দ্বিতীয় দৃশ্য
শান্তিকুঞ্জ
[বারুই নদীতীরে বীজগাঁ’র জমিদার ৺রাধামোহনের নির্মিত বিলাসভবন ‘শান্তিকুঞ্জ’। সংস্কারের অভাবে আজ তাহা জীর্ণ, শ্রীহীন, ভগ্নপ্রায়। তাহারই একটা কক্ষে তক্তপোশের উপর বিছানা, বিছানায় চাদরের অভাবে একটা বহুমূল্য শাল পাতা; শিয়রের দিকে একটা গোল টেবিল, তাহাতে মোটা বাঁধানো একখানা বইয়ের উপর আধপোড়া একটা মোমবাতি। তাহারই পাশে একটা পিস্তল। হাতের কাছে একটা টুল, তাহাতে সোডার বোতল, সুরাপূর্ণ গ্লাস ও মদের বোতল। বোতলটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। পার্শ্বে দামী একটা সোনার ঘড়ি—ঘড়িটা ছাইয়ের আধারস্বরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে—আধপোড়া একটা চুরুট হইতে তখনও ধূমের রেখা উঠিতেছে। সম্মুখের দেওয়ালে গোটা-দুই নেপালী কুকরী টাঙ্গানো, কোণে একটা বন্দুক ঠেস দিয়া রাখা, তাহারই অদূরে মেঝের উপর একটা শৃগালের মৃতদেহ হইতে রক্তের ধারা বহিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটা শূন্য মদের বোতল; একটা ডিসে উচ্ছিষ্ট ভুক্তাবশেষ তখনও পরিষ্কৃত হয় নাই, সন্নিকটে একখানা দামী ঢাকাই চাদরে হাত মুছিয়া ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে—সেটা মেঝেতে লুটাইতেছে। জীবানন্দ চৌধুরী বিছানায় আড় হইয়া পড়িয়া। পায়ের দিকের জানালাটা ভাঙ্গা, তাহার ফাঁক দিয়া বাহিরের একটা গাছের ডালের খানিকটা ভিতরে ঢুকিয়াছে। দুইদিকে দুইটি দরজা—দরজা ঠেলিয়া জীবানন্দের সেক্রেটারি প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]
প্রফুল্ল। সেই লোকটা এখানেও এসেছিল দাদা।
জীবানন্দ। কে বল ত?
প্রফুল্ল। সেই মাদ্রাজী সাহেবের কর্মচারী, যিনি আখের চাষ আর চিনির কারখানার জন্যে সমস্ত দক্ষিণের মাঠটা কিনতে চান। সত্যই কি ওটা বিক্রি করে দেবেন?
জীবানন্দ। নিশ্চয়। আমার এখন ভয়ানক টাকার দরকার।
প্রফুল্ল। কিন্তু অনেক প্রজার সর্বনাশ হবে।
জীবানন্দ। তা হবে, কিন্তু আমার সর্বনাশটা বাঁচবে।
প্রফুল্ল। আর একটি লোক বাইরে বসে আছেন, তাঁর নাম জনার্দন রায়। আসতে বলব?
জীবানন্দ। না ভায়া, এখন থাক। সাধু-সন্দর্শন যখন-তখন করতে নেই—শাস্ত্রের নিষেধ আছে।
প্রফুল্ল। (হাসিয়া) লোকটা শুনেছি খুব ধনী।
জীবানন্দ। শুধু ধনী নয়, গুণী। চিঠা, খত, তমসুক, দলিল, যথা-ইচ্ছা ইনি প্রস্তুত করে দিতে পারেন—নকল নয়, অনুকরণ নয়, একেবারে অভিনব, অপূর্ব, যাকে বলে সৃষ্টি। মহাপুরুষ ব্যক্তি।
প্রফুল্ল। এ-সব লোককে প্রশ্রয় দেবেন না দাদা।
জীবানন্দ। তার প্রয়োজন নেই প্রফুল্ল, ইনি নিজের প্রতিভায় যে উচ্চে বিচরণ করেন, আমার প্রশ্রয় সেখানে নাগাল পাবে না।
প্রফুল্ল। শুনলাম সমস্ত মাঠটা আপনার একার নয়, দাদা। এ সম্বন্ধে—
জীবানন্দ। না। প্রফুল্ল, এ সম্বন্ধে তোমাকে আমি কথা কইতে দেব না। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি, এর পরে তোমার সৎ-অসতের ভূত ঘাড়ে চাপলে আর রসাতলে তলিয়ে যাবার দেরি হবে না।
[একপাত্র মদ পান করিয়া]
জীবানন্দ। তুমি ভাবচ রসাতলের দেরিই বা কত? দেরি নেই সে আমি জানি। আরও একটা কথা তোমার চেয়ে বেশি জানি প্রফুল্ল, এর কূল-কিনারাও নেই।
[প্রফুল্ল নিঃশব্দে মুখ তুলিয়া চাহিল]
জীবানন্দ। ওই তোমার মস্ত দোষ প্রফুল্ল, শেষ হওয়া জিনিসটাও নিঃশেষ হচ্ছে শুনলে তোমার চোখ ছলছল করে আসে। যাও ত ভায়া, এককড়িকে পাঠিয়ে দাও ত। আর দেখ, তোমাকে একবার সদরে গিয়ে মাদ্রাজী সাহেবের সঙ্গে পাকা কথা কইতে হবে। বুঝলে?
প্রফুল্ল। (মাথা নাড়িয়া) তা হলে এখনো ত বেলা আছে। আজই ত যেতে পারি। সাহেবের সঙ্গে গাড়ি আছে।
জীবানন্দ। বেশ, তা হলে এঁর গাড়িতেই যাও।
[প্রফুল্লর প্রস্থান ও এককড়ির প্রবেশ]
জীবানন্দ। টাকা আদায় হচ্চে এককড়ি?
এককড়ি। হচ্চে হুজুর।
জীবানন্দ। তারাদাস টাকা দিলে?
এককড়ি। সহজে দিতে চায়নি। শেষে কান ধরে ঘোড়দৌড়, ব্যাঙের নাচ নাচাবার প্রস্তাব করতেই দিতে রাজি হয়ে বাড়ি গেছে। আজ দেবার কথা ছিল।
জীবানন্দ। তার পরে?
এককড়ি। মহাবীর সিংকে সঙ্গে দিয়ে হুজুরের পালকি বেহারাদের পাঠিয়েছি তাকে ধরে আনতে।
জীবানন্দ। (মদ্যপান করিয়া) ঠিক হয়েছে। তোমাদের এখানে বোধ করি বিলিতি মদের দোকান নেই। তা না থাক, যা আমার সঙ্গে আছে তাতেই এ ক’টা দিন চলে যাবে। কিন্তু আরও একটা কথা আছে এককড়ি।
এককড়ি। আজ্ঞে করুন।
জীবানন্দ। দেখ এককড়ি, আমি বিবাহ—হাঁ—বিবাহ আমি করিনি—বোধ হয় কখনো করবও না। (একটু পরে) কিন্তু তাই বলে আমি ভীষ্মদেব—বলি মহাভারত পড়েচ ত? তার ভীষ্মদেব সেজেও বসিনি—শুকদেব হয়েও উঠিনি—বলি কথাটা বুঝলে ত এককড়ি? ওটা চাই।
[এককড়ি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল]
জীবানন্দ। অপর সকলের মত যাকে-তাকে দিয়ে এ-সব কথা বলাতে আমি ভালোবাসি নে, তাতে ঠকতে হয়। আচ্ছা এখন যাও।
এককড়ি। আমি তারাদাসকে দেখি গে। সে এর মধ্যে প্রজা বিগড়ে না দেয়। (যাইতেছিল)
জীবানন্দ। প্রজা বিগড়ে দেবে? আমি উপস্থিত থাকতে?
এককড়ি। হুজুর, পারে ওরা।
জীবানন্দ। তারাদাসকেই ত জানি, আবার ‘ওরা’ এল কারা?
এককড়ি। চক্কোত্তির মেয়ে ভৈরবী। নইলে চক্কোত্তিমশাই নিজে তত লোক মন্দ নয়, কিন্তু মেয়েটাই হচ্চে আসল সর্বনাশী। দেশের যত বোম্বেটে বদমাশগুলো হয়েছে যেন একেবারে তার গোলাম।
জীবানন্দ। বটে! কত বয়স? দেখতে কেমন?
[ঘরের মধ্যে ক্রমশঃ সন্ধ্যার আবছায়া ঘনাইয়া আসিতে লাগিল]
এককড়ি। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে। আর রূপের কথা যদি বলেন হুজুর ত সে যেন এক কাটখোট্টা সিপাই! না আছে মেয়েলি ছিরি, না আছে মেয়েলি ছাঁদ। যেন চূয়াড়, যেন হাতিয়ার বেঁধে লড়াই করতে চলেছে। তাতেই ত দেশের ছোটলোকগুলো মনে করে গড়ের উনিই হচ্চেন সাক্ষাৎ চণ্ডী।
জীবানন্দ। (উৎসাহ ও কৌতূহলে সোজা উঠিয়া বসিয়া) বল কি এককড়ি? ভৈরবীর ব্যাপারটা কি খুলে বল ত শুনি?
এককড়ি। ভৈরবী ত কারু নাম নয় হুজুর। গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ওই হলো উপাধি। বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী, এর আগে যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল মাতঙ্গিনী। মার আদেশে তাঁর সেবায়েত কখনো পুরুষ হতে পারে না, চিরদিন মেয়েরাই হয়ে আসছে।
জীবানন্দ। তাই নাকি? এ ত কখনো শুনিনি।
এককড়ি। মায়ের আদেশে বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীকে আর ভৈরবীর স্পর্শ করবারও জো নেই। তাই দূরদেশ থেকে দুঃখী গরীবদের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়াও দেখতে পায় না। এই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) বল কি এককড়ি, একেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুধা ঢেলে দেওয়া—গরমমশলা দিয়ে চারটি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো—একেবারে কিছুই করতে পায় না?
এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই, কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখছি। লোকগুলো কি আর খামকা—তার সাক্ষী দেখুন না—কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গে মামলা-মকর্দমা বাধিয়ে দেয়!
জীবানন্দ। মেয়ে-মোহন্ত আর কি! তাতে দোষ নেই। এককড়ি আলোটা জ্বালো ত।
এক কড়ি। (আলো জ্বালিয়া) এখন আসি হুজুর।
জীবানন্দ। আচ্ছা যাও। বইখানা দিয়ে যাও ত।
[বই দিয়া প্রণাম করিয়া এককড়ি প্রস্থান করিল
[জীবানন্দ শুইয়া পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন। একটু পরে বাহিরে কাহার পায়ের শব্দ হইল।]
জীবানন্দ। কে?
সর্দার। (ষোড়শীকে লইয়া প্রবেশ করিয়া কহিল) শালা তারাদাস ভাগ্ গিয়া। হুজুর, উস্কো বেটীকো পাকড় লায়া।
জীবানন্দ। (বই ফেলিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বিস্মিতভাবে) কাকে? ভৈরবীকে? (কিছুক্ষণ পরে) ঠিক হয়েছে। আচ্ছা যা।
[সর্দার অনুচর পাইকদের লইয়া প্রস্থান করিল
জীবানন্দ। তোমাদের আজ টাকা দেবার কথা। টাকা এনেচ? (ষোড়শীর কণ্ঠস্বর ফুটিল না) আনো নি জানি। কিন্তু কেন?
ষোড়শী। আমাদের নেই।
জীবানন্দ। না থাকলে সমস্ত রাত্রি তোমাকে পাইকদের ঘরে আটকে থাকতে হবে। তার মানে জানো।
[ষোড়শী দ্বারের চৌকাঠটা দুই হাতে সবলে চাপিয়া ধরিয়া চোখ বুজিয়া মূর্ছা হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিল; এই ভয়ানক বিবর্ণ মুখের চেহারা জীবানন্দের চোখে পড়িল, মিনিট-খানেক সে কেমন যেন আচ্ছন্নের ন্যায় বসিয়া রহিল। তারপরে বাতির আলোটা হঠাৎ হাতে তুলিয়া লইয়া ষোড়শীর কাছে গেল। আলোটা তাহার মুখের সম্মুখে ধরিয়া একদৃষ্টে ষোড়শীর গৈরিক বস্ত্র, তাহার এলায়িত রুক্ষ কেশভার, তাহার পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর, তাহার সবল সুস্থ ঋজু দেহ, সমস্তই সে যেন দুই বিস্ফারিত চক্ষু দিয়া নিঃশব্দে গিলিতে লাগিল। এই ভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়া গেলে পর]
জীবানন্দ। (ফিরিয়া গিয়া আলোটা রাখিয়া দিয়া মদের বোতল হইতে কয়েক পাত্র উপর্যুপরি পান করিয়া) তোমার নাম ষোড়শী, না? (ষোড়শী নীরব) তোমার বয়স কত? (কোন উত্তর না পাইয়া কঠিন-স্বরে) চুপ করে থেকে বিশেষ কোন লাভ হবে না, জবাব দাও।
ষোড়শী। (মৃদু-স্বরে) আমার বয়স আটাশ।
জীবানন্দ। বেশ। তা হলে খবর যদি সত্যি হয় ত, এই উনিশ-কুড়ি বৎসর ধরে তুমি ভৈরবীগিরি করচ; খুব সম্ভব অনেক টাকা জমিয়েছ। দিতে পারবে না কেন?
ষোড়শী। আপনাকে আগেই ত জানিয়েছি আমার টাকা নেই।
জীবানন্দ। না থাকলে আরও দশজনে যা করছে তাই কর। যাদের টাকা আছে তাদের কাছে জমি বাঁধা দিয়ে হোক, বিক্রি করে হোক দাও গে।
ষোড়শী। তারা পারে, জমি তাদের। কিন্তু দেবতার সম্পত্তি বাঁধা দেবার, বিক্রি করবার ত আমার অধিকার নেই।
জীবানন্দ। (হঠাৎ হাসিয়া) নেবার অধিকার কি ছাই আমারই আছে? এক কপর্দকও না। তবুও নিচ্চি, কেন না আমার চাই। এই চাওয়াটাই হচ্ছে সংসারের খাঁটি অধিকার, তোমারও যখন দেওয়া চাই-ই, তখন—বুঝলে? (কিছু পরে) যাক, এত রাত্রে কি একা বাড়ি যেতে পারবে? যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে তাদের আর সঙ্গে দিতে চাইনে।
ষোড়শী। (সবিনয়ে) আপনার হুকুম হলেই যেতে পারি।
জীবানন্দ। (সবিস্ময়ে) একলা? এই অন্ধকার রাত্রে? ভারি কষ্ট হবে যে! (হাসিতে লাগিল)
ষোড়শী। না, আমাকে এখুনি যেতেই হবে।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) বেশ ত, টাকা না হয় নাই দেবে ষোড়শী। তা ছাড়া আরো অনেক রকমের সুবিধে—
ষোড়শী। আপনার টাকা, আপনার সুবিধা আপনারই থাক, আমাকে যেতে দিন।
[কয়েক পা অগ্রসর হইয়া সেই পাইকদের সম্মুখে কিছুদূরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আপনিই থমকিয়া দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (মুখ অন্ধকার করিয়া কঠিন-স্বরে) তুমি মদ খাও?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তোমার কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছে শুনেছি। সত্যি?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, মিছে কথা।
জীবানন্দ। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তোমার পূর্বেকার সকল ভৈরবীই মদ খেতেন—সত্যি? মাতঙ্গী ভৈরবীর চরিত্র ভাল ছিল না—এখনো তার সাক্ষী আছে। সত্যি, না মিছে?
ষোড়শী। (লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে) সত্যি বলেই শুনেছি।
জীবানন্দ। শুনেছ? ভালো। তবে হঠাৎ তুমিই বা এমন দলছাড়া, গোত্রছাড়া ভাল হতে গেলে কেন? (হঠাৎ সোজা উঠিয়া বসিয়া পুরুষ-কণ্ঠস্বরে) মেয়েমানুষের সঙ্গে তর্কও আমি করিনে, তাদের মতামতও কখনো জানতে চাইনে। তুমি ভাল কি মন্দ, চুল-চিরে তার বিচার করবারও আমার সময় নেই। আমি বলি, চণ্ডীগড়ের সাবেক ভৈরবীদের যেভাবে কেটেছে তোমারও তেমনিভাবে কেটে গেলেই যথেষ্ট। আজ তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।
[হুকুম শুনিয়া ষোড়শী বজ্রাহতের ন্যায় একেবারে কাঠ হইয়া গেল]
জীবানন্দ। তোমার সম্বন্ধে কি করে যে এতটা সহ্য করেচি জানিনে; আর কেউ এ বেয়াদপি করলে এতক্ষণ তাকে পাইকদের ঘরে পাঠিয়ে দিতুম। এমন অনেককে দিয়েচি।
ষোড়শী। (অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া, গলায় আঁচল দিয়া করজোড়ে) আমার যা-কিছু আছে সব নিয়ে আজ আমাকে ছেড়ে দিন।
জীবানন্দ। কেন বল ত? এরকম কান্নাও নতুন নয়, এরকম ভিক্ষেও এই নতুন শুনচি নে! কিন্তু তাদের সব স্বামী-পুত্র ছিল—কতকটা না হয় বুঝতেও পারি। (ষোড়শী শিহরিয়া উঠিয়া) কিন্তু তোমার ত সে বালাই নেই। পনের-ষোল বছরের মধ্যে তোমার স্বামীকে তুমি ত চোখেও দেখনি। তা ছাড়া তোমাদের ত এতে দোষই নেই।
ষোড়শী। (করজোড়ে অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে) স্বামীকে আমার ভালো মনে নেই সত্যি, কিন্তু তিনি ত আছেন! যথার্থ বলচি আপনাকে, কখনো কোন অন্যায়ই আমি আজ পর্যন্ত করিনি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন—
জীবানন্দ। (হাঁক দিয়া) মহাবীর—
ষোড়শী। (আতঙ্কে কাঁদিয়া) আমাকে আপনি মেরে ফেলতে পারবেন, কিন্তু—
জীবানন্দ। আচ্ছা, ও বাহাদুরি কর গে ওদের ঘরে গিয়ে। মহাবীর—
ষোড়শী। (মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া) কারও সাধ্য নেই আমার প্রাণ থাকতে নিয়ে যেতে পারে। আমার যা কিছু দুর্দশা—যত অত্যাচার আপনার সামনেই হোক—আপনি আজও ব্রাহ্মণ, আপনি আজও ভদ্রলোক!
জীবানন্দ। (কঠিন নিষ্ঠুর হাস্য করিল) তোমার কথাগুলো শুনতে মন্দ নয়, কিন্তু কান্না দেখে আমার দয়া হয় না। আমি অনেক শুনি। মেয়েমানুষের উপর আমার এতটুকু লোভ নেই—ভাল না লাগলেই চাকরদের দিয়ে দিই। তোমাকেও দিয়ে দিতুম, শুধু এই বোধ হয় আজ প্রথম একটু মোহ জন্মেছে। ঠিক জানিনে—নেশা না কাটলে ঠাওর পাচ্ছিনে।
মহাবীর। (দ্বারপ্রান্তে আসিয়া) হুজুর!
জীবানন্দ। (সম্মুখের কবাটটায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া) একে আজ রাত্রের মত ও-ঘরে বন্ধ করে রেখে দে। কাল আবার দেখা যাবে।
ষোড়শী। (গলদশ্রুলোচনে) আমার সর্বনাশটা একবার ভেবে দেখুন হুজুর! কাল যে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না।
জীবানন্দ। দু’একদিন! তার পরে পারবে। সেই লিভারের ব্যথাটা আজ সকাল থেকেই টের পাচ্ছিলাম। এখন হঠাৎ ভারী বেড়ে উঠল—আর বেশী বিরক্ত করো না—যাও—
মহাবীর। (তাড়া দিয়া) আরে, উঠ্না মাগী—চোল্!
জীবানন্দ। (ভয়ানক ধমক দিয়া) খবরদার, শুয়োরের বাচ্ছা, ভালো করে কথা বল্! ফের যদি কখনো আমার হুকুম ছাড়া কোন মেয়েমানুষকে ধরে আনিস ত গুলি করে মেরে ফেলব। (মাথার বালিশটা পেটের কাছে টানিয়া লইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া যাতনায় অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া) আজকের মত ও-ঘরে বন্ধ থাকো, কাল তোমার সতীপনার বোঝাপড়া হবে। আঃ—এই, যা’না আমার সুমুখ থেকে একে সরিয়ে নিয়ে।
মহাবীর। (আস্তে আস্তে বলিল) চলিয়ে—
[ষোড়শী নির্দেশমত নিরুত্তরে পাশের অন্ধকার ঘরে যাইতেছিল]
জীবানন্দ। ষোড়শী, একটু দাঁড়াও, প্রফুল্ল নেই, সে সদরে গেছে—তুমি পড়তে জানো, না?
ষোড়শী। জানি।
জীবানন্দ। তা হলে একটু কাজ করে যাও। ওই যে বাক্সটা, ওর মধ্যে আর একটা কাগজের বাক্স পাবে। কয়েকটা ছোট-বড় শিশি আছে, যার গায়ে বাঙলায় ‘মরফিয়া’ লেখা তার থেকে একটুখানি ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাও। কিন্তু খুব সাবধান, এ ভয়ানক বিষ। মহাবীর, আলোটা ধর।
[মহাবীর আলো ধরিল]
ষোড়শী। (বাতির আলোকে কম্পিত-হস্তে শিশিটা বাহির করিয়া) কতটুকু দিতে হবে?
জীবানন্দ। (তীব্র বেদনায় অব্যক্ত ধ্বনি করিয়া) ঐ ত বললুম খুব একটুখানি। আমি উঠতেও পারচি নে, আমার হাতেরও ঠিক নেই, চোখেরও ঠিক নেই। ওতেই একটা কাঁচের ঝিনুক আছে, তার অর্ধেকেরও কম। একটু বেশি হয়ে গেলে এ ঘুম তোমার চণ্ডীর বাবা এসেও ভাঙ্গাতে পারবে না।
[পরিমাণ স্থির করিতে ষোড়শীর হাত কাঁপিতে লাগিল, অবশেষে অনেক যত্নে অনেক সাবধানে নির্দেশমত ঔষধ লইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (হাত বাড়াইয়া সেই বিষ লইয়া চোখ বুজিয়া মুখে ফেলিয়া দিল) খুব কমই দিয়েচ—ফল হবে না হয়ত। আচ্ছা এই থাক।
[ষোড়শী পাশের ঘরে পা বাড়াইয়াছে, এমন সময় এককড়ি নিতান্ত ব্যস্ত ও ব্যাকুলভাবে প্রবেশ করিয়া ও এদিক-ওদিক চাহিয়া জীবানন্দের কানের কাছে চুপি চুপি কি বলিতে লাগিল। জীবানন্দের মুখের ভাবে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল। ষোড়শী দ্বারপ্রান্তে স্তম্ভিতের মত দাঁড়াইয়া রহিল]
জীবানন্দ। (হাত নাড়িয়া ষোড়শীকে) তোমার ভয় নেই, কাছে এসো, (ষোড়শী আসিলে) পুলিশের লোক বাড়ি ঘিরে ফেলেছে—ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গেটের মধ্যে ঢুকেছেন—এলেন বলে। (ষোড়শী চমকিয়া উঠিল) জেলার ম্যাজিস্ট্রেট টুরে বেরিয়ে ক্রোশ-খানেক দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন, তোমার বাবা এই রাত্রেই তাঁর কাছে গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন। কেবল তাতেই এতটা হতো না, কে-সাহেবের নিজেরই আমার উপর ভারী রাগ। গত বৎসর দু’বার ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি—আজ একেবারে হাতে হাতে ধরে ফেলেচে—(একটু হাসিল)
এককড়ি। (মুখ চুন করিয়া) হুজুর, এবার বোধ হয় আমাদেরও আর রক্ষা নেই।
জীবানন্দ। সম্ভব বটে। (ষোড়শীকে) শোধ নিতে চাও ত এই-ই সময়। আমাকে জেলে দিতেও পার।
ষোড়শী। এতে জেল হবে কেন?
জীবানন্দ। আইন। তা ছাড়া, কে-সাহেবের হাতে পড়েচি। বাদুড়বাগানের মেসে থাকতে এরই কাছে একবার দিন-কুড়ি হাজতবাসও হয়ে গেছে। কিছুতে জামিন দিলে না—আর জামিনই বা তখন হতো কে!
ষোড়শী। (উৎসুক-কণ্ঠে) আপনি কি কখনো বাদুড়বাগানের মেসে ছিলেন?
জীবানন্দ। হাঁ। ওই সময়ে একটা প্রণয়কাণ্ডের বৃন্দে হয়েছিলুম—ব্যাটা আয়ান ঘোষ কিছুতে ছাড়লে না—পুলিশে দিলে। যাক, সে অনেক কথা। কে আমাকে ভোলেনি, বেশ চিনে। আজও পালাতে পারতুম, কিন্তু ব্যথায় শয্যাগত হয়ে পড়েচি, নড়বার জো নেই।
ষোড়শী। (কোমল-কণ্ঠে) ব্যথাটা কি আপনার কমচে না?
জীবানন্দ। না, তা ছাড়া এ সারবার ব্যথাও নয়।
ষোড়শী। (কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া) আমাকে কি করতে হবে?
জীবানন্দ। শুধু বলতে হবে তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেচ, নিজের ইচ্ছায় এখানে আছ। তার বদলে তোমাকে সমস্ত দেবোত্তর ছেড়ে দেব, হাজার টাকা নগদ দেব, আর নজরের টাকার ত কথাই নেই।
[এককড়ি কি বলিতে যাইয়া ষোড়শীর মুখের পানে চাহিয়া থামিয়া গেল]
ষোড়শী। (সোজা হাসিয়া) এ কথা স্বীকার করার অর্থ বোঝেন? তার পরেও কি আমার জমিতে, টাকাকড়িতে প্রয়োজন থাকতে পারে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
জীবানন্দ। (বিবর্ণমুখে) তাই বটে ষোড়শী, তাই বটে। জীবনে আজও ত তুমি পাপ করোনি—ও তুমি পারবে না সত্যি। (একটু হাসিয়া) টাকাকড়ির বদলে যে সম্ভ্রম বেচা যায় না—ও যেন আমি ভুলেই গেছি। তাই হোক, যা সত্যি তাই তুমি বলো—জমিদারের তরফ থেকে আর কোনো উপদ্রব তোমার ওপর হবে না।
[এককড়ি ব্যাকুল হইয়া আবার কি বলিতে গেল, কিন্তু রুদ্ধদ্বারে পুনঃ পুনঃ করাঘাতের শব্দ শুনিয়া বিবর্ণমুখে থামিয়া গেল]
জীবানন্দ। (সাড়া দিয়া) খোলা আছে, ভিতরে আসুন।
[দরজা উন্মুক্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট, ইন্স্পেক্টার, কয়েকজন কনেস্টবল ও তারাদাস চক্রবর্তী প্রবেশ করিলেন]
তারাদাস। (ভিতরে ঢুকিয়াই কাঁদিয়া) ধর্মাবতার, হুজুর! এই আমার মেয়ে, মা-চণ্ডীর ভৈরবী। আপনার দয়া না হলে আজ ওকে টাকার জন্যে খুন করে ফেলত ধর্মাবতার।
ম্যাজিস্ট্রেট। (ষোড়শীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) তোমারই নাম ষোড়শী? তোমাকেই বাড়ি থেকে ধরে এনে উনি বন্ধ করে রেখেছেন?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, আমি নিজের ইচ্ছায় এসেচি। কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি।
তারাদাস। (চেঁচামেচি করিয়া উঠিল) না হুজুর, ভয়ানক মিথ্যে কথা, গ্রামসুদ্ধ সাক্ষী আছে। মা আমার ভাত রাঁধছিল, আটজন পাইক গিয়ে তাকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে টেনে এনেছে।
ম্যাজিস্ট্রেট। (জীবানন্দের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া ষোড়শীকে কহিলেন) তোমার কোন ভয় নেই, তুমি সত্য কথা বল। তোমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে?
ষোড়শী। না, আমি আপনি এসেচি।
ম্যাজিস্ট্রেট। এখানে তোমার কি প্রয়োজন?
ষোড়শী। আমার কাজ ছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট। এত রাত্রেও বাড়ি ফিরে যেতে দেরি হচ্ছিল!
তারাদাস। (চেঁচাইয়া) না হুজুর, সমস্ত মিছে—সমস্ত বানানো, আগাগোড়া শিখানো কথা।
ম্যাজিস্ট্রেট। (তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া শুধু মুখ টিপিয়া হাসিলেন এবং শিস্ দিতে দিতে প্রথমে বন্দুকটা এবং পরে পিস্তলটা তুলিয়া লইয়া জীবানন্দকে কেবল বলিলেন) I hope you have permission for this.
[ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন
ম্যাজিস্ট্রেট। (নেপথ্যে) হামারা ঘোড়া লাও!
[ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। তারাদাস হতজ্ঞানের ন্যায় স্তব্ধ অভিভূতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া]
তারাদাস। (অকস্মাৎ বুকফাটা ক্রন্দনে সকলকে সচকিত করিয়া পুলিশ-কর্মচারীর পায়ের নীচে পড়িয়া কাঁদিয়া) বাবুমশায়, আমার কি হবে! আমাকে যে এবার জমিদারের লোক জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
ইন্স্পেক্টার। (তিনি বয়সে প্রবীণ, শশব্যস্ত হইয়া তাহাকে চেষ্টা করিয়া হাত ধরিয়া তুলিয়া সদয়কণ্ঠে) ভয় কি ঠাকুর, তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাকো গে। স্বয়ং ম্যজিস্ট্রেট সাহেব তোমার সহায় রইলেন—আর কেউ তোমাকে জুলুম করবে না। (কটাক্ষে জীবানন্দের দিকে চাহিলেন)
তারাদাস। (চোখ মুছিতে মুছিতে) সাহেব যে রাগ করে চলে গেলেন বাবু!
ইন্স্পেক্টার। (মুচকি হাসিয়া) না ঠাকুর, রাগ করেন নি, তবে আজকের এই ঠাট্টাটুকু তিনি সহজে ভুলতে পারবেন, এমন মনে হয় না। তা ছাড়া আমরাও মরিনি, থানাও যা হোক একটা আছে। (আড়চোখে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া, কিছু পরে) এখন চল ঠাকুর, যাওয়া যাক। এই রাত্তিরে যেতেও ত হবে অনেকটা।
সাব-ইন্স্পেক্টার। (বয়সে তরুণ, অল্প হাসিয়া) মেয়েটি রেখে ঠাকুরটি কি তবে একাই যাবেন নাকি?
[কথাটায় সবাই হাসিল—কনস্টেবলগুলা পর্যন্ত। এককড়ি কড়িকাঠের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল। তারাদাসের চোখের অশ্রু চোখের পলকে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হইয়া গেল]
তারাদাস। (ষোড়শীর প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া সগর্জনে) যেতে হয় আমি একাই যাব। আবার ওর মুখ দেখব—আবার ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেব আপনারা ভেবেচেন?
ইন্স্পেক্টার। (সহাস্যে) মুখ তুমি না দেখতে পার কেউ মাথার দিব্যি দেবে না ঠাকুর! কিন্তু যার বাড়ি, তাকে বাড়ি ঢুকতে না দিয়ে আর যেন নতুন ফ্যাসাদে পোড়ো না।
তারাদাস। (আস্ফালন করিয়া) বাড়ি কার? বাড়ি আমার। আমিই ভৈরবী করেচি, আমিই ওকে দূর করে তাড়াব। কলকাঠি এই তারা চক্কোত্তির হাতে। (সজোরে নিজের বুক ঠুকিয়া) নইলে কে ও জানেন? শুনবেন ওর মায়ের—
ইন্স্পেক্টার। (থামাইয়া দিয়া) থামো ঠাকুর, থামো, রাগের মাথায় পুলিশের কাছে সব কথা বলে ফেলতে নেই—তাতে বিপদে পড়তে হয়। (ষোড়শীর প্রতি) তুমি যেতে চাও ত আমরা তোমাকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি। চল, আর দেরি করো না।
[ষোড়শী অধোমুখে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়াছিল, ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না]
সাব-ইন্স্পেক্টার। (মুখ টিপিয়া হাসিয়া) যাবার বিলম্ব আছে বুঝি?
ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া চাহিয়া ইন্স্পেক্টারের প্রতি) আপনারা যান, আমার যেতে এখনো দেরি আছে।
তারাদাস। (উন্মত্তের মত) দেরি আছে! হারামজাদী, তোকে যদি না খুন করি ত আমি মনোহর চক্কোত্তির ছেলে নই! (লাফাইয়া উঠিয়া ষোড়শীকে আঘাত করিতে গেল)
ইন্স্পেক্টার। (তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়া ধমক দিয়া) ফের যদি বাড়াবাড়ি কর ত তোমাকে থানায় ধরে নিয়ে যাব। চল, ভালমানুষের মত ঘরে চল।
[তারাদাসকে টানিয়া লইয়া তিনি ও সব পুলিশ-কর্মচারী প্রস্থান করিল, এককড়িও পা টিপিয়া বাহির হইয়া গেল। দূর হইতে তারাদাসের গর্জন ও গালাগালি ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর শোনা যাইতে লাগিল]
জীবানন্দ। (ইঙ্গিতে ষোড়শীকে আরো একটু কাছে ডাকিয়া) তুমি এঁদের সঙ্গে গেলে না কেন?
ষোড়শী। এঁদের সঙ্গে ত আমি আসিনি।
জীবানন্দ। (কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) তোমার বিষয়ের ছাড় লিখে দিতে দু’চারদিন দেরি হবে, কিন্তু টাকাটা কি তুমি আজই নিয়ে যাবে?
ষোড়শী। তাই দিন।
জীবানন্দ। (বিছানার তলা থেকে একতাড়া নোট বাহির করিল। সেইগুলা গণনা করিতে করিতে ষোড়শীর মুখের প্রতি বার বার চাহিয়া দেখিয়া একটু হাসিয়া বলিল) আমার কিছুতেই লজ্জা করে না, কিন্তু আমারও এগুলো তোমার হাতে তুলে দিতে বাধ-বাধ ঠেকছে।
ষোড়শী। (শান্ত নম্রকণ্ঠে) কিন্তু তাই ত দেবার কথা ছিল।
জীবানন্দ। কথা যাই থাক ষোড়শী, আমাকে বাঁচাতে তুমি যা খোয়ালে, তার দাম টাকায় ধার্য করচি, এ মনে করার চেয়ে বরঞ্চ আমার না বাঁচাই ছিল ভালো।
ষোড়শী। (তার মুখে স্থিরদৃষ্টে চাহিয়া) কিন্তু মেয়েমানুষের দাম ত আপনি এই দিয়েই চিরদিন ধার্য করে এসেছেন। (জীবানন্দ নিরুত্তর—কিছু পরে) বেশ, আজ যদি আপনার সে মত বদলে থাকে, টাকা না হয় রেখেই দিন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। কিন্তু আমাকে কি সত্যিই এখনো চিনতে পারেন নি? ভালো করে চেয়ে দেখুন দিকি?
জীবানন্দ। (নীরবে বহুক্ষণ নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) বোধ হয় পেরেচি। ছেলেবেলায় তোমার নাম অলকা ছিল না?
ষোড়শী। (তাহার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল) আমার নাম ষোড়শী। ভৈরবী দশমহাবিদ্যার নাম ছাড়া আর কোন নাম থাকে না। কিন্তু অলকাকে আপনার মনে আছে?
জীবানন্দ। (নিরুৎসুক-কণ্ঠে) কিছু কিছু মনে আছে বৈ কি! তোমার মায়ের হোটেলে মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। তখন তুমি ছোট ছিলে। কিন্তু আমাকে ত তুমি অনায়াসে চিনতে পেরেচ!
ষোড়শী। অনায়াসে না হলেও পেরেচি। অলকার মাকে মনে পড়ে?
জীবানন্দ। পড়ে। তিনি বেঁচে আছেন?
ষোড়শী। না—বছর-দশেক আগে তাঁর কাশীলাভ হয়েছে। আপনাকে তিনি বড় ভালোবাসতেন, না?
জীবানন্দ। (উদ্বেগে) হাঁ—একবার বিপদে পড়ে তাঁর কাছে একশ’ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেটা বোধ হয় আর শোধ দেওয়া হয়নি।
ষোড়শী। না, কিন্তু আপনি সেজন্য মনে কোন ক্ষোভ রাখবেন না। কারণ অলকার মা সে টাকা ধার বলে আপনাকে দেননি, জামাইকে যৌতুক বলে দিয়েছিলেন। (ক্ষণকাল চুপ করিয়া) চেষ্টা করলে এটুকু মনেও পড়তে পারে যে, সে দিনটাও ঠিক এমনি দুর্দিন ছিল। আজ ষোড়শীর ঋণটাই খুব ভারী বোধ হচ্চে, কিন্তু সেদিন ছোট্ট অলকার কুলটা মায়ের ঋণটাও কম ভারী ছিল না চৌধুরীমশাই।
জীবানন্দ। তাই মনে করতে পারতাম যদি না তিনি ঐ ক’টা টাকার জন্যে তাঁর মেয়েকে বিবাহ করতে আমাকে বাধ্য করতেন।
ষোড়শী। বিবাহ করতে তিনি বাধ্য করেন নি, বরঞ্চ করেছিলেন আপনি নিজে। কিন্তু, যাক ও-সব বিশ্রী আলোচনা। বিবাহ আপনি করেন নি, করেছিলেন শুধু একটু তামাশা। সম্প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, এই বোধ হয় তার পরে আজ প্রথম দেখা।
জীবানন্দ। কিন্তু তার পরে ত তোমার সত্যিকারের বিবাহই হয়েচে শুনেচি।
ষোড়শী। তার মানে আর একজনের সঙ্গে? এই না? কিন্তু নিরুপায় বালিকার ভাগ্যে এ বিড়ম্বনা যদি ঘটেই থাকে, তবু ত আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
জীবানন্দ। নাই থাক, কিন্তু তোমার মা জানতেন শুধু কেবল তোমাকে তোমার বাবার হাত থেকে আলাদা রাখবার জন্যেই তিনি যা হোক একটা—
ষোড়শী। বিবাহের গণ্ডী টেনে দিয়েছিলেন? তা হবেও বা। অলকার মাও বেঁচে নেই এবং আমিই অলকা কিনা, এতকাল পরে তা নিয়েও দুশ্চিন্তা করবার আপনার দরকার নেই।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে থাকিয়া) কিন্তু, ধর, আসল কথা যদি তুমি প্রকাশ করে বল, তা হলে—
ষোড়শী। আসল কথাটা কি? বিবাহের কথা? কিন্তু সেই ত মিথ্যে। তা ছাড়া সে সমস্যা অলকার, আমার নয়। সারারাত এখানে কাটিয়ে গিয়ে ও-গল্প করলে ষোড়শীর সর্বনাশের পরিমাণ তাতে এতটুকু কমবে না।
জীবানন্দ। (কয়েক-মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ষোড়শী, আজ আমি এত নীচে নেবে গেছি যে, গৃহস্থের কুলবধূর দোহাই দিলেও তুমি মনে মনে হাসবে, কিন্তু সেদিন অলকাকে বিবাহ করে বীজগাঁ’র জমিদার বংশের বধূ বলে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই কি ভাল কাজ হতো?
ষোড়শী। সে ঠিক জানিনে, কিন্তু সত্যি কাজ হতো এ জানি। কিন্তু আমি মিথ্যে বকচি, এখন এ-সব আর আপনার কাছে বলা নিষ্ফল। আমি চললাম—আপনি কোন কিছু দেবার চেষ্টা করে আর আমাকে অপমান করবেন না।
[এককড়ির প্রবেশ]
জীবানন্দ। (এককড়ি প্রবেশ করিতেই তাহাকে) এককড়ি, তোমাদের এখানে কোন ডাক্তার আছেন? একবার খবর দিয়ে আনতে পার? তিনি যা চাবেন আমি তাই দেব।
এককড়ি। ডাক্তার আছে বৈ কি হুজুর—আমাদের বল্লভ ডাক্তারের খাসা হাতযশ। (ষোড়শীর দিকে চাহিল)
জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) তাঁকেই আনতে পাঠাও এককড়ি, আর এক মিনিট দেরি করো না।
এককড়ি। আমি নিজেই যাচ্চি। কিন্তু হুজুরকে একলা—
জীবানন্দ। (দুঃসহ বেদনায় মুহূর্তে বিবর্ণ ও উপুড় হইয়া পড়িয়া) উঃ—আর আমি পারিনে।
ষোড়শী। তুমি বল্লভ ডাক্তারকে ডেকে আনো গে এককড়ি, এখানে যা করবার আমি করব এখন।
[এককড়ি ব্যস্তভাবে চলিয়া গেল
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ উপুড় হইয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া) ডাক্তার আসেনি? কতদূর থাকেন জানো?
ষোড়শী। কাছেই থাকেন, কিন্তু তাই বলে তিন-চার মিনিটেই কি আসা যায়?
জীবানন্দ। সবে তিন-চার মিনিট? আমি ভেবেচি আধ-ঘণ্টা—কি আরও কতক্ষণ যেন এককড়ি তাকে আনতে গেছে। (উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল) হয়ত তিনিও ভয়ে এখানে আসবেন না অলকা! (তাহার কণ্ঠস্বরে ও চোখের দৃষ্টিতে নিরাশ্বাসের অবধি রহিল না)
ষোড়শী। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে) ডাক্তার আসবেন বৈ কি!
জীবানন্দ। বোধ করি আমি বাঁচব না। আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্চে, মনে হচ্চে, পৃথিবীতে আর বুঝি হাওয়া নেই।
ষোড়শী। আপনার কি বড্ড কষ্ট হচ্চে?
জীবানন্দ। হুঁ। অলকা, আমাকে তুমি মাপ কর। (একটু থামিয়া) আমি ঠাকুর-দেবতা মানিনে, দরকারও হয় না। কিন্তু একটু আগেই মনে মনে ডাকছিলাম। জীবনে অনেক পাপ করেচি, তার আর আদি-অন্ত নেই। আজ থেকে থেকে কেবলি মনে হচ্ছে বুঝি সব দেনা মাথায় নিয়ে যেতে হবে। (ক্ষণেক থামিয়া) মানুষ অমর নয়, মৃত্যুর বয়সও কেউ দাগ দিয়ে রাখেনি—কিন্তু এই যন্ত্রণা আর সইতে পারচি নে—উঃ—মা গো! (ব্যথার তীব্রতায় সর্বশরীর যেন আকুঞ্চিত হইয়া উঠিল)
[ষোড়শী একটু ইতস্ততঃ করিয়া শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আঁচল দিয়া ললাটের ঘাম মুছাইয়া দিয়া, পাখার অভাবে আঁচল দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। জীবানন্দ কোন কথা কহিল না, কেবল তাহার ডান হাতটা ধীরে ধীরে কোলের উপর টানিয়া লইল]
জীবানন্দ। (ক্ষণেক পরে) অলকা—
ষোড়শী। আপনি আমায় ষোড়শী বলে ডাকবেন।
জীবানন্দ। আর কি অলকা হতে পার না?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। কোনদিন কোন কারণেই কি—
ষোড়শী। আপনি অন্য কথা বলুন। (জীবানন্দ নীরবে রহিল, ক্ষণেক পরে) কষ্টটা কি কিছুই কমেনি?
জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) বোধ হয় একটু কমেছে। আচ্ছা যদি বাঁচি, তোমার কি কোন উপকার করতে পারিনে?
ষোড়শী। না, আমি সন্ন্যাসিনী—আমার নিজের কোন উপকার করা কারো সম্ভব নয়।
জীবানন্দ। আচ্ছা এমন কিছুই কি নেই, যাতে সন্ন্যাসিনীও খুশি হয়?
ষোড়শী। তা হয়ত আছে, কিন্তু সেজন্যে কেন আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন?
জীবানন্দ। (একটু ক্ষীণ হাসিয়া) আমার ঢের দোষ আছে, কিন্তু পরের উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এ দোষ আজও কেউ দেয়নি। তা ছাড়া এখন বলচি বলেই যে ভালো হয়েও বলব, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই—এমনিই বটে! সারাজীবনে এ ছাড়া আর আমার কিছুই বোধ হয় নেই।
[ষোড়শী নীরবে তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল]
জীবানন্দ। (হঠাৎ সেই হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া) সন্ন্যাসিনীর কি সুখ-দুঃখ নেই? সে খুশি হয়, পৃথিবীতে এমন কি কিছুই নেই?
ষোড়শী। কিন্তু সে ত আপনার হাতের মধ্যে নয়।
জীবানন্দ। যা মানুষের হাতের মধ্যে? তেমন কিছু?
ষোড়শী। তাও আছে, কিন্তু ভালো হয়ে যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন তখনই জানাব।
জীবানন্দ। (তাহার হাতটাকে বুকের কাছে টানিয়া) না, না, আর ভালো হয়ে নয়—এই কঠিন অসুখের মধ্যেই আমাকে বল! মানুষকে অনেক দুঃখ দিয়েচি, আজ নিজের ব্যথার মধ্যে পরের ব্যথা, পরের আশার কথাটা একটু শুনে নিই। নিজের দুঃখের একটা সদ্গতি হোক।
[বাহিরে পদশব্দ শোনা গেল। ষোড়শী নিজের হাতটাকে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া লইল]
ষোড়শী। ডাক্তারবাবু বোধ হয় এলেন।
[ডাক্তার ও এককড়ি প্রবেশ করিল। ডাক্তার ষোড়শীকে এখানে দেখিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কিন্তু কিছু না বলিয়া নীরবে শয্যাপ্রান্তে আসিয়া রোগ পরীক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন; ষোড়শী এই সময়ে প্রস্থান করিল]
এককড়ি। যদি ভালো করতে পারেন ডাক্তারবাবু, বকশিশের কথা ছেড়েই দিন—আমরা সবাই আপনার কেনা হয়ে থাকব।
ডাক্তার। (পরীক্ষা শেষ করিয়া) অত্যাচার করে রোগ জন্মেছে। সাবধান না হলে পিলে কি লিভার পাকা অসম্ভব নয়, এবং তাতে ভয়ের কথা আছে। তবে সাবধান হলে নাও পাকতে পারে এবং তাতে ভয়ের কথাও কম। তবে এ কথা নিশ্চয় যে ওষুধ খাওয়া আবশ্যক।
জীবানন্দ। এ অবস্থায় কলকাতায় যাওয়া সম্ভব কিনা তা বলতে পারেন?
ডাক্তার। যদি যেতে পারেন তা হলেই সম্ভব, নইলে কিছুতেই সম্ভব নয়।
জীবানন্দ। এখানে থাকলে ভালো হবে কিনা বলতে পারেন?
ডাক্তার। (বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়া) আজ্ঞে না হুজুর, তা বলতে পারিনে। তবে এ কথা নিশ্চয় যে এখানে থাকলেও ভালো হতে পারেন, আবার কলকাতা গিয়ে ভালো নাও হতে পারেন।
এককড়ি। হুজুরের ব্যথাটা—
ডাক্তার। এরকম ব্যথা হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ কমে যায়। কাল সকালেই হুজুর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, আমাকে আবার আসতে হবে।
[এককড়ির কাছ থেকে ভিজিট লইয়া ডাক্তার প্রস্থান করিলেন জীবানন্দ। কি হবে এককড়ি?
এককড়ি। ভয় কি হুজুর, ওষুধ এল বলে! বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্চার খেলেই সব ভালো হয়ে যাবে!
জীবানন্দ। (ষোড়শী যে-দ্বারপথে একটু আগে বাহির হইয়া গেছে সেইদিকে উৎসুক-চোখে চাহিয়া) ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে—
[এককড়ি বাহিরে গিয়া ক্ষণেক পরে পুনরায় প্রবেশ করিল]
এককড়ি। তিনি নেই, বাড়ি চলে গেছেন হুজুর। ভোর হয়ে এসেচে।
জীবানন্দ। (ব্যগ্র ব্যাকুল-কণ্ঠে) আমাকে না জানিয়ে চলে যাবেন, না। এমন হতেই পারে না এককড়ি!
এককড়ি। হাঁ হুজুর, তিনি ডাক্তারবাবু আসবার পরেই চলে গেছেন। বাইরে সর্দার বসে আছে, সে দেখেছে ভৈরবী-ঠাকরুন সোজা চলে গেলেন।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ চোখের দিকে সোজা তাকাইয়া থাকিয়া) তা হলে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে তুমিও যাও এককড়ি, আমি একটু ঘুমুব।
[এককড়ি আলো নিভাইয়া দিল। জীবানন্দ বেদনা-ম্লানমুখে পাশ ফিরিয়া শুইলেন। আলো নিভাইতেই অতি প্রত্যুষের আবছায়া আভা জানালা দিয়া ঘরে ছড়াইয়া পড়িল]