অভিনয় নয়
কলকাতা নামক এই ধূসর মরুভূমিতে একটি মধ্যসাপ্তাহিক মরূদ্যান আছে; যেখানে সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যায় বিদগ্ধ পুরুষ এবং সুন্দরী রমণীরা সমবেত হন। সেখানে সোনালি পানীয় এবং মেজাজি আড্ডা এবং কখনও কখনও চূড়ান্ত সুখাদ্য আমার এবং অনেকের জন্যে অপেক্ষা করে। সরাসরি বলা উচিত ওই সান্ধ্য আসরে আমার অবারিত দ্বার।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই সুস্থলে আমি কদাচিৎ যাই। গেলে খুবই ভাল লাগে, কিন্তু যাওয়া হয় না। তার একটাই কারণ, অভিনয়। অভিনয়ের ব্যাপারে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হয়, গায়ে জ্বর আসে।
হয়তো আমার মঞ্চ-কাঁপানো কণ্ঠস্বর অথবা ভাঁড়োপম স্থূল অবয়ব আমার অবচেতন মনে অভিনয় সম্পর্কে একটা অতিশীতল অনীহা রচনা করেছে। অথচ সেখানে গেলেই দেখতে পাই আমার বিখ্যাত বন্ধুরা দিনের সমস্ত ক্লান্তি হাতে ঠেলে দিয়ে সায়াহ্নের পর সায়াহ্ন কেমন সাবলীলভাবে মহড়া দিয়ে চলেছেন। বিখ্যাত লেখক যাঁর কলম ছুরির মতো ধারালো, মৃত্যুঞ্জয়ী সার্জন যাঁর ছুরি মাখনের মতো মসৃণ, রূপসী বন্ধুপত্নী যাঁর হাসি জন্মজন্মান্তের অনুরাগ-বিধুর, প্রবীণ সম্পাদক যাঁর প্রতিষ্ঠা প্রবাদপ্রতিম তাঁরা কত অনায়াসে, কত আয়াসে নাটকের মুখস্থ পার্টে গলা জোগাচ্ছেন।
যে গান ভালবাসে না সে খুন করতে পারে। যে অভিনয় ভালবাসে না সেও খুন করতে পারে। কিন্তু আমি অভিনয় ভালবাসি না, তা তো নয়। আসলে আমি এখনও একটু চঞ্চল, একটু পরিহাস-প্রিয়, বাক্বিলাসী; আমার পক্ষে অসম্ভব স্থির হয়ে বসে অন্যদের কথাবার্তা শোনা, বিশেষ করে সে যদি হয় মুখস্থ পার্ট এবং আগেও একবার শোনা হয়ে গিয়ে থাকে।
স্বীকার করি অভিনয় সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা খুব পরিচ্ছন্ন নয়। উলটোদিক দিয়ে ব্যাপারটায় ঘুরে আসছি।
এ গল্পটা অবশ্য আগেও একাধিকবার অন্য সূত্রে বলেছি, তবে আমার অভিনয় অভিজ্ঞতার উদাহরণ হিসেবে এত ভাল যে না বলা ঠিক হবে না।
জীবনে মাত্র একবার আমি একটা থিয়েটারে পার্ট পেয়েছিলাম। ঠিক পার্ট বলা উচিত হবে না, কারণ আমার ভুবনবিখ্যাত কণ্ঠ ব্যবহার কররার কোনও সুযোগ ছিল না। নাটকের একেবারে প্রথম দৃশ্যে পর্দা উঠতেই, বিছানায় শায়িত মৃত্যুপথযাত্রী নায়কের বৃদ্ধ পিতার ভূমিকা ছিল আমার, একবার আর্তকন্ঠে ‘ওঃ, ওঃ’ বলে আমার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া এবং সেখানেই নাটকের শুরু।
কিন্তু এই সামান্য পার্টেও পরিচালক আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন। মহড়ার সময় যতবার ‘ওঃ ওঃ’ করে মারা যাই, পরিচালক বলেন মরার পরে ওরকম শক্ত হয়ে কাঠ হয়ে পড়ে থাকবেন না মৃত্যুর দৃশ্য হলে কী হবে, নাটকে সবকিছুর মধ্যেই লাইফ আনতে হয়, একটু লাইফ আনুন। বলা বাহুল্য মৃত্যুর মধ্যে কী করে জীবনসঞ্চার করতে হয় অদ্যাবধি সে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে বোধগম্য হয়নি।
মিথ্যাভাষণের অপবাদ এড়ানোর জন্যে এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি। এই মৃত পিতার ভূমিকার পূর্বেও আমার কৈশোরে একবার আমার মঞ্চে উঠবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেবার অবশ্য আমার কিছুই করতে হয়নি। একলব্য নাটক, আমাকে দেওয়া হয়েছিল গুরু দ্রোণাচার্যের মূর্তির ভূমিকা, রক্ত-মাংসের দ্রোণাচার্যের পার্ট করেছিল অন্য একজন। আমাকে মূর্তি হয়ে নিশ্চুপ, নিশ্চল বসে থাকতে হল, আমাকে সামনে রেখে একলব্য অস্ত্রশিক্ষা করল। মফস্বল শহরের আমবাগানে মশকবহুল সন্ধ্যায় প্রায় পনেরো মিনিটের সেই দৃশ্যে নট নড়নচড়ন স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকা, সে স্মৃতিও আমার খুব মধুর নয়। সে বড় সুখের সময় নয়।
আমি জানি, আমার এই দুঃখময় অভিনয় জীবনের কথা পাঠ করে কোমলতমা পাঠিকার নয়নকোলেও একবিন্দু অশ্রু সঞ্চারিত হবে না। আমি এও জানি, বরং তিনি এখন ঠোঁট টিপে হাসছেন, এবং সেটাই আমার নিয়তি। সুতরাং হাসির কথাই বলি।
এক বেদনাঘন, বিয়োগান্ত নাটকের নায়িকা এক সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি করুণ, হৃদয়স্পর্শী অভিনয় করছিলেন। প্রথম অঙ্কের শেষ দৃশ্যেই করুণ রসের শুরু, আর সেই দৃশ্যে যাকে দর্শকের ভাষায় ফাটিয়ে দেওয়া বলে, তাই করলেন নায়িকা। সিন পড়ে যাওয়ার পর উইংসের অভ্যন্তরে নায়িকাকে অভিনন্দন জানালেন পরিচালক, ‘এমন জীবন্ত, এমন প্যাথেটিক পার্ট এমন সুন্দর করছেন আজকে, ভাবাই যায় না। দর্শকরা কোনওদিন এই দৃশ্যে এত হাততালি দেয়নি।’
নায়িকা শুকনো গলায় ডান পায়ের থেকে চপ্পল খুলতে খুলতে বললেন, ‘এই চটিটার একটা পেরেক উঠে রয়েছে, সেটাই পায়ে ফুটে আমার চোখ দিয়ে জল বার করে দিচ্ছে। সাধে কি আর পার্ট এত সুন্দর হচ্ছে !’
এই কথা শুনে পরিচালক যেন হাতে চাঁদ পেলেন, তাড়াতাড়ি নায়িকাকে বললেন, ‘ম্যাডাম, এখন চপ্পলটা খুলবেন না। দয়া করে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পায়ে দিয়ে থাকুন। আর এর পর থেকে প্রত্যেক শোতেই পেরেক ওঠা অবস্থায় পায়ে দিয়ে আসবেন। এই পেরেক আপনার জীবনে আর বাংলার অভিনয়ের ইতিহাসে যুগান্তর এনে দেবে।’
আরেকটা মজার কাহিনী মনে আসছে। এক পেশাদারি নাটকের মঞ্চসফল নায়ক প্রযোজক মহোদয়কে অনুরোধ করেছিলেন, ‘স্যার, ওই নাচের সিনে যদি আপনি গেলাসে লাল রঙের শরবত দিয়ে সত্যিই মদ খেতে দেন তা হলে অভিনয়টা আরও প্রাণবন্ত, আরও জমজমাট করতে পারি।’
প্রযোজক মহোদয় ব্যান্ডেল লোকালে চানাচুর বিক্রি করে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। তারপর বহু ঘাটা-আঘাটা, নালা, খাল, বিল পার হয়ে হাতিবাগানের ঘাটে নৌকো এনে ভিড়িয়েছেন। এ ধরনের বাজে অনুরোধকে ঠান্ডা করতে তাঁর নিঃশব্দ পাথরপ্রতিম চাহনি, ইনডাস্ট্রির আপামরের ভাষায় সাপের চাউনি, যথেষ্টের চেয়ে বেশি কিন্তু নায়ক তো ফেলনা নয়। শিশির ভাদুড়ী কিংবা নির্মলেন্দু লাহিড়ী না হতে পারে কিন্তু ভদ্রলোকের বক্স অফিস খুব খারাপ নয়; প্রযোজক মহোদয় কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দিলেন, বললেন, ‘আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি। কিন্তু মনে রাখবেন, শেষ দৃশ্যে বিষপানের দৃশ্য আছে, আপনি যেখানে আত্মহত্যা করছেন। সেই দৃশ্যে আপনার গেলাসে খাঁটি বিষ দেবো তো ?’
এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই এইরকম আরও অনন্ত প্রশ্নের। কিছুদিন আগে দূরদর্শনে কয়েক রবিবার সকালে শ্রীযুক্ত শম্ভু মিত্র প্রাঞ্জল এবং সরসভাবে অভিনয়ের ব্যাপারটা নতুন যুগের নাট্যোৎসাহীদের ব্যাখ্যা করলেন। সেখানে তিনি প্রথমেই বললেন, সব মানুষই অভিনয় করে, অভিনয় করতেই হয় মানুষকে। বাড়িতে হয়তো কেউ এসেছেন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না, বিরক্ত হচ্ছি, কিন্তু তবু তাঁকে বলছি, ‘এখনই চলে যাচ্ছেন ? আরেকটু বসুন, এক পেয়ালা চা খেয়ে যান।’
শেক্সপিয়রের মতে, জীবনে এ রকম অভিনয় আমাদের সব সময়ই করে যেতে হচ্ছে।
শেক্সপিয়র সাহেব আরও বহু কথা—জন্মমৃত্যু, হাসি-কান্না, মিলন-বিরহ মানুষের সব কিছু নিয়ে সবরকম কথা বলে গিয়েছেন। এক ইংরেজ ভদ্রলোক তাঁর ছোট ছেলেকে নিয়ে শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। বেরিয়ে এসে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন দেখলে ?’ ছেলে গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘ভালই, তবে বইটা একেবারে কোটেশনে ভর্তি।’ আরেকটি ছেলেকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘শেক্সপিয়ার কে ?’ সে অম্লানবদনে বলেছিল, ‘ওই যে আমাদের স্কুলের বার্ষিক উৎসবের নাটক লেখে।’
অভিনয় সংক্রান্ত এই এলেবেলে নিবন্ধ মহাকবি শেক্সপিয়রকে দিয়ে সমাপ্ত করতে পারলেই বিদ্যাবুদ্ধির পরাকাষ্ঠা হত। কিন্তু আমার স্বভাব মন্দ; একটা প্রায় অপ্রাসঙ্গিক বাজে ঘটনা মনে পড়ছে। এক মূকাভিনেতার বাড়ির সামনে দিয়ে বছর কয়েক আগে নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণে যেতাম মাঝেমধ্যেই তাঁর বাড়ির দরজায় তার সঙ্গে আমার দেখা হত। সেই মূকাভিনেতার বন্ধু ছিলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্রের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। মূকাভিনেতার সঙ্গে দেখা হতেই আমি প্রশ্ন করতাম, ‘আচ্ছা অমুকে আপনার এত বন্ধু, আর আকাশবাণীতে আপনাকে একটা চান্স দেয় না।’ মূকাভিনেতা ভদ্রলোক করজোড়ে বলতেন, ‘দেখুন, আমি করি মূকাভিনয়, রেডিওতে আমার কী প্রোগ্রাম দেবে ?’ আমিও নাছোড়বান্দা, দেখা হলেই ওই একই প্রশ্ন করতাম। মূকাভিনেতা ভদ্রলোক শেষে আমার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমাকে দেখলেই মূকাভিনয় করতেন।