ষোড়শী – ৩.১

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

নাটমন্দির

[চণ্ডীর প্রাঙ্গণস্থিত নাটমন্দিরের একাংশ। সময়—অপরাহ্ন। উপস্থিত—শিরোমণি, জনার্দন রায় এবং আরও দুই-চারিজন গ্রামের ভদ্রব্যক্তি]

শিরোমণি। (আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত তুলিয়া জনার্দনের প্রতি) আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও, ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে।

জনার্দন। (হেঁট হইয়া পদধূলি লইয়া) আজ এই নিয়ে নির্মলকে দুটো তিরস্কার করতে হলো, শিরোমণিমশাই, মনটা তেমন ভালো নেই।

শিরোমণি। না থাকবারই কথা। কিন্তু এ একপ্রকার ভালই হলো ভায়া। এখন বাবাজীর চৈতন্যোদয় হবে যে, শ্বশুর এবং পিতৃব্যস্থানীয়দের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রত্যবায় আছে। আর, এ যে হতেই হবে। সর্বমঙ্গলময়ী চণ্ডীমাতার ইচ্ছা কিনা!

প্রথম ভদ্রলোক। সমস্তই মায়ের ইচ্ছা। তা নইলে কি ষোড়শী ভৈরবী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যেতে চায়!

শিরোমণি। নিঃসন্দেহ। মন্দিরের চাবিটা ত পূজারীর কাছ থেকে কৌশলে আদায় হয়েছে, কিন্তু আসল চাবিটা শুনচি নাকি গিয়ে পড়েছে জমিদারের হাতে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল, দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।

জনার্দন। ঐটে খেয়াল করা হয়নি।

শিরোমণি। না, এখন সহজে দিলে হয়। দশদিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ, কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না! কিন্তু আমরা সবাই জানি ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না—একটি পাই-পয়সা না।

[অনেকেই এ কথা স্বীকার করিল]

দ্বিতীয় ভদ্রলোক। এর চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।

শিরোমণি। চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই।

অনেকে। চাই চাই—অবিলম্বে চাই।

প্রথম ভদ্রলোক। আমি বলি, চলুন, আমরা দল বেঁধে যাই জমিদারের কাছে। বলি গে, চাবিটা দিন, কি আছে না আছে মিলিয়ে দেখি গে।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক। আমিও তাই বলি।

প্রথম ভদ্রলোক। আজ বেলা তৃতীয় প্রহরে—হুজুর ঘুমটি থেকে উঠে মদ খেতে বসেছেন, মেজাজ খুশ্ আছে—ঠিক এমনি সময়টিতে।

অনেকে। ঠিক ঠিক, এই ঠিক মতলব।

শিরোমণি। (সভয়ে) কিন্তু অত্যন্ত মদ্যপান করে থাকলে যাওয়া সঙ্গত হবে না। কি বল জনার্দন?

[অকস্মাৎ ইঁহাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে একজন কহিল, ‘স্বয়ং হুজুর আসচেন যে!’ পরক্ষণেই জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন। যাহারা বসিয়াছিল অভ্যর্থনা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ নাটমন্দিরে উঠিবার সিঁড়ির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘আসন, আসন, শীঘ্র একটা আসন নিয়ে এস’]

জীবানন্দ। (উপবেশন করিয়া) আসনের প্রয়োজন নেই।—দেবীর মন্দির, এর সর্বত্রই ত আসন বিছানো।

জনার্দন। তাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এ আপনারই যোগ্য কথা।

[প্রফুল্ল সিঁড়ির একাংশে গিয়া বসিল, এবং হাতে তাহার যে খবরের কাগজখানা ছিল তাহাই খুলিয়া নিঃশব্দে পড়িতে লাগিল]

শিরোমণি। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। মেঘ না চাইতে জল। আজই দ্বিপ্রহরে আমরা হুজুরের কাছে যাব স্থির করেছিলাম, কিন্তু পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয় এইজন্যেই—

জীবানন্দ। যাননি? কিন্তু হুজুর ত দিনের বেলা নিদ্রা দেন না।

শিরোমণি। কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর—

জীবানন্দ। শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন, যা সত্য নয় এবং অনেক কথা বলেন, যা মিথ্যা। এই যেমন, আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা—

[এই বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল]

জনার্দন। মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল—

জীবানন্দ। তিনি সোজা হলেন কি প্রকারে?

শিরোমণি। (খুশী হইয়া সদর্পে) সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে হতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর বইতে পারছিলেন না।

জীবানন্দ। তাই হবে। তার পরে?

শিরোমণি। কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন,—বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না।

জনার্দন। (চকিত হইয়া) মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েচি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেছেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম, ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে।

জীবানন্দ। তা করেছে। জমা-খরচের খাতাও একখানা দিয়েছে।

শিরোমণি। বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না।

জীবানন্দ। (মুহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখের প্রতি চাহিয়া) কিন্তু সেজন্য আপনাদের উদ্বেগ কিসের? তাকে তাড়ানও ত চাই। কি বলেন রায়মশায়?

জনার্দন। দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা-কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলেছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভালো হয়। হয়ত—

জীবানন্দ। হয়ত নেই? এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে?

জনার্দন। (হঠাৎ উত্তর খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে বলিলেন) কি জানেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর।

জীবানন্দ। ত যাবে। কিন্তু শুধু শুধু জানা গিয়ে আর লাভ কি?

শিরোমণি। (প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি অলক্ষ্যে) সেরেছে!

জনার্দন। কিন্তু কোনদিন ত জানতেই হবে হুজুর।

জীবানন্দ। তা হবে। কিন্তু আজ আর আমার সময় নেই রায়মশাই।

শিরোমণি। (ব্যগ্র হইয়া) আমাদের সময় আছে হুজুর। চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলেই সন্ধ্যার পরে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও কোনও দায়িত্ব থাকে না—কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক বলেছি কিনা?

[সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না শুধু যাহার হাতে চাবি]

জীবানন্দ। (ঈষৎ হাসিয়া) ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত ভিখিরীর কাছ থেকে আর আদায় হবে না। আজ থাক, যেদিন আমার অবসর হবে আপনাদের খবর দেব।

[মনে মনে সকলেই ক্রুদ্ধ হইল]

জনার্দন। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কিন্তু দায়িত্ব একটা—

জীবানন্দ। সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি।

[সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। চলিতে চলিতে জমিদারের শ্রুতিপথের বাইরে আসিয়া]

শিরোমণি। (জনার্দনের গা টিপিয়া) দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশিদিন।

জনার্দন। হুঁ। যা ভয় করা গেল তাই হলো দেখচি।

শিরোমণি। এবারে গেল সব শুঁড়ির দোকানে। বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল।

প্রথম ভদ্রলোক। হুজুর আর দিচ্চেন না।

শিরোমণি। আবার? এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। (কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল)

[সকলের প্রস্থান

প্রফুল্ল। (খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া) দাদা, আবার একটা নূতন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন? চাবিটা ওদের দিয়ে দিলেই ত হতো।

জীবানন্দ। হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।

প্রফুল্ল। সিন্দুকে আছে কি?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মুক্তোর মালা, মুকুট, নানা রকমের জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তা ছাড়া সোনা-রূপার বাসন-কোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতের ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।

প্রফুল্ল। (সভয়ে) বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র-সমর্পণ ডাইনীর হাতে?

জীবানন্দ। নিতান্ত মিথ্যে বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না অথচ এ আমি চাইনি। যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম, জনার্দনকে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে।

প্রফুল্ল। এর কারণ?

জীবানন্দ। বোধ হয় সে ভেবেছিল এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপালে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।

প্রফুল্ল। কিন্তু আপনাকে সে চিনতে পারেনি।

জীবানন্দ। (হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না) সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আর যত দিকেই করে থাকি প্রফুল্ল, আমাকে চিনতে না দেওয়ার অপরাধ করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এর মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি স্থির করে নেয় কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে একদিন মরফিয়া চেয়ে নিয়ে চোখ বুজে খেয়েছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের বড় তর্ক—সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর যে কোন উপায় ছিল না—সে ছাড়া যে আর কারও পানে চাইবার কোথাও কেউ ছিল না—এ-সব ষোড়শী একেবারে ভুলে গেছে। কেবল একটি কথা তার মনে জেগে আছে—যে নিজের প্রাণটা অসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল তাকে আবার অবিশ্বাস করা যায় কি করে! ব্যস্ যা কিছু ছিল চোখ বুজে দিলে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ায় ভয়ানক চালাক লোকেও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসারটা একেবারে মরুভূমি হয়ে যেত, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবারও ঠাঁই পেত না।

প্রফুল্ল। অতিশয় খাঁটি কথা দাদা! অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলে তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন—জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধ যায় ত শুধু রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।

জীবানন্দ। প্রফুল্ল, এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।

প্রফুল্ল। (হাত জোড় করিয়া) এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গিটা পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেছে। এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের যোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।

জীবানন্দ। (সহাস্যে) একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হলো প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। বার-চারেক। (হাসিয়া ফেলিয়া) ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি ত নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নীচু বলে এ দেহটায় মেদ-মাংসই কেবল পরিপূর্ণ করেছি, সত্যিকারের রক্ত বলতে আর ছিটেফোঁটাও বাকী রাখিনি। আজ ভাবচি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে গিয়ে খপ করে ভৈরবীঠাক্‌রুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে ফেলব। আপনার অনেক ভালো-মন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্থ করেচি, এ নইলে সেগুলো আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।

জীবানন্দ। (হাসিবার চেষ্টা করিয়া) আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্চে প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল। (যুক্তহস্তে) তা হলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেবির পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেছেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন—চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না কিন্তু আমাকে দান করে অতগুলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।

জীবানন্দ। তা হলে এবার আমাকে তুমি সত্যিই ছাড়লে

প্রফুল্ল। আশীর্বাদ করুন এই সুমতিটুকু যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। কিন্তু কবে যাচ্চেন তিনি

জীবানন্দ। জানিনে।

প্রফুল্ল। কোথায় যাচ্চেন তিনি

জীবানন্দ। তাও জানিনে।

প্রফুল্ল। জেনেও কোন লাভ নেই দাদা। বাপ রে মেয়েমানুষ ত নয় যেন পুরুষের বাবা। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম মনে হলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন পাথরে গড়া। ঘা মেরে গুঁড়ো করা যাবে কিন্তু আগুনে গলিয়ে ইচ্ছে মত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন সে বস্তুই নয়। পারেন ত ও মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।

জীবানন্দ। বিদ্রূপের স্বরে তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চো

প্রফুল্ল। গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।

জীবানন্দ। তা হতে পারে। আচ্ছা ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়

প্রফুল্ল। হয়। কারণ সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভালো কথা দাদা একটা খবর দিতে আপনাকে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি সেই ফকিরসাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তাঁর বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি—বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন—তিনি। কুর্নিশ করে কুশল প্রশ্ন করলাম ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেন্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্চেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চেন তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।

জীবানন্দ। এঁর সদুপদেশের ফলেই বোধ হয়?

প্রফুল্ল। না। বরঞ্চ, উপদেশের বিরুদ্ধেই যাচ্চেন।

জীবানন্দ। বল কি হে, ফকির যে শুনি তাঁর গুরু! গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?

প্রফুল্ল। এক্ষেত্রে তাই বটে।

জীবানন্দ। কিন্তু এতবড় বিরাগের হেতু?

প্রফুল্ল। হেতু আপনি। কি জানি, এ কথা শোনানো আপনাকে উচিত হবে কিনা, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন। পাছে কলহবিবাদের মধ্যে দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা। নইলে ভয় তাঁর মিথ্যা কলঙ্কেও নয়, গ্রামের লোককেও নয়।

[জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে নীরবে চাহিয়া রহিলেন]

প্রফুল্ল। দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, না হাত পেতে নিয়ে আপনিই মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল। বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাব আশা হয়।

[জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। সহসা বেয়ারা পাত্র ভরিয়া মদ লইয়া প্রবেশ করিতেই]

জীবানন্দ। আঃ—এখানেও! যা নিয়ে যা—দরকার নেই।

[বেয়ারা প্রস্থান করিল

প্রফুল্ল। রাগ করেন কেন দাদা, যেমন শিক্ষা। বরঞ্চ কখন দরকার সেইটেই বলে দিন না। অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে দাদা?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) অরুচি নয়, কিন্তু আর খাব না।

প্রফুল্ল। (হাসিয়া) এই নিয়ে ক’বার হলো দাদা?

জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।

[বেয়ারা পুনরায় প্রবেশ করিল]

বেয়ারা। এই পিস্তলটা ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে এসেছিলেন।

জীবানন্দ। ভুলেই এসেছিলাম বটে, কিন্তু ওতেও আর কাজ নেই, তুই নিয়ে যা।

প্রফুল্ল। কিন্তু রাত প্রায় এগারোটা হলো, বাড়ি চলুন।

জীবানন্দ। না, বাড়ি নয় প্রফুল্ল, এখন একলা অন্ধকারে একটু ঘুরতে বার হবো।

প্রফুল্ল। একলা? নিরস্ত্র? না না, সে হয় না দাদা। অন্ধকার রাত, পথে-ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। অন্ততঃ নিত্য-সহচরটিকে সঙ্গে রাখুন। (এই বলিয়া সে ভৃত্যের হাত হইতে পিস্তল লইয়া দিতে গেল)

জীবানন্দ। (পিছাইয়া গিয়া) এ জীবনে ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল। আজ থেকে আমি এমনি একাকী বার হবো, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার। আমার থেকেও কারও কোন না ভয় হোক; তার পরে যা হয় তা ঘটুক, আমি কারও কাছে নালিশ করব না।

প্রফুল্ল। হঠাৎ হলো কি? না হয়, পাইকদের কাউকে ডেকে দিই?

জীবানন্দ। না, পাইক-পেয়াদা আর নয়। তোমরা বাড়ি যাও।

প্রফুল্ল। আপনার অবাধ্য হবো না দাদা, আমরা চললাম, কিন্তু আপনিও বেশী বিলম্ব করবেন না আমার অনুরোধ।

[প্রফুল্ল ও বেয়ারা প্রস্থান করিল

[জীবানন্দ ধীরে ধীরে নাটমন্দিরের আর একটা দিকে আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন থাম ঠেস দিয়া বসিয়া মৃদুকণ্ঠে নাম-গান করিতেছিল এবং অদূরে চার-পাঁচজন লোক চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিল। জীবানন্দ হেঁট হইয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিবার চেষ্টা করিল]

গীত

পূজা করে তোরে তারা
সার যদি হয় নয়নধারা,
শুভঙ্করী নাম তবে মা
ধরিস কেন দুঃখ-হরা।
কি পাপেতে বল্ মা কালী
মাখালি কলঙ্ক-কালি—
এখন ভরসা কেবল কালী
তুই মা বরাভয়-করা।

জীবানন্দ। তুমি কে হে?

পথিক। আজ্ঞে, আমি একজন যাত্রী বাবু।

জীবানন্দ। বাবু বলে আমাকে চিনলে কি করে?

পথিক। আজ্ঞে, তা আর চেনা যায় না? ভদ্দরলোক ছাড়া এমন ধপধপে কাপড় আর কাদের থাকে বাবু?

জীবানন্দ। ওঃ—তাই বটে! কোথা থেকে আসচ? কোথায় যাবে? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী?

পথিক। আসচি মানভূম জেলা থেকে বাবু, যাব পুরীধামে। এদের কারও বাড়ি মেদিনীপুরে, কারও বাড়ি আর কোথাও—কোথায় যাবে তাও জানিনে।

জীবানন্দ। আচ্ছা, কত লোক এখানে রোজ আসে? যারা থাকে তারা দু’বেলা খেতে পায়, না?

পথিক। (লজ্জিত হইয়া) কেবল খাবার জন্যেই নয় বাবু! আমার পা কেটে গিয়ে ঘায়ের মত হয়েছে দেখেই মা-ভৈরবী নিজে হুকুম দিয়েছিলেন যত দিন না সারে তুমি থাকো।

জীবানন্দ। তোমাকে যেতে বলিনি ভাই, বেশ ত থাকো না। জায়গার ত আর অভাব নেই।

পথিক। কিন্তু ভৈরবী মা ত আর নেই শুনতে পেলাম।

জীবানন্দ। এরই মধ্যে শুনতে পেয়েছ? তা নাই তিনি থাকলেন, তাঁর হুকুম ত আছে? তোমাকে যেতে বলে কার সাধ্য? বাড়ি কোথায় তোমার ভাই?

পথিক। বাড়ি আমার ছিল বাবু মানভুঁয়ের বংশীতট গাঁয়ে। গাঁয়ে অন্ন নেই, জল নেই, ডাক্তার-বদ্যি নেই—জমিদার থাকেন কলকাতায়, কখনো তাঁকে কেউ দুঃখ জানাতে পারিনে। আছে শুধু গোমস্তা টাকা আদায়ের জন্যে।

[জীবানন্দ নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়া সায় দিল]

পথিক। উপরি উপরি দু’সন বৃষ্টি হলো না, ক্ষেতের ফসল জ্বলে-পুড়ে গেল, এও সয়েছিল বাবু, —কিন্তু— (কান্নায় তাহার গলা বুজিয়া আসিল)

জীবানন্দ। তাই বুঝি তীর্থ-দর্শনে একবার বেরিয়ে পড়লে?

পথিক। (মাথা নাড়িয়া) এই ফাল্গুনে পরিবার মারা গেল, একে একে দুই ছেলে ওলাউঠায় চোখের সামনে মারা গেল বাবু, একফোঁটা ওষুধ কাউকে দিতে পারলাম না।

[বলিতে বলিতে লোকটি উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া ফেলিল। জীবানন্দ জামার হাতায় চোখ মুছিতে লাগিলেন]

পথিক। মনে মনে বললাম, আর কেন? ভাঙ্গা কুঁড়েখানি বিধবা ভাইঝিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম—বাবু, আমার চেয়ে দুঃখী আর সংসারে নেই।

জীবানন্দ। ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।

পথিক। কিন্তু আমার মত—

জীবানন্দ। দুঃখী? কিন্তু দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নেই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই কেবল মানুষ টের পায়। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও। অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তাকে তুমি চিনতেও পারোনি। কিন্তু তুমি মায়ের নাম করছিলে—

[সহসা সাগর ও হরিহর দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল]

হরিহর। আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।

সাগর। মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো, ফাঁসি যেতে হয় তাও যাব।

হরিহর। হঃ—আমাদের আবার জেল, আমাদের আবার ফাঁসি! মা আগে যাক—

হরিহর ও সাগর। জয় মা চণ্ডী!

[উভয়ের প্রস্থান

জীবানন্দ। বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়।

পথিক। কি বললেন বাবু?

জীবানন্দ। কিছু না ভাই, মায়ের নাম করছিলে আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম। কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা পাবে।

পথিক। আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কালই সকালে চলে যেতে হবে।

জীবানন্দ। চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা এখনো সারেনি, তুমি হাঁটতে পার না?

পথিক। মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম তিনদিনের বেশি আর কেউ থাকতে পারবে না।

জীবানন্দ। (হাসিয়া) ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে? মা-চণ্ডীর কপাল ভালো! আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?

পথিক। যাদের তিনদিনের বেশি হয়নি তারা মায়ের প্রসাদ সবাই পেলে।

জীবানন্দ। আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে?

পথিক। ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।

জীবানন্দ। তাই হবে। (এই বলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিল)

জীবানন্দ। কাল আমি আবার আসব, কিন্তু ভাই, চুপিচুপি চলে যেতে পাবে না।

পথিক। ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলে?

জীবানন্দ। বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে, আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? রাত হলো এখন যাই, কিন্তু মনে থাকে যেন।

[এমনি সময়ে ষোড়শী প্রদীপ-হস্তে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিল, জীবানন্দ পিছন হইতে ডাক দিল]

জীবানন্দ। অলকা?

ষোড়শী। (চমকিয়া) আপনি? এত রাত্রে আপনি এখানে কেন?

জীবানন্দ। কি জানি, এমনি এসেছিলাম। তুমি যাত্রার আগে ঠাকুর-প্রণাম করতে যাচ্ছ, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।

ষোড়শী। আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে সে ত আপনি জানেন!

জীবানন্দ। বিপদ? জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারেই নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি, আমার শত্রু আছে এ আমি একটা দিনও আর মানব না।

ষোড়শী। কিন্তু কি হবে আমার সঙ্গে গিয়ে?

জীবানন্দ। কিছু না। শুধু যতক্ষণ আছ সঙ্গে থাকব, তার পর যখন সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব। যাবার দিন আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। আমার আয়ুর দাম জানো, হয়ত আর দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কতরকমে দয়া করে গেলে, শেষদিন পর্যন্ত আমি সেই কথাই স্মরণ করব।

ষোড়শী। আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে।

[রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে গিয়া ষোড়শী প্রণাম করিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল]

জীবানন্দ। তোমাকে আমার প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। একটা দিন?

ষোড়শী। না।

জীবানন্দ। তবে সকল অপরাধ আমার এইখানে দাঁড়িয়ে আজ ক্ষমা কর!

ষোড়শী। কিন্তু তাতে কি আপনার প্রয়োজন আছে?

জীবানন্দ। এর উত্তর আজ দেবার আমার শক্তি নেই। এখন কেবল এই কথাই আমার সমস্ত মন ছেয়ে আছে অলকা, কি করলে তোমাকে একটা দিনও ধরে রাখতে পারি। উঃ—নিজের মন যার পরের হাতে চলে যায়, সংসারে তার চেয়ে নিরুপায় বুঝি আর কেউ নেই।

[ষোড়শী জীবানন্দের কাছে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া নীরবে দাঁড়াইল]

জীবানন্দ। (দাঁড়াইয়া) আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ অলকা, সবাই জানবে আমি শাস্তি দিয়েছি, তুমি সহ্য করেছ, আর নিঃশব্দে চলে গেছ। এতবড় মিথ্যে কলঙ্ক আমি সইব কেমন করে? তাও সয় যদি একটি দিন—শুধু কেবল একটি দিনও তোমাকে কাছে রাখতে পারি।

ষোড়শী। (পিছাইয়া গিয়া) চৌধুরীমশাই, কিসের জন্যে এত অনুনয়-বিনয়? আপনার পাইক-পেয়াদাদের গায়ের জোরের ত আজও অভাব হয়নি। আপনি ত জানেন, আমি কারো কাছে নালিশ করবো না।

জীবানন্দ। (পথ ছাড়িয়া সরিয়া) তা হলে তুমি যাও। অসম্ভবের লোভে আর তোমাকে আমি পীড়ন করব না। পাইক-পেয়াদা সবাই আছে অলকা, তাদের জোরের অভাব হয়নি। কিন্তু যে নিজে ধরা দিলে না, জোর করে ধরে রেখে তার বোঝা বয়ে বেড়াবার জোর আর আমার গায়ে নেই।

ষোড়শী। (গড় হইয়া প্রণাম করিয়া জীবানন্দের পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া) আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ—

জীবানন্দ। কি অনুরোধ অলকা?

[বাহিরে গরুর গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ হইল]

ষোড়শী। দয়া করে একটু সাবধানে থাকবেন।

জীবানন্দ। সাবধানে থাকব! কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরে কে দুজন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে শপথ করে গেল, তাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে, তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না,—আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সব শুনলাম—দুদিন আগে হলে হয়ত মনে হতো আমিই বুঝি তাদের লক্ষ্য—দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হলো না—কি অলকা? চমকালে কেন?

ষোড়শী। (পাংশু-মুখে) না কিছু না। এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।

জীবানন্দ। (অন্যমনস্কতায়) কাজ নেই?

ষোড়শী। কৈ আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।

জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিয়া) কিন্তু তুমি ত অসতী নও!

[গাড়োয়ানের প্রবেশ]

গাড়োয়ান। মা, আর কি বেশী দেরি হবে?

ষোড়শী। না বাবা, আর বেশী দেরি হবে না।

[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল

চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে তা বলে দিচ্ছি।

জীবানন্দ। কোথায় যাব বল?

ষোড়শী। কেন, আপনার নিজের বাড়িতে। বীজগাঁয়ে।

জীবানন্দ। বেশ, তাই যাব।

ষোড়শী। কিন্তু কালকেই যেতে হবে।

জীবানন্দ। (মুখ তুলিয়া) কালই? কিন্তু কাজ আছে যে। মাঠে জলনিকাশের একটা সাঁকো করা দরকার। এদের জমিগুলো সব ফিরিয়ে দিতে হবে, সে ত তোমারই হুকুম। তা ছাড়া মন্দিরের একটা ভালো বিলি-ব্যবস্থা হওয়া চাই, —অতিথি-অভ্যাগত যারা আসে তাদের ওপর না অত্যাচার হয়—এ-সব না করেই তুমি চলে যেতে বলচ?

ষোড়শী। (মুশকিলে পড়িয়া) এ-সব সাধুসঙ্কল্প কি কাল সকাল পর্যন্ত থাকবে? (জীবানন্দ নীরব রহিল) কিন্তু আবশ্যকের চেয়ে একটা দিনও বেশী থাকবেন না আমাকে কথা দিন। এবং সে-ক’টা দিন আগেকার মত সাবধানে থাকবেন বলুন?

জীবানন্দ। (সে কথায় কান না দিয়া) আমার কৃতকর্মের ফল যদি আমি ভোগ করি সে অভিযোগ আমি কারুর কাছে করব না—কিন্তু যাবার সময় তোমার কাছে আমার শুধু একটিমাত্র দাবী আছে—(পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া ষোড়শীর হাতে দিয়া) এই চিঠিখানি ফকিরসাহেবকে দিয়ো।

ষোড়শী। দেবো। কিন্তু এ পত্র কি পড়তে পারিনে?

জীবানন্দ। পার, কিন্তু আবশ্যক নেই। এর জবাব দেবার ত প্রয়োজন হবে না। আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাবার জন্যে তার ঢের বেশী দুঃখ তুমি নিজে নিয়েচ। নইলে এমন করে হয়ত আমাকে—কিন্তু যাক সে। আমার শেষ অনুরোধ এতেই লেখা আছে, তা যদি রাখতে পার, তার চেয়ে আনন্দ আর আমার নেই।

ষোড়শী। তা হলে পড়ি?

[ষোড়শী নীরবে চিঠিখানি পড়িল, তাহার মুখে ভাবের একান্ত পরিবর্তন ঘটিল; জীবানন্দকে আড়াল করিয়া তাড়াতাড়ি সজল চক্ষু মুছিয়া ফেলিল]

ষোড়শী। আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এ খবর তুমি জানলে কি করে?

জীবানন্দ। কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও আমি যাদের চিনতে পারিনি তুমি তাদের চিনলে কি করে?

ষোড়শী। তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?

জীবানন্দ। (সহসা উত্তেজিত হইয়া) আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মত, আমি মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, সন্তান চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। কিন্তু এ প্রার্থনা জানাব আমি কার কাছে?

[গাড়োয়ানের প্রবেশ]

গাড়োয়ান। মা, শৈবালদীঘি সাত-আট কোশের পথ, এখন বার না হলে পৌঁছাতে বেলা হয়ে যাবে।

ষোড়শী। চল বাবা, যাচ্চি।

[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল। ষোড়শী পুনরায় জীবানন্দকে প্রণাম করিয়া]

আমি চললাম।

জীবানন্দ। এখনি? এত রাত্রে?

ষোড়শী। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই।

[প্রস্থান

জীবানন্দ। (একাকী অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া) অলকা! অলকা! একদিন তোমার মা আমার হাতে তোমাকে দিয়েছিলেন; তবু তোমাকে পেলাম না; কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।

[বাহির হইতে গরুর গাড়ি চালানোর শব্দ শুনা যাইতে লাগিল]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *