনা দিয়ে নিবেদন করি। রোগশয্যায় রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই সেবা করতে চাইতেন। ইয়া ধুমসো কামারের মতো কঠিন হাত দিয়ে হঠাৎ তার পা টিপতে আরম্ভ করতেন– যে পদযুগল ইন্দুমতীদের করস্পর্শ ছাড়া অন্য কোনও উৎপীড়ন কখনও সয়নি। কবি নাকি তখন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সয়ে যেতেন– সঙ্কোচবশত কিছু বলতে পারতেন না। আমার ভয় হচ্ছে, আমার চিঠি হয়তো সেইরকম বেদনাই দেবে। বিশেষত আমার ভাষার ত্রুটি-বিচ্যুতি আপনার কানকে পীড়া যখন দেবে তখন সেই পুরনো বাধতি বাধতে আবার মামদো হয়ে দেখা দেবে। (মামদো কথাটা আপনার অভিধানে পেলুম না– শুনেছি, কথাটা মুহম্মদ মুহম্মদী থেকে এসেছে, অর্থাৎ খাস মুসলমানি ভূত)। অথচ আমি ভাবছি রোগশয্যায় চিঠি পেতে অনেকেই ভালোবাসেন। আপনিও হয়তো অপছন্দ করবেন না।
আমি কোনও স্বার্থ নিয়ে এ চিঠি লিখছি না। খন্বিদং, বিরিঞ্চি বাবাদের আশীর্বাদ না থাকা সত্ত্বেও আমার অভাব-অনটন বিশেষ নেই। এমনকি কবি হাইনের মতো আমার নিম্নলিখিত প্রার্থনাও নেই- 0, God, you know, I am a Poet and have few needs indeed. All I want is a cottage and home-made bread and butter. Being a Poet, however, I should love to have a row of poplar trees in front of my cottage so that I may look at the trees and derive inspiration from them, and shouldst thou, O Lord, in the glory, want to make may happiness complete so that my cup runneth over, I should, like some of my enemies to be hanged to their loftiest branches, so that I could look at their dang line legs and contemplate over the glory! Of course Christ has ordered us to forgive our enemies and I shall, in the fulness of my heart, certainly forgive them but only after they are hanged! (এ স্থলে বলা আবশ্যক মনে করি যে বেচারা হাইনে বহুদিন ধরে তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত অযথা প্রচারিত নিন্দাবাদ চুপ করে শুনেছিলেন; শেষটায় যখন তার জাত তুলে, অর্থাৎ তার ইহুদিত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আরম্ভ হল তখন তিনি অস্ত্রধারণ করলেন এবং যে কী অস্ত্র! হাইনে নিজেই জানতেন না তিনি এরকম ব্যঙ্গ– satire লিখবার ক্ষমতা ধরেন এবং গোড়ার দিকে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর মতো মোলায়েম প্রেমের কবিতা পৃথিবীতে খুব অল্প লোকই লিখেছেন। তাঁর মায়ের উদ্দেশে লেখা কবিতাগুলো যে কী সুন্দর সে মূলে না পড়লে বোঝা যায় না। এই যে আমরা professional মা মা করনেওলা বাঙালি, আমরাও এরকম কবিতা লিখতে পারিনি– ইয়োরোপীয়রা তো পারেইনি। ইয়োরোপে মা-এর প্রতি ভালোবাসা বিরল– অন্তত আমার তা-ই মনে হয়েছে। হাইনে আসলে oriental– ইহুদি।)
আপনি আমার লেখা পড়বেন এ আশা আমি করিনে, আবার, আমার একটি লেখাও আপনার সামনে পড়ছে না এটা ভাবতেও ভালো লাগে না। আপনি মুরুব্বির মতো আছেন, হয়তো কখনও হুঙ্কার দিয়ে বললেন, মুজতবা আলীর কোনও বইটই বেরুল? কেউ এক পাতা পড়ে শোনাতে না শোনাতেই আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন, এই বা মন্দ কী? আমি জানি, আমি আপনার জন্য লিখি না। আমি লিখি টাঙা-ওলা বিড়িওলাদের জন্য অন্তত আমার ইচ্ছে, আমি যেন এমন সরল করে লিখতে পারি যে তারা আমার লেখা বুঝতে পারে। তা কিন্তু হয়ে উঠবে না। আপনি এত সরল সহজ লেখেন যে তার অর্থ বের করা এবং রসগ্রহণ কিছুমাত্র কঠিন কর্ম নয়, তবু প্রত্যয় যাবেন না, আমার একজন সমঝদার বন্ধু জনৈক বাঙলাতে এম.এ. পাস যুবককে আপনার লেখা বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়ালেন। আপনার আর সুকুমার রায়ের একই অবস্থা। এ tragedy কেন হয় আমি বুঝে উঠতে পারি নি। আপনি কি চিন্তা করেছেন? আমি সূক্ষ্ম কাজের কথা ভাবছিনে– জোয়ান জিল্টার বা বিলাতের সায়েবের কেন কোলড় হ্যাম– নাম হয়, এসব নয় মাথার উপর দিয়ে গেল কিন্তু অন্যান্য জিনিস? আপার কৃষ্ণকলির ভবতোষ ঠাকুর কেন উড়লেন না, সে বাবদে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল। এমিল জোলার নাম যখন ফ্রান্সের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তখন রুচিবাগীশ তাঁর কয়েকজন বন্ধু অনুরোধ করলেন একখানা clean বই লেখার জন্য। বিজ্ঞাপনের ভাষায় যেটি নির্ভয়ে পুত্রকন্যার হাতে তুলে দেওয়া যায়। জোলা লিখলেন। আনাতোল ফ্রস তার সমালোচনা লিখতে গিয়ে বললেন, জোলা শূয়রের মতো কাদা-ময়লার ভিতর চমৎকার wallow করতে পারেন। ফিরিস্তার মতো উড়তে গেলে শূয়রের যে হাস্যকর অবস্থা হয় এই clean বইয়েতে জোলার তাই হয়েছে। We prefer to see Zola wallow in the dirt.
এই গুরুবাদের ব্যাপারে আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি। ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত আমি য-ই শিখতে যাই না কেন, গুরুর চেষ্টা থাকে, কত শীঘ্র আমাকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারেন, অর্থাৎ নিজেকে useless করে তুলতে পারেন, আমাকে বলতে পারেন, বৎস, এইবারো তুমি চরে খাও। শুধু ধর্মের গুরু একেবারে মাথার রতন ন্যাপ্টে থাকেন আঠার মতন। সেই কোথায় গৌহাটি থেকে শিষ্য গুরুকে চিঠি লিখবেন পিণ্ড-দাদন-খানে এটাতে কী করব, ওটার কী হবে? আর গুরুও শেষ দিন পর্যন্ত উপদেশ-হুঁকুম ঝাড়তে থাকেন। তাই বোধহয় দক্ষিণের রমন মহর্ষি কোনও শিষ্য নিতেন না, পারতপক্ষে কাউকে কোনও উপদেশ দিতেন না, হুকুম তো শিকেয়। তাঁর চতুর্দিকে যে আশ্রম গড়ে উঠেছিল এবং সেখানে যে-সব কর্ম-কীর্তি হত তা দেখে ভদ্রলোক মর্মাহত হতেন। কিন্তু তিনি নিরুপায়। আশ্রম থেকে পালিয়ে গিয়ে যেখানেই যান না কেন, সেখানে গড়ে উঠবে বিরাটতম আশ্রম, সেখানে exploitation হবে নিদারুণতর। ওদিকে তিনি জরাজীর্ণ বৃদ্ধ। গভীর অরণ্যে একা থাকা অসম্ভব। এবং মানুষকে বিপদ-আপদে সাহায্য করার প্রবৃত্তিটিও তাঁর বিলক্ষণ ছিল। আরেকজন লোক দেখেছি, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাকে বলে ঋষিতুল্য। Learning, Wisdom, Art,- এর কী অদ্ভুত সমন্বয় এবং সর্বোপরি আচার-ব্যবহারে শিশুটির মতো কী সরলতা। তাঁর কপাল ভালো। রবির দিকে সকলের দৃষ্টি– তাকে অল্প লোকেই লক্ষ করত। তাকে গুরু হতে বললে তিনি হয়তো ঠা ঠা করে হেসে উঠতেন। (তার হাসি হেসেখেলে ফার্লঙ খানিক ডিঙোতে পারত)। গাঁধী-ব্রজেন্দ্র শীল একে বড় শ্রদ্ধা করতেন। শুনেছি, কে নাকি একবার বক্রোক্তি করে অরবিন্দ ঘোষকে শুধিয়েছিল, ব্রাহ্মসমাজের কেউ কি ভগবানকে 696309a And Pat came the reply, why? To begin with Dwijendranath Tagore? অবশ্য ভগবানকে পাওয়া-না-পাওয়া দূরের কথা। গর্কি যা বলেছিলেন তাই যথেষ্ট। টলস্টয়ের সঙ্গে একদিন দীর্ঘ আলাপচারির পর গর্কি লিখেছিলেন, And looking at him I, who am an atheist, said to myself, This man is God-like!
আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আপনার কাছ থেকে চিঠির উত্তরও প্রত্যাশা করি না। আপনার কাছ থেকে আমার একটি মধ্যাহ্ন কিংবা নিশিভোজন পাওনা আছে। এবারে কলকাতায় এসে সেটি ছাড়ব না। ২৪ ঘণ্টা আগেই কী কী খাব, তা জানিয়ে দেব। এবং এ কথা জানাবার প্রয়োজন বোধ করিনে যে খাওয়ার ব্যাপারে আমার এক ভাগ্নীর ভাষায়– মামুর শুধু মুখে মুখেই হাইজাম্প লঙজাম্প। তবে আমি পাতিপুরের রাজাবাহাদুরের মতো পাতিনেবু দিয়ে বার্লিও খাইনে। যদিও এই পোড়ার শান্তিনিকেতনে আমার সাতিশয় প্রিয় কইমাছ আদপেই পাওয়া যায় না। কলকাতায়ও এত মাগ্যি যে এ জমানার মেয়েরা ও-জিনিসটে রান্না করার সুযোগও পায়নি। এখন দু মুঠো অন্ন ভালো করে খেতে হলে ঢাকা যেতে হয়। সেখানে এখনও সবকিছু পাওয়া যায়। নবাব-বাড়ির কল্যাণে রান্নার standard উঁচু– কি হিন্দু কি মুসলমান, উভয় হেঁসেলেই। ভালো ভালো কবরেজও সেখানে আছে। শুধু বাছাই বাছাই পথ্যি করিয়ে বিস্তর ব্যামো সারিয়ে দেয়। আপনার সেই ভাইজী দুর্গাদেবী৭ তো আমাকে তার কোনও লেখার খবর দিলেন না? আপনি শীঘ্র সেরে উঠুন এই প্রার্থনা করি।
— গুণমুগ্ধ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[১. দাদুকে লেখা এই চিঠিটা পড়েই সৈয়দ মুজতবা আলীকে প্রথম চিঠি লিখি। (তাতে অবশ্য জানিয়েছিলুম অগণিত কাচ্চাবাচ্চার মধ্যে আমিই বাড়িতে একলা। বাকি সব রবাহূত।) পত্রপাঠ দু পাতার উত্তর পেয়েছিলুম আমার চিঠির ১ নং দ্রঃ। তারপর ছ বছর ধরে পত্রালাপ। অবশ্য তার ফাঁকে অসংখ্যবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখোমুখি বসে কথাও হয়েছে।
২. এখানটায় একটু বেশি আলঙ্কারিক প্রয়োগ হয়ে গেছে। দাদু কখনও হুঙ্কার দিয়ে কথা বলেননি। অন্য কাউকে কখনও কিছু পড়ে শোনাতেও বলেননি। নিজেই পড়তেন। এবং পড়তে পড়তে ঘুম কল্পনাতীত।
৩. পরশুরামের স্বয়ম্বরা ও শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পের দুটি চরিত্র।
৪. কৃষ্ণকলি যন্থের ভবতোষ ঠাকুর গল্পের শেষ লাইন : … সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের একটা লেখায় পড়েছি– পীর কখনও ওড়েন না, তাঁর চেলারাই তাঁকে ওড়ান।… এটা পড়েই এই বিস্তীর্ণ আলোচনা।
৫. চিঠির উত্তর কিন্তু পেয়েছিলেন। কপি নেই। আর আমি লিখেছিলুম আজই কইমাছ এসেছে। তার পর অনেকদিন ধরে এসে খাওয়ার কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনও দিনই হয়নি।
৬. পরশুরামের রাজভোগ গল্প থেকে উদ্ধৃতি।
৭. গিরীন্দ্রশেখর-কন্যা দুর্গাবতী ঘোষ।]
০৩.
শান্তিনিকেতন
১৫।৩।৬০
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আপনার জন্মদিনে আমার মনে কী আনন্দের সঞ্চার হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে বলার মতো ভাষা আমার নেই। আমার অজানা নেই যে আপনার শরীর সুস্থ নয় এবং এই জন্মদিন আপনার কাছে অল্প আনন্দই বহন করে আনছে, কিন্তু আপনি যিনি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে আমাদের আনন্দ দিয়ে আসছেন আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে আপনি যে আমাদের মাঝখানে আছেন তাতেই আমাদের গভীর আনন্দ। আমরা স্বার্থপরের মতো কথা বলছি, একথা সত্য। কিন্তু আমি স্বার্থপরতায় বিশ্বাসী। দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ কর, সমাজের জন্য স্বার্থপরতা ছাড় এসব বড় বুলি আমার কখনও ভালো লাগেনি। আমি বরঞ্চ বলেছি, একটুখানি স্বার্থপর হও, তা হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা লাগবে, ফলে দেশের কমপিটেস্ বেড়ে যাবে। আপনাকে বলছি এই যে চূর্ণ-বিচূর্ণ জর্মনি পাঁচ বছরের ভিতর ফের আপন পায়ে দাঁড়িয়ে উঠল, পনেরো বছরের পর এক আমেরিকা ছাড়া সবাইকে টাকা ধার দিতে চায় (কুলোকে বলে ফ্রান্সের এটম বমের রেস্ত যুগিয়েছে জর্মনি!), সে তো আত্মত্যাগ স্বার্থত্যাগের বুলি একবারও কপচায়নি। এ বিষয় দীর্ঘ লেকচার শোনার মতো আপনার মনের অবস্থা নয় কিন্তু ভবিষ্যতে যখন দেখা হবে তখন আমার কথাটা যে ঠিক সেই আমি উত্তম উত্তম ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণ করে দেব। ধর্মগ্রন্থ এই কারণে বললুম, সচরাচর লোকের বিশ্বাস ধর্ম বুঝি বেপরোয়া স্বার্থত্যাগ করতে উপদেশ দেয়, দ্বিতীয়ত আমার জীবনের বেশিরভাগ কেটেছে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে– তবে আপনাকে ভরসা দিচ্ছি, ধর্ম আচরণ করে নয়।
আমি জানি এ-সব প্রগলভতা। কিন্তু আপনিই বিবেচনা করে বলুন, আপনার মতো গুণী লোকের সামনে না করে কার সামনে করব? অন্যে ভুল বুঝবে, নিন্দা করবে। আপনি সস্নেহে মাফ করে দেবেন। তুলসীও বলেছেন, শিশুর আধো-আধো বুলি বাপ-মা গদগদ হয়ে শোনে। ক্রুর কুটিল কুবিচারী কিন্তু হাসে।
জো বালক কহে তোতরী বাতা
শুনত মুহিত নেন দিনু অছ মাতা
হাসি হাসে ক্রূর কুটিল কুবিচারী
জে পরফুল মুখশধারী–
তাই নিতান্ত স্বার্থপরের মতো বলছি, আপনি শতায়ু হন, সহস্ৰায়ু হন। আমাদের অক্ষম লেখার তোতরী বাতা একমাত্র আপনিই মুদিত নয়নে প্রসন্ন বয়ানে আশীর্বাদ করতে পারেন।
—গুণমুগ্ধ বশংবদ
সৈয়দ মুজতবা আলী
[এটাই রাজশেখর বসুকে লেখা মুজতবা আলীর শেষ চিঠি। উত্তর বোধহয় পাননি– কারণ তাহলে চিঠির ওপর উঃ… লেখা থাকত।
এর মাসখানেক পরে রাজশেখরের মৃত্যু হয় (২৭-৪-১৯৬০)।]