তৃতীয় দৃশ্য
৺চণ্ডী-মন্দিরের পথ। বেলা—পূর্বাহ্ন
[জনৈক ভিক্ষুক ও তাহার কন্যার প্রবেশ]
কন্যা। আর যে চলতে পারিনে বাবা, মায়ের মন্দির আর কত দূরে?
ভিক্ষুক। ঐ যে আগে কত লোক চলে যাচ্ছে মা, বোধ হয় আর বেশী দূরে নয়।
কন্যা। কে গান গাইতে গাইতে আসচে বাবা, ওকে শুধোও না?
[গান গাহিতে গাহিতে দ্বিতীয় ভিক্ষুকের প্রবেশ]
তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন, ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।
প্রথম ভিক্ষুক। মায়ের মন্দির আর কত দূরে বাবা?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। ঐ যে—
তখন ছিল মণি, ছিল মাণিক
পথের ধারে ধারে—
এখন ডুবলো তারা দিনের শেষে
বিষম অন্ধকারে।
প্রথম ভিক্ষুক। হাঁ গা—
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। কি গো কি?
প্রথম ভিক্ষুক। বিষ্ণু গাঁ থেকে আসছি বাবা, পথ যেন আর ফুরোয় না। শুনি যে জনার্দন রায়মশায়ের নাতির কল্যাণে আজ মায়ের পূজো। বামুন বোষ্টম ভিখারী যে যা চাইবে তাই নাকি রায়মশায়—
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। রায়মশায় নয়, রায়মশায় নয়, তার জামাই। পশ্চিম মুল্লুকের ব্যারিস্টার—রাজা বললেই হয়। দু’ সরা চিঁড়ে মুড়কি, এক সরা সন্দেশ, আর আট-গণ্ডা পয়সা নগদ—
ভিক্ষুক-কন্যা। (পিতার প্রতি) হাঁ বাবা, তুমি যে বলেছিলে মেয়েদের একখানা করে রাঙ্গা-পেড়ে কাপড় দেবে?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। দেবে, দেবে। যে যা চাইবে। রায়মশায়ের মেয়ে হৈমবতী কাউকে না বলতে জানে না।
আজ মিথ্যে রে তোর খোঁজা-খুঁজি
মিথ্যে চোখের জল,
তারে কোথায় পাবি বল,
(তোর) অতল তলে তলিয়ে গেল
শেষ-সাধনার ধন।
ভিক্ষুক-কন্যা। বাবা, চাইলে হয়ত তুমিও পাবে একখানা কাপড়, না?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। পাবে পাবে, একটু পা চালিয়ে এসো।
তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন,
ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।
[সকলের প্রস্থান
[কথা কহিতে কহিতে ষোড়শী ও ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]
ফকির। যে-সব কথা আমার কানে গেছে মা, চুপ করে থাকতে পারলাম না, চলে এলাম। কিন্তু আমি ত কিছুতেই ভেবে পাইনে ষোড়শী, সেদিন কিসের জন্য ও লোকটাকে তুমি এমন করে বাঁচিয়ে দিলে।
ষোড়শী। ঐ পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানই কি উচিত হতো ফকিরসাহেব?
ফকির। সে বিবেচনার ভার ত তোমার ছিল না মা, ছিল রাজার, তাই তাঁর জেলের মধ্যেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করেন। কিন্তু শুধু এই যদি কারণ হয়ে থাকে ত তুমি অন্যায় করেছ বলতে হবে।
[ষোড়শী নিঃশব্দে তাঁর মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল]
ফকির। যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এ ত্রুটি তোমাকে শুধরে নিতে হবে ষোড়শী।
ষোড়শী। তার অর্থ?
ফকির। ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই এ তুমি জানো। শাস্তি হওয়া উচিত।
ষোড়শী। (ক্ষণেক স্তব্ধ থাকিয়া) আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের কর্তব্য, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।
ফকির। সেদিন পারো নি সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতেও কি পারবে না?
ষোড়শী। না।
ফকির। আত্মরক্ষার জন্যেও না!
ষোড়শী। না, আত্মরক্ষার জন্যেও না।
ফকির। আশ্চর্য! (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তুমি ত এখন মন্দিরে যাচ্চ ষোড়শী, আমি তা হলে চললেম।
[ষোড়শী হেঁট হইয়া নমস্কার করিল; ফকির প্রস্থান করিলেন। অন্যমনস্কের ন্যায় ষোড়শী চলিবার উপক্রম করিতেই সাগর দ্রুতবেগে আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল]
সাগর। হাঁ মা, তোমার বাবা তারাদাস ঠাকুর নাকি ঘরে ঘরে তালা বন্ধ করে তোমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে? তারা সবাই মিলে নাকি মতলব করেচে, তোমাকে চণ্ডীমন্দির থেকে বিদায় করে আবার নতুন ভৈরবী আনবে? সে হবে না, সাগর সর্দার বেঁচে থাকতে তা হবে না বলে দিচ্চি।
ষোড়শী। এ খবর তুই কোথায় শুনলি সাগর?
সাগর। শুনেছি মা, এইমাত্র শুনতে পেয়ে তোমার কাছে জানতে ছুটে এসেছি। তুমি মেয়েমানুষ, তোমাকে একলা পেয়ে যদি জমিদারের লোক বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে সে কি তোমার অপরাধ? অপরাধ সমস্ত গ্রামের। অপরাধ এই সাগরের, যে কুটুম-বাড়িতে গিয়ে আমোদে মেতেছিল—মায়ের খবর রাখতে পারেনি। অপরাধ তার খুড়ো হরিহর সর্দারের, যে গাঁয়ের মধ্যে উপস্থিত থেকেও এতবড় অপমানের শোধ নিতে পারেনি।
ষোড়শী। কিন্তু এই যদি সত্যি হয়ে থাকে সাগর, তোরা দুজন খুড়ো-ভাইপোতে উপস্থিত থাকলেই বা কি করতিস বল ত? জমিদারের কত লোকজন একবার ভেবে দেখ দিকি!
সাগর। তাও দেখেচি মা। তাঁর ঢের লোক, ঢের পাইক-পিয়াদা। গরীব বলে আমাদের দুঃখ দিতেও তারা কম করে না। কিন্তু দিক আমাদের দুঃখ, আমরা ছোটলোক বৈ ত না। কিন্তু তোমার হুকুম পেলে মা, ভৈরবীর গায়ে হাত দেবার একবার শোধ দিতে পারি। গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ওই হুজুরকেই রাতারাতি মায়ের স্থানে বলি দিতে পারি মা, কোন শালা আটকাতে পারবে না।
ষোড়শী। (শিহরিয়া) বলিস কি সাগর, তোরা কি এত নিষ্ঠুর, এমন ভয়ঙ্কর হতে পারিস? এইটুকুর জন্যে একটা মানুষ খুন করবার ইচ্ছে হয় তোদের?
সাগর। এইটুকু? তোমার গায়ে হাত দেওয়াকে তুমি এইটুকু বল মা? তারাদাস ঠাকুরকেও আমরা মাপ করতে পারি, জনার্দন রায়কেও হয়ত পারি, কিন্তু সুবিধে পেলে জমিদারকে আমরা সহজে ছাড়ব না। (ক্ষণেক থামিয়া) কিন্তু ওরা যে সব বলাবলি করে মা, তুমি নাকি ওঁকেই সে-রাত্রে হাকিমের হাত থেকে রক্ষে করেছ? নাকি বলেছ, তোমাকে ধরে নিয়ে কেউ যায় নি, নিজে ইচ্ছে করেই গিয়েছিলে?
ষোড়শী। এমন ত হতে পারে সাগর, আমি সত্য কথাই বলেছিলাম।
সাগর। তাই ত বিষম খটকা লেগেছে মা, তোমার মুখ দিয়ে ত কখনো মিছে কথা বার হয় না। তবে এ কি! কিন্তু সে যাই হোক, যাই কেন না গ্রামসুদ্ধ লোকে বলে বেড়াক, আমরা ক’ ঘর ছোটজাত তোমার ভূমিজ প্রজারা তোমাকেই মা বলে জেনেছি; যদি চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাও মা, আমরাও তোমার সঙ্গে যাব, কিন্তু যাবার আগে একবার জানিয়ে দিয়ে যাব যে কারা গেল!
[দ্রুতপদে প্রস্থান
ষোড়শী। সাগর! একটা কথা তোকে বলতে পারলেম না বাবা, তোদের দায়িত্ব হয়ত আর বইতে পারব না।
[এককড়ির প্রবেশ]
ষোড়শী। কে, এককড়ি?
এককড়ি। (সসম্ভ্রমে) আপনার কাছেই এলাম। হুজুর একবার আপনাকে স্মরণ করেছেন।
ষোড়শী। কোথায়?
এককড়ি। কাছারিতে বসে প্রজাদের নালিশ শুনছেন। যদি অনুমতি করেন ত পালকি আনতে পাঠাই।
ষোড়শী। পালকি? এটি তাঁর প্রস্তাব, না তোমার সুবিবেচনা এককড়ি?
এককড়ি। আজ্ঞে, আমি ত চাকর, এ স্বয়ং হুজুরের আদেশ।
ষোড়শী। (হাসিয়া) তোমার হুজুরের বিবেচনা আছে তা মানি, কিন্তু সম্প্রতি পালকি চড়বার আমার ফুরসত নেই
এককড়ি। হুজুরকে বলো আমার অনেক কাজ।
এককড়ি। ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি সময় হবে না?
ষোড়শী। না।
এককড়ি। কিন্তু হলে ভাল হতো। আরও দশজন প্রজার নালিশ আছে কিনা।
ষোড়শী। (কঠোর-স্বরে) তাঁকে বলো এককড়ি, বিচার করার মত বুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজাদের করুন গে। আমি তাঁর প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে।
[ষোড়শী দ্রুতপদে প্রস্থান করিল এবং এককড়ি কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অপর দিক দিয়া হৈম ও নির্মল প্রবেশ করিল। হৈমর হাতে পূজার উপকরণ]
হৈম। যে দয়ালু লোকটি তোমাকে সেদিন অন্ধকার রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন, সত্যি বল ত তিনি কে? তাঁকে আমি চিনেছি।
নির্মল। চিনেছ? কে বল ত তিনি?
হৈম। আমাদের ভৈরবী। কিন্তু তুমি তাঁকে পেলে কোথায়, তাই শুধু আমি ঠাউরে উঠতে পারিনি!
নির্মল। পারোনি? পেয়েছিলাম তাঁকে অনেক দূরে। তোমাদের ফকিরসাহেবের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা শুনে ভারী কৌতূহল হয়েছিল তাঁকে দেখবার। খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম। নদীর পারে তাঁর আশ্রম, সেখানে গিয়ে দেখি তোমাদের ভৈরবী আছেন বসে।
হৈম। তার কারণ, ফকিরকে তিনি গুরুর মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু সত্যিই কি তোমাকে একেবারে হাত ধরে অন্ধকারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন?
নির্মল। সত্যিই তাই। যে মুহূর্তে তিনি নিশ্চয় বুঝলেন প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার অজানা পথে আমি অন্ধের সমান, নারী হয়েও তিনি অসঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাত ধরে আসুন। কিন্তু পরের জন্য এ কাজ তুমি পারতে না হৈম।
হৈম। না।
নির্মল। তা জানি। (ক্ষণেক থামিয়া) দেখ হৈম, তোমাদের দেবীর এই ভৈরবীটিকে আমি চিনতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এটুকু নিশ্চয় বুঝেচি এঁর সম্বন্ধে বিচার করার ঠিক সাধারণ নিয়ম খাটে না। হয়, সতীত্ব জিনিসটা এঁর কাছে নিতান্তই বাহুল্য বস্তু—তোমাদের মত তার যথার্থ রূপটা ইনি চেনেন না, না হয় সুনাম-দুর্নাম এঁকে স্পর্শ পর্যন্তও করতে পারে না।
হৈম। তুমি কি সেইদিনের জমিদারের ঘটনা মনে করেই এই-সব বলচ?
নির্মল। আশ্চর্য নয়। শাস্ত্রে বলে সাত পা একসঙ্গে গেলেই বন্ধুত্ব হয়। অতবড় পথটায় ওই দুর্ভেদ্য আঁধারে একমাত্র তাঁকেই আশ্রয় করে অনেক পা গুটিগুটি একসঙ্গে গেলাম, একটি একটি করে অনেক প্রশ্নই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু পূর্বেও যে রহস্যে ঢাকা ছিলেন পরেও ঠিক তেমনি রহস্যেই গা ঢাকা দিয়ে মিলিয়ে গেলেন—কিছুই তাঁর হদিস পেলাম না।
হৈম। তোমার জেরাও মানলেন না, বন্ধুত্বও স্বীকার করলেন না?
নির্মল। না গো, না, কোনটাই না।
হৈম। (হাসিয়া ফেলিল) একটুও না? তোমার দিক থেকেও না?
নির্মল। এতবড় কথাটা কেবল ফাঁকি দিয়েই বার করে নিতে চাও নাকি? কিন্তু নিজেকে জানতেও যে দেরি লাগে হৈম।
হৈম। দেরি লাগুক তবু পুরুষের হয়। কিন্তু মেয়েমানুষের এমনি অভিশাপ, আমরণ নিজের অদৃষ্ট বুঝতেই তার কেটে যায়।
নির্মল। (হৈমর হাত ধরিয়া) তুমি কি পাগল হয়েছ হৈম? চল, আমরা একটু তাড়াতাড়ি যাই, হয়ত পূজোর বিলম্ব হয়ে যাবে।
[উভয়ের প্রস্থান