সংখ্যাতত্ত্ব
যাঁরা আমাকে হরপ্পার যুগ থেকে চেনেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা জানেন কিংবা যাঁদের মনে আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় শেষ পত্রে সংখ্যাতত্ত্বের বিশেষ বিষয়ে আমি শূন্য পেয়েছিলাম, তাঁদের কারও পক্ষে একথা ভাবা হয়তো অসম্ভব নয় যে, আমার এই কাণ্ডজ্ঞানটি নিতান্তই বিদ্বেষপ্রসূত এবং প্রতিহিংসাবশত।
তবে সত্যি কথা, বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, এই পঁচিশ বছর পরে এখন আমার আর এ বিষয়ে রাগ বা হিংসে বলে মনের মধ্যে কিছু নেই। আর তা ছাড়া অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে সম্প্রতি কিছুদিন আমাকে জীবিকার জন্যে যে কাজটি দেখতে হচ্ছে সে ওই সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েই।
আর তা ছাড়া ওই শূন্যের ব্যাপারটার আমার কাছে আর কোনও গুরুত্ব নেই। শুধু ওই পরীক্ষায় নয়, তার আগে ও পরে জীবনের বহু পরীক্ষায় আমি অবলীলাক্রমে শূন্য পেয়েছি।
খুব অল্প বয়েসে ইস্কুলের নিচু ক্লাসে অঙ্কের পরীক্ষায় প্রথম যেবার শূন্য পাই, বাবা আমাকে মারতে এসেছিলেন। পরম স্নেহশীলা আমার রাঙা পিসিমা সেখানে ছিলেন, তিনি বাবাকে বাধা দেন এবং নাম ধরে ধমকিয়ে দিয়ে বলেন, ‘জটু, খোকাকে মারতে যাচ্ছ, কেন, খুব খারাপ কী করেছে? একেবারে কিছুই যে পায়নি তা তো নয়, শূন্য তো পেয়েছে।’
শূন্য পাওয়া একেবারে কিছুই না পাওয়া নয়, সেটা তখন থেকেই আমি জেনে গিয়েছি। কিন্তু শূন্যের সমস্যা বড় বেশি জটিল, তা নিয়ে অন্য কোনও দিন হাসাহাসি করা যাবে। আজ সংখ্যাতত্ত্ব।
কোনও এক মেডিক্যাল কলেজে সে বছর স্নাতকের সংখ্যা ছিল একশো, আর স্নাতকীর সংখ্যা ছিল দশ। এর মধ্যে পাঁচটি ডাক্তার ছেলে ভালবেসে তাদের পাঁচজন সহপাঠিনীকে বিয়ে করেছিল পাস করে বেরনোর পরেই। সে বছর সেই ডাক্তারি কলেজের পুনর্মিলন উৎসবের সুভেনিরে সম্পাদক রিপোর্ট করেছিলেন, ‘আমাদের মেডিক্যাল কলেজের শতকরা পাঁচজন ডাক্তারবাবু শতকরা পঞ্চাশজন ডাক্তার দিদিমণিকে আলোচ্য বছরে পরিণয়পাশে আবদ্ধ করেছেন।’
সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে নিশ্চয়ই এই ডাক্তারি রিপোর্টে কোনও ভুল নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক গোলমেলে! সাধে কী আর সেই বিখ্যাত সাহেব বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন, ‘মিথ্যে তিন রকম—‘মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে এবং সংখ্যাতত্ত্ব।’ সেই সাহেব আমার মতো শূন্য পাওয়ার রাগে ওই কথা বলেননি, সম্ভবত তাঁর রাগের কারণ ছিল অন্য।
‘এ সভায় প্রায় আধাআধি লোকই বোকা’ এবং ‘এ সভায় প্রায় অধিকাংশ লোকই বুদ্ধিমান,’ এ দুটি বাক্যের যে একই মানে, সে বুঝি শুধু সাংখ্য বিজ্ঞানেই সম্ভব।
তবুও সংখ্যাতত্ত্বের উপরে কিছু লোকের বড় বেশি ঝোঁক। আমার পরম গুরুদেব স্বৰ্গত স্টেফান লিকক সাহেব এ নিয়ে চরম রসিকতা করে গেছেন। লিকক সংখ্যাতত্ত্বে প্রচণ্ড উৎসাহী দুই ব্যক্তির আলাপ-আলোচনা নিয়ে লিখেছিলেন।
ধরা যাক, এই দুই ব্যক্তি আলোচনা করছিলেন ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে কিংবা সৌরমণ্ডল নিয়ে। দু’জনেই জানেন এর মধ্যে বড় বড় অঙ্কের ব্যাপার রয়েছে এবং দু’জনেই সব ঘুলিয়ে ফেলেছেন। একজন বলছেন, ‘হিসেবটা দেখেছ একবার? আমেরিকায় কত সাইকেল বিক্রি করি আমরা প্রত্যেক বছর? দাঁড়াও বলছি, এই তো কালকেই কাগজে দেখলাম, বহু হাজার, না না হাজার নয়। বেশ কয়েক লক্ষ সাইকেল চালান যায়, সংখ্যাটা ঠিক মনে পড়ছে না তবে বোধ হয় লক্ষ নয়, বেশ কয়েক কোটিই হবে। নাকি কয়েক হাজারই হবে। হাজার হাজার সাইকেল যাচ্ছে আমেরিকায়।’
কিংবা সৌরমণ্ডল, ‘দ্যাখো, কালকে একটা চমৎকার হিসেব পড়লাম। একজন মানুষকে যদি কামানের মধ্যে পুরে ছুড়ে দেওয়া যায়, আচ্ছা মানুষ নয়, ধরো একটা বল যদি মনে করো ঘণ্টায় দশ মাইল, না না দশ মাইল নয়, সম্ভবত সেকেন্ডে বারো হাজার তেত্রিশ কিংবা ওই রকম কী একটা কিলোমিটার গতিতে চাঁদের দিকে, সম্ভবত সূর্যের দিকে অথবা মঙ্গলগ্রহের দিকে, মনে হচ্ছে মঙ্গলগ্রহই হবে তাই পড়েছিলাম, চমৎকার বুঝিয়ে লিখেছে, যদি সেই বলটা যেতে থাকে তা হলে এক মাস সতেরো দিন, না সতেরো বছর এক মাস পরে সেই বলটা, হ্যাঁ এইবার যেন মনে পড়ছে, মঙ্গলগ্রহের মাটিতে পড়তে পারে।’
লিকক সাহেবকে কাণ্ডজ্ঞানে কায়দা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে খুব জট পাকিয়ে ফেললাম। তার চেয়ে সংখ্যাতত্ত্বের সহজ সরল পুরনো গল্পটি যারা জানেন না তাদের জন্যে আরেক বার বলি।
দিল্লি থেকে ভারত সরকার কোনও কারণে জানতে চেয়েছেন, বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম গৃহপালিত জন্তুর সংখ্যা কী রকম। প্রশ্নটির উত্তরের জন্যে টেলিগ্রাম গিয়েছে রাজ্যস্তর থেকে জেলাস্তরে, সেখান থেকে মহকুমায়, সেখান থেকে ব্লকে, সেখান থেকে গ্রামে।
সাধারণত গ্রামের চৌকিদার মশায় এ রকম সংখ্যাতত্ত্ব সরবরাহ করেন। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে কোনও এক গ্রামের খবর সংগ্রহ করলেন। ত্রিশটি গোরু, বারোটি মোষ, একুশটি শুয়োর, চল্লিশটি ছাগল, আড়াইশো পাতিহাঁস, চারটি রাজহাঁস, হাজার খানেক মুরগি ইত্যাদি। চৌকিদার মশায়ের ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে, তাকে তিনি বললেন, ‘এগুলো সব ইংরেজি করে দে।’ সে বেচারি অত্যন্ত ন্যায়-নিষ্ঠভাবে কাউ, বাফালো, সব সেরে শেষে অভিধান মিলিয়ে চারটি রাজহাঁসকে করল ফোর গ্যান্ডারস (Four Ganders)। সে অবশ্য ঠিকই করল। কিন্তু ব্লক অফিসে একজন এই রিপোর্ট দেখে জীবজন্তুর নাম ইংরেজিতে পড়ে ভাবলেন, চৌকিদারটা কী মূর্খ, গণ্ডার ইংরেজি জানে না, দ্যাখো কী লিখেছে! তিনি ইংরেজি অভিধানে বানান দেখে শুদ্ধ করে লিখে দিলেন,‘ফোর রাইনোসেরাস।’
চল্লিশটি গ্রাম থেকে রাজ্যস্তরে রিপোর্ট এসেছে, তার মধ্যে একটি ওই চারটি গণ্ডার। রাজ্যে চল্লিশ হাজার গ্রাম, পরিসংখ্যান রিপোের্ট গেল সারা রাজ্যে চার হাজার গৃহপালিত গণ্ডার আছে।
অবশ্যই এই রিপোর্টের পর শুধু ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। অনেক পর্যটক এলেন এইসব গৃহপালিত গণ্ডারদের দেখতে। তারপর কী হল আমরা জানি না। কারণ এটা নিতান্তই গল্প, এ গল্পের মর্মার্থ হল, বড় হিসেবে ছোট গোলমাল অনেক বর্ধিত আকারে দেখা দিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে। আবার সব সময় সব জিনিস বোঝানোও যায় না।
যেমন এই উদাহরণটি। কোনও এক বিলিতি শহরে পুলিশকর্তা হিসেব করে দেখালেন, শতকরা দশটি দুর্ঘটনার জন্যে মাতাল ড্রাইভারেরা দায়ি। এই কথা শুনে এক মদ্যপ পুলিশকে জানালেন, ‘শতকরা নব্বইটি দুর্ঘটনা যখন হচ্ছে মদ না-খেয়ে গাড়ি চালানোর জন্যে, তা হলে মদ না-খেয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিচ্ছ না কেন?’