পদ্মাসন
সকালবেলা বাজার করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি দাড়ি কামিয়ে অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। এমন সময় জরুরি খবর এল আমার এক মামাশ্বশুর সকালবেলা পদ্মাসন করতে গিয়ে আটকিয়ে গিয়েছেন।
ভদ্রলোক কাছেই থাকেন, সুতরাং এই বিপদে সর্বপ্রথমে আমাকেই খবর দিয়েছেন। বিপদটা সত্যি যে কী, তা আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। যদি পদ্মাসন করতে না পারেন, আটকিয়ে যান, করবেন না; আর তা ছাড়া আমি তো আর যোগব্যায়ামের শিক্ষক নই, সত্যি কথা বলতে গেলে যোগব্যায়ামের য-ও আমি জানি না, এ ব্যাপারে আমার কী করার আছে?
আমার এই মামাশ্বশুর, গজেনবাবু, আজ কিছুদিন হল যোগব্যায়ামে খুবই উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। নানা জনের কাছে এ সম্পর্কে নানা কথা শুনে তিনি যোগব্যায়ামের চার্ট কিনে নিজেই ছবি দেখে দেখে আসন শুরু করেন।
যোগব্যায়ামের বহুল প্রচলিত আসনগুলির মধ্যে একটি হল ওই পদ্মসন। আপাতভাবে ছবি দেখে আসনটি যত সহজ মনে হয় তা নয়, আবার খুব জটিল তাও নয়। আসলে একেক রকম আসন একেক জনকে পুষিয়ে যায়। যে পারে সে সহজেই পারে, যে পারে না সে হাজার চেষ্টা করেও পারে না, অনেকটা কবিতা লেখা বা গান গাওয়ার মতোই।
আগে আমরা কাঠের পিঁড়িতে জোড়াসন হয়ে বসে ভাত খেতুম। পদ্মাসন এই জোড়াসনেরই ঠিক পরের ধাপ। জোড়াসনে পায়ের পাতা দুটো ঊরুর নীচে থাকে, আর পদ্মাসনে সেটা ঊরুর উপরে চেপে বসিয়ে দিতে হয়; হাঁটু, পায়ের গোড়ালি এবং ঊরু কাপে কাপে আটকিয়ে যায়; এই আসনের সঙ্গে ঠিক মতো নিশ্বাসের ব্যায়াম করলে নাকি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকা যায়, সাধু-সন্ন্যাসীরা তাই করে বাতাসে ওড়েন।
এত কথা আমার জানা ছিল না। মাত্র তিনদিন আগে, গত শনিবার সন্ধ্যাবেলা আমার মামাশ্বশুর মশায় একঘণ্টা ধরে সমস্ত আমাকে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়েছেন। তারপর আজকেই এই অবস্থা।
মামাশ্বশুর মশায়ের গৃহভৃত্য আমাকে ডাকতে এসেছিল। এই লোকটির কোনও নাম নেই, আসলে ওর নাম ছিল বোধহয় নিখিল, মামাশ্বশুর মশায়ের বাবার নামও তাই। তখন তিনি ওর নতুন নামকরণ করেন মংলু। কিন্তু সে এই নাম গ্রহণ করতে রাজি হয়নি, এই নামে ডাকলে সাড়া দেয় না।আমি মামাশ্বশুর মশায়কে বলেছিলাম সাহেবদের কায়দায় ওকে ‘বয়’ অথবা ‘বেয়ারা’ বলে ডাকতে, কিন্তু তিনি সাত্ত্বিক মানুষ, এই বিজাতীয় পরামর্শে তিনি মোটেই রাজি হননি। ফল, লোকটিকে এই, ওই, হ্যাঁরে সম্বোধন করেই চালাতে হচ্ছে।
আমি লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁরে কী হয়েছে ঠিক করে বল তো?’ সে ভাল করে গুছিয়ে বলতে পারল না, কিন্তু তার উত্তেজনা এবং ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল ঘটনাটা সত্যিই গুরুতর।
মামাশ্বশুর মশায়ের বাড়ি গিয়ে দেখলাম রীতিমতো জটিল অবস্থা। বাইরের ঘরে ভিড়, ভিতরে শোবার ঘরের মেঝেতে কম্বল পেতে তিনি যোগাসন করছিলেন, সেখানে এবং বারান্দায়ও অনেক লোক। ‘কী হল’ জিজ্ঞাসা করাতে সকলের কাছ থেকে একই জবাব পেলাম, ‘আসন করতে গিয়ে আটকিয়ে গেছেন’। ভিড় ঠেলে শোবার ঘরে গিয়ে দেখি মামাশ্বত্র মশায় নতুন কেনা লাল কম্বলের উপরে তাঁর সাধের পদ্মাসনে বসে রয়েছেন। তবে তাঁর মুখে স্বৰ্গীয় প্রশান্তির পরিবর্তে প্রচণ্ড উদ্বেগ।
কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারলাম। সত্যিই উনি পদ্মাসনে আটকিয়ে গেছেন। আজই প্রথম বহু চেষ্টার পরে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পদ্মাসনে বসেছেন কিন্তু তার পরেই আটকে গিয়েছেন, এখন আর বেরিয়ে আসতে পারছেন না। তাঁর দুই পায়ের পাতা ঊরুর উপরে চেপে বসে গেছে, গিঁটে গিঁটে ফিট করে গেছে দুই গোড়ালি, এখন আর এই প্যাঁচ খুলতে পারছেন না।
প্রায় দু’ ঘণ্টা এই অবস্থায় আছেন। এটাই সর্বকালের দীর্ঘতম সময়ের পদ্মাসনের রেকর্ড, ঠিকমতো ভাবে পেশ করলে বুক অফ রেকর্ডেও স্থান পেতে পারে। তবে এতক্ষণ পদ্মাসনে থাকলে শূন্যে উঠে যাওয়ার যে সম্ভাবনা থাকে তা অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। মামাশ্বশুর মশায় বোধহয় মুখ বিকৃত করে সেই উড্ডয়ন-প্রবণতাকেই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। জানলা দিয়ে বেরনো এত বড় শরীরের পক্ষে সম্ভব নয়, মামিশাশুড়ি মহাশয়া বুদ্ধি করে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছেন যাতে তাঁর পতিদেবতা মহোদয় ফুরুত করে উড়ে না যান।
অবশ্য দেখেশুনে মনে হচ্ছে সে সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু উড়তে পারুন বা না পারুন, অন্তত এই পদ্মাসনের বেড়াজাল ছিঁড়ে তাঁকে অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো হাঁটাচলা, ওঠা-বসা তো করতে হবে সংসার আছে, অফিস আছে, আহার-নিদ্রা, শয়ন-ভোজন আছে, এই ভাবে পদ্মাসনে আটকে থাকলে চলবে না।
মুখ-চোখের বিকৃতি এবং উন্মুক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশের পেশি সঞ্চালন দেখে বুঝতে পারলাম তিনিও প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পদ্মাসন খুলে বেরিয়ে আসতে। দরদর করে সারা শরীর দিয়ে ঘাম পড়ছে তাঁর।
পাড়ার ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি পুরনো আমলের বুড়ো চিকিংক, কিন্তু জন্মে কোনও রোগীকে এ অবস্থায় দেখেননি। মামাশ্বশুর মশায়ের চারপাশে তিন-চার পাক দিয়ে তিনি বললেন, ‘গজেনবাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যান’।
হাসপাতালে নেওয়া কি সোজা কথা! অফিস পড়ে রইল। পাড়ার কয়েকটি ছেলের সাহায্যে একটি টেম্পো ভাড়া করে তারপর পাশের বাড়ির থেকে একটি বেশ বড় কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি ধার করে সেই পিঁড়ির উপরে তাঁকে বসিয়ে বিয়ের কনেকে যেভাবে পিঁড়িতে তুলে সাতপাক দেওয়া হয় সেইভাবে শূন্যে তুলে টেম্পোতে বসিয়ে দেওয়া হল।
এখন হাসপাতালে কী হবে কে জানে? মামাশ্বশুর মশায় কতদিন এইরকম আটকিয়ে থাকবেন তা-ই বা কে বলতে পারে?
তবে বেডের জন্য অসুবিধে হবে না নিশ্চয়। কারণ মামাশ্বশুর মশায়ের কোনও বেড দরকার নেই, তিনি তো বসেই আছেন, বেডে শোয়ার অবস্থায় পৌছালেই তিনি বাড়ি ফিরে আসবেন, তখন আর হাসপাতালের দরকার নেই।